আপস
এটা গল্প ঠিক নয়, মনস্তত্ত্বগ হিউম্যান বিহেভিয়ারিজম বা মানবিক আচরণের একটা অতিবাস্তব নজির বলা যেতে পারে। পল্লব গুপ্ত বয়সে আমার থেকে ঢের ছোট হলেও বন্ধুস্থানীয়। দাদা বলে ডাকে কিন্তু জিভ ছুটলে মনে-মুখে লাগাম নেই। এক-এক সময় ওর কথা শুনলে আমারই কানের ডগার রং বদলায়। কিন্তু ও-ছেলের এতটুকু সংকোচের বালাই নেই।
এক-একজন থাকে যার স্বভাব-চরিত্রের অবাঞ্ছিত দিকগুলোও বেশ অনায়াসে বরদাস্ত করা যায়, অন্যায় করে বেড়ালেও খুব অসহ্যরকমের অন্যায় মনে হয় না। সেগুলো দোষের ব্যাপারগুলো জানা থাকলেও তার সঙ্গ-সান্নিধ্য ভাল লাগে। পল্লব গুপ্ত সেই জাতের একজন।
পৈতৃক অবস্থা ভাল, নিজে মস্ত ফার্মের মোটা মাইনের পাবলিক রিলেশনস অফিসার। অনেকের মতে, এই চাকরিটাই ওকে আরো তরল-মতি করে তুলেছে। পকেটে সর্বদা দামী সিগার মজুত, হাতেও একটা জ্বলছেই। বড় বড় পার্টিকে বশে আনার দায় তার, সেই কারণে ওর কোম্পানির অঢেল খরচা করতেও দ্বিধা নেই –আর তাদের চিত্তবিনোদনের এই সব খরচাই হয়ে থাকে পল্লব গুপ্তর মারফত। পি. আর. ও.পাবলিক রিলেশনস অফিসার, অতএব সে-ই হোস্ট। ফলে, বড় বড় ড্রিঙ্ক পার্টিতে সকলের কাছে নিজেকে ইনটারেস্টিং করে তোলাটা চাকরির অঙ্গ। আর তার ফলে দস্তুরমত পানাসক্ত যে হয়ে পড়ছে এও নিজেই স্বীকার করে। নিজেই এক-এক সময় বলে, এ-শালার চাকরি থেকে কোনো একদিন রিটায়ার করার পর অবস্থাখানা যা হবে আমার, স্বভাব-চরিত্র একেবারে খেয়ে দিলে। কিন্তু এ নিয়ে ও সত্যি এতটুকু দুশ্চিন্তায় পড়েছে এ কোনদিন মনে হত না। পৈতৃক সম্পত্তি যা আছে তাতেও দুই-এক পুরুষ চোখ বুজে জাহান্নমে যেতে পারে।
পল্লব গুপ্তর স্বভাব-চরিত্রের আরো একটা দুর্বল দিক আছে। সেটা সুরূপা রমণী সংক্রান্ত। দিলখোলা হাসি-খুশি মিষ্টি চেহারার ছেলেটার মেয়েমহলেও বেশ কদর। এই ব্যাপারে বারকয়েক বিপাকে পড়তে পড়তে কোনরকমে পিছলে বেরিয়ে এসেছে। তবু মেয়েদের নিয়ে হৈ-হুঁল্লোড় করে আনন্দে কাটানার নেশাটা ছাড়তে পারেনি। একবার এক উঠতি ফিল্ম-আর্টিস্টের পিছনে এমন মেতে গেল যে চাকরি-বাকরি শিকেয় ওঠার দাখিল। আমরাও ধরেই নিলাম ওই ফিল্ম-আর্টিস্টই ওর গলায় ঝুলল। শেষে একদিন ও এসে নিজে থেকেই বলল, বাপের পুণ্যিতে খুব কাটান দিয়ে এলাম দাদা–বারোটা বেজে গেছল আর কি!
কৌতূহল চেপে জিজ্ঞাসা করেছি, এত কি ভয়ের ব্যাপার ছিল?
-আর বলেন কেন দাদা, এমন বুদ্ধ বনে গেলাম না যে নিজেকেই রামছাগল বলে গালাগাল না দিয়ে পারলাম না। আচ্ছা দাদা, আপনার কাছেও তো এনেছিলাম একদিন, নিজেই দেখেছেন–এমন নরম-সরম মিষ্টি হাবভাব দেখলে কোন শালা না। ধরে নেবে অক্ষত কুমারাটি একেবারে–আরও ভেবেছিলাম বারো ভূতে দেবে অমন একটা মেয়েকে লুটে-পুটে শেষ করে, তার আগে নিজেই পাকাপাকি দখল নিয়ে বসি। অনেকটা এগিয়েও ছিলাম বেশ, শেষে বলে কিনা, তোমাকে ছাড়া আর আমার চলছে না–এবারে ডিভোর্স স্যুট ফাইল করা যাক একটা, খরচপত্র যা লাগে তুমিই দেবে কিন্তু বাপু। শেষে জেরায় এগিয়ে আমি তো চিত্তির–শুধু বিবাহিতা নয়, দুদুটো মেয়ে আছে মহিলার!
-তারপর?
-তারপর আর কি, আমি বললাম, তার ডিভোর্স সহজ হলেও আমার ডিভোর্স সহজ হবে না, আমার গৃহিণীটি আঁশ-বঁটি নিয়ে তাড়া করবে দুজনকেই। আমিও বিবাহিত শুনে সে প্রথমে তাজ্জব, তারপর ঠক-প্রবঞ্চক রাস্কেল-টাস্কেল বলে বিদায় দিল আমাকে। আমি মনে মনে গঙ্গার চান সেরে সোজা আপনার এখানে, কারণ আপনি অবান্তরে এগোতে বারণই করেছিলেন আমাকে।
কেন বারণ করেছিলাম সঠিক বলতে পারব না, ফিল্ম-আর্টিস্টকে নিয়ে ওর সংসারযাত্রা খুব সুনির্বিঘ্ন হবে মনে হয়নি সম্ভবত। কিন্তু ছেলেটার উপস্থিত বুদ্ধি দেখে খুশি হয়েছি। ধাক্কা খেয়ে তক্ষুনি নিজেকেও বিবাহিত বলে চালিয়ে দিয়ে এসেছে। কিন্তু ওই গোছের আরো ছোট-খাটো দুই-একটা ধাক্কা খাবার পরেও ও-যে রমণীসঙ্গবিরহিত জীবন যাপন করছে, এমন নয়। এখনো অনেক সময় অনেক রকম মেয়ের সঙ্গে ওকে মেলামেশা করতে দেখা যায়। আর অম্লানবদনে নিজের এমন সব কীর্তির কথা বলে যে সাধারণস্থলে কান গরম হবার কথা। কিন্তু পল্লব গুপ্তর বলার ঢংটাই এমন-যে না শুনে পারা যায় না–শোনার পর ধমক-ধামকের প্রশ্ন।
এ-হেন পল্লব গুপ্ত একদিন এসে মুখ বেজার করে বলল, এবারে সত্যিই একটা যন্তন্নার মধ্যে পড়ে গেলাম দাদা, কি যে করি
জিজ্ঞাসা করলাম, কি ব্যাপার–কোনো মেয়ে?
–তাছাড়া আর কি!
–আবার ফেঁসেছ?
–ফেঁসে যাবার জন্য এবারে তো আমি হাঁ করে আছি, কিন্তু সে-ভাগ্য হবে কি হবে না সেই চিন্তাতেই তো এত যন্ত্রণা! আচ্ছা দাদা, এর নামই কি প্রেম?
জবাব না দিয়ে আবার জিজ্ঞাসা করলাম, মেয়েটা কে, আবার কোনো ফিল্ম আর্টিস্ট?
-না না, সে-রকম কিছু নয়–সোজাসুজি এক ভাল মধ্যবিত্ত ঘরের মেয়ে-বলেই ফেলি আপনাকে, আমার মাসির ভাশুরের মেয়ে। সেই চৌদ্দ বছর বয়সে দেখেছিলাম মেয়েটাকে, ভাল করে ফিরেও তাকাইনি–তখন বিশ বছর বয়েস আমার, আঠেরো বিশের শাড়ি-পরা সেই সব ডবকা ইয়ের মেয়ে ভিন্ন কারো দিকে তাকাতামই না। কিন্তু সেই চৌদ্দ বছরের মেয়ে যে বাইশ বছর বয়সে এ-রকম হয় তখন কি ছাই একবারও মনে হয়েছে। বিশ্বাস করবেন না দাদা, পাশ ঘেঁষে চলে গেলেও মনে হয় গায়ে এক ঝলক গরম বাতাসের ঘেঁকা লাগল। আর চোখে চোখ রেখে হেসে হেসে কথা বলে যখন, উঃ! এক গেলাস জল খাওয়ান দাদা
হাসি চেপে জল এনে দিয়ে জিজ্ঞাসা করলাম, তা কতদিন এই দশা চলেছে। তোমার?
টানা দুমাস হয়ে গেল। কিন্তু যত দিন যাচ্ছে দাদা আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি। মাথার মধ্যে বুকের মধ্যে চোখের মধ্যে কেবল ওই মঞ্জরী সেনই ঘুরপাক খাচ্ছে দিবারাত্র।
–তোমাকে সে-রকম পাত্তা দিচ্ছে না?
-একেবারে দিচ্ছে না বললেও ঠিক হবে না। হাজার হোক বাপের বিষয়ের সুপুর হয়ে বসেছি, ভাল চাকরি করি, নিজের একটা ঝকঝকে গাড়িও আছে-সকলের চোখে আমার দাম যে কিছু আছে সেটা ও মেয়েও বোঝে। কিন্তু ওই চেহারাপত্তর নিয়ে সে এই বাইশ বছর পর্যন্ত নিজেকে আগলে বসে আছে বর্গে তো বিশ্বাস হয়। না–দখলদারির জন্যে কে হাঁ করে আছে জানতে পারলে তবে তো ডুয়েল-টুয়েল লড়তে পারি–সেটাই যে কিছু আঁচ করতে পারছি না। মাসির মুখে শুনেছি, এম. এ. পাস না করে বিয়ে করবে না ঘোষণা করেছিল নাকি-কিন্তু আসলে সেটা কাউকে কিছু সময় দেবার ছল কিনা কে জানে-এবারে এম. এ. পাস করেছে শুনে আমার বুকের প্যালপিটেশানে ধড়াস ধড়াস শব্দ হচ্ছে।… ভাল কথা, মঞ্জরীর সঙ্গে কাল কিছু সাহিত্য-আলোচনা হয়েছিল। সেই কবে ইংরেজিতে এম. এ. পাস করেছিলাম, এতদিনে। সব গুলে খেয়ে বসে আছি! আর বাংলা সাহিত্যের দৌড় বঙ্কিম আর শরৎ পর্যন্ত, তাও বঙ্কিমের নায়িকার সঙ্গে শরৎবাবুর নায়িকা গুলিয়ে গেছে-কিন্তু মঞ্জরী দেখলাম আধুনিক সাহিত্য নিয়ে মাথা ঘামাচ্ছে, আপনার নামও দু-চারবার করল, কি ছাই লিখেছেন খানকতক বই বার করুন তো, প্রেসটিজটা বাঁচাই–
ওর পাল্লায় পড়লে আমারই প্রেসটিজের দফারফা হবার ম্ভাবনা। কিন্তু আলমারির বইয়ের কলেবর দেখে পল্লব আঁতকে উঠল।-এ আমার পড়ার সময় হবে কখন! তার থেকে বরং দু-চারখানা বইয়ের পাঁচ-সাত লাইনের মধ্যে জিস্ট বলে দিন তাই দিয়েই সামলে নেব।
অব্যাহতি পাবার আশায় বললাম, তার থেকে তুমি বরং কিছু জানান না দিয়ে মঞ্জরী সেনকে এখানে একদিন ধরে নিয়ে এসো, সে তার ইচ্ছেমত বই বেছে নেবেখন, আর সাহিত্যিকদের সঙ্গে তোমার যোগাযোগ আছে এও ধরেই নেবে।
ও বলল, মতলবটা ভালই দিয়েছেন। দেখা যাক।
যাবার আগে মঞ্জরী সেন সম্পর্কে আরো একটু খবর দিল পল্লব গুপ্ত। সমবয়সী মাসতুতো ভাই বলেছে, মঞ্জরী সে-রকম কোন ছেলেকে ধরে বসে আছে বলে মনে হয় না। তবে একটা ছেলে–তার নাম অনিমেষ সরকার, সে এখনো প্রায়ই ওদের। বাড়িতে আসে। আগে মঞ্জরীদের পাড়াতেই থাকত সেই লোক, ভাড়া না পেয়ে বাড়িওলা কেস করে তাদের উঠিয়েছে। লোকটা রাজনীতি করত, জেল-টেলও খেটেছে। মঞ্জরী নাকি আদর্শ নিয়ে খুব মাথা ঘামায়, তাই তার কাছে এই লোকটির কদর। তাকে নিয়ে মঞ্জরীর ভবিষ্যৎ কোন পরিকল্পনা আছে কিনা সেটা অবশ্য মাসতুতো ভাই সঠিক বলতে পারল না। ওদের বাড়ি গিয়ে সেই অনিমেষ সরকারকে মঞ্জরীর সঙ্গে কথা বলতেও দেখেছে পল্লব-একদিন নয়, দুদিন দেখেছে। আর তারপর থেকে গুণ্ডা লাগিয়ে খতম করা যায় কিনা সে-কথাও ভাবছে।
সব মিলিয়ে বোঝা গেল মঞ্জরী সেন নামে একটা মেয়ের জন্য পল্লব গুপ্তর এখন আহার-নিদ্রা ঘুচতে বসেছে।
সত্যিই মঞ্জরীকে একদিন বাড়ি নিয়ে এলো সে। আর আমারও ভালই লাগল। রূপসী না হোক বেশ সুন্দরীই বটে। আর সমস্ত মুখে ভারী একটা লাবণ্য মাখা। আমি পল্লবের প্রশংসা করলাম খুব, আর খানকতক বইয়ে তার নাম লিখে দিলাম। পরদিনই পল্লব লাফাতে লাফাতে এসে হাজির।
–দাদা, কাল আমার প্রেসটিজ যে কি বেড়ে গেছে ভাবতেই পারবেন না–বেরিয়ে এসে আমাকে চোখ রাঙালো, এ-রকম একজন লোকের সঙ্গে এত খাতির আমাকে কক্ষনো বলেননি পর্যন্ত! দাদা, আপনি যে এ-রকম একজন লোক সে তো আমিও এই প্রথম শুনছি!
আমার হাসিই পাচ্ছিল। জিজ্ঞাসা করলাম, অনিমেষ সরকারের খবর কি?
হেসে হেসে পল্লব বলল, অনিমেষ সরকারের?–তার বরও মাসতুতো ভাইয়ের মুখে যা শুনলাম আশাপ্রদ। আমার বরাত-গুণে লোকটা নিতান্ত গরীব–আর এরই মধ্যে নাকি কতগুলো ছোট ছোট ভাই-বোন রেখে তার বাবা মারা গেছে–বাবার বদলে অনিমেষ সরকার গেলে আরো একটু খুশি হওয়া যেত। তবে আর একটা ভাল খবর শুনলাম, মঞ্জরীর মা নাকি সাংঘাতিক গরীব ঘরের মেয়ে ছিল, রূপের জোরে সুখের ঘরে এসেছে। তাই মেয়ের কোন গরীব ছেলের সঙ্গে চেনা-জানা আছে শুনলেও নাকি ত্রাস তার। এই কারণেই অনিমেষ সরকারকে মা দুচক্ষে দেখতে পারে না। আর মাসতুতো ভাই বলে মঞ্জরীও গরীবানা চালে থেকে অভ্যস্ত নয়–যতই আদর্শ আর্শ করুক।
এরপর পল্লব গুপ্ত আবার একদিন এসে আনন্দের আতিশয্যে আমাকে ধরে দুটো ঝাঁকানি দিল। তারপর বিয়ের নেমন্তন্ন-পত্র হাতে দিল। বলল, এ যে এত সহজ ব্যাপার হবে ভাবতেও পারিনি দাদা–ওদের লক্ষ্যও যে আমি এ কি ছাই আগে বুঝেছি! তাহলে নির্লিপ্ত থেকে নিজের আর একটু কদর বাড়ানো যেত!
কিন্তু ওদের বিয়ের তিন মাসের মধ্যেই আমার কেমন মনে হল সমাচার ব কুশল নয়। গণ্ডগোলের সূত্রপাত মঞ্জরার দিক থেকে। দিলদরিয়া পল্লব ওর কেমন হাসাস দশা একটু। গম্ভীর মুখে মঞ্জরী একদিন আমাকে স্পষ্টই বলল, প্রথম দিন আপনি বাড়িয়ে বলেছিলেন দাদা, ওর অনেক খারাপ অভ্যাস আছে।
আমি আমতা আমতা করে বলেছি, কেন, এ রকম খোলামেলা চরিত্র
বাধা দিয়ে ঈষৎ ঝাঝালো সুরে মঞ্জরী বলল, চরিত্রেরও গলদ আছে।
বেচারা পল্লব জানালা দিয়ে মনোযোগ সহকারে রাস্তা দেখছে।
আরো মাস ছয় বাদে মনে হল গণ্ডগোলটা বেশ পাকিয়ে উঠেছে। পল্লবের সর্বই বিষণ্ণ অথবা বিরক্ত মুখ। একদিন ঘরে টেনে বসিয়ে জেরা শুরু করলাম, কি ব্যাপার সব খোলাখুলি বলো তো?
ও বলল, আমার বিরুদ্ধে অনেক মারাত্মক অভিযোগ, এ রকম জানলে ও নকি আমার ছায়াও মাড়াত না।
–কি অভিযোগ?
–প্রথম, আমার কোন রকম আদর্শের বালাই নেই।
–তারপর?
–দ্বিতীয়, সিগার।
–সিগার কি?
-আমি সিগার খাই, আমার সমস্ত গায়ে নাকি চুরুটের গন্ধ। চুমু খেতে গেলে ধাক্কা মেরে ঠেলে সরায়। ডেটল দিয়ে মুখ কুলকুচি করে আর গায়ে। সেন্ট মেখে তবে কাছে আসতে হয়–ততক্ষণে আমার চুমু খাওয়ার তেষ্টা চলে। যায়।
ওর খোলাখুলি বলার নমুনা দেখে আমি ঘাবড়ে গেলাম। পল্লব বলে চলল, তৃতীয় অভিযোগ, ড্রিঙ্ক করা। যত ভাল জিনিসই খাই ও ঠিক টের পায় আর তারপর কুরুক্ষেত্র। চতুর্থ অভিযোগও ওর কাছে তেমনি মারাত্মক–আমি মেয়েদের পিছনে ছোটাছুটি করি। আমার আগের চালচলন কিছু কিছু জেনে ফেলেছে, তাছাড়া বাড়িতে অনেক মেয়ের টেলিফোন আসে
বললাম, একটু সামলে-সুমলে চললেই তো পারো।
ও রেগে গিয়ে বলল, সব ছেড়ে-ছুঁড়ে পরমহংস হয়ে বসে থাকব? আমি তো মঞ্জরীকে শাসিয়েছি, এ-রকম করলে চাকরি-বাকরি ছেড়ে বিষয়-আশয় বিলি করে দিয়ে যেদিকে দুচোখ যায় চলে যাব–তাতেও ঘাবড়ায় না!
আরো মাস তিনেক বাদে একদিন দুজনেই এসে হাজির আমার বাড়িতে। সেদিন আবার ভিন্ন মূর্তি দুজনেরই। পল্লব গুপ্ত আগের মতোই হাসিখুশি আর মঞ্জরীও যেন আগের সেই লাবণ্যময়ী মিষ্টি মেয়েটি। ওদের কথাবার্তা থেকেও বোঝা গেল মাঝের একটা বছরের সমস্ত অশান্তি আর মনোমালিন্য অপগত। এক ফাঁকে জিজ্ঞাসা করলাম, কি হে, কিছু একটা ম্যাজিক-ট্যাজিক হয়ে গেছে মনে হচ্ছে?
খুশিতে ডগমগ পল্লব বলল, ম্যাজিক বলে ম্যাজিক–একেবারে নিদারুণ ম্যাজিক দাদা!
–কি করে হল?
–সেই অনিমেষ সরকারের কল্যাণে।
শুনে আমি অবাক।
তারপর মঞ্জরীকে ও-ঘরে আমার স্ত্রীর সঙ্গে গল্প করতে বসিয়ে দিয়ে ও মনের আনন্দে যে ফিরিস্তি দিল, তাতে আমি আরো অবাক। মঞ্জরী ওর সঙ্গে আপোস করেছে। সকাল থেকে সন্ধ্যার পরে পর্যন্ত গোটা ছয় সিগার চলতে পারে, ড্রিঙ্ক একেবারে ছাড়তে হবে না, বড় পার্টি হলে মাত্রা রেখে খেতে হবে, আর মেয়েদের সঙ্গে হৈ-হুঁল্লোড় করে বেড়ানোতেও আপত্তি নেই, তবে মঞ্জরীর অনুপস্থিতিতে সেটা করা চলবে না –যেখানে যাবে সে-ও সেখানে উপস্থিত থাকবে।
বলা বাহুল্য, পল্লব গুপ্ত সানন্দে রাজী। ম্যাজিকের ব্যাপারটা সংক্ষেপে এই রকম :
…সেদিনও মেজাজপত্র, বিগড়েই ছিল পল্লব গুপ্তর। তিন দিনের মধ্যে মঞ্জরী কাছে আসেনি, ওকেও কাছে ঘেঁষতে দেয়নি। সামনা-সামনি রাগও করতে পারে না পল্লব, কারণ সে রাগলে মঞ্জরী ডবল রাগে–আর তখন আরো বেশি আক্কেল দিতে চেষ্টা করে।
বিকেলে ওই রকম মেজাজ খারাপ নিয়েই বেরিয়ে পড়েছিল। হঠাৎ ফুটপাথের পাশে একেবারে একটা হ্যাঁগার্ড মার্কা লোককে দেখে গাড়ি থামাল। জামা-কাপড় আর ওই মূর্তি দেখলে কেউ তাকে ভদ্রলোক ভাববে না। তার ওপর একগাল দাড়ি, মাথার রুক্ষু চুল ঘাড় আর কান বেয়ে নেমেছে। গালের হাড় উঁচিয়ে আছে, দু চোখ গর্তয়। কিন্তু তা সত্ত্বেও অনিমেষ সরকারকে চিনতে পারল পল্লব গুপ্ত। বিয়ের আগে দু-দুটো দিন মঞ্জরীর ঘরে বসা দেখেছে-এ মুখ ভোলার কথা নয় তার।
কিন্তু অনিমেষ সরকার পল্লব গুপ্তকে দেখেও নি, চেনেও না। গাড়ি থেকে নেমে কাছে এসে জিজ্ঞাসা করল, আপনি এখানে এভাবে দাঁড়িয়ে?
কোটরের দুই চোখ তুলে লোকটা তাকালো, বুভুক্ষু চাউনি।–আপনি…?
–আমাকে চিনবেন না, আমি আপনাকে চিনি। আদর্শ মানুষ ছিলেন, এক সময় দেশের কাজে ঝাঁপিয়ে পড়েছিলেন।
লোকটার সেই ক্ষুধার্ত চোখ দুটো জ্বলে উঠল একবার। বিড়বিড় করে বলল, আদর্শ আর দেশের কাজ কোথায় আমাকে এনেছে দেখতেই পাচ্ছেন।… চেনেন যদি একটু উপকার করতে পারেন?
-বলুন?
–গোটা দশেক টাকা দিতে পারেন–ভাই-বোনদের নিয়ে তিন দিন ধরে উপোস চলছে!
পল্লব গুপ্ত চকিতে ভেবে নিল কি। তারপর বলল, আসুন আমার সঙ্গে, দশ টাকার পাঁচ গুণ দেব
লোকটা হতভম্বের মতো তার গাড়িতে উঠল। তাকে নিয়ে পল্লব গুপ্ত সটান বাড়ি। অকারণে হর্ন বাজিয়ে যা আশা করেছিল তাই হল। মঞ্জরী দোতলার বারান্দায় এসে দাঁড়িয়েছে। পাশ থেকে অনিমেষ সরকার তাকে দেখতে পাচ্ছে না।
পল্লব গাড়ি থেকে নামল, গলা একটু চড়িয়েই ডাকল, আসুন অনিমেষবাবু! অনিমেষ সরকার যথার্থই হকচকিয়ে গিয়ে কোনদিকে না তাকিয়ে তার সঙ্গে ঘরে এসে বসল।
পল্লব গুপ্ত চট করে বাইরে এলো একবার। যা ভেবেছে তাই। অবাক বিস্ময়ে মঞ্জরী সিঁড়ি ধরে নীচে নেমে আসছে। পল্লব তাড়াতাড়ি তার দিকে এগিয়ে গেল। বলল, তোমার সেই আদর্শ পুরুষ অনিমেষ সরকার কিছু আশা নিয়ে আমার কাছে এসেছে, তুমি এক্ষুণি ঘরে ঢুকো না।
মঞ্জরী হতভম্ব। যাকে দেখেছে ওপর থেকে সে অনিমেষ সরকার কি তার কঙ্কাল ভেবে পেল না। আর এই রকম বেশবাস…।
পল্লব বসার ঘরে ফিরে এলো আবার। দরজার ওধারে শ্রীমতীর অবস্থান স্বতঃসিদ্ধ ধরে নিয়েছে। প্রতিটি কথাও ঠিকই কানে যাবে।
-তারপর অনিমেষবাবু, এটা তাহলে আপনি সত্যি কথাই বলছেন–আপনার আদর্শই আজ আপনাকে এই অবস্থায় এনে দাঁড় করিয়েছে?
ক্লান্ত স্বরে উত্তেজনা ফুটিয়ে অনিমেষ সরকার জবাব দিল, চুলোয় যাক আদর্শ –পেটের জ্বালায় সবসুদ্ধ মরলাম–এর থেকে যদি মিস্ত্রীগিরিও শিখতাম
পল্লব বলল, কিন্তু আপনি দশ টাকা চেয়েছেন, ওতে আপনার কদিন চলবে? তিনদিন ধরে তো উপোস চলেছে বলছেন
–দুদিন চললে দুদিনই বাঁচলাম। খিদের জ্বালা যে কি আপনি বুঝবেন না!
-তাই তো… ইয়ে, আমার কাছে খুব ভাল বিলিতি হুইস্কি আছে, খাবেন একটু?
-ওসব আমি কিছু খাই নে মশাই, দুটো বেলা ডাল-ভাত খাবার মতো আমাকে কিছু দিন দয়া করে!
পল্লব গুপ্ত ওদিকের দরজার দিকে তাকালো একবার। তারপর পকেট থেকে সিগার-কেস বার করল।-আচ্ছা, ভাল চুরুট ধরান একটা!
-চুরুট আমি খাই নে, আমার যা দরকার তাই দিয়ে দিন সার
—-ও, পল্লব গুপ্ত ব্যস্ত, কি করে যে আপনাকে আনন্দ দেব একটু, আচ্ছা এক কাজ করলে হয় না, আমার ভাল ভাল কিছু মেয়ের সঙ্গে ইয়ে মানে অন্তরঙ্গতা আছে।
–চলুন যাই, সময়টা ভাল কাটবে।
ক্রুদ্ধ অনিমেষ সরকার উঠে দাঁড়াল। বলে উঠল, একজন ক্ষুধার্ত মানুষের সঙ্গে আপনি রসিকতা করছেন কিনা বুঝতে পারছি না–এসব অভ্যেসও আমার নেই–এখন আমার দরকার শুধু কিছু খাবার-দশটা টাকা চেয়েছিলাম, অন্তত পাঁচটা টাকা দিয়ে আজকের মতো বাঁচান আমাকে।
এবারে পল্লব গুপ্ত ধীরে-সুস্থে মানিব্যাগ বার করল পকেট থেকে। অনিমেষ সরকার এদিকে ফিরে আছে, ওদিকের দরজা দিয়ে গলা বাড়িয়ে নির্বাক বিস্ময়ে মঞ্জরী দেখছে তাকে।
পল্লব গুপ্ত বলল, দশ টাকার পাঁচ গুণ দেব বলেছিলাম, তাই দিচ্ছি। এই নিন পঞ্চাশ টাকা
লোকটা পাগল কিনা অনিমেষ সরকার ভেবে পেল না। লোভে দুচোখ চকচক করে উঠল তার। ছোঁ মেরে টাকা কটা নিয়ে সামনের দরজা দিয়ে ছুটে বেরিয়ে গেল সে।
বিবর্ণ পাংশু মুখে মঞ্জরী সামনে এসে দাঁড়াল।–কি ব্যাপার? এঁকে কোত্থেকে ধরে আনলে?
রাস্তা থেকে। উপোসের জ্বালায় রাস্তায় ভিক্ষে করতে বেরিয়েছিল।… দশ টাকা চেয়েছিল, পঞ্চাশ টাকা দিয়ে দিলাম।
একটা বড় রকমের ধাক্কা সামলে নিল মঞ্জরী। তারপর জিজ্ঞাসা করল, তার জন্যে এঁকে বাড়িতে ধরে নিয়ে এলে কেন, টাকা তো পকেটেই ছিল?
পল্লব গুপ্ত জবাব দিল, এনেছি তোমার জন্যে। ড্রিঙ্ক করে না, সিগার খায় না, মেয়েদের পিছনে ছোটে না–এ-রকম আদর্শ ব্যক্তির হাল কি হয় সেটা তোমাকে দেখাবার জন্যে।… আমাকেও তুমি এই অবস্থার দিকেই ঠেলে দিচ্ছ।
মঞ্জরা হাঁ করে চেয়ে রইল খানিক, তারপর ছুটে চলে গেল।
একমুখ হেসে পল্লব গুপ্ত সিগার-কেস বার করে দামী সিগার ধরাল একটা। বলল, তারপর এই আপোস।