আবার বক্তৃতা
বক্তৃতা যাঁরা করেন অর্থাৎ বক্তাবৃন্দ এবং বক্তৃতা যাঁরা শোনেন অর্থাৎ শ্রোতাবৃন্দ উভয়েই জানেন যে বক্তৃতা হল অত্যন্ত গোলমেলে ব্যাপার, রীতিমতো জটিল বিষয়।
বক্তৃতা একবার আরম্ভ হলে শ্রোতাদের পক্ষে অনুমান করা কঠিন হয়ে পড়ে কখন সে বক্তৃতা শেষ হবে। মজার কথা এই যে শুধু শ্রোতারাই নয়, বক্তা নিজেও বহু সময় জানেন না যে কখন তাঁর বক্তৃতা শেষ হবে। কখনও কখনও বক্তৃতার খেই হারিয়ে যায় কী বিষয়ে বলছিলেন সেটা বক্তা ভুলে যান। অনেক সময় ঘুরে ফিরে একই জায়গায় বারবার চলে আসেন। একবার এক বক্তৃতায় বক্তা মহোদয়কে এগারোবার বলতে শুনেছিলাম ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়।’ সেটা ছিল এক বিদ্যালয়ের পারিতোষিক বিতরণী উৎসব। এগারোবার একটু বেশি হয়ে গিয়েছিল তবুও বক্তব্যের কাছাকাছি ছিলেন তিনি।
ওই ভদ্রলোককে পরে একদিন অন্য এক জায়গায় ‘বর্ষামঙ্গল’ সংগীত উৎসবে উদ্বোধনী বক্তৃতা করতে শুনি। কিন্তু এবারেও উনি ওই ‘তমসো মা জ্যোতির্গময়’ সাতবার উদ্ধৃতি দিলেন।
পরে বুঝেছিলাম এটা তাঁর মুদ্রাদোষ। তবে এমন অনেক বক্তা আছেন যাঁরা বক্তৃতা করতে উঠে কিছুক্ষণ পরেই ভুলে যান কী বিষয়ে বক্তৃতা করছিলেন। এঁরা হঠাৎ বক্তৃতা থামিয়ে দিলে শ্রোতাদের আশ্বস্ত হওয়ার তেমন কোনও কারণ নেই। কারণ মঞ্চে উপবিষ্ট অন্য কারও কাছ থেকে সেদিনের সভার বিষয় সম্পর্কে অনুচ্চ কণ্ঠে এবং নির্লজ্জভাবে তথ্য সংগ্রহ করে নিয়ে কয়েক মুহূর্তের মধ্যেই এঁরা আবার মাইকে ফিরে আসেন। এইবার তাঁদের বক্তব্য আবার শুরু হয়, ‘হ্যাঁ, যা বলেছিলাম…’এই বলে। বলা বাহুল্য এতক্ষণ যা বলছিলেন এবং এখন যা বলবেন তা মোটেই এক নয়।।
ঘণ্টার পর ঘণ্টা যাঁরা অনর্গল বক্তৃতা করে যেতে পারেন তাঁদের প্রাণশক্তি, ফুসফুস এবং কণ্ঠনালি খুবই সবল। রাষ্ট্রপুঞ্জে কৃষ্ণ মেননের অথবা ভুট্টোর ঘণ্টার পর ঘণ্টা ধরে বক্তৃতা সারা পৃথিবীতে বিস্ময় সঞ্চার করেছিল। দীর্ঘ বক্তৃতা সম্পর্কে গল্প আছে যে এক ভদ্রলোক বক্তৃতা করতে করতে মধ্যরাত কাবার করে দেন। তারপর সেটা খেয়াল হতে লজ্জিত হয়ে নিজের শূন্য বাঁ হাতের মণিবন্ধটা দেখিয়ে বললেন, ‘হাতে ঘড়ি নেই তাই সময়টা খেয়াল করিনি, একটু দেরি হয়ে গেল কেউ কিছু মনে করবেন না।’ ক্লান্ত, নিদ্রাতুর শ্রোতাদের মধ্যে একজন হাই তুলতে তুলতে উঠে বলল, ‘হাতে ঘড়ি না থাক, দেওয়ালে তো ক্যালেন্ডার ছিল। সেটা দেখলেই বুঝতে পারতেন পুরো একদিন পার করে দিয়েছেন।’
এই প্রসঙ্গে অন্য একটা গল্প আছে, সেটা একটু জটিল। এক আশাবাদী বক্তা খুব বক্তৃতা করে চলছিলেন, শ্রোতারা ক্রমশ অধীর হয়ে উঠেছিল, অবশেষে সেই বক্তা বললেন, ‘আমার বক্তৃতা আপনাদের জন্যে নয়, আমি বলছি পরবর্তী প্রজন্মের উদ্দেশ্যে।’ শ্রোতাদের মধ্যে তখন একজন উঠে দাঁড়িয়ে বলল, ‘আপনি থামবেন না। আর একটু বক্তৃতা চালিয়ে গেলেই পরবর্তী প্রজন্ম এসে যাবে।’
সব বক্তারই প্রধান দুশ্চিন্তা হল যে তাঁর বক্তৃতার সময় লোজন হল থেকে উঠে না যায়। এ তো প্রায় সকলেরই জানা যে অনেক খ্যাতনামা লোক আছেন যাঁরা জীবনে তাঁদের নিজ ক্ষেত্রে সুপ্রতিষ্ঠিত কিন্তু তাঁদের বক্তৃতা কেউ শুনতে চায় না, তাঁরা মঞ্চে উঠলেই—এমনকী মঞ্চে ওঠার আগে তাঁদের নাম ঘোষণা মাত্রেই হল থেকে শ্রোতারা দল বেঁধে উঠে চলে যায়।।
স্বীকার করা ভাল যে এর মধ্যে তেমন কোনও পূর্ব পরিকল্পিত ষড়যন্ত্র নেই। আসলে উক্ত বক্তাদের বক্তৃতার কুখ্যাতি বহুদূর ছড়িয়ে পড়েছে, সে বক্তৃতার কোনও চমক নেই, রস নেই, নতুন বক্তব্য নেই—শুধু কথার পর কথার পর কথা। কে শুনবে সেই ছাইপাঁশ কাঠের চেয়ারে শক্ত হয়ে বসে।
তবে এই সমস্যার সমাধান করে ফেলেছিলেন এক বুদ্ধিমান হিন্দিভাষী বক্তা। যে কোনও অচেনা জায়গায় বক্তৃতা করতে গিয়ে প্রথমেই তিনি যা বলতেন, তার তর্জমা নিম্নরূপ।
‘বন্ধুগণ, আমি বক্তৃতা করার আগে একটা কথা জানাতে চাই। আমি যখন সভাকক্ষে আসছিলাম দেখলাম হলের বাইরের বারান্দায় এক পানওয়ালি দাঁড়িয়ে রয়েছে। সে বলল, হলের মধ্যে এক বাবু এসেছেন আমার কাছ থেকে একটা পান খেয়ে আর একটা প্যাকেট সিগারেট নিয়ে। কিন্তু দাম দিয়ে আসেননি। পানওয়ালিটি টাকার জন্যে বাইরে অপেক্ষা করছে। আমি তাকে বললাম ভেতরে আসতে। কিন্তু সে হলের মধ্যে আসতে সংকোচ বোধ করছে।…
‘সে যা হোক আমি বক্তৃতা আরম্ভ করছি। যিনি ওর কাছ থেকে পান সিগারেট খেয়ে এসেছেন পয়সা না দিয়ে তাঁকে অনুরোধ গরিব পানওয়ালিটি বাইরে দাঁড়িয়ে আছে, এবার উঠে গিয়ে তার হিসাবটা মিটিয়ে দিয়ে আসবেন।’
বলা বাহুল্য, এর পরে একজন শ্রোতাও ভদ্রলোকের বক্তৃতাকালে সভা ছেড়ে উঠে যাননি। কারণ তা হলেই সকলে ধরে নেবে ইনিই ওই পানওয়ালির খাতক।
তবে সবাই যে বক্তৃতা করতে ভালবাসেন কিংবা সদাসর্বদা বক্তৃতা করতে ইচ্ছুক ও উৎসুক তা নয়। বরং অধিকাংশ লোকই বক্তৃতা করতে চায় না, বক্তৃতার নামে তাদের গায়ে জ্বর আসে।
এই ধরনের লোকদের জন্যে একটি সুখবর আছে। খবরটি এসেছে সুদূর পলিনেসিয়া থেকে।
পলিনেসিয়ার আদিম জাতিদের ওপরে গবেষণা করতে গিয়েছিলেন এক বিখ্যাত নৃতত্ত্ববিদ। সেখানকার সামোয়া নামক এক গহন অরণ্য প্রদেশের সামন্তনেতা তাঁকে সাদর সংবর্ধনাজ্ঞাপন করেন একটি অনুষ্ঠানের মাধ্যমে।
উক্ত অনুষ্ঠানে উদ্বোধনী নৃত্যগীতাদির পরে সভার কার্যসূচিতে ছিল সামন্ত নেতা কর্তৃক নৃতত্ত্ববিদের প্রতি স্বাগত ভাষণ। সেই নৃতত্ত্ববিদ অবাক হয়ে দেখলেন যে ভাষণ দিতে সামন্তটি মোটেই উঠলেন না বরং অন্য এক ভাড়াটে বক্তা এসে তাঁর হয়ে দীর্ঘ ভাষণ দিয়ে নৃতত্ত্ববিদের প্রশংসা ও গুণগান করলেন।
অবশ্যই সভার নির্ঘণ্টে এর পরেই ছিল নৃতত্ত্ববিদের ভাষণ অর্থাৎ ধন্যবাদজ্ঞাপন জাতীয় একটু বক্তৃতা।
বক্তৃতা করার জন্যে নৃতত্ত্ববিদ মহোদয় উঠতেই তাঁকে বাধা দেওয়া হল। বিস্মিত হয়ে তিনি জানতে চাইলেন সভার কার্যসূচিতে তাঁর বক্তৃতা রয়েছে তা হলে বক্তৃতা দিতে বাধা দেওয়া হচ্ছে কেন? সামন্তনেতা তখন তাঁকে বুঝিয়ে বললেন যে বক্তৃতা হল পেশাদারি ব্যাপার। ওর জন্যে আলাদা লোক নিযুক্ত করা আছে। তারা এসব ব্যাপারে এক্সপার্ট। নৃতত্ত্ববিদকে কষ্ট করে নিজের ভাষণ দিতে হবে না তার জন্যে লোক মজুত আছে। যে একটু আগে সামন্তনেতার তরফে স্বাগত ভাষণ দিয়েছে সেই অতঃপর ধন্যবাদজ্ঞাপন করবে নৃতত্ত্ববিদের তরফে।
অবশেষে একটি উপদেশ।
কোনও সভায় বক্তৃতাকালে যদি কোনও বক্তা কোনও রসিকতা করেন তা হলে সে রসিকতা আপনার ভাল লাগুক অথবা না লাগুক, পছন্দ হোক বা নাই হোক চিৎকার করে অতি অবশ্য হো হো করে হাসবেন। চেষ্টা করবেন পাশের দর্শকদেরও দলে টানতে।
কারণ আপনারা যদি না হাসেন, ওই বক্তা ধরে নেবেন আপনারা তার রসিকতাটি মোটেই ধরতে পারেননি। তিনি আবার এবং আবার, আপনারা না হাসা পর্যন্ত রসিকতাটি চালিয়ে যাবেন। তার থেকে প্রথমবারে একটু কষ্ট করে হেসে নেওয়াই ভাল নয় কি?