আপাং গ্রামের বিষবৃক্ষ

আপাং গ্রামের বিষবৃক্ষ

আমরা ভূত দেখতে যাচ্ছি আমার মামার বাড়ির আপাং গ্রামে। শুধুই যে ভূত দেখতে যাচ্ছি, কথাটা বললে কিছুটা ভুল বলা হবে। সেই সঙ্গে দু-দিন ধরে ‘নায়ক অপেরা’-র যাত্রাপালাও দেখব আমরা । চৈত্রসংক্রান্তির গাজনের সময় প্রতি বছর আপাং গ্রামে যাত্রার আসর বসে। কলকাতা থেকে বড়ো বড়ো যাত্রার দল আসে। রথ দেখা আর কলা বেচার মতো আমাদের ভূত দেখা আর যাত্রা শোনা, দুটো কাজই হবে।

যাচ্ছি আমরা পাঁচজন। আমি, আমার বোন দিঠি, রৌণক, হেমেন্দু আর সুকোমল। দিঠির যত-না ভূতে আগ্রহ, তার চেয়ে অনেক বেশি আগ্রহ যাত্রায়। দিঠিকে এককথায় বলা যেতে পারে ‘যাত্রার পোকা’।

মিনিট পনেরো হাঁটার পরই রৌণক বলল, ‘আরও কত দূর রে সুতনু? সেই কখন থেকে হাঁটছি তো হাঁটছিই।’

দিঠি হেসে বলল, ‘তুমি কী গো রৌঁণকদা? কট্টুকু হাঁটলে? এখনও অনেকটা বাকি!’

আমি আগে একদিন স্কুল ছুটির পর বাড়ি ফেরার সময় ওদের গল্প করেছিলাম, ‘জানিস তো, আমার মামার বাড়ির আপাং গ্রামে কেউ নাকি কোনোদিন ভূত দেখেনি। তাতে কোনো ক্ষতি হয়নি। পৃথিবীতে সকলকেই ভূত দেখতে হবে এমন কী কথা আছে? তবু আশেপাশের গ্রামের লোকের মুখে যখন তাদের গ্রামের ভূতের গল্প শোনে, তখন আপাং গ্রামের সকলেরই কেমন মন খারাপ হয়ে যায়।’

সুকোমল কৌতুকের গলায় বলল, ‘ভূত না দেখলে যদি মন খারাপ হয়ে যায়, তা হলে ভূত দেখলে নিশ্চয়ই তাদের মন ভালো হয়ে যাওয়ার কথা?’

দিঠি আমাদের ভূত আর যাত্রা দেখতে যাওয়ার টিমের সবচেয়ে ছোটো সদস্য। সবে সেভেন পাসের পরীক্ষা দিয়েছে। একথা তার কানেই ঢুকল না। সে চোখ বড়ো বড়ো করে বলল, ‘জানো তো রৌণকদা, আমাদের বাড়ি থেকে মামাদের গ্রামের দূরত্ব ফিতে দিয়ে মাপলে সাত কিলোমিটারের বেশি হবে বই কম নয়।’

আমি দিঠির মুখ থেকে কথা কেড়ে নিয়ে বললাম, ‘প্রথমে তাহেরপুরের একটা চৌকো মাঠ পেরোলে বাঁদিকে একটা শুকনো খাল পড়বে। বছরের বেশিরভাগ সময় সে-খালে একফোঁটা জল থাকে না। এমনকী, বর্ষাকালে খুব সামান্য ছিরছিরে একটা সোঁতা মাঠঘাট থেকে নেমে আসে বটে, কিন্তু তাকে স্রোত বললে খানিকটা বাড়িয়েই বলা হবে।’

হেমেন্দু মুখটা গম্ভীর করে বলল, ‘সে-খালের পাড় ধরে টং টং করে হাঁটতে হবে তো? কিন্তু কতক্ষণ?’

আমি বললাম, ‘সে-খালের পাড় ধরে হাঁটতে থাকলে আধঘণ্টাটাক পরে পড়বে একটা ঝাঁকড়া বাজ-পড়া ন্যাড়া বিষবৃক্ষের গাছ। গাছটার কেন যে অমন ‘বিষবৃক্ষ’ নাম, দু-দশটা গ্রামের কেউ বলতে পারে না। কেউ বলে ওটা কী একটা জঙ্গুলে গাছ। দেখলে মনে হয়, বাজ পড়েছিল কোনোদিন। সত্যিই বাজ পড়েছিল হয়তো! কেমন ন্যাড়ামুড়ো ধরনের ডালপালা নিয়ে দাঁড়িয়ে আছে গাছটা। তবে কবে যে সে-গাছে বাজ পড়েছিল, সেকথা কেউ মনে করতে পারে না। গাছটায় কোনোদিন ফুল ফুটেছিল কি না তাও কেউ মনে করতে পারে না। কেউ বলে সে-গাছে নাকি এক-শো বছরে একবার ফুল ফোটে। এসব লোকমুখের কথা। সে-কথায় ইচ্ছে হলে কেউ কান দেয়, নয়তো দেয় না। তাই সে-গাছে ফলের দেখা পেয়েছে এমন লোকেরও এ পর্যন্ত দেখা পাওয়া যায়নি।’

সুকোমল হেসে বলল, ‘তা হলে আমরা তোর মামার বাড়ি যাচ্ছি কেন? সে-গ্রামে যখন কেউ কোনোদিন ভূত দেখেনি, আমরা আর সেখানে ভূতের দেখা পাব কী করে?’

দিঠি বলল, ‘কেন, যাত্রা দেখব তো? সেটাই বা কম কী?’

আমি দিঠির কথায় আমল না দিয়ে বললাম, ‘সেই বিষবৃক্ষ পেরিয়ে আরও আধঘণ্টা হাঁটলে তবে মামাদের আপাং গ্রাম।’

রৌণক বলল, ‘আপাং! ও আবার কেমন নাম রে তোর মামাদের গ্রামের?’

আমি বললাম, ‘মামাদের গ্রামে একসময় নাকি আপাং গাছের জঙ্গল ছিল। গাছের বীজগুলো ছিল খেলনা ধনুকের তিরের মতো দেখতে। মানুষের গায়ে লাগলে চামড়ার উপরে গেঁথে যেত! অনেকটা চোরকাঁটার মতো দেখতে বলতে পারিস। সেই থেকে মামাদের গ্রামের ওরকম নাম হয়েছে।’

ততক্ষণে কথায় কথায় আমরা হাঁটতে হাঁটতে সেই বিষবৃক্ষের নীচে এসে দাঁড়িয়েছি। দূরে আকাশের গায়ে টইটই করে বিকেল নামছে সন্ধ্যের দিকে। দুটো কাক কা কা করে কীসের যেন খবর জানাচ্ছে আমাদের বিষবৃক্ষের ডালে বসে। লোকে বলে কাক যখন কা কা করে একটানা ডাকে, তখন তারা নাকি কোনো খারাপ খবর আগাম জানাতে চায়।

রৌণক গাছটার দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে বলল, ‘এটাই তোর সেই বিষবৃক্ষ?’

আমি মাথা নাড়লাম, হ্যাঁ! মুখে কিছু বললাম না। তবে একটা কথা আমি ওদের এখনও বলিনি। একদম শেষে বলব বলে সেই কথাটা এখনও খরচ করিনি।

কথাটা হল, আমি আগেও যখন মামার বাড়ি এসেছি, তখন দেখেছি, এই বিষবৃক্ষের নীচে এলে কেমন একটা গা শিরশিরে শব্দ শোনা যেত। সে-শব্দটা শুনলে কখনো মনে হত, এবার বুঝি দূর থেকে একটা ঝোড়ো বাতাস আসবে। সব কিছু উড়িয়ে নিয়ে যাবে এক্ষুনি। আবার কখনো মনে হত, শব্দটা আসছে গাছটার ন্যাড়ামুড়ো ডালপালা থেকে। অনেকটা ঝিঁঝি পোকার হালকা ডাকের মতো।

মামাদের গ্রামে ভূত আছে কি নেই, সে-কথা আলাদা। কিন্তু মামাদের গ্রামের মিলনদাদুর সঙ্গে যখন দেখা হত, তাঁকে সবসময়ই খুব খুশি খুশি মনে হত। মামাদের গ্রামের চন্ডীমন্ডপের আটচালার নীচে সন্ধ্যেবেলা মিলনদাদুকে ঘিরে আমরা অনেকে গোল হয়ে বসতাম। তিনি হাসিখুশি মুখে নানা রকম গল্প শোনাতেন। কখনো কখনো আমাদের স্বাধীনতা সংগ্রামের গল্পও বলতেন।

আমি একদিন মিলনদাদুকে জিজ্ঞেস করেছিলাম, ‘আচ্ছা দাদু, তুমি সবসময় এত হাসিখুশি থাকো কী করে? তোমার মনে কোনো দুঃখ হয় না কখনো?’

মিলনদাদু ঘাড় নেড়ে বলেছিলেন, ‘না, আমার দুঃখ হয় না কখনো। কেন জানতে চাস?’

আমি ঘাড় নেড়ে বলেছিলাম, ‘বলো না!’

দাদু বলেছিলেন, ‘একদিন বলব। আজ না।’

তারও অনেক পরে একবার অ্যানুয়াল পরীক্ষার পর মামারবাড়ি গিয়েছি। সেবার দিঠি যায়নি। তখন সন্ধ্যে নামতে খুব বেশি দেরি নেই। একটা চামচিকে আমার মাথার উপর একটা চক্কর দিয়ে শাঁ করে বাঁশবাগানের দিকে উড়ে গেল। আমি শালুকদিঘির পাড় দিয়ে যখন মামারবাড়ির দিকে বাঁক নেব, ঠিক তখনই মিলনদাদুর সঙ্গে মুখোমুখি দেখা। দাদু আমাকে একা পেয়ে হেসে বললেন, ‘তুই একবার আমার কাছে একটা কথা জানতে চেয়েছিলি না? আজ তোকে সেই কথাটাই বলব।’

আমি তো অবাক। আকাশ থেকে পড়লাম। কবে, দাদুর কাছে এমন কী কথা জানতে চেয়েছিলাম, কিচ্ছু মনে নেই। মনে করার চেষ্টা করলাম। না:, কিচ্ছু মনে পড়ছে না। কিছুটা অবাক দৃষ্টিতে দাদুর মুখের দিকে তাকিয়ে থাকলাম।

দাদু বললেন, ‘তোরা এখনকার ছেলে। তোদের ওই এক দোষ। কিচ্ছু মনে রাখতে পারিস না। সেই যে জানতে চেয়েছিলি না, আমি কেমন করে এত হাসিখুশি থাকি?’

তখন আমার মনে পড়ে গেল কথাটা। দু-দিকে ঘাড় বাঁকিয়ে বললাম, ‘হ্যাঁ, হ্যাঁ। জানতে চেয়েছিলাম তো! তুমি পরে বলবে বলেছিলে, তারপর তো আর কোনোদিন বললেই না।’

মিলনদাদু ফিকফিক করে হাসলেন কিছুক্ষণ। তারপর বললেন, ‘তুই তো শুনেছিস, আমাদের গ্রামে কেউ কোনোদিন ভূত দেখেনি। তাই সকলের সারাক্ষণ মন খারাপ হয়ে থাকে। কিন্তু আমি ভূত দেখি। প্রতি পূর্ণিমা রাতে। জানিস তো, ভূত দেখলে মানুষের মন ভালো হয়ে যায়? তাই কখনো আমার মনে দুঃখ দেখবি না। ভূত দেখি বলে আমার মন সবসময় খুশি থাকে। বেশ কিছুদিন ধরে যদি ভূত না দেখি, যেই মনটা বিষণ্ণ বিষণ্ণ লাগে, অমনি সে-গাছটার কাছে চলে যাই। একটা বাজ-পড়া গাছের মাথায় বলতে গেলে ছোটোখাটো মতো একটা ভূতের গোটা গ্রাম আছে বলা যায়।’

দুটো জোনাকি আমার হাঁটুর পাশ দিয়ে উড়ে গেল। দাদুকে কীরকম একদম অচেনা লাগছে। দাদুর গায়ের হলদেটে ফতুয়াটা পার্টি অফিসের পতাকার মতো পতপত করে উড়ছে বাতাসে। মাথার বাউরি চুলের জটার ফাঁকফোকরে ঝাঁকঝাঁক জোনাকি লুকিয়ে আছে বলে মনে হল। চোখের সরু ফ্রেমের চশমাটা ঝুলে পড়েছে নাকের ডগা ছাড়িয়ে। দু-চোখের তারায় চোখ ফোটেনি এমন দুটো মথের বাচ্চা যেন বসে আছে ডানা গুটিয়ে, গাঢ় অন্ধকারের অপেক্ষায়।

আমি ফট করে বলে ফেললাম, ‘দাদু, ওকথা একদিন চন্ডীমন্ডপের আটচালায় বসে শুনব।’ বলেই এক ছুটে সোজা মামার বাড়ি।

এসব কথা রৌণকদের বলিনি। শুধু বললাম, ‘তোদের ভূত দেখাব বলেই যখন নিয়ে যাচ্ছি, তখন আমার উপর ভরসা রাখতেই পারিস।’

এমন সময় বিষবৃক্ষের একটা মোটা শিকড়ের উপর ধপাস করে বসে পড়ল সুকোমল। বলল, ‘দাঁড়া, খুব সুন্দর বাতাস বইছে। একটুখানি জিরিয়ে নিই। দ্যাখ, এই গরমে জামাটা কেমন শপশপে হয়ে ভিজে গেছে!’

সত্যি, সুকোমলের দিকে তাকালাম, ও ঘেমে একেবারে ভিজে উঠেছে। ওর দেখাদেখি হেমেন্দুও বসে পড়ল ঘাসের উপর। আমি আর বাকি থাকি কেন? আমিও বসে পড়লাম। দিঠি দূরের আকাশের মেঘে মেঘে ঘরবাড়ি, গাছপালা খুঁজতে লাগল আপনমনে। রৌণক দু-একবার ফুটবলারদের মতো গা ঘামাবার চেষ্টা করে শেষে সেও বসে পড়ল মাটিতেই।

রৌণকের এক পিসি থাকেন টাটার ডিমনা লেকের কাছে। পরিকল্পনা চলল, এর পরে কয়েক দিনের ছুটি পেলেই আমাদের গন্তব্য হবে ডিমনা লেক। আমি বললাম, ‘সেবার অবশ্য দিঠিকে সঙ্গে নেওয়ার প্রশ্ন নেই। ও একটা ভিতুর ডিম!’

সঙ্গে সঙ্গে প্রতিবাদ করল দিঠি, ‘কেন, আমার ভিতুর কী দেখলে দাদা? তোমরা বলো কোথায় ভূত আছে, আমি সেখানে গিয়ে ভূতকে টিকি ধরে হিড়হিড় করে টেনে আনতে পারি কি না দ্যাখো, তারপর বোলো!’

হেমেন্দু দিঠির দিকে মজার চোখে তাকিয়ে বলল, ‘ভূতের মাথায় টিকি থাকে কখনো শুনিনি। দিঠি, তুই নিশ্চয়ই ভূতের টিকি দেখেছিস?’

হেমেন্দুর কথায় ভারি রাগ হয়ে গেল দিঠির। মুখ ভার করে আকাশের দিকেই তাকিয়ে থাকল।

দেখতে দেখতে আকাশের ঈশান কোণের দিকে একটা কালো মেঘ উঠতেই ধুলো উড়িয়ে ভয়াল কালবৈশাখী ঝড় ধেয়ে এল। ধুলোয় চারদিক অন্ধকার। আমরা কেউ কাউকেই দেখতেই পাচ্ছি না। ঘনঘন বাজ পড়তে লাগল কড়কড় শব্দে। বিদ্যুৎ চমকাতে লাগল। মনে হল যেন, এক্ষুনি মহাপ্রলয় ঘনিয়ে আসবে।

সুকোমলের চোখে ধুলো পড়েছে। সে চোখ ঘষতে ঘষতে বলল, ‘সুতনু, এবার কী হবে? এখনও তো আধ ঘণ্টার পথ বাকি?’

সুকোমলের কথা শেষ হয়েছে কি হয়নি, চারদিক ঝাপসা হয়ে হুড়মুড় করে নেমে এল বৃষ্টি। আমরা পাঁচজন গোল হয়ে গুঁড়ির কাছে জটলা করে বসে পড়লাম। পাঁচজনেই ভিজে একশা।

একটু পরে দিঠি বৃষ্টিতে ভিজে কাঁপতে শুরু করল ঠকঠক করে। আমি বললাম, ‘দিঠি, এই জন্যে তোকে আমাদের সঙ্গে আসতে না করেছিলাম। এবার বোঝ! একটু শীত সহ্য করার ক্ষমতা নেই!’

আমার এই দোষারোপ কারও কানে পৌঁছল না। অন্ধকার ঘন হয়ে উঠল। তখনও বৃষ্টি থামার কোনো লক্ষণ নেই। কী করব আমরা কেউ ভেবে উঠতে পারছি না। এমন সময় প্রচন্ড ঝড়ে বিষবৃক্ষের একটা মোটা ডাল মড়মড় করে ভেঙে পড়ল একেবারে আমাদের সামনে। তারই একটা সরু ডালের ঝটকা এসে লাগল হেমেন্দুর মুখে। ‘আঁক’ করে চিৎকার করে উঠল হেমেন্দু। তক্ষুনি একটা বাজ এসে পড়ল একেবারে আমাদের মুখের সামনে। চোখ ধাঁধিয়ে গেল সকলের। কিছুক্ষণ আমরা কিছুই দেখতে পেলাম না। বাজের আগুনে ঘাস পুড়ে যাওয়ার গন্ধ এসে নাকে লাগল আমাদের। দিঠি ভয়ে আমার গায়ে জড়সড় হয়ে সেঁটে আছে। রৌণকের মুখ দিয়ে কোনো শব্দই বেরোচ্ছে না।

এমন সময় সুকোমল বিষবৃক্ষের দিকে ঘাড় উঁচু করে তাকিয়ে চিৎকার করে উঠল, ‘ওই দ্যাখ, একটা ঝাঁকড়া মাথা কেউ গাছ থেকে সড়সড় করে নেমে আসছে?’

ব্যাস, ধপাস! তারপর আর সুকোমলের কোনো সাড়া পাওয়া গেল না। রৌণক চিৎকার করে উঠল, ‘সুকোমল জ্ঞান হারাল যে?’

তক্ষুনি কেউ যেন সত্যি সত্যি আমার, রৌণকের আর হেমেন্দুর মাথা তিনটেকে ধরে প্রচন্ড জোরে ঠুকে দিতে লাগল। মাথা ঘুরে একটা মোটা শিকড়ের উপর পড়ে গেল হেমেন্দু। তাকে আর নড়তে দেখলাম না। দিঠি ছিটকে চলে গেল কয়েক হাত দূরে। তারপর সেও চুপ করে গেল। তারও গলা থেকে কোনো আওয়াজ পাওয়া গেল না।

তখনই শুনতে পেলাম, দূর থেকে ভেসে আসছে সরু মিহি কন্ঠে অনেক লোকের কথা। প্রথমে মনে হল এই পথেই কিছু লোক আপাং গ্রামে যাচ্ছে। তাদেরই গলার স্বর ভেসে আসছে। বৃষ্টিতে ভিজে গলার স্বর অমন মিহি শোনাচ্ছে। কিন্তু একটু পরে মনে হল, না। কই কোনো লোক তো এগিয়ে আসছে না। এতক্ষণে লোকগুলোর আমাদের কাছে চলে আসার কথা। ভয়ে আমার হাত-পা কাঁপছে। তখনই মনে হল, ওই অত গলার স্বর ভেসে আসছে বিষবৃক্ষের মগ ডালের দিক থেকে। আর অসংখ্য অতিকায় লম্বা ঝুলন্ত হাত সাপের মতো কিলবিল করছে আমাদের চারপাশে।

রৌণক আর্ত কন্ঠে চিৎকার করল, ‘সুতনু, কে যেন আমার গলা টিপে মেরে ফেলতে চাইছে। আমার দম বন্ধ হয়ে আসছে। বাঁচা আমাকে! না হলে এরা এক্ষুনি মেরে ফেলবে। পালা!’

রৌণক কথাটা বলল বটে, কিন্তু নিজে পালাতে পারল না। দুম করে পড়ে গেল মাটিতে।

রৌণককে পড়ে যেতে দেখে আমার মাথাটা মহাকাশযানের গতিতে বাঁই করে ঘুরে গেল। আর কিছু মনে নেই। আমরা কতক্ষণ এভাবে বিষবৃক্ষের তলায় পড়েছিলাম, জানি না। হঠাৎ আমার জ্ঞান ফিরতে দেখলাম, দিঠির মাথা আমার কোলে। আমি দিঠির মাথায় হাত বুলিয়ে দিতে লাগলাম। বললাম, ‘কী রে, খুব ভয় পেয়েছিস?’

দূরে তাকিয়ে দেখলাম, গোটা চরাচর তখন ভেসে যাচ্ছে পূর্ণিমার চাঁদের আলোয়।

রৌণক, হেমেন্দু, সুকোমল, একে একে উঠে বসল সকলে। ওদের চোখ-মুখ দেখে মনে হল, তখনও কারোরই ভয়ের ঘোর কাটেনি। কারও মুখ থেকে কোনো কথা বেরোচ্ছে না।

একটু পরে দিঠি বলল, ‘ওই শোন দাদা, যাত্রা শুরু হয়ে গেছে! চল, চল! ওই তো শুনতে পাচ্ছিস না দুর্যোধনের গলা ভেসে আসছে?’

আমি শুনলাম, মামাদের আপাং গ্রামের মাইক থেকে ভেসে আসছে দুর্যোধনের গলা, ‘বিনা যুদ্ধে নাহি দেব সূচ্যগ্র মেদিনী!’

আমরা সকলে জল-কাদা মাখা অবস্থায় উঠে দাঁড়িয়ে মন্ত্রমুগ্ধের মতো এগিয়ে চললাম আপাং গ্রামের দিকে। আমি মনে মনে ঠিক করলাম, কালই মিলনদাদুকে জিজ্ঞেস করতে হবে, ‘দাদু, তুমি সেদিন ভূতে ভরা বাজ-পড়া যে গাছটার কথা বলেছিলে, সেটা কি ওই বিষবৃক্ষ?’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *