আমরা তিনজন – ৩য় অংশ (শেষ)

দক্ষিণের বারান্দায় রোদে পিঠ দিয়ে ব’সে মোনালিসা চুল আঁচড়াচ্ছে। আমি কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম, দাঁড়িয়ে কথা বলতে ভুলে গেলাম। হঠাৎ যেমন নতুন লাগল তাকে, একটু অন্যরকম সিঁথিতে জ্বলজ্বলে সিঁদুর, পরনে কড়কড়ে শাড়ি, কানে হাতে গলায় চিকচিকে গয়না, আর কেমন একটা গন্ধ দিচ্ছে গা থেকে—হীরেনবাবুর সেন্টের গন্ধ না, নতুন ফার্নিচারের মদ-মদ গন্ধ না, চুলের তেল কি মুখের পাউডারেরও না—আমার মনে হ’লো এই সমস্ত মিলিত গন্ধের যেটা নির্যাস, সেটাই ভর করেছে মোনালিসার শরীরে। জোরে নিশ্বাস নিলাম কয়েকবার, মাথা যেন ঝিমঝিম ক’রে উঠলো।
চোখ তুলে আমার দিকে তাকিয়ে বললো, ‘কী?’
‘কিছু না’—সঙ্গে সঙ্গে কাজের কথাটা মনে পড়লো, ‘হীরেনবাবু ডাকছেন তোমাকে।’
আমার কথাটা যেন শুনতেই পেলো না মোনালিসা, নিশ্চিন্তে চুলই আঁচড়াতে লাগল।
‘শুনছ না কথা! হীরেনবাবু ডাকছেন তোমাকে।’
‘ডাকছেন তো হয়েছে কী। উনি ডাকলেই যেতে হবে?’
‘বাঃ—!’
চিরুনি থামিয়ে আমার মুখের দিকে তাকালো—‘আর কী—চলেই তো যাব শিগগির।’
আমি বললাম, ‘কত ভালো লাগবে তোমার কলকাতায় গিয়ে—ঢাকা কি একটা জায়গা!’
‘ঢাকা খুব ভালো।’ ঘাড় বেঁকিয়ে বাইরের দিকে তাকালো, একটু, শীতের দুপুরের সবুজ-সোনালি মাঠের দিকে। সেদিকে তাকিয়েই আবার বললো, ‘তোমরা আমাকে মনে রাখবে, বিকাশ?’
আমি ব্যস্ত হ’য়ে বললাম, ‘আর কথা না। চলো এখন।’
‘দেখছো না চুল আঁচড়াচ্ছি। বলো গিয়ে এখন যেতে পারবো না।’
কথা শুনে প্রায় ভড়কে গিয়েছিলাম, কিন্তু একটু পরেই মোনালিসা উঠলো, তার সঙ্গে সঙ্গে আমিও এলাম ঘরে। এসেই বললাম, ‘তারপর? সেই লোকটার কী হ’লো, হীরেনবাবু?’
কিন্তু হীরেনবাবুর গল্প বলার উৎসাহ দেখি মিইয়ে গেছে। জানালা দিয়ে বাইরের দিকে তাকিয়ে থাকলেন তিনি, আর মোনালিসা চেয়ারে ব’সে টেবিলের কাপড় খুঁটতে লাগল।
আমি পীড়াপীড়ি করলাম, ‘বলুন না কী হ’লো!’
‘এখন থাক।’
আমি খাটে ব’সে একটি ইংরেজি বইয়ের পাতা উল্টিয়ে বললাম, ‘এটা পড়েছি, ভারি মজার বই।’
হীরেনবাবু হঠাৎ হাত বাড়িয়ে আর-একটি বই টেনে নিয়ে বললেন, ‘এ-বইটাও ভারি মজার। এক কাজ করো তুমি—এটা বাড়ি নিয়ে গিয়ে প’ড়ে ফ্যালো, আমি চট ক’রে একটু ঘুমিয়ে নিই। কেমন?’ বলতে-বলতে তিনি একেবারে উঠে দাঁড়ালেন।
আর কথা না-ব’লে আস্তে বেরিয়ে এলাম আমি, পিঠ দিয়ে অনুভব করলাম ও-ঘরের দরজা বন্ধ হ’য়ে গেলো। বাড়ি গেলাম না; বারান্দায় যেখানে ও ব’সেছিলো ঠিক সেখানটায় ব’সে পড়লাম। ওর চুলের গন্ধমাখা চিরুনিটা সেখানেই প’ড়ে ছিলো, হাতে তুলে নিয়ে দাঁতগুলির উপর আস্তে আস্তে আঙুল চালাতে লাগলাম, বার-বার, বার-বার।
আরো একদিন, আরো একদিন। যাবার দিন এলো, পেছোল, আর-একটা একটা দিন শুধু; তারপর চলে গেলো।
চিঠি এলো এবার, তিনজনের কাছে একখানা, চিঠি, মোটা নীল খামে, আমার নামে! তিনজনের হ’য়ে জবাব লিখলাম, আমি, একটু লম্বাই হ’লো, সেই সঙ্গে একটা কবিতাও লিখে ফেললাম, সেটা অবশ্য পাঠালাম না। চিঠি বন্ধ হ’য়ে গেলো শিগগিরই, তারপর শুধুই কবিতা লিখতে লাগলাম, দেখতে দেখতে খাতা ভ’রে উঠলো!
মাসিমার কাছে খবর পাই সবই। ভালো আছে ওরা, খুব ভালো আছে। হীরেন গাড়ি কিনেছেন, সেদিন ওরা আসানসোল বেড়িয়ে এলো। কলকাতায় কথা-বলা সিনেমা দেখাচ্ছেন, টোম্যাটোর সের এক পয়সা, তবে শীত কমে গেছে, হঠাৎ অসুখ-বিসুখ দেখা না দেয়। আর-একটু গরম পড়লেই ওরা চলে যাবে দারজিলিং।
না-দেখা দারজিলিং-এর ছবি দেখতে লাগলাম, মনে-মনে, কিন্তু সে-ছবি মুছে দিয়ে মাসিমা একদিন বললেন, ‘ওরা তো আসছে।’
আসছে! এখানে! ঢাকায়। দারজিলিং-এর কী হ’লো? আমাদের নীরব প্রশ্নের উত্তরে বললেন, ‘শরীরটা খারাপ হয়েছে ওর, আমার কাছেই থাকবে এখন।’
‘কী? অসুখ করেছে আবার?’ চমকে উঠলাম তিনজনে।
‘না, অসুখ ঠিক না, শরীরটা ভালো নেই আর কি’, মাসিমা মৃদু হাসলেন।
খুব খারাপ লাগল। খারাপ লাগল মাসিমার কথা শুনে, হাসি দেখে। শরীর ভালো না, অথচ অসুখও না—এ আবার কী-রকম কথা? আর মাসিমা কেমন নিশ্চিন্ত নিরুদ্বেগ,—যেন খুশীই হয়েছেন খবর শুনে। রীতিমতো রাগ হ’লো মনে মনে।
ওরা পৌঁছোবার ঘণ্টাখানেকের মধ্যেই আমরা তিন মূর্তি গিয়ে হাজির হলাম। মোনালিসা সোফায় ব’সে আছে একটু এলিয়ে, হাতে সিগারেটের টিন। চকিতে আমরা তিনজন মুখ-চাওয়াচাওয়ি করলাম—হীরেনবাবু কি সিগারেট ধরিয়েছেন ওকে?
আমাদের দেখে ফিকে একটু হাসলো। কথা বললো না।
‘কেমন আছো মোনালিসা?’ আমরা চেষ্টা করলাম স্ফূর্তির সুর লাগাতে।
সিগারেটের টিনটা মুখের কাছে এনে তার সঙ্গে একবার মুখ ঠেকিয়ে ডালা বন্ধ ক’রে বললো, ‘এই—’
‘তোমার নাকি অসুখ?’
সে-কথার কোনো জবাব না-দিয়ে বললো, ‘তোমাদের কী খবর?’ তারপর আস্তে আস্তে এটা-ওটা গল্প করতে লাগল, আর সিগারেটের টিনটা মুখে তুলতে লাগল ঘন ঘন।
হীরেনবাবু ঘরে এসে ব্যস্তভাবে বললেন, ‘তরু এখন কেমন আছো?’
ক্লান্ত চোখ তুলে বললো, ‘ভালো।’
‘তুমি বরং একটু শোও।’
‘না, এই বেশ আছি।’
‘এই যে তোমরা এসেছো দেখছি। তরু তো এদিকে—’ হঠাৎ থেমে গেলেন হীরেনবাবু।
‘হয়েছে কী ওর?’
