আবার এসো
শিশু না হলে এই মহাপূজার মহানন্দ পুরোপুরি উপভোগ করা যায় না। আমরা যারা অর্থনীতির দাস, জীবিকার জন্যে কোথাও না কোথাও মাথা বিকিয়ে বসে আছি, তারা টাকা-আনা-পাইয়ের হিসেব করবে না, ‘মা তুমি এলে’ বলে আনন্দে ঢাকের তালে-তালে নৃত্য করবে, নতুন জামাকাপড় পরে। কী যে করা যায়! প্রতি বছর এ এক মহা অশান্তি। ‘সংসারী মানুষের সঞ্চয় করা উচিত’—এই উপদেশ শুনতে-শুনতে কান পচে গেল। উত্তর উপদেশ; কিন্তু এই বাজারে সঞ্চয় হয় কী করে? এক মহাপুরুষ বলেছিলেন, ‘দ্যাখো বৎস, জীবনে তিনটি কাজ কখনও করবে না, এক, মুদিখানায় খাতা রাখবে না। দুই, ভাজা জিনিসে আসক্তি না এনে, সেদ্ধ জিনিস খাওয়ার প্রবণতা বাড়াবে। তিন, ঠিক কত টাকা তুমি রোজগার করো নিজের স্ত্রীকে কদাচ জানাবে না।’ তিনটি নিষেধই এ কান দিয়ে শুনেও কান দিয়ে বের করে দিয়েছি। প্রতি মাসেই মুদিখানার খাতা দেখে স্প্রিংয়ের পুতুলের মতো লাফিয়ে উঠি। প্রতিজ্ঞা করি, দেনা শোধ করে খাতা পুড়িয়ে দেব। সে আর হয় না। আবার মাথা বাড়িয়ে দি মুড়িয়ে দেওয়ার জন্যে। একটা সত্য হাড়ে-হাড়ে বুঝেছি, ধার কখনও শোধ করা যায় না। আমাদের শ্বাস-প্রশ্বাসের মতো। জন্মেই নিতে আরম্ভ করেছি, বন্ধ করার উপায় নেই। একবার যখন টেনেছি তখন টানা-ছাড়া করতে-করতে শেষ ছাড়া ছাড়তে হবে শেষের দিনে। এ মাসের টাকা শোধ করার পর নগদে কেনার মতো টাকা থাকে না।
যবে থেকে চাকরি-জীবন শুরু হয়েছে তবে থেকেই শুরু হয়েছে ভাজা। খাচ্ছি ভাজা। হচ্ছি ভাজা-ভাজা। ডাল, ভাত, আলুভাজা কোনওরকমে মেরে দিয়ে, ছোটো বাস কী ট্রেনের পেছনে। তা ছাড়া আমাদের মতো মধ্যবিত্তের প্রাণের বন্ধু হল অম্বল। পেটে ঢুকে আলুভাজা রেপসিড অয়েল ছড়াতে শুরু করল মৃদুমন্দ। অফিস, হাজিরা খাতা, লাল দাগ, তিন দাগে এক সি এল, গুঁতোগুঁতি ধ্বস্তাধ্বস্তি, চেয়ারে বসেই পয়লা কাপ চা, পেট ফুলে ঢোল প্রথমত, টিফিনে ঝালমুড়ি অথবা ভে-চপ কিম্বা ক্ষয়া-ক্ষয়া লুচি। রাত দশটা অবধি শান্তি। সকালের আহারে একখণ্ড পাঁপড় ঢোকাতে পারলে আরও ভালো ফল পাওয়া যায়। সিগারেটের অভ্যাস থাকলে সোনায় সোহাগা। রাতে এক জোড়া অ্যান্টাসিড ছাড়া আর কিছুর প্রয়োজন হবে না। ঝট করে আলসারটা কালচার করে ফেলতে পারলেই ইন্টেলেকচ্যুয়াল। কপালের দুপাশে সরে যাওয়া চুল, মাঝে কাঁচাপাকার বাহার। চালসে ধরা চোখে মোটা ফ্রেমের চশমা। মুখে খুঁতখুঁতে সমালোচনা। জাতে ওঠার এই জাতীয় সড়ক।
মানুষ যখন দু’মহল বাড়ির অধিবাসী ছিল, বারমহল আর অন্দরমহল, তখন স্ত্রীজাতি থেকে দূরে থাকার অসুবিধে ছিল না। একালের ফ্ল্যাটে তা সম্ভব নয়। চোখ এড়িয়ে সিনেমা পত্রিকা দেখারই উপায় নেই, তো আয় গোপন করা। খুব পাকা চোর না হলে নিজের আয় থেকে কিছু করা যায় না। একালের স্ত্রীরা হলেন শার্লক হোমসের স্ত্রী সংস্করণ। দৃষ্টি ঘ্রাণ উভয়ই দুরন্ত। বিচারবুদ্ধিও প্রবল। কী তোমার চাকরি, বেসিক, ডিএ, এইচ আর এ সব মুখস্থ। পালাবার পথ নেই পাঁচু। তাছাড়া স্ত্রীরা আমাদের অর্ধাঙ্গিনী নন, আমরাই তেনাদের অর্ধাঙ্গ। হাতে হাল ধরিয়ে দুশ্চিন্তার পাল তুলে বসে থাক। বেশি টেন্ডাই-মেন্ডাই করেছ কি মরেছ। হালে পানি পাবে না। স্ত্রীরা আমাদের দয়া করে পোষেণ বলেই বেঁচে আছি, তা না হলে কবে রস মরে বীরখণ্ডি হয়ে মায়ের ভোগে চলে যেতে হত। কেরোসিন তেল, র্যাশান, ইলেকট্রিক বিল, স্কুলে দিয়ে আসা নিয়ে আসা, মাইনে দেওয়া, রুমাল, জামার বোতামের খবর রাখা, কোথায় ‘সেল’ দিচ্ছে সন্ধান রেখে দাঁও মারতে ছোটা। ইলেকট্রিক লাইন মেরামতের জন্য মিস্ত্রী ধরা, ছাদে জল পড়ছে, আলকাতরা মাখানো চট পাতা। দেবী দশভূজা! অসুরের বুকে বাক্যবাণের খাঁচাটি বজায় রেখে সস্নেহ দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছেন। আমাদের পজিশান আর পোজ ঠিক আছে। অ্যাকসান নেই। বধ হয়েছি, মরিনি। ওদিকে মুদি আর এদিকে স্ত্রী মাথা মুড়িয়ে ছেড়ে দিলে। নিজেদের বিকিয়ে বসে আছি।
শরতের নীল আকাশ, কাশফুলের ছবি, দূর থেকে ভেসে আসা ঢাকের বদ্যি চোখেও পড়ে না, কানে ঢোকে না। ছ-বার হাঁচলে বুঝতে পারি ঋতু পরিবর্তন হচ্ছে। বেমক্কা কেনাকাটা শুরু হলে বুঝতে পারি এসে গেল পুজো। দেওয়ার মতো আনন্দ আর কিছুতে নেই। রঙিন একটা জামা পরে শিশু হাসছে। নতুন জুতো জোড়া বালিশের পাশে রেখে কিশোর ঘুমোতে যাচ্ছে। পেছন থেকে বালা পরা কচি-কচি হাত দিয়ে গলা জড়িয়ে ধরে শিশুকন্যা আবদার করছে, এক শিশি কুমকুম। প্রিয়জন শাড়ির আঁচলা মেলে ধরে হাসি-হাসি মুখে বলছে, বা:, খুব সুন্দর হয়েছে। তার যে কী আনন্দ! প্রিয়জনের মুখে হাসি ফোটানো এক জিনিস। তোমরা সবাই হাসো, তোমাদের সঙ্গে আমিও হাসি।
প্রবাসী দাদা এই সময়ে সপরিবারে আসবেন। দাদা পিতার সমান। ভাইঝিটা ভারী সুন্দর হয়েছে। বছরে একবারই দেখা হয়। ছিল এতটুকু! দেখতে দেখতে মহিলা! ফ্রক ছেড়ে শাড়ি ধরেছে। চোখে কালো ফ্রেমের চশমা। মুখে অমলিন হাসি। ধীর স্থির মৃদুভাষী। লেখাপড়ায় কৃতী। বাবা নিজে পছন্দ করে বউদিকে এনেছিলেন। তাঁর পছন্দের তারিফ করতে হয়। প্রবাসী বলেই বাংলার পুজোর এত টান। রোজ অঞ্জলি দিতে পাড়ার পুজো প্যান্ডেলে ছুটবে। স্নান-পবিত্র মূর্তি। ফিরে আসবে কপালে এতখানি একটা সিঁদুরের টিপ নিয়ে। তখন মনে হবে দেবী তুমি প্যান্ডেলে অনড় প্রতিমা, না গৃহে সচলা। কোমরে আঁচল জড়িয়ে লেগে যাবে রান্নাঘরে। কত রকমের রান্নাই যে জানে! খুশির রান্না আর কর্তব্যের রান্নায় অনেক পার্থক্য। দিন দশেকের জন্যে যৌথ পরিবারের প্রাচীন সুখ ফিরে আসবে। বাবার কথা, মায়ের কথা, ছোট বোনটার কথা মনে পড়বে। তাঁরা ছিলেন, ছিন্নভিন্ন আমাদের রেখে চলে গেছেন। দাদার বাজারের শখ। রোজ সকালে আমার সঙ্গে বাড়ি থেকে বেরবে। ধোপ দুরস্ত পাঞ্জাবি পরে। যেতে-যেতে পুরোনো মানুষদের খবর নেবে। তাঁরা কোথায় আছেন? কেউ নেই। নতুন-নতুন সব বাড়ি উঠেছে। নতুন জীবন। যা কিছু পুরোনো, ধীরে-ধীরে সব হারিয়ে যাচ্ছে। প্রাচীন বসতবাড়ির হাতবদল হচ্ছে। নতুন ধনী মানুষেরা নতুন মূল্যবোধের পতাকা ওড়াচ্ছে। স্বজাতি হয়েও তারা যেন বি-জাতি। তাঁদের চলন-বলন, ভাব-ভাবনা, আমোদ-প্রমোদ সবই ভিন্ন ধরনের।
বাজারে নতুন ফুলকপি উঠেছে। কচি পালং। নতুন মূলো। মাঝের বাজারে অতি প্রাচুর্য নেই। পুরোনো আমলের, শান্ত মেজাজের বেপারিরা নেই। রাগি ছোকরারা বসে আছে। তারা হাসে না। কথা কম বলে। মাঝে-মাঝে ধমকায়।
খাওয়াদাওয়া সারতে সারতেই শীতের মুখের ছোট বেলা শেষ হয়ে আসবে। দিনান্তের ক্লান্ত পাখি অলস ডানা ঝাড়বে। বারান্দার ইজি চেয়ারে দাদা পুজোসংখ্যা খুলে বসবেন। জিগ্যেস করবেন, বল কার লেখাটা আগে ধরব? দূর থেকে মাঝে মাঝে ভেসে আসবে ঢাকের শব্দ। মাইকের গান। ভাইঝি একপাশে দাঁড়িয়ে চুল শুকোবে। বউদি আসবে পান চিবোতে-চিবোতে। তখন একটি কথাই মনে আসবে, মা আমাদের জন্যে অতীতকে ফিরিয়ে আনেন। আনন্দে ক্ষণমিলন সুখ।
পুজোসংখ্যা কোলের ওপর খোলাই পড়ে থাকে। অতীতের কথা হতে থাকে। মা কীরকম ঘুগনি করতেন। কে সবার আগে বিজয়া করতে আসত। লক্ষ্মীপুজোর চন্দ্রপুলী। তালের ফোঁপল কাটা কী কষ্টকর! সিদ্ধি খেয়ে আমরা একবার কী করেছিলাম! দশমীর দিন আমাদের কুকুরটা মারা গিয়েছিল। বউদি বসে থাকবে পা মুড়ে। দেখতে-দেখতে সূর্য নেমে আসবে আরও নীচে। দাদার মুখের বাঁ-পাশে নিস্তেজ রোদের রেখা পড়বে। উত্তর থেকে বয়ে আসবে শীত-শীত বাতাস। দূর আকাশের দিকে তাকালে মনে হবে, ঝাঁক-ঝাঁক সাদা পাখির মতো শীত আসছে পাহাড়ের আশ্রয় থেকে উড়ে-উড়ে। আকাশ প্রদীপ আকাশ ছোঁবে। দীপাবলীর মালা পরবে শহর দূর্গা হবেন শ্যামা। ত্বকে শীতের টান ধরবে। জল ঢাললে গা ছ্যাঁকছ্যাঁক করবে। রোদ হয়ে উঠবে কমলালেবুর মতো মিষ্টি। দিনের আলো নিবে গেলে দীপমালায় সেজে উঠবে শহর। তারার আকাশে এক ফালি কুমড়োর মতো লেগে থাকবে সপ্তমীর চাঁদ। মেয়েদের সাজগোজ শুরু হবে। এই কটা দিন মনেই হবে না আমরা হা-অন্ন নিরন্নের দেশে বাস করছি। চারপাশে রং শুধু রং। দু:খের মুখে সুখের প্রলাপ।
ঝগড়াঝাঁটি, মামলা-মোকর্দমা সবই আপাতত স্থগিত। র্যাশানের দোকানের সামনে বিশাল লাইন, কেরোসিনের জন্যে টিনবাদ্য সবই মনে হবে মধুর। ঢালাও উৎসবে সব তিক্ততাই সহনীয় হয়ে উঠবে। একই সঙ্গে শোনা যাবে, রবীন্দ্র সংগীত, হিন্দি ফিল্মি গান আর ঢাকের বাদ্যি। যত রাত বাড়বে, তত লোক বাড়বে পথে। জঞ্জাল, আবর্জনা, খানাখন্দ যেমন আছে, যেভাবে আছে, থাক পড়ে। পায়ে-পায়ে শুধু চলা। নতুন জুতো ফোসকা ফেলেছে, সেও আনন্দের। রাজনীতির থাবা আপাতত শিথিল, বিদ্যুতের মুষ্টিভিক্ষা এই কটি দিনের জন্যে ধনবানের দানসাগর। তামসিক নিদ্রা চোখের আসন ছেড়ে বিদায় নিয়েছে। ভাঙা-চোরা সব মুখই আলোয় উজ্জ্বল। মণ্ডপে-মণ্ডপে মাটির প্রতিমা সত্যিই জীবন্ত হয়ে উঠেছেন। দুটি চোখে তাঁর বিদ্যুৎ। পদতলে অসুর প্রকৃতই কাতর। এই আনন্দের দিনেও শ্মশান কিন্তু খালি যাবে না। মৃত্যুর ছুটি নেই। চিতায় উঠবে এক বধূ অথবা কোনও এক শিশু। জীবনের শেষ পুজোর শেষ পোশাকটি পরিয়ে দেওয়া হয়েছে অগ্নিসমর্পণে। কান্নারও আর সে জোর নেই। দু:খও তরল হয়ে গেছে। নাতির হাত ধরে বৃদ্ধ এসেছেন প্রতিমা দর্শনে, মনে মনে ভাবছেন, সামনের বার আর কী দর্শন হবে? নাতির প্রশ্নবানে জর্জরিত। থাকার আবেগে না থাকার শূন্যতা ভরে উঠছে। মৃত্যুর সিংহদুয়ারে দাঁড়িয়ে মনে পড়ে যাচ্ছে শিশু ভোলানাথের কথা। সব দৃষ্টিই মায়ের দিকে। এদিকে কারুর দৃষ্টি থাকলে, জীবনের তিল-তিল পরিণতি স্পষ্ট হত। আজ শিশুকালে সেই পরিণত বিদায়ী বৃদ্ধ। এক রাশ ঝরা ফুলের মতো পায়ের তলায় পড়ে আছে জীবনের ঝরা দিন।
এই শহরেরই একপ্রান্তে আছেন আমারই এক বৃদ্ধা আত্মীয়া। সাবেককালের নোনাধরা বাড়িতে নি:সঙ্গ জীবন। এককালে কী বোলবোলাই না ছিল! রূপও ছিল তেমনি। জুড়িগাড়ি চেপে গঙ্গাস্নানে যেতেন। রোজ সকালে আস্ত একটি রুইমাছ পড়ে থাকত রান্নাঘরের রকে। সে মাছের আকার-আকৃতি দেখে বেড়ালও থমকে থাকত ভয়ে দূরে। পরিবারের বড় আদরের বধূ ছিলেন তিনি। আভিজাত্য আছে। অর্থ নেই। প্রিয়জনেরা বিদায় নিয়েছেন একে-একে। স্মৃতি আছে ছবি হয়ে। কণ্ঠস্বর নেই। পিছনে ফেরে নিজেরই পদশব্দ, বিশ্বস্ত সঙ্গীর মতো। বড় আনন্দে রেখেছিলেন বৃদ্ধার স্বামী। নিত্য নতুন শাড়ি পরাতেন। প্রজাপতির মতো ঘুরে বেড়াবে এ-ঘরে ও-ঘরে। বেনারস থেকে জর্দা আনিয়ে দিতেন। কথা বললেই সুন্দর গন্ধ! সেই বাড়ির সব ঘরে এখন আর আলো জ্বলে না, আঁচলের আড়ালে সন্ধ্যার প্রদীপ হাতে বৃদ্ধা ঘরে-ঘরে ঘুরে বেড়ান। নিজেরই ছায়া কাঁপতে থাকে দীর্ঘ হয়ে দেওয়ালে। দুই সন্তান বিয়ের পর বউ নিয়ে আলাদা। মাসে-মাসে কিছু মাসোহারা পাঠায়। একালে কর্তব্যের নতুন ব্যাখ্যা এই হয়েছে। সেই বৃদ্ধার কাছে ইঞ্চিপাড় একটি শাড়ি আর এক বাক্স মিষ্টি হাতে পুজোর আগে যাওয়া এক বিচিত্র অভিজ্ঞতা। নি:সঙ্গতা, দু:খ তাঁকে ম্লান করতে পারেনি। কারুর প্রতি কোনও ক্ষোভ নেই, অভিযোগ নেই। জীবনে সুখের মাত্রা এত বেশি ছিল দু:খকে দু:খ বলে মনে হওয়ার আগেই জীবন শেষ হয়ে যাবে।
সন্ধ্যার মুখে তাঁর বাড়িতে যাব। ধ্যানস্থ প্রাচীন বাড়ি। কার্নিশে বটের ঝুরি ঝুলছে। নোনা লেগে খসে পড়েছে দেওয়ালের পলেস্তারা। মৃদু করাঘাতেই প্রাচীন কপাট উন্মুক্ত হবে। সচল প্রস্তর মূর্তির মতো সামনেই সেই বৃদ্ধা। চোখে রূপোর ডাঁটির চশমা। মুখে প্রসন্ন হাসি। জীবিত কোনও মানুষকে দেখার কী আনন্দ! মধ্যবিত্তের কায়ক্লেশ উপার্জনে কেনা সামান্য একটি কাপড়, এক বাক্স মিষ্টি, এমন কোনও মূল্যবান উপহার সামগ্রী নয়, মন দিতে চায় অনেক কিছু, সামর্থে কুলোয় না। তারপর এও ভাবি টাকার অঙ্কে সব আবেগ কি প্রকাশ করা যায়! সমস্ত প্রয়োজনের উর্ধে যিনি চলে গেছেন তাঁর কাছে উপহারের বিচার মূল্যে নয়। সংগ্রহে হাত পেতে নেবেন তিনি। ভাব দেখাবেন খুশি হয়েছেন তিনি। সে শুধু আমার লজ্জা ঢাকার জন্যে। স্নেহ আর আশীর্বাদ ছাড়া আমাকে তাঁর দেওয়ার কিছু নেই। জীবনে বহুমূল্য দুটি জিনিস। অর্থে যা কেনা যায় না। ফিরে আসার সময় চকিতে মনে হবে, সামনের বার আর কি দেখা হবে?
দেখতে-দেখতে দাদার ছুটির দিন শেষ হয়ে যাবে। শুরু হবে বাঁধা-ছাঁদা যেখানে যা ছড়ানো-ছেটানো ছিল একে-একে সবই উঠে যাবে। দাদা, বউদি, ভাইঝি তিনজনের চোখই ছলছল করবে। গাড়িটা পথের বাঁকে অদৃশ্য হয়ে যাবে। শেষ বাঁক নেওয়ার আগে পর্যন্ত তারা ফিরে-ফিরে তাকাবে। বাড়ি একেবারে ফাঁকা। এত ফাঁকা যে চড়াইয়ের কিচকিচ ডাক শোনা যাবে!
হাট ভাঙা সংসারের শূন্য বিছানায় মাঝরাতে শুয়ে মনের চোখে দেখব, বন-পাহাড়ের পাশ দিয়ে এঁকেবেঁকে ট্রেন চলেছে দূর থেকে দূরে। এ ট্রেন বছরে একবার আসে, একবার যায়। দু-প্রান্তে দুটি স্টেশন। এ-প্রান্তের স্টেশনের নাম প্রিয়জন, ও প্রান্তের নাম প্রয়োজন।