আমি আজকে যেটা নিয়ে লিখছি সেটা নিয়ে লেখাটা বুদ্ধিমানের কাজ হচ্ছে কিনা আমি বুঝতে পারছি না। আমার বুদ্ধি খুব বেশি সেটা কখনও-ই কেউ বলেনি (যাদের বুদ্ধি খুব বেশি, তারা যে খুব শান্তিতে থাকে তা-ও নয়)। তবে কিছু একটা লেখালেখি করে আমি সেটা পত্রপত্রিকায় ছাপিয়ে ফেলতে পারি। সেজন্য আমি যেন দায়িত্বহীনের মতো কিছু লিখে না ফেলি, আমার সব সময় সেটা লক্ষ্য রাখতে হয়। আমার চেয়ে অনেক সুন্দর করে গুছিয়ে লিখেও অনেকে তাদের লেখা পত্রপত্রিকায় ছাপাতে পারেন না। তাঁরা মাঝে মাঝে হতাশ হয়ে আমার কাছে সেই লেখাগুলো পাঠান। আমি পড়ি এবং দীর্ঘশ্বাস ফেলি।
আজকাল লেখাগুলো শুধু যে কাগজে ছাপা হয় তা নয়, সেগুলো ইন্টারনেটেও প্রকাশ হয়। সেখানে একটা নূতন স্টাইল শুরু হয়েছে, প্রত্যেকটা লেখার পিছনে লেজের মতো করে পাঠকেরা তাদের মন্তব্য লিখতে পারেন। আমি এখন পর্যন্ত কখনও-ই আমার লেখার পিছনের লেজে লেখা পাঠকদের মন্তব্য পড়িনি। কখনও পড়ব না বলে ঠিক করে রেখেছি। পৃথিবীর এমন কোনো মানুষ নেই যে নিজের সম্পর্কে ভালো কিছু শুনতে চায় না। তাই সেই মন্তব্যগুলো পড়লে আমি হয়তো নিজের অজান্তেই এমনভাবে লিখতে শুরু করব যেন সবাই আমার লেখা পড়ে ভালো ভালো মন্তব্য করে।
আমি সেটা চাই না, আমার যেটা লিখতে ইচ্ছে করে আমি সেটা লিখতে চাই। আমার সব কথাই যে সবার জন্যেই সত্যি হবে সেটা তো কেউ বলেনি। আমার কথাটা সবাইকে মেনে নিতে হবে, সেটাও আমি বলছি না, শুনতে নিশ্চয়ই সমস্যা নেই।
আজকে আমি যাদের নিয়ে লিখছি তাঁরা সবাই আমার সহকর্মী। তাঁদের সঙ্গে আমার উঠাবসা। তাঁরা বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক। আমার লেখাটি পড়ে তাঁরা হয়তো একটু ক্ষুব্ধ হবেন। খানিকটা আহত বোধ করবেন, তাই আগেভাগেই ক্ষমা চেয়ে নিচ্ছি।
কয়েকদিন আগে আমার টেলিফোনে একটা এসএসএম এসেছে। আমাদের বিশ্ববিদ্যালয় প্রাঙ্গনে সব শিক্ষকদের একটা মানব বন্ধনে যোগ দিতে অনুরোধ করা হচ্ছে। যদিও এসএসএমটি আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে পাঠানো হয়েছে কিন্তু এটি শুধু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের প্রোগ্রাম নয়, এটি ইউনিভার্সিটি ফেডারেশনের প্রোগ্রাম, অর্থাৎ বাংলাদেশের সব পাবলিক ইউনিভার্সিটির সব শিক্ষক সমিতির সম্মিলিত একটি প্রোগ্রাম।
মানববন্ধনে দুটি দাবির কথা বলা হয়েছে, একটি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে আলাদা বেতন স্কেল, দ্বিতীয়টি তাদের শিক্ষকতা জীবন বাড়িয়ে ৬৭ বছর করে দেওয়া! আমি এই দুটি দাবি নিয়ে আমার নিজের কথাগুলো বলতে চাই।
পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কত? প্রকৃত সংখ্যাটি বলা রুচিহীন কাজ হবে, তাই অন্যভাবে বলি। আমি কম্পিউটার সায়েন্স অ্যান্ড ইঞ্জিনিয়ারিং বিভাগের শিক্ষক, আমার ছাত্রছাত্রীরা যখন কোথাও চাকরি পেয়ে আমার সঙ্গে দেখা করতে আসে, আমি তখন তাদের জিজ্ঞেস করি, “তোমার বেতন আমার থেকে বেশি তো?”
