আমরা ভুলিনি, ক্ষমাও করিনি
৫ই সেপ্টেম্বর, ১৯৭২। সকাল ৫:৩০। ইসরায়েলের তৎকালীন প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার তখন অঘোরে ঘুমোচ্ছেন। হঠাৎ তাঁর শয়নকক্ষের দরজায় কেউ নক করল। ধড়মড় করে বিছানায় উঠে বসলেন লেডি মেয়ার।
এত সকালে আবার কে এল? মন কু গাইছিল। না জানি কোন খারাপ খবর শুনতে হবে! এমনিতেই দেশের শত্রুর অভাব নেই।
খুব একটা ভুল ভাবেননি গোল্ডা মেয়ার। একজন প্রধানমন্ত্রীকে অমন কাকভোরে দরজায় নক করে ঘুম ভাঙানোর ঘটনা কেবল ইসরায়েল কেন অন্য যে কোনো রাষ্ট্রের ক্ষেত্রেই কত বার ঘটেছে কে জানে? সত্যিই কি খুব খারাপ কিছুর ইঙ্গিত?
বিছানা ছাড়লেন প্রধানমন্ত্রী। দরজার বাইরে থাকা ব্যক্তির উদ্দেশে বললেন, ‘দাঁড়াও, যাচ্ছি!’ তারপর তিনি কাঁপা কাঁপা হাতে দরজা খুললেন। মুখে আর কোনো প্রশ্ন করতে হল না এবং খবরও এল প্রত্যাশিত রূপে। খারাপ খবর!
কী ছিল সেই সংবাদ?
জার্মানির মিউনিখ শহরে অলিম্পিকস গেমসে অংশগ্রহণকারী ইসরায়েলি খেলোয়াড়দের বন্ধক হিসাবে আটকে রেখে দিয়েছে কয়েক জন সন্ত্রাসবাদী।
‘ওরা কারা? কী চাইছে?’ বললেন গোল্ডা মেয়ার।
‘জানা নেই ম্যাডাম। হতে পারে ওরা পিএলও-এর লোক। এই অপারেশনটার নাম শোনা যাচ্ছে ইকরিৎ অ্যান্ড বিরাম।’
‘কোনো ড্যামেজ?’
সামনের মানুষটা চোখ নামিয়ে নেয়। উত্তর দেয় না।
বুকের ভেতরে ধড়াস করে উঠল মমতাময়ী মেয়ারের। উনি আবার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘টেল মি, ইফ এনি।’
‘ম্যাডাম, এর মধ্যেই ওরা ৩ জন খেলোয়াড়কে মেরে দিয়েছে।’
নিজের দুই হাত বুকের কাছে এনে প্রার্থনার ভঙ্গীতে রেখে চোখ বুজে ফেললেন মেয়ার। তারপর জানতে চাইলেন, ‘এখনও ক’জনকে ওরা হোস্টেজ করে রেখেছে?’
‘ন’ জন।’
ক্যাবিনেট মিটিং ডাকা হল তৎক্ষণাৎ। জার্মান গভর্নমেন্টের সঙ্গে সম্পর্ক করল ইসরায়েল সরকার।
জানা গেল নতুন তথ্য— সন্ত্রাসবাদীরা ইসরায়েলের বিভিন্ন জেলে বন্দি হয়ে থাকা ২৩৪ জন উগ্রপন্থীর মুক্তি দাবি করছে। আর দাবি ছিল ‘রেড আর্মি’ নামক সংগঠনের দুই উগ্রবাদীকে জার্মানির জেল থেকে মুক্তি দেওয়া হোক। এই উগ্রপন্থীদের প্রায় সবটাই ছিল প্যালেস্টাইনের ভিন্ন ভিন্ন বিচ্ছিন্নতাবাদী সংগঠনের সদস্য। এছাড়াও চাওয়া হল একটি বিমান। সেই বিমানে করে সন্ত্রাসবাদীরা যে কোথায় যেতে পারে সে কথাও বোঝা সম্ভব হচ্ছিল না জার্মানদের।
গোল্ডা একজন অসামান্য বুদ্ধিমতী এবং বিচক্ষণ মহিলা ছিলেন। উনি পরিস্থিতির গুরুত্ব বুঝে জার্মান সরকারের কাছে আপিল জানালেন যে, জার্মান গভর্নমেন্ট যেন ইসরায়েলের স্পেশ্যাল টিম সায়েরাত মটকলকে সেখানে গিয়ে অপারেশন চালানোর পারমিশন দেয়। এই টিম এ ধরনের অপারেশনের ব্যাপারে এক্সপার্ট।
কিন্তু রাজি হল না জার্মানরা। তাদের পক্ষ থেকে মেয়ারকে আশ্বাস দেওয়া হল, ‘আপনি চিন্তা করবেন না। আমরা সবাইকে ছাড়িয়ে আনব এবং কোনো অপরাধীকে রেহাই দেওয়া হবে না।’
গোল্ডার মন শান্ত হল না। তিনি খুব ভালো করেই জানতেন এ ধরনের পরিস্থিতির মোকাবিলা করার মতো বন্দোবস্ত ও দেশে নেই। সাধারণ পুলিশের নাগালের বাইরের কাজ ছিল ওই রেসকিউ অপারেশন। জার্মানিতে এটাই ছিল প্রথম সন্ত্রাসবাদী হামলা। যে দেশে কাউন্টার টেররিজম বাহিনী নেই, তারা কীভাবে মোকাবিলা করবে তা সত্যিই প্রশ্ন উদ্রেককারী বিষয় ছিল।
ফলাফল?
যা ভয় করা হয়েছিল তা-ই ঘটল। জার্মান অথোরিটি মূর্খের মতো ডিল করার চেষ্টা করে অসফল হল এবং জার্মানির পদক্ষেপ আগে থেকেই অনুমান করতে পারা সন্ত্রাসবাদীর দল এক এক করে সকল ইসরায়েলি খেলোয়াড়কে হত্যা করল।
সবথেকে ভয়ানক বিষয় কী ছিল জানেন পাঠক? এই হত্যাকাণ্ডের সবটাই ওই নরপিশাচরা লাইভ টেলিকাস্ট করে দেখিয়েছিল। অভাবনীয় একটি ঘটনা!
ভয়ানক প্রতিক্রিয়া হল ইসরায়েলে। দেশজুড়ে শোক, ক্ষোভ। নিজেদের দেশের মানুষকে এভাবে চোখের সামনে মরতে দেখে জনতা উন্মত্ত হয়ে উঠল। লাখ লাখ মানুষ পথে নামল। কার্যত অবরুদ্ধ হয়ে গেল তেল আভিভের পথ। ফেস্টুন, পোস্টার, ব্যানারে লাল কালিতে লেখা কথাগুলো বলে দিচ্ছিল জনগণ কতখানি ক্ষুব্ধ হয়েছে। ‘প্রতিশোধ চাই!’ স্বর গুঞ্জরিত হতে শুরু করে দিল ইসরায়েলের আকাশে-বাতাসে।
শোকের আবহে ইসরায়েলের মাটিতে ফিরিয়ে আনা হল খেলোয়াড়দের শবদেহ। দেশের বড় বড় ব্যক্তিত্ব অন্তিম সংস্কারের স্থানে উপস্থিত হয়ে নিহতদের সম্মান জানালেন। কিন্তু সবাইকে অবাক করে একজন এলেন না।
কে বলুন তো?
দেশের প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ার।
কারণ কী ছিল?
গোল্ডা জানিয়েছিলেন যে তাঁর বোন মারা গেছেন। তাই তিনি উপস্থিত হতে অপারগ।
কিন্তু আসল ব্যাপার এটা ছিলই না। বাস্তবে গোল্ডা নিহত খেলোয়াড়দের পরিবারবর্গের মুখোমুখি হতে ভয় পাচ্ছিলেন। তিনি ভেবেছিলেন ওঁদের পরিজনদের চোখে চোখ রেখে কথা বলবেন কীভাবে?
যে গোল্ডা মেয়ারকে সমগ্র বিশ্ব চেনে ‘আয়রন লেডি’ হিসাবে, সেই মেয়ার ভয় পাচ্ছিলেন। জাস্ট ইমাজিন!
মেয়ার এই ঘটনার পর থেকে রাতের পর রাত ঘুমোতে পারেননি। চোখের সামনে ভেসে উঠছিল নিহতদের মা, বোন, সন্তানদের মুখ।
এই সময়েই মোসাদের চিফ জ্বি জামির এবং ইসরায়েলের মিলিটারি ইনটেলিজেন্স চিফ এহরোন ইয়ারিভ মেয়ারের সামনে একটি গুরুত্বপূর্ণ তথ্য পেশ করলেন। আর সেটা দেখে চমকে উঠলেন আয়রন লেডি। উনি বললেন, ‘ইজ ইট সো?’
জামির উত্তরে বলেছিলেন, ‘ইয়েস ম্যাডাম!’
কী ছিল সেই রিপোর্টে?
পেশ করা তথ্য বলছিল এই হত্যাকাণ্ড ঘটিয়েছিল পিএলও গ্রুপ থেকে সদ্য তৈরি হওয়া একটি সন্ত্রাসবাদী সংগঠন— ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন! নৃশংসতার মূর্ত প্রতীক।
একবার বুঝে নেওয়া যাক এই বর্বর সংগঠনটির জন্মের ইতিহাস। ১৯৬৭ সাল। আরব লিগ-ইসরায়েলের যুদ্ধ সবে শেষ হয়েছে। জর্ডনের কাছ থেকে ওয়েস্ট ব্যাংক ছিনিয়ে নিয়েছে ইসরায়েল। অসংখ্য ফিলিস্তিনি তখন বাস্তু হারিয়ে আশ্রয় নিল জর্ডনে। সেই সময়ে জর্ডনের শাসক ছিলেন কিং হুসেইন। তিনি ফিলিস্তিনিদের মুক্তি সংগ্রামকে শক্তি জোগালেন। ধীরে ধীরে ফিলিস্তিনিতে ভরে উঠতে লাগল জর্ডন। জর্ডনের পার্লামেন্টে প্রভাব বাড়াতে লাগল তারা। জর্ডনের নগরী আম্মান হয়ে উঠল ফিলিস্তিনিদের নয়া শক্তিকেন্দ্র।
ওদিকে ইসরায়েল আবার সক্রিয় হয়ে উঠল। লক্ষ্য একটাই, ফিলিস্তিনি পিএলও-কে ধ্বংস করতে হবে। তারা আক্রমণ চালাল। আর এদিকে জর্ডন এবং পিএলও সর্বশক্তি দিয়ে প্রতিহত করার চেষ্টা করল সেই আক্রমণ। এবারে গেম ড্র হয়ে গেল, দু’ পক্ষই দাবি করল তাদের জয় হয়েছে। আর এরপর থেকেই বদলাতে লাগল জর্ডনের রাজনৈতিক সমীকরণ। পিএলও-কে সাপোর্ট দিয়ে আসলে বাঘের পিঠে চড়ে বসেছিলেন কিং হুসেইন। বসে থাকতেও ভয় করে, আবার নামলেও বাঘের পেটে যাওয়ার ভয়। কট্টর ইসলামিক, জেহাদি মুখগুলো জর্ডনের শক্তি দখলের খেলায় নামল। তারা ফিলিস্তিনি আন্দোলনের জন্য ‘জেহাদ ট্যাক্স’ আদায় করতে শুরু করে দিয়েছিল। ছড়িয়ে পড়ছিল চরম অরাজকতা। একটা বিশৃঙ্খলা দিয়ে কখনো শৃঙ্খলাপরায়ণ পরিচালনা আশা করা যায় না। ক্রমশ বিচ্ছিন্নতাকামী শক্তিরা জর্ডনের রাজতন্ত্র নিয়েই প্রশ্ন তুলতে থাকে। তাদের স্লোগান ছিল— ‘জর্ডনের পথই তেল আভিভের পথ!’ অর্থাৎ জর্ডনের মসনদের দখল নেওয়ার মধ্যে দিয়েই ইসরায়েল দখলের চেষ্টার সূত্রপাত ঘটবে।
কিং হুসেইন পড়লেন সাংঘাতিক দোলাচলে। তিনি বুঝলেন, যদি কোনো পদক্ষেপ না নেওয়া হয়, তবে সেনাবাহিনী তাঁর প্রতি আস্থা হারাবে। সবকিছু নিয়ন্ত্রণের বাইরে চলে যাবে। এমনিতেই দিনে দিনে বাড়ছিল কিডন্যাপিং, সন্ত্রাসবাদী আক্রমণ, প্লেন ধ্বংস করে দেওয়ার মতো ঘটনা।
কিন্তু দোলাচলের কী ছিল?
হুসেইন ভয় পাচ্ছিলেন অন্য একটি কারণে, ফিলিস্তিনিদের ওপরে আক্রমণ করলে যদি মুসলিম দেশগুলো ক্ষেপে যায়! তাই তিনি আমেরিকার মাধ্যমে ইসরায়েলের কাছে সাহায্য চাইলেন। ইসরায়েল দেখল মুসলিম দেশগুলি আমাদের শত্রু এবং এক্ষেত্রে তারা নিজেরাই নিজেদের মধ্যে লড়ে মরছে। তারা জর্ডনকে আশ্বাস দিল, সীমান্ত থেকে সেনা সরিয়ে নিয়ে আপনারা দেশের আভ্যন্তরীণ সমস্যা মেটান, আমাদের তরফ থেকে কোনো হামলা করা হবে না।
১৯৭০ সালের পুরোভাগ থেকেই খণ্ডযুদ্ধ চলতে থাকে জর্ডনের মাটিতে। একদিকে কিং হুসেইনের সেনা, অপর দিকে পিএলও-এর ফিদায়ে বাহিনী। কিং হুসেইনকে হত্যার একাধিক চেষ্টা করা হয়। তিনি প্রাণে বাঁচলেও একটি আক্রমণে তাঁর স্ত্রী নিহত হন। হুসেইন ঘোষণা করে দিলেন, ‘জর্ডন ইসরায়েলের বন্ধু। ফিদায়ে ইসরায়েলের উদ্দেশে রকেট ছোড়ায় জর্ডন দুঃখিত! ইসরায়েলকে নিশানা করে কাউকে আক্রমণ করতে দেখলেই শ্যুট অ্যাট সাইট অর্ডার দেওয়া হয়েছে।’
১৯৭০ সালের ১৬ সেপ্টেম্বর থেকে শুরু হয়ে ক্র্যাকডাউন। ট্যাঙ্ক নিয়ে আক্রমণ শুরু করে জর্ডনের বাহিনী। ভয়ানক প্রতিরোধের মুখে পড়ে পিছু হটতে থাকে ফিলিস্তিনি মিলিশিয়া। জর্ডন থেকে উচ্ছেদ করা হয় ফিলিস্তিনিদের, তারা লেবাননের দিকে সরে যায় এবং এখানে একটা অদ্ভুত তথ্য হল পাকিস্তানের তৎকালীন আর্মি ব্রিগেডিয়ার জেনারেল জিয়াউল হক জর্ডন আর্মিকে ট্রেনিং দেওয়ার ব্যাপারে সাহায্য করেছিলেন। ইসরায়েল নিজের বায়ুসেনার শক্তি প্রদর্শন দ্বারা নিজের সমর্থন বুঝিয়ে দিয়েছিল। হাজার হাজার ফিলিস্তিনি মিলিট্যান্ট মারা পড়ল। তারা হারও মানল। ১৯৭০ সালের সেপ্টেম্বর মাসের এই ক্র্যাকডাউন ইতিহাসে ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর’ নামে কুখ্যাত।
আর এই ঐতিহাসিক ঘটনার পর পিএলও-এর মধ্যে থেকেই একটা শাখা জন্ম নিল, যার নাম ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন’। কেউ কেউ একটা দ্বিমত পোষণ করে বলেন, সরাসরি পিএলও থেকে নয় বরং ইয়াসের আরাফাতের ‘ফাতাহ্’ নামক জঙ্গি সংগঠনের ‘বি টিম’ ছিল ‘ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন’ বা ‘বিএসও’।
ইতিহাসটা খতিয়ে দেখার পর ফিরে আসা যাক ইসরায়েল এবং বিএসও-এর টম অ্যান্ড জেরি খেলায়।
আমরা ঠিক কোথায় ছিলাম যেন?
ও হ্যাঁ, গোল্ডা মেয়ার জানতে পারলেন যে, মিউনিখ ম্যাসাকারের পিছনে বিএসও-এর হাত আছে।
মেয়ার জিজ্ঞাসা করলেন, ‘এই বিএসও-ই কি জর্ডনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ওয়াসফি টালকে হত্যা করেছিল?’
মোসাদ চিফ বললেন, ‘ইয়েস ম্যাম, দ্যাট ভেরি বিএসও!’
মেয়ার বললেন, ‘সবই বুঝলাম। আমি মিউনিখ ম্যাসাকারের শোধ নিতে চাই। আমার এই পদ আমার দেশের মানুষের কাছে ঈশ্বরতুল্য। তারা আমার কাছে বিচার চাইছে। ঘুমের ওষুধ খেয়েও দু’ চোখের পাতা এক করতে পারছি না আমি। প্রতিশোধ নিন!’
জামির জানালেন, ‘এত দিনে বিএসও-এর মেম্বাররা বিশ্বের নানা প্রান্তে ছড়িয়ে পড়েছে। কেউ আন্ডারকভার হিসাবে কাজ করছে। এদের ধরা কঠিন, কিন্তু অসম্ভব নয়। আমরা পারব। শুধু আপনার সম্মতি চাই।’
গোল্ডা চোখ বুজে সামান্য ভাবলেন। তারপর কাঁপা কাঁপা ঠোঁটে মোসাদ চিফকে নির্দেশ দিলেন, ‘সেন্ড ইয়োর বয়েজ!’
এই অপারেশনের নাম দেওয়া হল ‘র্যাথ অব গড’ অর্থাৎ, ‘ঈশ্বরের প্রকোপ’। আর দায়িত্ব দেওয়া হল মোসাদের কিডন টিমের মাইক হারারিকে। একটি উচ্চ পর্যায়ের কমিটি গঠন করা হল— ‘কমিটি এক্স’। চার জন সদস্যের কমিটি— গোল্ডা মেয়ার, জ্বি জামির, এহরোন ইয়ারিভ এবং ইসরায়েলের তৎকালীন প্রতিরক্ষা মন্ত্রী মোশে দয়ান।
একেবারে পরিকল্পনা করে এক একজনকে টার্গেট করা হল। একটি হত্যার জন্য তিনটি ইউনিট ফিক্স করল কমিটি।
বলা হল, প্রথম ইউনিটে ছ’ জন সদস্য থাকবে। তাদের কাজ কী হবে? টার্গেটকে অন্তিমবার যে জায়গায় দেখা গেছে সেখানে গিয়ে পৌঁছানো। তারপর তাকে ফলো করে এটা সুনিশ্চিত করতে হবে যে, সে-ই ওই ব্যক্তি যাকে মোসাদ খুঁজছে। টার্গেটকে দিনরাত অনুসরণ করে তার ছবি তোলা হবে, সে কোথায় যায়, কার সঙ্গে মেশে, কারা তার বন্ধু, কোন বারে গিয়ে মদ খায়, কোন রেস্তোরাঁ তার প্রিয়— এসবের একটা লিস্ট বানানো দরকার। তারপর এসব তথ্য চলে যাবে মোসাদ হেডকোয়ার্টার্সে। এসবের ভিত্তিতেই মোসাদ সিদ্ধান্ত নেবে যে, টার্গেটকে প্রাণে মারা হবে নাকি হবে না।
দ্বিতীয় ইউনিটে থাকবে মাত্র দুজন লোক। তাদের কাজ হবে অপারেশন যে শহরে হবে, সেখানে গাড়ির বন্দোবস্ত করা, বাড়ি ভাড়া নেওয়া, হোটেল বুকিং করা, জাল আইডি প্রুফ ইত্যাদির অ্যারেঞ্জমেন্ট।
তিন থেকে চার জন লোক নিয়ে তৈরি হবে একটা কমিউনিকেশন ইউনিট বা থার্ড ইউনিট। এদের কাজ হবে অপারেশনের জায়গা থেকে মোসাদের তেল আভিভের হেড কোয়ার্টার্সে যোগাযোগের পুরো ব্যাপারটা দেখা।
ফার্স্ট ইউনিট অপারেশনের এক-দু’ সপ্তাহ আগে সেই দেশ ছেড়ে বেরিয়ে আসবে। তারপর সেকেন্ড ইউনিট ক্লিনিং-এর কাজ করবে। মানে, ওই শহরে মোসাদের উপস্থিতির সমস্ত প্রমাণ লোপাট করাই হবে তাদের কাজ এবং এই সব কিছু ঠিকঠাক চললে অপারেশনের জন্য নির্ধারিত দিনের এক থেকে দু’ দিন আগে সেখানে গিয়ে উপস্থিত হবে কিডন টিম। তারাও কাজ সেরে দু-চার ঘণ্টার মধ্যে দেশ থেকে বেরিয়ে আসবে।
এত কিছুর পরিকল্পনা করা হলেও ভিন দেশে গিয়ে অপারেশন চালানো যথেষ্ট কঠিন কাজ। তার ওপরে বিএসও এক নৃশংস সংগঠন। এদের বর্বরতার একটা ছোট্ট ঘটনা বলি বন্ধুরা, জর্ডনের প্রাক্তন প্রধানমন্ত্রী ওয়াসফি টালকে হত্যা করার পর যখন তাঁর দেহ থেকে রক্ত গড়িয়ে মেঝেতে পড়েছিল, তখন একজন হত্যাকারী সেই রক্ত জিভ দিয়ে চেটেছিল। অনুমান করুন ব্যাপারটা।
সব রকমের ঝুঁকি নিয়েই আরম্ভ হয়ে গেল অপারেশন র্যাথ অব গড। প্রথম অপারেশন পয়েন্ট হিসাবে বেছে নেওয়া হল রোম শহরকে। টার্গেটের নাম ওয়াএল জোয়াইটার। সে রোমে লিবিয়ান দূতাবাসে অনুবাদকের কাজ করত। পারদর্শী অনুবাদক। তার পরিচিতবর্গের মধ্যে তার যা ভাবমূর্তি ছিল, তাতে সে সন্ত্রাসবাদী হতে পারে এ কথা কেউ বিশ্বাস করত না। বছর আটত্রিশের এই ফিলিস্তিনির আচার-আচরণও ছিল দারুণ নম্র, ভদ্র।
জোয়াইটার একটা ছোট্ট অ্যাপার্টমেন্টে থাকত। একদম সরল জীবনযাপন। মাসিক ১০০ লিবিয়ান দিনারে এমন বেশবাসই কাম্য। বন্ধুমহলে সে শান্তিপ্রিয় ব্যক্তি বলেই পরিচিত ছিল। সকলেই জানতে যে, জোয়াইটার সন্ত্রাস, হিংসা ইত্যাদিকে ঘৃণা করে।
কিন্তু যে কথাটা কেউ জানত না তা হল এই আপাতনিরীহ দর্শন জোয়াইটার সন্ত্রাসবাদী সংগঠন বিএসও-এর আন্ডারকভার এজেন্ট হিসাবে রোমে কাজ করছিল।
জোয়াইটারের কাজের একটা ছোট নমুনা দেখা যাক। সে রোমে ঘুরতে আসা দুই ব্রিটিশ তরুণীকে বোকা বানিয়ে একটি স্যুইস বিমানে বিস্ফোরণের ছক কষে। প্রথমে সে দুজন সুদর্শন ফিলিস্তিনি যুবকের প্রেমে ওই দুই তরুণীকে ফাঁসায়। তাদের সম্পর্ক বিছানা অবধি গড়ায়। ওই দুই ব্রিটিশ তরুণীকে এবার বলা হয় ইসরায়েলে পরিচিত এক মহিলার হাতে একটি টেপ রেকর্ডার পৌঁছে দিতে হবে। আসলে ওই টেপ রেকর্ডারের মধ্যে বোমা ছিল এবং সেখানে এমন একটি প্রযুক্তির ব্যবহার করা হয়েছিল যে, প্লেন একটি নির্দিষ্ট উচ্চতায় পৌঁছালেই ব্লাস্ট ঘটবে।
কিন্তু ধরা পড়ে গেল ওই দুই তরুণী এবং তাদের জিজ্ঞাসাবাদের পর সব সন্দেহের তির লক্ষ্য করতে থাকল রোমের এক সুদর্শন ফিলিস্তিনি যুবক, জোয়াইটারকে
মোসাদ এই সূত্রকে কাজে লাগাল। রোমে অবস্থিত লিবিয়ান এমব্যাসির বাইরে এরপর ঘন ঘন দেখা যেতে লাগল এক প্রেমিক যুগলকে। তারা সারাদিন ধরে ওখানে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে একে অপরের ছবি তুলছিল। আসলে তারা একে অপরের ছবি তোলার নাটক করছিল মাত্র, ছবি তোলা হচ্ছিল জোয়াইটারের। জোয়াইটার যখনই এমব্যাসিতে ঢুকত বা বেরোত, তখনই তার ছবি তুলে নেওয়া হত।
ইতিমধ্যে ইসরায়েল থেকে মোসাদের আরও কিছু নতুন মুখ ট্যুরিস্ট হিসাবে এসে ভিড় করল রোমে। রোমে এসে হোটেল, গাড়ি সব ভাড়া নিল। ১৯৭২ সালের ১৬ অক্টোবর শুরু হয়ে গেল তাদের অ্যাকশন। সারাদিনের কাজ শেষ করে জোয়াইটার নিজের অ্যাপার্টমেন্টে ফিরল। লিফট ইউজ করতে গেলে একটা নির্দিষ্ট স্লটে কয়েন ফেলতে হয়। রোজদিনের মতো সেই কাজটাই করল সে। সে খেয়াল করেনি অ্যাপার্টমেন্টের প্রবেশপথের মুখটা অন্য দিনের তুলনায় একটু বেশিই অন্ধকার। থার্ড ফ্লোর থেকে পিয়ানোর বিষাদ সুর ভেসে আসছিল। আর তখনই অন্ধকার থেকে দুজন আততায়ী বেরিয়ে এসে নিজেদের ব্যারেটা পিস্তল থেকে পর পর ১২টা গুলি দেগে দেয় জোয়াইটারের বুকে। কিন্তু সাইলেন্সার থাকায় কোনো শব্দ হল না, কেউ টের পেল না। নিজেদের অপারেশন সেরে তারা পাশেই পার্কিংয়ে রাখা একটা গড়িতে উঠে মিলিয়ে গেল অন্ধকারে। আর কয়েক ঘণ্টার মধ্যেই ফেরার হয়ে গেল রোম থেকেও। অপারেশন সাকসেসফুল!
নেক্সট স্টপ প্যারিস। ১৭৫ রুয়ে অ্যালেশিয়া স্ট্রিট। এই ঠিকানাতেই থাকে টার্গেট। টার্গেটের অ্যাপার্টমেন্টে ফোন বাজছিল। সে নিজেই গিয়ে রিসিভার তুলে নিল। ফোনের অন্য দিকে থাকা ব্যক্তি জিজ্ঞাসা করল, ‘ডক্টর মাহমুদ হামশারি?’
উত্তর গেল, ‘ইয়েস, স্পিকিং… ‘
ওদিক থেকে আর কোনো কথা ভেসে এল না। এদিকে হামশারি বললেন, ‘হ্যালো, হ্যালো…
প্রবল একটা বিস্ফোরণ ঘটল হামশারির ঘরে।
একবার দেখে নেওয়া যাক কে এই হামশারি। প্যারিসে অধ্যাপনার কাজে নিযুক্ত হামশারি বুদ্ধিজীবী মহলে বেশ পরিচিত মুখ ছিল। হামশারি ছিল পিএলও-এর প্রতিনিধি। ফরাসি মিডিয়াতে হামশারির ইমেজ বেশ সাফ ছিল। কিন্তু যে খবরগুলো কেউ জানত না, সেগুলোই জানত মোসাদ। হামশারি বেন- গুরিয়নকে গুপ্তহত্যার একটা ফেইলড অ্যাটেম্পটের সঙ্গে যুক্ত ছিল। ১৯৭০ সালে একটি স্যুইস বিমানের বিস্ফোরণে ধ্বংস হওয়ার ঘটনাতেও হামশারির যোগ পাওয়া যায়।
খুব সুপরিকল্পিত ছকে ফেলে হামশারির অ্যাপার্টমেন্টে প্রবেশ করে মোসাদ টিম। একজন সদস্য এক ইতালিয়ান সাংবাদিকের ছদ্মবেশে তার সাক্ষাৎকার নেওয়ার জন্য তাকে একটি কাফেতে দেখা করতে বলে। হামশারি নিজের বাড়ি থেকে বেরোনো মাত্রই তার অ্যাপার্টমেন্টে টেলিফোনে একটি বিশেষ বোমা লাগানো হয়। পনেরো মিনিটের মধ্যে কাজ সেরে বেরিয়ে মোসাদের টিম। আর তার পরদিনই টার্গেটের নাম জিজ্ঞাসা করে নিয়ে একটি নির্দিষ্ট সিগন্যালের মাধ্যমে বিস্ফোরণ ঘটানো হয় ওই টেলিফোনে। ব্লাস্টে হামশারির একটা পা উড়ে যায়। ভয়ানক আহত হামশারি রক্তক্ষরণে মারা যায়।
এভাবেই চলতে থাকে অপারেশন র্যাথ অব গড। ইসরায়েলে সরকার বদলেছে, প্রাইম মিনিস্টার পালটেছে, এসেছে নতুন মোসাদ চিফ কিন্তু ঈশ্বরের প্রকোপ থামেনি। এই অপারেশনের কয়েকটা নতুন দিক ছিল। যেমন ইসরায়েল এর আগে বা পরে যত অপারেশন করেছে তার খবর স্বীকারই করতে চাইত না। কিন্তু এক্ষেত্রে ইসরায়েল বুক ঠুকে স্বীকার করেছে। দুনিয়া জানুক এটাই চাইত ইসরায়েল। আসলে তারা বোঝাতে চাইছিল আমাদের দিকে ইট ছুড়লে, আমরা পাথর ছুড়ে তার জবাব দেব। এমনকী এই অপারেশনের প্রতিটা টার্গেটেড অ্যাসাসিনেশনের কয়েক ঘণ্টা আগে মোসাদ টার্গেটের পরিবারবর্গের কাছে ফুল আর সমবেদনাপত্র পাঠাত, যাতে লেখা থাকত— আ রিমাইন্ডার উই ডু নট ফরগেট অর ফরগিভ’, আমরা ভুলিনি, ক্ষমাও করিনি।
আর ইসরায়েল ক্ষমা করে না বলেই ছাড় পায়নি আবদ আল-হির। আবদ আল-হির ছিল সাইপ্রাসে বিএসও-এর মাথা। সোভিয়েত ইউনিয়নে সন্ত্রাসবাদীদের নেটওয়ার্ক চালানোটাও ছিল হিরের দায়িত্ব। হিরের নামে রেড পেপার জারি করল মোসাদ। আর মোসাদ তাকে হত্যার অপারেশন চালানোর আগে সাহায্য নিল রাশিয়ান কেজিবি-এর।
১৯৭৩ সালের ২৪ জানুয়ারি। সোমবার। সকাল আটটার সময় নিজের হোটেল থেকে বেরিয়ে গেল হির। তাকে গাড়িতে নিয়ে যাওয়া ব্যক্তিদের একজন ছিল কেজিবি এজেন্ট। অপরজনকে দেখতে রাশিয়ানদের মতোই লাগছিল, তবে পরিচয় অজানাই রয়ে গেছে। এটুকু নিশ্চিত ছিল যে, সেই ব্যক্তি আরব বা সাইপ্রিয়ট নয়। হিরকে সারাদিন তার হোটেল থেকে দূরে সরিয়ে নিয়ে গিয়ে একটি জায়গায় ব্যস্ত রাখার প্লট সফল হয়। আর ততক্ষণে কাজ সারা হয়ে গিয়েছিল। হিরের পাশের ঘরেই হানিমুনে আসা দুই ইসরায়েলি টুরিস্ট নিজেদের আসল রূপ ধারণ করল। হোটেলের ক্লিনিং স্টাফ কাজ সেরে যাওয়ার পরই হিরের ঘরে ঢুকে পড়ে দুই এজেন্ট। পূর্ব-পরিকল্পিত ভাবে একটা বোমা প্লান্ট করা হয় হিরের শয্যার ম্যাট্রেসের স্প্রিং-এর নীচে। রিমোট কন্ট্রোলড প্রেসার বম্ব। একবার শোওয়ার পর বোমা ফাংশনাল হয়ে গেলে বিছানা ত্যাগ করতে গেলে মৃত্যু অবধারিত। তারপর কেবল বেড ল্যাম্পটাকে ঠিক রেখে ঘরের সমস্ত লাইটের কানেকশন খারাপ করে দেওয়া হয়।
ঠিক সময়ে হিরকে হোটেলে ফিরিয়ে আনা হয়। হিরের পাশের ঘরের দুই এজেন্ট তখন হোটেলের বাইরে একটা গাড়িতে অপেক্ষারত। সময় আন্দাজ করে তাদের মধ্যে অ্যাভনের নামে এক এজেন্ট রিমোটের বাটন প্রেস করে। কিন্তু কিছু হয় না। সে অনুমান করে যে, সম্ভবত এখনও বোমার ওপরে শোয়নি হির। হয়তো বিছানার একধারে বসে মোজা খুলছে। খানিক পরে আবার বাটন প্রেস করে আবারও কিছু হয় না। ধৈর্য হারাতে থাকে সে ও তার হিট টিম। আবার রিমোটের বোতাম টেপে। আর এবার একটা সাংঘাতিক বিস্ফোরণে কেঁপে ওঠে হোটেল চত্বর। হির নিহত হয়।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশনও যে ঘাসে মুখ দিয়ে চলছিল না। তারা বুঝে গিয়েছিল যে ইসরায়েল তথা মোসাদ তাদের পিছনে উঠে-পড়ে লেগেছে। তারাও পালটা আঘাত করার জন্য প্রস্তুত থাকল, আর সময় ও সুযোগ পেতেই প্রত্যাঘাতও হানল।
২৬ জানুয়ারি, ১৯৭৩। মোশে হানান ইশায়ি নামে একজন ইসরায়েলি যুবক মাদ্রিদের একটা পাবে নিজের বন্ধুর সঙ্গে দেখা করতে এসেছে। দেখাসাক্ষাৎ হল, ছেলেটি পাব থেকে বেরিয়েও এল। আর তখনই তার সামনে এসে দাঁড়াল দুজন অজ্ঞাতপরিচয় ব্যক্তি। ইশায়ির সঙ্গে থাকা বন্ধুটি ছুটে পালাল। আর সঙ্গে সঙ্গে আগত ওই দুই ব্যক্তি ইশায়িকে লক্ষ্য করে কয়েকটা বুলেট দেগে দিল। মুহূর্তে নিহত হল ইশায়ি।
মিডিয়া রিপোর্টের কল্যাণে এই গল্পটা সবার জানা। যে কথাটা চমকে দেওয়ার মতো তা হল ইশায়ির আসল নাম ছিল বারুচ কোহেন। সে মোসাদের একজন এজেন্ট ছিল। মাদ্রিদের ফিলিস্তিনিদের মধ্যে তার বিশেষ পরিচিতি গড়ে উঠেছিল। তার কাজ ছিল সেখান থেকে খবর সংগ্রহ করা। যে বন্ধুর সঙ্গে সে পাবে দেখা করতে এসেছিল, সে আসলে একজন ফিলিস্তিনি এবং সে-ই কোহেনকে খবর দিত। কিন্তু সেই বন্ধুই ডাবলক্রস করেছিল কোহেনের সঙ্গে। আর ফলাফল সামনে পড়েছিল— কোহেনের লাশ হয়ে। টম অ্যান্ড জেরির লুকোচুরিতে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন মোসাদকে এক দানে মাত দিল। তারা হিরকে হত্যার প্রতিশোধ নিল আসলে।
এর পরপরই য়াদক অফির নামক এক মোসাদ এজেন্টকে ব্রাসেলসের একটা কাফেতে হত্যা করে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশন। একটা লেটার বম্বের মাধ্যমে হত্যা করা হয় লন্ডনের ইসরায়েলি দূতাবাসের অ্যাটাশে ডক্টর আমিকেও।
ইসরায়েলের চালে ভুল হচ্ছিল। আর নিজেদের ভুল ঠিক করার ব্যাপারে তাদের জুড়ি মেলা ভার। অ্যাটাক ইজ দ্য বেস্ট ডিফেন্স— এই নীতিটাই মানে তারা। হিরের উত্তরসূরী হিসাবে সাইপ্রাসে নিযুক্ত এজেন্টকে হত্যা করে তারা শোধ তুলল এবং সেটাও সেই এজেন্টের নিয়োগের মাত্র ২৪ ঘণ্টার মধ্যে করা হয়েছিল।
এরপর বিএসও ক্ষিপ্ত হয়ে ওঠে। আরাফাত কখনোই বিএসও-এর সঙ্গে নিজের প্রত্যক্ষ সম্পর্ক সামনে না আনলেও তাঁর হয়ে অপারেট করত আলি হাসান সালামেহ। এই সালামেহই ছিল মিউনিখ ম্যাসাকারের মাস্টারমাইন্ড। আসব তার কথায়।
আগে চিনে নেওয়া যাক কে এই সালামেহ?
আলি হাসান সালামেহ ছিল ফিলিস্তিনের ফোর্স ১৭-এর প্রধান মুখ। আরাফাতের ডান হাত। সালামেহকে নিয়ে কিছু এমন কথা চলত যা তার জীবদ্দশাতেই তাঁকে কিংবদন্তীতে পরিণত করেছিল। তার জীবনযাত্রা দেখলে আজকের বিজয় মাল্যরাও লজ্জা পেয়ে যাবেন আর কি! এমনই রঙিন ছিল প্লে- বয় সালামেহর জীবন।
সালামেহ ধনী পরিবারের সন্তান ছিল। তার পিতার নাম ছিল শায়েখ হাসান সালামেহ এবং শায়েখ হাসান সালামেহ ছিল ১৯৪৮ সালে ইসরায়েলের বিরুদ্ধে যুদ্ধে নিহত একজন ফিলিস্তিনি সৈনিক। সুতরাং ইহুদি-বিদ্বেষটা ছিল তার রক্তে।
একের পর এক চাল ভেস্তে যাওয়া, নিজেদের সংগঠনের লোকের মৃত্যুতে ক্ষুব্ধ আরাফাত এবং সালামেহ একটা বড় ধরনের প্রতিশোধের পরিকল্পনা করছিল। একটি হাইজ্যাকড বিমানকে বিস্ফোরকে বোঝাই করে তেল আভিভে নিয়ে গিয়ে ফেলার ছক কষে সালামেহ। দরকার ছিল একজন আত্মঘাতী পাইলটের। এটা ৯/১১-এরও অনেক আগের ঘটনা।
এই সময় প্যারিসের মোসাদ এজেন্টদের কাছে এক ব্যক্তির গতিবিধি বেশ সন্দেহজনক ঠেকে। সেই লোকের ফটো মোসাদ হেডকোয়ার্টারে পাঠানো হয়। নাম— বসিল আল-খুবায়শি। পেশায় আইনজীবি তথা বেইরুটে আমেরিকান ইউনিভার্সিটির অধ্যাপক। সুতরাং, মান্যগণ্য ব্যক্তি। মান্যগণ্য হলে হবেটা কী, জোয়াইটার ও হামশারির মতো ইনিও একজন বিপজ্জনক মানুষ। অন্তত তার রেকর্ড তো তাই বলছিল। বিএসও-এর একজন প্রবীণ সদস্য।
১৯৫৬ সালে খুবায়শি ইরাকের শাসক কিং ফয়জলকে হত্যা করার উদ্দেশ্যে তার কনভয়ের পথে বোমা রেখেছিল। কিন্তু বোমাটা আগেই ফেটে যাওয়ায় তার পরিকল্পনা ব্যর্থ হয়। খুবায়শি লেবানন হয়ে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পালায়।
খুবায়শি ইসরায়েলি প্রধানমন্ত্রী গোল্ডা মেয়ারকে দু’ বার হত্যার চেষ্টা করে। একবার মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে মেয়ারের সফরের সময় এবং পরের বার প্যারিসে। দু’ বারই ব্যর্থ হয় তার প্রয়াস।
খুবায়শি এরপরে ‘পপুলার ফ্রন্ট ফর লিবারেশন অফ প্যালেস্টাইন’ বা পপুলার ফ্রন্টে যোগ দেয়, যার প্রতিষ্ঠাতা ছিল জর্জ হাবাশ। এটা ছিল পিএলও- এরই একটা অংশ। ১৯৭২ সালের লড এয়ারপোর্টে আরব ও জাপানি সন্ত্রাসবাদীদের হামলাতেও তার হাত ছিল। ২৬ জন মারা গিয়েছিল সেদিন 1 এরপর খুবায়শি ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপে যোগ দেয়।
এ হেন আল খুবায়শিকে প্যারিসে দেখার পরই সন্দেহ হয় নিশ্চয়ই সে আত্মঘাতী হামলার ছক কষছে। ওই সময়ে খুবায়শির ঠিকানা ছিল রুডি আরকেডসের ছোট্ট একটি হোটেল।
মোসাদ এজেন্টরাও তক্কে তক্কে ছিল। এপ্রিলের ৬ তারিখ, ১৯৭৩ সাল। খুবায়শি ক্যাফে ডি লা পে থেকে রাতের খাবার খেয়ে হেঁটে হোটেলে ফিরছিল। চার জন মোসাদ এজেন্ট অপেক্ষা করছিল গাড়িতে বসে। কুবায়েশিকে দেখতে পাওয়া মাত্র দুজন তার দিকে এগিয়ে যায়। বন্দুক তাক করাই ছিল। ঠিক তখনই আরেকটা গাড়ি আল-খুবায়শির পাশে এসে দাঁড়ায়। আর গাড়ির ভেতর থেকে এক সুন্দরী মহিলা খুবায়শির সঙ্গে কিছুক্ষণ কথা বললেন। এজেন্টরা কিছু করে ওঠার আগেই খুবায়শি সেই মহিলার সঙ্গে গাড়িতে উঠে চলে গেল। তারপর অবশ্য এজেন্টরা বুঝতে পারল যে, ওই মহিলা ছিল একজন প্রস্টিটিউট। শিকার হাতের কাছে এসেও ফস্কে যাওয়ায় এজেন্টদের হাত কামড়ানো ছাড়া অন্য কোনো উপায় তখন ছিল না।
মোসাদ টিমের লিডার নির্দেশ দিলেন, ‘অপেক্ষা করো, ও ব্যাটা তো কাজ সেরে আবার ফিরবেই।’ হলও তাই। প্রায় কুড়ি মিনিট পর গাড়িটাকে আবার ফিরতে দেখা গেল। খুবায়শি গাড়ি থেকে নেমে ওই সুন্দরীকে বিদায় জানিয়ে হাঁটা দিল হোটেলের পথে। আর ঠিক তখনই অন্ধকার থেকে দুজন লোক তার পথ আগলে দাঁড়াল।
খুবায়শিও এক জিনিস! সে ততক্ষণে আঁচ করে ফেলেছে যে, কী হতে চলেছে। উত্তেজিত হয়ে সে চিৎকার করতে শুরু করল, ‘না, না… আমাকে মেরো না!’
ন’টা বুলেট তার শরীরে বিদ্ধ করে মোসাদ এজেন্টরা সেখান থেকে বিদায় নিল।
সালামেহর কেশাগ্রও তখন স্পর্শ করতে পারেনি মোসাদ। সে ছিল বেইরুট হেডকোয়ার্টারে। সেখানে বসেই সালামেহ চুপচাপ কাজ চালাচ্ছিল। তার নির্দেশে ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের টিম থাইল্যান্ডে ইসরায়েলি এমব্যাসি কবজা করে। কিন্তু থাই প্রশাসন ও মিশরীয় রাষ্ট্রদূতের চাপে তাদেরকে পিছু হটতে হয়।
কিন্তু দমে না সালামেহ। তারপরের অপারেশনটা আরও মারাত্মক আকার নিয়ে সামনে এল। সুদানের রাজধানী খার্তুমে তারা সৌদি এমব্যাসিতে হামলা চালায়। সেখানে তখন একজন ইউরোপিয়ান দূতের ফেয়ারওয়েল পার্টি চলছিল। ইউএস রাষ্ট্রদূত, ইউএস মিশনের ডেপুটি চিফ এবং বেলজিয়ামের অ্যাম্বাসডরকে নির্মমভাবে হত্যা করে সালামেহরা। আততায়ীদের গ্রেপ্তার করা হয় বটে কিন্তু আশ্চর্যজনকভাবে তাদের ছেড়েও দেয় সুদানের সরকার।
আর নয়! ইসরায়েল এবার ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর অর্গানাইজেশনকে খতম করার জন্য উঠে-পড়ে লাগল। নতুন করে বর্ষিত হল ঈশ্বরের প্রকোপ। একটা নতুন নামও উঠে এল— ‘অপারেশন স্প্রিং অফ ইয়ুথ’।
এপ্রিলের প্রথমেই বেইরুটে বিভিন্ন দিক থেকে মোসাদ এজেন্টরা এসে পৌঁছতে থাকল। অবশ্যই পর্যটকের বেশে। মোট ছ’ জন। এজেন্টরা সবাই শহরের রাস্তাঘাট ঘুরে ঘুরে দেখে নিল।
৯ এপ্রিল, ১৯৭৩। ন’টা মিসাইল বোট ও পেট্রল ভেসেল ইসরায়েলের সমুদ্র থেকে আরও গভীর সমুদ্রের দিকে চলে গেল। এই বোটগুলিতে রয়েছে সেরি কম্যান্ডো সদস্যরা। তাদের কাছে রয়েছে চার জনের ছবি। প্রথম জন আবু য়ুসুফ, ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের সুপ্রিম কমান্ডার। দ্বিতীয় জন কামাল আদওয়ান, ফাতাহ্-এর টপ অপারেশন কমান্ডার। তৃতীয় জন ফাতাহ মূল মুখপাত্র। আর চতুর্থ ব্যক্তির নাম ছিল আলি হাসান সালামেহ। প্রথম তিন জনের ঠিকানা থাকলেও চতুর্থ জন কোথায় আছে কেউ জানত না।
রাতের অন্ধকারে রাবারের ডিঙিগুলো বেইরুটের নির্জন সমুদ্রতটে ভিড়ল। তাদের জন্য অপেক্ষা করছিল ছ’টা গাড়ি। গাড়িগুলো আগে থেকেই ভাড়া করে রেখেছিল পর্যটকের বেশে আসা মোসাদ এজেন্টরা। কমান্ডোরা যে যার পূর্বনির্ধারিত গাড়িতে উঠে বসল। মুহূর্তের মধ্যে গাড়িগুলো অন্ধকারে মিলিয়ে গেল। তবে ভিন্ন ভিন্ন দিকে ছড়িয়ে পড়ল গাড়িগুলো। কয়েক জন গেল পপুলার ফ্রন্টের হেডকোয়ার্টারের দিকে, আর বাকিরা গেল ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের লিডারদের বাসস্থানের দিকে।
পপুলার ফ্রন্টের হেডকোয়ার্টারে পৌঁছতেই প্রতিরোধের মুখে পড়ল মোসাদ এজেন্ট ও কম্যান্ডোরা। সেখানকার গার্ডরা গুলি চালাতে আরম্ভ করে দিল।
দুজন ইসরায়েলি কমান্ডো মারাও পড়ল। কিন্তু শেষ পর্যন্ত তারা হেডকোয়ার্টারে প্রবেশ করতে সফল হয় এবং বিস্ফোরক লাগিয়ে তারা সেখান থেকে বেরিয়েও আসে। প্রচণ্ড একটা বিস্ফোরণে ধ্বসে পড়ল বিল্ডিং।
সায়েরাত মটকলের কমান্ডোরা রু ভারদুনের বিল্ডিংয়ে হামলা চালাল। কামাল আদওয়ান, কামাল নাসের ও আবু য়ুসুফের অ্যাপার্টমেন্টে প্রায় একই সময়ে ঢুকে পড়ল কমান্ডোরা। একই বিল্ডিংয়ের বিভিন্ন তলায় ছিল তাদের অ্যাপার্টমেন্ট। কিছু বুঝে ওঠার আগেই তাদের গুলি করে হত্যা করল কমান্ডোরা।
এই অ্যাপার্টমেন্টগুলো থেকে অনেক গুরুত্বপূর্ণ নথিপত্র মিলল। তারপর দ্রুত গতিতে গাড়িতে করে সমুদ্রতটের দিকে চলল টিম, যেখানে তাদের জন্য ডিঙিগুলো অপেক্ষা করছিল। অপারেশন সাকসেসফুল। পপুলার ফ্রন্টের হেডকোয়ার্টার নিশ্চিহ্ন হয়ে গিয়েছিল। ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের তিন জন গুরুত্বপূর্ণ সদস্যকে খতম করে দিতে পেরেছিল ইসরায়েলিরা।
কিন্তু সেদিন সালামেহকে মারতে পারেনি ইসরায়েলি কম্যান্ডোরা। আসলে তারা হদিশই পায়নি সালামেহর। জানতেও পারেনি যে, রু ভার্দুনের সেই অ্যাপার্টমেন্ট থেকে মাত্র ৫০ গজ দূরের অপর একটি অ্যাপার্টমেন্টে নিশ্চিন্তে ঘুমোচ্ছিল সালামেহ।
পরের দিন আবু য়ুসুফের জায়গায় ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের প্রধান হল আলি হাসান সালামেহ।
১৯৭১ সালের এপ্রিল মাসে দুজন সুন্দরী ফরাসি ভদ্রমহিলা লড এয়ারপোর্টে জাল পাসপোর্ট ব্যবহার করে ইসরায়েলে ঢুকতে গিয়ে গ্রেপ্তার হন। তল্লাশি করে তাদের কাছ থেকে প্রচুর পরিমাণে বিস্ফোরক পাউডার মেলে। তাদের জিজ্ঞাসাবাদ করে এই ঘটনার মূল চক্রী মোহাম্মদ বাউদিয়ার খোঁজ মেলে। বাউদিয়া একজন আলজেরিয়ান। সে প্যারিসের একটা থিয়েটারের ডিরেক্টর হিসাবে কাজ করত এবং নিজেও ছিল একজন অভিনেতা। তার বাস্তব জীবনের অভিনয়ও এবার ধরা পড়ে গিয়েছিল মোসাদের কাছে।
পরের মাসেই তার খোঁজে মোসাদ এজেন্টদের পাঠানো হয়। অভিনেতা হওয়ার সুবাদে ছদ্মবেশ ধরার কায়দা ছিল তার সহজাত। মোসাদের বেইরুট অভিযানের পর সে আরও সতর্ক হয়ে গিয়েছিল। একবার তো তার পিছু নিয়ে তার প্রেমিকার বাড়ির সামনে অবধি পৌঁছে যায় এজেন্টরা। কিন্তু বাউদিয়া যেন জাদুকর। ভেলকি দেখাল। সেখান থেকে সে একজন মহিলার ছদ্মবেশে বেরিয়ে আসে। এভাবে টম অ্যান্ড জেরির খেলা চলতে থাকে। শেষমেষ ২৯ জুন তার গাড়িতে রাখা বোমা বিস্ফোরণ ঘটিয়ে তাকে মারে মোসাদ।
বাউদিয়াকে মারার পরই খবর আসে যে আলি হাসান সালামেহ নরওয়ের একটা ছোট শহর লিলেহ্যামারে আছে। কয়েক দিনের মধ্যেই মাইক হ্যারারির নেতৃত্বে একটা কিডন হিট টিমকে পাঠানো হয় লিলেহ্যামারে।
এজেন্টরা শহরের একটা হোটেলের সুইমিং পুলের ধারে সালামেহকে দেখতে পায়। ফটোর সঙ্গে মিলিয়ে দেখে তারা নিশ্চিত হয় যে এ-ই সালামেহ। কোনো সন্দেহের অবকাশই ছিল না। কিন্তু একজন এজেন্টের খানিকটা খটকা লাগায় সে বলল, ‘লোকটাকে আমি নরওয়েবাসীদের ভাষায় কথা বলতে শুনেছি। সালামেহ তো এই ভাষা জানে না। তাহলে…’ তাকে কথা শেষ করতে দেয় না বাকিরা। তারা সালামেহকে সব জায়গায় ছায়ার মতো অনুসরণ করতে থাকে। সালামেহকে একজন ফরাসি মহিলার সঙ্গেও কথা বলতে দেখা যায়। তিনি আবার গর্ভবতী ছিলেন।
এবার সালামেহকে মারার প্ল্যান ঠিক করা হল। ইসরায়েল থেকে আরও এজেন্ট এল। মোসাদের প্রধান জ্বি জামিরও এলেন। প্ল্যান এক্সিকিউট করার দায়িত্ব দেওয়া হল জোনাথন ইনগ্লেবি, রল্ফ বেয়ার ও জেরার্ড এমিলে লাফন্ড-কে। এজেন্টদের জন্য হোটেল ভাড়া করা হল। ব্যবস্থা হল ভাড়া গাড়িরও।
২৯ জুলাই, ১৯৭৩। সালামেহ নিজের সঙ্গিনীকে নিয়ে একটা সিনেমা দেখে ফিরছিল। বাস থেকে নেমে একটা রাস্তা ধরে হাঁটছিল ওই যুগল। আচমকা একটা সাদা গাড়ি পাশে ব্রেক করে দাঁড়াল। সঙ্গে সঙ্গে গাড়ির দরজা খুলে বন্দুক হাতে কয়েক জন বেরিয়ে এল এবং নিমেষে তারা গুলিতে ঝাঁঝরা করে দিল সালামেহর শরীর।
অপারেশন সফল। এবার এজেন্টদেরকে নরওয়ে ছাড়ার নির্দেশ দেওয়া হল। কিন্তু বিপত্তি শুরু হল এরপর থেকেই। শুটিং প্লেসের কাছাকাছি একজন ভদ্রমহিলা গাড়িটাকে দেখতে পেয়েছিলেন এবং তিনি গাড়ির রঙ, কোম্পানির নাম মনে রেখে দিয়েছিলেন। এদিকে একজন পুলিস অফিসার লিলেহ্যামার ও ওসলোর মাঝামাঝি একজন সুন্দরী মহিলাকে গাড়ি চালাতে দেখে গাড়ির রঙ ও তার লাইসেন্স নম্বর নোট করে রাখেন। কাকতালীয়ভাবে এটাই ছিল সেই গাড়িটা। পরের দিন গাড়িটা এয়ারপোর্টের কার রেন্টাল ডেস্কে জমা দিতে গেলে গাড়ি ব্যবহারকারীদের সঙ্গে সঙ্গে গ্রেপ্তার করা হয়।
এরপর ক্রমে আরও এজেন্ট গ্রেপ্তার হল। জিজ্ঞাসাবাদের সূত্র ধরে পুলিশ ওসলোর একটা অ্যাপার্টমেন্টে রেইড করে। সেখান থেকে প্রচুর কাগজপত্র উদ্ধার হয় এবং তাতে ইসরায়েলি এমব্যাসির সিকিউরিটি অফিসার ইগাল ইয়ালের জড়িত থাকার প্রমাণ মেলে।
পরের দিন সমস্ত খবর প্রকাশিত হয় মিডিয়ায়। মোসাদের দক্ষতা ও বিশ্বাসযোগ্যতা তখন মাটিতে মিশে যাওয়ার উপক্রম।
আরেকটা খবর প্রকাশিত হয় এবং সেই খবরটাই সবচেয়ে বেশি মারাত্মক। সেটা ছিল— মোসাদ ভুল লোককে হত্যা করেছে!
লিলেহ্যামারে যাকে হত্যা করা হয়েছিল, তার নাম আহমেদ বুশিকি। সে ছিল আরব অরিজিনের একজন ওয়েটার। কাজের খোঁজে নরওয়ে এসেছিল। নরওয়ের এক ভদ্রমহিলাকে বিয়ে করেছিল বুশিকি। তার স্ত্রী সাত মাসের গর্ভবতী ছিল। এই খবর বিশ্বের সব দেশে ছড়িয়ে পড়ে। অনেক এজেন্টদের দীর্ঘমেয়াদি জেল হয় আহমেদ বুশিকিকে খুন করার অপরাধে। ইসরায়েল তার পরিবারকে ৪ লক্ষ মার্কিন ডলার ক্ষতিপূরণ দেয়। গোল্ডা মেয়ার জামিরকে ‘রাথ অফ গড’ বন্ধ করার নির্দেশ দেন। সে নির্দেশ অবশ্য কার্যকর করা যায়নি, কারণ ঠিক তখনই ‘য়ম কিপ্পুর ওয়র’ শুরু হয়।
আলি হাসান সালামেহ অধরাই রয়ে গেল। ১৯৭৭ সালের ৮ জুন সালামেহ ১৯৭৫ সালের মিস ইউনিভার্স জর্জিনা রিজককে বিয়ে করেন। সালামেহর লাইফস্টাইল ভারী অদ্ভুত ছিল। একজন সন্ত্রাসবাদী নেতা হিসাবে সেগুলো খাপ খায় না। কার রেসিং, ফ্যাশন ইভেন্টে হাজির থাকা, বিচ পার্টি, মহিলাসঙ্গ নিয়ে মেতে থাকত প্লেবয় সালামেহ। তার দুর্দান্ত ফ্যাশন সেন্সের জন্য তাকে ‘রেড প্রিন্স’ বলা হত।
নিজের নিরাপত্তা সম্পর্কে অদ্ভুত উদাসীন ছিল সালামেহ। সে বলত, ‘আমার কপালে যা লেখা আছে তা হবেই। মরার হলে সেদিন কেউ আমাকে বাঁচাতে পারবে না।’ কিন্তু এভাবে উদাসীন থাকা সত্ত্বেও টানা আট বছর ধরে সালামেহর পিছু নিয়েও মোসাদ কিছু করতেই পারছিল না।
মোসাদ একাধিক বার চেষ্টা করেও তাকে ছুঁতে পারছিল না। যেন মরীচিকা! জীবিত এক ভ্রম! চেষ্টা চলতে থাকল। জানা গেল ১৯৭৪ সালের ১২ জানুয়ারি পিএলও-এর নেতাদের সঙ্গে দেখা করার জন্য সালামেহ সুইজারল্যান্ডের একটি চার্চে যাবে। মোসাদের টিম সেখানে পৌঁছে অ্যাকশন আরম্ভ করে দিল। তিন জনকে মারল তারা। সেই তিন জন আরবি হলেও কেউই সালামেহ ছিল না।
এবার লন্ডনে সালামেহকে ট্রেসও করে ফেলল মোসাদ। তাকে মারার জন্য এগোবে কি এমন সময়ে এক দল আমেরিকান মাতাল তাদের ঘিরে ফেলে। দু’দলের সংঘর্ষে মাঝখান থেকে একজন মোসাদ এজেন্টই নিহত হয়। আর এই ফাঁকে সালামেহ সেখান থেকে পালিয়ে বাঁচে I
এবার মোসাদ বুঝে গিয়েছিল কেউ না কেউ খবর পৌঁছে দিচ্ছিল সালামেহর কাছে। ১১ নভেম্বর, ১৯৭৪। মোসাদ খবর পেল যে, স্পেনের তারিফায় একটি বিচ হাউসের পার্টিতে উপস্থিত থাকবে। খবর ঠিক ছিল। কিন্তু সেখানে অভিযান চালাতে গিয়ে ভয়ানক প্রতিরোধ সামলাতে হল মোসাদকে। সালামেহর আরব রক্ষীরা সেই সময়কার সবথেকে উন্নত হাতিয়ার একে ৪৭ নিয়ে আক্রমণ করেছিল। মোসাদের তিন জন এজেন্ট নিহত হয়। সালামেহর কিছু হয়নি।
এদিকে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদীরা প্লেন হাইজ্যাকিং ও সন্ত্রাসবাদী হামলার মাধ্যমে ইসরায়েলিদের জীবন অতিষ্ঠ করে তুলেছিল। তখন প্রধানমন্ত্রীর পদে রয়েছেন মেনাকিম বিগিন। তিনি সালামেহকে হত্যা করার জন্য আবার নির্দেশ দিলেন।
কিন্তু এখানে একটা ‘কিন্তু’ কাজ করছিল। আর সেই ‘কিন্তু’র নাম ছিল ‘সিআইএ’। সিআইএ এবং সালামেহর সম্পর্ক বেশ ভালো ছিল। এতটাই ভালো ছিল যে, ইয়াসের আরাফাতের পক্ষ থেকে সালামেহকেই সিআইএ-এর ডেপুটি ডিরেক্টর জেনারেলের সঙ্গে মরক্কোয় সাক্ষাতের জন্য পাঠানো হয়। সালামেহ কথা দিয়েছিল যে ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদীরা আমেরিকান নাগরিকদের কোনো ক্ষতি করবে না। আর সিআইএ তার পরিবর্তে সালামেহকে ধরিয়ে দিয়েছিল একটা ব্ল্যাঙ্ক চেক, আর বলেছিল, ‘তোমার সুরক্ষার দায়িত্ব আমরা নিলাম।’
আর এরপর সালামেহ নিজের কথা রেখে সম্পর্কটাকে আরও পরিণত করে তুলল। আমেরিকার ন্যাশনাল সিকিউরিটি অ্যাডভাইজার হেনরি কিসিঞ্জার মধ্যপ্রাচ্যে চলেছিলেন। সালামেহ সেই সময়ে একটা খবর পেল, কিছু ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদী কিসিঞ্জারের ফ্লাইট নামামাত্রই তাকে হত্যার ছক কষেছে। গোপনে সালামেহ সিআইএ-কে খবর দিল। সে যাত্রা রক্ষা পেল কিসিঞ্জার এবং তাকে সুরক্ষা দেওয়ার জন্য সালামেহর ১৭ জন ব্যক্তিগত রক্ষীকে ব্যবহার করা হয়েছিল। স্বাভাবিক ভাবে গদ্গদ হয়ে পড়ল সিআইএ। সে হয়ে উঠেছিল মধ্যপ্রাচ্যে সিআইএ-এর সবথেকে বিশ্বাসের ব্যক্তি।
বুঝতেই পারছেন বন্ধুরা, সিআইএ-এর এই ছাতা সরানোর দরকার আগেই ছিল। ইসরায়েল এবার সেই খেলাই খেলল। তারা জানাল, আমরা সালামেহকে মারতে চলেছি। তোমরা বলো, ও কি তোমাদের লোক?
সিআইএ পড়ল উভয় সংকটে। একদিকে এক শক্তিশালী বন্ধু-রাষ্ট্র, অপর দিকে মধ্যপ্রাচ্যের এক বিশ্বস্ত বন্ধু। কিন্তু শেষ অবধি তারা বলে দিল, সালামেহ আমাদের লোক নয়। ডেথ ওয়ারেন্ট জারি হয়ে গেল।
খবর মিলল যে, সালামেহ বেইরুটে আছে। এজেন্টদের পাঠানো হল বেইরুটে। এদের মধ্যে একজন ছিলেন এরিকা মেরি চেম্বার্স। বেইরুটে তিনি সালামেহর অ্যাপার্টমেন্টের কাছাকাছি একটা ফ্ল্যাট ভাড়া নিলেন। একটি ইন্টারন্যাশনাল অরগানাইজেশনের স্বেচ্ছাসেবীরূপে তিনি ওখানে গরিব বাচ্চাদের সাহায্য করার কাজ নিয়ে গিয়েছিলেন। নিজের অ্যাপার্টমেন্টের জানালা থেকে তিনি রোজ লক্ষ করতেন একেবারে বাঁধা সময়ে একটা সেভ্রোলে স্টেশন ওয়াগন ও তার পিছু পিছু একটা ল্যান্ড রোভার জিপ বেরিয়ে যায়। তিনি ওই গাড়িগুলোর বেরোনোর ও ঢোকার সময় নোট করে রাখতে থাকলেন। বাইনোকুলার লাগিয়ে একদিন তিনি সেভ্রোলে গাড়ির পিছনের সিটে সালামেহকে দেখতেও পেয়ে গেলেন। চেম্বার্স লক্ষ করলেন যে, প্রতিদিন একটা নির্দিষ্ট সময়েই গাড়িগুলি যাওয়া-আসা করছে। আর এটাই ছিল মোসাদের বাজিমাত করার সবচেয়ে বড় পয়েন্ট। রুটিন ফলো করেছ কি মরেছ!
১৯৭৯ সালের ১৮ জানুয়ারি পিটার স্ক্রাইভার নামের একজন ব্রিটিশ পর্যটক বেইরুটে এসে মেডিটেরানি হোটেলে রুম ভাড়া নিলেন। আর ভাড়া করলেন একটা নীল রংয়ের ফোক্সওয়াগন গাড়ি। সেদিনই রোনাল্ট কোলবার্গ নামে এক কানাডিয়ান পর্যটক রয়াল গার্ডেন হোটেলে রুম নিলেন ও একটা সিমকা ক্রিসলার গাড়ি ভাড়া নেন। প্রত্যেকেই ছিল মোসাদের এজেন্ট। তারা দুজনেই লেনাকার এজেন্সি থেকে গাড়ি ভাড়া নেন।
এরিকা চেম্বার্সও একটা গাড়ি ভাড়া নিলেন মাউন্টেন ট্রিপের উদ্দেশে একটা ডাটসুন কার।
সেদিন রাতেই ইসরায়েলি মিসাইল বোট বেইরুট এবং জনিয়েহ বন্দরের মাঝামাঝি সমুদ্রতটে পৌঁছাল এবং বিস্ফোরকের বাক্স রেখে চলে গেল। কোলবার্গ ও স্ক্রাইবার আগে থেকেই সেখানে মজুত ছিল। তারা ফোক্সওয়াগনে তুলে নিল সব বিস্ফোরক।
২১ জানুয়ারি পিটার স্ক্রাইভার তার নীল রংয়ের ফোক্সওয়াগন রাস্তার এমন একটা জায়গায় পার্ক করল, যাতে সেটা এরিকা চেম্বার্সের রুম থেকে দেখা যায়। ওই রাস্তা দিয়েই সালামেহর গাড়ি যাওয়া-আসা করত। গাড়িটা পার্ক করার পর সে একটা ক্যাব বুক করে সোজা এয়ারপোর্টে গিয়ে সাইপ্রাসের ফ্লাইট ধরে।
বিকেল ৩:৪৫-এ রোজকার মতো আলি হাসান সালামেহ তার সেভ্রোলেতে চেপে বেরোল। পিছনে তার বডিগার্ডের ল্যান্ড রোভার।
এরিকা চেম্বার্স তার অ্যাপার্টমেন্টের জানালা দিয়ে তাদের আসতে দেখলেন। তার পাশে দাঁড়িয়েছিল এজেন্ট মোলাড। হাতে একটা রিমোট কন্ট্রোল ডিভাইস। সেভ্রোলে যখন নীল ফোক্সওয়াগনটার পাশ দিয়ে বেরিয়ে যাচ্ছিল, ঠিক তখনই মোলাড তার রিমোটের বোতাম টিপল। বিস্ফোরণে উড়ে গেল ফোক্সওয়াগন, আর তার সঙ্গে উড়ে গেল সেভ্রোলে গাড়িটাও। প্রচণ্ড শব্দে অ্যাপার্টমেন্টের জানালার কাচ ভেঙে পড়ল। চারদিকে তখন ছড়িয়ে আছে গাড়ির টুকরো অংশ ও আর সেভ্রোলের ভেতর থাকা যাত্রীদের ছিন্নবিচ্ছিন্ন দেহ।
ইয়াসের আরাফাতের কাছে টেলিগ্রাম গেল। সংবাদ পেয়ে নাকি আরাফাত কান্নায় ভেঙে পড়েছিলেন। সালামেহ তাঁর প্রাণপ্রিয় ছিল।
সেই রাতেই জনিয়েহ সমুদ্রসৈকতে মোলাড ও এরিকা চেম্বার্স রাবারের ডিঙিতে করে পৌঁছালেন মূল জাহাজে, যা সমুদ্রতট থেকে অনেকটা দূরে অপেক্ষা করছিল। কয়েক ঘণ্টার মধ্যে তারা ইসরায়েল পৌঁছে গেলেন।
ব্ল্যাক সেপ্টেম্বরের ইতি এখানেই। ইতি পড়ল অপারেশন র্যাথ অব গড-এও।