পাঁচ
এতক্ষণ যাঁর কথা বলিনি, অথচ যিনি আমার ভবিষ্যৎ জীবনচর্যার অন্যতম প্রধান নিয়ামক, তিনি অমিয়কুমার দাশগুপ্ত। অর্থনীতির তত্ত্ব নিয়ে তাঁর মতো তন্নিষ্ঠ গবেষণা ইতিপূর্বে আমাদের দেশে কেউ করেননি। তাঁর চেয়ে দক্ষতর শিক্ষকও আমি দেশে-বিদেশে কোথাও পাইনি। তাঁর বিদ্যা ও পড়ানোর উৎকর্ষ ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রবাদপ্রতিম হয়ে দাঁড়িয়েছিল। দশকের পর দশক ধরে তিনি ঢাকায় প্রতিভাধর এন্তার ছাত্র তৈরি করেছেন। পরে কটকে র্যার্ভেনশ কলেজে, কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে এবং দিল্লিতে, একই জ্ঞানচর্চার পরম্পরা। মজার ব্যাপার হলো, বাংলার বিদগ্ধ মহলে প্রেসিডেন্সি কলেজ, এবং সেই সঙ্গে কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় ছাড়া অন্য কোনও গীত নেই, একজন-দু’জন পণ্ডিতপ্রবর এমনটাও দাবি করেছেন, প্রেসিডেন্সি কলেজই বাংলা, বাংলাই প্রেসিডেন্সি কলেজ। ইত্যাকার দাবি আসলে এক ধরনের কুপমণ্ডূকতা, পৃথিবীকে জানবার-চেনবার-বোঝবার জন্মগত অক্ষমতা। মাত্র ক’দিন আগে এক বাংলা দৈনিকের রবিবাসরীয় বিভাগে ‘মানুষগড়ার কারিগর’ শিরোনামে এক মস্ত প্রবন্ধ ফাঁদা হয়েছিল: কিংবদন্তী শিক্ষকদের নিয়ে আলোচনার প্রয়াস। কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয় এবং প্রেসিডেন্সি কলেজের বাইরে যেন পৃথিবীই নেই, বিদ্যাচর্চা ও শিক্ষকতাও অনুপস্থিত। শিক্ষকদের তালিকায় সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় অনুল্লিখিত, অনুচ্চারিত অমিয় দাশগুপ্ত মশাইয়ের নামও। সত্যেন্দ্রনাথ বসু প্রায় পঁচিশ বছর ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপনা করেছেন; তাঁর বৈজ্ঞানিক প্রতিভার স্ফুরণ ও বিকিরণও ঢাকাতেই। ১৯৪৫ সালের পর অবশ্য কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়ে চলে এসেছিলেন বছর পাঁচ-ছয়ের জন্য, তারপর শান্তিনিকেতন, জাতীয় অধ্যাপক হিশেবে বৃত হওয়া, রাজ্যসভার সদস্য। কিন্তু, হলে কী হয়, সেই যে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে গিয়ে একবার জাত খুইয়েছিলেন, তা আর পুনর্জয় করতে পারলেন না। কলকাতার বিদ্বজ্জনের কাছে তাঁর স্থান মেঘনাদ সাহার অনেকটাই নিচে।
অমিয় দাশগুপ্তের ললাটলিখন আরও শোকাবহ। পশ্চিম বাংলায় ক্বচিৎ-কদাচিৎ একজন-দু’জন পণ্ডিত মানুষ ব্যাতিরেকে বিশেষ কেউই তাঁর নাম উচ্চারণ করেন না। অথচ তিনি জীবনের শেষ বারো-চোদ্দো বছর একাদিক্রমে শান্তিনিকেতনে কাটিয়েছেন, ওখানকার ছাত্র-শিক্ষকদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ হবার চেষ্টা করেছেন, যে যখনই তাঁর কাছে জ্ঞাতব্য কিছু জানবার জন্য গিয়েছেন, স্বভাবঔদার্যে সমাদরে সে-সব অনুরোধ-আবদার রক্ষা করেছেন। এমনকি শান্তিনিকেতনে থাকাকালীনই নিভৃতে নিজের মতো করে অন্তত তিনটি তত্ত্বভিত্তিক গ্রন্থ রচনা করেছেন, সে-সব গ্রন্থ বিদেশে প্রকাশিত ও বহু সংবর্ধিত, কিন্তু পশ্চিম বাংলার নিথর ডোবায় তাঁর কোনও অনুকম্পন অনুভূত হয়নি। আমার এটা প্রতীতি, তাঁর চেয়ে শ্রেষ্ঠ অর্থনীতির শিক্ষক আজ পর্যন্ত ভারতবর্ষে জন্মগ্রহণ করেননি। একটু আগে যা বলেছি, জটিল তত্ত্ব সোজা করে বোঝানোর ক্ষেত্রে তাঁর দক্ষতা তুলনাহীন। সামান্য সান্ত্বনা, অমর্ত্য তার একটি গ্রন্থ অমিয়বাবুকে উৎসর্গ করেছে, উৎসর্গের বয়ানে তার অকপট স্বীকারোক্তি, ‘যিনি আমাকে প্রথম ধনবিজ্ঞানের মর্মবাণীতে দীক্ষিত করেছিলেন, সেই অমিয় দাশগুপ্তকে’।
ধনবিজ্ঞানে আমার তেমন আগ্রহ কোনওদিনই ছিল না। আকস্মিকতার পরিণামে, এবং কিছুটা দায়ে পড়ে, এই শাস্ত্রে আলতোভাবে অনুপ্রবেশ করেছি, প্রথম সুযোগেই সেই চত্বর থেকে বিদায় নিয়েছি। কিন্তু এটা স্বীকার করতে তো ন্যূনতম দ্বিধা নেই, অর্থনীতি সম্পর্কে আমার যতটুকু জ্ঞান, পুরোটাই অমিয়বাবুর শিক্ষকতার করুণাহেতু। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে অধ্যাপক হিশেবে তাঁকে আদৌ পাইনি। আমরা পড়তে ঢোকার কয়েক মাসের মধ্যে তিনি অন্যত্র চলে গেলেন, কয়েক বছর বাদে কাশী হিন্দু বিশ্ববিদ্যালয়ে যখন এম.এ পড়তে গেলাম, তখন থেকেই তাঁর স্নেহ আমার উপর অঝোরে বর্ষিত হলো। শুধু বিশ্ববিদ্যালয়ের ক্লাস ঘরে নয়, দিনান্তে এবং ছুটির দিনে, প্রত্যুষে, দ্বিপ্রহরে তথা সায়ংকালে, আলাপচারিতার মধ্য দিয়ে তিনি আমাকে অর্থনীতির রহস্যে প্রবেশ করিয়ে দিয়েছিলেন।
অমিয় দাশগুপ্তকে আমি নিজে ঢাকায় শিক্ষক হিশেবে পাইনি, কিন্তু তাঁর অধ্যাপনাযশ ঢাকার হাওয়ায়-হাওয়ায় নন্দিত হতো; আমাদের আগে দুই দশক ধরে যে ছাত্ৰকুল বিদ্যাচর্চা করেছেন, তাঁদের মুখে লোকপ্রবাদের মতো ঘুরতো। তখনকার তরুণতর শিক্ষকরা অনেকেই তাঁর ছাত্র, তাঁদের কাছেও সেই প্রবাদের উপর্যুপরি অভিভূত উচ্চারণ শুনতাম। অথচ কলকাতা এবং তার আশেপাশে কেউই তেমন করে তাঁর নাম জানেন না, তাঁর গ্রন্থাদির সঙ্গে পরিচয় নেই। বরঞ্চ হালে তাঁর পুত্র এবং জামাতা সম্পর্কে—দু’জনেই অর্থনীতিবিদ— অনেক বেশি আলোচনা, অমিয়বাবু উহ্য থেকেই যান। অবশেষে, কী জানি কী মনে করে, বছর দশেক আগে পশ্চিম বাংলার একটি বিশ্ববিদ্যালয় থেকে তাঁকে সাম্মানিক ডি.লিট ডিগ্রি দেওয়া হয়। শারীরিক অসুস্থতার জন্য তিনি সমাবর্তনে যেতে পারেননি। কিন্তু দীর্ঘ দু’বছরের মধ্যেও তাঁকে বিশ্ববিদ্যালয় থেকে সেই সম্মানপত্রটি পাঠিয়ে দেওয়ার ব্যবস্থা করা যায়নি।
অমিয়বাবু ঢাকা ছেড়ে চলে গেলেন যেমন, এক বছর-দু’বছরের মধ্যে বিশ্ববিদ্যালয়ের বিভিন্ন বিভাগ থেকেও অন্যান্য বহু শিক্ষক প্রস্থান করলেন। আসন্ন দেশভাগের অনিশ্চয়তা, অনেকেরই ভবিষ্যৎ-চিন্তা একটু উচ্চকিত। ভাঙা হাট ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমরা পড়ে রইলাম। যাঁরা চলে গেলেন তাঁদের অনুপস্থিতির পীড়নে আমরা বিচলিত। তা হলেও তখন যৌবনের দ্বারপ্রান্তে দাঁড়িয়ে, সাহিত্য-প্রেম-রাজনীতি-উন্মুখতা, বন্ধুবান্ধবদের সংখ্যা শাখাপ্রশাখায় ক্রমশ বিস্তৃত। যাঁদের সঙ্গে সখ্যের নিবিড় আলিঙ্গনে আবদ্ধ হয়ে ছিলাম, কালের রীতিতে তাঁরা কোথায় ছড়িয়ে-ছিটিয়ে পড়েছেন, অনেকের সঙ্গেই পরে আর যোগাযোগ হয়নি। কেউ-কেউ হয়তো ইতিমধ্যে এই পৃথিবী থেকেই অপসৃত। যে-দু’জন কলেজকালীন বন্ধুর সঙ্গে এখনও মাঝে-মাঝে দেখা-সাক্ষাৎ হয়, তাদের একজন সুনীলরঞ্জন বসু, বাচ্চু, অন্যজন হরিসাধন চট্টোপাধ্যায়। বাচ্চুর বরাবরই লেখাপড়ার চেয়ে নৃত্যবাদ্যে অধিকতর উৎসাহ, শেষ পর্যন্ত ওর বি. এ ডিগ্রিও নেওয়া হয়নি। তবে গিটারে নিমগ্ন থেকেছে, ঢাকা শহরে অনেক কিশোরী-যুবতী মেয়েদের নিয়ে নাচের মহড়া করিয়ে অনুষ্ঠানে হাজির করেছে। এখন কলকাতায় স্থিত, একটা যেমন-তেমন সরকারি কাজ থেকে অবসর নিয়ে সংগীতচর্চায় সদা ব্যাপৃত, ক্বচিৎ দেখা হয়। হরিসাধন দিল্লিতে বাণিজ্যমন্ত্রকে যোগ দিয়েছিল, অবসর না-নেওয়া পর্যন্ত বেশির ভাগ সময় বিদেশের দূতাবাসে অতিবাহন করেছে, এখন দিল্লিতে বাড়ি তুলেছে। তার কন্যা, সুজাতা, আমার বড়ো প্রিয়।
এনায়েত করিমের কথা বলি। আমরা একই বছরের, আমি আরমেনিটোলা স্কুলে, এনায়েত কলেজিয়েট স্কুলে। প্রবেশিকা পরীক্ষায় ও প্রথম হয়েছিল, আমি বেশ খানিকটা নিচে। (তার কারণ অবশ্য বুদ্ধদেব বসু। প্রবন্ধের পেপারে ‘তোমার প্রিয়তম বাংলা গল্প’ নিয়ে লিখতে বলা হয়েছিল। অকালপক্ক আমি, লিখেছিলাম ‘রাধারানীর নিজের বাড়ি’ নিয়ে। খাতা দেখেছিলেন নিয়মনিষ্ঠ এক পণ্ডিতমশাই, একশোতে আমাকে মাত্র ঊনপঞ্চাশ দিয়েছিলেন।) এনায়েত আই এ পড়তে প্রেসিডেন্সি কলেজে চলে যায়। বি. এ ক্লাসে ফিরে আসে ঢাকায়, ততদিনে সে ছাত্র ফেডারেশনের উৎসাহী কর্মী। ইতিহাস-বিখ্যাত মধুর দোকানের সম্মুখবর্তী সংকীর্ণ মাঠে আমাদের সকাল থেকে সন্ধ্যা আড্ডা। একসঙ্গে বি. এ পরীক্ষা দিলাম, আমি প্রথম, এনায়েত দ্বিতীয়। ছাত্র আন্দোলনের ফেরে পুলিশের হাতে ধরা পড়ে এনায়েত কিছুদিন কারাবাস করে এলো। জীবনের গতি ঘুরে যায়। কয়েক বছর বাদে এনায়েত পাকিস্তান ফরেন সার্ভিসে ঢুকলো, হল্যান্ডে গিয়ে হাজির হলো, আমিও তখন সে দেশে আমাদের আড্ডা আবার জমলো। পঞ্চাশের দশকের মাঝামাঝি কলকাতাস্থ পাকিস্তানের ডেপুটি হাইকমিশনে ওর কয়েক মাস অধিষ্ঠান। দিল্লি থেকে আমার কলকাতা এলেই আর-এক দফা আমাদের আড্ডার বেপরোয়া ঋতু। বছর দশেক বাদে, ততদিনে পাকিস্তান কিছু সময়ের জন্য কমনওয়েলথের বাইরে, এনায়েত নতুন দিল্লির দূতাবাসে উঁচুপদে আসীন, সঙ্গে স্ত্রী হোস্না। কূটনৈতিক মানুষ, মেপে কথা বলা ইতিমধ্যে বাধ্য হয়ে রপ্ত করেছে, অথচ আমার সঙ্গে হৃদ্যতা বরাবরই তুঙ্গে থেকেছে। বাংলাদেশ মুক্তিযুদ্ধের সময় এনায়েত ওয়াশিংটনের দূতাবাস থেকে বেরিয়ে স্বাধীন বাংলাদেশ সরকারের প্রতি আনুগত্য ঘোষণা করে, বাংলাদেশ সরকারের প্রথম বিদেশ সচিব নিযুক্ত হয়। কিছুদিনের মধ্যেই হৃদরোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর প্রয়াণ। আমার অবসাদবোধের সীমা নেই। হোস্নার সঙ্গে আমাদের যোগাযোগ তার পরেও অবশ্য অব্যাহত থেকেছে, হোস্না কলকাতায় আমাদের ফ্ল্যাটে এসেও থেকেছে। কয়েক বছর হলো সে-ও মায়া কাটিয়ে চলে গেছে।
যে কয়েকজন ঘনিষ্ঠ বন্ধুর অভাবে এখনও অহরহ বিষণ্ণ বোধ করি, এনায়েত করিম, নির্দ্বিধায় বলতে পারি, তাঁদের মধ্যে অন্যতম প্রধান। ও-রকম মুক্তমনা মানুষ পৃথিবীর জঙ্গলে কদাচ চোখে পড়ে। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে বসে সে একদিন আমাকে এক উপাখ্যান শুনিয়েছিল, যাতে তার সাম্প্রদায়িকতাবোধরহিত কৌতুকপ্রিয়তা বিচ্ছুরিত। হয়তো হুবহু নয়, তবে তার বলা গল্পটি যথাসম্ভব বিশ্বস্ত আকারে এখানে পেশ করি। ঢাকার কোনও বস্তি থেকে আদালতে এক ব্যক্তি সাক্ষ্য দিতে এসেছে। উকিলের প্রশ্ন: ‘তেরা নাম বাতা’। উত্তর: ‘হুজুর, কেরামত আলি’। উকিলের দ্বিতীয় প্রশ্ন: ‘তেরা বাপকা নাম বাতা’। —‘হুজুর, রহমত আলি’। —‘তেরা বাপকা বাপকা নাম বাতা’।—‘সেলামত আলি, হুজুর’। —‘ইস দফে তেরা বাপকা বাপকা বাপকা নাম বাতা’।—‘ইমারত আলি, হুজুর’। —‘আভি উসকা বাপকা নাম বাতা’। —’মাফ কিজিয়ে হুজুর, উ শালে হিন্দু থা’।
আরও দু’জনের কথা বলতে হয়, যাদের সঙ্গে আমার প্রীতির সম্পর্ক এই পঞ্চান্ন বছর পেরিয়ে এখনও অশিথিল! উভয়েই ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ে আমার সমকালীন, দুই বোন তারা, বিশ্ববিদ্যালয়ের বাণিজ্য বিভাগের প্রধান জুন্নরকর সাহেবের দুই কন্যা, সুশীলা ও শান্তি। অবাঙালি বলে তাঁদের ভুল করবার কোনও সুযোগই ছিল না, এখনও নেই। ঢাকা শহরে বড় হয়ে ওঠা, চেতনার উন্মেষ বাংলা ভাষার মধ্য দিয়েই, এমনকি দেশজ বাংলা বুকনিও, আমার সন্দেহ, আমার চেয়ে তাদের অনেক বেশি রপ্ত। সুশীলা, ‘সুশী’ নামেই অধিক পরিচিত, সংস্কৃত সাহিত্যে অসম্ভব ভালো ছাত্রী। পরবর্তী সময়ে স্টেটসম্যান পত্রিকার একদা সম্পাদক অমলেন্দু দাশগুপ্তের সঙ্গে তাঁর বিবাহ হয়। এমন বিদ্বান ও সুভদ্র পরিবার ক্বচিৎ চোখে পড়ে; তাঁদের জ্যেষ্ঠ পুত্র রাজা, পেশায় হিশেবরক্ষক, নম্র ও শান্ত; কন্যা সুপ্রিয়া, এখন যাদবপুর বিশ্ববিদ্যালয়ে ইংরেজি সাহিত্যের অধ্যাপক, তার স্বামী সুকান্ত চৌধুরী ও দাশগুপ্ত-দম্পতির কনিষ্ঠ পুত্র অম্লানও তাই। অম্লানের স্ত্রী অদিতির মতো সর্বগুণসম্পন্না সর্ব অর্থে ভালো মেয়ে আমার অভিজ্ঞতায় চোখে পড়েনি। কনিষ্ঠা জুন্নরকর দুহিতা শান্তি তার ঘরোয়া নাম ‘বেবি’ হিশেবেই বেশি পরিচিত ছিল। গিন্নিবান্নি মানুষ এখন, আর সেই নামে তো তাকে ডাকা যায় না। সে ইতিহাসের তুখোড় ছাত্রী, চোখেমুখে কথা বলতো। সুশীলা শান্ত, বৈকালিক নদীর মতো, ধীর কণ্ঠস্বর; শান্তি অন্যদিকে উচ্ছল ঝরনা, কল-কল কল-কল, আড্ডায়, পরচর্চায়, কৌতুকপ্রিয়তায় জুড়ি নেই। ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয় থেকে ইতিহাসে সাম্মানিক ডিগ্রি অর্জন করে কলকাতায় এসে এম.এ পাশ করে। কিছুদিন বাদে বাবা-মার সঙ্গে পশ্চিম ভারতে প্রত্যাবর্তনের পর বরোদাতে সতীশ দিঘে নামে এক চিকিৎসকের সঙ্গে পরিণীত হয়। তার দুটি উজ্জ্বল কন্যা, বিশাখা ও অঞ্জলি, তারাও এখন পাকাপোক্ত গৃহিণী। আমি কখনও কাশীতে, কখনও লখনউয়ে, কখনও দিল্লিতে, কখনও বিদেশে, কখনও ফের কলকাতায়। অথচ শান্তির সঙ্গে আমার বন্ধুত্ব অচ্ছেদ্যবন্ধনে বাঁধা, আমার সমস্যার সে শরিক, তাঁর সমস্যার আমি। আমার কাছে ঢাকা বিশ্ববিদ্যালয়ের পরিমণ্ডল অন্তত শান্তি জুন্নরকর নামের সঙ্গে সহ-শিহরিত।
আর একজনের কথাও বলতে হয়, তিনি সাগরিকা ঘোষ। সাগরিকা রাজনৈতিক কর্মী, আমার চিন্তাবিন্যাসের সঙ্গে তাঁর একেবারেই মিল নেই, কিন্তু পরস্পরের প্রতি আন্তরিক অনুরাগ এখনও অটুট।
বন্ধুদের সঙ্গে আদান-প্রদানের বিনিময়-প্রতিবিনিময়ের সেই বছরগুলি প্রশ্নবোধক চিহ্নে তবু সমাচ্ছন্ন। ভারতবর্ষ অস্থির, বাংলাদেশও সমান আন্দোলিত। আমরা মহাযুদ্ধ ও মন্বন্তরের ভয়ংকর সময় পেরিয়ে এসেছি, অথচ সামনের দিকে কী আছে তা জানি না। রাজনীতির আবর্ত, আজাদ হিন্দ ফৌজের উত্তর-আলোড়ন, কংগ্রেস সম্পর্কে যুবসম্প্রদায় ক্রমঅধৈর্য, তখনও পর্যন্ত কংগ্রেসের-মধ্যে-থাকা বামপন্থী গোষ্ঠীগুলি মাথা উঁচু করে দাঁড়ানো। এরই মধ্যে, হাজার প্রতিকূলতা সত্ত্বেও, কমিউনিস্ট পার্টির একটু-একটু করে দানা বাঁধা। কারান্তরালে, আন্দামানে এবং অন্যত্র, অনেক রাজবন্দী, কংগ্রেসের বিভিন্ন গোষ্ঠী থেকে বেরিয়ে, দলবদ্ধভাবে কমিউনিস্ট আন্দোলনে দীক্ষাগ্রহণ করেছেন। সে সমস্ত খবর আমরা বাইরে ঈষৎ জানতে পেরেছি, আবার অনেকটা জানিও না। সেই লগ্নে বাংলাদেশে মুসলিম লিগ মন্ত্রিসভা, পাকিস্তান আন্দোলন ক্রমশ শক্তি অর্জন করছে। প্রধানত কংগ্রেস দলের সর্বোচ্চ নেতৃত্বের স্বার্থপরতা ও অবিমৃষ্যকারিতা হেতু, হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের মধ্যে বর্ধমান আড়াআড়ি, যা ছাত্রসমাজের উপরেও কালো ছায়া ফেলেছে। ১৯৪৫ সালের শেষের দিকে, এবং ছেচল্লিশ সালের গোড়ায়, আজাদ হিন্দ ফৌজের বন্দিবীরদের মুক্তি আন্দোলন এবং মুম্বই বন্দরে নৌবিদ্রোহ কেন্দ্র করে যে-সংহত উদ্দীপনা ক্ষণিক দেখা দিয়েছিল, তার আবেশে হিন্দু-মুসলমান সম্প্রদায়ের তরুণদের, অল্প সময়ের জন্য হলেও, কাছাকাছি আসা ঘটলো। ঢাকা শহরে কয়েক বছর আগে যে-দাঙ্গা হয়েছিল, তার দুঃসহ স্মৃতি, আমরা আশা করেছিলাম, এই সুযোগে মিলিয়ে যাবে, স্বাধীনতা যুদ্ধের প্রত্যন্তকালে ধর্মনির্বিশেষে সমগ্র তরুণ সম্প্রদায় একতাবদ্ধ হয়ে সংগ্রামশীল হবে। কিন্তু আশা কুহকিনী। ছেচল্লিশ-সাতচল্লিশ সালের ঘটনাবলী দুই সম্প্রদায়কে, তরুণদের সুদ্ধু, সম্পূর্ণ বিভক্ত করে দিল। অতঃপর স্বাধীনতা ও দেশভাগ। হয়তো ভুল বললাম, দেশভাগ ও স্বাধীনতা।
কী করে যে বিশ্ববিদ্যালয়ে পড়াশুনোর চর্চা চলছিল সেই সময়ে, এখন ভেবে অবাক হই। বেশ কিছু অধ্যাপক বিশ্ববিদ্যালয় ছেড়ে চলে গেছেন। নতুন যাঁরা, তাঁরা অনভিজ্ঞ। তা ছাড়া বাইরের হুলস্থুল অবস্থার প্রভাব বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রাঙ্গণে পড়েছে। পর-পর কয়েক বছর, নভেম্বরের শুরু থেকে মার্চ মাসের গোড়া পর্যন্ত, বিশ্ববিদ্যালয়ে অস্থিরতা অব্যাহত। কোনও-না-কোনও উপলক্ষ্যে ধর্মঘট, বিশ্ববিদ্যালয়ের মাঠে দৈনন্দিন সভা। মধুর দোকানে গোল হয়ে বসে চা-চৰ্চার সঙ্গে ছাত্ররাজনীতির কৌশলবিন্যাস, মিছিল, স্লোগানের পর স্লোগানের উচ্চনাদ। ছেচল্লিশ সালে বড় দাঙ্গার সময় বিশ্ববিদ্যালয় বেশ কয়েক মাস এমনিতেই বন্ধ, তারপরও ছুটকোছাটকা নানা গোলমাল।
তখনও শ্রীসঙেঘর সঙ্গে আমার গভীর যোগাযোগ। লীলা রায় যে-ক’সপ্তাহ ঢাকা থাকেন, আমার উপর তাঁর অকুণ্ঠ স্নেহের বর্ষণ। কয়েক বছর বাদে আমি মার্কসবাদের দিকে ঝুঁকে পড়লাম, তিনি খুবই বিষণ্ণ হয়েছিলেন। সেই অস্থির মুহূর্তে তেমন অপরাধবোধ অনুভব করিনি। পরে যখন তিনি কলকাতায় পক্ষাঘাতগ্রস্ত অবস্থায়, জ্ঞানহীন, বিছানায় নিঃসাড় শুয়েছিলেন, অনেকবার ভেবেছি তাঁর কাছে গিয়ে, আমার আদর্শ উত্তরণের জন্য অনুশোচনা নয়, সৌজন্যমূলক দুঃখও নয়, বিনম্র শ্রদ্ধা প্রকাশ করে আসবো: সংকোচে আর যাওয়া হয়নি।
এই ঋতুতে আমি সাহিত্য ও কবিতায় আদ্যোপান্ত মজে আছি। ‘কবিতা’ পত্রিকার গ্রাহক হয়েছি, বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে নিয়মিত পত্রবিনিময় চলছে, অনেক অপোগণ্ড গম্ভীর বাক্যবাণ প্রতি চিঠিতে তাঁর উদ্দেশে নিক্ষেপ করছি, তিনি প্রতিটি চিঠির প্রায় সঙ্গে-সঙ্গে উত্তর দিচ্ছেন। চিঠি দিচ্ছি জীবনানন্দ দাশ-সঞ্জয় ভট্টাচার্যদের। অনুজ দেবীপ্রসাদের সঙ্গে কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তখন ‘রঙমশাল’ সম্পাদনা করছিলেন, কিন্তু পাশাপাশি ‘সংকেত’ নামে বড়দের জন্য একটি মাসিক পত্রিকারও সূচনা করেছিলেন, কয়েকটি সংখ্যা বের হবার পর বন্ধ হয়ে যায়। তবে তখন সাহিত্যযশোপ্রার্থী আমাকে ঠেকাবে কে? অবিশ্রান্ত পত্রাঘাতে কামাক্ষীপ্রসাদকেও সেই ঋতুতে জর্জরিত করে তুলেছি।
আমার চিঠির জোয়ার, যা আসলে সাহিত্যঈপ্সার উৎসমুখ, প্রবল ধারায় বইছিল, সম্পূর্ণ একটি অন্য প্রবাহ বেয়েও। জ্যোতিষ বন্দ্যোপাধ্যায়ের কাছ থেকে জেনে ফেলেছি, সুপ্রিয় সোম আসলে ওভারটুন হল ওয়াই এম সি এ-তে তার ঘরসঙ্গী সুরঞ্জন সরকার। সুরঞ্জন সরকারের দিক থেকে এবার স্বনামে আমাকে চিঠি লেখার শুরু। সপ্তাহে দু’টি কি তিনটি চিঠি, আমার দিক থেকেও সেই সংখ্যক প্রত্যুত্তর, এখন অনেকের কাছে সম্ভবত বিশ্বাসযোগ্য ঠেকবে না। সে সময় কাগজ দুষ্প্রাপ্য ও দুর্মূল্য। আমি প্রতিটি চিঠি লিখতাম, পূর্বেই উল্লেখ করেছি, শাদা ফুলস্ক্যাপ কাগজের উভয় পৃষ্ঠা ভরে, এবং চিঠিগুলির আয়তন আট-দশ-বারো-চোদ্দো পাতা ছাড়িয়ে যেত। বাষ্পভারাতুর চিঠি, কাহিনী ভারাতুর চিঠি, কবিতা ভারাতুর চিঠি, এক প্রসঙ্গ থেকে অন্য প্রসঙ্গে দুর্বার স্বচ্ছন্দ বিহার। তবে এমনি করেই আমার হয়তো বাংলা রচনায় আস্তে-আস্তে ঈষৎ স্বাচ্ছন্দ্য এসেছে।
প্রথম দিকে আমার লিখনে অসম্ভব বুদ্ধদেবীয় ঝোঁক অতি প্রকট; যে-আড়ষ্টতা বুদ্ধদেবের নিজস্ব ধর্ম, তা আমার ক্ষেত্রে নির্বোধ শব্দ কণ্ডুয়ন মাত্র। ভরসার কথা, এই পর্ব খুব বেশিদিন স্থায়ী হয়নি। সুরঞ্জন সরকার মহা মর্কট মানুষ, তার কাছ থেকে আমিও মর্কটত্বে দীক্ষা নিলাম। রচনায় দুষ্টুমি এলো, কিছুটা হয়তো চালিয়াতিও। কয়েক মাস বাদে অন্য এক অভাবনীয় সৌভাগ্যের পালা। রিপন কলেজে সুরঞ্জন সরকারের সহপাঠী অরুণকুমার সরকার। খুব সম্ভব সুরঞ্জনের কাছে আমার কিছু চিঠি অরুণ দেখেছিলেন। তাঁর কী মনে এলে অনুমান করতে পারি না, তিনিও হঠাৎ সপ্তাহে একটি-দু’টি করে চিঠি পাঠাতে লাগলেন, তাতে বিভিন্ন সাহিত্য প্রসঙ্গ, রাজনীতি, দর্শন, কখনও-কখনও আস্ত একটি কবিতা, কিংবা কবিতার টুকরো। সুরঞ্জন ও অরুণকুমার সরকারের যৌথ মাদকতায় আমি অচিরে নেশাগ্রস্ত হলাম। মনে পড়ে এমনই কোনও চিঠিতে অরুণকুমার সরকার তাঁর সদ্য-লেখা কবিতা মকশো করে পাঠিয়েছিলেন: ‘হে রাত্রি, মিনতি শোনো, মিত্র হও, কটাক্ষ হেনো না’। আরও যা মনে পড়ে, কোনও চিঠি, হয়তো দুই কিংবা তিন দিন ধরে লেখা, বিক্ষিপ্তভাবে, কখনও সকালে একটি অনুচ্ছেদ, দুপুরে একটি, রাত্রে অন্যটি, পরদিন আবার তেমনই করে এখান-ওখান থেকে কাগজের টুকরো জড়ো করে সেই অসম পরিমাপের কাগজে চিঠির বিন্যাস। এরকম একটি চিঠিতে হঠাৎ নিম্নোক্ত উচ্চারণ: ‘ঘুম থেকে উঠে কী খারাপ যে লাগছে কী বলবো। হঠাৎ একটি কবিতার লাইন মনে এলো: “লিখলুম বিচিত্রা দাশকে, বহুদিন দেখিনি আকাশকে”।’ কবিতাটি পরে অরুণকুমার সরকার সম্পূর্ণ করেছিলেন, তা বিখ্যাতও হয়। অরুণের মৃত্যুর পর তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতা আলোক সরকার প্রত্যয়সহ জানিয়েছিলেন, ‘লিখলুম বিচিত্রা দাশকে বহুদিন দেখিনি আকাশকে’-র অব্যবহিত পরবর্তী পঙ্ক্তি দু’টি ফিরতি চিঠিতে আমি নাকি যোগ করে দিয়েছিলাম, বাকিটুকু অরুণের স্বকীয় সংযোজন; সেই পঙ্ক্তিদ্বয়, ‘উষ্ণ তোমার স্মৃতি তবুও/আমার এ হৃদয়ের ফ্লাস্কে’। তবে এই ব্যাপারে আমার কোনও স্মৃতিই নেই: আলোকের সাক্ষ্যই আমার পাপাচারের কাহিনীর দায় বহন করছে।
ঢাকা থেকে কলকাতায় বছরে একবারের বেশি আসা হতো না। থাকতাম রাঙা পিসির বাড়িতে টালা পার্কে। সেখান থেকে দু’নম্বর বাসে চেপে কলেজ স্ট্রিটে চলে আসা; আড্ডা সেরে বারোটা-সাড়ে বারোটা নাগাদ ফিরে যেতাম নগরের উত্তরপ্রান্তে। বিকেল ছ’টা বাজলে ফের কলেজ স্ট্রিটে। সুরঞ্জনের ঘরে আড্ডা, ততদিনে সুরঞ্জনের নতুন ঘরসঙ্গী, মোনা, নরেন্দ্রনাথ নবিশ, অসমের এক সম্ভ্রান্ত বংশোদ্ভূত দারুণ শৌখিন যুবক, যাঁর চাকচিক্যের বহর অবলোকনে আমি প্রায় মূক হয়ে যেতাম। পরে সুরঞ্জনের দৌত্যে সেই নির্বাক পর্যায়ের অবসান ঘটে। সন্ধ্যাবেলা সুরঞ্জনের ঘরে জড়ো হতেন অরুণকুমার সরকার, সোমেশ আচার্য নামে অন্য-এক তরুণ, যিনি কমিউনিস্ট নেতা গোপাল আচার্যের ভ্রাতুষ্পুত্র আবদুল আজিজ নামে এক সাহিত্যরসিক ভদ্রলোক, যাঁর ওভারটুন হলের ঘরে ‘পরিচয়’ ও ‘চতুরঙ্গ’ পত্রিকার জড়ো-করা সংখ্যা দেখতাম। আরও যাঁরা-যাঁরা আসতেন, দ্রুততার সঙ্গে প্রবেশ করতেন, দ্রুততার সঙ্গেই তাঁদের নির্গমন ঘটতো, হয়তো মাত্র একটি চতুর বাক্যবন্ধ উচ্চারণ করে, কিংবা একটি সদ্য-শেখা ইংরেজি শব্দের প্রসাদ বিতরণ করে। একটা সময়ে যখন ওই ছোটো ঘরে স্থানসংকুলান হতো না, একতলায় ভবানী দত্ত লেনের গা-ঘেঁষা ওয়াই এম সি এ রেস্তোরাঁয় আমাদের অবতরণ। আমাদের পছন্দের বেয়ারাটির নাম এবং চেহারা এখনও মনে ভাসছে, নিতাই! নিতাই আমাদের সবাইকে চা পরিবেশন করতো, কিন্তু নানাজনকে পরিবেশিত পেয়ালার পরিমাপে উল্লেখযোগ্য তারতম্য: বড়ো আকার, মেজো আকার, খুদে আকার। সুরঞ্জন নিতাইকে কাছে ডেকে ফিসফিস করে প্রশ্ন ছুঁড়তো, ‘ভাই, আসল কথাটি বলো তো, ছোটো পেয়ালাগুলি বড়ো পেয়ালাগুলির পুত্রসন্তান, তাই না?’
সন্ধ্যা ঘনিয়ে আসে রেস্তোরাঁয়, আলো ঝলমল। কিন্তু দুটো প্রায়-বলাই-চলে ফরাশি জানালা, তাদের ওপাশে ভবানী দত্ত লেন, ঘুটঘুটে অন্ধকার। যতদিন ওভারটুন হলে গেছি, বা ওয়াই এম সি এ-র রেস্তোঁরায় ঢুকেছি, চোখ ওদিকে গেলেই ভবানী দত্ত লেনের অন্ধকারে-ঠাসা চেহারা, যেন কোনও প্রগাঢ় রহস্য সেই গলিকে মুড়ে রেখেছে। বহুদিন মনে-মনে চিন্তা করেছি, রেস্তোরাঁ পেরিয়ে আরও দশ-পনেরো গজ গেলে যদি একটি ক্ষত-বিক্ষত মৃতদেহ সেই অন্ধকারকে আরও প্রগাঢ় করে পড়ে থাকতো, তা হলে সেই পিস্তলবিদ্ধ শব নিয়ে একটি চমৎকার গোয়েন্দাকাহিনী রচনা করা সম্ভব। পরবর্তী কালে বন্ধু-সখা-সহচর অনেককে প্রলোভিত করার চেষ্টা করেছি এমনধারা একটি কাহিনী ফাঁদতে। মনে হয় পৃথিবীতে রোমাঞ্চবিলাসী মানুষের সংখ্যা ক্রমহ্রাসমান, কেউই আমার উপরোধ তেমন গুরুত্ব দিয়ে বিবেচনা করেননি। দু’-একজন হয়তো বলেছেন, তুমি প্রথম একটা-দুটো কিস্তি শুরু করো না কেন, তারপর আমরা দায় গ্রহণ করবো। পৃথিবীতে আলস্যেরও তো শেষ নেই, আমার আর অকুতোভয়ে ঝাঁপিয়ে পড়া হয়নি।
ওয়াই এম সি এ রেস্তোরাঁয় আড্ডা যখন জমাট হতো, তখন হইহই করে কফি হাউসে নিজেদের স্থানান্তরিত করতাম। অ্যালবার্ট হলের তখন এখনকার মতো জরাজীর্ণ অবস্থা নয়, সিঁড়িগুলিও এত ভাঙাচোরা তোবড়ানো ছিল না, সিঁড়ির পাশের দেওয়াল তাম্বুলচর্চার অঢেল সাক্ষ্য বহন করতো না। কফি হাউসের ভিতরে এক আলাদা জগৎ, উজ্জ্বল পরিবেশ। সিঁড়ি দিয়ে উঠলেই কফির মাদকতা-মাখানো গন্ধে নিজেদের জারিয়ে নেওয়া। সবুজ রঙের নিচু বেতের চেয়ার, চারটি-পাঁচটি করে প্রতিটি টেবিলের সংলগ্ন। এখন ঠিক মনে পড়ছে না, তিন আনা দিলেই হয়তো এক পেয়ালা কফি হাজির হতো, ঠাণ্ডা কফির জন্য সম্ভবত পাঁচ আনা, আইসক্রিম কফির জন্য আট আনা। বেয়ারাদের পোশাক সুশুভ্র, কালিমাবিহীন: মাথায় পাগড়ি, পাগড়ির পুরোভাগে তুঙ্গ হয়ে ওঠা উষ্ণীষ। ওরা আমাদের মুখ চিনতো, যেহেতু ঘণ্টার পর ঘণ্টা সকাল-দুপুর-বিকেল আমাদের কাটতো ওখানে। সকাল সাড়ে সাতটায় বউনি করে আসতাম, কফির সঙ্গে অমলেট, মাখন-মাখা রুটি, নয়তো প্লাম কেক। দুপুর একটু গড়ালে হয়তো চপ কিংবা কাটলেট। বিকেলে-সন্ধ্যায় কফির সঙ্গে উদরপূর্তির অন্য কোনও ব্যবস্থা। মেরিডিথ স্ট্রিটের কফি হাউসের সঙ্গে তখনও আমাদের পরিচয় হয়নি, তখনও আমরা কলেজ স্ট্রিটকেন্দ্রিক। প্রেসিডেন্সি কলেজ ও বিশ্ববিদ্যালয় ঝেঁটিয়ে ছাত্ররা আসতেন, একজন-দু’জন দুঃসাহসী ছাত্রীও। কবিরা আসতেন এন্তার, লেখক, সম্পাদক, একগুচ্ছ রাজনীতিবিদ। অন্য কিছু মানুষ, যাঁরা বাউন্ডুলেও হতে পারেন, মস্ত বৈজ্ঞানিকও হতে পারেন, অবিন্যস্ত চুল, এলোমেলো পোশাক, প্রায় উদ্ভ্রান্ত দৃষ্টি। সিঁড়ি দিয়ে আর এক দফা উঠে তেতলায় তথানামাঙ্কিত ব্যালকনি, কফির দাম ওখানে দ্বিগুণ, যাঁরা নিভৃতে প্রেমচর্চা করতে চান, তাঁরা যেতেন। আরো যেতেন কিছু-কিছু এলেমদার ব্যক্তি। তাঁদের সম্বন্ধে গভীর ঘৃণা পোষণ করা হতো: আমরা নিচের মহলে, ওঁরা উপর মহলে, সুতরাং পরিত্যাজ্য।
লম্বা ফরসা চমৎকার চেহারার একটি বেয়ারার কথা প্রায়ই মনে পড়ে। গর্বের সঙ্গে তার উষ্ণীষ অন্য সবাইয়ের উষ্ণীষ ছাড়িয়ে যেত, ছাপিয়ে যেত, তাকে সার্জেন্ট মেজর বলে অভিহিত করতাম। বহু বছর বাদে একদিন পুনে শহরে বেকার দ্বিপ্রহরে ঘুরতে-ঘুরতে ওখানকার কফি হাউসে হাজির হয়েছি, হঠাৎ একজন এসে সেলাম ঠুকলো। তাকিয়ে দেখলাম, আমার সার্জেন্ট মেজর, কলকাতা থেকে পুনেতে বদলি হয়ে এসেছে। ঝটকা মেরে চেয়ার থেকে উঠে তাকে জড়িয়ে ধরলাম, আত্মীয়তা ও প্রীতিবোধ অন্তরে শিহরণ তুলে দিল।
কলেজ স্ট্রিটের কফি হাউসে আমরা কেউ ঘড়ির দিকে তাকাতাম না। অথচ একটা সময়ে, রাত সাড়ে আটটা নাগাদ, উঠতেই হতো। উঠতেই হতো, কারণ মোটাসোটা ম্যানেজারমশাই, বোধহয় জনৈক চৌধুরী, পরনে টাই-সমেত বিদেশি পোশাক: আমরা ও আমাদের মতো যে-ক’জন অবিবেচক ছিলাম, সময়ের অনুশাসন উপেক্ষা করে তখনও গ্যাঁট হয়ে বসে, তাদের টেবিলের পাশে দাঁড়িয়ে করুণ নয়নে তাকাতেন। তাঁর প্রতি দয়াবশতই আমরা শেষ পর্যন্ত নিষ্ক্রান্ত হতাম।
এই চৌধুরীমশাইকে নিয়েও সুরঞ্জন সরকারের একটি বিশেষ বাঁদরামির কথা মনে পড়ছে। সেটা সাতচল্লিশ সালের শেষের দিক, কফি হাউসের উত্তর দেওয়ালে গান্ধিজীর একটি প্রতিকৃতি টাঙানো। তার পাশে অন্য একটি প্রতিকৃতিও: ভারতীয় কফি বোর্ডের যিনি সর্বাধ্যক্ষ ছিলেন, সম্ভবত তাঁর। কোনও এক প্রভাতকালে হঠাৎ লক্ষ্য হলো দুটি ছবিই উধাও; হয়তো নতুন করে বাঁধাতে দেওয়া হয়েছে, কিংবা অন্য কোনও কারণে। সুরঞ্জন পায়ের তলায় ঘাস গজাতে দিতে রাজি নয়, তক্ষুনি কারও কাছ থেকে একটি শাদা কাগজ চেয়ে নিয়ে খসখস করে ম্যানেজারকে চিঠির খসড়া রচনা: ‘মহাশয়, আমরা আজ এটা দেখে হতচকিত এবং বিস্ময়ে বিস্ফারিত, জনৈক শ্রীমোহনদাস করমচাঁদ গান্ধির ছবির পাশে ভারতীয় কফির জনকপ্রতিম মহামহিম মহানাত্মা শ্রীযুক্ত অমুকের যে অপার্থিব প্রতিকৃতি শোভা পাচ্ছিল, যে-প্রতিকৃতির উদ্দেশে আমরা প্রতিদিন সকালে-দ্বিপ্রহরে-অভিভূত সন্ধ্যায় স্বগত প্রার্থনা নিবেদন করতাম, সেই ছবি কোনও অজ্ঞেয় কারণে অপসারিত হয়েছে। এরকম ভয়ঙ্কর ঘটনাচক্রে আমরা বিমূঢ়। কোন দুশমন-শয়তানদের ষড়যন্ত্রে এই পাপকর্ম সাধিত হয়েছে তা জানবার জন্য আমরা অবিলম্বে লালবাজারের সঙ্গে যোগাযোগ করছি। কিন্তু তাতে আপনার দায়িত্ব বাষ্পে পরিণত হতে পারে না। আমরা নিম্নলিখিতগণ আপনার কাছে দাবিসনদ পেশ করছি। এই চিঠি পাওয়ামাত্র পত্রপাঠ পলমাত্র বিলম্ব না করে আপনি যদি ভারতীয় কফির মহান জনকের প্রতিকৃতি দেয়ালে ফিরিয়ে না দেন, তা হলে আমরা কফি হাউসের প্রতিটি টেবিল চূর্ণ-বিচূর্ণ করবো, প্রতিটি চেয়ার ভস্মীভূত করবো এবং আপনার ঝাঁ-চকচক বর্তুল মস্তকে বাইশটি তৈলাক্ত লাঠির বাড়ি মারবো’। সব শেষে পাঠোদ্ধার-অসম্ভব কয়েকশো স্বাক্ষর। পরদিন সন্ধ্যাবেলায়ই মহাত্মা গান্ধির প্রতিকৃতি দেওয়ালে ফিরলো, ভারতীয় কফির জনক চিরকালের জন্য বিসর্জিত হলেন।
সুরঞ্জনের দুর্ধর্ষ উপস্থিতপ্রতিভার অন্য একটি কাহিনী: সম্ভবত মুরারি সাহার বিবাহ, বিবাহবাসর কলকাতার উত্তর সীমান্তে, দক্ষিণ কলকাতা থেকে এক ভাড়া-করা বাসে চেপে বন্ধু-বোঝাই বরযাত্রী দল, সেই বাসে চেপেই মধ্যরাত্রিতে বিয়েবাড়ি থেকে ফেরা, চালক রাস্তা সংক্ষেপ করতে গিয়ে ক্যানাল ইস্ট রোড ধরেছে, হঠাৎ বাস বন্ধ হয়ে গেল, অনেক সাধ্যসাধনাতেও চালু করা সম্ভব হলো না, রাত দেড়টা পেরিয়ে দুই ছুঁইছুঁই করছে। এমন মুহূর্তে সুরঞ্জন খালপাড়ে চড়ে-বেড়ানো দু’টি হৃষ্টপুষ্ট মহিষ হ্যাট-হ্যাট করে তাড়িয়ে নিয়ে এসে বাসের সামনে জুড়ে দিল, তারপর চালকের আসনে বসে বিকট শব্দে ইঞ্জিন চালালো, ইঞ্জিনগর্জনে উদভ্রান্ত মহিষদ্বয়ের দিগ্বিদিক জ্ঞানশূন্য হয়ে ছুটতে শুরু করা; আর একটু হলে বরযাত্রী সম্প্রদায়ের বাগমারি খালের পূত জলে সলিল সমাধি ঘটতো।
সেই বছরগুলিতে কফি হাউসে আমাদের টেবিলে যাঁরা জড়ো হতেন, সুরঞ্জন সরকার, অরুণকুমার সরকারের বাইরে, তাঁরা অবশ্য অনেকেই বর্তমানে বিখ্যাত। মনে পড়ে নীরেন্দ্রনাথ চক্রবর্তী এক সন্ধ্যায় জমাট-হয়ে-বসা আমাদের তাঁর সেই দীর্ঘ কবিতা প্রথম পড়ে শুনিয়েছিলেন, ‘আর কতকাল তা হলে কবিতা লিখতে বলো, আর কতকাল লেখা-লেখা খেলা খেলতে বলো’। আতোয়ার রহমানের সঙ্গেও আমার বোধহয় কফি হাউসেই প্রথম আলাপ। তাঁকে তার কয়েক মাস আগে ময়মনসিংহে এক ছাত্র সম্মেলনে প্রথম দেখেছিলাম। তিনি আর আমি দুই বিপরীত জোটে; দুই পক্ষের মধ্যে কিছু দাঙ্গা-মারামারিও হয়েছিল। কফি হাউসের মাতাল পরিবেশে সে-কথা আমরা দু’জনেই ভুলে যাওয়া বাঞ্ছনীয় মনে করেছিলাম। আসতেন শিল্পী মণীন্দ্র মিত্র, দার্শনিকমনা ত্রিদিব ঘোষ, মানবেন্দ্রনাথ রায়-ভক্ত বেহালার সমরেন রায়, কবি ও জয়প্রকাশ নারায়ণ-আসক্ত আনন্দগোপাল সেনগুপ্ত, সদ্য-বিশ্ববিদ্যালয়-থেকে-বেরুনো ঝকঝকে চেহারার মুরারি সাহা, যিনি কয়েক মাস আগে ‘শতাব্দী’ নামে একটি সাহিত্যসংকলন প্রকাশ করে নাম কুড়িয়েছেন এবং যাঁর বিবাহঘটিত সুরঞ্জন-কাহিনী এইমাত্র বর্ণনা করেছি। আসতেন সুহৃদ রুদ্র, তাঁর সম্পাদিত ‘দ্বন্দ্ব’ পত্রিকা তখন যথেষ্ট আলোচিত। নিউজপ্রিন্টে ছাপা হতো, কিন্তু যথেষ্ট আকর্ষণীয় মালমশলা থাকতে প্রতি সংখ্যাতেই। এখন আর মনে আনতে পারি না, ‘যাযাবর’-এর ‘দৃষ্টিপাত’ ‘দ্বন্দ্ব’তে ধারাবাহিকভাবে ছাপা হয়েছিল কিনা। তবে তখন ‘দৃষ্টিপাত’ নিয়ে যথেষ্ট শোরগোল ওই পত্রিকা এবং তার বাইরেও যে হয়েছিল তাতে ভুল নেই। শুনলে এখন মজা লাগবে, মাঝে-মাঝে সুনীতি চট্টোপাধ্যায় মশাইও তাঁর পারিষদবর্গসহ কফি হাউসের এক কোণে আড্ডা জমাতেন। আড্ডায় মশগুল হতেন রাষ্ট্রবিজ্ঞানের দুই অধ্যাপক, ধীরেন্দ্রনাথ সেন ও নির্মলচন্দ্র ভট্টাচার্য; প্রথমজন গোড়ার দিকে হিন্দুস্থান স্ট্যান্ডার্ডের সম্পাদক ছিলেন; মার্কস বাদী প্রত্যয়ের জন্য তাঁকে সরে যেতে হয়, কিংবা নিজেই সরে যান। নির্মলবাবুও প্রথম দিকে কমিউনিস্ট বন্ধুবান্ধব ও ছাত্রদের পছন্দ করতেন; চীন সংকটের পর ঝাঁকের কই কংগ্রেসের ঝাঁকে ফিরে যান। এঁরা দু’জনেই অত্যন্ত ছাত্রবৎসল, প্রায়ই পয়সা খরচ করে ছাত্রদের কফি খাওয়াতেন। নির্মলবাবুর ছেলে সব্যসাচী, বাপ্পা, কুড়ি-পঁচিশ বছর বাদে আমার খুব কাছের মানুষ হয়ে যায়: তার বাবা যে-ক্ষুদে অস্টিন গাড়ি চালিয়ে শহরময় ঘুরতেন, তা নিয়ে ওর সঙ্গে প্রচুর স্মৃতিপরিক্রমা করেছি।
কফি হাউসে আড্ডার প্রসঙ্গে সমসাময়িক অন্য একটি পত্রিকার উল্লেখ না-করলে অন্যায় হবে। দীপ্তেন্দ্রকুমার সান্যালের ‘অচলপত্র’ স্ফুলিঙ্গের মতো জ্বলে উঠে স্ফুলিঙ্গের মতোই মিলিয়ে যায় কয়েক বছরের ব্যবধানে। তাঁর সহচররা, যেমন ব্রহ্মদেশ-ফেরত বারীন দাশ, কফি হাউসের বাঁধা খদ্দের ছিলেন না, মাঝে-মাঝে আসতেন। দীপ্তেন সান্যালের কলমে ব্যঙ্গ-বিদ্রূপ ফল্গুর মতো সাহজিকতায় বইতে। তাঁর একটি pun, আমার বিবেচনায়, অমরত্বের অধিকারী। এখন আর বিশেষ কারও মনে নেই, বুদ্ধদেব বসু দ্বিতীয় মহাযুদ্ধোত্তর কালে বাংলা সাহিত্যের একটি ক্ষুদ্রায়তন আলোচনা পুস্তক রচনা করেছিলেন: An Acre of Green Grass। দীপ্তেন্দ্রকুমারের ‘অচল পত্র’-এ প্রকাশিত মন্তব্য: আসলে এক একার ঘাস, বুদ্ধদেব বসু-র একার গ্রাসের পক্ষে, অনেকটাই।
আরও অজস্র নাম আউড়ে যেতে পারি। কিন্তু ভয় হয়: হয়তো কারও-কারও নাম বিস্মরণহেতু বাদ পড়ে যাবে, যা অক্ষমার্হ হবে। শুধু একজনের কথা বলি যিনি কলকাতা বিশ্ববিদ্যালয়-পরিচালিত প্রবেশিকা পরীক্ষায় একদা প্রথম হয়েছিলেন, পরে আর তেমন যুত করতে পারেননি। ইংরেজি সাহিত্যে বি. এ., এম. এ পাশ করে বেসরকারি কলেজে দীর্ঘদিন অধ্যাপনা করেছেন, সেই সঙ্গে কিছু অপেশাদার রাজনীতিচর্চাও। তাঁর বিষয়ে প্রবাদ শুনেছিলাম, তাঁকে কোনও পত্রিকা থেকে সঞ্জয় ভট্টাচার্যের ‘সৃষ্টি’ উপন্যাসটি আলোচনা করতে বলা হয়েছিল। তিনি যে-আলোচনা লিখেছিলেন তার অতি বিখ্যাত প্রথম পঙ্ক্তি: ‘প্রথম দর্শনেই সঞ্জয় ভট্টাচার্য আমাকে হতাশ করেন, যদিও আমার নিজের চেহারা প্রায় অমিয় চক্রবর্তীর মতো’। প্রায় ভুলেই যাচ্ছিলাম, অমিয় চক্রর্তীও কফি হাউসে মাঝে-মাঝে দেখা দিতেন, খানিকক্ষণ বসতেন, তারপর উঠে যেতেন। কে না জানে তাঁর প্রথম প্রেম ছিল কফি নয়, চকোলেট। প্রিয় ছাত্রছাত্রীদের ঘন-ঘন চকোলেট বিলোতেন। গুজব ছিল, শ্রীমতী হৈমন্তী দেবী অমিয়বাবুকে কড়া শাসনে রাখতেন, বাড়িতে বেশি মিষ্টান্ন জাতীয় পদার্থ খেতে দিতেন না। অমিয়বাবু তাই ফ্লুরি থেকে পেস্ট্রি কিনে পার্ক স্ট্রিটের মোড়ে ট্রামে চেপে খেতে- খেতে এলগিন রোডের ফ্ল্যাটমুখো হতেন প্রতিদিন বিকেলে।
অনেক সখ্যের স্থাপত্য শুরু হয়েছিল কফি হাউসে, অনেক প্রেমের প্রথম উচ্চারণের গুঞ্জরণ, অনেক রাজনীতি তথা বিপ্লবের স্বপ্নউন্মীলন, অনেক বিশুদ্ধ আড্ডায় বহুজনের ভেসে যাওয়া। কত কবিতা যে লেখা হয়েছে কফি হাউসের টেবিলে বসে ইয়ত্তা নেই। একটি বিশেষ কবিতার কথা মনে পড়ে, ইলাস্ট্রেটেড উইকলি পত্রিকার পৃষ্ঠার মার্জিনের ফাঁকে-ফাঁকে অরুণকুমার সরকারের কবিতা ‘মালবিকা হালদারকে মনে পড়ে বর্ষার সন্ধ্যায়, ব্রিস্টলে টেম্পলে মন্টিকার্লোর প্রেক্ষিতে’। কবিতাটির আদি পাঠ অবশ্য ‘সুরঞ্জন সরকারকে মনে পড়ে’ ইত্যাদি। সুরঞ্জনের কাস্টমসে চাকরি, ওভারটাইম খাটলেই প্রচুর টাকা, দুঃখী-দুঃখী বন্ধুবান্ধবদের নিয়ে মাঝে-মাঝে তার ব্রিস্টলে-মন্টিকার্লোতে চংক্রমণ। সুতরাং আদি পাঠ বহাল রাখলেও অরুণের কাব্যকে মিথ্যা সাক্ষ্য দেওয়ার অপরাধে ফৌজদারিতে চালান দেওয়া সম্ভব হতো না।
বছরে একবার-দু’বার কলকাতা আসতাম, কফি হাউসকেন্দ্রিক আড্ডার গহনে ডুবে যেতে, কিন্তু, একটু আগে যা বলেছি, সব মিলিয়ে এক সঙ্গে আট-দশ দিনের বেশি কলকাতাবাস হতো না। তবে উন্মাদনায় ভেসে যাওয়ার পক্ষে তাই-ই যথেষ্ট। কোনও-কোনও দিন অরুণকুমার সরকারকে নিয়ে কবিতাভবনে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে দেখা করতে যেতাম। আমার সন্দেহ, তখন কবিতাভবনের অন্তত সাময়িক ভাঙা হাট। সমর সেন, সুভাষ মুখোপাধ্যায়, কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায়, এমনকি মঙ্গলাচরণ চট্টোপাধ্যায়ও যাওয়া-আসা ছেড়ে দিয়েছেন, সম্ভবত বুদ্ধদেবের সঙ্গে রাজনৈতিক মতামতের আড়াআড়ির কারণে। বিষ্ণু দে-ও অনিয়মত, প্রিন্স গোলাম মহম্মদ রোডে তাঁর নিজের আড্ডাও তো ততদিনে জমে উঠেছে। এরই কিছুদিনের মধ্যে ‘বৈষ্ণব’-‘বৌদ্ধ’ দুই সম্প্রদায়ের কাব্যিক কোদল তুঙ্গে। এটি একটি রহস্যময় অধ্যায়, যার জন্য কমিউনিস্ট পার্টির ‘জনযুদ্ধ’ নীতি ঘোষণাই মনে হয় একমাত্র দায়ী ছিল না। তেতাল্লিশ সালের প্রত্যন্ত পর্যন্ত সমর সেন-মঙ্গলাচরণরা ‘কবিতা’ পত্রিকায় কবিতা পাঠিয়েছেন, সমালোচনা লিখেছেন। কিছু ব্যক্তিকেন্দ্রিক ভুল-বোঝাবুঝি সম্ভবত বিনিময়-প্রতিবিনিময়ে বাধা হয়ে দাঁড়ায়। অবশ্য সুভাষ মুখোপাধ্যায়ের স্বভাবছন্দোচাতুর্য সম্পর্কে বুদ্ধদেবের মুগ্ধতাঘোর কোনওদিনই কাটেনি। ‘আধুনিক বাংলা কবিতা’ সংকলনে অরুণ মিত্রের ‘লাল ইস্তাহার’ ঢোকানো নিয়ে প্রকাশক বুদ্ধদেব বসু প্রচুর অসুখী, যদিও হীরেন্দ্রনাথ মুখোপাধ্যায়ের উপরোধে অন্য সম্পাদক আবু সয়ীদ আইয়ুব তা মেনে নিয়েছিলেন। অনুমান করা সম্ভব, একটু-একটু করে রাজনৈতিক বিশ্বাসের তফাতের সঙ্গে ব্যক্তিগত ঝোঁকের দূরত্ববৃদ্ধির মিশ্রণ ঘটে। অথচ ওই পর্বেও প্রতিভা বসু সম্পাদিত ‘বৈশাখী’ সংকলনে দিনেশ দাসের সেই চতুর কবিতা মুদ্রিত হয়: ‘দক্ষিণ পথে মেলে যদি দক্ষিণা, ভেবে দেখো তবু সেই পথ ঠিক কিনা’। তবে আর কয়েক বছর বাদেই বুদ্ধদেব বসু সম্পূর্ণ দক্ষিণপন্থী বনে গেলেন, কলকাতাস্থ পুরনো সুহৃদ্দের মধ্যে শুধু সুধীন্দ্রনাথ দত্ত তাঁর সঙ্গে রইলেন। পরবর্তী যাঁরা এসেছিলেন, তাঁদের আগমন বেশ কিছু কালক্ষয়ের পর। প্রাক্তন অনুরাগীদের মধ্যে একমাত্র মণীন্দ্র রায়কেই কখনো-সখনো দেখতাম, দ্বিতীয় স্ত্রী তপতী চট্টোপাধ্যায়-সহ। তাঁর অকালমৃতা প্রথম স্ত্রী রমা গোস্বামীকে নিয়ে রচিত বুদ্ধদেবের সেই শোকগাথা: ‘ভুলিবো না: এত বড়ো স্পর্ধিত শপথে জীবন করে না ক্ষমা, তাই মিথ্যা অঙ্গীকার থাক’: ছাত্র ফেডারেশনের সেই উচ্ছল-উৎসাহী সদস্যা রমা গোস্বামীকে আর ক’জনই বা এখন মনে রেখেছেন?
বুদ্ধদেবের সমস্ত স্নেহবর্ষণ তখন প্রধানত নরেশ গুহকে ঘিরে। পুরনো বন্ধুরা খসে গেছেন, নতুন-কোনও অন্তরঙ্গ পরিচয় সূচিত হয়নি, মাত্র কয়েকজন ছাত্র, কয়েকজন ভক্ত-পাঠক, কয়েকজন তরুণ কবিযশোপ্রার্থী। আমরা চড়াও হবার আগে কয়েক মাস গল্পলেখক পৃথ্বীশ রায়চৌধুরীর আনাগোনা ছিল, ক্ষয়রোগে সে অচিরেই মিলিয়ে যায়। কালীঘাটের গলিতে তার অপরিসর ঘরে মাঝে-মাঝে গেছি। পৃথ্বীশ একই সঙ্গে ছবি আঁকতো, গল্প লিখতো। কোনও অজ্ঞাত কারণে বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে তার সম্পর্ক ছেদ হয়েছিল, তা রাজনীতিঘটিত নয়। ওই তরুণ, যতদিন তার সঙ্গে কথা বলেছি, আমার মনে হতো, সে যেন জানে তার দিন শেষ হয়ে আসছে, সব সময় একটি বিষাদের আবরণ তাকে ঘিরে। হয়তো উল্লেখ করা প্রয়োজন, পৃথ্বীশ সম্পর্কে অরুণকুমার সরকারের মাসতুতো ভাই।
মিমি-রুমি তখনও ছোটো, পাপ্পা মাত্র ভূমিষ্ঠ হয়েছে। শিশুদের বাইরের বারান্দায় খুব বেশি বের হতে দেখতাম না; প্রতিভা বসু মাঝে-মাঝে আসতেন। উপর থেকে কখনও-কখনও নামতেন অজিত দত্ত মহাশয়ের স্ত্রী, আমরা যাঁকে বেবিদি সম্বোধন করতাম। অজিতবাবু নিজে কিন্তু আদৌ নামতেন না। ততদিনে বুদ্ধদেব অজিতবাবুকে নিয়ে তাঁর বিলাপপাক্তি লিখে ফেলেছেন: ‘ছিলে তুমি ওস্তাদ ঘুড়ি উড়িয়ে/ছন্দের বাঁকাচোরা মোড় ঘুরিয়ে…’। এমনটাই বোধহয় হয়, সেই আট বছরের বন্ধু আমি আর নয়নকুমারের মতো। ঢাকায় প্রায় স্কুলপর্ব থেকে বুদ্ধদেবের সাহিত্যসখা অজিত দত্ত। অজিত দত্তর তুতো সম্পর্কের ভাই প্রভু গুহঠাকুরতা; এঁদের সম্মিলিত সৃষ্টি ‘প্রগতি’ পত্রিকা। অজিতবাবু ‘কবিতা’র উন্মেষমুহূর্তেও ছিলেন, কিন্তু কোথায় যেন একটি প্রাচীর মাথা তুলে দাঁড়ায়। দুই বাড়ির ছেলেমেয়েরা হরিহরআত্মা, অবিরল ২০২ নম্বরের দোতলা-তেতলা ছুটোছুটি করছে। কবিদের স্ত্রীরাও নৈকট্যে নিবিড়। কিন্তু কবিতা ভবন থেকে ‘বৈশাখী’ বার্ষিকী যেহেতু বেরোচ্ছে, তার জবাব দিতেই কি অজিত দত্ত নিয়মিত ‘দিগন্ত’ বার্ষিক পত্রিকা শুরু করলেন? ঠিক জানি না। তবে ওই ক’বছর, ছেচল্লিশ সাল থেকে শুরু করে পরবর্তী পাঁচ-ছ’বছর, কবিতা ভবনের নিয়মিত সান্ধ্য অতিথি নিছকই নরেশ গুহ-অরুণকুমার সরকার, ঢাকা থেকে কখনও-কখনও আমি, পরে চাইবাসা থেকে নিরুপম চট্টোপাধ্যায়। অবশ্যই আসতেন নিউ থিয়েটার্সের শিল্প-নির্দেশক সৌরেন সেন। সৌরেনবাবু অধিকাংশ সময় একপাশে চুপচাপ বসে থাকতেন, আমরাই আসর জমাতাম। আমাদের মতো তরুণ ও সদ্যযুবাদের কণ্ঠস্বর শ্রদ্ধাবিনীত থাকতো, শুধু বুদ্ধদেবই মাঝে-মাঝে তর্ক প্রসঙ্গে উচ্চগ্রাম হতেন, কিংবা আমাদের কোনও রসিকতায় হাসিতে ফেটে পড়তেন। আরও আসতেন, হয় ঢাকা থেকে বা পরে দিল্লি বা আলিগড় থেকে, ‘প্রগতি’র পুরনো বন্ধুরা, মন্মথনাথ ঘোষ, পরিমল রায়, অমলেন্দু বসু। আমি সে সময় আকাট বাঙাল, আমার শিক্ষকদের সমাগমে একটু ভরসা পেতাম।
নরেশ অবশ্য তখনও পর্যন্ত দ্বিরাচারী। বুদ্ধদেব বসুর প্রতি যেমন সর্বসমাচ্ছন্ন ভক্তি, সেই সঙ্গে বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর শিক্ষক অমিয় চক্রবর্তী সম্পর্কেও। অবশ্য রিপন কলেজে নরেশ-অরুণ-নীরেন-বীরেন এঁদের সবাইকেই বুদ্ধদেব পড়িয়েছেন। প্রায়ই বলতেন, বীরেনের যে-প্রতিভার প্রতিজ্ঞা, ওর আরও বেশি করে কবিতা লেখা উচিত। ১৯৫০ সালে বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের ‘কবিতা’য় প্রকাশিত সেই কবিতা, ‘মার্চেন্টের মারে নেই সেই সব খুঁত’, বুদ্ধদেব চেঁচিয়ে পড়ে প্রায় পাড়া জড়ো করে ফেলেছিলেন। তাঁর পক্ষে হতাশাব্যঞ্জক, আমাদের কারও-কারও পক্ষে মস্ত হর্ষদ্যোতক, বীরেন কিছুদিনের মধ্যেই আশ্চর্য দ্রুততার সঙ্গে অজস্র কবিতা লিখতে শুরু করলেন, সে-সব কবিতা রাজনৈতিক আদর্শে আগাগোড়া লেপা; বুদ্ধদেব ছাত্রের বিপথগামিতায় মাথায় হাত দিয়ে বসলেন।
বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে পরিচয়সূত্রেই তাঁর পরিবারস্থ অন্যদের সঙ্গে আলাপ। বিষ্ণু দে’র পরিবারের সঙ্গে ঠিক তার উল্টো। মিমি-রুমিদের সঙ্গে চেনা-জানার বেশ-কয়েক বছর পর বিষ্ণুবাবুর দুই দুহিতা, ইরা, রুচিরা, ও তারা, উত্তরা, আমার নৈকট্যের বৃত্তে উদিতা; ওঁদের মধ্যবর্তিতা ও আগ্রহেই আমার বিষ্ণুবাবু ও প্রণতিদির কাছাকাছি আসা।
মিমি-রুমিরা একবার কবিতাভবনের ভিতরের উঠোনে মঞ্চ খাটিয়ে বোধ হয় ‘লক্ষ্মীর পরীক্ষা’ অভিনয় করেছিল। রুমির অভিনয় আমার কাছে অতি চমৎকার লেগেছিল, পরে কিন্তু মিমি একটি-দু’টি চলচ্চিত্রে নায়িকা সেজে নেমেছে, রুমি ওই পথ মাড়ায়নি। কেন মাড়ায়নি, তা নিয়ে এখনও আমার দুঃখবোধ।
ইরা এখন গাব্দা-গোব্দা গৃহকর্ত্রী, শাশুড়ি মা ও ঠাম্মা, পুত্রবধূ রবীন্দ্রসংগীত গেয়ে আমাদের মুগ্ধ করে, ইরা নিজেও এখন রবীন্দ্রনাথের চিন্তা-ভাবনা-অনুভাবনায় তদ্গতপ্রাণ। তবে ওকে একটি কথা মনে করিয়ে দিয়ে প্রায়ই খ্যাপাই: এক সন্ধ্যায় গোলাম মহম্মদ রোডের বাড়িতে বিষ্ণুবাবুর সঙ্গে গল্প করে বেরিয়ে আসছি, দেখি বছর দশেকের ইরা, ফ্ৰকবতী, কাকে মস্ত জ্ঞান দিচ্ছে, ‘রবীন্দ্রনাথকে আমি দু’চক্ষে দেখতে পারি না, তাঁর আগাপাশতলা ন্যাকামি’।
১৯৪৮ সাল থেকেই আমার রাজনৈতিক মতিগতি বুদ্ধদেব বসু-নরেশ গুহদের প্রতীপ মেরুতে ভ্রাম্যমাণ। বিষ্ণুবাবু ততদিনে ‘সাহিত্যপত্র’ পত্রিকার সঙ্গে নিজেকে গভীরভাবে জড়িয়েছেন, রাজনৈতিক আদর্শের দিক থেকে যে-পত্রিকা আমার অলিন্দবর্তী। সুতরাং ওই আপাত-ভিন্ গোয়ালে ভিড়ে যেতে তেমন মনঃসংকটে ভুগতে হয়নি। মজা লাগছে এটা মনে করে, কাছাকাছি সময়ে ‘সাহিত্যপত্র’-এ বিষ্ণুবাবু আমার একটি কবিতা খুব খুশি মনে ছাপিয়ে দিয়েছিলেন, যাতে ‘ফরাশি অনুই’-র সঙ্গে ‘কনুই’-র মিল ছিল।
তা হলেও, না বুদ্ধদেব বসুর সঙ্গে, না নরেশের সঙ্গে, ব্যক্তিগত সম্পর্ক তো ঘোচবার নয়। তাঁরা দু’জনেই তখন কংগ্রেস ফর কালচারাল ফ্রিডম-এর গভীর অনুরাগী, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে সদা চিন্তিত, আমার সঙ্গে প্রায়ই লম্বা তর্ক। নরেশের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করেই একটি কাহিনী এখানে বিবৃত করছি। সম্ভবত উনপঞ্চাশ সালের দোলের দিন। নরেশের বাসস্থান তখন পাইকপাড়া-সংলগ্ন ব্যারাকপুর ট্রাঙ্ক রোডে এক গলির একটি প্রায়ান্ধকার খুপরিতে। ভোরবেলা আমি ওখানে হাজির, একটু বাদে দু’জনে হেঁটে-হেঁটে বি টি রোড ধরে শ্যামবাজারের দিকে এগোচ্ছি, উদ্দেশ্য ওখান থেকে বাস ধরে বালিগঞ্জগামী হবো। টালা ব্রিজ থেকে সানুদেশে পৌঁছুতেই দেখি জটলা। এক দঙ্গল ছেলে হাতে আবির-পিচকিরি নিয়ে দোলোৎসবে মেতেছে। আমাদের দেখে তারা প্রবল উৎসাহী: ‘আসুন দাদা, একটু হয়ে যান’। আমি দ্বিরুক্তি না-করে আত্মসমর্পণ করলাম, দুই গালে একটু রঙের চাপড় মেরে আমাকে মুক্তি দেওয়া হলো। কিন্তু নরেশ অন্য ধাতুতে গড়া, ব্যক্তিস্বাধীনতার সংগ্রামে জাগ্রত সৈনিক, ব্যক্তিস্বাধীনতা নিয়ে, হোলি না খেলবার নাগরিক অধিকার বিষয়ে, লম্বা বক্তৃতা ফাঁদলেন। ছেলেগুলির হাতে সময় কম, তারা মিনিটখানেক বক্তৃতা শুনে নরেশকে নিঃশব্দে চ্যাঙদোলা করে তুলে নিয়ে ঘোড়াকে-জল-খাওয়ানোর বাঁধানো আধারে রঙ গোলা ছিল, তাতে চুবিয়ে দিল। এই প্রক্রিয়ার তত্ত্বাবধান করছিলেন একজন, যাঁর মাথায় গান্ধি টুপি, ফরসা পাঞ্জাবি-পাজামায় রঙের ছিটেফোঁটাও নেই। একটি ছেলেকে জনান্তিকে জিজ্ঞাসা করলাম: ‘ভাই, ওঁকে রঙ দিচ্ছেন না কেন?’ গম্ভীর জবাব পেলাম, ‘উনি আমাদের ক্লাবের সেক্রেটারি।’ নরেশ গুহ রঙিন জলে অবগাহনের পরেও তড়পাচ্ছেন। তাঁকে কোনওক্রমে বুঝিয়ে বলি, যে-রাজনৈতিক দল তাঁরই মতো ব্যক্তিস্বাধীনতায় বিশ্বাস করে, কমিউনিস্টদের ঘৃণা করে, এই ছেলেরা সেই দলেরই উগ্র সমর্থক, তাই তার খেদ করবার কোনও কারণ নেই। এই সময়েই কিন্তু নরেশ ‘দুরন্ত দুপুর’-এর আশ্চর্য কবিতাগুলি লিখছেন, এমন মৃদু মর্মরের মতো কথা বলা, উদাস করে দেওয়া, বৈশিষ্ট্যের তুলনা মেলা ভার। কাছাকাছি কোনও বছর এক ঘোর বর্ষায় নরেশ আর আমি দু’-এক দিনের জন্য শান্তিনিকেতন গিয়েছিলাম, সেখানেই তাঁর বিখ্যাত কবিতা ‘দূরে এসে ভয়ে থাকি। সে হয়তো এসে বসে আছে…’র জন্ম। তাঁর অন্য এক কবিতার একটি চরণ মাঝে-মাঝে আমাকে তাড়া করে ফেরে: ‘তোমার রক্তের মতো পবিত্র হবো, বলেছিলে’।
নরেশ গুহর সৌজন্যেই আমার দিলীপকুমার গুপ্তর সঙ্গে আলাপ। উৎসাহে সর্বদা টগবগ করছেন, মাথায় নানা মৌলিক চিন্তা কিলবিল করছে, সে সব চিন্তার ফলিত প্রয়োগের জন্য সদাব্যস্ত, সদাত্রস্ত, কার সাধ্য আটকায় ডি কে-কে। সিগনেট প্রেস টিকে রইলো না, তাই-ই সম্ভবত, আমার অন্তত সেরকম ধারণা, তাঁর অপেক্ষাকৃত অকালে চলে যাওয়ার কারণ। আতিথেয়তায় ভরপুর, ব্যবহারে অভিজাত, কাউকে কোনওদিন ব্যথা দিয়ে কথা বলেছেন, তা আমি কিছুতেই বিশ্বাস করতে পারি না। এক বিশেষ রাত্রির কথা মনে পড়ে। কোনও এক পঁচিশে বৈশাখে নরেশ, অরুণ এবং আমাকে সারারাত তাঁর এলগিন রোডের বাড়িতে রবীন্দ্রনাথের গান শোনার জন্য নিমন্ত্রণ জানিয়েছিলেন। মস্ত রেডিওগ্রামে এক সঙ্গে আটটি-দশটি রেকর্ড চাপিয়ে দিচ্ছেন, রেকর্ডগুলি নিজের থেকেই ঘুরে যাচ্ছে, পূজার গান-প্রেমের গান প্রকৃতির গান, ঘণ্টায়-ঘণ্টায় গানের সারাৎসার পাল্টে যাচ্ছে; যখন কীর্তন শুনছি, উপর থেকে আমাদের জন্য রসের মিষ্টি আসছে, যখন খেয়াল-টপ্পা ধরনের গান, হয়তো কাবাব পরিবেশিত হচ্ছে, ‘শরতে আজ কোন অতিথি’র সঙ্গে বড়ো মাপের সন্দেশ, যখন রঙ্গ ভরা কোনও গানের আমেজে ঘর ছেয়ে যাচ্ছে, আমাদের জন্য লেডিকেনির আবির্ভাব। ডি. কে-কে কৃতজ্ঞতা জানিয়ে যখন সিগনেট প্রেস থেকে নিষ্ক্রান্ত হলাম, পুবের আকাশে ছাব্বিশে বৈশাখের সূর্যের অস্ফুট-অর্ধস্ফুট আভা।