আবার মুশকিল হতে পারে
ঘটনাটা কেউ খেয়াল করেনি। আর করবেই বা কেমন করে? ভোর ছ’টার সময়ে ক’জনই বা মানুষজন ছিল রাস্তায়! ফলে প্রফেসর মজুমদার ছাড়া ব্যাপারটার সাক্ষী আর কেউ ছিল না। কিন্তু বেলা বাড়তেই হুলস্থুল। রাস্তায় গাড়িঘোড়া লোকজন যেমন বাড়তে লাগল, হইচইও বাড়তে লাগল সমান তালে। তারপর যানজট, পুলিশ, ক্রেন। সে এক এলাহি কাণ্ড।
শুরু থেকেই তা হলে শুরু করা যাক।
গত কয়েকমাস ধরেই প্রফেসর শান্তনু মজুমদার একটা গোপন গবেষণা চালিয়ে যাচ্ছিলেন। পাড়ার সকলেই জানে, ওঁর সব গবেষণাই বেশ গোপন। আর উনি নানাভাবে ভারতের সামরিক বিভাগকে সাহায্য করে থাকেন। সুতরাং এবারের গবেষণাটাও যে সেইরকম তাতে কোনও সন্দেহ ছিল না।
আচার্য প্রফুল্লচন্দ্র রোডের ওপরেই প্রফেসর মজুমদারের সুন্দর তিনতলা বাড়ি। সেই বাড়ির একতলাটাই ওঁর গবেষণাগার। মাত্র দুজন সহকারী নিয়ে গত দশ বছর ধরে তিনি দিব্যি কাজ চালিয়ে যাচ্ছেন। লোকে বলে, ওঁর খ্যাতি নাকি দুনিয়া জোড়া। তাই কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে রিটায়ার করার পরেও তিনি বসে থাকতে পারেননি হাত গুটিয়ে। রাত-দিন বিচিত্র সব গবেষণায় ব্যস্ত থেকেছেন। ওঁর যেসব গবেষণা খুব গোপন সেগুলোর জরুরি খুঁটিনাটি সহকারীদেরও বুঝতে দেন না তিনি। আর সেই গবেষণা নিজে চালিয়ে যান রাত জেগে। যদি ঘুম পায়, তার জন্য রয়েছে ঘুমতাড়ানি ট্যাবলেট আর কড়া কফি।
প্রফেসর মজুমদার সাংঘাতিক বিজ্ঞানী হলে কী হবে, ভীষণ হাসিখুশি আর মিশুকে। পাড়ায় সবাই তাঁকে পছন্দ করে। সুন্দর সুঠাম চেহারা, সাহেবদের মতো টকটকে গায়ের রং, মাথার চুলে সবসময় দামি তেল, আর পোশাক-আশাক অষ্টপ্রহর ফিটফাট। শুনলে বিশ্বাস হবে না, কিন্তু তিনি দু-দিন অন্তর-অন্তর বাজার করেন। বাজারে চেনা লোকজনের সঙ্গে দেখা হলে বেশ খোলামনেই আলাপ করেন। লোকের বিপদে-আপদে সাহায্যও করেন দরকার মতো।
সুতরাং প্রফেসর মজুমদারের বিপদে পাড়াপড়শিরা যে ঝাঁপিয়ে পড়বে সে আর আশ্চর্য কী!
সারারাত জেগে কাজ করতে-করতে ভোরের দিকে সামান্য তন্দ্রামতো এসেছিল প্রফেসর মজুমদারের। আর তখনই হঠাৎ হাত ফসকে সংকর ধাতুর বলটা গড়িয়ে পড়ে ল্যাবরেটরির মেঝেতে। না, বলটা সেখানেই থামেনি। স্যার আইজ্যাক নিউটনের সূত্র অনুযায়ী গতিজাড্যের ঠেলায় গড়িয়ে গড়িয়ে চলে যায় দরজার বাইরে। তারপর সেখান থেকে রাস্তায়, একেবারে ট্রাম লাইনের ওপরে।
বলটা শেষপর্যন্ত থেমেছে বটে, কিন্তু এমনই থামান থেমেছে যে, সেখান থেকে কেউ আর সেটাকে নড়াতে পারছে না।
একটা নতুন ধরনের সংকর ধাতু তৈরির চেষ্টায় গবেষণা করছিলেন শান্তনু মজুমদার। সেটা যখন প্রায় তৈরি হওয়ার মুখে, তখনই এই বিপত্তি।
এলোমেলো চুলে বিভ্রান্ত অবস্থায় রাস্তায় বেরিয়ে এলেন প্রফেসর। অবাক হয়ে লক্ষ করলেন, বলটা যতই রাস্তার দিকে গেছে, ততই যেন গভীর হয়েছে তার চলার দাগ। ল্যাবরেটরির বাইরে বেরোনোর পরই সিমেন্ট-বাঁধানো মেঝেতে ফাটল ধরার ব্যাপারটা শুরু হয়েছে। তারপর যতই বলটা রাস্তার দিকে এগিয়েছে ততই ফাটল বেড়েছে। তারপর ট্রাম লাইনের ওপরে পৌঁছে বলটার প্রায় অর্ধেকটাই ডুবে গেছে পিচের রাস্তায়।
এর অর্থ একটাই হতে পরে। বলটার ওজন এখন বেড়ে গেছে অস্বাভাবিকরকম। অথচ একটু আগেই যখন তিনি সদ্য তৈরি করা বলটা হাতে নিয়ে ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে দেখছিলেন তখন তো ওটা বেশ হালকাই ছিল! আসলে একটা হালকা সংকর ধাতুই তৈরি করার চেষ্টা করছিলেন প্রফেসর মজুমদার। কিন্তু হঠাৎ হাত থেকে পড়ে গিয়েই বলটা কেমন যেন গোলমেলে হয়ে গেল। হালকা বলটা গড়াতে-গড়াতে ওজনে বাড়তে-বাড়তে চলে গেল রাস্তায়।
এপাশ-ওপাশ তাকালেন প্রফেসর। বহুদূরে চাদর মুড়ি-দেওয়া দুজন মানুষকে দেখতে পেলেন। ফুটপাথের ধারে দাঁড়িয়ে দাঁত মাজছে। দৌড়ে গিয়ে ওদের ডেকে নিয়ে এলে কেমন হয়? উঁহু, আসবে বলে মনে হয় না। কিন্তু একটা ট্রাম আসছে মনে হচ্ছে! নাকের ওপরে দূরদৃষ্টির চশমাটা ঠিক করে বসালেন প্রফেসর। হ্যাঁ, ট্রামই আসছে। কী হবে এখন! প্রফেসর মজুমদার সত্যিসত্যিই দিশেহারা হয়ে পড়লেন। ওঁকে ট্রাম লাইনের ওপরে দাঁড়িয়ে থাকতে দেখে ট্রাম ড্রাইভার ঘণ্টি বাজাচ্ছে ঘনঘন। ট্রামটা ক্রমশ কাছে এসে পড়ছে। দু-হাত মাথার ওপরে তুলে চিৎকার করতে শুরু করলেন প্রফেসর, ‘থামো! থামো!’
অনেকটা কাছাকাছি এগিয়ে এসে ট্রাম দাঁড়িয়ে পড়ল। ‘ঘস’ করে ব্রেক কষার শব্দ হল। রাস্তা থেকে ধুলো উড়ল খানিকটা। তারপর ফার্স্টক্লাসের কন্ডাক্টর নেমে এল ট্রাম থেকে।
‘কী ব্যাপার! ওটা আপনার?’
প্রফেসর মজুমদার কেমন হকচকিয়ে গেলেন। বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার—
মানে, হাত থেকে পড়ে গিয়ে গড়িয়ে-গড়িয়ে…।’
ঠং-ঠং করে আওয়াজ করল ট্রাম ড্রাইভার। চিৎকার করে কী যেন বলল। কন্ডাক্টরও ব্যস্ত হয়ে বলল, ‘জলদি সরিয়ে নিন ফুটবলটা—
যদিও বোঝা যাচ্ছিল বৃথা চেষ্টা, তবুও ঝুঁকে পড়ে বলটাকে টানাটানি করলেন প্রফেসর। না, একচুলও নড়ানো গেল না। মসৃণ পাথরের গম্বুজ যেন একটা।
নড়ানো যে যাবে না সেটা বলটার রাস্তা কেটে বসে যাওয়ার ধরন দেখেই বোঝা গিয়েছিল। কিন্তু তবুও দু-হাতে ওটাকে খানিকক্ষণ টানাটানি করে যেন চরম পরীক্ষা করলেন প্রফেসর।
হ্যাঁ, মাপে বলটা এখন ফুটবলেরই মতো। কিন্তু ল্যাবরেটরিতে যখন ওটা নিয়ে প্রফেসর মজুমদার নাড়াচাড়া করছিলেন তখন আরও বেশ খানিকটা বড় ছিল। খুঁটিয়ে লক্ষ করলে এও নজরে পড়ে, মাপের সঙ্গে-সঙ্গে বলটার রংও পালটেছে। তার মানে, বলটার ঘনত্ব যেমন বেড়েছে, ওটা আরও ভারী হয়েছে, সেইসঙ্গে মাপ বদলেছে, রংটাও আর ঠিক আগের মতো নেই। এ কোন বহুরূপী সংকর ধাতু তৈরি হয়ে গেল ল্যাবরেটরিতে!
রাস্তার মাঝে দাঁড়িয়ে মাথা চুলকোতে লাগলেন প্রফেসর মজুমদার। তারপর হেরে-যাওয়া গলায় বললেন, ‘কী করব ভাই, একচুলও নড়ানো যাচ্ছে না।
ততক্ষণে ড্রাইভার ও জনাকয়েক যাত্রী নেমে পড়েছে ট্রাম থেকে। দ্বিতীয় কন্ডাক্টর এসে যোগ দিয়েছে প্রথম জনের সঙ্গে। কিন্তু বল অটল। নট নড়ন চড়ন নট কিচ্ছু!
এইভাবে শুরু হওয়ার পর বেলা যতই বাড়তে লাগল, গোলমালও ততই বেড়ে চলল। ট্রামের পর ট্রাম দাঁড়িয়ে যেতে লাগল লাইনের ওপরে। জনাচারেক ট্রাফিক পুলিশ এগিয়ে এসে যানজট সামাল দিতে লাগল। প্রফেসর মজুমদারের পাড়ার ছেলেরা আর স্থানীয় লোকজন বিচিত্র গোলকটাকে ঘিরে ব্যারিকেড করে দাঁড়াল। দর্শকের ভিড় উপচে পড়তে লাগল। নানাজনের নানা প্রশ্ন : ‘ওটা কী, দাদা? শিবলিঙ্গ?’, ‘মাটি ফুঁড়ে উঠল, না আকাশ থেকে পড়ল?’, ‘ভোররাতে উল্কাপাত হল নাকি?’, ‘দমকলে খবর দিন, ওদের গাড়ির ধাক্কায় ঠেলে তুলে দেবে।’, ‘পাতাল রেলকে বলুন ক্রেন নিয়ে আসতে’।
প্রফেসর শান্তনু মজুমদার ভিড়ের মাঝে দাঁড়িয়ে চুপচাপ সব শুনছিলেন। ভাবছিলেন, কী করা যায় এখন। কী করে বলটাকে আবার ফিরিয়ে আনা যায় ল্যাবরেটরির ভেতরে।
হঠাৎই পুলিশের এক হোমরাচোমরা অফিসার হাজির হলেন ঘটনাস্থলে। ভিড়ের লোকজন সরে গিয়ে তাঁকে পথ করে দিল। একটি ছেলেকে কী যেন জিগ্যেস করলেন অফিসার। উত্তরে ছেলেটি আঙুল তুলে ইশারা করল প্রফেসর মজুমদারের দিকে। অফিসারটি-এগিয়ে এলেন শান্তনু মজুমদারের কাছে। মাটিতে বসে-থাকা বলটার দিকে দেখিয়ে জানতে চাইলেন, ‘ওটা আপনার?’
একটু চুপ করে থেকে প্রফেসর জবাব দিলেন, ‘হ্যাঁ, আমার— ‘সাতসকালে এই পিকিউলিয়ার বলটা নিয়ে কী করছিলেন জানতে পারি?’
প্রশ্নের কঠিন সুরটা প্রফেসর মজুমদারের কানে বাজল। একে তো নিজের গবেষণা নিয়ে সমস্যা, তার ওপরে এইরকম খোঁচা-দেওয়া প্রশ্ন। চশমাটা নেড়েচেড়ে বসিয়ে বেশ গম্ভীর গলায় বললেন, ‘না, আপনি যা ভাবছেন তা নয়। সাতসকালে ওটা নিয়ে ফুটবল খেলছিলাম না। আমার নাম শান্তনু মজুমদার। বিজ্ঞান নিয়ে একটু-আধটু গবেষণা করে থাকি…।’
নামটা শোনামাত্রই পুলিশ অফিসারের চোয়ালের রেখা নরম হল। খবরের কাগজের দৌলতে শান্তনু মজুমদার নামটা তাঁর শোনা। সুতরাং এরপর প্রশ্নের ধাঁচ ও সুর দুই-ই পালটে গেল।
প্রফেসর মজুমদারের কাছ থেকে সবকিছু শোনার পর অফিসারটি তড়িঘড়ি ক্রেনের ব্যবস্থা করতে ছুটলেন।
শান্তনু মজুমদার ভাবছিলেন। ভাবতে-ভাবতে সকালের মিঠে রোদ চড়া হয়ে গেল মাথার ওপরে। কিন্তু সমস্যার কোনও সুরাহা হল না। চারপাশে লোকজনের কোলাহল, বাস-গাড়ি-লরির হর্ন। কাছেপিঠে কোথায় যেন মাইকের চিৎকার শুরু হয়ে গেছে। সবকিছু কেমন জট পাকিয়ে যাচ্ছিল।
প্রফেসর মজুমদার বলটাকে লক্ষ করছিলেন। ওটার রং এখন অনেকটা নীলচে-বেগুনি। আর মাপে কি খানিকটা ছোট হয়েছে আরও!
হঠাৎই ভিড় ঠেলে চলে এল দুজন ফটোগ্রাফার। নানা অ্যাঙ্গেল থেকে বলটার ফটো তুলতে লাগল। রোগা চেহারার একটি ফরসা ছেলে এগিয়ে এল প্রফেসরের কাছে। হাতে নোটবই, ডটপেন। চোখে হাই পাওয়ারের চশমা। সব মিলিয়ে দেখে মনে হল, ভিটামিনের অভাবে ভুগছে। নিশ্চয়ই সাংবাদিক।
অতএব ব্যাপারটা দু-চার কথায় ছেলেটিকে বুঝিয়ে বললেন প্রফেসর। তারপর যখন বাড়ি ফিরে আসবেন বলে ভাবছেন, তখনই দেখতে পেলেন একটা ক্রেন এগিয়ে আসছে অকুস্থলের দিকে।
ক্রেনটাকে দেখেই সকলে একেবারে হইহই করে উঠল। ভিড় সরে গেল পলকে। ক্রেনটা ধীরে-ধীরে এগিয়ে এল কাছে। তার পাশাপাশি পায়ে হেঁটে হাজির হল পাঁচ-ছ’জন লোক। তার মধ্যে সেই পুলিশ অফিসারটিও আছেন।
কিন্তু শেষপর্যন্ত যা হওয়ার তাই হল। ক্রেন দিয়ে টানাহ্যাঁচড়ার চূড়ান্ত করেও বলটাকে একচুল নড়ানো গেল না। ক্রেন যখন বলটাকে আঁকড়ে ধরে প্রচণ্ড টান মারছিল তখন ভিড় করে দাঁড়ানো মানুষজন চেঁচিয়ে উঠছিল, ‘মারো জোয়ান হেঁইও…।’ কিন্তু লাভের মধ্যে শেষপর্যন্ত শেকলটাই গেল ছিঁড়ে, সঙ্গে -সঙ্গে তুমুল হট্টগোল, শব্দ, চিৎকার। আর প্রফেসর মজুমদারের দীর্ঘ শরীরটা যেন ঝুঁকে পড়ল খানিকটা। নিজের অজান্তে এ কী ভয়ংকর বস্তু তৈরি করলেন তিনি!
পুলিশ ভিড় সামলানোর চেষ্টা করছিল। কিন্তু খুব একটা যে পারছিল তা নয়। ক্যামেরা হাতে বেশ কয়েকজন পটাপট ছবি তুলছিল। বোঝাই যাচ্ছিল, আগামীকালের কাগজে ‘বলবান বলের রহস্য’ কিংবা ‘গোলক নিয়ে গোলমাল’এ-জাতীয় কোনও হেডিং দিয়ে এই রোমাঞ্চকর বিবরণ ছাপা হবে।
কিন্তু এখন এই প্রাণান্তকর অবস্থা থেকে কে উদ্ধার করবে!
এমনসময় ভিড় ঠেলে প্রফেসর মজুমদারের দুজন সহকারী অতুল আর বিমান এসে হাজির হল। ততক্ষণে ক্রেনটাকে বিদায় করার ব্যবস্থা নেওয়া হয়েছে।
রোগা চেহারার অল্পবয়েসি ছেলে অতুল জিগ্যেস করল, ‘কী ব্যাপার, স্যার?
প্রফেসর মজুমদার হাত-পা নেড়ে ব্যাপারটা বললেন অতুলকে। বিমানও শুনল। কিন্তু দুজনের একই অবস্থা। প্রফেসরের এই গোপন গবেষণায় ওদের কোনও হাত ছিল না। ওরা চুপচাপ মাথা চুলকোতে লাগল।
বেলা বাড়তে-বাড়তে যখন দুপুর, খিদেয় অনেকেরই পেট চোঁ-চো করছে, ঠিক এমনসময় এক অদ্ভুত চ্যাঁচামেচি শোনা গেল।
ট্রাম লাইন থেকে বেশ খানিকটা দূরে পুবদিকের ফুটপাথ ঘেঁষে একটা বড় অশ্বত্থ গাছ আছে। তার নীচে সিমেন্ট-বাঁধানো চাতালে পাড়ার ছেলেছোকরারা আড্ডা মারে। গোলমালটা ভেসে এল সেদিক থেকেই।
অনেকেই গলা উঁচু করে তাকাল সেদিকে। কীসের গোলমাল? শান্তনু মজুমদারও একটু হকচকিয়ে গেলেন। অতুল আর বিমানকে জিগ্যেস করলেন, ‘ব্যাপারটা কী বলো তো হে—?’
ওরা ব্যাপারটা ঠাহর করার জন্য সেদিকে এগোতে যাবে, ঠিক তখনই জনাকয়েক লোক ‘ফুঁয়াবাবা! ফুঁয়াবাবা!’ বলে চেঁচিয়ে উঠল।
আর তার একমিনিটের মধ্যেই ভিড় ঠেলে চার-পাঁচজন লোক হাজির হল প্রফেসরের সামনে। তারা যাকে টেনে হিঁচড়ে সঙ্গে নিয়ে এল, সে এক গেরুয়াপরা সন্ন্যাসী।
শুধু গেরুয়া নয়, সন্ন্যাসীদের সাধারণত যেমনটি থাকে, তার গালে মুখে সেরকম কাঁচাপাকা দাড়ি-গোঁফের জঙ্গল। নাক-মুখ ফোলা ফোলা। মোটা ভুরু৷ বড়-বড় চোখ। বেশ নাদুসনুদুস চেহারা।
সন্ন্যাসী পাবলিকের হাতের বাঁধন ছাড়ানোর জন্য প্রাণপণ চেষ্টা করছে আর বলছে, ‘না, না, এ আমার দ্বারা হবে না। আমাকে তোমরা ছেড়ে দাও। নরকেও তোমাদের ঠাঁই হবে না, পাপিষ্ঠ!’
সঙ্গের লোকগুলো একেবারে নাছোড়বান্দা। তারা সবাই মিলে বলতে লাগল, ‘না, বাবা, আপনাকে এটুকু উপকার করতেই হবে। মানবজাতিকে লিয়ে। ম্যানকাইন্ডের জন্যে।’
সাধুবাবার আপত্তি ক্রমশ প্রবল হচ্ছিল। সে তার ভারী শরীর নিয়ে মাঝেমাঝেই লাফ মারার চেষ্টা করছিল। আর মুখে ‘না, না—মুঝে ছোড় দো’ বলে চিৎকার করে উঠছিল।
এই হই-হট্টগোল চেঁচামেচি শুনে পুলিশ অফিসারটি এগিয়ে এলেন। তাঁকে দেখে চেঁচামেচি থামল। সকলে এবার বলটার দিক থেকে নজর সরিয়ে সন্ন্যাসীকে দেখছে।
অফিসারের জেরার উত্তরে জানা গেল, আজ প্রায় দিন-দশেক হল এই সাধুবাবা এসে ওই অশ্বত্থ গাছের নীচে আস্তানা গেড়েছে। আর তারপর থেকে নামমাত্র দক্ষিণার বিনিময়ে স্রেফ ফুঁ দিয়ে গরিব-দুঃখীদের অসুখ-বিসুখ সারিয়ে দিচ্ছে।
দু-চারদিন পর থেকেই ওই গাছতলায় ভিড় বাড়তে থাকে। নানা জায়গা থেকে লোকজন এসে হাজির হতে থাকে নানা প্রার্থনা নিয়ে।
এরকম অলৌকিক ‘বাবা’দের ওপরে প্রফেসর মজুমদারের কোনওকালেই কোনও আগ্রহ ছিল না। তাই অশথতলার ব্যাপারটা তিনি বিশদভাবে জানতেন না। এখন সাধুটিকে সামনাসামনি দেখে তাঁর কিন্তু কৌতূহল হচ্ছিল।
পুলিশ অফিসার জিগ্যেস করলেন, ‘ওকে এভাবে ধরে এনেছেন কেন?’ একটি ছেলে সঙ্গে-সঙ্গে জবাব দিল, ‘বলটাকে সরানোর জন্যে——।’
সাধুবাবার হাত ছেড়ে দিয়েছিল ওরা। সে অফিসারটির দিকে হাতজোড় করে অনুনয় করে বলল, ‘আমাকে মাপ করুন, স্যার। এ-কাজ আমার দ্বারা হবে না।’
ভিড়ের মধ্যে থেকে কে একজন বলে উঠল, ‘না, না, ওঁর আশ্চর্য ক্ষমতা আছে। ফুঁ দিয়ে আমার ছেলের জন্ডিস সারিয়ে দিয়েছেন।’
সাধুবাবা তো হাত-পা নেড়ে অস্থির। কাতর গলায় সে পুলিশ অফিসারকে বলল, ‘স্যার, আমার আসল নাম পঞ্চানন দাস। আমার কোনওরকম অলৌকিক ক্ষমতা-টমতা নেই, স্যার। আগে আমি রাস্তায় রাস্তায় ঘুরে ম্যাজিক দেখাতাম। এখন শরীরে আর বয় না। তাই এই গেরুয়া পরে গাছতলায় বসে ঝাড়ফুঁকের কাজ করি। অলৌকিক ক্ষমতার নাম করে দু-একটা ম্যাজিক ট্যাজিক দেখিয়ে দিই। বিশ্বাস করুন, তার বেশি কিছু নয়, স্যার—।’
বেচারা পঞ্চানন অফিসারের হাত চেপে ধরল মুঠো করে, ‘আপনি আমায় বাঁচান, স্যার।’
প্রফেসর মজুমদার বলতে যাচ্ছিলেন, লোকটিকে ছেড়ে দেওয়ার জন্য। কিন্তু ততক্ষণে জনতা নতুন মজা পেয়ে গেছে। তারা তখন সবাই মিলে হইহই করে বলল, ‘সাধুবাবাকে একবার চেষ্টা করতেই হবে! আমরা কোনও কথা শুনব না!’
সুতরাং অবস্থার চাপে পড়ে পুলিশ অফিসারটিও কিছু বলতে পারলেন না। এত সময় নষ্ট হয়েছে এই বলের পিছনে, না হয় আরও পাঁচ মিনিট বাড়তি নষ্ট হবে। প্রফেসর মজুমদার কপালে ভাঁজ ফেলে ব্যাপার স্যাপার লক্ষ করতে লাগলেন। আর জনতার তুমুল চিৎকারের মধ্যে সাধুবাবা এগিয়ে যেতে লাগল বলটার দিকে। বেচারার মুখের চেহারা দেখলে মনে হবে যেন ফাঁসিকাঠের দিকে এগিয়ে চলেছে।
বলের কাছে পৌঁছে সাধুবাবা থমকে দাঁড়াল। আর তার পিছনে দাঁড়ানো লোকজন চিৎকারে ফেটে পড়ল, ‘ফুঁয়াবাবা কী জয়!’
কেউ বলল, ‘এইবারে বল নড়বে—
আর-একজন বলল, ‘জলদি ফুঁ দিন, বাবা, জলদি ফুঁ দিন—।’
ফুঁয়াবাবা, ওরফে পঞ্চানন দাস, উপায়ান্তর না দেখে ঝুঁকে পড়ল মাটিতে
গেঁথে-থাকা বলের ওপরে। তারপর দু-চোখ বুজে গাল ফুলিয়ে প্রাণপণে ফুঁ দিল বলটাকে।
সঙ্গে-সঙ্গে বলটা নড়ে উঠল। ভেসে উঠল শূন্যে। মাটি থেকে হাত-তিনেক উঁচুতে স্থির হয়ে ভেসে রইল।
মোহনবাগান-ইস্টবেঙ্গলের খেলায় গোল হলে যে-চিৎকার শোনা যায় তার অন্তত দশগুণ চিৎকার শোনা গেল। বলটা শূন্যে ভেসে ওঠায় উল্লাসে একেবারে ফেটে পড়ল জনতা।
ফুঁ দেওয়ার পরেও চোখ বুজেই ছিল পঞ্চানন। হয়তো ভাবছিল, ঠিক কখন ওর পিঠে পাবলিকের প্রথম আঘাতটা পড়বে। কিন্তু আনন্দের হইচই শুনে অবাক হয়ে চোখ খুলল সে। দেখল মাটির দিকে। শুধু গর্তটা দেখা যাচ্ছে, বলটা নেই। তার পরক্ষণেই বলটাকে শূন্যে ভেসে থাকতে দেখল পঞ্চানন। সে সোজা হয়ে দাঁড়াল, চোখ গোল-গোল করে তাকিয়ে রইল বলটার দিকে।
জনতা প্রবল চিৎকার করে উঠল, ‘জয় ফুঁয়াবাবার জয়!’
আর সঙ্গে-সঙ্গেই অজ্ঞান হয়ে গোড়া-কাটা কলাগাছের মতো খসে পড়ল সাধুবাবা। কাছাকাছি দাঁড়িয়ে থাকা তিন-চারজন লোক ধরে ফেলল তাকে। কেউ বলল, ‘জল নিয়ে এসো।’ কেউ বা বলল, ‘জোরে জোরে বাতাস করো— আর তক্ষুনি অচৈতন্য সাধুবাবার জন্য শুরু হয়ে গেল ছুটোছুটি।
প্রফেসর মজুমদার লক্ষ করলেন, বলটা মাপে যেন কিছুটা বড় হয়ে গেছে।
সেইসঙ্গে রংও আবার পালটে গেছে। এখন খানিকটা বাদামি রঙের দেখাচ্ছে। বলটা শূন্যে ভেসে থাকা অবস্থাতেই সামান্য এপাশ-ওপাশ নড়ছিল। অতুল আর বিমান তাজ্জব হয়ে দেখছিল বলটাকে। প্রফেসর মজুমদার আর দেরি করলেন না। চেঁচিয়ে ওদের বললেন, ‘বলটা শিগগিরই ল্যাবরেটরিতে নিয়ে যাও। এরপরে আবার মুশকিল হতে পারে—
অতুল আর বিমান চমকের ঘোর কাটিয়ে দৌড়ে গিয়ে আঁকড়ে ধরল বলটা। ফটোগ্রাফাররা ঘনঘন ছবি তুলছিল। দু-চারজন লোক অতুল আর বিমানকে কী যেন জিগ্যেস করছিল। কিন্তু ওরা কোনওদিকে কান না দিয়ে পাখির পালকের মতো হালকা বলটাকে নিয়ে ভিড় ঠেলে সোজা রওনা দিল প্রফেসর মজুমদারের ল্যাবরেটরির দিকে।
হাতঘড়ির দিকে তাকালেন শান্তনু মজুমদার। বেলা তিনটে পার হয়ে গেছে। ক্লান্ত পায়ে তিনি এগোলেন অতুল আর বিমানের পিছু-পিছু।
ল্যাবরেটরিতে ঢুকে দরজা বন্ধ করতে যাবেন, দেখেন চার-পাঁচজন লোক দরজায় দাঁড়িয়ে। তার মধ্যে সেই সাংবাদিক ছেলেটি আর পুলিশ অফিসারটিও রয়েছে। একজন ফটোগ্রাফারের ফ্ল্যাশগান ঝলসে উঠল। প্রফেসর মজুমদার সামান্য বিরক্তভাবে বললেন, “প্লিজ, এখন এসব নয়। আমি ভীষণ টায়ার্ড।’
সাংবাদিক ছেলেটি চশমা ঠিক করতে-করতে বলল, ‘স্যার, গোটা ব্যাপারটা আমাদের কাছে অবিশ্বাস্য বলে মনে হচ্ছে। আমরা এর মাথামুণ্ডু কিছুই বুঝতে পারছি না। যদি আপনি একটু বুঝিয়ে বলেন—’
শান্তনু মজুমদার নিজেও মনে-মনে হাতড়াচ্ছিলেন। কী করে হল এমন আজব ব্যাপার? দেখলেন, অতুল আর বিমান বলটাকে ল্যাবরেটরির মেঝেতে সাবধানে নামিয়ে রেখে তার চারপাশ নানান জিনিস দিয়ে ঘিরে দিচ্ছে—যাতে বলটা আর না গড়ায়।
একটু আমতা-আমতা করে পুলিশ অফিসার বললেন, ‘প্রফেসর মজুমদার, এই বলের ব্যাপারটা নিয়ে একটা—ইয়ে, মানে, রিপোর্ট দিতে হবে আমাকে। তাই…ত …আপনি যদি…।’
শান্তনু মজুমদার তখন ভাবছিলেন। কতরকম পদার্থ আছে এই দুনিয়ায়। তাদের প্রত্যেকের মধ্যেই রয়েছে অণু, পরমাণু। পরমাণুর ভেতরে আবার আছে ইলেকট্রন, প্রোটন আর নিউট্রন। অণুই হচ্ছে পদার্থের ক্ষুদ্রতম অংশ যা পদার্থের নিজস্ব ধর্ম বজায় রাখে, আর স্বাধীনভাবে নিজের অস্তিত্ব বজায় রাখতে পারে। অণুর গঠনের জন্যই তো সোনার রং সোনালি, আর ঘনত্ব এত বেশি। আবার ওই অণুর গঠনের জন্যই তুলোর রং সাদা, আর তুলো এত হালকা যে, ফুঁ দিলেই উড়ে যায়। তা হলে নতুন এই পদার্থ নিয়ে গবেষণা করতে গিয়ে হঠাৎ করে এমন কোনও পদার্থ তৈরি হয়ে যায়নি তো যার অণুর গঠন অস্থায়ী, নিজে থেকেই ঘনঘন পালটে যাচ্ছিল! কখনও তার ঘনত্ব বাড়ছিল, আবার কখনও ঘনত্ব কমে গিয়ে হয়ে যাচ্ছিল পালকের মতো হালকা। এই একই কারণে হয়তো বলটার রংও বদলে যাচ্ছিল থেকে-থেকেই। মাঝখান থেকে শুধু-শুধু ওই গোবেচারা পঞ্চানন দাস অজ্ঞান হয়ে গেল।
নাঃ, ব্যাখ্যাটা যে শান্তনু মজুমদারের পুরোপুরি মনের মতো হচ্ছিল তা নয়। কিন্তু এতগুলো কৌতূহলী মানুষকে তো নিরাশ করা যায় না। সুতরাং আপাতত এই অণুর গঠনের ব্যাপারটাই ওদের বলা যাক। এই ভেবে প্রফেসর মজুমদার বলতে শুরু করলেন। আর একই সঙ্গে ভাবছিলেন, আশ্চর্য এই বলটা নিয়ে আরও জটিল, আরও জোরালো গবেষণা তাঁকে করতে হবে। একেবারে গোপন গবেষণা——যার বিন্দুবিসর্গ অতুল আর বিমানকেও তিনি জানাবেন না। বাইরের রাস্তায় তখন লোকজনের ভিড় কমতে শুরু করেছে।