আবার অশুভ সঙ্কেত – ১০

দশ

লিফটে ফ্রেডরিক আর্থারের সাথে দুই তরুণ উঠল। তাদেরকে মৃদু গলায় ‘শুভ সন্ধ্যা’ বলল রাষ্ট্রদূত। নিজের চিন্তায় বুঁদ হয়ে ছিল বলে শুরুতে ওদের কথা শুনতে পায়নি আর্থার। সচেতন হয়ে উঠল ‘শিকাগো’ শব্দটা শুনে। দুই তরুণ শিকাগোর এক প্লেন যাত্রীর করুণ মৃত্যু নিয়ে আলোচনা করছে। প্লেনের চাকার নিচে পড়ে চিড়ে-চ্যাপ্টা হয়ে গেছে বেচারা, বলছিল একজন তার সঙ্গীকে। ‘চিন্তা করতে পারো কেনেডি এয়ারপোর্টে ল্যান্ড করার সময় প্লেন টানা দু’মাইল দৌড়েছে। আর বেচারা যাত্রী চাকার সাথে পিষতে পিষতে ভর্তা হয়ে গেছে,’ শিউরে উঠল এক তরুণ।

‘লোকটা কি করত?’ জিজ্ঞেস করল আর্থার।

‘শুনেছি অ্যান্টিক ডিলার ছিল,’ জবাব দিল তরুণ। ‘পেপারে বেরিয়েছে খবরটা। নিউজেও দেখিয়েছে।

‘তার নাম কি ওয়াল্টার?’

‘জ্বী। জ্বী,’ তরুণ বিস্মিত চোখে তাকাল আর্থারের দিকে। ‘আপনি তাকে চিনতেন নাকি, স্যার?’

খুলে গেল লিফটের দরজা, ডানে-বামে মাথা নেড়ে বেরিয়ে এল আর্থার।

.

সে সন্ধ্যায় ফ্রেডরিক আর্থারের মন জুড়ে আচ্ছন্ন হয়ে রইল নিকোলাস ওয়াল্টার। চেষ্টা করল ভুলে থাকতে। কিন্তু চেহারাটা যেন মগজে ছাপ মেরে আছে, সরু গলাটা বারবার বাজছে কানে। ডিনারে কিছুই খেতে পারল না আর্থার। শীলার প্রশ্নের হুঁ হাঁ জবাব দিয়ে গেল। টিভিতে ওয়াল্টারের খবর দেখাল সবশেষে। সংবাদ পাঠক বললেন দুর্ঘটনা কিভাবে ঘটল প্যান অ্যাম তা তদন্ত করে দেখছে।

‘বেচারা!’ বলল আর্থার।

‘সম্ভবত মাতাল ছিল। নইলে প্লেন থেকে পড়ে যায় কেউ?’ মন্তব্য করল শীলা।

আর্থার কিছু না বলে বেরিয়ে এল ঘর থেকে, ঢুকল স্টাডিরুমে।

নিকোলাস ওয়াল্টারের প্যাকেজটা কতগুলো পত্রিকার ওপর রাখা। খোলা হয়নি এখনও। খুলল আর্থার। দুটো খাম, এক তাড়া নোট আর একটা পত্রিকার কাটিং বের হলো। নোটের প্রথম পৃষ্ঠায় আলাদা এক টুকরো কাগজ স্ট্যা করা। কাগজের মাথায় লন্ডনের এক হোটেলের ঠিকানা।

‘ডিয়ার মি. অ্যামব্যাসাডর,’ পড়ল আর্থার। ‘কৌতূহল প্রকাশের জন্যে ধন্যবাদ। অনুগ্রহ করে নোট আর চিঠি দুটি পড়বেন। অনুরোধ রইল পুরোটা পড়ার জন্যে। আমি শীঘ্রি কিছু নিখাদ প্রমাণ নিয়ে আপনার সামনে হাজির হব।

নিচে নিকোলাস ওয়াল্টারের স্পষ্ট হস্তাক্ষরের দস্তখত।

ব্রান্ডির বোতলের দিকে হাত বাড়াল আর্থার, ঢালল গ্লাসে। একটু আগে শীলা অনুযোগ করেছে সে আজ বেশি মদ খাচ্ছে। গ্রাহ্য করেনি আর্থার।

ওয়াল্টারের লিখিত নির্দেশ মত প্রথম চিঠিটা খুলল সে।

‘আগামী হপ্তা, ফাদার, আমাকে ক্লিনিকে ভর্তি করা হবে…’ ব্রান্ডির গ্লাসে চুমুক দিতে দিতে চিঠির ওপর ঝুঁকল আর্থার, ডেস্ক ল্যাম্পটা একটু ডানে সরাতে আলোটা সরাসরি পড়ল কাগজে। প্রথমটা পড়া শেষ করে দ্বিতীয়টা খুলল আর্থার। ‘ক্ষমা করুন, ফাদার, যে পাপ আমি করেছি…’

আবার সেই চিঠি! গুঙিয়ে উঠল আর্থার। সিনথিয়া অ্যাবটের চিঠি দলা পাকাল মুঠোর ভেতর। ইচ্ছে করছে কাগজটা ছিঁড়ে ফেলে দেয়। কিন্তু শেষ পর্যন্ত কৌতূহলের জয় হলো। আবার পড়তে শুরু করল। পড়া শেষে খামের ভেতর ঢোকাল চিঠি। এবার নোটগুলোর দিকে নজর দিল। প্রথম পৃষ্ঠায় টাইপ করা ‘মনাস্টেরি অভ সান বেনেডেটো।’

ফাদার ডি কার্লো সহজ ভাষায় লিখেছেন। বলেছেন আঠারো বছর আগে ক্যাসিওপিয়ায় কিভাবে কতগুলো তারা একত্র হয়ে পড়েছিল, কিভাবে তিনি এবং তাঁর ছয় সন্ন্যাসী ইংল্যান্ড এসেছিলেন অ্যান্টিক্রাইস্টকে ধ্বংস করতে, কিভাবে তাঁরা অন্ধকারের শক্তির সাথে লড়াই করেছেন এবং কিভাবে ছয় সন্ন্যাসীকে জীবন দিতে হয়েছে।

এসব ঘটনার বিশদ বর্ণনা দেননি ডি কার্লো, সংক্ষেপে লিখেছেন। শেষ প্যারাটা কর্কশ গলায়, ফিসফিসিয়ে পড়ে গেল আর্থার। ‘তিন তারকার মিলন হলো, সঙ্কেত পেলাম যীশুর দ্বিতীয়বার আগমনের। ভেবেছিলাম অ্যান্টিক্রাইস্টকে অবশেষে ধ্বংস করতে পেরেছি। ভেবেছিলাম ওটাই আমাদের শেষ লড়াই। কিন্তু ভুল ভেবেছিলাম। অ্যান্টিক্রাইস্টের শক্তি ধ্বংস হয়নি। তবে ঈশ্বর পুত্র আবার এসেছেন পৃথিবীর বুকে। অশুভ শক্তির সাথে তাঁর সাক্ষাৎ হবে রোজ-কেয়ামতের দিনে।’

শেষ চিঠিটি লিখেছে নিকোলাস ওয়াল্টার।

‘ব্যাপারটা বুঝতে হলে,’ লিখেছে ওয়াল্টার, ‘আপনাকে বাইবেল নিয়ে বসতে হবে…’

উঠে দাঁড়াল আর্থার, টলমল পায়ে এগোল শেলফের দিকে। বাইবেলের ওপর ধুলো জমে গেছে। ফুঁ দিল আর্থার। কেশে উঠল খক খক করে। নাকে-মুখে ঢুকে গেছে ধুলো। শেষ কবে বাইবেল খুলেছে মনে করতে পারল না।

ওয়াল্টার তার নোট বইতে বাইবেল থেকে কিছু উদ্ধৃতি দিয়েছে। সেই সাথে উদ্ধৃতিগুলোর বৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যাও করেছে। আর্থার বাইবেলের সাথে ওয়াল্টারের নোটের উদ্ধৃতি মিলিয়ে দেখল। তারপর থম্ মেরে বসে রইল।

বাইবেলে এক জায়গায় আছে ‘জাতি শত্রু হইয়া উঠিবে জাতির…’ এ উদ্ধৃতির ব্যাখ্যা করেছে ওয়াল্টার এভাবে-’অনেকের বিশ্বাস বাইবেলের এ উদ্ধৃতির সাথে প্রথম বিশ্বযুদ্ধের ঘটনা মিলে যায়।’

‘দেখা দিবে দুর্ভিক্ষ, মহামারী এবং ভূমিকম্প; ম্যাথিউ ২৪। ওয়াল্টার লিখেছে, ‘এবং তাই ঘটেছে ইতালি, চীন এবং জাপানে।

‘ম্যাথিউ যাকে কেয়ামতের দিন বলেছে তার লক্ষণ সবে শুরু, লিখেছে ওয়াল্টার। ‘দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধ, বিশ্বব্যাপী দুর্ভিক্ষ, ইসরায়েলে জুবিলী হামলা; ওই মহাযুদ্ধ প্রত্যক্ষ করেছে সেরকম মানুষ এখন খুব কমই বেঁচে আছে। কেয়ামতের দিন সম্পর্কে যে ভবিষ্যদ্বাণী করা হয়েছে তা সত্যি আসছে। শুধু বাইবেলেই নয়, জাসটিন, টারটুলিয়ানের মত পণ্ডিত ব্যক্তিরাও এ ব্যাপারে সতর্ক করে দিয়ে গেছেন।’

জুবিলী অর্থাৎ প্রতি পঞ্চাশ বছর অন্তর ইহুদিরা যে ধর্মোৎসব করে, সেই সুবর্ণ জয়ন্তীর বছর আবার আসছে ২০০০ সালে। ওয়াল্টার বলছে, এই সুবর্ণ-জয়ন্তীর বছরই কেয়ামতের বছর। নতুন শতকের এই বছরে আবার সংঘাত হবে শুভ এবং অশুভের মাঝে। যদি অশুভকে ধ্বংস না করা যায়, পৃথিবী পরিণত হবে অরাজক এক গ্রহে। তবে আশার কথা, যীশু আবার জেগেছেন। তাঁর সাহায্য নিয়ে ধ্বংস করতে হবে অ্যান্টিক্রাইস্টকে।

শ্যারন ফেয়ারচাইল্ডের লেখাটার দিকে তাকাল আর্থার, পড়তে ইচ্ছে করছে না। ইতিমধ্যে ব্রান্ডির বোতল প্রায় শেষ করে ফেলেছে সে। মাথা টলছে। এতক্ষণ যা পড়েছে, পুরো ব্যাপারটাই অবিশ্বাস্য আর পাগলামি মনে হচ্ছে। সিধে হলো ও, বাতি নিভিয়ে পা বাড়াল দরজার দিকে, সামান্য টলছে। শীলা হয়তো ঘুমিয়ে পড়েছে। বিয়ের পর এই প্রথম স্ত্রীর কণ্ঠ শুনতে মন চাইল না আর্থারের। ওকে এখন কেউ বিরক্ত করুক মোটেই চাইছে না।

চুপচাপ বিছানায়, শীলার পাশে শুয়ে পড়ল আর্থার। গভীর শ্বাস নিচ্ছে শীলা, ঘুমে অচেতন। জানালা দিয়ে রাতের আকাশে তাকাল আর্থার, অলস মস্তিষ্কে বৃথাই তারাগুলোর নাম দেয়ার চেষ্টা করল, হাল ছেড়ে দিয়ে চোখ বুজল, প্রায় সাথে সাথে ঘুমিয়ে পড়ল।

পরদিন সকালে আগে ভাগে অফিসে গেল ফ্রেডরিক আর্থার। তবে কাজে তেমন মন দিতে পারল না। আগের রাতে ভয়ানক এক দুঃস্বপ্ন দেখেছে। ওটা তার মগজ যেন কুড়ে কুড়ে খাচ্ছে।

সারাটা সকাল তার গেল কাজের ভান করে, কয়েকটা ফোন করে আর কারণে- অকারণে সেক্রেটারিকে ধমকে। দুপুরে লাঞ্চ করল পররাষ্ট্র মন্ত্রণালয়ের তরুণ এক ডিপ্লোম্যাটের সাথে। আসন্ন মীটিং নিয়ে কথা বলল দু’জনে। আসলে কথা বলল তরুণ, আর্থার শুধু হুঁ হাঁ করে গেল।

ডেস্কে ফিরে প্যাকেজটার কথা আবার মনে পড় গেল আর্থারের। স্টাডিরুমে তালা মেরে রেখেছে ওটা। হঠাৎ একটা নাম ঝিলিক দিল মনে। ইন্টারকমের সুইচ টিপল আর্থার।

‘মার্টিন কেইডিনকে দাও।’

এক মুহূর্ত পর চীফ প্রেস অ্যাটাচের কণ্ঠ ভেসে এল।

‘মার্টিন, শ্যারন ফেয়ারচাইল্ড নামে একটা মেয়ে কিছুদিন আগে আমার ইন্টারভ্যু নিতে চেয়েছিল না?’

‘এক মিনিট স্যার,’ চীফ প্রেস অ্যাটাচে দ্রুত তার ফাইল দেখল। তারপর বলল, ‘জ্বী, স্যার। মেয়েটা ড্যাগার, ছোরা ইত্যাদি নিয়ে কথা বলতে চেয়েছিল।’

‘ওকে জানাও আমি ইন্টারভ্যু দেব।’

‘কিন্তু, স্যার। মেয়েটা এমন বিশেষ কেউ নয় যে-’

‘ওর সাথে যোগাযোগ করো।’

‘আপনি যা বলবেন, স্যার।’

চেয়ারে গা এলিয়ে দিল আর্থার। কিছুক্ষণ পর বেজে উঠল ইন্টারকম।

‘কেইডিন বলছি, স্যার। আপনার রিপোর্টারের কোন হদিশ পাওয়া যাচ্ছে না। হঠাৎ যেন হাওয়ায় মিলিয়ে গেছে। আপনার সাথে যেদিন দেখা করতে চেয়েছিল সেদিন থেকে সে নিখোঁজ।’

‘ওহ্, ক্রাইস্ট,’ বলে চেয়ারে এলিয়ে পড়ল আর্থার।

‘এনিথিং রং, স্যার।

‘না, ঠিক আছে।’

‘আমি কি ইন্টারভ্যুর বিষয়টা ফাইলে তুলে রাখব? আবার যদি মেয়েটা আসে…’

‘রাখো। তবে আমার মনে হয় না…’ ম্লান, অস্পষ্ট শোনাল আর্থারের কণ্ঠ।

‘স্যার?’

‘হ্যাঁ, ফাইল করো।’

আরও একজন, ভাবল আর্থার। কড় গুনতে লাগল:

রেনল্ডস, সিনথিয়া, ডি কার্লো, ওয়াল্টার, ডুলান আর এখন শ্যারন, এরা প্রায় সবাই মারা গেছে, দু’একজনের খোঁজ পাওয়া যাচ্ছে না। হয়তো নিখোঁজ মেয়েটাও মরে গেছে।

বেঁচে আছেন শুধু ডি কার্লো। আর্থারের ধারণা উনি একটা পাগল। সত্যি কি তাই?

আবার ইন্টারকম বেজে উঠল। সেক্রেটারি জানাল স্টেট ডিপার্টমেন্ট থেকে ফোন এসেছে। ফোন করেছে বিল ওয়ালেস, আর্থারের ঘনিষ্ঠ বন্ধু। স্টেট ডিপার্টমেন্ট মূলত সে-ই চালায়। পররাষ্ট্র সচিবের মীটিং নিয়ে কথা বলল বিল।

‘চোখ-কান খোলা রাখতে হবে তোমাকে,’ বলল বিল।

‘ওই কাজের জন্যেই আমাকে বেতন দেয়া হয়।’

‘ভাল কথা, আর্থার। দেখলাম আগামী মাসে তুমি ছুটি চেয়েছ। আমি দুঃখিত, ভাই। তবে মনে হয় ছুটিটা তোমার ক্যান্সেল করতে হবে। জানোই তো, সময়টা খুব খারাপ যাচ্ছে।’

‘ঠিক আছে। অসুবিধে নেই।’

‘পরের ফল-এ ছুটি নিয়ো।’

‘বললাম তো অসুবিধে নেই।’ ফোন রাখতে যাচ্ছিল আর্থার, হঠাৎ একটা কথা মনে পড়ে গেল। বিল লোক ভাল। ওকে এরকম অনুরোধ করা যায়।

‘বিল, সরকারী এক কর্মকর্তার নতুন করে কবর খোঁড়া যাবে?’

‘নির্ভর করছে লোকটা কে তার ওপর।’

‘ডেমিয়েন থর্ন।’

‘কি! তোমার হলোটা কি, আর্থার?’

‘থর্নের লাশ কবরে আছে কিনা দেখার উপায় কি বলো?’

‘জেসাস, আর্থার।’

‘জানি পাগলের মত শোনাচ্ছে কথাগুলো। কিন্তু কাজটা করা সম্ভব?’

‘জানি না।’

‘তুমি পারবে কি না বলো।’

‘পারব হয়তো। কিন্তু কেন বলো তো?’

‘বলতে পারি যদি কথা দাও কথাটা গোপন রাখবে।’

কলেজ জীবনের মত অট্টহাসিতে ফেটে পড়ল দুই বন্ধু। হাসতে হাসতে ফোন রেখে দিল আর্থার। এখন ভাল লাগতে শুরু করেছে ওর। যেন কারও বোঝার খানিকটা ভার বইতে পেরে সন্তুষ্ট।

ওয়াশিংটনে, বিল ওয়ালেস তার সেক্রেটারিকে ডেকে বলল, ‘থর্ন কর্পোরেশনে ফোন লাগাও। জলদি।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *