৫
ট্রাকড্রাইভার এবং ট্রাকচালক সমিতির পিআরও সালামত এসেছে ভাইয়ার কাছে। সালামত লম্বা, চেহারায় ইঁদুরভাব প্রবল। চোখ কোটর থেকে খানিকটা বের হয়ে আছে। লম্বা নাক, নাকের নিচে পুরুষ্ট গোঁফ। গায়ের রং কোনো একসময় হয়তো ফরসা ছিল। ময়লা জমে কিংবা রোদে পুড়ে কালচে ভাব ধরেছে। তাকে ঘিরে সস্তা সিগারেটের গন্ধের সঙ্গে মিলেছে জর্দার কড়া গন্ধ। তবে এখন সে পান খাচ্ছে না।
আমি বসেছি ভাইয়ার ঘরের বারান্দায়। ভাইয়াকে দেখতে পাচ্ছি, কিন্তু সালামতকে দেখতে পাচ্ছি না। ভাইয়া বলল, আপনি ট্রাক চালান? আপনি তো ভাগ্যবান মানুষ।
এটা কেন বললেন?
বাংলাদেশের সব ট্রাকচালকের বেহেশত নসিব হবে, এই জন্যে বললাম।
কী বলেন এই সব?
ছুটন্ত ট্রাক দেখলেই আশপাশের সবাই আল্লাহর নাম নেয়। আপনাদের কারণে এত লোকজন আল্লাহর নাম নিচ্ছে, এই জন্যে আপনারা সরাসরি বেহেশতে যাবেন।
এই সব বাদ দেন। আমি আপনার কাছে কী জন্যে এসেছি সেটা শোনেন। উপায় না দেখে এসেছি।
বলুন, কী ব্যাপার।
পদ্ম মেয়েটার সঙ্গে দেখা করার ব্যবস্থা করে দেন। এটা আমার রিকোয়েস্ট। তার সঙ্গে আমার বিবাহ হয়েছে। একজনের বিবাহিত স্ত্রীকে আপনারা উঠায়ে নিয়ে এসেছেন, এটা কেমন কথা? আপনার স্ত্রীকে কেউ উঠায়ে নিয়ে গেলে আপনি কী করতেন?
ভাইয়া বলল, আমার স্ত্রীকে কেউ উঠায়ে নিয়ে যায় নাই, কাজেই কী করতাম বলতে পারছি না।
ভাইসাহেব, আমি ট্রাক নিয়ে এসেছি। পদ্মকে ডেকে দিন। আমি তাকে নিয়ে চলে যাব। কী ঘটেছিল তা নিয়ে মাথা ঘামাব না।
পদ্ম কি যাবে আপনার সঙ্গে?
অবশ্যই যাবে। তাকে ডেকে জিজ্ঞেস করেন। এটা আপনার কাছে রিকোয়েস্ট। রিকোয়েস্ট না শুনলে অন্য পথ ধরব। সেটা আপনার ভালো লাগবে না।
ভাইয়া পদ্মকে ডেকে পাঠালেন। পদ্ম এসে দাঁড়াল। আমি বারান্দা থেকে পদ্মকে দেখতে পাচ্ছি না। দেয়ালে পদ্মর ছায়া পড়েছে। সেই ছায়া দেখতে পাচ্ছি।
ভাইয়া বলল, পদ্ম! ট্রাকড্রাইভার সালামত তোমাকে নিয়ে যেতে এসেছে। ট্রাক নিয়ে এসেছে। তুমি কি তার সঙ্গে যাবে?
পদ্ম মিষ্টি করে বলল, যাব। কেন যাব না!
সালামত বলল, আমার স্ত্রীর নিজের মুখের কথা শুনলেন। এই কথার পর আর বিবেচনা নাই। পদ্ম, যাও, তৈয়ার হয়ে আসো। দশ মিনিট সময়।
পদ্ম বলল, এখন তো যেতে পারব না। পায়ে ব্যথা পেয়েছি। হাঁটতে পারি না। পায়ের ওপর দিয়ে রিকশা চলে গিয়েছিল। তুমি দেখো, পা ফুলে কী হয়েছে! পায়ের ফোলা কমুক। দশ দিন পরে আসো। এর মধ্যে পা ভালো হয়ে যাবে। আমি তোমার সঙ্গে চলে যাব।
সালামত বলল, পদ্ম, আমার কথা শোনো।
পদ্ম বলল, দশ দিন পরে তোমার কথা শুনব। এখন শুনব না।
পদ্ম খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বের হয়ে গেল। ভাইয়া বলল, দশ দিন পর আসুন, দেখি কী হয়।
সালামত হতাশ গলায় বলল, দশ দিন পরেও কিছু হবে না। এই মেয়েকে আর মেয়ের মাকে আমি হাড়ে-গোশতে চিনি। ভাইসাহেব, শুনেন। এই মেয়ের পড়াশোনার খরচ, হাতখরচ—সব আমি দিয়েছি। মা-মেয়ের মাসখোরাকি খরচ দিয়েছি। আমার টাকায় মেয়ে বিএ পাস দিয়েছে। যখন বিয়ের কথা বলাম তখন পদ্ম বলল, ‘আপনার স্ত্রী আছে, আমি তো সতিনের ঘর করব না। স্ত্রীকে তালাক দিয়ে আসেন। তারপর বিবেচনা করব।’ জোবেদারে তালাক দিলাম। জোবেদা আমার স্ত্রী। সে দুই মেয়ে নিয়ে বাপের বাড়ি চলে গেল। পদ্ম শুরু করল নানান ক্যাঁচাল। আজ না, সাত দিন পরে বিয়ে। সাত দিন পরে বলে, ‘বিষ্যুদবারে আমি বিয়ে করব না। বিষ্যুদবার আমার জন্যে খারাপ।’ তখন অন্য ব্যবস্থা নিলাম। বিয়ে হয়ে গেল। সন্ধ্যাবেলা তাকে নিয়ে ট্রাক চালায়ে দিনাজপুর যাব—সব ঠিকঠাক। ট্রাক নিয়ে উপস্থিত হয়ে শুনি, তাকে আপনারা জোর করে তুলে নিয়ে গেছেন।
ভাইয়া বলল, এত দিন যখন অপেক্ষা করেছেন, আরও দশটা দিন যাক। সবুরে মেওয়া ফলে। আপনার বেলায় সবুরে বউ ফলবে।
সালামত বলল, আপনার কথা মানলাম। আসব দশ দিন পরে। তখন যদি কিছু না হয়, আমি অন্য লাইন ধরব। আমি এত সহজ পাত্র না। পদ্ম এটা জানে না, পদ্মর মা জানে। সবকিছুর মূলে আছে ওই বদমাগি।
শাশুড়িকে মাগি ডাকছেন, এটা কেমন কথা!
ক্ষুব্ধ সালামত ঘর থেকে বের হয়ে গেল।
সালামতের আগমন এবং প্রস্থানে পদ্মর মধ্যে কোনো ভাবান্তর দেখা গেল না। সে কলপাড়ে বসে আছে। তার এক পা প্লাস্টিকের গামলায় ডোবানো। পায়ের জলচিকিৎসা চলছে। রহিমার মা গলা নামিয়ে তার সঙ্গে গল্প করছে।
গল্পের বিষয়বস্তু ড্রাইভার ইসমাইলের জিন। এই জিন ইসমাইলের সঙ্গেই সারাক্ষণ থাকে। শুধু শনিবার আর সোমবার থাকে না। এই দুই দিন জিন তার স্ত্রীর সঙ্গে দেখা করতে যায়। জিনের স্ত্রীর নাম হামাছা।
আজ ছুটির দিন। বাবা বাসায় আছেন। কিছুক্ষণের মধ্যে তিনি সাপ্তাহিক বাজারে যাবেন। আমাকে সঙ্গে যেতে হবে কি না বুঝতে পারছি না। বাবার সঙ্গে বাজারে যাওয়া বিড়ম্বনার ব্যাপার। কাঁচা মরিচ কেনার আগে তিনি মরিচ টিপে টিপে দেখবেন। একটা ভেঙে গন্ধ শুঁকবেন। ভাঙা মরিচ আমার দিকে বাড়িয়ে দিয়ে বলবেন, ‘জিভে ছুঁইয়ে দেখ ঝাল কি না।’ মরিচ বিক্রেতা এই পর্যায়ে অতিষ্ঠ হয়ে বলবে, ‘মরিচ ভাঙেন ক্যান?’ বাবা শান্ত গলায় বলবেন, ‘তোমার কাছ থেকে যদি মরিচ নাও কিনি, এই ভাঙা মরিচের দাম দেব। কাজেই হইচই করবে না। যে ভোক্তা, তার আইনি অধিকার আছে দেখেশুনে পণ্য কেনার। প্রয়োজনে মামলা করে দেব। বুঝেছ?’
একবার মাছ কিনতে গিয়ে মাছওয়ালার সঙ্গে তাঁর মারামারির উপক্রম হলো। মাছওয়ালা বঁটি উঁচিয়ে বলল, ‘দিমু কোপ।’ বাবা শান্ত গলায় বললেন, ‘কোপ দিতে হবে না। তুমি যে বঁটি উঁচিয়েছ, এর জন্যেই অ্যাটেম টু মার্ডারের মামলা হয়ে যাবে। সাত বছর জেলের লাপসি খেতে হবে। লাপসি চেন?’
বাবার কথা থাক। নিজের কথা বলি। আমি আগ্রহ নিয়ে পদ্ম ও রহিমার মায়ের কথা শুনছি। রহিমার মা উঠে যাওয়ার পর আমি পদ্মর কাছে গিয়ে দাঁড়ালাম। পদ্ম আমার দিকে তাকিয়ে হাসিমুখে বলল, ট্রাকড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে আমার হয়েছে, এই কথা আপনাকে বলেছিলাম। এখন কি আমার কথা বিশ্বাস হয়েছে?
হ্যাঁ।
এ কিন্তু মানুষ খারাপ না। আমাকে পড়াশোনা করিয়েছে। যেদিন বিএ পরীক্ষার রেজাল্ট বের হয়েছে, সেদিন শাড়ি কিনে দিয়েছে।
প্রিয় স্বামীর সঙ্গে চলে গেলে না কেন?
পদ্ম বলল, ভাঙা পা নিয়ে যাব নাকি! পা ঠিক হোক, তারপর যাব। স্বামী ট্রাক চালাবে, আমি পাশে থাকব। বিড়ি ধরিয়ে তার ঠোঁটে দিয়ে দেব। ট্রাক চালাতে চালাতে যেন ঘুমিয়ে না পড়ে এই জন্যে সারাক্ষণ তার গায়ে চিমটি কাটব। দেখুন, আমি হাতের নখ বড় রেখেছি চিমটি কাটার সুবিধার জন্যে। আপনি হাতটা বাড়ান, আপনার হাতে একটা চিমটি কেটে দেই।
আমার হাতে চিমটি কাটবে কেন?
আপনি আমার নকল স্বামী, এই জন্যে আপনার হাতে নকল চিমটি কাটব।
পদ্ম চিমটি কাটার সুযোগ পেল না, বাবা বারান্দায় এসে দাঁড়ালেন।
হাতের ইশারায় আমাকে ডাকলেন।
আমি এখন বাবার শোবার ঘরে। মা চাদর গায়ে শুয়ে আছেন। হাঁপানির টান এখনো ওঠেনি। টান উঠবে কি না তা পরিস্থিতির ওপর নির্ভর করছে। পরিস্থিতি যথেষ্ট ঘোলাটে বলে মনে হচ্ছে। কারণ, পদ্মর মা উপস্থিত আছেন। তিনি চেয়ারে বসে আছেন। তাঁর পাশের একটা চেয়ারে আমি বসেছি। ভদ্রমহিলা বিরক্ত চোখে আমাকে দেখছেন। বাবা বসেছেন মায়ের পাশে। বাবা প্রধান বিচারকের ভূমিকায় আছেন বলে মনে হচ্ছে। মা প্রধান বিচারকের সাহায্যকারী।
বাবা পদ্মর মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ভাবি! আমাকে বলা হয়েছিল, আপনি আপনার মেয়েকে নিয়ে ঝামেলায় পড়েছেন বলেই কিছুদিন আমার এখানে থাকতে এসেছেন। আমি বিষয়টা মেনে নিয়েছি। অনেক দিন পার হয়েছে। এখন আপনাদের চলে যেতে হবে। আপনাকে এক সপ্তাহ সময় দিচ্ছি।
পদ্মর মা চুপ করে আছেন। বাবার কথা শুনে তিনি যে ঘাবড়ে গেছেন এ রকম মনে হচ্ছে না। ভদ্রমহিলা শক্ত জিনিস। এসিড-মাতা বলে কথা!
বাবা বললেন, শেক্সপিয়ার বলেছেন, I have to be cruel only to be kind. এর অর্থ, মমতা প্রদর্শনের জন্যেই আমাকে নির্মম হতে হবে। আমি আমার ছেলেদের প্রতিও নির্মম। শুনেছেন নিশ্চয়ই, আমি আমার বড় ছেলেকে বাড়ি ছেড়ে চলে যেতে বলেছি। শুনেননি?
শুনেছি।
আপনাকেও একটা সময় বেঁধে দিচ্ছি। এই মঙ্গলবারের পরের মঙ্গলবার।
পদ্মর মা অবাক হয়ে বললেন, যে জমির ওপর এই বাড়ি, সেই জমি তো আমার। আমি কেন বাড়ি ছাড়ব?
বাবা বললেন, তার মানে?
জমির কাগজপত্র আমার নামে।
বাবা বললেন, ভাবি, শুনুন। নানা দুশ্চিন্তায় আপনার মাথা এলোমেলো হয়ে আছে। জমি আপনার নামে, মানে কী?
আমার কাছে কাগজপত্র আছে। আপনার বড় ছেলে জোগাড় করে দিয়েছে।
বাবা বললেন, আচ্ছা, আপনি যান, পরে আপনার সঙ্গে কথা বলব। মনজু, তুই তোর ভাইকে ডেকে আন।
আমি বললাম, ভাইয়া তো এখন ঘুমাচ্ছে।
ঘুম থেকে ডেকে তুলে আন।
পদ্মর মা বলল, আপনি কি কাগজগুলো দেখবেন?
পরে দেখব। এখন আপনি যান।
দ্বিতীয় সিটিং বসেছে। ভাইয়াকে ঘুম ভাঙিয়ে আনা হয়েছে। ঘুম পুরোপুরি কাটেনি। ভাইয়া একটু পরপর হাই তুলছে। পদ্মর মা যে চেয়ারে বসেছিলেন, ভাইয়া সেখানে বসেছে। বাবা অনেকক্ষণ ভাইয়ার দিকে একদৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকলেন। এটা বাবার পুরোনো টেকনিক। মূল বাজনায় যাওয়ার আগে তবলার ঠুকঠাক।
বাবা বললেন, শুনলাম তুমি পদ্মের মাকে কী সব কাগজপত্র দিয়েছ?
ভাইয়া বলল, ঠিকই শুনেছ। জমির দলিল আর নামজারির কাগজ।
পেয়েছ কোথায়?
সাবরেজিস্ট্রি অফিসে দুষ্ট কিছু লোকজন থাকে, যারা মিথ্যা কাগজ তৈরি করে দেয়।
তুমি ভুয়া কাগজপত্রের ব্যবস্থা করেছ?
হ্যাঁ। তবে ভুয়া হলেও কঠিন ঝামেলার কাগজ। মামলা করলে ফয়সালা হতে বিশ-পঁচিশ বছর লাগবে। তারপর দেখা যাবে, মিথ্যা কাগজ টিকে গেল।
তুমি এই কাজটা কেন করেছ জানতে পারি?
ভাইয়া বলল, টেনশন তৈরি করার জন্যে করেছি, বাবা। ছোট মা এবং তুমি—এই দুজন এখন শত্রুপক্ষ। এক ছাদের নিচে দুই কঠিন শত্রুর বাস মানে নানান কর্মকাণ্ড। এত দিন তুমি ভেজিটেবল হয়ে বাস করছিলা, এখন থেকে তোমার ভেতর থেকে ভেজিটেবল ভাব চলে যাবে। ভেজিটেবল হয়ে তো আর শত্রুর মোকাবেলা করা যায় না। তোমাকে বাধ্য হয়ে জেগে উঠতে হবে। এতে তোমার লাভ হবে একপর্যায়ে দেখা যাবে, তোমার ছাত্রছাত্রীরা তোমাকে মুরগি ডাকছে না। অনেক কথা বলে ফেললাম। নো অফেন্স, বাবা, যাই।
ভাইয়া উঠে দাঁড়াল। বাবা অধিক শোকে পাথর হয়ে বসে আছেন। একবার মায়ের দিকে তাকাচ্ছেন, একবার আমার দিকে। মায়ের হাঁপানির টান উঠে গেছে। নিঃশ্বাস নিতে গিয়ে তিনি এখন বিচিত্র শব্দও করছেন। শব্দ অনেকটা প্রেশার কুকারের মতো। কিছুক্ষণ বিজবিজ, তারপর ফোঁস—গ্যাস বের হয়ে যাওয়া।
বাবা মায়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, একটা পিস্তল থাকলে আমি নিজের হাতে তোমার ছেলেকে শ্যুট করতাম।
প্রবল ঝড়ের পর পরিস্থিতি অস্বাভাবিক শান্ত হয়। এখন আমাদের বাসার পরিস্থিতি শান্ত। পদ্মর মাথায় তার মা বাটা মেন্দি ঘসে ঘসে দিচ্ছেন। বাবা বাজার নিয়ে ফিরেছেন। কাঁচাবাজার হাতে নির্বোধ চেহারার এক ছেলেকে দেখা যাচ্ছে। বাবার কাছ থেকে জানা গেল, সে নিউমার্কেটে মিনতির কাজ করত। এখন থেকে এই বাড়িতে কাজ করবে। বাবার হাত-পা টিপে দেবে, ঘর ঝাঁট দেবে। ছেলের নাম জামাল। সে বাবাকে ‘আব্বা’ ডাকছে। আমার কাছে মনে হচ্ছে, বাবা তার মুখে ‘আব্বা’ শুনে সন্তুষ্ট। বাবা নিজে জামালের জন্যে তোশক-বালিশ আর মশারি কিনে আনলেন। তাকে কৃমির ওষুধ খাইয়ে দেওয়া হলো। সন্ধ্যাবেলা সে লাইফবয় সাবান দিয়ে গোসল করে আমাদের পরিবারভুক্ত হলো। বাবা তার সঙ্গে মিটিংয়ে বসলেন। কঠিন মুখ করে বললেন, আমি তোর দায়িত্ব নিয়েছি। শুধু ঘরের কাজ করলে হবে না। তোকে লেখাপড়া শিখতে হবে। রোজ আধঘণ্টা করে তোকে আমি পড়াব। ঠিক আছে?
জামাল বলল, জি, আব্বা।
বাবা বললেন, আজ থেকে শুরু। এই দেখ, একে বলে স্বরে অ। বল, স্বরে অ।
স্বরে অ।
এর পাশে আকার দিলে হয় আ, বল, আ।
আ।
দুইটা অক্ষর এক দিনে শিখে ফেললি। রাতে ঘুমাতে যাবার সময় একশবার করে স্বরে অ, স্বরে আ বলবি। ঠিক আছে?
ঠিক আছে, আব্বা।
এক একটা অক্ষর শিখবি আর দুই টাকা করে বকশিশ পাবি। আজ দুইটা অক্ষর শিখেছিস, এই নে চার টাকা।
জামাল টাকা নিয়ে বাবাকে পা ছুঁয়ে সালাম করল। পরদিন সকালে জামালকে পাওয়া গেল না। সে বাবার মোবাইল ফোন আর মানিব্যাগ নিয়ে পালিয়েছে। মানিব্যাগে ছিল সাতাশ শ টাকা। উঠানে পদ্মর একটা শাড়ি শুকাতে দেওয়া ছিল। সেই শাড়িও পাওয়া গেল না।
ভাইয়ার কর্মকাণ্ডে বাবা যতটা না মর্মাহত হয়েছিলেন, জামালের কর্মকাণ্ডে তার চেয়ে বেশি মর্মাহত হলেন। ইউনিভার্সিটি বাদ দিয়ে ঘরে বসে রইলেন। হাতে Party Jokes-এর বই।
পদ্মদের নিজস্ব রান্নাঘর চালু হয়েছে। বারান্দায় বাঁশের বেড়া দিয়ে ওপেন এয়ার কিচেন টাইপ রান্নাঘর। সে রাঁধছে, বাইরে থেকে দেখা যাচ্ছে। পাশাপাশি দুইটা কেরোসিনের চুলায় প্রথম রান্না বসল। রহিমার মা ভাইয়াকে জানাল, প্রথম দিন সরপুঁটি ভাজি আর কুমড়াফুলের ভাজি হচ্ছে।
ভাইয়া বলল, দুটাই তো শুকনা আইটেম।
রহিমার মা বলল, তরকারি আর ডাল আমাদের কাছ থেকে যাবে।
আমরা ওদের কোনো আইটেম পাব না?
মনে লয় না। একটা মাছ ভাজছে আর চাইরটা ফুল।
ভাইয়া বলল, কুমড়াফুলের ভাজি খেতে ইচ্ছা করছিল।
রহিমার মা বলল, কাইল আপনারে খিলাব। বকফুল ভাজি পছন্দ হয়? বকফুল আনব। সূত্রাপুর বাজারে পাওয়া যায়।
পদ্মদের পাশের গেস্টরুম তালাবদ্ধ ছিল। এক সকালবেলা (বুধবার আটটা চল্লিশ) পদ্মর মা তালা ভেঙে সেই ঘরের দখল নিয়ে নিলেন। বাবা হতভম্ব। আমাকে ডেকে বললেন, ঘটনা কী? পদ্মর মা আমার ঘরের তালা ভেঙেছে কী জন্যে?
আমি বললাম, ওনার কাছে চাবি ছিল না বলেই তালা ভেঙেছেন। চাবি থাকলে তালা ভাঙতেন বলে আমার মনে হয় না।
তুমি ব্যাপারটা বুঝতেই পারছ না। এরা চাচ্ছেটা কী? আমার বাড়িঘর দখল করে নিচ্ছে কেন? একটা ঘর কি তাদের জন্যে যথেষ্ট ছিল না?
আমি বললাম, না। একটা ঘরে থাকবে পদ্ম আর ওদের কাজের মেয়ে মরি। অন্য ঘরে পদ্মর মা। সবারই প্রাইভেসির দরকার।
তুমি ওদের হয়ে কথা বলছ কেন? তোমার সমস্যা কী? তোমার আচার-আচরণ, কথাবার্তা এবং চিন্তাভাবনা প্রতিবন্ধীদের মতো, এটা জানো?’
না।
সামনে থেকে যাও। পদ্মর মাকে আমার কাছে পাঠাও।
উনি বাড়িতে নেই, বাবা। ড্রাইভার ইসমাইলকে নিয়ে বের হয়েছেন।
কোথায় গেছেন?
কোথায় গেছেন শুনলে তুমি আপসেট হয়ে যাবে। তোমাকে আপসেট করতে চাচ্ছি না। উনি তোমার গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন।
গাড়ি নিয়ে বের হয়েছেন, মানে কী? গাড়ি তো নষ্ট।
অন্য একটা গাড়ি দড়ি দিয়ে বেঁধে তোমার গাড়ি টেনে নিয়ে গেছেন।
তুমি কিছু বললে না?
না। আমার ধারণা, উনি গাড়ি সারাতে নিয়ে গেছেন। ইসমাইল ড্রাইভার তা-ই বলল।
আমার সামনে হাবার মতো দাঁড়িয়ে থাকবে না। Get lost.
বাবার কাছ থেকে ছাড়া পাওয়ার পর মায়ের কাছে ধরা খেলাম। মা গাড়ির বিষয়ে এখনো কিছু জানেন না, তবে দ্বিতীয় গেস্টরুম দখল হয়ে গেছে এই খবর পেয়েছেন। তিনি হতাশ গলায় বললেন, এই সব কী হচ্ছে? ওরা নাকি গেস্টরুম দখল করে নিয়েছে?
হুঁ।
এখন আমরা কী করব? পুলিশে খবর দিব?
পুলিশে খবর দিয়ে লাভ হবে না। ওনার কাছে কাগজপত্র আছে, জমি তাঁর।
মা ফিসফিস করে বললেন, কাউকে দিয়ে কাগজপত্রগুলি চুরি করাতে পারবি?
আমি বললাম, এই বুদ্ধিটা খারাপ না। তুমি রহিমার মাকে লাগিয়ে দাও।
মা অনেক দিন পর উত্তেজনায় বিছানায় উঠে বসলেন। চাপা গলায় বললেন, টগরের সঙ্গে বিষয়টা নিয়ে আলাপ করলে কেমন হয়? এই সব বিষয় সে ভালো বুঝবে।
ভাইয়াকে ডেকে নিয়ে আসব?
না। আমি তার কাছে যাব।
মা তড়িঘড়ি করে বিছানা থেকে নামতে গিয়ে খাট থেকে পড়ে বিকট চিৎকার করতে লাগলেন, তখনো আমরা জানি না, মা তাঁর বাঁ পা ভেঙে ফেলেছেন।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, জুন ০৩, ২০১১