সকাল এগারোটা। বাবা কাজে চলে গেছেন। রহিমার মা ঘর ঝাঁট দিচ্ছে এবং নিজের মনে কথা বলছে। তার মন-মেজাজ খারাপ থাকলে অনর্গল নিজের মনে কথা বলে। মায়ের ঘর থেকে টিভির আওয়াজ আসছে। বাবা অফিসে যাবার পরপর মা একটা হিন্দি সিনেমা ছেড়ে দেন। রহিমার মা কাজের ফাঁকে ফাঁকে দু-তিন মিনিট করে দেখে।
ভাইয়া চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার হাতে উল্টা করে ধরা বই। ভাইয়া উল্টা করে বই পড়লে ধরে নিতে হবে তারও মন খারাপ। ভাইয়া বই নামিয়ে রাখতে রাখতে বলল, ‘কুতো বিদ্যার্থিনঃ সুখম।’
আমি বললাম, এর মানে কী?
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, ‘বিদ্যাশিক্ষার্থী মানুষের সুখ নাই।’
সংস্কৃত কোথায় শিখলে?
কোথায় শিখেছি সেটা ইম্পর্টেন্ট না। কিছু বলতে পারছি এটা ইম্পর্টেন্ট। ধর্মপ্রচারকদের বিভিন্ন সময়ে নানান ভাষায় কোটেশন দেবার ক্ষমতা থাকতে হয়।
তুমি ধর্মপ্রচার করছ?
হুঁ। ভালোবাসার বিপরীত শব্দ কী, বল দেখি।
ঘৃণা।
আমার ধর্মের মূল বিষয় হচ্ছে ঘৃণা। এই ধর্মের সবাই একে অন্যকে ঘৃণা করবে।
তোমার ধর্মের নাম কী?
রগট ধর্ম। ‘টগর’ উল্টা করে হয়েছে ‘রগট’। রগট ধর্ম তিন স্তম্ভের ওপর দাঁড়ানো। এই ধর্মের মানুষদের সপ্তাহে একটা মন্দ কাজ করতে হবে। নয়তো তার ধর্মনাশ হবে।
১. ঘৃণা।
২. হিংসা।
৩. বিদ্বেষ।
আমি ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। সে ফাজলামি করছে কি না, এখনো বুঝতে পারছি না। ভাইয়া অবশ্য ফাজলামি করা টাইপ না। তার মাথায় কিছু একটা নিশ্চয়ই খেলছে। ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, মনজু, একটা কাজ করে দিতে পারবি?
আমি বললাম, কী কাজ, বলো।
একটা মেয়ের ঠিকানা লিখে দিচ্ছি। মেয়েটাকে এবং মেয়ের মাকে নিয়ে আসবি। তারা এখন থেকে এ বাড়িতে থাকবে।
বাবাকে জিজ্ঞেস করেছ?
বাবাকে জিজ্ঞেস করব কোন দুঃখে? বাবা বাড়িতে এসে দেখবেন, তাঁর একটা গেস্টরুম দখল হয়ে গেছে। তাঁর চোখ কপালে উঠে যাবে। দর্শনীয় ব্যাপার হবে।
যাদের আনতে চাচ্ছ তারা কে?
মেয়েটার নাম পদ্ম। পদ্মর মায়ের নাম ভুলে গেছি। পদ্মকে চিনিস না?
হুঁ, বিড়াল-কন্যা।
বিড়াল-কন্যা এখন সিংহের মুখের সামনে। তাকে উদ্ধার করা জরুরি।
আমি বললাম, ঠিকানা দাও। নিয়ে আসছি।
ভাইয়া বলল, গুড বয়।
আমি বললাম, তাদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে?
হুঁ। বাবা মাঝেমধ্যে কিছু টাকা দেন। আমি নিয়ে যাই। কাজটা বাবা করেন অপরাধবোধ থেকে। এই বাড়ির অর্ধেকটা ওদের।
তুমি নিশ্চিত?
অবশ্যই। বাবা এমন কোনো দয়ালু মানুষ না যে ওদের দুর্দশা দেখে টাকা পাঠাবেন। তাঁর হচ্ছে হিসাবের পয়সা।
ওদের এ বাড়িতে এনে তোলার পরের ব্যাপারটা ভেবেছ?
না। আমি বর্তমানে বাস করি—অতীতে না, ভবিষ্যতেও না।
তোমার কর্মকাণ্ড তো তোমার রগট ধর্মের সঙ্গে যাচ্ছে না। তুমি পদ্ম ও তার মাকে দয়া করছ। ভালো কাজ করছ। রগটরা কি এই কাজ করতে পারে?
ভাইয়া হাসতে হাসতে বলল, দয়া দেখাচ্ছি তোকে কে বলল? এরা এ বাড়িতে এসে উঠলেই ধুন্দুমার লেগে যাবে। বাবা আধাপাগলের মতো হবেন। মা ঘন ঘন মূর্ছা যাবেন। আমার রগট ধর্ম এই জিনিসটাই চায়। ঝামেলা, সন্দেহ, ঈর্ষা, পরস্পরের প্রতি অবিশ্বাস।
আমি বললাম, সিএনজি ভাড়া দাও। সিএনজিতে করে নিয়ে আসি।
ভাইয়া উঠে বসতে বসতে বলল, ব্যাপারটা এত সহজ না। পদ্ম মেয়েটা আছে মহাবিপদে। আজ তাকে জোর করে বিয়ে দেবার ব্যবস্থা হচ্ছে। তুই একা কিছু করতে পারবি না। তোকে মেরে তক্তা বানিয়ে দেবে। তোর সঙ্গে লোকজন যাবে। ওরাই ব্যবস্থা করবে। এখন বাজে কয়টা?
এগারোটা বিশ।
তুই অপেক্ষা কর। বারোটার মধ্যে দলবল চলে আসবে। ওদের সঙ্গে যাবি। রহিমার মাকে বল, আমাকে চা দিতে।
ভাইয়া আবার শুয়ে পা নাচাতে লাগল। তাকে উৎফুল্ল দেখাচ্ছে। রগট ধর্মের মানুষদের উৎফুল্ল থাকার বিধান কি আছে?
সন্দেহজনক চেহারার কিছু লোকজন মাইক্রোবাসে বসা। এদের একজন আবার ইসমাইলের মতো মাওলানা। বিশাল দাড়ি। সেই দাড়ি মেন্দি দিয়ে রাঙানো। মাওলানার মাথায় জরির কাজ করা লাল টুপি। তাঁর শারীরিক কিছু সমস্যা আছে। কিছুক্ষণ পরপর তিনি শরীর কাঁপিয়ে হোঁৎ ধরনের শব্দ করেন। মাওলানা বসেছেন ড্রাইভারের পাশে। তিনি ক্রমাগত তসবি টেনে যাচ্ছেন। তাঁর গা থেকে কড়া আতরের গন্ধ আসছে।
আমি দুজনের মাঝখানে বসে আছি। ডান পাশের জনের পান-খাওয়া হলুদ দাঁত। এ-ই মনে হয় দলটির সবচেয়ে গুরুত্বপূর্ণ ব্যক্তি। সবাই তাকে ‘ব্যাঙা ভাই’ ডাকছে। ব্যাঙা কারোর নাম হতে পারে, তা-ই আমার ধারণা ছিল না। ব্যাঙা ভাই বেঁটেখাটো মানুষ। হাসিখুশি স্বভাব। তিনি আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ভয় খাইছেন নাকি, ভাই?
আমি বললাম, ভয় কোনো খাওয়ার জিনিস না। ভয় হচ্ছে পাওয়ার জিনিস। আমি ভয় পাচ্ছি না।
ব্যাঙা ভাই বললেন, ঘটনা মালেক গ্রুপের হাতে চলে গেছে, এটাই সমস্যা। মালেক গ্রুপ না থাকলে পুরা বিষয় ছিল পান্তাভাত।
আমি বললাম, মালেক গ্রুপ ব্যাপারটা কী?
মালেকের দল। মালেক হলো ট্রাক মালিক সমিতির কোষাধ্যক্ষ। এটা ওনার বাইরের পরিচয়। ভেতরের পরিচয় ভিন্ন। বিরাট ডেনজার লোক। তবে উনি আমারে খাতির করে। সে জানে ব্যাঙা সহজ জিনিস না।
আপনি কঠিন জিনিস?
অবশ্যই।
টগর ভাইয়ার সঙ্গে আপনার পরিচয় কীভাবে?
সে এক ঘটনা। আরেক দিন শুনবেন। টেনশানের সময় গল্পগুজবে মন বসে না।
আপনার টেনশান হচ্ছে?
মালেকের গ্রুপ, টেনশান হবে না? বিপদের সময় আমি সঙ্গে মাওলানা রাখি। মাওলানা দোয়া-খায়ের করতে থাকে, যেন বিপদ হালকা হয়। অল্পের ওপর দিয়া যায়। আজ মনে হয় অল্পের ওপর দিয়ে যাবে না। বাতাস খারাপ।
আগারগাঁওয়ের এক বস্তির কাছে মাইক্রোবাস থামল। মাওলানা আর আমাকে রেখে ব্যাঙা দলবল নিয়ে চলে গেল। ড্রাইভার তার সিটে বসা। তার দৃষ্টি তীক্ষ । ব্যাঙা যেদিকে গিয়েছে, ড্রাইভার সেদিকেই তাকিয়ে আছে। সেও নিশ্চয়ই এই দলের সঙ্গে যুক্ত।
সামনের দিক থেকে একটা ইয়েলো ক্যাব এসে মাইক্রোবাসের পাশে থামল। সাফারি গায়ে মোটাসোটা একজন নামল। কিছুক্ষণ মাইক্রোবাসের দিকে তাকিয়ে থেকে সে বস্তির ভেতর ঢুকে গেল।
মাইক্রোবাসের ড্রাইভার বলল, হাওয়া গরম, শামসু চলে আসছে।
আমি বললাম, শামসু কে?
ভেজালের জিনিস। শামসু আছে আর ভেজাল হয় নাই এমন কোনো দিন ঘটে নাই।
কী রকম ভেজাল?
লাশ পড়ে যায়। এই হলো ভেজাল।
আমি হতভম্ব। ঘটছেটা কী? ড্রাইভার বলল, ভাইজান, আপনি ভয় খাইয়েন না। বিপদ দেখলে গাড়ি টান দিব। আপনেরে বিপদের বাইরে রাখার অর্ডার আছে।
অর্ডার কে দিয়েছে? টগর ভাই?
ড্রাইভার মধুর ভঙ্গিতে হাসল। আমার প্রশ্নের জবাব না দিয়ে বলল, সিগারেট ধরান। সিগারেটের ধোঁয়া টেনশানের আসল ওষুধ।
আমি সিগারেট খাই না।
খান না ভালো কথা। আজ খান। দেখেন, টেনশান ক্যামনে কমে। টেনশনে গাঁজা খেলে টেনশান বাড়ে। সিগারেট-গাঁজা দুটাই ধোঁয়া, কাজ দুই রকম।
ড্রাইভার সিগারেটের প্যাকেট বাড়িয়ে দিল। আমি সিগারেট ধরিয়ে কাশতে কাশতে বললাম, আপনি তো খাচ্ছেন না।
টেনশান নাই, খামাখা কী জন্যে সিগারেট খাব?
গাড়ি থেকে বস্তির জীবনযাত্রা স্বাভাবিকই মনে হচ্ছে। বড় কিছু ঘটছে এমন কোনো আলামত দেখতে পাচ্ছি না। আধা নেংটা ছেলেপুলে হুটোপুটি করছে। সাইকেলের চাকা দিয়ে খেলছে। খেলার উত্তেজনা ছাড়া এদের মধ্যে বাড়তি কোনো উত্তেজনা নেই। কালো মাটির হাঁড়ি নিয়ে একজন চাকভাঙা মধু বিক্রি করছে। বস্তির মহিলাদের কেউ কেউ দরদাম করে কিনছে। মধুর সঙ্গে তারা চাকের একটা অংশও পাচ্ছে। এক বৃদ্ধকে দেখা গেল গাই দুয়াচ্ছে। গ্রাম বাংলার খানিকটা উঠে এসেছে।
মাইক্রোবাসের পাশে জিনসের প্যান্ট ও কলারওয়ালা নীল গেঞ্জি পরা মধ্যবয়স্ক এক লোক এসে দাঁড়াল। তার গেঞ্জিতে অ আ ক খ লেখা। ফেব্রুয়ারি মাসের গেঞ্জি এপ্রিল মাসে পরে এসেছে। নীলগেঞ্জি আমার দিকে তাকিয়ে বলল, আপনাকে ডাকে। আসেন আমার সঙ্গে।
আমি কিছু বলার আগেই ড্রাইভার বলল, কে ডাকে?
শামসু ভাই ডাকে।
শামসু ভাই ডাকলে উনি অবশ্যই যাবেন। কিন্তু শামসু ভাই যে ডাকে, সেটা বুঝব ক্যামনে? ওনাকে এসে ডেকে নিয়ে যেতে বলেন।
এটা সম্ভব না। ওনারে আমার সঙ্গে যেতে হবে। এক্ষণ গাড়ি থেকে নামতে বলেন।
ড্রাইভার গাড়ি স্টার্ট দিতে দিতে বলল, উনি গাড়ি থেকে নামতে পারবেন না। ওনার পায়ে সমস্যা। ওনারে কি কোলে করে নিতে পারবেন? কোলে করে নিতে পারলে কোলে উঠায়ে নিয়ে যান।
বলতে বলতেই ড্রাইভার গাড়ির এক্সেলেটরে চাপ দিল। নীলগেঞ্জি লাফ দিয়ে সরল। আমরা কিছুক্ষণের মধ্যেই ফার্মগেটে চলে এলাম। তাজ রেস্টুরেন্ট নামের এক রেস্টুরেন্টের সামনে এখন গাড়ি থেমে আছে। ড্রাইভার বলল, ভাইজান, চা-কফি কিছু খাবেন? এরা ভালো কফি বানায়।
ড্রাইভারের কথায় কোনো টেনশন নেই। হুট করে গাড়ি নিয়ে পালিয়ে আসা যেন খুবই স্বাভাবিক ঘটনা।
মাওলানা বললেন, গোশ্ত-পরোটা খাব। ভুখ লাগছে।
আমরা গোশ্ত-পরোটা খেলাম। কফি খেলাম। ড্রাইভার বলল, মোবাইলে কল পাওয়ার পরে যাব। মামলা ফয়সালা হতে সময় লাগবে। আমাদের দলে লোক কম, এইটাই সমস্যা। এক ব্যাঙা ভাই কয় দিক দেখবে!
মাওলানা বললেন, কথা সত্য। একজনের ওপর অত্যধিক চাপ।
সন্ধ্য মিলাবার পর আমাদের যেতে বলা হলো। আমরা উপস্থিত হবার কিছুক্ষণের মধ্যে কালো বোরকায় ঢাকা একজনকে নিয়ে ব্যাঙা ভাই উপস্থিত হলেন। তাঁর সঙ্গে আরও লোকজন আছে। ব্যাঙা ভাই হাসিমুখে বললেন, স্বামী-স্ত্রীর মিলন ঘটায়ে দিতে পেরেছি, এতেই আমি সুখী। বড় একটা সোয়াবের কাজ হয়েছে। স্বামী থাকা অবস্থায় অন্যের সঙ্গে বিবাহ হলে আল্লাহর গজব পড়ত।
মাওলানা ঘন ঘন মাথা নাড়ছেন। ব্যাঙা ভাই মাওলানার সঙ্গে সবার পরিচয় করিয়ে দিলেন।
‘ইনিই এদের বিয়ের কাজি ছিলেন। এদের বিয়ে উনি পড়িয়েছেন। পাঁচ লাখ টাকা দেনমোহরে বিবাহ। অর্ধেক উসুল। ঠিক না, কাজি সাহেব?’
মাওলানা বললেন, সামান্য ভুল করেছেন। দেনমোহর ছিল চার লাখ।
আমার সঙ্গে বিশেষভাবে পরিচয় করানো হলো। ব্যাঙা ভাই আমার হাত ধরে বললেন, ইনি পদ্মের স্বামী। আমার ওস্তাদের ছোট ভাই। দামান, সবাইরে আসসালামু আলায়কুম দেন।
আমি বললাম, আসসালামু আলায়কুম।
সবাই গম্ভীর হয়ে গেল। কেউ সালামের উত্তর দিল না।
ব্যাঙা ভাই তাঁর দল নিয়ে গাড়িতে উঠলেন। রাজনৈতিক নেতাদের মতো হাত নাড়ালেন। মাইক্রোবাস চলতে শুরু করল। ব্যাঙা ভাই তৃপ্তির গলায় বললেন, বিরাট ঝামেলা লেগে গিয়েছিল। শামসুু দেখলাম প্যান্টের পকেটে হাত দিল। আমি বললাম, শামসুু ভাই! যন্ত্রপাতি শুধু আপনার আছে, অন্যের নাই এ রকম মনে করবেন না। আমার ওপর ওস্তাদের অর্ডার, মেয়ে নিয়ে যেতে হবে।
শামসু বলল, আপনার আবার ওস্তাদ আছে নাকি?
আমি বললাম, তারা চলাফিরার পথে ওস্তাদকে সালাম দেয়। তাদের যদি ওস্তাদ থাকে, রাস্তাঘাটে যে পিপীলিকা চলাফেরা করে তাদেরও ওস্তাদ থাকে, আমার কেন থাকবে না?
মাইক্রোবাস ফার্মগেটের তাজ হোটেলে গেল। ব্যাঙা ভাই আমার দিকে তাকিয়ে ক্লান্ত গলায় বললেন, আপনি এখান থেকে সিএনজি নিয়ে চলে যান। মাইক্রোবাস নিয়ে যাওয়া ঠিক হবে না।
বোরকাওয়ালি বোরকা খুলেছে। ‘অধিক শোকে পাথর’ কথাটি সে সত্যি প্রমাণ করেছে। তাকে দেখে মনে হচ্ছে, সে মৃত মানুষ। আমি বললাম, পদ্ম, তুমি কি আমাকে চিনতে পেরেছ?
সে জবাব দিল না, আমার দিকে তাকালও না।
আমি বললাম, খুব ছোটবেলায় তুমি তোমার মাকে নিয়ে আমাদের বাসায় এসেছিলে। হাতে একটা কঞ্চি নিয়ে বিড়াল তাড়াচ্ছিলে। তোমার কি মনে আছে?
পদ্ম মৃদু গলায় কী যেন বলল। বড় বড় করে কয়েকবার নিঃশ্বাস নিয়ে মাথা ঘুরে গাড়ির সিট থেকে নিচে পড়ে গেল। আমি তাকে তুলতে গিয়ে প্রথম লক্ষ করলাম, জ্বরে তার শরীর পুড়ে যাচ্ছে।
পদ্মর মা আমাদের বাসায় চলে এসেছেন। সঙ্গে একটা সুটকেস, দুটা বড় বড় কাগজের কার্টনে তাঁর সংসার। এই মহিলাকে আনানোর ব্যবস্থা ভাইয়া আলাদাভাবে করেছেন।
মহিলা মেয়েকে দেখে আনন্দে পুরো পাগল হয়ে গেলেন। চেঁচিয়ে বলতে লাগলেন, ‘পদ্ম ও পদ্ম, তাকিয়ে দেখ আমি তোর মা। তোর আর কোনো ভয় নাই। তাকিয়ে আমাকে একটু দেখ, লক্ষ্মী মা।’ এই মহিলারও মনে হয় মেয়ের মতো মূর্ছাব্যাধি আছে। কিছুক্ষণ হইচই করে তিনি মাথা ঘুরে পড়ে গেলেন।
পদ্ম জ্বরে অচেতন। সে কিছুই তাকিয়ে দেখছে না। তবে আমার বাবা ও মা তাকিয়ে দেখছেন। বাবা বাসায় এসেছেন কিছুক্ষণ আগে। ঘটনা এখনো হজম করে উঠতে পারেননি। হজম করার কথা না। বাবা চোখের ইশারায় আমাকে ডাকলেন। আমি কিছুই ঘটেনি ভাব নিয়ে কাছে গেলাম। বাবা বললেন, মা-মেয়েকে তুমি এনেছ?
আমি বললাম, আমি মেয়েটাকে এনেছি। তার মায়ের বিষয়ে কিছু জানি না। ভাইয়া জানতে পারে। ভাইয়াকে ডাকব?
আগে তুমি আমার প্রশ্নের জবাব দাও, তারপর ভাইয়া। মেয়েকে কোত্থেকে এনেছ?
আগারগাঁওয়ে একটা বস্তি আছে, সেখান থেকে তাকে উদ্ধার করা হয়েছে। তাকে জোর করে এক ট্রাক ড্রাইভারের সঙ্গে বিয়ে দেওয়া হচ্ছিল।
সমাজের হিত করার চেষ্টা?
হ্যাঁ।
অভিযানে বের হচ্ছ এই বিষয়টা আমাকে জানানোর প্রয়োজনও বোধ করলে না?
গোপন অভিযান তো বাবা, কাউকে জানানো যাচ্ছিল না।
তোমার ভাইয়াকে আমার শোবার ঘরে আসতে বলো।
আমিও কি সঙ্গে আসব?
আসতে পারো।
রাত আটটা দশ। আমরা বাবার শোবার ঘরে। লোডশেডিং চলছে বলে মোমবাতি জ্বালানো হয়েছে। মায়ের শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে, তিনি বিছানায় শুয়ে আছেন। আমরা দুই ভাই তাঁর পায়ের কাছে খাটে পা ঝুলিয়ে বসেছি। ভাইয়া পা দোলাচ্ছেন। আমি দোলাচ্ছি না।
বাবা আমাদের থেকে সাত-আট ফুট দূরে একটা প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে বসেছেন। তিনি জাজসাহেব ভাব ধরার চেষ্টা করছেন। মোমবাতির রহস্যময় আলোর জন্যে তাঁর জাজসাহেব ভঙ্গিটা ফুটছে না। তাঁকে বরং অসহায় লাগছে।
বাবা ভাইয়ার দিকে তাকিয়ে বললেন, টগর, তোমার কিছু বলার আছে?
ভাইয়া পা দোলাতে দোলাতে বলল, না।
এত বড় ঘটনা তোমরা দুই ভাই মিলে ঘটালে, এখন বলছ তোমাদের কিছু বলার নেই?
ভাইয়া বলল, আমি বলেছি আমার কিছু বলার নেই। মনজুর বলার কিছু আছে কি না সেটা সে জানে। আমার জানার কথা না।
আমি সঙ্গে সঙ্গে বললাম, আমার কিছু বলার নেই, বাবা।
বাবার মধ্যে দিশাহারা ভাব দেখা গেল। তিনি কোন দিক দিয়ে এগোবেন তা বুঝতে পারছেন না। ভাইয়া বলল, বাবা, আমি উঠি। পদ্ম মেয়েটার অনেক জ্বর। ওকে ডাক্তার দেখাতে হবে কিংবা হাসপাতালে ভর্তি করাতে হবে।
বাবা বললেন, তোমার মায়েরও তো ঘটনা দেখে শ্বাসকষ্ট শুরু হয়েছে। তাকেও তো হাসপাতালে ভর্তি করাতে হতে পারে।
ভাইয়া বলল, মাকে ভর্তি করাতে হলে ভর্তি করাব। পদ্ম আর মা পাশাপাশি দুই বেডে শুয়ে থাকল।
বাবা হঠাৎ গলার স্বর কঠিন করে বললেন, আমার একটা প্রশ্নের জবাব দিয়ে তারপর যেখানে ইচ্ছা সেখানে যাও। তুমি কোন সাহসে মা-মেয়েকে এখানে এনে তুললে?
ভাইয়া বলল, সাহস দেখানোর জন্যে এখানে আনিনি, বাবা। মানবিক কারণে এনেছি। ওরা ভয়ংকর অবস্থায় পড়েছিল। সেখান থেকে উদ্ধার পেয়েছে। তা ছাড়া এই বাড়ির অর্ধেকের মালিক তো তারা।
তার মানে?
পদ্মর বাবা অনেক কষ্ট করে জমি কেনার অর্ধেক টাকা দিয়েছিলেন। বেচারা মারা যাওয়ায় আপনার জমি দখলের সুবিধা হয়েছে।
তুমি বলতে চাচ্ছ, আমি অন্যায়ভাবে একজনের টাকা মেরে দিয়েছি?
হুঁ।
কী কারণে এই ধারণা হলো?
ঘটনা বিশ্লেষণ করে এ রকম পাওয়া যাচ্ছে, বাবা।
ঘটনা বিশ্লেষণ করে ফেলেছ?
হুঁ। তুমি পাপ করেছ, তার ফল ভোগ করছ।
কী ফল ভোগ করেছি?
দুই অপদার্থ পুত্রের জন্ম দিয়েছ। তোমার ছাত্রছাত্রীদের কাছ থেকে ‘মুরগি’ নামে খ্যাতি লাভ করেছ। আরও শুনবে?
বাবা চোখমুখ শক্ত করে রাখলেন। ভাইয়া বলল, আরেকটা ইন্টারেস্টিং কথা বলি, বাবা? তালাবদ্ধ ঘরে একজন বৃদ্ধ ভূত থাকে বলে মার ধারণা। ভূতটা খক খক করে কাশে। মার দৃঢ়বিশ্বাস, এই ভূতটা পদ্মর বাবা। তিনি জমির টানে এখানে নাজেল হয়েছেন। ভূত ঠান্ডা রাখার প্রয়োজন আছে। এখন তিনি আর কাশবেন না। খড়ম পায়ে হেঁটে মাকে ভয়ও দেখাবেন না।
বাবা ইংরেজিতে একটা দীর্ঘ গালি দিলেন। তিনি ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্যের শিক্ষক। তাঁর গালি ইংরেজিতে হওয়ারই কথা। বাবার গালির বাংলা ভাষ্য হলো—এই কুকুরিপুত্র। ঘর থেকে এই মুহূর্তে বিদায় হ। আর যেন তোকে না দেখি।
গালি শুনে ভাইয়া সুন্দর করে হাসল। হাসতে হাসতে বলল, কালো হ্যয়ং নিরবধি বিপুলা চ পৃথ্বী। এর অর্থ হলো, অন্তকাল ও বিশাল পৃথিবী রহিয়াছে।
বাবার ঘর থেকে আমরা দুই ভাই চলে আসছি। বাবা পেছন থেকে স্যান্ডেল ছুড়ে মারলেন। ভাইয়া আগে আগে যাচ্ছিলেন বলে স্যান্ডেল তার গায়ে লাগল না। আমার গায়ে লাগল। দৃশ্যটা দেখল রহিমার মা। সে আমকে সান্ত্বনা দিয়ে বলল, পিতা-মাতার হাতে স্যান্ডেলের বাড়ি খাওয়া বিরাট ভাগ্যের ব্যাপার। যে জায়গায় বাড়ি পড়ছে, সেই জায়গা বেহেশতে যাবে।
সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ১৩, ২০১১
অসাধারণ লেখা।