ত্রিশ
‘আবার আমি, সেই আমি! সব কিছু আবার আমি বুঝতে পারছি’, গাড়ি ছাড়তে, খোয়া পাথরে বাঁধানো রাস্তায় ঘর্ঘর শব্দ তুলে দুলতে দুলতে এগোনো মাত্র আন্না ভাবলেন, আবার একের পর এক ছবি ভেসে উঠতে লাগল তাঁর মনে।
মনে করতে চাইলেন তিনি, ‘আচ্ছা, কি ভাবনাটা অমন চমৎকার এসেছিল? কেশপ্রসাধক ত্যুৎকিন? না, ওটা নয়। হ্যাঁ, ইয়াভিন যা বলে সেই কথাটা : অস্তিত্বের জন্যে সংগ্রাম আর ঘৃণা—কেবল এটাই লোকদের মধ্যে সম্পর্ক। উঁহু, খামোকা যাচ্ছেন আপনারা’, চার ঘোড়ায় টানা গাড়ির আরোহীদের উদ্দেশ করে মনে মনে বললেন তিনি, বোঝা যায় দলটা চলেছে শহরের বাইরে ফুর্তি করতে। ‘আর যে কুকুরটা আপনারা সাথে নিয়েছেন তাকে দিয়েও কোন সাহায্য হবে না। নিজের কাছ থেকে তো পালাতে পারবেন না।’ পিওত্র যেদিকে তাকাচ্ছে সেই দিকে তাকিয়ে তিনি দেখতে পেলেন নেশায় আধমরা এক মজুরকে। মাথা নড়বড় করছে, পুলিশ তাকে নিয়ে যাচ্ছে, কে জানে কোথায়। ‘এই যেমন এটি পারবে’, আন্না ভাবলেন, ‘কাউন্ট ভ্রন্স্কি আর আমি তৃপ্তি খুঁজে পেলাম না, যদিও অনেক আশা ছিল তার।’ আর এই প্রথম আন্না উজ্জ্বল আলোয় দেখতে পেলেন ভ্রন্স্কির সাথে তাঁর সম্পর্কের সবখানি যা নিয়ে আগে তিনি এড়িয়ে যেতেন ভাবতে। ‘আমার মধ্যে কি খুঁজেছিল সে? ভালোবাসা ততটা নয়, যতটা আত্মগরিমার সাফল্য।’ তাঁর মনে পড়ল তাঁদের সম্পর্কের প্রথম দিকটায় তাঁর কথা, তাঁর মুখভাব ছিল একটা প্রভুভক্ত কুকুরের মত। এখন সব কিছুতেই তা সমর্থিত হচ্ছে। ‘হ্যাঁ, আত্মগরিমার বিজয় পেয়েছিল সে। বলা বাহুল্য, ভালোবাসাও ছিল বৈকি, কিন্তু বেশির ভাগটা ছিল আত্মগরি-মার সাফল্য। আমাকে নিয়ে সে গর্ব করেছে। এখন এটা গেছে। গর্ব করার কিছু নেই। গর্ব নয়, লজ্জা। আমার কাছ থেকে সে যা পেরেছে সব নিয়েছে, এখন আমাকে আর দরকার নেই ওর। আমি ওর ওপর একটা বোঝা, আমার সাথে সম্পর্কে ও সম্মান রেখে চলতে চায়। কাল সে বলে ফেলেছিল, ও চায় বিবাহবিচ্ছেদ আর বিয়ে যাতে ফেরার সাঁকোটা পুড়িয়ে দেওয়া যায়। ও আমাকে ভালোবাসে, কিন্তু কেমন ভাবে? উৎসাহ নিবে গেছে। এ লোকটা সবাইকে তাক লাগাতে চায়, ভারি আত্মসন্তুষ্ট’, ভাড়া করা ঘোড়ায় চাপা লাল-গাল একজন দোকান কর্মচারীকে দেখে আন্না ভাবলেন; ‘হ্যাঁ, আমার মধ্যে সে স্বাদ ওর কাছে আর নেই। আমি যদি ওকে ছেড়ে যেতে চাই, ভেতরে ভেতরে সে খুশিই হবে।
