আপনার টুথপেস্টে কি বিষ আছে
অপারেশন এন্টাবে ইসরায়েলের ইতিহাসে এক অবিস্মরণীয় পর্ব। সুধী পাঠক, সেই অপারেশনের বিবরণ হয়তো পরে কখনো, কোথাও দেওয়া সম্ভব হবে। শুধু জেনে রাখুন, এক দল ফিলিস্তিনি সন্ত্রাসবাদী একটি ফ্রেঞ্চ এয়ারবাসকে উগান্ডায় হাইজ্যাক করে নিয়ে গিয়েছিল এবং ইহুদি যাত্রীদের বন্ধক বানিয়ে রেখেছিল। দুর্ধর্ষ একটি রেসকিউ অপারেশনের মাধ্যমে সেই সব যাত্রীদের ছাড়িয়ে আনা হয়। তারই নাম ছিল অপারেশন এন্টাবে। আর এই হাইজ্যাকিংয়ের মাস্টারমাইন্ড ছিল যে ব্যক্তি, তার নামটা এই অধ্যায়ে ছেয়ে থাকবে, মেঘের মতো। নাম তার ওয়াদি হাদ্দাদ।
ইসরায়েল নিজের শত্রুদের কথা বিশ্বাস করে এবং তাদের ভোলে না। হাদ্দাদের কুকর্ম ভোলেনি ইসরায়েল। বদলা নিয়েছিল। হাদ্দাদকে কষ্ট দিয়ে মেরেছিল তারা।
কিন্তু কীভাবে?
বিষের প্রয়োগে।
খুব স্বাভাবিক ভাবেই আপনার ভ্রূ কুঁচকে যাচ্ছে হয়তো। মুখে ফুটে উঠছে বিরক্ত ভাব। আপনি হয়তো ভাবছেন, এই বিশ্বের নানা প্রান্তে হাজার একটা মানুষকে বিষের প্রয়োগে হত্যা করা হয়। সেগুলোর বেশিরভাগটাই কোনো ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির কাজ নয়, আবার কিছু কিছু ঘটনায় ইন্টেলিজেন্স এজেন্সির যোগ মেলেও। কিন্তু বিষের প্রয়োগ দ্বারা হত্যা অতি সাধারণ একটি বিষয়। আর এমন একটি বিষয়কে আলাদা করে গুরুত্ব দিয়ে অধ্যায়ে পরিণত করার কী আছে?
আছে আছে। এগোনো যাক।
অপারেশন এন্টাবে’র ঠিক দেড় বছর পরে বিষক্রিয়ায় ওয়াদি হাদ্দাদের মৃত্যু ঘটে। মৃত্যুর সময়ে হাদ্দাদ ইরাকে ছিল। ইরাকের ইনটেলিজেন্স এজেন্সি তথা ইরাকি ফোর্সের নজরদারিতে থাকা হাদ্দাদকে কীভাবে বিষ দিল ইসরায়েল? ইসরায়েলের মাটি থেকে হাজার হাজার কিমি দূরে থাকা একটা মানুষকে বিষের প্রয়োগে মারা কি অতই সহজ কাজ ছিল?
হাদ্দাদের মৃত্যুর পর পোস্টমর্টেম হয়েছিল। দেশ-বিদেশের বড় বড় ডাক্তারেরা তবুও খুঁজে বের করতে পারলেন না যে ঠিক কোন বিষ দেওয়া হয়েছে হাদ্দাদকে। এই হল ইসরায়েল তথা তার গুপ্তচর সংস্থা মোসাদের বিশেষত্ব, যে কাজটা করার পর দুনিয়াবাসীকে জানাতে হবে তা সদর্পে জানায়, আর যেটা গোপনে রাখতে হবে তা গোপনেই রাখে। লক্ষ চেষ্টা করলেও সেই ইতিহাস খুঁড়ে বের করে আনার সাধ্য কারো নেই।
তবে এসবের আগে মোসাদের হাতে নিহত এই মহামানবটিকে একটু চিনে নেওয়া যাক। জন্মসূত্রে আবু হানি নাম থাকলেও শত্রু-মিত্র সকলেই একে চেনে ওয়াদি হাদ্দাদ হিসাবে। ফরসা, গোলগাল চেহারার মানুষটাকে দেখলে কেউ ভাবতেই পারবে না তার কুকর্মের কথা। আসুন জেনে নিই পপুলার ফ্রন্ট ফর দ্য লিবারেশন অব প্যালেস্টাইন নামক সন্ত্রাসবাদী সংস্থার এই নেতার কালো ইতিহাসটাকে—
-ইসরায়েলের নাগরিক এবং সম্পত্তির ওপরে একাধিক বার আক্রমণ।
-ব্ল্যাক সেপ্টেম্বর গ্রুপকে সমানে ইসরায়েল-বিরোধী কার্যকলাপে উদ্বুদ্ধ করা।
-ডসন’স ফিল্ড হাইজ্যাকিং, ১৯৭০ সাল।
-১৯৭৫ সালের ২১ ডিসেম্বর অস্ট্রিয়ার ভিয়েনাতে ওপেক কনফারেন্সে সন্ত্রাসবাদী হামলার পরিচালনা।
-এন্টাবে হাইজ্যাকিং, ১৯৭৬ সাল।
কিন্তু কয়েকটা বড় প্রশ্নও ওঠে : ইয়াসের আরাফাতের এই চেলাকে মারার সিদ্ধান্ত ঠিক কখন নিল ইসরায়েল? কেনই বা নিল? ইয়াসের আরাফাতকেই বা শেষ করার চেষ্টা করা হল না কেন?
আসলে ইয়াসের আরাফাত জাতিসংঘের মঞ্চ থেকে ভাষণ দেওয়ার পর আন্তর্জাতিক রাজনৈতিক ব্যক্তিত্বে পরিণত হয়েছিলেন। তাঁকে হত্যা করার একাধিক সুযোগ পেয়েও ইসরায়েল সরে এসেছে। স্নাইপারের নিশানায় পেয়েও তাঁকে ছেড়ে দিতে বাধ্য হয়েছিল ইসরায়েল। কারণ তাঁকে হত্যা করলে আন্তর্জাতিক বিরোধ আসতে পারত। এছাড়াও ইসরায়েলের পক্ষ থেকে আমেরিকাকে কথা দেওয়া হয়েছিল যে, ইয়াসেরকে তারা হত্যা করবে না। অবশ্য সেই কথা কতখানি রক্ষিত হয়েছে তা-ও আমরা দেখে নেব পরবর্তীতে।
যাইহোক, এসব রাজনৈতিক টালবাহানা করতে করতেই একটা সময়ে ইসরায়েলের হিটলিস্ট থেকে আরাফাতের নামটা মুছে দিয়ে লিখে ফেলা হল ওয়াদি হাদ্দাদের নাম।
আমরা ফিরে আসব মানুষরূপী এই শয়তানের নিধনপর্বে। এন্টাবে হাইজ্যাকিং পর্বের পরে প্রায় আঠারো মাস কেটে গিয়েছিল। বাগদাদ, বেইরুটে মজায় দিন কাটাচ্ছিল হাদ্দাদ। আর ওদিকে হিটলিস্টের মর্যাদা রক্ষা করার জন্য ইসরায়েলের গুপ্তচর সংস্থা মোসাদ নিজেকে প্রস্তুত করে তুলছিল। লক্ষ্য তখন হাদ্দাদ। কিন্তু একটা বড় সমস্যা ছিল। বাগদাদ, দামাস্কাস কিংবা বেইরুটের মাটিতে বোমা-বন্দুক চালিয়ে হাদ্দাদকে নিকেশ হয়তো করা যেত, কিন্তু তারপর সেখান থেকে মোসাদ এজেন্টদের প্রাণ নিয়ে বেরিয়ে আসা ছিল কার্যত অসম্ভব।
তাহলে কী উপায়?
এমন কোনো পন্থার প্রয়োজন ছিল যাতে হাদ্দাদের মৃত্যুকে স্বাভাবিক মনে হয়। যেমন: অসুস্থতা কিংবা গাড়ি দুর্ঘটনা এবং এসব ক্ষেত্রেও যদি কোনো ভাবে হাদ্দাদ প্রাণে বেঁচে যেত ও তার মনে বিন্দুমাত্র সন্দেহ জন্মাত তবে কার্যরত এজেন্টদের জান কয়লাই হত বলে মনে করেছিল ইসরায়েল তথা মোসাদ কর্তৃপক্ষ।
মোসাদ কাজ করে গোড়া মেরে। ঠিক হল বিষ প্রয়োগ করা হবে। যার ফলে মনে হবে হাদ্দাদ অসুস্থ হয়ে মারা গেছে। এক্ষেত্রে তারা হাদ্দাদের সংস্থার সর্ষের মধ্যেই ভূত ঢোকাল। হাদ্দাদের কাছের কোনো লোককে কাবু করে ফেলল তারা। সেই ব্যক্তির নাম পরেও সামনে আসেনি। মোসাদের খাতায় অবশ্য তার নাম হিসাবে লেখা হয়েছিল ‘এজেন্ট স্যাডনেস’। হাদ্দাদের বাসগৃহ এবং অফিসে এই এজেন্ট স্যাডনেসের গতিবিধি ছিল অবাধ।
খাবারের মধ্যে বিষ দেওয়া যেতে পারত, পানীয়ের মাধ্যমেও বিষের প্রয়োগ করা সম্ভব ছিল। কিন্তু তা করা হল না। কারণ এভাবে হঠাৎ বিষক্রিয়াতে হাদ্দাদ অসুস্থ হয়ে পড়লে সেই অসুস্থতাকে ‘স্বাভাবিক নয়’ ধরে এগিয়ে চিকিৎসা আরম্ভ হয়ে যেত। এ ধরনের কোনো ঝুঁকিই নেয়নি মোসাদ।
তাহলে কীসে দেওয়া হল বিষ?
দাঁতের মাজনে, টুথপেস্টে।
বিশ্বস্ত সূত্র বলছে, ১৯৭৮ সালের ১০ জানুয়ারি হাদ্দাদের টুথপেস্টের টিউবটাকে সরিয়ে ঠিক অমনই একটা টিউব রেখে দেয় এজেন্ট স্যাডনেস। আর ওই মাজনের মধ্যেই বিষ ছিল। প্রাণঘাতী বিষ!
তেল আভিভের দক্ষিণ-পূর্ব দিকের অবস্থিত নেস জিওনার ইসরায়েল ইনস্টিটিউট ফর বায়োলজিক্যাল রিসার্চ, ইসরায়েলের এই জাতীয় অপারেশনের জন্য ঘাতক বিষ তৈরি করে। ইসরায়েলের বায়োলজিক্যাল ওয়ারফেয়ারকে সেই ১৯৫২ সাল থেকে সামলাচ্ছে এই প্রতিষ্ঠান। নিখুঁত ভাবে।
হাদ্দাদ যখনই দাঁত মাজত, তখনই মাজনের মধ্যে থাকা মারাত্মক ওই বিষ অতি অল্প মাত্রায় ওর মুখের মধ্যেকার মিউকাস পর্দা ভেদ করে মিশে যেত ওর রক্তে। এভাবে রক্তে অল্প অল্প করে মিশতে থাকা বিষ এক সময়ে নিজের খেলা দেখাতে আরম্ভ করে দেয়। অসুস্থ হয়ে পড়ে ওয়াদি হাদ্দাদ।
ইরাকের সরকারি হাসপাতালে নিয়ে যাওয়া হয় এই জঙ্গি নেতাকে। প্রাথমিক ভাবে হাদ্দাদ চিকিৎসকদের জানিয়েছিল যে, জানুয়ারি মাসের মাঝামাঝি সময় থেকেই খাওয়ার পর থেকে ওর তলপেটে ব্যথা হচ্ছিল। সঙ্গে কমছিল খিদেও। ওজন কমে গিয়েছিল ১০ কেজির মতো।
ডাক্তারেরা বললেন হেপাটাইটিস। পরের দিকে সংক্রমণ ছড়াল। জ্বর। অ্যান্টিবায়োটিক প্রয়োগ করা হল। কাজ হল না। মাথার চুল ঝরতে লাগল। জ্বর বাড়ল। এবার ভ্রূ কোঁচকালেন চিকিৎসকেরা। সন্দেহ করা হল যে, সম্ভবত বিষ দেওয়া হয়েছে হাদ্দাদকে।
আরাফাতের ডান হাত হাদ্দাদ। সে অসুস্থ হলে তো আরাফাত চিন্তিত হবেনই। স্বাভাবিক উদ্বেগ নিয়ে তিনি যোগাযোগ করলেন স্টাসির সঙ্গে। ইস্ট জার্মানির এই সিক্রেট সার্ভিস কিন্তু সমানে ইসরায়েলের শত্রু প্যালেস্টাইনের বিভিন্ন সন্ত্রাসমূলক কাজ, সন্ত্রাসবাদী সংগঠনগুলোকে সাহায্য করত। কখনো জাল পাসপোর্ট বানিয়ে দিত, কখনো দিত আশ্রয়, আবার কখনো অস্ত্র জোগাত তাদের।
১৯৭৮ সালের ১৯ মার্চ হাদ্দাদকে ইস্ট জার্মানিতে উড়িয়ে নিয়ে যাওয়া হল। ওয়াদি হাদ্দাদের জীবনের অন্তিম এই ফ্লাইটের আগে তার সঙ্গীরা তার ব্যাগ গুছিয়ে দিয়েছিল। সঙ্গে যত্ন করে তুলে দিয়েছিল ওই বিষাক্ত মাজনের টিউবটাকেও।
মোসাদের কাছে খবর এল, পূর্ব জার্মানিতে চিকিৎসার জন্য নিয়ে যাওয়া হলেও হাদ্দাদকে বাঁচানো আর সম্ভব হবে না। ডাক্তাররা বলে দিলেন, ‘হি ইজ আ ডেড ম্যান ওয়াকিং।’
আহমেদ দৌকলি ছদ্মনাম দিয়ে হাদ্দাদকে ভর্তি করা হয়েছিল। কিন্তু তা সত্ত্বেও মোসাদের কাছে খবর আসা আটকানো সম্ভব হয়নি। দেহের ভেতরে- বাইরে নানা স্থানে রক্তক্ষরণ শুরু হয়ে গিয়েছিল। হার্টের পেরিকার্ডিয়ামে হেমোরেজ দেখা দিল। চোখে, টনসিলে, ফুসফুসের আবরণে, মস্তিষ্কে রক্তক্ষরণ আরম্ভ হল। প্রস্রাবে আসতে থাকল কাঁচা রক্ত। রক্তে হু হু করে কমতে থাকল অণুচক্রিকার সংখ্যা।
অজস্র টেস্ট করা হল। ব্লাড, ইউরিন, বোন ম্যারো, এক্স রে কিন্তু কিস্যু হল না। হবে কী করে? বিষটাকেই তো চিহ্নিত করা যাচ্ছিল না।
কেউ বলছিলেন র্যাট পয়জন। কারো মত ছিল ভারী কোনো মৌল ব্যবহার করা হয়েছে হয়তো। থ্যালিয়াম প্রয়োগের কথাও উঠল। শোনা যায়, হাদ্দাদ যন্ত্রণার চোটে এমন উন্মত্ত ভাবে চিৎকার করত যে সারা হাসপাতাল জুড়ে শোনা যেত তার আর্তনাদ। কড়া ডোজের ট্রাংকুইলাইজার দিয়ে ঘুম পাড়িয়ে রাখা হত ইসরায়েলের এই মহাশত্রুকে।
দশ দিন ধরে চিকিৎসার সবরকম চেষ্টা চালানোর পর অবশেষে হার মানল হাদ্দাদ। যবনিকা পাত হল আরাফাতের পোষা কুকুরের জীবনে। অটোপসি রিপোর্ট বলছে, ব্রেইন ব্লিডিং, নিউমোনিয়া এবং প্যানিমাইলোপ্যাথির ফলে মৃত্যু হয়েছিল।
তখন গুজব ছড়িয়েছিল বিষটা নাকি দেওয়া হয়েছিল চকোলেটের মাধ্যমে, কারণ হাদ্দাদ চকোলেট খেতে খুব পছন্দ করত। কিন্তু পরে বিশদ গবেষণায় সেই তত্ত্বকে খারিজ করে এই টুথপেস্ট থিওরি এসেছে এবং সম্ভবত তা ভুল নয়।
ইসরায়েল বা মোসাদ কখনোই হাদ্দাদকে হত্যা করার দায় স্বীকার করেনি। তবে ইসরায়েলের পক্ষ থেকে ব্যাপারটাকে ‘খুশির খবর’ বলে প্রকাশ করা হয়েছিল। কারণ ইসরায়েল বলে থাকে, ‘যাদের হাতে ইহুদিদের রক্ত লেগে থাকে আমরা তাদের ছেড়ে কথা বলি না।’ হাদ্দাদকেও ছেড়ে কথা বলা হয়নি!