আবার নীল মানুষ
রঘু সরদার আগে ছিল ডাকাত, পরে পুলিশের ভয়ে সাধু সেজেছিল, এখন সে হয়েছে রান্নার ঠাকুর। সে গুটুলি আর নীল মানুষের জন্য রোজ ভাত—ডাল রান্না করে।
রঘু সরদারের মনে বড় দুঃখ। সে এখানো বুড়ো হয়নি, তার গায়ে জোর আছে, তবু তাকে কিনা জঙ্গলের মধ্যে বন্দী থেকে এরকম একটা ছোট কাজ করতে হয়! যখন সে ডাকাতের সরদার ছিল তখন তার দলের দশ বারো জন লোক তার হুকুম শুনতো, গ্রামের লোক তার নাম শুনে ভয়ে কাঁপতো, মাঝ রাত্তিরে মশাল নিয়ে রে—রে—রে—রে করে গ্রামের কোনো বাড়িতে চড়াও হলে সে বাড়ির লোক টাকা—পয়সা, গয়না—গাঁটি সব ফেলে দিত তার পায়ের কাছে! কত আনন্দ ছিল তাতে।
সাধু সেজে থাকার সময়েও কম আনন্দ ছিল না। দলের তিনজন পুলিশের হাতে ধরা পড়ে তার নাম বলে দেওয়ায় কিছুদিনের জন্য তাকে গা—ঢাকা দিয়ে থাকতে হয়। অন্য গ্রামে এসে শ্মশানের ধারে সাধু সেজে বসলে গ্রামের মানুষ বেশ ভক্তি করে, পুলিশেও বিরক্ত করে না। সাধুসাজা অবস্থায় রঘু সরদারের খাওয়া—দাওয়া বেশ ভালোই জুটছিল, ভক্তদের হুকুম করলে তার পা টিপে দিত। এখন কিনা ওই বেঁটে বাঁটকুল গুটুলিটার হুকুম শুনতে হয় তাকে। এমনকি গুটুলির পা—ও টিপে দিতে হয় মাঝে মাঝে।
এখান থেকে পালাবারও কোনো উপায় নেই। রঘু সরদার বুঝতে পেরেছে যে পালাবার চেষ্টা করে ধরা পড়লে ওই আটফুল লম্বা নীল মানুষ শুধু তাকে তুলে একটা আছাড় দিলেই সব শেষ। রঘু সরদারের এখনো ধারণা, নীল মানুষ ঠিক মানুষ নয়, ব্রহ্মদৈত্য জাতীয়ই কিছু হবে। এরকম বিশাল চেহারারা কোনো মানুষ কি হতে পারে! গায়ের রং আবার গাঢ় নীল রঙের। তবে নীল মানুষের স্বভাবটা তেমন হিংস্র নয়, বেশির ভাগ সময়েই শুয়ে—বসে আলস্য করে আর হাসি ঠাট্টা করে কথা বলে। বরং ওই তিনফুট চেহারার গুটুলিটাই পাজী, ওর গাঁটে গাঁটে বুদ্ধি। নীল মানুষ ওর বুদ্ধিতেই চলে। ওই গুটুলিই ঠিক করেছে যে রঘু সরদারকে পুরো এক বছর জঙ্গলে থেকে ওদের সেবা করতে হবে। তারপর যদি সে নাক কান মূলে প্রতিজ্ঞা করে যে আর কোনো দিন ডাকাতি করবে না, তা হলে তাকে ছেড়ে দেওয়া হবে।
রঘু সর্দার মনে মনে উপায় খোঁজে, কী করে ওই গুটুলিটাকে জব্দ করা যায়!
সেদিন দুপুরে খাওয়া—দাওয়ার পর রঘু সরদার ঝর্ণার পাশে বাসন মাজতে বসলো। এটাও তাকে করতে হয়। এই সময়টায় তার সবচেয়ে বেশি রাগে গা জ্বলে যায়। সে ছিল কিনা একজন নামকরা ডাকাত সরদার। তাকে এখন মেয়েদের মতন বাসন মাজতে হচ্ছে!
সে আড় চোখে তাকিয়ে দেখলো, নীল মানুষ একটা গাছের তলায় ঘুমিয়ে পড়েছে আর গুটুলি একটু দূরে বসে একখানা বই পড়েছে। গুটুলি প্রায়ই একা একা শহরে যায়, আর নানান জিনিস পত্তর জোগাড় করে আনে।
বই থেকে মুখ তুলে গুটুলি বললো, বড্ড পান খেতে ইচ্ছে করছে। কতদিন পান খাই নি। রঘু, কয়েক খিলি পান এনে দাও তো!
রঘু সরদার বললো, পান? এই জঙ্গলের মধ্যে আমি পান কোথায় পাবো?
গুটুলি বললো, জঙ্গলের মধ্যে পান পাওয়া যাবে না, জানি। কিন্তু বাঁদিকে এই টিলার পাশ দিয়ে মাইল তিনেক হেঁটে গেলেই একটা বড় রাস্তা পাবে। একটা হাইওয়ে। সেখানে একটা পেট্রেল পাম্পের পাশেই একটা পান—বিড়ির দোকান আছে। সেখান থেকে নিয়ে এসো!
রঘু সরদার উঠে দাঁড়িয়ে বললো, আমি একলা পান আনতে যাবো?
গুটুলি তার দিকে একটা টাকা ছুঁড়ে দিয়ে বললো, হ্যাঁ, যাও, পান নিয়ে এসো। বেশি দেরি কারো না যেন!
রঘু সরদারের ভুরু কপালে উঠে গেছে। সে ব্যাপারটা বুঝতেই পারছে না। তাকে একলা একলা পাঠানো হচ্ছে জঙ্গলের বাইরে? সেখানেই হাইওয়ে দিয়ে গাড়ি, ট্রাক চলে। কোনো একটা ট্রাকে উঠে তো সে অনেক দূরে পালিয়ে যেতে পারে।
গুটুলি কি তাকে লোভ দেখাচ্ছে?
একটা হ্যাণ্ড ব্যাগে রঘু সরদারের কিছু লুকানো টাকা ও জামা—কাপড় রয়েছে। রঘু সরদার একবার সে দিকে তাকালো। ওই ব্যাগটার মায়া ত্যাগ করতে হবে।
মেঘের গর্জনের মতন নাক ডাকিয়ে ঘুমোচ্ছে নীল মানুষ। সে সহজে জাগবে না মনে হয়।
রঘু সরদার বললো, ঠিক আছে, তা হলে পান নিয়ে আসি!
গুটুলি বললো, বেশি দেরি করো না, কেমন? আর হ্যাঁ, ভালো কথা, তুমি দামোদর বলে কারুকে চেনো?
রঘু সরদার বললো, কোন দামোদর? কোন দামোদর?
গুটুলি বললো, তোমারি মতো ডাকাতি—টাকাতি করে!
রঘু সরদার জিজ্ঞেস করলো, তার কি বাঁ হাতের দুটো আঙুল কাটা? কথা বলতে বলতে হঠাৎ তোতলা হয়ে যায়?
—ঠিক ধরেছো। সেই দামোদরই বটে!
—সে তো এক সময় আমার দলেই ছিল। পরে নিজের আলাদা দল খুলেছে শুনেছি। তাকে তুমি চিনলে কী করে?
—চেনা হয়েছিল এক সময়। তুমি যে—দোকানে পান কিনতে যাচ্ছো, দামোদরই এখন সেই দোকানের মালিক।
—এঃ, ব্যাট ডাকাতি ছেড়ে এখন পানওয়ালা সেজেছে!
—ডাকাতি ছাড়েনি! তুমি যেমন পুলিশের চোখে ধুলো দেবার জন্য কিছুদিন সাধু সেজেছিলে, ওই দামোদরও তেমনি পানওয়ালা সেজেছে! তুমি ওই দামোদরকে এখানে ডেকে আনতে পারবে?
এখানে?
—হ্যাঁ, ওর সঙ্গে আমার দরকার আছে।
কথা শুনলে পিত্তি জ্বলে যায়। ওইটুকু একটা মানুষ, যাকে রঘু সরদার টিপে মেরে ফেলতে পারে, সে কি না বসে বসে হুকুম চালিয়ে যাচ্ছে। ব্রহ্মদৈত্যটাকে ও কী করে বশ করলো কে জানে!
রঘু সরদার জঙ্গলের মধ্যে দিয়ে খানিকটা হেঁটে তারপর দৌড়োতে শুরু করলো। মাঝে মাঝে সে পিছন ফিরে তাকিয়ে দেখছে যে নীল মানুষ তাকে তাড়া করে আসছে কি না! না, সে রকম কোনো চিহ্ন নেই। বন একেবারে নিস্তব্ধ।
ছুটতে ছুটতে সে ভাবতে লাগলো, বড় রাস্তায় পৌঁছে সে কী করবে? দামোদরের সঙ্গে সে দেখা করবে? কী দরকার? আপনি বাঁচলে তো বাপের নাম। সোজা একটা গাড়িতে উঠে পালিয়ে যাওয়াই তো ভালো।
হাতে একটা কোনো অস্ত্র নেই, সঙ্গে কোনো টাকা পয়সা নেই, শুধু মাত্র একটা টাকা সম্বল। তবু রঘু সরদার ঠিক করলো এবারে সে পালাবেই।
সে বড় রাস্তায় পৌঁছে গেল বিনা বাধায়। পেট্রল পাম্পটাও চোখে পড়লো। তার পাশে একটা পানের দোকান আছে ঠিকই। রঘু সরদার আড়াল থেকে দেখলো, আঙুল—কাটা দামোদর সেখানে বসে আছে ঠিকই। তার পাশে একজন বসে আছে। তার নাম ন্যাড়া গুলগুলি। ওর রোগা ছোট্টখাটো চেহারা, কিন্তু দারুণ ছুরি চালায়, চোখের নিমেষে যে—কোনো লোকের পেট ফাঁসিয়ে দিতে পারে। ওরা দুজনে যখন জাঁকিয়ে বসেছে, তখন নিশ্চয়ই বড় কোনো মতলব আছে।
রঘু সরদারের একবার লোভ হলো দামোদরের সঙ্গে গিয়ে কথা বলতে। আট দশজন লোক জুটিয়ে যদি একটা দল গড়া যায়, তাহলে ওই লম্বা নীল মানুষটা আর বাঁটকুল গুটুলিটাকে ভয় কী! ওদের কাছে তো ছুরি বন্দুক নেই!
কিন্তু নীল মানুষের চেহারাটা মনে পড়তেই তার বুক কেঁপে উঠলো। ও যদি ব্রহ্মদৈত্য হয় তা হলে তো গুলি গোলাও হজম করে ফেলবে! নীল মানুষটা একদিন গুটুলিকে কী যেন সব বলছিল, পৃথিবীর বাইরে অন্য গ্রহের কথা। ও কি সেখান থেকে এসেছে নাকি? তা হলে বাংলায় কথা বলে কী করে?
দরকার নেই বাবা, এ তল্লাট থেকে একেবারে চম্পট দেওয়াই ভালো।
রঘু সরদার পেট্রল পাম্পটার কাছাকাছি একটা গাছের আড়ালে লুকিয়ে রইলো। এ রাস্তা দিয়ে বাস চলে না। কিন্তু অন্য কোনো গাড়ি পেট্রল পাম্পে থামলেই সে তাতে উঠে পড়বে।
আধঘণ্টা পরে একটা অ্যাম্বাসেডর গাড়ি এসে থামলো। তাতে দু’জন মহিলা, দু’জন বাচ্চা আর দু’জন পুরুষ মানুষ। রঘু সরদার বিরক্তিতে মুখটা কোঁচকালো। এ গাড়িতে তাকে নেবে না।
দুটো ট্রাক ঝড়ের বেগে চলে গেল, থামলোই না। আর একটা গাড়ি থামলো, তাতে শুধু ড্রাইভার আর পেছনের সীটে একজন মোটা মতন লোক। এবারে রঘু সরদার গাড়িটার দিকে এগিয়ে গিয়ে ড্রাইভারকে কাচুমাচু মুখে বললো, ভাই, আমার খুব জরুরি দরকার, বাড়ি থেকে অসুখের খবর এসেছে, আমাকে সামনের শহরটাতে একটু পৌঁছে দেবে?
ড্রাইভার কিছু না বলে মালিকের দিকে তাকালো।
মালিক খেঁকিয়ে উঠে বললো, না, না। ওসব হবে না, এখানে হবে না!
ড্রাইভার গাড়িতে স্টার্ট দিতেই মালিক আবার বলতে লাগলো, ডাকাতের মতন চেহারা, ওসব লোককে একদম বিশ্বাস নেই। রাস্তা থেকে অচেনা লোককে কখনো তুলবে না!
রঘু সরদার অস্থির হয়ে উঠলো। মূল্যবান সময় নষ্ট হয়ে যাচ্ছে। তার দেরি দেখে যদি নীল মানুষ তার খোঁজে ধেয়ে আসে। তবে এই ক’দিনে একটা ব্যাপার সে বুঝেছে, সন্ধের আগে ওই নীল মানুষটা জঙ্গল ছেড়ে বেরুতে চায় না।
এদিকে বিকেলের আলো পড়ে আসছে, সন্ধের আর দেরি নেই।
আরও আধ ঘণ্টা পরে একটা ট্রাক এসে থামতেই রঘু সরদার অনেক কাকুতি—মিনতি করে তাতে উঠে পড়লো। ট্রাক ড্রাইভার বললো, দশ টাকা দিতে হবে। রঘু সরদারের কাছে টাকা না থাকলেও সে বলে উঠলো, দেবো, আগে আমাকে পৌঁছে দাও—।
মিনিট দশেক যেতে না যেতেই ট্রাকের গতি কমে এলো। রঘু সরদার জিজ্ঞেস করলো, কী হলো থামলে কেন ভাই? আমার যে খুব জরুরি দরকার। ট্রাক ড্রাইভার উত্তর দিল, সামনে পথ বন্ধ।
রাস্তাটা সেখানে একটা ছোট পাহাড়ের ওপরে দিয়ে ঘুরে গেছে। একদিকে ঘন জঙ্গল, আর একদিকে খাদের মতন। চার—পাঁচ খানা গাড়ি থেমে আছে সেখানে। এই সবকটা গাড়িকেই রঘু সরদার আগে চলে আসতে দেখেছে। সবাই গাড়ি থেকে নেমে পড়ে জটলা করছে এক জায়গায়। সামনে রাস্তার ওপরে একটা প্রকাণ্ড পাথরের চাঁই পড়ে আছে। সেটা না সরালে কোনো গাড়িই যেতে পারবে না। এত বড় পাথরটা সরানো যাবেই বা কী করে!
অন্ধকার হয়ে এসেছে, পাশের জঙ্গলে জোনাকি জ্বলছে। আকাশে আকাশে ছেঁড়া ছেঁড়া মেঘ, তার ফাঁক দিয়ে একটু করে বেরিয়ে আসছে চাঁদের আলো। জায়গাটা ভারি সুন্দর, কিন্তু সেখানে দাঁড়িয়েও রঘু সরদারের বুক ধড়াস ধড়াস করতে লাগলো। কোনো রকমে একটা শহরে পৌঁছতে পারলেই সে বেঁচে যেত। ব্রহ্মদৈত্যই হোক আর যা—ই হোক, শহরে তাদের জারিজুরি খাটবে না।
পাথরটা সবাই মিলে ঠেলে সরানো যায় না?
এমন সময় পাশের জঙ্গল থেকে সরু গলায় একটা গান শোনা গেল, ‘কে বিদেশী মন উদাশী বাঁশের বাঁশি বাজায় বনে!’
সে গান শুনেই রঘু সরদারের আত্মারাম খাঁচা ছাড়া হওয়ার উপক্রম। সবাইকে ঠেলে সে দৌড় লাগালো সামনের দিকে। বড় পাথরের চাঁইটার ওপরে উঠে লাফিয়ে পার হতে যেতেই জঙ্গল থেকে একটা লম্বা হাত বেরিয়ে এলো। তার কাঁধটা ধরে বেড়াল ছানার মতন শূন্যে তুলে সেই হাতটা তাকে নিয়ে গেল। অন্য একটা হাত পাথরটাকে ঠেলে গড়িয়ে দিল পাশের খাদে।
এমন চোখের নিমেষে ঘটনাটা ঘটলো সে অন্য লোকরা ভাবলো যে রঘু সরদারও বোধহয় পাথরটার সঙ্গে গড়িয়ে পড়ে গেল নিচে।
নীল মানুষ রঘু সরদারকে জঙ্গলের মধ্যে নামিয়ে দিল গুটুলির পায়ের কাছে। গুটুলি এখন মুখে দাঁড়ি—গোঁফ লাগিয়ে অন্য রকম সেজে আছে। সে কোমরে হাত দিয়ে চোখ পাকিয়ে বললো, রঘু, আমার পান কোথায়?
নীল মানুষ বললো, এটা তোমার কী রকম ব্যবহার বলো তো রঘু সরদার? দুপুরবেলা ভাত খাওয়ার পর পান খেতে ইচ্ছে হয়েছিল, আর এখন সন্ধে হয়ে গেল, তবু তুমি পান নিয়ে এলো না! ওখানে কী করছিলে?
রঘু সরদারের মুখে আর কথা নেই। সে বুঝতে পারলো তার শেষ নিঃশ্বাস ঘনিয়ে এসেছে!
গুটুলি আবার বললো, কী হলো আমার পান দাও!
রঘু সরদার এবারে বলে ফেললো, পানের দোকান বন্ধ ছিল। তাই আমি শহরে যাচ্ছিলুম পান আনতে!
তাই শুনে গুটুলি হি হি করে হেসে উঠলো আর নীল মানুষ হেসে উঠলো হা—হা করে।
তারপর নীল মানুষ বললো, এসো একটা জিনিস দেখবে এসো!
আবার সে রঘু সরদারের কাঁধ ধরে ঝুলিয়ে নিয়ে চললো। গুটুলিকে তুলে নিল অন্য হাতে। অনেকখানি জঙ্গল পেরিয়ে এসে সে এক জায়গায় থেমে বললো, ওই দ্যাখো! দোকান সমতে পানওয়ালাকে আমরা নিয়ে এসেছি তোমার জন্য।
এখন অনেকটা জ্যোৎস্না উঠছে, তাতে দেখা গেল দুটো গাছের সঙ্গে লতাপাতা দিয়ে বাঁধা রয়েছে দামোদর আর ন্যাড়া গুলগুলি। কাছেই পড়ে আছে একটা ছুরি।
পা দিয়ে সেই ছুরি ঠেলে দিয়ে নীল মানুষ বললো, এটা দিয়ে ওদের বাঁধন কেটে দাও! ছুরিটা কোথা থেকে এলো জানো? ওই ন্যাড়াটা ওই ছুরি দিয়ে আমার পেট ফাঁসাতে এসেছিল। ভোতা ছুরি, আমার পেটে ঢুকলোই না!
ন্যাড়া গুলগুলি বলতে লাগলো, ভূ—ভূ—ভূ—ভূ—ভূত!
আর তার মুখ দিয়ে ফেনা বেরিয়ে আসতে লাগলো।
ছুরিটার দিকে তাকিয়ে শিউরে উঠলো রঘু সরদার। প্রায় এক বিঘৎ লম্বা ওই ছুরি দিয়ে মানুষের মুন্ডু কেটে ফেলে যায়, আর সেই ছুরি নীল মানুষের পেটে ঢোকেনি!
নীল মানুষ আবার বললো, ওদের বাঁধন খুলে দাও, আর পান সাজতে বলো।
রঘু সরদার ওদের বাঁধন কেটে দিতেই ন্যাড়া গুলগুলি ধপাস করে অজ্ঞান হয়ে পড়ে গেল। আর কাঁপতে লাগলো থরথর করে।
রঘু সরদার বললো, ওরে দামোদর, বাঁচতে চাসতো পান সেজে দে! ওরা যা বলছে কর!
