আবার মনে মনে
আড়াই হাজার বছর আগে গ্রিক কবি ইউরিপিডেস বলেছিলেন, ঈশ্বর যখন ধ্বংস করেন, তখন প্রথম পাগল করে দেন। তারাশঙ্কর বন্দ্যোপাধ্যায় তাঁর এক উপন্যাসে লিখেছিলেন, মানুষ মহাপাপে পাগল হয়। শেক্সপিয়ার সাহেব তাঁর হ্যামলেট নাটকের দ্বিতীয় অঙ্কের দ্বিতীয় দৃশ্যে পাগলামির সঙ্গে সেই অমোঘ উক্তিটি করেছেন, এই যদি পাগলামি হয়, তবে এর ভিতরে পদ্ধতি রয়েছে, (Yet there is madness in it.)।
পাগল ও পাগলামি সংক্রান্ত মহাজনভাষণে আবদ্ধ না থেকে একটু সামনের দিকে যাচ্ছি।
প্রথমে নিজের কথা বলি। আমার লেখা পড়ে যদি কারও ধারণা হয়ে থাকে যে আমার মধ্যে পাগলামি রয়েছে তবে তাঁকে দোষ দেওয়া যাবে না। আমাদের বংশে এখন আর তেমন নামকরা পাগল কেউ নেই, কিন্তু বহুকাল পাগলামির ধারা ছিল। সে বিষয়ে বিস্তারিত বিবরণে যাব না, শুধু একটা ছোট ঘটনা বলি। একবার আমার স্বর্গত অগ্রজকে, যিনি পাগলামির জন্য নিজ গণ্ডির মধ্যে প্রসিদ্ধ ছিলেন, এক মানসিক ডাক্তারের কাছে নিয়ে গিয়েছিলাম। ডাক্তারবাবু দাদাকে পরীক্ষা করতে করতে নানা প্রশ্নের মধ্যে একটা প্রশ্ন জিজ্ঞাসা করেছিলেন, ‘আচ্ছা, আপনাদের বংশে কেউ কখনও পাগলামিতে ভুগেছে ?’ দাদা মৃদু হেসে জবাব দিয়েছিলেন, ‘না, ভোগেনি তবে অনেকেই পাগলামি উপভোগ করেছে, রীতিমতো এনজয় করেছে।’
পাগলামি উপভোগ করার একটা পুরনো গল্প আগে বলে নিই।
এই ভদ্রলোক বিমানবন্দরের কাছে থাকেন। প্রতিদিন বিকালে বিমানবন্দরের পাশের রাস্তায় পায়চারি করে বাড়ি ফিরে আসছেন, এমন সময় শুনতে পেলেন কে যেন তাঁকে ডাকছেন, ‘ও দাদা ও দাদা। এই যে এদিকে।’
ভদ্রলোক দেখলেন হাস্যমুখ এক ব্যক্তি বিমানবন্দরের এই প্রান্তে একটা ছোট বিমানের পাশে দাঁড়িয়ে তাঁকে হাত তুলে ডাকছেন। বিমানবন্দরের এদিকটায়, তারকাঁটার বেড়াটা একটু ঢিলে, তার মধ্যে দিয়ে চিকন পায়ে চলার পথ আছে।
আহ্বান শুনে পথচারী ভদ্রলোক কোনও একটা দরকারে ডাকছে এই ভেবে অগত্যা এগিয়ে গেলেন।
সেই হাস্যমুখ ব্যক্তিটি এবার এগিয়ে এসে বললেন, ‘দাদা, যাবেন নাকি, আমার এই প্লেনে মিনিট পনেরো আকাশে বেড়িয়ে আসতেন।’
যাঁকে অনুরোধ করা হল তিনি কখনও বিমানে চড়েননি। ভাবলেন, এ নিশ্চয় কোনও শৌখিন পাইলট। যাই মিনিট পনেরো আকাশ ভ্রমণ করে আসি। এমন মওকা সহজে জুটবে না।
ছোট প্লেন মাত্র কয়েকটা সিট। ভদ্রলোক উঠে দেখলেন, তিনি ছাড়া আর কোনও যাত্রী নেই। একটু পরেই পাইলট প্লেন ছেড়ে দিলেন, শূন্যে উঠল উড়োজাহাজ।
হঠাৎ যাত্রী ভদ্রলোক দেখলেন পাইলট অট্টহাসিতে ভেঙে পড়ছেন। একটু বোকার মতো যাত্রী ভদ্রলোক জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কী হল, এত হাসির কী হল ? এত হাসছেন কেন?’
উদ্দামভাবে হাসতে হাসতে ছোট প্লেনটাকে একটা নাক-উঁচু ডাইভ দিয়ে পাইলট বললেন, ‘আমি যে পাগলাগারদ থেকে পালিয়েছি, সেই পাগলাগারদের লোকেরা যখন টের পাবে যে আমি পালিয়েছি, তখন যে কী মজাই না হবে। কী মজা, কী মজা ! একবার ভাবুন তো দাদা !’
এত মজায় দাদার তখন বুকের রক্ত হিম।
আগের গল্পটি অবশ্য দারুণ গোলমেলে তদপুরি বিপজ্জনক। কিন্তু বায়ুরোগগ্রস্ত ব্যক্তিরা অত্যন্ত সামান্য কারণেও উত্তেজিত হয়ে পড়েন।
একবার এক বায়ুরোগগ্রস্ত ভদ্রলোক প্রাণপণ ছুটে মানসিক ডাক্তারের চেম্বারে ঢুকে যান, সঙ্গে আর্তনাদ, ‘ডাক্তারবাবু, বাঁচান, বাঁচান। আমি আর পারছি না। আমার চারদিক ঘিরে ধরেছে, চারপাশ থেকে আমাকে আটকে রেখেছে।’
হতভম্ব ডাক্তারবাবু রোগীকে যথাসাধ্য শান্ত করে জানতে চাইলেন, ‘জিনিসটা কী ? কী আপনাকে চারপাশে ঘিরে আটকে রেখেছে ?’ রোগী তাঁর হাওয়াই শার্ট উঁচু করে নীচে প্যান্টের কোমরে অঙ্গুলি নির্দেশ করে ফিস ফিস করে বললেন, ‘আমার এই কোমরের বেল্ট। এই বেল্টটা আমাকে আষ্টেপৃষ্টে ঘিরে রেখেছে।’
আরেক বাতিকগ্রস্তের কথা জানি, সেই ভদ্রলোকের ধারণা হয়েছিল তার এক ধরনের মারাত্মক লিভারের অসুখ হয়েছে। ডাক্তারকে বলতে ডাক্তার ব্যাপারটা হেসে উড়িয়ে দিলেন, বললেন, ‘এ অসুখ হলে আপনি জানতেই পারবেন না। এ আপনার সম্পূর্ণ কাল্পনিক। বাজে চিন্তা।’
রোগী জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন জানতে পারব না ?’ ডাক্তারবাবু বললেন, ‘কারণ এ অসুখ টের পাওয়া যায় না। কোনও ব্যথা, বেদনা বা অসুবিধে, এ অসুখের কোনও লক্ষণই নেই।’
এইবার রোগী দীর্ঘনিশ্বাস ফেলে বললেন, ‘ডাক্তারবাবু, সেইজন্যেই তো। কোনও লক্ষণ না থাকার জন্যই তো আমি বুঝতে পারছি যে ওই অসুখটা আমার হয়েছে।’
কোনও ডাক্তারের কাছে সুরাহা করতে না পেরে এই রোগী একদিন আমাকে তার মনের দুঃখের কথা বলেছিল। সবচেয়ে দুঃখজনক কথা যেটা বলেছিল, তা হল রোগের চিন্তায় আজকাল সারারাত তার ঘুম আসে না। বিনিদ্র রজনীতে বিছানায় শুয়ে ছটফট করে।
আমি অগত্যা তাকে একটা সুপরামর্শ দিয়েছিলাম, ‘রাতে এক ঘণ্টা পর পর এক পেগ করে হুইস্কি খাবে।’ সে অবাক হয়ে বলেছিল, ‘তাতে কি আমার ঘুম আসবে ?’
আমি বলেছিলাম, ‘ঘুম আসুক ছাই না আসুক, ঘুম না আসার কষ্টে ভুগবে না। পরম আনন্দে জেগে থাকবে।’ ওই রোগী আমার এই সুপরামর্শ গ্রহণ করেছিল কি না, আশা করি সে প্রশ্ন আমাকে কেউ করবেন না।
আরেকটা ছিটগ্রস্ত লোকের গল্প করি। এ ভদ্রলোক একদা আমার প্রতিবেশী ছিলেন। একবার সাঁওতাল পরগনা থেকে শীতের সময় বেড়াতে গিয়ে একটা ভালুকছানা নিয়ে এসেছিলেন।
ক্রমশ ভালুকছানাটা পাড়ার মধ্যে বড় হতে লাগল। পাশের বাড়িতে একটা হিংস্র জন্তু বড় হচ্ছে, নিতান্ত ভয়ে ভয়ে একদিন প্রতিবেশীকে বললাম, ‘আপনার ভালুকছানা তো বেশ বড় হল। এবার ওটাকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যান।’
ভদ্রলোক সঙ্গে সঙ্গে রাজি হয়ে গেলেন, বললেন, ‘সামনের রোববার অবশ্যই ওকে চিড়িয়াখানায় নিয়ে যাব।’ পরের সপ্তাহের মাঝামাঝি দেখি, ভালুকছানাটা, (এখন আর ছানা নয়, রীতিমতো বড়সড়) প্রতিবেশীর বাইরের ঘরের জানলার শিক ধরে দাঁড়িয়ে রয়েছে।
সন্ধ্যাবেলায় রাস্তায় প্রতিবেশীর সঙ্গে দেখা, জিজ্ঞাসা করলাম, ‘কী হল ? গত রোববার ভালুকের বাচ্চাটাকে চিড়িয়াখানায় নিতে বলেছিলাম যে। নিয়ে যাননি ?’
ভদ্রলোক মধুর হেসে বললেন, ‘তা নিয়ে গিয়েছিলাম বইকী। মধুলাল মানে আমার ওই ভালুকছানাটার চিড়িয়াখানা খুব ভাল লেগেছে। ভাবছি এই রোববারে মধুলালকে মিউজিয়ামে নিয়ে যাব। দেখি মধুলালের মিউজিয়াম চিড়িয়ানার মতোই ভাল লাগে কি না ?’
এত সব আজেবাজে গল্প লেখার পরে সবশেষে একটা প্রকৃত কাহিনী লিখছি; প্রকৃতই সত্য ঘটনা অবলম্বনে।
এক মনস্তত্ত্ববিদের চেম্বারে এক ভদ্রমহিলা এলেন। তাঁর সঙ্গে শিকলে বাঁধা একটি বেশ বড় মুখপোড়া হনুমান। ডাক্তার ভদ্রমহিলাকে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘আপনার জন্য আমি কী করতে পারি ?’
ভদ্রমহিলা বললেন, ‘আমি আমার জন্য আপনার কাছে আসিনি। আমি এসেছি আমার স্বামীর জন্য।’
ডাক্তারবাবু জিজ্ঞাসা করলেন, ‘কেন, আপনার স্বামীর কী হয়েছে ?’ মুখপোড়া হনুমানটির মুখের দিকে তাকিয়ে মহিলা দুঃখিত কণ্ঠে বললেন, ‘দেখুন, আমার স্বামীর বদ্ধমূল ধারণা যে তিনি একটা হনুমান।’