তেইশ
যবনিকা অনেকদিন ধরেই কম্পমান ছিল, জুন মাসের মাঝামাঝি এলাহাবাদ হাইকোর্টের বিচারকের রায়ে অনিশ্চয়তা ঘুচে গেল। নির্বাচনসংক্রান্ত অপরাধ, তার দায়ে ইন্দিরা গান্ধির, পাঁচ বছরের জন্যই বোধহয়, নির্বাচনে দাঁড়ানো নিষিদ্ধ, একাত্তর সালে লোকসভায় তাঁর নির্বাচনও সেই সঙ্গে খারিজ। হই হই ব্যাপার, সারা দেশে চাপা উত্তেজনা, হর্ষপ্রকাশও সঙ্গে-সঙ্গে; এবার মহিলা সত্যিই খুব ফাঁপরে পড়েছেন, নিজেকে উদ্ধার করবেন কী করে, তা নিয়ে জল্পনা। এই প্রথম আমরা প্রধান মন্ত্রীর দ্বিতীয় পুত্র সম্পর্কে কানাঘুষো সর্বত্র ছড়িয়ে, সে নাকি প্রবীণ রাজনৈতিক নেতাদের সরিয়ে দিয়ে, বাঘা-বাঘা আমলাদের দূরে রেখে, জননীর প্রধান পরামর্শদাতা হিশেবে আত্মপ্রকাশ করেছে, তার হুকুমেই নাকি ভারতবর্ষ চলছে, সে হাতে গলা কাটে, তার অনেক সমাজবিরোধী সাঙ্গোপাঙ্গ, তারা দিল্লিতে দৌরাত্ম্য করে বেড়াচ্ছে, কারও টুঁ শব্দটি করবার সাহস নেই। অনেক গুজব শোনা যেতে লাগলো। ইন্দিরা গান্ধির দ্বিতীয় পুত্রের গোড়ায় নাকি নামকরণ হয়েছিল সঞ্জীব, রাজধানীতে কোনও গাড়ি চুরির ঘটনায় সে গ্রেফতার হয়, পুলিশের খাতায় নাম ওঠে, যথা নিয়মে তাঁকে ছাড়িয়ে আনা হয়, তবে দাগী আসামী হিশেবে একবার চিহ্নিত হলে নানা ধরনের অসুবিধা, সেজন্যই, জনশ্রুতি, তার নাম পাল্টে রাখা হয় সঞ্জয়। একটি ছোটো ঘটনার কথা হঠাৎ আমার মনে এলো। কী কারণে যেন একাত্তর সালের কোনও সময় ইন্দিরা গান্ধি আমাকে অর্থমন্ত্রক থেকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। সাউথ ব্লকে তাঁর দফতরে পৌঁছে শুনি, ভিতরে হাকসার ও শিল্পোন্নয়ন সচিব ভৈরবদত্ত পাণ্ডে—বছর দশেক বাদে যিনি পশ্চিম বঙ্গের রাজ্যপাল হয়েছিলেন—প্রধান মন্ত্রীর সঙ্গে আলোচনারত, আমাকে অপেক্ষা করতে হবে। প্রায় এক ঘণ্টা পেরিয়ে গেল, তা-ও ওঁরা বেরুচ্ছেন না, প্রধান মন্ত্রী তলব করেছেন, দেখা না-করে ফিরেও আসতে পারি না, অবশেষে তাঁরা দু’জনে যখন নিষ্ক্রান্ত হলেন, উভয়েরই মুখ থমথমে। ইন্দিরা গান্ধির ঘরে ঢুকে আবিষ্কার করি তিনিও উত্তেজিত। মুখ লাল, আমাকে দেখেই সুতীক্ষ্ণ প্রশ্ন, প্রশ্ন না বলে অভিযোগ বলাই ভালো: ‘তুমি বলো তো, আমলারা আমার ছেলেকে এত অপছন্দ করে কেন?’ রামমোহন রায়ের ব্রহ্মসংগীত-পরিবেশিত উপদেশ ধারণ করে আমি অবশ্য নিরুত্তর রইলাম। পরে হাকসারের কাছ থেকে ঘটনার বিবরণ পেলাম, কিন্তু টুকরো-টুকরো, ঠিক বিবরণও নয়, আভাস: হাকসার কখনও ভুলক্রমেও ভিতরের কথা বাইরে বলতেন না, আমাদের মতো নিকটজনকেও না। যতটুকু শুনতে পেলাম, প্রধান মন্ত্রীনন্দনের শখ হয়েছে, সে সরকারি অর্থে, কিন্তু তার নিজের একচ্ছত্র ব্যবস্থাপনায়, উত্তর প্রদেশে একটি গাড়ি তৈরির কারখানা খুলবে, গাড়ির নামও ঠিক হয়ে গেছে—মারুতি—কিন্তু পাণ্ডে বিবেকবান রাজপুরুষ, তাতে সম্মত হননি, হাকসারের সঙ্গে পরামর্শ করে প্রধান মন্ত্রীকে বলতে গিয়েছিলেন, আপাতত গাড়ি তৈরির প্রস্তাবটি মুলতুবি থাকুক, সঞ্জয়কে স্কুটার্স ইন্ডিয়া, দ্বিপদবিশিষ্ট চালকযন্ত্র তৈরি করার কারখানা, বরঞ্চ উপঢৌকন দেওয়া হোক। ছেলেরা তাঁর চোখের মণি, প্রধান মন্ত্রী রাজপুরুষদের কথা শুনে ক্রোধে দিগ্বিদিকজ্ঞানশূন্য, অতি তীক্ষ্ণকণ্ঠে নাকি ভর্ৎসনা করেছিলেন হাকসার ও পাণ্ডেকে, শাণিত বাক্যবাণে বিদ্ধ করেছিলেন।
এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায় বেরোবার পরমুহূর্ত থেকে সঞ্জয় গান্ধি তার মাতার একমাত্র উপদেষ্টা, সঙ্গে অবশ্য ফেউ ছিল প্রচুর। সঞ্জয় মাকে জানালো, এসব রায়-ফায় তুচ্ছাতিতুচ্ছ ব্যাপার, বিচারকরাও তাঁর জননীর শত্রুপক্ষের সঙ্গে ভিড়ে গেছে, পুলিশকর্তা ও সেনাধ্যক্ষদের তিনি ডাকুন, তাঁদের নির্দেশ দেওয়া হোক যেন প্রতিপক্ষীয়দের, বিচারকমণ্ডলীসুদ্ধু, ঠান্ডাই-মাণ্ডাই সহযোগে জীবনের মতো স্তব্ধ করে দেওয়া হয়। প্রধান মন্ত্রী তখনও অব্যবস্থিতচিত্ত, কংগ্রেস দলের মধ্যে অনেকেই তাঁকে, কিছুটা ভয়ে-ভয়ে, অন্য পরামর্শ দিচ্ছেন, বিচারব্যবস্থাকে হেলাফেলা করা অনুচিত ও অসাংবিধানিক হবে এমনধারা কথা ঘুরিয়ে-ফিরিয়ে বলে। তাঁর অন্যতম প্রধান পরামর্শদাতা, ডি পি ধর, অনেকদিন থেকে কর্কট রোগে ভুগছিলেন, এলাহাবাদ আদালতের রায় যেদিন বেরোলো, সেদিনই মারা গেলেন। পরমেশ্বর হাকসার ততদিনে যোজনা কমিশনে নির্বাসিত; তাঁর সঙ্গে, সম্ভ্রমের সঙ্গে হলেও, কেউ তর্ক জুড়বে তা ইন্দিরা গান্ধি একেবারেই পছন্দ করছিলেন না, তাঁর কাম্য নিষ্কলুষ জো-হুকুম রাজ, হাকসারকে তাই সরিয়ে দিয়েছিলেন, কিংবা ইঙ্গিত পাওয়া মাত্র হাকসার হয়তো নিজে থেকেই সরে গিয়েছিলেন।
কংগ্রেসের বিভিন্ন নেতাবৃন্দের পরামর্শে প্রধান মন্ত্ৰীজী হয়তো বা একটু থমকে গেলেন, এলাহাবাদ হাইকোর্টের রায়ের বিরুদ্ধে সুপ্রিম কোর্টে প্রার্থনা জ্ঞাপন করলেন, সর্বোচ্চ আদালতে তখন গ্রীষ্মবকাশ শুরু হয়ে গেছে, অবকাশকালীন বিচারক কৃষ্ণ আয়ার, তাঁর ধরি মাছ-না ছুঁই পানি রায়, বিষয়টি পরে সুপ্রিম কোর্টে বিশদ আলোচনা হবে, আপাতত ইন্দিরা গান্ধি প্রধানমন্ত্রী থেকে যেতে পারবেন, কিন্তু লোকসভায় ভোট দেওয়ার অধিকার থাকবে না তাঁর।
এরকমই একটি সুযোগ খুঁজছিলেন ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর বিদূষকবৃন্দ। তাঁর ঘনিষ্ঠ আইনজ্ঞরা দিল্লিতে জড়ো হলেন, সংবিধানের জরুরি অবস্থা সংক্ৰান্ত ধারাগুলি চুলচেরা বিচার করা হলো, জরুরি অবস্থা ঘোষণার খসড়া প্রস্তুত, ২৫-২৬ জুন মধ্যরাতে বশংবদ রাষ্ট্রপতি ফখরুদ্দিন আলি আহমেদ্ তাতে সই করলেন, মন্ত্রিসভার বৈঠক ডাকা হলো ভোররাতে। তবে তার আগেই গোটা দেশ জুড়ে ধরপাকড় শুরু হয়ে গেছে। সংবাদপত্রগুলির দফতর দিল্লির যে-অঞ্চলে, সেখানে বিদ্যুৎব্যবস্থা কেটে দেওয়া হলো, যাতে খোদ রাজধানীতেও কোনও খবর না বেরোয়, দেশের অন্যান্য জায়গাতেও খবর পৌঁছুলো অনেক দেরিতে। সারারাত ধরে দেশময় পঞ্চাশ হাজার কি এক লক্ষ, ঠিক কত, তথাকথিত ইন্দিরাবৈরীদের ধরপাকড় করা হয়েছিল, তখনও হিশেব ছিল না, এখনও নেই। শুধু এটা বলা চলে শত্রু বাছতে ইন্দিরা গান্ধির অনুচরবর্গ কোনও পক্ষপাত দেখাননি, এমনকি কংগ্রেস ওয়ার্কিং কমিটির একজন-দু’জন সদস্যকে পর্যন্ত জেলে পুরে দিয়েছিলেন।
মন্ত্রিসভার বৈঠক তো নেহাতই দায়সারা ব্যাপার, মন্ত্রীদের মধ্যে এমন একজনও ছিলেন না যিনি প্রধান মন্ত্রীর মুখের উপর কথা বলতে পারেন। আর ইংরেজদের শিখিয়ে দেওয়া নিয়মনিষ্ঠার ধারাবাহিকতা, আমলাতন্ত্র তো সর্ব ঋতুতেই সাষ্টাঙ্গপ্রণত।
প্রায় বিকৃত, কঁপা-কাঁপা কণ্ঠে প্রভাতকালে জাতির উদ্দেশে ইন্দিরা গান্ধি ভাষণ দিলেন: ষড়ষন্ত্র চলছিল, দেশের সংবিধান উৎখাত করার বন্দোবস্ত হচ্ছিল, তিনি ঠিক সময়ে ধরতে পেরেছেন, এখন নিজেদের স্বার্থে জাতিকে অনুশাসন পর্বের মধ্য দিয়ে যেতে হবে, বিভেদকারী রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্ম বন্ধ রাখতে হবে, যারা ষড়যন্ত্র করছিল তাদের ইতিমধ্যেই কিছু-কিছু গ্রেফতার করা হয়েছে, আগামী কয়েকদিনে আরও করা হবে, এই ভয়ংকর মুহূর্তে ব্যক্তিস্বাধীনতা, বাক্স্বাধীনতা, সংবাদপত্রের স্বাধীনতা ইত্যাদি দেশের স্বার্থের পক্ষে হানিকর, তাই সর্বক্ষেত্রে নিয়ন্ত্রণ ব্যবস্থা চালু করা হচ্ছে, সবাইকে শৃঙ্খলা ও নিয়ম মেনে চলতে হবে, নির্দিষ্ট সময়ে দফতরে আসতে হবে, দফতর থেকে যেতে হবে; যারা এসব অনুশাসন মানবে না, তাদের বিরুদ্ধে কঠোরতম ব্যবস্থা গ্রহণ করা ছাড়া উপায় নেই।
পশ্চিম বাংলায় তেমন একটা হেরফের বোঝা গেল না, চার-পাঁচ বছর ধরে এখানে এমনিতেই জরুরি অবস্থা। হাজার-হাজার নারী-পুরুষ বিনা বিচারে কারাকক্ষে নিক্ষিপ্ত, সামলে-সুমলে মিটিং-মিছিল করতে হতো, অবশ্য মাঝে-মধ্যে রাজবন্দীদের মুক্তির দাবিতে মিছিল বের হয়েছে, কিন্তু সে-সব তেমন বড়ো আকারে না-হওয়াতে সরকারের পক্ষ থেকে দৃক্পাত করা হয়নি। প্রথম সারির রাজনৈতিক ব্যক্তিত্ব এ সমস্ত মিছিলে যোগ দিতেন না, কৌশলগত কারণে প্রধান-প্রধান বামপন্থী রাজনৈতিক দলের নেতা-কর্মীরাও অনুপস্থিত, যাঁরা নিয়মিত আসতেন তাঁদের মধ্যে থাকতেন, এখন যা মনে পড়ছে, বিবেকানন্দ মুখোপাধ্যায়, জ্যোতি ভট্টাচার্য, বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, হীরেন বসু গোছের মানুষেরা, এবং কিছু-কিছু অধ্যাপক-শিক্ষকবৃন্দ।
তবে ছাব্বিশে জুন থেকে সব মিছিল বন্ধ, সব সভাও। বই বা যে-কোনও রচনা ছাপবার আগে সরকারি অনুমতি নিতে হবে। দৈনিক পত্রিকার প্রতিটি পৃষ্ঠার প্রতিটি কোলামে সেন্সরের অনুমতি ছাড়া কোনও-কিছু ছাপা চলবে না। লোকসভার সদস্য জ্যোতির্ময় বসুর উপর ইন্দিরা গান্ধির বিশেষ রাগ ছিল, তিনি প্রথম দফাতেই ধরা পড়লেন, ধরা পড়লেন মার্কসবাদী কমিউনিস্ট পার্টির বহু নেতা, একমাত্র কয়েকজন বাইরে, অন্যান্য বিরোধী দলেরও বেশ কয়েক হাজার নেতা-কর্মী গ্রেফতার হয়ে গেলেন। তিন দশক বাদে ভারতবর্ষের কারাগারগুলিতে আর একবার জনসংখ্যা বৃদ্ধি পেল। তখনও দূরদর্শন তেমন চালু হয়নি, বেতার ভরসা, তাতে শুধু সরকারের গুণকীর্তন, খবরের কাগজগুলি সেন্সরের কবলে, সরকারবিরোধী যে-কোনও সংবাদ প্রকাশিত হবার উপায় নেই। এই পরিস্থিতিতে যা হওয়া স্বাভাবিক, তাই-ই ঘটতে শুরু করলো, মুখে-মুখে গুজব ছড়ালো, সে সব গুজব কী পরিমাণ সাচ্চা, কী পরিমাণ অলীক, নির্ণয় করার উপায় নেই। জরুরি অবস্থা ঘোষণার দু’-একদিনের মধ্যেই একটা খবর বেরোলো, এলাহাবাদ হাইকোর্টের জনৈক বিচারকের দুর্ঘটনায় মৃত্যু, নাম মুকুন্দবিহারী লাল বা ওরকম কিছু, তিনিই ইন্দিরা গান্ধির বিরুদ্ধে রায় দিয়েছিলেন কিনা, এবং সেই হেতু তাঁর অপমৃত্যু কিনা, তা নিয়ে জনে-জনে জটলা।
ঠ্যাটা স্বভাব, চ্যাটাং চ্যাটাং কথা বলতে কোনওদিন তেমন পিছুপা হইনি, যে-কারণে জীবনে অনেক ধাক্কা খেয়েছি, জরুরি অবস্থা ঘোষণার পর দেশে কী ভয়ংকর পরিবেশ, বর্ণনা করে লন্ডনের ইকনমিস্ট পত্রিকায় রেজিষ্ট্রি করে হাওয়াই ডাকে চিঠি পাঠালাম, কোনও রাখা-ঢাকা নেই, সরকারকে ঢালাও সমালোচনা-নিন্দা করে, শেষ পঙ্ক্তি জুড়ে দিলাম, ‘এই চিঠি লেখার জন্যই হয়তো ইন্দিরার পুলিশ মাঝরাত্রিতে আমার দরজার ধাক্কা দেবে’। আমার চিঠিপত্র টাইপ করতেন যে-ভদ্রলোক, তিনি ভীষণ শঙ্কিত, ‘আর একবার ভেবে দেখুন স্যার, চিঠিটা নিজের নামে পাঠাবেন কিনা’।
পরে আই সি এস থেকে অবসরপ্রাপ্ত এক ভদ্রলোক আমাকে বলেছিলেন, ওই শেষ পঙ্ক্তিটি লিখেছিলাম বলেই কয়েদ হওয়া থেকে বেঁচে গেলাম, তবে সেই চিঠি নানা দেশে বহু লোক পড়লেন, ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর কনিষ্ঠ তনয়ের প্রতি বিরূপ মনোভাব সর্বত্র গভীরতর, ‘পৃথিবীর বৃহত্তম গণতন্ত্র’ স্বৈরাচারের অন্ধকারে ডুবে গেল, তা নিয়ে বিবিধ আক্ষেপ।
দেশের প্রকৃত কর্তা এখন থেকে সঞ্জয় গান্ধি, সে শৃঙ্খলার পক্ষে, নিয়মানুবর্তিতার পক্ষে, বড়ো লোকদের পক্ষে, দরিদ্রদের বিপক্ষে। নতুন দিল্লির বিভিন্ন প্রান্তে যে-গরিব উদ্বাস্তুরা তাঁবু খাটিয়ে কিংবা কোনওক্রমে একচালা-দোচালা-চারচালা তুলে দিনযাপন করছিলেন, অকস্মাৎ ট্যাংক-বুলডোজার চালিয়ে সেগুলি ধূলিসাৎ করা হলো, আর-একবার-উদ্বাস্তু-হওয়া মানুষদের ট্রাকে চাপিয়ে রাজধানীর সীমানার বাইরে কুড়ি-পঁচিশ মাইল দূরে ছেড়ে দেওয়া হলো, সেখানে পড়ে মরুক গে তারা। গরিবরা বেশি বাচ্চা বিয়োয়, তা নিয়েও সঞ্জয়ের ক্রোধ, ইতস্তত দরিদ্র নারী-পুরুষ, হাজার-লক্ষ, দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে ধরে নিয়ে এসে হাসপাতালে পুরে নির্বীজকরণ করা হলো, এ সমস্ত কীর্তিকর্মে সঞ্জয়ের প্রধান সহচর যে-রাজপুরুষ, এখন তিনি ভারতীয় জনতা পার্টির মস্ত নেতা, কেন্দ্রীয় মন্ত্রী। সার্বিক লক্ষ্য ছিল ত্রাস সৃষ্টি, তাতে প্রধান মন্ত্রীর কীচকবর্গ যথেষ্ট সফল হলো, তবে তারা ভুলে গিয়েছিল, ইন্দিরা গান্ধিও স্বয়ং ভুলে থেকেছেন, যে ত্রাস-ভয়-আতঙ্ক চিরকালীন অনুভূতি নয়, সে-সব ছাপিয়ে একটা সময়ে বিরক্তির উদ্রেক হয়, বিরক্তি রাগে পরিণত হয়, সেই রাগ আরও কিছুকাল গড়ালে অপ্রতিরোধ্য আবেগের রূপ নেয়, তারপরে সারা দেশের মানুষের সমন্বিত বিস্ফোরণ।
কত মানুষজনের উপর অবর্ণণীয় অত্যাচার হয়েছে সে-সময়, আমার ব্যক্তিগত অভিজ্ঞতা তুলনায় অতি তুচ্ছ। ইকনমিক এ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি-তে কলকাতা ডায়েরি সপ্তাহে-সপ্তাহে লিখে আসর জমিয়েছিলাম, ক্রুদ্ধ সব লেখা, কিন্তু নিছক আবেগসর্বস্ব নয়, আবেগের সঙ্গে সম্ভবত কিছুটা যুক্তির সংশ্লেষ, যে-নকশালপন্থীরা প্রতি সপ্তাহে খুন বা নিরুদ্দেশ হয়ে যাচ্ছে, তাদের নিয়ে লেখা, সি পি আই এম-সহ অন্যান্য বামপন্থীদের যে অত্যাচার করে শেষ করা যাবে না, সে সম্পর্কে লেখা, কখনও, স্বাদ বদলাবার জন্য, কাব্য-সাহিত্য নিয়ে রচনা অথবা অভিনেতা-অভিনেত্রীদের বা শিল্পী-ক্রীড়াবিদদের নিয়ে, সে-সব লেখায় ইতস্তত অর্থনীতি থাকত, কৃষিসমস্যা নিয়ে হয়তো আলোচনা থাকতো, কিংবা শিল্পসংকট বিষয়ে বিস্তৃত হতাম মাঝে-মাঝে, তা ছাড়া সদ্য প্রয়াত কোনও বন্ধু-নায়ক-সাহিত্যিক-ঐতিহাসিক-ধনবিজ্ঞানীদের নিয়েও আবিষ্ট প্রবন্ধ। কলকাতায় কোনওদিনই ই পি ডাব্লিউ-র তেমন কদর নেই, কলকাতা ডায়েরিরও নেই কিন্তু দিল্লি-মুম্বই-চেন্নাই-বাঙ্গালোর-তিরুবন্তপুরমে অনেক পাঠক-পাঠিকা লেখাটি নিয়মিত পড়তেন, বিদেশেও অনেকে। অনেক বন্ধু রঙ্গ করে বলতেন, ক্যালকাটা ডায়েরির কল্যাণে খুব শিগগিরই দেশ জুড়ে অশোকের ফ্যান ক্লাব তৈরি হবে। এটা অবশ্য আংশিক ঠিক: যাঁরা আমার বক্তব্য পছন্দ করতেন না, তাঁরাও কলকাতা ডায়েরি-র জন্য প্রতি সপ্তাহে প্রতীক্ষায় থাকতেন, রাজনৈতিক নেতা, ভারি-মাপের আমলা, শিল্পপতি প্রমুখ। বিশিষ্ট ব্যবসায়ী, জাতীয় যোজনা পরিষদের সদস্য ছিলেন, পরে মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ভারতের রাষ্ট্রদূত হয়ে যান, গগনবিহারীলাল মেহতা, প্রথম জীবনে বহুকাল কলকাতায় কাটিয়েছেন, তাঁর তিন কন্যা গড় গড় করে বাংলা বলে, দু’জন বাঙালি বিয়েও করেছে, জ্যেষ্ঠ কন্যা নীলাঞ্জনা আমাদের ঘনিষ্ঠ বন্ধু, একবার দেখা হতে গগনবিহারীলাল মজা করে বলেছিলেন: ‘তুমি যা লেখো আমার ঘোর অপছন্দ, কিন্তু প্রতি সপ্তাহে তোমার লেখা না-পড়ে থাকতে পারি না’।
জরুরি অবস্থার প্রথম সপ্তাহে কলকাতা ডায়েরিতে কী লিখবো, কেমন করে লিখবো, ভেবে পাচ্ছিলাম না, হঠাৎ একটি মতলব মাথায় এসে গেল, সেই সপ্তাহের লেখাটি শুরু করলাম এভাবে,: আসুন, একটু মুখ বদলানো যাক, ধ্রুপদী সাহিত্য থেকে আমাদের অনেক কিছু জানবার-শেখবার আছে। এই গৌরচন্দ্রিকার পরেই লুই বোনাপার্টের অষ্টাদশ ব্রুমেয়ার থেকে দীর্ঘ উদ্ধৃতি, অনুচ্ছেদের পর অনুচ্ছেদ, স্বৈরাচার ও অত্যাচারের বিরুদ্ধে আগাপাশতলা কশাঘাত। মুম্বই শহরের সেন্সরের পক্ষে ব্যাপারটি হৃদয়ঙ্গম করা সোজা হলো না, মার্কসের গ্রন্থাবলী ক’জনের পড়া, তিনি ছাড়পত্র দিয়ে দিলেন, মহা উৎসাহে কৃষ্ণরাজ ই পি ডাব্লিউ-তে তা ছাপালো, পত্রিকা বেরিয়ে বিলি হতে দিন দুই সময় লাগলো, তারপর দিল্লি-মুম্বইয়ের কর্তাব্যক্তিদের চক্ষুস্থির, তাঁরা তো ভয়ে কাঠ, সঞ্জয় গান্ধির লেখাপড়ার সঙ্গে সম্পর্ক ছিল না, তবে ইন্দিরা গান্ধি তো পত্রিকাটি দেখেন, শচীন চৌধুরীর সঙ্গে তাঁর পরিচয় ছিল, সুতরাং পরের সপ্তাহ থেকে কলকাতা ডায়েরির প্রকাশ বন্ধ হয়ে গেল, ইন্দিরা গান্ধি আমাকে নীরব করে দিলেন।
আরও মজা ঘটলো কয়েক সপ্তাহ বাদে। আমার বিশিষ্ট বন্ধু কৃষিবিশেষজ্ঞ ওল্ফ্ লাডিজেনস্কির প্রয়াণের খবর পেলাম। লাডিজেনস্কির জন্ম রাশিয়াতে, কোন সালে কী অবস্থায় তিনি মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে পৌঁছেছিলেন, সেখানকার নাগরিকত্ব গ্রহণ করেছিলেন, ইত্যাদি আমার জানা নেই, কিন্তু দরিদ্র জনগণের প্রতি সমমর্মিতায় তাঁর জুড়ি দেখিনি। দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের পর জেনারেল ম্যাকার্থার লাডিজেনস্কিকে জাপানে নিয়ে গিয়েছিলেন, যুদ্ধোত্তর জাপানে যে আমূল ভূমিসংস্কার, যার ভিত্তিভূমিতে দাঁড়িয়ে ওই দেশের ক্ষিপ্রতম গতিতে আর্থিক উন্নয়ন, তা সম্পূর্ণ লাডিজেনস্কির প্রতিভা-পরামর্শ-প্রসূত। মার্কিন সরকার তাঁকে ইরানেও পাঠিয়েছিলেন, ওদেশেও অনুরূপ ভূমিসংস্কারের ব্যবস্থার জন্য। শাহ্ পেহলভি ভদ্র ব্যবহার করেছিলেন, কিন্তু লাডিজেনস্কির একটি কথাও শোনেননি; যদি শুনতেন, হয়তো তাঁকে সিংহাসনচ্যুত হতে হতো না। ষাটের-সত্তরের দশকে লাডিজেনস্কি বিশ্ব ব্যাঙ্কের তরফ থেকে কিছুদিন ভারতবর্ষে কাটিয়ে গিয়েছিলেন, বিশ্ব ব্যাঙ্কের মতামতের সঙ্গে তাঁর আদৌ সাযুজ্য ছিল না, তবে তাঁর অনেক গুণগ্রাহী ব্যাঙ্কের আশেপাশে ছিলেন, আর ভারতবর্ষের ভূমিব্যবস্থা সম্পর্কে তাঁর নিজের আগ্রহও ছিল, তাই নিছক পরামর্শদাতা হিশেবে ওঁদের আতিথ্যে এ দেশে এসেছিলেন। গোটা দেশ চষে বেড়িয়েছেন, ভারতবর্ষের অনগ্রসরতার প্রধান কারণ যে ভূমিসংস্কারের অনুপস্থিতি তা নিয়ে তাঁর বিন্দুমাত্র সংশয় ছিল না। বিশেষত বিহারের বাতাইদার—আমাদের পরিভাষায় ভাগচাষী—সম্প্রদায়ের উপর যে অবর্ণনীয় অত্যাচার জমিদারশ্রেণী যুগ-যুগ ধরে করে গেছেন, সে-সম্পর্কে একটি অবিস্মরণীয় প্রতিবেদন লাডিজেনস্কি রচনা করেছিলেন, যা এখনও মাঝে-মাঝে পেড়ে পড়ি।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার মাসখানেক বাদে লাডিজেনস্কির মৃত্যুসংবাদ পেলাম, অনেক বয়স হয়েছিল, সুতরাং তাঁর প্রয়াণের খবরে বিস্ময়ের কিছু ছিল না। কৃষ্ণরাজের সঙ্গে টেলিফোনে কথা হলো, ই পি ডাব্লিউ-র জন্য লাডিজেনস্কির উপর একটি ছোটো লেখা লিখে পাঠালাম। এখানেই মুশকিল ঘটলো। পশ্চিম বঙ্গের কৃষিসমস্যা ও কৃষি আন্দোলন নিয়ে লাডিজেনস্কি বিশেষ উৎসাহী ছিলেন, যতবার আমি দিল্লি থেকে কলকাতায় এসেছি, আমাকে বলতেন খোঁজ নিতে মুজফ্ফর আহমদ অথবা হরেকৃষ্ণ কোঙারের কোনও নতুন বই বেরিয়েছে কিনা, বেরিয়ে থাকলে আমি যেন নিয়ে আসি, বাংলায় লেখা হলেও ক্ষতি নেই, তিনি কাউকে দিয়ে সারাংশ উদ্ধার করে নেবেন। ইকনমিক এ্যান্ড পলিটিকাল উইকলি-র জন্য যে-স্মরণিকা লিখলাম, তার এক জায়গায় মন্তব্য জুড়ে দিলাম, ‘হি ওয়াজ নো আইডিয়োলগ, বাট হি ওয়াজ নট অ্যাফ্রেড অফ আইডিয়োলজ আইদার’। এটাও উল্লেখ করলাম যে কলকাতা থেকে তিনি আমাকে দিয়ে প্রায়ই মুজফ্ফর আহমদ ও হরেকৃষ্ণ কোঙারের লেখা বইপত্তর আনিয়ে নিতেন। মুম্বাইয়ের সেন্সরের কাছ থেকে লেখাটি ফিরে এলে দেখা গেল ‘হি ওয়াজ নো আইডিয়োলগ, বাট হি ওয়াজ নট…’ এর পরবর্তী পঙ্ক্তিগুলি নির্মমভাবে কাঁচি চালিয়ে ছেঁটে দেওয়া হয়েছে। হারভার্ড বিশ্ববিদ্যালয় থেকে পরে লাডিজেনস্কির সম্পূর্ণ রচনাবলী প্রকাশ করা হয়। সম্পাদক তাঁর মুখবন্ধে আমার লেখাটির যতটুকু ছাপা হয়েছিল পুরোপুরি তুলে দিয়েছেন, সেই গ্রন্থ খুলে যে-কেউ এখন আবিষ্কার করতে পারেন আমার রচনা, ‘হি ওয়াজ নো আইডিয়োলগ, বাট হি ওয়াজ নট…’ মন্তব্যের কপালে কী জুটেছিল। কী আর করা যাবে, ইন্দিরা গান্ধি স্বাধীন চিন্তা-ভাবনাকে যে অপছন্দ করতেন। জরুরি অবস্থায় রবীন্দ্রনাথকেও নিষিদ্ধ ঘোষণা করেছিলেন, কিন্তু শান্তিনিকেতনে স্থিত তাঁর পদলেহনকারী সম্প্রদায়ের তাতে কোনও ভাববিকার হয়নি।
অমর্ত্যের উৎসাহে ও-বছরের এপ্রিল মাসে সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় থেকে চিঠি পেয়েছিলাম ওখানকার ইন্সটিটিউট অফ ডেভেলপমেন্ট স্টাডিজে এক বছরের জন্য অতিথি অধ্যাপক হয়ে যেতে রাজি আছি কি না, আমন্ত্রণ গ্রহণও করেছিলাম। ইতিমধ্যে ইন্দিরা গান্ধির জরুরি কাণ্ড, আমি যে-ধরনের লেখালেখি করি দেশে তার সুযোগ বন্ধ। জ্যোতিবাবুকে জিজ্ঞাসা করলাম, তিনি জানালেন আমি ও সময়ে বিলেত গেলে তাঁদের সুবিধাই হবে, দেশে আমি বক্তৃতা দিতে পারবো না, লিখতেও পারবো না, বরঞ্চ বিলেতে-ইওরোপে জরুরি অবস্থার অত্যাচারের বিরুদ্ধে যে-আন্দোলন, তাতে সক্রিয় অংশগ্রহণ করতে পারবো। অক্টোবরের প্রথম সপ্তাহে বিলেত চলে গেলাম, সস্ত্রীক। জ্যোতিবাবু পার্টি-সংক্রান্ত কিছু নথিপত্র সঙ্গে দিলেন।
সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয় খোদ ব্রাইটন শহরের একটু উপকণ্ঠে, আমরা বাড়ি খুঁজে নিলাম আরও একটু দূরে, রিংমার নামে এক মনোমোহিনী গ্রামে। বাড়িওলা বিশ্ববিদ্যালয়েরই শিক্ষক, এক বছরের জন্য অস্ট্রেলিয়া না নিউজিল্যান্ড কোথায় যাচ্ছেন পড়াতে, গাড়ি-সহ বাড়ি পেলাম, পরিবহন সমস্যাও মিটলো। সাসেক্স অঞ্চল নিসর্গ সৌন্দর্যে ঠাসা, সমুদ্র আছড়ে পড়ছে গোটা উপকূল জুড়ে, সবুজে-সমাচ্ছন্ন নিচু মালভূমির পর মালভূমির ঢল, লন্ডনের হতকুচ্ছিত গোমড়ামুখ বৃষ্টি-কুয়াশাও নেই, বরফ তিন কালে একবার পড়ে। ওখানে থাকা এক হিশেবে তাই ভারি আরামদায়ক ছিল। পুরনো বন্ধু রণজিৎ গুহকে নতুন করে পেলাম, অনুজপ্রতিম প্রমিত চৌধুরীও ওখানে; তা ছাড়া ওই একবছর অঢেল সাহায্য করেছিল অতি-প্রতিভাবান তরুণ অর্থনীতিবিদ দীপক নায়ার ও তার স্ত্রী রোহিণী। দীপক এখন দিল্লি বিশ্ববিদ্যালয়ের উপাচার্য, তাদের দু’জনের সৌজন্য এখনো বহমান। সাসেক্স বিশ্ববিদ্যালয়ে প্রচুর বিদেশী ছাত্রছাত্রী ও অধ্যাপকদের সমাগম, শৌখিন ইওরোপীয় বামপন্থার একটা আমেজ অনেকের মধ্যে, প্রচুর নতুন পরিচয় হলো। তা হলেও গোটা পরিবেশ আমাকে স্বাচ্ছন্দ্যের চেয়ে অস্বাচ্ছন্দ্যই বেশি দিয়েছে। ইংরেজ জাতির মধ্যে ক্রমশ কূপমণ্ডূকতা অনুপ্রবেশ করেছে, এমনকি মস্ত উদারচরিত নারী-পুরুষরা পর্যন্ত তাঁদের সাম্রাজ্যবাদী ঐতিহ্যের কথা ভুলতে যথেষ্ট সময় নিচ্ছেন। সহকর্মীদের মধ্যে দিল্লি ও ব্যাংককে আমার পূর্ব-পরিচিত, একদা-জর্মান, বর্তমানে বৃটিশ পাসপোর্ট-নেওয়া প্রবীণ অর্থনীতিবিদ হান্স সিঙ্গারের সাহচর্য অবশ্য অত্যন্ত আনন্দ দিয়েছিল। কেমব্রিজ-অক্সফোর্ড-লন্ডন-গ্লাসগো-ব্রিস্টল-নরউইচ ইত্যাদি বিশ্ববিদ্যালয়ে বক্তৃতা দিয়েও মুখ বদলানোর খানিক সুযোগ পেয়েছিলাম।
তবে বেশির ভাগ সময়ই ওই ক’টা মাস কেটেছে রাজনৈতিক ক্রিয়াকর্মে। ভালো লেগেছিল উত্তর ইংল্যান্ডে ইয়র্কশায়ার-ল্যাঙ্কশায়ার অঞ্চলে ভারতীয় শ্রমজীবী মানুষদের কাছে গিয়ে। শাদামাটা সরল মানুষ, বামপন্থী, আদর করে তাঁদের ঘরে তুলেছেন, শ্রদ্ধার সঙ্গে অনুরাগ মিশিয়ে, সেরকম অতিথিরূপে রাত্রিবাসের একটি-দু’টি স্মৃতি এখনও মনের পটে উজ্জ্বল। এখানে-ওখানে ঘুরে বেড়িয়েছি ভারতবর্ষের রাজনৈতিক অবস্থা সম্পর্কে প্রবাসী ভারতীয়দের, এবং ইংরেজ জনসাধারণকে, সম্যক বোঝাতে। আমাদের দেশের সভা-সমিতির তুলনায় ওখানে মিটিংয়ের আকার ক্ষুদ্র, সেই কারণে, ঘন-ঘন, অনেক জায়গায় বলতে হতো, অপেক্ষাকৃত ছোটো-ছোটো জমায়েতে, এখানে-ওখানে গিয়ে।
বিশেষ চমৎকৃত হয়েছিলাম লন্ডনে ক্যাক্সটন হলে বক্তৃতা দিয়ে। এখানেই সেই ঊনিশশো চল্লিশ সালে জালিয়ানওয়ালাবাগের প্রতিশোধ হিশেবে উধম সিংহ পঞ্জাবের তৎকালীন গর্ভনর ও’ডায়ারকে হত্যা করেছিলেন। আরও একটি কারণে ক্যাক্সটন হলের সভার কথা এখনও মনে আছে। সভা-অন্তে এক বন্ধুর বাড়িতে গেছি, খানিক বাদে পাশের ঘর থেকে এক মহিলা বেরিয়ে এলেন, বার্ধক্যের ছাপ সারা শরীরে, মনের দিক থেকেও হয়তো মহিলা ক্লান্ত, কেমন নিঃঝুম হয়ে বসে রইলেন। শিহরিত হলাম জেনে ইনি কারমেল ব্রিঙ্কম্যান, যাঁকে সেই আটচল্লিশ সালে ঢাকা ও কলকাতায় বেশ কয়েকদিন ধরে দেখেছিলাম দক্ষিণ-পূর্ব এশিয়া যুব সম্মেলেন উপলক্ষে। কারমেলের ইংল্যান্ড থেকে ইন্দোনেশিয়ায় গমন পঞ্চাশের দশকের গোড়ায়, সেখানে এক ইন্দোনেশিয় কমরেডের পাণিগ্রহণ, পঁয়ষট্টি সালে দুজনেই মার্কিন-নির্দেশিত ফৌজি অভ্যুত্থানের শিকার, দশ বছর কারান্তরালে কাটিয়ে সদ্য মুক্তিপ্রাপ্ত কারমেল, পুরনো পরিচিতদের সঙ্গে দেখা করতে ইংল্যান্ডে কয়েক দিনের জন্য, অচিরে ইন্দোনেশিয়ায় ফিরে যাবেন। তার স্বামী তখনও ছাড়া পাননি, দু’জনকেই জেলখানায় প্রচুর অত্যাচারের সম্মুখীন হতে হয়েছে কিন্তু মার্কসীয় প্রজ্ঞা থেকে অপসরণ অকল্পনীয়। কারমেল জানালো, এখন ইন্দোনেশিয়াই তার স্বদেশ, সেখানে অবস্থান করে বে-আইনি কমিউনিস্ট পার্টির জন্য কাজ করে যাবে, যতদিন না ফের পুলিশ ও জঙ্গিবাহিনীর নজরে পড়ে।
যা দেশে থাকতে আদৌ অভ্যাস ছিল না, বিলেতে সংবাদপত্রের লোকজনদের ডেকে সাক্ষাৎকার দিতে শুরু করলাম। দেশের ভয়ংকর অবস্থা পৃথিবীর মানুষকে জানাতে হবে, তাই মিটিং-মিছিল যথেষ্ট নয়, যদিও হাইড পার্ক থেকে মিছিল করে ট্রাফালগার স্কয়্যার পর্যন্ত গিয়েছি স্বৈরাচারী ইন্দিরা গান্ধির বিনাশ কামনা করে। এই সংবাদপত্র-ওই সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকারের বন্যা বইয়ে দিলাম, লোকমত সঞ্চারের ক্ষেত্রে কিছুটা সাহায্য হয়তো হয়েছিল তাতে। লন্ডনে তখন আমাদের হাই কমিশনার ইন্দিরা গান্ধির জ্ঞাতি ব্ৰজকুমার (বি.কে) নেহরু, আমার সঙ্গে অতীতে সামান্য পরিচয় ছিল, লন্ডন থেকে ব্রাইটনে এক বন্ধু দেখা করতে এলেন, তাঁর সঙ্গে বি. কে. নেহরু কী ভেবে একটি উপদেশ-বাণী পাঠালেন: আস্ক অশোক টু একজামিন হিজ হেড। শুনে প্রচুর কৌতুক হলো।
পঁচিশে জুন জরুরি অবস্থার বর্ষপূর্তি। ইকনমিস্ট পত্রিকা থেকে অনুরোধ জানানো হলো, এই ভয়ঙ্কর সময়ের অভিজ্ঞতা নিয়ে একটি প্রবন্ধ পত্রিকাকে দিতে পারি কিনা। সম্মত হলাম, প্রবন্ধের খসড়া তৈরি করলাম, জরুরি অবস্থা দৃশ্যত ঘোর অপছন্দ করেন এমন-কিছু প্রবাসী ভারতীয়দের কাছ থেকে খসড়ার বয়ানের ত্রুটি-বিচ্যুতি-অম্পূর্ণতা-অস্পষ্টতা সম্পর্কে অভিমত চাইলাম, কোনও-কোনও ক্ষেত্রে তাঁদের অভিমত বিনয়ের সঙ্গে গ্রহণও করলাম। হঠাৎ খেয়াল হলো প্রবন্ধটি নিছক আমার নামে না-ছাপিয়ে এই ক’জন বন্ধুবান্ধদেরও যদি লেখক হিশেবে স্বাক্ষরযুক্ত করতে পারি, বক্তব্য আরও জোরালো হবে। ও হরি, তাঁরা নানা ওজর দেখিয়ে সই করা থেকে নিজেদের সরিয়ে রাখলেন, কারণগুলি এতই বালখিল্য যে আমার প্রায় হাসি পাচ্ছিল। তবে এ ব্যাপারে তেমন নিন্দামুখর হওয়ার যৌক্তিকতা নেই, অনেকেই আমরা ছাপোষা সংসারী মানুষ, অগ্রপশ্চাৎ বিবেচনা করতে ভালোবাসি।
দেশ ছাড়ার অব্যবহিত আগেও অনুরূপ একটি ব্যাপারে জড়িয়ে পড়েছিলাম। ত্রিবান্দ্রম থেকে জনৈক বন্ধু, খ্যাতনামা সমাজবিজ্ঞানী, বিশ্ববিদ্যালয়ে উপাচার্যও ছিলেন, অগস্ট মাসে আমাকে একটি আবেদনের খসড়া পাঠালেন, আবেদন রাষ্ট্রপতির কাছে: তিনি সমস্ত দিক বিবেচনা করে অবিলম্বে জরুরি অবস্থার ঘোষণা যেন অনুগ্রহ করে প্রত্যাহার করে নেন। বন্ধুটির অনুরোধ, আমি নিজে যেন সই করি, এবং সত্যজিৎ রায়ের স্বাক্ষর সংগ্রহ করতে যেন সাহায্য করি। টেলিফোন করে এক সকালে বিশপ লেফ্রয় রোডের ফ্ল্যাটে গেলাম, ওঁর যা চিরাচরিত নিয়ম, সত্যজিৎবাবু নিজে এসে দরজা খুলে দিলেন, সাদরে বসালেন, আগমনের কারণ খুলে বললাম, খসড়াটি ওঁকে পড়তে দিলাম। সেদিন ওঁর ব্যবহার ও আচরণ অতি চমৎকার লেগেছিল। পাঠান্তে আমার দিকে তাকিয়ে সত্যজিৎবাবু স্পষ্ট বললেন: ‘মশাই, আমার যে-বৃত্তি তাতে সরকারের উপর একান্ত নির্ভর করতে হয়, কাঁচা ফিল্মের জন্য তদ্বির করতে হয়, সেন্সরে ছাড় পাওয়ার জন্যও। সিনেমা হলের মালিকরাও সবাই-ই সরকারের বশংবদ। এই অবস্থায় এক কাজ করুন, আপনি রবিশঙ্কর বা আলি আকবরের কাছ থেকে একটা সই জোগাড় করে নিয়ে আসুন, তা হলে আমিও দ্বিধাহীন চিত্তে স্বাক্ষর জুড়ে দিতে পারি।’ এই খোলামেলা কথা আমাকে মুগ্ধ করেছিল, কারণ ওই সময়েই একজন-দু’জন কলকাতাস্থ ভদ্রলোকের কথা জানতাম, যাঁরা পুরোপুরি দু নৌকোর কাণ্ডারী, মুখে বিপ্লবী বাণী কপচাতেন, অথচ সরকারি প্রতিনিধিদলের সদস্য হয়ে রাশিয়া-আমেরিকাও ঘুরে বেড়াচ্ছেন, জরুরি অবস্থা ঘোষণা ও লক্ষ-লক্ষ নাগরিককে সরকারের তরফ থেকে জেলে পোরার পরেও।
এই বিশেষ জীবদের আমি ‘বহুরূপী’ আখ্যা দিয়েছিলাম: এঁরা টালিগঞ্জে নকশাল, কালীঘাটে সি পি আই এম, ভবানীপুরে দক্ষিণী কমিউনিস্ট, চৌরঙ্গীতে কংগ্রেস, বড়োবাজারে জনসংঘী। তখনও দিল্লিতে অবস্থান করছি, সত্তর-একাত্তর সালের রক্তাক্ত পরিস্থিতি, এক ভদ্রলোক কী কাজে দেশের রাজধানীতে এসে টালিগঞ্জ পাড়ায় বীভৎস পুলিশি অত্যাচারের ইনিয়ে-বিনিয়ে অনেক বর্ণনা শোনালেন। আমি সম্যক বিচলিত, ভদ্রলোককে বললাম, আমার সঙ্গে একটু প্রধানমন্ত্রীর দপ্তরে চলুন, আসল জায়গায় এই কথাগুলি আপনি বলুন, যাতে যথাযোগ্য ব্যবস্থা নেওয়া যায়। ভদ্রলোক মহা খুশি, সাউথ ব্লকে ক্ষমতার কেন্দ্রস্থলে যাওয়ার সুযোগ পেয়ে। কী আশ্চর্য, ভদ্রলোেক আসল জায়গায় পুলিশি অত্যাচার নিয়ে একটা কথাও বললেন না, ক্ষমতার সামীপ্যে গদগদ, একগুচ্ছ চাটুকারিতা দৃষ্টান্তিত করে এলেন।
সত্যজিৎ রায়কে সেদিন নমস্কার জানিয়ে চলে এসেছিলাম। আমার পক্ষে অবশ্য রবিশঙ্কর বা আলি আকবরের স্বাক্ষর সংগ্রহ করা সম্ভব হয়নি, ওঁদের সঙ্গে পরিচয় ছিল না বলে, বিশপ লেফ্রয় রোডে তাই আর প্রত্যাবর্তন করা হয়নি। নিজের সই-সম্বলিত খসড়া আবেদনপত্রটি ত্রিবান্দ্রমে বন্ধুর কাছে পাঠিয়ে দিলাম, সঙ্গে এটা যোগ করলাম, আবেদনপত্রে উল্লেখ থাকা প্রয়োজন, রাষ্ট্রপতি আমাদের অনুরোধ রক্ষা করতে অক্ষম হলে আমরা যাবতীয় সরকারি কমিটি বা কমিশন, যার সদস্য আছি, সমস্ত-কিছু থেকে পদত্যাগ করবো। কৌতুককর হতে পারে, হৃদয়বিদারকও হতে পারে, বন্ধুটির কাছ থেকে ওই চিঠির কোনও জবাব পেলাম না, আবেদনপত্রটির ভাগ্যে কী ঘটলো তা-ও অবগত হতে অসমর্থ হলাম। আমি অবশ্য তখন একমাত্র বাণিজ্যমন্ত্রকের অন্তর্গত বোর্ড অফ ট্রেডের সদস্য ছিলাম। জরুরি অবস্থার পরের দিন ছাব্বিশে জুনই সংশ্লিষ্ট মন্ত্রীকে লিখে আমার পদত্যাগের সিদ্ধান্ত জানিয়ে দিলাম। এটা উল্লেখ না-করা অসমীচীন হবে, বাঙালি মন্ত্রীমশাই অত্যন্ত ভদ্র জবাব দিয়েছিলেন, আমার বোর্ড অফ ট্রেড ছেড়ে দেওয়াতে তিনি আন্তরিক দুঃখিত, তবে মৎউল্লিখিত পদত্যাগের কারণ নিয়ে তিনি কোনও মন্তব্য করতে অপারগ।
ইকনমিস্ট-এ প্রবন্ধ পাঠানোর প্রসঙ্গে ফিরে যাই। আর কেউ তাঁদের নাম যুক্ত করতে সম্মত না-হওয়ায় লেখাটি একা নিজের নামেই পাঠিয়ে দিলাম, নির্দিষ্ট তারিখে পত্রিকায় ছাপা হলো, পত্রিকার সম্পাদকমণ্ডলী আমার নামের নিচে পরিচয় বসিয়ে দিলেন—প্রাক্তন মুখ্য অর্থনৈতিক উপদেষ্টা, ভারত সরকার।
জরুরি অবস্থা ঘোষণার ঠিক পরবর্তী মুহূর্তে পাঠানো চিঠি নিয়ে যথেষ্ট শোরগোল হয়েছিল, এবার হলো আরও ব্যাপকভাবে। নতুন দিল্লির নির্দেশে, ইকনমিস্ট ওই সংখ্যার সমস্ত কপি বাজেয়াপ্ত করবার ব্যবস্থা হলো, তা সত্ত্বেও কিছু-কিছু কপি ততদিনে দেশের মধ্যে এখানে-ওখানে অনেক লোকের চোখে পড়লো। বহু শুভানুধ্যায়ী আমাকে চিঠি লিখে পাঠালেন, জরুরি অবস্থা তো সহজে ঘুচবে না, আমার দেশে ফেরার পথ আমি নিজেই বন্ধ করে দিলাম। এ ধরনের ভর্ৎসনায় অবশ্য তেমন চিন্তার উদ্রেক হলো না।
বিলেতে এমন নামী পত্রিকায় প্রবন্ধটি ছাপা হয়েছে, যেন হাই কমিশনারেরই দায় এটা, কেন তিনি ইকনমিস্ট-কে ইত্যাকার অসভ্যতা থেকে বিরত করতে পারেননি, হয়তো দিল্লি থেকে এমন বার্তা এসেছিল। আমার প্রবন্ধের যথাযোগ্য উত্তর দিতে অতএব হাই কমিশন থেকে মহা আড়ম্বরে একটি খসড়া তৈরি করা হলো, তারপর তাতে স্বাক্ষর সংগ্রহ অভিযান। দুয়েক সপ্তাহের মধ্যেই জানতে পেলাম, অভিযান ব্যর্থ, বিলেতে অবস্থিত কোনও ভারতীয় অর্থনীতিবিদ বা সমাজবিজ্ঞানী ওই খসড়াতে সই করে আমার মতের প্রতিবাদ জানাতে সম্মত হননি, এমনকি আমার বামপন্থী চরিত্র যাঁরা অপছন্দ করেন, তাঁরাও না। হাল ছেড়ে দিয়ে হাই কমিশন থেকে তখন এক প্রবীণ প্রাক্তন ইংরেজ আই.সি.এস অফিসারকে পাকড়ানো হলো, তিনি দেশ স্বাধীন হওয়ার পরে ভারতবর্ষে থেকে গিয়েছিলেন, অনেক উঁচু-উঁচু পদে আসীন ছিলেন, কারও সুপারিশে জওহরলাল নেহরু যোজনা পরিষদের সদস্য করে নিয়েছিলেন তাঁকে। রক্ষণশীল মতামত ভদ্রলোকের; কপাল খারাপ, অধ্যাপক প্রশান্তচন্দ্র মহলানবিশ যখন কার্যত যোজনা কমিশনের সর্বেসর্বা, ভদ্রলোককে তাড়িয়ে দিলেন। বিতাড়িত ইংরেজ ভদ্রলোকটি অতঃপর ভাগ্যান্বেষণে প্রাক্-কেনিয়েত্তা যুগে কেনিয়া সরকারের উপদেষ্টা হয়েছিলেন, পরবর্তী পর্যায়ে বিশ্ব ব্যাংকের অন্যতম ভ্রাম্যমাণ উপদেষ্টা, যাঁরা প্রচুর অর্থ উপার্জনের বিনিময়ে অমুক অনুন্নত দেশে-তমুক অনুন্নত দেশে বিহার করে মার্কিন সরকারের জোগানো উপদেশ বিলিয়ে বেড়ান। যেহেতু ভদ্রলোকের মহলানবিশ মশাইয়ের উপর রাগ ছিল এবং, জনশ্রুতি, আমিও মহলানবিশ মশাইয়ের মতো নিরেট বামপন্থী, তিনি সানন্দে হাই কমিশন-রচিত সেই চিঠির খসড়ায় সই করলেন। আমার সুবিধাই হলো, এক বিদেশী সাম্রাজ্যবাদী আমলা ইন্দিরা গান্ধির দুরাচারকে সমর্থন করছেন, তাতে তো আশ্চর্য হওয়ার কিছু নেই!
দ্রুত দশ-এগারো মাস কেটে গেল, সাসেক্স-এ অধ্যাপনার মেয়াদ প্রায় শেষ, হঠাৎ আমেরিকা থেকে তিন মাসের জন্য একটি নিমন্ত্রণপত্র এলো। নিমন্ত্রণটি গ্রহণের খেয়াল চাপলো; আমার তো মার্কিন দেশে অনেক চেনা-জানা, ওই ক’টি মাস জরুরি অবস্থার বিরুদ্ধে কিছু প্রবন্ধ লেখা, সংবাদপত্রে সাক্ষাৎকার, সভাসমিতিতে অংশগ্রহণ ইত্যাদি কর্তব্যকর্ম সম্পন্ন করতে পারবো, এই আশায়। প্রায় বারো বছর বাদে আমেরিকা গেলাম, এবং রাজধানী ওয়াশিংটন শহরেই। প্রবাসী ভারতীয়দের কাছ থেকে ব্যক্তিগতভাবে সাদর অভ্যর্থনা পেলাম, কিন্তু ইংল্যান্ডের ভারতীয়দের চেয়েও তাঁদের অনেক বেশি ভয়-খাওয়া অবস্থা। সুতরাং সভা-টভা বিশেষ হলো না, তবে কথা বললাম বহু মার্কিন নীতিনির্ধারকের সঙ্গে, রাজনীতিবিদ, আমলা, অধ্যাপক, রাষ্ট্রনীতিবিদ, ধনবিজ্ঞানী, সাংবাদিক এমন-এমন অনেকের সঙ্গে। ওয়াশিংটন পোস্টে সাক্ষাৎকার বেরোলো, এবং নিউ ইয়র্ক টাইমস-এ আমার লেখা প্রবন্ধ। মার্কিন দেশেও ইন্দিরা গান্ধির সমর্থন রিপাবলিকান-ডেমোক্রাটিক উভয় দলের মধ্যেই যে ক্রমশ ক্ষীয়মাণ, সেটা সহজেই বোঝা গেল।
ছিয়াত্তর সাল ফুরোবার উপক্রম। অক্টোবরে আমার স্ত্রী দেশে ফিরে গেলেন, কলকাতায় কয়েক বছর আগে নতুন ফ্ল্যাটের জন্য টাকা জমা দেওয়া হয়েছে, খবর এলো নির্মাণের কাজ প্রায় শেষ, ফ্ল্যাটের দখল নিয়ে ভিতরের ব্যবস্থাদি সম্পূর্ণ করতে হবে, সুতরাং আমাদের মধ্যে একজনের অবিলম্বে প্রত্যাবর্তন প্রয়োজন। আমার নিজের কী গতি হবে তা কেউই জানি না, বন্ধুবান্ধবরাও না। বড়োদিনের সপ্তাহে আমেরিকা থেকে দেশে রওনা হলাম, লন্ডন-ব্রাইটনে কয়েক দিন কাটিয়ে মুম্বইমুখো। মুম্বই বিমানবন্দরে পুলিশ তুলে নেবে কিনা কোনও ধারণাই নেই। কিছুই হলো না অথচ। বিমানবন্দরে নেমে কাস্টমস ও অভিবাসনের বেড়া ডিঙোলাম, ট্যাক্সি চেপে পালি হিলে হিতেন চৌধুরীর বাংলোতে। ওই সপ্তাহে আমি তাঁর দ্বিতীয় অতিথি, প্রবোধকুমার সান্যাল দু’ দিন আগে থেকেই ছিলেন, তাঁর সঙ্গে সেই-ই আমার প্রথম আলাপ। একদা ‘মহাপ্রস্থানের পথে,’ ‘প্রিয় বান্ধবী’ এবং ‘আলো আর আগুন’ পড়ে রাতের পর রাত উন্মাদনায় কাটিয়েছি, ওই বই তিনটি থেকে দিস্তায়-দিস্তায় মুখস্থ বলতে পারতাম পর্যন্ত। কিন্তু সব পাখিই ঘরে ফেরে, সব আগুন নির্বাপিত হয়, প্রবোধবাবুর সঙ্গে পরিচিত হয়ে তেমন-কোনও আবেগে ভেসে গেলাম না।
কয়েক মাস আগে, যখন আমেরিকায় ছিলাম, হিতেনবাবুও গিয়েছিলেন কোনও কাজে, তাই ওঁর সঙ্গে আর নতুন করে আমার অনিশ্চিত ভবিষ্যৎ নিয়ে আলোচনার প্রয়োজন হলো না। একটা সময়ে ইন্দিরা গান্ধিকে তিনিও চিনতেন, আমিও চিনতাম, কিন্তু এই ঘোর-লাগা অবস্থায় আমার ক্ষেত্রে কী ঘটতে পারে তা নিয়ে আমাদের সংশয় অপরিবর্তিতই রইলো। সাতাত্তর সালের দ্বিতীয় দিবসে সকালের বিমানে কলকাতায়, এখানেও কোনওরকম অন্য-কিছু ঘটলো না, আমি সোজা নিউ আলিপুরে মাতৃগৃহে। আমার মা একেবারেই চাইছিলেন না, এই পরিস্থিতিতে আমি দেশে ফিরি। কেউ আমাকে গ্রেফতার করতে এলো না দেখে উনি একটু আশ্চর্য, সরলমনা মহিলার মন্তব্য, ‘ওরা বোধহয় ঠিকমতো খবর পায়নি’।
আমার ব্যাখ্যা অন্য রকম। জরুরি অবস্থার প্রায় দেড় বছর কেটে গেছে, ইন্দিরা গান্ধিরও সম্ভবত দম ফুরিয়ে এসেছে, যদিও তাঁর তনয়ের যায়নি, তা ছাড়া এসব ক্ষেত্রে যা হয়, প্রধান মন্ত্রী মহোদয়ার খবরের সূত্রগুলি তখন একমাত্র নিজের বিদূষকমহলে পর্যবসিত, তাঁরা ভালো-ভালো যে-কথাগুলি মহিলা শুনতে চাইতেন, তাই-ই আওড়াতেন। ভদ্রমহিলা হয়তো দৃঢ় বিশ্বাসে পৌঁছেছিলেন, জরুরি অবস্থার জন্য আপামর জনসাধারণ তাঁকে সাধুবাদ দিচ্ছে, এবার জরুরিত্ব ঘুচিয়ে সাধারণ নির্বাচনের ব্যবস্থা করা হলে তিনি বিপুল ভোটে জয়ী হবেন, তাঁর শত্রুরা আর ট্যা-ফোঁ করতে পারবে না। এই দৃষ্টিকোণ থেকে বিচার করলে কোন্ ওঁচা অর্থনীতিবিদ কোন্ বিদেশী কাগজে কী লিখেছে তা নিয়ে মাথা ঘামিয়ে কী দরকার, তাকে কয়েদ করারই বা কী দরকার! সঞ্জয় গান্ধির মতামত নিশ্চয়ই অন্যরকম হতো, কিন্তু সে পড়াশুনোর ধার ধারতো না, পত্রিকা-টত্রিকা পড়ার ব্যাপারে সমান অনাগ্রাহী। অনেকের ধারণা, হাকসারের মতো দিল্লিস্থ শুভানুধ্যায়ীদের চেষ্টাতেই আমি বিপদ এড়াতে পেরেছিলাম, তবে এই অনুমান তেমন বিশ্বাসযোগ্য নয়, কারণ কয়েক মাস আগে সঞ্জয়ের নির্দেশে হাকসারের খুড়োমহাশয়, কনৌট প্লেসের বিখ্যাত শৌখিন বস্তুসামগ্রীর সমাহার পণ্ডিত ব্রাদার্সের কর্ণধার, সর্বজনশ্রদ্ধেয় পণ্ডিতজীকে অতি সামান্য ছুতোয় কোমরে দড়ি বেঁধে কারাকক্ষে নিক্ষেপ করা হয়েছিল। ইন্দিরা গান্ধি স্বয়ং পণ্ডিতজীকে চিনতেন, হাকারের সঙ্গে আত্মীয়তার সম্পর্কও জানতেন, কিন্তু পুত্রকে কুনি দিয়ে পণ্ডিতজীর দ্রুত মুক্তির ব্যবস্থা করেননি। সঞ্জয়ের রাগ ছিল, সরকারি অর্থে ওর মারুতি কারখানা স্থাপনের পরিকল্পনা হাকসার-কর্তৃক গুবলেট করে দেওয়া হয়; তার বোধহয় প্রতিশোধ নিল সে।