পান সাজার জিনিস পত্তর সব এনে রাখা ছিল, দামোদর সেই রকম কাঁপতে কাঁপতেই দু’খিলি পান সাজলো।
নীল মানুষ বললো, এক খিলি পানে আমার কী হবে? আমার একসঙ্গে দশটা পান চাই। শিগগির!
তখন আবার পান সাজা হলো। তাড়াতাড়ির জন্য রঘু সরদারও সাহায্য করার জন্য হাত লাগালো।
—দুই ডাকাতে মিলে পান সাজছে!
এই বলেই খিলখিল করে হেসে উঠলো গুটুলি। নীল মানুষ বললো, এখন বেশ শান্ত শিষ্ট দেখাচ্ছে, না?
একসঙ্গে দশটা পান মুখে পুরে নীল মানুষ একটা তৃপ্তির ঢেকুর তুললো। তারপর সে রঘু সরদারের দিকে ফিরে বললো, এবারে একটা ঘটনা শোনো! মনে করো, একজন ছোটোখাটো চেহারার মানুষ, খুব নিরীহ, কারুর সাতে পাঁচে থাকে না, সে একটা দোকানে চাকরি করে। বেশ দিন কেটে যাচ্ছিল তার। তারপর একজন দুষ্টু লোক সেই দোকানে ডাকাতি করার ষড়যন্ত্র করলো। তারপর ডাকাতি করলোও ঠিক কিন্তু সব দোষ চাপিয়ে দিল ওই ছোটখাটো চেহারার নিরীহ লোকটির ওপর। তার ফলে সে মারধর খেল, চাকরিও গেল। এখন এটা খুব অন্যায় কি না বলো? তুমি ডাকাতি করতে চাও করো। কিন্তু একজন নিরীহ লোকের কাঁধে দোষ চাপাবে কেন? কী এটা অন্যায় নয়?
রঘু সরদার বললো, হ্যাঁ, অন্যায় খুব অন্যায়!
নীল মানুষ দামোদরের দিকে ফিরে জিজ্ঞেস করলো, তুমি কী বলো?
দামোদরও সঙ্গে সঙ্গে মাথা নেড়ে বললো, হ্যাঁ, হ্যাঁ ওটা খুব অন্যায়। পরের ওপর চোষ চাপানো মোটেই উচিত নয়!
নীল মানুষ বললো, বাঃ, বাঃ, এই তো চাই। তোমাদের দু’জনেরই তো বেশ ন্যায়—অন্যায় জ্ঞান আছে দেখছি!
গুটুলি এবারে এক টানে মুখের দাড়ি—গোঁফ খুলে ফেলে বললো, ওহে দামোদর, আমায় চিনতে পারো? আমিই রঘুনাথপুরের এক মুদিখানায় চাকরি করতুম, আর তুমি সেই দোকানে ডাকাতি করেছিলে!
দামোদর চোখ কপালে তুলে বললো, অ্যাঁ, অ্যাঁ ওরে বাবারে আমার মহা অন্যায় হয়ে গেছে। আমায় তুমি মাপ করো বামুন ঠাকুর। তোমার পায়ে পড়ি!
গুটুলি চোখ পাকিয়ে বললো, আমি বামুন ঠাকুর নই, আর তোমাকে মাপও করবো না! অন্যায় করলে তার শাস্তি পেতে হয় জানো না?
নীল মানুষ বললো, ওহে রঘু সরদার, তুমি আমাদের লোক। তোমার ওপরেই শাস্তির ভার দিলুম। ওকে কী শাস্তি দেওয়া যায় বলো তো?
রঘু সরদার নীল মানুষকে খুশি করার জন্য বললো, মাটিতে গর্ত করে ওকে বুক পর্যন্ত পুঁতে রাখা উচিত। আর ওই ন্যাড়া গুলগুলিটা আপনাকে ছুরি মারতে এসেছিল, ওকেও ওই শাস্তি দিতে হবে!
নীল মানুষ বললো, ওরে বাবা, এত কঠিন শাস্তি!
গুটুলি বললো, আর রঘু সরদার, তুমি যে কথার খেলাপ করে পালাবার চেষ্টা করেছিল, তা হলে তোমার কী শাস্তি হবে? তুমি যাতে আর পালাতে না পারো, সেই জন্য তোমাকেও মাটিতে গর্ত করে পুঁতে রাখা উচিত!
নীল মানুষ হা—হা করে হেসে উঠলো, তারপর বললো, তার চেয়ে বরং এক কাজ করা যাক। ওরা তিনজনেই তিনজনকে শাস্তি দিক।
প্রত্যেকে প্রত্যেকের মাথায় আটটা করে গাঁট্টা মারুক। নাও, রঘু সরদার তুমিই শুরু করো!
ন্যাড়া গুলগুলির এর মধ্যে জ্ঞান ফিরে এসেছে। সে উবু হয়ে জুল জুল করে তাকিয়ে সব কথা শুনছিল। সে তাড়াতাড়ি মাথায় হাত চাপা দিয়ে বললো, ওরে বাবারে, আমার মাথা ন্যাড়া, গাট্টা মারলে আমার বেশি লাগবে! এটা অন্যায়!
নীল মানুষ বললো, ঠিক আছে, তা হলে গাট্টার বদলে থাপ্পড় চলুক।
ন্যাড়া গুলগুলি বললো, আমার গায়ে জোর কম। আমি জোরে থাপ্পড় মারতে পারবো না, আমি চিমটি কাটবো!
নীল মানুষ বললো, ঠিক আছে তাই সই!
তারপর শুরু হলো এক মজার ব্যাপার! এ ওকে থাপ্পড় মারে আর এ ওকে চিমটি কাটে। লেগে গেল চ্যাঁচামেচি, ঝটাপটি। নীল মানুষ আর গুটুলি হেসে গড়াগড়ি যেতে লাগলো।
খানিকবাদে যখন প্রায় রক্তারক্তি শুরু হবার উপক্রম তখন নীল মানুষ হেঁকে বললো, ব্যস ব্যস, যথেষ্ট হয়েছে। নইলে কিন্তু এবারে আমি শুরু করবো!
অমনি সব চুপ।
গুটুলি বললো, রঘু সরদার যে মাটি খোঁড়ার কথা বলছিল, সেটা কিন্তু মন্দ নয়। এই জঙ্গলে বড় জলের কষ্ট। গ্রীষ্মকালে জঙ্গলের জন্তু—জানোয়াররাও জলের কষ্ট পায়। ওরা তিনজন এখানকার মাটি খুঁড়ে খুঁড়ে একটা পুকুর তৈরি করুক না। আমি খন্তা—শাবল এনে দেবো!
নীল মানুষ বললো, ভালো আইডিয়া। পুকুরটা পুরোপুরি খোঁড়া হয়ে গেলে আমি সেটার নাম রাখবো। রঘু—দামোদর—গুলগুলি!
দামোদর বললো, আমরা তিনজনে মিলে একটা পুকুর কাটবো? তাতে যে এক বছর লেগে যাবে!
গুটুলি বললো, পুলিশের হাতে ধরা পড়লে তো অন্তত পাঁচ বছর জেল খাটতে। তারচেয়ে এখানে এক বছর তো বেশ সস্তায় হয়ে গেল! জেলখানার থেকে এখানে ভালো খাবার পাবে! তোমরা নিজেরাই তো রান্না করবে।
নীল মানুষ বললো, খাবারের কথায় মনে পড়ে গেল। বড্ড খিদে পেয়েছে যে? ও রঘু সরদার, আজ কি কি খাওয়াবে? যাও, যাও উনুনে আগুন দাও!
গুটুলি বললো, দামোদর, পান সাজো!
ন্যাড়া গুলগুলি জিজ্ঞেস করলো, আমি কি করবো?
গুটুলি বললো, তুমি মাছ—তরকারি কুটবে। তোমার তো ছুরির হাত ভালো!
নীল মানুষ হাসতে হাসতে বললো, আমাদের সংসারটা দিব্যি বড় হয়ে গেল, কী বলো!