আবার অশুভ সঙ্কেত – ১৪

চোদ্দ

বিবিসি’র চীফ প্রেস অফিসার জিম থ্রপলটন আমেরিকান এমব্যাসী থেকে দাওয়াত পেয়ে আহ্লাদিত এবং কৌতূহলী হয়ে উঠল। এসভেনর স্কোয়ারে ট্যাক্সি চড়ে যাচ্ছে, পকেটে হাত ঢুকিয়ে ক্যাসেটটার স্পর্শ নিল। ফ্রেডরিক আর্থার এটার ব্যাপারে কেন আগ্রহ বোধ করেছেন ভেবে অবাক লাগছে তার। অ্যামব্যাসাডরের অফিসে ঢোকার সময় আর্থারের পূর্বসুরি এক রাষ্ট্রদূতের নির্মম মৃত্যুর কথা মনে পড়ে গেল। অ্যান্ড্রু ডয়েল। তিনি প্রেস কনফারেন্স ডাকার পর নিজের অফিসে বসে আত্মহত্যা করেন। জিমের তখন বয়স কম, রিপোর্টার হিসেবে অনেকের মত ডয়েলের আত্মহত্যার কারণ উদ্ঘাটন করতে চেয়েছিল সে-ও। কিন্তু ব্যর্থ হয়েছে।

‘অ্যামব্যাসাডর এখুনি দেখা করবেন আপনার সাথে।’ জানাল সেক্রেটারি।

জবাবে হাসি মুখে মাথা ঝাঁকিয়ে অফিসে ঢুকে পড়ল জিম। হাত বাড়িয়ে দিল আর্থার। হ্যান্ডশেক করার সময় ইউনাইটেড স্টেটস লেখা বড় সিলটার দিকে চোখ চলে গেল জিমের। ওখানে, বুলেটের আঘাতে ছিটকে পড়া ডয়েলের মগজ লেগে ছিল। ফটোগ্রাফ দেখেছে সে। ছবিটা এমন গা গোলানো যে কখনও ছাপা হয়নি পত্রিকায়।

‘এসেছেন বলে খুশি হয়েছি,’ বলল আর্থার।

‘আপনার সেবায় লাগতে পেরে নিজেকে ধন্য মনে করছি।’

‘টেপটা এনেছেন?

পকেট থেকে টেপটা বের করল জিম, আর্থার ইঙ্গিত করল ওকে টিভির সামনে যেতে। জিম ক্যাসেট ঢোকাচ্ছে ভি.সি.আরে, আর্থার কফি ঢালল দু’জনের জন্যে।

কফির কাপে চুমুক দিতে দিতে প্রোগ্রামটা দেখল ওরা। পর্দায় ফুটে উঠেছে টাইটেল: ওয়ার্ল্ড ইন ফোকাস।

এক তরুণী হাসল ক্যামেরার দিকে তাকিয়ে, তারপর ভূমিকা শুরু করে দিল। ‘কেট খুব সুন্দরী ছিল,’ নরম গলায় বলল জিম। ‘এবং প্রতিভাময়ী।’

‘চিনতেন ওকে?’

‘অল্প। খুব ট্রাজিক একটা ঘটনা। খুব কম বয়স ছিল মেয়েটার।’

‘শুনেছি মেয়েটা ক্যান্সারে মারা গেছে,’ পর্দায় চোখ রেখে বলল আর্থার।

‘হ্যাঁ।’

পর্দায় ডেমিয়েন থর্নকে দেখা গেল এবার। কেট রেনল্ডস সাক্ষাৎকার নিচ্ছে তার। কয়েক মিনিট কেটে গেল। ফিসফিস করে বলল জিম, ‘এবার।’

ডেমিয়েনের কথা বলার ভঙ্গিটা আন্তরিক, প্রাণবন্ত। ক্যামেরা ধরল কেটকে। মনোযোগের সাথে ডেমিয়েনের কথা শুনছে সে। কেট হঠাৎ ছাতের দিকে মুখ তুলে চাইল, চেহারায় ফুটে উঠল আতঙ্ক, দুড়ম করে কি একটা পড়ল টেবিলের ওপর। একটা লোক, ঝুলছে, মাথাটা দুলছে এদিক-ওদিক।

‘ভয়ঙ্কর একটা দৃশ্য,’ চাপা গলায় বলল জিম। ‘চোখে দেখা যায় না।’ কিন্তু আর্থার অপলক তাকিয়ে রইল টিভি স্ক্রীনের দিকে। বিদ্যুতের একটা ঝাড়ের ওপর থেকে পড়ে যায় বেচারা, পা বেঁধে গিয়েছিল রশিতে, তারপর আটকে যায় পর্দার মধ্যে। ঝুলতে থাকে ওখানে। এমন সময় বিস্ফোরিত হয় বৈদ্যুতিক বাল্বগুলো, আগুন ধরে যায় লোকটার গায়ে।’ ধারা ভাষ্যকারের মত বলে চলল জিম।

পর্দা হঠাৎ কালো হয়ে গেল।

‘নাইলনের পর্দায় পেঁচিয়ে গিয়েছিল হতভাগা। পুড়ে রোস্ট হয়েছে।’

‘পর্দায় লোকটাকে প্রথম যখন দেখা গেল সে জায়গাটা আবার দেখান তো।’ জিম একটা বোতাম টিপল, ঝুলন্ত লোকটাকে দেখা গেল আবার।

‘ফ্রিজ করে রাখুন।’

পর্দার সামনে গিয়ে দাঁড়াল আর্থার, ঝুঁকল।

‘আবার চালান।’

আর্থারের নির্দেশ পালন করল জিম।

‘থামুন।’

আবার পর্দার ওপর ঝুঁকে এল আর্থার। লোকটার চেহারা দেখল, দেখল বিকৃত মুখটা হাঁ হয়ে আছে চিৎকারের ভঙ্গিতে।

‘ওটা কি?’ পর্দার এক কোণে চকচকে এক টুকরো ধাতব খণ্ডের দিকে ইঙ্গিত করল আর্থার।

কাঁধ ঝাঁকাল জিম। ‘বলতে পারব না। ঝাড় থেকে ছিটকে পড়া কোন বোল্ট হবে হয়তো।’

‘ছুরি-টুরি নয়তো?’-

‘ছুরি?’ হতভম্ব দেখাল জিমকে।

‘কোন ছুরি পাওয়া যায়নি?’

‘না।’

আর্থার রিমোটটা জিমের হাত থেকে নিয়ে নীরবে টেপটাকে রিউইন্ড আর ফরোয়ার্ড করল।

‘লোকটার পরিচয় জানা সম্ভব হয়নি,’ বলে চলল জিম। ‘গোটা ব্যাপারটা ছিল রহস্যময়। তবে আমার ধারণা এ ঘটনার মধ্যে ছুরি-টুরির কোন ভূমিকা ছিল না।’

মৃদু মাথা দোলাল আর্থার, টেপটা বের করে জিমের হাতে দিল।

‘থ্যাঙ্কিউ অ্যানিওয়ে। আসার জন্যে ধন্যবাদ।’ দোরগোড়ায় দাঁড়িয়ে জিমের সাথে হাত মেলাল সে। ‘ঘটনাটা কাউকে বলার দরকার নেই কেমন? স্রেফ অলস একটা কৌতূহল ছিল আমার।’

জিম ঠোঁটে একটা আঙুল রেখে হাসল।

‘আপনার জন্যে যদি কিছু করার থাকে…’ বলল আর্থার।

‘আমরা একটা সিরিজ করার চিন্তাভাবনা করছি, স্যার। ক্ষমতাবান ব্যক্তিদের সমাজ জীবন-’

‘ঠিক আছে,’ ওকে বাধা দিল আর্থার। ‘আমার সেক্রেটারির সাথে কথা বলুন। একটা সময় বের করা যাবে।’

জিম থ্রপলটন এমব্যাসী থেকে বেরিয়ে ট্যাক্সি নিল। বাড়ি ফেরার পথে রাষ্ট্রদূতের সাথে আলাপচারিতার বিষয়টা নিয়েই ভাবল। বিচ্ছিন্ন এবং অদ্ভুত মনে হয়েছে তার গোটা ব্যাপার। সন্দেহ হলো আর্থার গোপনে কিছু করছেন কি না।

.

বিকেল পর্যন্ত টানা কাজ করল ফ্রেডরিক আর্থার। সেক্রেটারি চলে যাবার পর ফোন করল বাড়িতে।

বাসায় নেই শীলা। খুশি হলো আর্থার। স্ত্রীকে মিথ্যা কথা বলতে হলো না। অ্যানসারিং মেশিনে মেসেজ রেখে গেল-ফিরতে দেরি হবে, সাড়ে ন’টা বেজে যেতে পারে। তারপর বেরিয়ে পড়ল অফিস থেকে।

শেষ বিকেলের জ্যামে আটকা পড়ে একটা ঘণ্টা নষ্ট হলো আর্থারের। আরও চল্লিশ মিনিট লাগল গলি-উপগলি ধরে বার্কশায়ারে পৌঁছুতে। রাস্তায় দু’বার থামল সে, ম্যাপ দেখল। ইংরেজি ‘টি’ অক্ষরের মত দু’মুখো একটা রাস্তায় পৌছুল, তারপর মোড় নিল বামে। এটা একটা সরু, মেঠো রাস্তা। সারের গন্ধ ধাক্কা মারল নাকে। রাস্তাটা জনশূন্য। একটা খামার বাড়িও চোখে পড়ল না। অডোমিটার চেক করল ও। ডি কার্লোর বর্ণনা অনুসারে আসল জায়গায় চলে আসার কথা ওর।

একটা বাঁক ঘুরতেই সামনে একটা পাব দেখতে পেল আর্থার। আলো জ্বলছে। ছোট উঠনে গাড়ি থামাল সে। ওটা পার্কিং লট হিসেবে ব্যবহার করা হচ্ছে। গাড়ি থেকে নামল আর্থার। মুখ তুলে চাইল আকাশের দিকে। হালকা মেঘ জমেছে।

পাবে ঢুকল আর্থার। ছোট পাব। আর দশটা গ্রাম্য শুঁড়িখানার মতই, নিচু ছাত, মোটা, কালো খিলান। গরম পড়েছে। তবু কাঠের ফায়ার প্লেসে আগুন জ্বলছে।

বার ম্যান ওরফে শুঁড়িখানার মালিক মোটাসোটা, ভালুকের মত পেট, ঠোঁটের ওপর মস্ত গোঁফ, লাল টকটকে গাল। আর্থারকে দেখে ঝলমলে চোখে তাকাল।

আর্থার ব্রান্ডির অর্ডার দিল।

‘আমেরিকান, স্যার?’

‘না, শুধু সোডা।’

হেসে ফেলল শুড়িখানার মালিক। ‘না, স্যার। জিজ্ঞেস করেছি আপনি আমেরিকান কিনা।’

‘ও, হ্যাঁ।’

চারপাশে চোখ বোলাল আর্থার। বার এবং আগুনের ধারে কয়েকজন গ্রামবাসী বসে আছে। একজন তার দিকে তাকিয়ে চোখ পিটপিট করল। প্রত্যুত্তরে হাসল আর্থার।

ঘরে তৈরি ব্রান্ডি এনে দিল মোটকু আর্থারকে। আর্থার ভেবেছিল খেজুরে আলাপ জুড়ে দেবে লোকটা। গ্রামের শুঁড়িখানায় এমনটাই হয়। আমেরিকান পেলে নানা গপপো শুরু করে দেয়। তবে এ লোকটা ওরকম নয়।

তৃতীয় গ্লাস ব্রান্ডি পান করার পর শুঁড়িখানার মালিককে প্রশ্নটা করল আর্থার। ‘ও, হ্যাঁ,’ বলল সে। ‘এদিকে জিপসীদের আনাগোনা প্রচুর। সবগুলো শয়তানের হাড্ডি।

‘অদ্ভুত কোন জন্মের কথা শুনেছেন আপনি এখানে? বিশ বছর আগে?’

হাসল লোকটা। ‘জিপসীদের সবার জন্মই অদ্ভুত। কিন্তু আপনি ঠিক কি বলতে চাইছেন বুঝতে পারলাম না, স্যার।’

শ্রাগ করল আর্থার। জিপসীদের অনেক অদ্ভুত জন্মের কথা শুনেছি কিনা তাই আর কি।’

‘আপনি সাংবাদিক, স্যার?’

‘না। স্রেফ ট্যুরিস্ট।’

মাথা ঝাঁকিয়ে সরে গেল শুঁড়িখানার মালিক আরেক খদ্দেরের কাছে। ড্রিঙ্কটা শেষ করল আর্থার, উঠে পড়ল। নিজের ওপর রাগ লাগছে খুব। খামোকা সময় নষ্ট। এখানে কি পাবার আশায় এসেছে সে? আর্থার ঠিক করল জায়গাটা এক চক্কর দেখে বাড়ি ফিরে যাবে।

গ্রামবাসীদের শুভরাত্রি জানিয়ে পাব থেকে বেরিয়ে এল আর্থার। ওরা ওকে যেতে দেখল। শুঁড়িখানার মালিক বার ফ্ল্যাপ তুলে ধাক্কা মেরে হাফ-ডোরটা খুলল। তারপর সরে দাঁড়াল। খোলা দরজা দিয়ে বেরিয়ে এল তার কুকুরটা। অনুসরণ করল আর্থারকে। মাথা তুলে বাতাসের গন্ধ শুঁকল, তাকাল মেঘের দিকে, তারপর নিঃশব্দে এগোল, মাটিতে তার পায়ের কোন ছাপ পড়ল না।

.

একটা জলার সামনে দাঁড়িয়ে আছে ফ্রেডরিক আর্থার। জলায় থকথকে কাদা আর আগাছা ছাড়া কিছু নেই। স্যাঁতসেঁতে একটা গন্ধ ঢুকে পড়ছে ফুসফুসে। শুধু শুধু সন্ধেটা নষ্ট করার জন্যে নিজেকে আবার গালি দিল আর্থার। তারপর ঘুরল।

পাবটাকে দেখা যাচ্ছে না। কপালে ভাঁজ পড়ল আর্থারের। খানিক এগোবার পর ছাতের কাঠামোটা নজরে এল। ওরা আলো নিভিয়ে দিয়েছে। ঘড়ি দেখল আর্থার। এত তাড়াতাড়ি? শ্রাগ করল সে। এ নিয়ে তার মাথা না ঘামালেও চলবে। সে পা বাড়াল গাড়ির দিকে। হঠাৎ হিম বাতাস বইতে শুরু করল। গায়ে কাঁটা দিল আর্থারের।

গাড়ির ভেতর ঢুকল আর্থার। সারের গন্ধটা পাচ্ছে আবার। এবার যেন ভেতর থেকে আসছে। ইঞ্জিন চালাল আর্থার, ফ্যানের সুইচ অন করল। ঘুরল না ফ্যান। লাল বাতিটা জানান দিল বৈদ্যুতিক সমস্যা হয়েছে। ঘোঁৎ ঘোঁৎ করে উঠল আর্থার। ভাবল, ফ্যান নষ্ট হয়েছে হোক, এখন ভালয় ভালয় বাড়ি ফিরতে পারলেই বাঁচি।

গাড়ি চলতে শুরু করেছে, টপাস করে বৃষ্টির ফোঁটা পড়ল উইন্ডশিল্ডে। গ্লাসে, ওয়াইপারের গায়ে জমে আছে মরা পোকা। উইন্ডশিল্ড ওয়াশার চালু করতে গিয়ে দেখল ওটাও নষ্ট। এদিকে গন্ধটা বেড়েই চলেছে। জানালা খোলার জন্যে বোতাম টিপল আর্থার। খুলল না। মনে মনে গালি দিল ও। জুতোর ভেতর মুঠো করল পায়ের আঙুল, স্যাঁতসেঁতে ভাবটা যেন গোড়ালি বেয়ে উঠে আসছে।

‘শালার ড্যাম্প,’ বিড়বিড় করল আর্থার। গাড়ির গতি বাড়ছে, বাম দিকে তাকাতে এক ঝলক দেখতে পেল ও ওটাকে। মনে হলো একটা কুকুর তাকিয়ে আছে কটমট করে। রিয়ার ভিউ মিররে চাইল আর্থার। কেউ নেই।

মাথাটা ঘুরছে আর্থারের। অতখানি ব্রান্ডি খাওয়া উচিত হয়নি। মদের প্রভাব ওর অনুভূতিগুলোকে ভোঁতা করে দিচ্ছে, তালগোল পাকিয়ে যেতে চাইছে সবকিছু। কিন্তু তিনটে ব্রান্ডি এক সাথে এর আগেও অনেক পান করেছে আর্থার। কই, তখন তো কিছু হয়নি। এখন হচ্ছে কেন?

বৃষ্টির বেগ বেড়েছে। কাঁচ থেকে খসে পড়েছে পোকাগুলো। কিন্তু ওয়াইপারের অবস্থা আগের মতই। জানালা দিয়ে উঁকি দিল আর্থার। ওই তো দুমুখো রাস্তাটা দেখা যাচ্ছে। টি আকারের সাইন পোস্টটা নির্দেশ করছে বাম দিকে লন্ডন। রাস্তা খালি। হুইল ঘোরাল আর্থার, নিজের অজান্তে চোখ চলে গেল আয়নায়, দাঁড়িয়ে পড়ল ব্রেক কষে। সাইনপোস্টে কি যেন ঝুলছে, ছোট, গোলাপী রঙের। গেঁথে রয়েছে কাঠের সাথে। গাড়ি নিয়ে পিছিয়ে এল আর্থার। না, কিছু না। আলো পড়ে দূর থেকে অমন মনে হয়েছে। অ্যাকসিলেরাটরে চাপ দিল আর্থার, কিন্তু সাড়া দিল না গাড়ি

প্রথমে বামে তারপর ডানে তাকাল আর্থার। দু’পাশেই ঝোপঝাড়। জনমনিষ্যির চিহ্ন নেই কোথাও

ক্লাচ চেপে ধরল আর্থার, গিয়ার বদলাল, দু’পাশে মাথা ঝাঁকাচ্ছে। ঝিম ধরা ভাবটা আবার ফিরে এসেছে। গন্ধটা হঠাৎ বেড়ে গেছে। বমি আসছে ওর। খকখক কেশে উঠল আর্থার, আবার তাকাল আয়নার দিকে এবং আঁতকে উঠল। দুঃস্বপ্নে দেখা সেই ভয়ঙ্কর বাচ্চাটা খলখল করে হাসছে তার দিকে তাকিয়ে।

চিৎকার দিল আর্থার, চোখে হাত চাপা দিল। ঠিক তখন চলতে শুরু করল গাড়ি। এগোচ্ছে, রাস্তার পাশে, জলভরা একটা ডোবার দিকে। প্রচণ্ড জোরে উইন্ডশিল্ডে যখন ঠুকে গেল মাথা, তখনও চিৎকার করে চলেছে আর্থার।

.

শীলা আর্থার ফাঁকা চোখে তাকিয়েছিল টিভি পর্দার দিকে, মাঝে মাঝে ঘড়ি দেখছে। হঠাৎ বেজে উঠল ফোন।

‘হাই,’ উৎফুল্ল ভঙ্গিতে বলল সে, তারপর কাঁধ ঝাঁকাল।

‘না, ফেরেনি এখনও ও। ফিরলে জানাব।’

ফোন রেখে আবার সোফায় বসল শীলা। চোখ চকচক করছে। আধঘণ্টা পর আবার ফোন বাজল। ঝট্ করে রিসিভার তুলল শীলা, ‘হ্যাঁ,’ শব্দটা উচ্চারণ করল পরপর তিনবার, তারপর জিজ্ঞেস করল, ‘কোন্ হাসপাতাল?’ শেষে রিসিভার রেখে দৌড় দিল দরজার দিকে।

.

নরম, কোমল একটা হাত ওর কপালে বুলিয়ে দিচ্ছে কেউ। হাতটা ধরে ফেলল আর্থার, চোখ মেলার চেষ্টা করল। পারল না। শুনতে পেল একটা নারী কণ্ঠ তাকে বলছে সব ঠিক আছে। আঙুলগুলো শিশুর মত ধরে থাকল আর্থার। হঠাৎ টের পেল সুই ঢোকানো হচ্ছে তার শরীরে। আঁধার হয়ে এল আর্থারের দুনিয়া।

তালুতে দপদপে ব্যথা নিয়ে আবার জেগে উঠল আর্থার। ঘেমে নেয়ে গেছে একেবারে। সেই ভয়ঙ্কর দুঃস্বপ্নটা আবার দেখেছে। চোখ পিটপিট করল। কি হয়েছে মনে করার চেষ্টা করল। মনে পড়ছে না। মুখে হাত দিল ও। ব্যান্ডেজ বাঁধা মুখে। মাথায়ও। ধীরে ধীরে উঠে বসল বিছানায়। মাথাটা ঘুরে উঠল খুব, আবার শুয়ে পড়ল। কিছুক্ষণ পর বিছানা থেকে পা নামাল আর্থার, দরজার ধারে যাবে। কিন্তু শরীর টলছে। যেতে পারল না। বেডসাইড টেবিল থেকে একটা আয়না তুলে নিল। ভয়ে ভয়ে তাকাল ওদিকে। না, ভয়ের কিছু নেই। নিজের মুখটাকেই দেখতে পাচ্ছে সে। ব্যান্ডেজের নিচে ফোলা মুখ।

‘আর্থার!’

মুখ তুলে চাইল আর্থার। শীলা। দাঁড়িয়ে আছে দোরগোড়ায়। ওকে দেখে হাসল, কাছে এসে হালকা ভাবে ঠোঁট ছোঁয়াল মুখে। তারপর ওকে শুইয়ে দিল বিছানায়।

‘কি হয়েছিল আমার?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।

‘তুমি অ্যাক্সিডেন্ট করেছিলে। রক্তাক্ত অবস্থায় ওরা তোমাকে উদ্ধার করে। তুমি-‘

‘ওরা বাচ্চাটাকে উদ্ধার করতে পেরেছে?’

‘তুমি হ্যালুসিনেশনে ভুগছ,’ শিশু ভোলানো মিষ্টি হাসল শীলা। ‘অবশ্য এটাই স্বাভাবিক। মাথায় যা লেগেছে তোমার!’

কপালে হাত বুলিয়ে দিল শীলা, ওর হাতটা ধরে রইল আর্থার। টুকরো টুকরো স্মৃতি মনে পড়তে গিয়েও পড়ছে না। ‘এখন ঘুমাও,’ বলল শীলা।

চোখ বুজল আর্থার। কয়েক সেকেন্ড পর চোখ মেলে দেখল বেশ্যাদের মত নিতম্ব দুলিয়ে চলে যাচ্ছে শীলা। শীলা একবারও জিজ্ঞেস করেনি কেমন আছে আর্থার। যেন তাতে তার কিছু আসে যায় না। আবার চোখ বুজল আর্থার দীর্ঘশ্বাস ফেলে। একটু পর ঘুমিয়ে পড়ল।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *