আমরা কেউ বাসায় নেই – ০১

১.
আমাদের বাসায় একটা দুর্ঘটনা ঘটেছে। আরও খোলাসা করে বললে বলতে হয় দুর্ঘটনা ঘটেছে বাসার শোবার ঘরের লাগোয়া টয়লেটে। কী দুর্ঘটনা বা আসলেই কিছু ঘটেছে কি না তাও পরিষ্কার না। গত ৩৫ মিনিট ধরে বাবা টয়লেটে। সেখান থেকে কোনো সাড়াশব্দ আসছে না। মা কিছুক্ষণ পরপর দরজা ধাক্কাচ্ছেন এবং চিকন গলায় ডাকছেন, এই টগরের বাবা! এই!
মা হচ্ছেন অস্থির রাশির জাতক। তিনি অতি তুচ্ছ কারণে অস্থির হন। একবার আমাদের বারান্দায় একটা দাঁড়কাক এসে বসল, তার ঠোঁটে মানুষের চোখের মতো চোখ। মা চিৎকার শুরু করলেন। মা মনে করলেন দাঁড়কাকটা জীবন্ত কোনো মানুষের চোখ ঠোকর দিয়ে তুলে নিয়ে চলে এসেছে। একপর্যায়ে ধপাস অর্থাৎ জ্ঞান হারিয়ে মেঝেতে পতন।
বাবা ৩৫ মিনিট ধরে শব্দ করছেন না। এটা মার কাছে ভয়ংকর অস্থির হওয়ার মতো ঘটনা। মা এখনো মূর্ছা যাননি এটা একটা আশার কথা।
মা এখন আমাদের ঘরে। আমি এবং টগর ভাইয়া এই ঘরে থাকি। মার মনে হয় শ্বাসকষ্ট হচ্ছে। তিনি বাজার থেকে কেনা জীবিত বোয়াল মাছের মতো হাঁ করছেন আর মুখ বন্ধ করছেন।
টগর ভাইয়া বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে আছে। তার বুকের ওপর একটা বই ধরা। বইটার নাম Other world, বইটা উল্টা করে ধরা। টগর ভাইয়া প্রায়ই উল্টা করে বই পড়তে পছন্দ করেন।
মা বললেন, টগর এখন কী করি বল তো! দরজা ভাঙব?
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, ভাঙো। কবি নজরুল হয়ে যাও।
কবি নজরুল হব মানে?
ভাইয়া বুকের ওপর থেকে বই বিছানায় রেখে উঠে বসতে বসতে বলল, ‘লাথি মারো ভাঙরে তালা যতসব বন্দিশালা!’ মা তুমি একটা চায়নিজ কুড়াল জোগাড় করো। আমি দরজা কেটে বাবাকে উদ্ধার করছি। ঘরে কি চায়নিজ কুড়াল আছে?
মা ক্ষীণ গলায় বললেন, না তো!
ভাইয়া বললেন, চায়নিজ কুড়াল অতি প্রয়োজনীয় জিনিস। সব বাড়িতেই দুটা করে থাকা দরকার। একটা সাধারণ ব্যবহারের জন্যে। অন্যটা হলো স্পেয়ার কপি। লুকানো থাকবে। আসলটা না পাওয়া গেলে তার খোঁজ পড়বে।
মা কাঁদো-কাঁদো গলায় বললেন, উল্টাপাল্টা কথা না বলে একটা ব্যবস্থা কর। বাথরুমের দরজা পলকা। লাথি দিলেই ভাঙবে।
ভাইয়া বলল, লাথি দিয়ে দরজা ভাঙলাম, দেখা গেল বাবা নেংটো হয়ে কমোডে বসে আছেন। ঘটনাটা বাবার জন্যে যথেষ্ট অস্বস্তিকর হবে। এই বিষয়টা ভেবেছ?
টগর আয় তো বাবা, আয়।
ভাইয়া বিছানা থেকে নামল। সেনাপতির পেছনে সৈন্যসামন্তের মতো আমি এবং মা ভাইয়ার পেছনে।
শোবার ঘরে ঢুকে দেখি বাবা বিছানায় বসে আছেন। তার কাঁধে টাওয়েল। তিনি মার দিকে তাকিয়ে বললেন, এক কাপ লেবু চা দাও তো! কড়া হয় না যেন। টি-ব্যাগ এক মিনিট রেখে উঠিয়ে ফেলবে।
মা বিদ্যুৎবেগে রান্নাঘরের দিকে ছুটলেন। আমরাও মার পেছনে পেছনে গেলাম। টয়লেট-দুর্ঘটনা নাটকের এখানেই সমাপ্তি।
এখন আমাদের পরিচয় দেওয়া যাক।
বাবা
বয়স ৬৩। একটা প্রাইভেট বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি ভাষা ও সাহিত্য পড়ান। সপ্তাহে দুদিন একটা টিউটোরিয়াল হোমে ইংরেজি শেখান। বাবা অত্যন্ত সুপুরুষ। তার পরও কোনো এক বিচিত্র কারণে ছাত্রমহলে তাঁর নাম মুরগি স্যার। ইউনিভার্সিটি থেকে টিউটোরিয়াল হোমেও বাবার এই নাম চালু হয়ে গেছে। বাবা বাসায় মা ছাড়া কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেন না। মার সঙ্গে তাঁর কথাবার্তাও অত্যন্ত সংক্ষিপ্ত। এসএমএস ধরনের। উদাহরণ ‘টেবিলে খাবার দাও। খেতে বসব।’ এই বাক্য দুটির জন্যে বাবা শুধু বলবেন, ‘Food!’
একজন সাহিত্যের অধ্যাপকের বাসায় বেশ কিছু বইপত্র থাকার কথা। তাঁর বইপত্রের মধ্যে আছে দুটা ইংরেজি ডিকশনারি। একটা জোকসের বই, নাম Party Jokes. আমি পুরো বই পড়ে দেখেছি কোনো হাসি আসে না। সেই বই থেকে একটা জোকের নমুনা:
A physician told me about one of his favourite patients. The doctor once asked the fellow it he had lived in the same place all his life. The man replied, ‘No, I was born in the bedroom next to the one where I sleep now.’
বাবাকে ডিকশনারি প্রায়ই পড়তে দেখা যায়। তখন তাঁর মুখ থাকে হাসি-হাসি। এই সময় যে কেউ তাঁকে দেখলে মনে করবে তিনি রোমান্টিক কোনো উপন্যাস পড়ছেন।
তিনি টেলিভিশন দেখেন না, মাঝেমধ্যে ইংরেজি খবর পাঠ দেখেন। খবর পাঠ শেষ হওয়া মাত্র বিরক্ত মুখে বলেন, ভুল উচ্চারণ। থাবড়ানো দরকার। ‘থাবড়ানো দরকার’ তাঁর প্রিয় বাক্য। সবাইকে তিনি থাবড়াতে চান। রিকশাওয়ালা দুই টাকা বেশি নিলে তিনি বিড়বিড় করে বলবেন, থাবড়ানো দরকার।
বাবা স্বাস্থ্যের প্রতি অত্যন্ত যত্নশীল। প্রতিদিন ভোরবেলা তাঁকে উঠানে ঘড়ি ধরে ২০ মিনিট হাঁটতে দেখা যায়। ২০ মিনিট পার হলে ১০ মিনিট ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজ করেন। হণ্ঠন এবং এক্সারসাইজের সময়ের হিসাব রাখেন মা। তিনি বারান্দার মাঝখানে হাতঘড়ি নিয়ে বসে থাকেন। ২০ মিনিট পার হওয়ার পর বলেন, Time out. ১০ মিনিট ফ্রিহ্যান্ড এক্সারসাইজের পর আবার বলেন Time out. বাবা চান মা তাঁর সঙ্গে ইংরেজিতে কথা বলেন। মা Time out ছাড়া আর কোনো ইংরেজি বলেন না।
খাবার-দাবার বিষয়ে বাবাকে উদাসীন মনে হয়, তবে কিছু বিশেষ খাবার তাঁর অত্যন্ত পছন্দ। এই খাবারগুলোর রন্ধনপ্রক্রিয়া যথেষ্ট জটিল। শুধু একটি উল্লেখ করি। কলার মোচার বড়া। কলার মোচা প্রথমে ভাপে সেদ্ধ করতে হয়। তারপর ডিম মেশানো বেসনে মেখে অল্প আঁঁচে ভাজতে হয়।
বাবার বিনোদনের ব্যাপারটা বলি। মাঝেমধ্যে তাঁকে মোবাইল ফোনে একটি গেম খেলতে দেখা যায়। এই খেলায় সাপকে আপেল, আঙুর খাওয়াতে হয়। এসব সুখাদ্য খেয়ে সাপ মোটা হয়। সাপ ঠিকমতো খাদ্য গ্রহণ না করলে বাবা চাপা গলায় বলেন থাবড়ানো দরকার।
মা
ক্লাস টেনে পড়ার সময় বাবার সঙ্গে মার বিয়ে হয়। ইচ্ছাকৃতভাবে হোক বা অনিচ্ছাকৃতভাবে হোক বিয়ের রাতে বাবা তিনটা বিড়াল মেরে ফেলেন। স্ত্রীর ইংরেজি জ্ঞান পরীক্ষার জন্যে তিনটি প্রশ্ন করেন। কোনোটার উত্তরই মা দিতে পারেননি। প্রশ্নগুলো—
বাবা: ‘Hornet শব্দের মানে কী?’
মা: (ভীত গলায়) জানি না।
বাবা: Wood Apple কী?
মা: (আরও ভীত) জানি না।
বাবা: Daily life মানে কী?
মা: (ফোঁফাতে ফোঁফাতে) জানি না।
মা পরে আমাকে বলেছেন Daily life মানে তিনি জানতেন। ভয়ে মাথা আউলিয়ে গিয়েছিল।
বাবা: তুমি তো কিছুই জানো না, ফাজিল মেয়ে। তোমাকে থাবড়ানো দরকার।
বিয়ের রাতে মা যে ভয় পেয়েছিলেন সেই ভয় এখনো ধরে রেখেছেন। বাবাকে তিনি একজন মহাজ্ঞানী রাজপুত্র হিসেবে জানেন। তাঁর সামনে সব সময় নতজানু হয়ে থাকতে হবে, এটি তিনি বিধির বিধান হিসেবেই নিয়েছেন।
মা বাবাকে ভয় পান এবং প্রচণ্ড ভালোবাসেন। ভয় এবং ভালোবাসার মতো সম্পূর্ণ বিপরীত আবেগ একসঙ্গে ধরা কঠিন কিন্তু মা ধরেছেন। বাবার প্রতি মার ভালোবাসার একটা উদাহরণ দেওয়া যেতে পারে।
বাবাকে তার ছাত্রছাত্রীরা মুরগি ডাকে এই খবর প্রথম শুনে তিনি মাথা ঘুরে মেঝেতে পড়ে কপালে ব্যথা পেয়েছিলেন। মাথায় পানি ঢেলে মোটামুটি সুস্থ করার পর মার প্রথম বাক্য। টগর, সত্যি তোর বাবাকে সবাই মুরগি ডাকে?
ভাইয়া বলল, মুরগি সবাই ডাকে না, কেউ কেউ ডাকে মুর্গ, মুরগির চেয়ে মুর্গ শব্দটা ভালো। মুর্গ শুনলে মাথায় আসে মুর্গ মুসাল্লাম। মুর্গ মুসাল্লাম একটি উচ্চমানের মোঘলাই খানা। কাউকে মুর্গ ডাকা তার প্রতি সম্মানসূচক।
রূপবান পুরুষদের স্ত্রীরা কুরূপা হয় এটা নিপাতনে সিদ্ধ। মা নিয়মের ব্যতিক্রম। তিনি শুধু যে রূপবতী তা না, তাঁর বয়স মোটেই বাড়ছে না। তাঁকে এখনো খুকি মনে হয়। আমেরিকান সায়েনটিস্টরা খবর পেলে মার ‘জিন’ নিয়ে গবেষণা করে কিছু বের করে ফেলত।
মা অত্যন্ত অলস প্রকৃতির। সকাল ১০-১১টার আগে কখনো বিছানা থেকে নামেন না। তিনি অনেক ধরনের রান্না জানেন কিন্তু রাঁধেন না।
মার একটি বিশেষ অর্জন বলা যেতে পারে। স্কুলে ক্লাস এইটে পড়ার সময় মা শরৎচন্দ্রের দেবদাস উপন্যাস পুরোটা মুখস্থ বলে সবাইকে তাক লাগিয়ে দিয়েছিলেন। দেবদাস এখনো তাঁর মুখস্থচর্চার মধ্যে আছে। প্রায়ই তাঁকে দেবদাস হাতে নিয়ে বিছানায় শুয়ে থাকতে দেখা যায়।
টগর ভাইয়া
খুব ভালো রেজাল্ট করে বুয়েট থেকে মেকানিক্যাল ইঞ্জিনিয়ারিংয়ে পাস করেছে। তাকে বুয়েটে লেকচারার পদে যোগ দিতে বলা হলো। ভাইয়া বলল, আমি ‘চিৎকারক’ হব না। লেকচারার হওয়া মানে ক্লাসে চিৎকার দেওয়া এর মধ্যে আমি নই।
মা বললেন, তাহলে কী হবি?
ভাইয়া বলল, কিছুই হব না। চিন্তা করে করে জীবন পার করে দেব।
মা বললেন, কী সর্বনাশ!
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, সর্বনাশের কিছু না মা। এই পৃথিবীতে অনেক গুরুত্বপূর্ণ মানুষ আছেন, যাঁরা কোনো কাজকর্ম ছাড়া শুধু চিন্তা করে জীবন পার করে দিয়েছেন। যেমন গৌতম বুদ্ধ।
তুই গৌতম বুদ্ধ হবি?
গৌতম বুদ্ধ হওয়া যায় না। আমি অন্য কিছু হব।
অন্য কিছুটা কী?
চট করে তো বলা যাবে না। ভেবেচিন্তে বের করতে হবে।
প্রায় তিন বছর হয়ে গেল ভাইয়া চিন্তা করে যাচ্ছে।
বেশির ভাগ সময় বিছানায় চিৎ হয়ে শুয়ে তাকে পা নাচাতে দেখা যায়। এই সময় তার চোখ বন্ধ থাকে। ভাইয়া কখন জেগে আছে, কখন ঘুমাচ্ছে বোঝা যায় না। ঘুমের মধ্যেও সে পা নাড়তে পারে।
গতকাল রাতে বাবার সঙ্গে ভাইয়ার কথা হয়েছে। বাবা বললেন, তোমার মার কাছে শুনলাম তুমি গৌতম বুদ্ধ হবে।
ভাইয়া শুয়ে ছিল। শোয়া থেকে উঠে বসতে বসতে বলল, তোমরা সবাই যদি চাও তাহলে গৌতম বুদ্ধের মতো কেউ হওয়ার চেষ্টা করতে পারি। অনেক দিন হলো পৃথিবীতে নতুন কোনো ধর্ম আসছে না। নতুন ধর্ম আসার সময় হয়ে গেছে।
বাবা ঝিম ধরে কিছুক্ষণ বসে রইলেন। ভাইয়াও বসে ঘন ঘন হাই তুলতে লাগল। এক সময় বাবা উঠে চলে গেলেন। বিড়বিড় করে কিছু একটা বললেন। কী বললেন পরিষ্কার বোঝা গেল না। মনে হয় থাবড়ানো বিষয়ে কিছু বললেন।
ভাইয়ার ঘরের দেয়ালে তার মাথার কাছে আইনস্টাইনের একটা ব্ল্যাক এক হোয়াইট ছবি টাঙানো। ছবিতে জিভ বের করে আইনস্টাইন ভেঙাচ্ছেন। ছবির নিচে ভাইয়া লিখে রেখেছেন—The great fool.
ভাইয়ার স্বভাবও মার মতো অলস প্রকৃতির। গোসলের মতো প্রাত্যহিক কাজ তিনি আলস্যের কারণে করেন না। সপ্তাহে বড়জোর দুদিন তিনি গোসল করেন। গোসল না করার পেছনে তার যুক্তি হচ্ছে, পৃথিবীর অনেক দেশেই খাবার পানির ভয়ংকর অভাব, সেখানে আমি গায়ে ঢেলে এতটা পানি নষ্ট করব? অসম্ভব।
মা যেমন শুধু দেবদাস পড়েন, ভাইয়া সে রকম না। তার ঘরভর্তি বই। যতক্ষণ তিনি জেগে থাকেন ততক্ষণ তার মুখের সামনে বই ধরা থাকে।
আমি
আমার নাম মনজু। ভাইয়া যে রকম ব্রিলিয়েন্ট আমি সে রকম গাধা। দুবার বিএ পরীক্ষা দিয়ে ফেল করেছি। দ্বিতীয়বার ফেলের বিষয়টা শুধু ভাইয়া জানে। বাবা-মা দুজনকেই পা ছুঁয়ে সালাম করে বলেছি, হায়ার সেকেন্ড ক্লাস পেয়েছি। মা মিষ্টি কিনে বাড়িতে বাড়িতে পাঠিয়েছেন। আমাকে বলেছেন, তোর পাসের খবরে এত খুশি হয়েছি! আমি স্বপ্নে দেখেছিলাম তুই এবারও ফেল করেছিস।
[মার স্বপ্নের ব্যাপারটা বলতে ভুলে গেছি। মা যা স্বপ্নে দেখেন তাই হয়। একবার মা স্বপ্নে দেখলেন, রিকশা থেকে পড়ে বাবা পা ভেঙে ফেলেছেন। এক সপ্তাহ পর একই ঘটনা ঘটল। বাবা রেগে গিয়ে মাকে বলেছিলেন, এ ধরনের স্বপ্ন কম দেখলে ভালো হয়। ভালো কিছু দেখবে, তা-না পা ভাঙা, হাত ভাঙা। থাবড়ানো দরকার।
মা খুব লজ্জা পেয়েছিলেন।]
রহিমার মা
রহিমার মা আমাদের কাজের বুয়া। বিরাট চোর, তবে খুব কাজের। ভাইয়ার প্রতি তার আলাদা দুর্বলতা আছে বলে আমার ধারণা। ভাইয়ার যেকোনো কাজ করার জন্যে সে ব্যস্ত। ভাইয়ার সঙ্গে নানা ধরনের গল্পও করে। একদিন ভাইয়াকে বলল, ‘বুঝছেন ভাইজান, শইটলটা নিয়া পড়ছি বিপদে। মানুষের বাড়িত কাম করব কী সবাই শইলের দিকে চায়া থাকে।’
ভাইয়া বলল, ‘তাকিয়ে থাকার মতো শরীর তো তোমার না রহিমার মা। কেন তাকিয়ে থাকে?
কী যে কন ভাইজান, রইদে পুইড়া চেহারা নষ্ট হইছে, কিন্তু শইল ঠিক আছে। আইজ পর্যন্ত এমন কোনো বাড়িতে কাম করি নাই যেখানে আমারে কুপ্রস্তাব দেয়নি। হয় বাড়ির সাহেব কুপ্রস্তাব দেয়। সাহেব না দিলে বেগম সাবের ভাই দেয়।’
আমাদের বাড়ি থেকে তো এখনো কোনো কুপ্রস্তাব পাও নাই।
সময় তো পার হয় নাই ভাইজান। সময় আছে আর আমার শইলও আছে। যেদিন কুপ্রস্তাব পাব আপনারে প্রথম জানাব। এটা আমার ওয়াদা।
রহিমার মার বিয়ে হয়নি এবং রহিমা নামে তার কোনো মেয়েও নেই। সে ১৫-১৬ বছর বয়সে কাজ করতে গেল। কোনো বেগম সাহেব তাকে রাখে না। কুমারী মেয়ে রাখবে না। সে নিজেই তখন বুদ্ধি করে রহিমার মা নাম নিল। দেশের বাড়িতে তার স্বামী আছে, রহিমা নামের মেয়ে আছে। তখন চাকরি হলো। আমাদের এখানে দুই বছর ধরে আছে।
পরিবারের সবার কথাই তো মোটামুটি বলা হলো। এখন যে বাড়িতে থাকি তার কথা বলি। বাড়ি একটি জীবন্ত বিষয়। বাড়ির জন্ম-মৃত্যু আছে। রোগব্যাধি আছে। কোনো কোনো বাড়ির আত্মাও আছে। আবার আত্মা শূন্য নিষ্ঠুর বাড়িও আছে। আমরা থাকি ঝিগাতলার বুদ্ধিজীবী স্মৃতিসৌধের কাছাকাছি, একটা গলির ভেতর। গলির নাম ছানাউল্লাহ সড়ক। ছানাউল্লাহ আওয়ামী লীগের এক নেতা। গলির নামকরণ ছানাউল্লাহ সাহেব নিজেই করেছেন। নিজ খরচায় কয়েক জায়গায় সাইনবোর্ড টানিয়ে দিয়েছেন। স্থানীয় বাসিন্দারা ছানাউল্লাহ সড়ক বলে না। বলে মসজিদের গলি। গলির শেষ মাথায় মসজিদ আছে বলেই এই নাম। মসজিদের গলিতে বাবা ছকাঠা জায়গায় একতলা বাড়ি বানিয়েছেন। দোতলা করার শখ আছে। শখ মিটবে এ রকম মনে হচ্ছে না। বাবার জমি কেনার কিছু ইতিহাস আছে। জমিটা তিনি এবং তাঁর এক বন্ধু ফজলু চাচা কিনেছিলেন। জমি কেনার এক সপ্তাহের মাথায় ফজলু চাচা মারা যান। জমি রেজিস্ট্রি এবং নামজারি বাবা নিজের নামে করে নেন।
ফজলু চাচার স্ত্রী তাঁর বাচ্চা মেয়েকে নিয়ে কয়েকবার এই বাড়িতে এসেছিলেন। প্রতিবারই বাবা অতি ভদ্রভাবে বলেছেন, ভাবি! ফজলু এবং আমি দুজনে মিলেই জায়গাটা কিনতে চেয়েছিলাম। শেষ মুহূর্তে ফজলু টাকাটা দিতে পারেনি। টাকা নিয়ে সে রওনা হয়েছিল এটাও সত্যি। পথে টাকা ছিনতাই হয়। ফজলু সাত দিনের মাথায় মারা যায়। টাকার শোকেই মারা যায়।
ভদ্রমহিলা কাঁদতে কাঁদতে বললেন, আমার গয়না বিক্রি করা টাকা। পদ্মর বাবা বলেছিল, টাকা আপনার হাতে দিয়েছে।
আপনাকে শান্ত করার জন্যে বলেছে ভাবি। এতগুলো টাকা ডাকাতরা নিয়ে গেল। কাউকে বলাও তো কঠিন।
ভাই, আমি এখন কী করব বলুন। পড়াশোনা নাইন পর্যন্ত। কেউ তো আমাকে কোনো চাকরিও দেবে না।
বিভিন্ন অফিসে চেষ্টা করতে থাকুন। নতুন নতুন মার্কেট হচ্ছে, তাদের সেলস গার্ল দরকার। তারা বেতনও খারাপ দেয় না। আমিও চেষ্টা করব।
বাবা যতক্ষণ কথা বলছিলেন বাচ্চা মেয়েটা ততক্ষণই একটা কঞ্চি হাতে ছোটাছুটি করছিল। আমি বললাম, এই খুকি কী করছ?
সে বলল, আমার নাম খুকি না। আমার নাম পদ্ম।
আমি বললাম, এই পদ্ম, তুমি কঞ্চি নিয়ে কী করছ?
বিড়াল তাড়াচ্ছি।
বিড়াল কোথায়?
তোমাদের বাড়িতে অনেকগুলো বিড়াল। তুমি দেখতে পাচ্ছ না। আমি পাচ্ছি। ওই দেখ একটা কালো বিড়াল।
পদ্ম কঞ্চি হাতে কালো বিড়ালের দিকে ছুটে গেল।
ভাইয়ার কাছে শুনেছি, দু-তিন মাস পরপর ভাইয়াকে দিয়ে বাবা ফজলু চাচার স্ত্রীকে পাঠিয়েছেন। মেয়েদের এক স্কুলে আয়া শ্রেণীর চাকরিও জোগাড় করে দিয়েছিলেন। আমাদের এই বাড়ির আর্কিটেক্ট বাবা। মাঝখানে খানিকটা খালি জায়গা রেখে চারদিকে ঘর তুলে ফেলেছেন। বড় ঘর, মাঝারি ঘর, ছোট ঘর-ঘরের ছড়াছড়ি। এর মধ্যে দুটি ঘর তালাবদ্ধ। এই দুটি হলো গেস্টরুম। গেস্ট আসে না বলে তালা খোলা হয় না।
আমার মার ধারণা, বাড়িতে কোনো ঘর দীর্ঘদিন তালাবন্ধ থাকলে সেখানে ভূত-প্রেত আশ্রয় নেয়। মা মোটামুটি নিশ্চিত তালাবন্ধ ঘরের একটিতে একজন বৃদ্ধ ভূত বাস করে। মা অনেকবার খড়ম-পায়ে ভূতের হাঁটার শব্দ শুনেছেন এবং খক খক কাশির শব্দ শুনেছেন। মনে হয় যক্ষ্মা রোগগ্রস্ত ভূত। ভূত সমাজে অসুখ-বিসুখ থাকা বিচিত্র কিছু না। ভূতটা খড়ম পায়ে হাঁটে কেন তা পরিষ্কার না। খড়ম বাংলাদেশ থেকে উঠে গেছে। গ্রামের দিকেও স্পঞ্জের স্যান্ডেল। আমাদের এই ভূত অপ্রচলিত খড়ম কোথায় পেল কে জানে।
বৃদ্ধ ভূতের কিছু কর্মকাণ্ড আমি নিজের কানে শুনেছি। আমাদের বাড়ির ঠিক মাঝামাঝি জায়গায় একটা চাপকল। এক রাতে শুনি চাপকলে চাপ দিয়ে কেউ পানি তুলছে। ঘটং ঘটং শব্দ হচ্ছে। বাইরে এসে দেখি, ফকফকা চাঁদের আলো। চাপকলের ধারে কাছে কেউ নেই। আমি দৌড়ে ভাইয়ার ঘরে ঢুকলাম। ভূত দেখতে পাওয়া যেমন ভয়ংকর, দেখতে না পাওয়াও ভয়ংকর। এরপর থেকে আমি রাতে ভাইয়ার সঙ্গে ঘুমাই। কী দরকার ভূত-প্রেতের ঝামেলায় যাওয়ার!
ভাইয়া অবশ্য চাপকলের একটা ব্যাখ্যা দাঁড় করিয়েছে। ভাইয়ার ব্যাখ্যা হচ্ছে চাপকলের ভেতর থাকে পানি। মাঝেমধ্যে প্রাকৃতিক কারণে পানির স্তর ওঠানামা করে। এমন কোনো ঘটনা ঘটলে চাপকলের ভেতরের রিং স্ল্যাভ ওঠানামা করবে। বাইরে থেকে মনে হবে অদৃশ্য কেউ চাপকল চাপছে।
ভাইয়া যেকোনো বিষয়ে সুন্দর যুক্তি দিতে পারে। মাথার কাছে আইনস্টাইনের ছবি থাকায় মনে হয় এ রকম হচ্ছে।
আমাদের বিষয়ে যা বলার মোটামুটি বলা হয়ে গেছে। এখন মূল গল্পে আসা যেতে পারে। না না, মূল গল্পে আসার আগে আমাদের গাড়ি কেনার গল্পটা বলে নেই। সোমবারের বাবার দুটা ক্লাস। এই দিন তিনি সকাল সাতটার আগেই বাসা থেকে বের হন। এত সকালে রহিমার মার ঘুম ভাঙে না বলে নাশতা তৈরি হয় না। আমাকে দোকান থেকে নাশতা নিয়ে আসতে হয়। দুটা পরোটা, বুন্দিয়া আর একটা ডিম সেদ্ধ। বাবা ডিমের কুসুম খেয়ে সাদা খোসা আমার দিকে এগিয়ে দিয়ে বলেন লবণের ছিটা দিয়ে খেয়ে ফেল।
অন্যের উচ্ছিষ্ট খাওয়া নোংরা ব্যাপার। বাবার দিকে তাকিয়ে প্রতি সোমবার আমাকেই এই কাজটি করতে হয়। দুটা পরোটা তিনি খেতে পারেন না অর্ধেকটা বেঁচে যায়। এই অর্ধেকের ভেতর বুন্দিয়া দিয়ে তিনি রোলের মতো বানিয়ে বলেন, খেয়ে ফেল। বুন্দিয়া রোলও আমাকে খেতে হয়। সোমবার ভোর আমার জন্যে অশুভ।
আজ সোমবার। বাবা ইউনিভার্সিটি যাওয়ার জন্যে তৈরি হচ্ছেন না। চাপকলের কাছে প্লাস্টিকের লাল চেয়ারে টিভি বিজ্ঞাপনের এনএফএলের চেয়ারম্যানের মতো বসে আছেন। আমি বললাম, ‘টাকা দাও নাশতা নিয়ে আসি।’
বাবা বললেন, তুই আমাকে ডিকশনারিটা এনে দে।
আমি ডিকশনারি এনে দিলাম, বাবা গম্ভীর ভঙ্গিতে ডিকশনারির পাতা উল্টাতে লাগলেন।
আগেই বলেছি মা কখনোই ১০-১১টার আগে ঘুম থেকে উঠতে পারেন না। আজ সবই এলোমেলো, আটটার সময় মার ঘুম ভেঙে গেল। মা উঠানে এসে চিন্তিত গলায় বললেন, কী হয়েছে ইউনিভার্সিটি যাবে না?
বাবা বললেন, না।
না কেন শরীর খারাপ?
বাবা ডিকশনারি বন্ধ করতে করতে বললেন, কাছে আসো। Come closer.
মা ভীত গলায় এগিয়ে গেলেন। বাবা ফিস ফিস করে মাকে কিছু বললেন। কী বললেন আমি শুনতে পেলাম না, তবে নিশ্চয়ই গুরুত্বপূর্ণ কোনো কথা। মার মুখের হাঁ বড় হয়ে গেল। বুকে হাত দিয়ে ঘন ঘন নিঃশ্বাস নিতে লাগলেন। তাঁর মাথা মনে হয় ঘুরছে, তিনি পড়ে যাওয়ার মতো ভঙ্গি করছেন। বাবা চেয়ার থেকে উঠে মাকে ধরে চেয়ারে বসিয়ে দিয়ে নিজের ঘরে চলে গেলেন। আমি মার সামনে দাঁড়ালাম। চিন্তিত গলায় বললাম, মা কোনো সমস্যা?
মা বললেন, তোর বাবা গাড়ি কিনেছে। ক্রিম কালারের গাড়ি। নয়টার সময় ড্রাইভার গাড়ি নিয়ে আসবে। ড্রাইভারের নাম ইসমাইল। কী কাণ্ড দেখেছিস? তোর বাবা গাড়ি কিনে ফেলেছে। আল্লা গো আমার এখনো বিশ্বাস হচ্ছে না। মনে হয় স্বপ্ন দেখছি। কে জানে মনে হয় স্বপ্ন। টগরকে ডেকে তুলে গাড়ি কেনার কথা বল। এত বড় একটা ঘটনা, সে ঘুমাচ্ছে এটা কেমন কথা। রহিমার মাকেও ডেকে তোল। সে শুনলে খুশি হবে।
ভাইয়াকে বাবা নিজেই ডেকে তুললেন। গম্ভীর গলায় বললেন, তুই ইঞ্জিনিয়ার মানুষ গাড়ির কলকবজার কি অবস্থা দেখে দে।
ভাইয়া বলল, কিসের কলকবজা দেখব?
গাড়ির। একটা গাড়ি কিনেছি।
ভাইয়া হাই তুলতে তুলতে বলল, খামাখা গাড়ি কিনেছ কেন?
বাবা হতাশ গলায় বললেন, গাড়ির প্রয়োজন আছে এ জন্যে কিনেছি। আমার তো নানা জায়গায় যেতে হয়। তোর মতো বিছানায় শুয়ে থাকলে হয় না।
ভাইয়া বলল, তুমি শুধু ইউনিভার্সিটি যাও সেখান থেকে বাসায় আস। তোমার জন্যে রিকশাই যথেষ্ট।
নতুন গাড়ির প্রতি ভাইয়ার অনাগ্রহ মা পুষিয়ে দিলেন। তার বয়স পাঁচ বছর কমে গেল। গলার স্বরে কিশোরী ভাব চলে এল। আমাকে আহ্লাদি গলায় বললেন, তোর বাবা বলেছে আমাকে নিয়ে লং ড্রাইভে যাবে। শাড়ি কোনটা পরব বল তো। বিয়ের শাড়িটা পরব?
পরতে পারো। বাবাকে ভুলিয়ে-ভালিয়ে শেরওয়ানি পাগড়ি পরিয়ে দাও।
মা বললেন, ঠাট্টা করিস না। চট করে যা মসজিদে ইমাম সাহেবকে নিয়ে আয় নতুন গাড়িতে দোয়া বখশে দিবেন।
ইমাম বাইরে থেকে আনতে হলো না, গাড়ির সঙ্গেই চলে এলেন। গাড়ির ড্রাইভার ইসমাইলকে দেখে মনে হলো দেওবন্ধ মাদ্রাসার শিক্ষক। হাঁটুর গোড়ালির ওপর পায়জামা। সবুজ পাঞ্জাবিও হাঁটু ছাড়িয়ে অনেক দূর নেমে গেছে। মুখ ভর্তি চাপ দাড়ি। চোখে সুরমা। নামাজ পড়ে কপালে স্থায়ী দাগ ফেলে দিয়েছেন। ভাইয়া হুড খুলে গাড়ির ইঞ্জিন পরীক্ষা করে বলল, ইঞ্জিন তার জীবনের শেষ প্রান্তে চলে এসেছে। যেকোনো দিন ফোঁস করে নিঃশ্বাস ফেলে ইন্তেকাল করবে। এই যে বসবে আর উঠবে না। বাবা কী মনে করে এই আবর্জনা কিনল।
ড্রাইভার ইসমাইল বলল, ইঞ্জিন খুব ভালো অবস্থায় আছে ভাইজান। বাঘের বাচ্চা ইঞ্জিন।
ভাইয়া বলল, বাঘের হলে খুবই ভালো কথা। হালুম হালুম করে গাড়ি চলবে, মন্দ কি।
বাবা এবং মা (বিয়ের বেনারসি পরে) বাঘের বাচ্চা ইঞ্জিনের গাড়িতে করে বের হলেন। রহিমার মা ঠোঁটে লিপস্টিক মেখে তাঁদের সঙ্গে গেল। সে বসল ড্রাইভারের পাশে। তার গাম্ভীর্য দেখার মতো। তার হাতে টকটকে লাল রঙের ভ্যানিটি ব্যাগ। দুই ঘণ্টা রিকশা করে ভাড়া করা সিএনজিতে তিনজন ফিরল। তিনজনেরই মুখ গম্ভীর। রহিমার মার চোখে পানি। বাবার নতুন কেনা গাড়ির ইঞ্জিন বসে গেছে। ড্রাইভার ইসমাইল গাড়ি ঠেলে নিয়ে গেছে গ্যারেজে।
যাই হোক বাঘের বাচ্চা ইঞ্জিন ঠিক করা হয়নি। যে টাকায় বাবা তাঁর ইউনিভার্সিটির প্রক্টরের কাছ থেকে গাড়ি কিনেছেন, তার কাছাকাছি টাকা লাগছে ইঞ্জিন সারতে। এই টাকা বাবার কাছে নেই। গাড়ি এখন বাসায়। ড্রাইভার ইসমাইল রোজ এই গাড়ি ঝাঁড়-পোছ করে। সপ্তাহে একদিন গাড়ির গোসল হয়। নিজের টাকায় সে একটা এয়ারফ্রেশনার কিনে গাড়িতে লাগিয়েছেন। নষ্ট গাড়ি আমাদের বাসায় মহা যত্নে আছে। রহিমার মাকে প্রায়ই সেজেগুজে নষ্ট গাড়ির পেছনের সিটে বসে থাকতে দেখা যায়।
এখন গাড়ির ড্রাইভার ইসমাইল সম্পর্কে কিছু তথ্য দিয়ে মূল গল্পে চলে যাব।
ইসমাইল
আমাদের সাম্প্রতিক অন্তর্ভুক্ত পারিবারিক সদস্যদের একজন ইসমাইল। বাড়ি নেত্রকোনার ধুন্ধুল গ্রামে। শ্যাওড়াপাড়া থানা। অতি ধার্মিক। ফজরের নামাজের পর কোরআন পাঠ দিয়ে সে দিন শুরু করে। কোনো নামাজের ওয়াক্ত আজান না দিলেও সে মাগরিবের আজান দেয়। প্রায়ই শোনা যায় সে রোজা।
বাসার কিছু কাজকর্মে সে সাহায্য করে। যেমন বাজার করা, উঠান ঝাঁট দেওয়া। টবে পানি দেওয়া। তার একটি কর্মদক্ষতায় ভাইয়া মুগ্ধ। ইসমাইল একটা মুরগি জবেহ করতে পারে। দুই হাঁটুতে মুরগির পা চেপে ধরে এই কাজটি সে করে।
রহিমার মা ইসমাইলের কর্মকাণ্ড নিবিড় পর্যবেক্ষণে রেখেছে। ভাইয়ার সঙ্গে এই বিষয়ে সে মতবিনিময়ও করে। যেমন একদিন শুনলাম, সে ভাইয়াকে বলছে, লোকটা ভাবের মধ্যে আছে। মেয়েছেলে দেখলে সঙ্গে সঙ্গে চোখ বন্ধ করে। মাথা ঘুরায়ে নেয়।
ভাইয়া বলল, মওলানা মানুষ। এটাই তো স্বাভাবিক।
রহিমার মা বলল, থুন ফালায়া কত মওলানা দেখলাম। ইশারার অপেক্ষা। ইশারা পাইলেই ফাল পাড়ব।
ইশারা দিচ্ছ না?
সময় হোক, সময় হইলেই দিব। তখন দেখা যাবে কত বড় মুন্সি।
ইশারাটা দিবে কীভাবে?
সব তো আপনেরে বলব না। একেক জনের জন্যে একেক ইশারা। আপনের জন্যে যে ইশারা খাটবে, মুন্সির জন্যে সেটা খাটবে না।
ভাইয়া আগ্রহ নিয়ে বলল, আমাকে একবার একটা ইশারা দিও তো, দেখি ঘটনা কী?
আমাদের সংসারের চাকা এইভাবেই ঘুরছে। বাবা ক্লসে যাচ্ছেন, ফিরে আসছেন। রহিমার মা নষ্ট গাড়ির দরজা খুলে পেছনের সিটে বসে থাকছে। সন্ধ্যা বেলায় ড্রাইভার ইসমাইল কলপাড়ে দাঁড়িয়ে আজান দিচ্ছে। ভাইয়া বই উল্টা করে পড়ছে। রহিমার মা অপেক্ষায় আছে ইশারার। এমন সময় গুরুত্বপূর্ণ ঘটনা ঘটল।

সূত্র: দৈনিক প্রথম আলো, মে ০৬, ২০১১

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *