আন্না কারেনিনা – ৮.১৫

পনেরো

ছেলেমেয়েদের শশা আর মধু ভাগ করে দিতে দিতে ডল্লি বললেন, ‘জান কস্তিয়া, কার সাথে কজ্‌নিশেভ এখানে এসেছেন?—ভ্রন্‌স্কির সাথে! উনি সার্বিয়ায় যাচ্ছেন।’

কাতাভাসোভ বললেন, ‘তাতে আবার একা নন, নিজের খরচায় পুরো এক স্কোয়াড্রন অশ্বারোহী সাথে নিয়ে।‘

লেভিন বললেন, ‘এটা তাঁকে শোভা পায়।’ কজ্‌নিশেভের দিকে তাকিয়ে তিনি যোগ করলেন, ‘এখনো স্বেচ্ছাব্রতী যাচ্ছে নাকি?’

কোন উত্তর দিলেন না কজ্‌নিশেভ, ভোঁতা একটা ছুরি দিয়ে সন্তর্পণে কাপের কিনারায় মধুস্রোতে লেপটে যাওয়া তখনো জীবন্ত একটা মৌমাছিকে বার করার চেষ্টা করতে লাগলেন।

কাতাভাসোভ সশব্দে শশায় কামড় দিয়ে বললেন, ‘যাচ্ছে মানে, সে কি যাওয়া! কাল স্টেশনে কি ঘটছিল যদি দেখতেন!’

‘কিন্তু এটা বুঝতে হবে কিভাবে? খ্রিস্টের দোহাই, আমাকে একটু বুঝিয়ে বলুন কজ্‌নিশেভ, কোথায় যাচ্ছে এসব স্বেচ্ছাব্রতীরা, লড়ছে কার সাথে?’ স্পষ্টতই লেভিনের অনুপস্থিতিতে যে আরাপ শুরু হয়েছিল, সেটা চালিয়ে গিয়ে জিজ্ঞেস করলেন বৃদ্ধ প্রিন্স।

‘লড়ছে তুর্কীদের সাথে’, শান্তভাবে হেসে, অসহায়ের মত পা নাড়াচ্ছিল মধুতে কালো হয়ে আসা যে মৌমাছিটা তাকে ছুরি থেকে একটা শক্ত অ্যাম্পেন পাতায় স্থানান্তরিত করে জবাব দিলেন কজ্‌নিশেভ।

‘কিন্তু তুর্কীদের সাথে যুদ্ধটা ঘোষণা করল কে? কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনা আর মাদাম শ্টালের সাথে মিলে ইভান ইভানিচ রাগোজভ?’

কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘যুদ্ধ কেউ ঘোষণা করেনি, কিন্তু লোকে নিকট জনের দুঃখকষ্টে সহানুভূতি বোধ করছে, সাহায্য করতে চায় তাদের।’

কিন্তু প্রিন্স সাহায্যের কথা নয়, যুদ্ধের প্রশ্ন তুলেছেন’, শ্বশুরের পক্ষ নিয়ে লেভিন বললেন; প্রিন্স বলছেন যে সরকারের অনুমতি ছাড়া ব্যক্তিগতভাবে লোকে যুদ্ধে যোগ দিতে পারে না। ‘

‘এই দ্যাখো কস্তিয়া, একটা মৌমাছি! আমাদের সত্যিই হুল ফোটাবে!’ একটা বোলতাকে ঝেড়ে ফেলে ডল্লি, বললেন।

লেভিন বললেন, ‘আরে না, এটা মৌমাছি নয়, বোল্‌তা।’

‘বটে, বটে, আপনার তত্ত্বটি বলুন দেখি’, হেসে লেভিনকে বললেন কাতাভাসোভ, স্পষ্টতই তাঁকে তর্কদ্বন্দ্বে নামাতে চাইছিলেন তিনি, ‘কেন লোকের ব্যক্তিগত অধিকার থাকবে না?

‘আমার তত্ত্বটা এই : একদিকে যুদ্ধ এমন একটা পাশবিক, নিষ্ঠুর, ভয়াবহ একটা ব্যাপার যে কোন লোকও, খ্রিস্টান তো ততধিক, যুদ্ধ শুরুর দায়িত্ব নিতে পারে না, সেটা পারে কেবল সরকার। সেটা তার কাজ, অনিবার্যরূপে তারা গিয়ে পড়ে যুদ্ধে। অন্যদিকে বিদ্যা এবং সুবুদ্ধি দুই-ই বলে যে রাষ্ট্রীয় ব্যাপারে, বিশেষ করে যুদ্ধের ক্ষেত্রে নাগরিকদের উচিত নিজেদের ব্যক্তিগত ইচ্ছা ত্যাগ করা।’

কজ্‌নিশেভ আর কাতাভাসোভ তাঁদের তৈরি আপত্তি নিয়ে কথা বলে উঠলেন একই সাথে।

কাতাভাসোভ বললেন, কিন্তু সেখানেই তো খিঁচ যাদু, এমন ঘটনা হতে পারে যে সরকার নাগরিকদের ইচ্ছা পালন করছে না, তখন সমাজ ঘোষণা করে তা ইচ্ছা।’

কিন্তু বোঝা গেল এ আপত্তিটা কজ্‌নিশেভের পছন্দ হল না। কাতাভাসোভের কথায় ভুরু কুঁচকে তিনি অন্য যুক্তি দিলেন, ‘অনর্থক প্রশ্নটা তুই ওভাবে রাখছিস। এটা যুদ্ধের ঘোষণা নয়, স্রেফ মানবিক খ্রিস্টীয় অনুভূতির অভিব্যক্তি। খুন হচ্ছে ভাইয়েরা, একই যাদের রক্ত, একই ধর্ম বিশ্বাস। কিন্তু ধরে নিচ্ছি ভাইও নয়, সমধর্মীয়ও নয়, নিতান্ত শিশু, নারী, বৃদ্ধ; বিক্ষুব্ধ হয়ে ওঠে চিত্ত, এই বীভৎসতা বন্ধ করায় সাহায্য করার জন্যে ছুটে যাচ্ছে রুশীরা। কল্পনা কর, রাস্তা দিয়ে যেতে যেতে তুই খেতে পেলি এক মাতাল পেটাচ্ছে নারী কিংবা শিশুকে; আমি মনে করে, লোকটার বিরুদ্ধে যুদ্ধ ঘোষিত হয়েছে কি হয়নি জিজ্ঞেস না করেই ঝাঁপিয়ে পড়বি তার ওপর। আর্তকে রক্ষা করবি।’

‘তাই বলে খুন করব না তাকে।‘

‘না, খুনই করবি।’

‘জানি না। ঘটনাটা যদি নিজে দেখতাম, তাহলে হয়ত সরাসরি ভেসে যেতাম নিজের আবেগে; তবে আগে থেকে কিছু বলতে আমি পারি না। কিন্তু স্লাভদের ওপর পীড়নে এমন একটা সরাসরি আবেগ দেখা দিচ্ছে না, দেখা দেওয়া সম্ভব নয়।’

‘তোর পক্ষে সম্ভব না হতে পারে, কিন্তু অন্যদের সে আবেগ আছে, অসন্তোষে ভুরু কুঁচকে বললেন কজ্‌নিশেভ; ‘দুরাত্মা হাগর সন্তানদের’ জোয়ালের নিচে সনাতনী স্লাভদের নিগ্রহের কথা এখনো বেঁচে আছে কিংবদন্তিতে। জনগণ শুনেছে তাদের ভাইদের কষ্টের কথা এবং কথা বলতে শুরু করেছে।’

‘হয়ত তাই’, এড়িয়ে যাওয়া জবাব দিলেন লেভিন, ‘কিন্তু আমি তা দেখতে পাচ্ছি না; আমিও তো জনগণের একগণের একজন, কিন্তু তেমন কোন অনুভূতি আমার হচ্ছে না।’

‘আমারও না’, প্রিন্স বললেন, ‘আমি বিদেশে ছিলাম, খবরের কাগজ পড়তাম, কিন্তু স্বীকার করছি, এমন কি বুলগারীয় বীভৎসতার আগেও বুঝতে পারতাম না হঠাৎ কেন স্লাভ ভাইদের জন্যে সমস্ত রুশীর ভালোবাসা জন্মাল আর আমি কোন ভালোবাসাই টের পাচ্ছি না? ভারি বিছ্‌ছিরি লাগত আমার, ভাবতাম হয় আমি একটা গর্ভস্রাব, নয় কার্ল বাডের প্রভাব পড়ছে আমার ওপর। কিন্তু এখানে ফিরে শান্ত হলাম, দেখলাম আমি ছাড়াও এমন অনেকে আছে যাদের আগ্রহ শুধু রাশিয়াকে নিয়ে, স্লাভ ভাইদের নিয়ে নয়। যেমন এই কনস্তান্তিন।’

‘ব্যক্তিগত মতামতে কিছু এসে যায় না এক্ষেত্রে’, বললেন সের্গেই ইভানিচ, ‘গোটা রাশিয়া, জনগণ যখন তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করেছে, তখন ব্যক্তিগত মত অর্থহীন।’

‘মাপ করবেন, ওটা আমার চোখে পড়ছে না। জনগণ জানে না, জানতেও পারে না’, প্রিন্স বললেন।

‘না বাবা…জানে না মানে! রবিবারে কি হল গির্জায়?’ আলাপটা শুনতে শুনতে বললেন ডল্লি। বৃদ্ধ প্রিন্স ছেলেমেয়েদের দিকে তাকিয়ে হাসছিলেন, তাঁকে ডল্লি বললেন, ‘তোয়ালেটা দাও-না। এটা হতে পারে না যে সবাই…’

‘রবিবারে কি হয়েছিল গির্জায়? যাজককে বলা হয়েছিল পড়ে শোনাতে, তিনি পড়ে শোনালেন। লোকে কিছুই বুঝল না, শুধু প্রত্যেকটা ধর্মোপদেশের সময় তারা যা করে থাকে সেভাবে দীর্ঘশ্বাস ফেলল’, বলে চললেন প্রিন্স, ‘তারপর বলা হল আত্মা ত্রাণের জন্যে টাকা তোলা হচ্ছে গির্জায়, ওরাও এক-এক কোপেক চাঁদা দিলে। কিন্তু কিসের জন্যে দিলে নিজেরাই তা জানে না।’

‘জনগণ না জেনে পারে না; জনগণের মধ্যে সব সময়ই থাকে তাদের ভাগ্য সম্পর্কে একটা চেতনা আর বর্তমানের মত এরকম মুহূর্তে সেটা তার কাছে পরিষ্কার হয়ে যায়’, কজ্‌নিশেভ বৃদ্ধ মৌমাছিপালকের দিকে তাকিয়ে স্থির বিশ্বাসে ঘোষণা করলেন।

বৃদ্ধের দাড়ি ছাইরঙা, মাথায় ঘন রুপোলি চুল, নিশ্চল হয়ে দাঁড়িয়ে মধুর পাত্র হাতে সস্নেহে শান্তভাবে সে তার উচ্চতা থেকে তাকিয়ে ছিল ভদ্রলোকদের দিকে, স্পষ্টতই কিছুই সে বুঝতে পারছিল না, চাইছিলও না।

কজ্‌নিশেভের কথায় বিজ্ঞের মত মাথা নেড়ে সে বলল, ‘ঠিক তাই বটে।’

‘ওকে জিজ্ঞেস করুন-না। কিছুই ও জানে না, ভাবছেও না কিছুই’, লেভিন বললেন; যুদ্ধের কথা তুমি শুনেছ মিখাইলিচ?’ বৃদ্ধকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘গির্জায় কি পড়া হল? কি তুমি ভাবছ? খ্রিস্টানদের জন্যে আমাদের লড়া উচিত কি?’

‘আমাদের ভাববার কি আছে গো? সম্রাট আলেকজান্ডার নিকোলায়েভিচ সব ব্যাপারে আমাদের হয়ে ভেবে থাকেন, ভাবছে। উনি দেখতে পান আমাদের চেয়ে পরিষ্কার…আরো রুটি আনব কি? খোকাকে দিলে হয় না?’ গ্রিশা বুটির চটা পর্যন্ত খেয়ে ফেলেছিল, তাকে দেখিয়ে সে বলল দারিয়া আলেক্‌-সান্দ্রভনাকে।

‘জিজ্ঞেস করার প্রয়োজন নেই আমার’, বললেন কজ্‌নিশেভ, ‘শত শত লোককে আমরা দেখেছি দেখছি যারা সব কিছু ফেলে রেখে আসছে ন্যায়ের সেবার জন্যে, আসছে রাশিয়ার সবখান থেকে, সোজাসুজি পরিষ্কার করে ব্যক্ত করছে তাদের ভাবনা আর লক্ষ্য। তারা নিয়ে আসছে তাদের মুষ্টিভিক্ষা অথবা নিজেরাই চলে যাচ্ছে এবং সরাসরি বলছে কেন। কি এতে বোঝায়?’

‘আমার মতে এতে বোঝায়’, উত্তেজিত হতে শুরু করে লেভিন বললেন, ‘আট কোটি মানুষের মধ্যে এখনকার মত শত শত নয়, হাজার হাজার লোক পাওয়া যাবে যাদের সামাজিক প্রতিষ্ঠা খোয়া গেছে, বেপরোয়া সব লোক যারা পুগাচোভের দস্যুদলে যোগ দিতে, খিবায়, সার্বিয়ায় যেতে সব সময়ই রাজি….

‘তোকে বলছি শুধু শত শত নয়, বেপরোয়াও নয়, জনগণের সেরা প্রতিনিধি!’ কজ্‌নিশেভ বললেন এমন বিরক্তিতে যেন তিনি তাঁর শেষ সম্পত্তিটুকু রক্ষা করছেন, ‘আর চাঁদা? এখানে সমগ্র জনগণ সোজাসুজি তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত করছে।’

লেভিন বললেন, ‘জনগণ’ কথাটা খুবই অনির্দিষ্ট। একজন কেরানি, শিক্ষক, হাজার পিছু একজন চাষী হয়ত জানে ব্যাপারটা কি নিয়ে। বাকি আট কোটি এই মিখাইলিচের মত তাদের অভিপ্রায় ব্যক্ত তো করছেই না, কি নিয়ে তাদের ইচ্ছা ব্যক্ত করতে হবে সে সম্পর্কে সামান্যতম ধারণাও তাদের নেই। এটা জনগণের অভিপ্রায়—আমাদের কি এ কথা বলার অধিকার আছে?’

ষোলো

কজ্‌নিশেভ দ্বন্দ্বতত্ত্বে অভিজ্ঞ লোক। তিনি আপত্তি না করে সাথে সাথে আলাপটা অন্য এক প্রসঙ্গে নিয়ে গেলেন, ‘হ্যাঁ, তুই যদি পাটীগণিত দিয়ে জনগণের আত্মাকে ধরতে চাস, তাহলে বলাই বাহুল্য, সেটা ধরা খুবই কঠিন। এবং ভোটদানও আমাদের এখানে প্রবর্তিত হয়নি, হতে পারে না। কেননা তাতে প্রতিফলিত হয় না জনগণের ইচ্ছা; কিন্তু সেটা জানার জন্যে অন্য পথ আছে। বাতাসে সেটা টের পাওয়া যায়, টের পাওয়া যায় হৃদয় দিয়ে। যেসব অন্তঃস্রোত বইতে শুরু করেছে জনগণের অচল সাগরে, সংস্কারাচ্ছন্ন নয়, এমন প্রতিটি লোকের কাছে যা পরিষ্কার তার কথা তো তুললামই না। সমাজকে আরো ঘনিষ্ঠ অর্থে দ্যাখ। বুদ্ধিজীবী জগতের অতিবিভিন্ন সমস্ত দল, যারা আগে ছিল পরস্পর অতি শত্রুতাপারায়ণ, তারা মিলে গেছে এক হয়ে। শেষ হয়ে গেওছ সমস্ত বিবাদ, সমস্ত সামাজিক মুখপত্র একই কথা বলছে, একটা ভৌত শক্তি অনুভব করছে সবাই, সেটা তাদের একই দিকে জাপটে নিয়ে চলেছে।’

প্রিন্স বললেন, ‘হ্যাঁ, খবরের কাগজগুলো একই কথা বলছে বটে—তা ঠিক। একেবারে বজ্রমেঘ দেখে ব্যাঙদের একই রকম ডাকের মত, ফলে কিছুই আর শোনা যায় না।’

কজ্‌নিশেভ ভাইয়ের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘ব্যাঙ হোক বা না হোক—খবরের কাগজ প্রকাশ করি না আমি, তাদের সমর্থন করতেও চাই না, আমি বলছি বুদ্ধিজীবী জগতে একই চিন্তাধারার কথা।’

লেভিন উত্তর দিতে চাইছিলেন, কিন্তু বৃদ্ধ প্রিন্স তাঁকে থামালেন। বললেন : ‘ওই একই চিন্তাধারা নিয়ে অন্য কথাও বলা যায়। যেমন আমার ওই জামাতা, অব্‌লোন্‌স্কি, আপনি তো চেনেন ওকে। কি-একটা কমিশনের কমিটি নাকি আরো কি-সব নাম তার—মনে নেই আমার, সেখানে সে এখন কাজ পেয়েছে। শুধু সেখানে করার কিছু নেই কি হল ডল্লি, এটা তো গোপন কথা নয়! অথচ বেতন আট হাজার। ওকে জিজ্ঞেস করে দেখুন চাকরিটা প্রয়োজনীয় কিনা, ও প্রমাণ করে দেবে যে অতি প্রয়োজনীয়। অথচ ও সৎ লোক, কিন্তু আট হাজারের প্রয়োজনে বিশ্বাস না করে কি চলে।’

‘হ্যাঁ, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনাকে উনি বলতে বলেছেন যে চাকরিটা উনি পেয়েছেন’, প্রিন্স অপ্রাসঙ্গিক কথা পাড়ায় অপ্রসন্ন হয়ে বললেন কজ্‌নিশেভ। 

‘পত্রিকাগুলোর এক চিন্তাও সেই ব্যাপার। রোকে আমাকে এটা বুঝিয়ে দিয়েছে : যুদ্ধ বাদলেই তাদের মুনাফা হয় দ্বিগুণ। জনগণের ভাগ্য, স্লাভ… এসব না ভেবে তারা পারে কি?’ 

কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘অনেক পত্রিকাই আমার পছন্দ নয়, কিন্তু এ কথাটা অন্যায়।’ 

‘আমি শুধু একটা শর্ত রাখতে চাই’, প্রিন্স বলে গেলেন, ‘প্রাশয়ার সাথে যুদ্ধের আগে সেটা চমৎকার বলেছিলেন আলফোঁস কার। ‘আপনারা মনে করেন যুদ্ধের প্রয়োজন আছে? চমৎকার। বেশ, যারা যুদ্ধের প্রচার করছে তাদের একটা বিশেস বাহিনীতে অন্তর্ভুক্ত করে সবার আগে পাঠান ঝঞ্ঝাক্ৰমণে!’ 

‘বেশ দেখাবেন তাহলে সম্পাদকেরা’, সশব্দে হেসে উঠে বললেন কাতাভাসোভ। নির্বাচিত এই বাহিনীতে তাঁর পরিচিত সম্পাদকদের দশা কল্পনায় ভেসে উঠেছিল তাঁর কাছে। 

ডল্লি বললেন, ‘কি আর হবে, পালিয়ে যাবে তারা। শুধু ব্যাঘাত ঘটাবে।’ 

প্রিন্স বললেন, ‘যদি পালাতে যায়, তাহলে পেছন থেকে গুলি কিংবা চাবুক হাতে কসাক ঘোড়সওয়ার।’

কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘এটা একটা রগড় এবং মাপ করবেন প্রিন্স, তেমন ভালো রগড় নয়!’ 

‘আমার মনে হচ্ছে না এটা রগড়, আমি…’ শুরু করতে যাচ্ছিলেন লেভিন, কিন্তু কজ্‌নিশেভ তাঁকে থামিয়ে দিলেন। বললেন, ‘সমাজের প্রতিটি সভ্যই তার উপযুক্ত কাজ করতেই আহুত। আর সামাজিক মতামত প্রকাশ করে চিন্তা জগতের লোকেরা সেটাই করছেন। এবং সামাজিক মতের অভিন্ন ও পরিপূর্ণ প্রকাশই হল সংবাদপত্রের একটা বড় অবদান এবং সেই সাথে তা একটা আনন্দজনক ঘটনা। বিশ বছর আগে আমরা মুখ বুজে থাকতাম, কিন্তু এখন শোনা যাচ্ছে রূশী জনগণের কণ্ঠ, এক হয়ে তারা উঠে দাঁড়াতে প্রস্তুত, নিপীড়িত ভাইদের জন্য তারা আত্মদানে রাজি; এটা মস্ত একটা পদক্ষেপ এবং শক্তির ভাণ্ডার।’ 

‘কিন্তু শুধু তো আত্মদান নয়, তুর্কীদের খুন করাও’, সসংকোচে বললেন লেভিন, ‘লোকে আত্মদান করছে, করতে রাজি নিজের আত্মার জন্যে, হত্যা করার জন্যে নয়’, যে চিন্তাগুলো এখন তাঁর মন জুড়ে আছে, তাদের সাথে অগোচরে কথোপকথনটা যুক্ত করে যোগ দিলেন লেভিন। 

কাতাভাসোভ হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আত্মার জন্যে মানে? প্রকৃতিবিদের কাছে কথাটা দুর্বোধ্য। আত্মা কি জিনিস?’ 

‘আপনি তো সেটা জানেনই!’ 

কাতাভাসোভ উচ্চহাস্যে বললেন, ‘সৃষ্টিকর্তার দিব্যি, সামান্যতম ধারণাও নেই! 

‘খ্রিস্ট বলেছেন, ‘আমি শান্তি নয়, খড়গ এনেছি’, নিজের পক্ষ থেকে আপত্তি করে বললেন কজ্‌নিশেভ। বাইবেলের এই যে কথাটা লেভিনকে সবচেয়ে বেশি হতভম্ব করেছে, সেটা তিনি বললেন এমনি এমনি, যেন সেটা অতি বোধগম্য একটা ব্যাপার। 

‘ঠিক তাই’, ওঁদের কাছে দণ্ডায়মান বৃদ্ধ মৌপালক বলল তার প্রতি অকস্মাৎ একটা দৃষ্টিপাতের জবাবে।

কাতাভাসোভ ফুর্তিতে চিৎকার করলেন, ‘না ভায়া, হেরে গেছেন! একেবারে হেরে গেছেন!’ 

হেরে গেছেন বলে নয়, ক্ষান্ত না থেকে তর্ক করতে শুরু করেছেন বলে বিরক্তিতে লাল হয়ে উঠলেন লেভিন। ভাবলেন : ‘না। ওঁদের সাথে তর্ক করা আমার চলে না। ওরা বর্মাচ্ছাদিত, আর আমি নগ্ন।’ 

তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে বড় ভাই আর কাতাভাসোভকে বোঝানো যাবে না, আর তাঁদের কথায় সায় দেওয়া তাঁর পক্ষে আরো অসম্ভব। ওঁরা যা প্রচার করছিলেন, সেটা মননের সেই গরিমা যা তাঁকে প্রায় ধ্বংসের মুখে ঠেলে দিচ্ছিল। তিনি মেনে নিতে পারছিলেন না যে রাজধানী দিয়ে যাওয়া কয়েক’ প্রগল্ভ স্বেচ্ছাসৈনিকের কথা শুনে পত্রিকাগুলোর সাথে তাঁর বড় ভাইসহ কয়েক ডজন লোকের এ কথা বলার অধিকার আছে যে তাঁরা জনগণের চিন্তা ও ইচ্ছা প্রকাশ করছেন, তাও আবার এমন চিন্তা যা অভিব্যক্ত হচ্ছে প্রতিহিংসা আর হত্যায়। এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না, কারণ যে লোকগুলোর মধ্যে তিনি বাস করছেন তাদের ভেতর এসব চিন্তার প্রকাশ এবং নিজের মধ্যে এরকম চিন্তা তিনি দেখেননি (আর রুশ জনগণ যাদের নিয়ে গঠিত, নিজেকে তাদের একজন বলে ভাবতে তিনি যে কারো চেয়ে কম যান না তা মনে না করে পারতেন না); এটা তিনি মেনে নিতে পারেন না প্রধানত এই কারণে যে, সাধারণ কল্যাণ কি বস্তু সেটা তিনি ও জনগণ জানেন না, জানা সম্ভব নয়। কিন্তু এটা তিনি দৃঢ়ভাবেই জানেন যে, এই সাধারণ কল্যাণ অর্জন করা সম্ভব শুধু শুভের যে নীতিগুলি প্রত্যেকেরই জানা তা কঠোরভাবে পালন করে। আর তাই সাধারণ যে লক্ষ্যই থাক তার জন্য যুদ্ধ চাইতে বা তার প্রচার করতে তিনি পারেন না। মিখাইলিচ ও জনগণের চিন্তা প্রকাশ পেয়েছে ভারাঙ্গিয়ানদের আমন্ত্রণের কিংবদন্তিতে, তাদের সাথে তিনিও বলেছেন : ‘আমাদের ওপর রাজত্ব করুন, শাসন করুন। সানন্দে আমরা পরিপূর্ণ বশ মানছি। সমস্ত মেহনত, সমস্ত হীনতা, সমস্ত কোরবানি আমরা নিজেদের কাঁধে নিচ্ছি; কিন্তু আমরা বিচারও করব না, সিদ্ধান্তও নেব না।’ আর এখন, সের্গেই ইভানিচদের কথায়, মহামূল্যে কেনা এই অধিকার ত্যাগ করছে জনগণ। 

তাঁর বলতে ইচ্ছে করছিল, জনমত যদি হয় অপাপবিদ্ধ বিচারক, তাহলে স্লাভদের সাহায্যার্থে আন্দোলনের মত বিপ্লব, কমিউনও ন্যায্য হবে না কেন? কিন্তু এ সব চিন্তায় কিছুরই সমাধান হত না। শুধু একটা জিনিস নিশ্চিত বোঝা যাচ্ছিল—এই মুহূর্তে তর্ক কজ্‌নিশেভকে চটিয়ে দিচ্ছে, তাই তর্ক করা খারাপ; লেভিনও চুপ করে গেলেন এবং অতিথিদের দৃষ্টি আকর্ষণ করে দেখালেন যে মেঘ জমছে, বৃষ্টি নামার আগে বাড়িতে ফিরে আসা ভালো। 

সতেরো 

সের্গেই ইভানিচ আর প্রিন্স গাড়িতে বসে চলে গেলেন; বাকিরা পদক্ষেপ বাড়িয়ে হাঁটলেন বাড়ির দিকে। কিন্তু কখনো সাদা, কখনো কালো মেঘ এত দ্রুত এগিয়ে আসছিল যে বৃষ্টির আগে বাড়ি পৌঁছতে হলে পদক্ষেপ আরো বাড়ানো দরকার। ঝুলকালি মাখা ধোঁয়ার মত সামনের নিচু মেঘগুলো অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় ছোটাছুটি করছিল আকাশে। বাড়ি যেতে তখনো দু’শ পা বাকি, হঠাৎ বেগ উঠল বাতাসের। তুমুল বর্ষণ শুরু হয়ে যেতে পারে যে-কোন মুহূর্তে। 

ছেলেমেয়েরা সশংকিত সহর্ষ চিৎকার তুলে সামনে ছুটল। পায়ে জড়িয়ে যাওয়া স্কার্টের সাথে কোনক্রমে যুঝতে যুঝতে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা আর হাঁটছিলেন না, ছেলেমেয়েদের দৃষ্টিচ্যুত না করে শুরু করলেন দৌড়াতে। পুরুষেরা মাথার টুপি চেপে ধরে লম্বা লম্বা পা ফেলতে লাগলেন। অলিন্দের কাছে পৌঁছতেই বড় বড় ফোঁটা আছড়ে পড়ে ভেঙে যেতে লাগল টিনের পয়ঃপ্রণালীর কানায়। প্রথমে ছেলেমেয়েরা, তাদের পিছু পিছু বড়রাও ফুর্তিতে কথা বলতে বলতে ছুটলেন চালের আশ্রয়ে। 

শাল আর কম্বল নিয়ে আগাফিয়া মিখাইলোভনা এসে দাঁড়িয়েছিলেন প্রবেশ-কক্ষে, তাঁকে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন, ‘কাতেরিনা আলেক্‌সান্দ্রভনা?’ 

উনি বললেন, ‘আমরা ভেবেছিলাম আপনাদের সাথে আছেন।’ 

‘আর মিতিয়া?’ 

‘কলোক বনে থাকার কথা, আয়াও আছে তাদের সাথে।’ 

লেভিন কতকগুলো কম্বল নিয়ে ছুটলেন কলোক বনে। 

এই স্বল্প সময়টুকুর মধ্যেই মেঘ তার বুক দিয়ে সূর্যকে এতটা চাপা দিয়েছিল যে হয়ে উঠল গ্রহণ লাগার মত অন্ধকার। বাতাসের বেগ যেন নিজের জেদ ধরে একরোখার মত থামিয়ে দিচ্ছিল লেভিনকে, লিণ্ডেন গাছের পাতা আর ফুল ঝরিয়ে, অদ্ভুত আর বিশ্রীভাবে বার্চ গাছের সাদা ফেঁকড়ি ন্যাংটা করে একদিকে নুইয়ে দিচ্ছিল সব কিছুকে : অ্যাকেসিয়া, ফলগাছ, আগাছা, ঘাস, গাছের চুড়ো। বাগানে যে মেয়েরা কাজ করছিল তারা চিল্লিয়ে ছটে গেল চাকর- বাকরদের ডেরার চালার নিচে। দরদর ধারে বৃষ্টির পর্দায় দূরের বন আর কাছের মাঠের আধখানা ঢাকা পড়ে গিয়েছিল এর মধ্যেই। দ্রুত তা এগিয়ে আসছিল কলোকের দিকে। ছোট ছোট ফোঁটায় ভেঙে যাওয়া বৃষ্টির আর্দ্রতা টের পাওয়া যাচ্ছিল বাতাসে। 

ঝড়ে হাত থেকে শাল খসে গেল, সামনের দিকে মাথা নুইয়ে ঝড়ের সাথে লড়তে লড়তে লেভিন প্রায় এসে গিয়েছিলেন কলোক বনের কাছে, দেখতে পাচ্ছিলেন ওক গাছটার পেছনে সাদা কি-একটা দবধব করছে, এমন সময় হঠাৎ সব ঝলকে উঠল, আগুন লেগে গেল মাটিতে, মাথার ওপর যেন ফেটে গেল আকাশের গম্বুজ। ধাঁধিয়ে যাওয়া চোখ খুলে বৃষ্টির যে ঘন পর্দাটা এখন তাঁকে কলোক থেকে আলাদা করে ফেলেছে, তার ভেতর দিয়ে তিনি সবার আগে সভয়ে দেখলেন বনের মাঝখানে তাঁর পরিচিত ওক গাছটার সবুজ চুড়োটার অবস্থান বদলে গেছে। ‘সত্যিই বাজ পড়েছে নাকি? লেভিন কথাটা ভাবতে না ভাবতেই ওক গাছের চুড়োটা ক্রমেই দ্রুতবেগে হারিয়ে যেতে লাগল বাকি গাছের পেছনে, শোনা গেল অন্যান্য গাছের ওপর বড় একটা গাছের পতনের শব্দ। 

বিদ্যুতের ঝলক, বজ্রের নির্ঘোষ আর দেহে একটা ক্ষণিক শীতলতা বাধ লেভিনের কাছে মিলে গেল একটা আতংকে। ‘সৃষ্টিকর্তা! সৃষ্টিকর্তা! যেন ওদের ওপর না পড়ে!’ বিড়বিড় করলেন তিনি। 

যে ওক গাছটা এখন পড়ে গেছে তাতে ওরা যেন মারা না যায়, এ প্রার্থনা কতটা অর্থহীন সেটা তখনই তাঁর মনে হলেও তিনি এটা আওড়াতে লাগলেন এ কথা জেনেই যে, অর্থহীন প্রার্থনার চেয়ে ভালো কিছু আর তাঁর করার নেই। 

যেখানেই. ওরা সাধারণত থাকত, সে জায়গাটা পর্যন্ত দৌড়ে গিয়ে তিনি তাদের দেখতে পেলেন না। 

ওরা ছিল বনের অন্য প্রান্তে, বুড়ো লিন্ডেন গাছের তলে, ডাকছিল তাঁকে। কালচে রঙের (আগে তাদের রঙ ছিল হালকা) ফ্রক পরা দুটো মূর্তি কিসের ওপর যেন গুড়ি মেরে আছে। ওরা কিটি আর আয়া। লেভিন যখন ওদের কাছে ছুটে গেলেন, বৃষ্টি ততক্ষণে থেমে গেছে, ফরসা হতে শুরু করেছে আকাশ। আয়ার স্কার্টের নিচুটা একনো, কিন্তু কিটির ফ্রক ভিজে জবজবে হয়ে তার সারা গায়ে লেপটে গেছে। বজ্রপাতের সময় তারা যেভাবে ছিল বৃষ্টি তেমে গেলেও এখনো তারা সেই অবস্থাতেই। দুজনেই ঝুঁকে আছে সবুজ ছাতা মেলা প্যারাম্বুলেটারের ওপর। 

তিনি সরে না-যাওয়া পানিতে তাঁর পানি-ভরা জুতা থপথপিয়ে দৌড়াতে দৌড়াতে বললেন, ‘বেঁচে আছো? অক্ষত? সৃষ্টিকর্তা সুমহান ‘ 

কিটির সিক্ত আরক্তিম মুখ তাঁর দিকে চেয়ে বিকৃত টুপির তল থেকে ভয়ে ভয়ে হাসছিল। 

স্ত্রীর ওপর লেভিন খেঁকিয়ে উঠলেন, ‘লজ্জা হয় না তোমার! বুঝতে পারি না কেমন করে এত অসাবধানী হতে পার!’ 

কিটি কৈফিয়ৎ দিতে লাগল, ‘সত্যি, আমার দোষ নেই। আমরা চলে যাব ভাবছিলাম এমন সময় ও চেঁচিয়ে ওঠে। ওর কাঁথাকানি বদলাতে হল। আমরা সবে…’ 

মিতিয়া অক্ষত, শুকনো, দুর্যোগেও ঘুম তার ভাঙেনি। 

‘যাক গে, সৃষ্টিকর্তা সুমহান! কি বলছি খেয়ালই নেই!’ 

ভেজা কাঁথাগুলো জড় করা হল। শিশুটিকে বার করে তাকে কোলে নিয়ে চলল আয়া। নিজের রাগের জন্য দোষী- দোষী ভাব করে লেভিন যাচ্ছিলেন স্ত্রীর পাশে পাশে, আয়াকে লুকিয়ে কিটির হাতে চাপ দিচ্ছিলেন। 

আঠারো 

লেভিন সারাটা দিন নানারকম কথাবার্তায় যেন যোগ দিচ্ছিলেন শুধু তাঁর মানসের একটা বহির্ভাগ দিয়ে। নিজের প্রতীক্ষিত পরিবর্তনটার ব্যাপারে হতাশ হলেও অন্তরের মধ্যে একটা প্রসন্ন মূর্ছনা তাঁর থামছিল না। 

বৃষ্টির পর মাটি এত ভেজা যে বেড়াতে বেরোনো যায় না; তাছাড়া বজ্রগর্ভ কালো মেঘ দিগন্ত ছেড়ে চলে যায়নি, আকাশের কখনো এ কিনারায়, কখনো ও কিনারায় কারো হয়ে গর্জন করে ফিরছিল। বাকি দিনটা সবাই কাটালেন বাড়িতেই। 

বিতর্ক আর বাঁধেনি, বরং ডিনারের পর সবাই ছিলেন শরীফ মেজাজে। 

প্রথমে কাতাভাসোভ মহিলাদের হাসালেন তাঁর মৌলিক ধরনের হাস্যকৌতুক দিয়ে, যা তাঁর সাথে প্রথম পরিচয়ের সময় সবারই ভারি ভালো লাগত, কিন্তু পরে কজ্‌নিশেভের অনুরোধে তিনি শোনাতে লাগলেন ঘরোয়া মাছির বিভিন্ন স্বভাব, এমন কি স্ত্রী-পুরুষের চেহারায় পার্থক্য আর তাদের জীবন নিয়ে তাঁর অতি মনোগ্রাহী পর্যবেক্ষণের কথা। কজ্‌নিশেভও বেশ খুশিতে ছিলেন এবং চায়ের পর ভাই শুনতে চাওয়ায় তিনি প্রাচ্য প্রশ্নের ভবিষ্যৎ সম্পর্কে তাঁর মতামত পেশ করলেন এমন সহজ আর সুন্দর করে যে সবাই তাঁর কথা শুনতে লাগলেন। 

শুধু কিটির সবটা শোনা হল না, মিতিয়াকেও ডাকা হল তার কাছে শিশুকক্ষে। 

চা ফেলে রেখে, চিত্তাকর্ষক কথাবার্তাটায় ছেদ পড়ল বলে দুঃখ, সেই সাথে আবার ডাকা হয়েছে বলে উদ্বেগ (কেননা সেটা ঘটে কেবল গুরুত্বপূর্ণ ক্ষেত্রেই) নিয়ে লেভিন ঢুকলেন শিশুকক্ষে। 

মুক্তিপ্রাপ্ত চার কোটি স্লাভদের কি করে রাশিয়ার সাথে মিলে ইতিহাসের একটা নবযুগ শুরু করতে হবে, কজ্‌নিশেভের পুরো না শোনা ঐ পরিকল্পনাটা তাঁর কাছে একদম অভিনব বলে তাতে তিনি উৎসুক ও আকৃষ্ট বোধ করলেও, কেন তাঁকে ডাকা হল তার জন্য কৌতূহল ও অস্থিরতা তাঁকে উদ্বিগ্ন করে তুললেও, ড্রয়িং-রুম থেকে বেরিয়ে একা হওয়া মাত্রই লেভিনের মনে পড়ল তাঁর সকাল বেলাকার চিন্তা। এবং তাঁর প্রাণের মধ্যে যা ঘটছে তার তুলনায় বিশ্ব ইতিহাসে স্লাভ উপাদানের গুরুত্ব নিয়ে এসব যুক্তিবিস্তার তাঁর কাছে এতই তুচ্ছ মনে হল যে মুহূর্তে তিনি সে সব ভুলে চলে গেলেন সকাল বেলাকার মানসিকতায়। 

আগে যা ঘটত, চিন্তার গতিধারা কিভাবে এগিয়েছিল সেটা তাঁর মনে পড়ল না, এখন তার আর প্রয়োজন নেই তাঁর কাছে। এসব চিন্তার সাথে জড়িত যে অনুভূতিতে তিনি চালিত হয়েছিলেন তাতে ফিরে এসে তিনি দেখলেন, প্রাণের মধ্যে সে অনুভূতি আরো প্রবল ও সুনির্দিষ্ট। আগে তাঁর যা হত, কল্পিত একটা সান্ত্বনার জন্য চিন্তার পুরো ধারাটা ঝালিয়ে নিয়ে অনুভূতি জাগাতে হত, সেটা হল না। এখন বরং আনন্দ ও প্রশান্তির বোধ আগের চেয়ে জীবন্ত, চিন্তা তার নাগাল পাচ্ছিল না। 

ইতিমধ্যেই আঁধার হয়ে আসা আকাশে দুটো তারা ফুটেছে, বারান্দা দিয়ে যেতে যেতে সেদিকে চাইতেই হঠাৎ তাঁর মনে হল : আরে হ্যাঁ, আকাশের দিকে তাকিয়ে আমি ভাবছিলাম যে গম্বুজটা আমি দেখছি, সেটা অসত্য নয়। আর তাতে করে কি-একটা যেন আমি পুরো ভাবিনি, কি-একটা যেন লুকিয়ে রাখছিলাম নিজের কাছ থেকে’, ভাবলেন তিনি। ‘তবে সে যাই হোক, আপত্তি করা চলবে না। পুরো ভাবতে পারলেই সব পরিষ্কার হয়ে যাবে।’ 

শিশুকক্ষে ঢুকতেই তাঁর মনে পড়ল নিজের কাছ থেকে কি লুকিয়ে রাখছিলেন তিনি। শুভ আছে তাঁর, এই উন্মোচনটা যদি হয় ঐশী সত্তার প্রধান প্রমাণ, তাহলে কেন সে আবিষ্কার সীমাবদ্ধ থাকছে কেবল উপাসনালয়ে? এই উন্মোচনের সাথে কি সম্পর্ক থাকছে অন্যান্য ধর্মবিশ্বাসের? তারাও তো শুভের প্রচার, শুভকর্ম আচরণ করে থাকে? 

তাঁর মনে হল, এ প্রশ্নের উত্তর তাঁর আছে; কিন্তু নিজের কাছে সেটা প্রকাশ করতে পারার আগেই এসে গেলেন শিশুকক্ষে। 

আস্তিন গুটিয়ে কিটি দাঁড়িয়ে ছিল টবের কাছে, তাতে শিশুটিকে ধোয়াচ্ছিল। স্বামীর পায়ের আওয়াজ শুনে তাঁর দিকে মুখ ফিরিয়ে হেসে সে তাঁকে কাছে ডাকল। একটা হাতে সে চিৎ হয়ে ভাসন্ত হৃষ্টপুষ্ট ছটফটে-পা ছেলের মাথার তলে ঠেকা দিয়ে রেখেছিল, অন্য হাতটা দিয়ে পেশী টান করে স্পঞ্জ চেপে সমানে পানি ছিটিয়ে যাচ্ছিল তার ওপর। স্বামী কাছে আসতে কিটি বলল, ‘দ্যাখো, দ্যাখো! আগাফিয়া মিখাইলোভনা ঠিকই বলেছিলেন। চিনতে পারছে।’ ব্যাপারটা দাঁড়িয়েছিল এই যে, সেই দিন থেকেই মিতিয়া স্পষ্টতই তা আপনজনদের সবাইকে চিনতে পারছিল নিঃসন্দেহেই। লেভিন টবের কাছে যেতেই একটা পরীক্ষা দেখানো হল তাঁকে, ভালোই উত্তাল সেটা। এর জন্য বিশেষ করে ডেকে আনা হয়েছিল রাঁধুনিকে, ঝুঁকে পড়ল সে শিশুর ওপর। শিশু চোখ কোঁচকাল, মাথা নাড়লে আপত্তি জানিয়ে এবার কিটি ঝুঁকে এল, হাসিতে জ্বলজ্বল করে উঠল শিশু, দুই হাতে স্পঞ্জ চেপে ধরে ঠোঁট দিয়ে আত্মতৃপ্ত বিচিত্র সেই পতপত শব্দটা করতে লাগল যাতে শুধু কিটি আর আয়াকে নয়, লেভিনকেও পেয়ে বসত প্রত্যাশিত একটা উচ্ছ্বাস। 

এক হাতে শিশুকে টব থেকে তুলে, পানি ঢেলে, তোয়ালে জড়িয়ে, গা মুছে শিশুর তীক্ষ্ণ চিৎকারের পর তাকে দেওয়া হল মায়ের কোলে। 

‘ভারি আনন্দ হচ্ছে যে ওকে তুমি ভালোবাসতে শুরু করেছ’, ছেলেকে বুকে করে শান্তভাবে তার অভ্যস্ত জায়গাটিতে বসে কিটি বলল, ‘খুবই আনন্দ হচ্ছে। আমার তো দুঃখ হতে শুরু করেছিল। তুমি বলেছিলে যে, ওর জন্যে তোমার টান নেই।’ 

‘উহুঁ, টান নেই বলেছিলাম কি? আমি শুধু বলেছিলাম যে হতাশ হয়েছি।’ 

‘সে কি, ওর জন্যে হতাশা নয়, হতাশাটা নিজের স্নেহে; আমি আশা করেছিলাম আরো বেশি। আশা করেছিলাম, চমকে মত আমার মধ্যে নামবে নতুন একটা সুখানুভূতি। আর তার বদলে বিতৃষ্ণা, অনুকল্পা…’ 

মিতিয়াকে চান করাবার জন্য যে আংটিগুলি কিটি খুলে রেখেছিল, সরু সরু আঙুলে তা পরতে পরতে শিশুর মাথার ওপর দয়ে মনোযোগ সহকারে লেভিনের কথা শুনছিল কিটি। 

‘আর আসল কথা, তৃপ্তির বদলে ভয় আর করুণা অনুভব করতাম বেশি। আজ বজ্রঝঞ্ঝার সময় যে আতংক হয়েছিল তাতে বুঝলাম কত ভালোবাসি ওকে।’ 

কিটি হাসিতে উজ্জ্বল হয়ে উঠে বলল, ‘আর তুমি খুব ভয় পেয়ে গিয়েছিলে, না? আমিও। কিন্তু যেটা ঘটে গেছে, সেটা আমার কাছে এখন বেশি ভয়াবহ। আমি গিয়ে ওক গাছটা দেখে আসব। কি মিষ্টি লোক কাতাভাসোভ! হ্যাঁ, মোটের ওপর সারা দিনটা ভারি ভালো কাটল। আর ইচ্ছে করলে তুমিও কর্নিশেভের সাথে বেশ মানিয়ে নিতে পারো…নাও, এখন যাও। গোসলের পর জায়গাটা সব সময়ই গরম থাকে, ভাপ ওঠে… ‘ 

উনিশ 

লেভিন শিশুকক্ষ থেকে বেরিয়ে থামলেন। একা হতেই তাঁর ভাবনাটায় যে কি-একটা অস্পষ্টতা ছিল, সেটা তাঁর মনে পড়ে গেল। কার যেন কণ্ঠস্বর ভেসে আসছিল ড্রয়িং-রুম থেকে, কিন্তু তিনি সেখানে না গিয়ে থামলেন বারান্দায়, রেলিঙে কনুই ভর দিয়ে আকাশ দেখতে লাগলেন। 

একেবারে অন্ধকার হয়ে এসেছে এখন। আর দক্ষিণে, যেদিকে তিনি তাকিয়ে ছিলেন সেখানে মেঘ ছিল না। মেঘ ছিল বিপরীতি দিকে। সেখান থেকে ঝলসে উঠছিল বিদ্যুৎ, শোনা যাচ্ছিল দূরের মেঘগর্জন। লেভিন কান পেতে শুনছিলেন লিন্ডেন গাছের পাতা থেকে ফোঁটায় ফোঁটায় পানি ঝরার শব্দ। দেখছিলেন নক্ষত্রের পরিচিত ত্রিভুজ আর তার মাঝখান দিয়ে চলে যাওয়া পল্লবিত ছায়াপথ। বিদ্যুতের প্রতিটি ঝলকে শুধু ছায়াপথ নয়, জ্বলজ্বলে নক্ষত্রগুলোও অদৃশ্য হচ্ছিল। কিন্তু বিদ্যুৎ মিলিয়ে যেতেই আবার স্বস্থানে দেখা যাচ্ছিল তাদের, যেন কেউ তাদের ছুঁড়ে দিয়েছে নির্ভুল লক্ষ্যে। 

লেভিন নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কিন্তু কি আমাকে জ্বালাচ্ছে?’ যদিও আগে থেকেই তিনি টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর সংশয়ের নিরসন হয়ে আছে তাঁর প্রাণের মধ্যেই, যদিও তখনো তাঁর জানা নেই—সেটা ঠিক কি। 

‘… নিজেকে তিনি সেই প্রশ্নই করলেন যেটা তাঁর কাছে মনে বিপজ্জনক হচ্ছিল; কোটি কোটি এসব লোক সত্যিই কি সেই পরম আশীর্বাদ থেকে বঞ্চিত যা ছাড়া জীবন অর্থহীন?’ একটু ভাবলেন তিনি, কিন্তু তখনই নিজেকে সংশোধন করে নিলেন। কিন্তু কি আমার প্রশ্ন?’ তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, ঐশী সত্তার সাথে গোটা মানবজাতির নানাবিধ ধর্মবিশ্বাসের সম্পর্ক, হরেক রকম ঝাপসা ছোপ নিয়ে গোটা বিশ্বের কাছে সৃষ্টিকর্তার সাধারণ আবির্ভাব। কিন্তু আমি কি করছি? ব্যক্তিগতভাবে আমার কাছে, আমার হৃদয়ের কাছে নিঃসন্দেহে উদ্‌ঘাটিত হয়েছে—এমন জ্ঞান যা যুক্তির অনধিগম্য, অথচ একরোখার মত সে জ্ঞানটাকে আমি যুক্তি আর কথা দিয়ে প্রকাশ করতে চাইছি। 

বার্চ গাছের সর্বোচ্চ শাখায় সরে এসেছে যে উজ্জ্বল তারাটা তার দিকে তাকিয়ে তিনি নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আমি কি জানি না যে নক্ষত্রেরা চলিষ্ণু নয়? কিন্তু তারার গতি লক্ষ্য করতে গিয়ে পৃথিবীর ঘূর্ণন আমি কল্পনা করতে পারি না। তাই তারারা চলছে বলে ঠিকই বলছি আমি। 

‘জ্যোতির্বিদরা যদি পৃথিবীর সমস্ত জটিল ও বহুবিচিত্র গতিগুলোকে নেয়, তাহলে কিছু তারা বুঝতে, হিসেব কষতে পারবে কি? জ্যোতিষ্কগুলির দূরত্ব, ভার, গতি ও অস্থিরতা নিয়ে তাদের বিস্ময়কর সব সিদ্ধান্ত তো শুধু নিশ্চল পৃথিবীকে ঘিরে দৃশ্যগোচর গ্রহ-তারার গতির ভিত্তিতে, সেই গতি যা আমি এখন আমার সামনে লক্ষ করছি। যুগ যুগ ধরে কোটি কোটি লোকের কাছে যা সব সময় ছিল এবং থাকবে একই, আর তা যাচাই করা যায়। এবং একই মধ্যরেখা আর একই দিগন্তকে ধরে দৃষ্টিগোচর আকাশকে পরিদর্শন না করলে জ্যোতির্বিদের সিদ্ধান্ত যেমন অসিদ্ধ আর টলমলে হবে, ঠিক তেমনি শুভের যে বোধ সকলের কাছে সব সময় ছিল ও থাকবে একই, যা ধর্ম আমার কাছে উদ্ঘাটিত করেছে এবং প্রাণের মধ্যে সব সময়ই যা যাচাই করা চলবে, তার ভিত্তিতে না হলে আমার সমস্ত সিদ্ধান্তও হবে সমান অসিদ্ধ আর টলমলে। আর ঐশী সত্তার সাথে অন্য ধর্মবিশ্বাসীদের যে সম্পর্ক, আমার সে প্রশ্ন সমাধানের অধিকার ও সম্ভাবনা নেই।’ 

হঠাৎ কিটির কণ্ঠ শোনা গেল, ‘সে কি, তুমি যাওনি?’ একই পথে সে যাচ্ছিল ড্রয়িং-রুমের দিকে, ‘কোন কিছুতে বিচলিত হয়েছ নাকি?’ কিটি তারার আলোয় মন দিয়ে লেভিনের মুখ দেখার চেষ্টা করল। যদি ঠিক সেই মুহূর্তে আবার বিদ্যুৎ ঝলক তারাদের মিলিয়ে দিয়ে আলোকিত করে না তুলত তাঁর মুখ—তাহলেও দেখা সম্ভব হত না। বিদ্যুতের আলোয় তাঁর সমস্ত মুখখানা দেখতে পেল কিটি আর লেভিন যে সৌম্য, প্রসন্ন, তা লক্ষ করে তাঁর উদ্দেশে হাসল। 

লেভিনের মনে হল : ‘ও বুঝতে পারছে, ও জানে কি আমি ভাবছি। ওকে কি বলব, নাকি বলব না? উঁহু, বলব।’ কিন্তু যে মুহূর্তে তিনি বলতে যাচ্ছিলেন, তখন কিটিও কথা বলে উঠল। বলল, ‘শোন কস্তিয়া! আমার একটা উপকার কর। কোণের ঘরটায় গিয়ে দেখো গিয়ে, কজ্‌নিশেভের থাকার ব্যবস্থাটা কেমন হল। আমার পক্ষে অসুবিধা। নতুন ওয়াশ-স্ট্যান্ড দিয়েছে?’ 

লেভিন কিটিকে চুমু খেয়ে খাড়া হয়ে বললেন, ‘বেশ, অবশ্যই যাব।’ 

কিটি তাঁর আগে আগে চলে গেলে লেভিন ভাবলেন : ‘না, দরকার নেই বলার। এটা একটা গোপন রহস্য। কেবল আমারই তা দরকার। কেবল আমার কাছেই তা গুরুত্বপূর্ণ, যা কেবল কথায় প্রকাশ করা যায় না।’

‘আমাকে নতুন এই ভাবাবেগটা পালটে দেয়নি, সুখী করে তোলেনি। আমাকে হঠাৎ জ্ঞান দেয়নি, যা আমার পুত্রস্নেহের ব্যাপারে আমি কল্পনা করেছিলাম। কোন হঠাৎ চমক কিছু হয়নি কিন্তু এই সৃষ্টিকর্তা বিশ্বাস, না বিশ্বাস নয়, জানি না কি এটা, কিন্তু যন্ত্রণার মধ্য দিয়ে অলক্ষ্যে এসে গিয়ে দৃঢ়ভাবে তা আমার আত্মায় গাঁথা হয়ে গেছে। 

‘কোচোয়ান ইভানের ওপর একই রকম রেগে উঠব। একই রকম তর্ক করে যাব, নিজের ভাবনা বলে বসব খাপছাড়াভাবে। আমার প্রাণের কাছে যা পবিত্রাধিক পবিত্র এবং অন্য লোক, এমন কি স্ত্রী—একই রকম দেয়াল থেকে যাবে তাদের মাঝখানে, নিজের ভীতির জন্যে একই রকম দোষ ধরব কিটির আর অনুতাপ করব তার জন্যে। আমি কেন প্রার্থনা করছি যুক্তি দিয়ে সেটা একই রকম না বুঝেও প্রার্থনা করে যাব। কিন্তু এখন থেকে আমার জীবন, আমার পুরো জীবন, আমার যাই ঘটুক তা নির্বিশেষে, তার প্রতিটি মিনিট শুধু আগের মত আর অর্থহীন থাকবে না, তাতে শুভের সন্দেহাতীত একটা বোধ থাকবে,—যা সঞ্চারিত করতে পারি একমাত্র আমিই!’ 

***

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *