সতেরো
কলকাতায় বামপন্থী আন্দোলনের ক্রমশ সবল থেকে সবলতম হয়ে ওঠা, সি পি আই (এম)-এর ব্যূহ গঠন অব্যাহত। প্রতিদিন রাজপথে-জনপথে শ্রমজীবী মানুষ-সরকারি-সদাগরি কর্মচারীদের অকুতোভয় মিছিল, লেখক ও শিল্পী সংঘও ফের নতুন উদ্যমে চঞ্চল। সম-পরিমাণ বেশি আলোড়ন উৎপল দত্ত ও তাঁর লিটল থিয়েটার গ্রুপকে ঘিরে। উৎপল ‘অঙ্গার’ ও ‘ফেরারী ফৌজ’ পেরিয়ে ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ উপন্যাসকে নাটকে রূপান্তরিত করেছেন। নাটক নিয়ে তাঁর নানা পরীক্ষায় অন্তহীন আগ্রহ, প্রসেনিয়াম থেকে একটি সরু লম্বা পাটাতন বের করে প্রেক্ষাগৃহকে দ্বিখণ্ডিত করে চমক সৃষ্টির রচনায় আপাতত তিনি মগ্ন। এই প্রয়াসের একটি প্রায়-দার্শনিক ব্যাখ্যা নিয়েও তিনি প্রস্তুত। সেই সঙ্গে তাপস সেনের আলোর জাদু। ‘তিতাস একটি নদীর নাম’-এ অভিনয় করতে বিজন ভট্টাচার্যকে ধরে-পড়ে উৎপল নিয়ে এসেছেন, নির্মলেন্দু চৌধুরীকেও, গানের জোয়ারে ভাসিয়ে দিতে। তবে কলকাতার দর্শক বড়ো বেশি শহরমন্যতা-রোগজীর্ণ, ‘তিতাস একটি নদীর নাম’ পছন্দ করলেন না। পরোয়া নেই, উৎপলের অদম্য উৎসাহ, দু’মাসের মধ্যেই ‘কল্লোল’ নাটকের পাণ্ডুলিপি তৈরি। এই নাটকের বক্তব্যের সঙ্গে কলকাতার মধ্যবিত্ত নাগরিক মানসিকতার অদ্ভুত সাযুজ্য ঘটলো। প্রধান চরিত্রে শেখর চট্টোপাধ্যায়, খলনায়ক ইংরেজ নৌসৈনাধ্যক্ষ উৎপল নিজে। নাটকে মহিমাময়ী মাতার ভূমিকায় শোভা সেনের ধাঁধা-লাগানো অভিনয়, বিদ্রোহী রেইটিংদের অন্যতম চরিত্রে নির্মল ঘোষের স্বচ্ছন্দ কলা-নৈপুণ্য এখনও চোখের সামনে ভাসছে। উৎপলের সাহসের তো অবধি নেই, তাপস সেনের সঙ্গে পরামর্শ করে কোথা থেকে এক তরুণ মঞ্চ-স্থপতিকে জোগাড় করে আনা হলো, লিটল থিয়েটার গ্রুপের সাবেক মঞ্চসজ্জা-নির্দেশক নির্মল গুহরায় কোনও বৃত্তি নিয়ে তখন ফরাশি দেশে। এঁরা তিনজন, উৎপল, তাপস সেন, সুরেশ দত্ত, একটা গোটা খাইবার জাহাজের প্রতিরূপ মঞ্চে উপস্থাপন করলেন। বিদ্রোহের মুহূর্তে মঞ্চের আধো-অন্ধকারে বিদ্যুৎক্ষেপণের পরিষঙ্গে লাল ঝাণ্ডার আস্তে-আস্তে উপরে উঠে যাওয়া, সেই মুহূর্তে আন্তর্জাতিক সঙ্গীতের অনিবৰ্চনীয় মূৰ্ছনা। দর্শককুল ঠিক যেন বুঝতে পারছিলেন না, তাঁরা নাটক দেখছেন, না কি বিপ্লবের সক্রিয় দোসর হচ্ছেন। প্রেক্ষাগৃহ জুড়ে করধ্বনি, হর্ষধ্বনি, এমনকি লাল ঝাণ্ডাকে অভিবাদন জানিয়ে স্তুতিনাদ, সব-কিছুর একসঙ্গে মিলে যাওয়া, মিশে যাওয়া।
ভিড় ভেঙে পড়ছে, মিনার্ভা থিয়েটারের বাইরে ভোর থেকে লম্বা লাইন। গ্রাম থেকে, মফস্বল থেকে নাট্যামোদীরা আসছেন, টিকিট সংগ্রহ করতে না পেরে আদর্শবাদীরা হতাশ হয়ে ফিরে যাচ্ছেন, ফের আসছেন, অবশেষে মনস্থির করে দুই কি তিন সপ্তাহ বাদে কোনও অভিনয়-তারিখের টিকিট কেটে বিদায় নিচ্ছেন। বাইরের কলরোল, মিনার্ভা প্রেক্ষাগৃহের অভ্যন্তরে লাল ঝাণ্ডার আস্ফালন, পরস্পরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে অবশ্যম্ভাবী আশু বিপ্লবের নান্দীমুখ ঘোষণা করছে যেন।
শাসককুল চিন্তান্বিত, উৎপল দত্তের বাড়াবাড়ি সি পি আই (এম)-কে বাড়তি মদত দিচ্ছে দিনের পর দিন। বামপন্থী কমিউনিস্টদের সঙ্গে শলাপরামর্শ করে যে লিটল থিয়েটার গ্রুপ এসব ফিচকেমি করছে, তাতে, তাঁদের কাছে অন্তত, সন্দেহের অবকাশ নেই। ঊনবিংশ শতকের দ্বিতীয়ার্ধে নীলদর্পণ নাটক যে আইনের আশ্রয় নিয়ে বন্ধ করে দেওয়া হয়েছিল, তা প্রয়োগ করতে তবু ঈষৎ দ্বিধা ও লজ্জাবোধ। একটি নতুন আইনের খসড়া তৈরি হলো, যার ধারাগুলিও সমান প্রতিবাদ-অসহিষ্ণু। কারা তখন শাসক মহলের প্রধান-প্রধান পরামর্শদাতা ছিলেন, তা আজ পর্যন্ত ঠিক জানা যায়নি। ত্বরিত সিদ্ধান্ত গ্রহণ করা হলো, বাংলার জনগণের স্বদেশপ্রেমের আবেগে ঝাঁকুনি দিয়ে আবেদন করতে হবে, ‘কল্লোল’ দেশদ্রোহীদের নাটক, দেশকে নিন্দাবাদ করা হয়েছে এই নাটকে, সমস্ত দেশবাসীর কর্তব্য ‘কল্লোল’ থেকে দূরে থাকা, উৎপল দত্তকে ভাতে মারা। একটি মাত্র দৈনিক বাদ দিয়ে অন্য সমস্ত সংবাদপত্র ‘কল্লোল’-এর প্রচারবিজ্ঞপ্তি ছাপা বন্ধ করে দিলেন। কংগ্রেস দল, এবং সেই সঙ্গে, আমার সন্দেহ, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্ট বন্ধুদের পক্ষ থেকে নাট্য-সমালোচকদের উৎসাহ দান করা হলো ‘কল্লোল’ নাটকের এক ঝাঁক বিরূপ সমালোচনা প্রকাশ করতে। কিন্তু ‘কল্লোল’ স্তব্ধ হলো না। সাধারণ মানুষের গোঁ চেপে গিয়েছিল, লিটল থিয়েটার গোষ্ঠীরও। বোধহয় তাপস সেনের মাথাতেই প্রথম ভাবনাটির উদয় হয়, ছোট্ট একটি হ্যান্ডবিল ছাপিয়ে লক্ষ-লক্ষ কপি, কলকাতা শহরময় এবং মফস্বলে, দেওয়ালে দেওয়ালে, গাছের গুঁড়িতে, রেল স্টেশনের প্ল্যাটফর্মে, যাত্রীবাহী বাসের পৃষ্ঠদেশে ছড়িয়ে পড়লো: ‘কল্লোল’ চলছে, চলবে। পশ্চিম বাংলার সর্বত্র প্রতিধ্বনি রণিত: ‘কল্লোল’ চলছে, চলবে। পরশ্রীকাতর ও চক্রান্তকারীদের ষড়যন্ত্র শুধু ব্যর্থই নয়, সেই সঙ্গে ‘চলছে, চলবে’ এই দ্বিশব্দবন্ধনী বাংলা ভাষায় প্রচলিত বুকনির অবধারিত অঙ্গে পরিণত হলো।
থমথমে অবস্থা, সব-কিছু জড়িয়ে মানুষের মনে পুঞ্জিত বিক্ষোভ, গ্রামাঞ্চলেও জমির লড়াই-মজুরির লড়াই ধীরে-ধীরে সংহততর হচ্ছে। সামনের দিকে তাকিয়ে সত্যিই বোঝা যাচ্ছিল না অতঃপর কী হতে যাচ্ছে। ঘোরের মধ্যে আছি, এরই মধ্যে আর এক দফা বিদেশ ঘুরতে যাওয়া। উনিশশো পঁয়ষট্টি সালের অগস্ট মাস, বেলগ্রেডে রাষ্ট্রসংঘ আহৃত বিশ্ব-জনসংখ্যা সম্মেলন। গবেষণাপ্রবন্ধ পড়বার নিমন্ত্রণ ছিল আমার। এ সমস্ত সম্মেলনে সাধারণত যা হয়, মোচ্ছবের পরিবেশ, নানা দেশ থেকে জড়ো হওয়া পণ্ডিত-পণ্ডিতম্মন্যদের প্রায় উদ্দেশ্যহীন ভিড়। অবশ্য ঠিক উদ্দেশ্যহীনও নয়: আমি তোমার আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করে দিয়েছি, এবার অন্য কোনও আন্তর্জাতিক সম্মেলনে তুমি আমার আমন্ত্রণের ব্যবস্থা করবে, এই গোছর বোঝাবুঝি। সুতরাং সম্মেলনের বিভিন্ন বৈঠকে যা আলোচনা হতো তা গৌণ, জড়ো-হওয়া পণ্ডিতদের পারস্পরিক দেওয়া-নেওয়ার সমারোহই প্রধান উপলক্ষ্য। ওয়াশিংটনে আমার এক প্রাক্তন ছাত্র যুগোশ্লাভিয়ার জাতীয় বিনিয়োগ ব্যাংকে সর্বোচ্চ পদে সমাসীন। সে হাঙ্গেরির সীমান্তবর্তী এক বনে আমাদের কয়েকজনকে সপ্তাহান্ত কাটাবার ব্যবস্থা করলো। নির্জন নিভৃত বন, চমৎকার থাকবার জায়গা, সকাল থেকে মধ্যরাত্রি পর্যন্ত প্রহরের পর প্রহর জুড়ে পানাহারের আয়োজন। আমার বার-বার মনে পড়ছিল বিষ্ণুবাবুর ব্যঙ্গ-শাণিত উক্তি, ‘আর্কেডিয়া কী বুঝবে তাই’।
সম্মেলনের ঢক্কানিনাদ সহকারে সমাপ্তি ঘোষণা। আমি আর আমার এক মার্কিন বন্ধুর একটি গাড়ি ভাড়া করে যুগোশ্লাভিয়া থেকে দেশের পর দেশ পেরিয়ে আমস্টারডাম পর্যন্ত ঘুরতে-ঘুরতে পৌঁছুনো। দু’জনে পালা করে গাড়ি চালাচ্ছি, যেখানে খুশি থামছি, জাদুঘর দেখছি, চিত্রশালা দেখছি, রাত্রি যাপন করছি, মিউনিখ কিংবা স্টুডগার্টে অর্কেস্ট্রা শুনছি, অটোবানের মসৃণ সুখবিলাস। দিন দশেক বাদে আমস্টারডামে গাড়ি জমা দিয়ে বন্ধুটি আমেরিকার প্লেনে চাপলো। ফ্রান্সের ব্রিটানি অঞ্চলে খটোমটো কী একটি অর্থনৈতিক বিষয় নিয়ে বিশেষজ্ঞ বৈঠকে আমার যোগ দেওয়ার পালা এবার। সেই বৈঠক শেষে, আগে থেকেই খুরশীদকে জানানো ছিল, প্যারিস থেকে প্লেনে চেপে করাচি পৌঁছে কয়েকটা দিন ওদের সঙ্গে কাটাবো। খুরশীদ সদ্য-বিবাহিতা। তার নতুন-পাতা সংসারের আমেজে স্নিগ্ধ হবো, মনে এরকম ইচ্ছা।
ভোরবেলা করাচিতে বিমান থেকে নেমে সব কিছু একটু যেন অন্যরকম লাগলো, আমার টিকিটে-পাসপোর্টে-ভিসায় কোনও গোলমাল নেই, পরিখার এপার থেকে দেখতে পাচ্ছি ওপারে খুরশীদের স্বামী হায়দরভাই আমার জন্য অপেক্ষমান, তবু অভিবাসন কর্মচারী ও পুলিশ প্রহরীদের কী যেন বলতে গিয়ে থেমে যাওয়া, মিনিট পনেরো-কুড়ি বাদে পাসপোর্টে সিলমোহর পড়লো, তা আমাকে প্রত্যর্পণ করা হলো, পরিখার ওপারে গেলাম, মালপত্রসুন্ধু হায়দরভাইয়ের সঙ্গে গাড়িতে উঠলাম। হাওয়াই আড্ডা থেকে নিষ্ক্রমণ, চওড়া মসৃণ পথ, গাড়িতে যেতে-যেতে হায়দরভাই রহস্যটি ভাঙলেন: আগের রাতে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ শুরু হয়ে গেছে, সীমান্ত পেরিয়ে ভারতীয় বাহিনী এদিকে ঢুকেছে, সীমান্তের অন্য কোনও অংশে পাকিস্তান বাহিনী ভারতে ঢুকেছে, অনেক বলে-কয়ে ওঁরা প্লেন থেকে নামবার মুহূর্তে আমাকে যাতে আটক না-করা হয় সে-ব্যবস্থা করেছেন, এখন যে করেই হোক আমাকে ভারতবর্ষে ফেরত পাঠাতে হবে। জল্পনা করতে-করতে খুরশীদদের বাড়িতে পৌঁছুলাম, অভ্যর্থনার উচ্ছ্বাসে হ্রস্বতা নেই, তা হলেও দুশ্চিন্তার একটি কালো ছায়া সকলেরই চোখে-মুখে। আমাকে আশ্বস্ত করা হলো, চিন্তার কোনও কারণ নেই, খুরশীদের ছোট বোনের স্বামী পাকিস্তানের খোদ আইনমন্ত্রী, তিনি লেগে আছেন, একটা ব্যবস্থা হবেই, রাত বারোটা নাগাদ কে এল এম-এর একটি বিমান নামছে, করাচি থেকে ফের উড়ে সেটা মুম্বই যাবে, আমাকে সেই বিমানে তুলে দেওয়ার জন্য পাকিস্তান সরকারের সর্বোচ্চ মহলে কলকাঠি নাড়া হচ্ছে। আমি নিরুদ্বিগ্ন, দায়িত্ব তো আমার নয়, যাঁদের অতিথি তাঁদের, সুতরাং আবহাওয়া হালকা করতে প্রয়াসী হলাম, দিনভর সবাইকে নিয়ে কৌতুকে মেতে থাকা, খুরশীদদের বাবা-মাকে তাঁদের বাড়িতে গিয়ে সশ্রদ্ধ নমস্কার জানিয়ে আসা, বিকেল চারটে নাগাদ খবর পাওয়া গেল মুশকিল আসান, ওই বিমানে আমার যাওয়ার অনুমতি মিলেছে। রাত সাড়ে দশটায় অন্যদের কাছে বিদায় নিয়ে হাওয়াই আড্ডায় প্রত্যাবর্তন, সঙ্গে খুরশীদ ও হায়দারভাই। রাত সাড়ে বারোটা নাগাদ অন্য যাত্রীরা উঠবার আগে আমাকে এক জঙ্গি অফিসার বিমানে বসিয়ে দিয়ে শুভেচ্ছাজ্ঞাপন করে বিদায় নিলেন, ইতিমধ্যে ভারত-পাকিস্তান যুদ্ধ আরও জমে উঠেছে।
মুম্বই পৌঁছে ট্যাক্সি নিয়ে সোজা চার্চিল চেম্বার্স, শচীনদার ফ্ল্যাটে, ওই ফ্ল্যাটে তো তিথি মেনে কেউই কোনওদিন যায় না, সুতরাং আমিও নিশ্চিন্ত, নিরুদ্বিগ্ন। পৌঁছে দেখি শচীনদা বিছানার উপর বসে আছেন, আমাকে দেখে যেন একটু কুণ্ঠিত, তাঁর সেই গেটওয়ে অফ ইন্ডিয়া-কাঁপানো উচ্চকণ্ঠ হাসি অনির্গত। কয়েক মুহূর্ত বাদে জানতে পারলাম, দিন কুড়ি আগে শচীনদার গুরুতর হৃদ্রোগের প্রকোপ দেখা দিয়েছে, কোনওক্রমে সামলে নিয়েছেন, এখন বেশ কয়েক সপ্তাহ সম্পূর্ণ বিশ্রামে থাকতে হবে, সবরকম আড্ডা বরবাদ। শচীনদার কুণ্ঠার কারণও সেটা, চিকিৎসকদের নির্দেশ অমান্য করতে ঠিক সাহস পাচ্ছেন না, অথচ আমি মুম্বইতে, চার্চিল চেম্বার্সে, কিন্তু আড্ডার প্রসঙ্গ উহ্য, এ তো অভাবনীয় পরিস্থিতি! যা-ই হোক, তিন-চার দিন ওঁর সঙ্গে কাটিয়ে, ওঁকে যথাসম্ভব কথা না বলতে দিয়ে, আমার দিক থেকে একপেশে কথা চালিয়ে অতঃপর কলকাতায় ফেরা। কলকাতায় পৌঁছে আবিষ্কার করলাম, থমথমে ভাব আদৌ কমেনি, পাকিস্তানের সঙ্গে যুদ্ধহেতু আরও বেড়েছে, নতুন করে রাজনৈতিক নেতা-কর্মীদের ধরপাকড় শুরু হয়েছে, ভারত-পাকিস্তান সম্পর্ক নিয়ে ‘দেশহিতৈষী’-র শারদ সংখ্যায় উৎপল দত্ত-র কী একটা প্রবন্ধ বেরিয়েছে, তা ছুতো করে উৎপলকে জেলে পোরা হয়েছে, যদিও আসল কারণটি স্পষ্ট: উৎপলবিহীন ‘কল্লোল’-এর অভিনয় নিজে থেকেই, আশা, বন্ধ হয়ে যাবে। তবে মাত্র কয়েক বছরে সমাজের মেজাজ আদ্যোপান্ত পাল্টে গেছে। যুদ্ধের ভণিতা লোকমানসে কোনওই দাগ কাটতে পারছে না, বরঞ্চ উৎপল ও অন্যান্য বেশ কয়েকজনকে গ্রেফতারের মধ্য দিয়ে সরকারের বুজরুকি যেন সাধারণ মানুষের কাছে স্পষ্টতর। উৎপলের সঙ্গে জোছন দস্তিদারকেও ধরে নিয়ে যাওয়া হয়েছে, সমস্ত নাট্যগোষ্ঠী এক কাট্টা, একশো চুয়াল্লিশ ধারার পরোয়া না-করে প্রতিদিন প্রতিবাদ মিছিল বেরোচ্ছে, নাট্যশিল্পী ও কর্মীদের মিছিলের সঙ্গে সর্বস্তরের নাগরিকদের প্রতিবাদী পদধ্বনিও একসঙ্গে রণিত। লিটল থিয়েটার গ্রুপের একদা-সম্পাদক, বাউন্ডুলে মার্কসবাদী, বিপ্লবের জন্য, লোকপরিবাদ, সব সময়ই দু’-পা এগিয়ে থাকা রবি সেনগুপ্তের সঙ্গে সৌহার্দ্য ঘনতর হলো, প্রায় প্রতি সন্ধ্যাতেই শোভা সেন, তাপস সেন, রবি সেনগুপ্ত ও আমার মধ্যে শলাপরামর্শ, উৎপল ও অন্যান্য বন্দীদের মুক্তির দাবি জানিয়ে বিবৃতির খসড়া তৈরি, এঁর-ওঁর-তাঁর কাছ থেকে সই সংগ্রহ। লিটল থিয়েটার গ্রুপ ও ব্রেশট সোসাইটির পক্ষে অনেককে নিয়ে প্রতিবাদসভা-মিছিল, সেই উপলক্ষ্যে মন্মথ রায়ের সঙ্গে যোগাযোগ।
ইতিমধ্যে ‘নাউ’ পত্রিকার জঙ্গি ঝোঁকও প্রতি সপ্তাহে তীক্ষ থেকে তীক্ষ্ণতর। ততদিনে সমর সেন আমার মতামতের সঙ্গে সম্পূর্ণ মিলে গেছেন, দু’জনে প্রতি সপ্তাহে যে-সব উগ্র মেজাজের সম্পাদকীয় লিখতাম, তা পাঠান্তে নাকি ঘোর কমিউনিস্ট মহলেও ঈষৎ পুলকমিশ্রিত উদ্বেগ, হুমায়ুন কবিরের মনের অবস্থা তো কল্পনাই করা যেত। ‘নাউ’-এর এমন চরিত্র পরিবর্তনে নিরঞ্জন মজুমদাররা তেমন প্রীত হচ্ছিলেন না হয়তো, নিরঞ্জন তো প্রায়ই প্রকাশ্যে অনুযোগ জানাতেন, ইংরেজি খোলশ ছেড়ে নিরেট বাংলায়: ‘অশোকটা সমরকে জেলে পাঠাবে’। তবে রবি সেনগুপ্ত যেটা স্পষ্ট ব্যক্ত করলেন: সমরবাবু তো নাবালক নন, বুঝে-সুঝেই সিদ্ধান্ত নিচ্ছেন।
‘নাউ’-এর প্রচার প্রতি সপ্তাহে লাফিয়ে-লাফিয়ে বাড়ছে। তরুণ সম্প্রদায় প্রতিটি সংখ্যার জন্য চাতকের মতো অপেক্ষা করে থাকে, সম্পাদকীয় মন্তব্য ও কলকাতা ডায়েরি উভয়েরই মেজাজের পারদ দ্রুত ঊর্ধ্বমুখী, দিল্লি-কলকাতার দুই সরকারকেই প্রতি সপ্তাহে প্রহারেণ ধনঞ্জয় করা হচ্ছে। ব্যাপারস্যাপার দেখে সমরবাবুর ‘অ-রাজনৈতিক’ বন্ধুরা যদিও চিন্তিত, সমরবাবু নিজে কিন্তু নির্বিকার। এই ঋতুতেই প্রমোদ সেনগুপ্তের সঙ্গে আমার মোলাকাত। উনি থাকতেন বেকবাগান পেরিয়ে লোয়ার সার্কুলার রোডের এক গলির মোড়ে, প্রায়ই গুটি-গুটি পায়ে হেঁটে আমাদের হাঙ্গারফোর্ড স্ট্রিটের ফ্ল্যাটে চলে আসতেন। গোঁড়া রাজনৈতিক মতাবলম্বী, অথচ ভারি ঠান্ডা প্রকৃতির মানুষ প্রমোদবাবু। তাঁর অতীত বৈপরীত্যে ঠাসা, নাম-লেখানো কমিউনিস্ট, কিন্তু যুদ্ধের সময় জার্মানিতে সুভাষচন্দ্রের আজাদ হিন্দ সরকারেও ছিলেন। জর্মান স্ত্রী, যিনি কলকাতার হিন্দুস্থান স্টিল সংস্থার দফতরে কাজ করতেন, প্রধানত অনুবাদের কাজ; কোথায় যেন শুনেছিলাম তিনি এঙ্গেলসের সাক্ষাৎ নাতনি, তবে এটা বোধহয় নেহাৎই জনশ্রুতি। প্রমোদ সেনগুপ্ত, আমার যতদুর জানা ছিল, পুরোটা সময়ই সক্রিয় রাজনীতিতে। চৌষট্টি সাল থেকে সি পি আই (এম)-এ, তারপর সাতষট্টি সাল-পরবর্তী ধোঁয়াশায় নকশালপন্থীদের কোন গোষ্ঠীলগ্ন ছিলেন, বুঝতে পারিনি। আমার লেখা পড়েই হয়তো তাঁর আলাপ করবার আগ্রহ, ছেষট্টি সালের শেষের দিকে আমার দিল্লি চলে যাওয়ার পর পরিচয় শিথিল হয়ে যায়, বাহাত্তর সালে ফিরে আর তাঁকে পাইনি। তাঁর, বা তাঁর স্ত্রীর, শান্তিনিকেতনে একটি বাড়ি ছিল, প্রমোদবাবুর মৃত্যুর পর ভদ্রমহিলা জর্মানি ফিরে যান, বাড়িটা প্রমোদবাবুর আত্মীয়দের কাছ থেকে পরে কিনে নেন ‘এক্ষণ’ সম্পাদক নির্মাল্য আচার্যের পরম সখা, আমাদের বিখ্যাত উড়নচণ্ডী বন্ধু, ‘সুবর্ণরেখা’-স্বত্বাধিকারী ইন্দ্রনাথ মজুমদার। ইন্দ্রনাথকে যাঁরা জানেন, তাঁরা এটাও জানেন, তাঁর ক্ষেত্রে কার্যকারণ সম্পর্ক একটু প্রতীপমুখী। প্রায় হলফ করেই বলতে পারি, বাড়িটা কিনেছিলেন বলেই ইন্দ্ৰনাথ শান্তিনিকেতনে ‘সুবর্ণরেখা’-র একটি শাখা বিপণি খুলে বসেন, দোকানটা চালাতে সুবিধা হবে ভেবে বাড়িটা কেনেননি। শান্তিনিকেতনে গেলেই ইন্দ্রনাথের সঙ্গে দেখা হয়, স্বতই প্রমোদ সেনগুপ্তের কথা মনে পড়ে।
পঁয়ষট্টি-ছেষট্টি সালে ফিরে যাই, সেই পঁয়তিরিশ বছর আগেকার কথায়। কলকাতায় মধ্যবিত্ত শ্রেণীর একটি বড়ো অংশ সমাজবিপ্লবের স্বপ্নে বিভোর। আন্তর্জাতিক পরিস্থিতিও ঘুরতে শুরু করেছে। মার্কিনরা তখনও ভারতবর্ষ সম্পর্কে বিরূপ, অস্ত্রশস্ত্র ও সাধারণ পৃষ্ঠপোষকতা আমাদের সরকার পাচ্ছিলেন একমাত্র সমাজতান্ত্রিক রাষ্ট্রসমূহ থেকে। যে কারণেই হোক, দুই সোভিয়েট নেতা, বুলগানিন-কোসিগিন, পাকিস্তান-ভারত হানাহানি পছন্দ করছিলেন না, তাঁদের হয়তো চিন্তা হলো এ-সমস্ত ঘটনাবলী পাকিস্তানকে আরও পশ্চিমের দেশগুলির দিকে ঠেলে দেবে। কলকাঠি নড়লো, যুদ্ধে যদিও ভারতীয় সেননী একটু সুবিধাজনক অবস্থায় ছিল, নতুন দিল্লির সরকার যুদ্ধবিরতি ঘোষণা করতে বাধ্য হলেন, কয়েক সপ্তাহ বাদে তাসখন্দ। বেচারি প্রধানমন্ত্রী লালবাহাদুর শাস্ত্রী তাসখন্দে সোভিয়েট নেতাদের কাছ থেকে, আবার সন্দেহ, এত ঝাড়াই খেলেন যে ওখানেই হৃদ্রোগে আক্রান্ত হয়ে তাঁর মৃত্যু। হঠাৎ কংগ্রেসের নেতাদের মধ্যে সংঘাত-বিভাজনের ঈষৎ সম্ভাবনা মাথা চাড়া দিল। জানুয়ারির শেষে নতুন প্রধান মন্ত্রী নির্বাচনে কংগ্রেস সাংসদীয় দলে ভোটাভুটি, ইন্দিরা গান্ধি মোরারজি দেশাইকে গোহারা হারিয়ে দিলেন। কংগ্রেস সংগঠনে রাজ্যে-রাজ্যে যাঁরা ক্ষমতা দখল করে ছিলেন, তাঁরা অধিকাংশই প্রাচীনপন্থী, রক্ষণশীল, সুতরাং প্রথম থেকেই ইন্দিরা গান্ধির একটু ভয়ভীত কোণঠাসা অবস্থা। তাঁর শক্তিসংগ্রহ প্রয়োজন, দেশবাসীর কাছে বিশ্বাসযোগ্যতা অর্জন জরুরি। সে সময় তাঁর যাঁরা পরামর্শদাতা ছিলেন, তাঁদের মধ্যে অনেকেই কৃষ্ণ মেননপন্থী, তা ছাড়া একদা-কমিউনিস্ট ছিলেন, এখন-কোনও-দলের-ছাপ নেই, এমন কিছু রাজনৈতিক কর্মী ও সাংবাদিক, যেমন ‘সেমিনার’ পত্রিকার সম্পাদক রমেশ থাপর। সব চেয়ে বড়ো কথা, মোরারজী দেশাই সম্পর্কে বেশির ভাগ সাধারণ মানুষের মনে যথেষ্ট বীতশ্রদ্ধ ভাব। প্রতিক্রিয়াজর্জর, গোঁয়ার, পুঁজিপতি-ঘেঁষা ইত্যাদি বিশেষণে তিনি তখন অহরহ ভূষিত হতেন। মোরারজী যদিও ইন্দিরা গান্ধির মন্ত্রীসভায় উপপ্রধান মন্ত্রী তথা অর্থমন্ত্রী হতে রাজি হলেন, সকলেই ধরে নিলেন এটা সাময়িক বোঝাপড়া, গুজরাটি ভদ্রলোক সুযোগ খুঁজছেন পরিস্থিতি কখন মোড় ফেরে, তখন ঝোঁপ বুঝে কোপ মারবেন।
এই পটভূমিকায় কেন্দ্রীয় সরকারের রাজনৈতিক আচরণ-বিচরণে ঈষৎ পরিবর্তনের আভাস, ইন্দিরা গান্ধি ও তাঁর ঘনিষ্ঠ পরামর্শদাতাদের অঙ্গুলিনির্দেশে মাত্র বছরখানেক আগে বামপন্থীদের দেশদ্রোহিতা নিয়ে যে-সমস্ত গালগল্প রচিত হয়েছিল, সব উপেক্ষা করে নীতির নববিধান। ছেষট্টি সালের এপ্রিল-মে মাস থেকে দেশ জুড়ে বামপন্থী কমিউনিস্টরা মুক্তি পেতে শুরু করলেন। ঐ সময়েই কেরলে যে-বিধানসভা নির্বাচন হয়েছিল, ই এম এস-সুদ্ধু অধিকাংশ সি পি আই (এম) নেতৃবৃন্দ হয় কারারুদ্ধ নয় আত্মগোপন করে থাকা, তা সত্ত্বেও দল রাজ্যের অবিসংবাদী প্রধান শক্তি হিশেবে আত্মপ্রকাশ করলো, বন্দী নেতা ও কর্মীরা তারপর থেকে একটু-একটু করে মুক্ত হলেন।
পশ্চিম বাংলায় পরিস্থিতি আরও অনেক বেশি টালমাটাল। মধ্যবিত্তদের প্রকাণ্ড বড়ো অংশ মূল্যবৃদ্ধির প্রকোপে জেরবার, দৈনিক পত্রিকাগুলির বিরূপতা সত্ত্বেও সি পি আই (এম)-এর জনপ্রিয়তা বৃদ্ধি পাচ্ছে, শহরে-গ্রামে-গঞ্জে সংগঠনের শাখাপ্রশাখা ব্যাপ্ততর হচ্ছে, কারও-কারও এমনও ভ্রান্তিবিলাস আরম্ভ হলো যে হাত বাড়ালেই বিপ্লবকে এবার বুঝি ছোঁয়া যায়। কয়েক সপ্তাহের ব্যবধানে উৎপল-জোছনরা কারামুক্ত, সর্বস্তরের শিল্পীদের-কর্মীদের রাজনৈতিক মেজাজ উচ্চগ্রামে উঠছে, দক্ষিণ তরফের কমিউনিস্টরা যেন প্রায় একঘরে। উৎপল দত্তের ছাড়া পেতে তখনও কয়েক সপ্তাহ বাকি, সোভিয়েট দেশ থেকে বলশয় ব্যালে দলের কিছু প্রতিনিধি কলকাতায় উপস্থিত, দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্টরা কোনও হল খুঁজে পাচ্ছেন না যেখানে সোভিয়েট নৃত্য দলকে সংবর্ধনা দিতে পারেন, বলশয় দলের নৃত্যপ্রদর্শনী দেখতে পাবেন, বাধ্য হয়ে তাঁরা লিটল থিয়েটার গ্রুপ-এর শরণাপন্ন, দয়া করে যদি মিনার্ভা হল ছেড়ে দেওয়া হয়। উৎপলের অনুপস্থিতিতে তাপস সেন এল.টি.জি.-র সভাপতি, নিজেদের মধ্যে পরামর্শ করে দক্ষিণপন্থীদের অনুরোধ রক্ষা করা হল। তবে সভাপতি হিশেবে অভ্যর্থনা জানাতে গিয়ে তাপস সেন লম্বা বক্তৃতা ফাঁদলেন, তাতে এক কাহন ভারত সরকারের নিন্দা, ভারত সরকারের চীন-বিরোধী নীতির বিরুদ্ধে বিক্ষোভপ্রকাশ, এই সরকার কত যে প্রতিক্রিয়াশীল তার প্রমাণ দেশের সর্বশ্রেষ্ঠ নট-নাট্যকার-নাট্য প্রযোজক উৎপল দত্তকে বিনা বিচারে আটক করে রাখা হয়েছে, আরও হাজার-হাজার বামপন্থী নেতা-কর্মী কারারুদ্ধ, বলশয় দল দেশে ফিরে গিয়ে তাঁদের মহান সমাজতান্ত্রিক সরকারকে যেন অনুগ্রহ করে আমাদের নিবেদন পৌঁছে দেন, ভারতবর্ষের এই চরম প্রতিক্রিয়াশীল সরকারের সঙ্গে তাঁরা যেন কোনও সম্পর্ক না রাখেন। সেজে-গুজে দক্ষিণপন্থী কমিউনিস্টরা ঝেঁটিয়ে বলশয় নৃত্য দেখতে এসেছেন, তাঁরা রেগে কাঁই, অথচ কিছু বলবার সাহস নেই, তা হলে হয়তো লিটল থিয়েটার গ্রুপ মিনার্ভা হলে নৃত্যপ্রদর্শনী বন্ধ করে দেবে।
বাংলা খবরের কাগজের ভাষায় যাকে বলা হয় অগ্নিগর্ভ, ঠিক সে রকম অবস্থায় পশ্চিম বাংলা পৌঁছে গেল। সে বছর যদিও শস্যে টান পড়েছিল, রাজ্য সরকার জমিদার, জোতদার ও ব্যবসাদারদের কাছ থেকে ধান সংগ্রহের পরিমাণ কেন্দ্রের নির্দেশে বাড়িয়ে দেওয়ার সিদ্ধান্ত নিলেন। অজয় মুখোপাধ্যায়ের মতো বহু আজন্ম-কংগ্রেসীর মনে অনেক অসন্তোষ জমা ছিল অতুল্য ঘোষ-পরিচালিত, প্রফুল্ল সেনের নেতৃত্বে গঠিত রাজ্যের কংগ্রেস সরকার সম্পর্কে। জোতদার-জমিদারদের একটি প্রভাবশালী অংশ অজয়বাবুর সঙ্গে কংগ্রেস থেকে বেরিয়ে এলেন। হুমায়ুন কবির, যিনি ইন্দিরা গান্ধির মন্ত্রীসভায় ঠাঁই পাননি, তিনিও বেরিয়ে এসে অজয়বাবুর সঙ্গে হাত মেলালেন, অর্থাৎ পশ্চিম বাংলায় কংগ্রেস দল দ্বিখণ্ডিত, পাশাপাশি র্যাশনে অপরিমিত সরবরাহ, মজুতদাররা তাঁদের চিরাচরিত ধর্ম পালন করছেন, বুভুক্ষাশঙ্কিত মানুষজন রাস্তায় বেরিয়ে এসে বিক্ষোভ জানাচ্ছেন যত্রতত্র, বিশৃঙ্খলা, অরাজকতার পূর্বলক্ষণ, নদীয়া জেলার নানা জায়গায় পুলিশের গুলিতে মিছিলে-সামিল-হওয়া কয়েকটি অবোধ শিশুর মৃত্যু, জনসাধারণের মেজাজ আরও চড়লো, ‘নাউ’ পত্রিকার সম্পাদকীয় মন্তব্যে আমরা আরও-আরও আগুন ঝরিয়ে দিতে লাগলাম।
রাজ্য সরকার কিছুটা পিছুপা হলেন, একটু-একটু করে রাজনৈতিক কর্মী ও নেতারা ছাড়া পেতে শুরু করলেন, উৎপল-জোছনরাও সেই সঙ্গে। ‘কল্লোল’-এর সাফল্য গগনস্পর্শী, বাড়তি প্রদর্শনীর ব্যবস্থা করেও দর্শকদের আগ্রহ মেটানো যাচ্ছে না, তাঁরা তো দর্শক নন, তাঁরা যেন বিপ্লবের অগ্রদূত। নাট্যশিল্পী ও কর্মীদের সংঘবদ্ধতা আরও জোরদার হলো, উদ্দামতার মধ্যে সবাই। সি পি আই (এম)-এর পলিটব্যুরো সদস্যরা সবাই প্রায় একসঙ্গে বন্দিত্ব থেকে মুক্তি পেলেন, তখনও কেন্দ্রীয় কমিটির দফতর কলকাতায়, লেক প্লেসে, মুক্তির পর পলিটব্যুরোর প্রথম বৈঠক বসলো কলকাতাতেই। উৎপলের নাটকীয়তার অভাব কোনও দিনই ছিল না। কলকাতার জনগণের পক্ষ থেকে পলিটব্যুরোর সদস্যদের ময়দানে অভিনন্দন জানানো হলো, লিটল থিয়েটার গ্রুপ থেকে সিদ্ধান্ত, ‘কল্লোল’-এর উদ্দীপক-উত্তেজক দৃশ্যগুলির একটি-দু’টি ময়দানের সেই সভায় উপস্থাপন করা হবে। সে এক আশ্চর্য মনোমোহন দৃশ্য, সারি দিয়ে নেতারা সামনে বসে আছেন, বাইরের আলো নিবিয়ে দেওয়া হয়েছে, গোটা মঞ্চ জুড়ে খাইবার জাহাজের উদ্ধত উপস্থিতি, রেইটিংদের উচ্চনাদ, নো স্যারেন্ডার, লাল ঝাণ্ডা কেঁপে-কেঁপে একটু-একটু করে আকাশের দিকে উঠছে, আন্তর্জাতিক সংগীত, তার সঙ্গে হাজার-হাজার যূথবদ্ধ জনতার কণ্ঠ মেলানো।
কলকাতার দখল পুরোপুরি যেন বামপন্থীদের হাতে চলে গেছে, সরকার ম্রিয়মাণ, প্রায় কিংকর্তব্যবিমূঢ়। খাদ্যের দাবিতে, বাড়তি মজুরির দাবিতে, বন্ধ কারখানা খোলার দাবিতে সপ্তাহে-সপ্তাহে হরতাল-ধর্মঘট, কলকাতার প্রতিটি অঞ্চলের স্তব্ধ হয়ে আসা, সবচেয়ে রোমাঞ্চকর ঘটনা সেপ্টেম্বর মাসে আটচল্লিশ ঘণ্টাব্যাপী ধর্মঘট ঘোষণা বাম দলগুলির পক্ষ থেকে। অমন নিঃশব্দ রূপ মহানগরী এর আগে কোনওদিন পরিগ্রহ করেনি, পরেও না। জননেতা হিশেবে জ্যোতি বসুর প্রখ্যাতি তুঙ্গে।
স্কটিশ চার্চ কলেজে ছাত্রাবস্থা থেকে সমর সেনের সঙ্গে স্নেহাংশুকান্ত আচার্যের বন্ধুত্ব, স্নেহাংশুবাবু কয়েকমাস আগে জেল থেকে বেরিয়ে এসেছেন, ‘নাউ’ পত্রিকায় চে গুয়েভারার সঙ্গে আমার সাক্ষাতের বিবরণ পড়ে আমার সঙ্গে দেখা করার জন্য আগ্রহ প্রকাশ করলেন, সমরবাবু বলমাত্র আলাপ করিয়ে দিলেন। পঁয়ষট্টি সালের মাঝামাঝি থেকে সাতাশ বেকার রোডে আমার নিয়মিত যাওয়া-আসা, কখনও সমরবাবুর সঙ্গে, কখনও একা। স্নেহাংশু ও সুপ্রিয়া আচার্য তাঁদের আতিথেয়তার জন্য সুবিখ্যাত, তার উপর ‘নাউ’ পত্রিকায় এবং অন্যত্র আমার রচনাদি পড়ে তাঁরা বুঝে নিলেন অনুকম্পায়ী একজনকে পাওয়া গেছে। আশ্চর্য চরিত্রের মানুষ ছিলেন স্নেহাংশু আচার্য। ময়মনসিংহের মহারাজকুমার, বিখ্যাত ব্যারিস্টার ব্যোমকেশ চক্রবর্তীর দৌহিত্র, আভিজাত্য তাঁর রন্ধ্রে-রন্ধ্রে। অথচ সর্বস্তরের সবরকম লোকজনের সঙ্গে অক্লেশে মিশতে পারতেন। মজলিশি মানুষ, যে-কোনো আড্ডার প্রাণপুরুষ, খিস্তে-খেউড়ে অপ্রতিদ্বন্দ্বী নায়ক। যে-কোনও ক্রীড়াচর্চায় একেবারে সামনের সারিতে, সংগীতের আসরেও সমান ওজনদার। মানব মনের প্রক্রিয়া দুর্জ্ঞয়ে, এই মানুষটিই ছাত্রাবস্থায় স্বাদেশিকতায় অনুপ্রাণিত হয়ে ‘যুগান্তর’ গোষ্ঠীতে যোগ দিয়েছিলেন, সেখান থেকে, অতল জলের আহ্বান, কমিউনিস্ট পার্টিতে অভিযাত্রা। আদর্শের প্রতি আনুগত্যে তাঁর সামান্যতম খামতি ছিল না। সর্ব ঋতুতে উদার হৃদয়, পরিচিত-অপরিচিতদের বিপন্ন মুহূর্তে টাকা-পয়সা দিয়ে, আইনি পরামর্শ দিয়ে, অন্যান্য বিবিধ উপায়ে যেমন সহায়তার হাত বাড়িয়ে দিয়েছেন, পার্টিকে সাহায্যের ক্ষেত্রেও তাই। দার্জিলিঙে এবং অন্যত্র উত্তরাধিকার সূত্রে পাওয়া সম্পত্তি পার্টির হাতে তুলে দিয়েছেন, দলের পত্রিকা চালানোর জন্য ছাপাখানা কিনে দিয়েছেন, দলের কর্মী-সমর্থকদের জেল থেকে মুক্ত করে আনার প্রতিজ্ঞায় মামলার পর মামলা লড়েছেন, একাই যেন পূর্বপুরুষের পুঞ্জিত পাপের প্রায়শ্চিত্ত সম্পন্ন করবেন। তাঁর কারাবাসের ডায়েরি এক অত্যাশ্চর্য গ্রন্থ, বাইরেকার আচরণে যাঁর লঘুতা-চটুলতার ছটা, তার অন্তঃস্থিত আদর্শ-আনুগত্যের পরিচয় পেয়ে অবাক হতে হয়। সৌরীন্দ্রমোহন মুখোপাধ্যায়ের যে তিন কন্যা—সুজাতা, সুপ্রিয়া, সুচিত্রা—ছাত্র ফেডারেশনের বিভিন্ন আন্দোলনে সক্রিয় ভূমিকা পালন করছেন, সেই বৃত্তান্ত কুড়ি বছর আগে ঢাকা শহরে জানতে পেয়ে উদ্দীপ্ত বোধ করতাম, তাঁদের মধ্যে যিনি দ্বিতীয়, তিনিই আচার্য-জায়া, এই তথ্যও আমার কাছে নতুন করে রোমাঞ্চদ্যোতক।
ক্রমে স্নেহাংশুবাবুর বাড়িতে আরও অনেক বামপন্থী নেতাদের সঙ্গে ঘনিষ্ঠ পরিচয় হলো, বিশেষ করে জ্যোতি বসু ও প্রমোদ দাশগুপ্ত উভয়ের সঙ্গেই। জ্যোতিবাবু বরাবরই স্বল্পবাক্, স্নেহাংশুবাবুর কথার তোড়ে তেমন কোনও যতিপাতের সম্ভাবনা নেই বলে আরও, তবে জ্যোতিবাবর সঙ্গে স্নেহাশুবাবর তিরিশ বছরের দোস্তি, খুব খোলামেলা সম্পর্ক। প্রমোদ দাশগুপ্তের সঙ্গে একটু আলাদা ঘনিষ্ঠতা, তাঁকে খুবই শ্রদ্ধা ও সমীহ করতেন আচার্য-দম্পতি। আরও একটি জিনিশ নজরে এলো: স্নেহাংশুবাবুদের প্রচুর বই, জ্যোতিবাবু বেছে নিতেন হাল্কা মেজাজের কোনও গ্রন্থ, অন্যদিকে প্রমোদবাবু সব সময়ই তত্ত্ব বা নীতি বিষয়ক বই ঢুঁড়ে বের করে বগলদাবা করতেন। দলের শীর্ষ নেতৃদ্বয়ের সঙ্গে পরিচয় স্নেহাংশুবাবুর দৌত্যে ক্রমে গভীরতর হতে লাগলো। ওঁরা প্রথম-প্রথম হয়তো ভাবতেন, আমি প্রায়-সরকারি চাকরি করছি, ওঁদের সঙ্গে মেশামেশিতে আমার ক্ষতিও হতে পারে: ওঁদের সেই জড়তা ভাঙতে মাঝে-মাঝে প্রমোদবাবুকে কিংবা সস্ত্রীক জ্যোতিবাবুকে নৈশাহার অন্তে আমার গাড়িতে বাড়ি পৌঁছে দিতাম।
‘নাউ’ এবং সমরবাবুকে নিয়ে কী করবেন, হুমায়ুন কবির মনস্থির করতে পারছিলেন না। কেন্দ্রীয় সরকার-বিরোধী লেখা বেরোচ্ছে, তা অতি উত্তম, কিন্তু এমন প্রচণ্ড বামঘেঁষা মতামত, যে-কারণে তাঁর যে-বন্ধুবান্ধব পত্রিকা প্রতিষ্ঠার জন্য কবির সাহেবকে টাকা জুগিয়েছিলেন, তাঁরা কুপিত; তিনি নিজেও সমান চিন্তিত। অথচ তখনও সমরবাবুকে খুব ঘাঁটাতে সাহস পাচ্ছিলেন না, আমরা তাই পরম আনন্দে বিপ্লব ভজনা করছিলাম ‘নাউ’ পত্রিকার পৃষ্ঠায়।
হঠাৎ একটু ব্যক্তিগত সমস্যায় পড়া গেল। ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটে চণ্ডীর পরেই পদমর্যাদার দিক থেকে আমার স্থান সবচেয়ে এগিয়ে। ইতিমধ্যে কথা পাকা হয়ে গেছে, চণ্ডী দিল্লি চলে যাবেন সদ্য-গঠিত ভারতের ফুড কর্পোরেশনের সর্বাধ্যক্ষ হয়ে। ইনস্টিটিউটে তাঁর পদে কে বৃত হবেন তা নিয়ে জল ঘোলা শুরু। ইনস্টিটিউটের পরিচালকমণ্ডলীর সভাপতি পদাধিকারবলে মুখ্যমন্ত্রী প্রফুল্লচন্দ্র সেন, তাঁর সিদ্ধান্তই প্রধান। ইতিমধ্যে বাজারে রটে গেছে, এই লোকটা, অশোক মিত্র, যদিও পড়ায় ভালো, কিন্তু পাক্কা কমিউনিস্ট, ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের মতো সম্ভ্রান্ত প্রতিষ্ঠানে তাঁকে অধ্যক্ষ করা হলে সর্বনাশ হবে: কর্তাব্যক্তিদেরও তেমন মতামত। কর্তৃপক্ষের এই বার্তাটি আমার গোচরে আনলেন অমৃতবাজার-যুগান্তর পত্রিকার সুকমলকান্তি ঘোষ, যাঁর সঙ্গে আমার সামান্য পরিচয় ছিল, তিনি নিজেও ছিলেন পরিচালকমণ্ডলীর অন্যতম সদস্য।
একই সময়ে অন্য পট পরিবর্তন। তাঁর অসুখের পর শচীনদা এমনিতেই ‘ইকনমিক উইকলি-র কাজে তেমন নজর দিতে পারতেন না, তার উপর যাঁরা পত্রিকার মূলধনের প্রধান অংশীদার, সেই গোষ্ঠীর কোনো একজনের একটি মন্তব্যে তিনি ঈষৎ অপমান বোধ করলেন, রেগে পত্রিকার প্রকাশ বন্ধ করে দিলেন। বন্ধুবান্ধব ও শুভানুধ্যায়ীদের মধ্যে আলোচনা-পরামর্শ চললো, যে করেই হোক আমাদের নিজস্ব পত্রিকা চাই, সুতরাং নিজেদের মধ্যে চাঁদা তুলে, অন্য অনেকের কাছ থেকে অর্থ সংগ্রহ করে, একটি অছি পরিষদ গঠনের কথা পাকা হলো। অনেক অর্ধপরিচিত-অপরিচিত মানুষও এই পত্রিকা প্রকাশের উদ্যোগের সঙ্গে নিজেদের জড়িত করেছিলেন দেশের বিভিন্ন অঞ্চল থেকে। আমরা সিদ্ধান্ত নিয়েছিলাম, বিদেশী টাকার ফাঁদে পড়বো না, যদিও অনেক বেসরকারি কোম্পানিতে কর্মরত বাক্সওলা নিজেদের ব্যক্তিগত সংগ্রহ থেকে টাকা দিয়েছিলেন, আমরা গ্রহণ করেছি। শচীনদা একই সঙ্গে সম্পাদক ও কার্যনির্বাহী অছি, সুপ্রিম কোর্ট থেকে সদ্য-অবসর-গ্রহণ করা প্রধান বিচারপতি গজেন্দ্রগড়কর মহাশয় অছি সংসদের সভাপতি। ট্রাস্টের নিয়মাবলীতে স্পষ্ট নির্দেশ লিপিবদ্ধ করা হলো, অছি পরিষদের কিংবা অন্য কারওরই সম্পাদকীয় নীতির উপর ছড়ি ঘোরানোর অধিকার থাকবে না, নতুন পত্রিকার নাম হবে ইকনমিক অ্যান্ড পলিটিক্যাল উইকলি। ইকনমিক উইকলি বন্ধ হওয়ার মাস ছয়েকের মধ্যেই ছেষট্টি সালের অগস্ট থেকে নতুন পত্রিকার যাত্রা শুরু।
শচীনদার শরীর ভালো না। কথা উঠলো, আমি মুম্বই গিয়ে নতুন পত্রিকার কার্যনির্বাহী সম্পাদক হতে পারি কি না, শচীনদা একটি পোশাকি চিঠিও দিলেন এ ব্যাপারে। আমার মনে দ্বিধা, আমার স্ত্রীর মনে আরও বেশি, কারণ মুম্বইতে কোথায় গিয়ে থাকবো, এবং পত্রিকার প্রাথমিক অবস্থায় ব্যয়সঙ্কোচ যেখানে অতি প্রয়োজনীয়, সেখানে আমাকে মাইনেপত্তর দেওয়াও একটি বড়ো সমস্যা হয়ে দাঁড়াবে।
এই মানসিক জটিলতার মধ্যে অন্য এক ঘটনার উদ্ভব। দিল্লি থেকে কেন্দ্রীয় কৃষিমন্ত্রী সুব্রহ্মণ্যম্ দূত পাঠালেন, নব-প্রতিষ্ঠিত কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনে আমাকে তিনি সভাপতি করতে আগ্রহী, যদি দয়া করে সম্মতি জানাই। অন্য সূত্রে খবর পেয়েছিলাম, আগ্রহটি কৃষিমন্ত্রীর নয়, প্রধান মন্ত্রী ও তাঁর অনুচরবর্গের। ইন্দিরা গান্ধি তখন আশেপাশে, বোধহয় কৌশলগত কারণেই, অনেক বামপন্থী মানুষজন জড়ো করছিলেন, বামপন্থীরাও হয়তো কৌশলগত কারণেই তাঁর আশেপাশে জড়ো হচ্ছিলেন, এই বুঝি সুযোগ ক্ষমতার অলিন্দে প্রবেশ করবার, সেই সঙ্গে প্রতিক্রিয়াশীলদের রুখবার।
প্রিয়জনদের সঙ্গে কথা বললাম, বিশেষ করে হরেকৃষ্ণ কোঙার-সহ রাজনৈতিক দু’-একজন নেতাস্থানীয়ের সঙ্গে। তাঁরা মত দিলেন, দিল্লি চলে যাওয়াই শ্রেয়, ই পি ডব্লিউ তো আমাদের হাতেই রইলো, দিল্লি থেকেও আমি শচীনদাকে যথেষ্ট সাহায্য করতে পারবো, কেন্দ্রীয় সরকারে অনুপ্রবেশ করা আরও অনেক বেশি জরুরি।
শচীনদা একটু হতাশ হলেন, চণ্ডী হাঁফ ছেড়ে বাঁচলেন, আমাকে ম্যানেজমেন্ট ইনস্টিটিউটের অধ্যক্ষ করা না-গেলেও মহাভারত অশুদ্ধ হবে না, আমি তার চেয়েও অনেক বেশি গুরুত্বপূর্ণ পদে দিল্লি যাচ্ছি। এটাও মজার ব্যাপার, কমিউনিস্ট বলে প্রফুল্ল সেন আমাকে ইনস্টিটিউটের ডিরেক্টর বানালেন না, অথচ ইন্দিরা গান্ধি দিল্লিতে কেন্দ্রীয় সরকারের সচিব পদের সমপর্যায়ভুক্ত দায়িত্ব গ্রহণ করতে আহ্বান জানালেন। অনেকে তখন অবশ্য এরই মধ্যে তত্ত্ব আবিষ্কার করেছিলেন: প্রফুল্ল সেন দক্ষিণগামী, ইন্দিরা গান্ধি বামের দিকে ঝুঁকছেন।
অতএব ছেষট্টি সালের পয়লা নভেম্বর দিল্লিতে কৃষিপণ্য মূল্য কমিশনের সভাপতি হিশেবে যোগ দিলাম, আমার বয়স তখন সবে আটতিরিশ; সম্ভবত এর আগে বা পরে এত কম বয়সে কেউ কোনও সরকারি কমিশনের মাথায় বসেননি।