আপনি হলে কী করতেন?
অন্ধকার মঞ্চ। কলিং বেলের শব্দ। প্রথম দু—বার ধীরে, তৃতীয়বার একটু বেশিক্ষণ। মঞ্চে আলো জ্বললে দেখলাম, পাশের ঘর থেকে এক মধ্যবয়সিনি বেরিয়ে দরজার পাশের সুইচ থেকে হাত সরালেন। তাঁর পরনে ব্লাউজ এবং শায়া। সেই অবস্থায় বাইরের দরজার কী—হোলে চোখ রেখে দেখতে চাইলে চতুর্থবার বেল বেজে উঠল। এবার আরও জোরে। মধ্যবয়সিনি চমকে ছিটকে সরে এলেন।
মধ্যবয়সিনি : কে? কে?
দরজার বাইরে থেকে : আমি, দরজা খোল। মধ্যবয়সিনি ঠোঁট কামড়ে দু—পাশে মাথা রাখল। না, এত রাতে দরজা খুলব না।
দরজার বাইরে থেকে: প্লিজ, প্লিজ, মালিনী, আমি আর দাঁড়াতে পারছি না, ভিতরে ঢোকার পর তুমি যা চাও বলতে পার…!
মধ্যবয়সিনি, যার নাম মালিনী, ভিতরের ঘরে চলে গিয়েই ফিরে এল একটা নাইটি পরতে পরতে। সেটা পরা হলে দু—হাতে মাথার চুল ঠিক করে দরজা খুলতেই বছর চল্লিশের এক স্বাস্থ্যবান পুরুষ ভিতরে ঢুকে সামনের চেয়ারে সশব্দে বসে পড়ল। চুপচাপ দরজা বন্ধ করে সেখানে ঠেস দিয়ে দাঁড়িয়ে—
মালিনী : এত রাত্রে আমাকে না জ্বালালে তোমার সুখ হয় না, না?
সুব্রত : আমার সুখ—!
মালিনী : যেখানে ছিলে সেখানেই সকাল পর্যন্ত থেকে গেলে না কেন? নাকি থাকতে দিল না? অবশ্য তোমার ওই বিকট নাকের গর্জন কোনো সুস্থ মানুষের পক্ষে বেশিক্ষণ সহ্য করা সম্ভব নয়।
সুব্রত : কী যা তা বলছ?
মালিনী : যা তা বলছি? সন্ধে সাড়ে সাতটায় তোমার অফিসে ফোন করেছিলাম। সেখান থেকেই তো জানতে পারলাম।
সুব্রত : কী জানতে পারলে?
মালিনী : অফিস বন্ধ হয়ে গিয়েছিল। কিন্তু একটা বেয়ারা গোছের লোক বলল, ‘চার বাজে মিসেস মুখার্জি আর সাহাব সাইট মে ভিজিট করনে গিয়া।’ তখনই বুঝেছি। সাইট না ছাই। ওই মিসেস মুখার্জি মানে ডিভোর্সি পুরুষখেকো মহিলা? ইদানীং তুমিও ছোঁক ছোঁক করছ।
সুব্রত : মালিনী একটু ভদ্রভাষায় কথা বললে ভালো হয় না?
মালিনী : আশ্চর্য! তোমার কাছে আমি কোনটা ভালো কোনটা মন্দ শিখব? তোমার কাছে? প্লিজ আমাকে জ্ঞান দিতে এসো না। এখন যেটুকু রাত আছে আমাকে ঘুমোতে দিলে ধন্য হয়ে যাব।
(মালিনী ভিতরের দরজার দিকে এগোতেই ল্যান্ড ফোন বেজে উঠল। শব্দটা সুশ্রাব্য নয়। মালিনী দাঁড়িয়ে পড়ল। সুব্রত উদবিগ্ন মুখে উঠে দাঁড়াল। কিন্তু সে পা বাড়াবার আগেই মালিনী পৌঁছে গিয়ে রিসিভার তুলে একটু অপেক্ষা করে বলল, ‘হ্যালো!’)
(ওপারের কথা শুনে)
মালিনী : হ্যাঁ। এত রাত্রে কে ফোন করছেন? (চোখ বন্ধ করে শুনল)
মালিনী : আপনি আমার প্রশ্নের উত্তরে প্রশ্ন করছেন। আপনার পরিচয় না পেলে কথা বলব কী করে? (আবার শুনল মালিনী)
মালিনী : ও তাই বলুন। (হেসে ফেলল)। সুব্রত বাড়ি ফিরে এসেছে কি না তা জানতে ওর মোবাইলে ফোন করলেই তো পারতেন।
(উত্তরটা শোনার পর সুব্রতর দিকে তাকাল মালিনী। দাঁড়িয়ে থাকা সুব্রত ধীরে ধীরে বসে পড়ল।)
মালিনী : সেকি! মোবাইল অফ করে রেখেছে! কী খারাপ কথা। আপনি ওকে শেষ কখন দেখেছেন? মানে, কখন শেষবার কথা হয়েছে?’
(উত্তরটা শুনল মালিনী)
মালিনী : না, না, আপনি যথেষ্ট চিন্তা করছেন, অনেক ধন্যবাদ আপনাকে। একটা প্রবাদ আছে, জানেন নিশ্চয়ই, মাতালরা কখনও গাড়ি চাপা পড়ে না। আর সব পাখি যেমন ঘরে ফেরে তেমনি সব স্বামী ঠিকঠাক ঘরে ফিরে আসবে। আচ্ছা, গুড নাইট।
(রিসিভার নামিয়ে রেখে খুব শান্ত গলায়)
মালিনী : মিসেস অঞ্জনা মুখার্জি। তোমাকে তিনি শেষবার দেখেছিলেন রাত দশটায়। দেখা হওয়ার পক্ষে সময়টা শোভনসীমার শেষ দিকে পড়লেও শালীনতা ছাড়ায় না। কিন্তু তুমি বাড়ি ফিরে এসেছ কি না তা জানতে পাঁচ ঘণ্টা পরে ফোন করেছেন। ঘুমিয়ে পড়েছিলেন হয়তো। ঘুম ভাঙতেই দুশ্চিন্তা হতেই আর ঘড়ি দেখেননি। মোবাইল বন্ধ দেখে ল্যান্ডলাইনে ফোন করলেন। কিছু বলবে তুমি।
(সুব্রত জোরে শ্বাস নিল। কথা বলল না।)
মালিনী : আচ্ছা সুব্রত, তুমি বাড়িতে ঢোকার পর তুমি চারবার কথা বলেছ। আর আমি একাই বকবক করে চলেছি। এই ব্যাপারটার যদি কোনো দর্শক থাকত তাহলে সে নিশ্চয়ই আমাকে মেয়েভিলেন বলে ভেবে নিত। মেয়েভিলেনের বাংলা কী হবে জানি না। আচ্ছা, তোমাকে কি অসহায় নায়ক হিসেবে কল্পনা করত?
সুব্রত : মালিনী, এত রাত্রে তোমার ঘুম ভাঙানোর জন্য আমি সত্যি দুঃখিত। তুমি ঘুমোতে যাও। এখনও রাত শেষ হতে দেরি আছে।
মালিনী : আমি যে তোমার মতো অঙ্ক করে সব কিছু করতে পারি না তা তুমি জানো। আমাকে ঘুমোতেও হবে অঙ্ক করে?
সুব্রত : বেশ। তাহলে শোনো, আমি বলতে বাধ্য হচ্ছি, সন্দেহ করা তোমার এখন অভ্যাসে পরিণত হয়ে গেছে।
মালিনী : চমৎকার। একজন মহিলা রাত তিনটের সময় ফোন করে জিজ্ঞাসা করছেন তুমি বাড়ি ফিরেছ কি না। এটাকে আমি স্বাভাবিক মনে করব? অথচ তুমি অফিস থেকে ফোন করে বলেছিলে তোমাকে সাইটে যেতে হচ্ছে! এই তোমার সাইটে যাওয়ার নমুনা?
সুব্রত : কী বলব বল। তুমি তো আমার কথা বিশ্বাসই করবে না।
মালিনী : বিশ্বাস করার জন্য যে জায়গার দরকার হয় সেটা তুমি রাখনি।
সুব্রত : আমি অফিস থেকে বেরিয়েছি তিনটের সময়। ইনস্পেকশন শেষ করে সন্ধে সাড়ে ছটায়, যখন বেরোতে যাচ্ছি তখন চারতলায় যে নতুন কনস্ট্রাকশন হচ্ছিল সেখানে একজন লেবার গলায় দড়ি দিয়েছে। ব্যস, হয়ে গেল। সেই ঝামেলা শেষ হতে হতে রাত দুটো বেজে গেল। পুলিশের প্রশ্ন তো শেষ হয় না।
মালিনী : (হেসে ওঠে) গল্পটা কাঁচা হয়ে গেল! সাইটে তুমি একা যাওনি। সঙ্গে মিসেস মুখার্জিও ছিল। একজন ডিভোর্সি এবং পুরুষখেকো মহিলা সন্ধের পর সঙ্গে থাকলে যে গল্পটা বাস্তব হয়ে যায় তা চেপে যাচ্ছ কেন?
সুব্রত : মিসেস মুখার্জি আমার সহকর্মী। এছাড়া তাঁর সঙ্গে আমার কোনো সম্পর্ক নেই। তাঁকে অফিস থেকেই পাঠানো হয়েছিল। কিন্তু সুইসাইডের খবর পেয়ে এত নার্ভাস হয়ে পড়েন যে সবাই ওকে বাড়ি ফিরে যেতে বলে। তিনি চলেও গিয়েছেন।
মালিনী : তাহলে এত উদবেগে এই সময়ে ফোন করলেন কেন?
সুব্রত : জানি না। বোধহয় সুইসাইডের ব্যাপারটা ওঁর মাথায় থাকায় সময় গুলিয়ে ফেলেছিলেন।
মালিনী : ঠিক আছে। আমি তোমাকে বিশ্বাস করছি না কিন্তু বিশ্বাস করার ভান করছি। মেয়েটা পাস না করা পর্যন্ত এই ভানটা করে যেতে হবে। আমি শুতে চললাম।
(মালিনী বেরিয়ে গেল। এই প্রথমবার সুব্রতকে একটু হালকা দেখাল।)
দ্বিতীয় দৃশ্য
(একই ঘর। মালিনী যে দরজা দিয়ে বেরিয়েছিল, তার উলটো দিকের দরজা দিয়ে ঢুকল সুব্রত। বাড়িতে থাকার পোশাক। এখন সকাল। চেযারে বসে চারপাশে তাকিয়ে বিরক্ত হল। তারপর গলা চড়িয়ে ডাকল)
সুব্রত : মানুর মা, মানুর মা। সকাল সাড়ে সাতটা অথচ এখনও চা পেলাম না। খবরের কাগজই বা কোথায়। মানুর মা, শুনতে পাচ্ছ?
মালিনী : (ওপাশের দরজা দিয়ে ঢুকল)। মানুর মা শুনতে পাবে না।
সুব্রত : মানে?
মালিনী : তোমার কণ্ঠস্বর গ্রামে পৌঁছোচ্ছে না।
সুব্রত : সে কি! ও দেশে গিয়েছে নাকি?
মালিনী : হ্যাঁ। ওর ছেলের অসুখের খবর পেয়ে কাল সন্ধের ট্রেনে ক্যানিং রওনা হয়েছে। রাতটা কোনো আত্মীয়ের বাড়িতে থেকে আজ ভোরে নৌকায় উঠবে। অতএব চ্যাঁচামেচি করে কোনো লাভ নেই।
সুব্রত : সর্বনাশ! ব্যাপারটা ভেরিফাই না করেই ওকে ছেড়ে দিলে?
মালিনী : ওর দেশের এক মাস্টারমশাই ফোন করেছিলেন। তাঁর সঙ্গে কথা বলে মনে হয়নি তিনি মিথ্যে বলছেন। ছেলে অসুস্থ শুনে আমি কোনো মাকে, আগে ভেরিফাই করি তারপর ছাড়ব, বলব? আশ্চর্য!
(কয়েক মুহূর্ত চুপচাপ)
সুব্রত : কবে আসবে বলেছে?
মালিনী : তিন চারদিন লাগবে বলেছে। আমি ওটা এক সপ্তাহ ধরে নিচ্ছি। এবার শোন। আমার পক্ষে রান্নাবান্না করে সংসারের সব কাজ শেষ করে অফিস যাওয়া অসম্ভব নয় কিন্তু পরিশ্রম আমি করতে চাই না। আমি সাতদিন ছুটি নিচ্ছি।
সুব্রত : ও।
মালিনী : তুমি সকালে উঠে চা চা করে চ্যাঁচাবে না। যখন হবে তখন পাবে। প্রথমে বাজারে যাবে। ফ্রিজে মাছ রাখতে দাও না, ফ্রেশ মাছ না খেলে টেস্ট পাও না বলে এসেছ এতদিন। দয়া করে সকাল সাড়ে সাতটার মধ্যে বাজার করে আনবে। নিজের জামাকাপড় নিজে কাচবে। মনে রেখো, আমাকে যেমন রান্না করতে হবে তেমনি ঘর ঝাঁট দেওয়া, মোছা, বাসন ধোয়ার কাজটাও করতে হবে। তুমি দয়া করে নিজের বিছানা ঠিকঠাক করে নেবে। (উঠে দাঁড়ায়) চা দিচ্ছি, খেয়ে বাজারে যাও। আর হ্যাঁ, তোমার অফিস পাঁচটায় ছুটি হয়, ছটার মধ্যে বাড়ি ফিরবে।
সুব্রত : (অবাক হয়ে)। কেন?
মালিনী : (যেতে যেতে ঘুরে দাঁড়ায়) । কেন? প্রশ্নটা তুমি করতে পারলে সুব্রত? আমি সারাদিন ঝি—গিরি করব আর তুমি অফিসের পর ক্লবে গিয়ে ফুর্তি করবে?
(সুব্রত মাথা নীচু করল। মালিনী বেরিয়ে গেল)
তৃতীয় দৃশ্য
(সন্ধেবেলা। একই ঘর। বেল বাজাল। মালিনী ঘরে ঢুকে দরজা খুলল। সুব্রত অপরাধীর ভঙ্গিতে ঘরে ঢুকল)
সুব্রত : একটু দেরি হয়ে গেল। বেশি না (মোবাইল দেখল) ঘণ্টা দেড়েক। বিশ্বাস কর, ক্লাবে যাইনি। অফিসেই…
(মালিনী চেয়ারে বসল)
মালিনী : আজ দুপুরে মানুর মায়ের ফোন এসেছিল।
সুব্রত (উজ্জ্বল মুখে) : আচ্ছা, পাঁচদিন তো হয়ে গেল। কাল আসবে?
মালিনী : এখন আসতে পারবে না। কবে পারবে তাও জানে না। আমাকে লোক দেখে নিতে বলল। ভালো কাজের লোক যেন হাতের মোয়া।
সুব্রত : (বসে পড়ে চেয়ারে)। সর্বনাশ!
মালিনী : শোন, আমার পক্ষে এত পরিশ্রম করা সম্ভব নয়। তাছাড়া সাতদিন ছুটি নিয়েছি। অফিস থেকেও ফোন এসেছিল, জয়েন করতে বলছে।
সুব্রত : তাহলে…।
মালিনী : আমি কাল সকাল সকাল মায়ের কাছে চলে যাব। ওখান থেকেই অফিস করব যদ্দিন তুমি একজন হোলটাইমার না পাও।
সুব্রত : আমি হোলটাইমার কোথায় পাব?
মালিনী : বন্ধুদের বল, পাড়ায় খোঁজ নাও।
সুব্রত : ইমপসিবল। এ পাড়ায় জীবনদা নামে একজন আছে তার নামটাই এখন পালটে গেছে।
মালিনী : তার মানে?
সুব্রত : ভদ্রলোকের স্ত্রীর জন্য কোনো কাজের লোক চারদিনের বেশি টেঁকে না। রবিবার সকালে ওকে বেরোতে হয় নতুন কাজের লোকের খোঁজে। তার ফলে পাড়ায় ওঁর নাম হয়ে গিয়েছে ঝি খোঁজা বাবু, সরি।
(এই সময় বাইরে থেকে কেউ বেল বাজাল। মালিনী উঠল। দরজা খুলল। একটি বছর কুড়ির আটপৌরে মেয়ে হাতে কাপড়ের ব্যাগ, ঢিপ করে প্রণাম করল মালিনীকে)
মালিনী : (একটু পিছিয়ে গিয়ে) আরে! তুমি কে? প্রণাম করছ কেন?
মেয়েটি : বারে! আপনি আমার চেয়ে কত বড়—! আমার নাম কুন্তী।
মালিনী : কুন্তী? এখানে কী দরকারে এসেছ? কে পাঠাল তোমাকে?
কুন্তী : যমুনা মাসি। আমি ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলাম। যমুনা মাসি কাজে যাচ্ছিল, সব শুনে আপনাদের বাড়িতে আসতে বলল।
মালিনী : ও হ্যাঁ, যমুনাকে আজ বিকেলে বলেছিলাম। ভিতরে এসো।
(মালিনী তার চেয়ারে গিয়ে বসল। কুন্তী মেঝেতে উপুড় হয়ে বসতে গিয়েও বসল না।)
কুন্তী : মাসি, ইনি নিশ্চয়ই দাদাবাবু?
মালিনী : দাদাবাবু!
সুব্রত : ওঁকে মাসি বললে আমাকে মেসো বলতে হবে।
কুন্তী : ও। বাড়ির কর্তাকে তো দাদাবাবু বলে সবাই…।
মালিনী : ঠিক আছে। তোমাকে আত্মীয়তা তৈরি করতে হবে না। তোমাকে কি যমুনা এ বাড়িতে কাজের জন্য পাঠিয়েছে?
কুন্তী : হ্যাঁ, মাসি, আমাকে আপনি আশ্রয় দিন।
মালিনী : তুমি কি এই পাড়ার কোনো বাড়িতে কাজ করতে?
কুন্তী : হ্যাঁ। ওই যে বটগাছ আছে যে বাড়ির সামনে, ওই মল্লিকদের বাড়িতে। দু—বছর কাজ করেছি। সকাল ছ—টা থেকে রাত বারোটা পর্যন্ত কাজ করতাম।
মালিনী : বললে ফুটপাথে দাঁড়িয়ে কাঁদছিলে? কেন?
কুন্তী : (ঠোঁট কামড়ায়, আঁচলে চোখ মোছে) আমাকে তাড়িয়ে দিল গো।
মালিনী : দু—বছরের কাজের লোককে কেউ এমনি তাড়ায় না। কী করেছিলে?
কুন্তী : একটা চিনে মাটির কাপ হাত থেকে পড়ে গিয়ে ভেঙে গিয়েছিল বলে বড় গিন্নি গায়ে হাত তুলল। ঘাড় ধরে বের করে দিল। বলল, মাইনেটাও দেবে না। (ফুঁপিয়ে কাঁদতে লাগল।)
সুব্রত : বুর্জোয়া মেন্টালিটি। কী করে পাবে!
মালিনী : তোমার দেশ কোথায়?
কুন্তী : কাকদ্বীপের কাছে।
মালিনী : বাড়িতে কে কে আছে?
কুন্তী : মা, বাবা, ভাই, বোন কেউ নেই। আয়লা সবাইকে খেয়ে নিয়েছে। থাকার মধ্যে আছে মামা আর মামি। মামি চায় না আমি ওদের বাড়িতে থাকি।
মালিনী : এই যে বললে কাকদ্বীপের কাছে বাড়ি?
কুন্তী : ওখানেই তো মামা—মামি থাকে।
মালিনী : হুম। তুমি কী কী কাজ ভালো জানো।
কুন্তী : নিজের মুখে কী বলব মাসি, কাজ করিয়ে দেখ।
মালিনী : শোন, সকাল নটার মধ্যে ভাত ডাল তরকারি আর মাছের ঝোল করে দিতে হবে। তার আগে চা, দু—বার। আমার টিফিনটাও করে দিতে হবে। রাত্রে এক একবার এক একরকম, পারবে?
কুন্তী : আপনারা যদি চাইনিজ খেতে ভালোবাসেন, তাহলে রাত্রে তাই করে দেব।
(মালিনী সুব্রতর দিকে তাকাল।)
সুব্রত : তুমি মোগলাই রান্না জানো?
কুন্তী : ওই বাড়ির ছোটবাবু আমার হাতের মোগলাই রান্না খুব পছন্দ করত।
মালিনী : তুমি যা বলছ তাতে…। থাক গে। এখানে কাজ করলে কত মাইনে চাও? দেখ, আমরা দু—জনই থাকি। আমাদের মেয়ে বেঙ্গালুরুতে হস্টেলে থেকে পড়াশোনা করে। অতএব কাজের চাপ একদমই নেই। তাই বল, কত চাও?
কুন্তী : আমি কী বলব মাসি। আমি তো একটু আশ্রয়ের জন্য আপনাদের বাড়িতে এসেছি। এখানে আমি নিরাপদে থাকতে পারব। যা দেবেন তা আপনারাই ঠিক করবেন।
সুব্রত : না না। এটা হতে পারে না। আচ্ছা মল্লিকবাড়িতে তুমি কত পেতে?
কুন্তী : ওখানে অনেক মানুষের কাজ করতে হত। আচ্ছা, আমি কেমন কাম করি তা একমাস দেখুন, দেখে যা দেবেন তাই আমি খুশি হয়ে নেব।
মালিনী : তোমার জিনিসপত্র কোথায়? ওই ব্যাগে কী আছে?
কুন্তী : এতেই সব। দু—তিনটে শাড়ি, জামাটামা…। আমার আবার জিনিস!
মালিনী : (উঠে দাঁড়ায়)। তুমি ব্যাগটাকে রেখে বাইরে যাও। যমুনাকে ডেকে নিয়ে এসো। তোমাকে রাখার আগে আমি ওঁর সঙ্গে কথা বলতে চাই।
কুন্তী : আমি এখনই যাচ্ছি। ব্যাগটাকে এখানে রাখি?
(কুন্তি ব্যাগ রেখে বেরিয়ে যায়)
সুব্রত : একেই বলে মেঘ না চাইতেই জল। একে কী বলা যায়। কাকতালীয় ব্যাপার? যাই হোক, সব সমস্যার সমাধান হয়ে গেল। তোমাকে কাল থেকে সাত তাড়াতাড়ি ঘুম থেকে উঠতে হবে না। রান্না করতে হবে না।
মালিনী : বাঃ, বেশ। এই মেয়েটাকে রাখলাম। ওর রান্না খেয়ে কাল দু—জনে অফিসে বেরিয়ে গেলাম। গোটা ফ্ল্যাটে ও একাই থাকল। তারপর সন্ধেবেলায় বাড়ি ফিরে দেখলাম সব ভোঁ ভাঁ। আলমারি ভেঙে সব নিয়ে হাওয়া হয়ে গিয়েছে। পুলিশ কী বলবে? একজন অজানা অচেনা মেয়ের হাতে ফ্ল্যাট ছেড়ে দিয়ে কী করে গেলেন? কী জবাব দেবে?
সুব্রত : আরে! এটা তো মাথায় আসেনি। মানুর মা দশ বছর ধরে ছিল। ওর নাড়ি নক্ষত্র তুমি জানো। এ তো একেবারে উটকো। তাহলে কী করবে? রাখবে না? কিন্তু মুশকিল হল, নতুন যে আসবে তারই তো একই অবস্থা হবে। ইস, আজ যদি মা বেঁচে থাকতেন। মানে, আগেকার একান্নবর্তী পরিবারে এই সমস্যা তো হত না।
(একটু ভেবে) আচ্ছা মালিনী। ওই যমুনা যদি সার্টিফিকেট দেয়, যদি বলে, কুন্তী চোর ডাকাত নয়, তাহলে কি আমরা ওকে রাখতে পারি?
(এই সময় ফোন বেজে উঠল। মালিনী এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তুলল)
মালিনী : হ্যালো! কে বলছেন? (উত্তর শুনল) ও যমুনা, তুমি কোথায়? (উত্তর শুনল) অ। শোন, ওই মেয়েটা, যার নাম কুন্তী, তাকে তুমি তো পাঠিয়েছ। কিন্তু মেয়েটা কেমন? (উত্তর শুনল) যা দিনকাল, কাউকে বাড়িতে রাখতে ভয় হয়। আবার আমরা যারা চাকরি করি, তাদের তো না রেখেও উপায় নেই। ওকে তুমি কীরকম চেনো? (উত্তর শুনল) ভাবো। চিনে মাটির পেয়ালা, তার দাম যাইহোক, ভাঙার জন্য মেরে তাড়াবে? তা তুমি ওকে দু—বছর ধরে চেনো? (উত্তম শুনল) দ্যাখো যমুনা, তোমাকে তো দুবেলা দেখছি, ঠিকেকাজ ছাড়া করবে না তুমি, নইলে তোমাকেই বলতাম আমার বাড়িতে রাত—দিনের কাজ করতে। তা তোমার উপর ভরসা করে ওকে না হয় রাখছি। (উত্তর শুনল) তা বলতে। শোয়ার ঘরের দরজাটাও তালা দিয়ে রাখব।
(রিসিভার নামিয়ে রাখল)
মালিনী : (স্বগতোক্তি)। দেখা যাক, কপালে কী আছে।
সুব্রত : না না। ভালোই হবে, চিন্তা করো না।
মালিনী : আমার কপাল কী রকম তা তো জানি।
(আড় চোখে স্বামীকে দেখে ভিতরে চলে যায় মালিনী)
(ঠিক তখনই বেল বাজে। সুব্রত এগিয়ে যায় দরজা খুলতে)
চতুর্থ দৃশ্য
(রাত। খাওয়ার টেবিল। সুব্রত অপেক্ষা করছিল। মালিনীও। কুন্তী খাবার পরিবেশন করছিল। খাবার দেখে চোখ বড় হয়ে গেল সুব্রতর।
সুব্রত : মাই গাড। এটা কী?
কুন্তী : (শাড়ি পালটেছে)। মিশ্র ভাজা ভাত। সঙ্গে ঝাল হাড়ছাড়া মাখা মাখা মুরগির টুকরো।
সুব্রত : (হাঁ হয়ে গেল)। মিশ্র—
মালিনী : মিক্সড ফ্রায়েড রাইস আর বোনলেস চিলি চিকেন।
সুব্রত : ও। শুনলে কীরকম অচেনা বাংলা খাবার বলে মনে হয়। শুরু করা যাক। (চামচে ভাত তুলে মুখে পুরে চোখ বন্ধ করে) আঃ ফার্স্টক্লাস। মনে হচ্ছে চিনে হোটেলে বসে খাচ্ছি।
মালিনী : সুব্রত।
সুব্রত : হ্যাঁ।
মালিনী : ধীরে ধীরে। হ্যাঁ। ভালোই রান্না হয়েছে। কুন্তী। (খেতে খেতে) কিন্তু কোথায় শিখলে এসব রান্না?
কুন্তী : মল্লিক বাড়ির ছোট মেয়ে বিয়ের আগে যখন এসব রান্না শিখছিল তখন ওর সঙ্গে থেকে শিখে নিয়েছি। আমি বিরিয়ানিও পারি।
সুব্রত : অ্যাঁ? বিরিয়ানি? কী কপাল? সামনের রবিবার দুপুরে তাহলে বিরিয়ানি হয়ে যাক। কী বল মালিনী?
কুন্তী : জাফরান না পড়লে বিরিয়ানির স্বাদ খোলে না। কিন্তু খাঁটি জাফরানের দাম তো অনেক। বড় হোটেলও তা দিতে পারে না।
সুব্রত : কুছ পরোয়া নেই। যত দাম হোক, আমি নিয়ে আসব।
মালিনী : আমার মনে হয় আপাতত তোমার সামনে এখন যা রয়েছে তাই তোমার খাওয়া উচিত।
(এই সময় ফোন বেজে উঠল। পাশের ঘরে)
কুন্তী : আপনারা খাচ্ছেন, আমি ফোন ধরব?
মালিনী : ধরো। দরকারি ফোন হলে বোলো আধঘণ্টা পরে করতে।
(দ্রুত চলে গেল কুন্তী। রিং বন্ধ হল)
মালিনী : সুব্রত, শুরুতেই এত প্রশংসা করলে ওর মাথা কি ঠিক থাকবে?
সুব্রত : না। আমি একটু অ্যাপ্রিসিয়েট করছিলাম।
মালিনী : ওর সামনে না করলেই কি নয়। কুন্তী ভালো কাজ করলে তো আমাদের ভালো লাগবেই। কিন্তু এত ভালো কাজ যে করে তাকে একটা পেয়ালা ভাঙার জন্য ওরা ছাড়িয়ে দিল?
সুব্রত : তাহলে কি মল্লিকবাড়িতে গিয়ে খোঁজ নেব?
মালিনী : না। না। তেমন কিছু হলে যমুনা ওকে দিত না।
(কুন্তী ফিরে এল। মুখে একগাল হাসি)
মালিনী : কী হয়েছে?
কুন্তী : উনি আপনাকে চাইছিলেন। বললাম এখন খাচ্ছেন, পরে ফোন করবেন। তখন বললেন, তুমি কে?
আমি আমার নাম বললে জিজ্ঞাসা করলেন, তুমি কি দাদাবাবুর মেয়ে? (খিলখিলিয়ে হাসে)
সুব্রত : কে? কে ফোন করেছিল?
কুন্তী : এই যাঃ নামটা তো জিজ্ঞাসা করিনি।
মালিনী : পুরুষ না মহিলা?
কুন্তী : না না পুরুষ না। গলার স্বর খুব মিষ্টি। দাদাবাবু আর একটু মিশ্র ফ্রায়েড ভাত দেব?
সুব্রত : আচ্ছা, দাও—! (কুন্তী রান্নাঘরে চলে গেল)
মালিনী : ইনি কে?
সুব্রত : ইনি? কার কথা বলছ?
মালিনী : রাত দশটায় যিনি ফোন করেছেন।
সুব্রত : আশ্চর্য! আমি কী করে বলব। ফোন করে তো তোমার সঙ্গে কথা বলতে চেয়েছেন, আমার সঙ্গে নয়।
মালিনী : কিন্তু ওকে জিজ্ঞাসা করেছেন তোমার মেয়ে কি না। আমার মেয়ে কি না জিজ্ঞাসা করেননি। অর্থাৎ পরিচয় তোমার সঙ্গেই। কিন্তু আমার সঙ্গে কেন কথা বলতে চাইছেন?
(মালিনী তাকাল সুব্রতর দিকে) এই সময় কুন্তী খাবার নিয়ে এল।
সুব্রত : কুন্তী, তুমি যার সঙ্গে ফোনে কথা বললে, তিনি তোমাকে কী জিজ্ঞাসা করেছেন, মনে করে বল?
কুন্তী : ওই যে বললাম, তুমি কি দাদাবাবুর মেয়ে? এই তো বললেন।
সুব্রত : দাদাবাবুর মেয়ে। দাদাবাবুর নাম বলেছেন?
কুন্তী : না তো। কোনো নাম বলেননি।
সুব্রত : (মালিনীকে)। শুনলে? ফোনটা তো রং নাম্বারও হতে পারে। এই কলকাতায় লক্ষ লক্ষ দাদাবাবু আছেন। তাই না। আমি উঠছি।
কুন্তী : ও মা! আপনি আর একটু নেবেন বললেন যে!
সুব্রত : না। পেট ভরে গেছে।
(সুব্রত বেরিয়ে যায়)
মালিনী : আমাকে দাও। নিয়ে যখন এসেছ তখন দাও।
(মালিনীর প্লেটে খাবার দিতে লাগল কুন্তী)
পঞ্চম দৃশ্য
(বাইরের ঘর। আরাম করে বসে বই পড়ছিল সুব্রত। একা। ঘড়িতে এখন রাত সাড়ে দশটা। হঠাৎ পিছনের দরজায় শব্দ হল। বই বন্ধ করে সুব্রত পিছনে তাকাতেই কুন্তীকে দেখতে পেল, অর্ধেকটা দেখা যাচ্ছে)
সুব্রত : কী ব্যাপার?
কিছু বলবে?
কুন্তী : ভাবলাম, জিজ্ঞাসা করি।
সুব্রত : করো।
কুন্তী : আপনি কি এখন একটু কফি খাবেন?
সুব্রত : কফি?
কুন্তী : হ্যাঁ। কেউ কেউ রাতের খাবারের পর কফি খায়। ওই বাড়ির ছোটবাবু নিয়ম করে খেত।
সুব্রত : (হেসে ফেলে)। বাঃ বেশ তো। দাও।
(কুন্তী হেসে চলে যায়। সুব্রত খুশিতে মাথা নাড়ে)
ষষ্ঠ দৃশ্য
(অফিসের পোশাকে সুব্রত। এখন সন্ধ্যা। মালিনী দরজা খুলল বেল বাজলে)
মালিনী : বাবাঃ, আজ কি শরীর খারাপ?
সুব্রত : কেন? দেখে কি মনে হচ্ছে?
মালিনী : যখন কাজের লোক ছিল না তখন তাড়াতাড়ি বাড়ি ফেরার সময় মুখ হাঁড়ি হয়ে যেত। কুন্তী আসার পর তো আবার আগের রুটিন। আজ হঠাৎ তাড়াতাড়ি এলে?
সুব্রত : তাহলে ঘণ্টা দুয়েক পার্কে বসে আসি।
মালিনী : না না। বসো।
সুব্রত : তুমি কখন ফিরলে?
মালিনী : আধঘণ্টা হল। জানো, কুন্তী আজ পাটিসাপটা তৈরি করছে।
সুব্রত : গ্রেট। ওটা জানে?
মালিনী : আমি অবাক হয়ে যাচ্ছি। শোন—।
সুব্রত : থামলে কেন?
মালিনী : তুমি আমার উপর খুব অসন্তুষ্ট তাই না?
সুব্রত : হঠাৎ এই উপলব্ধি?
মালিনী : সেই রাত্রে এক অজানা মহিলা ফোন করল আর কুন্তী যেই দাদাবাবু বলল অমনি আমার মাথা গরম হয়ে গিয়েছিল।
সুব্রত : ঠান্ডা হল কী করে?
মালিনী : সেই মহিলা আর কেউ নয়, আমার মাসতুতো বোন ইতি। ও তো তোমাকেও দাদাবাবু বলে কয়েকবার ডেকেছে। সেই রাত্রে ফোন করার পর আজ আবার করেছিল। খুব বকেছি ওকে, বলেছি, আর কখনও দাদাবাবু বলবি না। প্লিজ রাগ কোরো না—!
(এই সময় ল্যান্ডফোন বেজে উঠল)
সুব্রত : দাঁড়াও, আমি ধরছি। (এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তোলে) হ্যালো! (ওপারে কথা শুনে) হ্যাঁ, ঠিক নম্বরেই ফোন করেছেন। কাকে চাই। (উত্তর শুনে) কুন্তী? আপনি কুন্তীর সঙ্গে কথা বলতে চাইছেন…
(সুব্রত মালিনীর দিকে তাকায়। মালিনীর চোখ বড় হয়ে যায়)
(উত্তর শুনে) কে আপনি? ওর ভাই! কীরকম ভাই? কী নাম আপনার? (ঠোঁট কামড়াল সুব্রত) রিসিভার রেখে দিতে দিতে বলল) ব্যাটা লাইন কেটে দিল।
মালিনী : ওর ভাই?
সুব্রত : (কাছে এসে)। ভাই না ফালতু। ভাই হলে নাম বলত না? ফোন কেটে দিত? গলার স্বর শুনেই—
মালিনী : কিন্তু কুন্তী তো বলেছে, ওর বাবা, মা, ভাইরা, আয়লায় ডুবে মরে গেছে। এই পৃথিবীতে মামা—মামি ছাড়া আর কেউ নেই।
সুব্রত : ওকেই জিজ্ঞাসা করা দরকার।
মালিনী : আচ্ছা, এমন তো হতে পারে এই ফোনটা ওর মামাতো ভাই করেছিল। কুন্তীই হয়তো তাকে নাম্বারটা দিয়েছে।
সুব্রত : তার মানে এই ফোনটা কুন্তী ব্যবহার করছে। মানুর মা যখন ছিল তখন তালা দিয়ে রাখতে। এখন রাখো না?
মালিনী : মাথা থেকে বেরিয়ে গিয়েছিল। (গলা তুলে) কুন্তী, অ্যাই কুন্তী?
(কুন্তী প্রায় দৌড়ে ঘরে এল)
কুন্তী : আমাকে ডাকছেন মাসি?
মালিনী : তোমার কোনো মামাতো ভাই আছে?
কুন্তী : না। মামার কোনো ছেলেমেয়ে নেই। তাই আমাকে কোকিল বলত। ডানায় জোর এলেই উড়ে যখন যাব তখন থাকার দরকার নাই।
(মালিনী সুব্রতর দিকে তাকায়)
কুন্তী : কিছু হয়েছে নাকি মাসি?
সুব্রত : একটি ছেলে এইমাত্র ফোন করেছিল। বলল যে তোমার ভাই। নাম জিজ্ঞাসা করাতে লাইন কেটে দিল।
মালিনী : তুমি কি এই বাড়ির নাম্বার কাউকে দিয়েছ?
কুন্তী : মাইরি বলছি (জিভ বের করে) সরি, মাইরি বলতে নেই। না, না, আমি কাউকেই নাম্বার দিইনি।
সুব্রত : তাহলে এই ছেলেটা কে? আন্দাজ করতে পার?
(মাথা নীচু করে একটু ভাবল কুন্তী)
মালিনী : কী হল?
কুন্তী : একটা কথা বলব বলব করেও আপনাদের বলতে পারিনি। কী জানি যদি ভুল বোঝেন। জানেন, তোমাদের এই পাড়াটা ভালো না।
মালিনী : খুলে বল। বুঝতে পারছি না।
কুন্তী : আপনাদের বাড়িতে আগে যে কাজ করত সে কিছু বলেনি?
মালিনী : কী ব্যাপার?
কুন্তী : এই পাড়া নিয়ে? ওহো, সে বলবে কী করে! আমার মতো বয়সি তো ছিল না। বয়স কম হলে ঠিক বলত।
মালিনী : আঃ কী বলতে চাও খুলে বলো তো।
কুন্তী : এই পাড়ার ছেলেগুলো আমাকে দেখলেই ফুট কাটে। গান গায়। কে তুমি নন্দিনী, আগে তো দেখিনি…। এত লজ্জা লাগে তখন!
সুব্রত : (রেগে গিয়ে)। কারা? নাম জানো?
কুন্তী : আমি কী করে নাম জানব! আজ সকালে যখন বাজারে যাচ্ছি, তখন একজন তো সাইকেল চালিয়ে আমার গায়ের কাছে এসে শাহরুখ খানের মতো বলল, ‘ম্যাটিনি শো দেখে আসি চল, যাবে? আমি মাটির দিকে তাকিয়ে হেঁটে গেছি, মুখ তুলিনি। হয়তো সেই ফোন করেছিল?
সুব্রত : ফোন নাম্বার পাবে কোথায়?
কুন্তী : বারে! আমি কী করে বলব? তবে আপনাদের ওই ফোনের নম্বর তো অনেকেই জানে। এই যেমন বাজারের মুদির দোকান, যেখান থেকে মাসকাবারি আসে, মাছওয়ালা শিবু, মানে মাসি ফোন করে ওদের জিনিসপত্র মুটের মাথায় পাঠাতে বলতেন। এসব আমার জানার কথা নয়, বাজারে গিয়ে, ওদের মুখে জেনেছি।
সুব্রত : বুঝেছি। এই ছেলেটাকে দেখিয়ে দিতে পারবে? অন্তত ওর নামটা বললেই হবে।
কুন্তী : না দাদাবাবু, আপনি ওদের জব্দ করলে আমার বাইরে বের হওয়া বন্ধ হয়ে যাবে। তখন দোকান যাবে কে? বাজার করবে কে? মাসি, আমি কি ঠিক বলছি না? আমাকে যদি বাইরে যেতে না হয়, তাহলে আমি কালই ওর নাম জেনে আপনাকে বলে দেব।
সুব্রত : আমরা থাকতে তুমি এত ভয় পাচ্ছ কেন কুন্তী?
কুন্তী : ভয় পাবো না। এখন ওরা পিছনে একটু ফুট কাটছে, আপনি কিছু করলে ওরা ঠিক অ্যাসিড বালব ছুড়ে আমার মুখ পুড়িয়ে দেবে। পোড়া মুখের কথা ভাবলেই আমি শিউরে উঠি।
মালিনী : ঠিক আছে, ঠিক আছে। তুমি যাও। তোমাকে কারও নাম জানাতে হবে না। বাইরে যখন যাবে তখন সাবধানে যাওয়াআসা করবে।
(কুন্তী মাথা নেড়ে ভিতরে চলে যায়)
মালিনী : ছেলেগুলোর কী রুচি! ঘেন্না লাগে! খোঁজ নিলে দেখবে এই ছেলেরা সব ভদ্রলোকের সন্তান।
সুব্রত : কুন্তীর চেহারা সুন্দর বলেই হয়তো—! দেখি, এই পাড়ার পার্টির নেতা আমাকে খুব দাদা দাদা করে, তাকে বলব। অনেক কপাল করে কুন্তীর মতো কাজের লোক পেয়েছি, ওকে হারাতে চাই না।
(এই সময় টেলিফোন বেজে উঠল)
(সুব্রত উঠে গিয়ে রিসিভার তুলল)
সুব্রত : হ্যাঁ বলছি। (শুনল) ঠিক নাম্বারেই ফোন করেছেন। কে বলছেন? (শুনল) হ্যাঁ। আচ্ছা সে, কোথায়? দিন।
(রিসিভারে হাত চাপা দিয়ে মালিনীকে)
সুব্রত : মানুর মা কথা বলতে চাইছে। বলবে?
(মালিনী ইশারায় সুব্রতকেই কথা বলতে বলল)
সুব্রত : হ্যাঁ, মানুর মা। কেমন আছে তোমার ছেলে? (শুনল) বাঃ, খুব ভালো। তুমি ভালো আছ তো? (শুনল) আমরা সবাই ভালো আছি। (শুনল) না না, এত তাড়তাড়ি তোমাকে এখানে আসতে হবে না। অনেকদিন পরে দেশে গিয়েছ। ছেলে সম্পূর্ণ সুস্থ হোক, তুমিও বিশ্রাম নাও। (শুনল) না না, আমাদের কোনো অসুবিধে হচ্ছে না। যদি হয় তাহলে এই নাম্বারে ফোন করে দেব। (শুনল) কত টাকা? (শুনল) ঠিক আছে, তোমার বউদিকে বলছি। তোমার ঠিকানা তো ওর ডায়ারিতে লেখা আছে। পেয়ে যাবে। রাখছি।
(রিসিভার রেখে স্ত্রীর কাছে এল)
সুব্রত : অনেক কষ্টে কাটাতে পেরেছি। চাইলে কালই চলে আসত। খারাপ লাগছিল কিন্তু কুন্তী যা রান্না করে, যেভাবে ঘর পরিষ্কার রাখে তার সিকিভাগও মানুর মা পারে না। টাকা দেব যখন তখন ভালো সার্ভিসই চাইব।
মালিনী : কত টাকা চাইল?
সুব্রত : দু—হাজার।
মালিনী : যাওয়ার সময় হাজার নিয়ে গিয়েছে। অবশ্য ওর পাওনা ছিল হাজার তিনেক। হিসেব করেই চেয়েছে।
সুব্রত : মানি অর্ডার করে দিও, নইলে টাকার জন্য চলে আসতে পারে। এসে যদি কুন্তীকে দেখে তাহলে—।
মালিনী : কুরুক্ষেত্র বাধাবে। আমাদের অসুবিধে হচ্ছিল কি না জিজ্ঞাসা করল?
সুব্রত : হ্যাঁ। আসলে বহু বছর ধরে আছে, একটা অ্যাটাচমেন্ট হয়ে গিয়েছে। জিজ্ঞাসা তো করবেই।
মালিনী : হাতে ধরে রান্না শিখিয়েও ওকে আটপৌরে রান্না ছাড়া করাতে পারিনি। তবে হ্যাঁ, মানুর মায়ের সবচেয়ে বড় গুণ হল ও খুব সৎ। একটা টাকাও কখনও এদিকওদিক করেনি। স্নানের সময় বাথরুমে কতবার হার খুলে রেখে এসেছি, ও ঠিক এনে দিয়েছে।
সুব্রত : কুন্তীকেও অসৎ বলে মনে হয় না।
মালিনী : এই তোমার মুশকিল। যাকে ভালো লাগে তাকে রাতারাতি আকাশে তোল। সবে তো এল, একটু সবুর কর, তারপর বলবে।
(মালিনী উঠল)
সপ্তম দৃশ্য
(মধ্যরাত। সেই বসার ঘরের সোফায় সুব্রত পাশ ফিরে আধশোয়া। বোঝা যাচ্ছে ঘুমিয়ে পড়েছে। ঘরের এক কোণের মিউজিক সিস্টেমে রবীন্দ্রনাথের গান বাজছে, ‘সহেনা যাতনা। ভিতরের দরজার ফ্রেমে এসে দাঁড়াল মালিনী, রাতপোশাক। মুখে বিরক্তি)
মালিনী : এখন রাত বারোটা বাজে। তুমি কী চাইছ?
সুব্রত : আমি? কী চাইছি! (উঠে বসে)
মালিনী : আঃ, গান কেউ এত রাত্রে ওই ভল্যুমে শোনে না। দয়া করে কমিয়ে দেবে—
সুব্রত : (রিমোট টেপে, শব্দ থেমে যায়)। তুমি অনুরোধ করলে আমি কি উপেক্ষা করতে পারি?
মালিনী : তুমি কী পারো আর না পারো তার ফিরিস্তি এই মাঝরাতে আমাকে দিতে হবে না। এই রাতদুপুরে অত জেরে গান বাজিয়ে আমার ঘুম নষ্ট করে তুমি কী চাইছ?
সুব্রত : দ্যাখো, এখন আমি আর কিছুই চাই না। কারণ জানি, চাইলেও পাব না।
মালিনী : ন্যাকামি! তুমি কি চাইছ আমি এখন বাড়ি থেকে বেরিয়ে যাই?
সুব্রত : এত রাত্রে কোথাও যাওয়া কি খুব জরুরি?
(মালিনী রাগে বিরক্তিতে কাঁধ নাচাল এবং এই সময় সশব্দে বাজ পড়ল। তারপর বৃষ্টির আওয়াজ। মালিনী কানে হাত চাপল)
সুব্রত : ওই শব্দের উপর আমার কোনো কনট্রোল নেই।
মালিনী : উঃ ভগবান!
সুব্রত : এককালে ওঁর ছিল। এখন ভগবানের ক্ষমতা প্রায় নিল। এই যে লে—তে মেঘ ভেঙে মাটিতে আছড়ে পড়ল, নেপালে ভূমিকম্পে কত মানুষ মারা গেল, ভদ্রলোক কিছুই করতে পারলেন না।
(মালিনী দ্রুত ভিতরে চলে গেলে আবার বাজ পড়ল সশব্দে। বৃষ্টি জোরালো হয়েছে। সুব্রত সোফায় আধশোয়া হয়ে রিমোট হাতে নিয়েও রেখে দিল। তারপর চোখ বন্ধ করল)
অষ্টম দৃশ্য
(সকাল। সুব্রত পাশ ফিরে শুয়ে আছে। কুন্তী চায়ের কাপ হাতে নিয়ে ঘরে ঢুকল)
কুন্তী : দাদাবাবু, ও দাদাবাবু, উঠুন, আটটা বেজে গেছে।
সুব্রত : (ঘুম জড়ানো গলায়)। কটা বাজে?
কুন্তী : আটটা বেজে দু—মিনিট।
(শোনামাত্র লাফিয়ে উঠে বসল—)
সুব্রত : ‘আরে! আমাকে ডাকোনি কেন?’
কুন্তী : ডেকেছি। এই নিয়ে তিন তিনবার। প্রথমবার, মাসি যখন চা খেলেন, দ্বিতীয়বার, উনি যখন বাথরুমে গেলেন, তৃতীয়বার—
সুব্রত : থাক। ওটা তাহলে এক গজের চা। ফেলে দিয়ে নতুন চা নিয়ে এসো।
কুন্তী : এক গজের চা মানে?
সুব্রত : তিনবার ফুটিয়েছ গরম রাখার জন্য।
কুন্তী : এম্মা! আপনার জন্য প্রতিবারই নতুন করে চা বানাই—
সুব্রত : তাই! থ্যাংক ইউ, দাও। (হাত বাড়িয়ে পেয়ালা নেয়) এই সময় ভিতর থেকে মালিনীর গলা ভেসে আসে —কুন্তী, ব্রেকফাস্ট দে।’ কুন্তী দৌড়ে ভিতরে চলে যায়। সুব্রত তৃপ্তির সঙ্গে চা খায়। মালিনী ঘরে ঢোকে)
মালিনী : শোন, আজ থেকে তুমি আমার ঘুমের ডিসটার্ব করবে না। কাল রাত্রে আমাকে ঘুমের ওষুধ খেতে হয়েছে। এখন এই সাতসকালে ছুটতে হবে। শরীরটা এত ম্যাজম্যাজ করছে।
সুব্রত : সরি, ম্যাডাম, আর তোমাকে রাতবিরেতে বিরক্ত করব না। কিন্তু এই ভোরবেলায় ব্রেকফাস্ট খেয়ে ছুটছ কোথায়?
মালিনী : ভোরবেলায়। এখন কটা বাজে তা জানো? আটটা বেজে গিয়েছে আর তুমি নাক ডাকিয়ে ঘুমাচ্ছ। আছ বেশ।
সুব্রত : এই তো বললে সাতসকালে ছুটতে হবে। যাচ্ছ কোথায়?
মালিনী : অফিসের পিকনিকে। (কুন্তীর গলা ভেসে আসে— মাসি!)
(মালিনী ভিতরে চলে যায়, টেলিফোন বেজে ওঠে। সুব্রত চায়ের কাপ রেখে উঠে গিয়ে রিসিভার তোলে।)
সুব্রত : হ্যালো! (উত্তর শোনে) হ্যাঁ, কে বলছেন? (উত্তর শোনে) আপনি মালিনীর সহকর্মী? বলুন কী চাই? (উত্তর শোনে) না, মালিনী সাজগোজ করছে, এখনও বাড়ির বাইরে পা দেয়নি। কিছু বলতে হবে? (উত্তর শোনে) আপনি বাড়ির নীচের রাস্তায় গাড়ি নিয়ে অপেক্ষা করছেন? খুব ভালো। (উত্তর শোনে) ওর মোবাইল বোধহয় খারাপ হয়েছে। সরি। রাখছি ভাই। (রিসিভার নামিয়ে রাখে। তারপর একটু খুশি খুশি গলায় ডাকে, মালিনী—’। মালিনী জুসের গ্লাস নিয়ে ঢোকে)
মালিনী : এমন চিনি মেশানো গলায় ডাকছ, কী ব্যাপার?
সুব্রত : অমিতাভবাবু তোমার জন্য বাড়ির সামনের রাস্তায় গাড়িতে বসে আছেন। পিকনিকের দেরি হয়ে যাচ্ছে।
মালিনী : এ কথা তোমাকে কে বলল!
সুব্রত : ফোন করেছিলেন। তোমাকে মোবাইলে পাচ্ছেন না। কেন যে মানুষকে অপেক্ষা করাও।
মালিনী : তুমি কী বলতে চাইছ?
সুব্রত : আমি তো কিছুই বলতে চাইনি।
মালিনী : তুমি আমাকে আবার ছোট করলে। তোমার কথায় নোংরা ইঙ্গিত ছিল। আমি অমিতাভবাবুকে আমার বাড়ির সামনে অপেক্ষা করতে বলিনি। উনি নিজেই এসেছেন। নীচে গিয়ে দ্যাখো, ওঁর গাড়িতে আমাদের অন্য সহকর্মী মহিলাও আছেন। ছিঃ। তোমার সঙ্গে কথা বলতে— (ফোন বেজে উঠল। সুব্রত এগিয়ে যাচ্ছিল। মালিনী গলা তুলল—)
মালিনী : তুমি ধরবে না।
সুব্রত : হয়তো অমিতাভবাবু আবার ফোন করেছেন!
মালিনী : আমি দেখছি। (মালিনী এগিয়ে যায়, রিসিভার তোলে)
মালিনী : হ্যালো! (উত্তর শোনে) ও, তুমি। বল, যমুনা। খুব কি জরুরি? আমি এখন ব্যস্ত, বেরোতে হবে—! (শোনে) কী কথা? ঠিক আছে, তুমি সন্ধের পরে এসো, শুনব। (উত্তর শোনে) কী করেছে কুন্তী? (উত্তর শোনে) ওকে ছাড়িয়ে দেব? সেকি? কেন? তুমিই তো দেখেশুনে দিয়েছ (উত্তর শোনে) তারপর নার্ভাস হয়ে রিসিভার রেখে দেয়। ঠোঁট কামড়ায়)
সুব্রত : (এগিয়ে যায়)। কী হয়েছে?
(মালিনী খুব ক্লান্ত ভঙ্গিতে সোফায় বসে পড়ে। ঠিক তখনই আবার ফোন বেজে ওঠে। সুব্রত এগিয়ে গিয়ে রিসিভার তোলে।)
সুব্রত : হ্যালো (উত্তর শুনে রিসিভারে হাত চেপে মালিনী বলে) অমিতাভবাবু—।
মালিনী : না না অসম্ভব। ওঁকে বলে দাও হঠাৎ শরীর খুব খারাপ হয়েছে, আমি যেতে পারব না, খুব দুঃখিত।
সুব্রত : (টেলিফোনে) কিছু মনে করবেন না, মালিনীর শরীর খুব খারাপ হয়েছে, বোধহয় প্রেসার বেড়ে গেছে। তাই আপনাদের চলে যেতে বলল, ওর পক্ষে যাওয়া সম্ভব হচ্ছে না।
(রিসিভার নামিয়ে রাখে সুব্রত। মালিনীর পাশে গিয়ে বসে।)
সুব্রত : কুন্তীকে ছাড়িয়ে দিতে বলেছে যমুনা?
(দু—হাতে মুখ ঢেকে থাকা মালিনী মাথা নেড়ে হ্যাঁ বলে)
সুব্রত : কেন? ওর কী অপরাধ? তুমি এত আপসেট হচ্ছ কেন? দেখো, নিশ্চয়ই যমুনা তার কোনো ভাইঝি, ভাগ্নীকে কুন্তীর জায়গায় ঢোকাতে চাইছে না।
(মালিনী মাথা নাড়ল—’না’।)
সুব্রত : তাহলে?
মালিনী : কুন্তী প্রেগন্যান্ট।
নবম দৃশ্য
(একই ঘর। একটু সময় এগিয়েছে। স্বামী—স্ত্রী এখন কাছাকাছি)
সুব্রত : আমরা বোধহয় একটু বেশি রি—অ্যাক্ট করছি মালিনী। কুন্তী আমাদের কাজের মেয়ে। সে কীরকম কাজ করছে সেটাই আমরা দেখব। তাই না? ওর ব্যক্তিগত ব্যাপার নিয়ে আমরা ভাবছি কেন?
মালিনী : ভাবতে হবে সুব্রত। কারণ আমরা একা একা থাকলেও সমাজকে নস্যাৎ করতে পারি না। আমাদের বাড়িতে একটি অবিবাহিতা মেয়ে কাজ করছে এবং সে প্রেগন্যান্ট যা কয়েক মাসের মধ্যেই সবাই বুঝতে পারবে, কেউ প্রশ্ন করলে তার জবাব দেওয়ার নৈতিক দায়িত্ব আমাদের নিতে হবেই।
সুব্রত : একটা কথা, কুন্তী যে অবিবাহিতা এই সিদ্ধান্তে আসছ কী করে?
মালিনী : কী আশ্চর্য! ও প্রথম দিনেই বলেছিল মামা এবং মামি ছাড়া ওর কোনো আত্মীয় বেঁচে নেই। স্বামী থাকলে বলত না? তাছাড়া ওর সিঁথিতে সিঁদুর দেখেছ?
সুব্রত : ওটা অনেকেই পরে না, চুল উঠে যাবে বলে তুমিও পরো না। মালিনী (উঠে দাঁড়ায়) কার সঙ্গে আমি কথা বলছি।
সুব্রত : প্লিজ এত অধৈর্য হয়ো না। কাজের পিছনে না ছুটে আগে কানে হাত দিয়ে দেখো ওটা যথাস্থানে আছে কি না।
মালিনী : মানে?
সুব্রত : প্রথমে কুন্তীর সঙ্গে কথা বল। যাও।
মালিনী : যাও মানে? আমি তোমার সামনেই ওর সঙ্গে কথা বলব।
(চেঁচিয়ে ডাকে) কুন্তী, কুন্তী এই ঘরে এসো।
সুব্রত : তুমি তো ওকে তুই করে বলতে।
মালিনী : আঃ।
(কুন্তী হাসি মুখে ঢোকে)
কুন্তী : একি মাসি, তুমি এখনও এখানে? কখন পিকনিকে যাবে?
মালিনী : (খুব গম্ভীর গলায়) ওখানে চুপ করে দাঁড়াও। তোমাকে কয়েকটা প্রশ্ন করব, ঠিকঠাক উত্তর দেবে।
কুন্তী : আমি তো কখনও তোমাকে বেঠিক উত্তর দিইনি মাসি।
মালিনী : বড্ড বেশি কথা বলছ কুন্তী। প্রথমে জিজ্ঞাসা করছি, তুমি কি বিবাহিত? বিয়ে হয়েছিল? হলে আমাদের বলনি কেন?
সুব্রত : বিয়ে হয়ে থাকলে তোমার স্বামীর নাম বল।
কুন্তী : (খিলখিলিয়ে হেসে ওঠে) ওমা, এসব কী বলছ তোমরা। আমার বিয়ে হল কবে? হ্যাঁ, একবার মামা কোন দোজবরের সঙ্গে বিয়ে দিতে চেয়েছিল কিন্তু টাকা পায়নি বলে শেষপর্যন্ত বিয়ে দেয়নি। বিয়েই যখন হয়নি তখন স্বামীর নাম কী করে বলব?
(সুব্রত এবং মালিনী পরস্পরের দিকে একবার তাকাল)
মালিনী : শোন, একটু আগে যমুনা ফোন করেছিল।
কুন্তী : ওমা! ফোন করার কী আছে। দু—বেলা বাড়ির সামনে দিয়ে এই বাড়ি ওই বাড়ি কাজে যায়।
সুব্রত : সরাসরি জিজ্ঞাসা কর।
মালিনী : যমুনা তোমার সম্পর্কে যা বলেছে তা শোনার পর তো আর এই বাড়িতে রাখতে পারি না।
সুব্রত : কিন্তু যমুনার কথায় বিশ্বাস করছি না বলে তোমার মুখ থেকে শুনতে চাইছি, কথাটা সত্যি না মিথ্যে?
কুন্তী : আমি তো কিছুই বুঝতে পারছি না। বললাম তো আমার এখনও বিয়ে হয়নি। এটা মিথ্যে নয়, একদম সত্যি।
সুব্রত : তাহলে তুমি মা হচ্ছে কী করে?
কুন্তী : মা?
মালিনী : তোর পেটে বাচ্চচা আসেনি? সত্যি কথা বল?
(কুন্তী ঠোঁট কামড়াল, মাথা বুকের কাছে ঝুঁকল)
মালিনী : কী কথা নেই কেন মুখে? ছি ছি ছি। আইবুড়ো মেয়ে হয়ে এমন কাণ্ড করেছিস বলে তোকে মল্লিকবাড়ি থেকে তাড়িয়ে দিয়েছে, ঠিক কি না বল?
(কুন্তী ধীরে ধীরে মাটিতে বসে পড়ে দু—হাতে মুখ ঢেকে ফুঁপিয়ে কাঁদতে থাকল।)
মালিনী : এখানে বসে কেঁদে কোনো লাভ হবে না। আমি আর তোমাকে রাখতে পারব না। যে কয়েকদিন কাজ করেছ তার জন্য টাকা দিয়ে দিচ্ছি নিয়ে বিদায় হও।
(কুন্তী পাথরের মতো বসে কেঁদে চলল)
মালিনী (রেগে গিয়ে)। কথাগুলো কানে গিয়েছে।
কুন্তী : (মুখ না তুলে) কেন? আমার দোষ কী?
মালিনী : অদ্ভুত! এর পরেও জিজ্ঞাসা করছে আমার দোষ কী?
কুন্তী : আপনারাই তো বলেন আমি খুব ভালো রান্না করি, ঘরের সব কাজ মানুর মায়ের থেকে অনেক ভালো করি, তাহলে আমাকে চলে যেতে বলছেন কেন? আমার দোষ কী?
মালিনী : আমাদের দেশের মেয়েরা বিয়ের আগে মা হয় না, তুমি হয়েছ। দোষটা কী জানো না।
কুন্তী : আমাকে ছোটবাবু অন্য কথা বলেছিল।
সুব্রত : ছোটবাবু, সে কে?
কুন্তী : যে বাড়িতে কাজ করতাম, সেই মল্লিকবাড়ির ছোটবাবু।
সুব্রত : কী বলেছিল?
কুন্তী : অনেক আগে এদেশের কুমারী মেয়েরা মা হত। আমার নামে একজনের নাম ছিল অনেক আগে। সে নাকি কুমারী অবস্থায় বাচ্চচার মা হয়েছিল। ছোটবাবু বলেছিল, তাকে সবাই সতী বলে। তাহলে?
সুব্রত : (মালিনীকে) কথাগুলো মিথ্যে বলেনি।
মালিনী : (চাপা গলায়)। সুব্রত। শোন কুন্তী, আমি আর কথা বাড়াতে চাই না।
কুন্তী : কিন্তু মাসি, আমি কোথায় যাব?
মালিনী : ওসব ঘটনা যখন ঘটিয়েছিলে তখন মনে ছিল না?
কুন্তী : (মাথা নাড়ে)। না। বিশ্বাস করুন।
মালিনী : যে চুলোয় যাও, আমার তাতে কিছু যায় আসে না।
কুন্তী : এমন করে বলবেন না মাসি। আমার কেউ নেই। কোথাও যাওয়ার জায়গা নেই, আমাকে তাড়িয়ে দেবেন না।
মালিনী : এসব কথা মল্লিকবাড়ির গিন্নিকে বলনি কেন? ওরা তাড়িয়ে দিল আর তুমি এ বাড়িতে এসে কাপ ভাঙার চমৎকার গল্প বানালে। এখন অন্য কোথাও গিয়ে নতুন গল্প শোনাও।
(কুন্তী কাঁদতে থাকে আবার। দু—হাতে মুখ ঢেকে)
সুব্রত : ঠিক আছে, যে তোমার এই অবস্থার জন্য দায়ী তাকেই সব দায়িত্ব নিতে হবে। আমি তাকে বাধ্য করব। কী নাম তার?
(কুন্তী কেঁদেই চলল)
সুব্রত : কেঁদে তো কোনো লাভ হবে না। আমি তোমার উপকার করতে চাইছি। তোমার এই অবস্থার জন্য আর একজন দায়ী। নামটা বল। আমি পার্টির লোকদের বলে তোমাদের বিয়ের ব্যবস্থা করব।
মালিনী : সমাজসেবা করছ?
সুব্রত : এটুকু না করলে—! হ্যাঁ বল।
কুন্তী : কী বলব!
সুব্রত : নাম। মল্লিকবাড়ির কেউ?
(কুন্তী মাথা নাড়ে, হ্যাঁ বলে)
সুব্রত : কে? কী নাম? মল্লিকবাড়ির বড়বাবু?
কুন্তী : এম্মা। ছিঃ। তিনি বুড়ো মানুষ।
সুব্রত : তাহলে মেজবাবু?
কুন্তী : না—না উনি মেজ বউদিকে খুব ভয় পান।
সুব্রত : তাহলে নিশ্চয়ই সেজবাবু?
কুন্তী : সেজবাবু তো বিদেশে থাকেন।
মালিনী : এত ন্যাকামি করছ কেন? ছোটবাবুর নামটা বলে ফ্যালো।
কুন্তী : কী করে বলব? ঠিক বুঝতে পারছি না।
মালিনী : মানে? বুঝতে পারছিস না মানে? ছোটবাবু তোকে—।
কুন্তী : হ্যাঁ। কিন্তু ওর এক বন্ধু মাঝে মাঝে বাড়িতে আসত। ঠিক দুপুরবেলায় সেও আমাকে ছাড়েনি।
মালিনী : সর্বনাশ। এ তো ভয়ংকর মেয়েছেলে! একসঙ্গে দু—দুটো পুরুষকে—। উঃ। ওর পেটে যে আছে তার বাবা কে তা কী করে বুঝবে?
সুব্রত : বাচ্চচাটা হওয়ার পর ডিএনএ টেস্ট করা ছাড়া উপায় নেই।
মালিনী : এই, তুই দূর হ। এসব শোনার পর উঃ আমার কান ঝাঁ ঝাঁ করছে।
কুন্তী : আমি কোথায় যাব মাসি?
মালিনী : খবরদার আমাকে মাসি বলবি না।
কুন্তী : বেশ, আপনি যখন চাইছেন না, কিন্তু—!
মালিনী : আবার কিন্তু কেন?
কুন্তী : আজ তো বৃহস্পতিবার। আজকের দিনে কাউকে তাড়ালে গৃহস্থের অকল্যাণ হয়। আমাকে অন্তত কাল সকাল পর্যন্ত থাকতে দিন। আমি আপনাকে কথা দিচ্ছি—।
মালিনী : আমি এসব কথা শুনতে চাই না, তুমি বিদায় হও।
কুন্তী : এমন করে বলছেন কেন? আমি আপনার কী ক্ষতি করেছি?
মালিনী : হায় ভগবান!
কুন্তী : আচ্ছা দাদাবাবু, আমি এখানে থাকলে আপনাদের কি খুব ক্ষতি হবে? আমি রাস্তায় গিয়ে দাঁড়ালে সবাই আমাকে ছিঁড়ে খাবে। উঃ। আমার পেটে যেটা আছে তার জন্য ভয় পাচ্ছেন? আচ্ছা, যখন ওর আসার সময় হবে তখন আমাকে কোনো হাসপাতালে দিয়ে দেবেন। আপনাদের একটুও কষ্ট দেব না।
(সুব্রত কিছু বলতে যাচ্ছিল, মালিনী তাকে হাত তুলে থামাল)
মালিনী : এসব কিছুই করতে হবে না তোমাকে। একটু আগে বলেছিলে আজকের রাতটা থাকতে চাও, কাল ভোরে চলে যাবে। বেশ তাই হোক। আজ তুমি তোমার ঘর থেকে বের হবে না। কোনো কাজ করতে হবে না। এখন চলে যাও সামনে থেকে—।
(প্রায় দৌড়ে ভিতরে চলে গেল কুন্তী। মালিনী সোফায় এসে শরীরটাকে তার উপর ছেড়ে দিল। তিরিশ সেকেন্ড চুপচাপ।
সুব্রত : মেয়েটার কী হবে বল তো?
(মালিনীর চোখ বন্ধ। জবাব দিল না।)
সুব্রত : হয় ওকে রেডলাইট এরিয়ায় গিয়ে বাকি জীবন কাটাতে হবে নয়তো আত্মহত্যা করা ছাড়া কোনো উপায় থাকবে না। যদি ওকে, ধরো, মাদার টেরেজার মতো কোনো হোমে নিয়ে যাওয়া যেত। বড় ভালো মেয়েটা।
মালিনী : (চোখ খুলল)। এখনও ওকে দেখলে বোঝা যাচ্ছে না। ওসব করতে গেলে যে সময় যাবে, তখন যদি বলে এই বাড়ির দাদাবাবু ওর এই অবস্থার জন্য দায়ী তখন কী জবাব দেবে? জবাব দিতে পারবে তো? (মালিনী উঠে ভিতরে যেতে গিয়ে দাঁড়ায়)
মালিনী : বাইরের দরজায় লক করে রাখো। কিছুই অসম্ভব নয়।
(মালিনী চলে যায়)
দশম দৃশ্য
(বাইরের ঘর) রাত অনেক। বই পড়ছিল সুব্রত। হঠাৎ পিছনের দরজার শব্দ হল। চমকে উঠল সুব্রত। বই বন্ধ করল। তারপর পিছনে তাকাতেই দরজায় কুন্তীকে দেখতে পেল। অর্ধেকটা আড়ালে।
কুন্তী : দাদাবাবু—!
(সুব্রত মুখ নীচু করল। উত্তর দিল না)
কুন্তী : আপনার জন্য একটু কফি করে আনি?
(সুব্রত ঠোঁট কামড়াল)
কুন্তী : আপনি তো রোজ খেতেন, আজ খাবেন না?
(মঞ্চ অন্ধকার হয়ে যায়। যখন আলো ফিরে আসে তখন কুন্তী দরজায় নেই। সুব্রত মাঝখানে দাঁড়িয়ে)
সুব্রত : (দর্শকদের দিকে তাকিয়ে)। কী উত্তর দেব আমি? মন চাইছে, বলি, হ্যাঁ, দাও, নিশ্চয়ই কফি খাব। কিন্তু আমি এমন খোলা গলায় বলতে পারছি না কেন? আপনি, আপনারা হলে কী উত্তর দিতেন?