আমরা যত বন্য – ভগীরথ মিশ্র

আমরা যত বন্য – ভগীরথ মিশ্র

[ নাটকটিতে কেবল একটিমাত্র মনুষ্যচরিত্র রয়েছে, বাকি সবই গাছপালা, পশুপাখিদের। নাটকটিকে মঞ্চস্থ করা একদিক থেকে দেখলে খুব দুরূহ, কারণ গাছপালা, পশুপাখিদের ভূমিকায় সারাক্ষণ অভিনয় করে যাওয়া সোজা নয়। তার চেয়েও বড়ো কথা, চরিত্রগুলিকে বিশ্বাসযোগ্য করে তোলার জন্য গাছ এবং পশুদের সাজসজ্জার বিষয়টিও বেশ কষ্টসাধ্য ব্যাপার। অন্যদিক থেকে দেখলে এমন নাটক মঞ্চস্থ করা বেশ সোজা এবং মজাদার হয়ে ওঠে যদি মঞ্চ এবং চরিত্রগুলির সাজপোশাক প্রতীকী এবং ইঙ্গিত ধর্মী করে তোলা যায়। তবে, যেহেতু এটি একটি রূপকধর্মী নাটক, মঞ্চসজ্জা, আলো, আবহ, নাচ, গান সবকিছুতেই কল্পনা প্রয়োগের প্রচুর সুযোগ রয়েছে। এমনকী পুরো নাটকটিকে গীতি-আলেখ্যধর্মীও করে তোলা যায়।

নাটকটিতে চরিত্রের সংখ্যা অনেক। কিন্তু প্রয়োজনে চরিত্রের সংখ্যা কমিয়ে ফেলবারও সুযোগ রয়েছে। ]

পবন কাঠুরে খরগোশ

শিমুল হরিণদিদি

সেগুন টিয়া

শাল ময়না

নিম মৌটুসি

কুরচি ভোঁভোঁ মৌমাছিদের সর্দার

মহুয়া মেঘরাজ মেঘদের সর্দার

গুলমোহর হাওয়াসর্দার

কপিল নদী কালিমেঘ

বাঘমামা শ্যামলীমেঘ

ভালুকভায়া কুনকি হাতি

হুতোমপ্যাঁচা সুয্যিমামা

পিটপিট বাঁদর চারাগাছ (৫-৬ জন)

ময়ূর বর্গি হাওয়া (৫-৬ জন)

ময়ূরী ভুনিকাক

প্রথম দৃশ্য

মধুবন

[ মঞ্চের পশ্চাৎপট এবং পার্শ্বপটগুলি জুড়ে ঘন অরণ্য। জঙ্গলের মাঝ বরাবর বয়ে চলেছে একটা নদী। নদীর মাঝখানে ক্ষীণধারা। দু-ধারে বারো আনাই বালুচর। পশ্চাৎপটের একপ্রান্তে একটা ঝুপড়ির আধখানা দৃশ্যমান।

পরদা উঠলে দেখা গেল, মঞ্চ জুড়ে আটজন গাছরূপী কুশীলব। সব কুশীলব-গাছ এক দৈর্ঘ্যের নয়। কেউ ছোটো, কেউ বড়ো। কেউ পুরুষ, কেউ মেয়ে। নেপথ্যে পাখি ও জীবজন্তুর ডাক।

পরদা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে গাছেরা নেচে নেচে গাইতে থাকে ]

সব পুরুষ গাছ। আমরা হলেম গাছ

সব মেয়ে গাছ। আমরা হলেম গাছি

সবাই। বনের মধ্যে ডাল দুলিয়ে,

মনের সুখে নাচি।

নিম। আমরা হাওয়ায় পরানবায়ু ঢালি

কুরচি। আমরা জোগাই ফুল ও ফলের ডালি

আম। আমরা জোগাই খাদ্য

সেগুন। আমরা বাজাই জীবনের জয়বাদ্য

শাল। (আমরা) আঁকড়ে ধরি মায়ের মতো মাটিকে

গুলমোহর। মাটির মতো এই দুনিয়ায় খাঁটি কে?

তেঁতুল। (আমরা) নামিয়ে আনি আকাশ থেকে বৃষ্টি

মহুয়া। মাঠে মাঠে ফসল ফলাই, বাঁচিয়ে রাখি সৃষ্টি

সবাই। (আমরা) সবার বাঁচার ভাবনা ভাবি

সবার জন্য বাঁচি

বনের মধ্যে ডাল দুলিয়ে

মনের সুখে নাচি।

[ গান শেষ হল। মঞ্চে ঢুকল পবন। তার কাঁধে কুড়ুল। দৃপ্ত ভঙ্গি ]

কুরচি। (পাশের শিশুগাছটিকে জড়িয়ে ধরে) বাছারা, কেউ শব্দ করিসনে। চুপ করে বসে থাক। আজ যে কার কপালে কী আছে!

[ পবন মঞ্চের মধ্যে ভারী ভারী পায়ে হেঁটে বেড়ায়। এ গাছ দেখে, ও গাছ দেখে। অবশেষে একটি গাছকে নির্বাচন করে। তার গুঁড়ির চারপাশের লতাগুল্ম টান মেরে ফেলে দেয়। গাছটি আর্তনাদ করে ওঠে। পবন গাছটার গুঁড়িতে কুড়ুলের ঘা মারতে থাকে। গাছটি আর্তনাদ করতে থাকে। চারপাশের অন্য গাছগুলি ভয়ে, আতঙ্কে তাকিয়ে থাকে।

খানিকক্ষণ কুড়ুল চালাবার পর পবন ওই গাছটার ছায়ায় বসে দম নেয়। তারপর আবার গাছটিকে কাটতে থাকে। একসময় গাছটা মড়মড় শব্দ করে মাটিতে লুটিয়ে পড়ে।

নেপথ্যে চলন্ত লরির শব্দ শোনা যায়। একটু বাদে থেমে যাওয়ার শব্দও। পবন গাছটিকে টানতে টানতে নিয়ে যায় পার্শ্বপটের আড়ালে। এরপর লরি চলে যাওয়ার শব্দ ]

শিমুল। ইস, ছাতিমদাদা আর আমাদের মধ্যে রইল না। একসঙ্গেই বেড়ে উঠেছিলুম আমরা।

সেগুন। ঠিক বলেছ গো শিমুলদাদা, জায়গাটা কেমন ফাঁকা ফাঁকা লাগছে।

শাল। ফাঁকাই তো হয়ে আসছে চারপাশ! একে একে আমাদের কত সঙ্গীই তো চলে গেল! আমি হলেম ঢ্যাঙা শাল। কত উঁচু থেকে পুরো জঙ্গলটাকেই দেখতে পাই।

নিম। আমরাও আর কদিন বাঁচব, কে জানে!

মহুয়া। আমরা তো কারোর কোনো ক্ষতি করিনে গো নিমদাদা।

নিম। বরং উপকারই করি।

কুরচি। এর কি কোনো প্রতিকার নেই?

গুলমোহর। কে করবে প্রতিকার? আমাদের কথা কে ভাবে, বলো?

শিমুল। এক কাজ করি এসো। চলো, আমরা রাজামশাইয়ের কাছে যাই।

সেগুন। ঠিক বলেছে শিমুলদাদা। চলো, সবাই এক সাথে যাই।

আম। রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে কী হবে?

শিমুল। আমরা তাঁর কাছে বিচার চাইব। আমাদের রক্ষা করবার দায়িত্ব তো তাঁরই।

গুলমোহর। তা ছাড়া, রাজামশাইয়ের সঙ্গে আমার কতদিনের বন্ধুত্ব। ফি-মরসুমে গিয়ে তাঁকে ফুল দিয়ে আসি। না গেলে তিনি উতলা হয়ে ওঠেন। কই, গুলমোহর তো এল না। তোমাদের সঙ্গে আমি গেলেই কাজ হবে।

[ সবাই মুখ টিপে হাসতে থাকে ]

মহুয়া। এই জন্যেই তোমার নাম গুলমোহর। গুলের রাজা তুমি।

গুলমোহর। গুল! ঠিক আছে, গেলেই বুঝতে পারবে। তোমরা তো আমার সব কথাকেই গুল ভাব।

কপিল নদী। (অলক্ষে) আহ, ঝগড়া বন্ধ করো দেখি। শিমুলভাই ঠিকই বলেছে। তোমরা রাজার কাছে যাও।

শিমুল। ওই শোনো, কপিলদাদুও একই কথা বলছে।

সেগুন। কিন্তু রাজামশাই যদি আমাদের বিশ্বাস না করেন? আমাদের পক্ষে সাক্ষী কই?

[ মঞ্চে ঢোকে বাঘমামা, ভালুকভায়া, হুতোমপ্যাঁচা, বাঁদর, খরগোশ, হরিণদিদি, টিয়া আর ময়না ]

বাঘমামা। সাক্ষীর জন্য ভাবনা কী? আমরা সবাই যাব তোমাদের সঙ্গে। সাক্ষী দেব রাজার কাছে।

ভালুকভায়া। শুধু তো তোমাদেরই নয়, ওরা তো আমাদেরও মেরে ফেলছে।

খরগোশ। সত্যি, প্রাণ হাতে নিয়ে বেঁচে রয়েছি।

হরিণদিদি। তা ছাড়া, তোমরা নেই তো, আমরাও নেই।

টিয়াবোন। হরিণদিদি ঠিকই বলেছে। তোমাদের আমাদের ভাগ্য তো একই সুতোয় বাঁধা।

ময়না। ভেবো না। তোমাদের সঙ্গে আমরা সব্বাই যাব।

হুতোমপ্যাঁচা। আমরা সব্বাই তোমাদের হয়ে সাক্ষী দোব।

বাঁদর। কপিলদাদু, তুমিও আমাদের সঙ্গে যাবে তো?

কপিল নদী। হ্যাঁরে পিটপিট। অবশ্যই যাব। গাছেরা না থাকলে তো মেঘভায়ারা নামবে না এখানে। জল না পেলে আমি বাঁচব কী করে?

শিমুল। তাহলে আর দেরি নয়, যত জলদি সম্ভব খবর পাঠানো হোক মধুবনের সমস্ত গাছেদের কাছে, পশুপাখিদের কাছে।

গুলমোহর। ঠিক। দলে ভারী না হলে আজকাল কেউ কথা শোনে না।

খরগোশ। আমরা সবাই মিছিল করে রাজামশাইয়ের কাছে যাব। স্লোগান দিতে দিতে পথ হাঁটব।

[ সবাই হাসতে থাকে ]

ময়নাবোন। আহা, ভিতুর ডিম, এখন তড়পাচ্ছে, এক ধমকে কোন ঝোপের মধ্যে লুকোবে। তোমার কাণ্ডকারখানা দেখিনে, ভাবছ?

খরগোশ। অ্যাই! শুধু শুধু বদনাম দিয়ো না বলছি।

টিয়াবোন। বদনাম? কোথাও খুট করে শব্দ হলে কী করো তুমি?

খরগোশ। (হেসে ফেলে) একটুখানি ভয় পেয়ে যাই।

[ সবাই শব্দ করে হেসে ওঠে ]

বুড়ো শিমুল। যাগগে। ঠাট্টা-মশকরা রাখো।

ঢ্যাঙা শাল। ঠিক। এখন ঠাট্টা-মশকরার সময় নয়।

কুঁজো নিম। এখন প্রাণ নিয়ে টানাটানি।

গুলমোহর। খালি বকবক করলে পেট ভরবে? কবে যাবে ঠিক করো। আমি আবার ব্যস্ত বড়োই। হুট করে বললেই যেতে পারব না।

সেগুন। দেরি কেন, কালকে গেলেই তো হয়।

বুড়ো শিমুল। কালকে গেলেই তো হয়! অত জলদি মধুবনের সব গাছগাছালি পশু-পাখালিদের খবরটা কে দেবে শুনি?

কুঁজো নিম। শুধু মধুবনের কেন? চারপাশের সব বনেদেরও তো খবর দেওয়া উচিত। এটা তো তাদেরও সমস্যা।

বাঘমামা। শুধু বনের গাছ-পাখিদেরই বা কেন? লোকালয়ের গাছেরা, পশু-প্রাণীরা কি খুব সুখে রয়েছে?

টিয়াবোন। মোটেই নয়। মাঝে মাঝে লোকালয়ে তো ফলটা-পাকুড়টা খেতে যাই, সেখানেও মানুষের হাতে ওদের দুর্গতির শেষ নেই।

হরিণদিদি। তাহলে তো বহুজনকে খবর দিতে হয়। একদিনের মধ্যে হবে কি?

হাওয়া। (অলক্ষ্যে) কেন হবে না? আমরা আছি কী করতে? একদিনেই সারা দুনিয়া খবর দিয়ে দোব।

গুলমোহর। শুনলে তো? হাওয়াদাদারাই সে দায়িত্ব নিচ্ছে। অবশ্য আমিও এ কাজ করতে পারতুম . . ।

ভালুকভায়া। তাহলে তো মিটে গেল সমস্যা। কাল সকাল সকালই রওনা দেওয়া হোক তবে।

হুতোমপ্যাঁচা। (মিনতি করে) দিনের বেলায় নয়। সন্ধেয় সন্ধেয় বেরোও। দিনের বেলায় চোখে তো তেমন দেখিনে।

বুড়ো শিমুল। তাই হোক তবে। সন্ধে নামলেই রওনা দেওয়া যাক। সবাইয়ের কথা তো ভাবতে হবে।

ঢ্যাঙা শাল। রাতের বেলা বলে অসুবিধে কিছু হবে না। চাঁদমামা তো কদিন যাবৎ রোজই আসছে।

বুড়ো শিমুল। তাহলে ওই কথাই রইল। কাল সন্ধের আগে আগে আমরা সব্বাই জড়ো হব কপিলদাদুর দু-ধারে।

খরগোশ। মিছিল করে যেতে হবে কিন্তু। স্লোগানও দিতে হবে।

[ ভিতু খরগোশকে হম্বিতম্বি করতে দেখে সবাই সশব্দে হেসে ওঠে ]

দ্বিতীয় দৃশ্য

গাছেদের রাজার দরবার

[ একটি প্রাচীন বটই হল গাছেদের রাজা। তাঁর দু-পাশে বৃদ্ধ অশ্বত্থ, প্রাচীন পাকুড়, হত্তুকি, বহেড়ারা দাঁড়িয়ে। রাজার সামনে বিচার প্রার্থীর দল।

পশ্চাৎপট এবং পার্শ্বপটে লম্বা লম্বা তাল-খেজুরেরা বরকন্দাজের মতো দাঁড়িয়ে রয়েছে। এ ছাড়া রয়েছে আরও কিছু গাছ। তাদের ডালে ডালে অসংখ্য পাখপাখালি ময়ূর, কাঠবিড়ালি চিতা, এবং বানরের দল। প্রেক্ষাপটের এক অংশে কপিল নদীকেও দেখা যাচ্ছে। মেঘ এবং হাওয়াদের সর্দারও উপস্থিত।

পরদা ওঠার সঙ্গে সঙ্গে প্রজারা সবাই মাথা নুইয়ে অভিবাদন জানাল রাজাকে। তারপর তারা রাজামশাইয়ের সামনে নেচে নেচে গাইতে শুরু করল। নেপথ্যে হরেক জাতের পশুপাখির কলরব ]

সব পুরুষ গাছ। আমরা হলেম গাছ

সব মেয়ে গাছ। আমরা হলেম গাছি

সবাই। তোমার রাজ্যে ডাল দুলিয়ে

মনের সুখে নাচি।

অন্য গাছেরা। আমরা হলেম বৃক্ষ

মাটির ওপর থাকি

মুণ্ডু দিয়ে ঢাকি

আকাশ অন্তরীক্ষ।।

রাজঘোষক-গাছ। আচ্ছা, এবার চুপ করুন সবাই। শান্ত হোন। দরবারের কাজ শুরু হচ্ছে। প্রথমেই মন্ত্রীমশাইয়ের প্রারম্ভিক ভাষণ।

মন্ত্রী-গাছ। মহামহিম, মহিমানব, রাজাধিরাজ, সর্বগুণান্বিত শ্রীল শ্রীযুক্ত বটেশ্বর মান্ধাতাপুত্র বৃক্ষগৌরব প্রজাপালক, দীর্ঘ জীবিতেষু-, দরবারে উপবিষ্ট পাত্রমিত্র-অমাত্য বৃক্ষপালগণ, হরিতকি, বহেড়ার মতো রাজবৈদ্যগণ, রাজজ্যোতিষী শুকপাখি, পশ্চাতে দণ্ডায়মান রাজপ্রহরীবৃন্দ, মহামান্য কপিল নদী এবং মধুবন ও অন্যান্য এলাকা থেকে আগত বৃক্ষ ও পশুপাখিবৃন্দ! মানুষের লাগাতার অত্যাচার ও জুলুমে অতিষ্ঠ হয়ে, মধুবনের সমস্ত গাছ এবং পশুপাখি তাদের রাজার কাছে বিচারপ্রার্থী হয়ে এসেছে। তারা হাওয়াকে দিয়ে চারপাশের বনজঙ্গল এবং লোকালয়ের গাছ ও পশু- পাখিদের কাছেও খবর পাঠিয়েছিল। কিন্তু কেবল মধুবনের বাসিন্দারা ছাড়া তেমন কেউই আসেনি। কাছের জঙ্গলগুলো থেকে এসেছে অল্প সংখ্যক। দূরের বন ও পাহাড় থেকে নামমাত্র।

বৃক্ষরাজ। এ তো ভালো কথা নয়। এই যে একের বিপদে অন্যের মুখ ফিরিয়ে থাকা, এটা আমাদের মধ্যে ছিল না। মানুষের থেকেই অভ্যেসটা ছড়িয়ে পড়েছে আমাদের মধ্যেও। ঘুঁটে পোড়ে গোবর হাসে, এই নীতি মানুষের সমাজেই চালু রয়েছে। কিন্তু আমাদের পক্ষে এমন আচরণ লজ্জার। যাগগে, মন্ত্রীমশাই, আপনি বলুন।

মন্ত্রী। লোকালয়ের গৃহপালিত গাছ ও পশুপাখিরা কেউই আসেনি। তবে তারা হাওয়াকে দিয়ে খবর পাঠিয়েছে। রাজামশাইকে বারংবার প্রণাম জানিয়ে তারা বলেছে, যেতে তো খুবই ইচ্ছে করে, কিন্তু কী করে যাব? আমরা যে পরাধীন। আমরা আম, কাঁঠাল, লেবু, পেয়ারা, সজনে, ঝুঁটিওয়ালা মোরগ, ডুবুরি হাঁস, ধবলি গাই, বাঁকা-শিঙে মোষ, লালিভুলি কুকুর, মিউমিউ বেড়াল, ব্যা-ব্যা ছাগল, কেষ্টভজা টিয়ে, কেঁদে গান-গাওয়া ময়না-কাকাতুয়ার দল, আমরা তো গেরস্তের বাগানে, বাড়িতে কিংবা খাঁচায় আজীবন বন্দি। গেরস্তের ইচ্ছেয় আমাদের মরা-বাঁচা। লুকিয়ে যাবারও তো উপায় নেই। তারা আমাদের সর্বদাই চোখে চোখে রাখে। দিনে-রাতে পাহারা দেয়। কাজেই, যতদিন না আমাদের এই পরাধীনতা ঘুচছে, তোমাদের ডাকে সাড়া দেওয়া আমাদের পক্ষে অসম্ভব। তবে, আমরা এই উদ্যোগের সাফল্য কামনা করছি আন্তরিকভাবেই। বিচারসভা কেমন জমল, কী কী সিদ্ধান্ত নেওয়া হল, যেন জানতে পারি হাওয়া-বন্ধুর মারফত। আমাদের সমস্ত শুভ কামনা রইল এই উদ্যোগের পেছনে। তো, যারা আজ উপস্থিত হতে পেরেছে, রাজামশাই তাদের প্রত্যেকের অভিযোগ শুনতে প্রস্তুত। তোমরা তোমাদের বক্তব্য রাজামশাইয়ের কাছে পেশ করো।

[ গাছ এবং পশুপাখিরা নাচ-গানের মাধ্যমে তাদের আরজি পেশ করতে লাগল ]

সব পুরুষ গাছ। আমরা হলেম গাছ

সব মেয়ে গাছ। আমরা হলেম গাছি

উভয়ে। তোমার রাজ্যে ডাল দুলিয়ে

মনের সুখে নাচি।

গাছের আরেক দল। আমরা হলেম বৃক্ষ

মাটির ওপর থাকি

মুণ্ডু দিয়ে ঢাকি

আকাশ অন্তরীক্ষ।

পাখিরা। আমরা যত পাখি

তোমার রাজ্যে থাকি

মনের সুখে গান গাই,

তোমার গাছের কোলে ঘুমোই

তোমার গাছের ফল খাই,

তেষ্টা পেলে কপিল নদীর জল খাই।

গাছ ও পাখিরা একত্রে। আমরা যত গাছ ও প্রাণী

তোমায় রাজা বলেই জানি

ধন্য, তুমি ধন্য,

তোমার পায়ে প্রণাম জানাই

আমরা যত বন্য।

[ গানের সঙ্গে নাচতে থাকে একজোড়া ময়ূর ]

বৃক্ষরাজ। (ময়ূরদের দিকে তাকিয়ে) বাহ, বাহ, তোফা!

প্রথম ময়ূরী। (লাজুক হেসে) তাও তো বর্ষাকাল নয় এটা।

দ্বিতীয় ময়ূরী। বর্ষা আসুক, পাকা জামের মতো কালো মেঘ জমুক আকাশে, দেখিয়ে যাব পেখম তোলা নাচ। বুঝবেন, নাচ কাকে বলে!

বৃক্ষরাজ। (সকলের দিকে তাকিয়ে)

কিন্তু সাঁঝপহরে দল বেঁধে যে?

কী হয়েছে, বল দেখি?

মুখগুলো সব শুকনো কেন?

চোখের কোণে জল দেখি!

বুড়ো শিমুল। আমরা যত গাছ ও প্রাণী

তোমায় রাজা বলে মানি।

বৃক্ষরাজ। এসব কথা কে বলেছে মিথ্যে?

শুধু শুধু কাঁদিস কেন? দুঃখ কেন চিত্তে?

কুঁজো নিম। ওগো রাজামশাই-

তোমার রাজ্যে দিচ্ছে হানা, গাছকাটা এক কশাই।

ঢ্যাঙা শাল। তার কুড়ুলে অর্ধেক বন ফরসা,

তুমি মোদের রাজামশাই

তুমিই এখন ভরসা।

পাখি। আমরা গাছের ডালে বাসা খড়কুটোতে বাঁধি

সেই বাসাটি ভাঙলে পরে কার দুয়োরে কাঁদি?

বাঘমামা। সেই সৃষ্টির আদি থেকে বনই মোদের জন্মভূমি,

সেই ভূমিটাই হারিয়ে যাচ্ছে, বিচার করো তুমি।

বৃক্ষরাজ। (পাত্র-মিত্র-অমাত্যদের দিকে তাকিয়ে) যা শুনছি, আর তো চুপ করে বসে থাকা যায় না। কিছু একটা করতে হয়।

[ চতুর্দিকে কান্নার রোল পড়ে যায় ]

মন্ত্রী অশ্বত্থ। আহা, কাঁদছ কেন? কেঁদে কিছু হয় না। সবাই একে একে তোমাদের অভিযোগ রাজামশাইকে জানাও। সবকিছু না শুনলে তিনি বিচার করবেন কী করে?

বুড়ো শিমুল। আমরা যে সমূলে বিনষ্ট হয়ে গেলাম মহারাজ। রোজ রোজ আমাদের কেটে নিয়ে যাচ্ছে।

কুঁজো নিম। আমরাই কদিন আস্ত থাকব, তার কিচ্ছু ঠিক নেই।

ঢ্যাঙা শাল। দেখতে দেখতে আমাদের বসতিটা ফাঁকা হয়ে এসেছে মহারাজ। বিশ্বাস না হয়, হাওয়াদাকে জিজ্ঞেস করুন।

হাওয়া। হ্যাঁ মহারাজ, আগে আমরা জঙ্গলের মধ্যে ঢুকতে পারতুম না। এখন সারা জঙ্গল দৌড়ে বেড়াই।

মেঘ। আমি মেঘেদের সর্দার, মহারাজ। আগে আমরা একটুখানি ক্লান্ত হলেই নেমে পড়তাম মধুবনে। এখন সারা শরীর ক্লান্তিতে ভেঙে পড়লেও নামতে পারিনে ওই এলাকায়। উহ, কী গরম! একটুখানি নামলেই গা জ্বলে যায়!

কপিল নদী। আমার শরীর একটুখানি ছায়া পায় না আজকাল। আগে মেঘভাইয়েরা প্রায় রোজ এসে চান করিয়ে যেত। এখন কালেভদ্রে আসে। কোনো রকমে দু-চার ফোঁটা জল ছিটিয়েই পালায়। সারাদিন রোদ্দুরে শুকোতে থাকি আমি। পাখিরা খেলতে আসে না। পশুপাখি পেট ভরে জল খেতে পায় না। বড়ো মাছ তো নেই-ই, ছোটো মাছগুলোও মরে যাচ্ছে!

মৌমাছিদের সর্দার। আমি মৌমাছিদের সর্দার, ভোঁ-ভোঁ, আগে সারা বনে শয়ে শয়ে মৌচাক বানাতুম আমরা। সেইজন্যই বনটার নাম হয়েছিল মধুবন। আর, এখন গিয়ে দেখুন মহারাজ। দশ-বিশটার বেশি মৌচাকই নেই। কারণ, মৌচাক বাঁধবার মতো মোটা গুঁড়ি আর কোটরওয়ালা গাছের সংখ্যাই কমে গিয়েছে ভীষণ। আর, শাল, পিয়াল, পলাশ, মহুয়া, নিম, খলসের গাছগুলোকে তো রোজই কেটে ফেলছে। ওই গাছগুলোই তো হরেক মরশুমে ফুল ফুটিয়ে মধু জোগাত আমাদের।

মৌটুসি। আমরাও আর মধু খেতে পাইনে আজকাল। প্রায়দিনই খিদেয় কাটে আমাদের। মধু ছাড়া আমরা কীই বা খাই, বলো?

টিয়া। শুধু ফুলের নয়, ফলের গাছগুলোও নিকেশ হয়ে যাচ্ছে। আমরা আর বেশি দিন বাঁচব না।

ভালুক। সব মহুয়া গাছ কেটে ফেললে আমরাই বা কী খেয়ে বাঁচি?

বুড়ো তেঁতুল। হ্যাঁ, কত ফলের গাছ ছিল মধুবনে। দেখেছি তো! মরসুমে ফলগুলো পেকে থাকত। কী তাদের গায়ের রং! কী তাদের স্বাদ! জঙ্গলের পশুপাখিরা পেট ভরে খেত। চারপাশের গাঁ থেকে গরিব মানুষেরা ঝেঁটিয়ে আসত ফল কুড়োতে। অভাব-অনটনের সময়ে বনের ফল খেয়েই চালিয়ে নিত তারা। তাও রাশি রাশি ফল গাছের তলায় পচে নষ্ট হত। আমরা অনাহারে থাকতে দিইনি কাউকেই। না পশুপাখিকে, না মানুষকে।

শ্যাওড়া। কিন্তু মানুষ তো এই উপকারের কথা মনে রাখে না। তারা আমাদের বনের ফল খেয়ে গায়ের বল বাড়ায়। তারপর, ওই বল খাটিয়ে আমাদের কাটে।

বুড়ো শিমুল। মানুষগুলো হল বজ্জাতের ধাড়ি।

কুঁজো নিম। সবাই বজ্জাত নয়। সবাইকে দোষ দিয়ো না।

বৃক্ষরাজ। কিন্তু কে করছে এসব? তার নাম কী?

কুঁজো নিম। তার নাম, মহারাজ, পবন কশাই। একটা কুড়ুল নিয়ে রোজ ঢোকে মধুবনে। সারাদিন ইচ্ছেমতো গাছ কাটে। দিনের শেষে একটা চারপেয়ে জন্তু গর্জন করতে করতে আসে, কাটা গাছগুলোকে ওই জন্তুর মাথায় বোঝাই করে নিয়ে ফিরে যায় শহরে।

ভুনিকাক। শহরে মরা গাছেদের ভাগাড় রয়েছে অনেক। সেখানে পাহাড়-প্রমাণ মরা গাছেদের লাশ। ওরা লাশগুলোকে টুকরো টুকরো করে কাটে। তারপর ওই দিয়ে হরেক জিনিস বানায়। ওই পবনটাই হচ্ছে নাটের গুরু।

ঢ্যাঙা শাল। পবন কশাইয়ের শাস্তি না হলে আমরা সবাই মারা পড়ব, মহারাজ।

শিশুগাছ। হ্যাঁ মহারাজ, ওই পবন কশাইকে কঠিন সাজা দিতে হবে।

উপস্থিত সবাই। পবন কশাইয়ের শাস্তি চাই, শাস্তি চাই। ওর কালো হাত ভেঙে দাও, গুঁড়িয়ে দাও।

[ সহসা গাছ ও পশুপাখিদের মধ্যে তুমুল কলরোল ]

বৃক্ষরাজ। (হাত তুলে) আহ। থামো, থামো। হইচই করলে সবকিছুই পণ্ড হবে। ঠান্ডা মাথায় ঠিক করতে হবে সব কিছু।

[ সবাই শান্ত হয় ]

বৃক্ষরাজ। (মন্ত্রীর দিকে তাকিয়ে) কী করা যায়? কেমন করে শায়েস্তা করা যায় পবনকে? আপনারা সব কী বলেন?

পাকুড়। বাঘমামাকে হুকুম দিলে কেমন হয়? সে পবনের ঘাড় মটকে খাক।

[ বৃক্ষরাজ মাথা নাড়েন ]

মহুল। ভালুকদাদা ওকে নখে-দাঁতে চিরে ফালা ফালা করুক।

[ বৃক্ষরাজ মাথা নাড়েন ]

হরীতকী। হাতিমামা ওকে শুঁড়ে তুলে আছাড় মারুক।

[ বৃক্ষরাজ মাথা নাড়েন ]

বহেড়া। সাপেদের বলা হোক। তারা এক ছোবলে পবনের ভবলীলা সাঙ্গ করুক।

[ বৃক্ষরাজ মাথা নাড়েন ]

শাল। বলা হোক বিষ বিছেকে। ও একটি বার হূল ফোটালে পবনকে আর উঠে দাঁড়াতে হবে না।

গুলমোহর। বললে, আমিই ওর মাথায় একখানা ভারী ডাল ফেলে দিতে পারি।

বৃক্ষরাজ। (সজোরে মাথা নাড়েন) না, না, না। এসব চলবে না। এসব তোমরা ভুলে যাও।

ঢ্যাঙা শিমুল। কেন চলবে না? বলুন বৃক্ষরাজ? ওরা আমাদের রোজ রোজ খুন করবে, আর আমরা-।

বৃক্ষরাজ। (দু-হাত নাড়িয়ে, মাথা ঝাঁকিয়ে) ওরা যা পারে, আমাদের তা শোভা পায় না। আমরা হলেম গাছ। সৃষ্টির আদিপুরুষ। আমরা বড়ো। ওদের মতো আমরা কোনো হীন পন্থা গ্রহণ করতে পারিনে। আমরা প্রকৃতির সন্তান। প্রকৃতিকে ভালোবাসি। আমরা জন্ম থেকেই সবাইকে ভালোবাসতে শিখেছি। সকলের উপকার করাকেই নিজেদের ধর্ম বলে মেনে নিয়েছি। ধ্বংসের জবাবে আমরা কখনো ধ্বংসের পথ নিতে পারিনে। আমরা তো আর মানুষ নই যে, প্রকৃতির বুকে বাস করেও প্রকৃতির নিয়ম-নীতি মানব না। এর জন্য যদি আমাদের প্রাণও যায়, সেও উত্তম।

কয়েকটি গাছ। তাহলে পবনের কোনো শাস্তি হবে না?

বৃক্ষরাজ। হবে। অবশ্যই শাস্তি পাবে সে। কিন্তু তার জন্য আমরা যে পন্থা নেব, তা হবে নীতি-নিয়মে বাঁধা। সবাই আমাদের দেখে শিখবে। জখম, হত্যা, পেছন থেকে ছুরি মারা, ছলনার আশ্রয় নেওয়া, না, না, না। তাহলে মানুষের সঙ্গে আমাদের কোনো তফাত থাকবে না।

[ সবাই লজ্জায় মাথা নোয়ায় ]

বাঘমামা। মহারাজ, যদিও আপনাদের মতো অতখানি অহিংস আর সহিষ্ণু আমরা নই, তবুও আমরা নিতান্ত নীতিহীন নই। পেটের দায়ে আমাদের মধ্যে কেউ কেউ প্রাণীহত্যা করি বটে, কিন্তু সেক্ষেত্রেও কিছু নিয়ম মেনে চলি। আমাদের খাদ্য গোষ্ঠী ঠিক করা রয়েছে। তার বাইরে আমরা সাধারণত খাইনে। খিদে মিটে গেলে নিতান্ত অকারণে কাউকে মারিনে। মানুষের মতো আমরা সর্বভুক নই। চারপাশের সকলের প্রতি অকারণে জুলুম করিনে। আমরা মানুষের চেয়ে অনেক নীতিবান।

বৃক্ষরাজ। (খুশি হয়ে) প্রকৃতির সন্তান, তোমাদের কল্যাণ হোক। তোমরা ঠিকই বলেছ। পশুপ্রাণী হলেও তোমাদের একটা নির্দিষ্ট চরিত্র রয়েছে। খুব অল্প ক্ষেত্রেই তোমরা তোমাদের নিজস্ব চরিত্রের বাইরে গিয়ে কিছু করো। মানুষেরা যেমন সব পশুপ্রাণীর চরিত্রকে আত্মসাৎ করেছে, তোমরা তেমনটি নও। তাই বলছি, পবনকে সাজা দিতে হলে আমরা সধর্মে থেকেই তা করব।

. . . তারপর গাছটিকে কাটতে শুরু করে।

[ এরপর ইঙ্গিতের মাধ্যমে সবাই আলোচনায় মগ্ন হয়ে যায়। শেষ অবধি একটা সিদ্ধান্ত হয়। বৃক্ষরাজ সবাইকে তাঁর হুকুম জানিয়ে দেন। মধুবনের বাসিন্দারা খুশি হয়েছে বোঝা যায়। এই পর্বটিতে সারাক্ষণ অর্কেস্ট্রা বাজতে থাকে।

একসময় বৃক্ষরাজ সভাভঙ্গের কথা ঘোষণা করেন। সবাই ফিরে যেতে থাকে, মঞ্চে একটু একটু করে অন্ধকার নেমে আসে ]

তৃতীয় দৃশ্য

মধুবন

[ আঁধার একটু একটু করে কেটে গিয়ে ভোরের আলো ফুটছে। সূর্য উঠছে গাছগাছালির ফাঁকে। রোদ্দুর ছড়িয়ে পড়ছে সারা বনে। নেপথ্যে পশুপাখির প্রাতঃকালীন ডাক। মঞ্চে গাছরূপী কুশীলবেরা দাঁড়িয়ে রয়েছে। তাদের শরীরের কচি ডালগুলো দোল খাচ্ছে হাওয়ায়। এমনি সময়ে পার্শ্বপট থেকে দৃশ্যমান হয় পবন ]

ঢ্যাঙা শাল। ওই দেখ, কশাইটা আসছে।

[ সবাই মুখ ফিরিয়ে পবনকে দেখে। মুখগুলো ভয়ে বিবর্ণ হয়ে যায় ]

খোঁড়া সেগুন। আজ কার কপাল পুড়ল, কে জানে!

বৃদ্ধ শিমুল। ভয়ে কাঁপছ কেন তোমরা? মনে নেই আমাদের মহাসভার কথা? মহারাজের আদেশের কথা এর মধ্যে ভুলে গেলে?

[ পবন খুব দৃপ্ত পায়ে মঞ্চের মাঝখানে আসে। দেখেশুনে একটি গাছকে নির্বাচন করে। তারপর গাছটিকে কাটতে শুরু করে। সূর্য মাথার ওপর ওঠে। তীব্র আলো পড়ে পবনের গায়ে। পবন ঘাড় তুলে সূর্যকে দেখে। মাথা থেকে গামছা খুলে মুখ, ঘাড়, গলা মোছে ]

পবন। উহ রোদ্দুরের কী তেজ আজ। সারা শরীর ঝলসে যাচ্ছে।

[ ছায়ার দিকে সরে যায়। আবার কুড়ুলের ঘা মারতে থাকে গাছের গুঁড়িতে। ওর মাথার ওপর থেকে ডালটা ধীরে ধীরে সরে যায়। আবার তীব্র রোদ্দুর পড়ে ওর শরীরে। ওপরের দিকে তাকায় পবন। গামছা দিয়ে জোরে জোরে হাওয়া করতে থাকে। আবার ছায়ার দিকে সরে যায়। সঙ্গে সঙ্গে ওপরের ডালটি সরে যায়। আবার তীব্র আলো পড়ে পবনের গায়ে। এমনিভাবে বারবার হতে থাকে। পবন প্রচণ্ড গরমে ক্লান্ত হয়ে পড়ে। অল্প দূরে গিয়ে আরেকটি গাছের তলায় বসে। সঙ্গে সঙ্গে ওই গাছটা পবনের শরীর থেকে সরিয়ে নেয় ছায়া। পবন দৌড়ে গিয়ে আরেকটা গাছের তলায় বসে। একইভাবে ছায়া সরে যায় পবনের শরীর থেকে। প্রচণ্ড দাবদাহে ঝলসে যায় পবনের শরীর। গাছের তলায় বসে হাঁফাতে থাকে সে।

বসতে বসতে অস্থির হয়ে ওঠে পবন। এক সময় উঠে দাঁড়ায় ]

পবন। উহ! সারা শরীর জ্বলে গেল আমার! তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাওয়ার জোগাড়। দু-ঢোক জল না খেলে নির্ঘাত ছাতি ফেটে মরে যাব আমি।

[ বলতে বলতে পবন মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়। গাছগুলো ফিক ফিক করে হাসে

বুড়ো শিমুল। কেমন জব্দ! মজাটা বোঝ এবার!

ঢ্যাঙা শাল। হুঁ-হুঁ, এ হল রাজার দেওয়া সাজা। এবার আর রেহাই নেই তোর।

খোঁড়া সেগুন। এই তো সবে শুরু! এবার বুঝতে পারবি, কত ধানে কত চাল।

গুলমোহর। হুঁহ! বলে কিনা, যাই জল খেয়ে আসি। জল পাবি না কচু! দৌড়োনোই সার হবে তোর।

খোঁড়া সেগুন। আচ্ছা এক বুদ্ধি বেরিয়েছে আমাদের রাজামশাইয়ের মাথা থেকে। শুধু পবন কশাই-এর মাথার ওপর থেকে ছায়াটা সরিয়ে নাও। এক চালেই পবন কশাই মাত।

গুলমোহর। সেকথা বলো তো, বুদ্ধিটা প্রথমে বেরিয়েছিল আমার মাথা থেকে। আমিই রাজামশাইকে বললাম…।

খোঁড়া সেগুন। থামো। বড্ড গুল মারো তুমি। সেইজন্যেই সবাই তোমাকে গুলমোহর বলে ডাকে।

গুলমোহর। গুল? গুল মারছি আমি? বেশ, রাজামশাইয়ের কাছে গিয়ে শুধিয়ে আসুক যে-কেউ।

[ পশ্চাৎপটে কপিল নদীর ওপর আলো পড়ে। ভুনিকাক বসেছিল নদীর পাড়ে। চঞ্চু দিয়ে জল খেতে চায়। কিন্তু কপিল নদীতে জল নেই ]

ভুনিকাক। এক্কেবারে শুকিয়ে গেলে যে গো। আমরা যে জল বিহনে মারা পড়ব।

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) কী করি বলো! ওপরওয়ালা দেয় না যে।

ভুনিকাক। ওপরওয়ালা মানে? কার কথা বলছ? মেঘ না পাহাড়?

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) দুজনের কথাই বলছি। আগের দিনে দু-দিক থেকেই পেতুম। আকাশ থেকে যা ঝরত, তার বেশির ভাগই পুঁতে রাখতুম মাটির তলায়। পাহাড় থেকে যা আসত, তা দিয়ে চাষবাস হত, তোমরা খেতে, গাঁয়ের মানুষ খেত। আমার ওপর দিয়ে সারা বছর নৌকো চলত, জানো তো?

ভুনিকাক। তা আর জানিনে? আমি কি আজকের নাকি? কতদিন ধরে আছি মধুবনে। কতদিন ধরে খাচ্ছি তোমার জল। কিন্তু আর বুঝি থাকা চলে না এই এলাকায়। চোত-বোশেখে জল খেতেও যদি দু-দশ ক্রোশ উড়তে হয় …। কোনোদিন দেখো, উড়তে উড়তে টুপ করে ঝরে পড়ব মাটিতে।

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) আমাকে ওসব শুনিয়ে লাভ কী? সেই কত যুগ ধরে তো তোমাদের সব্বাইকে সারা বছর জল জুগিয়ে এসেছি। এখন যদি না পাই তো দোব কোত্থেকে? তাও যেটুকু সুতোর মতো বইছে, ওই দিয়েই ঠোঁট ভেজাও, যে কদিন পাচ্ছ।

ভুনিকাক। ঠোঁট ভেজাব কী? যা গরম জল, ঠোঁট পুড়ে যায়।

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) যে কদিন পাচ্ছ, ওই খাও ঠোঁট পুড়িয়ে। বেশি দিন তাও পাবে বলে মনে হচ্ছে না। আকাশে মেঘ দেখেছ এই কমাস?

[ ভুনিকাক নিঃশব্দে মাথা নাড়ে ]

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) তাহলে বোঝো, কেমন দিন আসছে সামনে!

[ এমনি সময়ে পার্শ্বপট ভেদ করে পবন ঢোকে। ক্লান্ত অবসন্ন পায়ে নদীর দিকে হাঁটতে থাকে ]

ভুনিকাক। ওই দেখো, কশাইটা তোমার দিকেই আসছে।

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) তাই তো! পালাও কাকভায়া। আমিও লুকিয়ে পড়ি বালির তলায়। দুর্জনের মনে কী আছে, কে জানে!

[ ভুনিকাক ডানা মেলে উড়ে চলে যায়। পবন এসে দাঁড়ায় নদীর পাশটিতে। নদীর তীরে হা৺টু গেড়ে বসে। দু-হাত দিয়ে আঁজলা বানিয়ে ডুবিয়ে দেয় নদীতে। কিন্তু আঁজলায় জলের বদলে বালি উঠে আসে ]

পবন। ওগো কপিল নদী, আমায় এক আঁজলা জল দাও। তেষ্টায় আমার ছাতি ফেটে যাচ্ছে।

কপিল নদী। (অলক্ষ্যে) জল নেই। দোব কোত্থেকে?

পবন। কিন্তু যখন ঢুকলাম বনে, তোমার ওপর দিয়েই তো গেলাম। তখনও তো তির তিরিয়ে বইছিলে।

কপিল নদী। (গলায় বিরক্তি) তখন ছিল, এখন নেই। ফুরিয়ে গেল কথা। অত জেরা কীসের?

পবন। (তপ্ত বালিতে লাফাতে থাকে) ইস, বালি কী তেতেছে! পা রাখা দায়! দাও না গো এক আঁজলা জল?

কপিল নদী। কোত্থেকে দোব? তুমিই তো সে পথ মেরে দিয়েছ একটু একটু করে।

পবন। (বিস্মিত) আমি!

কপিল নদী। নয় তো কে? গাছগুলো একে একে কেটে ফেললে। জায়গাটা গরম হয়ে গেল। মেঘভাইয়েরা ওই গরমে নামে? ওরা না নামলে বৃষ্টি হয়?

পবন। (তপ্ত বালির ওপর দাঁড়িয়ে, থাকতে পারছিল না) দোষ করেছি আমি, ভুল করেছি, এখন এক আঁজলা জল দিয়ে আমার প্রাণটা বাঁচাও কপিল নদী।

কপিল। এক আঁজলা জল হয়তো বা দেওয়া যেত তোমাকে। বালির মধ্যে অল্পস্বল্প তো লুকিয়ে রেখেছি এখনও অবধি। কিন্তু তার তো কোনো উপায় নেই।

পবন। কেন?

কপিল। রাজামশাইয়ের হুকুম যে। তোমাকে জল দেওয়া বারণ। গাছেরা তোমায় ছায়া দেবে না, আমি জল দেব না, হাওয়ারা তোমার গায়ে পাখা করবে না। রাজার হুকুম কেমন করে অমান্য করি, বলো?

পবন। (কাঁদতে থাকে) কিন্তু এক ফোঁটা জল না পেলে আমি তো মরেই যাব। আমাকে দেখে দয়া হচ্ছে না তোমার?

কপিল। (নরম গলায়) দয়া তো হচ্ছে, কিন্তু রাজার আদেশ রয়েছে যে। তুমি বরং এক কাজ করো। আমাদের রাজার কাছে যাও।

পবন। তোমাদের রাজার কাছে?

কপিল। হ্যাঁ। তিনি মাফ করলেই সবাই তোমাকে সব দেবে। ছায়া, জল, হাওয়া …। সুয্যিমামাও নরম চোখে তাকাবে তোমার দিকে।

পবন। রাজার কাছে যাওয়ার ক্ষমতা নেই আমার। উহ, রোদ্দুরে সেদ্ধ হয়ে গেলুম আমি! তেষ্টায় ছাতি ফেটে যাচ্ছে। আপাতত ওই কুঁড়েঘরটার মধ্যে গিয়ে একটুক্ষণ জিরোই। রোদের তেজটা কমুক। তারপরে না হয় যাব তোমাদের রাজার কাছে।

[ পবন দৌড়োতে দৌড়োতে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যেতে চায়। কিন্তু বেশিদূর যেতে পারে না। মঞ্চের এক কোণে পড়ে গিয়ে জ্ঞান হারায়। বৃত্তাকারে আলো পড়ে পবনের ওপর। কয়েক মুহূর্তের জন্য মঞ্চে অন্ধকার নেমে আসে। সেই ফাঁকে মঞ্চে দাঁড়িয়ে থাকা গাছরূপী কুশীলবের দল মঞ্চ থেকে বেরিয়ে যায়। যখন পুনরায় আলো জ্বলে, মঞ্চ পুরোপুরি ফাঁকা। পশ্চাৎপটে কপিল নদী সহ জঙ্গলের দৃশ্য।

বৃত্তাকারে আলো পড়ে পবনের ওপর। সেই আলো সরে গিয়ে মঞ্চের মাঝখানে থামে। আলোর বৃত্তটা বিস্তৃত হয়। পবন পড়ে থাকে বৃত্তের বাইরে।

মঞ্চের আলো কমতে কমতে মেঘলা দিনের রূপ ধরে। দূর থেকে মেঘ ডাকার শব্দ ভেসে আসে। মেঘবরণ পোশাক পরে ছেলে-মেয়েরা মেঘের রূপ ধরে মঞ্চে ঢোকে। তারা নাচতে গাইতে থাকে ]

মেঘেদের সমবেত গান। (নিয়ে) বুক ভরতি জল

(মোরা) হাঁটছি টলমল

ওই দেখা যায় কুটুমবাড়ির সবুজ দেশ।

(চল) জোরসে পা চালাই

(গেলে) মিলবে ক্ষীর-মালাই

ভিজিয়ে দোব কুটুমগুলোর শুকনো বেশ।

[ মেঘেদের দেখে আশায় আশায় মঞ্চে ঢোকে পবন। বড়ো আশা নিয়ে আকাশের দিকে বাঁ হাত আড়াল করে তাকায় ]

পবন। তোমরা কে গো?

মেঘরাজ। আমরা মেঘ। আমি মেঘেদের রাজা। আর, এ হল কালি মেঘ, এ হল শ্যামলী মেঘ, এ হল কুনকি হাতি।

পবন। কোথায় চলেছ গো তোমরা?

[ মেঘেরা হেসে ওঠে ]

কালি মেঘ। আমরা চলেছি উঁচু পাহাড়ের দেশে। আরও অনেক দল আসছে পেছনে। তাদের পেছনে আরও অনেক দল…।

পবন। আমিও যাব তোমাদের সঙ্গে।

মেঘসর্দার। তুমি কী করে যাবে? তোমার বাড়িঘর, ছেলে-মেয়েদের জন্য মন কেমন করবে না?

পবন। আমি তো আবার ফিরে আসব। তোমাদের সঙ্গেই ফিরে আসব।

মেঘসর্দার। আমরা তো কবে ফিরব, ঠিক নেই। ফিরলেও এই আকাশ-পথ দিয়ে ফিরব না।

পবন। তবে?

মেঘসর্দার। আমরা ফিরব নদী-পথে।

শ্যামলী মেঘ। নদীপথেই আমরা চলে যাব সাগরে।

পবন। (হতাশ) তাহলে আর তোমাদের সঙ্গে যাওয়া হল না। যাও তবে। কী আর করা যাবে! তবে যাওয়ার আগে এখানে একটু নামো না গো। আমি যে তেষ্টায়, গরমে একেবারে মরে গেলুম।

কালি মেঘ। সেই ভালো।

(সুরে) গা হয়েছে ভারী

আর উড়তে নারি

চলো, নামি, একটুখানি হালকা হই।

মেঘসর্দার। (সুরে) আমরাও তো নামতে চাই

এখানে নামার জায়গা কই?

গাছগাছালি হালকা, তাই

এখানে নামার উপায় নাই।

কালি মেঘ। কিন্তু আমি যে আর ভেসে থাকতে পারছিনে।

শ্যামলী মেঘ। আমিও আর ভেসে থাকতে পারছিনে। মনে হচ্ছে, আমাদের ঘাড়ের ওপর যেন বিশ মণ পাথর চাপিয়ে দিয়েছে কেউ।

কালি মেঘ। সত্যি, নেমে একটুখানি জিরিয়ে না নিলে আর চলে না।

কুনকি হাতি। অত বোঝা নিয়ে অতখানি পথ ভেসে থাকা যায়? তুমি যেন কী গো মেঘরাজ!

মেঘরাজ। (রেগে যায়। আকাশে চড়াক চড়াক বিদ্যুৎ চমকায়। গরগর শব্দ ওঠে) বড়োদের কথা শুনবিনে তো তোরা? এই হয়েছে তোদের স্বভাব। ভালো কথা কানে ঢোকে না। ঠিক আছে, নাম তবে। নেমে দেখ, কত ধানে, কত চাল।

[ মেঘেরা নেচে নেচে নামতে থাকে। মঞ্চ জুড়ে মেঘ ঘনিয়ে আসে ]

কালি মেঘ। বাপ রে! কী অসহ্য গরম! গা জ্বলে যায়।

শ্যামলী মেঘ। এ এলাকায় এত গরম কেন?

কুনকি হাতি। মাটি থেকে যেন আগুন বেরোচ্ছে!

কালি মেঘ। আমার সারা শরীর জ্বলছে। আমি আর নামছিনে ভাই।

শ্যামলী মেঘ। আমিও নামছিনে। জিরিয়ে আমার কাজ নেই।

কুনকি হাতি। ওঠ, ওঠ, জলদি ওঠ উঁচুতে। শরীরটা জুড়োক।

[ মেঘেরা উচুঁ আকাশে উঠে যায়। মঞ্চে মেঘলা ভাব কমে আসে ]

মেঘরাজ। কী রে, ফিরে এলি যে বড়ো? নামলিনে যে?

কালি মেঘ। কী গরম গো মেঘরাজ! মনে হচ্ছিল, সারা শরীর টগবগিয়ে ফুটছে।

শ্যামলী মেঘ। কিন্তু ওখানে এত গরম কেন?

মেঘরাজ। গরম তো হবেই। এ বনের সমস্ত গাছ কেটে প্রায় সাফ করে দিচ্ছে পবন নামে একটা কশাই। গাছেরাই তো হাওয়া থেকে গরম শুষে নেয়।

কুনকি হাতি। কিন্তু এমন করে তো বেশিক্ষণ ভেসে থাকতে পারব না মেঘরাজ।

মেঘরাজ। বেশি দূর যেতে হবে না তোদের। আর খানিক এগোলে, ওই ছোট্ট পাহাড়টার আড়ালে রয়েছে একটা ঘন জঙ্গল। সেখানে আমাদের অনেক কুটুম-বাটুমের বাস। আমরা সেখানেই নামব।

সব মেঘ। (গাইতে গাইতে চলতে থাকে)

চল রে, চল, জোরসে চল

মনের মধ্যে পেলাম বল

একটুখানি এগিয়ে গিয়ে

কুটুমের দেশে ঢালব জল।

[ মেঘেরা উধাও হয়ে যায়। মঞ্চ আবার উজ্জ্বল হয়ে ওঠে। পবনের ওপর বৃত্তাকারে আলো পড়ে। বর্শার মতো তীক্ষ্ম আলোর রেখা পবনের পিঠে গেঁথে যায়। পবন আধো চেতনায় হাত দিয়ে পিঠের ওই জায়গাটাতে হাত রাখে। হাত দিয়ে সরিয়ে দিতে চায় আলোটা। কিন্তু আলোটা বিঁধেই থাকে। পবন চিত হয়ে শোয়। আলোটা বিঁধে থাকে ওর বুকে। পবন ভেতরে ভেতরে যন্ত্রণা বোধ করছিল। এক সময় উঠে বসে সে। তার সারা শরীর ঘামে ভিজে গিয়েছে। আর, সারা শরীর জুড়ে তীব্র আলো ]

পবন। উহ! কী যে করি! কেমন করে যে বাঁচি! আকাশ থেকে যে আগুন বৃষ্টি হচ্ছে। (কুঁড়ে ঘরটার দিকে তাকিয়ে) যাই, ওর মধ্যে গিয়ে একটুখানি জিরোই।

[ টলতে টলতে পার্শ্বপট দিয়ে বেরিয়ে যায় পবন। মঞ্চ উজ্জ্বল আলোয় ভরে যায়। নেপথ্যে ঝড় ওঠার শব্দ। ক্রমশ ঝড়ের আওয়াজ প্রবল হতে থাকে। নাচতে নাচতে ঝড়েরা মঞ্চে আসে। সমবেত ভাবে গান গাইতে থাকে ওরা ]

ঝড়দের সমবেত গান। কে আমাদের দেবে বাধা

গাছগুলো তো নাই

মনের সুখে নাচ-গান কর, ভাই।

(আমরা) বর্গি হাওয়ার দল

সর্বদা চঞ্চল

(আমরা) ধ্বংসের গান গাই।।

[ নেপথ্যে প্রবল ঝড়ের আওয়াজ, মঞ্চে ঝড়দের প্রলয় নৃত্য ]

আয়, গাছেদের মুণ্ডু ধরে নাড়ি,

আয় ভাঙি সব দোকান দালান বাড়ি,

আয় করি সব ছারখার

কারো কাছে নেই হার,

(আমরা) বর্গি হাওয়ার দল

সর্বদা চঞ্চল

(আমরা) ধ্বংসের গান গাই।

[ ঝড়দের নাচ চলতে থাকে। নেপথ্যে প্রবল ঝড়ের শব্দ। আচমকা একটা কুঁড়েঘরের মড়মড় শব্দে ভেঙে পড়বার আওয়াজ হয়। ঘরের চালের একটা অংশ মঞ্চের ওপর এসে পড়ে। পর মুহূর্তে প্রায় দৌড়োতে দৌড়োতে মঞ্চে ঢোকে পবন। একেবারে দিশেহারা দেখায় ওকে। প্রবল ঝড়ের মধ্যে অসহায়ভাবে ছুটোছুটি জুড়ে দেয়। ঝড়েরা নাচছিল। পবনকে দেখামাত্র হা-হা রবে হেসে ওঠে। ওরা দু-দিক থেকে পবনকে টানাহেঁচড়া করতে থাকে। ওদের প্রবল টানে পবনকে একবার এদিকে, একবার ওদিকে টেনে নিয়ে যায়। হাওয়ারা ওকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে আছাড় মারে মেঝেতে। সেই সঙ্গে তার সারা শরীরে বর্শার ফলার মতো তীক্ষ্ণ রোদ্দুর পড়তে থাকে। পবন যেদিকেই যায়, রোদ্দুরের ফলাগুলি তার সারা শরীরে বিঁধতে থাকে অবিরাম। পবন নাজেহাল হয়ে যায়। প্রবল যন্ত্রণায় কাতরাতে থাকে। বারবার চারপাশে হাতজড়ো করে করুণা ভিক্ষা করে ]

পবন। আর না। আর মেরো না। দয়া করো। তোমাদের কাছে প্রাণ ভিক্ষে চাইছি আমি। আর কক্ষনো এ এলাকায় আসব না। এই নাক মলছি, কান মলছি। এবারের মতো রেহাই দাও আমায়।

হাওয়াদের সর্দার। আমাদের কাছে প্রাণভিক্ষা চেয়ে কোনো লাভ নেই। বাঁচতে চাও তো আমাদের রাজার কাছে যাও। তিনি মাফ করলে তবেই রেহাই পাবে তুমি।

পবন। তাই যাচ্ছি। ছাড়ো আমাকে। আমি এক্ষুনি তোমাদের রাজার কাছে যাব। পায়ে ধরে মাফ চাইব তাঁর কাছে।

হাওয়া। ছেড়ে দিচ্ছি আজকের মতো-। (হাওয়া থেমে আসে)

সূর্য। (অলক্ষ্যে) রেহাই দিলুম আজকের মতো। (রোদ্দুরের ফলাগুলো মিলিয়ে যায়)

হাওয়া। কিন্তু রাজামশাই মাফ না করলে, কাল ফের তোকে নিয়ে ফুটবল খেলব।

সূর্য। (অলক্ষ্যে) তোর সারা শরীরে আরও বর্শা বিঁধিয়ে দেব।

পবন। না, না, বিশ্বাস করো। এই আমি চললুম তোমাদের রাজার কাছে। আমি মরতে চাইনে। চাইনে।

[ পবন মঞ্চ থেকে টলতে টলতে বেরিয়ে যায়। পেছন পেছন ঝড়েরাও। মঞ্চের আলো পুরোপুরি নিভে যায় ]

চতুর্থ দৃশ্য

গাছেদের রাজার দরবার

[ আড়ালে ডালপালার দোল খাওয়ার শব্দ। পাখিদের ডাক। বিপর্যস্ত পবন টলতে টলতে মঞ্চে ঢোকে। সটান শুয়ে পড়ে রাজার পায়ের তলায় ]

পবন। (হাত জোড় করে) আমাকে ক্ষমা করুন বৃক্ষরাজ। আমাকে বাঁচান।

বৃক্ষরাজ। তুই খুনি। আমার অনেক প্রজাকে তুই খুন করেছিস।

পবন। আমার ঘোর অপরাধ হয়েছে মহারাজ।

মন্ত্রীগাছ। তোর জন্য মধুবনের অনেক পশু, কত সুন্দর সুন্দর পাখি মরে গেছে খাদ্য ও আশ্রয়ের অভাবে।

রাজবৈদ্য গাছ। কত ভেষজ গুল্ম, লতা, ছায়া না পেয়ে নির্মূল হয়ে গিয়েছে।

বৃক্ষরাজ। তোর জন্য মেঘ-বন্ধুরা আমার রাজ্যে নামতে পারে না।

মন্ত্রীগাছ। বর্গি হাওয়ার দল তাণ্ডব চালায়।

বৃক্ষরাজ। তোর জন্যই কপিল নদীতে জল নেই। মাঠে ফসল ফলে না বৃষ্টির অভাবে।

মন্ত্রীগাছ। শুধু নিজেকে বাঁচিয়ে রাখবার জন্য চারপাশের সবাইকে, সবকিছুকে, ধ্বংস করে ফেলতে চাস তুই?

রাজবৈদ্য। তোকে কঠোর সাজা পেতে হবে।

পবন। আমি সব দোষ স্বীকার করছি বৃক্ষরাজ। এবারের মতো মাফ করে দিন আমাকে।

বৃক্ষরাজ। মাফ করবার প্রশ্নই ওঠে না। শাস্তি তোকে পেতেই হবে। কী শাস্তি দেওয়া যায়, সেটাই ভাবছি।

চারপাশের গাছেরা। মৃত্যুই ওর একমাত্র শাস্তি।

পশুরা। ঠিক। মৃত্যু ছাড়া কোনো শাস্তিই দেওয়া চলে না ওকে।

গাছেরা। ওর মৃত্যু ছাড়া আমাদের মৃত আত্মীয়রা পরলোকে শান্তি পাবে না।

পশুরা। মৃত্যুদণ্ড কার্যকরী করবার ভার আমাদের ওপর দেওয়া হোক।

[ গাছ ও পশুদের মধ্যে তুমুল কলরোল শুরু হয়। পবন ভয়ে আতঙ্কে চারপাশের গাছেদের, পশুদের দিকে তাকাচ্ছিল ]

বৃক্ষরাজ। থামো।

[ মঞ্চ নিস্তব্ধ হয়ে যায় ]

বৃক্ষরাজ। মানুষের হাওয়া গায়ে লেগেছে তোমাদের। মানুষের মতোই ভাবতে শিখেছ। প্রকৃতির নিজস্ব নিয়ম ভুলে গেছ। হত্যার বদলে হত্যা, বর্বর মানুষদের এই ঘৃণ্য নীতি অনুসরণ করব আমরাও? আমরা না গাছ? এই পৃথিবীর আদি প্রাণ? আমরা না সবার চাইতে বয়েসে বড়ো? আমরা না প্রকৃতির সন্তান? তোমাদের লজ্জিত হওয়া উচিত।

[ গাছেরা, পশুরা, লজ্জায় মাথা হেঁট করে দাড়িয়ে থাকে ]

বৃক্ষরাজ। (পবনের দিকে তাকিয়ে) শোন, পবন, তোকে আমি এবারের মতো মাফ করতে পারি।

পবন। আপনার অসীম করুণা। বৃক্ষরাজ।

বৃক্ষরাজ। কিন্তু একটা শর্তে।

পবন। বলুন, বৃক্ষরাজ।

বৃক্ষরাজ। সারা মধুবনের যত গাছ তুই এ-যাবৎ কেটেছিস, প্রতিটি কাটা গুঁড়ির পাশে দুটো করে সেই জাতের গাছ লাগাতে হবে তোকে।

পবন। লাগাব বৃক্ষরাজ।

বৃক্ষরাজ। নদীর থেকে জল বয়ে এনে সেই চারাগুলোর গোড়ায় দিতে হবে রোজ।

পবন। দেব বৃক্ষরাজ।

বৃক্ষরাজ। একটি চারাও যেন না মরে।

পবন। মরবে না বৃক্ষরাজ।

বৃক্ষরাজ। তাহলেই ধীরে ধীরে তোর গায়ের জ্বলন কমে আসবে। গাছেরা ছায়া দেবে তোকে। কপিল নদী দেবে জল।

পবন। তাই হবে মহারাজ। আপনার হুকুম অক্ষরে অক্ষরে পালন করব আমি।

[ পবন আবার সাষ্টাঙ্গে বৃক্ষরাজকে প্রণাম করে। মঞ্চের আলো ধীরে ধীরে নিভে আসে ]

পঞ্চম দৃশ্য

মধুবন।

[ পবনের বাঁ হাতে অনেকগুলি চারা। ডান হাতে কোদাল। সারা জঙ্গলময় চারা পুঁতেছে সে। চারা পোঁতা শেষ হল। পবন বেরিয়ে গেল মঞ্চ থেকে। পর মুহূর্তে বালতি-মগ নিয়ে ফিরে এল। চারাগুলোর গোড়ায় জল দিতে লাগল। জল দেওয়া শেষ করে মঞ্চ থেকে বেরিয়ে গেল। পুনরায় চারা গাছ সহ ফিরে এসে চারা পুঁততে লাগল। এইভাবে পরপর তিনবার চারা পোঁতা এবং জল দেওয়ার কাজ চলবে। এইসব করতে করতে তার সারা মুখ অনির্বচনীয় খুশিতে ভরে যেতে লাগল। তার হাঁটাচলা ও অঙ্গভঙ্গিতে সেই খুশির অভিব্যক্তি দেখা গেল।

একসময় শ্রান্ত হয়ে একটি ঝাঁকড়া আম গাছের তলায় বসল পবন। আমগাছ ডাল দুলিয়ে ওকে হাওয়া করতে লাগল। একসময় আসরে ঢুকল কচি চারার দল। তারা নেচে নেচে খুশির গান গাইতে লাগল ]

চারা গাছদের গান। মাটির বুকেতে জন্ম নিলেম

নতুন গাছের দল

হাঁটতে পারিনে এখনও পা টলমল

বড়ো হয়ে মোরা বাড়াব মাটির বল

দান করে যাব ফুল-ফল-আর

আকাশ ভরতি জল।

[ গান চলাকালীন পবনের ওপর বিশেষভাবে আলো পড়ে। পবন চারা গাছদের গান শুনতে শুনতে খুশিতে হাসছে। আমের ডাল দুলছে। এমনি সময়ে একটি আম খসে পড়ল পবনের কোলে। পবন ওপরের দিকে তাকায়। গাছটির প্রতি গাঢ় কৃতজ্ঞতায় ভরে যায় সারা মুখ ]

চারা গাছদের গান। মাটিকে বাঁধব গভীর সোহাগে

আকাশকে ছোঁব গাঢ় অনুরাগে

যতদিন বাঁচি সবুজে সবুজে

সাজাব ধরণীতল।

[ গান চলতে থাকে। ধীরে ধীরে যবনিকা নেমে আসে ]

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *