1 of 2

আমরা জোনাকি

আমরা জোনাকি

সমীর সকাল থেকে দোকান খুলে বসেছিল। সকাল থেকে এখনও একজন খদ্দের আসেনি। একজন এসেছিল। সেও কিছু কেনেনি। কাল রাতে একটি টাইম-পিস কিনে নিয়ে গেছিল। সেটার রং পছন্দ হয়নি, তাই বদলে নিয়ে গেল।

এই দোকান করা সমীরের ভালো লাগে না। বাবা বেঁচে থাকতে বাবার অনেক আশা ছিল যে সমীর খুব বড়ো হবে। মানে ছোটো শহরের অখ্যাত ঘড়ির দোকানদারের চেয়ে বড়ো কিছু হবে। বি এ-টা পাসও করেছিল সমীর সময়মতো। ভালোভাবেই। তার পর কীভাবে সমীরকে বড়ো করা যায় ভাবতে ভাবতে সমীরের বাবা মারা গেলেন। এমন কিছু আর্থিক, সামাজিক বা খুঁটির জোর ওদের ছিল না যে, বাবার ওই ভাঙা ঘড়ির দোকানে বসা ছাড়া ও অন্য কিছু করে।

ওই সমস্ত জোর না থাকলেও বাবা বেঁচে না থাকলেও যে জীবনে কিছু করা যায় তা সমীর বরাবর বিশ্বাস করে এসেছে, কিন্তু ওর নিজের ওপর ওর বিশ্বাস ছিল না। ও জানত যে ও সে দলের নয়।

রোজ সকালে পাজামার ওপর খদ্দরের পাঞ্জাবি চড়িয়ে তার ওপর বাবার গায়ের গন্ধমাখা পুরোনো আলোয়ানটা গায়ে জড়িয়ে সমীর যখন সাইকেলটা দেওয়ালে ঠেস দিয়ে দাঁড় করিয়ে রেখে, পুরানিবাজারে সবজি মন্ডির পাশের ছোটো রং-চটা সাইনবোর্ড-টাঙানো দোকানটার তালা খুলত, তখন ওর মনে হত আরম্ভতেই ও শেষ হয়ে গেছে জীবনে।

বাড়ি-দোকান, দোকান-বাড়ি; তার বাইরে ওর জন্যে পৃথিবীতে যেন অন্য কিছু আর ওর অপেক্ষায় থাকেনি। ও যেন খুব সুন্দর একটা ডিপার্টমেন্টাল দোকানে অনেক কিছু সওদা করবে বলে, অনেক পথ হেঁটে পরিশ্রান্ত হয়ে এসে, শেষ-অবধি একদিন পৌঁছেছিল। কিন্তু পৌঁছে দেখল, সব সওদা শেষ হয়ে গেছে। ওর জন্যে কিছুই আর বাকি নেই। তাই ধীরে ধীরে এই দীন দৈনন্দিনতাতে ও আজকাল অভ্যস্ত হয়ে গেছে। ওর দোকানের কাউন্টারে বসে, বাসের আসা-যাওয়া, টাঙা, রিকশা, ক্কচিৎ প্রাইভেট গাড়ি, চেনা-অচেনা পথ-চলতি মুখের ভিড়—এইসব দেখতে দেখতে প্রতিদিন কখন যে দিন গড়িয়ে সন্ধে নামে ওর যেন হুঁশই থাকে না।

ওর চশমার কাচে মাঝে মাঝে ধুলো জমে ওঠে। ঘড়ি-মোছা শ্যাময় দিয়ে চশমার কাচ পরিষ্কার করে নিয়ে আবার চশমাটা পরে নিয়ে ও পথের দিকে চেয়ে বসে থাকে।

চামারিয়া-টাটিঝামা-বাতরা, আইয়ে বাবু আইয়ে—বলে ড্রাইভারের অ্যাসিস্ট্যান্টটি চা-এর দোকানের সামনে দাঁড়িয়ে চেঁচাতে লাগল। যেসব প্যাসেঞ্জার চা খেতে নেমেছিল, তারা তাড়াতাড়ি করে প্লেটে ঢেলে গরম চা খেতে লাগল উঃ আঃ করে। বাস ছাড়বে এখুনি। ড্রাইভার বারকয়েক হর্ন বাজাল। সকলে সিগারেটের ও বিড়ির টুকরো ছুড়ে ফেলে, পানের পিকের পিচকিরি ছুড়ে, তড়িৎ-ঘড়িৎ বাসে উঠে পড়ল। ধুলো উড়িয়ে মন্থর গতিতে বাস চলে গেল। বাসস্ট্যাণ্ডটা হঠাৎ ভীষণ খালি হয়ে গেল। শালপাতার ঠোঙা, চায়ের ভাঁড়, সিগারেটের টুকরো, লালমাটির ওপরে গড়াগড়ি যেতে লাগল।

কয়েক মিনিট পরেই উলটোদিক থেকে আরেকটি বাস এসে দাঁড়াল স্ট্যাণ্ডে।

অতুল লাফিয়ে নামল বাস থেকে। নেমেই দৌড়ে এল সমীরের দোকানে। বলল, এই দেখ, ঘড়ির ব্যাণ্ডটা বাসে বসে থাকতে থাকতেই ছিঁড়ে গেল। কী কেলেঙ্কারি বল তো?

সমীর বলল, কেলেঙ্কারি কী রে? হাঁটতে হাঁটতে বা বাসে উঠতে নামতে যদি ছিঁড়ত তখন তো ঘড়িটাই যেত। বসা অবস্থায় ছিঁড়েছে তো ভালোই হয়েছে বল?

অতুল বলল, ছিঁড়েই যখন গেল তখন আর ভালো বলি কী করে?

কথা না বলে, ঘড়িটা নিয়ে সমীর মুখ নীচু করে ঘড়ির ছেঁড়া ব্যাণ্ডটা খুলতে লাগল। মুখ নীচু করা অবস্থাতেই বলল, চা খাবি?

অতুল বলল, খাওয়া। বলে অতুল নিজেই রাস্তার উলটোদিকের পান্ডেজির চায়ের দোকানের ছোকরার উদ্দেশে হাঁক লাগাল, দো চায়ে লাও, জলদি।

আয়া বাবু আয়া—বলে উত্তর দিল ছেলেটি।

সমীর বলল, কোথায় গেছিলি?

গেছিলাম একটু টাটিঝামা। ধান-টান কত হল, কী হল, আদৌ হল কি না দেখতে। এবারেও পুজোর সময়ে জ্যাঠামণিরা আসছে তো। মহা ঝামেলা। হিসেব দাও, পত্তর দাও, ধান নিয়ে মাহাতোর সঙ্গে লাঠালাঠি। বাপের গোয়ালে ধুঁয়ো দিয়ে বেশ তো এতদিন কাটল। জমিজমা যদি চলে যায় কী খাব বল তো? পড়াশুনোও তো আর করলাম না। একদম না খেয়ে মরব।

সমীর ওকে আশ্বস্ত করে বলল, আরে যাবে না, যাবে না।

যাবে রে দোস্ত, সব যাবে। আর শালা যাওয়াই উচিত। বাবা তো এম এ, ল পাস করে সারাজীবন নড়ে বসল না, বাইরের ঘরে বসে শুধু সিগারেট খেল আর খবরের কাগজে লেটারস টু দি এডিটরস কলামে চিঠি লিখল। আমি তো বাবারই ছেলে বল? এখন কি আর জোতদারি করার দিন আছে বসে বসে? ভবিষ্যৎ যখন ভাবি তখন একেবারে অন্ধকার দেখি বুঝলি সমীর? এমন করে বাঁচার কোনো মানে নেই।

সমীর ঘড়িতে একটা নতুন ব্যাণ্ড লাগানো শেষ করে ঘড়িটা কাউন্টারের ওপর রাখল। বলল, কই তোর চা এল?

ওই তো আনছে। বলল অতুল। ওরা দুজনে একসঙ্গে চোখ তুলে দেখল ছেলেটা দু-হাতে দু-কাপ চা নিয়ে আসছে।

অতুল বলল, নে চা খা। তার পর বলল তোর ব্যাণ্ডের দাম কত?

সমীর অনেকক্ষণ চুপ করে রইল। ওর ইচ্ছে করে না, বন্ধু-বান্ধব, চেনা পরিচিত কারো কাছ থেকে দাম নিতে। অতুলের সঙ্গে ও স্কুলে পড়েছে, কলেজে পড়েছে।

অতুল বলল, কী রে? তুই কি দাতব্য চিকিৎসালয় খুলেছিস? খদ্দের তো দিনে একটা কি দুটোই আসে। তাও যদি তাদের কাছ থেকে পয়সা না নিস, চলবে কী করে?

সমীর বলল, পয়সা তো নিই। আর চলে একরকম করে যাচ্ছেই। সংসার তো মা আর ছেলের। ভালো করে নাই বা চলল।

হঠাৎ অতুল বলল, হ্যাঁরে সমীর, মাসিমা কেমন আছেন?

সমীর বলল, ভালো।

অনেকদিন থেকে ভাবছি একবার যাব যাব তোদের বাড়ি, যাওয়া আর হয়ে ওঠে না। জ্যাঠামণিদের সঙ্গে অতসী কলকাতা থেকে ফিরলেই একদিন যাব।

সমীর বলল, অতসী কেমন আছে রে? ওর বর ভালো আছে?

ভালোই আছে। বেশ ভালো আছে। তুই তো বহুদিন দেখিস না ওকে? না?

ব-হু-দি-ন, টেনে টেনে বলল সমীর। প্রায় দু-বছর হতে চলল। ও মাঝে বিয়ের পর পর যখন এসেছিল তখন আমি পাটনা গেছিলাম বাবাকে ডাক্তার দেখাতে। ও এলে একদিন ওকে আসতে বলিস। মা খুব খুশি হবেন।

আর তুই? চোখ নাচিয়ে অতুল বলল।

সমীর ওর চশমাপরা চোখ দুটো তুলে অনেকক্ষণ অতুলের চোখের দিকে চেয়ে রইল। যেন বুঝতে চাইল ও কী বলতে চাইছে। তার পর চোখ নামিয়ে বলল, আমিও হব।

অতুল উঠল, বলল, নে এই টাকাটা রাখ বলে একটা পাঁচ টাকার নোট সমীরের দিকে এগিয়ে দিল। বলল, পরে এসে ব্যালান্স নিয়ে যাব।

সমীর বলল, না, না এক্ষুনি নিয়ে যা। তুই কবে আবার আসবি এদিকে ঠিক কী?

অতুল হাত বাড়াল। সমীর অন্য দিকে চেয়ে মুঠিবদ্ধ করে নোট ও খুচরো অতুলের হাতে ভরে দিল। অতুলও সেদিকে না তাকিয়ে মুঠিবদ্ধ হাত পকেটে চালান করে দিল। ওদের সম্পর্ক যে টাকা-পয়সা এসে নষ্ট করে দেবে তা ওদের দুজনের কেউই হতে দিতে চায় না। কত দাম, সমীর কত দিল, অতুল কত নিল তা ওদের দুজনের কেউ খুলে বলল না, চোখে দেখল না।

অতুল পথে পা বাড়াল।

অতুল চলে গেলে সমীর আবার বসে রইল দোকানে একা একা। সমীর ভাবল, জীবনের সমস্ত সম্পর্ক থেকেই টাকা জিনিসটাকে আড়াল করে রাখা সম্ভব হলে কী ভালোই না হত।

পথে আস্তে আস্তে ভিড় বাড়তে লাগল। স্কুলে, কলেজে, কোর্টে-কাছারিতে লোকজন ছুটতে লাগল। সেই প্রবহমান জনস্রোতের দিকে উদ্দেশ্যহীনভাবে চেয়ে থাকতে থাকতে সমীরের অনেক পুরোনো কথা মনে হতে লাগল। অতসীর কথা।

চায়ের দোকানের ছোকরাটা এসে চায়ের দাম নিয়ে গেল। কাপগুলো তুলে নিয়ে গেল। কলেজের কয়েকটা ছেলে ইতিমধ্যেই সে দোকানের চেয়ার-টেবিল দখল করে বসেছে। অনর্গল সিগারেট খাচ্ছে। কারো সামনে চা, কারও টেবিল শূন্য। ফলে, অনেক খরিদ্দার এসে বসবার জায়গা না পেয়ে ফিরে যাচ্ছে। গতকাল বিকেলে একদল ছেলে দোকানে এসে চা ও কচুরি খেয়ে পয়সা না দিয়ে চলে গেছে। দোকানের মালিক পান্ডেজি ভয়ে কিছু বলতে পারেননি। কিছু বললে দোকান লুঠ হবার ভয় আছে। আশ্চর্য। অথচ দোকানের মালিক জগদানন্দ পান্ডে ছোটোবেলায় এ অঞ্চলের সবচাইতে নামকরা পালোয়ান ছিল। এখনও সে ইচ্ছা করলে কুড়িটা কলেজের ছেলে একা মেরে শুইয়ে দিতে পারে। অথচ তবু কাল বিকেলে সে কিছু বলেনি। শুধু ছেলেদের মধ্যে যে সর্দার গোছের তাকে বলেছিল, ই ঠিক নেই হ্যায় বাবু। ছেলেটা ঝাঁকড়া চুলের ঘাড় ঘুরিয়ে হেসেছিল, বলেছিল সব ঠিক্কে হ্যায়। তার পর পান্ডেজির টেবিলের ওপর রাখা কিছু মশলা খেয়ে ও ছড়িয়ে সাইকেলে চড়ে ওরা দল বেঁধে ক্রিং ক্রিং করে চলে গেছিল।

সমীর বসে দেখেছিল ও ভেবেছিল, পান্ডেজির ভয়টা ওর নিজের শরীরের ভয় নয়—মার দিতে বা মার খেতে সে ভয় পাবার লোক নয়। কিন্তু তার দোকান, তার থরে থরে সাজানো মিষ্টি, তার এতদিনের পরিশ্রমে গড়ে তোলা গুডউইল—সাইনবোর্ডের ওপর লালের ওপর কালোতে বড়ো বড়ো করে লেখা ‘পান্ডে-সুইটস’—সব কিছু নষ্ট হয়ে যাবার ভয় ছিল—একটা মারামারি—কেলেঙ্কারিতে। সমীর চশমার কাচ মুছতে মুছতে ভেবেছিল, মানুষের হারাবার ভয় থাকলে তাকে কিছু বলার বা করার আগে অনেক কিছু ভাবতে হয়। মাথা উঁচু করে বেঁচে থাকতে হলে আবার নিরন্তর মাথা নীচু করেও থাকতে হয়। অনুক্ষণ ছোটো হতে হয়, অন্যায়, অত্যাচার অনেক সহ্য করতে হয়। তবু বেঁচে থাকতে হয়, বেঁচে থাকার জন্যে।

ও-ও তো বেঁচে আছে। ওর সম্পত্তি নেই। ঘর দোকানে কোনো খরিদ্দার নেই, ওর কোনো ভবিষ্যতের আশা নেই। ওর বুকে কারো ভালোবাসা নেই। যাকে ও ভালোবেসেছিল, ওর সর্বস্বতা দিয়ে, সে তাকে প্রতিমুহূর্তে অপমান করে, অসম্মান করে ওকে পায়ে দলে চলে গেছে। তবু ও বেঁচে আছে। তবুও বেঁচে থাকতে হয়। দিনের শেষে মা-ছেলেতে দু-মুঠো খেয়ে শুয়ে পড়ার জন্যে। লাইব্রেরি থেকে কোনো বই এনে সেই বইয়ের শুকনো পাতার খনি খুঁড়ে সোনা আবিষ্কার করার জন্যে। অন্ধকার রাতের তারা-ভরা আকাশের অসীম নিস্তব্ধ দুর্জ্ঞেয়তার মধ্যে জীবনের মানে খোঁজার জন্যে। ও তবু এমনি করেই বেঁচে আছে, যদিও ওর নতুন করে কিছু হারানোর ভয় নেই।

