আমরা কিন্তু হাসছি না

আমরা কিন্তু হাসছি না

‘নাও, নাও, আজ আবার লিখে রেখে গিয়েছে৷’ বাড়ির বাইরে বেরিয়েই মেঘের মতো গর্জে উঠলেন দুর্গাপ্রসাদ৷ মেঘ গর্জালে বাজ পড়বেই৷ বাজখাঁই গলায় হুংকার করে উঠলেন ঝুমরি, ‘আবার! বলি, বুড়ো মানুষটাকে কি রোজ দগ্ধে দগ্ধে মারবি? তিনকাল গে এককালে ঠেকল, এখনও ভীমরতি গেল না? অ্যাঁ?’

যার উদ্দেশ্যে বলা, তিনি উলটোদিকের বাড়ির দোতলায় ঘাপটি মেরে বসে ছিলেন৷ মিটমিট করে চেয়ে ছিলেন এ বাড়ির দিকে৷ মেঘের গর্জন ওঁর কানে যায়নি, কিন্তু বজ্রপাতখানা শুনেছেন৷ আপাতত তিনি কিছুক্ষণ মজা দেখবেন৷ মোবাইল ফোনে গোটা চিৎকারপর্ব রেকর্ড করবেন৷ তারপর সারাদিন সেইটে চালিয়ে রাখবেন লুপে৷

দুর্গাপ্রসাদ ও ওঁর স্ত্রী উত্তেজিত হলে তিনি বেজায় আনন্দ পান৷ ব্যাপার কিছুই নয়৷ দিন সাতেক হল, দুর্গাপ্রসাদের বাড়ির বাইরের দরজায় কারা যেন চক দিয়ে লিখে যাচ্ছে৷ রোজ সকালে উঠে পুজোর ফুল কিনতে গিয়ে দরজায় চোখ পড়ছে দুর্গাপ্রসাদের৷ অমনি সেই লেখা পড়ে তিনি তুর্কিনাচন নাচছেন৷ লেখার বয়ান কিন্তু রোজই এক, ওই চারটি শব্দ—‘আমরা কিন্তু হাসছি না’৷

দুর্গাপ্রসাদ আজও তুর্কিনাচনের জন্যে ঘুঙুর পরলেন, ‘বলি, হাসির এত আছেটা কী? উচ্ছে একশো টাকা কেজি, বাসমতী চাল দেড়শো টাকা, তা-ও দাঁতে কাঁকর পড়ে, এমনকি ইশবগুলটা…’

শেষের কথাটা বলতে গিয়ে আটকে গেলেন দুর্গা৷ ইশবগুল ছাড়া যে ওঁর চলে না, সেটা জনতা জানলে আর-একপ্রস্থ হাসাহাসি হবে৷ চারপাশে একবার মুখ তুলে তাকালেন, তারপর ছিন্ন সূত্র আবার হাতে তুলে নিলেন, ‘গুলি… গুলি করে দেব… হাতের সামনে পেলে এক-একটাকে দানা দিয়ে দেব, এই বলে রাখলাম৷’

মেঘে মেঘে ঘর্ষণ, আবার কড়াৎ করে বাজ পড়ল, ‘কে করেছে তা-ও যদি না জানতাম… তা হাসিটা পাবে কী করে? যবে থেকে পলি গরমেন্ট সার্ভিস পেয়েছে, তবে থেকে হিংসে জ্বলেপুড়ে এইসব করছে৷ ঢের ঢের বুড়োহাবড়া দেখেছি, কিন্তু এমন ঘাটের মড়া বাপের কালে দেখিনি৷’

উলটোদিকে রাধারমণের তিনতলা বাড়ির দিকে তাকিয়ে একবার ফুৎকার করার চেষ্টা করলেন দুর্গা৷ কিন্তু তাঁর বয়স প্রায় ছেষট্টি, তার উপরে হার্টের ব্যামো, ফলে ফুৎকারের বদলে ঘেউ আর ভৌয়ের মাঝামাঝি একটা শব্দ বেরিয়ে পড়ল৷

নীচে বাবা, উপরে মা-র চিৎকারে সকালের কাঁচা ঘুম ভেঙে গিয়েছিল সমুদ্রর৷ সে বিরক্ত মুখে বারান্দায় দাঁড়িয়ে উঁচু গলায় বলল, ‘উফ, সকাল সক্কাল কী শুরু করেছ বলোতো তোমরা?’

‘আমরা শুরু করেছি৷’ ঝাঁজিয়ে ওঠেন ঝুমরি, ‘খুব বাড় বেড়েছে বুড়োটার৷ পাড়ার ছেলেরা মিলে যবে টাইট দিয়ে কাছা খুলে নেবে, সেদিন বুঝবে৷’

‘সে টাইট দিক, আমার মেয়েটা কাল রাত অবধি পড়াশোনা করে ঘুমিয়েছে৷ এখন মাছের বাজার বসিও না৷’

শেষকথাটা দু-জনেরই মনে ধরল৷ দুর্গাপ্রসাদ বাড়ির ভিতরে ঢুকে একটা ভুল সুরে ‘হরি দিন তো গেল সন্ধে হল’ গাইতে গাইতে ন্যাতা এনে দরজার উপর থেকে চকের লেখাটা মুছে দিলেন৷ ঝুমরিও রান্নাবান্নায় মন দিলেন৷ দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তী মানুষটা বড়ো সংবেদনশীল৷ পাড়ার মোড়ে তাঁকে নিয়ে কেউ কথা বলছে কি না, হাসাহাসি করছে কি না, ওঁত পেতে সেইসব শোনার চেষ্টা করেন৷ ঘুমোনোর সময় সামান্য নাক ডাকে ওঁর, বাড়ির লোক হাসাহাসি করত বলে নাকের অপারেশন করিয়েছেন, রাধারমণের মতো জিন্স পরার শখ জাগে মাঝে মাঝে, কিন্তু পাঁচকথার ভয়ে সেসব ইচ্ছা মনেই রেখে দেন৷

সারাদিন চারতলা বাড়িতে থাকেন বলতে দুর্গাপ্রসাদ নিজে, স্ত্রী ঝুমরি, ছেলে সমুদ্র, ছেলের বউ অরুণিমা আর তাঁদের মেয়ে পলি৷ এই পাঁচজন মানুষের জন্যে চারতলা বাড়ি একটু বাড়াবাড়ি৷ কিন্তু সমালোচকরা বলে, এ বাড়ি নাকি প্রতিবেশী রাধারমণ তালুকদারের সঙ্গে প্রতিযোগিতা করে বানিয়েছিলেন তিনি৷

দু-জনেই ছেলেবেলায় একই ইস্কুলে পড়েছেন৷ বড়ো হয়ে একজন হয়েছেন হোমিওপ্যাথি ডাক্তার আর একজন অ্যালোপ্যাথ৷ ব্যস! তার পর থেকেই সাপে-নেউলে লেগে গেছে৷

ইনি ছাদে গোলাপের টব বসালে উনি হাসনুহানা নিয়ে আসেন, এঁর বাড়ি থেকে ইলিশমাছের গন্ধ ভেসে এলে উনি মাটন আনতে বাজারে ছোটেন৷

একসপ্তাহ হল দুর্গাপ্রসাদের নাতনি পলি সরকারি চাকরি পেয়েছে৷ তার কিছুদিন পর থেকেই দুর্গাপ্রসাদের দরজায় ফুটে উঠছে ওই লেখা, ‘আমরা কিন্তু হাসছি না’৷

আজ আর ফুল-টুল আনতে ইচ্ছা করল না দুর্গার৷ মনে মনে ভাবলেন, রাধারমণ দেহ রাখলে একেবারে তাঁর খাট সাজানোর জন্যে রজনীগন্ধা আর চোখে দেওয়ার তুলসী কিনে আনবেন৷ এই মুহূর্তে কাশীনাথের ঠেক লক্ষ্য করে পা বাড়ালেন তিনি৷

কাশীনাথের একটা ছোটো চায়ের দোকান আছে৷ ইনিও রাধারমণ ও দুর্গাপ্রসাদের সঙ্গে একই স্কুলে পড়তেন৷ কিন্তু তেমন আয় নেই বলে কারও সঙ্গে তেমন ঠোকাঠুকি লাগেনি তাঁর৷ আপাতত দু-পক্ষের সঙ্গেই ভালো সম্পর্ক রেখেছেন কাশীনাথ৷ অ্যালোপ্যাথি ফেল করলে হোমিওর কাছে যান, হোমিও মাথা নাড়লে অ্যালো৷

ঝড়ের মতো কাশীনাথের দোকানে ঢুকে এলেন দুর্গাপ্রসাদ৷ একটা চেয়ার টেনে নিয়ে তার উপর ধপ করে বসে পড়ে ভয়ানক দুলতে দুলতে বললেন, ‘আহাম্মক ঘড়িয়াল… হিংসুটে কুচুটে খোলোকুটে…’

কাশীনাথ খুব একটা অবাক হল না৷ দুর্গাপ্রসাদ গালাগালি দিচ্ছেন মানে কার উদ্দেশ্যে সেটা বোঝা কঠিন নয়৷ ঘটনাটা অবশ্য একটু ভনিতা না করে খুলে বলবেন না৷ দুধের প্যাকেট কাটতে কাটতে বললেন, ‘ঠান্ডা হও দুর্গাদা, গরম চা দেব নাকি?’

‘গরম চা দিয়ে ঠান্ডা করবে তুমি? এইসব বোকা-বোকা কথার জন্যে তোমার বিজনেস মডিউলটা মার খাচ্ছে, বুঝলে?’

‘বেশ তো, ঠান্ডা চা দিচ্ছি৷ তা-ই খাও৷’

‘ধ্যার বাবা…’ দুর্গাপ্রসাদের বিরক্তিটা বেড়ে উঠল, ‘এমনিতেই সকাল থেকে মাথাটা ঘেঁটে আছে, তার উপরে এই অশিক্ষিতের পাল্লায় পড়েছি৷’ বুড়ো দুলুনি আরও বাড়িয়ে দিলেন৷ কাশীনাথের ভয় হল, আর-একটু রেগে গেলেই তিনি দুলুনির চোটে মাটিতে আছাড় খাবেন৷

‘কিন্তু আমি ভেবে পাচ্ছি না, এত হাসির আছেটা কী?’ মচমচ শব্দে দুলতে দুলতে বলেন দুর্গাপ্রসাদ৷

‘হাসি? কীসের হাসি?’ কাশীনাথ এতক্ষণে আগ্রহ দেখায়৷

‘আরে, সেই যে দরজায় লিখে গিয়েছিল, আজ আবার লিখেছে!’

‘বলো কী৷ কে?’ কাশীনাথ দুধ জ্বাল দিতে দিয়ে বসে পড়ে৷

‘আর কে? এমন আইবুড়ো কীর্তি আর কার হতে পারে? আমাকেও চেনো না, ওর বাপ… বাপ…’ পুরোটা মনে করতে পারলেন না দুর্গা, কাশীনাথ জিব চুক চুক করে বললেন, ‘এই বয়সে বাপ তুলে গালাগালি দেওয়াটা কিন্তু…’

‘আরে ধ্যার আহাম্মক, ব্যাপটিসিয়া তিন্তাোরিকা, একটু ঘন করে ঠুসে দিলেই ওই গাধারমন সিধে হয়ে যাবে…৷’

কাশীনাথের চোখ গোল-গোল হয়ে ওঠে, কী যেন ভেবে সে বলে, ‘কাল সকালেও তো এল আমার দোকানে৷ দেওয়ালে লেখার কথা তো কিছু বলল না৷’

‘বলবে কেন? আগে থেকে ফাঁস করে দিলে আমাকে বেইজ্জত করবে কী করে?’ দুর্গা ফুঁসলে ওঠেন, ‘আজ পলি ঘুমোচ্ছিল বলে ছেড়ে দিয়েছি৷ কাল দেখে নেব ওর একদিন কী আমার একদিন৷’ কথাটা বলেই তার গলার পর্দা নীচে নেমে আসে, মিনমিন করে বলেন, ‘কিন্তু হাসার কথা বলছে কেন বলোতো? কিছু কি জেনে ফেলেছে?’

‘তোমার আর জেনে ফেলার মতো আছে কী? তবে…’

‘তবে কী?’

একটু থেমে ইতস্তত করে কাশীনাথ বলেন, ‘তোমার নামটা… মানে ধরো ব্যাটাছেলের নাম দুর্গা… একটু যেন কেমন কেমন…’

দমে যেতে গিয়েও আবার গর্জে উঠলেন দুর্গা, ‘তো ওর নামটার এমন কী ছিরি? রাধা… আর তুমিই বা বলো কোন মুখে? অ্যাঁ?’

নীরবে কয়েকটা মুহূর্ত কাটে৷ দুধ উপচে ওঠে৷ কাশীনাথ গ্যাস বন্ধ করে৷ তারপর সেটা একপাশে সরাতে সরাতে বলে, ‘এমনও তো হতে পারে যে আদৌ কাজটা রাধাদা করছে না৷’

‘তাহলে?’

‘পাড়ার চ্যাংড়া ছেলেরা করে থাকতে পারে৷ তারাই হয়তো কিছু দেখে ফেলছে৷’

দুর্গা একটা প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন৷ কিন্তু থেমে গেলেন৷ এতক্ষণে মনে পড়েছে৷ কাল বিকেলে পার্কে হাঁটতে গিয়ে অনুলোম-বিলোম করছিলেন৷ একনাকে নিঃশ্বাস নিয়ে আর-এক নাক দিয়ে শ্বাস ছাড়ছিলেন৷ ওতে নাকি হৃৎপিণ্ডকে পোষ মানানো যায়৷ কিন্তু সে কথা মানুষে বোঝে, কুকুরে বোঝে না৷ তারা উদ্ভট জিনিস দেখলেই ঘেউ ঘেউ করে তাড়া করে৷ দুর্গাকেও তা-ই করেছিল৷

কুকুরের কবল থেকে দৌড়ে পালাতে গিয়ে দুর্গাপ্রসাদের ধুতি খুলে যায়৷ সেই ধুতির গিঁট পায়ে আটকে গিয়ে মাটিতে আছাড় খেয়ে পড়েন তিনি৷ কোনওরকমে উঠে যখন হ্যাঁচোড়-প্যাঁচোড় করে দৌড়ে বাড়ি ফেরেন তখন শুধু দুই নাকই নয়, মুখ দিয়েও নিশ্বাস নিচ্ছিলেন৷

এখন ওঁর মনে হল, কাল সেই ধুতির গিঁট পায়ে জড়ানো অবস্থায় এনিমি স্কোয়াডের কেউ হয়তো দেখে ফেলেছিল ওঁকে৷ এবং তারপরেই ওঁকে পাড়ার লোকের সামনে অপদস্থ করার জন্যে লিখে দিয়ে গিয়েছে, ‘আমরা কিন্তু হাসছি না’৷

লজ্জায় লাল হয়ে উঠলেন দুর্গা৷ ব্যাপারটা কে দেখেছে কে জানে, রাধারমণ নিজেই দেখে ফ্যালেনি তো? দুর্গা আবার তাঁকে কিছু বলতে গেলেই পাড়াময় রাষ্ট্র করে দেবেন কথাটা৷ তখন আর পাড়ায় মুখ দেখাতে পারবেন না তিনি৷

উপায়ান্তর না দেখে দুর্গা কাশীনাথকেই গোটা ব্যাপারটা খুলে বললেন৷ কাশীনাথ মন দিয়ে শুনলেন, কিন্তু হাসলেন না৷ বরঞ্চ খানিক ভেবে-চিন্তে বললেন, ‘লেখাটা তো বললেন, বেশ কয়েকদিন যাবৎ হচ্ছে, অথচ আপনার কাছা খুলেছে গতকাল৷ উঁহু, মেলানো যাচ্ছে না৷’

এই সময়ে পাশে কচুরির দোকানে একটা ভোজপুরি গান শুরু হল৷ সেদিকে মনোযোগ দিয়ে কথাগুলো শুনতে লাগলেন দুর্গা,

‘লাগা কে ফেয়ার এন্ড লাভলি, জান লেবে কা রে পাগলি৷

খাটারা কে নিশানি, পার কাইলে বা জুল্মি জওয়ানি

কেহু পাগাল ভাইল বা, কেহু দেতাউ ছাগাল নিশানি’

ছাগলের কথা বলা হচ্ছে কি গানটায়? আহা, প্রেম-ভালোবাসার সঙ্গে পাঁঠার এমন মেলবন্ধন আগে শোনেননি তিনি৷ ভারী মোলায়েম একটা ব্যাপার আছে গানটায়, মন শান্ত হয়ে যায়৷ খানিক স্বস্তিও পেলেন দুর্গা৷ চায়ের গায়ে একটা মিহি চুমুক দিলেন৷ কেমন যেন বিস্বাদ লাগল চা-টা৷ জিবটাই আঁটিয়ে গিয়েছে হয়তো৷ চ্যাক চ্যাক আওয়াজ করে মুখটাকে নিমের পাঁচনের মতো করে নামিয়ে রাখলেন চা-টা৷ প্রশস্ত টাকে একবার হাত বোলালেন, ‘তাহলে তো কোনও সমাধান পাচ্ছি না হে…’

 ‘যদ্দুর মনে হচ্ছে এ তোমার কোনও পুরোনো দুশমন৷ হয়তো ছেলেবেলায় কারও সঙ্গে বজ্জাতি করেছিলে৷’

‘কই, তেমন তো কিছু মনে পড়ছে না৷’

‘পরীক্ষায় কাউকে ভুল উত্তর বলে ল্যাজে-গোবরে করেছিলে?’

‘ফুঁ, আমি সেই কোনকালে পরীক্ষা…’

কথাটা বলতে গিয়েও আটকে গেলেন দুর্গা৷ একটা কথা ক্ষীণভাবে মনে পড়েছে ওঁর৷ বছর তিনেক আগে সারাক্ষণ মাথাটা ব্যথা করত বলে ডাক্তার দেখাতে গিয়েছিলেন৷ মাথার ডাক্তার৷ তো সে বলেছিল, মাথার মধ্যে কীসব যেন ব্যামো আছে দুর্গাপ্রসাদের৷

ব্যাপারটা ভালোভাবে রাষ্ট্র হবার আগেই কোনওরকমে পালিয়ে এসেছিলেন দূর্গা৷ মাথার ব্যামোর ব্যাপারটা রটে গেলে অপমানের আর শেষ থাকবে না৷ তড়াক করে লাফিয়ে উঠলেন দুর্গাপ্রসাদ৷ চা রইল পড়ে৷ কাশীনাথকে রীতিমতো অবাক করে দিয়ে ঝড়ের বেগে বাড়ির দিকে ধেয়ে এলেন তিনি৷ দরজা খুলে ভিতরে এসেই দোতলায় উঠে এলেন৷ আলমারি খুলে পুরোনো একটা প্রেসক্রিপশন বের করলেন৷ কী যেন পড়ে নিয়েই ল্যান্ডফোনের দিকে এগিয়ে এলেন৷ একটা নম্বর ডায়াল করলেন৷ ওপাশে মাঝবয়সি পুরুষালি গলা শোনা গেল৷

‘আরে দুর্গাদা, এতদিন পরে…’

‘একটা সমস্যা হয়েছে ভাই, একটু সাহায্য করতে হবে৷’

‘হ্যাঁ নিশ্চয়ই, বলেই দ্যাখ না৷’

এতদিন পরে ফোন করেই সোজা কাজের কথা বলতে শুরু করেছেন দুর্গাপ্রসাদ৷ তাতে হয়তো একটু বিরক্ত হয়েছে লোকটা৷

‘একটা রোগের নাম বলছি৷ মাথার রোগ, ব্যাপারটা ঠিক কী, একটু বলে দাও তো ভাই৷’

‘রোগ? কার হয়েছে?’

‘আমার এক পরিচিতর… রোগটার নাম হল… অ্যাঁ… অ্যাঁ… অ্যান্টিডেফোবিয়া৷’

ওপাশ থেকে বেশ মিনিটখানেক কোনও আওয়াজ শোনা গেল না৷ তারপর একটা মৃদু হাসির আওয়াজ শোনা গেল৷ হাসছে কেন? মানুষের রোগের সঙ্গে হাসির কী সম্পর্ক?

দুর্গাপ্রসাদের গা জ্বলে উঠল৷

‘এ তো ভারী মজার রোগ, দুর্গাদা৷ মানে যারা লোকে কী বলছে, সেই নিয়ে খুব কনসার্নড, তাদের হয় এমন রোগ৷ এক ধরনের অবসেসিভ ডিসঅর্ডার৷ এতে যে লোক ভুগছে তার থেকে থেকে মনে হয়, কেউ তার উপরে নজর রাখছে৷’

‘কে নজর রাখছে?’

‘একটা হাঁস৷’

‘হাঁস!’

দুর্গাপ্রসাদ খাবি খেলেন৷ ওপাশ থেকে আরও একদমক হাসির পর কথা শোনা গেল, ‘একটা বুনো হাঁস৷ সে সারাক্ষণ নজর রেখে চলেছে৷ তা এ ব্যামো কার হল দুর্গাদা?’

‘রাধারমণের৷’

ঠকাস করে ফোনটা রেখে দিলেন দুর্গা৷ মাথাটা এইবার ভোঁভোঁ করতে শুরু করেছে৷ এই কথাটাই ডাক্তারের মুখ থেকে কোনওভাবে রটে গিয়েছে তাহলে৷

‘মুখপোড়া ডাক্তার৷ বেল্লিক কোথাকার…’ চেঁচিয়ে উঠলেন দুর্গা৷ আবার ফুৎকারের চেষ্টা করলেন কিন্তু ভ্রষ্ট হলেন৷ ঘেউ-এর কাছাকাছি একটা আওয়াজ বেরিয়ে এল৷

তবে তাতে পাশের ঘর থেকে পলি ছুটে এল৷ এতক্ষণে ওর ঘুম ভেঙে গিয়েছে৷ হাতে একটা পাউরুটির টুকরো নিয়ে এ ঘরে ঢুকল ও৷ দুর্গা ভাবলেন, পলিও কি এতক্ষণে জেনে গেছে সেই হাঁসের কথাটা? ছি ছি ছি… এর থেকে বেশি লজ্জার আর কী থাকতে পারে?

দুর্গার পাশের চেয়ারে বসে পাউরুটিতে একটা কামড় দিল পলি৷ তারপর মুখ তুলে বলল, ‘সকালবেলা অত চেঁচামেচি হচ্ছিল কেন দাদু?’

বিমর্ষ মাথা নাড়লেন দুর্গা, ‘সাধে কি আর চেঁচাই রে মা? এ পাড়ায় সব্বাই আমাদের পিছনে লেগেছে৷’

‘কেন? কী হয়েছে?’

‘দেখিসনি দরজায় কী লিখে দিয়ে যাচ্ছে রোজ?’

‘কী লিখছে?’

‘রোজ ওই একই কথা, আমরা কিন্তু হাসছি না৷’

মনে মনে ভাবলেন দুর্গা, এই ‘হাসছি’ কথাটার মধ্যে দিয়ে হাঁসের ব্যাপারটারই সংকেত দেওয়া আছে৷ কী মুশকিল! হাঁসের ব্যাপারে তিনি কখনও কিছু ভাবেনই না৷ এদিকে ডাক্তারে লিখে দিয়েছে, তাঁর নাকি হাঁসের নজর ফোবিয়া আছে৷ যতসব টুকে পাশ করা ডাক্তার৷

‘রোজ লেখে মানে আজও লিখতে আসবে তাহলে?’

‘কী জানি…’ আবার বিমর্ষ দেখাল দুর্গাকে৷ ভবিতব্য যেন মেনে নিচ্ছেন তিনি৷

‘তাহলে আজ রাতে তুমি-আমি মিলে পাহারা দিলেই হয়৷’ পাউরুটিতে শেষ কামড় দিল পলি৷

আচমকা বিদ্যুৎ খেলে গেল দুর্গার মাথায়৷ হ্যাঁ, এই কথাটা তো এতক্ষণ মাথায় আসেনি ওঁর৷ হেহে, এই না হলে নাতনি৷ এই না হলে সরকারি চাকরি পাওয়া নাতনি? এমন একটা বংশধর থাকলে ওই গাধারমণের গুষ্টির ষষ্ঠিপুজো করে ছেড়ে দেবেন তিনি৷

একটা বাজখাঁই চাপড় মারলেন তিনি পলির পিঠে, ‘শাবাশ মেরে শের, আজ রাতে ব্যাটাকে হাতেনাতে ধরব৷’

সেদিন ভালো করে খাওয়াদাওয়া করলেন দুর্গা৷ আজ ঘুঘু ধরা পড়বেই৷ একবার হাতে পেলে সব হাসি বের করে দেবেন তিনি৷ একটা পুরীর লাঠি আলমারির পিছনে বিড়াল তাড়ানোর জন্যে রাখা ছিল৷ সেইটা ভালো করে পরিষ্কার করে একটু ছুলে নিলেন দুর্গা৷ কয়েকটা চোঁচ রেখে দিলেন ইচ্ছা করে৷

সন্ধেবেলাই রাতের খাওয়াদাওয়া সেরে নিলেন৷ খানিকটা কফি গরম করে ফ্লাস্কে ঢুকিয়ে নিলেন৷ দীর্ঘদিন তিনি রাত জাগেননি৷ ঠিক করেছেন, লোকটা ধরা পড়লে সকাল অবধি এই দরজাতেই বেঁধে রাখবেন৷ সকাল হলে লোকজনের ঘুম ভাঙলে গোটা পাড়া ডেকে এনে গণপিটুনি দেবেন৷ ভারী একচোট হেসে নিলেন দুর্গা৷

ঝুমরির নামটা এ পাড়ার লোকের মুখে একটু অপভ্রংশ হয়ে উঠেছে৷ ওঁর বাজখাঁই গলার আওয়াজ আর খাণ্ডার রাগের সুনাম হিসেবে নামটা ঝুমরি থেকে খানিক পালটে ঝালমুড়ি হয়ে গিয়েছে৷

তো দুর্গাপ্রসাদের এই রাত জেগে পাহারা দেওয়ার ব্যাপারে ওঁর তেমন সম্মতি ছিল না৷ তা-ও তিনি রাজি হয়েছেন, তার একটা কারণ আছে৷ তলে তলে ঝুমরি জানেন লেখাটা দুর্গাপ্রসাদকে নিয়ে নয়, ওঁকে নিয়েই লেখা৷

ব্যাপার হয়েছে কী, দিন সাতেক আগে দুপুরে আচার খেতে খেতে ঝুমরি ছাদে গেছিলেন জামাকাপড় তুলতে৷ তো গিয়েই দেখেন, ওঁর বিয়ের দামি বেনারসিটার উপরে এক হতচ্ছাড়া আরশোলা পায়চারি করে বেড়াচ্ছে৷ দেখেই আচার খাওয়া মাথায় উঠল ওঁর৷ লাফিয়ে গিয়ে এক আছাড়ে আরশোলাকে ঘায়েল করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু আঙুলের ঘায়ে শাড়িতে আঁচড় পড়ে যাওয়ার কথা মনে আসতেই থমকে যান৷

নিপুণভাবে বাঁ হাতে ডানা ধরে আরশোলাকে হাতে তুলে নেন৷ পায়ের তলায় ফেলে পিষে দিতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় নীচ থেকে কীসের হাঁকডাক শুনে থমকে যান৷ ছাদের ধার দিয়ে মুখ বাড়িয়ে দেখেন, রাধারমণ বুড়ো বয়সে সাইকেল চালাতে গিয়ে রাস্তায় উলটে পড়ে গড়াগড়ি খাচ্ছেন৷

ব্যাপারটা দেখেই খলখল করে হেসে ওঠেন তিনি৷ এবং আনন্দের আতিশয্যে বেখেয়ালে আচারের বদলে অপর হাতে ধরা আরশোলা মুখে দিয়ে চিবিয়ে দেন৷

এই ঘটনার পর থেকেই দরজায় লেখা দেখতে পাওয়া যায়; অর্থাৎ কোনও সন্দেহ নেই লেখাটা ঝুমরিকে নিয়ে৷ শুধু একটা ব্যাপার ভাবিয়ে তুলেছে৷ রাধারমণ ছাড়া আর কারও বাড়ির ছাদ এত উঁচু নয়৷ তাহলে ঝুমরিকে আরশোলা খেতে দেখল কে? ভারী রহস্যময় ব্যাপার৷

রাত এগারোটা পেরোলেই এ বাড়ির সবাই শুয়ে পড়ে৷ মানে অন্যদিন শুয়ে পড়ে আর কী৷ আজ দু-জন শুধু জেগে রইল৷ প্রথম দুর্গাপ্রসাদ, ওঁর হাতে সেই চোঁচ বের করা পুরীর লাঠি আর অন্য হাতে একটা ভেঁপু বাঁশি৷ দ্বিতীয়জন হল পলি, সে একটা টর্চ হাতে নিয়েছে, কানে ইয়ারফোন গুঁজে গান শুনছে৷ পাশে ফ্লাস্কে কফি করে রাখা আছে৷ মাঝরাতে ঘুম তাড়ানোর ওষুধ৷

দু-জনে মিলে গিয়ে বসল দোতলার ঝুলবারান্দায়৷ এমনভাবে বসল, যাতে নীচ থেকে উপরের কাউকে চোখে না পড়ে, কিন্তু রেলিং-এর ফাঁক দিয়ে নীচের লোককে স্পষ্ট দেখা যায়৷

‘বারে বারে ঘুঘু তুমি খেয়ে যাও ধান, হুহু… আজ এসো বাছাধন…’ বারোটা অবধি নাতনির কাছে নিজের জীবনের গল্প করছিলেন দুর্গাপ্রসাদ৷ ছোটবেলা থেকে কত পানা ঠেলে করে পড়াশোনা করেছেন৷ একই পাজামা সারা বছর পরতে পরতে পেছন ছিঁড়ে চশমা হয়ে গিয়েছিল৷ কত তাগড়াই অফিসারের ধাতানি খেয়ে চাকরিজীবন কাটিয়েছেন৷ পলিকে সেইসব করতে হবে না৷ গভর্নমেন্ট সার্ভিস করে কিছুদিনের মধ্যেই সেটল হতে চলেছে সে৷

পলির কিন্তু এসবে তেমন মন ছিল না৷ সারাদিন উৎসাহে ওর ঘুম আসেনি৷ পাড়ার আলোগুলো একটা একটা করে নিবে আসতেই একটা মিহি ঘুমে ওর চোখ বুজে এল৷

দাদুর ঘ্যানঘেনে ইতিহাস ওর ভালো লাগছে না৷ কানে গোঁজা ইয়ারফোনে আদুরে সুর উঠেছে৷ তার পিছন থেকে হালকা ভেসে আসছে ঝিঁঝির ডাক৷ একটা মোলায়েম দখিনা হাওয়া উড়ে এসে বারবার ঘুমোতে বায়না করছে৷ আধ ঘণ্টা পর নীচ থেকে কচকচ আওয়াজ আসতে নড়েচড়ে বসলেন দুর্গা৷ তারপর হাতের কনুই দিয়ে পলিকে আলতো টোকা দিয়ে বললেন, ‘এই পলি, শুনতে পাচ্ছিস?’

ওদিক থেকে কোনও সাড়া এল না৷ দুর্গা বুঝলেন, পলি ঘুমিয়ে পড়েছে৷ বিরক্ত হয়ে তিনি পাশে পড়ে থাকা টর্চটা তুলে নিলেন৷ ধীরে ধীরে উঠে দাঁড়িয়ে একঝটকায় নীচে আলো ফেললেন, একটা বিড়াল৷

ততোধিক বিরক্ত হয়ে উঠলেন দুর্গা, ধ্যাত! আসল লোক যদি কাছাকাছি এসে থাকে তাহলে এই আলো পড়তে দেখে সে নিশ্চয়ই বুঝে যাবে, উপরে কেউ বসে আছে৷ জলদি আলো নিবিয়ে আবার গুটিসুটি মেরে বসলেন দুর্গা৷ পলিটা ঢ্যাঁড়স৷

বিড়ালটা এই রাতবিরেতে চোখে আলো পড়ায় মোটেই খুশি হয়নি, ‘ম্যাও, ম্যাও’ শব্দে মানব সভ্যতাকে অভিসম্পাত করতে করতে সে কেটে পড়ল৷ চারদিক আবার নিস্তব্ধ হয়ে এল৷

মিনিট দশেক পরে দুর্যোগের ছায়া ঘনিয়ে এল৷ আকাশে নয়, দুর্গাপ্রসাদের চোখে৷ পাতা ভারী হয়ে ঘুম পেল তাঁর৷

হাত বাড়িয়ে ফ্লাস্ক তুলে নিলেন তিনি৷ খানিকটা কফি ঢাললেন কাপে৷ তারপর তারিয়ে তারিয়ে গলায় ঢালতে লাগলেন সেটা৷ মুশকিলটা হল তারপরে৷ কফি খেয়ে দুর্গাপ্রসাদের ঘুম কেটে যাওয়ার বদলে আরও তেড়ে ঘুম পেল৷ সারাদিন লাফঝাঁপ কম যায়নি, সেই তাড়নাতেই বুঝি একটু একটু করে ওঁর বুকের উপরে মাথাটা ঝুলে এল৷ স্পষ্ট বুঝতে পারলেন নীচের তলা থেকে খচখচ করে একটা আওয়াজ আসছে, ঘুমের ঘোরে ভুলও শুনতে পারেন অবশ্য৷ কিন্তু তিনি হাতে-পায়ে আর জোর পেলেন না৷

দুর্গাপ্রসাদ খোলা বারান্দায় নাতনির সঙ্গে ঘুমিয়ে স্বপ্ন দেখলেন৷ ওঁকে ঘিরে ধরেছে একখণ্ড অলৌকিক কুয়াশা, আর সেই কুয়াশার ভিতর থেকে খ্যাঁকখ্যাঁক করে হাসছে একগাদা লোক৷ তাদের দেখা যাচ্ছে না৷

‘হাসবে না, একদম হাসবে না, হাসলেই ব্যাপ্টিসিয়া…’ ঘুমের ঘোরে চেঁচিয়ে উঠলেন দুর্গা৷ পলিকে বোধহয় খামচেও দিলেন একবার৷

এমন সময় কুয়াশার ভিতর থেকে উঁকি দিল সেই অসন্তুষ্ট বিড়াল৷ এখন সেও সাদাসাদা দাঁত বের করে হাসছে৷

দুর্গাপ্রসাদ ঘুমের মধ্যেও রেগে উঠলেন৷ অমনি তাঁর মনে হল, পায়ের কাছ থেকে কে যেন তাঁর ফতুয়া টানছে৷ নীচে তাকিয়ে দুর্গাপ্রসাদ আরও রেগে গেলেন, একটা হাঁস৷

সেই যে সব দেখনেওয়ালা হাঁসটা৷ দুর্গাপ্রসাদ আর্তনাদ করতে গেলেন, কিন্তু তাঁর গলা দিয়ে প্যাঁকপ্যাঁক ছাড়া কোনও আওয়াজ বের হল না৷ দুর্গা যত চিৎকার করতে যান খাউয়া-খাউয়া করে হেসে ওঠে হাঁসটা৷ একটু একটু করে রাধারমণের রূপ নিতে লাগল সেটা…

সকালবেলা দুর্গার ঘুম ভাঙল ঝুমরির চিৎকারে৷ আজ বিনা মেঘে বাজ পড়ছে৷ আকাশ থেকে নয়, বাজটা আসছে নীচের দিক থেকে৷

দরজার বাইরে থেকে তারস্বরে চিৎকার করে চলেছেন ঝুমরি, ‘নাকের ডগা দিয়ে আবার লিখে চলে গেল! বলি, রাত জেগে যে পাহারা দিলে…. ঘুঘু তো আবার ধান খেয়ে বুড়ো আঙুল দেখিয়ে কেটে পড়েছে৷’

ক্রমশ ব্যাপারটা অনুধাবন করতে পারলেন দুর্গাপ্রসাদ৷ কাল রাতে ওঁর ঘুমের সুযোগ নিয়ে কেউ আবার সেই কথাটা লিখে দিয়ে গিয়েছে৷

এইবার একটা দক্ষযজ্ঞ বেধে গেল৷ প্রবল বিক্রমে ফুঁসে উঠলেন দুর্গা৷ অনেক সহ্য করেছেন তিনি৷ আজ একটা শেষ ফয়সালা হয়ে যাবে৷ আজ দুর্গাপ্রসাদ দেখিয়ে দেবেন তিনি কারও পরোয়া করেন না৷ অন্যদিন তিনি লেখা মোছবার জন্যে ন্যাতা আনতে ভিতরে যান৷ আজ কিন্তু সেসবের ধার ধারলেন না৷ সিঁড়ি ভেঙে দপদপাস করে নীচে নামলেন৷ ঝালমুড়ি তখনও ঝাঁজিয়ে চলেছে৷ ওর কথায় কান না দিয়ে রাস্তার উপরে পড়ে, থাকা একটা ইটের টুকরো তুলে নিলেন দুর্গাপ্রসাদ৷ সেদিকে তাকিয়ে ঝুমরি মুখ বাঁকিয়ে বলল, ‘ও দিয়ে আর মারবে কাকে? পাখি যে ফুড়ুত…’

‘মারব না৷’ কথাটা বলেই দরজাটার দিকে এগিয়ে গেলেন তিনি৷ তারপর ইটের টুকরো দিয়ে রাতের লেখাটার নীচে গোটা গোটা অক্ষরে লিখে দিলেন, ‘হাস ব্যাটারা, যত খুশি হাস৷ আমার কিসসু এসে যায় না৷’ লিখে দিয়েই গম্ভীর গলায় হুকুম দিলেন তিনি, ‘দুটো লেখাই যেন কেউ না মোছে৷ দুর্গাপ্রসাদ চক্রবর্তী ডাজন্ট কেয়ার৷’

বলেই ফুৎকারের মতো একটা আওয়াজ করলেন তিনি৷ এতবারের চেষ্টার পর এই প্রথম সফল হল সেটা৷

সিঁড়ি দিয়ে উপরে উঠতে যাচ্ছিলেন তিনি৷ এতক্ষণে ঝুমরির হাঁকডাকে পলির ঘুম ভেঙেছে৷ সে চোখ মুছতে মুছতে বাইরে বেরিয়ে এসে একবার দরজার দিকে তাকাল, একবার দাদুর মুখের দিকে৷ আবার সে ভিতরে ঢুকে যেতে যাচ্ছিল, কী যেন মনে পড়তে একবার থেমে গিয়ে বলল, ‘ওঃ, তোমাকে একটা কথা বলার ছিল, দাদু৷’

‘কী বলবি?’ রাগত গলা নীচে নামিয়ে জিজ্ঞেস করেন দুর্গাপ্রসাদ৷

‘চাকরিটা আমি করতে চাই না৷’

‘করতে চাস না মানে? তাহলে পরীক্ষা দিয়েছিলি কেন?’ বৃদ্ধের পেটের ভিতরে আগ্নেয়গিরি জেগে ওঠে৷

‘তখন তোমরা জোর করেছিলে৷ ভাবিনি যে পেয়ে যাব৷’

‘তো কী করার ইচ্ছা তোর?’

‘ফ্যাশন ডিজাইনিং নিয়ে পড়ব৷’ থমথমে গলায় বলে পলি৷

ঝুমরি কিছু একটা বলে প্রতিবাদ করে উঠতে যাচ্ছিলেন, দুর্গা ওঁকে থামিয়ে বাতাসে হাত আছড়ে বললেন, ‘তা হয় নাকি? পাড়ার সবাইকে বলেছি, তুই গভরমেন্ট সার্ভিস পেয়ে গিয়েছিস, এবার যদি বলি, সেটা পেয়েও করবি না তাহলে তো লোকে…’ পরের শব্দটা বলতে গিয়েও থেমে গেলেন দুর্গাপ্রসাদ, থেমে থেমে আলগা উচ্চারণ করলেন, ‘হা…স…বে…’

কয়েকটা নীরব মুহূর্ত৷ সামনে-পিছনে দু-দিক থেকে দুটো অদৃশ্য শক্তি ধাক্কা মেরে চলেছে মানুষটাকে৷ কেঁপে উঠছেন তিনি৷ দুর্গার চোখ গিয়ে পড়ল দরজাটার উপরে৷ সেখানে একটু আগেই লিখে এসেছেন তিনি, ‘হাস ব্যাটারা, যত খুশি হাস৷ আমার কিসসু এসে যায় না৷’

দেওয়াল থাবড়ে গর্জন করে উঠলেন বৃদ্ধ, ‘তা-ই পড়বি, যেইটা ইচ্ছা, সেইটা করবি৷ যে ব্যাটাচ্ছেলে হাসার, সে হেসে নিক৷ ওদের দাঁত আছে, হাসবে, আমার বুড়ো আঙুল আছে, দেখাব৷ আমার কিসসু এসে যায় না…’

একটু থতমত খেয়ে গিয়েছিল পলি৷ অল্প মাথা নাড়িয়ে ধীরে ধীরে উপরে উঠে আসে ও৷

বাবা-মা এখনও ঘুম থেকে ওঠেননি৷ তাঁদের ঘরে একবার উঁকি মারে৷ নীচ থেকে এখনও দুর্গাপ্রসাদের দাপাদাপির শব্দ শোনা যাচ্ছে৷ একরাতে যেন অনেকটা পালটে গিয়েছেন বৃদ্ধ৷

টেবিলের একটা ড্রয়ার খুলে মোটা চকগুলো বের করল পলি৷ তারপর চারপাশটা একবার দেখে নিয়ে সেগুলো ছুঁড়ে ফেলে দিল জানলা দিয়ে৷ তার ঠিক পাশেই ঘুমের ট্যাবলেট রাখা ছিল ক-টা, কাল রাতে ভয়ে ভয়ে কফির ফ্লাস্কে কম করেই মিশিয়েছিল৷ ওগুলোর আর দরকার হবে না ওর…

সমুদ্রদের বিছানার একটা পাশ ফাঁকা ছিল৷ সেখানে একটু জায়গা করে নিয়ে শুয়ে পড়ল ও৷ ক’দিন রাতে ঠিকঠাক ঘুম হয়নি… ভারী ঘুম পাচ্ছে৷ মিনিটখানেকের মধ্যেই ঘুম নামল ওর চোখে৷ ঘুমের ঘোরেই ওর ঠোঁটের কোণদুটো একটু চওড়া হল৷

দেখে মনে হচ্ছে বটে, তা-ও… পলি কিন্তু হাসছে না…

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *