আবার আবার সেই কামান গর্জন!

আবার আবার সেই কামান গর্জন!

খুন করার পরেই খুনির প্রধান সমস্যা, মড়াটা নিশ্চিহ্ন করবে কী প্রকারে? সমস্যাটা মান্ধাতার চেয়েও প্রাচীন। আমাদের প্রথম পিতা আদমের বড় ছেলে কাইন তার ছোট ভাই আবেলকে খুন করেন। তাঁর সামনেও তখন ওই একই সমস্যা, মৃতদেহটা নিয়ে করবেন কী? সাধারণ সাদামাটা বুদ্ধি খাঁটিয়ে তিনি সেটাকে পুঁতে ফেললেন মাটির ভেতর। কিন্তু মাটিকে আমরা মা-টিও বলি; তিনি সইবেন কেন এক পুত্রের প্রতি অন্য পুত্রের এরকম নৃশংসতা। তাই পরমেশ্বর কাইনকে বললেন, এ তুমি করেছ কী? মাটির (মা ধরণীর) তলা থেকে তোমার ভাইয়ের রক্ত যে আমাপানে চিৎকার করছে। অর্থাৎ মাটিতে পুঁতেও নিস্তার নেই। তাই পৃথিবীর একাধিক ভাষাতে এটা যেন প্রবাদ হয়ে গিয়েছে। সন্দেহবশত গোর খুঁড়ে লাশ বের করে পোস্টমর্টেমের ফলে যখন ধরা পড়ে লোকটার অস্বাভাবিক মৃত্যু হয়েছিল তখন ওইসব ভাষাতে বলা হয়, মৃতের রক্ত বা মা ধরণী মাটির তলা থেকে চিৎকার করছিল প্রতিশোধের জন্য। (১,২)  

খুন-খারাবির ইতিহাস যারা পড়েছেন তারাই জানেন লাশ গায়েব করার জন্য যুগ যুগ ধরে খুনি কত-না আজব-তাজ্জব কায়দাকে বের করেছে। অবশ্য খুনি যদি ডাক্তার হয় (না পাঠক, ডাক্তার-বদ্যি-হেকিম চিকিৎসার অছিলায় যে খুন করে তার কথা হচ্ছে না) তবে তার একটা মস্ত বড় সুবিধা আছে। বছর বিশেক পূর্বে বিলাতবাসী এক কালা-আদমি সারজন তার মেম বউকে খুন করে। বাথটাবে লাশ ফেলে সেটাকে ডাক্তারি কায়দায় টুকরো টুকরো করে কেটে ড্রইংরুমের চিমনিতে ঢুকিয়ে দিয়ে সচহ্ লাশটা পুড়িয়ে ফেলে। কিন্তু পাক প্রণালীতে করল একটা বেখেয়ালির ভুল। তখন ভর গ্রীষ্মকাল– ড্রইংরুমে আগুন জ্বালাবার কথা নয়। দু-একজন প্রতিবেশী ওই ঘরের চিমনি দিয়ে যে ধুয়ে উঠেছে সেটা লক্ষ করল। ডাক্তারের বউ যে হঠাৎ গায়েব হয়ে যায়, সে যে মাঝে মাঝে ডাইনে-বাঁয়ে সাইড-জাম্প দিত, স্বামী-স্ত্রীতে যে ইদানীং আছারই বেহদ্দ ঝগড়া-ফসাদ হত এসব তত্ত্ব পাড়াপড়শির অজানা ছিল না। পুলিশ সন্দেহের বশে সার্চ করে চিমনিতে ছোট্ট ছোট্ট হাড় পেল, চানের টাটা যদিও অতিশয় সযত্নে ধোওয়া-পোছা করা হয়েছিল তবু সূক্ষ্ম পরীক্ষা করে মানুষের রক্তের অভ্রান্ত চিহ্ন পাওয়া গেল।… মোদ্দা ডাক্তারকে ইহলোক ত্যাগ করার সময় মা ধরণীর সঙ্গে সমান্তরাল (হরাইজনটাল) না হয়ে লম্বমান (পারপেনডিকুলার) হয়েই যেতে হয়েছিল।

অবশ্য ডাক্তারের ফাঁসি হওয়ার পর তার আপন লাশ নিয়ে কোনও দুশ্চিন্তার কারণ ছিল না– কারওরই। যে সরকারি কর্মচারী, অশ্লীল ভাষায় যাকে বলে ব্যাঙম্যান, ডাক্তারের গলার প্রয়োজনাতীত দীর্ঘ প্রয়োজনাধিক দৃঢ় একটি নেটাই সযত্নে পরিয়ে ডাক্তারের পায়ের তলায় টুলটি হঠাৎ লাথি মেরে ফেলে দেয় সে এই অপকর্মটি করেছিল জজ-সাহেবের আদেশে, সামনে ওই ডাক্তারেরই পরিচিত আরেক ডাক্তারকে এবং জেলার সায়েবকে সাক্ষী রেখে। শুনেছি, এদেশের সরকারি ফাঁসুড়ে আসামির গলায় দড়ি লাগাবার সময় তাকে মৃদুকণ্ঠে বলে, ভাই, আমার কোনও অপরাধ নিও না; যা করছি সরকারের হুকুমে করছি। ইয়োরোপীয় ফাঁসুড়েদের এরকম ন্যায়ধর্ম-জাত কোনও সূক্ষ্মানুভূতি নেই। সেখানে ফাঁসুড়ে তার মজুরির ওপর ফাঁসির দড়াটা বকশিশ পায়, এবং সে সেটা ছোট ছোট টুকরো করে পাড়া-প্রতিবেশীর কাছে আক্ৰাদরে বেচে ফাঁসির দড়ি নাকি বড় পয়মন্ত।

কিন্তু সরকার, রাজা বা ডিটেটর যেখানে বেআইনি খুন করে সেখানে এদের সামনেও সেই সমস্যাই দেখা দেয়। যখন পাইকিরি হিসেবে খুন করা হয় তখন দেখা দেয় আরও দুটি সমস্যা :

১. যাদের খুন করা হবে তাদের মনে সন্দেহ না জাগিয়ে কী প্রকারে তাদের একজোট করা যায়?

২. খুন করার জন্য অল্প খরচে অল্প সময়ে কী প্রকারে বিস্তর লোকের ভবলীলা সাঙ্গ করা যায়?

জর্মন মাত্রই স্ট্যাটিস্টিকসের ভক্ত। একশোটি মেয়েছেলের মধ্যে যদি নব্বইটি কুমারী হয়, এবং দশটি গর্ভবতী হয় তবে তারা টরেটক্কা হিসাব করে বলে এই একশোটি মেয়ের প্রত্যেকটি নব্বই পারসেন্ট অক্ষতযোনি কুমারী এবং দশ পারসেন্ট গর্ভবতী।

হিটলার এই ন্যায়শাস্ত্র অবলম্বন করে বললেন, নব্বই পারসেন্ট তো ইহুদি বাদবাকি দশ পারসেন্ট জিপসি, পাগল (বসে বসে শুধু খায়, লড়াইয়ের ব্যাপারে কোনও সাহায্যই করে না) ইত্যাদি। ওই হল!–জিপসি ও নব্বই পারসেন্ট ইহুদি। হিসাবে মিলে গেল।

দেখা গেল, হিটলারের তাঁবেতে ১৯৪১-৪২ সালে যেসব রাষ্ট্র এসেছে এবং আসছে তাতে আছে প্রায় আশি লক্ষ ইহুদি এখানে আমি জিপসি, পাগল, রুশ, হিটলারবৈরী ফরাসি-জর্মন-রুশ ইত্যাদিকে বাদ দিচ্ছি। হিটলার ডাকলেন হিমলারকে। ইনি পুলিশ, সেকুরিটি, ইনটেলিজেন্স, হিটলারের আপন খাস সেনাদল (এরা দেশের সরকারি সৈন্য-বিভাগের অংশ নয়) কালো কুর্তিপুরা এস এস এবং আরও বহু সরকারি বেসরকারি প্রতিষ্ঠানের সর্বাধিকারী ফুরার। হিটলার একেই হুকুম দিলেন চালাও, ক-ই-আম্! অর্থাৎ পাইকারি কচুকাটা! নাদির-তিমুর যখন দিল্লিতে এই পদ্ধতির প্রবর্তন করেন তখন কৎল-ই-আমই করেছিলেন। আম= সাধারণ (দিওয়ান-ই-আম তুলনীয়) আর কৎল= কতল। অবশ্য নাদির-তিমুর কল-ই-আম্ করেছেন প্রকাশ্যে, হিটলার-হিমলার করলেন অতিশয় সঙ্গোপনে।(৩) বস্তুত হিমলার ও তার সাঙ্গোপাঙ্গ যে সতর্কতা অবলম্বন করেছিলেন সেটা যেমন অভিনব এবং জটিল তেমনি ক্রুর এবং মোক্ষম। তদুপরি বাইরের থেকে তাবৎ ব্যাপারটা যেন করুণাময়ের স্বহস্তে নির্মিত নিষ্পাপ কবুতরটি; ভিতরে ছিল শয়তানের সাঙাৎ কালকূটে-ভরা বেইমান, অশেষ পাপের পাপী পঞ্চম পাতকী তার চেয়ে বেশি পাপী বিশ্বাসঘাতকী, কালনাগিনী। এ এক অভিনব সমন্বয় : বাইরে কবুতর, অন্তরে বিষধর।

পূর্বেই বলেছি, প্রথম সমস্যা : তাবৎ ইহুদি একত্র করা যায় কোন পদ্ধতিতে? এই মর্মে একটি গোপন সভা আহ্বান করলেন হিমলারের ঠিক নিচের পদের কর্তা হাইডেরিষ বার্লিনের উপকণ্ঠে তার সৌখিন ভিলা ভানজে-তে। এ-সভায় আইষমানকেও ডাকা হয়, যদিও পদগৌরবে তিনি এমন কেষ্টবিষ্ট ছিলেন না। কিন্তু হাইডেরিষ ছিলেন সত্যিকার আদম-শনাস মানুষের জৌরি তিনি জানতেন আইষমান তালেবর ছোকরা, যতই ঝুটঝামেলার ঝকমারি ব্যাপার হোক না কেন, সেটার বিলিব্যবস্থা করে সবকিছু ফিটফাট করে নিতে সে পয়লা নম্বরি। সেই সুদূর স্তালিনগ্রাদ থেকে ফ্রান্সের পূর্ব উপকূল, ওদিকে নরওয়ে থেকে উত্তর আফ্রিকা অবধি সর্বত্র ছড়িয়ে আছে ইহুদিগোষ্ঠী। আইষমানের ওপর ভার পড়ল আড়কাঠি হয়ে এদের কয়েকটি কেন্দ্রে জড়ো করা।

আইষমান সম্বন্ধে বাংলাতেও বই বেরিয়েছে; কাজেই তার সম্বন্ধে আমাকে বিশেষ কিছু বলতে হবে না। শুধু একটি কথা এখানে বলে রাখি; বাংলা বইয়ে আছে আইষমান পাঁচ লক্ষ ইহুদির মৃত্যুর জন্য দায়ী। এটা বোধহয় স্লিপ। পাঁচ লক্ষ নয়, হবে পাঁচ মিলিয়ন অর্থাৎ পঞ্চাশ লক্ষ।

শব্দার্থে ছলে বলে এবং কৌশলে আইষমান যেভাবে ইহুদিদের জড় করেছিলেন সেটা এত সুচারুরূপে আর কেউ সম্পন্ন করতে পারত না একথা তাবৎ নাৎসি, অ-নাস সবাই একবাক্যে স্বীকার করেছেন।

অনেকেই প্রশ্ন জিগ্যেস করেন, আড্ডা–ইহুদিদের প্রতি হিটলারের এই যে আক্রোশ এর তো তুলনা পাওয়া ভার। এর কারণটা কী?

এর উত্তর দিতে হলে তিনভলুমি কেতাব লিখতে হয়। খ্রিস্টধর্ম প্রবর্তনের কিছুকাল পর থেকেই আরম্ভ হয় খ্রিস্টান কর্তৃক ইহুদি নিপীড়ন (এবং এরাই সর্বপ্রথম নয়– সেই খ্রিস্টজন্মের হাজার তিন বছর আগে থেকে পালা করে, মিশর, আসিরিয়া, ব্যাবিলনিয়া, রোমান সবাই এদের ওপর অত্যাচার করেছে)। মধ্যযুগে স্পেনে একবার এক লক্ষ ইহুদিকে খেদিয়ে আফ্রিকায় ঠেলে দেওয়া হয়, এবং হাজার হাজার ইহুদিকে স্রেফ ধর্মের নামে খুন করা হয়।

কিন্তু হিটলার তো খ্রিস্টান কেন, কোনও ধর্মেই বিশ্বাস করতেন না। পারলে তিনি এ সংসারে কোনও ধর্মেরই অস্তিত্ব রাখতেন না।

হিটলার ইহুদিদের বিরুদ্ধে মাঝে-মিশেলে যুক্তিতর্কের অবতারণা করতেন কিন্তু সেগুলো আকছারই পরস্পরবিরোধী। একদিকে বলতেন, ইউরো-আমেরিকার অধিকাংশ ক্যাপিটাল ইহুদিদের হাতে–যত বেকার সমস্যা, যত রক্তাক্ত বিপ্লব, যত যুদ্ধ ইউরোপে হচ্ছে তার পিছনে রয়েছে ইহুদি পুঁজিপতি। আবার একই নিশ্বাসে বলতেন, যে রুশ-কম্যুনিজম ইউরোপের সভ্যতা সংস্কৃতি ধনদৌলত সমূলে বিনাশ করার জন্য উঠেপড়ে লেগেছে তার আগাপাশতলা ইহুদি প্ররোচনায়। অর্থাৎ ইহুদি একাধারে কম্যুনিস্ট এবং ক্যাপিটালিস্ট। এবং যারা তার একমাত্র বই মাইন কাপ (মাই স্ট্রাগল-এর ঠিক ঠিক অনুবাদ নয়– আমার জীবনসংগ্রাম বললে অনুবাদটা মূল জর্মনের আরও কাছাকাছি আসে। মোদ্দা আমি আমার জীবন আদর্শ বাস্তবে পরিণত করার জন্য সর্বপ্রকার বাধা-বিপত্তি সর্ব দুশমনের সঙ্গে যে লড়াইয়ের পর লড়াই যুঝেছি তার ইতিহাস) পড়েছেন তারা জানেন তিনি তার সিদ্ধান্তে দলিলপত্র পেশ করে কখনও সপ্রমাণ করেননি, করবার চেষ্টা দেননি। এর কারণটি অতিশয় সরল।

ইহুদি যে এ পৃথিবীর সর্ব দুঃখের কারণ এটা হিটলারের কাছে স্বতঃসিদ্ধ টেনেট অব ফেৎ (অন্যতম মৌলিক বিশ্বাস)। খ্রিস্টান-মুসলমান যেরকম যুক্তি-তর্কের অনুসন্ধান না করে সর্ব সত্তা দিয়ে বিশ্বাস করে ইহসংসারের সব পাপ সর্ব দুঃখ সর্ব অমঙ্গলের জন্য শয়তানটাই দায়ী, হিন্দু যেমন বিশ্বাস করে মানব-জাতির সর্ব যন্ত্রণার জন্য তার পূর্বজন্মকৃত কর্মই দায়ী, ঠিক তেমনি হিটলার তার সর্ব অস্তিত্ব দিয়ে বিশ্বাস করতেন বিশ্বভুবনজোড়া সর্ব অশিবের জন্য ইহুদি জাতটা দায়ী– অন্ধ খঞ্জ বৃদ্ধ অবলা শিশু ইহুদি, সব সব, সবাই দায়ী। তার অন্তরঙ্গ জনকে তিনি অসংখ্যবার বলেছেন ইহুদিকুল ছারপোকা-ইঁদুরের মতো প্রাণী (ভারমিন), ছারপোকা ধ্বংস করার সময় তো কোনও করুণা-মৈত্রীর কথা ওঠে না, ইঁদুরের বেলাও কোনটা ধেড়ে কোনটা নেংটি সে প্রশ্নও অবান্তর।

এ-কথা সত্য আমরা ছারপোকা নির্বংশ করার সময় কোনও বাছবিচার করিনে; এবং যে কোনও প্রকারের প্রাণীহত্যা করলেই যে এদেশের কোনও কোনও সম্প্রদায় আমাদের খুনি বলে মনে করেন সে তত্ত্বও আমাদের অজানা নয়। তৎসত্ত্বেও প্রশ্ন থেকে যায়, সত্যিই মানুষে-ছারপোকাতে কোনও পার্থক্য নেই? এদিকে আবার বহু খ্রিস্টান সাধুসজ্জন ইহুদি-ছারপোকাতে পার্থক্য করতেন বটে কিন্তু সেটা সামান্যই। আমি কাইন এবং আবেলের যে বাইবেল কাহিনী দিয়ে এ নিবন্ধ আরম্ভ করেছি সেটাকে রূপকার্থে নিয়ে ওইসব সাধুসজ্জন কাইনকে ধরেন ইহুদিদের সিনাগগ (ধর্ম প্রতিষ্ঠান) রূপে এবং আবেলকে খ্রিস্ট চার্চরূপে অর্থাৎ ইহুদি তার আপন ধর্মবিশ্বাস দ্বারা প্রবুদ্ধ হয়ে যেখানে খ্রিস্টানকে খ্রিস্টধর্মকে পায় সেখানেই তাকে নিধন করে। ইহুদি ভ্রাতৃহন্তা, সে বিশ্বগ্ন।…পাঠক স্বপ্নেও ভাববেন না, আমি হিটলারের ইহুদি নিধন সমর্থন করছি। আমি এ প্রবন্ধ লিখছি অন্য উদ্দেশ্য নিয়ে এবং এ স্থলে আমি শুধু তার বিশ্বাসের পটভূমিটির প্রতি ইঙ্গিত করছি; তার মতো আরও বহু বিশ্বাসী যে পূর্ববর্তী যুগেও ছিলেন তারই প্রতি ইঙ্গিত করছি।

তা সে যাই হোক, এইসব ইহুদিদের এক জায়গায় জড় করতে মোটেই বেগ পেতে হয়নি— ছারপোকাতে-ইহুদিতে ওইখানেই তফাৎ, ছারপোকা এক জায়গায় জড় করতে পারলে তো আর্ধেক মুশকিল আসান! গ্রামে গ্রামে শহরে শহরে ইহুদি মুরুব্বিদের বলা হত, তাবৎ ইহুদি পরিবার যেন এক বিশেষ জায়গায় জড় হয়। তাদের ভিন্ন ভিন্ন জায়গায় কলোনি পত্তন করা হবে। তার পর ট্রেনে-মোটরে করে কন্‌সেনট্রেশন ক্যাম্পে নিয়ে গিয়ে তাদের দিয়েই একটা লম্বা নালা খোঁড়ানো হত। তার পর আদেশ হত, নালার প্রান্তে গিয়ে দাঁড়াও। একদল এস এস (ব্ল্যাক শার্ট–হিটলারের খাস সেনাবাহিনী) পিছন-থেকে গুলি করত। অধিকাংশ ইহুদি গুলির ধাক্কায় সামনের নালাতে পড়ে যেত। বাকিদের লাথি মেরে মেরে ঠেলে ঠেলে নালাতে ফেলা হত। সবাই যে সঙ্গে সঙ্গে মরে যেত তা নয়– সবসময় তাগ অব্যর্থ হয় না। এদের কেউ কেউ নালা থেকে হাত তুলে বোঝাবার চেষ্টা করত তারা মরেনি–উদ্ধার লাভের জন্য চিৎকারও শোনা যেত। ওদিকে দৃপাত না করে তাদের উপর নালার মাটি ফের নালাতে ফেলা হত এবং সর্বশেষে তার উপর স্টিমরোলার চালিয়ে দিয়ে মাটিটা সমতল করা হত।

নালা খোঁড়া, তার উপর ফের মাটি ফেলা এ-সব কাজের জন্য ইহুদিই জোগাড় করার জন্য কোনও বেগ পেতে হয়নি। একদল ইহুদিকে এই নিধনকর্মটি দাঁড় করিয়ে দেখানোর পর বলা হত তারা যদি গুলি করা ছাড়া অন্য সর্ব কার্যে, সহায়তা করে তবে তারা নিষ্কৃতি পাবে।… বলাই বাহুল্য এরা নিষ্কৃতি পায়নি। আখেরে ওরা ওই একই পদ্ধতিতে প্রাণ হারায়– সাক্ষীকে ছেড়ে দেওয়া কোনও স্থলেই নিরাপদ নয়।

এইসব নিহতজনের অধিকাংশই বুড়োবুড়ি, ছেলেমেয়ে, কোলের শিশু এবং রুগ্‌ণ অসমর্থ যুবক-যুবতী। সমর্থদের বন্দিদশায় একাধিক বড় বড় কারখানায় বেগার খাটার জন্য নিয়ে যাওয়া হত। আখেরে, অর্থাৎ ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে, যুদ্ধশেষের কিছুদিন পূর্বে এদেরও মেরে ফেলা হয়। যুদ্ধপূর্ব জর্মনিতে ছিল ৫,৫০,০০০ ইহুদি, যুদ্ধশেষে রইল ৩০,০০০। পোলান্ডের সংখ্যা বীভৎসতর; যুদ্ধপূর্বে সেখানে ছিল তেত্রিশ লক্ষ, যুদ্ধশেষে মাত্র ত্রিশ হাজার। এবং আশ্চর্য এই, ত্রিশ হাজারের চোদ্দআনা পরিমাণ লোক আপন দেশ ছেড়ে পুণ্যভূমি ইহুদি স্বর্গ ইজরাএলে যেতে রাজি হয়নি। অনেকেই বলে, জর্মনি আমার পিতৃভূমি (ফাটেলান্ট), এদেশ ছেড়ে আমি যাব কেন? যে পিতৃভূমিতে সে তার অধিকাংশ আত্মজন হারাল তার প্রতি এই প্রেম প্রশংসনীয় না কাণ্ডজ্ঞানহীন একগুঁয়েমির চুড়ান্ত– জানেন শুধু সৃষ্টিকর্তা!

আমি বর্ণনাটা সংক্ষেপে সারলুম, কারণ ইহুদি নিধনের এটা অবতরণিকা মাত্র চলি চলি পা পা মাত্র। যেমন এস এস-দের নিধনকর্মে অভিজ্ঞতা বাড়তে লাগল, হননকর্ম তেমন তেমন সূক্ষ্মতর, বিদগ্ধতর ও ব্যাপকতর হতে লাগল।

ভিন্ন ভিন্ন ক্যাম্পের অধিকর্তা, যারা গুলি মারার আদেশ দিতেন তাদের কয়েকজন যুদ্ধশেষে ধরা পড়েন। তাঁদের একজন ওলেন। মিত্রশক্তি কর্তৃক জর্মনির নরবের্গ শহরে সাক্ষ্যদানকালীন ওলেনডর আসামিপক্ষের উকিল আমেনের এক প্রশ্নের উত্তরে বলেন, আমি এই পদ্ধতির সমর্থন করিনি।

উকিল আমেন : কেন?

ওলেনডরফ : এ পদ্ধতিতে নিহত ইহুদি এবং যারা গুলি ছুড়ত উভয় পক্ষেরই মাত্রাহীন অসহ মানসিক যন্ত্রণা বোধ হত। ইহুদিদের প্রতি কসাই ওলেনডফের এই দরদ অভিনব, বিচিত্র। এই কুম্ভীরাশ্রুর একমাত্র কারণ তিনি তখন নিজেকে ফাঁসিকাঠ থেকে বাঁচাতে আপ্রাণ চেষ্টা দিচ্ছেন।

কিন্তু এ-কথা সম্পূর্ণ সত্য, যে-সব এস এস সৈন্য গুলি ছুড়ত তাদের অনেকেই এই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতার ফলে হঠাৎ সাতিশয় মনমরা হয়ে যেত, মদ্যমৈথুন ত্যাগ করত, অবসর সময়ে সঙ্গীসাথী বর্জন করে এককোণে বসে বসে শুধু চিন্তা করত। হিটলারের আদেশে তাদের গুলি ছুঁড়তে হবে– এ-কথা তাদের স্পষ্ট বলে দেওয়া হয়েছে। কাজেই তার আদেশ লঙ্ঘনের কোনও প্রশ্নই ওঠে না–বছরের পর বছর তারা ট্রেড় হয়েছে বশ্যতা মন্ত্রে– অবিডিয়েনস্ এবাভ অল– ফুরারের আদেশে কোনও ভুল থাকতে পারে না, আপ্তবাক্যের ন্যায় তাঁর আদেশ অভ্রান্ত, ধ্রুব সত্য।

কিন্তু ওই ভয়ঙ্কর অভিজ্ঞতাটাও তো নির্মম সত্য!

 হাল বয়ান করে হিমলার-যমকে জানানো হল। ইস্পাতের তৈরি সাক্ষাৎ যমদূত-পারা কুচিৎ এস এস-এর নার্ভাস ব্রেক-ডাউনের খবর পেয়ে তিনি উম্মা প্রকাশ করেছিলেন কি না সে খবর জানা নেই। তবে একটা কেলেঙ্কারির খবর অনেকেই জানত; ইহুদি নিধনযজ্ঞের গোড়ার দিকে হিমলারের একবার কৌতূহল হয়, ম্যাস-মারডার– পাইকারি কচুকাটা দেখার। একশো জন ইহুদি নারী-পুরুষকে সার বেঁধে দাঁড় করিয়ে গুলি চালানো হল। সে দৃশ্য দেখে স্বয়ং শ্রীমান হিমলার ভিরমি যাচ্ছিলেন। সঙ্গীরা তাকে ধরে দাঁড় করিয়ে রাখল! স্বয়ং যম যদি মৃত্যু দেখে চোখে-মুখে পাঙাস মারেন তবে বালখিল্য যমদূতেরাকোজ্জাবে মা? এবং আশ্চর্য স্বয়ং হিটলারও চোখের সামনে রক্তপাত সহ্য করতে পারতেন না। এবং প্রাণীহত্যা আদৌ বরদাস্ত করতে পারতেন না বলে তিনি ছিলেন কড়া নিরামিষভোজী। মাংসাশীদের বলতেন শবাহারী।

হিমলারের আদেশে দু খানা বিরাট মোটর ট্রাক তৈরি করা হল। দেখতে এমনি সাধারণ ট্রাকের মতো, তবে চতুর্দিক থেকে টাইট ঢাকা এবং বন্ধ। শুধু বাইরের থেকে একটা পাইপ ভিতরে চলে গেছে। মোটর চালানোমাত্র বিষাক্ত গ্যাস ভিতরে যেতে থাকে, এবং দশ-পনেরো মিনিটের ভেতর অবধারিত মৃত্যু। ততক্ষণ অবধি ভেতর থেকে চাপা চিৎকার আর দরজার উপর ধাক্কা আর ঘুষির শব্দ শোনা যেত। প্রাচীন পাপী ওলেনডর্ফকে আদালতে শুনো হল, ওদের তোমরা ট্রাকে তুলতে কী করে?

ওয়েলডরফ : ওদের বলা হত তোমাদের অন্য জায়গায় নিয়ে যাওয়া হচ্ছে।

কিন্তু এ পন্থাতেও এস এস-দের কেউ কেউ সেই প্রাচীন চিত্তাবসাদে ভুগতে লাগল। ট্রাক থেকে বের করার সময় দেখা যেত মৃতদের মুখ বীভৎসরূপে বিকৃত। গাড়িময় রক্ত মলমূত্র। একে অন্যের শরীরে জামা-কাপড়ে পর্যন্ত। একে অন্যকে এমনই জড়িয়ে ধরে আছে যে লোহার আঁকশি আর ফাঁস দিয়ে ছাড়াতে শরীর ঘেমে উঠত, মুখ চকের মতো ফ্যাকাসে হয়ে যেত, মগজে ভূতের নৃত্য আর চিন্তাধারায় বিভীষিকা।

অকল্পনীয় এই খুনে গাড়ি দুটোর অভাবনীয় মৌলিক আবিষ্কারক ডক্টর বেকারকে জানানো হল। আসলে ইনি এস এস-দের চিকিৎসক (এবং স্বয়ং এস এস)। ইনি কিন্তু আমাদের সেই স্ত্রীহন্তা ডাক্তারের মতো নন। তিনি একমেবা করেই প্রসন্ন। ইতি ভূমার সন্ধানে আবিষ্কারক হয়ে গিয়েছিলেন।

ঈষৎ বিরক্তির সুরে তিনি লিখলেন, আমি যে ব্যবহার পদ্ধতি লিখে দিয়েছিলুম (ঠিক যেভাবে তিনি ওষুধের প্রেসক্রিপশনে সেবন পদ্ধতি; ডাইরেকশন ফর ইউজ লিখে থাকেন!) সেভাবে কাজ করা হয়নি। অপ্রিয় কর্ম তড়িঘড়ি শেষ করার জন্য গ্যাসযন্ত্র পরিচালক গ্যাস ছাড়ার হ্যাঁন্ডিলটা একধাক্কায় সর্বশেষ ধাপে নিয়ে যায়; ফলে ইহুদিরা শ্বাসরুদ্ধ হয়ে মারা যায়। হ্যাঁন্ডিল ধীরে ধীরে চালালে এরা আস্তে আস্তে আপন অলক্ষে মৃদুমধুর নিদ্রায় প্রথম ঘুমিয়ে পড়ে, শেষনিদ্রা আস্তে আস্তে এবং এতে করে আরও কম। সময়ে এদের মৃত্যু হয়। দরজায় ঘুষি, মলমূত্র ত্যাগ, বিকৃত মুখভঙ্গি, একে-অন্যে মোক্ষম জড়াজড়ি– এসব কোনও উৎপাতই হয় না।

অত্যুত্তম প্রস্তাব। কিন্তু তা হলেও তো বিরাট সমস্যার সমাধান কণা পরিমাণও হয় না। কারণ ফি ট্রাকে মাত্র পনেরো থেকে পঁচিশ জন প্রাণী লাদাই করা যায়। এদিকে হিটলার যে বিরাট সংখ্যার দিকে ঊর্ধ্বনেত্রে তাকিয়ে আছেন, এসব গাড়ি গণ্ডায় গণ্ডায় বানিয়েও তো সেখানে পৌঁছনো যাবে না। ওই সময়েই রাশার কিয়েফ শহরের কাছে প্রায় চৌত্রিশ হাজার প্রাণীকে এদের অধিকাংশই ইহুদি-মাত্র দু দিনের ভেতর খতম করার হুকুম এল, জর্মন কর্মতৎপরতা সে কর্ম সম্পূর্ণ করলও বটে। গ্যাসভ্যান দিয়ে এত লোক অল্পসময়ে নিশ্চিহ্ন করা যেত না।

হিটলার-হিমলারের আদেশে জর্মনির ভিতরে-বাইরে বিশেষ করে পোলানডে অনেকগুলো কনসেনট্রেশন ক্যাম্পূ (কক) নির্মাণ করা হয়। সর্ব-বৃহৎ ছিল আউশভিৎস্-এ। তার বড়কর্তা ছিলেন শ্রীযুক্ত হয়ে। হিমলার তাকে ডেকে বললেন, ফুরার (হিটলার) হুকুম দিয়েছেন, ইহুদিদের খতম করতে হবে, প্রথমত খুব তাড়াতাড়ি, দ্বিতীয়ত গোপনতম গোপনে। কী পরিমাণ ইহুদিকে খতম করতে হবে মোটামুটি হিসাব হিমলার দিলেন। ইউরোপে তখন এক কোটি ইহুদি; অবশ্য বহু জায়গা হিটলারের তাবেতে নয় বলে অসংখ্য ইহুদিকে পাকড়াও করা যাবে না।

ইতোমধ্যে ছোটখাটো দু-চারটি ক ক-তে ইহুদি সমস্যার খানিকটে সমাধান হয়ে গিয়েছে। মাঝারি রকমের একটা নিরন্ধ্র হলঘরে ইহুদিদের চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো হয়। দরজা বন্ধ করে ছেড়ে দেওয়া হয় মনো-অক্সাইড গ্যাস। আধঘণ্টার ভেতর এদের মৃত্যু হয়। কিন্তু এসব জায়গায় ছ মাসে আশি হাজারের বেশি প্রাণী নিশ্চিহ্ন করা যায় না। তা হলে তো হল না।

হয়েস খাঁটি জর্মনদের মতো পাকা লোক। কাজ আরম্ভ করার পূর্বে সব কটা ক ক দেখে নিলেন। (যুদ্ধশেষে হয়ে এক চাষাবাড়িতে আশ্রয় নেন; সেখানে ধরা পড়েন। নরবে শহরে গ্যোরিঙ, হেস, রিবেট্রপ ইত্যাদির বিরুদ্ধে যখন মিত্রশক্তি মোকদ্দমা চালাচ্ছেন তখন হয়ে সাক্ষীরূপে যা বলেন তার নির্গলিতাৰ্থ-)

আমি ক ক-গুলো পরিদর্শন করে আদপেই সন্তুষ্ট হতে পারলুম না। প্রথমত মনো-অক্সাইড গ্যাস যথেষ্ট তেজদার গ্যাস নয়, দ্বিতীয় চাবুক মেরে মেরে গ্যাস-ঘরে লোক ঢোকাতে হলে বিস্তর লোকের প্রয়োজন, তৃতীয় সেই প্রাচীন সমস্যা– লাশগুলোর সর্বোত্তম ব্যবস্থা কী হতে পারে?

কারণ ইতোমধ্যে দেখা গেল, গ্যাস-ভর্তি লাশ পুঁতলে তারই ঠেলায় গোরের উপরের মাটি ফুলে ওঠে কয়েকদিন অপেক্ষা করে তবে স্টিমরোলার চালানো যায়। তদুপরি লক্ষ লক্ষ লাশের বেশাতি! অতখানি জায়গা কোথায়? আউশভিৎস জায়গাটি ছিল নিকটতম গ্রাম থেকে কয়েক মাইল দূরে, নির্জনে এবং কাছেপিঠে লোক চলাচলের কোনও সদর রাস্তাও তার গা-ঘেঁষে যায়নি। তবু কেউ সেদিক দিয়ে যাবার সময় সেই বিরাট প্রতিষ্ঠানের দেউড়ির উপরের দিকে তাকালে দেখতে পেত লেখা রয়েছে স্নান প্রতিষ্ঠান, গেট দিয়ে দেখতে পেত, প্রতিষ্ঠানের প্রবেশপথের দু পাশে কাতারে কাতারে শৌখিন মরসুমি ফুলের কেয়ারি। দূর থেকে নৃত্যসম্বলিত হালকা গানের কনসারট সঙ্গীত ভেসে আসছে। কে বলবে সেখানে পৃথিবীর অভূতপূর্ব বিরাটতম নর-নিধনালয়!

মেন রেললাইন থেকে একটা সাইড লাইন করিয়ে নিলেন হের হয়ে তাঁর ক ক পর্যন্ত। যেদিন যে সংখ্যার নরনারী শেষ করা সম্ভব সেই সংখ্যার ইহুদি গরুভেড়ার মালগাড়ির ট্রাকে করে নিয়ে আসা হয়েছে পোল্যান্ড থেকে, হাঙ্গেরি থেকে, সুদূর রুশ থেকে। এদের খেতে দেওয়া হয়নি; ট্রাকে পানীয় জলের, শৌচের ব্যবস্থা নেই। ট্রাক খোলা হলে দেখা যেত শতকরা আট থেকে দশ-জনা– বিশেষ করে শিশুদের মধ্যে মরে আড়ষ্ট হয়ে আছে। শীতকালে শুধু জমে গিয়েই এর সংখ্যা দেড়া হয়ে যেত।

এদের নামানো হত রেলকর্মচারীদের বিদেয় দেওয়ার পর।

ইহুদিদের বলা হয়েছে, এখানে এদের বিশেষ ওষুধ মাখানো জলে স্নান করিয়ে গা থেকে উকুন সরানো হবে (ডিলাউজিং)। তারাও দেউড়িতে দেখতে পেত লেখা রয়েছে স্নান প্রতিষ্ঠান। ফুলের কেয়ারি, ঘনসবুজ লন, আর আবহাওয়া উত্তম হলে সেই লনের উপর বসেছে সুবেশী তরুণীদের কনসারট। চটুল নৃত্য-সঙ্গীত শুনতে শুনতে তারা এগুতে রেসেপসনিস্ট-এর কাছে। ইতোমধ্যে দু জন এস এস ডাক্তার ইঙ্গিত করে বুঝিয়ে দিচ্ছেন, কারা কর্মক্ষম আর কারা যাবে গ্যাস চেম্বারে। শতকরা পঁচিশ জনের মতো কর্মক্ষম যুবক-যুবতীকে আলাদা করে নিয়ে যাওয়া হত অন্যদিকে। যুবতী মা-দের কেউ কেউ আপন শিশু হতে বিচ্ছিন্ন হতে চায় না বলে আপন স্কার্টের ভেতর লুকিয়ে রাখবার চেষ্টা করত কিন্তু হয়ে বলেছেন, এস এস-দের তারা ফাঁকি দিতে পারত না। এদিকে যারা গ্যাস চেম্বারে যাবে তাদের বলা হয়েছে তাদের টাকাকড়ি, গয়না, ঘড়ি, মণিজওহর– মূল্যবান যাবতীয় বস্তু আলাদা আলাদা করে রাখতে, যাতে করে স্নানের শেষে যে যার মূল্যবান জিনিস ঠিক ঠিক ফিরে পায় (দেশ থেকে এদের নিয়ে আসার সময় তাদের বলা হয়েছে, তারা ভিন দেশে নতুন, কলোনি (দণ্ডকারণ্য?) গড়ে তুলবে; আপন দেশে ফিরবার কোনও সম্ভাবনা নেই, তাই–হীরাজওহর টাকাকড়ি সঙ্গে নিয়ে যেতে)। ওদিকে কনসারটে পলকা নৃত্যসঙ্গীত বেজেই যাচ্ছে, বেজেই যাচ্ছে। তামাশাটা পরিপূর্ণ করার জন্য কোনও কোনও দিন এদের ভেতর আবার স্থানীয় নৈসর্গিক দৃশ্যের পিকচার পোস্ট কারড় দেওয়া হত– আত্মীয়স্বজনকে পাঠাবার জন্য, তাতে ছাপা রয়েছে আমরা মোকামে পৌচেছি এবং চাকরি পেয়েছি; এখানে খুব ভালো আছি; তোমাদের প্রতীক্ষা করছি। ইতোমধ্যে কয়েকজন অফিসার হন্তদন্ত হয়ে বলতেন, একটু তাড়াতাড়ি করুন; নইলে পরের ব্যাচকে খামখা বসে থাকতে হবে যে! তার পরই সবাই সম্পূর্ণ উলঙ্গ অবস্থায় গিয়ে ঢুকত সেই গ্যাস চেম্বারে।

হয়েস বলছেন, ব্যাপারটা যে কী কখনই কেউই বুঝতে পারত না তা নয়। তখন ধুন্ধুমার, প্রায় বিদ্রোহের মতো লেগে যেত। তখন অন্যান্য ছোটখাটো ক ক-তে যে-রকম বেধড়ক চাবুক মেরে মেরে ঢোকানো হয় তাই করা হত।

একটা হল-এ প্রায় দু হাজারের মতো লোক ঠাসা যেত।

এত লোককে একসঙ্গে শাওয়ার বাথে ঢোকানো হয় তাই দেখে অন্তত তখন, অনেকেরই মনে ভীষণ সন্দেহ জাগত। কিন্তু ততক্ষণে টু লেট। ফ্রিজিডেরের দরজার মতো নিরন্ধ্র বিরাট দু পাট দরজা তখন বন্ধ করে দেওয়া হয়েছে। দেয়ালের কাছে যারা দাঁড়িয়েছে তারা শাওয়ারের চাবি খুলে দেখে জল আসছে না।… এবং প্রায় সঙ্গে সঙ্গেই আসতে লাগল অন্য জিনিস… দরজা বন্ধ করে দেওয়ার পর লন-এ উপস্থিত একজনের দিকে ইশারা দেওয়া হত। সঙ্গে সঙ্গে সেই এস এস সেখানে একটা পাইপ খুলে ছেড়ে দিত এক টুকরো নিরেট ক্রিসটেলাইজড সাইক্লন বি গ্যাস।৬ এই বস্তুটি অক্সিজেনের সংস্পর্শে আসামাত্রই মারাত্মকভাবে গ্যাসে পরিবর্তিত হয়ে পাইপের ভেতর দিয়ে উন্মুক্ত শাওয়ারের ছিদ্র দিয়ে বেরুতে থাকত। এক নিশ্বাস নেওয়া মাত্রই মানুষ ক্লরফরম্ নেওয়ার মতো সংজ্ঞা হারায়। যাদের নাকে তখনও গ্যাস ঢোকেনি তারা তখন চিৎকার আর ধাক্কাধাক্কি করত বন্ধ দরজার দিকে এগোবার জন্য আর যারা দরজার কাছে, তারা আপ্রাণ ঘুষি মারত বন্ধ দরজার উপর। সেই মৃত্যুভয়ে ভীত প্রাণাতঙ্কে উন্মত্ত জনতা দরজার দিকে ঠেলে ঠেলে সেখানে মনুষ্য-পিরামিডের আকার ধারণ করত।

মোক্ষম পুরু কাঁচের ছোট একটি গবাক্ষের ভেতর দিয়ে করুণাসাগর এস এস্-রা (তিন থেকে পনেরো মিনিটের মধ্যেই সব শেষ– আবহাওয়া ও মৃত্যোৎসর্গিত প্রাণীর ওপর নির্ভর করত সময়ের তারতম্য।) যখন দেখত অচৈতন্য শরীরগুলো আর থেকে থেকে হ্যাঁচকা টান দিচ্ছে না, তখন ইলেকট্রিক পাম্প দিয়ে ভেতরকার গ্যাস শুষে নেওয়া হত। বিরাট দরজা খোলা হত।

গ্যাস ম্যাসক্ (ছিদ্রহীন মুখোশ), রবারের হাঁটু-ছোঁয়া বুট পায়ে পরে হাতে হৌস-পাইপ নিয়ে ঢুকত একদল ইহুদি পূর্বেই বলেছি এদের লোভ দেখানো হয়েছে, প্রয়োজনীয় কাজ করে দিলে এদের মুক্তি দেওয়া হবে।

দরজা খোলামাত্র লাশের পিরামিড, এমনকি যারা দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে মরেছে তারাও, মাটিতে পড়ে যেত না। একে অন্যকে তখনও তারা জাবড়ে আঁকড়ে ধরে আছে। নাকমুখ দিয়ে বেরোনো রক্ত, ঋতুস্রাবের রক্ত, মলমূত্র সব লাশ ছেয়ে আছে, মেঝেতেও তাই। ইহুদিদের প্রথম কাজ হত হৌস দিয়ে সব কিছু সাফসুৎরো করা। তার পর আঁকশি আর ফাঁস দিয়ে মৃতদেহগুলো পৃথক করা। এর পর লাশগুলোর হাত থেকে আংটি সরানো হত, ডেনটিসট্রা এসে সাঁড়াশি দিয়ে মুখ খুলে সোনার, সোনা বাঁধানো দাঁত– দরকার হলে হাতুড়ি ঠুকে ঠুকে বের করে নিত। মেয়েদের মাথার চুল দু-চারবার কাঁচি চালিয়ে কেটে নিয়ে বস্তায় পোরা হত– পরে কৌচসোফা এই দিয়ে তুলতুলে করা হবে এবং যুদ্ধের অন্যান্য কাজে লাগবে। সর্বশেষ ইহুদি জমাদাররা স্ত্রী-পুরুষ উভয়ের গোপনস্থলে পরীক্ষা করে দেখে নিত হীরকজাতীয় মহা মূল্যবান কোনও বস্তু লুকোনো আছে কি না।

ন্যুরনবের্গ মোকদ্দমায় বলা হয় যে, কোনও কোনও ক ক-তে লাশের চর্বি ছাড়ানো হত সাবান ইত্যাদি তৈরি করার জন্য, এবং কোনও এক বিশেষ ক কর প্রধান কর্মচারীর শৌখিন পত্নী মানুষের চামড়া দিয়ে ল্যাম্পশেড় তৈরি করাতেন। কিন্তু এগুলো সপ্রমাণ হয়নি। অধমের নিবেদন, অনাহারে অত্যাচারে রোগব্যাধি তথা অসহ মানসিক ক্লেশে ইহুদিদের দেহে তখন যেটুকু চর্বি অবশিষ্ট ছিল, তা দিয়ে একটি কবরেজি বড়িও হয় না।

মণিমাণিক্য অলঙ্কারাদি জর্মন স্টেট ব্যাংকে পাঠানো হত। এ পদ্ধতিতে স্টেট ব্যাংক কী পরিমাণ মাল পেয়েছিলেন তার হিসাব যুদ্ধশেষে নির্ধারিত করা যায়নি। তবে ব্যাংক বেশিরভাগ বিক্রি করে দেওয়ার পরও যা পাওয়া গিয়েছিল তাই দিয়ে যুদ্ধশেষে মার্কিনরা তিনটে বিরাট ভলট কাঁঠাল-বোঝাই করেছিল। এবং একখানা চিঠি থেকে কী পরিমাণ মাল জোগাড় করা হয়েছিল তার কিছুটা হদিস মেলে। স্টেট ব্যাংক সরকারি লগ্নী প্রতিষ্ঠানকে সে চিঠিতে লেখেন, এই দুসরা কিস্তিতে আমরা যা পাঠাচ্ছি তার মধ্যে আছে, ১৫৪ সোনার পকেট-ঘড়ি, ১৬০১ সোনার ইয়ারিং, ১৩২ ডায়মন্ড আংটি, ৭৮৪ রুপোর পকেটঘডি, ১৬০ বিশুদ্ধ ও মিশ্রিত সোনার দাঁত, ইত্যাদি ইত্যাদি অতি দীর্ঘ সে ফিরিস্তি। চিঠি লেখা হয় ১৫ সেপ্টেম্বর ১৯৪২-এ। বরং ইহুদিনিধন চালু ছিল ফুল (গ্যাস) স্টিমে ১৯৪৪-এর শেষ পর্যন্ত এবং তার পর মন্দাগতিতে। মার্কিনরা এখনও তাই ঠিক ঠিক মোট-জমা প্রকাশ করতে পারেননি।

কিন্তু এসব জিনিস থাক। যে জিনিসটা জনৈক মার্কিন অফিসারকে অত্যন্ত বিচলিত করেছিল (এবং আমাকেও করেছে) সেটা নিবেদন করার পূর্বে বলি, এই অফিসারটি রীতিমতো হারড় বয়েল্ড ঝাণ্ড– বিস্তর লড়াই লড়েছেন, বীভৎস সব বহু বহু দৃশ্য দেখেছেন, গণ্ডায় গণ্ডায় গুপ্তচরকে তাঁর সামনে তার আদেশে গুলি করে মারা হয়েছে (যুদ্ধের সময় গুপ্তচর নিধন আন্তর্জাতিক আইনে বাধে না); সে-সবের ঠাণ্ডামাথা হিমশীতল বর্ণনা পড়ে মনে হয়, এসব ক্ষেত্রে ভদ্রলোকের নেকটাইটি পর্যন্ত এক মিলিমিটার এদিক-ওদিক হয়নি কিন্তু তার ওয়াটারলু এল যুদ্ধের পর, আউশভিৎস দেখতে গিয়ে, টুরিস্ট রূপে (এখনও এটি সে অবস্থাতেই রাখা আছে– পাঠক নেকট ট্রিপে সেটা দেখে নেবেন। আমি হিম্মৎ করতে পারিনি)। মার্কিন অফিসার গ্যাস চেম্বার, পোড়াবার জায়গা, বন্ধ চুল্লি, খোলা চুল্লি সব– সব দেখলেন। সর্বশেষে গাইড নিয়ে গেল একটা গুদামঘরে, সেখানে নিহত ইহুদিদের অপেক্ষাকৃত কমদামি জামা-কাপড়, জুতো-মোজা সারে সারে সাজানো ছিল।

তারই এক অংশে তিনি দেখতে পেলেন চল্লিশ হাজার জোড়া জুতো। ক্ষুদে ক্ষুদে। নিতান্ত কাঁচা-কচি শিশুদের।

.

এবারে আমরা যে প্রসঙ্গ নিয়ে এ নিবন্ধ আরম্ভ করেছি সেখানে ফিরে যাই।

মার্কিন মনস্তত্ত্ববিদ ড. গিলবারট আউশভিৎস ক্যাম্পের কর্তা হয়েকে আশ্চর্য হয়ে শুধোন, এত অসংখ্য লোককে তোমরা মারতে কী করে? হয়ে বাধা দিয়ে শান্তকণ্ঠে বললেন, আপনি তাবৎ জিনিসটাকে ভুল দৃষ্টিকোণ থেকে দেখছেন। মারাটা তো সহজ। মিনিট পনেরো লাগে কি না লাগে, দু হাজার লোককে মেরে ফেলতে (হয়ে বোধকরি জানতেন না যুদ্ধের শেষের দিকে এক জর্মন ডাক্তার চমৎকার একটি ইনজেকশন বের করেন, এবং মোদ্দা কথা তার দাম ফিনলের চেয়েও কম, ঘাড়ের কাছে সে ইনজেকশন আনাড়িতেও দিতে পারে, শিকার খতম হয় মাত্র কয়েক সেকেন্ডের ভেতর)। কিন্তু আসল সমস্যা, লাশগুলো নিশ্চিহ্ন করা যায় কী করে। বিরাট বিরাট চুল্লি তৈরি করে এবং সেগুলো চব্বিশ ঘণ্টা চালু রেখেও আমরা ওই সময়ের ভেতর দশ হাজারের বেশি লাশ নিশ্চিহ্ন করতে পারতুম না। মনে রাখতে হবে চুল্লি থেকে মাঝে মাঝে হাড় আর ছাই বের করতে হত। হাড়গুলো মেশিনে গুঁড়ো করে ছাইসুদ্ধ পাশের নদীতে ফেলে দেওয়া হত (শুনেছি তো হাড়ের গুঁড়ো আর ছাই উত্তম সার– তবে জর্মনরা এটা বরবাদ করত কেন?– যেস্থলে চুল পর্যন্ত কাজে লাগানো হচ্ছে– লেখক) মোটামুটি বলতে গেলে আমরা আউশভিৎসে ২৭ মাসে ২৪,৩০,০০০ (প্রায় সাড়ে চব্বিশ লক্ষ) লোক মেরেছি।

আইষমান গর্ব করে বলেছিলেন, সব কটা ক ক-তে মিলে সবসুদ্ধ পঞ্চাশ লক্ষ প্রাণী খতম করা হয়। হয়ে স্বীকার করেছেন, শত চেষ্টা সত্ত্বেও লাশ নিশ্চিহ্ন করার কাজটা গোপন রাখা যায়নি। অর্থাৎ গ্যাস চেম্বারের নিধনকর্মটি গোপন রাখা যায় কিন্তু মাটিতেই পেতো আর পুড়িয়েই ফেল– সেটা কিন্তু গোপন রাখা যায় না। লাশ-পোড়ানোর তীব্র উৎকট গন্ধ, আর চিমনির চোঙা থেকে যে ধুয়ো বেরুচ্ছে তার ছাই ছড়িয়ে পড়ত কয়েক মাইল দূরে অবস্থিত চতুর্দিকের গ্রামে। তারা বুঝে যেত ওই নিরীহ স্নান-প্রতিষ্ঠান কোন বিশ্বপ্রেমের খয়রাতি রাজকার্যে লিপ্ত আছেন এবং শুধু সর্বান্তঃকরণে প্রার্থনা করত বাতাস যেন তাদের আপন বসগ্রামের দিকে না যায়! এটা কিছু নতুন নয়। যুদ্ধের গোড়াতেই এই নিধনযজ্ঞ হিটলার আরম্ভ করেন জর্মনির পাগলাগারদগুলো দিয়ে পাগলদের ভেতর অবশ্য কিছু ইহুদিও ছিল, কিন্তু অধিকাংশই খাঁটি জর্মন। নামকা ওয়াস্তে একটা কমিশন বসল– এতে অল্পসংখ্যক পাগল রেহাই পেল, যদি আদৌ কেউ পেয়ে থাকে, যে সেটার কোনও উল্লেখ পর্যন্ত নেই– এবং পাগলদের কতকগুলো কেন্দ্রে জড় করে গ্যাস মারফত মেরে ফেলে পুড়িয়ে দেওয়া হল। এটা স্রেফ খুন। জর্মন আইনে নিকটতম তিনজন আত্মীয়ের অনুমতি ভিন্ন পাগলকে এক প্রতিষ্ঠান থেকে অন্য প্রতিষ্ঠানে সরানো পর্যন্ত যায় না– নিধন করার (যাকে ভদ্রভাষায় বলা হয় মারসি কিলিং= অন্তত যন্ত্রণা থেকে রেহাই দেবার জন্য দয়াবশত কাউকে হত্যা করা, কিংবা অনারোগ্য ক্যানসারের অসহ্য যন্ত্রণায় রুগী যখন বিষ খেতে চায় তাকে বিষ এনে দেওয়া। ডাক্তারি আইনে একে বলা হয়– Euthanasia, গ্রিক সমাস) তো কোনও কথাই ওঠে না। পাগলদের মেরে পুড়িয়ে ফেলার প্রধান কেন্দ্র ছিল হাডামার নামক গ্রামে। তারই পাশে লিম্বুর শহর। সেখানকার বিশপ জর্মনির আইনমন্ত্রীকে একখানা চিঠিতে জানান, স্কুলের ছেলেমেয়েরা পর্যন্ত সেই বন্ধ বাসগুলো চেনে, যার ভিতরে করে পাগলদের হাডামারে নিয়ে যাওয়া হয় এবং এর কোনও একটাকে দেখলেই ছেলেরা বলে ওঠে– ওই যাচ্ছে খুনের বাস= মারডার বক্স। তাচ্ছিল্যভরে কথায় একে অন্যকে বলে ক্ষেপলি নাকি?– যাবি নাকি হাডামারের বেকিং বসে (যাতে কেক বানানো হয়; এস্থলে লাশ পোড়াবার চুল্লি?) হাডামারের চিমনি ছাড়ে ধুয়ো আর সেখানকার অধিবাসীরা are tortured with the ever-present thought of depending on the direction of the wind. 099 কথা সত্য এ-সব খুন-খারাবি, লাশ পোড়ানোর খবর দেশময় ছড়িয়ে পড়তে পারেনি। যারা জানত, তারা জানত। অন্য কাউকে বলতে গিয়ে কেউ গেস্তাপোর (গোপন পুলিশ–এদের প্রধানতম কর্ম ছিল রাজনৈতিক, অনেকটা রুশের ওগপুর মতো– এদের কাহিনী ক ক-র চেয়েও বীভৎসতর) হাতে ধরা পড়লে প্রথমে তার ওপর কল্পনাতীত নানা অত্যাচার এবং এতেও যদি সে না মরে তবে সর্বশেষে তাকে কোনও একটা ক ক-তে সমর্পণ এবং সেখানে গ্যাস-চেম্বারে মৃত্যু। কাজেই হাডামার বা ক ক-গুলোতে কী হচ্ছে সে সম্বন্ধে মুখ খুলে কেউ রা-টি কাড়ত না! তাই ওই আমলে একটা চুটকিলা রসিকতা সৃষ্ট হয়–

তুই নাকি, ভাই, ডেনটিসটরি পড়া ছেড়ে দিয়েছিস?

বাধ্য হয়ে ছাড়তে হল। কেউ যে মুখ খুলতে রাজি হয় না।

 লিমবুরগ-এর বিশপের চিঠি পেয়ে আইনমন্ত্রী হিটলারের আপন আইন উপদেষ্টার কাছে এ বাবদে অনুসন্ধান করলেন। আইন-উপদেষ্টা হিটলারের সেই চিঠি দেখালেন। আইনমন্ত্রী বললেন, এটা তো তাঁর নির্দেশ। এটা তো আইন নয়। আপনারা তা হলে এটাকে আইনের রূপ দিন, সেটাকে তার পর দেশে প্রবর্তিত করুন।…তা হলেই তো চিত্তির! কারণ, জর্মন পার্লিমেন্ট আইন করার সক্ষমতা সর্ব অধিকার হিটলারকে দিয়েছিল বটে, কিন্তু আইন মাত্রই সরকারি গেজেটে প্রকাশ করতে হয়। তার পর এক বছর কেটে গেল, আইনমন্ত্রী কোনও উত্তর পেলেন না। ইতোমধ্যে দেশের সব পাগল খতম। সমস্যাটার সুচারু সমাধান হয়ে গেল আপসে আপ। কোনও কোনও দেশে যেরকম দুর্ভিক্ষের সমস্যা আপৃসে আপ সমাধান হয়ে যায় কয়েক লক্ষ লোক না খেয়ে মরে যাওয়ার পর।

লাখ তিরিশ বা পঞ্চাশেক ইহুদিকে যে ওপারে পাঠানো হল তার জন্যও কোনও আইন বিধিবদ্ধভাবে তৈরি করা হয়নি। কিন্তু সে মামলা নিয়ে কখনও কোনও লেখালেখি হয়নি,– ফরিয়াদ করবে কে?– হলেও সেটা লোকচক্ষুগোচর হয়নি। পবিত্র পিতা পোপের কাছে কোনও নিধনই অজানা ছিল না। তিনি থেকে থেকে বিশ্বজন তথা সুস্পষ্ট ইঙ্গিতে হিটলারের কাছে এপিল করতেন ক্রিসটিয়ান চ্যারিটি দেখবার জন্য। এর বেশি তিনি কিছু করে উঠতে পারেননি। (৭)

হিটলার ক ক-তে কত লক্ষ ইহুদি, রুশ, বেদে ইত্যাদিকে নিহত করেন সেই সংখ্যা নিয়ে যখন নরবের্গ মোকদ্দমায় তুমুল তর্কাতর্কি হচ্ছে তখন আসামিদের একজন ছিলেন ফ্রান্। (এরই আদেশে অসংখ্য ইহুদিকে আইষমানের হাতে সমর্পণ করা হয় এবং বিচারে এঁর ফাঁসি হয়। ওই বিচারে উনিই একমাত্র আসামি যিনি নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করেন)। সেই তর্কাতর্কির ভেতর আসামিদের কাঠগড়ার পিছনে যে মার্কিন সান্ত্রি দাঁড়িয়ে ছিল সে শুনতে পেল (যে সব মার্কিন জোয়ান উত্তম জর্মন জানত তাদেরই এ কাজে নিয়োজিত করা হত এবং এরা ভাবখানা করত যেন জর্মন বিলকুল বোঝে না– ফলে আসামিরা নিজেদের ভিতরে এমন সব কথা বলে ফেলত যেগুলো সান্ত্রিরা ফরিয়াদি পক্ষের মার্কিন উকিলকে জানিয়ে দিত। আমার মনে হয় এটা অত্যন্ত বে-আইনি ব্যাপার। কিন্তু মার্কিন আইনকানুন যেন শিব ঠাকুরের আপন দেশে আইনকানুন সর্বনেশে ॥) ফ্রানু ফিসফিস করে তাঁর সহআসামি হিটলারের অন্যতম মন্ত্রী রোজেনবেরককে বলেছেন, এরা—-অর্থাৎ মার্কিনিংরেজসহ মিত্রশক্তি চেষ্টা করেছে আউশভিৎসে দৈনিক যে দু হাজার ইহুদি মারা হত তার কুল্লে গুনাহ্ কালটেন ব্রুনারের ওপর চাপাবার।(৮) কিন্তু ওই যে মার্কিনিংরেজের বোমাবর্ষণের ফলে ঘন্টা দুয়েকের ভেতর হামবুর্গ বন্দরে ত্রিশ হাজার লোক মারা গেল তার কী? এদের বেশিরভাগই তো ছিল শিশু এবং অবলা। তার পর ওই যে জাপানে এটম বম ফেলে আশি হাজার লোক মারা হয় তার কী? এই বুঝি ন্যায়, এই বুঝি ইনসা?

রোজেনবেরক হেসে উত্তর দিলেন, আমরা যুদ্ধে হেরেছি যে!(৯)

ইতোপূর্বে যে মনস্তত্ত্ববিদ মার্কিন ডাক্তার গিলবারটের উল্লেখ করেছি, তিনি এই কথোপকথনের ওপর ফোড়ন দিয়ে বলেছেন, এ হল গে টিপিকল নাৎসি যুক্তিপদ্ধতি।

বট্ট্যে? তা সে যাকগে আমরা এস্থলে আউশভিৎস-হিরোশিমার তুলনামূলক আলোচনা করব না।(১০) শুধু একটি সামান্য খবর পাঠককে দিই।

হিরোশিমায় এটম বম্ ফাটানো হয় ৬ আগস্ট ১৯৪৫ খ্রিস্টাব্দে। এর পক্ষাধিক কাল পূর্বে মহাভারতের সঞ্জয়ের ন্যায় জাপান জয়াশা ত্যাগ করে যুদ্ধে নিরপেক্ষ দেশ সুইডেনের মারফত যুদ্ধবিরতি কামনা করে আত্মসমর্পণের প্রস্তাব পাঠায় (এর মাস তিনেক পূর্বে হিটলারের দক্ষিণ হস্ত স্বরূপ হিমলার তার প্রভু হিটলারকে না জানিয়ে ওই সুইডেনের মারফতেই মিত্রশক্তির নিকট সন্ধিপ্রস্তাব পাঠান, কিন্তু দুই মহাপ্রভুর কেউই খ্রিস্টের উপদেশ মানতেন না বলে বাম হস্তটি অর্থাৎ হিটলার খবরটা জানতে পান এবং আত্মহত্যার কয়েক ঘণ্টা পূর্বে হিমলারকে পদচ্যুত করেন) কিন্তু মার্কিন তখন হন্যে হয়ে উঠেছে, নবাবিষ্কৃত এটম বম্ একটা ঘনবসতিওলা শহরে ছাড়লে তার প্রতিক্রিয়া কী হয় সেটা জানবার জন্য। জাপানদত্ত সন্ধিপ্রস্তাব গ্রহণ করলে তো আর বোমাটার এক্সপেরিমেন্ট চালানো যায় না– এতএব, চালাও যুদ্ধ আরও কয়েকদিন, বোমা ফাটিয়ে দেখা যাক ক হাজার লোক স্রেফ পুড়ে মরে, শহর কতটা ধ্বংস হয়। বলা নিতান্তই বাহুল্য হিটলারের ক ক-তে গ্যাসে মৃত্যু ছিল সম্পূর্ণ যন্ত্রণাহীন, এটম বমে জাপানিরা জ্বলন্ত জামাকাপড় নিয়ে ছুটোছুটি করে মরেছে বহু সহস্র, এবং অসংখ্য জন মরেছে বোমার ফলে নানাবিধ অজানা-অচেনা রোগের যন্ত্রণায় বছরের পর বছর জীবন্ত হয়ে।…এবং কর্তারা একটা বোমা ফেলেই প্রসন্ন দক্ষিণং মুখং ধারণ করেননি। আমরাও জানি, এক সংখ্যাটাই বড়ই অপয়া নিদেন দুটো বাতাসা খেতে হয়।

স্পর্শকাতর পাঠক এতক্ষণে হয়তো কিঞ্চিৎ অসহিষ্ণু হয়ে ভাবছেন, আমি এসব পুরনো কাসুন্দি ঘাটছি কেন। তবে কি আমি মডার্ন লেখকদের পাল্লায় পড়ে বীভৎস রসের অবতারণা করে শিঙ ভেঙে বাছুরের দলে ভিড়তে চাই! ঈশ্বর রক্ষতু। আমার সেরকম কোনও উচ্চাশা নেই। বরঞ্চ বলব, মর্ডানদের এই যে নতুন টেকনিক আগেভাগে সব কিছু বলে দিয়ে কোনও প্রকারের সারপ্রাইজ এলিমেন্ট না রেখে পাসে মারা ধূসর মারকা প্লট-বিবর্জিত গল্প লেখা (এদের বক্তব্য : বাস্তব জীবনে সারপ্রাইজ নেই– আছে একঘেয়েমির ধূসরিমা, পান্তাভাতের পানসেমি, মরা ইঁদুরে পাঙাশ-মারা পেট)–এটা আমি রপতো করতে পারব না … আমার যেটা মূল বক্তব্য সেটাতে আসি সর্বশেষে।

এই মাস, অর্থাৎ সেপ্টেম্বর ১৯৩৮, আজকের ঠিক ২০ বছর পূর্বে শ্রীযুক্ত চেম্বারলেন ও ফরাসি প্রধানমন্ত্রী দালাদিয়ে, দুজনাতে, গণতন্ত্রের প্রতিভূ হিসেবে চেকোশ্লোভাকিয়াকে হিটলারের করকমলে সমর্পণ করেন।

গুণ্ডামি আরম্ভ হয় সেই সময় থেকে। ক ক তার শেষ।

আজ আবার এরা গণতন্ত্র দেশের লক্ষ্মীছাড়া সব পলিটিশানরা চেকোশ্লোভাকদের তাতাচ্ছে।

অথচ, পাঠক, দেখো, চেকোশ্লোভাকদের সাহায্য করার রত্তিভর ক্ষ্যাতা ওদের নেই।

তাই তারা জর্মনির দুই লক্ষ সৈন্যকে তিন লক্ষ, না পাঁচ লক্ষে ওঠবার অনুমতি দিয়েছেন।

একদা যে রকম গণতন্ত্রের মুনিব চেম্বারলেন-দালাদিয়ে চেকোশ্লোভাকদের হিটলারের হাতে ছেড়ে দিয়েছিলেন, আজ ঠিক তেমনি তাদের বংশধররা, চেকোশ্লোভাকদের তাড়িয়ে দিয়ে, রুশদের হাতে ছেড়ে দেবেন।

আবার শুরু হবে ক ক।

 গ্যাস চেম্বার!

 শা-লা!

———–

১. মূল গল্পের ধারা অনেক ক্ষেত্রে ফুটনোটের আধিক্যবশত বাধা পায়। অধম কিন্তু ফুটনোট শাস্ত্রসম্মত পদ্ধতিতে দেয়– অর্থাৎ কোনও পাঠক যদি ফুটনোট আদৌ না পড়েন তবে তিনি মূল গল্পের (টেক্সটের) কোনও প্রকারের সারবস্তু থেকে বঞ্চিত হবেন না। ফুটনোটে থাকবার কথা মূল গল্পের বক্তব্যের সঙ্গে সম্পর্কিত নানাপ্রকারের আশ-কথা পাশ-কথা, যেগুলো অত্যধিক কৌতূহলী পাঠক পড়েন যাতে করে কিঞ্চিৎ ফালতো জ্ঞান সঞ্চয় হয় কিংবা এবং যারা বইখানা পয়সা দিয়ে কিনেছেন বলে বিজ্ঞাপনত বাদ দেয় না। অন্যদের জন্য মিষ্টান্নই যথেষ্ট- অর্থাৎ আটপৌরে পাঠক টেক্সট পড়েই সন্তুষ্ট। ফুটনোটে এমন কিছু দেওয়া যেটা না পড়লে মূল কাহিনী বুঝতে অসুবিধা হয় লেখকের পক্ষে অমার্জনীয় অপরাধ।

 ২. ভ্রাতৃহত্যার চিহ্নস্বরূপ সদাপ্রভু কাইনের কপালে একটি লাঞ্ছনা এঁকে দেন। লেখকের প্রেম অনুবাদ দ্রষ্টব্য।

৩. হিটলারের খাস ভালে ছিলেন লিঙে। তিনি এতই বিশ্বাসী ভৃত্য ছিলেন যে হিটলার-প্রিয়া (পরস্ত্রী) এফা ব্রাউনের বিছানা পর্যন্ত করে দিতেন। যুদ্ধশেষে দশ বছর রুশদেশে বন্দিজীবন কাটিয়ে জমনি ফিরে হিটলার সম্বন্ধে একখানি চটিবই লেখেন। হিটলারের প্রেম ও হিটলারের শেষ দশ দিবস (পুস্তকাকারে প্রকাশিত) প্রবন্ধে এর পূর্ণ পরিচয় দেওয়া হয়েছে। লিঙেকে যখন পরবর্তীকালে শুধানো হয় ইহুদিনিধন সম্বন্ধে বহু জর্মন কিছুই জানত না কেন, তিনি বলেন, হিটলার-হিমলার বহুবার সম্পূর্ণ একলা একলা গোপন সলাপরামর্শ করতেন। সে সময়ে সেখানে লিঙের চা-কফি নিয়ে যাওয়াও মানা ছিল।

৪. এই একশো জনের ভেতর এক যুবতীকে দেখে হিমলার রীতিমতো বিস্মিত হন। চেহারা, চুল নাক আদৌ ইহুদির মতো নয়। যে নরডিক (বিশুদ্ধতম আর্যরক্তের জৰ্মন) জাত হিটলার-হিমলার আদর্শ বলে ধরতেন তাদেরই মতো ব্লনড চুল, নীল চোখ, ব্রিজহীন সোজা নাক ইত্যাদি। হিমলারের ডাকে সে এগিয়ে এলে হিমলার তাকে বললেন, তুমি ইহুদি নও। গর্বিত উত্তর; না, আমি ইহুদি। তুমি বল, তুমি ইহুদি নও, আমি তোমাকে নিষ্কৃতি দেব। গর্বিততর কণ্ঠে, না, আমি ইহুদি। তার পর দৃঢ় পদক্ষেপে ফিরে গিয়ে আপন জায়গায় দাঁড়াল।

৫. ইনি হিটলারের ডেপুটি রুডলফ হেস (Hess) নন, যিনি সন্ধিপ্রস্তাব নিয়ে ইংলন্ডে যান। এর নাম Hoess।

৬. কোন্ প্রকারের গ্যাস, কেমিকেল ইত্যাদি সম্বন্ধে এ-লেখকের বিন্দুমাত্র ধারণা নেই। জর্মন এনসাইক্লোপিডিয়া বলেন Zyklon (ৎসাইক্লন) এক প্রকারের অতি মারাত্মক বিষাক্ততম প্রাসিক (হাই সায়েনিক) এসিড। হয়েস-এর উৎসাহে এক বৈজ্ঞানিক সাইক্লন বা Zyklon B আবিষ্কার করেন। এরই অন্য নাম Zyanwass erstoffkrisatle অর্থাৎ Zyankale

৭. যুদ্ধের পর হিটলারের প্রতি পোপের আচরণ নিয়ে তুমুল বাগবিতণ্ডা হয়– তামাম ইউরোপ-আমেরিকা জুড়ে। পোপবৈরীরা তাঁকে যে পরিমাণে দোষী সাব্যস্ত করেছেন সেটা সাধারণ রাজনৈতিকের পক্ষে মারাত্মক হত। এঁরা স্মরণ করিয়ে দেন, ১৯৩৩ খ্রিস্টাব্দে হিটলার জর্মন রাষ্ট্রের চ্যানসেলর (সর্বাধিকারী) হওয়ার সঙ্গে সঙ্গেই পোপ জর্মনিতে আপন রোমান ক্যাথলিক চার্চ ও তস্য বিশ্বাসীগণকে নাৎসি নিপীড়ন থেকে রক্ষা করার উদ্দেশ্যে হিটলারের সঙ্গে একটি চুক্তি (কনকরডাট) করেন। এতে করেই বিশ্বজনসমাজ মাঝে হিটলারের জল চল হয়ে যায়। তার পর আর সে পাগল জগাইকে আর ঠেকায় কে? এই তাবৎ মামলা নিয়ে মধ্য-ইউরোপে ফিলমফ এবং নাট্যও দেখানো হয়। ক্যাথলিক সমাজ স্বভাবতই অত্যন্ত মর্মাহত হয়েছিলেন। কলকাতাবাসীদের মনে থাকতে পারে, বহু বছর পূর্বে অংশতম পোপ-বিরোধী মারটিন লুথার নামক একটি ফিল্ম দেখবার সময় তথাকার ক্যাথলিকগণ ফিল্মটির বিরুদ্ধে রচিত ছাপা হ্যান্ডবিল বিতরণ করেন, এবং সেটাকে বয়কট করার জন্য অনুরোধ জানান।

৮. নাৎসি রাজত্বে ক্ষমতার ধাপগুলো ছিল : হিটলার হিমলার কালুটেন ব্রুনার আইষমান। হিটলার-হিমলার আত্মহত্যা করেন– আইষমান তখন ফেরার। ফলে সব চাপ গিয়ে পড়ে কালটেন ব্রুনারের ওপর। এরও ফাঁসি হয়। নিষ্ঠুরতায় এর সমকক্ষ লোক পাওয়া কঠিন।

৯, রোজেবেরুককে নাৎসি দলের চিন্ময় নেতা= স্পিরিচুয়াল ফুরার আখ্যা দেওয়া হয়েছিল। তার প্রখ্যাততম গ্রন্থ বিংশ শতাব্দীর মিথ গ্রন্থে তিনি উঠেপড়ে লাগেন, আর্যরাই যে পৃথিবীর সর্বোকৃষ্ট জাতি সেইটে প্রমাণ করার জন্যে।

১০. হিরোশিমার এটম বম্ বর্ষণ বাবদে জনৈক প্রত্যক্ষদর্শী জাপানি চিকিৎসকের একটি বয়ান আমার হাতে এসে পৌচেছে– inspite of the sharks, popularly and mistakenly known in Calcutta as Foreign Book-seller সুযোগ পেলে সেটি পাঠকের হস্তে সমর্পণ করব। ডাক্তারটি বোমা পতনের ফলে আহত হয়ে কয়েক বছরের ভিতরেই অসহ্য যন্ত্রণা ভোগ করে মারা যান।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *