“আপনার পূজা আপনি করিলে, এ কেমন লীলা তব!”
না, ঠাকুরের কোন অসুখ হয়নি। দেহবোধ থাকলে তবেই সুখ-অসুখ। ঠাকুরকে প্রথমে চিনেছিলেন মথুরবাবু। ঠাকুর কৃপা করে তাঁকে চিনিয়েছিলেন—জমিদার মথুরমোহন, আমাকে চিনে নাও, কে আমি! কার সেবা করছ তুমি, করবে তুমি! হাটে হাঁড়ি ভাঙার আগেই ভেঙে দেওয়া!
মথুরমোহন দেখলেন, রাম আর কৃষ্ণ মিলে রামকৃষ্ণ তো বটেই, আবার শিব এবং কালী, শিবকালীও। কোন্ দুশ্চর, দুরূহ সাধনে মথুরমোহনের শ্রীরামকৃষ্ণে ইষ্টদর্শন হলো? সমর্পণে, বিশ্বাসে, সেবায়। মথুরমোহন ভোগী, রাজসিক। যৌবনের সেই কালে নানা এদিক-সেদিক তো ছিলই। সখা পার্থকে যে- প্রতিশ্রুতি দিয়েছিলেন তা দক্ষিণেশ্বরের রামকৃষ্ণরূপী শ্রীকৃষ্ণ রাখলেন— “মামেকং শরণং ব্রজ”। (গীতা, ১৮।৬৬) “সর্বধর্মান পরিত্যজ্য” এবারে আর বলতে হলো না, কারণ এবারের লীলায় সব ধর্মই এক। ধর্মের সংজ্ঞাও অতি সহজ। সেবারের ধর্ম ছিল ক্ষত্রিয়ের রাজধর্ম। মহাপ্রভু-রূপে প্রেমধর্ম। শঙ্কর- রূপে জ্ঞানধর্ম। গৌতম-রূপে ত্যাগধর্ম, আর রামকৃষ্ণ-রূপে গৃহীর রসেবশে ধর্ম। কিন্তু মূল নির্দেশটি এক : “শরণং ব্রজ”—আমার আশ্রিত হও। আর তখন আমি তোমার জন্য কি করব! আমি তোমার জন্য তোমারই রচনা পাঁকে নেমে পদ্ম ফোটাব। তোমাকে পরিস্রুত করে আমার কৃপালাভের উপযুক্ত করব। আমি কেমন গোয়ালা? না, তোমার পাত্র পরিষ্কার করে কৃপা-দুগ্ধ ঢালব। “অহং ত্বাং সর্বপাপেভ্যো মোক্ষয়িষ্যামি মা শুচঃ।” (গীতা, ১৮।৬৬) তোমার অনুশোচনার কিছু নেই। তুমি শুধু বুড়ি ছুঁয়ে থাক। আর অতি সামান্য একটি স্নেহের অনুরোধ—”মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।” (গীতা, ১৮।৬৫)
গিরিশচন্দ্রকে কৃপা করলেন—কিছুই যখন পারবে না, তখন দাও, আমাকে বকলমা দাও। বললেন, গিরিশ ঘোষ, তোমাকে আমি এমন করে দেব, লোকে অবাক হবে। গিরিশচন্দ্রের দর্শন হলো। একটু ঘুরিয়ে বললেন : “ব্যাস, বাল্মীকি যাঁর ইয়ত্তা করতে পারেননি, আমি তাঁর সম্বন্ধে কি বলব!” গিরিশচন্দ্র বারে বারে বলতেন : “ঠাকুরের মিরাকল যদি দেখতে চাও, তাহলে আমাকে আর লাটুকে (স্বামী অদ্ভুতানন্দ) দেখ।” আর দেহাবসানের পর শ্রীশ্রীমা একটিমাত্র খেদোক্তিতে সব ব্যক্ত করে দিলেন : “মা কালী গো! তুমি কোথায় গেলে!” কি অদ্ভুত শ্রীরামকৃষ্ণের এই অবতারলীলা! স্বামীজী বললেন, এমনটি আর কখনো হবে না। মহাকালের কোলে, এমনটি এই একবারই হলো। ঠাকুর শ্রীশ্রীমাকে বলছেন—মন্দিরে যিনি রয়েছেন তুমি তো তাঁরই প্রতিরূপ—মা ভবতারিণী। শ্রীশ্রীমা বলছেন : “তুমিই আমার কালী।” ভৈরবী বললেন : “নিত্যানন্দের খোলে চৈতন্যের আবির্ভাব।” গিরিশচন্দ্র বললেন : “আপনি রাম, আপনি কৃষ্ণ।” দক্ষিণেশ্বরে কে এসেছিলেন গত শতাব্দীতে! কে তুমি শ্রীরামকৃষ্ণ! তুমি দেহ! তুমি জ্ঞান! তুমি চৈতন্য! তুমি প্রেম! তুমি গ্রামের! তুমি শহরের! তুমি সভ্যতার! তুমি প্রাক্-সভ্যতার! তুমি সাধারণের! তুমি অসাধারণের, পাপীর, পুণ্যবানের, গৃহীর, সংসারীর! কে তুমি!
সেদিন যাঁরা কাছে ছিলেন তাঁর শ্রীমুখ থেকে শুনেছিলেন উত্তর, হয়তো বোঝেননি, কারণ যা কালে আছে, ‘কাল’ না এলে উদ্ঘাটিত হবে না। মাস্টারমশাই (মহেন্দ্রনাথ গুপ্ত) সেদিন ঠাকুরের কাছে এসেছেন। সঙ্গে আছেন বন্ধু কালীকৃষ্ণ ভট্টাচার্য। বিদ্যাসাগর কলেজের সংস্কৃত ভাষা ও সাহিত্যের প্রধান অধ্যাপক। মাস্টারমশাই বন্ধুকে বলেছেন : “শুঁড়ির দোকানে যাবে তো আমার সঙ্গে এস; সেখানে এক জালা মদ আছে।” মাস্টারমশাই ঠাকুরকে সেই কথা বলায় তিনি হাসছেন, বলছেন : “ভজনানন্দ, ব্রহ্মানন্দ—এই আনন্দই সুরা, প্রেমের সুরা। মানবজীবনের উদ্দেশ্য ঈশ্বরে প্রেম। ঈশ্বরকে ভালবাসা।” তাহলেই জানা যাবে তাঁর স্বরূপ। জানা যাবে তাঁর তত্ত্ব, পাওয়া যাবে পথনির্দেশ। গীতায় শ্রীভগবান অর্জুনকে দুবার ‘প্রিয়’ বললেন—তুমি আমার প্রিয় তাই তোমাকে আমি সর্বগোপ্য হতেও অত্যন্ত গোপনীয় কথা বলছি, তুমি শোন, পুনর্বার শোন—”সর্বগুহ্যতমং ভূয়ঃ শৃণু মে পরমং বচঃ।” (গীতা, ১৮।৬৪) তোমার প্রকৃত কল্যাণকর সার কথা—”মন্মনা ভব মদ্ভক্তো মদ্যাজী মাং নমস্কুরু।/মামেবৈষ্যসি সত্যং তে প্রতিজানে প্রিয়োঽসি মে।।” ঠাকুর যেমন দিব্য করে বলতেন : “মাইরি বলছি”, শ্রীকৃষ্ণও সেইরকম অর্জুনকে বলছেন— “প্ৰতিজানে”–প্রতিজ্ঞা করে বলছি, যা বলছি তার মধ্যে কোন মিথ্যা নেই— তুমি আমাতে হৃদয় অর্পণ কর, আমার ভক্ত হও, আমার পূজনশীল হও, আমাকেই নমস্কার কর। তাহলে তুমি আমাকে পাবে, কেননা তুমি আমার প্রিয়
ঈশ্বরকে ভালবাস, তাঁর প্রিয় হও। “জ্ঞান বিচার করে ঈশ্বরকে জানা বড় কঠিন।”
ঠাকুর তখন সেই গানটি গাইলেন, তাঁর অতি প্রিয় গীত, যার কথায় তাঁরই তত্ত্ব বিধৃত—
“কে জানে কালী কেমন, ষড় দর্শনে না পায় দরশন।
আত্মারামের আত্মা কালী প্রমাণ প্রণবের মতন,
সে যে ঘটে ঘটে বিরাজ করে ইচ্ছাময়ীর ইচ্ছা যেমন।”
কৃপাময় শ্রীরামকৃষ্ণ। যাকে যে-ভাবে দেখা দিলেন। কারো চোখে অশিক্ষিত গ্রাম্য ব্রাহ্মণ। কারো দৃষ্টিতে উন্মাদ। কেউ এখনো বিচার শেষ করে উঠতে পারেননি। কারো পাঁচ সিকে পাঁচ আনা বিশ্বাসে তিনি অবতার। স্বামীজীর দৃঢ় জ্বলন্ত বিশ্বাসে—”নিত্যসিদ্ধ মহাপুরুষ লোকহিতায় মুক্তোঽপি শরীরগ্রহণকারী।” স্বামীজীর এই বিশ্বাস এতটাই দৃঢ় যে, তিনি দুবার শপথ করে বলছেন— “নিশ্চিত নিশ্চিত ইতি মে মতিঃ।”
দেহধারী ভগবানের বিচিত্র লীলার শেষখণ্ডটিতে আগত আধুনিক যুগের ইঙ্গিত। বুদ্ধদেব পরিণত বয়সে খাদ্যবিষে লীলা সমাপ্ত করলেন। শ্রীকৃষ্ণ নিহত হলেন। মহাপ্রভু কৃষ্ণলীন হলেন। শ্রীরামকৃষ্ণ বেছে নিলেন খ্রীস্টের ‘সাফারিং’। ক্রুশের মতোই কণ্ঠে ধারণ করেছিলেন ক্যান্সার। ত্যাগী শিষ্যমণ্ডলীকে সমস্ত উদাহরণই দেখিয়েছিলেন, বাকি ছিল একটি—’রোগজানুক আর দেহজানুক’। আত্মারামের আত্মাতেই আরাম, বিরাম, অভিরাম। দেহেরই সব। আত্মার লিঙ্গ নেই, ব্যাধি নেই। স্বামীজী গুরুর শরীরে দেখলেন চল্লিশ বছর যাবৎ ‘কঠোর ত্যাগ, বৈরাগ্য, পবিত্রতা, কঠোরতম সাধন, অলৌকিক জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম, বিভূতি। তাঁর আবির্ভাবের কারণ খুঁজে পেলেন—”পাশ্চাত্য বাক্ছটায় মোহিত ভারতবাসীর পুনরুদ্ধার”। মাঝে মাঝে মনে হয়, স্বামীজীকে জড়িয়ে ধরে বসে থাকি। মনে হয়, তাঁর পায়ের চটি জুতো হয়ে সঙ্গে সঙ্গে ঘুরি। একমাত্র স্বামীজীই হাসতে হাসতে ঠাকুরকে বলতে পারেন : “আমায় নইলে ত্রিভুবনেশ্বর তোমার প্রেম হতো যে মিছে!” একথা আমরা পাশ থেকে বলছি। স্বামীজী যা বললেন, তা একমাত্র স্বামীজীই বলতে পারেন—”আমি রামকৃষ্ণের দাস। তাঁহার নাম তাঁহার জন্ম ও সাধন-ভূমিতে দৃঢ় প্রতিষ্ঠিত করিতে ও তাঁহার শিষ্যগণের সাধনের অনুমাত্র সহায়তা করিতে যদি আমাকে চুরি ডাকাতি করিতে হয়, আমি তাহাতেও রাজি।” “For we have taken up the Cross, Thou hast laid it upon us, and grant us strength that we bear it unto death.”
হিসেব করে দেখলেন—”সময় হয়েছে নিকট এবার বাঁধন ছিঁড়িতে হবে।” এতদিন বলেছেন : “আমি খাই দাই আর থাকি, আর সব আমার মা জানেন।” কে মা! তিনি পুরুষ না প্রকৃতি! শ্যামা অথবা কৃষ্ণ! ছোট ছোট মানুষের সঙ্কীর্ণ ধারণা। প্রকৃত কি?
“কালীর উদরে ব্রহ্মাণ্ড ভাণ্ড প্রকাণ্ড তা বুঝ কেমন,
যেমন শিব বুঝেছেন কালীর মর্ম, অন্য কে বা জানে তেমন।”
সেদিন অমাবস্যা, ৬ নভেম্বর ১৮৮৫, ঠাকুর শ্যামপুকুরবাটীতে। কণ্ঠক্ষতের চিকিৎসা হচ্ছে, কদিন ধরে বারেবারে যীশুর প্রসঙ্গ হচ্ছে। ছয়দিন আগে শনিবার শ্যামপুকুরবাটীতে প্রভুদয়াল মিশ্র এসেছিলেন। উত্তর-পশ্চিম ভারতের মানুষ। ব্রাহ্মণ। খ্রীস্টের প্রতি আকৃষ্ট হয়ে খ্রীস্টান হয়েছেন। এক ভাইয়ের বিয়ের দিন সেই ভাই ও আরেক ভাইয়ের একসঙ্গে আকস্মিক মৃত্যুতে প্রভুদয়ালের মনে বৈরাগ্য এসেছে। তাঁর বাইরে সাহেবি পোশাক, ভিতরে গেরুয়া। কোয়েকার সম্প্রদায়ভুক্ত এক সাধু। ঠাকুরকে আগে দেখেছেন। অসুস্থতার সংবাদে প্রাণের টানে ছুটে এসেছিলেন শ্যামপুকুরে। সেই জোড়া মৃত্যুর দিন থেকেই সংসার ত্যাগ করে সন্ন্যাসী। ইউরোপীয়ান পোশাকের তলায় গেরুয়া কৌপীন।
ঠাকুরের জীব-শরীর ক্রমশই দুর্বল থেকে দুর্বলতর হচ্ছে। এক-একদিন এক-একরকম দেহলক্ষণ। পার্ষদদের মধ্যে ব্যাসদেবের মতো কেউ থাকলে উদ্ধবকে দিয়ে শ্রীকৃষ্ণকে যেমন প্রশ্ন করিয়েছিলেন, অনুরূপ প্রশ্ন করাতেন শ্রীরামকৃষ্ণকে। শ্রীমদ্ভাবগতের একাদশ স্কন্ধের ষষ্ঠ অধ্যায়টি যেন যুগ-সন্ধ্যার সূচনাকারী এক বিমর্ষ অধ্যায়। শ্রীরামকৃষ্ণ-ভাগবতের ‘শ্যামপুকুরবাটী’। সাহসী উদ্ধবের অনুপস্থিতিতে কেউ প্রশ্ন করতে পারছেন না
“দেবদেবেশ যোগেশ পুণ্যশ্রবণকীর্তন।
সংহৃত্যৈতৎ কুলং নূনং লোকং সংত্যক্ষ্যতে ভবান্।
বিপ্ৰশাপং সমর্থোঽপি প্রত্যহন্ ন যদীশ্বরঃ।।” (ভাগবত, ১১।৬।৪২)
—সখা উদ্ধব পরপর চারটি বিশেষণ প্রয়োগ করলেন—দেবদেবেশ, যোগেশ, পুণ্যশ্রবণকীর্তন, ঈশ্বর। দেবদেবেশ দুটি বিশেষণের যৌগ। দেবদেব-ঈশ। দেবতা শ্রেষ্ঠেরও নিয়ন্তা। হে দেবদেবেশ, যোগেশ, পুণ্যশ্রবণকীর্তন, সর্বশক্তিমান বা ঈশ্বর হওয়া সত্ত্বেও তুমি যে বিপ্রশাপ নিবারণ করলে না, তাতে মনে হয়, তুমি নিশ্চয় এই বংশ নাশ করে ইহলোক ত্যাগ করবে!
শ্রীভগবান অপূর্ব হেসে বললেন : “সখা উদ্ধব, তোমার অনুমান অভ্রান্ত। ব্রহ্মা, শঙ্কর এবং অন্য লোকপালগণের ইচ্ছা যে, আমি নরলীলা শেষ করে বৈকুণ্ঠধামে ফিরে যাই।” শ্রীরামকৃষ্ণ-লীলায় প্রশ্ন নেই, অনুমান আছে। শ্ৰীকৃষ্ণ বলছেন : “যে-কাজ করার জন্য অংশাবতার বলরামের সঙ্গে আমি এসেছিলাম সে-কাজ পূর্ণরূপে সম্পাদন করেছি।”
শ্রীরামকৃষ্ণের ‘বলরাম’ নরেন্দ্রনাথ বলছেন, সে-কাজ, শ্রীরামকৃষ্ণ যা করতে এসেছিলেন, তা এখনো সারা হয়নি। ১৮৯০-এর ২৬ মে, স্বামীজী বাগবাজার থেকে প্রমদাবাবুকে লিখছেন : “সেই মহাপুরুষ যদ্যপি চল্লিশ বৎসর যাবৎ এই কঠোর ত্যাগ, বৈরাগ্য এবং পবিত্রতা এবং কঠোরতম সাধন করিয়া ও অলৌকিক জ্ঞান, ভক্তি, প্রেম ও বিভূতিমান হইয়াও অকৃতকার্য হইয়া শরীর ত্যাগ করিয়া থাকেন, তবে আমাদের আর কি ভরসা?”
এ যেন অর্জুনের বিষাদযোগ! সঙ্গে সঙ্গে শ্রীকৃষ্ণের শক্তির মতো শ্রীরামকৃষ্ণের ‘পাওয়ার’ এগিয়ে এসে নরেন্দ্র-রথের লাগাম ধরে এগিয়ে নিয়ে যাবেন। সংহার, সৃজন ও পালনের ত্রিশূল শিবকালী শক্তি। বুকে হাত রেখে নরেন্দ্রনাথকে তখন বিদ্যুৎ-কণ্ঠে বলতে হবে—”পূজা তাঁর সংগ্রাম অপার, সদা পরাজয় তাহা না ডরাক তোমা।/চূর্ণ হোক স্বার্থ সাধ মান, হৃদয় শ্মশান, নাচুক তাহাতে শ্যামা।।”
উদ্ধব কয়টি বিশেষণ লাগিয়েছিলেন! নরেন্দ্রনাথ উজাড় করে দিয়ে শান্ত হলেন অবশেষে প্রণামমন্ত্রে—”স্থাপকায় চ ধর্মস্য সর্বধর্মস্বরূপিণে।/ অবতারবরিষ্ঠায় রামকৃষ্ণায় তে নমঃ।।”
শ্যামপুকুরবাটীতে পটভূমি প্রস্তুত। সাগর সন্নিকটে নদী। শান্ত, ধীর, গভীর। ভাব অনেক ঘন, কথা অনেক বেশি অর্থবহ। কণ্ঠ কথাপ্রকাশে বিদ্রোহী। সর্বকালের সর্বদর্শনের সমন্বয় ঘটছে। যেসব প্রশ্নের সমাধান পাওয়া যেত না, সেইসব প্রশ্নের উদার সমাধান হচ্ছে। বিচলিত ধর্ম পাকাপোক্তভাবে সমস্ত রকমের বিশ্বাসে স্থাপিত হচ্ছে।
প্রভুদয়াল বললেন : “ওহি রাম ঘট ঘটমে লেটা।”
ঠাকুর ছোট নরেনকে মৃদুকণ্ঠে বলছেন—ইচ্ছে যে প্রভুদয়ালও যেন শুনতে পান—”এক রাম তাঁর হাজার নাম।” একটু বিরতির পর বললেন : “খ্রীস্টানরা যাঁকে God বলে, হিন্দুরা তাঁকেই রাম, কৃষ্ণ, ঈশ্বর—এইসব বলে। পুকুরে অনেকগুলি ঘাট। এক ঘাটে হিন্দুরা জল খাচ্ছে, বলছে জল; ঈশ্বর। খ্রীস্টানেরা আরেক ঘাটে খাচ্ছে, বলছে ওয়াটার; গড যীশু। মুসলমানেরা আরেক ঘাটে খাচ্ছে, বলছে পানি; আল্লা।”
ভাবস্থ ঠাকুর। কথা কয়টি বলে থামলেন।
প্রভুদয়াল বললেন : “মেরির ছেলে Jesus নয়। Jesus স্বয়ং ঈশ্বর।”
এরপর প্রভুদয়াল ভক্তদের তাঁর অদ্ভুত উপলব্ধি ও দর্শনের কথা বললেন : “ইনি (শ্রীরামকৃষ্ণ) এখন এই আছেন—আবার এক সময় সাক্ষাৎ ঈশ্বর। আপনারা এঁকে চিনতে পারছেন না। আমি আগে থেকে এঁকে দেখেছি—এখন সাক্ষাৎ দেখছি। দেখেছিলাম, একটি বাগান, উনি ওপরে আসনে বসে আছেন; মেঝের ওপর আরেকজন বসে আছেন, তিনি ততটা advanced নন।” এইবার যে-কথাটি বললেন সেটি ভারি সুন্দর—”এই দেশে চারজন দ্বারবান আছেন। বোম্বাই অঞ্চলে তুকারাম, কাশ্মীরে রবার্ট মাইকেল, এখানে ইনি, আর পূর্বদেশে আরেকজন আছেন।”
ঠাকুর শৌচে গেলেন। প্রভুদয়াল পোশাকাদি খুলে গেরুয়া কৌপীনখানি পরে বারান্দায় দাঁড়িয়ে আছেন। শৌচ থেকে ফেরার পথে ঠাকুর দেখলেন। ঘরে এসেছেন ঠাকুর। প্রভুদয়াল পোশাক পরিধান করে এসেছেন। ঠাকুর দাঁড়িয়ে আছেন পশ্চিমাস্য। প্রভুদয়ালকে এই কথাটি বলতে বলতেই সমাধিস্থ— তোমাকে দেখলাম বীরের ভঙ্গি করে দাঁড়িয়ে আছ।
ঠাকুর প্রকৃতিস্থ হয়ে প্রভুদয়ালকে দেখছেন, হাসছেন, ভাবস্থ অবস্থায় শেক হ্যান্ড করছেন, আবার হাসছেন, ভক্ত প্রভুদয়ালের হাত দুটি ধরে কৃপা করছেন—”তুমি যা চাইছ তা হয়ে যাবে।” উপস্থিত মহেন্দ্রনাথ ভাবছেন, ঠাকুরের বুঝি যীশুর ভাব হলো। নিজেকেই প্রশ্ন করছেন : “ঠাকুর আর যীশু কি এক?”
শ্যামপুকুরবাটীতে Jesus Christ!
সেই শনিবার আজ শুক্রবার। অমাবস্যা। কালীপূজা আজ।
মাস্টারমশাই সকালে স্নান সেরে, নগ্নপদে ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরী কালীমাতার মন্দিরে। গুরুর আদেশ! পুষ্প, ডাব, চিনি, সন্দেশ দিয়ে সকালেই পূজা দেবে। আরেকটি আদেশ—ডাক্তার সরকারের জন্য কিনে আনবে রামপ্রসাদের, কমলাকান্তের গানের বই।
মাস্টারমশাই আদেশ পালন করে শ্যামপুকুরবাটীতে প্রবেশ করছেন। সকাল ৯টা।
দোতলার দক্ষিণের ঘরে দাঁড়িয়ে আছেন ঠাকুর। পরিধানে শুদ্ধ বস্ত্র, কপালে চন্দনের ফোঁটা।
মা বোধহয় সাজিয়ে দিয়েছেন!
মাস্টারমশাই ঘরে প্রবেশ করে বললেন, এই যে প্রসাদ, আর গানের বই। ঠাকুর সঙ্গে সঙ্গে পাদুকা খুলে, অতি ভক্তিভরে প্রসাদের কিঞ্চিৎ গ্রহণ করলেন, কিঞ্চিৎ ধারণ করলেন মস্তকে। মাস্টারমশাইকে বললেন : “বেশ প্রসাদ।”
বেলা বাড়ল। ক্রমশই বাড়ল ভক্তসমাগম। বেলা তখন দশটা।
ঠাকুর মাস্টারমশাইকে বললেন : “আজ কালীপূজা, কিছু পূজার আয়োজন করা ভাল। ওদের একবার বলে এস। প্যাকাটি এনেছে কিনা জিজ্ঞাসা কর দেখি।”
রাত সাতটা। অমাবস্যা-রাতের পিচকালো আকাশ শহরের ওপর উপুড় হয়ে আছে। বাড়িতে বাড়িতে দীপমালা। মা দুর্গা এসেছিলেন শরতের মেঘমালা নিয়ে। তাদেরই কয়েকখণ্ড শেষ যাত্রী হয়ে ভেসে চলেছে হিমালয়ের দিকে।
ওপরের সেই দক্ষিণের ঘরেই পূজার সমস্ত আয়োজন হয়েছে।
ঠাকুর বসে আছেন। তাঁরই সামনে সাজানো হয়েছে নানারকমের ফুল, বেলপাতা, জবা, চন্দন, পায়েস, নানাবিধ মিষ্টান্ন। ভক্তেরা বসে আছেন ঘিরে শরৎ, শশী, রাম, গিরিশ, চুনিলাল, মাস্টার, রাখাল, নিরঞ্জন, ছোট নরেন, বিহারী, আরো অনেকে।
রাত ক্রমশ ময়রার দোকানের ভিয়েনের মতো জমছে। আকাশের এধার- ওধারে মাঝে মাঝেই ফুঁসে উঠছে তারাবাজি। ঘরে জ্বলছে দেওয়ালগিরি, বড় বড় প্রদীপ। দেওয়ালের ছায়া কাঁপছে।
ঠাকুরের আদেশ শোনা গেল—”ধুনা আন।’
ধুনোর ধোঁয়ায় ঘরের পরিবেশ আরো রহস্যময় হলো। দক্ষিণেশ্বরের পরে, পঞ্চবটীতে তন্ত্রসাধনার বহুদিন পরে ঠাকুর আবার পূজারী। প্রতিমা অন্তরে। কিছুক্ষণ পরে ঠাকুর জগন্মাতাকে সব নিবেদন করে দিলেন। মাস্টারমশাই একেবারে পাশটিতে বসেছিলেন। ঠাকুর বললেন : “একটু সবাই ধ্যান কর।”
ধুনো, চন্দন, গুম্বুলের ধোঁয়া মহাদেবের জটাজালের মতো পাকিয়ে পাকিয়ে উঠছে। ফুল বেলপাতার সুবাসের সঙ্গে মিশে অপূর্ব সৌরভ। ধ্যানস্থ ভক্তমণ্ডলী, ধ্যানস্থির প্রদীপশিখা। আসনে নিশ্চল জ্যোতির্ময় ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ। মনে হচ্ছে, সোনার প্রতিমা!
হঠাৎ গিরিশচন্দ্রের হাতদুটি কোল ছেড়ে উঠছে। হাতে ধরা আছে একটি জবার মালা। এগিয়ে যাচ্ছে ঠাকুরের পাদপদ্মের দিকে। গিরিশের অঞ্জলি। মাস্টারমশাইও ঠাকুরের শ্রীচরণে পুষ্পাঞ্জলি দিলেন। আর কি ঠেকানো যায়! পর পর ভক্তদের অঞ্জলি –’রাখাল, রাম…।’ ‘নিরঞ্জন’ শ্রীপদে ফুল দিয়ে ভাবাবেগে ঘরের নিথর নীরবতা চমকে দিলেন, ‘ব্রহ্মময়ী, ব্রহ্মময়ী’ বলতে বলতে ভূমিষ্ঠ হয়ে চরণে মাথা রাখলেন। আরতির মতো ভক্তকণ্ঠে সমবেত রব-’জয় মা! জয় মা!’
দেখতে দেখতে ভগবান শ্রীরামকৃষ্ণ সমাধিস্থ। সবাই আশ্চর্যে হতবাক। ঠাকুর ধীরে ধীরে রূপান্তরিত হচ্ছেন, মুখমণ্ডলে অলৌকিক দিব্যদ্যুতি, উত্থিত দুই হস্তে বরাভয়, নিস্পন্দ, বাহ্যশূন্য। বসে আছেন উত্তরাস্য। দক্ষিণেশ্বরের মা, চতুর্ভুজা জগন্মাতা শ্যামপুকুরবাটীতে আজ ‘দ্বিভুজা বরাভয়া’।
গিরিশচন্দ্র শুরু করলেন স্তব-
“কে রে নিবিড় নীলকাদম্বিনী সুরসমাজে।
কে রে রক্তোৎপল চরণ যুগল হর উরসে বিরাজে।।”
*
ঘুরে গেল শতাব্দী। আরেকটি শতাব্দীরও অস্তকাল। চরিত্র সব ইতিহাস। ঘটনা। স্মৃতি। শ্যামপুকুরবাটী ঠাকুরের সেই সত্তরদিনের অধিষ্ঠানে আজ এক মহাপীঠস্থান।
সেদিন ছিল চাঁদের আলোর রাত। শ্যামপুকুরবাটীর দোতলার সেই ঘরে স্বামী পূর্ণাত্মানন্দজীর পাঠ ছিল। বাড়ি, বারান্দা, রাস্তা উপচে পড়া ভক্তসমাগম। প্রসঙ্গ সমাপ্ত। ভক্তমণ্ডলী বিদায় নিলেন। একেবারে নিরালা উঠানে দাঁড়িয়ে দোতলার বারান্দার শূন্যতার দিকে তাকিয়ে আছি। শেষ ঝাড়টি তখনো নেভেনি। পাশে দাঁড়িয়ে শ্রীম-র প্রপৌত্র, নীরব কর্মী গৌতম গুপ্ত।
ঐ সেই বারান্দা, ঐখানেই দাঁড়িয়েছিলেন ঠাকুর, পরিধানে শুদ্ধ বস্ত্ৰ, কপালে চন্দনের টিপ। শ্রীম আসছেন, হাতে ঠনঠনের সিদ্ধেশ্বরীমাতার প্রসাদ। আজো তিনি দাঁড়িয়ে আছেন। বলেছিলেন, প্রেমের চোখে দেখা যায় তাঁকে। চোখে প্রেম! সে তো অনেক পরে, আগে বিশ্বাস। মনের বিশ্বাস।