এক
প্রায় এক ঘণ্টা হলো হিথ্রো এয়ারপোর্টের প্রাইভেট লাউঞ্জে বসে আছে যুবক। রানওয়ে আর বার ছুঁয়ে যাচ্ছে তার অস্থির দৃষ্টি, উত্তেজনা কমাতে মদের গ্লাসে চুমুক দিচ্ছে। একটু পরপর ঘড়ি দেখছে সে, হাতে ধরা কাগজের তাড়ায় চোখ বোলাচ্ছে। বুড়োর সাথে এর আগে সাক্ষাৎ হয়নি তার, তবে জানে পল বুহেরের চোখ ফাঁকি দেয়া অত্যন্ত কঠিন। উল্টোপাল্টা কিছু বললে বা ভুল কোন তথ্য দিলে সে খুবই বিরক্ত হয়।
হঠাৎ জ্যান্ত হয়ে উঠল লাউডস্পীকার। একঘেয়ে একটা কণ্ঠ বলতে শুরু করল:
‘থর্ন কর্পোরেশনের প্রাইভেট চার্টার শিকাগো থেকে এইমাত্র ল্যান্ড করল।’
যুবক সশব্দে দম ফেলল।
‘প্লেনের যাত্রী মি. পল বুহের এক্ষুণি টার্মিনাল লাউঞ্জে এসে পৌঁছুবেন। ধন্যবাদ।’
দ্রুত টাইয়ের নট ঠিক করল যুবক, জামার বোতাম লাগাল। থর্ন কোম্পানির চেয়ারম্যান এবং বেশিরভাগ শেয়ারের অংশীদার পল বুহের পশ্চিমা বিশ্বের সবচে’ ক্ষমতাবান এবং প্রভাবশালী ব্যবসায়ীদের একজন। এই মানুষটির একক প্রচেষ্টায় থর্ন কর্পোরেশন বিশ্বের বৃহত্তম মাল্টিন্যাশনাল কমপ্লেক্সে পরিণত হয়েছে। বুহের ত্রিশ বছর আগেই বুঝতে পেরেছিল পৃথিবীতে খাদ্য হলো সবচে’ প্রয়োজনীয় অর্থনৈতিক পণ্য। সে তৃতীয় বিশ্বের বাজার দখল করে ফেলেছে বহু আগে, বর্তমানে থর্ন কোম্পানিকে বিশ্বের বৃহত্তম ফার্টিলাইজার এবং সয়া ম্যানুফ্যাকচারার হিসেবে সবাই চেনে। পল বুহের প্রায়ই বলে ‘আমাদের লাভজনক ভবিষ্যৎ লুকিয়ে আছে দুর্ভিক্ষের মধ্যে।’
বর্তমানে বুহের পরিণত হয়েছে জীবন্ত এক কিংবদন্তীতে।
যুবক তাকিয়ে আছে বাইরে, থর্ন-এর ব্যক্তিগত প্লেন খুঁজছে, এমন সময় লাউঞ্জের দরজা খুলে গেল। ভেতরে ঢুকল পল বুহের। লম্বা, একহারা গড়ন, মাথায় কোঁকড়ানো, সাদা, ঘন চুল।
‘মি. বুহের, দ্রুত তাঁর দিকে এগিয়ে গেল যুবক। ‘আমার নাম জন। লন্ডনে স্বাগতম,’ অনেকটা ট্যুরিস্ট গাইডদের মত শোনাল কথাগুলো।
‘থ্যাঙ্ক ইউ, জন,’ হাসল বুহের। ‘নাইস অভ ইউ টু মিট মি।’
বুহেরের প্রবল ব্যক্তিত্বময় উপস্থিতির কাছে নিজেকে নিতান্তই খেলো মনে হলো জনের। বিনীত গলায় বলল, ‘আপনার জন্যে গাড়ি অপেক্ষা করছে, স্যার।’
‘ঠিক আছে,’ মাথা ঝাঁকাল বুহের। মনে মনে বলল, ব্যাটা বেশি ফাজিল।
.
পুব দিকে ছুটে চলেছে লিমোজিন, জন একটানে খুলে ফেলল ককটেল ক্যাবিনেট। মাথা নেড়ে নিষেধ করল পল বুহের। খাবে না।
‘লিবিয়ানদের কাছ থেকে কোন সাড়া পেয়েছ?’ জিজ্ঞেস করল সে।
‘না, স্যার,’ বলল জন।
‘অসুবিধে নেই। ওদের ফ্যাসিলিটি আরও তিন হপ্তা বাড়িয়ে দাও আর সুদের হারও দেড় গুণ বাড়াও।’
চোখ পিটপিট করল জন। ‘ওরা আপত্তি তুলতে পারে, স্যার।’
‘ওদের তো সবকিছুতেই আপত্তি। যাকগে, আমি একটু চোখ বুজলাম। অফিসে পৌছুলে জাগিয়ে দিও।’
সীটে হেলান দিল বুহের। জন শঙ্কিত হয়ে ভাবল ওর কোন কথায় বস্ আবার মাইন্ড করে বসেননি তো।
টেমস নদীর দক্ষিণ তীরে, ইংরেজী ‘টি’ অক্ষরের আদলে গড়ে উঠেছে থর্ন কর্পোরেশনের ব্রিটিশ হেড অফিস। থর্ন লোগোটি শিকাগোর হেডকোয়ার্টারের ক্ষুদ্র সংস্করণ বলা চলে। টপ ফ্লোরে, নিজের স্যুইট থেকে চেয়ারম্যান টেমস নদী এবং ব্যাংক অভ ইংল্যান্ড পরিষ্কার দেখতে পায়। বাঁয়ে তাকালে চোখে পড়ে হাউজ অভ পার্লামেন্ট। ফোন করার সময় বুহের দালানটার দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকে। এটা তার অভ্যাসে দাঁড়িয়ে গেছে।
অফিসে পৌঁছেই বুহের খোঁজ নিল গত দু’দিনে তার নামে কতগুলো টেলেক্স এসেছে। তারপর বলল আগামী একঘণ্টার মধ্যে কেউ যেন তাকে বিরক্ত না করে। এক ঘণ্টার মধ্যে তাকে কেউ বিরক্ত করল না। নির্ধারিত সময় শেষে তার সেক্রেটারি বসের স্যুইটে নক করল, দরজা খুলে তাকাল ভেতরে।
‘হ্যাপী বার্থডে, স্যার,’ বলল সে।
বুহের মুখ তুলে চাইল, হাসি ফুটল মুখে, সেক্রেটারির পেছনে দেখা যাচ্ছে লন্ডন হেডকোয়ার্টারের বড়-মাঝারি গোছের সকল কর্মকর্তাদের।
‘ধন্যবাদ,’ বলে উঠে দাঁড়াল সে, ইঙ্গিত করল ওদের ভেতরে আসতে।
সারিবদ্ধভাবে শৃঙ্খলার সাথে ভেতরে ঢুকল তারা। প্রথমে তিনজন ভাইস প্রেসিডেন্ট জন্মদিনের অভিনন্দন জানাল পলকে, তারপর ডিপার্টমেন্টাল হেডের দল, সবশেষে এল কোম্পানি এক্সিকিউটিভরা। এদের চেহারাটাই শুধু চেনা পলের। নাম জানে না।
প্রত্যেকে সসম্ভ্রমে পল বুহেরের সাথে হাত মেলাল। হ্যান্ডশেক পর্ব শেষ হলে তরুণ এক ভৃত্য বয়ে নিয়ে এল মোমবাতি দিয়ে সাজানো, ইংরেজী ‘টি’ আকারের বিশাল এক কেক। নিঃশব্দে বুহেরের ডেস্কে কেকটা রেখে পিছিয়ে গেল সে। মৃদু হেসে তাকে ধন্যবাদ দিল বুহের। তিন বারের চেষ্টায় ফুঁ দিয়ে নেভাতে পারল সব ক’টা মোমবাতি। কাজটা শেষ করে রীতিমত হাঁপাতে লাগল সে। সবাই হাততালি দিয়ে অভিনন্দিত করল তাকে। দোরগোড়ায় দেখা গেল ট্রলি ঠেলে নিয়ে আসছে এক ওয়েটার। 1
‘শ্যাম্পেন চলবে?’ জিজ্ঞেস করল সেক্রেটারি।
‘মন্দ কি!’ বলল বুহের।
শ্যাম্পেনের বোতল খুলতে শুরু করল ওয়েটার। একটা গ্লাস নিয়ে স্মিত মুখে তার কর্মচারীদের স্তুতি শুনছে পল বুহের।
‘পল, বোঝাই যায় না আপনার বয়স হয়েছে।’
….আশা করি গত বছরের মত এ বছরটাও আপনি সাফল্যের সাথে পার করে দেবেন, স্যার,’ ইত্যাদি ইত্যাদি।
কর্মচারীদের সাথে হালকা মেজাজে কথা বলতে বলতে পল ভাবছিল এদের মধ্যে কে হতে পারবে তার যোগ্য উত্তরাধিকারী। কিন্তু কাউকেই তার মনে ধরছে না। শিকাগোর হেডকোয়ার্টারেরও একই দশা। এই বিশাল সাম্রাজ্য চালাতে তার দরকার আরেকজন চল্লিশ বছরের পল বুহের।
‘সত্তর বছর বয়সকে অভিনন্দন।’
ঘুরে দাঁড়াল পল। জন। মদ খেয়ে লাল হয়ে গেছে চেহারা, ওর দিকে গ্লাস তুলে দেখাচ্ছে।
বিরক্ত বোধ করল বুহের।
‘অভিনন্দন তিন কুড়ি দশকেও,’ মুচকে হাসল জন।
হঠাৎ কেন যেন কেঁপে উঠল বুহের, এক পা পিছিয়ে গেল। কোত্থেকে উদয় হলো তার সেক্রেটারি, সব ক’টা দাঁত বের করে হাসতে হাসতে জনের হাত ধরে টান দিল। ‘আমি কি কিছু বলেছি?’ হতবুদ্ধি দেখাল জনকে।
‘ওকে এখান থেকে নিয়ে যাও,’ মৃদু গলায় বলল বুহের। সেক্রেটারি টানতে টানতে জনকে নিয়ে চলল দরজার দিকে, সেই সাথে উপস্থিত অভ্যাগতরাও তার পেছন পেছন এগোল।
বুহের নিজের চেয়ারে এসে বসে পড়ল ধপ করে, চোখ বুজল। খানিকপর চোখ খুলে দেখে সামনে দাঁড়িয়ে আছে তার সেক্রেটারি।
‘সরি, স্যার…’
মাথা নাড়ল বুহের। ‘না, ঠিক আছে।’
‘আপনার কিছু লাগবে?’
‘আরও ত্রিশ বছর,’ বলল বুহের।
জবাবে কি বলবে ভেবে না পেয়ে শুধু হাসল মেয়েটা। তারপর বেরিয়ে গেল দরজা বন্ধ করে।
.
ঘুমের মধ্যে ছটফট করছে পল বুহের, এপাশ ওপাশ করছে, কি যেন বলছে বিড়বিড় করে। পাশে শোয়া মেয়েটা কনুইতে ভর দিয়ে উঁচু হলো, তাকাল পলের দিকে। আঙুল দিয়ে বুকে আঁকিবুকি কাটতে লাগল সে, ডানহাতটা ঝাঁকি খেল বুহেরের। হাতটা চেপে ধরল মেয়েটি, তালুতে সুড়সুড়ি দিল। কপালে ভাঁজ পড়ল বুহেরের, অস্পষ্ট গলায় কি বলল বোঝা গেল না।
হেসে উঠল মেয়েটা, কনিষ্ঠা আঙুলটা ধরে নাড়াতে লাগল। জন্মদাগ দেখা যাচ্ছে আঙুলের ডগায়। আঁকাবাঁকা রেখাগুলো দেখতে অবিকল সংখ্যার মত: একদিক থেকে মনে হয় ইংরেজী তিনটে নয়, আবার অন্য অ্যাঙ্গেল দিয়ে তাকালে ঠিক তিনটে ছোট ছয়-এর মত লাগে।
মোচড় খেল বুহের, খালি হাতটা শূন্যে উঠে গেল, সাঁতার কাটার ভঙ্গিতে। ঠোঁট নড়ছে ওর।
‘কি বলছ?’ কানের কাছে মুখ এনে ফিসফিস করল মেয়েটা।
‘তিন কুড়ি এবং দশ,’ বিড়বিড় করছে বুহের।
‘শ্শ্শ্শ্শ্…’ শক্ত করে হাতটা চেপে ধরল মেয়েটা, ঘুমের মধ্যে বুহের এত জোরে চাপ দিল, রীতিমত ব্যথা পেল সে। খসখসে জন্মদাগে লাগছে খুব। হাতটা ছাড়িয়ে নিতে চাইল সে, কিন্তু বুহের ধরেই থাকল।
‘পল,’ ককিয়ে উঠল মেয়েটা।
‘তিন কুড়ি এবং দশ,’ কর্কশ গলায় বলল বুহের। ‘আরমাগেড্ডন… কেয়ামতের বছর। সত্তর বছর।’
টান মেরে হাত ছাড়িয়ে নিল মেয়েটা, গড়ান দিয়ে সরে গেল বুহেরের পাশ থেকে। এখনও ঠোঁট নড়ছে ওর, তবে শব্দ হচ্ছে না। নিজের হাতের দিকে চাইল মেয়েটা। আঙুলে বুহেরের জন্মদাগের ছাপ পড়ে গেছে। জ্বলছে খুব। এক মুহূর্ত অসাড় বোধ করল সে, স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে আছে জন্মদাগের দিকে, তারপর মুখে পুরে নিল আঙুলটা, চুষতে লাগল। মুখ থেকে আঙুলটা বের করল সে, জিভের ডগা ছোয়াল খুদে তিনটা ছয়ের ওপরে, তারপর পাশ ফিরে শুলো, বুহেরের গালে চুমু খেল, বিড়বিড় করে কি যেন বলল। একটু পরে গভীর ঘুমে তলিয়ে গেল সে। তৃপ্ত এবং সন্তুষ্ট।