তত্ত্ব ও ধারণার রাজনীতি
পরিচিতির রাজনীতি
উপস্থাপনের রাজনীতি
অনুভূতির রাজনীতি

আবেগতান্ত্রিক নির্মাণ: পঞ্চাশ-ষাটের দশকের জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামায় পুরুষত্বের উপস্থাপনা – সায়ন চট্টোপাধ্যায়

আবেগতান্ত্রিক নির্মাণ: পঞ্চাশ-ষাটের দশকের জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামায় পুরুষত্বের উপস্থাপনা – সায়ন চট্টোপাধ্যায়

লিঙ্গের সামাজিক ব্যাখ্যা ও মনঃসমীক্ষার মধ্যে পার্থক্য হল, প্রথমটির ক্ষেত্রে মনে করা হয় যে নিয়মের আত্মীকরণ মোটামুটিভাবে সফল হয়, অপরদিকে মনঃসমীক্ষার গোড়ার কথা হল যে সেটা হয় না। অবচেতন সবসময়ই আত্মপরিচিতির বিফলতাকেই অনাবৃত করে চলে।

—জ্যাকলিন রোজ

পরিচিতি কেবলমাত্র প্রকৃতি দ্বারা নির্ধারিত হয় না বা কেবল সংস্কৃতির দ্বারা প্রকাশিত হয় না। বরং সংস্কৃতি পরিচয় গঠনের একটি প্রক্রিয়া; এটি শরীর এবং সত্তার সমস্ত পার্থক্যগুলি নিয়ে গঠিত হয়। সুতরাং, সংস্কৃতি একটি প্রক্রিয়া, ‘হয়ে ওঠা’র একটি উপায় এবং পরিচিতি সেই প্রক্রিয়াটির মধ্য দিয়ে নির্মিত হয় কিংবা পুনর্নির্মিতও হতে পারে। বেশ কয়েক জন উত্তর-কাঠামোবাদী তাত্ত্বিক যুক্তি দিয়েছেন যে আমাদের আচার, আচরণ ও রীতিনীতিগুলি কোনও পূর্ববর্তী, মৌলিক পরিচয় নয়, বা কোনও এজেন্ট বা বিষয়ীর দ্বারা সংঘটিত ক্রিয়ার প্রকাশ নয়, যা তাঁর দ্বারা সংঘটিত ক্রিয়াকলাপগুলির পূর্ববর্তী হিসাবে ধরে নেওয়া যেতে পারে। বরং, আমাদের আচরণ ও অভ্যাসগুলিই হল সেই ‘প্রক্রিয়া’ যার মাধ্যমে আমরা একজন যথার্থ বিষয়ী হিসাবে গণ্য হয়ে উঠি।

পুরুষত্ব বিষয়ে তাত্ত্বিক আগ্রহ নারীবাদী আন্দোলনের একটি প্রত্যক্ষ ফলাফল, যা প্রমাণ করে দিয়েছিল যে জেন্ডার একটি সামাজিকভাবে নির্মিত বিভাগ যার স্বাভাবিকীকরণ হয়েছে। নারীবাদী চলচ্চিত্র তাত্ত্বিকরা তাই তাদের নিজস্ব তত্ত্ববিশ্বের মধ্যেই ‘পুরুষের’ একতরফা ধারণাটি সম্পর্কে জিজ্ঞাসাবাদ শুরু করেছিলেন। চলচ্চিত্র, লরা মলভের ভাষায়, হল সেই ‘অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ পরিসর’ যাকে কেন্দ্র করে সংস্কৃতি, প্রতিনিধিত্ব এবং পরিচয় বিষয়ক নারীবাদী বিতর্কগুলি এগিয়ে গেছে। এই প্রবন্ধটিও, একটি বিশেষ ঐতিহাসিক মুহূর্তের বাংলা চলচ্চিত্রকে সামনে রেখে নারীবাদী পাঠের নিরিখে উপস্থাপনার রাজনীতিকে বুঝতে চেষ্টা করছে।

চলচ্চিত্র জগতের মধ্যে পুরুষ এবং পুরুষতন্ত্রের উপস্থাপনা বিষয়ে একাধিক ক্ষেত্রে আলোচনা হয়েছে। যদিও চলচ্চিত্রে আঞ্চলিক বা স্বাধীনতা-পরবর্তী পুরুষত্বের উপস্থাপনা নিয়ে খুব কমই গবেষণাধর্মী কাজ হয়েছে। আরও লক্ষণীয়ভাবে, বিভিন্ন গবেষক আগ্রহ দেখিয়েছেন যে কীভাবে চলচ্চিত্র দেখার কাঠামোর ক্ষেত্রেও পুরুষতন্ত্র এবং লিঙ্গবৈষম্য জড়িত থাকে। এটি অবশ্যই লক্ষণীয় যে পুরুষত্ব এবং ভারতীয় জনপ্রিয় সিনেমা নিয়ে বেশিরভাগ গবেষণাগুলি সত্তর ও আশির দশকে জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের ‘রাগী যুবক’ (Angry young man) চরিত্রকে কেন্দ্রে রেখেই প্রকাশিত হয়েছিল। এখানে মনে রাখা প্রয়োজন যে, লিঙ্গবৈষম্য একটি গুরুত্বপূর্ণ ভূমিকা পালন করে, যাকে ঘিরে দৃষ্টিকোণের সম্পর্কগুলি আবর্তিত হয়। লিঙ্গ সেইদিক থেকে ভিন্নতার চিহ্নক হিসাবে প্রকাশিত হয়। অথবা বলা যায়, এটি সেই মৌলিক দ্বি-মেরু বিভাগকে ইঙ্গিত করে যা সামগ্রিকভাবে চলচ্চিত্রকে ও উপস্থাপনার রাজনীতিকেই বিশিষ্টতা দেয়।

লিঙ্গভেদ ও জঁরের মধ্যে সম্পর্কের দিকটিও পুরুষত্বের সিনেম্যাটিক উপস্থাপনা অধ্যয়ন করার একটি অন্যতম দিক হয়ে উঠতে পারে। সামনে আসতে পারে চলচ্চিত্রের বিশেষ কিছু জঁরের সঙ্গে বিশেষ ধরনের পুরুষত্ব অথবা নারীত্বের সংযোগ। মহাকাব্য, ওয়েস্টার্ন, যুদ্ধনির্ভর ছবি, হরর ছবি এবং অ্যাকশন ছবি সহ সাধারণভাবে, বিশেষ কিছু জঁর যে বিষয়গুলির উপর জোর দেয়, তা হল প্রথমত, তারা বিভিন্ন ধরনের বীরত্বের প্রকাশ বিষয়ে আগ্রহী, ও আত্মবিসর্জনের ধারণার উপর নির্ভরশীল; দ্বিতীয়ত, শরীর মূলত স্পেক্টাকল ও অবদমিত সমকামনার পরিসর হিসাবে উপস্থাপিত হয়; এবং তৃতীয়ত, এই ধরনের ছবিগুলিতে হিংস্রতাকে প্রায়শই একটি সফল পুরুষত্বের পরিচায়ক হিসাবে তুলে ধরা হয়।

সঞ্জয় শ্রীবাস্তবের মতে, স্বাধীনতা-পরবর্তী জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রের পুরুষ নায়ক পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনা (এফওয়াইপি) প্রণয়ন ও বাস্তবায়নের জাতীয়তাবাদী অর্থনৈতিক বিকাশের দর্শনের সঙ্গে দৃঢ়ভাবে সংযুক্ত। এই চিন্তাধারা দুন স্কুলের গণ্ডির মধ্য থেকেই মধ্যবিত্তের ‘জ্ঞানতাত্ত্বিক পুরুষত্ব’র ধারণাটিকে উত্থিত করেছিল। জনপ্রিয় হিন্দি চলচ্চিত্রে ‘এফওয়াইপি নায়ককে’ বিভিন্ন ঐক্ষিক ট্রোপ এবং খুব নির্দিষ্ট কিছু পরিসরের প্রদর্শনের মাধ্যমে উপস্থাপিত করা হয়েছে— প্রথমত, রাস্তা এবং মহাসড়কের আইকনিক ব্যবহার এবং বিশেষত এফওয়াইপি নায়কের প্রযুক্তিগত দক্ষতা প্রদর্শনের মাধ্যমে (যেখানে তিনি সুনিপুণভাবে আধুনিকতার আকাঙ্ক্ষার প্রতিরূপ মোটর গাড়িটি চালনা করেন); দ্বিতীয়ত, নায়কের ‘স্বাভাবিক’ আবাস হিসাবে মহানগরের পরিসরটিকে সামনে রাখার মাধ্যমে, কেননা নগরের পরিসরের মধ্যেই নায়ক স্বাধীনতা-পরবর্তী পরিকল্পিত আধুনিকতা অর্জনের প্রত্যাশা করতে পারে; এবং চতুর্থ, প্রায়শই এফওয়াইপি নায়ক একজন পুরোপুরি শহুরে পুরুষের চেয়ে মূলত একজন প্রাদেশিক, বুর্জোয়া মধ্যবিত্ত পুরুষের প্রতিরূপ হিসাবেই সামনে আসেন।

তবে স্বাধীনতা-পরবর্তী হিন্দি ছবির প্রসঙ্গ তুলে, যেভাবে সঞ্জয় শ্রীবাস্তব পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার সঙ্গে জড়িত হেজিমনিক নায়ককে বর্ণনা করেছেন তার সঙ্গে বাঙালি পুরুষত্বের গুরুত্বপূর্ণ পার্থক্য রয়েছে। পঞ্চবার্ষিকী পরিকল্পনার নায়ক ভারতীয় পুরুষত্বের একটি বিশেষ দিককে ইঙ্গিত করে, যেখানে পুরুষত্ব শারীরিক উপস্থাপনা বা আক্রমণাত্মক আচরণের সঙ্গে সংযুক্ত না হয়ে ‘বৈজ্ঞানিক’ এবং ‘যুক্তিবাদী’ হয়ে ওঠার মধ্য দিয়েই প্রকাশ পায়। কিন্তু এই প্রবন্ধের উদ্দেশ্য হল ১৯৫০-এর দশকের জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্র পাঠের মাধ্যমে তর্ক তোলা যে— বাঙালি পুরুষত্বের মধ্যে অঙ্গীভূত থাকে আবেগের ধারণা, যা একরকমভাবে প্রাধান্য অর্জন করে নেয়। বাঙালি পুরুষের পারফর্মেটিভিটি কীভাবে আবেগের ধারণাকে পরিবেষ্টন করে থাকে এই প্রশ্নটিই এই প্রবন্ধের ভরকেন্দ্র বলা চলে। পঞ্চাশের দশকের জনপ্রিয় বাংলা ছবি পথে হল দেরী-কে পাঠের মাধ্যমে, এই প্রবন্ধে, পঞ্চাশ-ষাটের দশকের জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামাতে লিঙ্গের উপস্থাপনা, অথবা আরও নির্দিষ্টভাবে পুরুষত্বের উপস্থাপনার উপর আলোকপাত করার চেষ্টা করা হয়েছে।

