আপেক্ষিক মোরচাবাদ : নয়া বিজ্ঞান
পশ্চিমবঙ্গের কংগ্রেস-সি পি আই মোরচা ওরফে প্রগতিশীল গণতান্ত্রিক মোরচা ওরফে পি ডি এ-র উপনেতার পদ থেকে সি পি আই পরিষদ দলের নেতা কমরেড বিশ্বনাথ মুখারজি ঘটা করে ইস্তফা দেওয়ায় এক ঐতিহাসিক পলিটিক্যাল প্রেমে যে জটিলতার সৃষ্টি হয়েছিল, সি পি আই নেতৃবৃন্দের— ‘মোরচার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা জানি না তবে পি ডি এ-তে আছি’— এই সোচ্চার ঘোষণায় আমার ধারণা ছিল, সেই জটিলতা বুঝি কেটে গেল।
‘মোরচার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা জানি না, তবে পি ডি এ-তে আছি’— এমন একটা সুন্দর, সরল এবং সহজিয়া অর্থবোধক ঘোষণায় কেউ যে আবার ফ্যাকড়া তুলতে পারেন, একথা ছিল আমার স্বপ্নেরও অগোচর। তাই জনৈক অবিশ্বাসী যখন পটাং করে প্রশ্ন তুললেন, ‘হ্যাঁ মশাই একথার মানে কী’, তখন সত্যি বলতে কী, রীতিমতো অবাক হলাম।
‘কোন্ কথার মানে জানতে চাইছেন?’ জিজ্ঞাসা করলাম।
উনি বললেন, ‘আরে মশাই ওই যে— ‘মোরচার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা জানি না তবে পি ডি এ-তে আছি’— ঐ কথাটার।’
‘এমন যুক্তাক্ষর বর্জিত একটা বাক্যের মানে বুঝতে অসুবিধে ঠেকছে কোথায়? মোরচা মানে হল এলায়েনস। অভিধানে বলছে, এলায়েন্স কথাটা এসেছে অ্যালাই (ভারত ট্র্যানজেটিভ) থেকে, যার অর্থ বিবাহসূত্রে বা বন্ধুত্বসূত্রে অথবা কোন বিশেষ উদ্দেশ্যে সাধনার্থ মৈত্রীবন্ধনে আবদ্ধ হওয়া। অর্থাৎ ‘এলায়েনস বা মোরচা হচ্ছে উক্ত সকর্মক ক্রিয়ারই বিশেষ্য।’
বাধা দিয়ে উনি বললেন, ‘আহা, তা তো জানি। আলগা আলগা প্রত্যেকটা শব্দের মানে বুঝতে অসুবিধে হচ্ছে না। সবগুলো মিলে কী দাঁড়াচ্ছে? আমরা সাধারণ মানুষ, আমাদের বোঝবার পদ্ধতিটাও সাদা-মাটা। ধরুন, মোরচার প্রয়োজনীয়তা আছে, আমরা পি ডি এ-তে আছি, কিংবা মোরচা আছে, আমরা পি ডি এ-তে আছি— এটা আমরা বুঝতে পারি। কিংবা মোরচার প্রয়োজনীয়তা নেই, আমরা পি ডি এ-তে নেই— এটাও আমরা বুঝতে পারি। কিন্তু মোরচার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা জানিনে তবুও আমরা পি ডি এ-তে আছি— একথার মানে বোঝা কি আমাদের সাধ্য? বলুন। আপনাকে যদি বলি, মোরচা নেই, তবু আমরা পি ডি এ-তে আছি— আপনি কিছু বুঝবেন?’
বললাম, ‘সি পি আই নেতাদের এই ঐতিহাসিক সহজিয়া ঘোষণা বুঝতে কোথায় আপনার অসুবিধা হচ্ছে, এতক্ষণে বুঝলাম। আচ্ছা, আপনি বোস স্ট্যাটিসটিক বা বাংলায় যাকে বোস সংখ্যায়ন বলে, তার নাম শুনেছেন?’
‘বাঃ! কী যে বলেন? যা নিয়ে এত কাণ্ড হয়ে গেল তা আর জানিনে। আমাদের বিজ্ঞানী সত্যেন বোস মশায় একটা অঙ্ক কষে দেন, যার ফলে আইনস্টাইনের কী একটা সুবিধে হয়ে যায়, সেই ব্যাপার তো?
‘হ্যাঁ, অনেকটা তাই বটে। অধ্যাপক বোসের ওই সংখ্যায়ন যেমন পরমাণু কেন্দ্রিক পদার্থ বিজ্ঞানে এক নূতন যুগের দরজা খুলে দিয়েছে তেমনি আরেকটি সংখ্যায়ন প্রেমকেন্দ্রিক পলিটিক্যাল বিজ্ঞানে নব দিগন্তের অজস্র দুয়ার খুলে দিয়েছে। ফলিত পলিটিক্যাল বিজ্ঞানের দুই যুগ-প্ৰতিভা যুগ্মভাবে এই সংখ্যায়নের জন্ম দিয়েছেন বলে এই সংখ্যায়ন আন্তর্জাতিক পলিটিক্যাল বিজ্ঞানী মহলে ওই যুগল-জনকের নামানুসারে রায়-মুখারজি সংখ্যায়ন নামে পরিচিতি লাভ করেছে।’
উদ্দীপ্তভাবে উনি জিজ্ঞাসা করলেন, ‘বাঙ্গালী? নাম কি মশাই?’
‘এই ফলিত পলিটিক্যাল বিজ্ঞানী দুজনের নাম যথাক্রমে সর্বশ্রদ্ধেয় অধ্যাপক সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং অধ্যাপক বিশ্বনাথ মুখারজি। এবং এঁদের ঐতিহাসিক আবিষ্কারের নাম আপেক্ষিক মোরচাবাদ। মোরচা থেকে পদত্যাগও করছি আবার মোরচাতেও আছি, এই আপাত জটিল অথচ আসলে সরল ব্যাপারটার সন্তোষজনক ব্যাখ্যা একমাত্র রায়-মুখারজি সংখ্যায়নের ভিত্তিতে গড়ে তোলা আপেক্ষিক মোরচাবাদের আলোকেই দাঁড় করানো যায়।’
‘ইয়া আল্লা! তাহলে তো মোরচার প্রয়োজনীয়তা আছে কিনা জানিনে তবে পি ডি এ-তে আছি’— এই তত্ত্বেরও ব্যাখ্যা পাওয়া যাবে। কি বলেন।’
‘আলবৎ যাবে। বিজ্ঞান কী ইয়ারকির জিনিষ। এখন মন দিয়ে শুনুন। পলিটিক্যাল প্ৰেম পদার্থ না অপদার্থ এ নিয়ে দেশ বিদেশের পলিটিক্যাল বিজ্ঞানী মহলে দীর্ঘকাল ধরেই গবেষণা চলেছে। পলিটিক্স্ মেকস্ স্ট্রেন্জ ফেলোজ— এই সূত্রটি ১৮৭০ সালে চারল্স ড্যাডলি ওয়েমার নামে পাশ্চাত্যের এক মনীষী আবিষ্কার করেন। এই সূত্র ধরে পাশ্চাত্যের পলিটিক্যাল বিজ্ঞানী মহলও তত্ত্বানুসন্ধান কম চালান নি। আকর্ষণ বিকর্ষণের আপাত লক্ষণ দেখে পলিটিক্যাল বিজ্ঞানী মহল এই সেদিন পর্যন্তও পলিটিক্যাল প্রেমকে পদার্থ বলেই ধরে নিয়েছিলেন। অবশেষে রায়-মুখারজি সংখ্যায়নের আলোকে তত্ত্বটা যে ভুল, সংশয়াতীতভাবে তা প্রমাণ করা সম্ভব হল। এই প্রতিভাবান পলিটিক্যাল বিজ্ঞানীযুগল প্রমাণ করলেন, পলিটিক্যাল প্রেম অংশত পদার্থের গুণসম্পন্ন হলেও আসলে তা অপদার্থের কণা। সুবিধাবাদী আকর্ষণে এই কণাগুলি জমাট বাঁধে বলেই তা পদার্থের আংশিক গুণপ্রাপ্ত হয়।
‘অধ্যাপক সিদ্ধার্থশংকর রায় এবং অধ্যাপক বিশ্বনাথ মুখারজি এই সংখ্যায়নের উপর ভিত্তি করেই তাঁদের ঐতিহাসিক অবদান আপেক্ষিক মোরচাবাদ তত্ত্ব গড়ে তোলেন এবং ১৯৭২ সালের নির্বাচনে এই তত্ত্ব সাফল্যজনকভাবে প্রয়োগ করেন। আপেক্ষিক মোরচাবাদের প্রধান উপকারিতা এই যে, রাজনৈতিক মেলবন্ধনকে এই তত্ত্ব যেমন যথেষ্ট গতিশীল করে তুলেছে, তেমনি মোরচার শরিককে বেকায়দায় পেলে তাঁকে বাঁশ দেবার পূর্ণ অধিকারও অন্য শরিককে দিয়েছে।’
‘বুঝেছি মশাই, বুঝেছি। এতক্ষণে ব্যাপারটা ক্লিয়ার হল। সেইজন্যই সি পি আই কংগ্রেসী মোরচায় থেকেও সি পি এম-এর মদতে কংগ্রেসীদের হরবখত ইয়ে দিয়ে যাচ্ছে। তা হ্যাঁ মশাই, এত বড় আবিষ্কারকে তো আন্তর্জাতিক স্বীকৃতি দেওয়া উচিত। নয় কি?’
‘শুনছি তো, অধ্যাপক রায় এবং অধ্যাপক মুখার্জি এবার যৌথভাবে লেনিন শান্তি পুরস্কার পাবেন।’
৬ ফেব্রুয়ারি ১৯৭৪