‘হয় নি কিছু, তবে…’
তবে কী? ওর কী এমন সাংঘাতিক কোনো অসুখ করেছে যা কারো কাছে বলাও যায় না? আর ও যেন কেমন হ’য়ে গেছে, যেন আধ-মরা, আস্তে কথা ব’লে, একভাবে স্থির হ’য়ে ব’সে থাকে, হাসি পেলে ভালো ক’রে হাসেও না। মায়েদের মুখে শুনেছি যে বিয়ের পরে মেয়েদের শরীর আরো ভালো হয়, কিন্তু আমাদের মোনালিসার নাকি এই হ’লো?
ছোট একটা প্লেট হাতে ক’রে মাসিমা এসে বললেন, ‘এটা একটু মুখে দিয়ে দ্যাখ তো?’
‘কী, মা?’
‘দ্যাখ না—’ ব’লে তিনিই আঙুল দিয়ে মুখে গুঁজে দিলেন।
‘না, না, আর না—’, মোনালিসার মুখে কষ্টের রেখা ফুটে উঠলো, গলার কাছটায় হাত রেখে মুখ নিচু করলো সে।
বেরিয়ে এসে খানিকক্ষণ নিঃশব্দ হাঁটলাম আমরা, মন বিষণ্ন খুবই। হঠাৎ অসিত বললো, ‘ও বার-বার থুতু ফেলছিলো সিগারেটের টিনে।’
‘যাঃ!’ আমি আঁতকে উঠলাম।
‘সত্যি! আমি দেখলাম!’
হিতাংশু বললো, ‘তা হলে এটাই বোধহয় ওর অসুখ।’
‘অসুখ না’, অসিত গম্ভীরভাবে বললো, ‘ওর ছেলে হবে।’
শুনে হিতাংশুটা খুকখুক ক’রে হেসে উঠলো।
‘হাসছো কেন?’—আমি রেগে গেলাম—‘হাসবার কী আছে এতে?’
অসিত বললো, ‘ঐ জন্যেই তো টক এনে দিলেন মাসিমা। এ-রকম হলে টক খেতে ভালো লাগে।’
‘তুমি সবই জানো!’ রাগে গর্জে উঠলাম আমি।
‘হ’লো কী তোমার?’ অসিত যেন সকৌতুকে আমার দিকে তাকালো।
‘যাও! কিছু ভালো লাগছে না আমার, আমি বাড়ি যাই।’ ওদের ত্যাগ ক’রে একা ফিরে এলাম বাড়িতে, বেলা শেষের আলোয় একটা বই খুলে পড়তে ব’সে গেলাম।
হীরেনবাবু ফিরে গেলেন দু’দিন পরেই। দুপুরবেলা গাড়ি। ঘোড়ার গাড়িতে মাল তোলা হ’লো : হীরনেবাবু উঠতে গিয়ে থমকালেন। আমি তাড়াতাড়ি বললাম, ‘কিছু ফেলে এসেছেন, নিয়ে আসবো?’
‘না, না, আমি যাচ্ছি।’
তাড়াতাড়ি বাড়ির ভেতরে গেলেন তিনি, ফিরে এসে কোনোদিকে না তাকিয়ে গাড়িতে উঠে বসলেন। চাবুকের শব্দ হ’লো। অসিত সাইকেলে উঠলো—স্টেশনে যাবে সে। হিতাংশু গলা বাড়িয়ে জিজ্ঞেস করলো, ‘কবে আসবেন আবার?’
‘আসবো—তোমরা দেখো ওকে’, ব’লে হীরেনবাবু মুখ ফিরিয়ে নিলেন। আমার মনটা হু হু ক’রে উঠলো।
কী স্তব্ধ সেই দুপুরবেলা, কী-রকম ছবির মতো সুন্দর, সেই উনিশ-শো-আটাশ সনে, পুরানা পল্টনের ফাল্গুন মাসে! ঘোড়ার গাড়ি আর অসিতের সাইকেল, ছোট হ’তে-হ’তে রাস্তার বাঁকে অদৃশ্য হ’লো; আমি আর হিতাংশু ভেতরে এলাম। বালিশে মুখ গুঁজে মোনালিসা ফুলে ফুলে কাঁদছে।
‘মোনালিসা!’
‘শোনো, কথা শোনো।’
‘হীরেনবাবু আবার তো আসবেন—’
‘এরপর ওঁকে আর যেতেই দেব না আমরা!’
‘আর না—আর কেঁদো না, মোনালিসা, তোমার পায় পড়ি।’ থামল না কান্না। আমি মেঝেতে ওর কাছে হাঁটু ভেঙে ব’সে পড়লাম, ওর মাথায় হাত রেখে গুনগুন ক’রে বলতে গেলাম, ‘আর না, আর কাঁদে না, একটু থামো, একটু চুপ ক’রো মোনালিসা!’ হঠাৎ গলা ভেঙে গিয়ে আমিও ফুঁপিয়ে কেঁদে উঠলাম।
একটু পরে মোনালিসা আমাকে ঠেলা দিয়ে বললো, ‘এই—কাঁদছ কেন? বোকা!’ আমি দু’হাতে মুখ ঢেকে থাকলাম, আমাকে চুলে ধ’রে ঝাঁকানি দিয়ে আবার বললো, ‘পুরুষমানুষ—কাঁদতে লজ্জা ক’রে না। থামো এক্ষুনি!’
আমি হাত সরিয়ে ভেজা চোখে তাকালাম। ওর সঙ্গে চোখাচোখি হতেই সুখে আমার বুক কেঁপে উঠলো, তারপর সারাদিন ধ’রে একটু একটু কাঁপল, রাত্রে ঘুমের মধ্যেও ভুলতে পারলাম না।
আমরা তিনজন ওকে ঘিরে রইলাম। ও যাতে ভালো থাকে, কখনো মন খারাপ না ক’রে। হঠাৎ এক-একটা অদ্ভুত জিনিষ ওর খেতে ইচ্ছা ক’রে, অসিত শহর ঢুঁড়ে তা জোগাড় ক’রে আনে। দেখেই ওর ইচ্ছে চলে যাবে, জানা কথা; কবে আবার নতুন ইচ্ছে হবে সেই আশায় থাকি আমরা। আর যদি কখনো একটু খায়, খেয়ে ভালো ব’লে, তাহলে তো কথাই নেই—আহ্লাদে আমরা হাবুডুবু।
হীরেনবাবুর চিঠি আসতে দেরি হলেই আমরা বলি, উনি হঠাৎ এসে অবাক ক’রে দেবেন ব’লেই চিঠি লিখছেন না। কথাটা ঠিক নয় জেনেও প্রতিবারেই মোনালিসার মুখ উজ্জ্বল হ’য়ে ওঠে। আমরা চুপ ক’রে উপভোগ করি।
হীরেনবাবু এলেন তিন মাস পরে। ততদিন ওর শরীরটা অনেকটা সেরেছে, খায়, বেড়ায়, ফেরিওলা ডেকে কাপড় কেনে, চেহারাও ভারী হয়েছে একটু। এবারে দিন দশেক থাকলেন তিনি, তারপর পুজোর সময় এসে এক মাস কাটালেন।
ততদিন ওর শরীর আবার খারাপ হচ্ছে। ডাক্তার আসছেন ঘন-ঘন, ওষুধ দিচ্ছেন, কিন্তু যা শুনি তাতে মনে হয় কিছুই উপকার হচ্ছে না। কী কষ্ট জানি না, বুঝি না, শুধু চোখে দেখতে পাই;—চোখে কালি পড়েছে, দু’টো কথা বললেই হাঁপিয়ে প’ড়ে, মুখটা এক-এক সময় নীল হ’য়ে যায়। আমরা কাছে কাছে ঘুরঘুর করি, শুয়ে থাকলে হাওয়া করি হাতপাখায়, কখনো একটু ভালো দেখলে হাসি-ঠাট্টায় ভোলাতে চাই—কিছুই পারি না।
একদিন আমি বললাম, ‘বাবর নিয়েছিলেন হুমায়ুনের অসুখ, ও-রকম পারলে বেশ হ’তো।’
অসিত হো হো ক’রে হেসে উঠলো—’আর যাই পারো, ওর এ-অসুখটা তুমি নিতে পারবে না!’
লাল হ’য়ে বললাম, ‘অসুখ না, অসুখের কষ্ট।’
হিতাংশু বললো, ‘কী কষ্ট, সত্যি! সারারাত নাকি পায়চারি ক’রে—ঘুমোতে পারে না, শুতেও নাকি কষ্ট হয়।’
অসিত বললো, ‘হবে না, দেখতে কীরকম হয়েছে দেখেছ!’
আমি ঝাঁঝিয়ে উঠে বললাম, ‘কীরকম আবার হবে! সুন্দর হয়েছে, খুব সুন্দর।’
‘যত সুন্দরই হোক, এই শেষের সময়টা…’
আর-এক পরদা গলা চড়িয়ে বললাম, ‘এই সময়টাই তো সবচেয়ে সুন্দর!’
সত্যিই তাই, আমার চোখে সত্যিই তা-ই দেখলাম। দিন যত কাটল, তত ওকে আরো বেশি সুন্দর দেখলাম আমি, ওর সমস্ত শরীর এক অসহ্য সৌন্দর্যে ভরপুর হ’য়ে উঠলো আমার চোখে। একদিন ওকে না-ব’লে পারলাম না সে-কথা। আগের বছর যেদিনে ওরা রাঁচি থেকে ফিরেছিলো, যেদিন রেলগাড়ির একটা ছোট কামরায় সমস্ত স্বর্গ ধ’রে গিয়েছিলো, ঠিক সেইরকম একটি শীতের আমেজ-লাগা দিনে হঠাৎ ও বললো, ‘বিকাশ তোমার হয়েছে কী বলো তো? বড্ড আজকাল তাকিয়ে থাকো আমার দিকে!’
আমি একটুও লজ্জিত না হ’য়ে জবাব দিলাম, ‘তুমি আজকাল খুব সুন্দর হয়েছ কি না, তাই।’
‘আগে বুঝি সুন্দর ছিলাম না?’
‘এখনকার মতো না!’
‘তাই বুঝি?’ মোনালিসা ভুরু কুঁচকে বাইরে মাঠের দিকে তাকালো। একটু চুপ ক’রে থেকে বললো, ‘সত্যি আমাকে ভালোবাসো তোমরা। কিন্তু ও-রকম ক’রে আর তাকিয়ো না, ভারি অসুবিধে লাগে আমার।—ইস্, কী রোদ!’
আমি উঠে সামনের জানালাটা ভেজিয়ে দিলাম।
‘একটু ঘুমিয়ে নিই কেমন?’
পায়ের কাছে একখানা চাদর ছিলো, ভাঁজ-করা, খুলে গায়ের উপর ছড়িয়ে দিতে-দিতে বললাম, ‘আজকাল তুমি বেশ ভালো আছো, না?’
‘আমি তো ভালোই আছি।’
ওর মুখে দেখলাম সাহসের সঙ্গে আশা, আশার সঙ্গে ভয়, ভয়ের সঙ্গে ধৈর্য। পায়ের পাতা দুটির উপর থেকে চাদর সরিয়ে দিয়ে বললাম, ‘হীরেনবাবু চলে গেলেন কেন?’
‘বা রে! ওর বুঝি কাজকর্ম নেই?’
‘কবে আসবেন আবার?’
‘আসবেন সময়মতো।’
‘কী দরকার ছিলো যাবার—আমার মোটেও ভালো লাগে না!’
‘হয়েছে হয়েছে, আর সর্দারি করতে হবে না’—বলে পাশ ফিরে চোখ বুজল। বোজা চোখেই ব’লে নিলো, ‘আমি কিন্তু ঘুমোলাম’, এবং বলবার সঙ্গে-সঙ্গে ঘুমিয়ে পড়লো। আহা, রাত্তিরে ঘুমোতে পারে না, কত ক্লান্তি ওর শরীরে! মনে-মনে বললাম—কার কাছে বললাম জানি না—ওর ভালো হোক, ওর ভালো হোক।
রাত্রে বিছানায় শুয়ে মনে হ’লো ও হয়তো এতক্ষণ ছটফট করছে কষ্টে, উঠে পায়চারি করছে ঘরের মধ্যে, আর বাইরে শেয়াল-ডাকা অন্ধকার, আর আকাশে এখনো সাত-আট ঘণ্টা রাত্রি। কেন আমি কিছু করতে পারি না, কেন এক্ষুনি যেতে পারি না ওর কাছে, কোনো অলৌকিক উপায়ে ঘুম পাড়িয়ে দিতে পারি না ওকে? চোখের উপর কষ্ট দেখতে হবে, কিছু করা যাবে না, এই কি মানুষের ভাগ্য? সত্যি কি আমাদের হাত-পা বাঁধা, কোনো উপায় নেই? ভাবতে ভাবতে ঘুম ছুটল চোখের, কবিতার লাইন মনে এলো, উঠে বসতেই চোখে পড়লো ছায়া-ছায়া জ্যোৎস্না ফুটেছে বাইরে, আমার জানালা দিয়ে আবছা দেখা যাচ্ছে তারা-কুটির স্বপ্নের মতো। বেশিক্ষণ তাকালাম না, লণ্ঠন জ্বেলে কেরোসিনের গন্ধে আর মশার কামড়ে ব’সে ব’সে কবিতা বানাতে লাগলাম।
রোজ হ’তে লাগল এ-রকম, আমার রাত্রি থেকে ঘুম প্রায় চলে গেলো। আমিও জেগে আছি ওর সঙ্গে-সঙ্গে, আমি ওর প্রহরী, সকল দুঃখ থেকে আমি বাঁচাব ওকে—এ কথা ভাবতে-ভাবতে দেবতা মনে হ’লো নিজেকে, কবিতায় এমন সুন্দর সুন্দর কথা এলো যে নিজেই অবাক হলাম।
এমনি এক রাত্রে—রাত তখন দুটো প্রায়—লিখতে লিখতে হঠাৎ আমার হাত কেঁপে একটা অক্ষর বেঁকে গেলো। শুনলাম বাইরে কে ডাকছে আমাকে, ‘বিকাশ বিকা—শ!’ একটু অপেক্ষা করলাম, আবার শুনলাম চাপা গলার ডাক। আস্তে দরজা খুলে বেরিয়ে এসে দেখি, ওরা দু’জন ছায়ার মতো দাঁড়িয়ে আছে।
সে রাত্রে তখনও চাঁদ ওঠেনি, সারা রাত্রেও বোধহয় ওঠেনি, অমাবস্যার কাছাকাছি রাত সেটা। আকাশ ছিলো তারায় ঝকঝকে, তারই ধুলোর মতো আলোয় আমরা তিনজন দাঁড়ালাম—শীতের রাত্রি, মাঠের মধ্যে, ঢিপঢিপ বুকে।
‘কী, অসিত? হিতাংশু কী খবর?’
‘আরম্ভ হয়েছে বোধহয়’, কথা বললো হিতাংশু।
‘আরম্ভ হয়েছে?’
‘একতলায় শুনলাম চলাফেরা, কথাবার্তা, আর চাপা একটা গোঙানি। ঘুমের মধ্যেই যেন শুনলাম, তারপর আর বিছানায় থাকতে পারলাম না। অসিতকে ডেকে তুলে তোমার কাছে এলাম। তুমি কি জেগেই ছিলে?’
আমি কথা বললাম না, তারার আলোয় দেখলাম হিতাংশুর মুখ শাদা হ’য়ে গেছে, আর অসিত মুখ ফিরিয়ে তাকিয়ে আছে দূরের দিকে। এ-কদিনে আমরাও যেন বদলে গিয়েছিলাম; হাসি, ঠাট্টা, ঘোরাঘুরি কমে গিয়েছিলো আমাদের, বেশি কথা বলতাম না, আর এতদিন ধ’রে যে-মানুষকে নিয়ে লক্ষ কথা আমরা বলেছি, তার সম্বন্ধে একেবারে নীরব হ’য়ে গিয়েছিলাম। রুদ্ধশ্বাস আমরা, প্রতীক্ষায় রুদ্ধশ্বাস।
আমরা বুঝলাম না যে আমরা কাঁপছি, জানলাম না যে আমরা হাঁটছি, কখন বাগানের ছোট গেট খুলে এসে সিঁড়ির তলায় দাঁড়ালাম। নিশ্চয়ই আমরা কোনো শব্দ করি নি, কোনো কথাও বলি নি, কিন্তু প্রায় সঙ্গে-সঙ্গেই দে-সাহেব টর্চ হাতে বেরিয়ে এলেন, যেন আমাদেরই অপেক্ষা করছিলেন এতক্ষণ। নিচুগলায় বললেন, ‘অসিত, একবার যাও তো সাইকেলটা নিয়ে ডক্টর মুখার্জির কাছে—একেবারে সঙ্গে ক’রে নিয়ে আসবে তাঁকে।’
অন্ধকারে হাওয়ার মতো মিলিয়ে গেলো অসিত। আমি আর হিতাংশু সিঁড়ির উপরেই ব’সে পড়লাম। একটা কান্না, চাপা একটানা, আমাদের পিঠ ফুঁড়ে বুকের মধ্যে ঢুকলো, তার যেন আওয়াজ নেই, শুধু কষ্ট আছে, যেন পৃথিবীর প্রাণে আঘাত দিয়েছে কেউ, পৃথিবীর বুক থেকে এই কান্না উঠছে, তাই কোনোদিন থামবে না।
ওকে চোখে দেখতে পারি না আমরা, দূর থেকেও না; ও-ঘরে যেতে পারি না আমরা, ঘরের কাছেও না। শুধু বাইরে ব’সে থাকতে পারি, শীতে, অন্ধকারে, না-জেগে, না-ঘুমিয়ে, আকাশের সামনে, অদৃষ্টের মুখোমুখি।
ডাক্তারের আনাগোনা শুরু হ’লো, চললো বাকি রাত ভ’রে, চললো তার পরের দিন। ভোর হ’তেই চড়া মাশুলের টেলিগ্রাম পাঠিয়ে দিলাম হীরেনবাবুকে—মনে মনে ভাবলাম, টেলিগ্রাম যত দ্রুতই ছুটে যাক, তার চেয়েও দ্রুতবেগে ছুটে আসুক হীরেনবাবুর মন, কাল বিকেলের আগে তিনি পৌঁছতে পারবেন না কিছুতেই—কী অসহায় মানুষ, কী নিরুপায়! ডাক্তার, নার্স, ওষুধ, ইনজেকশন, পরিশ্রম, প্রার্থনা;—তবু অসহায়, তবু মানুষ অসহায়—কী হচ্ছে, কী হ’লো, কী হবে, এসব প্রশ্নের উত্তর নেই কারো চোখে, ডাক্তারের মুখ পাথরের মতো, ওর মা-বাবার মুখে সংক্ষিপ্ত ফরমাশ ছাড়া আর-কোনো কথা নেই, মাসিমা আমাদের সঙ্গে চোখাচোখি পর্যন্ত ক’রেন না, আর দে-সাহেবের পরিপাটি চেহারাটির তলায় একজন কোঁকড়ানো বুড়োমানুষ যে লুকিয়ে ছিলো তা কে জানতো! কে জানতো আকাশের নীল নরম ঘোমটার তলায় এই কান্না লুকিয়ে আছে! আর আমাদের কি আর কিছু নেই, আর কিছু করবার নেই, শুধু কান পেতে এই কান্না শোনা ছাড়া?
দুপুরের আগেই বিকেল হ’য়ে গেলো সেদিন, বিকেলের আগেই অন্ধকার। তারপর, রাত যখন একটু ভারি হয়েছে, হঠাৎ যেন পৃথিবীর বুক চিরে চিৎকার উঠলো একটা; উঠলো, পড়লো, আবার উঠলো আকাশের দিকে; আকাশ চুপ, তারাদের নড়চড় হ’লো না; আবার উঠলো চিৎকার, যেন প্রতিমার সামনে ছাগশিশুর আর্তরব, ঘণ্টার পর ঘণ্টা, বিরামহীন। আমরা ছুটে চলে গেলাম বাইরে, মাঠের মধ্যে, কিন্তু যতদূর সে-শব্দ চলে আমাদের, মাতা পৃথিবীর আদিম কান্না এটা, এ থেকে নিস্তার কোথায়?
ফিরে এলাম। ভিতরে আলো, ব্যস্ততার ঢেউয়ের পর ঢেউ, ফাঁকে ফাঁকে ডাক্তারের মোটা গলা, আর বাইরে অফুরন্ত তারা, অসীম অন্ধকার, অপরূপ রাত্রি, কিন্তু পৃথিবীর কান্না তো থামে না।
যে-তারা ছিলো মাথার উপরে নেমে এলো পশ্চিমে, যে-তারা ছিলো চোখের বাইরে উঠে এলো দিগন্তের উপরে, পুবের কালো ফিকে হ’লো, ছোট ছোট অনেক তারা মুছে গিয়ে মস্ত সবুজ একলা একটি তারা জ্বলজ্বল করতে লাগল সেখানে। এই সেই অপার্থিব মুহূর্ত, সেই অলৌকিক লগ্ন, যখন আমি জেগে উঠে বাইরে এসেছিলাম ওর বিয়ের দিন, যখন আমি ওকে পেয়েছিলাম মৃত্যুর হাত থেকে, অন্ধকারের সমুদ্রের মধ্যে একটিমাত্র ভেসে চলা আলো-জ্বলা নৌকায়। অন্তত একমুহূর্তের জন্য সেদিন সে আমার হয়েছিলো, আজ কি আবার এলো সেই মুহূর্ত?
অসিত ফিসফিস ক’রে বললো, ‘কী হ’লো?’
হিতাংশু বললো, ‘কই, না!’
‘সব যেন চুপ?’
‘তাই তো।’
‘যাব একবার ভেতরে?’ অসিত উঠে দাঁড়াল, কিন্তু গেলো না। অনেক, অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলাম আমরা, কিন্তু আর কোনো শব্দ নেই, সব স্তব্ধ, তারপর হঠাৎ দেখি দে-সাহেব আমাদের সামনে এসে দাঁড়িয়েছেন। ভোরের প্রথম ছাইরঙা আলোয় দেখলাম তাঁর ঠোঁট নড়ে উঠলো, এমন স্থির হ’য়ে আমরা তাকিয়েছিলাম আর এমন স্তব্ধ চারদিক যে তাঁর কথাটা আমরা কানে না-শুনে যেন চোখ দিয়ে দেখলাম :
‘এসো তোমরা, ওকে দেখবে।’
অসিত আর হিতাংশুই সব করলো, রাশি রাশি ফুল নিয়ে এলো কোথা থেকে, আরো কত কিছু বেলা দু’টো পর্যন্ত শুধু সাজাল শুধু সাজাল, তারপর নিয়ে যাবার সময় সকলের আগে রইল ওরা দু’জন। আরো অনেকে এলো কাঁধ দিতে, শুধু আমি বেঁটে ব’লে বাদ পড়লাম, পিছনে পিছনে হেঁটে চললাম একা-একা। ঠিক একা-একাও নয়, কারণ ততক্ষণ হীরেনবাবু এসে পৌঁছেছেন, গাড়ির কাপড়ে জুতো-ছাড়া পায়ে তিনিও চললেন আমার পাশে পাশে।
হীরেনবাবু পরের বছর আবার বিয়ে করলেন, দে-সাহেব চলে গেলেন বদলি হ’য়ে। কিছুদিন পর্যন্ত লোকেরা বলাবলি করলো ওঁদের কথা, তারপর তারা-কুটিরের একতলায় অন্য ভাড়াটে এলো, পুরানা পল্টনে আরও অনেক বাড়ি উঠলো, ইলেকট্রিক আলো জ্বললো। অসিত স্কুল থেকে বেরিয়ে চাকরি নিলো তিনসুকিয়ায়, ছ-মাসের মধ্যে কী একটা অসুখ ক’রে হঠাৎ মরে গেলো। হিতাংশু এম.এস.সি. পাস ক’রে জার্মানিতে গেলো পড়তে আর ফিরল না, সেখানকারই একটা মেয়েকে বিয়ে ক’রে সংসার পাতল, এখন এই যুদ্ধের পরে কেমন আছে, কোথায় আছে কে জানে। আর আমি—আমি এখনো আছি, ঢাকায় নয়, পুরানা পল্টনে নয়, উনিশ-শো সাতাশে কি আটাশে নয়, সে-সব আজ মনে হয় স্বপ্নের মতো, কাজের ফাঁকে ফাঁকে একটু স্বপ্ন, ব্যস্ততার ফাঁকে ফাঁকে একটু হাওয়া—সেই মেঘে-ঢাকা সকাল, মেঘ-ডাকা দুপুর, সেই বৃষ্টি, সেই রাত্রি, সেই—তুমি! মোনালিসা, আমি ছাড়া আর কে তোমাকে মনে রেখেছে!

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *