আপনার নির্বাচন
আপনাকে আমি একটু সমস্যায় ফেলতে চাই। খুব বড় মাপের কিছু না হলেও এটাকে মোটামুটি মাঝারি মাপের সমস্যা বলা যায়। আসলে আমাদের গোটা ব্যাপারটাই মাঝারি। যেমন, আপনার বয়েস মাঝারি, বুদ্ধিবৃত্তি মাঝারি, যদি বউ থাকে তো বউয়ের সৌন্দর্য মাঝারি, এমনকী উচ্চতা–তাও মাঝারি।
এই মাঝারি মাপের সমস্যাটা হল নির্বাচন ও আপনার পছন্দ করার ক্ষমতা। উঁহু, ভুল হল। বরং বলা উচিত একই ধরনের কয়েকটা জিনিসের মাঝ থেকে নিজের পছন্দটি বেছে নেওয়ার ক্ষমতা।
যেমন ধরা যাক, তিন-তিনটে মেয়েকে আপনি ভালোবাসেন। অথবা ভালোবাসেন বলে নিজে মনে করেন। মেয়ে তিনটির নাম ধরা যাক, রূপবতী, ধনবতী ও কলাবতী। রূপ, ধন ও কলা সংক্রান্ত গুণাবলি ওদের সকলেরই প্রায় সমান-সমান। আপনি ওদের তিনজনকেই চেনেন, জানেন, পছন্দও করেন। এমন অবস্থায় হঠাৎই একদিন আপনাকে বলা হল, তিনজনের মধ্যে থেকে একজনকে আপনার বেছে নিতে হবে। তখন আপনার অবস্থাটা কী হবে একবার ভাবুন তো!
আমি জানি, আপনি তিন-তিনটি রাত জেগে কাটাবেন। দাঁত দিয়ে নখ কাটবেন। কিংবা মাথার মাঝারি-সংখ্যক চুলের বেশ কিছু উপড়ে নেবেন। অথচ এতসবের পরেও আপনি নিঃসন্দেহ হয়ে বলতে পারবেন না কোনটি আপনার পছন্দ।
রূপবতী, ধনবতী, কলাবতী–এই তিন নারীর গোলকধাঁধায় আপনি ঘুরপাক খাবেন। অবশেষে মরিয়া হয়ে যদি বা কিছু নির্বাচন করেন, তাহলে সন্দেহ নেই, কয়েক দিন, কিংবা মাস, কিংবা বছরের পর আপনি সুনিশ্চিত প্রমাণ পেয়ে যাবেন যে, আপনার নির্বাচনে গলদ ছিল।
এবারে আপনাকে দ্বিতীয় উদাহরণের কথা বলি।
ধরা যাক, আপনাকে বলা হল একজন মানুষ নির্বাচন করতে যার মতো হতে পারলে আপনার আর কোনও দুঃখ, আপোেশ বা ক্ষোভ থাকে না। আপনি একবার ভাবেন নেতাজি হবেন, পরক্ষণেই হতে চান মোহনদাস। তার পর ইচ্ছে হয় রাজেশ খান্না কিংবা অমিতাভ হতে। তারও পরে হাজি মস্তান বা বিবেকানন্দ হতে মন চায়।
এইভাবে শেষ পর্যন্ত দেখা যায়, কোনও পছন্দেই আপনার আশ মেটে না, খুঁতখুঁতুনি যায় না। সুতরাং, আপনি শ্রীনিবারণ গলুই বা যা-হোক কিছু, পরিণামে নিবারণ গলুই থেকে গিয়েই ক্ষান্ত হন।
এরপর মনে করা যাক, আপনাকে বলা হল একজন মানুষের নাম করতে–যে মরে গেলে আপনার বাধা-বিপত্তি-অসুবিধে দূর হয়। সোজা কথায় আপনার আশ মেটে। ব্যস, এ-অনুরোধ করামাত্রই আপনি একটি তালিকা তৈরি করে ফেলতে চেষ্টা করবেন–যে-তালিকায় আপনার আত্মীয় পরিজন-বন্ধুবান্ধব অথবা শত্রুদের শুভনাম লিপিবদ্ধ করা আছে।
এরপর আসবে বাছাইয়ের পালা। কারণ, মাত্র একজনকে নিশ্চিন্তে নিকেশ করার অধিকার দেওয়া হয়েছে আপনাকে। অতএব আপনার মনে ঘূর্ণিঝড় শুরু হয়ে যাবে। নানান চরিত্রের নানান খুঁটিনাটি ঘটনা টেকনিকালার ছবির মতো সরে-সরে যাবে আপনার মাঝারি-নজরী চোখের সামনে। অনেক তোলপাড় হবে, অনেক দ্বিধা-দ্বন্দ্ব তৈরি হবে এবং এরকমটা চলতেই থাকবে। কোনও সিদ্ধান্তে আপনি পৌঁছোতে পারবেন না।
না, আপনাকে আমি বেহদ্দ শিরদাঁড়াহীন মানুষ হিসেবে প্রমাণ করতে চাইছি না। আসলে এই সমস্যাগুলো আমার নিজের। কোনওরকম সমাধানে পৌঁছোতে না পেরে আপনার মনে শরণার্থী হয়ে ঢুকে পড়তে চাইছিযদি আপনার কাছ থেকে কোনওরকম সাহায্য কিংবা পরামর্শ পাওয়া যায়।
যেমন ধরুন, নির্বাচন-সংক্রান্ত আরও একটা সমস্যা হল জননেতা নির্বাচন। কাকে ভোট দেবেন আপনি? অনেকগুলো নাম-ধাম-চরিত্র আপনার সামনে দাঁড়িয়ে। প্রত্যেকেই ভালো-মন্দয় মেশানো মানুষ। আপনি, শ্রীনিবারণ গলুই, আবার সংকটে পড়ে যান। বন্ধুবান্ধব, এমনকী সহধর্মিণীর পরামর্শও হয়তো চেয়ে বসেন এ-বিষয়ে। না, প্রকৃত কোনও সাহায্য তারা আপনাকে করতে পারবে না–যেমন আমার বেলাতেও পারেনি। শেষমেশ মরিয়া হয়ে যা-হোক কাউকে ভোট দিয়ে ফেলেন আপনি–সুনির্বাচিত প্রতীক চিহ্নে সিলমোহর দেগে দেন পরম প্রত্যয়ে। এবং তার পরমুহূর্ত থেকেই শুরু হয়ে যায় বিবেক-দংশন। সিদ্ধান্তের ছোট-বড় গলদ খুঁজে পান আপনি। নিজেকে ধিক্কার দেন নির্বাচনে ভুলভাল করে ফেলার জন্য। তখন নিজেকে বোকা-টোকা ইত্যাদি বলে মনে হতে থাকে।
যেসব উদাহরণগুলোর কথা আপনাকে বিরক্তিকরভাবে শোনালাম, এসব ঘটনাগুলোই আমার জীবনে বাস্তবে ঘটে গেছে। এবং যথারীতি সব নির্বাচনেই আমি বিলকুল গরমিল করে বসে আছি। আসলে এই সমস্যাগুলো আমার-আপনার সবার। সোজা কথায়, তামাম মাঝারি মানুষের এক মৌলিক সমস্যা।
যাক, এখন আর-একটু সংকটময় বিপজ্জনক নির্বাচনে আসা যাক। কখনও কি ভেবে দেখেছেন, আপনার মতে সবচেয়ে ব্যর্থ এবং অপদার্থ মানুষটি কে? লক্ষ-লক্ষ কোটি-কোটি মানুষের মধ্যে আপনাকে বলা হল সবচেয়ে ব্যর্থ অপদার্থ মানুষটি নির্বাচন করতে। ব্যস, সঙ্গে-সঙ্গে শুরু হয়ে যাবে আপনার ধন্দময় অনুসন্ধান। অনেক খোঁজাখুঁজি করে তামাম তালাশি নেওয়ার পর আপনি শুন্য নজরে চেয়ে থাকেন। আমি জানি, কেন। কারণ, সেই বিশেষ মানুষটিকে খুঁজে পাননি আপনি। না, খুঁজে পাননি বললে ভুল বলা হয়, বরং বলা উচিত খুঁজে পেয়েও নির্বাচনের দ্বিধা কাটিয়ে উঠতে পারেননি। তার নামটি উচ্চারণ করতে আপনার লজ্জা এবং সংকোচ হচ্ছে।
হ্যাঁ, এরকম লজ্জা-সংকোচ আমারও হয়েছিল। কারণ, নিজের নাম উচ্চারণ করতে আমরা, মাঝারি মানুষরা, সবসময়েই লজ্জা পাই। বলুন তো, সত্যি কোনও সন্দেহ কি আছে যে, আপনার বিচারে সবচেয়ে ব্যর্থ এবং অপদার্থ মানুষটি আপনি নিজে? যেমন, আমার বিচারে আমি!
এই নির্বাচনের ফলাফলটুকু আঁচ করার পর আমার মনে হয়েছে, বেঁচে থাকার অর্থ কী? সত্যিই কি আমার, কিংবা আপনার, বেঁচে থাকার কোনও মানে আছে? যথাযথ কারণ আছে কি কোনও?
জীবনের প্রতিটি ক্ষেত্রে আপনি এবং আমি ব্যর্থ। সেরা অপদার্থও যে, তাতেও কোনও সন্দেহ কি আর বাকি আছে? আপনি এখনও ভাবছেন? না, আমার ভাবাভাবির পালা শেষ। কিন্তু তবুও আর-একটা নির্বাচনের সমস্যায় পড়েছি আমি।
আমার সামনে এই মুহূর্তে একটা নাক বোঁচা পিস্তল, তার পাশে বিষের শিশি, আরও আছে। ফাঁস লাগানোর নাইলন-দড়ি, কিংবা কেরোসিনের টিন, এবং সব শেষে অতি ধারালো জাপানি ক্ষুর। জাপান শব্দটায় কি গৌরবময় হারাকিরির কথা মনে পড়ে যাচ্ছে আপনার?
সে যাই হোক, এখন আপনি বলুন, কোন অস্ত্রটা আমি নির্বাচন করি! হ্যাঁ, নিজের বিচারে আমি যখন সবচেয়ে ব্যর্থ ও অপদার্থ মানুষ, তখন আর বেঁচে থেকে লাভ কী! অন্তত নির্বাচনের সংকট থেকে তো মুক্তি পাওয়া যাবে। কিন্তু মুক্তি কই? এই আপন্ন মুহূর্তেও আমি অস্ত্র নির্বাচনের ক্ষুরধার সমস্যায় পড়ে গেছি! নির্বাচনের পর হয়তো বুঝব আমার বিচারে গলদ থেকে গিয়েছিল। তাই আপনার সাহায্য চাইছি আমি।
বলুন, দয়া করে বলুন, পিস্তল, বিষ, দড়ি, কেরোসিন, না ক্ষুর–কোন অস্ত্রটা আমি বেছে নিই। এ কী নিবারণবাবু, আপনিও গালে হাত দিয়ে ভাবতে শুরু করেছেন? আমারই মতো আপনিও শেষ নির্বাচনের সমস্যায় পড়ে গেলেন?
কী বললেন? ঠিক একইরকম অস্ত্রাবলি এইভাবে সাজিয়ে বহুদিন ধরে একই সংকটে ডুবে আছেন আপনিও? পছন্দ-অপছন্দের ঝড়ঝাপটায় ঘুরপাক খাচ্ছেন অসহায়ের মতো!
তাহলে এখন আমি কার কাছে যাই! কে আমাকে সুপরামর্শ দিয়ে সাহায্য করবে এই সমস্যায়!
আচ্ছা আপনি, হ্যাঁ, আপনি যিনি এই সমস্যায় কথা এতক্ষণ ধরে পড়লেন। আপনি একটু সাহায্য করতে পারেন আমাকে? বলতে পারেন, কোন হাতিয়ারটা পছন্দ করি? পিস্তল, বিষ, দড়ি, কেরোসিন, না ক্ষুর?
প্লিজ, ব্যক্তিগত নির্বাচনে এটুকু সাহায্য আপনাকে করতেই হবে! বলা যায় না, এই নির্বাচন হয়তো একদিন আপনার নিজেরও কাজে লাগবে। এতএব দয়া করে বলবেন কি, পিস্তল, বিষ, দ—