আবুহোসেন পর্ব

আবুহোসেন পর্ব

হায়দ্রাবাদে নেমে দেখি কেয়া তাজ্জব কী বাত! অন্ধ্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী শ্রী পি. ভি. নরসিংহরাও স্বয়ং ও প্রচুর হোমরাচোমরা হাজির। (সবাই অবশ্য প্রাক্তন! যথা, সোমালিয়ার প্রাক্তন অ্যামবাসাডর, হায়দ্রাবাদের প্রাক্তন মেয়র, ইত্যাদি)। এঁরা কি আমাকেই নিতে এসেছেন নাকি? নিশ্চয়ই না। নিশ্চয়ই এই সঙ্গে কোনো (প্রাক্তন) ভি. আই. পি.-ও আসছেন। নমস্কার। নমস্কার। ওমা, একি, এঁরা আমাকেই নিয়ে গিয়ে ভি. আই. পি. লাউঞ্জে বসাচ্ছেন যে!—চা?—কফি?—না না, কিছু চাই না। তবে কি সোজাই গেস্ট হাউসে? বেশ বেশ।—আমার বয়স ও ওজন দেখে এঁরা বেশ হতাশ হয়েছেন বোঝা গেল। এ আমার ললাটের লিখন—চেহারাটায় কিছুতেই ‘ব্যক্তিত্ব’ ফোটে না। দর্শকের এ হতাশা আমার অভ্যেস হয়ে গেছে বক্তৃতাটা একবার দিয়ে ফেলবার পরে অবশ্য এঁদের আর এরকম ভাবসাব থাকবে না, তাও জেনে গেছি।

.

গ্রীনল্যাণ্ডস্ গেস্টহাউসে গাড়ি ঢুকল। বিশাল সুরম্য প্রাসাদ। তার বিপুল আউট হাউসে একটি আরামকেদারায় মুণ্ডিতমস্তক এক গৈরিকধারী সন্ন্যাসী শুয়ে আছেন। কে উনি? শুনি উনিই সেই বৌদ্ধ ভিক্ষু চমনলাল—বিখ্যাত ‘হিন্দু আমেরিকা’ বইয়ের লেখক, যিনি নানাভাবে প্রমাণ দেখিয়েছেন যে দক্ষিণ আমেরিকার সুপ্রাচীন মায়া-আজটেক সভ্যতা, আসলে হিন্দু সভ্যতা। বইটি মার্কিন মুলুকে প্রচুর সাড়া জাগিয়েছে। মনটা উৎফুল্ল হল। বাঃ প্রবেশ পথেই পুণ্যসঞ্চয়, সাধুসন্দর্শন! গেস্ট হাউসের গাড়িবারান্দার সিঁড়ি থেকেই লাল গালিচা বিছানো। হেড্‌বাবুর্চি অ্যান্টনি ও চার-পাঁচ জন কর্মচারী এসে সবিনয়ে অভ্যর্থনা জানাল। ঢুকতে ঢুকতে হঠাৎ বাঁদিকে মস্ত ঘরের ভেতর খোলা দরজাপথে চেয়েই দেখি মুখখানি পাউডারে সাদারং করা, লিপস্টিকপরা টুকটুকে ঠোটের ওপরে কার্তিক মার্কা গোঁফ, ডোরাকাটা কয়েদীটাইপ জামা গায়ে বাবরিচুলো এক কিস্তৃত ভদ্রলোক ওঠ বস জাতীয় কিছু একটা ব্যায়াম করছেন। খুব অবাক হয়ে গেলেও, স্টেট গেস্ট তো, যথাসাধ্য গাম্ভীর্য বজায় রেখে প্রশ্ন করলুম না। আরেকটু এগিয়ে দেখি বারান্দায় সোফার ওপরে একটি রংচঙে রূপযৌবনবতী স্খলিতবসনা আলুলায়িত কুন্তলা কেমন যেন আলুথালু হয়ে শুয়ে আছেন, এবং ঢুলুঢুলু নয়নে আমাকেই নিরীক্ষণ করে দেখছেন। একজন আয়া তাঁর পায়ে হাত বুলিয়ে দিচ্ছে। নাঃ অতিথিশালার ব্যাপারস্যাপার ঠিক সুবিধার লাগছে না। কী জানি, এসব নিজামশাহী অঞ্চলের খানদানী কায়দাকানুন, আমি শহর কলকাতার উটকো মানুষ, কী বা জানি, কী বা বুঝি! আপাত দৃষ্টিতে করিডরে এই দৃশ্য খুবই বেমানান মনে হল, কিন্তু আমি বাবা স্পিকটি নট! কিছু জিজ্ঞেস করে বোকা হয়ে যাব আর কি? মুখে চোখে যথাসাধ্য ‘এ আর এমন কি, এরকম আমরা কত দেখেছি’—ভাবখানা আনবার চেষ্টা করে ডিগনিফায়েড পায়ে সিঁড়ি দিয়ে উঠতে থাকি। উঠতে উঠতে যেই আড়চোখে আরেকবার ঐদিকে চেয়ে ফেলেছি, অমনি অ্যান্টনি, বহুঘাটের জল খাওয়া অতি চালু পার্টি ঝট করে বলে ওঠে—’স্যরি ম্যাম্, আজ তামিল ছবির শুটিং হচ্ছে কিনা আমাদের বাগিচাতে সুইমিংপুলে প্রায়ই শুটিং হয়। এঁরা নায়ক-নায়িকা নাউ রিল্যাক্সিং এ বিট।’ ও হরি তাই বলো। এ কোথায় এসেছ, নবনীতা? ওপাশে আজটেক সভ্যতা নিয়ে বৌদ্ধভিক্ষু, এপাশে ওঠ-বস করে বিশ্রাম নিচ্ছেন তামিল নায়ক, মধ্যপথে তুমি শ্রীমতী! বাপ্ রে!

.

এ্যাঁ? এত বড়ো সুইটটা পুরো একা আমার? রাজকীয় কাণ্ড কারখানা! বিশাল ঘর, বাথরুম, অ্যান্টি চেম্বার, মস্ত মস্ত দু’খানা খাট (হায়রে! আমার কুচোকাচা মেয়ে দুটোকে আনলে কি মজাই হত) মস্ত গোল ড্রেসিং টেবিল, এখানে আয়না, ওখানে আয়না; সেখানে আয়না, বাথরুমই বা কী। ঠান্ডাপানি গরমপানি পাঙ্খা এয়ারকনডিশনার সব কুছ হ্যায়। আধুনিক পাঁচতারা হোটেলের যাবতীয় সুখসুবিধা, সব। কিন্তু আরাম আয়েসের সুযোগ অর্থাৎ, স্পেসটা তার চেয়ে ঢের বেশি। এই ঘরটাই তো কলকাতার যে কোনো ফাইভস্টারের লবি হতে পারত। অ্যান্টনি বলে—’টি? কফি?’

–’কফি, প্লিজ।’ বলেই বুঝলুম বেজায় খিদে পেয়েছে। এত লম্বা একটা ট্রিপে এলুম কলকাতা থেকে হায়দ্রাবাদ–প্লেনে কিছুই খেতে দেননি মহামান্য সরকার। অ্যান্টনি নির্ঘাত থরিডিং জানে। সে বললে—’ডিনার কখন চাই? ইংলিশ ডিনার? বেঙ্গলী ডিনার? সিলোনিজ? চাইনিজ? আপ ফরমাইয়ে হম সার্ভ করেঙ্গে। মেরে পাস সব কিসিমকে কুক হ্যায়।’ কী সর্বনাশ! রাঁধুনির প্রদর্শনী নাকি! গুণীলোকে কুকবুক কালেক্ট করে, অ্যান্টনি যে দেখি জ্যান্ত কুক-কালেক্টর। চীনে, সিংহলী, আবার বাঙালিও?

–’আর অ্যান্টনি, তুমি? তুমি নিজে কী? গোয়ানিজ?’ কালোমুখে ধবধবে হেসে উঠে অ্যান্টনি বলে—’নো ম্যাম্। মি ম্যাড্রাসি। ট্যামিল। ক্রিশ্চান।’ অ্যান্টনি এর আগে এক অ্যাম্বাসাডরের সঙ্গে ঘুরে এসেছে ওদিকে সাউথ আমেরিকা (নো স্পিকিং ইংলিশ দেয়ার ম্যাম্! নো হিন্দি! আদার ল্যাংগুয়েজ) এবং এদিকে আফ্রিকা পর্যন্ত (ওনলি ব্ল্যাক ম্যান দেয়ার, ম্যাম, অল ব্ল্যাক) ‘বাট নো কান্ট্রি মোর বিউটিফুল দ্যান ইন্ডিয়া ম্যাম্। ও ইয়েস।’—অ্যান্টনি কলকাতাতেও ছিল। বহুকাল আগে, কিশোর বয়সে। তখনও দ্বিতীয় যুদ্ধ বাধেনি। অর্থাৎ এই শ্রীমতীর জন্ম হয়নি। ‘লিভিং নিয়ার দি ময়দান ম্যাম্, বিউটিফুল সিটি। বিফোর ওয়ার। মাই আংকল ওয়ার্কিং অ্যাট গ্র্যান্ড হোটেল ম্যাম্। ক্যালকাটা, ওলি বিগ সিটি ইন ইন্ডিয়া দ্যাট টাইম। নাউ দিল্লি বম্বে বিগার মে বি। বাট আই লাভ ক্যালকাটা ম্যাম্।’

আমিও কলকাতাকে ভালোবাসি, অ্যান্টনি। তোমার সঙ্গে এখানে আমার মিল।

ইংলিশ ডিনারের অর্ডার নিয়ে অ্যান্টনি চলে যেতেই কফি এনে দিল রুম বয়। কফি খেতে খেতে খাটে চিৎপটাং হয়ে ঘরের শোভা পর্যবেক্ষণ করছি। বড়ো বড়ো আলো জ্বলছে দুদিকে দুটো। আরও যে কত ছোটোখাটো খুচরো আলোর ব্যবস্থা। মাঝে একটা ঝাড় লণ্ঠনও আছে। সোনালি নকল ব্রোকেডের সোফা কৌচ। মেহগনির কফিটেবল। বালিশের কাছে এটা কী? বেডসুইচ নিশ্চয়। টেপা যাক তাহলে। দেখি ঘরের আলোক বিন্যাসে কী কী বদল হয়। টিপলুম বেডসুইচ। আলো যেমন কে তেমনি রইল। সে কি? কেন জ্বলল না? আবার টিপলুম, সবলে। এবারেও আলো জ্বলল না।

কোথাও কোনো প্লাগ খোলা আছে কিনা দেখতে উঠব, এমন সময় হঠাৎ বলা নেই কওয়া নেই ঘরের মধ্যে হুশ করে উদয় হলেন এক সেলামরত মূর্তি।—ইয়েস ম্যাডাম। ফরমাইয়ে।’ তবে কি ওটা ম্যাজিকল্যাম্প, এই তার দৈত্য? তার মানে এটা বেডসুইচ নয়, নির্ঘাত কলিংবেল। হায় হায়! এখন কী করি? কী বলি? কী চাইব? দাঁড়িয়ে আছে যে! হঠাৎ মস্তিষ্কে একটা বুদ্ধি খেলে যায়। খুব গম্ভীর গলা করে বললুম—

-’একটা টাইপমেশিন আনো।’

-’জী মেমসাব? ক্যা চাইয়ে আপকো?’ রুমবয় হতচকিত। হয় চা, নয় তো কফি, না হলে আরেকটু জোরাল কিছু—এই ফরমাশেই সে অভ্যস্ত? আচমকা এ আবার কি আবদার।

—’টাইপমেশিন হ্যায় ইহাপর?’

-’হ্যায় জি। অফিসমে।’

–’চালু মেশিন?’

-’উওভি পাত্তা নেই সাব।’ ফরমাশের গুণে আমি ‘সাব’ হয়েছি।

—’চলে না?’

—’উওভি পাত্তা নেই সাব।’ কিছুই জানে না। বাঃ, কী শিশুসুলভ সারল্য। দরজায় টোকা পড়ল।

-’আসুন।’ ঘরে ঢুকল স্মার্ট, সুদর্শন, দক্ষিণী এক যুবক। সবিনয়ে নমস্কার করে জানাল—

-’আমি চন্দ্রশেখর। আপনার কম্প্যানিয়ন-গাইড। আপনার যখন যা প্রয়োজন আমাকে বলবেন।’ চন্দ্রশেখরের চাঁচাছোলা ভদ্রতায় আমার কেন জানি না ঝট করে মনে পড়ে যায় মেফিস্টোফিলিসকে। আমি কি ফাউস্ট?

—‘আচ্ছা চন্দ্রশেখর, একটা টাইপরাইটার হবে?’

-’টাইপরাইটার’ চন্দ্রশেখর শিহরিত হয়। ‘–কেন, টাইপ-রাইটার দিয়ে কী করবেন ম্যাডাম, আমি এক্ষুনি স্টেনো এনে দিচ্ছি। ক’টায় চাই বলুন?’

প্রোগ্রাম চেক করে দেখা গেল আগামীকাল রাত্রি নয় ঘটিকার পূর্বে আমার মোটেই সময় নেই। পরশু সকাল নটাতে আমার বক্তৃতা। কাল সকালেই সভা শুরু হয়ে যাচ্ছে। বেশ তো, চন্দ্রশেখর তক্ষুনি রাজি। এতে আর মুশকিল কি? কাল রাত্রি ন’টাতেই স্টেনোমশাই আসবেন। আমার দায় উদ্ধার হবে বৈকি। বিশিষ্ট আতিথ্য বলে কথা!

—‘নো প্রোবলেম ম্যাডাম।’ যন্ত্র সমেত স্টেনো ধরে আনবে চন্দ্রশেখর।—’আর কিছু?’–’হ্যাঁ, আরেকটা ব্যাপার। চন্দ্রশেখর, আমার এই হায়দ্রাবাদ—কলকাতা এয়ারটিকিটটা হায়দ্রাবাদ-বারাণসী করে দিতে হবে। যেমন করে হোক ১৮ই আমাকে সকালবেলাই বারাণসী পৌঁছুতে হবে। ঐ রাত্রেই এলাহাবাদে কুম্ভস্নান।’—এলাহাবাদ, ম্যাডাম? কুম্ভে যাচ্ছেন? কার সঙ্গে ম্যাডাম?-ধুৎ তোর! কম্প্যানিয়ন গাইডের নিকুচি করেছে। সবতাতেই কম্প্যানিয়ন চাই?—’সঙ্গে আবার কি? হায়দ্রাবাদ কার সঙ্গে এসেছি?’—’আহাহা ব্যাপারটা কি এক হল ম্যাডাম?’ সবিনয়ে সার্ভিসের লাইন থেকে চন্দ্রশেখর মুহূর্তেই গ্যালান্ট প্রোটেকশনের লাইনে ওই যে, আমার ব্যক্তিত্ব নেই। তারই বিষময় ফল। আবার দরজায় টোকা। ধীরপায়ে ঘরে প্রবেশ করলেন দুধেল পোশাকে সোনারুপোর তকমা আঁটা, মাথায় এরোপ্লেনের পাইলটের মতো হুডওলা টুপি, রাশভারি এক ব্যক্তি। তাড়াতাড়ি কফি-টপি, আঁচল-টাচল সামলে-সুমলে সসম্ভ্রমে উঠে দাঁড়াতেই তিনি এক বিনয়াবনত সেলাম ঠুকে ঘোষণা করলেন—’আমি রাজ্যেশ্বর। আপনার শোফার। গাড়ি তৈরি। কোথাও বেরুবেন কি এখন?’

বুক থেকে একটা পাথর নামল। ড্রাইভার। আমি ভেবেছি কে-না-কে। নেটিভ স্টেটের রাজা-রাজড়ারাও তো ঠিক এমনি ড্রাইভার-ড্রাইভার রাজবেশ পরেন, তকমা আঁটেন, এমন কি রয়্যালকনসর্ট প্রিন্স ফিলিপ পর্যন্ত। এরও যেমন সাজ, তেমনি নাম! রাজ্যেশ্বর। তা ভালো। ড্রাইভার। সারা-জীবন গাড়ি চালাতে চালাতে হাতে তো কড়া পড়ে গেল। এখানে তবু দুদিন আরাম করা যাবে। আ-হ। এই তাহলে স্টেট-গেস্ট হওয়ার মানে! সত্যি সত্যিই আবুহোসেন? এ বক্তৃতা যে সত্যিই প্রায় সেই জাদুপ্রদীপ হয়ে দাঁড়াচ্ছে। এ মণিহার আমায় নাহি সাজে, তবু, এসেছে যখন, থাকুক। (মণিহার বলে কথা!) কিন্তু ড্রাইভার জুটেছে বলেই এই ক্লান্ত শরীরে কোথাও বেরুতে পারব না বাপু।—’রাজ্যেশ্বর, কাল সকাল পৌনে ন’টায় তুমি এস।—চন্দ্রশেখর, আপনি বরং রাজ্যেশ্বরকে নিয়ে এখনই এয়ারপোর্টে চলে যেতে পারেন, হায়দ্রাবাদ কলকাতা টিকিটটাকে হায়দ্রাবাদ-বারাণসী’—’কেন চিন্তা করছেন ম্যাডাম? এই তো এলেন। যাবার ব্যবস্থা পরে হবে। ওটা একটু মিনিস্টারের সঙ্গে কথা বলে নিতে হবে, এলাকাটি, এই ভিড়ে কুম্ভ!’ দূর ছাই। একি ঝামেলা! এ যে দেখি স্নেহময়ী জননীর প্রতিচ্ছবি!—’দেরি করলে আর রিজার্ভেশন পাব না যে?’—খুব পাবেন। দেখুন, হুট করে কিছু করবেন না ম্যাডাম।’ ম্যাডাম যে তেমনি-তেমনিই ম্যাডাম, হুট করে ছাড়া প্ল্যান করে কিছুই পারেন না, চন্দ্রশেখর তো তা জানে না। ভাবতে ভাবতেই দরজায় আবার টোকা। এবার প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী পি. ভি. নরসিংহরাওজি স্বয়ং। এখনও তাঁর সম্মান ও প্রতিপত্তি দেখলে আশ্চর্য হতেই হয়।—’কী ব্যাপার? ঘর ঠিক আছে? চা? কফি? আপনি তো ননভেজিটেরিয়ান? ঘর পছন্দ?’ সঙ্গে রয়েছেন সেক্রেটারি শ্রীদামোদর।

-’হ্যাঁ হ্যাঁ, ঘর ঠিক আছে। খুব আরাম। কেবল এই টিকিটটাকে যদি বদল করে…’ এই সময়ে শ্রীদামোদরন আমার হাতে আরেকটা টিকিট দিলেন।

–’এই যে, আপনার তিরুপতি দর্শন সব ঠিকঠাক।’ দেখি হাতে হায়দ্রাবাদ-তিরুপতি এয়ার টিকিটে, ১৭ তারিখের জন্য ও.কে. করা।—’এটা ইনস্টিট্যুট থেকে আপনাকে প্রীতি-উপহার দেওয়া হল। ১৭ই ওখানে থাকবেন, ১৮ই ভোরে ভেক্টটেশ্বরের স্নান ইত্যাদি দেখে ফিরবেন। ঐ রাত্রেই কলকাতা। ঠিক আছে?’

‘কলকাতায় তো যাব না?’—এবার ওঁদের অবাক হবার পালা। ‘তবে? কোথায় যাবেন?’ যথাসাধ্য দৃঢ় নিশ্চয় গলার সুরে বলি, ‘আমি তো এখন কুম্ভে যাব। ১৮ই বারাণসী পৌঁছাত চাই। মৌনী অমাবস্যা ১৮ই রাত্রি থেকে শুরু।’—’কুম্ভযাত্রী? ওখানে আপনাকে কার করছেন? কোথায় থাকবেন বলে ঠিক আছে?’

–’কিছুই ঠিক নেই এক স্নানের লগ্নটি ভিন্ন। কাউকেই মীট্ করছি না গঙ্গাযমুনাসরস্বতীকে ছাড়া।’—”আর ইউ ক্রেজী?’ শুক্লকেশ সত্তরছোঁয়া দামোদরনের ধৈর্য্যচ্যুতি হয়।—’ম্যাডাম ওসব ছাড়ুন, তিরুপতি দর্শনেই যথেষ্ট পুণ্য হবে আপনার। আর পুণ্যে কাজ নেই। আপনাকে আরামসে স্পেশাল দর্শন করিয়ে দেবেন টাউন কংগ্রেসের প্রেসিডেন্ট স্বয়ং, আপনাদের বন্ধু হন—ওসব কুম্ভটুম্ভ শিয়ার ম্যাডনেস, ওসব ছাড়ুন, ওখানে অবিশ্বাস্য ভিড়। ভাবতে পারেন, টেন মিলিয়ন? এক কোটি মানুষ? ‘

-’আমাদের তো গ্রেটার ক্যালকাটা ধরলে নিজের শহরেই রোজ দিনের বেলায় এক কোটি, আর দুর্গাপুজোর ক’দিন আরও বেশি’

-’সে অন্য পরিস্থিতি, এ অন্য। পূর্বাহ্নে ব্যবস্থা না করে রাখলে ওখানে যাবার প্রশ্নই ওঠে না।’ আমি তাতে একটুও দমি না—’মশাই, বলি এক কোটি লোকের প্রত্যেকের কি ওখানে চেনাশুনো আছে?’

—’ওদের কথা ছেড়ে দিন। ওরা দল বেঁধে যায়। আপনি একা স্ত্রীলোক…তার চেয়ে বরং দুটো কাজের কথা বলি শুনুন, মুক্তোটুক্তো কিছু কিনবেন? এখানে সস্তায় ভালো জহরত পাওয়া যায়।’ চন্দ্রশেখর জুড়ে দেয়—’পোছমপল্লী শাড়িও।’ বারে বা! মেফিস্টোফিলিস, বাঃ আমি কোথায় মুক্তি কিনতে বেরুতে চাই, তোমরা আমাকে মুক্তো দিয়ে ভোলাচ্ছো। এই তো সেই মোহিনীর মায়ার ফাঁদ? আমি তোমাকে চিনেছি। তুমি আমাকে অমৃতের ভাগ দিতে চাও না। এই তো? ঠিক আছে, আমিও ছাড়ছি না। আমি ভুলছি না বাপু। হ্যাঁ।—’দেখুন, ওসব মুক্তোটুক্তো কেনার পয়সা আমার নেই। আমি এখন বারাণসী যাব। আমার একটাই কেবল আরজি, আমার টিকিটটা যদি দয়া করে একটু শিগগির বদলে—’ স্বল্পভাষী শ্রী পি. ভি. নরসিংহরাওজি এতক্ষণ একটাও মন্তব্য করেন নি। তাঁর সঙ্গে আমার আলাপ লণ্ডন বিশ্ববিদ্যালয়ে ১৯৭৪-এ। দুজনেই একটা ইন্টারন্যাশনাল সেমিনারে বক্তা হিসেবে গিয়েছিলুম। তিনি সেই প্রথম বিদেশে গেলেন। হঠাৎ বিদেশী বিশ্ববিদ্যালয়ের কচকচির মধ্যে কেমন যেন ডাঙায় তোলা মাছের মতো একা পড়ে গিয়েছিলেন। সম্ভবত তাঁর প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রিত্বের বিভা এবং মদ-মাংসবিহীন আহার—এই দুই সাত্ত্বিক গুণের কারণে। বেশ বোঝা যায় ওঁর বুকের ভেতরে সত্যিই এক সন্ন্যাসীর বাস। জানি না কীভাবে উনি রাজনীতি করেন! সেই বেখাপ্ বিভুঁইয়ে আমি যতটুকু পারি ওঁর কাছে কাছে ছিলুম। বড়ো মায়া হতো ওঁর নিঃসঙ্গতা দেখে। যতই মন্ত্রি-টন্ত্রি (অর্থাৎ যত পাপীই) হোন—আসলে ভদ্রলোক সাহিত্যিক এবং বহুভাষাবিদ পণ্ডিত। আধুনিক ভারতীয় সাহিত্যে সত্যিই তাঁর ব্যাপক জ্ঞান এবং আগ্রহ। সেই সেমিনারেই বিজয়লক্ষ্মীর কন্যা শ্রীমতী নয়নতারা সেহগলের সঙ্গেও আলাপ হয়েছিল। আমাকে এখানে মোটামুটি রাওই একমাত্র চেনেন। এবারে তিনি কথা বললেন—’আমার এক বন্ধু আছেন এলাহাবাদে, দেখি তাঁকে ফোন করতে পারি কিনা। দেখছ না, ও মেয়ে তো যাবেই! চন্দ্রশেখর, কাল বরং দুপুরের সেশনে ওকে তুমি কলেরা ভ্যাকসিনেশনটা দিইয়ে সার্টিফিকেটটা যোগাড় করে দিও। নইলে ঢুকতে দেবে না ওকে কুম্ভমেলায়। আর ওর হায়দ্রাবাদ-কলকাতার টিকিটটা এখনই বরং হায়দ্রাবাদ—বেনারস-ভায়া-দিল্লী করে আনো। এলাহাবাদ যাবার এই একটাই পথ কিনা এখান থেকে। অবশ্য একটু ঘুরপথ হয়’–আহ্লাদের এক ধাক্কায় হৃৎপিণ্ডটা লাফ দিয়ে যেন গলার ভেতর উঠে এসে কণ্ঠরোধ করে দিল আমার! হবে? হবে তাহলে? কুম্ভযাত্রা শুরু হয়ে গেছে আমার? ঈশ্বর! তোমার অসীম করুণা। নরসিংহরাওজি বললেন—’ওসব ব্যবস্থা হয়ে যাবে’খন, এখন আসুন কালকের প্রোগ্রামটা ফিক্স করে নিই। কাল সকালের সেশনের বক্তা স্বামী রঙ্গনাথানন্দজি। উনি বলছেন ইন্ডিয়ার স্পিরিচুয়াল ইন্টিগ্রেশন নিয়ে। পরশু সকালের সেশনে আপনি আছেন, বিষয় লিটারারি ইন্‌টগ্রেশন। কাল দুপুরে আছেন ডাঃ এ. এম. খুসরো, আলিগড় বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, বিষয় হচ্ছে ইকনমিক ইন্টিগ্রেশন, পরশু দুপুরে নায়েক আসছেন দিল্লী থেকে, তাঁর বিষয় লিংক ল্যাংগুয়েজ। এই যে আমার ওয়েলকম অ্যাড্রেসের কপি–’ দোরে আবার অসহিষ্ণু টোকা, তারপরেই একঘর খুশি নিয়ে পদভরে ধরণী কম্পিত করে প্রবেশ করলেন স্বয়ং খুসরো সাব, একদা আমাদের দিল্লী বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রতিবেশী বন্ধু, এখন আলিগড়বাসী। হৈ হৈ করে বলে উঠলেন—’আরে আরে নবনীতা, প্রোগ্রামে তোমার নাম দেখেই দৌড়ে এলাম। হাউ ওয়ান্ডারফুল টু সী য়ু আফটার সাচ আ লং টাইম। আমিও এখানেই উঠেছি, ওপাশের ঘরটায়—যদিও আমি হায়দ্রাবাদীই।’ প্রতিবেশীদের উচ্ছ্বসিত পুনর্মিলনে নরসিংহরাওজি মৃদুমৃদু হাসছেন, কিন্তু দামোদরন্ প্রোটোকলে অদম্য বিশ্বাসী। তিনি উঠে দাঁড়িয়ে আমাদের মধ্যে পরিচয় করিয়ে দিতে থাকলেন—’উনি ডঃ অমুক, ফ্রম আলিগড়, ইনি ডঃ তমুক ফ্রম ক্যালকাটা’–আমাদের তুমুল হল্লায় ওঁর ভদ্র বাক্যগুলি চাপা পড়ে গেল। তখন খুসরো সাব বলছেন-’তারপর বাচ্চারা কত বড়ো হল?’ গল্পগুজবের মোড় ঘুরে গেল, আবার কফি এল, কিন্তু আমার বুকের ভেতরে আর সব কথাবার্তা ছাপিয়ে একটাই খুশি কেবল ভাঙা রেকর্ডের মতো ঘুরছে—হবে, হবে। চন্দ্রশেখর চলে গেছে টিকিট’ বদল করতে। সতেরোই তিরুপতি আঠারোই প্রয়াগ! মহাকুম্ভ! পূর্ণকুম্ভ! অমৃতকুম্ভের যাত্রা আমার শুরু হয়ে গেছে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *