আমরা
সেবার গ্রীষ্মকালের শেষদিকে দিন চারেক ইনফ্লুয়েঞ্জাতে ভুগে উঠলেন আমার স্বামী। এমনিতেই তিনি একটু রোগা ধরনের মানুষ, ইনফ্লুয়েঞ্জার পর তাঁর চেহারাটা আরও খারাপ হয়ে গেল। দেখতাম তাঁর হনুর হাড়দুটো গালের চামড়া ফুঁড়ে বেরিয়ে আছে, গাল বসা, চোখের নীচে গাঢ় কালি, আর তিনি মাঝে—মাঝে শুকনো মুখে ঢোক গিলছেন— কণ্ঠাস্থিটা ঘনঘন ওঠা—নামা করছে। তাঁকে খুব অন্যমনস্ক, কাহিল আর কেমন যেন লক্ষ্মীছাড়া দেখাত। আমি তাঁকে খুব যত্ন করতাম। বিট—গাজর সেদ্ধ, টেংরির জুস, দুবেলা একটু একটু মাখন, আর রোজ সম্ভব নয় বলে মাঝেমধ্যে এক—আধটা ডিমের হাফবয়েল তাঁকে খাওয়াতাম। কিন্তু ইনফ্লুয়েঞ্জার একমাস পরেও তার চেহারা ভালো হল না, বরং আরও দুর্বল হয়ে গেল। সিঁড়ি ভেঙে দোতলায় উঠে তিনি ভয়ংকর হাঁফাতেন, রাত্রিবেলা তার ভালো ঘুম হত না, অথচ দেখতাম সকালবেলা চেয়ারে বসে চায়ের জন্য অপেক্ষা করতে করতে তিনি ঢুলছেন, কষ বেয়ে নাল গড়িয়ে পড়ছে। ডাকলে চমকে উঠে সহজ হওয়ার চেষ্টা করতেন বটে, কিন্তু স্পষ্টই বোঝা যেত যে তিনি স্বাভাবিক নেই। বরং অন্যমনস্ক এবং দুর্বল দেখাচ্ছে তাকে।
ভয় পেয়ে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম— তোমার কী হয়েছে বলো তো!
তিনি বিব্রত মুখে বললেন— অনু, আমার মনে হচ্ছে ইনফ্লুয়েঞ্জাটা আমার এখনও সারেনি। ভেতরে ভেতরে আমার যেন জ্বর হয়, হাড়গুলি কটকট করে, জিভ তেতো—তেতো লাগে। তুমি আমার গা—টা ভালো করে দেখ তো!
গায়ে হাত দিয়ে দেখি গা স্বাভাবিকের চেয়ে অনেক বেশি ঠান্ডা। সে কথা বলতেই তিনি হতাশভাবে হাত উলটে বললেন— কী যে হয়েছে ঠিক বুঝতে পারছি না। আমার বোধহয় একটু একসারসাইজ করা দরকার। সকাল—বিকেল একটু হাঁটলে শরীরটা ঠিক হয়ে যাবে।
পরদিন থেকে খুব ভোরে উঠে,আর বিকেলে অফিস থেকে ফিরে তিনি বেড়াতে বেরোতেন। আমি আমাদের সাত বছর বয়সের ছেলে বাপিকে তাঁর সঙ্গে দিতাম। বাপি অবশ্য বিকেলবেলা খেলা ফেলে যেতে চাইত না, যেত সকালবেলা। সে প্রায়ই এসে আমাকে বলত— বাবা একটুও বেড়ায় না মা, পার্ক পর্যন্ত গিয়েই দাঁড়িয়ে পড়ে, আর রেলিঙে ঠেস দিয়ে ঢুলতে থাকে। আমি বলি, চলো বাবা লেক পর্যন্ত যাই, বাচ খেলা দেখে আসি, আমাদের স্কুলের ছেলেরাও ওখানে ফুটবল প্র্যাকটিস করে,কিন্তু বাবা রেললাইন পারই হয় না। কেবল ঢুল—ঢুল চোখ করে বলে, তুই যা, আমি এখানে দাঁড়াই, ফেরার সময়ে আমাকে খুঁজে নিস।
আমাদের স্নানঘরটা ভাগের। বাড়িওয়ালা আর অন্য এক ভাড়াটের সঙ্গে। একদিন সকালবেলা অফিসের সময়ে অন্য ভাড়াটে শিববাবুর গিন্নি এসে চুপি চুপি বললেন, ও দিদি আপনার কর্তাটি যে বাথরুমে ঢুকে বসে আছেন, তারপর আর কোনো সাড়াশব্দ নেই। আমার কর্তাটি তেল মেখে কখন থেকে ঘোরাফেরা করছেন, এইমাত্র বললেন, দেখ তো, অজিতবাবু তো কখনো এত দেরি করে না!
শুনে ভীষণ চমকে উঠলাম। তাড়াতাড়ি গিয়ে আমি বাথরুমের দরজায় কান পাতলাম। কিন্তু বাথরুমটা একদম নিশ্চুপ। বন্ধ দরজার ওপাশে যে কেউ আছে তা মনেই হয় না। দরজায় ধাক্কা দিয়ে ডাকলাম, ওগো, কী হল।
তিনি বললেন, কেন?
এত দেরি করছ, কেন?
তিনি খুব আস্তে, যেন আপনমনে বললেন, ঠিক বুঝতে পারছি না। তারপর হুড়মুড় করে জল ঢেলে কাক—স্নান সেরে তিনি বেরিয়ে এলেন।
পরে যখন জিজ্ঞেস করলাম, বাথরুমে কী করছিলে তুমি? উনি বিরসমুখে বললেন, গা—টা এমন শিরশির করছিল যে জল ঢালতে ইচ্ছে করছিল না। তাই চৌবাচ্চার ধারে উঠে বসেছিলাম।
বসেছিলে কেন?
ঠিক বসেছিলাম না। জলে হাত ডুবিয়ে রেখে দেখছিলাম ঠান্ডাটা সয়ে যায় কিনা। বলে তিনি কিছুক্ষণ নীরবে ভাত নিয়ে নাড়াচাড়া করে একসময়ে বললেন, আসলে আমার সময়ের জ্ঞান ছিল না। বাথরুমের ভিতরটা কেমন ঠান্ডা ঠান্ডা, জলে ভেজা অন্ধকার, আর চৌবাচ্চা ভরতি জল ছলছল করে উপচে বয়ে যাচ্ছে খিলখিল করে— কেমন যেন লাগে!
ভয় পেয়ে গিয়ে আমি জিজ্ঞেস করলাম, কেমন?
উনি ম্লান একটু হাসলেন, বললেন, ঠিক বোঝানো যায় না। ঠিক যেন গাছের ঘন ছায়ায় বসে আছি, আমার সামনে দিয়ে নদী বয়ে যাচ্ছে।
সেদিন বিকেলে অফিস থেকে ফিরে এসে তিনি বললেন— বুঝলে, ঠিক করলাম এবার বেশ লম্বা অনেকদিনের একটা ছুটি নেব।
নিয়ে?
কোথাও বেড়াতে যাব। অনেকদিন কোথাও যাই না। অনু, আমার মনে হচ্ছে একটা চেঞ্জের দরকার। শরীরের জন্য না, কিন্তু আমার মনটাই কেমন যেন ভেঙে যাচ্ছে। অফিসে আমি একদম কাজকর্ম করতে পারছি না। আজ বেলা তিনটে নাগাদ আমার কলিগ সিগারেট চাইতে এসে দেখে যে আমি চোখ চেয়ে বসে আছি, কিন্তু সাড়া দিচ্ছি না। সে ভাবল, আমার স্ট্রোক—ফোক কিছু একটা হয়েছে, তাই ভয় পেয়ে চেঁচামেচি করে সবাইকে ডেকে আনল। কী কেলেঙ্কারি! অথচ তখন আমি জেগেই আছি।
জেগেছিলে! তবে সাড়া দাওনি কেন?
কী জানো! আজকাল ভীষণ অলস বোধ করি। কারও ডাকে সাড়াই দিতে অনেকক্ষণ সময় লাগে। এমনকী মাঝে—মাঝে অজিত ঘোষ নামটা যে আমার তা বুঝতে অনেক সময় লাগে। কেউ কিছু বললে চেয়ে থাকি কিন্তু বুঝতে পারি না। ফাইলপত্র নাড়তে ইচ্ছে করে না, একটা কাগজ টেবিলের এধার থেকে ওধারে সরাতে, পিনকুশনটা কাছে টেনে আনতে গেলে মনে হয় পাহাড় ঠেলার মতো পরিশ্রম করছি। সিগারেটের ছাই কত সময়ে জামায় কাপড়ে উড়ে পড়ে— আগুন ধরার ভয়েও সেটাকে ঝেড়ে ফেলি না।
শুনে, আমার বুকের ভিতরটা হঠাৎ ধক করে উঠল। বললাম, তুমি ডাক্তার দেখাও। চলো, আজকেই আমরা মহিম ডাক্তারের কাছে যাই।
দুর! উনি হাসলেন। বললেন, আমার সত্যিই তেমন কোনো অসুখ নেই। অনেকদিন ধরে একই জায়গায় থাকলে, একই পরিবেশে ঘোরাফেরা করলে মাথাটা একটু জমাট বেঁধে যায়। ভেবে দেখ, আমরা প্রায় চার—পাঁচ বছর কোথাও যাইনি। গতবার কেবল বিজুর পৈতেয় ব্যান্ডেল। আর কোথাও না। চলো, কাছাকাছি কোনো সুন্দর জায়গা থেকে মাসখানেক একটু ঘুরে আসি। তাহলেই সব ঠিক হয়ে যাবে। এমন জায়গায় যাব যেখানে একটা নদী আছে, আর অনেক গাছগাছালি।
আমার স্বামী চাকরি করেন অ্যাকাউন্ট্যান্ট জেনারেলের অফিসে। কেরানি। আর কিছুদিন বাদেই তিনি সাবর্ডিনেট অ্যাকাউন্টস সার্ভিসের পরীক্ষা দেবেন বলে ঠিক করেছেন। অঙ্কে তাঁর মাথা খুব পরিষ্কার, বন্ধুরা বলে— অজিত এক চান্সে বেরিয়ে যাবে। আমারও তাই বিশ্বাস। কিছুদিন আগেও তাঁকে পড়াশুনো নিয়ে খুব ব্যস্ত দেখতাম। দেখে খুব ভালো লাগত আমার। মনে হত, ওঁর যেমন মনের জোর তাতে শক্ত পরীক্ষাটা পেরিয়ে যাবেনই। তখন সংসারের একটু ভালো ব্যবস্থা হবে। সেই পরীক্ষাটার ওপর আমাদের সংসারে অনেক পরিকল্পনা নির্ভর করে আছে। তাই চেঞ্জের কথা শুনে আমি একটু ইতস্তত করে বললাম— এখন এক—দেড় মাস ছুটি নিলে তোমার পড়াশুনোর ক্ষতি হবে না?
উনি খুব অবাক হয়ে বললেন, কীসের পড়াশুনো?
ওই যে এস—এ—এস না কী যেন!
শুনে ওঁর মুখ খুব গম্ভীর হয়ে গেল! ভীষণ হতাশ হলেন উনি। বললেন, তুমি আমার কথা ভাবো, না কি আমার চাকরি—বাকরি, উন্নতি এইসবের কথা? অনু, তোমার কাছ থেকে আর একটু সিমপ্যাথি আশা করি। তুমি বুঝতে পারছ না আমি কী একটা অদ্ভুত অবস্থার মধ্যে আছি!
আমি লজ্জা পেলাম, তবু মুখে বললাম— বাঃ, তোমাকে নিয়ে ভাবি বলেই তো তোমার চাকরি, পরীক্ষা, উন্নতি সব নিয়েই আমাকে ভাবতে হয়। তুমি আর তোমার সংসার এ ছাড়া আমার আর কী ভাবনা আছে বলো?
উনি ছেলেমানুষের মতো রেগে চোখ—মুখ লাল করে বললেন, আমি আর আমার সংসার কি এক?
অবাক হয়ে বললাম, এক নও?
উনি ঘনঘন মাথা নেড়ে বললেন, না। মোটেই না। সেটা বোঝে না বলেই তুমি সবসময়ে আমাকে সংসারের সঙ্গে জড়িয়ে দেখ, আলাদা মানুষটাকে দেখ না।
হেসে বললাম, তাই বুঝি।
উনি মুখ ফিরিয়ে বললেন, তাই। আমি যে কেরানি তা তোমার পছন্দ না, আমি অফিসার হলে তবে তোমার শান্তি। এই আমি তোমাকে বলে দিচ্ছি, আমি চিরকাল এইরকম কেরানিই থাকব, তাতে তুমি সুখ পাও আর না পাও।
থাকো, না, আমি কেরানিকেই ভালোবেসেছি, তাই বাসব।
কিন্তু উনি এ কথাতেও খুশি হলেন না। রাগ করে জানালার থাকের ওপর বসে বাইরের মরা বিকেলের দিকে চেয়ে রইলেন। বেড়াতে গেলেন না। দেখলাম, জ্বর আসার আগের মতো ওঁর চোখ ছলছল করছে, মাঝে—মাঝে কাঁপছে ঠোঁট, হাঁটু মুড়ে বুকের কাছে তুলে এমনভাবে বসে আছেন যে রোগা দুর্বল শরীরটা দেখে হঠাৎ মনে হয় বাচ্চা একটা রোগে—ভোগা ছেলেকে কেউ কোলে করে জানালার কাছে বসিয়ে দিয়েছে।
আচ্ছা পাগল। আমাদের ছেলের বয়স সাত, মেয়ের বয়স চার। আজকালকার ছেলেমেয়ে অল্প বয়সেই সেয়ানা। তার ওপর বাসায় রয়েছে ঠিকে ঝি, ভাড়াটে আর বাড়িওয়ালার ছেলেমেয়ে— এতজনের চোখের সামনে ভরসন্ধেয় কী করে আমি ওঁর রাগ ভাঙাই! তবু পায়ের কাছটিতে মেঝেতে বসে আস্তে আস্তে বললাম, লক্ষ্মী সোনা, রাগ করে না। ঠিক আছে, চলো কিছুদিন ঘুরে আসি।
পরীক্ষা না হয় এবছর না দিলে, ও তো ফি—বছর হয়।
উনি সামান্য একটু বাঁকা হাসি হেসে বললেন, তবু দেখ, পরীক্ষার কথাটা ভুলতে পারছ না। এ বছর নয় তো সামনের বার। কিন্তু আমি তো বলেই দিয়েছি কোনোদিন আমি পরীক্ষা দেব না।
দিয়ো না। কে বলছে দিতে! আমাদের অভাব কীসের! বেশ চলে যাবে। এবার ওঠো তো—
আমার স্বামীর অভিমান একটু বেশিক্ষণ থাকে। ছেলেবেলা থেকেই উনি কোথাও তেমন আদর—যত্ন পাননি। অনেকদিন আগেই মা—বাবা মারা গিয়েছিল। তারপর থেকেই মামাবাড়িতে একটু অনাদরেই বড়ো হয়েছে। বি—এসসি পরীক্ষা দিয়েই ওকে সে বাড়ি ছেড়ে মির্জাপুরের একটা মেসে আশ্রয় নিতে হয়। সেই মেসে দশ বছর থেকে চাকরি করে উনি খুব নৈরাশ্যবোধ করতে থাকেন। তখন ওঁর বয়স তিরিশ। ওঁর রুমমেট ছিলেন আমার বুড়োকাকা। তিনিই মতলব করে ওঁকে একদিন আমাদের বাড়িতে বেড়াতে নিয়ে এলেন। তারপর মেসে ফিরে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন, আমার ভাইঝিকে কেমন দেখলে? উনি খুব লজ্জা—টজ্জা পেয়ে অবশেষে বললেন, চোখদুটি বেশ তো! তারপরই আমাদের বিয়ে হয়ে গেল। আমরা উঠলাম এসে লেক গার্ডেনসের পাশে গরিবদের পাড়া গোবিন্দপুরে। যখন এই একা বাসায় আমরা দু—জন, তখন উনি আমাকে সারাক্ষণ ব্যস্ত রাখতেন দুরন্ত অভিমানে— এই যে আমি অফিসে চলে যাই, তারপর কি তুমি আর আমার কথা ভাবো! কী করে ভাববে, আমি ত্রিশ বছরের বুড়ো, আর তুমি কুড়ির খুকি। তুমি আজ জানালায় দাঁড়াওনি…কাল রাতে আমি যে জেগেছিলাম কেউ কি টের পেয়েছিল! কী ঘুম বাব্বা!
ওঁর অভিমান দুরন্ত হলেও সেটা ভাঙা শক্ত নয়। একটু আদরেই সেটা ভাঙানো যায়। কিন্তু এবারকার অভিমান বা রাগ সেই অনাদরে বড়ো হওয়া মানুষটার ছেলেমানুষি নেই— আঁকড়ে ব্যাপার তো নয়! এই ব্যাপারটা যেন একটু জটিল। হয়তো উনি একেবারে অমূলক কথা বলছেন না। আমি সংসারের ভালোমন্দর সঙ্গে জড়িয়েই ওঁকে দেখি। এর বাইরে যে একা মানুষটা, যার সঙ্গে অহরহ বাইরের জগতের একটা অদৃশ্য বনিবনার অভাব চলছে তার কথা তো আমি জানি না। নইলে উনি কেন লোকের ডাকে সাড়া দেন না, কেন চৌবাচ্চার জলে হাত ডুবিয়ে অনেকক্ষণ বসে থাকেন, তা আমি বুঝতে পারতাম।
রাত্রিবেলা আমাদের ছেলেমেয়ে ঘুমিয়ে পড়লে উনি হঠাৎ চুপি চুপি আমার কাছে সরে এলেন। মুখ এবং মাথা ডুবিয়ে দিলেন আমার বুকের মধ্যে। বুঝতে পারলাম তার এই ভঙ্গির মধ্যে কোনো কাম—ইচ্ছা নেই। এ যেমন বাপি আমার বুকে মাথা গোঁজে অনেকটা সেরকম। আমি কথা না বলে ওঁকে দু—হাতে আগলে নিয়ে ওঁর রুক্ষ মাথা, আর অনেকদিনের আ—ছাঁটা চুলের মধ্যে মুখ ডুবিয়ে গভীর আনন্দের একটি শ্বাস টেনে নিলাম। বুক ভরে গেল। উনি আস্তে আস্তে বললেন, তোমাকে মাঝে—মাঝে আমার মায়ের মতো ভাবতে ইচ্ছে হয়। এরকম ভাবাটা কি পাপ?
কী জানি! আমি এর কী উত্তর দেব? আমি বিশ্বসংসারের রীতিনীতি জানি না। কার সঙ্গে কীরকম সম্পর্কটা পাপ, কোনটা অন্যায় তা কী করে বুঝব! যখন ফুলশয্যার রাতে প্রথম উনি আমাকে জড়িয়ে ধরেছিলেন, সেদিনও আমার শরীর কেঁপে উঠেছিল বটে। কিন্তু সেটা রোমাঞ্চে নয়— শিহরনেও নয়, বরং মনে হয়েছিল— বাঁচলাম! এবার নিশ্চিন্ত। এই অচেনা, রোগা কালো কিন্তু মিষ্টি চেহারার দুর্বল মানুষটির সেই প্রথম স্পর্শেই আমার ভেতরে সেই ছেলেবেলার পুতুলখেলার এক মা জেগে উঠেছিল। ছেলেমেয়েরা যেমন প্রেম করে, লুকোচুরি করে, সহজে ধরা দেয় না, আবার একে অন্যকে ছেড়ে যায়— আমাদের কখনো সেরকম প্রেম হয়নি।
উনি বুকে মুখে চেপে অবরুদ্ধ গলায় বললেন, তোমাকে একটা কথা বলব কাউকে বোলো না। চলো জানালার ধারে গিয়ে বসি।
উঠলাম। ছোট্ট জানালার চৌখুপিতে তাকের ওপর মুখোমুখি বসলাম দু—জন। বললাম, বলো। উনি সিগারেট ধরালেন, বললেন, তোমার মনে আছে, বছর দুই আগে একবার কাঠের আলমারিটা কেনার সময়ে সত্যচরণের কাছে গোটা পঞ্চাশেক টাকা ধার করেছিলাম?
