আপিলা-চাপিলা – ৩০

তিরিশ

জেলায়-জেলায় ঘুরে বেড়ানোরে সুযোগে সবচেয়ে যা মোহিত করতে তা পার্টির শহর, শহরতলি ও গ্রামস্তরের কমরেডদের সান্নিধ্য। পার্টি বড়ো হয়েছে, রাজ্যের জনগণের একটি প্রধান অংশের কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন করতে পেরেছে, সংগঠন ক্রমশ পাকাপোক্ত, সমস্ত-কিছুর মূলে কিন্তু রাজ্যময় বিস্তৃত এই হাজার-হাজার সাধারণ কর্মীর শ্রম ও তিতিক্ষা। তাঁদের শ্রদ্ধা ও ভালোবাসার প্লাবনে ভেসে গিয়ে মাঝে-মাঝে ভয়গ্রস্ত হতে হতো: এত আস্থার যোগ্য কি হতে পেরেছি, হতে কি পারবো, আচরণে বিনম্র থাকতে পেরেছি কি, এঁদের বিশ্বাসের যথাযথ প্রতিদান দিতে পারবো কি। প্রায়ই অভিভূত হয়ে যেতাম জেলা বা শাখা দফতরের সঙ্গে সর্বক্ষণ-যুক্ত-থাকা কমরেডদের দেখে। এঁদের মধ্যে অনেকে হয়তো অতীতে হাতে বোমা-পিস্তল নিয়ে বিদেশী প্রভুদের দেশ থেকে তাড়াবার স্বপ্ন দেখেছেন, পরে কারাভ্যন্তরে মার্কসবাদে দীক্ষা নিয়েছেন, বেরিয়ে এসে অনেক আন্দোলনের সঙ্গে যুক্ত হয়েছেন, ফের জেলে গেছেন, পুলিশের লাঠিসোঁটা খেয়েছেন, অনশন-ধর্মঘট করেছেন, এখন বছরের পর বছর পার্টি সংগঠনের দায়িত্বে আছেন। নিঃসংকোচে পুনরুক্তি করছি, এঁদের অনেকেরই নাম ইতিহাসে লিপিবদ্ধ থাকবে না, কিন্তু এঁরাই তো আসলে ইতিহাস রচনা করেন।

রাজনীতির আবর্তে পড়ে আমি কি এই ঘোর-লাগা বছরগুলিতে একান্ত ব্যক্তিগত বন্ধুদের ভুলে ছিলাম? নিশ্চয়ই তা নয়, তবু এতটা সময় প্রশাসনে ও পার্টিগত দায়িত্বে ব্যয় করতে হতো যে আলাদা সময় বলে নিজের কিছু থাকতো না। তা হলেও নিয়ম করে যে-যে রবিবার বা ছুটির দিনে বাইরে যেতাম না, বন্ধুদের ডেকে নিয়ে নরক গুলজারের আয়োজন। সেই রাবিবারিক আড্ডায় নিকটজনরা আসতেন, চা-কফি-চানাচুর-বিস্কুট, কখনও-কখনও সন্দেশ-পান্তয়া রসগোল্লা, কবি-সাহিত্যিক বন্ধরা আসতেন, বৃত্তির বন্ধুরা, অধ্যাপককুলের মধ্যে কেউ-কেউ, একজন-দু’জন নাটকের লোক, কোনও তকমা না-আঁটা নিছক ‘বাউণ্ডলে’ বন্ধ একজন-দু’জন, অকূলে সদাই ভেসে যেতাম। কয়েক ঘণ্টার জন্য এভাবে ভেসে-যাওয়ার হয়তো প্রয়োজনও ছিল, সপ্তাহের বাকিটা সময় তো রাজনীতি-অর্থনীতি-প্রশাসনিক কচকচানি।

এই বছরগুলি আমার কাছে মর্মান্তিকও, অন্য কারণে: বন্ধুজনের মৃত্যু। ঘনিষ্ঠতম তিন বন্ধু, আতোয়ার রহমান সাতাত্তর সালের শেষের দিকে, অন্য দু’জন, অরুণকুমার সরকার ও সুরঞ্জন সরকার, আশি সালের গোড়ায় গত হলেন। কামাক্ষীপ্রসাদ চট্টোপাধ্যায় তো প্রয়াত হয়েছিলেন তারও আগে, ছিয়াত্তর সালে, যখন আমি সাসেক্সে অধ্যাপনারত। এটা ঘটনা, আমার অধিকাংশ বন্ধু বয়সে আমার চেয়ে বেশ কয়েক বছরের বড়ো, অথচ তাঁদের সঙ্গে হার্দ্যিক বিনিময়-প্রতিবিনিময়ে কোনওদিনই বিন্দুমাত্র অসুবিধা দেখা দেয়নি।

আতোয়ার রহমান কঠিন অসুখে ভুগছিলেন বেশ কিছুদিন ধরে, আমার মহাকরণে ঢোকবার কয়েকমাসের মধ্যেই তিনি চলে গেলেন, অসহায় স্ত্রী নীরা ও আকুল-শোকে-ভেসে-যাওয়া পুত্র টিটো ও কন্যা বুড়িকে রেখে; জীবনে এমন দাগা খুব কমই পেয়েছি। সুরঞ্জন সরকার ও অরুণকুমার সরকারের সঙ্গে যেই পর্বে আলাপ, আমি প্রায় কিশোর, ওঁরা উদ্দাম যৌবনের মধ্যলগ্নে: ওঁদের চিঠির জোয়ার আমার উপকূলে, আমার চিঠির প্রত্যাঘাত ওঁদের দুয়ারে। দেশভাগের পরিণামে আমার কী সবচেয়ে বড়ো ণ, কিরণময় রাহা-রবি সেনগুপ্ত-ধ্রূব্যক্তিগত বিষাদবোধ, কেউ প্রশ্ন করলে উত্তর জোগাতে আমাকে কিঞ্চিতমও দ্বিধান্বিত হতে হবে না। যে দুই ক্যাম্বিসের ঝোলায় সুরঞ্জন-অরুণকুমার সরকারের পত্রগুচ্ছ রক্ষিত ছিল, তা সেই ডামাডোলের কালে কোথায় হারিয়ে যায়; শুধু আমার পক্ষেই নয়, গলা উঁচু করে বলতে পারি, বাংলা সাহিত্যের পক্ষেও তা অপূরণীয় ক্ষতি। একটা সময়ে সুরঞ্জন ও অরুণকুমার সরকার পরস্পরের হরিহর-আত্মা বন্ধু ছিলেন, কাজও করতেন কেন্দ্রীয় সরকারের একই দফতরে। এসব ক্ষেত্রে কখনও-কখনও যা হয়ে থাকে, তাঁদের নিজ-নিজ বৃত্ত পরে আলাদা হয়ে যায়, নিঃশব্দ পারস্পরিক অনুরাগ যদিও অটুট ছিল। অরুণকুমার সরকার, বার-বার স্পর্ধিত উক্তি করছি, উত্তর-তিরিশ যুগের অন্যতম প্রধান বাঙালি কবি, কিন্তু প্রচারবিমুখ, সংবাদপত্রের সঙ্গে যুক্ত থাকেননি কোনওদিন, তাঁর অনুজ আলোক সরকারের মতোই, সম্বর্ধনা-সম্ভাষণের ধার-কাছ দিয়ে হাঁটেননি, বাংলা সাহিত্যের ইতিহাসে সুতরাং তাঁর নাম জ্বলজ্বল করে লেখা থাকবে না।