এটা শুধু অনুমান নয়, যে অন্তর্ভেদী আলোয় এখন তাঁর কাছে জীবন ও মানবিক সম্পর্কের অর্থ ধরা পড়ছিল, তাতে তিনি এটা স্পষ্ট দেখতে পেলেন।
‘আমার ভালোবাসা ক্রমেই বেশি করে হয়ে উঠছে প্রজ্বলিত, আত্মকেন্দ্রিক, আর ওর নিভে যাচ্ছে ক্রমেই, এজন্যই আমরা পার্থক্য হয়ে পড়ছি’, ভাবনার জের টেনে চললেন আন্না, ‘এখানে সাহায্য করার কিছু নেই। আমার সব কিছু ওর জন্যে আর আমি চাই সে যেন ক্রমেই বেশি করে আমার কাছে উজাড় করে তার সব কিছু। আর ও চাইছে ক্রমেই আমার কাছ থেকে সরে যেতে। আমাদের মিলন হবার আগে পর্যন্ত আমরা ক্রমাগত পরস্পরের কাছে এগিয়েছি, তারপর অপ্রতিরোধ্য গতিতে সরে যাচ্ছি বিভিন্ন দিকে। এটাকে বদলানো যায় না কিছুতেই। ও আমাকে বলে যে আমি অর্থহীন রকমে ঈর্ষান্বিত, আমিও নিজেকে বলেছি যে আমার যা ঈর্ষা হচ্ছে তা কোন মানে হয় না; কিন্তু সেটা ঠিক নয়, আমি ঈর্ষান্বিত নই, অসন্তুষ্ট। কিন্তু…’ হঠাৎ আসা একটা চিন্তার উত্তেজনায় মুখ হাঁ করে তিনি সরে বসলেন গাড়িতে, ‘যদি তার আদরের আকুল কামুকী এক নাগরী ছাড়া অন্য কিছু হতে পারতাম; কিন্তু অন্যকিছু হতে আমি পারি না, চাই না। আমার এই কামানায় তার বিতৃষ্ণা হয়, আর তাতে সে আমাকে রাগিয়ে দেয়। এ ছাড়া অন্যকিছু হতে পারে না। আমি কি জানি না যে আমাকে ও প্রতারণা করছে না, সরোকিনার ওপর তার চোখ নেই, কিটির অনুরক্ত সে নয়, আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা ও করবে না? এসবই আমি জানি, কিন্তু তাতে আমার অবস্থা সহনীয় হচ্ছে না। যদি সে ভালো না বেসে আমার ওপর সদয় আর কোমল থাকে, কিন্তু আমি যা চাই সেটা থাকছে না, তাহলে তা বিদ্বেষের চেয়েও হাজারগুণ খারাপ! সেটা নরক! আর এই নরকই রয়েছে। অনেকদিন থেকেই সে আমাকে আর ভালোবাসে না। আর যেখানে ভালোবাসার শেষ, সেখানে ঘৃণার শুরু। এই রাস্তাগুলো আমার একেবারে অজানা। কি- সব ঢিপি, কেবল বাড়ি আর বাড়ি… আর বাড়িতে লোক আর লোক… কত যে লোক তার ইয়ত্তা নেই। আর সবাই ঘৃণা করে পরস্পরকে। কিন্তু ভাবা যাক, সুখী হতে হলে আমার কি চাই। বেশ, আমি বিবাহবিচ্ছেদ পেলাম, কারেনিন আমাকে দিলেন সেরিওজাকে, ভ্রনস্কিকে বিয়ে করলাম আমি।’ কারেনিনের কথা ভাবতেই তিনি তাঁকে দেখতে পেলেন তাঁর ভীরু ভীরু নির্জীব নিভন্ত চোখ, সাদা হাতে শিরা, আঙুল মটকানি, কথার টান নিয়ে অসাধারণ স্পষ্টতায় জীবন্ত, আর তাঁদের মধ্যে যে সম্পর্ক ছিল, যাকেও ভালোবাসা বলা হত, তা মনে পড়ে ঘৃণায় শিউরে উঠলেন তিনি। ‘বেশ, আমি বিবাহবিচ্ছেদ পেয়ে বিয়ে করলাম ভ্রন্স্কিকে। কি হবে, কিটি আজকের মত আমার দিকে কি আর চাইবে না? না। আমার দুই স্বামী নিয়ে প্রশ্ন করতে বা ভাবতে ক্ষান্ত থাকবে সেরিওজা? আর ভ্রন্স্কি এবং আমার মধ্যে নতুন কি সম্পর্ক আমি ভাবতে পারি? সুখ আর নয়, কিন্ত যন্ত্রণার অবসান কি আদৌ আর সম্ভব? না, না!’ নিজেকে এবার তিনি বললেন বিনা দ্বিধায়; ‘না, না! সে অসম্ভব! জীবনেই আমরা পার্থক্য হয়ে যাচ্ছি, আমি ওকে অসুখী করছি, সে আমাকে, এটা বদলানো ওর বা আমার পক্ষে সম্ভব নয়। সব চেষ্টা করা হয়েছে, খুলে এসেছে ইস্কুপ। হ্যাঁ, ছেলের সাথে ভিখারিণী, সে ভাবছে লোকে ওকে করুণা করবে। কিন্তু সবাই আমরা দুনিয়ায় আসিনি কি বেবল পরস্পরকে ঘৃণা করতে আর তাতে করে নিজেকে আর অন্যদের কষ্ট দিতে? স্কুলের ছাত্ররা যাচ্ছে, হাসাহাসি করছে। সেরিওজা?’ মনে পড়ল তাঁর, ‘আমিও ভেবেছিলাম আমি তাকে ভালোবাসি, মন ভিজে উঠল স্নেহে। অথচ রইলাম তো তাকে ছাড়াই, তাকে বিনিময় করে গেলাম অন্য একটা ভালোবাসার পেছনে, আর যতদিন সে ভালোবাসায় পরিতৃপ্তি পেয়েছি, ক্ষোভ করি নি এ বিনিময়ের জন্যে।’ আর যেটার তিনি নাম দিয়েছিলেন ভালোবাসা সে কথা মনে পড়ে ঘৃণা হল তাঁর। আর যে স্পষ্টতায় এখন তিনি দেখতে পাচ্ছেন তাঁর এবং অন্য সব লোকের জীবন, তাতে আনন্দ বোধ করলেন তিনি। ‘আমি, পিওত্র, সহিস ফিওদর, আর সেই সমস্ত লোক যারা থাকে ভল্গা পাড়ে, যেখানে যাবার জন্যে ডাক দিচ্ছে বিজ্ঞাপনটা, সবাই আমরা ওরকম’, নিজনি নভগোরদ স্টেশনের নিচু দালানটার কাছে যখন পৌঁছে গেছেন, ছুটে আসছে মুটেরা, তখন এই কথা ভাবছিলেন তিনি।
পিওত্র জিজ্ঞেস করল, ‘বলুন, ওবিরালোঙ্কা-র টিকিট কাটব?’
আন্না একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন কোথায় এবং কেন তিনি যাচ্ছেন। বহু চেষ্টা করে প্রশ্নটার মানে বোধগম্য হল তাঁর।
‘হ্যাঁ’, ওকে একটা মানি-ব্যাগ দিয়ে আন্না বললেন, তারপর নিজের ছোট লাল থলিটা নিয়ে নামলেন গাড়ি থেকে।
ভিড়ের মধ্যে দিয়ে প্রথম শ্রেণীর ওয়েটিং-রুমের দিকে যেতে যেতে একটু একটু করে তাঁর মনে পড়ল নিজের অবস্থার খুটিনাটি আর যেতে যেতে একটু একটু করে তাঁর মনে পড়ল নিজের অবস্থার খুঁটিনাটি আর যেসব সিদ্ধান্তের মধ্যে তিনি দোল খেয়েছেন, তার কথা; এবং আবার পুরানো আর্ত জায়গাগুলো নিয়ে কখনো আশা কখনো হতাশা আঁচড়াচ্ছিল তাঁর জর্জরিত, সাংঘাতিক দপদপ করা হৃদয়ের ক্ষতগুলোকে। ট্রেনের অপেক্ষায় পঞ্চমুখী সোফায় বসে, যে লোকগুলোকে। ট্রেনের অপেক্ষায় পঞ্চমুখী সোফায় বসে, যে লোকগুলো ঢুকছিল আর বেরোচ্ছিল, ঘৃণায় তাদের দিকে তাকিয়ে (এখন সবাই তাঁর কাছে জঘন্য) আন্না ভাবছিলেন কিভাবে গন্তব্যে পৌঁছে তিনি ওঁকে চিঠি পাঠাবেন, তাতে কি লিখবেন, ভাবছিলেন কিভাবে এখন তিনি মায়ের কাছে নিজের ভাগ্য নিয়ে অনুযোগ করছেন (আন্নার যন্ত্রণাটা না বুঝে), কিভাবে তিনি ঘরে ঢুকবেন আর কি তিনি বলবেন ওঁকে। তারপর ভাবলেন জীবন কত সুখের হতে পারত আর কি যন্ত্রণায় আন্না তাঁকে ভালোবাসেন ও ঘৃণা করেন, তাঁর বুকটা কি ভয়ংকরভাবে ঢিপঢিপ করছে।
একত্রিশ
ট্রেনের হুইসেল পড়ল। কি-সব কুৎসিত, বেহায়া, হন্তদন্ত তবে সেই সাথে কি ছাপ তারা ফেলছে সে সম্পর্কে সচেতন যুবকেরা বেরিয়ে গেল; ভোঁতা, পশুবৎ মুখে চাপরাশ আর বোতাম-আঁটা বুট পরা পিওত্র তাঁকে ট্রেনে চাপিয়ে দেবার জন্য ওয়েটিং-রুম পেরিয়ে এল তাঁর কাছে। প্ল্যাটফর্মে কোলাহল করা যুবকদের পাশ দিয়ে আন্না যখন যাচ্ছিলেন, চুপ করে গেল তারা। একজন আরেকজনের কানে কানে কি যেন বলল—বলাই বাহুল্য, জঘন্য কোন মন্তব্য। আন্না উঁচু সিঁড়ি দিয়ে উঠে একলা বসলেন একতটা গদি আঁটা দাগ ধরা সোফায়, যা একসময় ছিল সাদা। ব্যাগটা স্প্রিঙের ওপর লাফাতে লাফাতে কাত হয়ে পড়ল। জানালার কাছে এসে বোকার মত হেসে বিদায় জানাবার জন্য সোনালি ফিতে দেওয়া টুপি তুলল পিওত্র। অভদ্র কন্ডাক্টর ঝপাং করে দরজা বন্ধ করে হুড়কো দিলে। বা পরা জনৈক কুৎসিত মহিলা (আন্না মনে মনে মহিলাটিকে বিবস্ত্র করে স্তম্ভিত হলেন তার কুশ্রীতায়) আর অস্বাভাবিক হাসি হাসতে হাসতে একটি মেয়ে ছুটে নেমে গেল প্ল্যাটফর্মে।
‘কাতেরিনা আন্দ্রেয়েভনার সব আছে, আমার চাচি!’
‘খুকি আর সেও কিনা বিকৃত, ন্যাকামি করছে’, ভাবলেন আন্না। কাউকে যাতে আর দেখতে না হয় তার জন্য আন্না ঝট করে উঠে ফাঁকা ওয়াগনে বসলেন উলটো দিকে জানালার কাছে। এ জানালার সামনে দিয়ে সরে গেল তেল- কালি লাগা কুঃিসিত একটা লোক, মজুরের টুপির তল থেকে এলোমেলো চুল বেরিয়ে পড়েছে, নিচু হয়ে ওয়াগনের চাকাগুলোয় কি যেন সে করছিল। ‘এই কুৎসিত লোকটার মধ্যে কি যেন চেনা-চেনা ঠেকছে, ভাবলেন আন্না। আর তাঁর স্বপ্নের কথা মনে পড়ে যেতে আতংকে শিউরে উঠে গেলেন অন্য দরজার কাছে। দরজা খুলে একজোড়া স্বামী- স্ত্রীকে ভেতরে ঢুকতে দিল কন্ডাক্টর।
‘আপনি কি বেরোবেন?’
জবাব দিলেন না আন্না। অবগুণ্ঠনের তলে তাঁর মুখের আতংক নবাগত বা কন্ডাক্টর—চোখে পড়ে নি কারুরই। আন্না ফিরে গিয়ে বসলেন নিজের কোণটিতে। স্বামী-স্ত্রী উলটো দিকে বসে মন দিয়ে তবে গোপনে গোপনে লক্ষ করছিলেন তাঁর পোশাক। স্বামী-স্ত্রী দুজনকেই জঘন্য লাগল আন্নার। স্বামী জিজ্ঞেস করলেন ধূমপান করা চলবে কি? স্পষ্টতই ধূমপানের চেয়েও নিরর্থক। বোকামির ভান করে তাঁরা কথা বলছিলেন শুধু আন্নার কানে যাতে তা যায়। আন্না পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন পরস্পরের ওপর কি রকম বিরক্তি ধরে গেছে তাঁদের, কি ঘৃণাই না তাঁরা করেন পরস্পরকে। আর এই ধরনের কুশ্রী জীবদের ঘৃণা না করেও পারা যায় না।
দ্বিতীয় ঘণ্টা পড়ল, তার পরেই শোনা গেল মাল ঠেলা, চেঁচামেচি, গোলমাল, হাসির শব্দ। আন্নার কাছে খুবই পরিষ্কার যে কারো আনন্দ করার কিছু নেই, হাসিটা তাঁকে বিরক্ত করে তুলল যন্ত্রণার মাত্রায়, তা যাতে মুনতে না হয় তার জন্য কানে আঙুল চাপা দেবার ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর। অবশেষে পড়ল তৃতীয় ঘণ্টা, শোনা গেল হুইসেল, ফোঁস করে উঠল ইঞ্জিন, টান পড়ল শেকলে, স্বামী ক্রুশ করলেন। ‘কি ভেবে এটা সে করছে, জিজ্ঞেস করলে হত’, আক্রোশে লোকটার দিকে তাকিয়ে আন্না ভাবলেন। যারা ট্রেনে চাপিয়ে দিতে এসেছিল, প্ল্যাটফর্মে দাঁড়িয়ে আছে, মহিলার পাশ থেকে জানালা দিয়ে তাদের দেখতে লাগলেন আন্না। ঠিক যেন পেছিয়ে যাচ্ছে সবাই। আন্না যে ওয়াগনটায় বসেছিলেন, রেল লাইনের জোড়গুলোয় তা সমতালে কেঁপে কেঁপে পেরিয়ে যেতে লাগল প্ল্যাটফর্ম, পাথরের দেয়াল, সিগন্যাল পোস্ট, অন্যান্য ওয়াগন; ট্রেনের চাকা হয়ে উঠল মসৃণ, অনায়াস, মৃদু আওয়াজ উঠতে লাগল তা থেকে, উজ্জ্বল সান্ধ্য কিরণে আলো হয়ে উঠল জানালা, পর্দায় খেলা করতে লাগল বাতাস। কামরায় তাঁর সহযাত্রীদের কথা ভুলে গিয়ে ট্রেনের সামান্য দুলুনিতে তাজা বাতাসে নিঃশ্বাস নিয়ে আন্না আবার ডুবে গেলেন তাঁর ভাবনায়।
‘কি যেন ভাবছিলাম? হ্যাঁ, আমি এমন অবস্থা কল্পনা করতে পারি না যেখানে জীবন হবে না যন্ত্রণাকর, সবাই আমরা জন্মেছি কষ্ট পেতে, আমরা সবাই এটা জানি আর আত্মপ্রতারণার উপায় খুঁজি। কিন্তু সত্যকে যখন মুখোমুখি দেখি, কি তখন করব আমরা?
‘যা আমাদের অস্থির করে তোলে তা থেকে উদ্ধার পাবার জন্যেই তো বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে মানুষকে’, ফরাসিতে বললেন মহিলাটি, স্পষ্টতই নিজের বুকনিতে খুশি হয়ে এবং ভাষার কেরদানি দেখিয়ে।
কথাগুলো যেন আন্নার চিন্তার জবাব।
‘যা আমাদের অস্থির করে তোলে তা থেকে উদ্ধার পাওয়া’, কথাগুলোর পুনরাবৃত্তি করলেন আন্না। আর রক্তিমগও স্বামী আর শীর্ণ স্ত্রীর দিকে তাকিয়ে তিনি বুঝলেন যে রুগ্না স্ত্রী নিজেকে মনে করেন এক প্রহেলিকাময়ী নারী আর তাঁর নিজের সম্পর্কে ধারণাটায় ইন্ধন জুগিয়ে স্বামী প্রতারণা করেন তাঁকে। আন্না যেন আলো ফেলে তাঁদের সমস্ত স্বামী প্রতারণা করেন তাঁকে। আন্না যেন আলো ফেলে তাঁদের সমস্ত কাহিনী, প্রাণের কোনাকানাচগুলো দেখতে পাচ্ছিলেন। কিন্তু চিত্তাকর্ষক কিছু ছিল না সেখানে, নিজের ভাবনা তিনি ভেবে চললেন।
‘হ্যাঁ, আমাকে খুবই অস্থির করে তোলে আর মানুষকে বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে তা থেকে উদ্ধার পাবার জন্যে, তাহলে উদ্ধার পাওয়া দরকার। যখন দেখবার কিছু আর নেই তখন বাতিটা কেন নিবিয়ে ফেলব না, যখন এসব কিছুর দিকে তাকাতে ঘৃণা করে? কিন্তু কেমন করে? করিডোর দিয়ে কন্ডাক্টর ছুটে গেল কেন? ওই ওয়াগনে কেন চিৎকার করছে ওরা, ওই ছোকরারা? কেন কথা বলছে তারা? কেন হাসছে? সব বেঠিক, সব মিথ্যা, সবই প্রতারণা, সবই অশুভ!…’
আন্নার স্টেশনে যখন ট্রেন থামল, অন্যান্য প্যাসেন্জারদের ভিড়ের সাথে তিনিও নামলেন আর যেন, কুষ্ঠব্যাধিগ্রস্তদের ছোঁয়া এড়িয়ে দাঁড়িয়ে রইলেন প্ল্যাটফর্মের মাঝখানে। চেষ্টা করলেন স্মরণ করতে কেন তিনি এখানে এসেছেন, কি করার সংকল্প ছিল তাঁর। আগে যা তাঁর কাছে সম্ভব মনে হয়েছিল, এখন তা কল্পনা করাই কঠিন হল, বিশেষত এই হৈচৈ করা কদর্য লোকগুলোর ভিড়ে, যারা তাঁকে শান্তিতে থাকতে দিচ্ছে না। মাল বইবার আশায় মুটেরা ছুটে এল তাঁর কাছে, প্ল্যাটফর্মের তক্তায় হিলের দুমদাম শব্দ করে ছোকরারা উচ্চেঃস্বরে কথা বলতে বলতে তাকাতে লাগল তাঁর দিকে, উল্টো দিক থেকে আসা যাত্রীর স্রোত তাঁকে ঠেলে দিলে অন্যদিকে জবাব না পেলে তিনি আরো এগিয়ে যাবেন ভেবেছিলেন সেটা মনে পড়ায় একজন মুটেকে থামিয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন কাউন্ট ভ্রন্স্কির কাছে একটা চিঠি নিয়ে যাবার মত কোন গাড়োয়ান এখানে পাওয়া যাবে কিনা।
‘কাউন্ট ভ্রন্স্কি? ওঁদের কাছ থেকে এখুনি গাড়ি এসেছিল প্রিন্সেস সরোকিনা আর তাঁর মেয়ের জন্যে। আচ্ছা, কোচোয়ান দেখতে কেমন?’
আন্না মুটের সাথে যখন কথা বলছিলেন, তখন বুকের ওপর চেন ঝোলানো চটকদার নীল কোট পরা রাঙা-মুখ ফুর্তিবাজ কোচোয়ান মিখাইল এসে একটা চিঠি দিলে তাঁকে, বোঝা যায় এমন চমৎকার করে দায়িত্ব পালন করেছে বলে ভারি গর্ব তার। চিঠি পড়তে গিয়ে বুক তাঁর আগের চেয়েও হিম হয়ে এল।
হেলাফেলা হস্তাক্ষরে ভ্রন্স্কি লিখেছেন, ‘ওখানে চিঠিটা পাইনি বলে খুবই দুঃখিত। দশটায় পৌঁছব।’
‘বটে! তাই আমি ভেবেছিলাম!’ মনে মনে বললেন তিনি আক্রোশের বাঁকা হাসি নিয়ে।
‘বেশ, তাহলে বাড়ি চলে যাও’, মিখাইলের দিকে তাকিয়ে তিনি আস্তে করে বললেন। আস্তে করে বললেন কারণ বুকের দ্রুত স্পন্দনে কষ্ট হচ্ছিল নিঃশ্বাস নিতে। ‘না, আমাকে যন্ত্রণায় ভোগাতে তোমাকে দেব না’, ভ্রন্স্কিকে নয়, নিজেকে নয়, যে তাঁকে যন্ত্রণায় ভোগাচ্ছে তাকে হুমকি দিয়ে বললেন তিনি, চলতে লাগলেন স্টেশন ঘর পেরিয়ে প্ল্যাটফর্ম বরাবর।
দুজন চাকরানি প্ল্যাটফর্মে পায়চারি করছিল। ঘাড় ফিরিয়ে তাঁকে দেখে তাঁর সাজপোশাক সম্পর্কে নিজেদের মতামত তারা ব্যক্ত করল শুনিয়ে শুনিয়ে : আসলী মাল’, তাঁর পরনের লেস সম্পর্কে বলাবলি করল তারা। ছোকরারা শান্তিতে থাকতে দিচ্ছিল না তাঁকে। আবার তারা তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে সহাস্যে অস্বাভাবিক গলায় কি-একটা ‘চিৎকার করে চলে গেল পাশ দিয়ে। স্টেশন মাস্টার যেতে যেতে জিজ্ঞেস করলেন আরো দূরে তিনি যাবেন কিনা। যে ছেলেটা ভাস বিক্রি করছিল, সে তাঁর ওপর থেকে চোখ সরাতে পারছিল না। ‘সৃষ্টিকর্তা, কোথায় আমি যাব?’ প্ল্যাটফর্ম বরাবর ক্রমেই দূরে চলে যেতে যেতে ভাবলেন তিনি। প্ল্যাটফর্মের শেষে থামলেন। চশমাধারী এক ভদ্রলোককে নিতে আসা মহিলা আর ছেলেপেলেরা সজোরে হাসাহাসি করে কথা বলছিল, আন্না তাদের কাছাকাছি যেতে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে চুপ করে গেল তারা। দ্রুত পদক্ষেপে আন্না তাদের ছাড়িয়ে গেলেন প্ল্যাটফর্মের একেবারে প্রান্তে। একটা মালগাড়ি আসছিল। প্ল্যাটফর্ম থরথরিয়ে উঠল আর আন্নার মনে হল আবার ট্রেনে চেপে যাচ্ছেন তিনি।
ভ্রন্স্কির সাথে প্রথম সাক্ষাতের দিন ট্রেনে যে লোকটা কাটা পড়েছিল, হঠাৎ তার কথা মনে পড়ে যাওয়ায় তিনি বুঝলেন কি তাঁর করা দরকার। স্টেশনের সিঁড়ি গিয়েছিল পানির পাম্প থেকে রেল লাইন পর্যন্ত, ক্ষিপ্র লঘু পায়ে তা বেয়ে নেমে তিনি দাঁড়ালেন চলন্ত মালগাড়িটার একেবারে কাছ ঘেঁষে। ওয়াগনগুলোর তলের দিকটা, ধীরে ধীরে যাওয়া প্রথম ওয়াগনটার বোল্ট, শেকল আর লোহার উঁচু চাকাটার দিকে তাকালেন তিনি, চোখ আন্দাজে স্থির করার চেষ্টা করলেন সামনের চাকা আর পেছনের চাকার মাঝখানটা কোথায় আর কখন সে মাঝখানটা এসে পড়বে তাঁর সামনে।
‘ওখানে!’ ওয়াগনের ছায়া থেকে কয়লা আর বালি ছড়ানো স্লিপারগুলোর দিকে তাকিয়ে ভাবলেন তিনি, ‘ওখানে, একেবারে মাঝখানে। ওকে শাস্তি দেব আর সবার কাছ থেকে, নিজের কাছ থেকেও নিষ্কৃতি পাবো।’
আন্না প্রথম ওয়াগনটার মাঝখানটা তাঁর সামনাসামনি হতেই ঝাঁপিয়ে পড়তে চেয়েছিলেন। কিন্তু লাল ব্যাগটা হাত থেকে খুলতে যাওয়ায় দেরি হয়ে গেল : মাঝখানটা পেরিয়ে গেল তাঁকে। তাহলে পরের ওয়াগনটার জন্য অপেক্ষা করতে হয়। গোসল করতে গিয়ে ঠাণ্ডা পানিতে ঝাঁপাবার আগে যেমন লাগত, তেমন একটা অনুভূতি তাঁকে আচ্ছন্ন করল, ক্রস করলেন তিনি। ক্রস করার অভ্যস্ত ভঙ্গিটায় তাঁর প্রাণে জেগে উঠল বাল্য ও কৈশোরের একসারি স্মৃতি আর যে অন্ধকারটা তাঁর সব কিছু য়েকে রেখেছিল, হঠাৎ তা ফেটে চৌচির হয়ে গেল, মুহূর্তের জন্য অতীতের সমস্ত ভাস্বর আনন্দ নিয়ে জীবন ভেসে উঠল তাঁর সামনে। কিন্তু এগিয়ে আসা দ্বিতীয় ওয়াগনটার চাকা থেকে দৃষ্টি সরালেন না তিনি। তারপর দুই চাকার মাঝখানটা তাঁর সামনাসামনি হতেই তিনি ছুঁড়ে ফেললেন লাল ব্যাগটা, কাঁধে মাথা গুঁজে ঝাঁপিয়ে পড়লেন ওয়াগনের তলে দুই হাতের ওপর, আর যেন তখনই দাঁড়িয়ে পড়বেন এমন লঘু ভঙ্গিতে উঠে বসলেন হাঁটুর ওপর। আর সেই মুহূর্তেই যা করেছেন তাতে আতংক হল তাঁর। ‘কোথায় আমি? কি করলাম? কেন?’ তিনি চেয়েছিলেন উঠে দাঁড়াবেন, লাফিয়ে ফিরে আসবেন; কিন্তু বিপুল, অমোঘ কোন কিছু ঘা দিল তাঁর মাথায়, টেনে নিয়ে যেতে লাগল পিঠ ধরে। সংগ্রাম অসম্ভব টের পেয়ে আন্না অস্ফুট মিনতি করলেন, ‘সৃষ্টিকর্তা, আমার সব কিছু ক্ষমা করো!’ ছোটখাট একটা বৃদ্ধ কি যেন বিড়বিড় করে কাজ করছিল লোহা নিয়ে। আর যে মোমবাতিটার আলোয় তিনি শংকা, প্রতারণা, দুঃখ আর অকল্যাণে ভরা বইখানা পড়ছিলেন, তা এত উজ্জ্বল হয়ে উঠল যা কখনো হয়নি, আগে যা ছিল অন্ধকারে তা সব আলো করে তুলল। তারপর দপদপ করে উঠে ম্লান হয়ে আসতে লাগল, চিরদিনের জন্য নিভে গেল।