ওমা, মনে নেই! আমি তো কতবার তোমাকে টাকাটা শোধ দেওয়ার কথা বলেছি।
আমার স্বামী একটা শ্বাস ফেলে বললেন, হ্যাঁ, সেই ধারটার কথা নয়, সত্যচরণের কথাই বলছি তোমাকে। সেদিন মাইনে পেয়ে মনে করলাম এ মাসে প্রিমিয়াম ডিউ—ফিউ নেই, তা ছাড়া রেডিয়োর শেষ ইনস্টলমেন্টটাও গতমাসে দেওয়া হয়ে গেছে, এ মাসে যাই সত্যচরণের টাকাটা দিয়ে আসি। সত্যচরণ ভদ্রলোক, তা ছাড়া আমার বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র ওরই কিছু পৈতৃক সম্পত্তি আছে— বড়োলোক বলা যায় ওকে। সেই কারণেই বোধহয় ও কখনো টাকাটার কথা বলেনি আমাকে। কিন্তু এবার দিয়ে দিই। তা ছাড়া ওর সঙ্গে অনেককাল দেখাও নেই, খোঁজখবর নিয়ে আসি। ভেবে—টেবে বিকেলে বেরিয়ে ছ—টা নাগাদ ওর নবীন পাল লেনের বাড়িতে পৌঁছোলাম। ওর বাড়ির সামনেই একটা মস্ত গাড়ি দাঁড়িয়ে ছিল যার কাচের ওপর লাল ক্রশ আর ইংরেজিতে লেখা— ডক্টর। কিছু না ভেবে উপরে উঠে যাচ্ছি। সিঁড়ি বেয়ে হাতে স্টেথসকোপ ভাঁজ করে নিয়ে একজন মোটাসোটা ডাক্তার মুখোমুখি নেমে এলেন। সিঁড়ির উপরে দরজার মুখেই সত্যর বউ নীরা শুকনো মুখে দাঁড়িয়ে ছিল। ফর্সা, সুন্দর মেয়েটা, কিন্তু তখন রুক্ষ চুল, ময়লা শাড়ি, সিঁদুর ছাড়া কপাল আর কেমন একটা রাতজাগা ক্লান্তির ভারে বিচ্ছিরি দেখাচ্ছিল ওকে। কী হয়েছে জিজ্ঞেস করতেই ফুঁপিয়ে উঠল— ও মারা যাচ্ছে, অজিতবাবু। শুনে বুকের ভেতরে যেন একটা কপাট হাওয়া লেগে দড়াম করে বন্ধ হয়ে গেল। ঘরে ঢুকে দেখি সত্যচরণ পুবদিকে মাথা করে শুয়ে আছে, পশ্চিমের খোলা জানালা দিয়ে সিঁদুরের মতো লাল টকটকে রোদ এসে পড়েছে ওর সাদা বিছানায়। মাথার কাছে ছোটো টেবিলে কাটা ফল, ওষুধের শিশি—টিশি রয়েছে, মেঝেয় খাটের নীচে বেডপ্যান—ট্যান। কিন্তু এগুলি তেমন উল্লেখযোগ্য কিছু না। ঘরের মধ্যে ওর আত্মীয়স্বজনও রয়েছেন কয়েকজন। দু—জন বিধবা দু—ধারে ঘোমটা টেনে বসে, একজন বয়স্কা মহিলা পায়ের দিকটায়। একজন বুড়ো মতো লোক খুব বিমর্ষ মুখে সিগারেট পাকাচ্ছেন জানালার কাছে দাঁড়িয়ে, দু—জন অল্পবয়সি ছেলে নীচু স্বরে কথা বলছে। দু—একটা বাচ্চাও রয়েছে ঘরের মধ্যে। তারা কিছু টের পাচ্ছিল কিনা জানি না, কিন্তু সেই ঘরে পা দিয়েই আমি এমন একটা গন্ধ পেলাম— যাকে— কী বলব— যাকে বলা যায় মৃত্যুর গন্ধ। তোমাকে ঠিক বোঝাতে পারব না কিন্তু আমার মনে হয় মৃত্যুর একটা গন্ধ আছেই। কেউ যদি কিছু নাও বলত, তবু আমি চোখবুজেও ওই ঘরে ঢুকে বলে দিতে পারতাম যে ওই ঘরে কেউ একজন মারা যাচ্ছে। যাকগে, আমি ওই গন্ধটা পেয়েই বুঝতে পারলাম নীরা ঠিকই বলেছে, সত্য মারা যাচ্ছে। হয়তো এখুনি মরবে না, আরও একটু সময় নেবে। কিন্তু আজকালের মধ্যেই হয়ে যাবে ব্যাপারটা। আমি ঘরে ঢুকতেই মাথার কাছ থেকে একজন বিধবা উঠে গেলেন, পায়ের কাছ থেকে সধবাটিও। কে যেন একটা টুল বিছানার পাশেই এগিয়ে দিল আমাকে বসবার জন্য। তখনও সত্যর জ্ঞান আছে। মুখটা খুব ফ্যাকাশে রক্তশূন্য আর মুখের চামড়ায় একটা খড়ি—ওঠা শুষ্ক ভাব। আমার দিকে তাকিয়ে বলল, কে? বললাম, আমিরে, আমি অজিত। বলল, ওঃ অজিত! কবে এলি? বুঝলাম একটু বিকারের মতো অবস্থা হয়ে আসছে। বললাম, এইমাত্র। কেমন আছিস? বলল, এই একরকম, কেটে যাচ্ছে। আমি ঠিক ওখানে আর বসে থাকতে চাইছিলাম না। তুমি তো জানো ওষুধ—টসুধের গন্ধে আমার কীরকম গা গুলায়! তাই একসময় ওর কাছে নীচু হয়ে বসলাম, তোর টাকাটা দিতে এসেছি। ও খুব অবাক হয়ে বলল, কত টাকা! বললাম, পঞ্চাশ। ও ঠোঁট ওলটাল, দুর, ওতে আমার কী হবে! ওর জন্য কষ্ট করে এলি কেন? আমি কি মাত্র পঞ্চাশ টাকা চেয়েছিলাম তোর কাছে? আমি তো তার অনেক বেশি চেয়েছিলাম! আমি খুব অবাক হয়ে বললাম, তুই তো আমার কাছে চাসনি! আমি নিজে থেকেই এনেছি, অনেকদিন আগে ধার নিয়েছিলাম— তোর মনে নেই? ও বেশ চমকে উঠে বলল, না, ধারের কথা নয়। কিন্তু তোর কাছে আমি কী একটা চেয়েছিলাম না? সে তো পঞ্চাশ টাকার অনেক বেশি। জিজ্ঞেস করলাম, কী চেয়েছিলি? ও খানিকক্ষণ সাদা ছাদের দিকে চেয়ে কী ভাবল, বলল, কী যেন— ঠিক মনে পড়ছে না— ওই যে— সব মানুষই যা চায়— আহা, কী যেন ব্যাপারটা। আচ্ছা দাঁড়া বাথরুম থেকে ঘুরে আসি, মনে পড়বে। বলে ও ওঠার চেষ্টা করল। সেই বিধবাদের একজন এসে পেচ্ছাপ করার পাত্রটা ওর গায়ের ঢাকার নীচে ঢুকিয়ে ঠিক করে দিল। কিছুক্ষণ— পেচ্ছাপ করার সময়টায়, ও বিকৃত মুখে ভয়ংকর যন্ত্রণা ভোগ করল শুয়ে শুয়ে। তারপর আবার আস্তে আস্তে একটু গা—ছাড়া হয়ে আমার দিকে চেয়ে বলল, তোর কাছেই চেয়েছিলাম না কি— কার কাছে যে— মনেই পড়ছে না। কিন্তু চেয়েছিলাম— বুঝলি— কোনো ভুল নেই। খুব আবদার করে গলা জড়িয়ে ধরে গালে গাল রেখে চেয়েছিলাম, আবার ভিখিরির মতো হাত বাড়িয়ে ল্যাং ল্যাং করেও চেয়েছিলাম, আবার চোখ পাকিয়ে ভয় দেখিয়েও চেয়েছিলাম— কিন্তু শালা মাইরি দিল না…। কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী চেয়েছিলি! ও সঙ্গে সঙ্গে ঘোলা চোখ ছাদের দিকে ফিরিয়ে বলল, ওই যে— কী ব্যাপারটা যেন— নীরাকে জিজ্ঞেস করত তো, ওর মনে থাকতে পারে— আচ্ছা দাঁড়া—একশো থেকে উলটোভাবে গুনে দেখি, তাতে হয়তো মনে পড়বে। বলে ও খানিকক্ষণ গুনে হাল ছেড়ে দিয়ে বলল— না সময় নষ্ট। মনে পড়ছে না। আমি তখন আস্তে আস্তে বললাম— তুই তো সবই পেয়েছিস! ও অবাক হয়ে বলল, কী পেয়েছি— অ্যাঁ— কী? আমি মৃদু গলায় বললাম— তোর তো সবই আছে। বাড়ি, গাড়ি, ভালো চাকরি, নীরার মতো ভালো বউ, অমন সুন্দর ফুটফুটে ছেলেটা দার্জিলিঙে কনভেন্ট পড়ছে। ব্যাঙ্কে টাকা, ইন্সিয়োরেন্স— তোর আবার কী চাই? ও অবশ্য ঠোঁটে একটু হাসল, হলুদ ময়লা দাঁতগুলি একটুও চিকমিক করল না, ও বলল— এসব তো আমি পেয়েইছি। কিন্তু এর বেশি আর একটা কী যেন— বুঝলি— কিন্তু সেটার তেমন কোনো অর্থ হয় না। যেমন আমার প্রায়ই ইচ্ছে করে একটা গাছের ছায়ায় বসে দেখি সারাদিন একটা নদী বয়ে যাচ্ছে। অথচ ওই চাওয়াটার কোনো মাথামুণ্ডু হয় না। ঠিক সেইরকম—কী যেন একটা— আমি ভেবেছিলাম তুই সেটাই সঙ্গে করে এনেছিস! কিন্তু না তো, তুই তো মাত্র পঞ্চাশ টাকা— তাও মাত্র যেটুকু ধার করেছিলি— কিন্তু কী ব্যাপারটা বল তো, আমার কিছুতেই মনে পড়ছে না! অথচ খুব সোজা, জানা জিনিস সবাই চায়!
আমার স্বামীকে অন্ধকারে খুব আবছা দেখাচ্ছিল। আমি প্রাণপণে তাকিয়ে তাঁর মুখের ভাবসাব লক্ষ করার চেষ্টা করেছিলাম। কিন্তু কিছুই বুঝতে পারছিলাম না। উনি একটু বিমনা গলায় বললেন— অনু, সত্যচরণের ওখান থেকে বেরিয়ে সেই রাত্রে প্রথম বর্ষার জলে আমি ভিজেছিলাম— তুমি খুব বকেছিলে— আর পরদিন সকাল থেকেই আমার জ্বর— মনে আছে? আমি মাথা নাড়লাম।
সত্যচরণ তার তিনদিন পর মারা গেছে। সেই কথাটা শেষ পর্যন্ত বোধহয় তার মনে পড়েনি। কিন্তু আমি যতদিন জ্বরে পড়েছিলাম ততদিন, তারপর জ্বর থেকে উঠে এ পর্যন্ত কেবলই ভাবছি কী সেটা যা সত্যচরণ চেয়েছিল! সবাই চায়, অথচ তবু তার মনে পড়ল না কেন?
বলতে বলতে আমার স্বামী দু—হাতে আমার মুখ তুলে নিয়ে গভীরভাবে আমাকে দেখলেন। তারপর আস্তে আস্তে বললেন, তবু সত্যচরণ যখন চেয়েছিল তখন আমার ইচ্ছে করছিল সত্যচরণ যা চাইছে সেটা ওকে দিই। যেমন করে হোক সেটা এনে দিই ওকে। কিন্তু তখন তো বুঝবার উপায় ছিল না ও কী চাইছে। কিন্তু এখন এতদিনে মনে হচ্ছে সেটা আমি জানি।
আমি ভীষণ কৌতূহলী হয়ে জিজ্ঞেস করলাম, কী গো সেটা?
আমার স্বামী শ্বাস ফেলে বললেন, মানুষের মধ্যে সবসময়েই একটা ইচ্ছে বরাবর চাপা থেকে যায়। সেটা হচ্ছে সর্বস্ব দিয়ে দেওয়ার ইচ্ছে। কোথাও একজন বসে আছেন প্রসন্ন হাসিমুখে, তিনি আমার কিছুই চান না, তবু তাঁকে আমার সর্বস্ব দিয়ে দেওয়ার কথা। টাকাপয়সা নয় আমার বোধ বুদ্ধি লজ্জা অপমান জীবন মৃত্যু— সবকিছু। বদলে তিনি কিছুই দেবেন না, কিন্তু দিয়ে আমি তৃপ্তি পাব। রোজগার করতে করতে, সংসার করতে করতে মানুষ সেই দেওয়ার কথাটা ভুলে যায়। কিন্তু কখনো কখনো সত্যচরণের মতো মরার সময়ে মানুষ দেখে সে দিতে চায়নি, কিন্তু নিয়তি কেড়ে নিচ্ছে, তখন তার মনে পড়ে— এর চেয়ে স্বেচ্ছায় দেওয়া ভালো ছিল।