কিন্তু এ কি বাঁচা? সমীর অনেকদিন বোঝবার চেষ্টা করেছে একজন পুরুষ কেন বাঁচে। সে কি শুধু লেখাপড়া করে, টাই পরে অফিস যাবার জন্যেই, একটা বিয়ে করার জন্যেই, শুধু বুড়ো হয়ে রিটায়ার করে হঠাৎ সেরিব্রাল কি করোনারি থ্রম্বোসিসে মরে যাবার জন্যেই কি বাঁচে? কেউ কেরানি হয় জীবনে, কেউ বড়োসাহেব হয়, কেউ পিওন হয়, কেউ ইণ্ডাস্ট্রিয়ালিস্ট হয়, কেউ-বা তার মতো ছোটো দোকানদার হয়—কিন্তু শুধু এইটুকু হওয়ার জন্যে বা করার জন্যেই কি মানুষ বেঁচে থাকে? এই অনুক্ষণ সরীসৃপের মতো নির্জীব হয়ে, অন্যনির্দিষ্ট পথে জীবনের বছর, মাস, দিনগুলো এক এক করে শেষ করার জন্যে, যৌবনে ঘুস খেয়ে শেষজীবনে হরিনাম করার জন্যেই কি মানুষ বেঁচে থাকে?

সমীর কিছুতেই বুঝতে পারে না মানুষ কেন বাঁচে? এত লক্ষ লক্ষ কোটি কোটি পুরুষমানুষ কেন বেঁচে আছে? কেন কলের পুতুলের মতো লম্ফঝম্ফ করছে? উকিলেরা কেন কালো কোট পরে হাত নাড়ছে, রিকশাওয়ালা, বেশ্যার দালাল কেন অনুক্ষণ রিকশার ঘণ্টা বাজাচ্ছে? কেন ছাত্রেরা বই টুকে পরীক্ষা পাস করছে? কেন রাজনীতিকরা সর্বক্ষণ তাদের ভোটদাতাদের মর্মান্তিকভাবে ঠকাচ্ছে? কেন? কেন? কেন?

কারণ একটা নিশ্চয়ই আছে, এই কেনর একটা উত্তর হয়তো কোথাও না কোথাও নিশ্চয়ই লুকিয়ে আছে। কোনো একটা বোধ, চেতনায় কোনো একটা জাগরণের ঢেউ, কিছু একটা কোথাও নিশ্চয়ই আছে। নিজের বুকের মধ্যে, কি মুষ্টিবদ্ধ হাতের মধ্যে, কি কানের পাশের শিরার দপদপানির মধ্যে; যা ওকে একদিন জানিয়ে দেবে, বুঝিয়ে দেবে, একজন পুরুষ কী নিয়ে বাঁচে, কীসের জন্যে বাঁচে।

সমীর খুব ভাবে। হয়তো দোকানে ওর একা একা বসে থাকতে হয় ঘণ্টার পর ঘণ্টা সেজন্যেই এই ভাবনার রোগ ওর মাথায় ঢুকেছে। তবু, ও ভাবে। ও একা থাকতে ভালোবাসে। ওর মনে হয় ও নিজেকে নিয়ে সম্পূর্ণ। ওর কোনো পরিপূরকের দরকার নেই জীবনে। কোনো বন্ধুর উচ্চ হাসি, কোনো মেয়ের ভালোবাসার নরম হাত, কোনো ভগবানের আশীর্বাদ। কিছুতেই ওর প্রয়োজন নেই। ও এমনি একা একা ভেবেই সারাটা জীবন কাটিয়ে দিতে চায়, জীবনের মানে খুঁজে।

ও কেবলই ভাবে, পুরুষের কর্মজীবনের কতগুলি মুহূর্তে তারা সত্যিকারের বাঁচে। নি:শ্বাস ফেলার নামই কি বাঁচা? পেট ভরে খাওয়ার নামই কি বাঁচা? যেকোনো মেয়েকে বুকের মধ্যে জড়িয়ে ধরার আরেক নামই কি বাঁচা? ঠাকুরের মন্দির, খেলার মাঠ, অফিসের টেবিল, সাংসারিক পটভূমি, মেয়ের বিয়ের ভাবনা, এইসব খন্ড খন্ড, টুকরো টুকরো বুটি বসানো জীবনের একঘেঁয়ে ধূসর রঙের শাড়ির মধ্যে কোন জায়গায় একজন পুরুষ সত্যিকারের বাঁচে? কোন মুহূর্তটিতে সে সবচেয়ে বেশি করে বাঁচে?

সমীর ভাবে, মুখ নীচু করে ঘড়ির ব্যাণ্ড বদলাতে বদলাতে, সাইকেলরিকশার প্যাঁকপ্যাকানি শুনতে শুনতে, ওর দোকানের ভাঙা চেয়ারটার ছারপোকার কামড়ে নড়েচড়ে বসতে বসতেই একদিন ওর বোধিলাভ হবে। একদিন ও জানতে পারবেই একজন পুরুষ কেন বাঁচে।



অতসীরা পরশু এসেছে। অতসীর বর আসেনি। অতসীর বর এক ওষুধের কোম্পানিতে বড়ো চাকরি করে। অতসীর বর, চেহারা, শিক্ষা, বংশপরিচয়, চাকরি সমস্ত বিষয়েই প্রতিসাবজেক্টে এবং এগ্রিগেটে সমীরকে মর্মান্তিকভাবে হারিয়ে দিয়েছে। এইজন্যেই বোধ হয় সমীর অতসীকে হারানোর দুঃখটা সহন করে নিয়েছিল বিধাতার আমাঘ বিধান হিসেবে। সমীর জানত, অতসীকে দেবার মতো সমীরের কিছুই ছিল না। শুধু রক্তজবার মতো নির্ভেজাল হৃদয়-উপড়ানো নি:শেষে সমর্পিত এক অবিশ্বাস্য ভালোবাসা ছাড়া। কিন্তু ভালোবাসার নিজের তো কোনো দাম নেই। ভালোবাসার দাম কেউ দেয় না। টাকার মতো। বদলে কিছু বিনিময় করার থাকলে, পাবার থাকলেই ভালোবাসা দেওয়া চলে। যেখানে প্রতিদানে কিছু পাবার নেই, সেখানে কেউ মিছিমিছি ভালোবাসা খরচ করে না। বিশেষ করে অতসীরা।

অতসী কাল বাড়িতে এসেছিল। দুপুরবেলা। কাল রবিবার ছিল। সমীরের মায়ের সঙ্গে অতসী গল্প-টল্প করল। মা ধনেপাতা-কাঁচালঙ্কা দিয়ে চালতা মেখেছিলেন। অতসী উঠোনের রোদে পিঠ দিয়ে বসে মায়ের সঙ্গে গল্প করতে করতে মাঝে মাঝে টাগরায় জিভ দিয়ে টাক টাক শব্দ করতে করতে চোখ-মুখ নাচিয়ে চালতা-মাখা খেল। সমীরের ঘরের জানালা দিয়ে সমীর দূর থেকে ওকে দেখছিল। এমন সময়ে পাশের বাড়ির রবির মা, মাসিমা আসাতে অতসী বলল, মাসিমা আপনারা গল্প করুন, আমি সমীরদার ঘরে যাচ্ছি—একটু গল্প করে আসি।

সমীর ঘরে বসেছিল। একটা পুরোনো খাট। মাদুর পাতা। বিছানাটা বালিশ-লেপসুদ্ধু গোটানো ছিল মাথার কাছে। সমীর ওর নড়বড়ে টেবিলটার সামনে বসেছিল। একটা বই সামনে নিয়ে। বইয়ে ওর মন ছিল না। জানালা দিয়ে ম্লান রোদ এসে ঘরে পড়ে ছিল। বাইরের সেগুনগাছের বড়ো বড়ো পাতাগুলোতে পেছন দিক থেকে রোদ পড়ায় পাতাগুলোকে লালচে দেখাচ্ছিল। রবিদের বাড়ির কুয়োতলায় কেউ জল তুলছিল। লাটাখাম্বা উঠছিল নামছিল। ক্যাঁচ-কোঁচ শব্দ হচ্ছিল। কতগুলো শালিক জানালার পাশে বসে কিচির-মিচির করছিল। এখন সময়ে অতসী ভেজানো দরজা ঠেলে সমীরের ঘরে ঢুকল।

অতসী আগের থেকে অনেক সুন্দরী হয়েছে। জল-খাওয়া মাধবীলতার মতো ওর মধ্যে একটা সবুজ ফুল ফলন্ত ভাব এসেছে। এমনিতে সুন্দরী বলতে যা বোঝায় তা অতসী নয়। কিন্তু সমীরের চোখে পৃথিবীতে অত সুন্দর আর কিছু ছিল না, কোনো হলুদ-বসন্ত পাখি, কোনো বসন্তের সকাল, কোনো উড়ন্ত প্রজাপতি, কিছুর সঙ্গেই ও অতসীর তুলনা খুঁজে পেত না। ওর হাঁটা, চলা, ওর কথা বলা, অতসীর হাসি, অতসীর সাজগোজ, অতসীর মিষ্টি ব্যবহার সবকিছু সমীরের চোখে সৌন্দর্যের সংজ্ঞা বলে মনে হত। বরাবর বরাবর।

অতসী বলল, কী করছিলে? ঘাড় গুঁজে?

এই একটা বই দেখছিলাম, সমীর বলল।

তুমি কেমন আছ? অতসী বলল।

ভালোই আছি। তুমি কেমন আছ?

দেখে কী মনে হচ্ছে?

সমীর জবাব দিল না।

অতসীর চোখে-মুখে একটা অবজ্ঞা, একটা তাচ্ছিল্য ফুটে উঠেছিল সমীরের প্রতি। অতসী দারুণ ভালো আছে একথাটা যে জিজ্ঞাসার অপেক্ষা রাখে, একথা ভেবে অতসী যেন বিরক্ত হচ্ছিল।

অতসী বলল, কী? দেখে কি খারাপ মনে হচ্ছে?

সমীর হাসল। বলল, তা তো বলিনি। দু-বছর পর তোমার সঙ্গে দেখা হল। তুমি কি ঝগড়া করবে বলে মনস্থির করে এসেছ?

কীসের ঝগড়া তোমার সঙ্গে? সেবারে যখন এলাম তখন তো তুমি এখানে ছিলেই না। ওর সঙ্গে আলাপ হত।

সমীর মুখ নীচু করে হাসল। বলল, আলাপ না হলেও তোমার স্বামীর সম্বন্ধে সব কিছু শুনেছি। তোমার মতো মেয়েকে যে পেয়েছে সে তো ভালো হবেই। তার প্রশংসায় সকলে পঞ্চমুখ।

এই আর কী? প্রশংসা-ফ্রশংসা বাজে—তবে ভালোই। বলে বাঁকা চোখে সমীরের দিকে একবার তাকাল। তার পর হঠাৎ ওর হাতব্যাগ খুলে সমীরকে একটা খাম দিল।

সমীর বলল, এটা কী?

অতসী বলল, এতে তোমার চিঠি আছে। সত্যি, সমীরদা তোমার কি কোনো সেন্স নেই? বিয়ের পরও তুমি কী বলে আমাকে চিঠি লিখতে গেলে? আমি তো লজ্জায় মরি। একটা চিঠি তো ও খুলেই ফেলেছিল; পড়ল। তবে ও খুব মডার্ন। তাই কোনোরকমে ম্যানেজ করেছি। যদি ও না বুঝত তাহলে আমার কতখানি ক্ষতি হত বলো তো?

সমীর বলল, বোকার মতো, তোমার কোনোই ক্ষতি করতে চাইনি আমি অতসী। তা ছাড়া কারো বিয়ে হলেই যে তার সঙ্গে সমস্ত সম্পর্ক, সমস্ত যোগাযোগ শেষ হয়ে যায়, একথাটা তখনও আমি নিজেকে বোঝাতে পারিনি।

অতসী বেড়ালনির মতো ফুঁসিয়ে উঠে বলল, তুমি নিজেকে কোনোদিনও তা বোঝাতে পারবে না, কিন্তু আমার সব কথা বলতে হল ওকে।

সমীর চমকে উঠল, বলল, কী কথা?

সে নাই শুনলে।

না, না, বলোই না, কী কথা?

সব কথা। তুমি কী ধরনের লোক, তুমি কী করো, বিয়ের আগে তুমি কতভাবে কতদিন আমাকে বিরক্ত করেছ। তুমি নিজেকে কী মনে করো সত্যিই আমি জানি না। তুমি কী করে কল্পনা করতে পারলে যে তোমাকে আমি ভুলে যাব না। সত্যি সমীরদা তোমার মতো নাছোড়বান্দা লোক আমি দেখিনি। তোমার মাথায় কী আছে তুমিই জানো।

সমীর বাধো বাধো গলায় বলল, তোমার বিয়ের পর তোমাকে মাত্র দুটো চিঠি পাঠিয়েছিলাম অতসী, তার পর তো আর লিখিনি। আর হয়তো পাঠাবও না কোনোদিন। হয়তো চেষ্টা করলেও পারব না! ওই দুটোও পাঠাতাম না। তুমি হয়তো বিশ্বাস করবে না, কত চিঠি আমি লিখে ছিঁড়ে ফেলেছি, কত চিঠি এখনও লিখি এবং ছিঁড়ে ফেলি। রোজ রোজ।

তোমার কথা ভাবলেই, তোমার কথা মনে পড়লেই আমার ভেতরে যে-যন্ত্রণা হয় তার একটা প্রকাশ না থাকলে আমি বোধ হয় পাগল হয়ে যেতাম। তুমি কিছু মনে কোরো না। তোমাকে বিয়ের পর কোনোভাবেই বিব্রত করতে চাইনি আমি। বিশ্বাস করো, তোমাকে আমি সব সময়ে ভুলে যেতে চাই, নিজেকে সব সময়ে আমি কত বকি, কত মারি, ভুলে যাওয়ার চেষ্টা করি, তবু……।

কিছুক্ষণ চুপ করে রইল সমীর। আগের কথা শেষ করতে পারল না। তার পর সমীর ওর টেবিলের ড্রয়ার টেনে বের করে, ভেতর থেকে একটি খাম বের করল। তারমধ্যে অতসীর দুটি ছবি ছিল। একটি রাঁচির স্টুডিয়োতে তোলা, অন্যটি ‘সিসরামা’ ফলস-এর পাশে একটি গাছের নীচে দাঁড়ানো ছবি। ওরা পিকনিকে গিয়ে তুলেছিল। তখন অতসী কলেজে পড়ত। চোখে সানগ্লাস পরে ছিল অতসী। সমীর বলেছিল, সবসময়ে বলত, তুমি সানগ্লাস পোরো না, তোমার চোখ দেখতে পাই না তাহলে। অতসী হাসত, বলত, থাক বেশি দেখো না।

সমীর বলল, আমি তোমার এই ছবি দুটো দেখি, মাঝে মাঝে, যখন একা থাকি। একাই তো থাকি। মনে মনে তোমার সঙ্গে কথা বলি, তোমাকে চিঠি লিখি। তোমাকে আমি শুধু এইভাবেই বিব্রত করি।

দেখি, দেখি, অতসী বলল, ছবিগুলো দেখি একবার, বলেই হাত বাড়িয়ে ছবিদুটো নিয়েই হঠাৎ কুচি কুচি করে ছিঁড়ে ফেলল। ছিঁড়ে জানলা গলিয়ে ফেলে দিল বাইরে।

সমীর ফ্যাকাশে মুখে চেয়ার ছেড়ে উঠে দাঁড়াল। বলল, এর কি খুব দরকার ছিল? ছবিগুলো ছিঁড়ে তোমার কী লাভ হল? তোমার এই ছবি দুটো ছাড়া আমার কাছে তোমার তো আর কোনো চিহ্ন ছিল না।

অতসী জানলা থেকে সরে এসে খাটটায় বসল। বলল, ঢং। এইসব ন্যাকামি আমার ভালো লাগে না।

‘ন্যাকামি’ বা ‘ঢং’ বলতে কী বোঝাতে চায় অতসী, সমীর তা বুঝল না। সমীরের চোখে, সমীরের মনে অতসী বরাবরের মতো আঁকা হয়ে গেছিল। তাকে কিছুতে মুছে ফেলা সম্ভব ছিল না তার পক্ষে। ছোটোবেলার মহুয়ার গন্ধ, ভোরের রোদ্দুর, খুশির দুপুরের শালপাতা-ওড়া হাওয়ার স্মৃতির সঙ্গে অতসীর স্মৃতি একাত্ম হয়ে গেছিল চিরকালের জন্য। সমীরের মনে আছে, অতসী যখন কলেজে পড়ত এখানে তখন সমীরকে প্রায় রোজই ভোরবেলা সাইকেল চালিয়ে মহিলাসমিতির সেক্রেটারির বাড়ি মায়ের হাতের কাজ পৌঁছে দিতে যেতে হত। অতসীদের বাড়ির পাশ দিয়ে কতকগুলোমেহগিনি গাছের সারির মধ্যে মধ্যে পথ ছিল। ও যখন ভোরে ওদের বাড়ির পাশ দিয়ে যেত তখন অতসী ঘুমিয়ে থাকত। সমীর মনে মনে অতসীকে রোজ দেখতে পেত, গুঁড়িশুঁড়ি হয়ে সে ঘুমিয়ে আছে। ওর মিষ্টি ঘুমন্ত মুখটিতে পৃথিবীর সমস্ত শান্তি বাসা বেঁধেছে। সাইকেল চালাতে চালাতে ভোরের বাতাস লাগত গায়ে, আর সমীরের মনে হত, ওর দুটি হাতে যত শক্তি আছে, ওর মস্তিষ্কে যতটুকু মেধা আছে, ওর বুকে যতটুকু ভালোত্ব আছে, সব দিয়ে ও অতসীকে পৃথিবীর সমস্ত রোদ, সমস্ত দুঃখ, সমস্ত অশান্তি থেকে আড়াল করে রাখবে এজীবনে। ওকে চিরদিন এমনি করে ও আবেশে, আরামে ও আশ্লেষে ঘুমোতে দেবে। সেইসব সকালে, অতসীর মুখ, তার হাসি, তার গলার স্বর শরতের হাওয়ার মতো এসে সমীরের সমস্ত সত্তাকে একটি ভোরের শিউলি গাছের মতো নাড়া দিয়ে যেত। ভালো লাগার ফুল ঝরত ঝরঝরিয়ে—ভালোলাগায় সমীর কেঁপে কেঁপে উঠত। অথচ, এ জীবনে সমীরের হাত দুটো অতসীর জন্যে কিছুই করতে পারল না। তার বুকের সমস্তটুকু ভালোত্ব বিফলেই ও বয়ে বেড়াল।

অতসীর এই ছবি দুটি বুকে করে রেখেছিল ও এতদিন। ওর দারিদ্র্য, ওর দোকানের দৈন্য, ওর সামান্যতার কালি, ওর সমস্ত কিছু দুঃখ, মাঝে মাঝে এই ছবি দুটির দিকে চেয়ে ও সেই ছোটোবেলার, শিউলিফুলের গন্ধভরা কমলা-রঙা ভালোলাগা দিয়ে ভরিয়ে দিত।

সমীর কী বলবে ভেবে পেল না। জানালার কাছে গিয়ে মুখ নীচু করে দাঁড়াল। অতসীও অনেকক্ষণ কোনো কথা বলল না।

সমীর চুপ করে জানলা দিয়ে বাইরে চেয়ে রইল।

বেলা পড়ে আসছিল। লাল ধুলোর রাস্তায় মাঝে মাঝে সাইকেলের ক্রিং ক্রিং শোনা যাচ্ছিল। রিফর্মেটরির মাঠ থেকে তিতিরগুলো সব একসঙ্গে টিঁউ টিঁউ টিঁউ করে ডাকছিল। সিঁদুর গাঁয়ের দেহাতি মেয়েদের হাট-ফিরতি গলা শোনা যাচ্ছিল ছায়াঢাকা পথে। শীতের বিকেলের বিষণ্ণ শীতার্ত শান্তি সমীরের ঘর এবং বাইরের প্রকৃতি ভরে ছিল। রবিদের বাড়ির কুয়োর লাটাখাম্বা উঠছিল নামছিল। শব্দ হচ্ছিল ক্যাঁচোর কোঁচোর, কোঁচোর ক্যাঁচোর। ধীরে ধীরে ঘরের মধ্যে বাইরের ছায়ার অন্ধকার এগিয়ে আসছিল।

সমীর হঠাৎ বলে উঠল, অতসী, একবার আমার কাছে এসো, কতদিন তোমাকে কাছ থেকে দেখিনি। সমীর অনেক চেষ্টা করে কথা ক-টি বলল।

অতসী রূঢ় গলায় বলল, না।

না, কেন? সমীর শুধোল। ওর গলায় মিনতির সুর বাজল, কেন না?

অতসী বলল, তোমাকে আমি বিশ্বাস করি না।

সমীর মুখ নীচু করে ভারী গলায় বলল, এতদিনে তুমি আমাকে এই চিনলে?

অতসী বলল, তোমাকে আমি ভালো করেই চিনি। হাড়ে হাড়ে চিনি। এক নিষ্ঠুর হিমেল হাসি অতসীর মুখে লেগে রইল। ওর চোখের দৃষ্টি সমীরের মুখের ওপর স্থির হয়ে রইল।

একটু পরেই অতসী বলল, আমি এবার যাব। বলে আর কথা না বলে অতসী ঘর থেকে উঠে চলে গেল।

সমীর কয়েক মুহূর্ত একা একা বসে রইল। তার পরই জানলার কাছে দৌড়ে গেল। অতসী কাছে এল, তবু তাকে মন ভরে, চোখ ভরে দেখা হল না। তাই যতক্ষণ তাকে দেখা যায় দেখবে ভেবে, সমীর জানালায় দাঁড়িয়ে রইল।

অতসী বাইরের দরজা দিয়ে বেরিয়ে মার ঘরের পাশ দিয়ে হেঁটে আসছিল। জানালার পাশ দিয়ে হেঁটে যেতে যেতে জানালাটা প্রায় অতিক্রম করে যাওয়ার সময়ে হঠাৎ অতসীর চোখ পড়ল সমীরের দিকে। অতসী দাঁড়িয়ে পড়ল। সেই সায়ান্ধকারে অতসীর পাশ ফেরানো মুখের দিকে মুগ্ধদৃষ্টিতে তাকাল সমীর। অতসী কী যেন ভেবে একেবারে জানালার কাছে চলে এল, তার পর নীচু গলায় বলল, একটা কথা বলব? মনোযোগ দিয়ে শুনবে?

সমীর চশমাটা খুলে রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে বলল, বলো।

অতসী ঘৃণার মুখে বলল, বাজারের যে-গলিতে মেয়েরা নির্বিচারে ভালোবাসা বিকোয় তাদের কাছে যাও না কেন? গেলেই পারো? বলেই অতসী চলে গেল।

সমীর চশমাটা খুলে ফেলেছিল, সমীর চোখে কিছু দেখতে পাচ্ছিল না। সব ঝাপসা। সব অন্ধকার। সামনে, পেছনে চতুর্দিকে। ঘরের মধ্যে অন্ধকার, ঘরের বাইরে অন্ধকার; সব অন্ধকার।

সায়ান্ধকার পাখি-ওড়া আকাশে, সার্কিট হাউসের রাস্তার পত্রশূন্য বড়ো বড়ো গাছগুলো আকাশের দিকে প্রচন্ড প্রাচীন হাত তুলে কী যেন ভিক্ষা চাইছিল। একজোড়া বাদুড় ডানা ঝটপটিয়ে মাথার ওপর দিয়ে উড়ে গেল। সমীর হাঁটতে হাঁটতে হাসল একবার। সমীরের হঠাৎ মনে হল, ও যেন বুঝতে পেল একজন পুরুষ কীসে বাঁচে।

টাটিঝামা পাহাড়ের নীচে অন্ধকার ছমছম করছিল। সমীর আস্তে আস্তে সেই গাছটার নীচে গিয়ে দাঁড়াল। আড়াই বছর আগে এই গাছের নীচে সমীর অতসীকে একমুহূর্তের জন্যে বুকে পেয়েছিল, একলহমার জন্যে তার ঠোঁট নিজের ঠোঁটে শুষে নিয়েছিল, তার চোখের পাতায়, তার গলায় চুমু খেয়েছিল।

সমীর অনেকক্ষণ চুপ করে পাহাড়তলির অন্ধকারে দাঁড়িয়ে থাকল। মাথাটা খুব পরিষ্কার করে ভাবার চেষ্টা করল। অতসীকে ক্ষমা করার চেষ্টা করল। যেখানে দাঁড়িয়ে, একজনকে একদিন বুকের মধ্যে আদরে জড়িয়ে ধরতে পেরে ওর শরীরের সমস্ত অণু-পরমাণু ভালোলাগায় শিরশির করে উঠেছিল, ওর মনের মনিহারি দোকানের সব ক-টি ফ্লুরোসেন্ট আলো যে-মুহূর্তে একসঙ্গে দপদপ করে জ্বলে উঠেছিল—সেখানে দাঁড়িয়ে ও অতসীকে ক্ষমা করে দিল—সমীর মনে মনে বলল, অতসী, একজনকে তুমি বাঁচাতে পারতে। তুমি যাকে বাঁচতে দাওনি তার জন্য বাজারের গলি নয়। সেখানে শুধুই তার-ছেঁড়া তানপুরা আর ফেঁসে-যাওয়া তবলার ভিড়। সেখানে কোনো সুর নেই, সেখানে কোনো বাঁচার অনুপ্রেরণা নেই; তোমার মতো কোনো সুরেলা দিলরুবা সেখানে তার জন্যে কেউ সাজিয়ে রাখেনি।

সমীর অন্ধকারের মধ্যে পাহাড়কে শুনিয়ে স্পষ্ট গলায় জোরে জোরে বলল, অতসী তুমি আমাকে একমুহূর্তের জন্যে বাঁচতে দিয়েছিলে এইখানে, সেজন্যে আমি তোমার কাছে কৃতজ্ঞ আছি। এবং থাকব। একদিন, এক সময়ে, একমুহূর্তের জন্যে আমি বেঁচেছিলাম এইখানে। সমীর গাছটার গায়ে হাত বোলাতে বিড় বিড় করে বলতে লাগল, আমি বেঁচেছিলাম এখানে। আমি একমুহূর্তের জন্য বেঁচেছিলাম।

অনেকক্ষণ পর একা একা টাটিঝামা পাহাড়ের নীচ থেকে ডি এস পি -র বাড়ির পাশের নির্জন রাস্তা ধরে সমীর বাড়ি ফিরে এল।

বাড়ি ফিরতেই মা বললেন, অতসী একটা চিঠি পাঠিয়েছে।

সমীর চিঠিটা খুলল। দেখল খামের মধ্যে চিঠির সঙ্গে অতসী একটা ছবি পাঠিয়েছে, লিখেছে, তোমার জন্যে আমার একটি ছবি পাঠালাম। ছবিটি পোস্ট-কার্ড সাইজের। কলকাতার কোনো ভালো স্টুডিয়োতে তোলা। অতসী ও অতসীর বর পাশাপাশি দাঁড়িয়ে আছে। একটু চালিয়াত চালিয়াত হলেও বেশ ভালো দেখতে ভদ্রলোককে।

লণ্ঠনের আলোয় অনেকক্ষণ একদৃষ্টে ছবিটা দেখল সমীর। কিছুক্ষণ পর আবার একবার দেখল। তার পর কাঁচি দিয়ে অতসীর নিজের ছবিটা আলাদা করে কেটে ফেলল, এবং ওর সর্বগুণসম্পন্ন সুরূপ বরের ছবিটা কুচি কুচি করে ছিঁড়ে বাইরে ফেলে দিল। বাইরে তখন গাছ-পাতা থেকে হিম পড়ছে, ফিস ফিস। বোবা-অন্ধকারে গোঙানির মতো ঝিঁ ঝি ডাকছে—ঝিঁঝির, ঝিঁঝির। গাছে, গাছে, পথের পাশে। ঝিঁ ঝি ডাকছে কুয়োতলায়, তখন ঝিঁ ঝি ডাকছে মনের মধ্যে। তখন মনের মধ্যে শিশির পড়ছে, দারুণ শীত, ফিস-ফিস ফিস-ফিস।

সেদিন দোকানে যেতে দেরি হয়ে গেছিল সমীরের। কাল সন্ধেবেলায় পাহাড়ের নীচে সেই গাছের তলায় দাঁড়িয়ে যেমন ভালো লেগেছিল ওর, আজ সকাল হওয়ার পর থেকে তেমনি খারাপ লাগছে। ও যেন এতদিন জানত না যে, ও বেঁচে নেই। কাল সন্ধেবেলা অতসীর নিষ্ঠুর শীতলতায় তাড়িত হয়ে যদি-না সেই গাছের কাছে যেত, যদি না ওর মনে পড়ত ও এক সময়ে একদিন, একটি উষ্ণ জীবন্তমুহূর্তে ভীষণ জীবন্তভাবে বেঁচেছিল, তবে হয়তো ও, ওর প্রতিমুহূর্তের বিফল মৃত্যু সম্বন্ধে এমন সচেতন হয়ে উঠত না।

ও এতদিন ভাবত, বোঝবার চেষ্টা করত যে, মানুষ কীসে বাঁচে, কখন বাঁচে, কেন বাঁচে, কী নিয়ে বাঁচে, কতটুকু বাঁচে, কিন্তু আগে ওর কখনো মনে হয়নি যে, ও নিজে অমন নিশ্চিন্তভাবে মরে আছে।

কলেজের সময় হয়েছে। ছেলে-মেয়েরা কলেজের দিকে চলেছে। কেউ সাইকেলে, কেউ রিকশায়, কেউ হেঁটে। কোর্ট-কাছারির ভিড়ও শুরু হয়েছে। পথের দিকে তাকিয়ে বসে থাকতে থাকতে ওর শীত শীত করতে লাগল! ইচ্ছে হল এককাপ চা খায়। পান্ডেজির দোকানের ছেলেটিকে চায়ের জন্যে হাঁক দিল।

একটু পরেই, ছেলেটি যখন চা নিয়ে ওর দোকানের দিকে আসছিল এমন সময়ে কান্ডটা ঘটল। মেয়ে দুটি কলেজের দিকে হেঁটে যাচ্ছিল। একটু আগে ওরা ওর দোকানের সামনে দিয়ে গেছে। দুজনেই সাদা শাড়ি পরা, নীল পাড়—নীল ব্লাউজ গায়—দুজনেরই বেণী ঝোলানো।

চার-পাঁচটা ছেলে সাইকেলে চড়ে ওদের চতুর্দিকে বৃত্তাকারে ঘুরতে ঘুরতে আসছিল হাসতে হাসতে। সাইকেলের বেল বাজাতে বাজাতে ক্রিং ক্রিং করে। হঠাৎ মেয়ে দুটি দাঁড়িয়ে পড়ল। মনে হল মেয়ে দুটি ভয় পেয়েছে। ওদের চোখে আশঙ্কার ছায়া পড়ল। ছেলেগুলো ওদের বাঁদরামির বৃত্তটা ছোটো করে আনতে লাগল।

সাইকেলগুলো ঘুরতে ঘুরতে একেবারে ওদের কাছে চলে এল। একটি মেয়ে ঘাড় ঘুরিয়ে বলল, জংলি। বলতেই একটি ছেলে তার বেণী ধরে টান লাগাল। বেণী ধরে টানতেই মেয়েটি তার হাতের মোটা বই দিয়ে সাইকেল-চড়া ছেলেটির মুখে এক ঘা লাগাল। আঘাত লাগতেই ছেলেটি সাইকেলসুদ্ধু পড়ে গেল। পড়তে পড়তে এগিয়ে যেতেই অন্য ছেলে দুটি সাইকেলের ধাক্কায় পড়ে গেল। এবং পান্ডেজির দোকানের সামনে ঠেসান দিয়ে দাঁড় করানো সাইকেলের স্তূপে ধাক্কা লাগাতে দোকানের খরিদ্দারদের অনেকগুলো সাইকেল ঝন ঝন করে মাটিতে পড়ে গেল।

তার পরই ব্যাপারটা ঘটল। ছেলেগুলো শকুনের মতো মেয়ে দুটির ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। একজন একটি মেয়ের শাড়ির কোনা চেপে ধরল। মেয়েটি দৌড়ে পালাতে গেল এবং পালাতে গিয়ে তার শাড়ি ছিঁড়ে গেল। তার পর খুলে গেল। সেই বাজারের রাস্তায় শায়া পরা উনিশ-কুড়ি বছরের মেয়েটিকে ভীষণ ভীত ও অসহায় মনে হল। ততক্ষণে অন্য মেয়েটিকে মাটিতে ফেলে দিয়ে ছেলেগুলো উদ্দাম পাশব চিৎকার শুরু করেছে।

আশপাশের দোকানের দোকানদার, পথচলতি লোকেরা সকলেই ব্যাপারটার অভাবনীয়তায় একেবারে হতবাক হয়ে স্থাণুর মতো দাঁড়িয়ে রইল। ছেলেগুলোকে আজকাল সকলে ভয় করে। সকলে জানে যে, ওদের ন্যায়-অন্যায় বোধ নেই, ওদের অভিধানে সম্মান বলে কোনো কথা লেখা নেই। ওরা করতে পারে না এমন কোনো কাজ নেই, এবং যা ওরা করবে সেটাই ন্যায্য বলে মানতে হবে। ওদের দিকে সাহস করে কেউ এগোল না।

কী হল, কেমন করে হল সমীর জানে না। সমীরের শুধু মনে আছে যে, ওর দোকানের কাউন্টার টপকে ও ছেলেগুলোর দিকে একনিশ্বাসে দৌড়ে গেল। দৌড়ে গিয়ে যে মেয়েটিকে ওরা মাটিতে শুইয়ে ফেলেছিল তাকে টেনে তুলল। ও এক একটা ছেলেকে এক এক ঘুসিতে এদিকে ওদিকে ফেলে দিল। ছেলেগুলোকে ওর পাটকাঠির মতো হালকা ও অন্তঃসারশূন্য বলে মনে হল। ওর মনে হল, অন্যায়ের নিজের জোর থাকে না—অন্যায় শুধু ছুরির ফলায় আর বোমার আওয়াজে মাঝে মাঝে ঝলসে উঠে ভয় দেখায় মাত্র।

মেয়েটাকে ছাড়িয়ে দিতেই, মেয়েটা দৌড়ে পান্ডেজির দোকানে ঢুকল। মেয়েটার শাড়ি খুলে গেছিল ব্লাউজ ছিঁড়ে গেছিল বইগুলো সব রাস্তায় লুটোচ্ছিল। মেয়েটা হাপুস-নয়নে কাঁদছিল।

দ্বিতীয় মেয়েটার দিকে এগোতেই সমীর বুঝতে পেল, আজ তার বিষম বিপদ। ছেলেগুলোসকলে মিলে সমীরকে ঘিরে ফেলল।

আকাশে তখন সূর্যটা ঠিক মাথার ওপর। রোদ ঝকঝক করছে। সমীরের ওই সূর্যের আলোর আশীর্বাদে দাঁড়িয়ে একরাস্তা লোকের সামনে শ-য়ে শ-য়ে মানুষের মুগ্ধ ও আতঙ্কগ্রস্ত মুখে তাকিয়ে হঠাৎ মনে হল, জীবনে এই প্রথম মৃত্যুর শীতল রং-চটা খোলস ছেড়ে ও জীবনের উষ্ণ রোদ্দুরের স্বাদ পেল। ও যে বেঁচে আছে এটা প্রমাণ করার মতো কিছু একটা ওর জীবনে ঘটল।

কিন্তু সমীর একা। ওরা প্রথমে শুধু চারজন ছিল। কিন্তু সমীর ওদের মারার সঙ্গে সঙ্গেই কোথা থেকে আরও অনেক ছেলে জুটে এল ওদের সাহায্যে। অন্যায়ের দল সহজে ভারী হল। ন্যায়ের দলে তখন ও একা।

দেখতে দেখতে ওরা সকলে একসঙ্গে সমীরের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ল। সমীর দু-হাত দিয়ে আত্মরক্ষার জন্যে সমানে ঘুসি চালাতে লাগল। সমীর কখনো কারো সঙ্গে মারামারি করেনি—। মারামারি করতে পারত পান্ডেজি—পালোয়ান। কিন্তু তার বড়ো দোকান, তার দোকানের বিখ্যাত বালুশাই-র গুডউইল, তার ফার্নিচার, তার ক্যাশের টাকা, তার কাচের শো-কেস এত কিছু বিসর্জন দিয়ে ন্যায়ের জন্যে দাঁড়ানো তার পক্ষে অসম্ভব ছিল। শুধু তার পক্ষে কেন, হয়তো কারো পক্ষেই অসম্ভব।

সমীর প্রচন্ড মার খাচ্ছিল। ওর ঠোঁটের কোনা বেয়ে রক্ত পড়ছিল। ডান চোখের পাশটা কেটে গেছিল একটা ঘুসিতে—তবুও সমীর পাগলের মতো হাত চালাচ্ছিল। কপালের ওপর, কানের পাশে ও যখন ঘুসির পর ঘুসি খাচ্ছিল, ওর স্নায়ুগুলো যখন ঝন ঝন করে বেজে উঠছিল তখন সেই ছোটোবেলার দিনগুলো ওর ভীষণ মনে পড়ছিল। যখন ও অতসীর বাড়ির পাশ দিয়ে সাইকেল চালিয়ে যেত—যখন মনে মনে ঘুমন্ত অতসীকে বলত, আমার মস্তিষ্কে যতটুকু মেধা আছে, আমার বুকে যতটুকু ভালোত্ব আছে, আমার দু-হাতে যতটুকু শক্তি আছে সব দিয়ে আমি তোমাকে সমস্ত রোদ, সমস্ত দুঃখ, সমস্ত অশান্তি থেকে আড়াল করে রাখব। সেই কথাগুলো মনে পড়ছিল। এই মেয়ে দুটির মধ্যে ও কি অতসীকেই হঠাৎ আবিষ্কার করেছিল? নইলে ও ওদের জন্যে এমনভাবে মার খেয়ে মরতে যাবে কেন?

ওরা মারতে মারতে সমীরকে মাটিতে ফেলে দিল। সমীরের মাথা ফেটে দরদর করে রক্ত পড়তে লাগল। ছেলেগুলো কতগুলো নেকড়ের মতো ওকে ঘিরে নাচতে লাগল! সমীরের খুব ক্লান্তি লাগতে লাগল, খুব ঘুম পেতে লাগল, সমীরের মনে হতে লাগল, এই ছেলেগুলোরমায়েরা বোধ হয় হায়েনা, কি নেকড়ে, কি কাঁকড়াবিছেদের সঙ্গে কোনোদিন এক বিছানায় শুয়েছিল। মানুষের বাচ্চাদের চোখমুখ কখনো এমন হতে পারে না, কখনো না।

যন্ত্রণায় কাতরাতে কাতরাতে পাশ ফিরতে গেল সমীর, যেন পাশ ফিরে পথের ধুলোর বিছানায় শুলে ও আরাম পাবে। সমীর পাশ ফিরে শুতে শুতে তার দোকানের কাউন্টারের ওপরে রাখা তার গরম চায়ের কাপটা দেখতে পেল। সমীরের খুব ইচ্ছে হল ওকে যারা মারছে তাদের মধ্যে একটি ছেলেকে বলে, ভাই আমার চায়ের কাপটা একটু এনে দেবে? পরমুহূর্তেই ওর দোকান থেকে ওর রক্তমাখা চোখের দৃষ্টি সরতেই ও দেখতে পেল পান্ডেজিকে। সে-দৃশ্যের জন্যে ও মনে মনে প্রস্তুত ছিল না। সমীর দেখতে পেল একটা তেলমাখানো বাঁশের লাঠি হাতে করে ফিনফিনে ধুতি ও সিল্কের পাঞ্জাবি পরা পান্ডেজি দৌড়ে এদিকে এগিয়ে আসছেন। আনন্দে সমীরের কপালচোঁয়ানো রক্ত চোখের জলের সঙ্গে মিশে গেল। সমীর চোখ বুজতে বুজতে দেখতে পেল পান্ডেজি লাঠি ঘোরাতে ঘোরাতে পরমবিক্রমে এসে ওই কাঁকড়াবিছের বাচ্চাদের ওপর ঝাঁপিয়ে পড়লেন। চতুর্দিকে প্রচন্ড চিৎকার শোনা গেল। তার পর সমীরের আর মনে নেই। সমীরের খুব ঘুম পেয়েছিল।

জ্ঞান ফিরল তিন দিন পর। সমীরের জ্ঞান ফিরল! কিন্তু পান্ডেজির জ্ঞান আর ফিরল না। পান্ডেজির বুকে একটি বড়ো ছোরা আমূল বিদ্ধ হয়ে গেছিল। পান্ডেজির দোকান লুট হয়ে গেছিল। তবু ঘটনার শেষ সেখানেই নয়। সমস্ত শহরে হই হই পড়ে গেছিল। হাজার হাজার লোক হাসপাতালে এসেছিল। পান্ডেজির শব নিয়ে যে শোভাযাত্রা বেরিয়েছিল তাতে ছেলে ও মেয়ে কলেজের অধ্যক্ষরা, ডিস্ট্রিক্ট ম্যাজিস্ট্রেট, এসপি, ডিস্ট্রিক্ট জাজ সকলে যোগ দিয়েছিলেন খালিপায়ে। শহরের সব কিছু বন্ধ ছিল সেদিন।

আরও সাতদিন পর সমীর বিছানায় শুয়ে কথা বলতে পারল। চোখ মেলতে পারল। মাথায় যন্ত্রণা না ঘটিয়ে প্রথম কিছু ভাবতে পারল। অনেক দিন পর।

সেই ছোটো শহরের শান্ত একঘেয়ে জীবনের জলে যে-ঢেউ উঠেছিল তা এখন আবার শান্ত হয়ে গেছে। হাসপাতালের জানালা দিয়ে রোদ এসে পায়ের কম্বলের ওপর পড়েছে! সমীরের শরীরে যদিও অনেক উদবেগ ছিল, তবুও অনেক কিছু ভাবতে ইচ্ছে করছিল।

সমীর শুয়ে শুয়ে ভাবল, আমরা কেউই অনুক্ষণ বেঁচে থাকি না। আমরা কখনো-সখনো প্রতিদিনের মৃত্যুর একঘেয়ে অন্ধকারে জোনাকির মতো হঠাৎ বেঁচে উঠি; জ্বলে উঠি; আবার পরক্ষণেই নিবে যাই। যে-পান্ডেজি সারাজীবন চমৎকার বালুশাই বিক্রি করে গেলেন, সেটা প্রয়োজন ও অভ্যাসবশেই করলেন—মানুয়াটাঁড়ে একটা কোঠাবাড়ি ও একটি জিপগাড়ি কিনবেন এই উচ্চাশায়। পান্ডেজি মানুষটাকে কেউ জানত না, পান্ডেজির দোকানের মতো বালুশাই শহরে অন্তত আরও দশটা দোকানে পাওয়া যেত। শুধু সেই বালুশাইর গর্বটুকু নিয়ে কোনো মানুষ বাঁচে না। বাঁচতে পারে না। পান্ডেজি তাঁর পঁয়তাল্লিশ বছরের নির্বিরোধী মৃত্যুশীতল জীবনের শেষদিনটিতে অন্যায়ের বিরুদ্ধে একটি তেল-মাখানো বাঁশের লাঠি ঘুরিয়ে হঠাৎ দারুণভাবে বেঁচে গেলেন।

আকাশে তাকিয়ে থাকতে থাকতে সমীরের অতসীর কথা মনে হল। অতসীর চোখ দুটির কথা। সে চোখ দুটির আশ্রয়ে ও ক্লান্তজীবনে দু-দন্ড বিশ্রাম চেয়েছিল। অতসী এখন কী করছে কে জানে? অতসী ওকে দেখতে আসেনি। আসবে না যে, তা সমীর জানত। অতসী হয়তো এখন চান করতে গেছে। কিংবা হয়তো চান হয়ে গেছে ওর। হয়তো বারান্দার রোদে বসে কারো সঙ্গে গল্প করছে। হয়তো ওর স্বামীকে চিঠি লিখছে—ভালোবাসার চিঠি। অসুস্থ শরীরে বারে বারে, সমীরের ফিরে ফিরে অতসীর কথাই মনে পড়ছিল। যে-অতসী তাকে হাড়ে হাড়ে চিনে ফেলেছে এ-জীবনে। যে অতসী, তাকে বাজারের মেয়েদের কাছে যেতে বলেছিল।

বাইরে হাসপাতালের কম্পাউণ্ডের বড়ো বড়ো ইউক্যালিপটাস গাছের মসৃণ গায়ে রোদ পিছলে পড়ছে। আকাশটা ঘন নীল। আকাশে রোদ অভ্রর কুচির মতো উড়ছে। জানালার আলসেতে বসে একটা কাক টাগরা দেখিয়ে ডাকছে কা-কা, কা-কা। দূরের রাস্তা বেয়ে সাইকেল ও সাইকেল-রিকশার সারি চলেছে। তার ক্রিং ক্রিং টুং টাং শব্দ কানে আসছে সমীরের, সমীর আকাশের দিকে চেয়ে শুয়ে রয়েছে।

মাথা উঁচু-করা রোদ-ঝিলমিল ইউক্যালিপটাস গাছগুলোর দিকে চেয়ে থাকতে থাকতে সমীরের মনে হল, একজন পুরুষ বোধ হয় প্রথমত তার কাজের স্বীকৃতি ও প্রশংসার জন্যেই বেঁচে থাকে। এবং দ্বিতীয়ত তার জীবনে কোনো বিশেষ অতসীর ভালোবাসা চাওয়া এবং পাওয়ার জন্যে। এর বাইরে বোধ হয় কোনো পুরুষেরই কোনো অস্তিত্ব নেই। সমীর যেন বুঝতে পারল, যারা এই স্বীকৃতি ও ভালোবাসা পায়নি ও পাবে না, তারা শুধুই প্রশ্বাস নেয় ও নিশ্বাস ফেলে।

তাদের নাকের কাছে হাত ছোঁয়ালে গরম হাওয়া লাগে হাতে; কিন্তু তারা সকলেই ঠাণ্ডা মরা ব্যাঙের মতো মৃত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *