পাঁচ
তার একটা হল ‘মরামাটিতে রাজা লিয়ার’ নামে একটি উদ্ভট সঙ্গীত। অন্যটি বাখ স্মরণে একটি কোয়ার্টেট। দুটো জিনিসই নতুন, পরিবেশিত ও হয়েছিল নতুন প্রেরণায়, লেভিনের ইচ্ছে হল এদের সম্পর্কে নিজের একটা অভিমত খাড়া করেন। শ্যালিকাকে তাঁর আসনে এগিয়ে দিয়ে তিনি দাঁড়ালেন একটা থামের কাছে, স্থির করলেন যথাসম্ভব মন দিয়ে সততার সাথে শুনবেন। মন বিক্ষিপ্ত হতে না দিতে, সাদা টাই পরা কন্ডাক্টরের হাতে আন্দোলন না দেখতে যা সব সময়ই বিছ্ছিরি ভাবে সঙ্গীত থেকে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করে, টুপি পরিহিত যে মহিলারা কনসার্টের জন্য সযত্নে রিবন ঝুলিয়ে কান ঢেকেছেন তাঁদের দিকে না চাইতে, এই যেসব লোক হয় কিছুতেই আকৃষ্ট নন, নয় শুধু সঙ্গীত ছাড়া আরো নানান বিষয়ে আকৃষ্ট তাঁদের দিকে দৃষ্টিপাত না করতে যাতে মেজাজ মাটি না হয়ে যায় তার চেষ্টা করছিলেন লেভিন। সঙ্গীতের সমঝদার বাক্যবিলাসী ব্যক্তিদের এড়াতে চাইছিলেন তিনি, দাঁড়িয়ে রইলেন সামনে নিচের দিকে তাকিয়ে আর শুনছিলেন।
কিন্তু যত তিনি ‘রাজা লিয়ার’ শুনতে লাগলেন ততএসবনির্দিষ্ট একটা অভিমত খাড়া করার সম্ভাবনা থেকে বহু দূরে চলে যাচ্ছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর। অবিরাম শুরু হচ্ছিল যেন আবেগের সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তি রূপে নিতে চলেছে, আর তখনই তা ভেঙে পড়ছিল নতুন সূত্রপাতের টুকরোয় আর মাঝে মাঝে অসংলগ্ন কিন্তু অসাধারণ জটিল ধ্বনিতে সুরকারের খামখেয়াল ছাড়া আর কিছুর সাথেই যেগুলির যোগ ছিল না। কিন্তু সাঙ্গীতিক অভিব্যক্তির এই যে টুকরো মাঝে মাঝে ভালোই হতে পরত তা বিছ্ছিরি লাগছিল, কারণ তা আসছিল কোনরকম প্রস্তুতি ছাড়াই, একেবারে হঠাৎ করে। আনন্দ, বিষাদ, হতাশা, মাধুর্য আর গাম্ভীর্যের উদয় হচ্ছিল কোনরকম যোগাযোগ ছাড়াই, যেমন ঘটে উন্মাদদের ক্ষেত্রে। আর ঠিক উন্মাদদের যা হয়, আবেগগুলো বিলুপ্তও হচ্ছিল হঠাৎ।
পরিবেশনের সমস্ত সময়টা লেভিনের নিজেকে মনে হচ্ছিল এক বধির যে নৃত্য দেখছে। কনসার্ট শেষ হতে একেবারে বিহ্বল হয়ে পড়েন লেভিন, মনোযোগের যে চাপটা পুরস্কৃত হল না কোন কিছু দিয়ে তাতে ক্লান্তি লাগছিল তাঁর। তুমুল করতালি শোনা গেল চারদিক থেকে। সবাই উঠে দাঁড়াল, যাতায়াত শুরু করল, কথা বলতে লাগল। অন্যদের কেমন লাগল তা জেনে নিজের বিহ্বলতাটা সাফ করে নেবেন বলে তিনি সমঝদারদের খোঁজে হাঁটাহাঁটি শুরু করলেন আর তাঁর পরিচিত পেসোভের সাথে একজন নামজাদা সমঝদারকে কথা বলতে দেখে খুশি হলেন।
জলদগম্ভীর স্বরে অভিবাদন জানিয়ে পেস্তসোভ বলছিলেন, ‘আশ্চর্য! কনস্তান্তিন দুদ্মিত্রিচ। বিশেষ করে যে জায়গাটায় কর্ডেলিয়ার আগমন অনুভূত হচ্ছিল, যেখানে নারী শাশ্বত নারীত্ব ভাগ্যের সাথে লড়াই শুরু করছে, তা পরিবেশিত হয়েছে চিত্রময়তায়, বলা যায় ভাস্কর্যের মত, বর্ণবহুলতায়। তাই না?’
‘এখানে কর্ডেলিয়া এল কোথা থেকে?’ অদ্ভুত সঙ্গীতটায় যে ‘মরামাটিতে রাজা লিয়ার’কে দেখানো হয়েছে সেটা সম্পূর্ণ ভুলে গিয়ে ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘কর্ডেলিয়ার আগমন… এই যে!’ হাতে ধরা চকচকে বিজ্ঞাপনটায় আঙুল দিয়ে টোকা মেরে এবং লেভিনকে সেটা দিয়ে বললেন পেস্তসোভ।
কেবল তখনই লেভিনের স্মরণ হল সঙ্গীতটার নাম কি, তাড়াতাড়ি করে পড়তে লাগলেন বিজ্ঞাপনের উলটো পিঠে মুদ্রিত রুশ অনুবাদে শেক্সপীয়রের কবিতা।
‘এটা ছাড়া সঙ্গীত বোঝা যাবে না’, লেভিনকে উদ্দেশ করে বললেন পেস্তসোভ, কেননা যাঁর সাথে আলাপ করছিলেন তিনি চলে যান, ফলে কথা বলবার মত লোক কেউ ছিল না।
বিরামের সময় লেভিন আর পেস্তুসোভের মধ্যে তর্ক বাঁধল সঙ্গীতে ভাগনার ধারার উৎকর্ষ ও অপকর্ষ নিয়ে। লেভিন দেখাতে চাইলেন যে ভাগনার ও তাঁর অনুগামীদের ভূলটা এই যে তাঁদের সঙ্গীত অন্য শিল্পকলার ক্ষেত্রে চড়াও হতে চায়, যেভাবে কবিতা ভুল করে যখন তা কোন মুখের আদল ফোটাতে চায় যেটা চিত্রকলার কাজ, আর এই ধরনের ভুলের দৃষ্টান্ত হিসেবে তিনি একজন ভাস্করের নাম করলেন যিনি জনৈক কবিমূর্তির বেদীর চারপাশে কাব্য প্রতিমাগুলির ছায়া খোদাই করে বসে। ‘ভাস্করের এই ছায়াগুলো এত কম ছায়া যে সেগুলো টিকে আছে মই ধরে’, লেভিন বললেন। কথাটা তাঁর মনে ধরেছিল কিন্তু তাঁর স্মরণ হল না এটা তিনি আগে বলেছিলেন কিনা এবং এই পেস্তসোভকেই, আর তাই কথাটা বলেছেন বলে অস্বস্তি হল তাঁর।
পেস্তসোভ প্রমাণ করতে চাইছিলেন যে শিল্প একটাই আর তার সমুচ্চ প্রকাশ সম্ভব কেবল অন্য সমস্ত ধরনের শিল্পের সাথে যোগাযোগে।
দ্বিতীয় অনুষ্ঠানটা লেভিন শুনতেই পেলেন না। পেস্তসোভ তাঁর পাশে দাঁড়িয়ে অনবরত বকবক করে গেলেন, অনুষ্ঠানটির সমালোচনা করলেন তার মাত্রাতিরিক্ত, অতিমধুর, কপট সহজতার জন্য এবং এ সরল-তাকে তিনি তুলনা করলেন প্রাক্-রাফায়েলী চিত্রকলার সাথে। বেরিয়ে যাবার সময় আরো অনেক পরিচিতের সাথে দেখা হল লেভিনের, রাজনীতি সঙ্গীত এবং অন্যান্য পরিচিতদের নিয়ে কথা বললেন তিনি। এর ভেতর সাক্ষাৎ হয়ে গেল কাউন্ট বলের সাথে, তাঁর ওখানে যাবার কথা তিনি একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন।
তিনি কথাটা ভভাকে বলতে পরামর্শ দিলেন, ‘তাহলে এখনই চলে যান, হয়ত লোকের সাথে দেখা নাও করতে পারেন। তারপর আমাকে নিয়ে যাবার জন্যে আসবেন সভায়। এখনো সময় আছে।’
ছয়
লেভিন কাউন্টেস বলের বাড়ির প্রবেশ-কক্ষে ঢুকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘আজ হয়ত লোকের সাথে দেখা করছেন না ওঁরা?’
হল-পোর্টার দৃঢ়ভাবে লেভিনের ওভারকোট খুলে বলল, ‘দেখা করবেন বৈকি, দিন।
‘কি দুঃখের কথা’, নিঃশ্বাস ফেলে এক হাতের দস্তানা খুলে টুপি ঠিক করতে করতে ভাবলেন লেভিন, ‘কিন্তু কেন আমি যাচ্ছি? ওঁদের সাথে কি কথা বলার আছে আমার?’
প্রথম ড্রয়িং-রুম দিয়ে যাবার সময় দোরগোড়ায় দেখা হয়ে গেল কাউন্টেস বলের সাথে, উদ্বিগ্ন ও কঠোর মুখে চাকরকে কি যেন একটা হুকুম করছিলেন তিনি। লেভিনকে দেখে তিনি হাসলেন, তাঁকে নিয়ে গেলেন পাশের ছোট ড্রয়িং-রুমটায়, গলার আওয়াজ শোনা যাচ্ছিল যেখান থেকে। এখানে ইজি-চেয়ারে বসেছিলেন কাউন্টেসের দুই কন্যা আর লেভিনের পরিচিত এক মস্কো কর্নেল। তাঁদের কাছে গিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করে লেভিন বসলেন সোফায়, টুপিটা ধরে রাখলেন হাঁটুর উপর
‘আপনার স্ত্রী কেমন আছেন? আপনি কনসার্টে গিয়েছিলেন? আমরা যেতে পারলাম না। মাকে যেতে হয় অন্ত্যেষ্টিক্রিয়ায়।’
লেভিন বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি শুনেছি…কি অপ্রত্যাশিত মৃত্যু।‘
কাউন্টেস এসে বসলেন সোফায়, তিনিও তাঁর স্ত্রীর খবর আর কনসার্টের কথা জিজ্ঞেস করলেন।
লেভিন জবাব দিয়ে আপ্রাসিনার অকালমৃত্যু নিয়ে তাঁর উক্তিটার পুনরাবৃত্তি করলেন।
‘তবে স্বাস্থ্য ওঁর খারাপ ছিল বরাবরই।’
‘আপনি গতকাল অপেরায় গিয়েছিলেন?’
‘গিয়েছিলাম।’
‘চমৎকার গেয়েছেন লুক্কা। ‘
‘হ্যাঁ, খুবই চমৎকার’, লেভিন বললেন এবং তাঁর সম্পর্কে কে কি ভাবছে তাতে তাঁর কিছুই এসে যায় না বরে গায়িকার বৈশিষ্ট্য সম্পর্কে শতবার যেসব কথা শুনেছেন তাই আওড়াতে লাগলেন। কাউন্টেস বল্ বান করলেন যেন শুনছেন। তারপর তিউরিনের প্রস্তাবিত পাগলা দিন-এর কথা তুলে হো-হো করে হেসে উঠে দাঁড়ালেন তিনি। হৈহৈ করে চলে গেলেন। লেভিনও উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু কাউন্টেসের মুখ দেখে টের পেলেন এখনো তাঁর সময় হয়নি যাবার। আরো মিনিট দুয়েক তাঁর থাকা দরকার। বসলেন।
কিন্তু যেহেতু তিনি সব সময় ভাবছিলেন এগুলো কি আহাম্মকি, তাই কথোপকথনের বিষয়বস্তু খুঁজে না পেয়ে চুপ করে রইলেন।
‘আপনি জনসভায় যাচ্ছেন না? শুনেছি খুব আকর্ষণীয় হবে’, কাউন্টেস শুরু করলেন।
লেভিন বললেন, ‘না, আমি আমার শ্যালিকাকে কথা দিয়েছি তাঁকে নিয়ে আসব ওখান থেকে।’
নীরবতা নামল। মা-মেয়েরা আরেকবার মুখ চাওয়া-চাওয়ি করলেন।
‘মনে হয় এবার সময় হয়েছে’, এই ভেবে লেভিন উঠে দাঁড়ালেন। মহিলারা করমর্দন করলেন তাঁর, অনুরোধ করলেন স্ত্রীকে যেন তাঁদের পক্ষ থেকে জানানো হয় হাজারো অভিবাদন।
হল-পোর্টার তাঁকে কোট পরাতে পরাতে জিজ্ঞেস করল : ‘আপনার ঠিকানাটা বলবেন কি?’ তখনই একটা বড়, চমৎকার বাঁধানো খাতায় তা টুকে রাখল।
‘বলাই বাহুল্য আমার এতে কিছু এসে যায় না, তাহলেও লজ্জাকর এবং আহাম্মকি’, ভাবছিলেন লেভিন। সবাই এটা করে বলে নিজেকে প্রবোধ দিয়ে চলে গেলেন কমিটির জনসভায়, যেখান থেকে শ্যালিকাকে নিয়ে একসাথে বাড়ি ফেরার কথা।
কমিটির জনসভায় লোক হয়েছিল প্রচুর, প্রায় গোটা সমাজ। লেভিন যখন পৌঁছলেন তখন সমীক্ষা চলছিল, সবাই বরলে সেটা খুবই চিত্তাকর্ষক। সমীক্ষা পাঠ শেষ হলে সমাজ ছড়িয়ে পড়ল এবং সিআঙ্কি আর অব্লোন্স্কি, উভয়ের সাথেই দেখা হল লেভিনের। প্রথম জন তাঁকে অবশ্য-অবশ্যই আসতে বললেন সেই সন্ধ্যায় কৃষি সমিতির অধিবেশনে যেখানে চমৎকার প্রতিবেদন পাঠ হবে, দ্বিতীয় জন সবেমাত্র এলেন রেস থেকে। দেখা হল হল অন্যান্য পরিচিতদের সাথেও, এবং জনসভা, নতুন নাটক আর মামলা নিয়ে লেভিন নিজেও বললেন, অন্যদেরও মতামত শুনলেন। কিন্তু মামলা নিয়ে আলোচনার সময় মনোযোগের যে ক্লান্তি তিনি বোধ করতে মুরু করেছিলেন, সম্ভবত তারই ফলে তিনি একটা ভুল করে বসেন এবং পরে সেই ভুলের জন্য মনে মনে বারকয়েক নিজের ওপর রাগ হয়েছিল তাঁর রাশিয়ায় বিচারাধীন জতনৈক বিদেশীর আসন্ন শাস্তি এবং রাশিয়া থেকে বহিষ্কার করে শাস্তি দেওয়াটা যে সঠিক নয়, এই বিষয়ে বলতে গিয়ে লেভিন গতকাল তাঁর বন্ধুর সাথে কথোপকথনে যা শুনেছিলেন তারই পুনরাবৃত্তি করেন।
লেভিন বললেন, ‘আমি মনে করি ওকে সীমান্তের বাইরে বিতাড়িত করা আর পাইক মাছকে পানিতে ভাগিয়ে দিয়ে শাস্তি দেওয়া একই কথা।’ পরে তাঁর মনে পড়েছিল বন্ধুর কাছ থেকে শোনা এবং যেন-বা তাঁর নিজের বলে চালিয়ে দেওয়া এই কথাটা ক্রিলভের নীতিকাহিনী থেকে নেওয়া, সংবাদপত্রের একটি রসরচনা পড়ে বন্ধু সেটার পুনরাবৃত্তি করেছিলেন।
লেভিন শ্যালিকাকে নিয়ে বাড়ি পৌঁছে দেখলেন কিটি সুস্থ, মেজাজও ভালো। তাই তিনি ক্লাবে চলে গেলেন।
সাত
লেভিন ঠিক সময়েই ক্লাবে পৌঁছলেন। তখনই আসছিলেন ক্লাবের সদস্য আর অতিথিরা। লেভিন ক্লাবে আসেননি অনেকদিন, বিশ্ববিদ্যালয় থেকে বেরিয়ে যখন মস্কোয় বাসা পেতেছিলেন, সমাজে যাতায়াত করতেন, তারপর থেকে আর নয়। ক্লাবের কথা মনে আছে তাঁর, খুঁটিনাটিতে তার বাহ্য আকৃতিটাও। কিন্তু আগে ক্লাবে তাঁর কেমন লাগত সেটা তিনি একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। কিন্তু অর্ধবৃত্তাকার অঙ্গনে এসে যেই তিনি ছ্যাকড়া গাড়ি থেকে নেমে ঢুকলেন গাড়ি-বারান্দায় আর কুঁচি দেওয়া উর্দিতে পোর্টার নিঃশব্দে দরজা খুলে দিয়ে অভিবাদন করল তাঁকে; পোর্টারের ঘরে যেই তিনি দেখলেন ক্লাব-সদস্যদের গাদা করা ওভারকোট আর জুতার প্রচ্ছদ যাঁরা ভেবে দেখেছেন যে প্রচ্ছদ পরে ওপরে ওঠার চেয়ে তা এখানেই খুলে রেখে যাওয়ায় খাটুনি কম; যেই তিনি শুনলেন তাঁর আগমন ঘোষণার রহস্যময় ঘণ্টি আর গালিচায় মোড়া সিঁড়ি বেয়ে উঠে দেখলেন সোপান-চত্বরে প্রস্তরমূর্তি আর ওপরের একটা দরজায় তাঁর পরিচিত, ক্লাবের উর্দি পরা, বুড়িয়ে যাওয়া তৃতীয় পোর্টারকে, যে অতিথির দিকে দৃষ্টিপাত করে তাঁর জন্য দরজা খুলতে শশব্যস্তও হল না, গড়িমসিও করল না—অমনি ক্লাবের অনেকদিনকার পুরানো আবেশ আচ্ছন্ন করল লেভিনকে, আরাম, পরিতোষ, সেটা শোভনতার আবেশ।
‘মাপ করবেন, টুপি’, লেভিনকে বলল পোর্টার, টুপি যে তার কাছে রেখে যেতে হয়, ক্লাবের এ নিয়মটা লেভিন ভুলে গিয়েছিলেন; ‘অনেকদিন আসেননি। গতকালই প্রিন্স নাম লিখিয়ে রেখেছেন আপনার। প্রিন্স অব্লোন্স্কি আসেন নি এখনো।’
পোর্টার শুধু লেভিনকে নয়, তাঁর সমস্ত যোগসম্পর্ক, আত্মীয়-স্বজনদেরও জানত আর তাদের কথা পাড়ল তখনই। স্ক্রিন দিয়ে ভাগ করা প্রথম যে প্রবেশ-কক্ষটার ডান দিকের ঘরটায় ফলওয়ালা বসে, সেখানে মন্থরগতি এক বৃদ্ধকে পেছনে ফেলে লেভিন এগিয়ে গেলেন রোকজনে মুখরিত ডাইনং-রুমটায়।
ইতিমধ্যেই প্রায় দখল হয়ে যাওয়া আসনগুলো পেরিয়ে যেতে যেতে তিনি লক্ষ করতে লাগলেন অতিথিদের 1 এখানে-ওখানে চোখে পড়ছিল অতি বিভিন্ন ধরনের সব লোক—কেউ বৃদ্ধ, কেউ যুবক, কেউ নামমাত্র পরিচিত, কেউ ঘনিষ্ঠ। রুষ্ট বা দৃশ্চিন্তাগ্রস্ত মুখ দেখা দিল না একটাও। পোশাক রাখার ঘরে তাঁরা যেন তাঁদের টুপির সাথে সাথে সমস্ত উদ্বেগ উৎকণ্ঠাও রেখে এসেছেন সেখানে, এখন ধীরে-সুস্থে জীবনের পার্থিব আনন্দ উপভোগ করতে চান। সিয়াস্কি, শ্যেরবাৎস্কি, নেভেদোভস্কি, বৃদ্ধ প্রিন্স, ভ্রন্স্কি, কজ্নিশেভও এখানে ছিলেন।
‘আ, দেরি হল যে?’ হেসে বললেন প্রিন্স, কাঁধের ওপর দিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন তাঁর দিকে; কিটি কেমন আছে?’ ওয়েস্ট-কোটের বোতামের ফুটোয় গোঁজা ন্যাপকিনটা ঠিক করে নিয়ে তিনি যোগ দিলেন
‘ভালো আছে। তিনজন ওরা বাড়িতে ডিনার খাচ্ছে।’
‘বটে, বকবকম তাহলে। আমাদের এখানে কিন্তু জায়গা খালি নেই। ওই টেবিলটায় গিয়ে জায়গা দখল করো গে তাড়াতাড়ি’, এই বলে তিনি ঘুরে সাবধানে নিলেন মাছের সুপের প্লেট।
‘লেভিন, এখানে!’ খানিক দূর থেকে ভেসে এল একটা হৃদ্য ডাক। লোকটি তুরোভ্ৎসিন। তিনি বসেছিলেন তরুণ একজন সামরিক অফিসারের সাথে, কাছেই দুটো ওলটানো চেয়ার। আনন্দেই লেভিন গেলেন তাঁদের দিকে। ভালোমানুষ লোচ্চা তুরোভ্ৎসিনকে লেভিনের ভালো লাগত সব সময়ই তাঁর সাথে জড়িয়ে আছে কিটির কাছে প্রেম নিবেদনের স্মৃতি কিন্তু আজ, এত মননশীল আলোচনার চাপের পর তুরোৎসিনের সহৃদয় চেহারা তাঁর খুবই প্রিয় মনে হল।
‘এ চেয়ার দুটো তোমার আর অবলোন্স্কির জন্যে। শিগগিরই ও এসে পড়বে।’
অত্যন্ত সিধে হয়ে বসে থাকা ফুর্তিবাজ যে অফিসারটির চোখ অনবরত হাসছিল, তিনি পিটার্সবুর্গের গাগিন। তুরোভ্ৎসিন পরিচয় করিয়ে দিলেন ওঁদের।
‘অবলোনস্কি বরাবরই দেরি করে।
‘আরে এই তো ও।’
‘এখনই এলে তুমি?’ দ্রুত ওঁদের কাছে এসে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘হ্যাল্লো! ভোদ্কা খেয়েছ? তাহলে চল যাই।’ লেভিন উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর সাথে গেলেন বড় টেবিলটার কাছে যেখানে সাজানো ছিল ভোদ্কা আর অতি বিভিন্ন রকমের চাঁট। মনে হবে বিশ রকমের ডিশগুলো থেকে নিজের রুচি মত কিছু বাছা সম্ভব, কিন্তু অব্লোন্স্কি কি-একটা বিশেষ চাঁটের জন্য জেদ ধরলেন আর যে চাপরাশিগুলি দাঁড়িয়ে ছিল তাদের একজন তখনই নিয়ে এল সেটা। এক- এক পাত্র পান করে তাঁরা নিজেদের টেবিলে ফিরলেন।
মাছের স্যুপের সাথে তখনই এক বোতল শ্যাম্পেনের বরাত দিলেন গাগিন আর সেটা চারটা গ্লাসে ঢালতে বললেন। এগিয়ে দেওয়া পাত্রটায় আপত্তি হল না লেভিনের, নিজেই আরেক বোতল চাইলেন। খিদে পেয়েছিল তাঁর, পানভোজন চালালেন অতি তৃপ্তি সাথে, আরো তৃপ্তির সাথে যোগ দিলেন সহালাপীদের হাসি-খুশি সহজসরল আলাপে। নিচু গলায় গাগিন শোনালেন পিটার্সবুর্গের নতুন একটা চুটকি, আর চুটকিটা অশ্লীল ও নির্বোধ হলেও এতই তা হাস্যকর লাগল যে লেভিন এমন হো-হো করে হেসে উঠলেন যে পাশের টেবিলের লোকেরা তাকালেন তাঁর দিকে।
‘এটা এই গোছের : ‘এটা একেবারে খাশা। আরেক বোতল নিয়ে এসো’, চাপরাশিকে হুকুম করে চুটকি বলতে শুরু করলেন তিনি।
‘পিওত্র ইলিচ ভিনোস্কি পাঠিয়েছেন’, অব্লোন্স্কির চুটকিতে বাধা দিয়ে বৃদ্ধ চাপরাশি সরু সরু দুই গ্লাসে ফেনিল শ্যাম্পেন এনে দিলে অব্লোন্স্কি আর লেভিনের জন্য। অব্লোন্স্কি তাঁর গ্লাস নিয়ে টেবিলের অপর প্রান্তে পাটকিলে রঙের গুম্ফশোভিত টেকো এক ভদ্রলোকের সাথে চোখাচোখি হতে হেসে তাঁর উদ্দেশে মাথা নাড়লেন।
‘কে ইনি?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন
‘ওঁকে তুমি আমার বাড়িতে দেখেছ, মনে নেই? বেশ লোক।’
অব্লোন্স্কি যা করেছিলেন, লেভিনও তাই করে গ্লাস নিলেন।
অব্লোন্স্কির চুটকিটাও হল খুবই মজাদার। লেভিনও বললেন নিজের চুটকি, সেটা অন্যদের ভালো লাগল। তারপর ঘোড়া, এ বছরের রেস, ভ্রন্স্কির ‘সাতিন’ কি উদ্দাম ধাবনে প্রথম পুরস্কার জিতেছে, কথা চলল সেই নিয়ে। লেভিন খেয়ালই করেন নি কখন শেষ হয়ে গেল ডিনার।
‘আরে, এই তো ওরা!’ ডিনারের শেষে চেয়ারে বসেই পিঠের দিকে পেছন ফিরে ভ্রন্স্কি আর একজন ঢ্যাঙা গার্ড কর্নেলের দিকে হাত বাড়িয়ে দিলেন অব্লোন্স্কি। ভ্রন্স্কির মুখেও শোভা পাচ্ছিল ক্লাবের সাধারণ ভালোমানুষি আমোদ। উনি ফুর্তিতে অব্লোন্স্কির কাঁধে কনুই রেখে ফিসফিসিয়ে কি যেন বললেন তাঁকে আর সমান সানন্দ হাসি নিয়ে হাত বাড়িয়ে দিলেন লেভিনের দিকে।
‘দেখা হয়ে ভারি আন্দ হল’, বললেন ভ্রন্স্কি; ‘নির্বাচনে আমি তখন আপনার খোঁজ করেছিলাম, কিন্তু শুনলাম আপনি আগেই চলে গেছেন’, লেভিনকে বললেন তিনি।
‘হ্যাঁ, আমি ওই দিনই চলে যাই। এইমাত্র আপনার ঘোড়া নিয়ে কথা হচ্ছিল এখানে। অভিনন্দন আপননাকে’, লেভিন বললেন, ‘খুবই জবর দৌড়।’
‘আপনারও তোর ঘোড়া আছে।’
‘না, আমার পিতার ছিল, তবে আমার মনে আছে, কিছু জানি ও ব্যাপারে।’
‘কোথায় ডিনার সারলে তুমি?’ জিজ্ঞেস করলেন অব্লোন্স্কি। ‘থামগুলোর পেছনে দ্বিতীয় টেবিলটায়।’
‘একটু উৎসব ছিল আমাদের’, বললেন ঢ্যাঙা কর্নেল, ‘দ্বিতীয়বার বাদশাহী পুরস্কার, ঘোড়ায় ওর যেমন কপাল, তাসে আমার তেমনি হলে হত।’
‘কিন্তু সময় সোনা, খুইয়ে কি লাভ। আমি চললাম জাহান্নামে’, বলে কর্নেল টেবিল ছেড়ে গেলেন।
‘ইনি ইয়াভিন’, তুরোভ্ৎসিনকের বললেন ভ্রন্স্কি এবং কাছেই খালি হয়ে যাওয়া একটা চেয়ারে বসলেন। এগিয়ে দেওয়া পাত্রটা শেষ করে তিনি আরেক বোতলের বরাত দিলেন। ক্লাবের পরিবেশে নাকি মদ্যপানের প্রভাবে লেভিন ভ্রন্স্কির সাথে কথা বললেন সেরা জাতের গরু নিয়ে এবং তাঁর প্রতি কোন বিদ্বেষ বোধ করছেন না দেখে খুশি হলেন। এমন কি এ কথাও তিনি বললেন যে স্ত্রীর কাছে তিনি শুনেছেন যে ওঁদের দেখা হয়েছিল প্রিন্সেস মারিয়া বরিসভনার ওখানে।
‘ও, প্রিন্সেস মারিয়া বরিসভনা—অনন্যসাধারণ।’ বলে অব্লোন্স্কি তাঁর সম্পর্কে এমন একটা চুটকি ফাঁদলেন যা সবাইকেই হাসাল। বিশেষ করে ভ্রন্স্কি এমন প্রাণখোলা হাসি হাসলেন যে লেভিন অনুভব করলেন যে তাঁর একেবারে মিটমাট হয়ে গেছে ওঁর সাথে।
অব্লোন্স্কি উঠে দাঁড়িয়ে হেসে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি, শেষ হয়েছে? তাহলে যাওয়া যাক!’
আট
টেবিল থেকে উঠে হাঁটতে গিয়ে লেভিন টের পেলেন যে তাঁর বাহুর দুলুনি হয়ে উঠেছে অসাধারণ সঠিক আর লঘু। গাগিনের সাথে উঁচু উঁচু ঘরের মধ্যে দিয়ে তিনি যাচ্ছিলেন বিলিয়ার্ড-রুমে। উঁচু হলটা পেরিয়ে যাবার সময় শ্বশুরের সাথে দেখা হল।
‘কি, আমাদের প্রমোদভবন কেমন লাগল তোমার?’ লেভিনের হাতটা টেনে নিয়ে বললেন তিনি, ‘চল, হাঁটা যাক।’
‘আমিও তাই চাইছিলাম—হাঁটতে আর এটা-ওটা দেখতে। বেশ ভালো লাগবে।’
‘তোমার ভালো লাগবে। কিন্তু আমার আগ্রহ অন্য জিনিসে। ওই বৃদ্ধটিকে দেখছ তো’, একেবারে কুঁজো হয়ে যাওয়া, নিচের ঠোঁট ঝুলে পড়া, নরম বুট পরা কোনরকমে ঘষটে ঘষটে যে বৃদ্ধটি তাঁদের দিকে আসছিলেন তাঁকে দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘ভাবছ উনি ঐ রকম সাতখাজা হয়েই জন্মেছিলেন।’
‘সাতখাজা মানে?’
‘আ, কথাটা ও দেখছি তুমি জানো না। ওটা আমাদের ক্লাবের লবজ। ইস্টার পরবের ডিম জানো তো গড়ানো হয়, কিন্তু ডিম বেশি গড়ালে তা ভেঙে গিয়ে হয়ে পড়ে সাতখাজা। আমাদের বন্ধুও তাই ভায়া, ক্লাবে আসি, আসি, তারপর হয়ে পড়ি সাতখাজা। তুমি হাসছ, কিন্তু আমার বন্ধুটি লক্ষ রেখেছে কখন নিজেই সে সাতখাজা হয়ে পড়বে। প্রিন্স চেচেন্স্কিকে জানে তো?’ শ্বশুর জিজ্ঞেস করলেন আর লেভিন তাঁর মুখ দেখে টের পেলেন যে মজার কিছু-একটা উনি বলতে চাইছেন।
‘না, জানি না।’
‘সে কি! প্রিন্স চেচেস্কিকে সবাই জানে। সে যাক গে। তা সব সময়ই বিলিয়ার্ড খেলেন উনি। তিন বছর আগেও তিনি সাতখাজা হননি, বড়াই করতেন, আর নিজে অন্যদের বলতেন সাতখাজা। একবার তিনি এলেন আর আমাদের পোর্টার…চেনো তো ভাসিলিকে? ওই যে মুটকো। ভারি ফাজিল। তা প্রিন্স চেচেস্কি ওকে জিজ্ঞেস করলেন : ‘কি ভাসিলি, কে কে এসেছেন? আর সাতখাজারা কেউ আছে?’ ও বলে দিল : ‘আপনি তৃতীয় জন।’ হ্যাঁ ভায়া, এমনি ব্যাপার!’
গল্প চালিয়ে আর পরিচিতদের সাথে দেখা হলে কুশল বিনিময় করে লেভিন আর প্রিন্স সমস্ত ঘরগুলোয় চক্কর দিলেন : বড় ঘর যেখানে ইতিমধ্যেই টেবিল পাতা হয়েছে, অল্পস্বল্প বাজিতে খেলছিল অভ্যস্ত খেলোয়াড়রা; সোফার ঘর, যেখানে দাবাখেলা চলছিল আর কজ্নিশেভ বসে কার সাথে যেন কথা বলছিলেন; বিলিয়ার্ড-রুম, যেখানে ঘরের বাঁকে সোফার কাছে শ্যাম্পেন সহযোগে চলছিল আমুদে তাসখেলা, গাগিনও যোগ দিয়েছিলেন তাতে; জাহান্নামেও উঁকি দেওয়া হল, সেখানে ইয়াভিন যে টেবিলটার সামনে বসেছিলেন, তার কাছে ভিড় করেছিল বাজি-ধরা লোকেরা। যথাসম্ভব নিঃশব্দে তাঁরা ঢুকলেন অন্ধকার পাঠকক্ষে; সেখানে শেড দেওয়া বাতির নিচে রুষ্ট মুখে একটি যুবক বসে একের পর এক পত্রিকা উল্টে চলেছেন আর টাক মাথা এক জেনারেল পাঠে নিমগ্ন। সে ঘরটাতেও গেলেন, যাকে প্রিন্স বলতেন মনন-কক্ষ; তিনজন ভদ্রলোক সেখানে সাম্প্রতিক রাজনৈতিক ঘটনা নিয়ে উত্তেজিত আলোচনা করছিলেন।
‘প্রিন্স, সব তৈরি, আসুন’, প্রিন্সকে এখানে পেয়ে বললেন তাঁর তাসের একজন জুড়ি, প্রিন্স চলে গেলেন। লেভিন বসে বসে তর্ক শুনছিলেন, কিন্তু আজ সকালের সমস্ত কথাবার্তা মনে পড়ে যাওয়ায় হঠাৎ সাংঘাতিক বেজার লাগল তাঁর। তাড়াতাড়ি উঠে দাঁড়িয়ে খুঁজতে গেলেন অব্লোন্স্কি আর তুরোৎসিনকে, এঁদের সাহচর্যে তাঁর ফূর্তি লাগে।
তুরোভ্ৎসিন পানপাত্র হাতে বসেছিলেন বিলিয়ার্ড-রুমের উঁচু একটা সোফায় আর ঘরের দূর কোণের দুয়ারের কাছে ভ্রন্স্কির সাথে কি নিয়ে যেন কথা বলছিলেন অব্লোন্স্কি।
‘আন্নার একঘেয়ে লাগছে তা নয়, তবে অবস্থার এই অনির্দিষ্টতা, অনিশ্চয়তা’, লেভিনের কানে আসতেই তাড়াতাড়ি তিনি চলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু অবলোনস্কি ডাকলেন তাঁকে।
‘লেভিন!’ বললেন তিনি আর লেভিন লক্ষ করলেন যে চোখে তাঁর পানি নয়, আর্দ্রতা, যা তাঁর ক্ষেত্রে সব সময় দেখা দেয় যখন তিনি বেশি পান করেন, অথবা যখন তিনি খুবই আলোড়িত। আজ দুটো উপলক্ষই আছে; ‘লেভিন, যেও না’, কনুইয়ের ওপরে বাহুতে সজোরে চেপে ধরলেন তাঁকে, কিছুতেই যেতে দেবেন না বলে।
‘এ আমার অকৃত্রিম, প্রায় সর্বশ্রেষ্ঠ বন্ধত্ব’, ভ্রন্স্কিকে বললেন তিনি, ‘তুমিও আমার ঘনিষ্ঠ এবং প্রিয়। এবং আমি চাই আর জানি যে তোমাদের বন্ধু আর ঘনিষ্ঠ হতে হবে, কেননা দুজনেই তোমরা ভালো লোক।’
‘তাহলে দেখছি চুম্বন বিনিময়টাই শুধু বাকি’, হাত বাড়িয়ে দিয়ে সহৃদয় রহস্যে বললেন ভ্রন্স্কি।
ঝটিতি সে হাত নিয়ে লেভিন সজোরে চাপ দিলেন।
করমর্দন করতে করতে বললেন, ‘অত্যন্ত, অত্যন্ত খুশি হলাম আমি।’
ভ্রন্স্কি বললেন, ‘ওহে, এক বোতল শ্যাম্পেন।’
কিন্তু অব্লোন্স্কির যত ইচ্ছা থাক, এঁদের নিজেদেরও যত ইচ্ছা থাক, পরস্পরকে তাঁদের বলার কথা কিছু ছিল না, আর দুজনেই সেটা টের পাচ্ছিলেন।
‘জানো, আন্নার সাথে ওর পরিচয় নেই?’ ভ্রন্স্কিকে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘আমি ওকে আন্নার কাছে নিয়ে যেতে দৃঢ়প্রতিজ্ঞ। চল লেভিন!’
‘তাই নাকি?’ ভ্রন্স্কি বললেন, ‘ও খুব খুশি হবে।’ তারপর যোগ দিলেন, ‘আমি এখুনি বাড়ি যেতে পারতাম, কিন্তু ইয়াভিনের জন্যে দুশ্চিন্তায় আছি। ও শেষ না করা পর্যন্ত আমি এখানে থাকতে চাই।’
‘তাহলে বিলিয়ার্ড এক দান? খেলবে লেভিন? চমৎকার’, বললেন অব্লোন্স্কি, ‘পিরামিড সাজাও’, মার্কারকে বললেন তিনি।
‘অনেকক্ষণ তৈরি’, মার্কার বলল। বলের পিরামিড অনেক আগে সাজিয়ে সে তখন লাল বলটাকে ঘুরিয়ে ঘুরিয়ে খেলা করছিল।
‘বেশ দাও।’
খেলা শেষ হলে ভ্রন্স্কি আর লেভিন গিয়ে বসলেন গাগিনের টেবিলে আর টেক্কা বাজি রাখার খেলায় অব্লোন্স্কির প্রস্তাবে অংশ নিলেন লেভিন। ভ্রন্স্কি কখনো বসে থাকছিলেন টেবিলেই আর অবিরাম তাঁর কাছে আসছিল পরিচিতরা, কখনো ইয়াভিনের খবর জানার জন্য যাচ্ছিলেন জাহান্নামে। সকালে বুদ্ধিবৃত্তির ক্লান্তির পর উপাদেয় বিশ্রাম উপভোগ করছিলেন লেভিন। ভ্রন্স্কির সাথে শত্রুতার অবসানে আনন্দ হয়েছিল তাঁর, শান্তি শিষ্টতা তৃপ্তির একটা আমেজ তাঁর কাটছিল না।
খেলা শেষ হলে অব্লোন্স্কি লেভিনের হাত ধরলেন।
‘তাহলে চল যাই আন্নার কাছে। এখনই? অ্যাঁ? সে বাড়ি আছে। আমি ওকে অনেকদিন হল কথা দিয়েছি যে তোমাকে নিয়ে যাব। সন্ধ্যায় কোথায় যাবে ভাবছিলে?’
‘বিশেষ কোথাও নয়। সি্ভ্য়াজ্স্কিকে কথা দিয়েছিলাম যে কৃষি সমিতির অধিবেশনে থাকব। তা বেশ, চলো যাই’, লেভিন বললেন।
‘চমৎকার, চল তাহলে! দ্যাখো তো, আমার গাড়িটা এল কিনা’, চাপরাশিকে বললেন অব্লোন্স্কি।
লেভিন টেবিলের কাছে গিয়ে টেক্কার খেলায় যে চল্লিশ রুব্ল হেরেছেন তা শোধ দিলেন। দরজার কাছে দণ্ডায়মান বৃদ্ধ চাপরাশির কাছেই রহস্যজনক উপায়ে যা জানা তা ক্লাবের সে বিলও মেটালেন আর প্রচণ্ড হাত দোলাতে দোলাতে সমস্ত হল পাড়ি দিয়ে বহির্দ্বারের কাছে গেলেন।
নয়
পোর্টার রাগত হেঁড়ে গলায় চেঁচাল, ‘অব্লোন্স্কির গাড়ি!’ গাড়ি এসে দাঁড়াল, উঠে বসলেন দুজনে। ক্লাবের ফটক দিয়ে গাড়ি বেরিয়ে যাবার পর শুধু প্রথম কিছুক্ষণই লেভিন ক্লাবের প্রশান্তি, পরিতৃপ্তি আর চারপাশের লোকদের নিঃসন্দেহ শিষ্টতার আমেজটা অনুভব করে যাচ্ছিলেন; কিন্তু যেই গাড়ি রাস্তায় গিয়ে পড়ল আর বন্ধুর রাস্তায় গাড়ির দোলন টের পেলেন, বিপরীত দিক থেকে আসা গাড়ির গাড়োয়ানের ক্রুদ্ধ চিৎকার শুনলেন, দেখলেন অস্পষ্ট আলোয় শুঁড়িখানা আর দোকানের লাল সাইনবোর্ড, আমেজটা কেটে গেল এবং নিজের আচরণ সম্পর্কে ভাবতে লাগলেন, নিজেকে প্রশ্ন করলেন, আন্নার কাছে যে যাচ্ছেন সেটা ভালো হচ্ছে কি? কিটি কি বলবে? কিন্তু অব্লোন্স্কি ওঁকে ভাবতে দিলেন না, যেন তাঁর খুঁতখুঁতি ধরতে পেরে তা কাটিয়ে দিলেন
বললেন, ‘ওকে যে তুমি জানবে, এতে আমি কি খুশিই না হয়েছি। জানো, ডল্লি বহুদিন থেকে এটা চাইছিল। আর ভভও আন্নার ওখানে গেছে এবং যায়। আমার বোন হলেও’, বলে চললেন অব্লোন্স্কি, ‘এ কথা বলার সাহস আমি রাখি যে এ নারী অপূর্ব। এই তো তুমি নিজেই দেখবে। অবস্থা ওর অতি দুঃসহ, বিশেষ করে এখন।’
‘কেন বিশেষ করে এখনই?’
‘স্বামীর সাথে বিবাহবিচ্ছেদ নিয়ে আমাদের কথাবার্তা চলছে। উনি রাজি আছেন। কিন্তু এখানে একটা গণ্ডগোল বাঁধছে ছেলেকে নিয়ে। ফলে এই যে ব্যাপারটা অনেক আগেই চুকে যাওয়ার কথা, তা আজ তিন মাস ধরে ঝুলে রয়েছে। বিবাহবিচ্ছেদ হওয়া মাত্র সে বিয়ে করবে ভ্রন্স্কিকে। কি নির্বোধ এসব প্রাচীন রীতিনীতির জট যাতে কেউ বিশ্বাস করে না, যা শুধু বাগড়া দেয় লোকের সুখে!’ তারপর অব্লোন্স্কি যোগ দিলেন, ‘তখনই ওদের অবস্থাটা হবে সুনির্দিষ্ট, যেমন আমার, যেমন তোমর।’
‘কিন্তু গণ্ডগোলটা কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন। ‘আহ, ওটা একটা দীর্ঘ নীরস বৃত্তান্ত! আমাদের সব কিছুই ভারি অনির্দিষ্ট। কিন্তু ব্যাপারটা হল এই যে আন্না বিবাহবিচ্ছেদের আশায় এখানে, মস্কোয়, সবাই যেখানে ওদের দুজনকে জানে, রয়েছে তিন মাস, কোথাও বেরোয় না, মহিলাদের মধ্যে ডল্লি ছাড়া আর কারো সাথে দেখা করে না, কারণ, বুঝেছ তো, ও চায় না যে কেউ কৃপা করে আসুক ওর কাছে; বুদ্ধিহীনা ঐ যে প্রিন্সেস ভারভারা-সাথে থাকাটা অশোভন হবে দেখে তিনিও চলে গেলেন। এই অবস্থায় অন্য কোন নারীই মনে জোর পেত না। ও কিন্তু, তুমি নিজেই দেখবে, কি চমৎকার গুছিয়ে নিয়েছে নিজের জীবন কি সে শান্ত, কি তার আত্মমর্যাদা। বাঁয়ে গলিতে, গির্জার সামনে!’ গাড়ির জানালা দিয়ে মুখ বাড়িয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন অব্লোন্স্কি, ‘উহ্ কি গরম!’ হিমাংকের নিচে বারো ডিগ্রি সত্ত্বেও এমনিতেই বোতাম-খোলা ফারকোট আরো খুলে তিনি বললেন।
‘ওঁর তো একটি মেয়ে আছে, নিশ্চয় তাকে নিয়ে ব্যস্ত থাকেন?’ লেভিন বললেন।
‘মনে হচ্ছে তুমি সমস্ত নারীকে ভাবো কেবল মাদি, কেবল ‘ডিমে তা দেওয়া মুরগি’ বলে’, বললেন অব্লোন্স্কি; ‘ব্যস্ত থাকতে হলে অবশ্যই শিশুদের নিয়ে। না, মেয়েটাকে সে চমৎকার মানুষ করছে মনে হয়, কিন্তু তা নিয়ে কোন কথা শোনা যায় না। ও প্রথমত লেখা নিয়ে ব্যস্ত। দেখতে পাচ্ছি তুমি বাঁকা হাসছ, কিন্তু ওটা মিছে। শিশুদের জন্যে বই লিখছে ও, কিন্তু কাউকে সে কথা বলে না, তবে আমাকে পড়ে শুনিয়েছে, পাণ্ডুলিপিটা আমি দিই ভরকুয়েভকে…প্রকাশক সে…মনে হয় আবার নিজেও লেখক, এসব বোঝেসোঝে। ও বলছে, চমৎকার লেখা। তুমি কি ভাছ যাদের নারী-লেখিকা বলা হয়, ও সেই দলে পড়ে? একেবারে না। সর্বাগ্রে ও হল হৃদয়বান নারী। নিজেই দেখবে তুমি। এখন ওর সংসারে আছে একটি ইংরেজ মেয়ে আর তার গোটা পরিবার। তাদের নিয়ে ব্যস্ত থাকতে হয়।’
‘লোকহিতের ব্যাপার বুদ্ধি?’
‘এখানেও তুমি কিছু-একটা খারাপ দেখতে চাও। লোক হিত-টিত নয়, হৃদয়ের ব্যাপার। ওদের, মানে ভ্রন্স্কির ছিল এক ইংরেজ জকি, নিজের কাজে ওস্তাদ, কিন্তু মদ্যপ। ভয়ানক মদ টানে, সুরাসার-ঘটিত প্রলাপ পরিবারকে ভাসিয়ে দিল। আন্না ওদের দেখে, সাহায্য করে, জড়িয়ে যায় ব্যাপারটায়, আর এখন গোটা সংসার তার আশ্রয়ে। এটা শুধু কৃপাবৰ্ষণ নয়, টাকা দিয়ে নয়, ছেলেগুলোকে জিমনাসিয়ামে ভর্তি করাবার জন্যে আন্না নিজেই তাদের রুশ শেখাচ্ছে, আর মেয়েটাকে রেখেছে নিজের কাছে। চলো, দেখবে এখুনি।
গাড়ি আঙিনায় ঢুকল আর প্রচণ্ড শব্দ করে অব্লোন্স্কি ঘণ্টা দিল দোরগোড়ায়, একটা স্লেজ দাঁড়িয়ে ছিল সেখানে। যে ভৃত্যটি দরজা খুলল তাকে আন্না বাড়ি আছেন কিনা জিজ্ঞেস না করেই অব্লোন্স্কি ঢুকে গেলেন প্রবেশ চত্বরে। লেভিন গেলেন তাঁর পিছু পিছু ভালো নাকি খারাপ করছেন এই সন্দেহটা ক্রমেই বেড়ে উঠছিল তাঁর।
আয়নায় লেভিন দেখলেন যে মুখ তাঁর আরক্তিম, কিন্তু মাতাল যে হননি এই দৃঢ়বিশ্বাস তাঁর ছিল, তাই অব্লোন্স্কির পেছন পেছন ওপরে উঠতে লাগলেন গালিচায় মোড়া সিঁড়ি বেয়ে। ওপরে যে খানসামাটি অব্লোন্স্কিকে অভিবাদন জানাল অতি আপনজনের মত, তাকে আন্নার কাছে কে আছে এই প্রশ্ন করে জানা গেল, আছেন ভরকুয়েভ সাহেব।
‘কোথায় তারা?’
‘স্টাডিতে।’
ছোট একটা ডাইনং-রুমের দেয়াল গাঢ় রঙের কাঠ দিয়ে তৈরি, তার নরম গালিচা মাড়িয়ে অব্লোন্স্কি লেভিনকে নিয়ে ঢুকলেন আধো অন্ধকার স্টাডিতে, গাঢ় শেড দেওয়া শুধু একটা বাতিতেই তা আলোকিত। রিফ্লেক্টার লাগানো আরেকটা বাতির আলো গিয়ে পড়েছে দেয়ালে, তাতে দেখা যাচ্ছে বড় একটা পূর্ণাবয়ব মহিলার প্রতিকৃতি, আপনা থেকেই তা দৃষ্টি আকর্ষণ করল লেভিনের। এটা ইতালিতে মিখাইলোভের করা আন্নার পোর্ট্রেট। অব্লোন্স্কি স্ক্রিনের ওপাশে যেতেই জনৈক পুরুষের কণ্ঠস্বর থেমে গেল, আর লেভিন দাঁড়িয়ে রইলেন প্রতিকৃতির সামনে, উজ্জ্বল আলোয় সে প্রতিকৃতি যেন ফ্রেম থেকে বেরিয়ে আসতে চাইছে; চোখ সরাতে পারছিলেন না তিনি; ভুলে গেলেন কোথায় আছেন, কি কথা হচ্ছে, আশ্চর্য এই প্রতিকৃতি গ্রাস করে নিল তাঁর দৃষ্টিকে। এ যেন ছবি নয়, অপরূপা জীবন্ত এক নারী, কালো চুল যাঁর কুঞ্চিত, বাহু স্কন্ধ নগ্ন, নরম রোঁয়ায় ছাওয়া ঠোঁটে চিন্তামগ্ন আধো হাসি, লেভিনের দিকে তিনি চেয়ে আছেন বিজয়িনীর স্নিগ্ধ দৃষ্টিতে, যাতে অস্বস্তি হচ্ছিল তাঁর। এ নারী জীবিত নয় শুধু এজন্য যে কোন জীবিতা এতটা সুন্দরী হতে পারে না।
‘ভীষণ আনন্দ হল’, কাছেই কাকে বলতে শুনলেন তিনি স্পষ্টতই তাঁকে উদ্দেশ করে। এ কণ্ঠস্বর সেই নারীরই যাঁর পোর্ট্রেটে তিনি মুগ্ধ। স্ক্রিনের ওপাশে থেকে আন্না বেরিয়ে এসেছিলেন তাঁকে অভ্যর্থনা জানানোর জন্য আর স্টাডির আধো আলোয় লেভিন পোর্ট্রেটের সেই নারীকেই দেখলেন গাঢ়, বর্ণবহুল নীল পোশাকে—ভঙ্গিটা তাঁর তেমন নয়, মুখভাব তেমন নয়, কিন্তু পোর্ট্রেটে শিল্পী তাঁকে যে সৌন্দর্যে ধরে রেখেছেন তারই পরাকাষ্ঠায়। বাস্তবে এ নারী হয়ত কম চমকপ্রদ, কিন্তু নতুন, আকর্ষণীয় কিছু-একটা দেখা যাচ্ছিল তাঁর মধ্যে যা পোর্ট্রেটে নেই।