আমরা সবাই সমান
বাপি অফিসে বেরিয়ে গেলে রূপান নিজেকে একজন কেউকেটা বলে মনে করে। কারণ, তখন বাড়িতে সে-ই একমাত্র পুরুষ সিংহ — অতএব হেড অফ দ্য ফ্যামিলি।
সদর দরজার কলিংবেলটা যখন বাজল তখন মা রান্নাঘরে— গরম কড়াইয়ে ছ্যাঁকোর-ছোঁকর শব্দ তুলতে ব্যস্ত। আর রূপান অঙ্কের হোমটাস্ক নিয়ে মশগুল ছিল।
কিন্তু কলিংবেল বেজে উঠতেই রূপানের মনে হল, দরজা খোলার দায়িত্বটা হেড অফ দ্য ফ্যামিলিরই নেওয়া উচিত। তাই দৌড়োনো আর হাঁটার মাঝামাঝি ঢঙে ও পৌঁছে গেল দরজার কাছে।
কে এল এই অসময়ে? এখন তো কারও আসার কথা নয়!
‘ম্যাজিক আই’-এ চোখ রেখে চকচকে একটা কিছু চোখে পড়ল। ঠিক যেন স্টিলের বাসন-টাসন।
কিন্তু দরজা খুলতেই অবাক হয়ে দেখল স্টিলের বাসন নয়, একটা রোবট দাঁড়িয়ে রয়েছে দরজায়।
পথে-ঘাটে এখন যে-হারে রোবট ঘুরে বেড়ায় তাতে একটা মেটাল বড়ির রোবট দেখে ক্লাস সেভেনে পড়া রূপানের মোটেই অবাক হওয়ার কথা নয়।
ও অবাক হয়েছে ওদের বাড়ির দরজায় একটা রোবটকে একা দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে।
রোবটটা লিকলিকে। চোখগুলো মানুষের মতো। বেশ টানা টানা। মাথায় চকচকে নাইলনের চুল—অ্যালবার্ট কেটে আঁচড়ানো। পরনে রঙিন হাফশার্ট আর প্যান্ট। তবে মুখ আর দু-হাতে কোনও ঢাকাঢুকি নেই। রোদ পরে চকচক করছে। ‘কাকে খুঁজছেন?’ রূপান গলাটা একটু ভারী করে জানতে চাইল।
‘আমি ম্যাথামেটিকা গ্রহ থেকে আসছি, স্যার,—’ রূপানকে হাতজোড় করে নমস্কার জানিয়ে মিহি গলায় বলল রোবটটা, ‘আমার নাম লেবেগিউ। আমি প্রফেসর শান্তারাম মিত্রের বাড়িটা খুঁজছি। আমাদের কাছে যা ডেটাবেস রয়েছে তাতে ওঁর বাড়িটা এই এলাকাতেই হওয়ার কথা, স্যার…।’
রোবটটা ওকে ‘স্যার’ বলে দুবার ডাকায় রূপানের মনে হল, ও আর মাটিতে দাঁড়িয়ে নেই—দু-চার ফুট শূন্যে উঠে পড়েছে। একইসঙ্গে ও লেবেগিউর দিকে ভুরু কুঁচকে তাকাল রোবটটার ভেতরের কলকবজা কিংবা সফ্টওয়্যার বিগড়ে যায়নি তো! যার জন্য ও ভুল করে ভাবছে যে, ও অন্য গ্রহ থেকে এসেছে!
না, প্রফেসর শান্তারাম মিত্র নামে এই এলাকায় কেউ থাকেন না। কিন্তু রোবটটা ওঁকে খুঁজছে কেন? ভীষণ জানতে ইচ্ছে করল রূপানের।
‘এই নামে এ পাড়ায় কেউ থাকে বলে মনে হয় না।’ গম্ভীর গলায় বলল, রূপান, ‘কিন্তু ওঁকে খুঁজছেন কেন জানতে পারি?’
‘হ্যাঁ, স্যার, বলছি—’ হতাশার একটা দীর্ঘশ্বাস বেরিয়ে এল লেবেগিউর নাক দিয়ে, তারপর বলল, ‘সমান চিহ্ন নিয়ে ওঁর কাছে আমাদের একটা কমপ্লেন আছে। আপনাদের এই পৃথিবীতে ওটা ঠিকঠাকভাবে ব্যবহার করা হয় না।’
‘মানে?’ তাজ্জব হয়ে গেল রূপান। এ-রোবটটা বলছে কী! ও নিজে সমান চিহ্ন ব্যবহার করে কত যে অঙ্ক করেছে তার হিসেব নেই।
‘হ্যাঁ, স্যার। আপনি তো জানেন, অঙ্কে এই “ইকোয়াল্স টু” চিহ্নটা সবসময় ব্যবহার করা হয়। কারণ অঙ্ক মানেই তো “ইকোয়েশান”—বাঁ-দিকের সাথে ডানদিন সমান। এই সমান চিহ্নটা ছাড়া অঙ্ক অচল। অন্তত আমাদের গ্রহে তো তাই, স্যার…।’
রূপান তখনও বুঝতে পারছিল না, লেবেগিউ কী বলতে চায়। তাই ও চুপ করে রইল।
‘যেমন ধরুন স্যার…’ রোবটটা বলে চলল, ‘ছয় যোগ চার সমান দশ। এই অঙ্কটা লিখে ফেললে দেখবেন, সমান চিহ্নের বাঁ-দিকে ছয় যোগ চার, আর ডানদিকে দশ। “৬+৪” লেখাটার সঙ্গে “১০” লেখাটার চেহারার কোনও মিল নেই—কিন্তু চেহারার মিল না থাকা সত্ত্বেও ওরা সমান…।’
‘হ্যাঁ, হ্যাঁ,—ঠিক বলেছেন…’ রূপান সায় দিয়ে মাথা নাড়ল। ব্যাপারটা ভেবে একটু অবাকও হল।
‘তারপর, মনে করুন, এই পৃথিবীর সমস্ত অঙ্ক থেকে যদি সমান চিহ্নটা টধাও করে দেন তা হলে কী সাংঘাতিক অবস্থা হবে! সবকিছু একেবারে ঘেঁটে যাবে। তার মানে, যে-কোনও অঙ্কে সমান চিহ্ন থাকাটা সবচেয়ে জরুরি…।’ রূপান আবার সায় দিল।
‘আমাদের গ্রহে দুজন মানুষের মধ্যে চেহারা কিংবা অন্য কিছুর মিল না থাকলেও তাদের মধ্যে সমান চিহ্ন বসানো হয়। অর্থাৎ, ওরা সমান। দেখতে আলাদা হলেও ওদের মধ্যে আসলে কোনও তফাত নেই। তাই আমাদের গ্রহে সবাই সমান। কিন্তু পৃথিবী গ্রহে “ইকোয়াল্স টু” চিহ্নটার ব্যবহার শুধু অঙ্কের মধ্যেই আটকে গেছে—মানুষের মধ্যে আসতে পারেনি। সেটা জানানোর জন্যেই ম্যাথামেটিকা গ্রহের মানুষরা আমাকে দূত হিসেবে পাঠিয়েছে। বলেছে, ম্যাথামেটিশিয়ান প্রফেসর মিত্রকে আমাদের অভিযোগ জানাতে। উনি যদি বিষয়টা সবাইকে বোঝাতে পারেন…। ঠিক আছে, চলি, স্যার—প্রফেসর মিত্রের বাড়িটা খুঁজতে হবে…।’
রূপানের মা রান্নাঘর থেকে চেঁচিয়ে জিগ্যেস করলেন, ‘রূপান, কে এসেছে?’
রূপান বলল, ‘কেউ না, মা—’
লেবেগিউ লম্বা-লম্বা পা ফেলে চলে যাচ্ছিল। ওর দিকে তাকিয়ে রূপানের খুব ভালো লাগছিল। আজ ওকে রোবটটা অভিনব এক অঙ্ক শিখিয়ে গেল : সমান চিহ্নের ঠিকঠাক ব্যবহার।
আসলে আমরা সবাই সমান।
*সমাপ্ত*