এক

এখানে, প্রাথমিকভাবে আবেগ ও অনুভূতির ধারণার মধ্যে গঠনমূলক পার্থক্যটির প্রতি নজরটান টানা প্রয়োজন। এই পার্থক্যটি কেবলমাত্র মানবচরিত্রেই নয় বরং চলচ্চিত্রের ক্ষেত্রেও, বিশেষভাবে মেলোড্রামার ক্ষেত্রেও একটি গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। ‘আবেগ’ বলতে সাধারণভাবে বুঝি শরীরের প্রভাবিত করার ক্ষমতা অথবা অন্যান্য শরীরের দ্বারা প্রভাবিত হওয়ার ক্ষমতা। যার ফলে শরীরের সক্রিয়তাকে বাড়ানো যায় বা হ্রাস করা যায়। আবেগ, অনুভূতির পূর্ববর্তী হিসাবে, অনুভূতির জন্য প্রয়োজনীয় শর্তগুলিকে প্রতিষ্ঠা করে এবং অনুভূতির প্রকাশের মুহূর্তের থেকেও বেশি সময় স্থায়ী হয়। এক দিকে অনুভূতি বলতে বোঝায় অভ্যাসগতভাবে অর্জিত, সাংস্কৃতিকভাবে প্রোথিত এবং স্থানীয়ভাবে প্রভাবিত আবেগ। অপর দিকে, ব্রায়ান মাসুমির ব্যাখ্যায়, আবেগ বলতে বোঝায়, অনুভূতির ব্যতিক্রমী, অপ্রত্যাশিত ও অকপট অভিব্যক্তিগুলির প্রতি উন্মুক্ত থাকা। এটি লক্ষ করা গুরুত্বপূর্ণ যে, আবেগ এবং অনুভূতির মধ্যে বিভিন্ন পার্থক্য থাকা সত্ত্বেও, বাস্তবে এই দু’টি ধারণা আলগাভাবে হলেও সংযুক্ত রয়েছে। যদিও অনুভূতি শব্দটি মানসিকভাবে অনুভূত আবেগ বোঝাতে বেশি ব্যবহৃত হয়। অনুভূতি অনেকসময় শরীর যেভাবে প্রভাবিত হয় অথবা অন্য শরীরকে প্রভাবিত করে তাকে মূর্ত করে তোলে। অতএব, ধারণাটিকে এভাবে ভেবে নেওয়া যেতে পারে যে, আবেগ এবং অনুভূতি আলগাভাবে সংযুক্ত থাকে ও আবেগের সঙ্গে জড়িয়ে থাকা বিভিন্ন অভিব্যক্তির মাত্রা ও প্রক্রিয়ার সঙ্গে সম্পর্কযুক্ত থাকে। তবে এই আলোচনার জন্য যেদিকটি গুরুত্বপূর্ণ তা হল, আবেগগত ও বৌদ্ধিক ধারণার মধ্যে পার্থক্য। আমি প্রতিপন্ন করার চেষ্টা করছি যে, ‘বৈজ্ঞানিক’ এবং ‘যুক্তিবাদী’ হিসাবে বিবেচিত হেজিমনিক, উত্তর-ঔপনিবেশিক ভারতীয় পুরুষত্বের ধারণা আবেগের ধারণার সঙ্গে সমন্বয়বিধান করে না। যে আবেগের ধারণাটি বাঙালি পুরুষত্বের একটি গঠনমূলক দিক হিসাবে রয়ে গেছে।

ফ্রয়েডের মতে, ‘আবেগ’ শব্দটি ‘ধারণা’ শব্দটির বিরোধিতা করে। আবেগগত ও বৌদ্ধিক ধারণার মধ্যের বিরোধিতা দর্শনের অন্যতম প্রাচীন বিষয় এবং জার্মান মনোবিজ্ঞানের মাধ্যমে ফ্রয়েডের শব্দভাণ্ডারে প্রবেশ করেছিল। জাক লাকাঁর মতে অবশ্য, আবেগগত ও বৌদ্ধিক ধারণার মধ্যের বিরোধিতা মনোবিশ্লেষিক ক্ষেত্রে বৈধ নয়। লাকাঁর মতে কিন্তু বৌদ্ধিকতা থেকে আবেগের ক্ষেত্রকে আলাদা করা অসম্ভব— আবেগ কোনও বিশেষ ঘনত্বের মতো নয় যা বৌদ্ধিকতার হিসাবের বাইরে চলে যেতে পারবে। চিহ্ন তৈরি হওয়ার পূর্বের কোনও কাল্পনিক পরিসরে— যা সন্দর্ভের মধ্যে থেকে নির্মাণেরও পূর্বের এক পরিসর— একে পাওয়া যাবে না। যদিও লাকাঁ আবেগ সম্পর্কে কোনও বিশেষ তত্ত্ব আলোচনা করেননি, কিন্তু এর মনোবিশ্লেষিক দিক সম্পর্কে মন্তব্য করেছেন। তিনি মনে করেন, আবেগ প্রতীকী বিন্যাসের সঙ্গে সম্পর্কিত, কেননা আবেগ বলতে বোঝায় যে, ব্যক্তি অপরের সঙ্গে তার সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবান্বিত। সুতরাং, বাঙালি পুরুষত্ব, আবেগকে প্রাধান্য দিয়ে ‘এফওয়াইপি নায়ক’ বা জাতীয় পুরুষত্বের ধারণার বিপরীতে গঠিত হয়, যেটা তার আত্মনিষ্ঠাকে নির্মাণ করে।

এটা সম্ভবত অস্বীকার করা যাবে না যে, ১৯৫০-৬০-এর দশকের বাংলা চলচ্চিত্রে বাঙালি পুরুষ নিয়ে আলোচনা করলে, অবশ্যম্ভাবীরূপে উত্তমকুমারই সেই আলোচনার কেন্দ্রে থাকবেন। তিনি বাংলা চলচ্চিত্রের অন্যতম জনপ্রিয় তারকা হিসাবে এক অভূতপূর্ব সাফল্য উপভোগ করেছেন। উত্তমকুমারের কর্মজীবন ১৯৫০-এর দশক থেকে শুরু করে ১৯৭০-এর দশকের শেষ ভাগ পর্যন্ত বিস্তৃত ছিল, যে-সময়টা সাধারণত বাংলা চলচ্চিত্রের সোনালি বছর হিসাবে বিবেচিত হয়। তবে তাঁর কর্মজীবনের স্বর্ণযুগ সম্ভবত ১৯৫০-৬০ এই দু’টি দশক, যখন তিনি প্রায় একশো চব্বিশটি ছবিতে প্রধান চরিত্রে অভিনয় করেছিলেন। উত্তমকুমারের এই অপরিসীম জনপ্রিয়তা স্বাধীনতা পরবর্তী সময়কালে বাঙালি পুরুষের একটি বিশেষ দৃষ্টিভঙ্গিকে ইঙ্গিত করে।

উত্তমকুমারের আগে প্রমথেশ বড়ুয়া (১৯০৩-১৯৯১) একজন অভিনেতা-পরিচালক হিসাবে প্রচুর সফলতা অর্জন করেছিলেন। তবে তাঁর সাফল্য ‘তাঁর জীবনের বিচ্ছিন্নতা, বিশৃঙ্খলা এবং অবিবেচকের মত আবেগতাড়িত হওয়ার কাহিনীকে ঢেকে দিতে ব্যর্থ হয়েছিল’। তাঁর পরদার উপরের ও পরদার পিছনের আত্মবিনাশক, অর্ধ-মাতাল, যৌন আক্রমণাত্মক ব্যক্তিত্ব এক বিরলদৃষ্ট পুরুষচরিত্র নির্মাণ করেছিল। প্রমথেশ বড়ুয়া কখনও বাঙালি মধ্যবিত্তের গতানুগতিক সংসারজীবনে নেমে আসেননি। বাঙালি দর্শক তাঁর সম্পর্কে কৌতূহল বোধ করেছেন তবে নিকটাত্মীয় হিসাবে নয়। অন্য দিকে, উত্তমকুমার জনপ্রিয় তারকা হওয়া সত্ত্বেও তাঁকে পাশের বাড়ির প্রতিবেশী বলে মনে হত, যাঁকে খুব সহজেই ‘কেমন আছেন’ জিজ্ঞেস করা সম্ভব। উত্তমকুমারের পুরুষত্ব ঐতিহাসিকভাবে নির্দিষ্ট সন্দর্ভ, শরীর ও আবেগের দ্বারা সংঘটিত। বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কাছে দীর্ঘ দিন ধরেই উত্তমকুমার ‘হয়ে ওঠা’টা এক অদম্য ইচ্ছা।১০ উত্তমকুমারের মধ্য দিয়ে প্রতিফলিত এই আদর্শ পুরুষের নির্মাণটির প্রতি সাধারণ বাঙালি পুরুষদের আসক্তি কীভাবে ব্যাখ্যা করব? এই ‘হয়ে ওঠা’র চাহিদাগুলির উপাদানগুলোই-বা কী কী?

বেশিরভাগ ছবিতেই উত্তমকুমার একজন মার্জিত, সম্পন্ন ডাক্তার, আইনজীবী, ইঞ্জিনিয়ার, সম্ভ্রান্ত ব্যবসায়ী বা বিশ্ববিদ্যালয়ের মেধাবী স্নাতকের ভূমিকায় অভিনয় করেছেন। এই চরিত্রগুলি স্বাধীনতা পরবর্তী ভারতের আদর্শ নাগরিকের ধারণার সঙ্গে খাপ খেয়ে যায়। কিন্তু, ইতিমধ্যেই উল্লেখ করেছি, আধুনিকতার সংসাধন তাঁর পুরুষত্বকে তৈরি করেছে নিবৃত্তিমূলক, বহিষ্করণীয় সন্দর্ভের পরিণতি হিসাবে।

হিন্দি চলচ্চিত্রের মিস-অ-সিনে-র মাধ্যমে যখন একইসঙ্গে আশঙ্কাজনক ও আকাঙ্ক্ষিত উত্তর-ঔপনিবেশিক শহরটিকে আধুনিকতাবাদী আশার জটিল পরিসর হিসাবে উপস্থাপিত করা হচ্ছে, তখন এটি মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে বুর্জোয়া প্রকাশভঙ্গিতে জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামা ছিল ‘এক দিকে পুরাতন পরিবার এবং সম্প্রদায়ের প্রতি টান এবং অন্য দিকে ব্যক্তিবাদ এবং শিল্পোন্নতির স্বপ্নের মধ্যে একটি সমঝোতা’।১১ এই সমঝোতার মধ্যেই, আবেগের ধারণাটি নায়কের চরিত্রকে নির্মাণ করে তোলে অনেকগুলি জনপ্রিয় চলচ্চিত্রের মধ্যে। যেমন পথে হল দেরী (১৯৫৭), সবার উপরে (১৯৫৫), সপ্তপদী (১৯৬১), জীবন মৃত্যু (১৯৬৭) এবং সেই সময়কার আরও বেশ কিছু চলচ্চিত্র।

দুই

অগ্রদূত পরিচালিত জনপ্রিয় ছবি পথে হল দেরী-র প্রসঙ্গ টেনে এনে এখানে কিছুটা সংক্ষেপে আমি আলোচনা করতে চাই, আবেগের ধারণা এবং উত্তমকুমারের পুরুষত্বের উপস্থাপনায় আবেগের প্রভাব বিষয়ে। প্রতিভা বসুর কাহিনি অবলম্বনে পথে হল দেরী-র চিত্রনাট্য রচনা করেছিলেন নিতাই ভট্টাচার্য। এই ছবিতে মল্লিকা বন্দ্যোপাধ্যায় (অভিনয়: সুচিত্রা সেন), এক ধনী অভিজাত পরিবারের নাতনি, যিনি তাঁর দাদামশাই এবং ছোট ভাইয়ের সঙ্গে থাকেন, ও ঘটনাক্রমে প্রেমে পড়েন ডক্টর জয়ন্ত মুখোপাধ্যায়ের (অভিনয়: উত্তমকুমার) প্রতি, যিনি এক দরিদ্র স্কুলশিক্ষকের ছেলে, মধ্যবিত্ত, ডাক্তারির ছাত্র। যার স্বপ্ন ইংল্যান্ডে গিয়ে এফআরসিএস ডিগ্রি পাওয়া ও একজন নামজাদা ডাক্তার হয়ে ওঠা। তারা প্রেমে পড়লেও জয়ন্ত নিজেদের প্রণয় সম্পর্কে দ্বিধাগ্রস্ত হয়ে পড়ে, কেননা মল্লিকা এক অতীব সচ্ছল পরিবারের কন্যা, যে তার মধ্যবিত্ত, অত্যন্ত সাধারণ জীবনযাত্রার সঙ্গে সবসময় মানিয়ে চলতে না-ও পারে। তবে মল্লিকা তাকে নিশ্চিত করে বলে, ‘আমি জানি আমার জীবনের অসারতা। আমার দাদুর টাকা বাদ দিলে আমার মূল্য একটা কুলি মেয়ের থেকেও কম। কাজের কোষ্ঠী পাথরে আমি মরা সোনা… চারিপাশে মামুলি সাধনের মধ্যে আমার প্রাণটা যখন হাঁপিয়ে উঠেছিল, তখন এক ঝলক দমকা হাওয়ার মতো আপনি এলেন আমার জীবনে। সব ওলটপালট হয়ে গেল…’। কিন্তু, মল্লিকার পিতামহ, শ্রীপতিবাবু (ছবি বিশ্বাস) তীব্রভাবে তাদের প্রেমের সম্পর্ককে নাকচ করে দিতে উদ্যত হন। কেননা তিনি মনে করেন, যেহেতু জয়ন্ত খুব ধনী, সম্ভ্রান্ত ও সামাজিক মর্যাদাসম্পন্ন পরিবারের অন্তর্গত নয়, ফলে সে তাঁর নাতনির জন্য মানানসই নয়। তা ছাড়া, তিনি মল্লিকার সঙ্গে বিয়ে দেবেন বলে ঠিক করে রেখেছেন প্রমথেশ নামে এক ধনী, সম্ভ্রান্ত, উচ্চাকাঙ্ক্ষী ব্যারিস্টারকে, যে ইউরোপে গিয়ে আইন পড়ে সেখানেই তার কর্মজীবন কাটাতে চায়। তবে, জয়ন্তের প্রেমে পাগল মল্লিকা জয়ন্ত ব্যতীত অন্য কাউকে বিয়ে না করার সিদ্ধান্ত নেয় এবং তারা গোপনে স্বামী-স্ত্রী হিসাবে শপথ গ্রহণ করে। পরবর্তীকালে, মল্লিকা জয়ন্তকে তার মৃত মায়ের মূল্যবান অলংকার নিতে বাধ্য করে, যাতে তার ইউরোপ যাওয়ার খরচ উঠে আসে ও জয়ন্ত ইউরোপ থেকে এফআরসিএস পাশ করে, ‘বিলেত ফেরত’ ডাক্তার হয়ে উঠতে পারে। ঘটনাচক্রে, মল্লিকার দাদা যখন জানতে পারে যে জয়ন্ত মল্লিকার দেওয়া টাকায় ইংল্যান্ডে ডাক্তারি পড়তে গেছে, তখন জয়ন্তকে একজন প্রতারক হিসাবে সন্দেহ করে। এমন একজন যে মল্লিকাকে কেবল ইউরোপে যাওয়ার স্বার্থে ব্যবহার করেছে। সব কিছু জানতে পেরে, শ্রীপতিবাবু ক্রোধোন্মত্ত হয়ে মল্লিকাকে তার ইচ্ছের বিরুদ্ধে প্রমথেশকে বিয়ে করতে বাধ্য করেন ও ইউরোপে জয়ন্তকে একটি চিঠি পাঠান যে মল্লিকা তার ভুল বুঝতে পেরেছে এবং প্রমথেশকে বিয়ে করতে রাজি হয়েছে; আর এও জানান যে জয়ন্ত যেন মল্লিকার নববিবাহিত জীবন নষ্ট করার চেষ্টা না করেন।

কিন্তু মল্লিকা তাঁর দাদামশাইয়ের ইচ্ছার সঙ্গে সহমত হতে পারে না। মল্লিকা বাড়ি থেকে পালিয়ে গিয়ে, জয়ন্তের ফিরে আসার অপেক্ষায় তার শৈশবের গৃহশিক্ষকের বাড়িতে আশ্রয় নেয় ও আরতি নামের এক সম্ভ্রান্ত মহিলার বাড়িতে সংগীতশিক্ষিকা হিসাবে কাজ শুরু করে। এদিকে আরতিই একদিন কাকতালীয়ভাবে মল্লিকাকে ভিয়েনায় তাঁর নিজের সঙ্গে জয়ন্তের একটি ছবি দেখিয়ে জানায় যে জয়ন্তর সঙ্গে তাঁর আলাপ হয়েছিল ভিয়েনায় আর তারপরই সে জয়ন্তর প্রেমে পড়ে যায়। সে এও জানায় যে, তারা খুব শীঘ্রই বিয়ে করতে চলেছে। এই অপ্রত্যাশিত সংবাদ মল্লিকাকে একবারে চূর্ণবিচূর্ণ করে দেয়। তীব্র বিষণ্ণতা সহ্য করতে না পেরে মল্লিকা সাইকোনিউরোসিস বা আংজাইটি নিউরোসিসের কবলে পড়েন ও অল্পদিনের মধ্যেই তার শরীরের নীচের অংশটি পক্ষাঘাতগ্রস্ত হয়ে পড়ে। ঘটনাচক্রে, মল্লিকার ডাক্তার হিসাবে জয়ন্তই শেষপর্যন্ত উপস্থিত হয়। সেইসময় মল্লিকা একজন সম্পূর্ণ শয্যাশায়ী, প্রায় হিস্টেরিক মহিলা। কিন্তু জয়ন্ত তাঁকে সুস্থ করে তোলার পণ নেয়। দীর্ঘ প্রচেষ্টার পর, অবশেষে, জয়ন্ত মল্লিকাকে নিরাময় করতে সক্ষম হয় ও চলচ্চিত্রটির আনন্দময় সমাপ্তি ঘটে।১২

পথে হল দেরী-কে সামনে রাখার উদ্দেশ্য হল বাঙালি পুরুষত্বের নির্মাণের অঙ্গ হিসাবে আবেগের গুরুত্ব বোঝা এবং বিশেষত উত্তমকুমারের মধ্যে দিয়ে এই সংগঠন কীভাবে চিত্রিত হয়েছে সে-সম্পর্কিত কিছু বিতর্ক উপস্থাপন করা। এখানে, অত্যন্ত সংক্ষেপে চলচ্চিত্রটির একেবারে শুরুর একটি দৃশ্যের কথা উল্লেখ করা প্রয়োজন। এই দৃশ্যে, জয়ন্তর এক সহকর্মী ডাক্তার এসে জয়ন্তকে বলে যে শ্রীপতিবাবুর পরিজনের যত্ন নেওয়া বেশি আবশ্যক, কেননা শ্রীপতিবাবু যথেষ্ট ধনী ও প্রভাবশালী। কিন্তু, জয়ন্ত দৃঢ়তার সঙ্গে জানায়, একজন কুলির ভাঙা হাতের শুশ্রূষা করা বেশি প্রয়োজন কেননা কুলি তার জীবিকানির্বাহের জন্য তার হাতের ওপরই নির্ভরশীল, কিন্তু শ্রীপতিবাবুর পরিজনের সেই অত্যাবশ্যকতা নেই। এই উক্তি কেবলমাত্র একজন যুক্তিবাদী, আধুনিক ডাক্তারের বয়ান নয়, যা নির্দিষ্ট ঔপনিবেশিক পুরুষত্বের গঠনকে চিহ্নিত করে, বরং এই উক্তির মধ্যে সন্নিহিত আবেগের সাক্ষ্য বহন করে জয়ন্তর বাঙালি পুরুষত্বের নির্মাণ।১৩ স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি পুরুষের নির্মাণ এইভাবেই, বিভিন্ন ক্ষেত্রে, আবেগকে বৌদ্ধিকতার থেকে বেশি মান্যতা দেয়। চিকিৎসক কেবল যৌক্তিক-বৈজ্ঞানিক শক্তিতে বলীয়ান হয়ে যৌক্তিক পরিবর্তনের নিদর্শনই হয়ে ওঠেন না বরং তিনি আবেগকে মূর্ত করে এই সত্যকে প্রতিষ্ঠা করেন যে তিনি ‘অপর’-এর সঙ্গে তাঁর সম্পর্কের দ্বারা প্রভাবিত।

ছবিটির শেষে জয়ন্ত রক্তস্বল্প, আংশিকভাবে পক্ষাঘাতগ্রস্ত, ও হিস্টেরিক হওয়ার সমস্ত লক্ষণ সংবলিত মল্লিকার মুখোমুখি হয়। যদিও সে তার ‘বৈজ্ঞানিক’ চিকিৎসাশাস্ত্রের জ্ঞানের সাহায্যে ছয় মাস ধরে তাকে নিরাময়ের জন্য অদম্য চেষ্টা করছে, কিন্তু ধীরে ধীরে মল্লিকার অবস্থার অবনতিই ঘটেছে। তারপরই জয়ন্ত বুঝতে পেরেছিল, ‘যদি তার মন নিরাময় না হয় তবে তার শরীরের আরোগ্য হবে না… এখন একমাত্র সমাধান হল যেভাবেই হোক তার মনকে জাগ্রত করা।’ এর ঠিক পরেই চলচ্চিত্রের মেলোড্রামা-শৈলীকে অনুসরণ করে জয়ন্ত অত্যন্ত উচ্চকণ্ঠে মল্লিকার প্রতি তাদের অতীতের সুখ এবং প্রতিশ্রুতির মুহূর্তগুলো উল্লেখ করতে থাকে। আর মল্লিকা মৃতপ্রায় মহিলার মতো বিছানার উপর শুয়ে থাকে। এইসময়ই সে হঠাৎ করে মল্লিকার দাদামশাই জয়ন্তকে যে-সমস্ত চিঠিগুলি পাঠিয়েছিল এবং জয়ন্ত ইউরোপ থেকে মল্লিকাকে যে-চিঠিগুলি পাঠিয়েছিলেন, যার একটিও মল্লিকা পায়নি, সেগুলি নিয়ে আসে। আবেগতাড়িত উত্তেজনার বসে, জয়ন্ত মল্লিকার মুখে চিঠির গুচ্ছ নিক্ষেপ করে। ফলস্বরূপ, আশ্চর্যজনকভাবে অল্প সময়ের মধ্যেই মল্লিকার মধ্যে গতিময়তা লক্ষ করা যায়। সে ধীরে ধীরে চিঠিগুলি পড়া শুরু করে। আরও কয়েক মুহূর্তের মধ্যে সে তার আংশিক পক্ষাঘাত থেকেও সুস্থ হয়ে ওঠে। ঠিক সেই মুহূর্তেই পিয়োন তাকে একটি চিঠি দেয় যা আসলে জয়ন্তর মাসির কাছ থেকে আসা জয়ন্তর প্রতি লেখা চিঠি। এই চিঠিতে পরিষ্কারভাবে বর্ণনা করা হয়েছে যে জয়ন্ত কীভাবে মল্লিকার চিকিৎসার জন্য সবরকম ত্যাগস্বীকার করেছে, যদিও মল্লিকা তাঁকে ভুল বুঝেছে। এখন, অপরাধবোধে জর্জরিত মল্লিকা সিদ্ধান্ত নেয় যে সে আত্মহত্যা করবে, কিন্তু জয়ন্ত তাকে সঠিক সময়ে নিরস্ত করে ও সে এক প্রাণোচ্ছল, পুনরুজ্জীবিত, সম্পূর্ণরূপে নিরাময় হয়ে যাওয়া মল্লিকার সঙ্গে আলিঙ্গনাবদ্ধ হয়।