তারা একটু লজ্জা পায় কিন্তু প্রায় সব সময়েই মাথা নেড়ে জানায় যে তাদের বেতন আমার থেকে বেশি! আমি আমার বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে সিনিয়র শিক্ষক, যতদূর জানি আমার বেতন পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের একজন অধ্যাপকের সর্বোচ্চ বেতন। সত্যি মিথ্যা জানি না। শুনেছি সচিবালয়ের একজন মাঝারি আমলা তার গাড়ির রক্ষণাবেক্ষণের জন্য আমার বেতন থেকে বেশি টাকা পান।
আমাদের পাশের দেশ ভারতবর্ষের একটি বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা একবার গিয়েছিলাম, সেখানকার লেকচারাররা সবাই নিজের গাড়ি চালিয়ে বিশ্ববিদ্যালয়ে আসেন। সেই দেশের বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন আমাদের বেতন থেকে আনুমানিক চার গুণ বেশি! সেই দেশিটা সুঁই থেকে গাড়ি সবকিছুই নিজেরা তৈরি করে, তাই সে দেশে বেঁচে থাকার খরচ আমাদের থেকে কম।
অনেকদিন আগে আমি একবার পত্রিকায় লিখেছিলাম আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের লেকচারারের বেতন একজন গাড়ির ড্রাইভারের বেতন থেকে কম। মনে আছে পরের দিন একজন লেকচারার শুকনো মুখে আমার কাছে ছুটে এসেছিল, হাহাকার করে বলেছি, “স্যার, আপনার লেখা পড়ে আমার বিয়ে ভেঙে গেছে।”
তবে কেউ যেন ভুল না বুঝেন, বিয়ের বাজারে কদর কমে যাবে জেনেও কিন্তু আমাদের বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে ভালো ছাত্র এবং ছাত্রীরা এখনও বিশ্ববিদ্যালয়ে শিক্ষক হিসেবে যোগ দিতে চায়। সম্ভবত এটাই হচ্ছে পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয়ের সবচেয়ে বড় শক্তি! তবে এই শক্তি কতদিন থাকবে আমি জানি না। একজন ছাত্র বা ছাত্রী সবার চাইতে ভালো পরীক্ষায় ফলাফল নিয়েও আজকাল আর নিশ্চিত হতে পারে না সে কি আসলেই শিক্ষক হতে পারবে কিনা। নিজের সমস্ত আত্মসম্মান বিসর্জন দিয়ে দলবাজি করে এমন শিক্ষকদের পাশে তাদের ঘুরঘুর করতে হয়।
নিয়োগ কমিটির গুরুত্বপূর্ণ সদস্যেদের পকেটে নিজেদের প্রার্থী থাকে। তারা সরাসরি একে অন্যের সঙ্গে দরদাম করেন। বলেন, “আমার একজনকে নেন, তাহলে আমি আপনার একজনকে নিতে দেব।” বাইরে ছাত্রনেতারা বসে থাকে, মন্ত্রীরা ফোন করে, সাংসদেরা হুমকি দেয়। তাই পত্রিকায় একজন শিক্ষক নিয়োগের বিজ্ঞাপন দেওয়া হলেও হালি হিসেবে শিক্ষক নিতে হয়। যারা সত্যিকারের ভালো মেধাবী শিক্ষক, তারা শেষ পর্যন্ত আরও ভালো জায়গায় চলে যায়, অপদার্থরা থেকে যায়। দেখতে দেখতে বিশ্ববিদ্যালয়গুলো অপদার্থ শিক্ষকের আড্ডাখানা হয়ে যায়। তাতে কোনো সমস্যা নেই, বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশাসনের নিয়ম খুবই উদার, বয়স হলেই লেকচারাররা দেখতে দেখতে প্রফেসর হয়ে যায়।
যাই হোক, আমি অবশ্যি শিক্ষকদের বেতন নিয়ে কথা বলতে বসেছি, তারা কি পদার্থ না অপদার্থ সেটা নিয়ে কথা বলতে বসিনি। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা এক সময় খুব সম্মানিত মানুষ ছিলেন, এখন আর সে রকম সম্মানী মানুষ নন। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক বললেই চোখের সামনে একজন জ্ঞানতাপস গবেষক এবং নিবেদিতপ্রাণ শিক্ষকের চেহারা ফুটে না উঠে কুটিল-কৌশলী-দলবাজ-রাজনৈতিক মানুষের চেহারা ফুটে উঠে।
যে চেহারাই ফুটুক, এই বেচারাদের সংসার খরচ চালাতে হয় খানিকটা ঠাট বজায় রাখতে হয়। সেজন্যে তাদের একটা সম্মানজনক বেতন দরকার। খুব উচ্চমহলে সেটা নিয়ে দেন দরবার করার পর একজন বিশ্ববিদ্যালয় শিক্ষকের একটা মিলিয়ন ডলার উপদেশ দিয়েছিলেন, বলেছিলেন, “আপনাদের বেতন বাড়ানোর কোনো রাস্তা নেই। পরীক্ষার খাতা-ফাতা দেখার সময় বেশি বেশি টাকা বিল করে কোনোভাবে পুষিয়ে নেন।”
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা সে মিলিয়ন ডলার উপদেশ অক্ষরে অক্ষরে পালন করেছেন। তারা পরীক্ষার খাতা দেখার জন্যে টাকা নেন, পরীক্ষার গার্ড দেওয়ার জন্যে টাকা নেন, ভাইভা নেওয়ার জন্যে টাকা নেন। পৃথিবীর সব দেশে পরীক্ষার খাতা একবার দেখা হয়, এই দেশে সেটা দুইবার দেখা হয়, কোনো কোনো সময় তিনবার!
আমি নিয়মিত ছাত্রছাত্রীদের পড়াই, আমরা যখন ছাত্র ছিলাম সবসময় তক্কে তক্কে থাকতাম কীভাবে লেখাপড়া না করেই কাজ চালিয়ে দেওয়া যায়। আজকালকার ছাত্রছাত্রীদের খুব একটা উন্নতি হয়নি। তারাও তক্কে তক্কে থাকে কীভাবে পড়াশোনা না করে ছাত্রজীবনটা ম্যানেজ করে ফেলা যায়। তাদেরকে জোর করে লেখাপড়া করানোর অমোঘ অস্ত্র হচ্ছে ঘন ঘন ক্লাস টেস্ট নেওয়া, আমি সেটা করি এবং আমার ধরনটা মুখে স্বীকার না করলেও আমার ছাত্রছাত্রীরা সে জন্যে কখনও আমাকে ক্ষমা করেনি।
খুবই বিস্ময়ের সঙ্গে আবিষ্কার করেছি যে এখন নাকি ক্লাস টেস্ট নিলেও টাকা পাওয়া যাবে। বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষক হিসেবে নানা ধরনের কমিটিতে থেকে কাজ করতে হয়। আজকাল দেখছি কমিটিতে বসে মিটিং করলেই একটা পেটমোটা খাম ধরিয়ে দেওয়া হয়! আমি অপেক্ষা করে আছি কোনোদিন শুনতে পাব ক্লাস নিলেই এখন হাতে টাকার খাম ধরিয়ে দেওয়া হবে। এটাই শুধু বাকি আছে।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের টাকা উপার্জনের সবচেয়ে সম্মানজনক এবং অনৈতিক পদ্ধতিটি হচ্ছে ভর্তিপরীক্ষা নামক প্রক্রিয়া থেকে টাকা উপার্জন। আমার কথা বিশ্বাস না করলে একবার ভর্তিপরীক্ষার পর একেকজন শিক্ষক কত টাকা করে উপার্জন করেন তার তালিকাটি এক নজর দেখা উচিত। আমি বহুদিন থেকে সাংবাদিকদের বলে আসছি ভর্তিপরীক্ষা শেষ হবার পর বিভিন্ন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা কে কোন কাজটুকু করার বিনিময়ে কত টাকা আয় করেছেন সেটা যেন প্রকাশ করে দেন। এটি একটি অত্যন্ত চমকপ্রদ তথ্য হতে পারত।
আমার ধারণা আমাদের দেশের সাংবাদিকদের এখনও শিক্ষকদের জন্যে এক ধরনের সম্মানবোধ এবং মমতা আছে। তাই এই তথ্যগুলো কখনও প্রকাশ হয় না।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের মতো এত বড় সম্মানী মানুষেরা অল্প কিছু টাকা-পয়সার জন্যে এত ধরনের তুচ্ছ কাজ করেন, তার কারণ একটাই, তাদেরকে খুব অল্প বেতন এবং তার চাইতেও কম সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হয়। পরিবার-পরিজন নিয়ে সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকার জন্যে সম্ভবত তাদের আর কোনো উপায় নেই। তাই তারা যদি নিজেদের আলাদা বেতন স্কেলের জন্যে মানব বন্ধন করেন, পথে নেমে দাবি-দাওয়া পেশ করেন ,তাহলে তাদের দোষ দেওয়া যায় না।
আমি মনে করি তাদের দাবিটি খুবই যৌক্তিক কিন্তু তারপরও আমি কিন্তু সেই মানব বন্ধনে যোগ দিইনি। কেন যোগ দিইনি সেটি বলার জন্যে আমার এই বিশাল গৌরচন্দ্রিকা।
বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বেতন কম হতে পারে কিন্তু তারা এই দেশের সবচেয়ে ক্ষমতাবান মানুষ। বড় বড় বিশ্ববিদ্যালয়ের বড় বড় ভাইস চ্যান্সেলররা, এই দেশের মন্ত্রী প্রধানমন্ত্রীদের সঙ্গে ওঠাবসা করেন। রিটায়ার করার পর তারা নানা দেশের হাই কমিশনার অ্যাম্বেসেডর হন। তারা প্রধানমন্ত্রীর উপদেষ্টা হন। রাষ্ট্রের সব বড় বড় গুরুত্বপূর্ণ কমিটিতে তারা সদস্য থাকেন।
প্রশ্ন ফাঁস হবার পর দেশের শিক্ষাব্যবস্থা লাইনে আনার জন্যে মাননীয় শিক্ষামন্ত্রী যে মিটিং ডেকেছিলেন আমি সেখানে বসে ডানে বামে যেদিকেই তাকিয়েছি সেদিকেই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের দেখেছি, বিশ্ববিদ্যালয়ের ভাইস চ্যান্সেলরদের দেখেছি। স্কুল-কলেজের শিক্ষদের দেখিনি। সেখানে কথাবার্তা যা বলেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরাই বলেছেন। স্কুল-কলেজের লেখাপাড়ার সমস্যার কথা যখন আলোচনা হয়েছে সেটাও আলোচনা করেছেন বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা, যাদের প্রকৃত বাস্তব সমস্যা নিয়ে কোনো অভিজ্ঞতা নেই।
যারা এই দেশের সবচেয়ে বেশি সংখ্যক ছাত্রছাত্রীদের পড়াশোনার দায়িত্ব নিয়েছেন সেই স্কুল-কলেজের শিক্ষকরা যেন একটা গুরুত্বহীন জনগোষ্ঠী। তাদের কথা কে বলবে? কোথায় বলবে?
আমি মাঝে মাঝে একেবারে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের সাথে কথা বলেছি। তাদের জগৎটি প্রায় পরাবাস্তব জগতের মতো। যেভাবে তাদের দিন কাটাতে হয়, ছাত্রছাত্রীদের পড়াতে হয় সেটি নিজের চোখে দেখেও বিশ্বাস হয় না। ভোটার লিস্ট থেকে শুরু করে গ্রামে কতগুলো স্যানিটারি লেট্রিন আছে সেটাও তাদের করতে হয়। তারা কি যথেষ্ট বেতন পান? সেই বেতন নিয়ে তারা কি সম্মান নিয়ে বেঁচে থাকতে পারেন? যদি না পারেন তাহলে তাদের বেতন বাড়ানোর কথা কে বলবে? কার কাছে বলবে? তাদের কথা কে শুনবে?
আমি বিশ্বাস করি তাদের কথাও আমাদের মতো বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদেরই বলতে হবে, কারণ আমরা একেবারে উপরের মহলে কথা বলার সুযোগ পাই, তারা পায় না। তাই আমি যখন হঠাৎ করে দেখি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকেরা তাদের আলাদা একটা বেতন স্কেলের জন্যে মানব বন্ধন করছেন, তখন আমার কেন জানি মনে হয় তারা স্বার্থপরের মতো শুধু নিজের কথা বলছেন। দেশের পুরো শিক্ষাব্যবস্থার নেতৃত্বের দায়টুকু যেহেতু বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের ঘাড়েই পড়েছে, তাদের দাবিটি হওয়া উচিত ছিল সকল শিক্ষকদের জন্যে। মানববন্ধন করা উচিত ছিল বাংলাদেমের সকল শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের জন্যে, শুধুমাত্র বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের জন্যে নয়।
সত্যি কথা বরতে কী, আলাদা বেতন স্কেলে যদি শুরু করতে হয় তাহলে প্রথমে প্রাইমারি স্কুলের শিক্ষকদের দিয়েই শুরু করতে হবে। আমরা যদি আমাদের দেশের শিক্ষার মান বাড়াতে চাই, হাই ফাই নূতন বিশ্ববিদ্যালয় দিয়ে হবে না, ভালো প্রাইমারি স্কুল দিয়েই করতে হবে।
অবশ্যি বলাবাহুল্য, এই পুরো দাবিটা আসলে এক ধরনের নিষ্ঠুর কৌতুকের মতো, আমরা সবাই জানি কখনও-ই এটা হবে না, ক্ষমতাশালী আমলারা গলা টিপে শিক্ষকদের আলাদা বেতন স্কেলের দাবিটাকে শেষ করে দেবেন। শিক্ষক বললে যে মানুষগুলোর ছবি তাদের চোখের সামনে ভেসে উঠে সেই মানুষগুলোর জন্যে তাদের কোনো শ্রদ্ধাবোধ নেই, কোনো ক্ষমতা নেই। তাদের আলাদা বেতন স্কেল দেওয়ার আগে রাস্তাঘাট তৈরি হবে, ব্রিজ তৈরি হবে, কলকারখানা হবে, এয়ারপোর্ট হবে, যুদ্ধজাহাজ হবে, ক্যান্টনমেন্ট হবে। দাবিটার আগে প্লেন হবে, বন্দর হবে, শুধু শিক্ষকদের বেতনটুকু হবে না। তাদেরকে সম্মানজনকভাবে কাজ করতে দেওয়া হবে না।
কেমন করে হবে? বাংলাদেশ সরকার সারা পৃথিবীর সামনে অঙ্গীকার করেছিল যে এই দেশেরি জিডিপির শতকরা ৬ শতাংশ শিক্ষার পিছনে খরচ করবে। সেই অঙ্গীকার সরকার রাখেনি, এখন জিডিপির মাত্র ২.২ শতাংশ শিক্ষার পিছনে খরচ হয়।
আর কোনো সভ্য দেশ শিক্ষার পিছনে এত কম টাকা খরচ করে না। সত্যি কথা বলতে কী, এত কম টাকা খরচ করার পরও আমরা যে কোনো এক ধরনের শিক্ষা পাচ্ছি সেটাই মনে হয় আমাদের চৌদ্দ পুরুষের ভাগ্য।
বাংলাদেশে যদি শুধুমাত্র একটা দাবি করতে হয় তাহলে সেটি হতে হবে এই বিষয়টি নিয়ে, দরকার হলে সব কিছু বন্ধ করে শিক্ষার জন্যে আরও বেশি অর্থ বরাদ্দ করতে হবে।
শিক্ষকদের দ্বিতীয় দাবিটি হচ্ছে তাদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ করে দিতে হবে। আমি এর সরাসরি বিরুদ্ধে। অল্প কিছুদিন আগেও সেটা ছিল ৬০ বৎসর, কীভাবে কীভাবে সেটা জানি ৬৫ করিয়ে নেওয়া হল। সেটাতে এখনও অভ্যস্ত হইনি। এখন হঠাৎ করে দাবি উঠেছে সেটাকে ৬৭ করতে হবে। সত্যি কথা বলতে কী অন্য সবাইকে দাবি করে সেটা আদায় করতে হয়। পাবলিক বিশ্ববিদ্যালয় যেহেতু স্বায়ত্তশাসিত, তাদের কারও কাছ থেকে সেটা আদায় করতে হয় না, নিজেরা নিজেরাই সেটা নিজেদের জন্যে করে ফেলে। যতদূর জানি কোনো কোনো বিশ্ববিদ্যালয় সেটা এর মাঝে করেও ফেলেছে। অন্যদের তাহলে দাবি তুলে সেটা আদায় করতে হবে কেন? নিজেরা নিজেরা করে ফেললেই পারে।
পৃথিবীর নিয়ম হচ্ছে পুরানোদের সরে গিয়ে নূতনদের জায়গা করে দিতে হয়। বুড়ো অধ্যাপকেরা যদি সরতে রাজি না হন, বছরের পর বছর নিজের চেয়ারটা জোর করে আঁকড়ে ধরে বসে থাকেন তাহলে নূতনেরা কেমন করে দায়িত্ব নেবেন? যারা চেয়ারটা আঁকড়ে ধরে রেখেছেন তাদের কয়জন বুকে হাত দিয়ে বলতে পারবেন যে তারা নিজেদের কাজকর্ম গবেষণা দিয়ে এই জায়গায় পৌঁছেছেন?
যারা সত্যিকারের ভালো অধ্যাপক তাদের সাহায্যটুকু নেওয়ার জন্যে একশ একটা উপায় বের করা যায়। সে জন্যে তাদের চাকরির বয়স ৬৭ করতে হয় না।
যখন শুনতে পেয়েছি বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের চাকরির বয়সসীমা ৬৭ করার একটা পাঁয়তারা চলছে তখন আমার একজন অধ্যাপক বন্ধু আমাকে বিষয়টা বুঝিয়েছিল। সে বলেছিল, অমুক বিশ্ববিদ্যালয়ের অমুক অমুক প্রফেসরের রিটায়ার করার সময় এসেছে, অবসরের বয়স ৬৭ করা না হলে তারা বিদায় হয়ে যাবে, ইউনিভার্সিটির পলিটিক্স আর করতে পারবে না। পলিটিক্সের জন্যে তাদেরকে রাখতেই হবে, সেই জন্যে তাড়াহুড়ো করে চাকরির বয়স ৬৭ পর্যন্ত ঠেলে দেওয়া হয়েছে।”
আমার অধ্যাপক বন্ধু আরও ভবিষ্যৎবাণী করল, বলল, “অমুক অমুক বিশ্ববিদ্যালয় এখন বয়সসীমা ৬৭ করবে না, কারণ সেটা করা হলে অমুক অমুক প্রফেসরদের বিদায় করা যাবে না। তারা বিদায় হবার পর এটা ৬৭ করা হবে, কারণ তখন আর কোনো সমস্যা হবে না। ভাইস চ্যান্সেলরদের বয়স কম, তাদের কোনো তাড়াহুড়া নেই!”
আমি বিশ্ববিদ্যালয় জটিল পলিটিক্স বুঝি না, তাই আমার অধ্যাপক বন্ধুর ভবিষ্য বাণীর মাঝে কতটুকু যুক্তি এবং কতটুকু টিটকারি ধরতে পারিনি। ভবিষ্যৎবাণীটুকু মিলে গেলে বুঝতে পারব, দেখার জন্যে অপেক্ষা করে আছি।
আপাতত আমি বলতে চাই বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকদের বয়সসীমা ৬৭ করে ফেলাটুকু হবে নেহায়েত স্বার্থপরের কাজ। শুধুমাত্র নিজেদের জন্যে আলাদা বেতন স্কেল দাবি করে যে স্বার্থপরের কাজ করেছি, নূতন প্রজন্মকে জায়গা করে না দিয়ে জোর করে চেয়ারটা ধরে রেখে সেই স্বার্থপরতাটুকু ষোল কলায় পূর্ণ করার আমি ঘোরতর বিরোধী।
আমার কথা কাউকে মানতে হবে না, শুনতে দোষ কী?