অরুণকুমার সরকার আশি সালের জানুয়ারিতে প্রয়াত হলেন, সুরঞ্জন মাস তিনেক বাদে। তাঁর মৃত্যুর মুহূর্তে অরুণকুমার সরকারের একমাত্র সন্তান অভিরূপ বিদেশে; সে পরে কৃতী হয়েছে, কিন্তু সেই কৃতিত্ব তার বাবা দেখে যেতে পারলেন না।

বন্ধুরা ক্রমশ উধাও, আমার ফ্ল্যাটের রাবিবারিক আড্ডার ভিড় ক্ষীয়মাণ, কিরণময় রাহা-রবি সেনগুপ্ত-ধ্রুব মিত্ররা তখনও আসেন, মাঝে-মাঝে দমকা হাওয়ার মতো সুরজিৎ সিংহ, শান্তি চৌধুরী বা রবি ঘোষ। সমর সেন সাধারণত আসতেন না, আমিই যেতাম তাঁর সুইনহো স্ট্রিটের বাড়িতে। সেখানেও আড্ডায় জনসংখ্যা দ্রুত হ্রাস পাচ্ছে, সব চেয়ে আগে গেলেন তাঁর জ্যেষ্ঠ অগ্রজ অমলদা, বৃত্তিতে হোমিওপ্যাথ চিকিৎসক, তা ছাপিয়ে তাঁর পূর্ণতর পরিচয় সর্বাত্মক সমাজসেবী মানুষ, যেখানে যার যত সমস্যা, অমলদা সঙ্গে-সঙ্গে ঘাড়ে তুলে নিচ্ছেন। সমান চমৎকার মানুষ ছিলেন তাঁদের মেজোভাই গাবুদা, বিখ্যাততম বাঙালি শিল্পসংস্থার সঙ্গে যুক্ত, মনটা সদাই উড়ু-উড়ু সান্ধ্য আড্ডার প্রতীক্ষায়, পৃথিবীর সমস্ত গুজবের ভাষ্য-ভাষ্যান্তর গাবুদার নখাগ্রে। পানপিপাসু, তবে ধাতস্থ হতে পারেননি কোনওদিনই, একটা-দুটো চুমুকের পরই কেমন নেতিয়ে পড়তেন, কিন্তু এই মানুষটির ভালোত্ব সম্পর্কে কারও মনে কোনও প্রশ্নই জড়ো হতো না। ততদিনে নিরঞ্জন মজুমদার প্রয়াত, তবে দেবু চৌধুরী অবশ্যই থাকতেন, সেই সঙ্গে প্রায়ই তাঁর ঢাকা-যুগের বন্ধু সুবোধ বসু, পেশায় গোত্রহীন, তবে বসুবৈধ কুটুম্বকম্‌। আরও বছর দশেক বাদে, তাঁর অন্তরঙ্গ বন্ধুরা প্রায় সবাই অন্তর্হিত, তবু সখ্যের মোহ কাটে না, সোনারপুর থেকে ঠেঙিয়ে প্রতি রবিবার সকালে আমাদের ফ্ল্যাটে হাজির হতেন সুবোধদা, কখনও-কখনও পুরো দিনটা কাটিয়ে যেতেন।

সমরবাবুদের কাচের গেলাসের সেই ঠাসা আড্ডায় মাঝে-মাঝে উদয় হতাম, খানিকক্ষণ থেকে অন্যত্র ধাওয়া। দুই দাদা সদ্য গত হয়েছেন, সমরবাবুর বুকে শেল হানলো মার্কিন মুলুকে জ্যেষ্ঠা কন্যা বীথির আত্মহনন। বীথি সম্পর্কে আমার ও আমার স্ত্রীর সস্নেহ দুর্বলতা ছিল, পাগলাটে, একগুঁয়ে, কিন্তু আশ্চর্য বুদ্ধিমতী, চাতুর্যে-মাধুর্যে উজ্জ্বলা। কিশোরীবয়স থেকেই সে বিদ্রোহিণী। ইংরেজি সাহিত্যে ভালো ছাত্রী, সুন্দর লেখার হাত, অথচ বাবা-মা’র সঙ্গে মনের আড়াআড়ি। কুড়ি না পেরোতেই বিয়ে করলো, সে বিয়ে খুব অল্প দিনই টিকে ছিল, তারপর তার আপাতউচ্ছৃঙ্খল দিনযাপন, অথচ সেই সঙ্গে নিষ্পাপ কোমলতা। স্বামীর সঙ্গে ক্ষণিক সময়ের জন্য পুনর্মিলন, আবার ছাড়াছাড়ি, এবার পুরোপুরি বিবাহবিচ্ছেদ, কিছুদিন তার ইতস্তত ঘুরে বেড়ানো। বীথির ফুটফুটে পুতুলের-মতো-সুন্দর-দেখতে মেয়েটি, বান্ডিল, সমরবাবু ও সুলেখা সেন নিজেদের কাছে রেখে বড়ো করেছেন, ছেলেবেলায় বাবা-মা’র সান্নিধ্য তার ভাগ্যে জোটেনি, সে-ও তাই তখন ছিল, যা আদৌ আশ্চর্যের নয়, অসম্ভব খেয়ালি।

বিবাহবিচ্ছেদের সামান্য পরে বীথি একটি ধড়িবাজ মালয়ালি ছেলের পাল্লায় পড়ে, তার সঙ্গে বিয়ের অনুষ্ঠান হয়, দু’জনের বস্টন গমন। বছর না ঘুরতেই বীথি বুঝতে পারলো জীবনে আর একবার ভুল করেছে। এর আগেও সে একবার-দু’বার আত্মহত্যার চেষ্টা করেছে, শেষ মুহূর্তে বন্ধুরা কেউ গিয়ে বাঁচিয়েছে, এবার তাকে আর রক্ষা করা গেল না। আমেরিকা যাওয়ার মুহূর্তে বাণ্ডিলকে সমরবাবুদের কাছ থেকে বীথি কেড়ে নিয়ে গিয়েছিল। বিদেশে কন্যার অপমৃত্যু, বালিকা নাতনি নিঃসহায় একা, অনেক কাঠখড় পুড়িয়ে বান্ডিলকে কলকাতায় ফিরিয়ে আনা হলো। সমরবাবু এমনিতেই রুগ্‌ণ ছিলেন, এবার শরীর প্রচণ্ড ভেঙে পড়লো। বেশ কয়েকমাস কঠিন পীড়ায় আক্রান্ত, হাসপাতাল-নার্সিং হোম ঘুরে বাড়ি আসার পর স্বাস্থ্য খানিকটা ফিরলো, মনের বিষণ্ণতা অব্যাহত। ‘বাবু বৃত্তান্ত’-এর নির্দয় নাস্তিক অধ্যায়গুলি কয়েকমাস ধরে লিখেছেন, আরও হয়তো লিখতেন, কিন্তু মনে কোনও উৎসাহ পেলেন না, প্রকৃতিগত ব্যঙ্গ-বোধ গভীর তিক্ততায় আচ্ছন্ন, তবে এটাই বাঙালি ভদ্রলোক চরিত্রের স্ববিরোধিতা, সেই তিক্ততার বাচনিক বহিঃপ্রকাশ নেই, প্রায় সকলের সঙ্গেই স্বল্পবাক, নম্রভাষী, একমাত্র সহ্যের সীমা পেরোলে একটি-দু’টি খণ্ডিত বাক্যের প্রহারে শত্রু-সংহার করতেন। আর শত্রু তো পৃথিবী জুড়ে, পৃথিবীতে তো ভণ্ড-বুজরুকদের, তাঁর বিবেচনায়, শেষ নেই।

একটি ছোট্ট ঘটনার কথা মনে এলো। সমরবাবু গুরুতর অসুস্থ, বন্ধুরা মিলে ওঁকে সুখলাল কারনানি হাসপাতালে ভর্তি করবার ব্যবস্থা করেছি। জ্যোতিবাবুকে অনুরোধ জানালাম, সমরবাবুর যথাসম্ভব যত্ন নেওয়ার জন্য স্বাস্থ্য অধিকর্তা মহাশয়কে ডেকে একটু অনুরোধ জ্ঞাপন করতে। মুখ্যমন্ত্রী সঙ্গে-সঙ্গে উক্ত ভদ্রলোককে ডেকে পাঠালেন, ‘আপনারা তো জানেন উনি আমাদের একজন প্রধান কবি, আশা করি আপনি ও আপনার সহকর্মীরা ওঁকে একটু দেখবেন।’ শাণিত রসিকতায় জ্যোতিবাবু প্রতিদ্বন্দ্বীহীন, হঠাৎ আমার দিকে তাকিয়ে যোগ করলেন, ‘আমিও একবার ভাবছিলাম সমরবাবুকে দেখতে যাবো, কিন্তু আমাকে দেখলে ওঁর অসুখ হয়তো বেড়ে যাবে।’

বামফ্রন্ট সরকারের প্রথম পাঁচ বছর প্রায় সমাপ্তির মুখে, ইতিমধ্যে বিধানসভায় প্রতিপক্ষীয়দের প্রচুর বীতরাগের লক্ষ্যে পরিণত হয়েছি, তাতে আমার কিছুমাত্র বিষাদবোধ নেই। সর্ববৃহৎপ্রচারিত বাংলা দৈনিক পত্রিকাটিরও বিষম চক্ষুশূল হয়েছি, তাঁরা আমার সম্পর্কে ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক অকথা-কুকথা লিখতেন, যে-কারণে একটা সময় আমার ধারণা হয়েছিল ওই পত্রিকার দফতরে যখন নবীন কর্মী-কমিণীদের নিয়োগ করা হয়, তাঁদের জন্য সম্ভবত প্রথমেই বিশেষ অনুশীলনের ব্যবস্থা থাকে, কী করে তথ্যের সঙ্গে বিন্দুমাত্র সংস্রবহীন অঢেল মিথ্যে কথা তড়তড় করে লিখতে শেখা যায়। ওই গোষ্ঠীর এক তরুণ সাংবাদিকের দুরদর্শনে এক ভাষণ শুনে একদিন চমৎকৃত হয়েছিলাম: সত্য বলে কোনও বস্তু নেই, তথ্যের কোনও বিশেষ অবয়ব নেই আমরা আমাদের মনের মতো করে যা পরিবেশন করব, তা-ই সত্য, তা-ই তথ্য।

সুতরাং আঁচ করতে পারছিলাম, নতুন যে-নির্বাচন আসন্ন, তাতে অনেক দিক থেকে আক্রমণের শিকার হবো। পার্টির অভ্যন্তরেও তা নিয়ে উদ্বেগ। আমিই প্রথম কমিউনিস্ট পার্টির প্রতীক নিয়ে রাসবিহারী কেন্দ্র থেকে জয়ী হই সাতাত্তর সালে, একমেবমদ্বিতীয়ম্‌। ওই কেন্দ্রের যা শ্রেণীচরিত্র, এবং বাজারে আমার সম্বন্ধে যে-রটনা, ওখান থেকে দ্বিতীয়বার জেতা মোটেই সহজ নয়। এরই মধ্যে একদিন বিনয় কোঙার ঘরে ঢুকে বললেন, বর্ধমান জেলার কোনও কেন্দ্র থেকে আমাকে প্রার্থী করতে তাঁরা আগ্রহী, আমি নিজে আগ্রহী কিনা যদি জানাই। সবচেয়ে বেশি জল্পনা চলছিল চব্বিশ পরগনার যাদবপুর কেন্দ্র নিয়ে। এখান থেকে দীনেশ মজুমদার সাতাত্তর সালে হেসে-খেলে জয়ী হয়েছিল। ওর হঠাৎ-প্রয়াণের পর কয়েক মাস ওই কেন্দ্রের বিধায়ক ছিলেন কৃষক নেতা ক্ষুদিরাম ভট্টাচার্য, তাঁর উপর দক্ষিণ চব্বিশ পরগনা পার্টির জেলা সম্পাদকের দায়িত্বও। তিনি আর বিধায়ক থাকতে রাজি নন, সুতরাং ছক কষা হচ্ছিল আমাকে যাদবপুর কেন্দ্রে চালান করে দেওয়ার। পার্টি দপ্তরে গিয়ে ঘোর প্রতিবাদ জানালাম, জনগণ আমাকে ভীরু কাপুরুষ বলবে, পুরনো আসন থেকেই তাই দাঁড়াতে চাই। প্রমোদবাবু আমাকে কড়কে দিলেন : ‘আসনটা আপনার নয়, পার্টির। পার্টি আপনাকে যেখান থেকে দাঁড় করাবে, আপনি সেখান থেকে দাঁড়াতে বাধ্য।’ নতমস্তকে যদিও সেদিন চলে এলাম, শেষ পর্যন্ত তাঁর মন গললো, রাসবিহারী কেন্দ্র থেকেই ফের প্রতিদ্বন্দ্বিতার অনুমতি পেলাম। সাতাত্তর সালে ওই কেন্দ্রে প্রদত্ত ভোটের আমরা শতকরা মাত্র সাঁইতিরিশ ভাগ পেয়েছিলাম, কংগ্রেস ও জনতা দলের মধ্যে উল্টো দিকের ভোট ভাগাভাগি হওয়ায় বেরিয়ে যাই। আশি সালের লোকসভা নির্বাচনে আমাদের প্রার্থী কংগ্রেস প্রার্থীর চেয়ে ওই কেন্দ্রে পিছিয়ে ছিলেন। তা হলেও, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক নিয়ে এত চেঁচামেচি করেছি, বাজারে নাম ছড়িয়েছে, পার্টির প্রভাব ওই মুহূর্তে সর্বত্র তুঙ্গে, কংগ্রেসের মধ্যে অনেক দলাদলি, আশা ছিল এবারও বেরিয়ে যাবো। গেলাম না। পার্টির সমস্ত সাংগঠনিক শক্তি রাসবিহারী কেন্দ্রে নিয়োজিত হলো, সর্বস্তরের বন্ধু, পরিচিত ও শুভানুধ্যায়ীরা প্রাণপাত পরিশ্রম করলেন, পোস্টারে-ফেস্টুনে মিছিলে-সভায় রাসবিহারী কেন্দ্রের সব ক’টি ওয়ার্ড উত্তাল করে দেওয়া হলো। কিন্তু শেষ রক্ষা হলো না, কারণটা আমার কাছে স্পষ্ট, যদিও পার্টিকে তা কোনওদিন বলবার চেষ্টা করিনি।

সেই ভুয়ো সঞ্চয়সংস্থার বিরুদ্ধে ব্যবস্থা গ্রহণ করায় উচ্চবিত্ত-মধ্যবিত্ত শ্রেণীর অনেকে ক্ষতিগ্রস্ত হয়েছিলেন, তাঁদের একটি বড়ো অংশ প্রথম থেকেই আমাকে হারাতে বদ্ধপরিকর। তবে মনে হয় না আমার অসাফল্যের তা মুখ্য হেতু। যদিও এবারও নির্বাচনী প্রচারে মলয় চট্টোপাধ্যায় আমার মস্ত অবলম্বন, সার্বিক দায়িত্বে ছিলেন এক ঘোরতম আদর্শবাদী কমরেড। সকাল-বিকাল স্বেচ্ছাসেবকদের ভোটের প্রচারে পাঠাবার আগে পঁয়তাল্লিশ মিনিট বা এক ঘণ্টা ধরে তাঁদের কাছে তাত্ত্বিক বক্তৃতা দিতেন, আমাকে পাশে বসে থাকতে হতো। মনে-মনে আঙুল কামড়াতাম, ওই সময়টায় মুক্তি পেলে রাসবিহারীর উন্নাসিক মধ্যবিত্ত-উচ্চবিত্তদের বাড়ি-বাড়ি একটু ঘুরতে পারতাম; সঞ্চয়সংস্থাটির বিরুদ্ধে কেন ব্যবস্থা গ্রহণ করা হয়েছে, তাঁদের বিশদ করে হয়তো বোঝাতে পারতাম। কিন্তু নির্বাচনপ্রচারসর্বাধ্যক্ষের কড়া অনুশাসন, আমাকে প্রতিদিন বসে থেকে তাঁর বক্তৃতা শুনতে হবে। নির্বাচনের আগের দিন রাত্রিবেলা প্রতাপাদিত্য রোড ধরে ফিরছি, এক বাড়ির পাঁচিলের ওপার থেকে শুনতে পেলাম সর্বাধিনায়কের কণ্ঠস্বর, দু-তিনশো স্বেচ্ছাসেবক জড়ো করে ওই মধ্যনিশীথে প্রায়-অপোগণ্ডদের বোঝাচ্ছেন, নির্বাচনে জয়লাভ আমাদের মুখ্য উদ্দেশ্য নয়, আমাদের লক্ষ্য পার্টির আদর্শ মজবুত করে প্রচার করা। আমার বোধহয় তখন স্বগত বিলাপোক্তি করা উচিত ছিল, ‘তনয়ে তারো তারিণী’।

আমার পরাজয়ে কংগ্রেস মহলে আনন্দ ধরে না। তিন দিন ধরে আকাশবাণী ও দূরদর্শনে দেশের সর্বত্র প্রতিটি সংবাদ বুলেটিন অশোক মিত্রের পরাজয়ের উল্লেখ দিয়ে শুরু। আমাকে যে-ভদ্রলোক হারিয়েছিলেন, তিনি দিল্লি গেলেন, ইন্দিরা গান্ধি সময় করে তাঁর সঙ্গে পাঁচ মিনিটের জন্য দেখা করলেন, তাঁকে অভিনন্দন জানালেন, এমন সৌভাগ্য সারা দেশে কংগ্রেস বিধায়কদের মধ্যে অন্য কারও হয়নি। প্রমোদবাবুর চেয়েও জ্যোতিবাবু দৃশ্যত বেশি মুষড়ে পড়লেন, তাঁকে বললাম অবিলম্বে সত্যব্রত সেনকে রাজ্য পরিকল্পনা পরিষদের সহ-সভাপতি করে দায়িত্ব দেওয়া হোক, সত্যব্রতবাবু অর্থ দফতরের কাজকর্মে তাঁকে সাহায্য করতে পারবেন, তা ছাড়া সুজিত পোদ্দার তো রইলোই, অর্থ দফতরের আঁটঘাট সব-কিছু ওর জানা। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে যে অধ্যাপনার কাজ দু’ মাস করেই ক্ষান্ত দিয়েছিলাম, তাতে ফিরে গেলাম, ইনস্টিটিউটের বাসে চেপে নিত্যদিন বরানগরে। মন্ত্রীগিরি থেকে বেরিয়ে এসে এই আপাতঅবসরযাপন ভালোই লাগলো। মধ্যবর্তী পাঁচ বছরে ধনবিজ্ঞান আরও অনেক এগিয়ে গেছে, আমার বিদ্যার পুঁজি আরও কমেছে, সুতরাং অনুকম্পায়ী সহযোগীরা আমার উপর তেমন বেশি শিক্ষকতার দায় চাপালেন না। যে লেখালেখির অভ্যাস প্রায় চলে গিয়েছিল, তা আবার মকশো করা শুরু। সবচেয়ে বড়ো লাভ, যে-বন্ধুরা প্রকৃতির নিয়মে তখনও হারিয়ে যাননি, তাঁদের সঙ্গে ফের চুটিয়ে আড্ডা দেওয়া: রবিবারের প্রভাতী আসরে উপভোগের পাত্র উছলে উঠে মাধুরী দান করতে লাগলো।

কয়েক মাস না যেতেই ফের মর্মান্তিক শোক সংবাদ। জ্যোতিবাবুর সঙ্গে হালকা আড্ডা জমানো সম্ভব, কিন্তু যে বিষয়ে তিনি আলোচনায় এগোতে অনিচ্ছুক তা নিয়ে তাঁকে বিব্রত বা বিরক্ত করবার মতো বাসনা বা প্রবৃত্তি তখনও ছিল না, এখনও নেই। অন্য পক্ষে চারিত্রিক বিন্যাসে প্রমোদবাবুর থেকে আমি শত হস্ত দূরে থাকলেও তাঁর সঙ্গে যে কোনও বিষয় নিয়ে আড্ডা দেওয়া যেত, তর্ক করা যেত, এমনকি তর্ককে ঝগড়ার পর্যায়েও তুলে নিয়ে যেতে কোনও বাধা ছিল না। মহাকরণে যাওয়া নেই, স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে কর্তব্য সমাপনান্তে হাতে প্রচুর সময়, প্রায়ই আলিমুদ্দিন স্ট্রিটে গিয়ে প্রমোদবাবুর মুখোমুখি হতাম। তাঁর হাতে চুরুট, চুরুটের ধোঁয়া ভেদ করে আমার তর্কবাণ নিক্ষেপ। সহসা সব-কিছু অন্যরকম হয়ে গেল। নভেম্বর মাস, চীন পার্টির আমন্ত্রণে প্রমোদবাবু ওদেশে গেলেন, আর ফিরলেন না, তাঁর শবদেহ কলকাতায় ফিরে এলো। নিজেকে যেন অবলম্বনহীন মনে হলো। যে কথাগুলি জ্যোতিবাবুকে বলা যেত না, বলতে বাধো-বাধো ঠেকত, এতদিন তা অনায়াসে দ্বিধাহীন চিত্তে প্রমোদবাবুকে বলতে পারতাম: সেই সম্ভাবনায় এখন থেকে চিরদিনের জন্য ছেদ।

বুঝতে পারছিলাম অর্থ দফতরের দায়িত্বে আলাদা কোনও মন্ত্রী না-থাকায় জ্যোতিবাবুর উপর চাপ বাড়ছে। সত্যব্রতবাবু যদিও সকাল থেকে সন্ধ্যা পরিশ্রম করছেন, ইংরেজি ভাষায় যাকে বলা হয় ব্যক্তিগত সমীকরণ, জ্যোতিবাবুর সঙ্গে তা তাঁর কোনওদিনই ছিল না, আমি জ্যোতিবাবুকে অবাধে যতটুকু বলতে পারতাম, সত্যব্রতবাবুর পক্ষে সেটুকুও সম্ভব হতো না। আরও সমস্যা দেখা দিল, বিরাশি সালের শেষের দিকে জ্যোতিবাবু নিজে অসুস্থ হয়ে পড়লেন। সিঁড়ি ভাঙার অসুবিধা এড়ানোর জন্য সেই যে হিন্দুস্থান পার্কের বাড়ি ছাড়লেন, আর কোনওদিন তাঁর ফেরা হয়নি। রাজভবনের প্রাঙ্গণে সরকারি আমলাদের জন্য তৈরি একটি একতলার ফ্ল্যাটে জ্যোতিবাবু উঠে গেলেন, বেশ কয়েক বছর বাদে সেখান থেকে সল্ট লেকের ইন্দিরা ভবনে।

যে-যাদবপুর কেন্দ্র থেকে এক বছর আগে প্রার্থী হতে গভীর অনিচ্ছা প্রকাশ করেছিলাম, শঙ্কর গুপ্ত সেখান থেকে জিতে বিদ্যুৎ বিভাগের রাষ্ট্রমন্ত্রী, দুরারোগ্য অসুখে তাঁর অকালমৃত্যুর পর আসনটি ফের খালি। জ্যোতিবাবুর স্বাস্থ্যাবনতির উল্লেখ করে পার্টি থেকে আমাকে ফের উপরোধ, বারবার অসম্মতি জানানো, অনেকেই বললেন, অনুচিত। ইন্ডিয়ান স্ট্যাটিস্টিক্যাল ইনস্টিটিউটে অধ্যাপনার ফাঁকে-ফাঁকে প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির পৌরোহিত্য করছিলাম, কমিটির প্রতিবেদন দাখিল করবার ক’মাস বাদে যাদবপুর থেকে পুনরায় বিধানসভায় অতএব নির্বাচনপ্রার্থী।

প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির কাজে সোমনাথ চট্টোপাধ্যায় ও একজন অভিজ্ঞ রাজপুরুষ আমাকে সহযোগিতা করেছিলেন। প্রধানত দু’টি বিষয়ের প্রতি আমাদের দৃষ্টি নিবদ্ধ ছিল; এক, প্রশাসনিক বিকেন্দ্রিকরণের লক্ষ্যে অবশ্যপ্রয়োজন সংস্কারাদির নির্ঘণ্ট-নির্দেশাবলী তৈরি করা; দ্বিতীয়, প্রশাসনের ঢিলেঢালা প্রক্রিয়াকে কোন্‌-কোন্ পদ্ধতি বা প্রকরণের সাহায্যে দ্রুততর করা সম্ভব, তা নিয়ে কিছু নির্দিষ্ট প্রস্তাব পেশ। অন্য কয়েকটি সমস্যা নিয়েও কমিটি কিছু চিন্তাভাবনা করেছিল। প্রশাসনের সর্বস্তরে বাংলা ভাষার দ্রুত অনুপ্রবেশ ঘটানোর লক্ষ্যে একগুচ্ছ প্রস্তাব আমরা দাখিল করেছিলাম। তবে প্রশাসনরূপী গণেশকে নড়ে-চড়ে বসানো চাট্টিখানি কথা নয়, বামপন্থী সরকারের নেতৃত্ব সত্ত্বেও নয়: দ্বারপ্রান্তে শুধু যে মাধবীরই মন ঠেকে যায় তা তো নয়। মাত্র কয়েকমাস আগে, বিংশ শতাব্দী শেষ হবো-হবো করছে, হঠাৎ কাগজে দেখে চমৎকৃত হলাম, আমরা আঠারো-উনিশ বছর আগে প্রতি বিভাগে একটি করে অভিযোগ কেন্দ্র খোলবার জন্য যে-সুপারিশ করেছিলাম, তা এতদিনে কার্যকর হচ্ছে। প্রশাসনে বাংলা ভাষার প্রাধান্য এখনও ঠিক কায়েম হয়নি। আর ফাইলের শম্বুকগতি, তাই-ই কি ধাক্কা মেরে দ্রুততর করবার প্রয়াস এমন কি অংশতও সফল হয়েছে? কমিটির সচিব একটি বিশেষ ফাইলের ক্ষেত্রে গবেষণা করে দেখিয়েছিলেন, পাকা সিদ্ধান্ত নেওয়ার আগে দুশো ঊনসত্তর বা দুশো ঊনআশিবার তা উপরে-নিচে, ডাইনে-বাঁয়ে হেলেছে, দুলেছে, তিন-না-সাড়ে তিন বছর ধরে।

কমিটির পর কমিটি প্রতিবেদন দাখিল করলে কী হয়, ঐতিহ্য টোল খায় না। প্রশাসনিক স্বার্থে মেদিনীপুর জেলা ভাগ করার যে-সুপারিশ তখন করেছিলাম, তা কার্যকর হলো উনিশ বছর বাদে; পশ্চিম দিনাজপুর জেলার ক্ষেত্রে অবশ্য মাত্র বছর দশেক লেগেছিল।

অন্য একটি সুপারিশ ছিল বিকেন্দ্রিকরণের পাশাপাশি প্রশাসনের গণতন্ত্রীকরণ বিষয়ে, রাজপুরুষদের যে-ধরাবাঁধা স্তরবিন্যাস তা কমিয়ে আনার অভিপ্রায়ে। এ-সব সুপারিশই এখন কীটদষ্ট, প্রায়-বিস্মৃত; শত ঢুঁড়লেও সেই কমিটির রিপোর্টের কপি সংগ্রহ করা সম্ভব নয়। শুধু আই.এ.এস. রাজপুরুষরা নন, যোগ্যতার ভিত্তিতে নিম্নতর বর্গভুক্ত রাজপুরুষদের মধ্য থেকেও বেছে নিয়ে জেলা প্রশাসনের সর্বোচ্চ দায়িত্বে অধিষ্ঠিত করা উচিত, কমিটির এই বিশেষ সুপারিশ রূপায়িত হলো একবিংশ শতাব্দীর দ্বিতীয় বছরে।

মহাকরণে কাজ করতে গিয়ে সবচেয়ে অবসন্ন লাগতো উন্নয়নমূলক নানা কর্মসূচি প্রশাসনিক ঢিলেমিতে আটকা পড়ে থাকার অভিজ্ঞতা থেকে। মুখে বিপ্লবের কথা বলি আমরা বামপন্থীরা, অথচ সমাজব্যবস্থার বাধ্যবাধ্যকতা মেনে নিয়ে আপাতরূঢ় সিদ্ধান্ত গ্রহণ থেকে প্রায়ই পিছিয়ে আসি। আরও যা সমস্যা, বিভিন্ন মন্ত্রীরা সংস্কারের জালে আচ্ছন্ন। ঊনআশি না আশি সাল এখন ঠিক মনে নেই, পূর্ণ সূর্যগ্রহণ, পৃথিবী নাকি সেই তারিখে প্রলয়ে ভেসে যাবে; সব চেয়ে গলা উঁচু যে শরিকি মন্ত্রীর, তাঁর প্রচণ্ড চাপে মন্ত্রিসভায় সিদ্ধান্ত নেওয়া হলো সেদিন সরকারি ছুটি ঘোষণা করা হবে। পরিমল মিত্র প্রচণ্ড বিরক্তিতে দাবি করলেন, এই সিদ্ধান্তে তাঁর অসম্মতি যেন মন্ত্রিসভার কার্যবিধিতে সুস্পষ্ট উল্লেখ থাকে, তাঁর সঙ্গে আমিও গলা মেলালাম।

সমর সেন একদা ‘নাউ’ পত্রিকার পৃষ্ঠায় সম্পাদকীয় মন্তব্য করেছিলেন, যে-হারে দেবদেবীর সংখ্যা বৃদ্ধি পাচ্ছে, সেই সঙ্গে দেবোত্তর সম্পত্তির পরিমাণ, দেবতাদের জন্যও জন্মনিয়ন্ত্রণ প্রবর্তন অবশ্য সামাজিক কর্তব্য। প্রশান্ত শূর অত্যন্ত কর্তব্যশীল মন্ত্রী, কৌশলগত সুবিধার স্বার্থে রাজনৈতিক দৃষ্টিভঙ্গি বিসর্জন দিতে তিনি আদৌ রাজি ছিলেন না। মন্ত্রিত্বে প্রবেশের প্রথম বছরেই দুটো করণীয় কাজে তাঁর দৃষ্টিক্ষেপ। কলকাতার রাজপথে কিংবা অলিতে-গলিতে, দু’কদম এগোতে না এগোতে, শিবরাম চক্রবর্তী যাকে বলেছিলেন দেবতার জন্ম: যত্রতত্র একটি কুৎসিত ক্ষুদে মূর্তি বা নিরেট পাথর বসিয়ে পুজোর ভণিতা করে তা থেকে কোনও ধাপ্পাবাজের পয়সা উপার্জনের ফিকির বন্ধ করতে তিনি প্রাথমিক উদ্যোগ গ্রহণ করলেন। পাড়ায়-পাড়ায় কয়েক সপ্তাহ ধরে রাস্তা আটকে সার্বজনীন দুর্গাপূজা বা অন্য কোনও ধর্মীয় অনুষ্ঠানের নামে সাধারণ মানুষের অশেষ অসুবিধা ঘটানোর প্রক্রিয়াটি বিসর্জনের ব্যবস্থা নিয়েও প্রশান্তবাবু উদ্যোগী হলেন। তবে বৃথাই নগর উন্নয়ন মন্ত্রীর তর্জনগর্জন: অচিরে নির্দেশ এলো, এসব স্পর্শকাতর ব্যাপারে বেশি না এগোনোই আপাতত ভালো। প্রশান্তবাবু হতাশ, আমরা যারা পাশ থেকে তাঁকে উৎসাহ যোগাচ্ছিলাম, তারাও।

এই সব কিছুর চেয়েও গভীরতর সমস্যা অনেক মন্ত্রীর মধ্যেই দৃঢ়প্রোথিত সামন্ততান্ত্রিক মানসিকতা: আমি মন্ত্রী, আমি এই বিভাগের দায়িত্বে আছি, আমার দায়দায়িত্ব আমি যেমন খুশি পালন করবো, তুমি কোথাকার নটবর হে, মাথা গলাতে আসছো? অথচ অর্থ তথা পরিকল্পনা দফতরের মন্ত্রী হিশেবে আমার তো এটা স্বাভাবিক শিরঃপীড়া, গরিব সরকারের বহু কষ্টে সংগৃহীত পয়সাকড়ি ঠিকমতো ঠিক সময়ে খরচ হচ্ছে কিনা তা দেখা, পরিকল্পনাগত কর্মসূচি প্রতিটি বিভাগে সুসম্পন্ন হচ্ছে কিনা তা নিয়ে সজাগ-সতর্ক থাকা। অন্তত আর্থিক ব্যবস্থাপনার ক্ষেত্রে বিভাগীয় কাজকর্মের পারস্পরিক সংযোগ নিবিড় না-হলে কী করে বিভিন্ন ক্ষেত্রে আমাদের লক্ষ্যমাত্রা সুষ্ঠু পূরণ করতে পারবো, পূরণ করে অন্যান্য রাজ্যের জন্য দৃষ্টান্ত স্থাপন করতে পারবো, যে-দৃষ্টান্তে উদ্বুদ্ধ হয়ে সারা দেশের মানুষ বামপন্থার দিকে ঝুঁকবেন?

একটু মজাই লাগতো আমার। বন্ধুভাবে হয়তো কোনও মন্ত্রীকে পরামর্শ দিতে গেলাম, তাঁর বিভাগে ফিতের বাঁধন কী করে সামান্য আল্‌গা করা যেতে পারে, অর্থ ও পরিকল্পনা দপ্তরের সঙ্গে নিবিড়তর সংযোগে প্রশাসনিক প্রক্রিয়া কী করে দ্রুততর করা সম্ভব। আমার সদিচ্ছা তো পূর্ণ হতোই না, বরঞ্চ উল্টো ফল হতো, মন্ত্রীরা অসহযোগিতার মাত্রা আরও বাড়িয়ে দিতেন। মানিকবাবুর ‘পুতুলনাচের ইতিকথা’-র একটি উপকাহিনী মনে না পড়ে পারতো না। শশী ডাক্তারের পিতৃদেব গোপাল দাস শাঁসালো জোতদার-মহাজন, বাড়িতে অনেক দুঃস্থ আত্মীয়স্বজনের ঠাঁই৷ শশী লক্ষ্য করেছে এক আশ্রিতা আত্মীয়া তার শিশুসন্তানটির উদরে খুব বেশি পরিমাণে ভাত ঠেসতে ব্যস্ত। চিকিৎসকের মনস্কতা নিয়ে শশীর পরামর্শ, ‘পিসি, ওকে অত ভাত খাইয়ো না, পেটে পিলে বাড়বে।’ পিসির তৎক্ষণাৎ স্বগতমন্তব্য, ‘দেখেছো, আমরা অসহায় আশ্রিত বলে কী হেনস্থা। মাছ-মাংস নয়, পরমান্ন নয়, জোটে তো সামান্য ক’টি ভাত, তাতেও বড়োলোক আশ্রয়দাতার বুক পোড়াচ্ছে।’ ফলের মধ্যে হলো পিসি ছেলেকে আরো বেশি করে ভাত খাওয়াতে লাগলেন। সহযোগী অনেক মন্ত্রীকে ভালো মনে সুপরামর্শ দিতে গিয়ে আমারও অনুরূপ অভিজ্ঞতা।

পাঁচ বছর এ-সমস্ত অসুবিধার পীড়নে ভুগেছি, মনে-মনে শপথবদ্ধ ছিলাম, দ্বিতীয়বার মন্ত্রী হলে প্রশাসনিক ব্যবস্থায়, অন্তত অর্থনৈতিক ক্ষেত্রে, পারস্পরিক সংযোগ যে-করেই হোক সংহততর করতে হবে, প্রমোদবাবু-জ্যোতিবাবুকে রাজি করিয়ে একটি-দু’টি জরুরি পদক্ষেপ নেওয়ার চেষ্টা করবো। নির্বাচনে হেরে গেলাম, কয়েক মাস বাদে প্রমোদবাবু প্রয়াত, মনের ইচ্ছা মনেই থেকে গেল। যাদবপুর থেকে জিতে যখন মন্ত্রিসভায় পুনঃপ্রবেশের তারিখ অত্যাসন্ন, মনের প্রকোষ্ঠে আর একবার নাড়া দিল সেই ইচ্ছা। দলের রাজ্য সম্পাদক ও জ্যোতিবাবুকে ব্যাখ্যা করে বললাম আমি কী চাইছি, কেন চাইছি। বুঝতে পারলাম জ্যোতিবাবুর সায় নেই, তাঁর বিবেচনায় বিভিন্ন বিভাগের কাজকর্মের মধ্যে সংযোগ ঘটানোর দায়িত্বে মুখ্যমন্ত্রীই তো আছেন, সেই দায়িত্ব আমার প্রস্তাবমতো কেন আলাদা করে অর্থ ও পরিকল্পনা দপ্তরকে দেওয়া হবে, তাতে সংযোগসাধন মাথায় উঠবে, বিসংবাদ বৃদ্ধিরই বেশি আশঙ্কা, বিভাগীয় মন্ত্রীরা চটে যাবেন। অর্থ ও পরিকল্পনা দফতরকে এমনিতেই এই সংযোগস্থাপনের দায়িত্ব নিতে হয়, স্পষ্ট করে উল্লেখ থাকলে সমস্যা একটু কমবে, এই ব্যাখ্যা জ্যোতিবাবুকে সন্তুষ্ট করতে পারলো না। তিনি অবশ্য মুখ্য সচিবের আপত্তির কথা বললেন, যিনি নাকি বলেছেন, আমি যে-প্রশাসনিক সংস্কারের কথা বলছি তা চালু করতে গেলে মন্ত্রিসভার নিয়মাবলী খোলনল্‌চে পাল্‌টাতে হবে। তর্ক জুড়তে পারতাম, মন্ত্রিসভায় একটি সংশোধনী প্রস্তাব গ্রহণ করেই তা করা যায়। কিন্তু জ্যোতিবাবুর অসম্মতি বুঝে দ্বিরুক্তি না করে ফের শপথ গ্রহণ করলাম নিছক অর্থ ও পরিকল্পনা মন্ত্রী হিশেবেই। এবার আবগারি বিভাগের দায়ও রইলো না।

আসল লোকসান যা হলো, আমার অনুপস্থিতিতে সত্যব্রত সেনের কাজের চাপ অনেক বেড়ে গিয়েছিল, তিনি স্পষ্টতই হাঁপিয়ে উঠেছেন, সত্যবাবু আর মহাকরণে থাকতে রাজি হলেন না, পার্টির কাজে ফিরে গেলেন পুরো সময়ের জন্য। তবে আমি যেমন আলস্যের ভেলায় দিনের পর দিন কাটিয়ে দিতে পারি, কোনও কাজ না করে স্রেফ আড্ডায় মজে গিয়ে সময়ের অপচয় করতে বিবেকে বাধে না, দায়িত্ব ঘাড়ে এসে পড়লে ষোলো-আঠারো ঘণ্টা কাজে লেগে থাকতেও কোনও সময়ই পিছুপা হই না। ইতিমধ্যে প্রশাসনিক অভিজ্ঞতা একটু বেড়েছে, প্রশাসনিক সংস্কার কমিটির কর্মসূত্রে আত্মবিশ্বাসও বেড়েছে, কেন্দ্র-রাজ্য সম্পর্ক পুনর্বিন্যাসের গদা ঘুরিয়ে কেন্দ্রীয় সরকারকে ঘায়েল করবার আগ্রহে সত্তা-চেতনা নিশপিশ করছে। পুনর্বার মন্ত্রীরূপে শপথ নেওয়ার কয়েক সপ্তাহের মধ্যেই রাজস্ব সংগ্রহের লক্ষ্যে একগুচ্ছ কর সংশোধনের প্রস্তাব বিধানসভায় মঞ্জুর করিয়ে নিলাম। অন্যতম লক্ষ্য ছিল খনিজ পণ্যাদি থেকে রাজস্ব সংগ্রহ বাড়ানো। সংবিধানের অনুশাসন, ভূগর্ভস্থ খনিজ পদার্থের উপর রাজ্যগুলির কর বসাবার অধিকার নেই, উত্তোলিত খনিজ বাবদ কেন্দ্রীয় সরকার রয়্যালটি নির্ধারণ করবে, তা থেকে রাজ্যগুলির কিছু প্রাপ্য মিলবে।

সাধারণ মূল্যমান চড়ছে, কয়লা-লোহার দামও ঊর্ধ্বগামী, অথচ রয়্যালটি বাড়াবার ব্যাপারে কেন্দ্রের কোনও উদ্যোগই নেই, যথাযথ প্রাপ্য থেকে যেন ইচ্ছা করেই আমাদের বঞ্চিত করা হচ্ছে। অন্য দিকে তৈল উত্তোলনের ক্ষেত্রে অসম ও গুজরাট সরকারের প্রাপ্য রয়্যালটির মাত্রা বহুগুণ বাড়িয়ে দেওয়া হয়েছে: আমরা শুধু বঞ্চিতই নই, একপেশে আচরণেরও শিকার। বিষয়টি নিয়ে বিহার ও ওড়িশার অর্থমন্ত্রীদের সঙ্গে আলাপ হলো। তাঁরা একট ধর্মভীরু মানুষ, পশ্চিম বাংলার সঙ্গে গলা মেলাতে তাঁদের রাজনৈতিক অসুবিধা ছিল, উভয় রাজ্যেই তখন কংগ্রেসি মন্ত্রিসভা। এই অবস্থায় অতিরিক্ত রাজস্ব সংগ্রহের স্বার্থে বিশেষ একটি কৌশল অবলম্বনে বাধ্য হলাম। খনির উপর রাজ্য সরকারগুলির কর বসানোর সাংবিধানিক অধিকার নেই, কুছ পরোয়া নেই, যেহেতু ভূমি ও ভূমিব্যবস্থা রাজ্যের এখতিয়ারে, খননযোগ্য ভূমির উপর ঢালাও উন্নয়ন শুল্ক আরোপের প্রস্তাব বিধানসভায় উপস্থাপন করা হলো, সঙ্গে-সঙ্গে তা মঞ্জুরও হয়ে গেল, রাজস্বসংগ্রহের একটি নতুন উৎস এখন থেকে উন্মুক্ত; রয়্যালটি থেকে যে-যৎসামান্য উপার্জন হতো, এই সূত্র থেকে সংগ্রহের সম্ভাব্য পরিমাণ তার চেয়ে ঢের বেশি। কেন্দ্রীয় সরকার আমাদের এই নবব্যবস্থা সংবিধান-বহির্ভূত দাবি করে সুপ্রিম কোর্টে মামলা রুজু করেছিলেন, সে মামলা টেকেনি। পশ্চিম বাংলাকে জব্দ করবার উদ্দেশ্যে কেন্দ্র কর্তৃক তখন সিদ্ধান্ত ঘোষণা করা হলো, যে-যে রাজ্য খনিজ জমির উপর উন্নয়ন শুল্ক বসাবে, তাদের আর কয়লা থেকে প্রাপণীয় রয়্যালটি দেওয়া হবে না। আইনজ্ঞ নই, তবু আমার দৃঢ় ধারণা এই সিদ্ধান্তটিও সুপ্রীম কোর্টের বিচারে খারিজ হতে পারতো: আর কিছু না হোক, সংবিধানের চোদ্দো সংখ্যক ধারা অনুযায়ী নাগরিকে-নাগরিকে পৃথগীকরণ যেমন সংবিধান-সম্মত নয়, রাজ্যগুলির মধ্যে বিভেদীকরণও সমান অবৈধ। কুছ পরোয়া নেই, ততদিনে বেশ কয়েক বছর গড়িয়ে গেছে, আমি আর সরকারে নেই, বাইরে থেকে শুধু দার্শনিকের ভূমিকা পরিপালন করে গেছি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *