আবার জ্যোতিষী
শাস্ত্রে মূকের কথা বলার এবং পঙ্গুর গিরি লঙ্ঘনের কথা আছে। কিন্তু সেখানে অন্ধ বা দৃষ্টিহীনের দেখার কথা কিছু নেই।
সম্প্রতি একটি পত্রিকায় রবিবাসরীয় গ্ৰহরত্নের, জ্যোতিষের এলাকায় একটি বিজ্ঞাপন দেখে চমকিত হলাম। এক জন্মান্ধ হাত দেখছেন এবং ভূত-ভবিষ্যৎ-বর্তমান হুবহু মিলিয়ে দিচ্ছেন।
খবরের কাগজে আরও একটা খবর পড়লাম। হাসির বিষয় নয়, ভয়াবহ খবর। কুচবিহারের মদনমোহনের বিগ্রহ চুরি করার ব্যাপারে মূর্তিচোরদের সাহায্য করার জন্য যে কয়জন সরকারি কর্মচারী ধরা পড়েছেন এবং বরখাস্ত হয়েছেন, তাঁদের একজনের ক্ষেত্রে ঘটনাটা ঘটে গেছে জ্যোতিষের কল্যাণে।
ছাপোষা কর্মচারী নিজের ভাগ্যগণনা করতে গিয়েছিলেন। খুবই উপযুক্ত স্থানে গিয়েছিলেন, তাঁরই বিভাগীয় ওপরওয়ালা স্বয়ং হাত দেখেন, ছক বিচার করেন। অনেক দেখে-শুনে গণকঠাকুর অভিমত দিয়েছিলেন, কর্মচারীটির আশু ভবিষ্যৎ খুবই বিপজ্জনক এবং গ্রহশান্তি করা ছাড়া পরিত্রাণ নেই। এই গ্রহশান্তির জন্য অতি অবশ্য অবিলম্বে একটি মূল্যবান প্রস্তর ধারণ করতে হবে যার ব্যয় অন্তত পনেরো-বিশ হাজার টাকা।।
মূর্তিচোরদের কাছে ঘুষ পাওয়া সোনা বেচে ওই কর্মচারীটি হাজার বারো টাকা পেয়েছিলেন, আর কয়েকহাজার টাকা সংগ্রহ করতে পারলেই, প্রস্তর ধারণ করলেই তাঁর ফাঁড়া কেটে যেত। কিন্তু দুঃখের বিষয়, তা হল না। একেই বলে বিধির বিড়ম্বনা।
গ্রেপ্তারির পরে কর্মচারীটির বোন সাশ্রুয়নে বলেছেন, ‘আমার দাদা কখনওই ঘুষ খেত না। কখনওই এ রকম ছিল না। ওই হাত দেখাতে, ভবিষ্যৎ জানতে গিয়ে এই বিপদে পড়ল।’
খুব দুঃখের ব্যাপার হলেও সুকুমার রায়ের সেই বিখ্যাত ছড়াটি এই সূত্রে মনে পড়ে যাওয়া অস্বাভাবিক নয়। সেই কতকাল আগে ও পাড়ার নন্দখুড়ো আমাদের নন্দ গোঁসাইয়ের কথা লিখেছিলেন সুকুমার রায়।
ভালই ছিলেন নন্দখুড়ো, হুঁকো হাতে হাস্যমুখে। অমায়িক শান্ত বুড়ো, অসুখ-বিসুখ ছিল না। হঠাৎ কী হল, হাত দেখাতে গেলেন, ফিরে এলেন ঠকঠক করে কাঁপতে কাঁপতে, কাঁদতে কাঁদতে। খুড়োকে জিজ্ঞাসা করা হল, ‘কী হয়েছে নন্দ গোঁসাই? কাঁদছ কেন?’…
…খুড়ো বলে, বলব কি আর,
হাতে আমার স্পষ্ট লেখা
আমার ঘাড়ে আছেন শনি,
ফাঁড়ায় ভরা আয়ুর রেখা।
এতদিন যায়নি জানা
ফিরছি কত গ্রহের ফেরে
হঠাৎ আমার প্রাণটা গেলে
তখন আমায় রাখবে কে রে?
সংবাদপত্র দিয়েই যখন শুরু করেছি, আরেকবার সেখানে ফিরে যাই। কয়েক সপ্তাহ আগে সংবাদপত্রে পড়লাম কলকাতায় ‘জ্যোতিষ সম্মেলন’ হচ্ছে। সেখানে যুক্তিবাদীরা কয়েকটি প্রশ্ন তুলতে গিয়ে সম্মেলনের সংগঠকদের হাতে প্রহৃত হলেন। অনেকগুলো পত্রিকায় সম্মেলনের বিবরণ এবং গোলমালের বর্ণনা শুনে মনে হল সংগঠকেরা আগে থেকেই আক্রমণ করার জন্যে প্রস্তুত হয়েছিলেন।
পরে জানা গেছে যে, ওই সম্মেলনের উদ্যোক্তা জ্যোতিষীরা আগে থেকেই গ্রহ-নক্ষত্র বিচার করে জানতে পেরেছিলেন যে সম্মেলনে গোলমাল হবে এবং সেই জন্য তাঁরা যথাযথ ব্যবস্থা নিয়েছিলেন।
যাঁরা খবরের কাগজে এই সংবাদটি পাঠ করেছেন, জ্যোতিষ গণনার এ জাতীয় উৎকর্ষে নিশ্চয়ই তাঁরা যথেষ্টই চমকিত হয়েছেন। তবে এই পৃথিবীতে মন্দ লোকের অভাব নেই। তাঁরা সব কিছুই সন্দেহের চোখে দেখেন, সব কিছুতেই কটাক্ষ করেন।
সংবাদপত্রে এই খবর পাঠ করে জনৈক পাঠক একটি প্রশ্ন তুলেছেন। জ্যোতিষঠাকুরেরা শুধু শুধু যুক্তিবাদীদের মারধর করতে গেলেন। তাঁরা তো অনায়াসেই শনি কিংবা রাহু লেলিয়ে দিতে পারতেন যুক্তিবাদীদের ওপর। শনির কোপে, রাহুর দোষে যুক্তিবাদীরা ছারখার হয়ে যেতেন। অন্যথায় সরাসরি করতে পারতেন শনিধন যজ্ঞ, এ দাওয়াই অব্যর্থ, ‘মাত্র দুই সপ্তাহের মধ্যে শত্রু পরাস্ত হইয়া থাকে।’ পঞ্জিকায় দেখেছি, খরচও খুব বেশি নয়, ‘মাত্র নয়শত নিরানব্বই টাকা।’ তবে বিশেষ জরুরি হলে কিংবা শত্রু মহাপরাক্রমী হলে এই সঙ্গে ‘বগলামুখী কবচ’ ধারণ করলে ফল আরও জোরদার হত। বগলামুখী কবচের খরচও খুব বেশি নয়, মাত্র এক হাজার একশো এগারো টাকা।
পুনশ্চ:
আপনি জ্যোতিষ শিখতে চান?
জ্যোতিষ শাস্ত্রের প্রথম পাঠ আপনাকে শিখিয়ে দিচ্ছি নিতান্ত বিনামূল্যে। অবশ্য শিক্ষান্তে সন্তুষ্ট হলে আপনি আমাকে যে কোনও উপঢৌকন পাঠালে আমি আপত্তি করব না। তবে দয়া করে মন্ত্রপূত আংটি, কবচ বা মাদুলি পাঠাবেন না যেন, এসবে আমার বড় ভয়।
এবার জ্যোতিষের প্রথম পাঠ। যে কোনও ব্যক্তির হাত দেখুন।
দেখে তাঁকে বলুন, ‘আপনার শত্রুদের মধ্যে একজন আছেন, যাঁর নামের আদ্যক্ষর ইংরেজি (S)’, দেখবেন তিনি কেমন অভিভূত হন। কারণ বাঙালির শত্রুর অভাব নেই এবং অসংখ্য লোকের নামের আদ্যক্ষর এস। এ ক্ষেত্রেও ব্যতিক্রম হওয়ার কোনও কারণ নেই। মিলবেই মিলবে।