এই দৃশ্যটি আমাদের ইঙ্গিত দেয় যে মল্লিকার হিস্টেরিক অবস্থা স্পষ্টতই একটি আবেগগত দশা। কারণ ফ্রয়েড মন্তব্য করেছিলেন যে, এটি শরীরের তাৎক্ষণিক প্রতিক্রিয়া নয়, যেরকমটা মনোবিজ্ঞান আমাদের বিশ্বাস করতে বলে, বরং এটি একটি সংকেত যা মানবপ্রজাতির মধ্যেই নিহিত রয়েছে। লাকাঁর ধারণা অনুযায়ী, মল্লিকার উদ্বেগ এই বিষয় থেকে উদ্ভূত হয়েছিল যে সে অপরের আকাঙ্ক্ষার সম্মুখীন হলেও, সেই আকাঙ্ক্ষার পরিসরে তার অবস্থিতি সম্পর্কে সে নিশ্চয়তা পায়নি। সুতরাং, আকাঙ্ক্ষাটি মূলত অপরের আকাঙ্ক্ষার পরিসরে আসার বাসনা, যার অর্থ হল, প্রথমত অপরের আকাঙ্ক্ষার বস্তু হয়ে ওঠা এবং দ্বিতীয়ত অপরের দ্বারা স্বীকৃতি পাওয়ার ইচ্ছা। অন্যভাবে বলতে গেলে, মল্লিকার আকাঙ্ক্ষার লক্ষ্যবস্তুটি খুঁজে বের করা তার আচরণের বিশ্লেষণের জন্য গুরুত্বপূর্ণ নয়, বরং যেটা গুরুত্বপূর্ণ সেটা হল যে-বিশেষ জায়গা থেকে সে আকাঙ্ক্ষাটি করছে তাকে চিহ্নিত করা, অথবা, যে-বিষয়ীর সঙ্গে মল্লিকা নিজেকে অভিন্ন বলে ভাবছে তাকে চিহ্নিত করা। সুনির্দিষ্ট মনঃসমীক্ষণের দিক থেকে যাকে বলা হয় ‘আকাঙ্ক্ষার বিষয়ী’, সেই বিষয়ী কেবলমাত্র উপস্থিত থাকতে পারে এই প্রশ্নের উপর ভর করে যে অপরের জন্য তিনি কতটা লক্ষিত বস্তু?১৪

অতঃপর, চিঠিগুলি পড়ার পর থেকে মল্লিকা ক্রমাগত পুনরুক্তি করে যাচ্ছিল, ‘’জয়ন্তর জীবনে আমিই সব’— যেন এর ফলে সে এক ধরনের বিশোধক ফলাফল পেতে পারে।১৫ আবেগের ধারণার দ্বারা পরিচালিত আকাঙ্ক্ষার অর্থনীতির মধ্যে থেকে মল্লিকার আত্মমাত্রিকতাকে পুনর্বিন্যস্ত করাই হল এর উদ্দেশ্য। স্মৃতিগুলি মূলত আবেগের দ্বারা নির্মিত স্মৃতি, ‘অতীতের অভিজ্ঞতালব্ধ অনুভূতির অবিচ্ছিন্ন প্রভাব’। ফ্রয়েড-এর ব্যাখ্যা করা স্মৃতির সহযোগী তত্ত্ব এখানে খেয়াল করা জরুরি— যেটা ‘সত্যিকারের’ স্মৃতি এবং ‘ভ্রান্ত’ স্মৃতির মধ্যে পার্থক্য নির্দিষ্ট করে দেয়, তা হল ‘আবেগ’, এবং যা ‘সবসময় সত্য’ ও যা প্রাথমিক ধারণার স্মার্তচিহ্নের সহায়তায় অর্থের পুনরাবিষ্কারের পথপ্রদর্শন করতে পারে। পথে হল দেরী, চলচ্চিত্রে চিঠিগুলি স্মার্তচিহ্নের ভূমিকা পালন করে যা এতটাই তীব্র ও ইন্দ্রিয়গতভাবে সংবেদনশীল যে এগুলি চেতনার উপর দিয়ে প্রবাহিত হয়ে যায় ও তাদের মধ্যে আবেগগত বন্ধনকে পুনরুজ্জীবিত করে তোলে। অর্থাৎ, মল্লিকার নিরাময় সম্পূর্ণ বৈজ্ঞানিক নয় বরং স্পষ্টতই আবেগনির্ভর যা স্মৃতি ও এবং স্মার্তচিহ্নের লক্ষণগুলির সঙ্গে সম্পর্কিত।১৬

সম্ভবত স্বাভাবিকভাবেই জয়ন্ত তার একচেটিয়া বৈজ্ঞানিক, আধুনিক এবং যুক্তিসম্মত বৈশিষ্ট্যকে কাজে লাগিয়ে তার উত্তর-ঔপনিবেশিক জ্ঞানতাত্ত্বিক পুরুষত্বকে পুরোপুরি রূপ দিতে পারে না এবং সেইজন্যই তার পুরুষত্বের আবেগপ্রবণ দিকটিকেও সম্পূর্ণ অস্বীকার করা তার পক্ষে সম্ভব হয় না। একটি বিশেষ দৃশ্যে যে-মহিলা মল্লিকার চিকিৎসায় জয়ন্তকে সহায়তা করছেন, তিনি উৎসুকভাবে জিজ্ঞাসা করেন, ‘আপনি কেন তাঁর সঙ্গে একজন রোগীর মতো ব্যবহার করেন?’ যেন, তার আর মল্লিকার সম্পর্কের মধ্যে আবেগের স্বাভাবিক প্রাধান্য, একজন সাধারণ ডাক্তার–রোগীর বৈজ্ঞানিক, জ্ঞানতাত্ত্বিক কাঠামোর মধ্যে দিয়ে প্রকাশিত হতে পারছে না; এবং অবশেষে জয়ন্তকে মল্লিকার নিরাময়ের জন্য আবেগের অনুবর্তীই হতে হয়। জয়ন্তের পুরুষত্বের এই দ্ব্যর্থতা— একজন ‘ডাক্তার’ এবং ‘প্রেমিক’ পরিচিতির মধ্যে; ‘বিজ্ঞানমনস্কতা’ ও ‘আবেগ-ভাবাপন্ন’ হয়ে ওঠার মধ্যে— এক ধরনের দ্বৈত-গতিময়তার কথা স্মরণ করিয়ে দেয় যা জয়ন্তর পুরুষ হয়ে ওঠার প্রক্রিয়ায় পারফর্মেটিভ বিভাজনের দিকে ইঙ্গিত করে।

এক্ষেত্রে এটি উল্লেখ করা প্রয়োজনীয় যে আবেগপ্রবণ বাঙালির পুরুষত্ব সদ্য-স্বাধীন রাষ্ট্রের আর্থ-সামাজিক প্রেক্ষাপটের বাইরে বোঝা সম্ভব নয়। জয়ন্ত একজন সম্পূর্ণরূপে আদর্শবাদী ডাক্তার হিসাবে চিহ্নিত না-ও হতে পারে, কেননা সে যে অর্থ এবং খ্যাতির দিকগুলি সম্পর্কে সম্পূর্ণ উদাসীন এমনটা নয়। আবার তার সারাটা জীবন গ্রামের দরিদ্রদের সেবার জন্য উৎসর্গ করেছিল, তা-ও নয়।১৭ বরং, জয়ন্ত ইউরোপে যাওয়ার জন্য বাসনা প্রকাশ করে এবং একজন প্রখ্যাত ও সচ্ছল ডাক্তার হয়ে ওঠার ইচ্ছা সাগ্রহে কামনা করে; আর এই ইচ্ছাকে সমর্থন করে ভাগ করে নেয় মল্লিকাও। ইউরোপে যাওয়ার জন্য যে-অর্থের প্রয়োজন, তার ব্যবস্থা করার জন্য জয়ন্তর বেছে নেওয়া পদ্ধতি স্পষ্টতই বাঙালি পুরুষত্বের অংশ হিসাবে বুদ্ধিবলের কার্যকারিতারই ইঙ্গিত করে। জয়ন্ত মল্লিকাকে জানায় যে সে নার্সিং বিষয়ে একটি বই লিখছে এবং ওই বইটি থেকে যে অর্থোপার্জন করা যাবে তা-ই দিয়েই সে এফআরসিএস ডিগ্রি অর্জনের জন্য ইংল্যান্ডে যেতে পারবে। তাই, যদিও তার পৈতৃক সম্পত্তি থেকে স্থিতিশীল আয়ের অভাব একজন এমবিবিএস ডাক্তার হিসাবে তিন শত টাকা মাসিক আয় করে মেটানো যেত, কিন্তু একজন উচ্চাকাঙ্ক্ষী মধ্যবিত্ত হিসাবে জয়ন্তরও বাসনা যে, সে ইংল্যান্ড গিয়ে চিকিৎসাবিজ্ঞানের উচ্চতর ডিগ্রি অর্জন করে আরও বৈভবশালী জীবনধারা নিশ্চিত করতে পারে। তাই সে মল্লিকার প্রশ্নের জবাব দিয়েছে—

মল্লিকা:আপনার বিলিতি ডিগ্রির এত মোহ কেন?
জয়ন্ত:এটা মোহ নয় মিস ব্যানার্জি। এটা প্রয়োজন। একটা সাধারণ এমবিবিএস ডাক্তারের আর কতটুকু জ্ঞান?… মনে মনে কত স্বপ্ন গড়েছি। বিলেত যাব। বড় ডাক্তার হব। মহাত্মা পাস্তুরের মতো রিসার্চ করব। আরও কত কী… যাকগে, ওই ছেঁড়া কাঁথায় শুয়ে রাজপ্রাসাদের গল্প শুনে আপনি আর কী করবেন?

এখানে, মনে রাখার প্রয়োজন যে, এই সময়টা ছিল নেহরুর রূপায়িত সমাজতন্ত্রের পর্ব; রাষ্ট্রের দায়িত্বে অর্থনৈতিক উন্নয়নের পর্যায়। তবে যেমনটি আমি আগেই বলেছি, স্বাধীনতা পরবর্তী বাঙালি ভদ্রলোকের পারফর্মেটিভ আধুনিকতার নির্মাণ হয়েছিল কতগুলি পরস্পর নির্ভরশীল বহিষ্করণের ফলস্বরূপ। তবে এখানে আমি উল্লেখ করতে চাই যে, এই অসম্পূর্ণতা কেবলমাত্র কিছু সামাজিক বহিষ্করণের ফল নয়, বরং নির্দিষ্ট কিছু অন্তর্ভুক্তির সঙ্গেও যুক্তিযুক্তভাবে জড়িত। আমি জুডিথ বাটলার-এর সঙ্গে একমত হয়ে বলব যে, অন্তর্ভুক্তকরণের ক্ষেত্র কখনও চূড়ান্ত অথবা সম্পূর্ণ হতে পারে না, কেননা, সামাজিক ক্ষেত্রের ঐতিহাসিকতা ও জটিলতা কখনওই কোনও বর্ণনা দ্বারা সম্পূর্ণরূপে সারসংক্ষেপিত করা যেতে পারে না এবং গণতান্ত্রিক স্বার্থে তা না হওয়াই উচিত।১৮ স্বাধীনতা পরবর্তী সময়ে হেজিমনিক পুরুষত্বের বিপরীতে, পারফর্মেটিভ বাঙালি পুরুষত্ব, বুর্জোয়া বাসনার সঙ্গে বোঝাপড়া করে আবেগের প্রাধান্য নির্দেশ করে এমন এক সময়ে যেখানে এক দিকে সামন্ততান্ত্রিক বিন্যাস ক্রমশ ক্ষয় পাচ্ছে ও অপর দিকে পুঁজি নতুনভাবে বণ্টিত হচ্ছে।

১৯৫০ ও ৬০-এর দশকের জনপ্রিয় বাংলা ছায়াছবিতে বাঙালি পুরুষত্বের সঙ্গে আবেগের সম্পৃক্ততাকে কাছ থেকে পড়লে, তার সঙ্গে জড়িয়ে থাকা পারফর্মেটিভের ধারণার মধ্যের ফাঁকফোকরগুলোও সন্ধান করা সহজ হয়ে যায়। বাটলারের মতো একাধিক গবেষক বিবাহকে পারফর্মেটিভের আদর্শ উদাহরণ হিসাবে সামনে রেখে থাকেন এটা বোঝাবার জন্য যে পারফর্মেটিভ উচ্চারণ সফল হতে পারে না যদি-না তা একটা সূত্রবদ্ধ, পুনরাবৃত্তিমূলক কাঠামোর পুনরুক্তি করে। বাটলার এই যুক্তিকে আরও প্রসারিত করে দাবি করেন যে, প্রাথমিক পারফর্মেটিভ উচ্চারণ ‘মেয়ে হয়েছে!’ (‘It’s a girl!’)-এর মধ্যেই নিহিত আছে আগামী দিনের ‘আমি আপনাদের বিবাহিত পুরুষ এবং স্ত্রী হিসাবে ঘোষণা করছি’ (‘I pronounce you man and wife’) এই অনুমোদনকারী ঘোষণার প্রত্যাশা।১৯ কিন্তু, পথে হল দেরী–তে জয়ন্ত ও মল্লিকা হিন্দুবিবাহের রীতি মেনে বিবাহসূত্রে আবদ্ধ হয় না। তারা কোনও মন্ত্রও উচ্চারণ করে না, বা তাদের বিবাহ প্রাতিষ্ঠানিক কোনও রীতি মেনেই হয়নি, তবুও তারা একে অপরকে বিবাহ করে।

জয়ন্ত:ব্রাহ্মণ দেবতাকে সাক্ষী করে এবং মন্ত্র পাঠ করে তবে স্বামী-স্ত্রী হতে হয়।
মল্লিকা:মন্ত্র তো তোমার হৃদয়ে আমারও, আমার হৃদয়ে তোমারও, তা কি হয়নি?
জয়ন্ত:মলি…
মল্লিকা:তুমি ব্রাহ্মণ, দেবতা হিমালয় সাক্ষী। যে সাক্ষী চিরদিন আমাদের ভালবাসার সাক্ষী দেবে, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমি তোমাকে বলছি— মি আমার স্বামী, আমি তোমার স্ত্রী।
জয়ন্ত:যে সাক্ষী চিরদিন আমাদের ভালবাসার সাক্ষী দেবে, তাঁর সামনে দাঁড়িয়ে আমিও বলছি— তুমি আমার স্ত্রী, আমি তোমার স্বামী।

এই ধরনের উচ্চারণের একটি আদর্শ উদাহরণ হয় অস্টিন-এর ফাঁপা বা অকার্যকর পারফর্মেটিভ২০ যা ঐকান্তিকভাবে উচ্চারিত হয়নি, কিন্তু যার ব্যবহার তার স্বাভাবিক ব্যবহারের উপর পরজীবীর মতো প্রয়োগ হয়ে থাকে।২১ তবে কীভাবে জয়ন্ত ও মল্লিকা সহ চলচ্চিত্রের দর্শকরাও তাদের বিবাহকে একটি ‘আন্তরিক’ কার্য বলে বিবেচনা করল? এতটাই আন্তরিক ও গুরুতর যে বছরের পর বছর ধরে জয়ন্ত ইংল্যান্ড থেকে ফিরে না এলেও, সে এবং মল্লিকা সেই ভূমিকাতেই আবদ্ধ থাকে? যদি পুনরাবৃত্তিমূলক কাঠামোকে উদ্ধৃত না-ই করা হয় তবে তাদের সম্পর্কের অনুমোদন কোথা থেকে আসছে? এক্ষেত্রে বোঝাই যাচ্ছে, আবেগের ধারণাই এই পারফর্মেটিভ উচ্চারণকে গুরুত্ব ও কর্তৃত্ব ধার দেয় ।

যদি মনস্তাত্ত্বিক দৃষ্টিকোণ থেকে বিবেচনা করা হয়, এটা স্বীকার করা যেতে পারে যে আবেগের একটি স্বাভাবিক প্রকাশ আছে। তবে, আমরা যদিও-বা এটা স্বীকার করতে পারি যে শরীর কথা বলে, কিন্তু আমরা কি এটা স্বীকার করতে পারি যে শরীর সবসময় ‘সত্য’ কথা বলে? এখানে এটা বলে নেওয়া প্রয়োজন যে, আবেগের স্বাভাবিক প্রকাশ আছে এটুকুই যথেষ্ট নয়, বরং আবেগের প্রকাশেরও একটি গঠন-কাঠামো আছে; আবেগও যে একটি অন্তর্নিহিত গূঢ়লেখ দ্বারা পরিচালিত হয় সেটা চিহ্নিত করা প্রয়োজন।২২ সেইজন্যই জয়ন্ত এবং মল্লিকার বিবাহ আবেগের রাজনীতির এক সংযোজিত অংশ হয়ে ওঠে যা পারফর্মেটিভ ক্রিয়াকে সফল করার জন্য তার নিজের পুনরাবৃত্তিমূলক কাঠামোকে ধার দেয়। ফলে শুধুমাত্র উত্তমকুমার বাংলা ছবির প্রতীকী রোম্যান্টিক নায়ক হিসাবেই দর্শকদের সন্তুষ্ট করেন না, উত্তম-সুচিত্রাও পরদায় প্রতীকী যুগল হিসাবে দর্শকের আবেগপূর্ণ প্রত্যাশা চরিতার্থ করেন। আর, পঞ্চাশ ও ষাটের দশকের বাংলা চলচ্চিত্র আজও মূলত আবেগজাত সাংস্কৃতিক অভিজ্ঞতা হিসাবেই সামনে আসে।

বাঙালি পুরুষের পারফর্মেটিভিটি এইভাবে আবেগের ধারণাকে পরিবেষ্টন করে থাকে; কিন্তু, এখানে, একটা প্রশ্ন উঠতে পারে, তাহলে কি দু’টি স্বতন্ত্র আবেগের অস্তিত্ব আছে? যা পৃথকভাবে পুরুষ ও নারীকে চিহ্নিত করতে পারে? যদিও, সুস্পষ্টভাবে পুরুষ ও নারীতে আবেগকে ভাগ করা যাবে না। কিন্তু প্রকৃতপক্ষে আবেগের আদর্শস্থাপনকারী, পুনরাবৃত্তিমূলক গূঢ়লেখ বর্তমান, যা নারী ও পুরুষের লিঙ্গবৈষম্যকে স্বাভাবিকীকরণে সহায়তা করে। সুতরাং, আমি বলতে চাই যে, বাঙালি ভদ্রলোক পরিচয়টি পারফর্মেটিভ ক্রিয়ার দ্বারা সংঘটিত যা আবেগ দ্বারা কার্যকরীভাবে প্রভাবিত। যেহেতু, আবেগকে সুস্পষ্টভাবে নারী বা পুরুষে বিভাজিত করা যায় না সেইজন্যই যৌক্তিকভাবে বাঙালি পুরুষের এক উভলিঙ্গ দিক থাকতে পারে। আবার বাঙালি মেলোড্রামার দর্শকের ক্ষেত্রেও নারী ও পুরুষে দৃষ্টির ক্ষেত্র অনেকসময়ই যুগপৎ ঘটার জন্য মেলোড্রামাটিক কাঠামোটিকেই উভলিঙ্গ বলে মনে করা যেতে পারে। পারফর্মেটিভিটির দু’টি ভিন্ন দিক হওয়ার পরিবর্তে, তারা উদ্ধৃতিমূলক হয়ে উঠে একত্রিত হয়, যেখানে সমাজের নির্দিষ্ট বাধ্যবাধ্যকতাগুলো আরও প্রতিশ্রুতিবদ্ধ নিয়ন্ত্রণের কবলে পড়ে।

তিন

চলচ্চিত্রের একটি জঁর হিসাবে বাঙালি মেলোড্রামা স্টিফেন নিলের দেওয়া জঁরের সংজ্ঞার সঙ্গে কার্যকরভাবে মিলে যায়। যেভাবেই সংজ্ঞায়িত করা হোক না কেন, জঁরিক সুনির্দিষ্টতা একচেটিয়া কিছু উপাদান বিষয়ক প্রশ্ন নয়, বরং সেই উপাদানগুলির বিশেষ রকম সংযুক্তি ও প্রয়োগ বিষয়ক প্রশ্ন; জঁরের কোনও একটি বিশেষ উপাদান যার সঙ্গে অন্যান্য জঁরের সম্পর্ক আছে তার উপর গুরুত্ব দেওয়ার প্রশ্ন। বিসমকামী আকাঙ্ক্ষা কখনওই মিউজিক্যাল অথবা মেলোড্রামা জঁরের ক্ষেত্রে একচেটিয়া নয়। কিন্তু এইসমস্ত জঁরের ক্ষেত্রে যে-ভূমিকা বিসমকামী আকাঙ্ক্ষা পালন করে থাকে তা কিন্তু সুনির্দিষ্টভাবে স্বতন্ত্র।২৩

১৯৫০ ও ১৯৬০-এর দশকে বিশিষ্ট বাঙালি জনপ্রিয় চলচ্চিত্র পরিচালকরা মূলত বাঙালি পরিবারকে কেন্দ্রে রেখে মেলোড্রামা পরিচালনা করেছিলেন। অজয় কর, হীরেন নাগ, অগ্রদূত, অগ্রগামী, অসিত সেন প্রমুখ পরিচালকেরা বাঙালি পারিবারিক মেলোড্রামাকে একটি বিশেষ ধরনের মিস-অ-সিন্ হিসাবে প্রতিষ্ঠা করেছিলেন, যা অবশ্যই ১৯৫০-এর দশকের হলিউড মেলোড্রামার দ্বারা প্রভাবিত ছিল। প্রথমত, এর পশ্চাতে ছিল সাহিত্য সংক্রান্ত বিষয়বস্তুর সফল ঐতিহ্য; দ্বিতীয়ত, নরম ফোকাস, সাদা-কালো সিনেমাটোগ্রাফি, আলোকসজ্জা, ক্যামেরা-অ্যাঙ্গেল ও ক্যামেরার গতিবিধির একটি স্বতন্ত্র করণপ্রণালী; তৃতীয়ত, গানের দৃশ্য, যা প্রায়শই ব্যাপকভাবে জনপ্রিয় হয়ে উঠে ছবিটিকে জঁরিক নির্দিষ্টতা প্রদান করত, গানের দৃশ্যগুলি হয়ে উঠত মেলোড্রামা এবং দর্শকদের সঙ্গে একটি নির্দিষ্ট রকমের সঞ্চারের ব্যবস্থা। চতুর্থত, আমি আগেই উল্লেখ করেছি, উত্তমকুমার বাংলা ছায়াছবির প্রধান তারকা হিসেবে এবং বাঙালি পুরুষের প্রতীকরূপে এবং উত্তম-সুচিত্রা এক ‘আদর্শ যুগল’ হিসাবে বাঙালি মেলোড্রামায় ভীষণভাবে প্রভাব ফেলেছিলেন প্রায় তিন দশক ধরে। পঞ্চাশ-ষাটের দশকে জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামাতে লিঙ্গের উপস্থাপনা, অথবা আরও নির্দিষ্টভাবে পুরুষত্বের উপস্থাপনা কেন্দ্রীভূত ছিল পরিবারের ধারণার উপর। মেলোড্রামাটিক মোডের উত্থান তিনটি স্বতন্ত্র দিক নির্দেশ করে— প্রথমত, প্রচলিত ইতিহাসের যথাযথ সংমিশ্রণ (বাস্তববাদ, ট্র্যাজেডির বিকাশ ইত্যাদি); দ্বিতীয়ত, বুর্জোয়া শ্রেণির উত্থান; এবং তৃতীয়ত, পরিবারকে কেন্দ্র করে এক ধরনের মনস্তাত্ত্বিক ধারণার রূপদান। চরিত্রগুলি শাসক বা শাসিত নয়, বরং একটি মধ্যবর্তী জায়গা দখল করে। ক্ষমতার কেন্দ্র হল পরিবার এবং ব্যক্তিগত সম্পত্তি, যে–দু’টি সাধারণভাবে উত্তরাধিকারের মাধ্যমে সংযুক্ত।২৪ এখানে, আমি জোর দিয়ে বলতে চাই যে, ১৯৫০-এর দশকের পারিবারিক মেলোড্রামাগুলি প্রায়শই বর্ণনা করা হয়েছে এমন এক আখ্যান হিসাবে যা আদর্শের দ্বন্দ্বকে সামনে নিয়ে আসে।২৫ পারিবারিক মেলোড্রামাতে প্রধান বিষয়টি অবশ্যই লিঙ্গ ও পারিবারিক সম্পর্ক নির্মাণের উদ্বেগ। কিন্তু যেহেতু বেশ কয়েক জন গবেষক এ বিষয়ে একমত যে জনপ্রিয় আখ্যানের কাজ হল প্রভাবশালী মতাদর্শকে শক্তিশালী করা, সেইজন্যই কোনও প্রতিরোধ গড়ে তোলা কিংবা কোনও দৃষ্টান্তমূলক পরিবর্তন নিয়ে আসা যথেষ্ট কঠিন। কিন্তু তা সত্ত্বেও, আমি বিশ্বাস করি, এই অসংগতি বেশ কয়েকটি অনুমানের দিকে আঙুল তোলে, যেগুলি বাঙালি পুরুষত্ব ও মেলোড্রামাটিক মোডের মধ্যের জটিল সম্পর্ককে তুলে ধরতে সক্ষম হবে।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ যে, লরা মলভে যেসব পারিবারিক মেলোড্রামা পুরুষের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে তার থেকে যে-মেলোড্রামাগুলি মহিলাদের দৃষ্টিকোণ থেকে দেখানো হয়েছে তাদের মধ্যে পার্থক্য করেছেন।২৬ তিনি বলেছেন, যদিও পুরুষ-সংস্করণে সামঞ্জস্যবিধান করা যায় না এরকম সামাজিক এবং যৌন সংকটাবস্থার সমাধান করা যায় কিন্তু মহিলা-সংস্করণটি এক ধরনের কাল্পনিক পরিত্রাণ দেয়, যার ফলে এক ধরনের ‘আধিক্য’ জন্ম নেয় যা সন্তুষ্টিকে আটকে দেয়। এখানে মলভে-বর্ণিত পুরুষতান্ত্রিক আখ্যান (পুরুষভিত্তিক মেলোড্রামা) ও নারীকেন্দ্রিক আখ্যান (নারীভিত্তিক মেলোড্রামা)-এর মধ্যে পার্থক্যের দিকে দৃষ্টি আকর্ষণ করতে চাই। পুরুষতান্ত্রিক আখ্যান এক দিকে অর্থকে একীকরণ করার লক্ষ্যে অগ্রসর হয়, অপর দিকে নারীকেন্দ্রিক আখ্যান অর্থকে ছড়িয়ে দেয় ও বন্ধকরণের প্রতিরোধ করে। কিন্তু, আমি মলভের ব্যাখ্যা থেকে সরে এসে তর্ক তুলতে ইচ্ছুক যে, বাঙালি পারিবারিক মেলোড্রামা, পুরুষ বা মহিলা মূলচরিত্র নির্বিশেষে স্ত্রীলিঙ্গাত্মক ও পুংলিঙ্গবাচক সাবজেক্টিভিটির মধ্যে একটা বোঝাপড়ায় আসে, যেটা আবেগের মাধ্যমে উদ্ভাসিত হয়। এই বৈপরীত্য, বা সম্ভবত আরও স্পষ্টভাবে বিভিন্ন ‘কণ্ঠস্বর’-এর সহাবস্থান, পারিবারিক মেলোড্রামায় বর্ণিত। জেফ্রি নওল-স্মিথ তাঁর প্রবন্ধ, ‘মিনেলি এবং মেলোড্রামা’-র শেষ অনুচ্ছেদে যেমন মন্তব্য করেছেন,

মেলোড্রামাকে এইভাবে একটি বিপরীতমুখী সম্বন্ধ হিসাবে দেখা যেতে পারে, যার মধ্যে নির্দিষ্ট কিছু নির্ধারক (সামাজিক, শারীরিক, শৈল্পিক) [আমি পুংলিঙ্গ এবং স্ত্রীলিঙ্গকেও অন্তর্ভুক্ত করব] একত্রিত করা হয়। তবে এতে এই নির্ধারকগুলির সংযোগস্থাপনের সমস্যাটি সফলভাবে সমাধান করা যায় না। মেলোড্রামার গুরুত্ব… এর আদর্শের ব্যর্থতার মধ্যে নিখুঁতভাবে নিহিত। যেহেতু এটি প্রকৃত বর্তমান বা আদর্শ ভবিষ্যতের পরিসরে নিজের সমস্যার সমাধান করতে পারে না, সেজন্যই তাদের লজ্জাহীন পরস্পরবিরোধিতা উন্মুক্ত হয়ে পড়ে।২৭

স্বাধীনতার পরবর্তী বছরগুলিতে বাংলা জনপ্রিয় চলচ্চিত্রগুলি এই ধরনের ‘নির্লজ্জ বিরোধিতা’ দ্বারা চিহ্নিত একটি সময়ের উপস্থাপনা করেছিল— যখন আত্মপরিচিতির লিঙ্গনির্মাণ পরিবারের পরিবর্তনশীল ধারণার সঙ্গে ও আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতির দ্বারা প্রভাবিত হচ্ছিল। নারীকেন্দ্রিক ছায়াছবি স্বাভাবিকভাবেই নারীচরিত্রের উপর নির্ভর করেই এগিয়ে চলে, তবে পুরুষকে কেবল আখ্যানের চূড়ান্ত সমাপ্তির জন্যই প্রয়োজন হয় না, বরং নারীত্বের নির্মাণের জন্যও প্রয়োজন হয়। এক্ষেত্রে, মহিলাচরিত্রের পরস্পরবিরোধিতা প্রকাশ পায় এক দিকে তাঁর ব্যক্তিস্বাধীনতার প্রকাশের মাধ্যমে, যার ফলে তিনি সামাজিক নিয়মের বিরোধিতা করার ইচ্ছা প্রকাশ করেন (এর মধ্যে নিহিত থাকতে পারে একাধিক বিষয়— আধুনিকতা, শিক্ষিতা কর্মজীবী মহিলা বনাম পারিবারিক ও দাম্পত্য সম্পর্কিত দায়িত্ব), এবং অপর দিকে, তাঁর নির্ভরশীলতা প্রকাশের দ্বারা, যার ফলে তিনি পুরুষের সাহচর্যের আকাঙ্ক্ষা প্রকাশ করেন। পুরুষের ক্ষেত্রে এই পরস্পরবিরোধিতা প্রকাশ পায় তার সক্রিয়ভাবে অথবা নিষ্ক্রিয়ভাবে জড়িয়ে থাকার মধ্যে দিয়ে। এই সক্রিয়তা/নিষ্ক্রিয়তার বৈপরীত্য অনিবার্যভাবে অন্য একটি বৈপরীত্য দিয়ে অতিক্রম করে যাওয়া যায়, যেটা হল, পুরুষত্ব ও নারীত্বের মধ্যের বৈপরীত্য।

মেলোড্রামাতে, এমনকী যেখানে কেন্দ্রীয় চরিত্রটি একজন পুরুষ সেখানেও, অনেকসময়ই তার ‘পুরুষত্ব’-এর প্রতিবন্ধকতা দেখা দেয়, বিশেষত পুরুষত্বের প্রভাবশালী মান-নির্ধারক আদর্শের নিরিখে।২৮ সপ্তপদী বা পথে হল দেরী-র মতো জনপ্রিয় বাংলা মেলোড্রামার পুরুষচরিত্রগুলিও পরিষ্কারভাবে আবেগপ্রবণতা প্রদর্শন করে। পুরুষের এই আবেগপ্রবণতার প্রকাশই, মহিলা চরিত্রটির কাছে সবচেয়ে প্রয়োজনীয় এবং তার সাহায্যেই বেশিরভাগ সময়ে, পরদার যুগল পারিবারিক ও সামাজিক চাপ কাটিয়ে ওঠে। এদিক থেকে দেখতে গেলে, বাঙালি পুরুষ আবেগের স্বাভাবিক সূত্রগুলির নিরিখে পুরুষ হয়েও নারীত্বের বৈশিষ্ট্যগুলি প্রদর্শন করে। এই পরস্পরবিরোধিতা দৃঢ়ভাবে প্রমাণ করে যে, নারী অথবা পুরুষের ইঙ্গিত বহনকারী উভয় ধরনের আবেগই বাঙালি পুরুষের নির্মাণের সঙ্গে জড়িয়ে আছে ও পঞ্চাশ-ষাটের দশকের জনপ্রিয় বাংলা চলচ্চিত্রের মেলোড্রামার মধ্যে দিয়ে উপস্থাপিতও হয়েছে। চলচ্চিত্রের আখ্যানের সঙ্গে সাযুজ্য রেখে পুরুষ ও নারী উভয়ের ইঙ্গিতবাহী আবেগকে ‘উদ্ধৃতি’ করে বাঙালি ভদ্রলোক পুরুষ এক ধরনের উভলিঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির সম্ভাবনা খুলে দেয়; এবং বাঙালি পারিবারিক মেলোড্রামার আখ্যানের সঙ্গে দর্শকের একাত্মতা নির্ভর করে ওই ধরনের উভলিঙ্গ দৃষ্টিভঙ্গির সঙ্গে ঐকাত্ম্য বোধ করার মধ্য দিয়ে। আর সেইজন্যই মেলোড্রামাটিক মোডটির নিজস্ব অবলোকন উভলিঙ্গ হিসাবে উপস্থিত বলে মনে হয়।

যদিও জুডিথ বাটলার, সম্ভবত ‘উভলিঙ্গ’-এর মতো একটি প্রতিষ্ঠিত বিভাগকে পুরুষত্বের এই অনির্দিষ্ট স্থিতি বুঝবার জন্য ব্যবহার করতে দ্বিমত পোষণ করবেন। পরিবর্তে, তিনি লিঙ্গনির্মাণের প্রক্রিয়াটাকে এমনভাবে বুঝতে চান যেটা কোনও অর্থেই নির্ধারিত নয়, তাঁর মতে— ‘এমন এক সত্তা হয়ে ওঠা সম্ভব যাকে সম্পূর্ণরূপে পুরুষ বা মহিলা হিসাবে বর্ণনা করা যায় না’।২৯ কিন্তু বাটলার আমাদের তৎক্ষণাৎ সাবধান করে দেন যে সেই সত্তাটি উভলিঙ্গ কিংবা এক কল্পিত ‘তৃতীয় লিঙ্গ’ না-ও হতে পারে, আর সেটা বৈপরীত্যকে ছাপিয়ে না-ও যেতে পারে। বরং একে একটি ‘অভ্যন্তরীণ সাবভার্সন’ হিসাবে ভাবা যেতে পারে যেখানে বাইনারিটি এতটাই পূর্বানুমান করা হয়েছে এবং প্রসারিত হয়েছে যে এর থেকে আর যথার্থভাবে কোনও অর্থ জ্ঞাপিত হচ্ছে না। বাটলার যেটার ইঙ্গিত দেওয়ার চেষ্টা করেছেন তা হল পরিচিতির বিভাগগুলির বাইরে একটি অভিজ্ঞতা, ‘পুরানো ধ্বংসাবশেষ থেকে নতুন বিভাগগুলি তৈরি করার এক আবেদনময় সংগ্রাম, সাংস্কৃতিক পরিসরের মধ্য থেকে দেহ হয়ে ওঠার এক নতুন উপায় এবং বর্ণনার সম্পূর্ণ নতুন ভাষা’।

যাই হোক, আমি ‘উভলিঙ্গ’ এই শব্দটি ব্যবহার করছি মেলোড্রামাটিক মোড এবং বাঙালি পুরুষের আবেগগত সংগঠনকে নির্দেশ করার জন্য। মেলোড্রামা সবসময়ই এক ধরনের ‘আধিক্য’ দ্বারা চিহ্নিত করা যায়, যাকে চরিত্র অথবা কাহিনিসূত্রের মাধ্যমে খাপ খাইয়ে নেওয়া যায় না, ফলে এই আধিক্য সংগীত এবং মিস-অ-সিন্–এর মাধ্যমেও উদ্ভাসিত হয়, যা কেবলমাত্র ঘটনার অনুভূতির মাত্রাটাকেই বাড়িয়ে দেয় না, কিছুটা প্রতিস্থাপিতও করে দেয়।৩০ যেটা লক্ষণীয় সেটা হল, এই প্রক্রিয়াটি আসলে যেভাবে আবেগ কাজ করে তার অনুরূপ। আবার যেভাবে ‘আধিক্য’ ও ‘অতিশয়োক্তি’ পরিচিতিনির্মাণের প্রচেষ্টার সঙ্গে যুক্ত থাকে তারও সমধর্মী। বাটলার যেমন ব্যাখ্যা করেছেন,

একটি সূক্ষ্ম এবং রাজনৈতিকভাবে প্রযুক্ত পারফর্মেটিভিটির পরিণতি হিসাবে, লিঙ্গ হল একটি ‘অভিনয়’, যা বিভাজন, স্ব-বিদ্রূপ, নিজ-সমালোচনা এবং স্বাভাবিকের সেই অতিশয়োক্তি যা অতিরঞ্জনের মধ্যে দিয়ে এর মৌলিক ফ্যান্টাসমেটিক অবস্থা প্রকাশ করে।৩১

এইভাবে মেলোড্রামাটিক মোডের দ্ব্যর্থব্যঞ্জকতা বাঙালি পুরুষের পারফর্মেটিভিটিকে শক্তিশালী করে তোলে।

চার

এখানে এই প্রশ্নটা উঠতেই পারে— তাহলে পুরুষোচিত ও পুরুষত্বের মধ্যের সম্পর্কটা কীরূপ? যদি স্থায়ী সত্তার ধারণাটা, বাটলারের মতানুসারে, এক ‘কল্পিত নির্মাণ’ হয়, যা বাধ্যতামূলক গুণাবলির বিন্যাসের ফলে সুসংগত লিঙ্গপরম্পরা সৃষ্টি করে, তাহলে, পুরুষোচিত ও পুরুষত্বের বিভাগগুলিকে প্রশ্ন করা প্রয়োজন, যা বোধগম্যতার পুনরুক্তিমূলক ও কার্যকারণসম্বন্ধীয় কাঠামোগুলির সঙ্গে সামঞ্জস্যবিধান করে। বাঙালি পুরুষ যে ‘স্থায়ী সত্তা’কে আত্মীকরণ করতে চায় তার কি কোনও বিশেষ বৈশিষ্ট্য আছে? পুরুষ ও মহিলাদের মধ্যে ‘হতে চাওয়া’র এক মৌলিক পার্থক্য রয়েছে। যেমন স্লাভয় জিজেক স্পষ্টভাবে বলেছেন যে, এক দিকে পুরুষ ধারণা দিতে চান যে তিনি সত্যই তা-ই যার ভান তিনি করছেন, অপর দিকে নারী ‘প্রতারণার মাধ্যমেই প্রতারণা করেন, তিনি মুখোশটিকে মুখোশ হিসাবেই তুলে ধরেন, অসত্য ভান হিসাবেই তুলে ধরেন, যাতে মুখোশের পেছনের গোপনীয়তার সন্ধান শুরু হয়ে যায়’।৩২

পুরুষত্ব ও নারীত্বের সমস্যাটি প্রায়শই লাকাঁর সুপরিচিত ধারণা যে যৌনপার্থক্য ফ্যালিক অর্থনীতিরই অংশ, তার সঙ্গে জড়িত, কেননা শিশ্ন ‘থাকা’ ও শিশ্ন ‘হয়ে ওঠার’ মধ্যে পার্থক্য রয়েছে। আমি এই ধারণাটিকে অনুসরণ করে পুরুষোচিত ও পুরুষত্বের মধ্যের সম্পর্কটা সম্বন্ধে কয়েকটি বিষয় উত্থাপন করতে চাই। এই বিরোধিতা ‘থাকা’ ও ‘হয়ে ওঠার’ মধ্যে নয়, বরং জিজেক যেভাবে দেখিয়েছেন, ‘থাকা’ ও ‘প্রতীয়মান হওয়া’-র মধ্যেই। একইভাবে, পুরুষোচিত হয়ে ওঠার মানে অভিনয়ের মাধ্যমে নির্মিত হওয়া, যেগুলি আভ্যন্তরীণভাবে বিচ্ছিন্ন, ফলে সত্তার প্রকাশও একইরকমভাবে এক নির্মিত আত্মপরিচিতি, একটি পারফর্মেটিভ ক্রিয়া। তাহলে, সেই ‘স্থায়ী সত্তার’ কী হল যা ব্যক্তি আত্মস্থ করতে চায় ‘পুরুষোচিত’ হওয়ার জন্য? নিয়মতান্ত্রিক আদর্শকে পুরোপুরি আত্মভূত করে ‘পুরুষ’ হয়ে ওঠা কি আদৌ সম্ভব? এই বিষয়ে বাটলার যে গুরুত্বপূর্ণ যুক্তি তুলে ধরেছেন তা হল— কোনও বিষয়ীর পক্ষেই লিঙ্গ-নীতিগুলি পুরোপুরিভাবে অভ্যন্তরীণ করে নেওয়া সম্ভব নয়। অর্থাৎ লিঙ্গনির্মাণের নিয়মগুলো মূলত ফ্যান্টাসমেটিক, পুরোপুরি মূর্ত করে তোলা অসম্ভব।৩৩ এখানেও আমরা দেখতে পাচ্ছি, পুরুষত্ব এইরকম ফ্যান্টাসমেটিক প্রতিশ্রুতি হিসাবেই উদ্ভূত হয়, যা সত্তার অলীকতাই কেবলমাত্র সামনে আনতে পারে। অতএব এই ফ্যান্টাসমেটিক প্রতিশ্রুতিকে পূর্ণ করা অসম্ভব, তবে যে-কেউ সেই চেষ্টা চালিয়ে যেতে পারে।

এটা মনে রাখা গুরুত্বপূর্ণ এখানে যে বাঙালি পুরুষ এই সকল সন্দর্ভ দ্বারা কেবলমাত্র ‘গঠিত’ কিন্তু এর মানে এই নয় যে সে সম্পূর্ণরূপে ‘নির্ধারিত’। কেননা ‘নির্ধারণ’ এজেন্সির সম্ভাবনাকে নিবারণ করে’।৩৪ এইভাবেই, পথে হল দেরী-র, জয়ন্তর মতো আরও অনেক বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোক পরিচয় নির্মাণের নিয়মতান্ত্রিক, মাননির্ধারক সন্দর্ভ দ্বারা সংসাধিত। তারা যে নিয়ম-রীতির মধ্যে দিয়ে নির্মিত হয়েছে, তার দ্বারা তারা নির্ধারিত নন, কেননা সিগনিফিকেশন কোনও স্থায়ী বুনিয়াদি ক্রিয়া নয়, বরং পুনরাবৃত্তিমূলক, নিয়মাত্মক কিন্তু বাধ্যতামূলক ক্রিয়া, যা বিভিন্নতা এবং/বা ব্যর্থতার দ্বারা উন্মুক্ত। সুতরাং, কেবলমাত্র পুনরাবৃত্তিমূলক উপস্থাপনার মধ্যেই রয়েছে আত্মপরিচয়ের সাবভার্সনের সম্ভাবনা। একজন আদর্শ নাগরিক, একজন আদর্শ বিসমকামী প্রেমিক, একজন ভাল ডাক্তার, একজন ভাল স্বামী বা পুত্র বা বন্ধু হয়ে ওঠার পশ্চাতে রয়েছে বিভিন্ন ধরনের চাহিদার প্রতিক্রিয়া হিসাবে প্রকাশিত একাধিক পুনরাবৃত্তিমূলক, নিয়মাত্মক ক্রিয়া। এই ক্রিয়াগুলিই ফ্যান্টাসমেটিক পুরুষত্বের উপর অনুশাসন জারি করে, যার বিভিন্নতা এবং ব্যর্থতার প্রতি প্রবণতা থাকবেই, কিন্তু ঐতিহাসিকভাবে গড়ে ওঠা পুনরাবৃত্তিমূলক রীতি হিসাবে বাঙালি পুরুষত্বও তার স্বাভাবিকীকরণের জোর খাটিয়ে যায়।

সুতরাং, সম্পূর্ণরূপে ‘পুরুষত্ব’ অর্জন করা অসম্ভব, বরং একজনের পক্ষে কেবলমাত্র ‘পুরুষোচিত’ বৈশিষ্ট্যগুলিই অর্জন করা সম্ভব, যা পুনরাবৃত্তির সম্ভাবনাকে জাগিয়ে রাখে। কিন্তু একইসঙ্গে পুরুষত্বের ফ্যান্টাসমেটিক আদর্শের নিরিখে একটা ব্যর্থতার ধারণাও জড়িয়ে থাকে। হেজিমনিক পুরুষত্বের ধারণাও, সেই অর্থে, পুরুষত্বের ফ্যান্টাসমেটিক আদর্শের ধারণার উপরই নির্ভরশীল।৩৫ তাই বাঙালি মধ্যবিত্ত ভদ্রলোকের কেবলমাত্র ‘পুরুষোচিত’ বৈশিষ্ট্যগুলিই থাকতে পারে, যা সংস্কৃতিগতভাবে নির্দিষ্ট শৈলীবদ্ধ ক্রিয়াকলাপ ও যা কেবলমাত্র সত্তার প্রতীয়মান হওয়ার ইঙ্গিত দেয় এবং সর্বদা ব্যর্থতার অনুভূতি বজায় রাখে। আর সম্ভবত এই ‘পুরুষোচিত’ হয়ে ওঠার চেষ্টা ও ‘পুরুষত্ব’র ফ্যান্টাসমেটিক প্রতিশ্রুতির মধ্যেকার ফারাকের মধ্যেই লুকিয়ে আছে এজেন্সির সম্ভাবনা।

টীকা সূত্রনির্দেশ

. Jacqueline Rose, Sexuality in the field of vision (London: Verso, 2005), p. 90.

. Laura Mulvey. 1989. British Feminist Film, Theory’s Female Spectators: Presence and Absence. Camera Obscura, 20 (21), p. 77.

. Sanjay Srivastava, Constructing Post-Colonial India: National Character and the Doon School (London; New York: Routledge, 1998).

. Brian Massumi, Parables for the virtual: Movement, affect, sensation (Durham: Duke University Press, 2002).

. অনির্বাণ দাশ দেখিয়েছেন, বাঙালি কবি, যাকে অনেকসময়েই ‘মেয়েলি’ হিসাবে কল্পনা করা হয়, তাঁর পুরুষত্ব তাঁর সৃষ্টিকর্মের মধ্যে দিয়েও প্রকাশিত হতে পারে ও তিনি ‘পৌরুষদীপ্ত মেয়েলি’ সত্তা হিসাবেও উদ্ভাসিত হতে পারেন। যদিও, অনির্বাণ দাশের মতে এই সৃষ্টিকার্যের ধারণাও প্রজননকেন্দ্রিক হেটেরোনরম্যাটিভিটির দ্বারাই প্রভাবিত।

. লাকাঁ কিন্তু মনোবিশ্লেষণী গবেষণার ক্ষেত্রে, আবেগ অথবা বৌদ্ধিক ক্ষেত্র কোনওটাকেই প্রাধান্য দিতে নারাজ। কারণ তাঁর মতে, এটি সিম্বলিক অর্ডারের উপর ভিত্তি করে প্রতিষ্ঠিত, যা আবেগ এবং বৌদ্ধিক ক্ষেত্রের মধ্যের বিরোধকে অতিক্রম করে। তাঁর মতে উদ্বেগই একমাত্র আৱেগ যা বিশ্বাসযোগ্য।

. খানে উল্লেখযোগ্য বিষয় হল তাঁর অভিনয়ক্ষমতা বিচারের একটি প্রচলিত উপায় ছিল আবেগ এবং বুদ্ধির ধারণাকে কেন্দ্র করে। বেশ কয়েকটি অনুমোদিত জীবনী দাবি করেছে যে উত্তমকুমার মূলত তাঁর মস্তিষ্ক থেকে নয় বরং তাঁর হৃদয় থেকে অভিনয় করতেন। ‘উত্তমকুমার ছিলেন হৃদবৃত্তির অভিনেতা’, মন্তব্য করেছেন উত্তমকুমারের জীবনী লেখক আশীষতরু মুখোপাধ্যায়। এই ধরনের মূল্যায়নের বৈধতা নির্বিশেষে এই মন্তব্যগুলির মধ্যে ‘আবেগ’-এর অন্তর্নিহিত ধারণাটিই লক্ষণীয়।

. Ashis Nandy, An Ambiguous Journey to the City: The Village and Other Odd Ruins of the Self in the Indian Imagination (New Delhi: Oxford University Press, 2001), p. 150.

. সঞ্জয় মুখোপাধ্যায়, হে চলমান চিত্রমালা (কলকাতা: কোডেক্স, ২০০৩), পৃ. ১১৭।

১০. একটি শীর্ষস্থানীয় বাংলা সংবাদপত্রের একটি নিবন্ধে, উত্তমকুমারের পুনরাবৃত্তি এবং ব্যর্থ অনুকরণকে বর্ণনা করা হয়েছে, এটি কেবল বিপরীত লিঙ্গকেই আকর্ষণ করার জন্য নয় বরং তার মনোহারিতাকে অঙ্গীভূত করার জন্যও ব্যবহার করা হয়ে থাকে। এই নিবন্ধটি একইরকম শত শত নিবন্ধ বা সংবাদপত্র ও ম্যাগাজিনে প্রকাশিত প্রবন্ধগুলোর একটি মাত্র নমুনা, যা বার বার বাঙালি পুরুষের উত্তমকুমার হয়ে ওঠার চেষ্টাকে বর্ণনা করে।

১১. Moinak Biswas. 2004. Her Mother’s Son: Kinship and History in Ritwik Ghatak. Rouge, 3: http://www.rouge.com.au/3/ghatak.html.

১২. চলচ্চিত্রটির এই নির্দিষ্ট সমাপ্তি সরাসরিভাবে একজন মহিলার পিতৃতান্ত্রিক বুর্জোয়া সামাজিক কাঠামোর মধ্যে খাপ খাইয়ে নেওয়ায় জন্য একজন পুরুষের প্রয়োজনীয়তার কথাই চিত্রিত করে। তাদের সুখী পরিণতি দৈবিক, যা নারীকেন্দ্রিক পারিবারিক মেলোড্রামার একটি বিশেষ বৈশিষ্ট্য।

১৩. এখানে, অবশ্যই উল্লেখ করা প্রয়োজন যে এই দৃশ্যটি তাঁর স্বাধীনতা-পরবর্তী পিতৃতান্ত্রিক অভিব্যক্তি হিসাবেও পড়তে পারি যা স্পষ্টতই শ্রেণিপার্থক্য সম্পর্কে অবগত। তা ছাড়া, ডাক্তার ও আইনজীবীদের জীবিকা আবেগের সঙ্গে একটি স্বাভাবিক সম্বন্ধ রেখে চলে, যা বিশেষ করে নেহরু রূপায়িত সমাজতন্ত্রে বিশেষ গুরুত্ব পেয়েছিল।

১৪. Slavoj Zizek. 1995. Woman is One of the Names-of-the-Father, or How Not to Misread Lacan’s Formulas of Sexuation. Lacan.com: http://www.lacan.com/zizwoman.htm.

১৫. যখন ব্যক্তির বাসনা তার ভাষার মাধ্যমে বর্ণিত হয় তখনই তাকে চিহ্নিত করা সম্ভব। যদিও, ভাষার মধ্য দিয়ে বাসনা কতটা প্রকাশ করা সম্ভব হবে তার একটা সীমা রয়েছে, কেননা বাসনা সবসময়ই ‘অপর’ কিছুর জন্য আকাঙ্ক্ষা, কারণ ইতিমধ্যে যা আছে তা কামনা করা অসম্ভব। সেজন্যই বাসনার বস্তু অবিচ্ছিন্নভাবে বিলম্বিত হয়ে যায়, এ কারণেই বাসনা একটি মেটানোমি।

১৬. মনঃসমীক্ষণ তত্ত্বে স্মৃতি হল ব্যক্তিসত্তার প্রতীকী ইতিহাস, একত্রে সংযুক্ত চিহ্নের একটি শৃঙ্খলা, একটি ‘অর্থবোধক জ্ঞাপন’।

১৭. সুজাতা (১৯৫৯, বিমল রায়) এবং অনুরাধা (১৯৬০, হৃষীকেশ মুখোপাধ্যায়) এরকমই কিছু চলচ্চিত্রের উদাহরণ যা সদ্যস্বাধীন রাষ্ট্রের ‘আদর্শ’ নাগরিক নির্মাণকে চিত্রিত করে।

১৮. Judith Butler, Bodies That Matter: On the Discursive Limits of “Sex” (New York: Routledge, 1993), p. 221.

১৯. Ibid., p. 232.

২০. J.L. Austin, How to Do Things with Words (Cambridge, Mass.: Harvard University Press, 1962), p. 22.

২১. এক্ষেত্রে অস্টিনের মৌলিক আপত্তি বিবেচনা করছি না, যেখানে অস্টিন মঞ্চের কোনও অভিনেতার দ্বারা (বা এই ক্ষেত্রে, চলচ্চিত্র), বা কোনও কবিতায় বা একাকী কথা বলার মধ্যে দিয়ে এই উক্তিগুলির উচ্চারণ সম্পর্কে আপত্তি জানিয়েছেন। যেখানে অস্টিন অভিনেতার সংলাপের সঙ্গে সাধারণ অর্থে বাচনক্রিয়ার পার্থক্য করেছেন, সেখানে দেরিদা উভয়কেই কাঠামোগতভাবে এক হিসাবে কল্পনা করেছেন।

২২. কোনও চিন্তা বা ধারণা দমন করা যেতে পারে, তবে আবেগকে কখনওই দমন করা যায় না। শুধুমাত্র আবেগের সঙ্গে জড়িত ধারণাটি দমন করা যেতে পারে। ফ্রয়েড একে বলেন ‘আইডিয়া’ আর লাকাঁ বলেন ‘সিগনিফায়ার’। ফ্রয়েড ব্যাখ্যা করেন যেহেতু ধারণাটি দমন করা হয় এবং আবেগ হয় না, তাই আবেগ নিজেকে অন্য ধারণার সঙ্গে সংযুক্ত করে, যেটা দমন করা হয়নি।

২৩. Jackie Byars, All That Hollywood Allows: Re-reading Gender in 1950s Melodrama (London: Routledge, 1991), p. 95.

২৪. Steve Neale. 1983. Masculinity as spectacle: reflections on men and mainstream cinema, Screen, 24 (6), 2–16.

২৫. Jackie Byars, All That Hollywood Allows: Re-reading Gender in 1950s Melodrama (London: Routledge, 1991), p. 96.

২৬. Laura Mulvey. 1975. Visual pleasure and narrative cinema. Screen, 16 (3), 6-18.

২৭. Geoffrey Nowell-Smith. 1977. Dossier on Melodrama: Minnelli and Melodrama. Screen, 18(2), 113-118.

২৮. Ibid., p. 118.

২৯. Judith Butler, Gender Trouble: Feminism and the Subversion of Identity (New York: Routledge, 1990), p. 162.

৩০. Geoffrey Nowell-Smith, 1977, Minnelli and Melodrama.

৩১. Judith Butler, 1990, Gender Trouble, p. 187.

৩২. Slavoj Zizek. 1995. Woman is One of the Names-of-the-Father, or How Not to Misread Lacan’s Formulas of Sexuation. Lacan.com : http://www.lacan.com/zizwoman.htm.

৩৩. Butler, 1990, Gender Trouble, p. 179.

৩৪. Ibid., p. 182.

৩৫. জিজেক এর ব্যাখ্যা দিয়েছেন যে রাজনৈতিক সিগনিফায়ার— বিশেষত যেগুলি ব্যক্তিসত্তার অবস্থিতিকে নির্দেশ করে— আসলে ফাঁপা প্রতীক যা বিভিন্ন ধরনের ফ্যান্টাসমেটিক উপাদান দিয়ে পূর্ণ করা হয়।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *