একতিরিশ
তবে সে-বিষয়ক কাহিনী তো পরের বৃত্তান্ত। যুযুধান আমি, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের লড়াইয়ে তিরাশি সালে মন্ত্রিসভায় ফিরে ফের কোমর বেঁধে নামলাম। অন্তবর্তী সময়ে আমাদের সম-মনোভাবসম্পন্ন রাজ্যগুলির যুগপৎ সংখ্যা ও শক্তি বেড়েছে। কেরলে বাম-গণতান্ত্রিক জোটের মুখ্যমন্ত্রী কমরেড নায়ানার, কর্ণাটকে জনতা দলের সরকার, মুখ্যমন্ত্রী রামকৃষ্ণ হেগড়ে, অন্ধ্র প্রদেশে মুখ্যমন্ত্রী বিপুল জনসমর্থন পেয়ে সদ্য-নির্বাচিত তেলেগু দেশমের এন টি রামরাও। তামিলনাড়ুতে পালা করে হয় এম জি রামচন্দ্ৰন, নয় এম কে করুণানিধি, মুখ্যমন্ত্রী, কিন্তু কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের ব্যাপারে দু’তরফই আমাদের সমর্থন জ্ঞাপন করতে উদ্গ্রীব। পঞ্জাবে অকালি দল শাসনক্ষমতায়, আনন্দপুর সাহেব প্রস্তাবের ধারাগুলি দলের মন্ত্রীদের শিরায়-তন্ত্রীতে প্রবাহিত। যা আগেই উল্লেখ করেছি, রাজস্থানের মুখ্যমন্ত্রী শেখাওয়াত যদিও ভারতীয় জনতা পার্টির বড় নেতা, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের বিতর্কে আমাদের সঙ্গে অনেক বিষয়েই গলা মিলিয়ে যাচ্ছিলেন। যতক্ষণ রাজনৈতিক প্রশ্নাবলী, যেমন ৩৫৬ ধারার প্রয়োগ প্রসঙ্গ, আসছে না, স্রেফ রাজস্ব বৃদ্ধি-সংক্রান্ত আলোচনা, এমনকি কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলিও আমাদের সঙ্গে তাল মেলাতে তেমন অনাগ্রাহী নয় সে সময়। কয়েক মাস বাদে জম্মু ও কাশ্মীরে নির্বাচন, ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে লড়াই করে ফারুখ আবদুল্লা ও ন্যাশনাল কনফারেন্সের শ্রীনগরে ক্ষমতা দখল, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের ব্যাপারে তাঁরাও আমাদের সামিল। প্রায় ধর্মযুদ্ধ। সময় করে বিভিন্ন রাজ্য ঘুরে মুখ্যমন্ত্রীদের সঙ্গে মাঝে-মধ্যে বিতর্কযুদ্ধের কলাকৌশল আলোচনা করতে যেতাম, কয়েকজনের সঙ্গে ব্যক্তিগত সৌহার্দ্যও স্থাপিত হয়েছিল। রামকৃষ্ণ হেগড়ে মজলিশি আড্ডাবাজ মানুষ, ব্যাঙ্গালোরে গেলেই বাড়িতে ধরে নিয়ে যেতেন, তাঁর তৎকালীন অর্থমন্ত্রী বোম্মাইয়াও উপস্থিত থাকতেন। তাঁদের বিদেশী হুইস্কিতে অভিরুচি, আমার নেই, তা সত্ত্বেও আড্ডা জমাতে অসুবিধা হতো না, রাজনৈতিক আদর্শ ও জীবনদর্শনের দুস্তর ফারাক সত্ত্বেও হতো না। (বোম্মাইয়া কথাচ্ছলে একদিন বলেছিলেন, তিনি প্রথম জীবনে মানবেন্দ্রনাথ রায়ের মন্ত্রশিষ্য ছিলেন। এমন কথা আমাকে বলেছিলেন উত্তর প্রদেশের একদা পরিকল্পনা মন্ত্রী ব্ৰহ্মদত্তও, আর বলেছিলেন, কী সর্বনাশ, ভারতীয় জনতা পার্টির তাত্ত্বিক নেতা জগদীশপ্রসাদ মাথুর, টাইমস অফ ইন্ডিয়ার ঘোর প্রতিক্রিয়াশীল সম্পাদক প্রয়াত গিরিলাল জৈনও: কোথাকার জল যে কোথায় গিয়ে দাঁড়ায়।) হেগড়ের বাড়িতে যাতায়াতের সূত্রে তাঁর স্ত্রী ও কন্যাদের সঙ্গেও সামান্য পরিচয়। হেগড়েপত্নী সারস্বত ব্রাহ্মণকুলবতী, মেয়েরা আদি অর্থে খাঁটি সমোপলিটান, কারও স্বামী মালয়ালি, কারও সিন্ধি, কারও বা গুজরাটি। হেগড়েগৃহে শুধু পানসমারোহ নয়, খাদ্যসম্ভারের উৎকর্ষেরও অকুণ্ঠ প্রশংসা করতে হয়। তবে, আলাপ যদিও জমতে, ঈষৎ আড়ষ্টতাবোধেও ভুগতাম; ওই সমস্ত রাজ্যের মন্ত্রী তথা মুখ্যমন্ত্রীদের বৈভব অবলোকনে গরিব পশ্চিম বাংলা থেকে আগত আমার চোখ ছানাবড়া, আমার বামপন্থী বিবেক কুঁকড়ে আসতো। অপরিমিত ঐশ্বর্য, অপরিমিত আপ্যায়ন, উদার আচ্ছা, যার শরীরে মিশে থাকতে প্রচুর পরকীয়-পরকীয়া চর্চা, কিছু রঙ্গকৌতুকও। একটি নমুনা উপস্থাপন করছি। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের কোনও খটোমটো বিষয় নিয়ে আলোচনা চলছে হেগড়ের বাড়িতে, আমাদের জোট বাঁধতে হবে, একাধিক মুখ্যমন্ত্রীকে সঙ্গে পেতে হবে। অন্ধ্র প্রদেশে প্রায়-আধাপাগল রামরাও সমাসীন, জনগণের কাছে তিনি দেবতাসদৃশ, তবে তাঁর খামখেয়ালেরও শেষ নেই। গুজব রটলো তিনি নিজেকে অর্ধনারীশ্বররূপে গণ্য করেন, তাই রাত্রিবেলা শাড়িপরিহিত হয়ে ঘুমোত যান। সন্ধ্যা থেকে আমাদের আলোচনা চলছে, রামরাওয়ের সঙ্গে পরামর্শ প্রয়োজন, হেগড়ে আপ্ত সহায়ককে বললেন তাঁকে ফোনে ধরতে, তিরিশ সেকেন্ড বাদে ফোন বাজলো, হেগড়ে ধরলেন, কন্নড়ে কী কথা হলো আপ্ত সহায়কের সঙ্গে, আমার দিকে ফিরে হেগড়ে হতাশ হয়ে হাত ঘুরিয়ে বললেন: ‘হলো না, হি ইজ অলরেডি ইন হিজ শাড়ি’। অর্থাৎ রামরাও ইতিমধ্যেই শুতে চলে গেছেন, কথা বলা স্থগিত রইলো।
অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীর তাড়াতাড়ি শুতে না গিয়ে উপায় ছিল না, তিনি প্রত্যূষে তিনটে-সাড়ে তিনটের মধ্যে ঘুম থেকে উঠতেন, প্রাতঃকৃত্য ও প্রাতঃপ্রাণায়ামের পর পৌনে চারটে-চারটে থেকে বহিরাগতদের সাক্ষাৎকারে ডাকতেন। গরজ বড়ো বালাই, আমাকে একবার, বাইরে নিরেট অন্ধকার, ভোর চারটেয় ওঁর সঙ্গে দেখা করতে যেতে হয়েছিল, কেন্দ্র-রাজ্য যুদ্ধে অন্ধ্র প্রদেশকে পাশে পাওয়া আমাদের যে একান্ত প্রয়োজন।
চেন্নাইতে এম জি রামচন্দ্রন একদিন তাঁর গৃহে নৈশাহারে নিমন্ত্রণ করেছিলেন। ভক্ত অনুরাগীদের দঙ্গল বাইরে অপেক্ষমাণ, আমরা দু’জন মুখোমুখি বসে রসম্ থেকে শুরু করে বিবিধ দক্ষিণী খাদ্যউপচারের সদ্ব্যবহার করছি। মজার ব্যাপার, যে দুই অভিনেতা- অভিনেত্রী তামিলনাড়ুর রাজনীতিতে আমূল পরিবর্তন ঘটিয়ে দিয়েছেন, রামচন্দ্রন ও জয়ললিতা, কেউই খাঁটি তামিল নন, রামচন্দ্রন আসলে মালয়ালি মেনন, শ্রীলঙ্কায় শৈশব কাটিয়েছেন, শ্রীলঙ্কা ফেরত তামিলনাড়ু পৌঁছে আন্নাদারাইয়ের শিষ্যত্ব গ্রহণ। অন্য পক্ষে তাঁর বান্ধবী ও শিষ্যা জয়রাম জয়লতিতা আয়েঙ্গার ব্রাহ্মণী, তাঁরও জন্ম অন্যত্র, কর্ণাটকে। জয়ললিতা কনভেন্টে-পড়া মহিলা, চোস্ত ইংরেজি বলেন। কিন্তু রামচন্দ্রন বলতেন যাকে বলে চড়ুই ইংরেজি। ওঁর চেহারা যে কত সুন্দর তা টুপি ও চশমা খুলে ফেললে বোঝা যেত। হয়তো সামান্য টাক পড়ে এসেছিল বলে মাথা ঢেকে রাখতেন, তবে চোখ ঢেকে রাখবার রহস্য কোনওদিন নির্ণয় করতে পারিনি। যে সন্ধ্যায় আমাকে খেতে বলেছিলেন, অনেক সময় নিয়ে প্রচুর গল্প করলেন। সামান্য আবেগবিহ্বল হয়ে বললেন: ‘দ্যাখো, তোমাদের রাজ্য সম্পর্কে আমার ভীষণ দুর্বলতা, আমি সতেরো বছর বয়সে ভাগ্যান্বেষণে কলকাতায় ইস্ট ইন্ডিয়া মুভিটোনে যোগ দিয়েছিলাম। বছরে একটা-দুটো তামিল ছবি হতো তখন ওখানে; আমি এখনও তার স্মৃতিতে উদ্বেল’। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের প্রসঙ্গ উঠলে, উত্তেজিত হয়ে ভাঙা-ভাঙা ইংরেজিতে হতাশোক্তি: ‘নো ইউজ, নো ইউজ, শী ডিক্টেটর, ডাজেন্ট লিসন, নেশন ইন গ্রেট ডেঞ্জার’! ইন্দিরা গান্ধি সম্পর্কে এই কথাগুলি অবশ্য তিনি কিছুতেই বাইরে বলতেন না, অন্য বাধ্যবাধকতা। কিন্তু কোনও আর্থিক সমস্যা নিয়ে কেন্দ্রের সঙ্গে বিসংবাদ ঘটলে আমাদের সঙ্গে গলা যোগ করতে আপত্তি ছিল না রামচন্দ্রনের।
আকালি দলের সুরজিৎ সিং বারনালার সঙ্গে সাতাত্তর সাল থেকে আলাপ, তখন তিনি কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী, অত্যন্ত অমায়িক মানুষ। একবার কী প্রসঙ্গে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী এইচ এম প্যাটেলের ঘরে বৈঠক ছিল, আমি সুরজিৎ সিং-এর পাশে বসা, তাঁকে বললাম, কৃষিমন্ত্রকের সঙ্গে আমার একটি বিষয় নিয়ে আলোচনা প্রয়োজন। তিনি আহ্বান জানালেন অর্থমন্ত্রীর ঘরের বৈঠক শেষ হলে তাঁর সঙ্গে সোজা কৃষি ভবনে যেতে, তখনই কথা বলে নেওয়া যাবে। দিল্লিতে যে কোনও যুগে, যে কোনও পর্বে, যে কোনও অধ্যায়ে যা অভাবনীয়, কেন্দ্রীয় ক্যাবিনেট মন্ত্রী তাঁর পাশে বসিয়ে ছোটো ফিয়াট গাড়ি নিজে চালিয়ে আমাকে তাঁর দফতরে নিয়ে গেলেন। রাজনীততে অনেক উথালপাথাল, ১৯৯৮ সাল থেকে তিনি ভারতীয় জনতা দলের জোড়াতালি-দেওয়া মন্ত্রিসভায় ক্যাবিনেট মন্ত্রী, একদিন রাজ্য সভার লাউঞ্জে আমাকে ডেকে নিয়ে নিচু স্বরে বললেন: ‘তোমাদের দল পঞ্জাবে লোকসভা নির্বাচনে একমাত্র আমারই বিরুদ্ধে প্রার্থী দিয়েছিল, যদিও আমি জিতেছি; আমার কী অপরাধ আজ পর্যন্ত জানতে পারিনি’। বোধহয় আমতা-আমতা করে বলেছিলাম, ‘ওসব উচ্চমার্গের ব্যাপার আমার জানা নেই’।
আলাপ হলো ফারুখ আবদুল্লার সঙ্গেও। বাবার ক্ষুরধার বুদ্ধি নেই, আকর্ষণক্ষমতাও বাবার তুলনায় অনেক কম, কিন্তু ইন্দিরা গান্ধি অহোরাত্র তাঁর অনিষ্ট কামনা করছেন, আত্মরক্ষার খাতিরেই কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের লক্ষ্যে আমাদের আলোড়ন-তোলা আন্দোলনে ফারুখ যুক্ত হয়ে গেলেন, তিরাশি সালের অগস্ট মাসে শ্রীনগরে রাজ্যদের দাবি জোরদার করতে বড়ো সম্মেলন আহ্বান করলেন। কে ছিলেন না সেই সম্মেলনে: নাম্বুদ্রিপদ, রাজেশ্বর রাও থেকে শুরু করে জগজীবন রাম-বিজু পট্টনায়ক পর্যন্ত! একমাত্র ব্যতিক্রম চরণ সিংহ, তাঁকে অনুরোধ-উপরোধ করে নিয়ে আসার জন্য বিজু পট্টনায়ককে দূত হিশেবে শ্রীনগর থেকে দিল্লিতে পাঠানো হলো, ব্যর্থমনোরথ হয়ে ফিরলেন। তবে তেমন ক্ষতিবৃদ্ধি হলো না তাতে। তিনদিন ধরে জমাট বৈঠক, আমার সঞ্চালনায় বিভিন্ন প্রস্তাবের খসড়া তৈরির জন্য একটি উপ-সমিতি গঠন করা হলো, তাতে রাজেশ্বর রাও যেমন ছিলেন, ছিলেন ইন্দ্রকুমার গুজরালও। সারা দেশ থেকে ঝেঁটিয়ে সাংবাদিকরা এলেন, শেষ দিনে হোতা হিশেবে ফারুখ আবদুল্লার সাংবাদিক সম্মেলন, প্রারম্ভিক একটা-দুটো কথা বলে আমার উপরই সম্মেলনের সিদ্ধান্তগুলি ব্যাখ্যা করবার দায়িত্ব অর্পণ করলেন।
আন্দোলনে জোর ধরলো, জাতীয় রাজনীতির প্রধান সমস্যা রূপে কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পুনর্বিন্যাস আলোচনার পুরোভাগে চলে এলো, কংগ্রেস দল প্রায় একঘরে। উৎসাহের স্রোতধারা বজায় রাখবার উদ্দেশ্যে কলকাতায় জ্যোতিবাবুর আমন্ত্রণে ওই বছরেরই ডিসেম্বর মাসে আর একটি বৈঠকের আয়োজন। এবার সম্মেলন আরও জমজমাট, যতদূর মনে পড়ে, চরণ সিংহও যোগ দিয়েছিলেন, জনতা দলের সব শরিকরাও। বামপন্থীদের বাইরে হেগড়ে-রামরাওরা তো ছিলেনই, ছিলেন অকালি দলের প্রতিনিধিরা, ডি এম কে-র প্রতিনিধি হিশেবে খোদ করুণানিধি ও তাঁর ভাগ্নে মুরোসোলি মারান। বৈঠকশেষে ব্রিগেড প্যারেড মাঠে বিশাল জনসভা, ভিড়ের আয়তন দেখে অন্য রাজ্যের নেতাদের বিস্ময়ে নির্বাক হয়ে আসা।
চুরাশি সাল, নানা রাজ্য থেকে আমন্ত্রণ আসছে বক্তৃতা দেওয়া ও শলাপরামর্শের জন্য। আর একবার ‘পুতুল নাচের ইতিকথা’-য় ফিরতে হয়: কুমুদ যে যাত্রা দলের সঙ্গে যুক্ত, তারা মতিদের গ্রামে ‘জনা’ অভিনয় করছে, রাত গড়াচ্ছে, মঞ্চে অভিনেতা-অভিনেত্রীদের আগমন-নির্গমন, অমিত্রাক্ষর ছন্দের অসম পঙ্ক্তিতে কথোপকথন আবেগশীর্ষে পৌঁছুচ্ছে, মতি উত্তেজনায় কাঁপছে, মতির মুখ দিয়ে মানিকবাবুর সুমিত মন্তব্য: জমিবে, পালা জমিবে। আমরাও তখন বলতে পারতাম, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্কের পালা খাসা জমে গেছে, আরও জমবে।
তাঁর নয়া জমানায় ইন্দিরা গান্ধিকে সুপরামর্শ দেওয়ার মতো তেমন কেউই আর পাশে ছিলেন না, যাঁরা ছিলেন তাঁরা প্রধানত চাটুকার শ্রেণীভুক্ত, বিদূষক, কুম্ভীলক বৃত্তি ছাড়া তাঁদের অন্য-কোনও ভূমিকা ছিল না। বছরের মাঝামাঝি ইন্দিরা গান্ধি পর-পর তিনটি ভুল করলেন, সম্ভবত পুত্র রাজীব ও পারিষদ অরুণ গান্ধির কথা শুনে। কাহিনীটি একটু বিস্তারিত করে বললে হয়তো অন্যায় হবে না। প্রতি পাঁচ বছর অন্তর সংবিধানের ২৮০ ধারা অনুযায়ী রাষ্ট্রপতিকে একটি অর্থ কমিশন নিয়োগ করতে হয়। কমিশনে সাধারণত জনৈক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব নেতৃত্ব দিয়ে থাকেন, তাঁকে সাহায্য করবার জন্য থাকেন একজন করে আইনজ্ঞ, অর্থনীতিবিদ এবং প্রবীণ প্রশাসক। কমিশনের অন্যতম প্রধান কৃত্য আয়কর ও কেন্দ্রীয় অন্তঃশুল্ক থেকে আহৃত রাজস্ব কেন্দ্র ও রাজ্যগুলির মধ্যে বন্টনের নীতিনির্ধারণ, সেই সঙ্গে রাজ্যগুলির জন্য বরাদ্দ অর্থ কী করে বিভিন্ন রাজ্যের মধ্যে ভাগ করা হবে, তা নির্দেশ। ১৯৮৪-৮৫ থেকে পরবর্তী পাঁচ বছরের সুপারিশ পেশের জন্য যে-কমিশন গঠিত হয়েছিল, তার সভাপতি ছিলেন আর একজন একদা-মানবেন্দ্রনাথ রায়-ভক্ত, যশবন্ত চবন, মহারাষ্ট্রের প্রাক্তন মুখ্যমন্ত্রী, কেন্দ্রের প্রাক্তন অর্থ ও প্রতিরক্ষা মন্ত্রী, আমার সঙ্গে বহুদিনের পরিচয়। কমিশনের অন্য সদস্যদের নিয়ে তিনি কলকাতায় বৈঠক করতে এলেন, খোলাখুলি পশ্চিম বঙ্গের বেহাল অর্থব্যবস্থার বর্ণনা দিলাম তাঁর কাছে, কেন্দ্রীয় নীতির পরিবর্তন না-ঘটলে সর্বনাশ যে অত্যাসন্ন, জোর গলায় তা জানালাম। এটাও যোগ করলাম যে যতবার দিল্লি যাই, প্রতিবারই আমার মনে হয় যেন এক ধনী বিদেশের ঝলমলে রাজধানীতে পৌঁছেছি এক গরিব হতজীর্ণ দেশ থেকে। এই জায়গায় চবন আমাকে থামিয়ে কপালে সামান্য কুঞ্চন নিয়ে জিজ্ঞাসা করলেন, ‘অশোক, কবে থেকে তোমার এই অনুভূতি হচ্ছে?’ মুহূর্তমাত্র না-থেমে আমার জবাব ‘গত দশ-পনেরো বছর থেকে’।
চিরাচরিত নিয়ম, অর্থ কমিশনের সুপারিশ কেন্দ্রীয় সরকার হুবহু মেনে নেয়, তাদের অসুবিধা থাকলেও মেনে নেয়। প্রতি মাসে একবার-দু’বার বিভিন্ন ব্যাপারে দরবার করতে দিল্লি যেতে হতো, কেন্দ্রের বাঙালি অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে বৈঠক করতে হতো। কাগজে বেরিয়ে গেছে রাষ্ট্রপতির কাছে চবন অর্থ কমিশনের প্রতিবেদন দাখিল করেছেন, অথচ কোনও দুর্জ্ঞেয় কারণে কেন্দ্রীয় সরকার তা প্রকাশ করতে বিলম্ব ঘটাচ্ছেন, কেন বিলম্ব হচ্ছে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রীকে প্রশ্ন করে কোনও স্পষ্ট উত্তর পাচ্ছি না।
কমিশনের সুপারিশ কুজ্ঝটিকার আড়ালে, এমন মুহূর্তে ইন্দিরা গান্ধি একটি বড়ো কেলেঙ্কারি করলেন। ফারুখ আবদুল্লা কাশ্মীরের নির্বাচনে তাঁর দলকে হারিয়ে দিয়েছেন, ফারুখকে তিনি সহ্য করতে পারছেন না, ষড়যন্ত্র ফাঁদছেন। কাশ্মীরে তখন রাজ্যপাল ইন্দিরারই ঘনিষ্ঠ আত্মীয় ব্রিজকুমার নেহরু, কিন্তু নেহরুকে দিয়ে কার্যসিদ্ধি হবে না বুঝতে পেরে তাঁকে সরিয়ে দেওয়া হলো গুজরাটে, শ্রীনগরে রাজ্যপাল হয়ে এলেন সঞ্জয়সখা, জরুরি অবস্থার কালে তুর্কমান গেট-এর কলঙ্কনায়ক, সেই কুখ্যাত আমলাটি। নব-নিযুক্ত রাজ্যপালের মধ্যবর্তিতায় বহু কোটি টাকা খরচ করে কিছু বিধায়ক কেনা হলো, হবু মুখ্যমন্ত্রী হিশেবে বাছাই করা হলো ফারুখের ভগিনীপতি, চরম দুর্নীতিগ্রস্ত, গুলাম মহম্মদ শাহ-কে। প্রস্তুতি সম্পূর্ণ। এক অপরাহ্নে রাজ্যপাল ফারুখকে রাজভবনে ডেকে পাঠালেন, একটি সংক্ষিপ্ত বাক্য উচ্চারণ: ‘আপনাকে এই মুহূর্তে পদচ্যুত করা হলো।’ বিধানসভা ডেকে ভোট যাচাই করার প্রশ্ন নেই, পাশের ঘরে অপেক্ষমাণ গুল শাহ, তাঁকে দিয়ে সঙ্গে-সঙ্গে শপথবাক্য পাঠ করানো। ইন্দিরা যা চেয়েছিলেন, তা এবার ষোলোকলা পূর্ণ, কাশ্মীরে। একজন ক্রীড়নক মুখ্যমন্ত্রী। এ ধরনের স্বৈরাচারের বিরুদ্ধেই তো সর্বক্ষণ লড়াই করছিলাম আমরা। বিভিন্ন রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রীদের ও বিরোধী দলের নেতাদের সঙ্গে কলকাতা থেকেই যোগাযোগ স্থাপন করলাম, আলাপ-আলোচনার সুবিধার জন্য জ্যোতিবাবুর নির্দেশে দিল্লি চলে গেলাম। কর্ণাটক ভবনে রামকৃষ্ণ হেগড়ের পৌরোহিত্যে পরামর্শ সভা, তাড়াহুড়ো করে ডাকা সভা, উপস্থিত ছিলেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বাসবপুন্নাইয়া, সি পি আই-এর রাজেশ্বর রাও, আদি কংগ্রেস দলের তারকেশ্বরী সিংহ ও অম্বিকা সোনি (তখন ঘোর ইন্দিরা-বিরোধী), চন্দ্রজিৎ যাদব (ইনিও তখন কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এসে বামপন্থীদের সঙ্গে ঘোরাফেরা করছিলেন, তারপর অবশ্য আরও অনেক ঘাটের জল খেয়েছেন), আরও কারা-কারা ছিলেন এখন ঠিক মনে পড়ছে না। কাশ্মীরে গণতন্ত্র নিধন নিয়ে কড়া প্রতিবাদ প্রস্তাব গৃহীত হলো, সিদ্ধান্ত হলো পরদিনই শ্রীনগরে গিয়ে ফারুখকে, এবং কাশ্মীরের জনগণকে, আমাদের সহমর্মিতা জ্ঞাপন করা হবে, কাশ্মীরের সংগ্রাম যে ভারতবর্ষের প্রতিটি বিরোধী দলের সংগ্রাম, প্রতিটি রাজ্যের সংগ্রাম, সে বিষয়ে কাশ্মীরের জনগণকে নিঃসংশয় করা জরুরি কর্তব্য।
কোনও-কোনও ব্যাপারে আমি হয় বেশি আশাবাদী, নয়তো প্রগাঢ় কাণ্ডজ্ঞানহীন। কলকাতায় ফেরার তাড়া ছিল, ভেবেছিলাম সকালের বিমানে অন্য সকলের সঙ্গে শ্রীনগর পৌঁছে যা-যা করণীয় সেরে সন্ধ্যার বিমানে দিল্লি প্রত্যাবর্তন করবো, তাই গেলাম সম্পূর্ণ এক বস্ত্রে। দিল্লি থেকে বিমান ছাড়তেই অনেক দেরি, খানিক বাদে বুঝতে পারলাম, সেদিন আর প্রত্যাবর্তন সম্ভব হবে না, তখন আর বাড়তি জামাকাপড় নিয়ে আসার উপায়ও নেই, অথচ রাত্রিবাস করতেই হবে শ্রীনগরে। যে-বিমানে আমার ফেরার কথা, আমার চোখের সামনেই শ্রীনগর থেকে উড়ে গেল, বেশি রাত্তিরে শুনতে পেলাম তা দিল্লি পৌঁছয়নি, দুই খালিস্তানি বিমানটি কব্জা করে লাহোরে নিয়ে গেছে। ঘোর নিশীথকালেই আমার সহযোগী রাজনৈতিক নেতারা অভিনন্দন জানাতে এলেন, কাশ্মীর সমস্যা থেকে আর একটু হলেই সমান গুরুতর অন্য সমস্যার অংশীদার হতাম: এক ভারতীয় রাজ্যমন্ত্রী পাকিস্তানে পণবন্দী। দিল্লি থেকে যে ছ’-সাতজন এসেছিলাম, ফারুখের সঙ্গে দেখা করলাম, রাজ্যপালের কুচক্রান্তের বিস্তৃত বিবরণ শুনলাম। ফারুখের বয়ান অনুযায়ী এক সপ্তাহ ধরেই নাকি শ্রীনগর বিমানবন্দরে ঝাঁকে-ঝাঁকে ভারতীয় সৈন্য অবতরণ করছিল, অথচ রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী কিছু জানেন না। ফারুখের আরও বিলাপ, শুধু তাঁর ভগিনীপতিকেই নয়, তাঁর কনিষ্ঠ ভ্রাতাকেও ইন্দিরা গান্ধি বশ করে ফেলেছেন, শ্রীনগরের ক্ষুব্ধ জনতা রাগে টগবগ করছে, তারা ফারুখের সঙ্গে, ন্যাশনাল কনফারেন্সের সঙ্গে। কিছুক্ষণ বাদে রাজ্যপালের সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। তিনি যে অসাংবিধানিক কাজ করেছেন, তীব্র কণ্ঠে তার প্রতিবাদ জানালাম, তাঁর অবিমৃষ্যকারিতার জন্য গোটা দেশকে এখন দীর্ঘ কাল ধরে খেসারত দিতে হবে, আমাদের বক্তব্যে তা-ও উহ্য রইলো না। মুখ্যমন্ত্রীকে না জানিয়ে সৈন্য আমদানির প্রসঙ্গ উত্থাপন করা হলো, রাজ্যপাল ভাঙেন তো মচকান না, তাঁর সংক্ষিপ্ত বচন: ‘এমন কতগুলি বিষয় আছে যা আমি মুখ্যমন্ত্রীকে জানাতে বাধ্য নই, মহাশয়-মহাশয়াগণ, ক্ষমা করবেন, আপনাদেরও জানাতে বাধ্য নই’। যখন চলে এলাম, প্রধান মন্ত্রীর তল্পিবাহক বলে তাঁকে গাল পাড়া থেকে বিন্দুমাত্র বিরত হইনি আমরা। তাঁকে এ-ও জানিয়ে আসতে কসুর করিনি, এই কাহিনীর এখানেই ইতি নয়, ইতি হতে পারে না। ফিরে গিয়ে রাজ্যপালের সঙ্গে আমাদের নৈরাশ্যব্যঞ্জক কথাবার্তার বিবরণ ফারুখকে দিলাম, তাঁকে বোঝালাম এক মাঘে শীত যায় না, ইন্দিরা গান্ধি এই ন্যক্কারজনক অপকর্ম করে পার পাবেন না, আমরা গোটা ভারতবর্ষ জুড়ে অপ্রতিরোধ্য আন্দোলন গড়ে তুলবো কাশ্মীরে গণতন্ত্র পুনঃস্থাপনের লক্ষ্যে; তবে এটা সমান প্রয়োজন যে, কাশ্মীরে যেন শান্তি বজায় থাকে; উপত্যকার মানুষজনের সম্যকরূপে। ক্ষিপ্ত হওয়ার অধিকার আছে, কিন্তু ফারুখকে দেখতে হবে সাধারণ মানুষের প্রতিবাদ যেন সংযত থাকে, মাত্রা ছাড়িয়ে না যায়। ফারুখজননী বেগম আবদুল্লার সঙ্গেও সৌজন্যসাক্ষাৎ করতে গেলাম। তিনি বিষাদপ্রতিমায় রূপান্তরিতা; উর্দুতে আমাদের বললেন, জওহরলাল নেহরুর মেয়ে ইন্দিরাকে তিনি দীর্ঘদিন চেনেন, স্নেহও করতেন তাঁকে, কিন্তু কোনওদিন আর তাঁকে ক্ষমা করবেন না, কারণ ভারতবর্ষের প্রধান মন্ত্রী তাঁর, বেগম আবদুল্লার, পরিবারের মধ্যে চিড় ধরিয়েছেন, এক ভাইকে আর এক ভাই থেকে আলাদা করে দিয়েছেন, বোনকে সরিয়ে দিয়েছেন ভাইয়ের সান্নিধ্য থেকে।
শ্রীনগর উষ্মায় উত্তপ্ত-উন্মত্ত, যা এতদিন অভাবিত ছিল, কোনও-কোনও মহল্লায় পাকিস্তান-ঘেঁষা ধ্বনি উচ্চারিত হচ্ছে পর্যন্ত। ফারুখের অনুরোধ, আমরা শহরে গিয়ে যেন জনগণকে বোঝাই যে ভারতবর্ষের সমস্ত বিরোধী দল, যাদের আমরা প্রতিনিধিত্ব করছি, একবাক্যে ইন্দিরাকৃত অনাচারের নিন্দায় মুখর, যতদিন ন্যাশনাল কনফারেন্সের সরকার স্ব-অধিকারে পুনঃপ্রতিষ্ঠিত না-হচ্ছে, ততদিন আমরা ক্ষান্ত হবো না। ফারুখের প্রস্তাবে তৎক্ষণাৎ সাড়া দিয়ে দু’তিনটি গাড়ি করে শহরের ঘনবসতি অঞ্চলে উপস্থিত হলাম, আমাদের দেখে সাধারণ মানুষ উদ্বেলিত, কিছুটা আশ্বস্তও। একজন-দু’জন যুবক পাকিস্তানের সমর্থনে চিৎকার শুরু করলে ফারুখ কাছে গিয়ে নম্রস্বরে তাদের সঙ্গে কথা বললেন, তাদের বোঝালেন, তারা শান্ত হলো। শহর পরিভ্রমণান্তে ন্যাশনাল কনফারেন্সের সদর দফতরে পৌঁছে দোতলার উন্মুক্ত ব্যালকনি থেকে জড়ো-হওয়া মানুষদের কাছে ভাষণ দেওয়ার পালা। ভাষণ দিতে হবে সবাইকে উর্দুতে, আমাকে পর্যন্ত। চোখকান বুজে কয়েকটি ‘তানাশাহী তোরনা পড়েগা’ গোছের বাঁধা গতের বুলি আউড়ে চার-পাঁচ মিনিট বাদে যখন ক্ষান্ত দিলাম, মুহুর্মুহু হাততালি, তারকেশ্বরী সিংহর উক্তি, ‘তুমি যে এত ভালো হিন্দি-উর্দু জানো, তা তো জানতাম না’। পরদিন এক ‘জাতীয় সংবাদপত্রে জনৈক মহিলা সাংবাদিকের মন্তব্য: সবচেয়ে ভালো বক্তৃতা উর্দুতে দিয়েছিলেন অশোক মিত্র। জনপরিবাদ কী করে জন্ম নেয়, অলীক ভিত্তি সত্ত্বেও, তার প্রত্যক্ষ প্রমাণ পেলাম।
যে ধুতি-পাঞ্জাবি পরে গিয়েছিলাম, তাতেই রাত্রিবাস। প্রত্যেকের জন্য ফারুখ ডাল হ্রদে একটি করে বজরার ব্যবস্থা করেছিলেন। আমার পাশের বজরায় চন্দ্রজিৎ যাদব, তাঁর কাছ থেকে দাড়ি কামাবাব সরঞ্জাম ও একটি চিরুনি ধার করে কোনওক্রমে রাজ্যমন্ত্রীর বহির্মর্যাদা রক্ষা করা গেল। সকালের বিমানে আমাদের কয়েকজনের দিল্লি প্রত্যাবর্তন। কেন্দ্রীয় বঙ্গভাষী অর্থমন্ত্রীর সঙ্গে আমার দেখা করবার কথা ছিল সেদিন, অন্য কথাবার্তা সমাপ্ত হওয়ার পর তাঁকে ফের জিজ্ঞাসা করলাম, ‘মশাই, ক’দিন আগে আপনিই তো বলেছিলেন, চবনের সুপারিশ অনুযায়ী আমরা পশ্চিম বাংলায় অনেক টাকা পাবো। ব্যাপারটি আর কতদিন ঝুলিয়ে রাখবেন?’ কেন্দ্রীয় মন্ত্রীটি হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘কাশ্মীর নিয়ে আপনারা খুব বেশি চেঁচামিচি করবেন নাকি?’ আমার বিস্মিত জবাব, ‘তার সঙ্গে অর্থ কমিশনের রিপোর্টের কী সম্পর্ক?’ মন্ত্রী মৃদু হাসলেন।
সম্পর্ক বোঝা গেল পরের সপ্তাহে। জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠক, ছ’জন কংগ্রেস-বিরোধী মুখ্যমন্ত্রী মিলে সিদ্ধান্ত গ্রহণ করলেন তাঁরা কাশ্মীরে সংসাধিত অনাচারের প্রতিবাদে উন্নয়ন পরিষদের বৈঠক বর্জন করবেন, তাঁদের তরফ থেকে অস্ত্রের মুখ্যমন্ত্রী একটি বিবৃতি পাঠ করবার পর। বিবৃতির খসড়া তৈরি হলো, রামরাও তা পাঠ করতে উঠলেন, ততক্ষণে ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর পারিষদরা বুঝে গেছেন কী ঘটতে যাচ্ছে, তাঁরা এন টি আর-কে বিবৃতি পড়তে না দিতে বদ্ধপরিকর, বিদূষকদের মধ্যে কয়েকজন, যেমন বুটা সিংহ, রাজেশ পাইলট, ওড়িশার মুখ্যমন্ত্রী জানকীবল্লভ পট্টনায়ক, সরবে এন টি আর-এর পাঠ ভণ্ডুল করার চেষ্টায় রত। তাঁদের দেখাদেখি আমারও চেঁচিয়ে প্রতি-প্রতিবাদে গলা সংযোগ, এমন সময় ইন্দিরা গান্ধি একটি বিচিত্র কাণ্ড করলেন, হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে, কণ্ঠস্বর সরু ও তীক্ষ্ণ, বললেন, ‘রাজ্যের মন্ত্রী যাঁরা উপস্থিত আছেন, জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের কতগুলি নিয়ম তাঁদের জানা উচিত। কোনও রাজ্যের মুখ্যমন্ত্রী উপস্থিত থাকলে, এমনধারা বৈঠকে একমাত্র তিনিই কথা বলতে পারেন, তাঁর সহচর-হয়ে-আসা কোনও মন্ত্রী পারেন না’। অর্থাৎ ইন্দিরা। গান্ধি আমার উপর তাঁর গায়ের ঝাল ঝাড়লেন। হট্টগোল, হট্টগোল, রামকৃষ্ণ হেগড়ে উঠে দাঁড়িয়ে ইন্দিরার মন্তব্যের কড়া প্রতিবাদ জানালেন, রামরাও তাঁর পড়া শেষ করলেন, আমরা শোভাযাত্রা করে সভা ছেড়ে বেরিয়ে এলাম, সঙ্গে-সঙ্গে সাংবাদিক সম্মেলন। হেগড়ে রাগে ফুঁসছেন, আমাকে অপমান করবার অধিকার ইন্দিরার নেই, আমি হেসে হেগড়ের হাত ধরে বললাম, অল ইন দ্য গেম।
খেলা যে আরও কতদূর গড়াবে, টের পেলাম দিন কয়েক বাদে যখন অর্থ কমিশনের সুপারিশাদি এবং তৎসম্পর্কে কেন্দ্রীয় সরকারের সিদ্ধান্ত ঘোষিত হলো। আমার আর্ত কথাগুলি স্পষ্টতই যশবন্ত চবনকে নাড়া দিয়েছিল, তিনি কমিশনের প্রতিবেদনে ১৯৮৪-৮৫ এবং ১৯৮৫-৮৬ এই দুই বছর একটি বিশেষ সুত্র-অনুযায়ী পশ্চিম বাংলার জন্য প্রচুর বাড়তি বরাদ্দের সুপারিশ করেছিলেন। আরও কয়েকটি রাজ্যের জন্যও করেছিলেন, কিন্তু পশ্চিম বঙ্গই ওই সূত্রে সবচেয়ে বেশি উপকৃত। কিন্তু না, কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রকের বিজ্ঞপ্তিতে বজ্রনির্ঘোষ: দেশে মুদ্রাস্ফীতি চিন্তাজনক হারে বাড়ছে, জাতীয় কোষাগারে অর্থের অনটন, অর্থ কমিশনের এই বিশেষ সুপারিশ অতএব মান্য করা যাবে না। স্বাধীননাত্তর ভারতবর্ষে এই প্রথম, এবং আজ পর্যন্ত এই-ই শেষ, অর্থ কমিশনের সুপারিশ অগ্রাহ্য হলো। একটু চোখের চামড়া তখনও তো ছিল, শুধু পশ্চিম বাংলাকে বঞ্চিত করলে সাংবিধানিক প্রশ্ন দেখা দিতে পারে, সুতরাং কোনও রাজ্যের ক্ষেত্রেই ওই সূত্রটি প্রয়োগ করা হলো না। তবে কেন্দ্রীয় অর্থমন্ত্রী বেছে-বেছে কংগ্রেস-শাসিত রাজ্যগুলিতে গিয়ে অভয় দিলেন, তাঁদের চিন্তার কারণ নেই, অর্থ কমিশন থেকে প্রাপ্য যে-টাকা থেকে তাঁরা বঞ্চিত হলেন, তা তিনি তাঁদের বিনাসুদে দীর্ঘ মেয়াদি ঋণ দিয়ে পূরণ করে দেবেন, একমাত্র পশ্চিম বাংলা অথৈ জলে ডুবুক। ঘোর দুর্ভাগ্য, কমিশনের সুপারিশ-করা অর্থ থেকে আমাদের বঞ্চিত করার ব্যাপারে অধিকাংশ অন্য অকংগ্রেসি রাজ্যগুলি থেকে তেমন অনুকম্পায়ী স্বর শুনতে পেলাম না, তাঁদের লাভ-ক্ষতির তাৎক্ষণিক হিশেব আমাদের থেকে ভিন্ন। সাংবিধানিক প্রশ্ন তুলে সুপ্রিম কোর্টে যাওয়ার কথা ভাবা হলো, কিন্তু আবিষ্কার করলাম, সে-ভাবনাতেও পশ্চিম বাংলা একা। তা হলেও একটা কিছু তো করতেই হয়, মস্ত স্মারকলিপি তৈরি করে রাষ্ট্রপতির সঙ্গে দেখা করতে গেলাম। বোঝা যাচ্ছিল, রাষ্ট্রপতি জৈল সিংহ-এর সঙ্গে তখন থেকেই ইন্দিরা গান্ধির মতান্তর দেখা দিয়েছে, আমার হাত থেকে স্মারকলিপিটি গ্রহণ করে, পাতাগুলি সামান্য নেড়ে-চেড়ে রাষ্ট্রপতি বিরক্তিসূচক উক্তি করলেন, অবশ্যই হিন্দিতে: ‘এ সব ব্যক্তিরা খামোখা আপনাদের সঙ্গে ঝগড়ায় লিপ্ত হচ্ছে কেন?’ সেদিনই প্রথম খেয়াল হলো যে ‘খামোখা’ আদতে হিন্দি শব্দ।
যদিও তাঁর সুপারিশ থেকে কার্যকরী উপকার পশ্চিম বাংলার অপ্রাপ্যই রইলো, তবু কৃতজ্ঞতা জানাতে যশবন্ত চবনের সঙ্গেও দেখা করলাম। তিনি স্পষ্টতই মর্মাহত, খুব অসহায় বোধ করছেন; জানালেন যদিও কাজের কাজ কিছু হবে না, তবু ইন্দিরা গান্ধির সঙ্গে দেখা করে অর্থ মন্ত্রকের সিদ্ধান্তের প্রতিবাদে সোচ্চার হবেন। মাসখানেক বাদে রিজার্ভ ব্যাংকের তৎকালীন গভর্নরের সঙ্গে দেখা, তিনিও পরে কেন্দ্রে অর্থমন্ত্রী হয়েছিলেন। তাঁর কাছে শুনলাম, তিনি প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে দেখা করে বলেছিলেন, অর্থ কমিশনের প্রথম দুই বছরের সুপারিশ পুরোপুরি মেনে নিলে জাতীয় অর্থব্যবস্থা বা মুদ্রাস্ফীতির ক্ষেত্রে কোনও সমস্যা হতো না, রাজ্যগুলির উৎকীর্ণ অর্থাভাব, যে টাকা তারা পেল না তার ঘাটতি মেটাতে তারা বাড়তি ওভারড্রাফট নিতে বাধ্য হবে। ইন্দিরা গান্ধি নাকি উত্তর দিয়েছিলেন, তাঁর কিছু করার নেই, তাঁর অর্থমন্ত্রী তাঁকে বলেছেন এমন না করলে দেশের সর্বনাশ হবে।
ইন্দিরা গান্ধি জটিল চরিত্রের মানবী, সরকারি বৈঠকে আমাকে কর্কশ, প্রায়-অভদ্র গাল পাড়লেন। অথচ প্রায় কাছাকাছি সময়ে কলকাতায় নীলিমা দেবী প্রয়াত হলেন, স্মরণিকা হিশেবে আমি একটি প্রবন্ধ ছাপালাম, তাতে উল্লেখ ছিল শৈশবে এলহাবাদ শহরে বিজয়লক্ষ্মী পণ্ডিতের তিনি সহচরী ছিলেন, বিবাহিত স্বামীকে ছেড়ে প্রেমিক পুরুষের সঙ্গে চলে গিয়ে সামাজিক ঐতিহ্যের বিরুদ্ধে যে বিদ্রোহের সাহস নীলিমা দেবী দেখিয়েছিলেন, বিজয়লক্ষ্মী অনুরূপ সাহস দেখিয়ে তাঁর মুসলমান প্রেমিককে বরণ করতে অসমর্থ হয়েছিলেন; বেচারী প্রেমিকটিকে সারা জীবন নিউ ইয়র্কে নির্বাসনে থাকতে হয়। লেখাটি ইন্দিরা গান্ধির চোখে পড়েছিল, বড়ো পিসির সঙ্গে বরাবর ইন্দিরার মধুর সম্পর্ক, পিসি সম্পর্কে সামান্য বাঁকা মন্তব্য ছিল বলেই লেখাটি তার আরো পছন্দ। আমার পরিচিত এক মহিলার কাছে ইন্দিরা গান্ধির মন্তব্য, ‘প্রবন্ধটি লেখার আগে অশোক আমাকে জিজ্ঞেস করেনি কেন? তা হলে নীলিমা দেবী ও আমার পিসি সম্পর্কে আরো অনেক খবর ওকে দিতে পারতাম।’
মূল প্রসঙ্গে ফিরি। পশ্চিম বাংলার প্রতিবাদ যেমন ঢেউ তুললো না, কাশ্মীরে ফারুখকে অপসারণের প্রতিবাদতরঙ্গও, যা হওয়া আদৌ উচিত ছিল না, একটু-একটু করে মিলিয়ে যাচ্ছিল। কিন্তু যিনি নিজের পায়ে কুড়ুল মারতে বদ্ধপরিকর, তাঁকে ঠেকাবে কে? ফারুখকে উৎখাত করেছেন, পশ্চিম বাংলাকে ভাতে মারবার আয়োজন করেছেন, এবার এন টি আর-এর পালা। জাতীয় উন্নয়ন পরিষদের বৈঠকের মাসখানেক বাদে হায়দরাবাদে ফের নাটক। হরিয়ানা থেকে এক দুর্নীতিগ্রস্ত অপদার্থ ব্যক্তিকে অন্ধ্র প্রদেশে রাজ্যপাল করে পাঠানো হয়েছিল কয়েক সপ্তাহ আগে। রামরাও বিদেশে, জনৈক রাজ্যমন্ত্রীকে টোপ দেওয়া হলো, তিনি বেরিয়ে আসুন, যদি পারেন আরও কয়েকজনকে সঙ্গে নিয়ে, তাঁকে মুখ্যমন্ত্রী করে দেওয়া হবে। তাই-ই করা হলো, রামরাও বরখাস্ত হলেন, সেই মন্ত্রী, ভাস্কর রাও না কী যেন নাম, ভুলেই গেছি, তাঁকে দিয়ে মুখ্যমন্ত্রী হিশেবে শপথবাক্য পাঠ।
ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর পরামর্শদাতারা হয়তো ভাবলেন, দান দান তিন দান, এবার কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে ঠান্ডাই-মাণ্ডাই চিরতরে স্তব্ধ করে দেওয়া হলো। তাদের প্রকাণ্ড ভুল হয়েছিল। অন্ধ্র প্রদেশের অধিকাংশ বিধায়ক শুধু রামারাওয়ের প্রতি অনুগত্যে অটল রইলেন না, গোটা তেলেগুভাষী জনসাধারণ ক্ষেপে উঠলেন। বাস-সরকারি গাড়ি পুড়লো হায়দরাবাদে, রাজ্যের অন্যান্য শহরে-গ্রামে-গঞ্জে, অস্থির উত্তেজিত মানুষদের রাস্তায় বেরিয়ে আসা। দু’সপ্তাহের মধ্যেই ইন্দিরা গান্ধি পরাজয় বরণ করে পুরোপুরি আত্ম সমর্পণ করতে বাধ্য হলেন। এন টি আর ফের অন্ধ্র প্রদেশের মুখ্যমন্ত্রীরূপে বৃত হলেন, সেই রাজ্যপালটিকে অন্ধ্র ছেড়ে পালিয়ে আসতে হলো, সর্বোপরি, এখন আর পালাবার পথ নেই প্রধান মন্ত্রীর, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক সামগ্রিক পুনর্বিন্যাসের জন্য একটি সরকারি কমিশনের কথাও ঘোষণা করতে হলো তাঁকে। কমিশনের জন্য যে-নির্দেশাবলী প্রস্তুত করা হলো, তা নিটোল আমাদের পছন্দসই নয়; যে-তিনজনকে নিয়ে কমিশন গঠিত হলো, তাঁদের স্বাধীন চিন্তাশক্তি নিয়েও আমাদের সন্দেহ ছিল। কিন্তু মূল লক্ষ্যের অভিমুখে খানিকটা তো এগোনো গেল।
নানা কুকাজ করে ইন্দিরা গান্ধি ক্রমশ সারা দেশে অশ্রদ্ধার পাত্রী হচ্ছিলেন। আমরা প্রায় নিশ্চিত ছিলাম, পঁচাশি সালের গোড়ায় যে-সাধারণ নির্বাচন, তাতে কংগ্রেস গো-হারা হারবে। প্রধান মন্ত্রীর রাজনৈতিক নিঃসঙ্গতা প্রতিদিন প্রকটতর; বিরোধী দলগুলির পরস্পরের কাছাকাছি আসার যে-প্রক্রিয়া শুরু হয়েছে, তা থেকেই, আমরা ভেবে নিয়েছিলাম, একটি নীতি-ও কর্মসূচি-ভিত্তিক জোট তৈরির কাজ কয়েক মাসের মধ্যেই সুসম্পন্ন করা সম্ভব হবে, ইন্দিরা গান্ধি বিভিন্ন অবিমৃষ্যকারিতার পরিচয় দিয়ে আমাদের প্রচুর সুবিধা করে দিয়েছেন।
অক্টোবরের শেষ তারিখে তাঁর নৃশংস হত্যা সব-কিছু হিশেব উল্টে দিল। কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক জড়িত আন্দোলনও তখন থেকে একটু ঝিমিয়ে এলো। আমার ক্ষেত্রে অন্তত, এখন এ সব নিছক স্মৃতিচারণ; তা হলেও, কবুলতি না করা অক্ষমার্হ হবে, দেশ জুড়ে কেন্দ্র-রাজ্য সমস্যা নিয়ে যে শোরগোল তোলা গিয়েছিল, তাতে যদিও একটি মাঝারি-গোছের ভূমিকা পালন করেছিলাম, জ্যোতিবাবুর, এবং সেই সঙ্গে পার্টির, অকুণ্ঠ সমর্থন ও উৎসাহ ছাড়া এক পা অগ্রসর হওয়াও আমার সাধ্যের বাইরে ছিল। যবনিকার আড়াল থেকে অভয় ও ভরসা পেয়েছিলাম বলেই হইরই করে যুদ্ধক্ষেত্রে অবতীর্ণ হতে সক্ষম হয়েছিলাম, আত্মশ্লাঘা নিয়ে বাড়াবাড়ি তাই উপহসনীয়।
প্রসঙ্গান্তরে যাওয়ার আগে একটি ঘটনার কথা বলি। ইন্দিরা গান্ধি যেদিন খুন হলেন, জ্যোতিবাবু দক্ষিণ ভারতে, আমরা ক’জন মন্ত্রী রাইটার্স বিল্ডিংয়ে উপস্থিত, ঘন-ঘন দিল্লি থেকে খবর আসছে, দাঙ্গার আগুন দ্রুত ছড়িয়েছে, শিখ সম্প্রদায়ভুক্তরা কচু-কাটা হচ্ছেন, কলকাতায় ও পশ্চিম বাংলায় সেরকম কিছু হতে না দিতে আমরা বদ্ধপরিকর। আমাদের মধ্যে কয়েকজন, সঙ্গে পুলিশের কিছু বড়ো-মেজো কর্তা, শহর টহল দিতে বেরোলাম। আমার সঙ্গে কলকাতা পুলিশের এক যুগ্ম কমিশনার, গাড়িতে উঠেই আমার দিকে তাকিয়ে তাঁর গর্বিত পরিতৃপ্তির হাসি: ‘এবার সর্দারগুলোকে বাগে পেয়েছি, ঠেঙিয়ে ঢিট করে দেবো৷’ আমি স্তম্ভিত, কোথায় নিরপরাধ শিখদের হামলার হাত থেকে রক্ষা করবার উদ্দেশ্যে বেরিয়েছি, এই পুলিশ কর্তা ঠিক উল্টো কথা বলছেন। কড়া ভাষায় তাঁকে ধমকালাম, ঘাবড়ে গিয়ে নীরব হলেন। এই ব্যক্তিই, কার সুপারিশ জানি না, কয়েক বছর বাদে খোদ পুলিশ কমিশনার নিযুক্ত হয়েছিলেন, তবে নিজের অবিবেচনায় টিকে থাকতে পারেননি। এ ধরনের মানুষ, আমার সন্দেহ, প্রশাসনে এখনও বেশ-কিছু বহাল আছেন।