3 of 8

আবার বইমেলা

আবার বইমেলা

বইমেলা সম্পর্কে আমার যা অভিজ্ঞতা তা নিতান্তই পাঠক বা ক্রেতার। কবি, লেখক বা গ্রন্থকার হিসেবে বইমেলায় প্রবেশ করার কোনও সুযোগ কখনও আমার হয়নি। লাইনে দাঁড়িয়ে কাউন্টার থেকে টিকিট কেটে আর সকলের মতো সারি দিয়ে বইমেলায় আমি ঢুকি। বইমেলার উদ্যোক্তারা, হয়ত সংগত কারণেই, আমাকে কখনও গ্রন্থকার বা কবি হিসেবে খাতির করেননি।

তবে আমি থাকি বইমেলার মাঠের খুব কাছে। প্রতিদিনই সকালে এবং ছুটির দিনে বিকেলেও আমি আমার বৃদ্ধ সারমেয়টিকে নিয়ে এরই কাছাকাছি এলাকার ময়দানে বা ভিক্টোরিয়া স্মৃতিসৌধের চারপাশে শৌখিন ভ্রমণচর্চা করি।

ওই কাছে থাকি বলেই বইমেলার সময়ে আমি প্রথম দিনে একসঙ্গে আট-দশটা প্রবেশপত্র ক্রয় করে রাখি। কারণ শেষের দিকে ভিড় বেড়ে যায়। তখন টিকিট কাটা যেন কঠিন হয়ে পড়ে, বহু সময় লাগে।

বিকেলের দিকে অফিস থেকে ফিরে একটু হাতমুখ ধুয়ে, জলখাবার খেয়ে ধীরেসুস্তে বইমেলায় পৌঁছাই। বইমেলায় পৌঁছে কিন্তু এই ধীরতা বা সুস্থতা থাকে না। ভিড়, চেঁচামেচি, হইচই, হট্টগোল। বইমেলার মতো এত ভিড়, এত ধুলো কলকাতার আর কোনও মেলাতেই হয় না, শেয়ালদার রথের মেলাতেও নয়।

বইমেলায় আমি যে খুবই বই-টই কিনি তা নয়। কারণটা খুবই সরল, বইমেলায় যে কমিশনে বই বিক্রি হয়, তার চেয়ে অনেক বেশি কমিশন আমি কলেজ স্ট্রিটে পাই।

তবু বইমেলায় যাই। বই কিনেও ফেলি। সেগুলো একটু আলাদা ধরনের বই। হয়তো সব সময় সব জায়গায় পাওয়া যায় না।

আমার বই কেনার ব্যাপারটা অবশ্য সৈয়দ মুজতবা আলি কথিত ভদ্রমহিলার মতো নয়। এই মহিলার কথা আমি নিজেও এর আগে লিখেছি, তবু এখানে তাঁকে আরেকবার স্মরণ করা হয়তো অন্যায় হবে না।

তবে এ যাত্রায় গল্পটা সংক্ষিপ্ত করে বলছি।

এক ভদ্রমহিলা একটা বড় ডিপার্টমেন্টাল স্টোরে, মানে যে রকম দোকানে মনিহারি, প্রসাধন দ্রব্য থেকে শুরু করে জামাকাপড়, ঘড়ি, কলম, বইখাতা ইত্যাদি সব জাতীয় জিনিসপত্রই পাওয়া যায়, তাঁর স্বামীর জন্মদিনের জন্য একটা উপহার কিনতে গিয়েছেন।

ভদ্রমহিলা সিগারেট কেস দেখলেন, চপ্পল দেখলেন, নেকটাই দেখলেন, শার্ট, জরিদার পাঞ্জাবি সবই ঘুরে ঘুরে দেখলেন কিন্তু কিছুই তাঁর পছন্দ হল না। দোকানের মালিক দূরে দাঁড়িয়ে ব্যাপারটা অনেকক্ষণ লক্ষ করেছিলেন, অবশেষে তিনি ভদ্রমহিলাকে সাহায্য করতে এগিয়ে এলেন।

যখন তিনি শুনলেন মহিলা তাঁর স্বামীর জন্য উপহার কিনতে এসেছেন, তিনি মহিলাকে বললেন, ‘দাঁড়ান, আমি আপনাকে বেছে দিচ্ছি।’ ভদ্রলোক ঘুরে ঘুরে মহিলাকে রঙিন টেবিল ল্যাম্প, বেতের লাঠি, হাতির দাঁতের এলাচ রাখার বাক্স কত কী দেখালেন, কিন্তু মহিলা যা কিছুই দেখেন, বলেন, ‘না ঠিক এই জিনিস আমার বরের একটা আছে।’ দোকানি অবশেষে অপারগ হয়ে মহিলাকে বললেন, ‘তা হলে বইয়ের সেকশনে যান, সেখান থেকে নতুন একটা বই নিয়ে যান।’ এই পরামর্শ শুনে নির্বিকার ভদ্রমহিলা জবাব দিলেন, ‘বই চলবে না, আমার বরের বইও আছে একটা।’

এই গল্পর সমান্তরাল আরেকটা গল্পও বিদ্যাবুদ্ধি নাকি জ্ঞানগম্যিতে লিখেছিলাম। প্রায় একই ব্যাপার, জন্মদিনের উপহার ও বই নিয়ে সেই গল্প।

ওই একই মহিলা একই দোকানে গিয়েছেন এবং সবচেয়ে আশ্চর্যের কথা, এবার একটা বই কিনতে গিয়েছেন। দোকানের সেই মালিক ভদ্রমহিলাকে দেখে এগিয়ে এলেন এবং যখন শুনলেন ইনি এবার বই কিনতে এসেছেন, তাঁর প্রায় মূৰ্ছা যাবার জোগাড়, কোনও রকমে সামলে উঠে তিনি বললেন, ‘সে কী, ম্যাডাম, আপনি না সেবার বললেন, আপনাদের একটা বই আছে। আরেকটা বই কী কাজে লাগবে?’ ম্যাডাম বললেন, ‘আমার জন্মদিনে আমার বর একটা টেবিল ল্যাম্প দিয়েছে। সেটা ব্যবহার করার জন্য আমার নিজের একটা বই চাই। আগের বইটা তো আমার বরের।’

বইমেলার, বইমেলার প্রকাশক, গ্রন্থকার এবং দোকানদারের ভাগ্য ভাল যে ওই ভদ্রমিহলা কিংবা আমার মতো খদ্দের বইমেলায় খুব বেশি যায় না।

বইমেলায় ধুলো ভরা কিংবা জলকাদা ভরা উঠোনে গাদাগাদি রুদ্ধশ্বাস ভিড়ে পায়ে পায়ে ঘুরে বেড়ায় চিরদিনের পাঠক। সে নির্বিচারে বইয়ের পাতা ওলটায়, নির্বিকারভাবে বই কেনে কিংবা কেনে না, লোলুপ দৃষ্টিতে চাটে শো কেসের নতুন বইয়ের আহ্লাদি মলাট।

মোটা কাচ, স্টিলের ফ্রেম, গোল চশমা রিটায়ার্ড মাস্টারমশাই হুমড়ি খেয়ে পড়বেন শালোয়ার কামিজ পরিহিতা ও কলেজের কিশোরী পাঠিকার গায়ে; নবীন যুগের নবীন কবি মোটা আমলার নেকটাই ধরে ঝুলে পড়বে, বলবে, ‘দাদা, একটা কবিতার বই।’ গাঁজাভরা সিগারেট টেনে পৃথিবীর শেষ পাঠক বলবে, ‘ধুৎ!’ এই হল বইমেলা।

বইমেলা নিয়ে কয়েক বছর আগে আমি একটি কবিতা লিখেছিলাম। মজার কথা এই যে কবিতাটির নাম ছিল ‘প্রতিবাদের কবিতা’ এবং ওই নামের একটি কাব্য সংকলনের জন্য কবিতাটি রচনা করেছিলাম। সংকলনটি সম্পাদনা করেছিলেন মঞ্জুষ দাশগুপ্ত। কবিতাটি কঠিন নয়, আরেকবার নিবেদন করছি।

সে বছর বইমেলায়

ময়দানের শেষ প্রান্তের নিঃসঙ্গ বকুল গাছটির

ডালে ডালে পাতায় পাতায়

লাল নীল টুনি বাল্ব জ্বালিয়ে দেয়া হয়েছিল।

বকুল গাছের সেটা মোটেই পছন্দ হয়নি।

এমনিই এত ভিড়, হট্টগোল।

ধুলো আর ছেঁড়া কাগজ

এত ব্যর্থ পাঠক আর অসফল লেখক

এগুলো বকুল গাছ স্বভাবতই ভালবাসে না।

তারপর ওই লাল নীল আলো সবুজ পাতার মধ্যে

পুরো শীতকালটা।

বকুলগাছ গম্ভীর হয়ে রইল।

এমনকী যেদিন গভীর রাতে গভীর হাওয়ায়

ভিক্টোরিয়ার চূড়ায় কৃষ্ণপরী।

অনেকদিন পরে ডানা মেলে ধরল,

বকুল গাছ একবারের জন্যও

মুখ তুলে তাকিয়ে দেখল না।

শুধু পরের ফাল্গুনে

ময়দানের শেষ প্রান্তের সবুজ ঘাস ছেয়ে গিয়েছিল

নিঃশব্দ প্রতিবাদের অনন্ত সাদা ফুলে।

***

এই গুরুগুরু গম্ভীর গম্ভীর নিবন্ধটি শেষ করার মুহূর্তে আমার একটা ভয়াবহ অভিজ্ঞতার কথা বলি বইমেলা বিষয়ে।

একদিন বইমেলা ভাঙার পর বেরিয়ে আসছি। রাস্তায় ভিড়, লোকে লোকারণ্য, এমন সময় এক ভদ্রমহিলার সঙ্গে দেখা। কেমন যেন চেনা চেনা, কিন্তু কিছুতে মেলাতে পারলাম না।

ভদ্রমহিলাও আমাকে দেখেছেন, তিনি হাসিমুখে আমার দিকে এগিয়ে এলেন, হাত তুলে নমস্কার করতে যাচ্ছিলেন কিন্তু আমার থতমত ভাব দেখে চমকে গিয়ে বললেন, ‘কিছু মনে করবেন না, আমি বোধহয় ভুল করেছিলাম, আমি ভেবেছিলাম আপনি আমার এক বাচ্চার বাবা।’

ভদ্রমহিলার কথা শুনে আমি চমকে উঠলাম কিন্তু কিছু বলার আগেই তিনি ধুলো আর ভিড়ে মিলিয়ে গেলেন এবং সেই মুহূর্তে মনে পড়ল অনেক দিন আগে প্রাইমারি ইস্কুলে আমার ছেলে একদা তাঁর ছাত্র ছিল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *