আপ রুচি খানা
আপ রুচি খানা।
নিজের রুচিমতো খাবে।
আর পরের রুচিমতো পরবে, অর্থাৎ জামাকাপড় পরিধান করবে।
এই হল আপ্তবাক্য। কিন্তু আপ্তবাক্য তো সদা সর্বদা অনুসরণ করা সম্ভব হয় না। নিজের রুচিমতো, ইচ্ছেমতো সব সময় কি সব জিনিস খাওয়া হয়?
আমরা তো সন্দেশ, রসগোল্লা, দই-মিষ্টি খেতে ভালবাসি। কিন্তু তা খাওয়া হয় না, ডাক্তারবাবু বারণ করেছেন। বিয়েবাড়িতে পাশের লোকেরা যখন বিরিয়ানি, ফ্রাই, কাটলেট ইত্যাদি প্রাণপণ খাচ্ছেন, আপনি লোলুপ দৃষ্টিতে তাকিয়ে থাকেন, আপনার প্লেটে তখন সাদা ভাত, শুক্তো, পনিরের ঝোল। এসবই চিকিৎসক মহোদয়ের নির্দেশ। আপনি ব্যতিক্রমী হতে চাইলেও পারবেন না, কারণ, সবাই জানে আপনার রক্তে চিনি এবং শ্যাওলা খুব বেশি। আপনি বিরিয়ানি, ফ্রাই ইত্যাদি খেতে চাইলে গৃহকর্তাই বাধা দেবেন।
এ তো গেল ক্ষুন্নিবৃত্তির কথা। খাওয়ার কথাও ভাবা যেতে পারে।
আমরা কি সব কিছু স্বেচ্ছায় খাই? তা তো নয়। আমরা মুখ কুঁচকিয়ে, চোখ বুজে কবিরাজ মশাইয়ের দেয়া নিমপাতার পাঁচন পাথরের গেলাসে করে খাই। আমরা বন্ধুর অনুরোধে, তাকে সঙ্গ দিতে গরমের দিনের দুপুরে ঘামতে ঘামতে বিস্বাদ তেতো বিয়ার খাই। আমরা শ্যালিকা ঠাকুরানিকে কিংবা প্রিয় বান্ধবীকে খুশি করার জন্যে তাঁর আবিষ্কৃত, তাঁর নির্মিত আদা-কাঁচকলার সাহী কাবাব (প্রিয় বান্ধবী জনৈকা শ্রীমতি সাহা, সাহা থেকে সাহী) যতটা সম্ভব মুখ অবিকৃত করে খাওয়ার চেষ্টা করি।
নিজে রান্না করে খেলে অবশ্য নিজের রুচিমতো কিছুটা খাওয়া-দাওয়া করা যায়। কিন্তু সেটা কখনও চেষ্টা করে দেখেছেন?
হাত পুড়ে গেছে, মুখে আগুনের ঝলক কিংবা তেলকালি লেগেছে, জামায় ঝোল, হাতে হলুদ—রান্না করতে গিয়ে এমন হতেই পারে। কিন্তু নির্বিবাদে আপনার পছন্দমতো রান্না করতে পেরেছেন কি?
গাড়িতে যেমন ব্যাকসিট ড্রাইভিং আছে, স্বামী গাড়ি চালান আর স্ত্রী গাড়ির পিছনের সিটে বসে ক্রমাগত নির্দেশ দিয়ে যাচ্ছেন। ‘আস্তে’, ‘এইবার খুব স্পিডে’ ‘সামনের গোরুর গাড়িটা বাঁদিকে কাটাও’, ‘ধুৎ, তুমি একেবারে যাচ্ছেতাই’, ‘হ্যাঁ হ্যাঁ আরও বাঁয়ে, আরও বাঁয়ে’, ‘আরে সাবধান, এ যে একেবারে নর্দমার মধ্যে’।
রান্নাঘরেও ঠিক তাই। ঠিক পিছনেই গৃহিণী। ‘আর কয়েকটা লঙ্কা, না না আস্ত নয় ভেঙে দাও’, ‘জিরের কৌটো কোথায়?’, ‘না না সাদা জিরে নয়, কালোজিরে’, ‘দই দিচ্ছ কেন, দই দিয়ে কী হবে?’ আপনার ডান হাত থেকে দইয়ের বাটিটা আর বাঁ হাত থেকে স্টিলের খুন্তিটা কেড়ে নিয়ে আপনাকে বিতাড়িত করে সহধর্মিনী এবার রান্নায় হাত দিলেন। আপনার স্বপ্নের দই ইলিশ কিংবা মাটন রেজালা রান্না করা আর হল না। তা হলে বলুন তো কী করে নিজের রুচিমতো খানা হবে?
এই ভর সন্ধ্যায় খালি পেটে লোভনীয় খাবারের কথা আর বলব না, বরং পরিধানে যাই।
পরিধান, অর্থাৎ জামা কাপড়। আপ্ত নির্দেশ হল অন্যের রুচি অনুযায়ী পোশাক পরবে।
এ বিষয়ে বিস্তারিত একটি আলোচনা পরে করছি, আগে দুয়েকটি তথ্য বিবেচনা করি।
মাত্র তিরিশ চল্লিশ বছরে বাঙালি স্ত্রী-পুরুষের সাজপোশাকের বিস্তর বদল হয়েছে। কিশোরী থেকে অনতিযুবতী বাঙালি মহিলার প্রধান পোশাক এখন শালোয়ার কামিজ, গ্রামে শহরে সর্বত্র। এটা বাড়ির বাইরের পোশাক, বাড়ির মধ্যে ম্যাক্সি বা ওই জাতীয় অন্য কিছু। মাত্র চল্লিশ বছর আগেও এ রকম সম্ভব ছিল না। শাশুড়ি মা ঝলমলে শালোয়ার কামিজ পরে, কপালে সিঁথিতে ডগমগে সিঁদুর, হাতে মোটা সাদা শাঁখা, বেনারসি পরিহিতা নতুন বউমাকে নিয়ে কালীঘাটে পুজো দিচ্ছেন, এখন এ অতি পরিচিত দৃশ্য। অথচ এই তো সেদিন, বড়জোর তিরিশ বছর, প্রথম যে মেয়েটি শালোয়ার কামিজ পরে রাইটার্স বিল্ডিংয়ে কাজে গেল, সে রীতিমতো চাঞ্চল্য সৃষ্টি করেছিল। আর এখন তো মহিলারা প্যান্ট, লুঙ্গি, হাফ-শার্ট সব কিছুই পরিধান করছেন। ভালই দেখায়। সমাজও মেনে নিয়েছে।
পুরুষেরাও ধুতি থেকে প্যান্টে দ্রুত চলে এসেছে। পঞ্চাশের দশকে লালবাজারের বিখ্যাত গোয়েন্দা দেবী রায় ধুতি পরে অফিস যেতেন। রাইটার্সেও পদাধিকারিকেরা প্রায় সবাই ধুতি পরতেন, কেরানিবাবুরা তো বটেই।
ধুতি শাড়ি কাজকর্মের পৃথিবীতে প্রায় বিদায় নিয়েছে। প্রথমদিকে সবাই ব্যাপারটা মেনে নিতে পারেননি। সেই সময়ের একটি গল্পে আছে ক্রু কাট চুল, রঙিন চকরাবকরা জামা, স্ট্রাইপ প্যান্ট পরা কৃশকায় এক যুবতীকে এক বিয়েবাড়িতে দেখে গঙ্গারাম যুবক ভেবেছিল। ভোজনের সময় মন্তব্য করেছিল, ‘ওই ছেলেটি কিছুই খাচ্ছে না।’ সঙ্গে সঙ্গে পাশ থেকে প্রতিবাদ আসে, ‘ও ছেলে নয়, মেয়ে, আমার মেয়ে। ডায়েটিং করছে।’ গঙ্গারাম বক্তার দিকে ঘুরে তাকিয়ে বলেছিল, ‘আপনিই বুঝি ওই মেয়েটির বাবা?’ সঙ্গে সঙ্গে অনুরূপ পোশাক করা পাশের ব্যক্তিটি প্রতিবাদ জানান, ‘আমি ওর বাবা নই, আমি ওর মা।’