পঁচিশ
সবকিছু মিটমাট হয়ে গেছে মনে করে আন্না সকাল থেকে সোৎসাহে যাত্রার তোড়জোড় করতে লাগলেন। যদিও স্থির হয়নি যাওয়া হবে সোমবার নাকি মঙ্গলবার, কেননা কাল দুজনেই দুজনের ওপর তার ভার ছেড়ে দিয়েছিলেন। তাহলেও আন্না সযত্নে যাবার জন্য তৈরি হতে লাগলেন, যাওয়া হবে একদিন আগে কি পরে তাতে তাঁর একেবারেই কিছু এসে যায় না। খোলা একটা ট্রাঙ্কের ওপর ঝুঁকে জিনিসপত্র বাছছিলেন তিনি, এমন সময় পোশাক পরে, সচরাচরের চেয়ে আগে ভ্রন্স্কি এলেন তাঁর কাছে।
বললেন, ‘এখনি মায়ের কাছে যাচ্ছি, টাকা উনি আমাকে পাঠাতে পারেন ইয়েগরভের হাত দিয়ে। কালই যাবার জন্যে আমি তৈরি।’
মন যত ভালোই থাক, মায়ের উল্লেখমাত্রই আন্নার বুকে যেন ছোরা বিধল।
‘না, আমি নিজেই গুছিয়ে উঠতে পারব না’, আন্না বললেন এবং তখনই ভাবলেন : ‘তাহলে আমি যা চেয়েছিলাম, তার ব্যবস্থা করা যেত দেখছি।’
‘না, তুমি যা চেয়েছিলে তাই করো। ডাইনিং-রুমে যাও, আমি শুধু এই নিষ্প্রয়োজন জিনিসগুলো বেছে এখনই আসছি’, এই বলে তিনি আনুশ্কার হাতে আরো কিসব তুলে দিতে লাগলেন, এর মধ্যেই সে হাতে জমে উঠেছিল ন্যাতাকানির ডাঁই।
আন্না যখন ডাইনিং-রুমে এলেন, ভ্রন্স্কি তখন বিফস্টিক খাচ্ছিলেন।
—তুমি ভাবতে পারবে না এই ঘরগুলোয় কি-রকম ঘৃণা ধরে গেছে আমার’, ভ্রন্স্কির পাশে বসে নিজের কফি টেনে নিয়ে বললেন তিনি; ‘এসব আসবাব সমেত ভাড়া করা ঘর-এর চেয়ে ভয়াবহ আর কিছু হতে পারে না। ওদের কোন চেহারা নেই, প্রাণ নেই। এসব ঘড়ি, পর্দা, বিশেষ করে ওই ওয়াল-পেপারগুলো—বীভৎস। ভজ্দ্ভিজেনস্কয়ে-র কথা যখন ভাবি, মনে হয় প্রতিশ্রুত দেশ। তুমি ঘোড়াগুলোকে এখনো পাঠাওনি?’
‘না, ওরা আসবে আমাদের পরে। কেন, যাবে কোথাও?
‘উইলসনের কাছে যাব ভাবছিলাম। কিছু পোশাক নিয়ে যেতে হবে ওর জন্যে। তাহলে কাল যাওয়াই ঠিক?’ খুশির গলায় জিজ্ঞেস করলেন তিনি; কিন্তু হঠাৎ মুখভাব তাঁর বদলে গেল।
ভ্রন্স্কির সাজ-ভৃত্য পিটার্সবুর্গ থেকে আসা একটা টেলিগ্রামের রসিদ চাইতে এসেছিল। ভ্রন্স্কির কাছে টেলিগ্রাম আসায় অস্বাভাবিক কিছু নেই, কিন্তু উনি যেভাবে বললেন যে রসিদ আছে স্টাডিতে, তাতে মনে হল উনি আন্নার কাছ থেকে কিছু-একটা যেন লুকিয়ে রাখতে চাইছেন। তাড়াতাড়ি করে আন্নাকে বললেন, ‘কাল আমি অবশ্যই সব শেষ করে ফেলব।’
ওঁর কথায় কান না দিয়ে আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘কার কাছ থেকে টেলিগ্রাম?’
‘স্তিভার কাছ থেকে’, অনিচ্ছায় উত্তর দিলেন ভ্ৰন্স্কি।
‘আমাকে দেখালে না যে? স্তিভা আর আমার মধ্যে গোপন কিছু থাকতে পারে?’
সাজ-ভৃত্যকে ফিরিয়ে ভ্রন্স্কি তাকে টেলিগ্রামটা আনতে বললেন।
‘আমি দেখাতে চাইনি কারণ টেলিগ্রাম করার একটা দুর্বলতা আছে স্তিভার। টেলিগ্রাম পাঠাবার কি আছে যখন সিদ্ধান্ত হয়নি কিছুরই?’
‘বিবাহবিচ্ছেদের?’
‘হ্যাঁ, ও লিখেছে: এখনো কিছু করে উঠতে পারিনি। দিন কয়েকের মধ্যেই চূড়ান্ত সিদ্ধান্ত জানাবে বলেছে। নাও, পড়।’ কাঁপা-কাঁপা হাতে টেলিগ্রামটা নিয়ে ভ্রন্স্কি যা বলেছেন, তাই পড়লেন আন্না। শেষে আরেকটু যোগ করা ছিল : আশা কম, তবে আমি সম্ভব অসম্ভব সব কিছু করব।
‘কালই তো আমি বলেছি যে বিবাহবিচ্ছেদ কবে পাব, আদৌ পাব কিনা, আমার কাছে সবই সমান’, লাল হয়ে আন্না বললেন, ‘আমার কাছ থেকে লুকিয়ে রাখার প্রয়োজন ছিল না।’—’এভাবেই তো অন্য নারীদের সাথে পত্রালাপ সে লুকিয়ে রাখতে পারে আর লুকিয়ে রাখে আমার কাছ থেকে’, আন্নার মনে হল।
‘ও হ্যাঁ, ইয়াভিন আর ভোইতভ আজ সকালে আসবে ভাবছিল’, ভ্রন্স্কি বললেন, ‘মনে হয় পেসভের কাছ থেকে সব কিছু ও জিতে নিয়েছে, ও যা শোধ দিতে পারবে, তারও বেশি—প্রায় ষাট হাজার।
‘না, বলো’, কথাবার্তার প্রসঙ্গ বদলে দিয়ে ভ্রন্স্কি যে স্পষ্টতই দেখাতে চাইলেন যে আন্না চটেছেন, তাতে চটে উঠে আন্না বললেন, ‘কেন তুমি ভাবলে যে খবরটা আমার কাছে এতই আগ্রহোদ্দীপক যে লুকিয়েই রাখতে হবে? আমি বলেছি যে ও নিয়ে আমি ভাবতে চাই না। আমার মত তোমারও যাতে এতে কম আগ্রহ থাকে, তাই আমার ইচ্ছে
‘আমি আগ্রহ বোধ করি কারণ আমি ভালোবাসি সুস্পষ্টতা’, ভ্রন্স্কি বললেন।
‘স্পষ্টতাটা বাহ্যরূপে নয়, ভালোবাসায়’, ভ্রন্স্কির কথায় নয়। যে নিরুত্তাপ সুস্থির কণ্ঠে তিনি তা বললেন তাতে আরো চটে উঠে আন্না বললেন, ‘এ স্পষ্টতা তুমি কেন চাও?
‘সৃষ্টিকর্তা, আবার ভালোবাসা’, মুখ কুঁচকে ভাবলেন ভ্রন্স্কি। বললেন, ‘তুমি তো জানো কিসের জন্যে : তোমার জন্যে আর যে ছেলেমেয়েরা হবে, তাদের জন্যে।’
‘ছেলেমেয়ে হবে না।’
‘খুবই দুঃখের কথা’, উনি বললেন।
‘তোমার ওটা দরকার ছেলেমেয়েদের জন্যে, আর আমার কথা তুমি ভাবছ না?’ উনি যে ‘তোমার জন্যে আর ছেলেমেয়েদের জন্যে ভ্রন্স্কির আকাঙ্ক্ষার ব্যাখ্যা তাঁর কাছে ছিল এই যে উনি তাহলে তাঁর রূপে মূল্য দিচ্ছেন না।
‘আহ্, আমি বললাম : তোমার জন্যে, সবচেয়ে বেশি তোমার জন্যে…’ যেন যাতনায় কুঞ্চিত মুখে পুনরাবৃত্তি করলেন ভ্রন্স্কি, ‘কারণ আমার সন্দেহ নেই যে তোমার জ্বালার বেশির ভাগটা আসছে অবস্থার অনির্দিষ্টতা থেকে।’
‘হ্যাঁ, ভান করা থামাতে এখন আমার প্রতি তার কঠোর ঘৃণাটা সমূহ দেখা যাচ্ছে, ভাবলেন আন্না। ওঁর কথা কানে না তুলে তিনি আতংকে তাকিয়ে রইলেন সেই নিষ্প্রাণ নিষ্ঠুর বিচারকের দিকে যে তাঁকে রাগিয়ে দিয়ে চেয়ে ছিল চোখের কোণ থেকে।
বললেন, ‘ওটা কারণ নয়, বুঝি না, যাকে তুমি আমার জ্বালা বলছ, কেমন করে তার কারণ হতে পারে যে আমি পুরোপুরি তোমার অধীনে। অবস্থার অনির্দিষ্টতা এখানে কোথায়? বরং বিপরীত।
‘খুবই দুঃখ হচ্ছে যে তুমি বুঝতে চাইছ না’, নিজের ভাবনাটা পুরো বলবার জেদে আন্নাকে বাধা দিয়ে বললেন ভ্রন্স্কি, ‘অনির্দিষ্টতা এখানে যে তোমার মনে হচ্ছে আমি স্বাধীন।’
‘এ ব্যাপারে তুমি একদম নিশ্চিন্ত থাকতে পারো’, বলে আন্না ওঁর দিক থেকে মুখ ফিরিয়ে কফি খেতে লাগলেন। কড়ে আঙুলটা ছেড়ে রেখে কফির কাপ মুখে তুলেছিলেন আন্না। কয়েক ঢোক খাওয়ার পর আন্না চাইলেন ভ্রন্স্কির দিকে, তাঁর মুখভাব দেখে পরিষ্কার তিনি বুঝলেন যে তাঁর হাত, হাতের ভঙ্গি, কফিতে চুমুক দেবার শব্দ, সবই তাঁর কাছে কদর্য লাগছিল।
কাঁপা কাঁপা হাতে পেয়ালা নামিয়ে তিনি বললেন, ‘তোমার মা কি ভাবেন, কিভাবে তোমার বিয়ের ব্যবস্থা করতে চান, তাতে একেবারে বয়ে গেল আমার।’
‘কিন্তু আমরা তো এ নিয়ে কথা বলছিলাম না।’
‘না, এই নিয়েই। আর তোমাকে বলে রাখি, হৃদয়হীন কোন নারী, বৃদ্ধা সে হোক বা না হোক, তোমার মা কি অপরের, তাতে আমার কোন আগ্রহ নেই, আমার কোন সম্পর্ক নেই তাঁর সাথে।’
‘আন্না, অনুরোধ করছি, আমার মা’কে অসম্মান করে কথা বলো না।’
‘যে নারী হৃদয় দিয়ে ধরতে পারেনি তার ছেলের সুখ-সম্মান কিসে, তার হৃদয় নেই।’
‘আবার অনুরোধ করছি, আমার মা’কে অসম্মান করে কথা বলো না। তাঁকে আমি সম্মান করি’, ভ্রন্স্কি বললেন গলা চড়িয়ে, আন্নার দিকে কঠোর দৃষ্টিতে চেয়ে।
আন্না জবাব দিলেন না। ওঁর দিকে, ওঁর মুখ, হাতের দিকে স্থিরদৃষ্টিতে চেয়ে তাঁর মনে পড়ল গতকাল তাঁদের মিটমাট আর ভ্রন্স্কির সাবেগ আদরের সমস্ত খুঁটিনাটি কথা। ‘ঠিক একই রকম আদর উনি দিয়েছেন, দেবেন, দিতে চান অন্য নারীদের!’ ভাবলেন তিনি।
‘মাকে তুমি ভালোবাসো না। এটা কেবল ফাঁকা কথা, কথা আর কথা!’ বিদ্বেষভরে ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে আন্না বললেন।
‘তাই যদি হয়, তাহলে…’
‘তাহলে সিদ্ধান্ত নিতে হয় এবং আমি নিয়েছি’, এই বলে আন্না চলে যেতে চাইছিলেন, কিন্তু এই সময় ঘরে ঢুকলেন ইয়াভিন। আন্না সম্ভাষণ বিনিময় করে রয়ে গেলেন।
কেন, বুকের মধ্যে যখন ঝড় ফুঁসছে, যখন টের পাচ্ছেন যে তিনি জীবনের এমন একটা মোড়ের মুখে এসে পড়েছেন যার পরিণাম হতে পারে ভয়াবহ। তখন কেন এই মুহূর্তে প্রয়োজন পড়ল অপর লোকের সামনে ভান করার, যে আজ হোক, কাল হোক সবই জানবে—এটা আন্না বলতে পারতেন না; কিন্তু তখনই বুকের ভেতরকার ঝড় চাপা দিয়ে আন্না বসে কথাবার্তা বলতে লাগলেন অতিথির সাথে।
‘তা আপনার খবর কি? দেনা শোধের টাকা পেয়েছেন?’ ইয়াভিনকে জিজ্ঞেস করলেন আন্না।
‘চলছে একরকম; মনে হচ্ছে সব টাকাটা পাব না। ওদিকে চলে যাচ্ছি বুধবার। আর আপনারা কবে যাচ্ছেন?’ ভুরু কুঁচকে ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন ইয়াভিন, বোঝা যায় একটা ঝগড়া যে হয়ে গেছে, সেটা তিনি অনুমান করেছেন।
‘সম্ভবত পরশু’, ভ্রন্স্কি বললেন।
‘তবে আপনারা যাব-যাব করছেন অনেকদিন থেকেই।’
‘কিন্তু এখন একেবারে স্থির’, আন্না বললেন ভ্রন্স্কির দিকে সোজাসুজি যে দৃষ্টিতে চেয়ে, তা বলছিল মিটমাটের কথা তিনি যেন স্বপ্নেও না ভাবেন।
‘হতভাগ্য ওই পেসভের জন্যে কষ্ট হয় না আপনার?’ ইয়াভিনের সাথে কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন আন্না। ‘কষ্ট হয় কি হয় না, আন্না আর্কাদিয়েভনা, ভেবে দেখি নি কখনো। আমার সমস্ত সম্পত্তি যে এখানে’, নিজের পাশ পকেট দেখালেন তিনি, ‘এখন আমি ধনী লোক; আর আজ ক্লাবে যাব, বেরোব হয়ত ভিখিরি হয়ে। আমার সাথে যে খেলতে বসে সে চায় আমাকে ন্যাংটা করে ছাড়তে, আমিও ওকে। কিন্তু আমরা লড়ছি, সেই তো আনন্দ।’
‘কিন্তু আপনি যদি বিবাহিত হতেন’, আন্না বললেন, ‘কেমন লাগত আপনার স্ত্রীর?’
ইয়াভিন হেসে উঠলেন।
‘বোঝা যাচ্ছে সেই জন্যেই আমি বিয়ে করিনি এবং কখনো করার বাসনাও নেই।’
‘আর হেলসিঙ্গফোর্স?’ কথাবার্তায় যোগ দিয়ে হাস্যময়ী আন্নার দিকে দৃষ্টিপাত করে বললেন ভ্রন্স্কি।
সে দৃষ্টি লক্ষ্য করে আন্নার মুখভাব হয়ে উঠল হঠাৎ শীতল-কঠোর। যেন তা ভ্রন্স্কিকে বলছিল : ‘কিছুই ভোলা হয়নি। সবই রয়েছে আগের মতন।’
ইয়াভিনকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘সত্যিই প্রেমে পড়েছিলেন নাকি?’
‘হে সৃষ্টিকর্তা! কতবার! কিন্তু মনে রাখবেন, একজন তাসে বসে শুধু ততটা, যাতে অভিসার-এর সময় উঠে পড়া যায়। কিন্তু আমি প্রেম নিয়ে মেতে থাকতে পারি শুধু ততটা, যাতে সন্ধ্যার জুয়ায় দেরি না হয়। সেই ব্যবস্থাই আমি করি। ‘
‘না, ও কথা আমি জিজ্ঞেস করছি না, সত্যিকারের’, হেলসিঙ্গফোর্স কথাটা বলতে চেয়েছিলেন আন্না, কিন্তু ভ্রন্স্কির উচ্চারিত কথাটা বলার ইচ্ছে হল না তাঁর।
ভোইতভ এলেন, একটা মর্দা ঘোড়া কিনছিলেন তিনি। আন্না উঠে বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
বাড়ি থেকে বেরোবার আগে ভ্রন্স্কি এলেন তাঁর কাছে। আন্না ভেবেছিলেন টেবিলে কিছু-একটা যেন খুঁজছেন এমন ভাব করবেন। কিন্তু ভান করায় লজ্জা বোধ করে সোজাসুজি তাঁর দিকে তাকালেন নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে।
‘কি আপনার চাই?’ জিজ্ঞেস করলেন ফরাসিতে।
‘গা’তে্-এর জন্যে সার্টিফিকেট। আমি ওকে বেচে দিলাম’, ভ্রন্স্কি বললেন এমন স্বরে যাতে পরিষ্কার প্রকাশ পেল : ‘বেশি কথা বলার সময় নেই আমার, কোন ফলও নেই তাতে।’
মনে মনে তিনি ভাবলেন, ‘ওর কাছে আমি তো কোন দোষ করিনি। যদি নিজেকে সে শাস্তি দিতে চায়, ওর পক্ষে তাতে আরো খারাপ’, কিন্তু বেরিয়ে যাবার সময় ওঁর মনে হল আন্না কি যেন বললেন, হঠাৎ সমবেদনায় বুক.. তাঁর মোচড় দিয়ে উঠল।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘এ্যাঁ, কি বলছ আন্না?’
‘কিছুই না’, একইরকম শীতল ও শান্ত উত্তর দিলেন তিনি।
‘কিছুই না যদি, তাহলে আরো খারাপ’, আবার শীতল হয়ে মনে মনে ভাবলেন ভ্রন্স্কি। তারপর ফিরে চলে গেলেন। বেরোবার সময় আয়নায় সান্ত্বনার দুটো কথা বলবে ওঁকে, কিন্তু কি বলবেন ভেবে উঠতে না উঠতেই পা দুটো তাঁকে বার করে আনল ঘর থেকে। সারাটা দিন তিনি কাটালেন বাড়ির বাইরে, রাতে যখন ফিরলেন। দাসী তাঁকে জানাল যে আন্না আর্কাদিয়েভনার মাথা ধরেছে, তিনি তাঁর কাছে যেতে বারণ করেছেন।
ছাব্বিশ
আজ সারাটা দিন ঝগড়াঝাটিতে কেটেছে। আগে এমন হয়নি কখনো। আজই প্রথমবার। আর এটা ঝগড়াও নয়। ভালোবাসা যে ঠাণ্ডা হয়ে আসছে এটা তার পরিষ্কার স্বীকৃতি। সার্টিফিকেটের জন্য ঘরে ঢুকে যেভাবে তিনি ওঁর দিকে তাকিয়েছিলেন, সেভাবে তাকানো চলত কি? হতাশায় বুক ওঁর ফেটে যাচ্ছে এটা চেয়ে দেখেও অমন নির্বিকার নিরুদ্বিগ্ন মুখে নীরবে চলে যাওয়া? ওঁর প্রতি প্রেম শুধু তাঁর জুড়িয়ে যায়নি, তাই নয়, তাঁকে তিনি ঘৃণা করেন কারণ ভালোবাসেন অন্য নারীকে, এটা পরিষ্কার।
আর যেসব নিষ্ঠুর কথা ভ্রন্স্কি বলেছেন তা স্মরণ করে, এবং আরো যেসব কথা তিনি স্পষ্টতই বলতে চাইছিলেন এবং বলতে পারতেন, তা কল্পনা করে আন্না ক্রমেই ক্ষিপ্ত উঠতে লাগলেন।
ভ্রন্স্কি বলতে পারতেন, ‘আমি আপনাকে ধরে রাখছি না, যেখানে খুশি আপনি যেতে পারেন। স্বামীর সাথে আপনি বিবাহবিচ্ছেদ চাইছিলেন না, সম্ভবত তাঁর কাছে ফিরবেন বলে। ফিরে যান। আপনার যদি টাকার দরকার থাকে, আমি দেব। কত রুব্ল চাই আপনার?’
রূঢ় একজন মানুষ যত নিষ্ঠুর কথা বলতে পারে, আন্নার কল্পনায় ভ্রন্স্কি তাই বললেন তাঁকে, আর সে জন্য আন্না তাঁকে ক্ষমা করলেন না, যেন কথাগুলো সত্যিই তিনি বলেছেন।
‘এই কালই কি শপথ করে সে বলেনি যে ভালোবাসে : এই ন্যায়নিষ্ঠ সৎ মানুষটা? অনেকবার কি আমি অনর্থক হতাশায় পৌঁছাইনি?’ এরপর নিজেকে জিজ্ঞেস করলেন আন্না।
উইলসনের কাছে যাবার দু’ঘণ্টা ছাড়া সারাটা দিন আন্নার কাটল এই সন্দেহে; সবই কি শেষ, নাকি মিটমাটের আশা আছে। এখুনি কি চলে যাওয়া দরকার, নাকি ওঁকে আরো একবার দেখবেন। সারা দিন ওঁর পথ চেয়ে ছিলেন আন্না, আর সন্ধ্যায় নিজের ঘরে গিয়ে তাঁর মাথা ধরেছে—দাসীকে এই কথা ওঁকে বলতে বলে দিয়ে নিজের দিক থেকে স্থির করলেন, ‘দাসীর কথা সত্ত্বেও যদি সে আসে, তার মানে এখনো সে ভালোবাসে। যদি না আসে তার মানে সব শেষ, তখন আমি ঠিক করব কি আমাকে করতে হবে! … ‘
সন্ধ্যায় আন্না শুনলেন : তাঁর গাড়ির আওয়াজ থামল, ঘণ্টা দিলেন; শুনলেন তাঁর পায়ের আওয়াজ, দাসীর সাথে কথাবার্তা, ভ্রন্স্কি যা শুনলেন তা বিশ্বাস করলেন, আর কিছু প্রশ্ন না করে চলে গেলেন নিজের ঘরে। তাহলে সব শেষ।
এবং তাঁর প্রতি ভ্রন্স্কির ভালোবাসা আবার জাগিয়ে তোলা, তাঁকে শাস্তি দেওয়া, অলক্ষ্মী তাঁর বুকে ঠাঁই নিয়ে যে লড়াই চালাচ্ছে ভ্রন্স্কির সাথে তাতে জয়লাভ করার একমাত্র উপায় হিসেবে মৃত্যু তাঁর সামনে যেন দেখা দিল পরিষ্কার, জীবন্ত মূর্তিতে।
ভজ্দ্ভিজেনস্কয়ে-তে যাওয়া আর না-যাওয়া, স্বামীর কাছ থেকে বিবাহবিচ্ছেদ পাওয়া আর না-পাওয়া – এখন সবই সমান, সবই নিষ্প্রয়োজন। প্রয়োজন শুধু একটা—ওঁকে শাস্তি দেওয়া।
আফিমের রোজকার ডোজ ঢেলে যখন তিনি ভাবলেন কেবল ওই পুরো শিশিটা খেলেই মৃত্যু হবে, জিনিসটা তখন তাঁর কাছে এত সহজ মনে হল যে আবার তৃপ্তির সাথে ভাবতে লাগলেন কিভাবে উনি যন্ত্রণা পাবেন, বিলাপ করবেন, ভালোবাসবেন তাঁর স্মৃতিকে যখন বড়ই দেরি হয়ে গেছে। চোখ মেলে বিছানায় শুয়ে শুয়ে ফুরিয়ে আসা মোমবাতির আলোয় তিনি দেখতে লাগলেন সিলিঙের ঢালাই কাজ আর স্ক্রিনের ছায়ায় ঢাকা পড়া তার একাংশ এবং পরিষ্কার দেখতে পেলেন, তিনি যখন থাকবেন না, ওঁর জন্য যখন থাকবে শুধু তাঁর স্মৃতি, তখন কি তাঁর মনে হবে। ‘এসব নিষ্ঠুর কথা আমি কি করে বলতে পেরেছিলাম?’ বলবেন তিনি, ‘ওকে কিছু না বলে কি করে আমি বেরিয়ে যেতে পেরেছিলাম ঘর থেকে? এখন সে আর নেই, চিরকালের মত সে ছেড়ে গেছে আমাদের, সে ওখানে… হঠাৎ স্ক্রিনের ছায়া দপদপিয়ে উঠে গ্রাস করে নিল গোটা ঢালাই কাজটা, গোটা সিলিঙ, অন্যান্য জায়গা থেকে অন্যান্য ছায়া এগিয়ে এল তাঁর দিকে; মুহূর্তের জন্য ছোটাছুটি করল ছায়ারা, তারপর নতুন দ্রুততায় এগিয়ে গেল, দপদপাল, একাকার হয়ে গিয়ে অন্ধকার হয়ে উঠল সব কিছু। ‘মৃত্যু!’ মনে হল আন্নার। আর এতই তাঁর আতংক হল যে অনেকক্ষণ ভেবে পেলেন না কোথায় তিনি আছেন, যে মোমবাতিটা পুড়ে নিবে গেছে, তার জায়গায় নতুন একটা জ্বালাবার জন্য কম্পিত হাতে দেশলাই খুঁজে পেলেন না অনেকক্ষণ। ‘না-না, যাই হোক শুধু বাঁচা! আমি তো ওকে ভালোবাসি, ও তো আমাকে ভালোবাসে! এমন আগেও ঘটেছে, এটাও কেটে যাবে’, আন্না বলছিলেন, টের পাচ্ছিলেন জীবনে প্রত্যাবর্তনের আনন্দাশ্রু গড়িয়ে পড়েছে তাঁর গাল বেয়ে। আর আতংকের হাত থেকে বাঁচার জন্য তাড়াতাড়ি করে গেলেন ভ্রন্স্কির কাছে।
স্টাডিতে ভ্রন্স্কি গভীর ঘুমে আচ্ছন্ন। আন্না তাঁর কাছে গিয়ে ওপর থেকে আলো ধরে বহুক্ষণ দেখলেন তাঁকে। এখন ঘুমন্ত অবস্থায় তাঁকে এতই তিনি ভালোবাসছিলেন যে কোমলতার অশ্রু বাধা মানল না; কিন্তু আন্না জানতেন যে জেগে উঠলে ভ্রন্স্কি একই রকম শীতল, নিজের সত্যতায় সজাগ দৃষ্টিতে তাকাতেন তাঁর দিকে; আর নিজের ভালোবাসার কথা বলার আগে আন্নাকে দেখাতে হবে যে তাঁর কাছে ভ্রন্স্কি কত দোষী। আন্না তাঁকে জাগালেন না, নিজের ঘরে ফিরে এসে দ্বিতীয় ডোজ আফিম খেয়ে ভোরের দিকে ঢলে পড়লেন একটা দুঃসহ অর্ধনিদ্রায়, যার ভেতর চেতনা তাঁর মিলিয়ে যাচ্ছিল না।
সকালে ভয়াবহ একটা দুঃস্বপ্ন, ভ্রন্স্কির সাথে পরিচয়ের আগেও যা তিনি একাধিকবার দেখেছেন, জাগিয়ে দিলে তাঁকে। এলোমেলো দাড়িওয়ালা এক বুড়ো লোহার ওপর ঝুঁকে পড়ে কি যেন করছে, বিড়বিড় করছে অর্থহীন ফরাসি কথা আর এই দুঃস্বপ্নটার ক্ষেত্রে বরাবরের মত (এটাই তার ভয়ংকরতা) আন্না টের পাচ্ছেন যে চাষীটা তাঁর দিকে মন দিচ্ছে না, কিন্তু লোহা নিয়ে তাঁর জন্যই ভয়ংকর কিছু-একটা করছে। ঠাণ্ডা ঘামে জেগে উঠলেন আন্না।
যখন শয্যা ত্যাগ করলেন, আগের দিনের ঘটনাগুলো কুয়াশার মত ঝাপসা মনে পড়ল তাঁর।
ঝগড়া হয়েছিল। যা হয়েছিল তা আগেও কয়েকবার ঘটেছে। আমি বলেছিলাম আমার মাথা ধরেছে, ও ঘরে ঢোকেনি। কাল আমরা চলে যাচ্ছি, তার সাথে দেখা করতে আর তৈরি হতে হবে যাত্রার জন্যে’, নিজেকে আন্না বললেন। ভ্রন্স্কি তাঁর স্টাডিতে আছেন জেনে গেলেন তাঁর কাছে। ড্রয়িং-রুম দিয়ে যাবার সময় আন্না শুনতে পেলেন দেউড়িতে একটা গাড়ি থামল। জানালা দিয়ে গাড়িটা দেখতে পেলেন তিনি, বেগুনি টুপি পরা একটি তরুণী তার ভেতর থেকে মুখ বাড়িয়ে কি যেন হুকুম করছিল ঘণ্টি দেওয়া চাপরাশিকে। হলঘরে কথাবার্তার পর কে যেন ওপরে উঠে গেল, ড্রয়িং-রুমের পাশে শোনা গেল ভ্রন্স্কির পায়ের আওয়াজ। দ্রুত পায়ে তিনি নামছিলেন সিঁড়ি দিয়ে। আন্না আবার জানালার কাছে এলেন। ভ্রন্স্কি খোলা মাথায় গাড়ি-বারান্দা দিয়ে গেলেন গাড়িটার কাছে। বেগুনি টুপি পরা তরুণী একটা লেফাফা দিল তাঁকে। ভ্রন্স্কি হেসে কি যেন তাকে বললেন। গাড়ি চলে গেল; দ্রুত সিঁড়ি দিয়ে উঠতে লাগলেন ভ্রন্স্কি।
যে কুয়াশা কেবলি বিছিয়ে যাচ্ছিল আন্নার মনে, হঠাৎ তা কেটে গেল। গতকালের অনুভূতি আরো তীক্ষ্ণ হয়ে বিধল তাঁর রুগ্ণ হৃদয়ে। এখন তিনি বুঝতে পারছিলেন না নিজেকে তিনি এত হীন করলেন কেমন করে যে সারা দিন একই বাড়িতে কাটালেন ওঁর সাথে। নিজের সিদ্ধান্ত ঘোষণার জন্য তিনি স্টাডিতে গেলেন তাঁর কাছে।
‘সরোকিনা আর তাঁর মেয়ে মায়ের কাছ থেকে টাকা আর দলিল দিয়ে গেল। কাল তা পাওয়া সম্ভব হয়নি। তোমার মাথা কেমন, ভালো?’ আন্নার মুখে অন্ধকার ‘বিজয়ের ভাব দেখতে আর বুঝতে না চেয়ে শান্তভাবে বললেন তিনি।
ঘরের মাঝখানে দাঁড়িয়ে আন্না নীরবে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে রইলেন তাঁর দিকে। ভ্রন্স্কি ওপর দিকে তাকিয়ে মুহূর্তের জন্য ভুরু কোঁচকালেন, তারপর পড়ে যেতে লাগলেন চিঠি। আন্না ধীরে ধীরে বেরিয়ে যাচ্ছিলেন ঘর থেকে। ভ্রন্স্কি তখনো তাঁকে ফেরাতে পারতেন, কিন্তু আন্না দুয়ার পর্যন্ত গেলেও তিনি চুপ করে রইলেন। শোনা যাচ্ছিল কেবল পাতা ওলটানোর খখস্ শব্দ।
‘ও হ্যাঁ’, আন্না যখন দুয়ারে পৌঁছে গেছেন, তখন উনি বললেন, ‘কাল আমরা যাচ্ছি, ঠিক তো? তাই না?
ওঁর দিকে ফিরে আন্না বললেন, ‘আপনি যাবেন, আমি না।’
‘আন্না, এভাবে চলা যায় না…’
আন্না পুনরুক্তি করলেন, ‘আপনি যাবেন, আমি না।’
‘এ যে অসহ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে!’
‘আপনি… আপনি এর জন্যে অনুতাপ করবেন’, এই বলে আন্না বেরিয়ে গেলেন ঘর থেকে।
যে মরিয়া হতাশায় কথাগুলো বলা হয়েছিল তাতে ভয় পেয়ে ভ্রন্স্কি লাফিয়ে উঠেছিলেন, ভেবেছিলেন ছুটে যাবেন তাঁর পেছনে, কিন্তু সম্বিত ফিরতে আবার বসলেন, ভুরু কোঁচকালেন দাঁতে দাঁত চেপে। এই অভদ্র, ভ্রন্স্কির তাই মনে হয়েছিল, হুমকিটা কেন জানি ক্ষেপিয়ে তুলছিল তাঁকে। ‘আমি সব রকম চেষ্টা করে দেখেছি’, ভাবলেন তিনি, ‘বাকি আছে শুধু একটা—ওর দিকে কোন মন না দেওয়া।’ তিনি তৈরি হতে লাগলেন শহরে যাওয়া এবং আবার মায়ের কাছে যাবার জন্য। দলিলে তাঁর সই নেওয়া দরকার ছিল।
স্টাডিতে এবং ডাইনিং-রুমে তাঁর পায়ের আওয়াজ শুনলেন আন্না। ড্রয়িং-রুমে তিনি থামলেন। কিন্তু আন্নার ঘরের দিকে না ফিরে তিনি শুধু এই আদেশ দিয়ে বলেন যে তিনি না থাকলেও ঘোড়া যেন দেওয়া হয় ভোইতভকে। তারপর আন্নার কানে এল গাড়ি এনে দাঁড় করাবার আওয়াজ, দরজা খুলল, আবার তিনি বেরোলেন। আবার তিনি গাড়ি-বারান্দায় ঢুকলেন, কে যেন ছুটে গেল ওপরে। এটা ওই ভুলে ফেলে আসা দস্তানার জন্য গিয়েছিল তাঁর সাজ- ভৃত্য। জানালার কাছে গেলেন আন্না, দেখতে পেলেন চোখ তুলে না চেয়েই তিনি দস্তানা নিলেন, কোচোয়ানের পিঠে হাত দিয়ে কি যেন বললেন তাকে। তারপর জানালার দিকে না তাকিয়ে গাড়িতে বসলেন তাঁর অভ্যস্ত ভঙ্গি, পায়ের ওপর পা তুলে দিয়ে তারপর দস্তানা পরে আড়ালে গেলেন।
সাতাশ
‘চলে গেল! সব শেষ!’ জানালার কাছে দাঁড়িয়ে নিজেকে বললেন আন্না আর জবাবে নিভন্ত মোমবাতির অন্ধকার আর ভয়াবহ দুঃস্বপ্নটা একসাথে মিলে হিম ত্রাসে বুক তাঁর ভরে তুলল।
‘না, এ হতে পারে না!’ ঘরটা পেরিয়ে তিনি সজোরে ঘণ্টি দিলেন। এখন একা থাকতে তাঁর এত ভয় করছিল যে চাপরাশি আসা পর্যন্ত অপেক্ষা না করে নিজেই গেলেন তার কাছে। বললেন, ‘কাউন্ট কোথায় গেছেন জেনে আসুন।’
লোকটা বলল যে কাউন্ট আস্তাবলে গেছেন।
‘হুকুম আছে যে আপনি বেরোতে চাইলে গাড়ি এখনই ফিরবে।’
‘তা বেশ। দাঁড়ান। এখনই আমি একটা চিঠি লিখে দিচ্ছি। সেটা নিয়ে মিখাইলকে পাঠান আস্তাবলে। জলদি।’
সীলমোহর করে সেটা দিলেন ভৃত্যকে।
এখন একা থাকতে ভয় হচ্ছিল তাঁর, লোকটার পিছু পিছু তিনি ঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন শিশুকক্ষে।
‘সে কি, এ যে সে নয়! কোথায় তার নীল চোখ, ভীরু-ভীরু মিষ্টি হাসি?’ গোলমেলে চিন্তায় শিশুকক্ষে যে সেরিওজাকে দেখবেন ভেবেছিলেন তার বদলে কোঁকড়া কালো-চুল, গোলগাল তাঁর মেয়েকে দেখে এই কথাটাই তাঁর মনে এসেছিল প্রথম। মেয়েটা টেবিলের কাছে বসে একরোখার মত তার ওপর সজোরে ঠুকছিল একটা ছিপি। কালো বৈঁচির মত মণিতে সে মায়ের দিকে তাকাল শূন্য দৃষ্টিতে। তিনি বেশ ভালো আছেন, কাল গ্রামে চলে যাচ্ছেন ইংরেজ মহিলাটিকে এই বলে আন্না বসলেন মেয়ের কাছে, পানির পাত্রের ছিপিটা ঘোরাতে লাগলেন তার সামনে। কিন্তু মেয়ের উচ্চ ঝমঝমে হাসি আর ভুরু তোলার ভঙ্গি এমন জীবন্ত করে মনে পড়িয়ে দিল ভ্রন্স্কিকে যে কান্না ঠেকাবার জন্য তিনি ঝট করে উঠে চলে গেলেন। ‘সত্যিই কি সব শেষ? না, এ হতে পারে না’, ভাবলেন তিনি, ‘সে ফিরে আসবে। কিন্তু সেই মেয়েটার সাথে কথা বলার পর এই হাসি, এই সজীবতার কারণ সে আমাকে বোঝাবে কি করে? না, বোঝাতে পারবে না, তাহলেও বিশ্বাস করব। বিশ্বাস না করলে আমার করার আছে শুধু একটাই, আর সেটা আমি চাই না।’
ঘড়ি দেখলেন আন্না। বারো মিনিট কেটেছে। ‘চিঠিটা সে পেয়েছে, ফিরে আসছে; আর বেশিক্ষণ নয়, দশ মিনিট… কিন্তু যদি না আসে? না, এটা হতে পারে না। আমার কান্নাভেজা চোখ ওকে দেখানো উচিত নয়। যাই, মুখ ধুয়ে আসি। আর হ্যাঁ, আজকে কি আমি চুল আঁচড়েছি, নাকি আঁচড়াইনি?’ নিজেকে প্রশ্ন করলেন তিনি, কিন্তু মনে করতে পারলেন না। চুলে হাত দিয়ে দেখলেন। ‘হ্যাঁ’, চুল আঁচড়ানো, কিন্তু কখন আঁচড়েছেন, পারলেন না সেটা মনে করতে। ‘কে এটা?’ আয়নায় আতপ্ত মুখে অদ্ভুত জ্বলজ্বলে চোখে ভীতভাবে যে তাঁর দিকে তাকিয়ে ছিল তাকে দেখে ভাবলেন তিনি; ‘আরে, এ তো আমি’, এই ভেবে শোবার ঘরে গেলেন।
‘এ যে আমি পাগল হয়ে যাচ্ছি’, এই ভেবে শোবার ঘরে গেলেন তিনি, আনুশ্কা সেখানে ঘর পরিষ্কার করছিল। ‘আনুশ্কা’, এই বলে তিনি তার দিকে তাকিয়ে থামলেন তার সামনে, কিন্তু ভেবে পেলেন না কি বলবেন পরিচারিকাকে।
‘দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার কাছে আপনি যেতে চাইছিলেন’, পরিচারিকা বলল যেন ব্যাপারটা বুঝতে পেরে।
‘দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা? হ্যাঁ, যাব।’
‘পনের মিনিট যেতে, পনের মিনিট আসতে। ও রওনা দিয়েছে, এখনই এসে পড়বে’, ঘড়ি বার করে দেখলেন আন্না; ‘কিন্তু আমাকে এ অবস্থায় ফেলে রেখে কি করে যেতে পারল সে? আমার সাথে মিটমাট না করে কিভাবে সে থাকতে পারে?’ জানালার কাছে গিয়ে তিনি তাকিয়ে রইলেন রাস্তার দিকে। এই সময়ের মধ্যে তাঁর ফেরার কথা। কিন্তু হিসাবে ভুল হতে তো পারে। আবার তিনি মনে করতে লাগলেন কখন তিনি গেছেন, গুনতে লাগলেন কত মিনিট কাটল।
যে সময় তিনি নিজের ঘড়ি মিলিয়ে দেখার জন্য বড় ঘড়িটার কাছে যাচ্ছিলেন, কে যেন এল। জানালা দিয়ে আন্না দেখলেন তাঁর গাড়ি। কিন্তু কেউ সিঁড়ি দিয়ে উঠল না। নিচে কণ্ঠস্বর শোনা গেল। যে গাড়ি নিয়ে এসেছে এটা তার গলা। আন্না গেলেন তার কাছে।
‘কাউন্টকে পাওয়া যায়নি। উনি চলে গেছেন নিজনি নভগোরদ রেল স্টেশনে।’
‘কি, কি দরকার তোমার?…’ রাঙা-মুখ ফুর্তিবাজ মিখাইলকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, চিঠিটা ফেরত দিচ্ছিল সে।
তাঁর মনে পড়ল, ‘কিন্তু চিঠিটা সে তো পায়নি।’
তিনি মিখাইলকে বললেন, ‘এই চিঠিটা নিয়েই চলে যাও গ্রামে, কাউন্টেস ভস্কায়ার কাছে, জানো তো? আর সাথে সাথেই উত্তর আনবে।’
‘আর আমি নিজে? কি আমি করব?’ ভাবলেন তিনি, ‘হ্যাঁ, আমি যাব ডল্লির কাছে। সেটা ঠিকই। নইলে পাগল হয়ে যাব। টেলিগ্রামও পাঠানো যেতে পারে।’ এবং টেলিগ্রামে তিনি লিখলেন : ‘আপনার সাথে কথা বলা দরকার, এখনই চলে আসুন।’
টেলিগ্রামটা পাঠিয়ে তিনি সাজপোশাক করতে গেলেন। টুপি মাথায় দেবার পর তিনি মুটিয়ে ওঠা আনুশ্কার শান্ত চোখের দিকে চাইলেন। তার ছোট ছোট ধূসর মায়াময় চোখে আন্নার জন্য সুস্পষ্ট সমবেদনা।
‘আনুশ্কা কি আমি করি?’ অসহায়ের মত ইজি-চেয়ারে এলিয়ে ডুকরে উঠলেন আন্না।
পরিচারিকা বলল, ‘অত অস্থির হবার কি আছে, আন্না আর্কাদিয়েভনা! এ তো ঘটেই থাকে। যান, হালকা হয়ে নিন।’
সজাগ হয়ে উঠে দাঁড়িয়ে আন্না বললেন, ‘হ্যাঁ, আমি যাব। আমি না থাকতে কোন টেলিগ্রাম এলে লোক পাঠিও দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার কাছে… না, নিজেই আমি ফিরে আসব।’
হ্যাঁ, ভেবে লাভ নেই, কিছু-একটা করা দরকার, চলে যেতে হবে, প্রধান কথা এ বাড়ি থেকে চলে যাওয়া’, বুকের ভয়ংকর ঢিপঢিপ শুনে নিজেকে বললেন তিনি, তাড়াতাড়ি করে বেরিয়ে গিয়ে গাড়িতে উঠলেন
কোচবাক্সে ওঠার আগে পিওত্র জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেতে হবে?’
‘জ্নামেন্কা, অব্লোন্স্কিদের ওখানে।’
আটাশ
আবহাওয়াটা ছিল চমৎকার। সারাটা সকাল ঝিরিঝিরি বৃষ্টি পড়েছে ঘন ঘন। কিছুক্ষণ আগে ফরসা হয়ে গেছে আকাশ। বাড়ির চাল, ফুটপাথের টালি, পাথর বাঁধানো রাস্তা, গাড়ির চাকা, চামড়া, তামা আর পেতল –সবই ঝকঝক করছিল মে মাসের রোদে। বেলা তখন তিনটা, রাস্তায় সবচেয়ে বেশি ব্যস্ততা।
ছাইরঙের ঘোড়া দুটোর দ্রুতগতিতে স্প্রিঙের ওপর গাড়িটা দুলছিল। রাস্তায় গাড়ির অবিরাম ঘর্ঘর, নির্মল হাওয়ায় দ্রুত বদলে যাচ্ছে দৃশ্য; গাড়ির কোণে বসে গত কয়েকদিনের ঘটনা বিচার করে আন্না দেখলেন যে বাড়িতে যা মনে হয়েছিল, তা থেকে অবস্থা তাঁর একেবারেই অন্যরকম। এখন মৃত্যুচিন্তা অমন ভয়াবহ আর প্রকট ঠেকল না। খোদ মৃত্যুটাই মনে হল না অনিবার্য। যে হীনতায় তিনি নেমেছিলেন, তার জন্য ধিক্কার দিলেন নিজেকে। ‘আমি ওর কাছে ক্ষমা ভিক্ষা করেছি। আমি ওর বশীভূত হয়েছি। নিজেকে দোষী বলে স্বীকার করেছি। কেন? ওকে ছাড়া কি থাকতে আমি পারি না?’ এবং ওঁকে ছাড়া কিভাবে তিনি থাকবেন সে প্রশ্নের জবাব না দিয়ে সাইনবোর্ড পড়তে লাগলেন। ‘অফিস ও গুদাম’, ‘দাঁতের ডাক্তার’। হ্যাঁ, ডল্লিকে আমি সব বলব। ভ্রন্স্কিকে সে পছন্দ করে না। লজ্জা করবে, কষ্ট হবে, কিন্তু সব বলব তাকে। আমাকে সে ভালোবাসে, ওর পরামর্শ মেনে আমি সব বলব। ভ্রন্স্কিকে সে পছন্দ করে না। লজ্জা করবে, কষ্ট হবে, কিন্তু সব বলব তাকে। আমাকে সে ভালোবাসে, ওর পরামর্শ মেনে আমি চলব। ভ্রন্স্কির অধীন হয়ে থাকব না; ওকে সর্দারি করতে দেব না আমি। ‘ফিলিপভের পাঁউ-রুটি’। লোকে বলে ওরা মাখা ময়দার তাল নিয়ে যায় পিটার্সবুর্গেও। মস্কোর পানি কি ভালো। মিতিশ্যির কুয়ো, সরুচাকলিও।’ আন্নার মনে পড়ল অনেকদিন আগে, যখন তাঁর বয়স সতের বছর, ফুফুর সাথে গিয়েছিলেন এইৎসে-সের্গিয়েস্কি মঠে। ‘তাতে আবার ঘোড়ার গাড়িতে। সে কি আমি, লাল লাল যার হাত? তখন যা সুন্দর আর আয়ত্তের বাইরে বলে মনে হত, তেমন কত জিনিস হয়ে গেছে তুচ্ছ, আর তখন যা ছিল তা আজ চিরকালের মত আয়ত্তের বাইরে চলে গেছে। তখন কি আমি বিশ্বাস করতে পারতাম যে এতটা হীনতায় নামা আমার পক্ষে সম্ভব? আমার চিঠি পেয়ে কি গর্বিত আর আত্মসন্তুষ্টই নামা আমার পক্ষে সম্ভব? আমার চিঠি পেয়ে কি গর্বিত আর আত্মসন্তুষ্টই না সে হবে! কিন্তু আমি ওকে দেখাব… কি দুর্গন্ধ এই রংটায়। সবাই কেন বাড়ি বানায় আর রং করে? ‘টুপি আর গাউন’–আন্না পড়লেন। একজন লোক তাঁর উদ্দেশে মাথা নোয়ালে। লোকটা আনুশ্কার স্বামী। মনে পড়ল ভ্রন্স্কি যা বলতেন : ‘আমাদের গলগ্রহ। আমাদের? কেন আমাদের? কি ভয়ংকর যে অতীতকে সমূলে উৎপাটন করা যায় না। উৎপাটন করা যায় না, তবে তার স্মৃতি গোপন করা যায়। আমিও গোপন করি।’ আন্নার মনে পড়ল কারেনিনের সাথে তাঁর অতীত জীবন, যা তিনি মুছে দিয়েছে স্মৃতি থেকে। ‘ডল্লি ভাববে যে আমি দ্বিতীয় স্বামীকে ত্যাগ করছি। সুতরাং নিশ্চয় অন্যায় করছি আমি আমি কি ন্যায় করতেই চাই? পার না আমি!’ বিড়বিড় করলেন আন্না আর কান্না পেল তাঁর। কিন্তু তখনই তিনি ভাবলেন মেয়ে দুটো হাসতে পারছে কি কারণে? ‘নিশ্চয় ভালোবাসার কথায়? ওরা জানে না এটা কতখানি আনন্দহীন, নীচ… বুলভার আর শিশু। তিনটা ছেলে ছুটছে গোড়া-ঘোড়া খেলায়। সেরিওজা! আমি সব হারাব কিন্তু ওকে ফিরে পাব না। হ্যাঁ, সব হারাব যদি ও না ফেরে। ও হয়ত ট্রেন ফেল করেছে, ফিরে এসেছে বাড়িতে। আবার অপমান চাইছ!’ নিজেকে বললেন তিনি; ‘না, আমি ডল্লির কাছে যাব, তাকে আমি সোজাসুজি বলব : আমি অভাগা, তাই হওয়া আমার উচিত। আমি দোষী, তাহলেও আমি অভাগা, সাহায্য কর আমাকে। এই ঘোড়া, এই গাড়ি, নিজেকেই আমার ঘৃণা হচ্ছে এই গাড়িতে—সবই ওর; কিন্তু এসব চোখে দেখার পালা এবার আমার শেষ। ‘
কিভাবে ডল্লিকে সব বললেন তা ভাবতে ভাবতে এবং ইচ্ছে করে হৃদয়কে বিষে ভরে তুলে আন্না উঠলেন সিঁড়িতে।
হলে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘বাইরের কেউ আছে?’
চাপরাশি বলল, ‘কাতেরিনা আলেক্সান্দ্রভনা লেভিনা।’
‘কিটি! সেই কিটি যার প্রেমে পড়েছিল ভ্রন্স্কি’, আন্না ভাবলেন, ‘সেই মেয়েটা যার কথা ভ্রন্স্কি স্মরণ করত ভালোবাসা নিয়ে। ওর আফসোস হচ্ছে যে, ওকে সে বিয়ে করেনি। আর আমার কথা সে স্মরণ করে বিদ্বেষভরে, আফসোস করে যে আমার সাথে সে আছে।’
আন্না যখন আসেন শিশুকে খাওয়ানো নিয়ে দুই বোনের মধ্যে তখন পরামর্শ চলছিল। আলাপে বাধা দেওয়া অতিথিকে স্বাগত করতে ডল্লি বেরিয়ে এলেন একা।
‘আরে, তুমি চলে যাওনি এখনো? আমি নিজেই তোমার কাছে যাব ভাবছিলাম’, ডল্লি বললেন, ‘আজ চিঠি পেয়েছি স্তিভার।’
‘আমরাও টেলিগ্রাম পেয়েছি’, কিটিকে দেখার জন্য এদিক-ওদিক চোখ বুলিয়ে আন্না বললেন।
‘লিখেছে, বুঝতে পারছে না কারেনিন ঠিক কি চান। তবে জবাব আদায় না করে ফিরবে না।’
‘আমি ভেবেছিলাম তোমার এখানে কেউ এসেছে। চিঠিটা পড়তে পারি?’
‘হ্যাঁ, কিটি’, অস্বস্তিভরে বললেন ডল্লি, ‘ও রয়ে গেছে শিশুকক্ষে। ভারি অসুস্থ হয়েছিল সে।’
‘শুনেছি। চিঠিটা পড়তে পারি?’
‘এখনই নিয়ে আসছি। তবে উনি প্রত্যাখ্যান করেননি; বরং উলটো, স্তিভা আশা করে আছে’, ডল্লি বললেন দোরগোড়ায় থেমে।
আন্না বললেন, ‘আমি কোন আশা করি না এবং চাই না।’
ডল্লি চলে গেলে আন্না ভাবলেন, ‘কি ব্যাপার, আমার সাথে সাক্ষাৎ কি কিটি অপমানজনক বলে মনে করে? হযত সে ঠিক। কিন্তু ঠিক হলেও নিজেই যে ভ্রন্স্কির প্রেমে পড়েছিল, তার পক্ষে এটা আমাকে দেখানো চলে না। আমি জানি যে আমার বর্তমান অবস্থায় কোন সুশীলা নারী আমার সাথে দেখা করতে পারে না। ওর জন্যে সব কিছু ত্যাগ করার সেই প্রথম মুহূর্ত থেকে এটা আমি জানি। আর কেনই বা এলাম এখানে? আমার শুধু আরো খারাপ, আরো দুঃসহ লাগছে।’ অন্য ঘর থেকে দুই বোনের কথাবার্তার শব্দ কানে এল তাঁর। ‘কি আমি এখন বলব ডল্লিকে? কিটিকে এই বলে আশ্বস্ত করব যে আমি অভাগা, তার আনুকূল্য মেনে নিচ্ছি? না, আর ডল্লিও বুঝবে না কিছু। ওকে আমার বলবারও নেই। শুধু কিটির সাক্ষাৎ এসে যায় না, সেটা ওকে দেখাতে পারলে হত।’
ডল্লি ঢুকলেন চিঠি নিয়ে। আন্না সেটা পড়ে নীরবে ফেরত দিলেন।
বললেন, ‘এসবই আমি জানি। এতে আমার কোন আগ্রহও নেই।’
‘সে কি? আমি এদিকে বরং আশা করে আছি’, ডল্লি বললেন আন্নার দিকে উৎসুক চোখে চেয়ে। আন্নাকে এমন অদ্ভূত উত্ত্যক্ত অবস্থায় তিনি আগে কখনো দেখেননি। জিজ্ঞেস করলেন, ‘কবে যাচ্ছ?’
আন্না চোখ কুঁচকে চেয়ে রইলেন সামনের দিকে, উত্তর দিলেন না।
‘কিটি আমার কাছ থেকে লুকিয়ে থাকছে যে?’ দরজার দিকে তাকিয়ে লাল হয়ে বললেন আন্না।
‘আহ্, যতসব বাজে কথা! ছেলেকে দুধ দিচ্ছে সে, ওর সব ভালো চলছিল না, আমি কিছু উপদেশ দিলাম… খুব খুশি। এখুনি সে আসবে’, অসত্য বলার অভ্যাস না থাকায় আনাড়ির মত ডল্লি বললেন, ‘হ্যাঁ, ওই তো সে।’
আন্না এসেছেন জানতে পেরে কিটি বেরোতে চাইছিল না ঘর থেকে। কিন্তু ডল্লি তাকে বুঝিয়ে রাজি করান। সমস্ত শক্তি সঞ্চয় করে কিটি এসে হাত বাড়িয়ে দিল আন্নার দিকে। কাঁপা কাঁপা গলায় বলল, ‘ভারি আনন্দ হল।’
ভ্রষ্টা এই নারীর প্রতি বিদ্বেষ এবং তাঁর প্রতি অনুকূল হবার বাসনার মধ্যে যে সংগ্রাম চলছিল তার মধ্যে, তাতে অস্বস্তি হচ্ছেল কিটির; কিন্তু আন্নার সুন্দর প্রিয়দর্শন মুখখানা দেখা মাত্র বিদ্বেষ মিলিয়ে গেল তার।
‘আমার সাথে আপনি দেখা করতে না চাইলে আমি কিন্তু অবাক হতাম না। সব কিছুতেই আমি এখন অভ্যস্ত। আপনার অসুখ করেছিল? হ্যাঁ, অন্যরকম দেখাচ্ছে আপনাকে?, আন্না বললেন।
কিটি টের পেল যে আন্না তাকে দেখছেন বিদ্বেষ নিয়ে। যে আন্না আগে তার প্রতি আনুকূল্য দেখিয়েছেন, আর এখন তিনি তার সামনে, যে অস্বস্তিকর অবস্থায় পড়ছেন, বিদ্বেষটা তারই ফল বলে ধরলে কিটি। তাঁর জন্য কষ্ট হল তার।
কিটির অসুখ, শিশুটি, স্তিভাকে নিয়ে কথাবার্তা হল ওঁদের মধ্যে, কিন্তু বোঝা গেল কোন কিছুতেই আগ্রহ নেই আন্নার।
উঠে দাঁড়িয়ে তিনি বললেন, ‘আমি এসেছিলাম তোমার কাছে বিদায় নিতে।’
‘তোমরা কবে যাচ্ছে?’
কিন্তু তার জবাব না দিয়ে আন্না ফিরলেন কিটির দিকে।
হেসে বললেন, ‘সত্যি, আপনাকে দেখতে পেলাম বলে ভারি খুশি হলাম। সবার কাছ থেকে আমি আপনার কথা কত যে শুনেছি, এমন কি আপনার স্বামীর কাছ থেকেও; উনি এসেছিলেন আমাদের ওখানে, আমার বেশ লাগল ওঁকে’, স্পষ্টতই দুরভিসন্ধি নিয়ে কথাটা যোগ করলেন আন্না। ‘এখন উনি কোথায়?
লাল হয়ে কিটি বলল, ‘উনি গ্রামে চলে গেছেন। ‘
‘আমার হয়ে অভিনন্দন জানাবেন ওঁকে, অবশ্য-অবশ্যই জানাবেন।’
আন্নার চোখের দিকে সহানুভূতির দৃষ্টিতে তাকিয়ে সরলভাবে কিটি বলল, ‘অবশ্যই জানাব।’
‘তাহলে বিদায় ডল্লি!’ ডল্লিকে চুমু খেয়ে আর কিটির করমর্দন করে তাড়াতাড়ি বেরিয়ে গেলেন আন্না।
‘সেই একই রকম, তেমনি আকর্ষণীয়, ভারি সুন্দর!’ আন্না চলে গেলে বোনকে একা পেয়ে কিটি বলল; ‘কিন্তু ওর মধ্যে করুণ কি-একটা যেন আছে! সাংঘাতিক করুণ!’
ডল্লি বললেন, ‘নাঃ, আজ সে অন্যরকম। ওকে যখন হল পর্যন্ত পৌঁছে দিই, তখন মনে হল ও বুঝি এখনই কেঁদে ফেলবে।’
ঊনত্রিশ
আন্নার মনের অবস্থা বাড়ি থেকে বেরোবার সময় যে রকম ছিল, তার চেয়েও অনেক খারাপ অবস্থায় তিনি বসলেন গাড়িতে। আগেকার যন্ত্রণার সাথে যুক্ত হল অপমান আর অস্পৃশ্যতার ছোঁয়া যা তিনি পরিষ্কার অনুভব করেছিলেন কিটির উপস্থিতিতে।
পিওত্র জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যেতে হবে? বাড়ি?’
‘হ্যাঁ, বাড়ি’, কোথায় যেতে হবে, এখন সে কথা না-ভেবেই বললেন আন্না।
‘আমার দিকে ওরা চাইছিল কেমন করে, যেন আমি একটা ভয়াবহ, দুর্বোধ্য, কৌতূহলজনক বস্তু’, দুজন পথচারীর দিকে তাকিয়ে আন্না ভাবলেন : ‘আহ্, সোৎসাহে সে কি বলতে পারে অন্যকে। নিজের যা অনুভূতি, সে কি অন্যদের বলা যায়? ডল্লিকে আমি সব বলতে চেয়েছিলাম, ভাগ্যিস বলিনি। আমার দুর্ভাগ্যে কি খুশিই না সে হত! সেটা সে চেপে রাখত অবশ্য; তবে প্রধান কথা, যে উপভোগের দরুন আমাকে সে হিংসে করে, তার জন্যে শাস্তি পেয়েছি বলে আনন্দ হত তার। কিটি, সে তো আরো খুশি হত। আমি তার ভেতরটা দেখতে পাচ্ছি! সে জানে যে ওর স্বামীর প্রতি আমার সৌজন্য ছিল সচরাচরের চেয়ে বেশি। তাই আমাকে সে ঈর্ষা করে, দেখতে পারে না। তদুপরি ঘৃণাই করে। ওর চোখে আমি দুর্নীতিপরায়ণ নারী। দুর্নীতিপরায়ণ হলে আমি ওর স্বামীকে আমার প্রেমে পড়াতে পারতাম… যদি চাইতাম। হ্যাঁ, চেয়েইছিলাম। আর এই যে আত্মসন্তুষ্ট লোকটা’, মোটা সোটা রক্তিমগণ্ড এক ভদ্রলোক সম্পর্কে তিনি ভাবলেন। ভদ্রলোক আসছিলেন উল্টো দিক থেকে, তিনি আন্নাকে পরিচিত মনে করে চকচকে টেকো মাথা থেকে চকচকে টুপিটা তুলেছিলেন, পরে ভুল বুঝতে পারেন। ‘ও ভেবেছিল আমাকে সে চেনে। অথচ দুনিয়ায় যত লোক আমাকে যতটুকু চেনে, ও চেনে ততটুকুই কম। নিজেই আমি চিনি না নিজেকে। ফরাসিরা যা বলে, আমি জানি আমার খিদে। এই তো, ওরা ওই নোংরা কুপি বরফ খেতে চাইছে। এটা ওরা নিশ্চয় জানে’, ভাবলেন উনি দুটো ছেলেকে দেখে। বরফওয়ালার কাছে দাঁড়িয়ে ছিল তারা। সে তার মাথা থেকে গামলা খুলে নিয়ে রুমালের খুঁট দিয়ে মুখের ঘাম মুছছিল। ‘আমাদের সবারই ইচ্ছে মিষ্টি, সুস্বাদু কিছু। চকোলেট না থাকলে নোংরা কুপি বরফই সই। কিটিও তাই, ভ্রন্স্কি নেই তাহলে লেভিনই সই। আর আমাকে সে ঈর্ষা করে। ঘৃণা করে আমাকে। সবাই আমরা ঘৃণা করি পরস্পরকে। আমি কিটিকে, কিটি আমাকে। এটা ঠিক কথা। ‘কেশপ্রসাধক ত্যুৎকন’। আমি ত্যুৎকিনের কাছে কেশ প্রসাধন করি …।ও এলে কথাটা আমি ওকে বলব’, ভেবে হাসলেন তিনি। কিন্তু তখনই মনে পড়ল হাসির কথা শোনাবেন এখন এমন কেউ নেই তাঁর। ‘তাছাড়া মজার বা হাসিরই কিছু নেই। সব কিছু জঘন্য। সান্ধ্যা উপাসনার ঘণ্টা বাজছে আর কি নিখুঁত করে ক্রুশ করছে বেনিয়াট! যেন কিছু বুঝি খোয়া যাবে বলে ভয় পাচ্ছে। কেন এই গির্জা, এই ঘণ্টা, এই মিথ্যা? শুধু গোপন করার জন্যে যে আমরা সবাই ঘৃণা করি পরস্পরকে, ঠিক ওই ছ্যাকড়া গাড়ির গাড়োয়ানদের মত, যারা অমন খেপে গালিগালাজ করে নিজেদের মধ্যে। ইয়াভিন বলে, সে চায় আমাকে ন্যাংটা করে ছাড়তে, আমিও ওকে। এই হল সত্যি!’
এই যেসব চিন্তায় তিনি নিজের অবস্থার কথা ভুলে গিয়েছিলেন তা ভাবতে ভাবতে তিনি এসে থামলেন নিজের বাড়ির গাড়ি-বারান্দায়। তাঁর দিকে হল-পোর্টারকে আসতে দেখেই কেবল তাঁর মনে পড়ল যে তিনি চিঠি আর টেলিগ্রাম পাঠিয়েছিলেন।
জিজ্ঞেস করলেন, ‘জবাব এসেছে?’
‘এখনই দেখছি’, হল-পোর্টার তার ডেস্কে গিয়ে টেলিগ্রামের পাতলা চৌকো একটা খাম এগিয়ে দিলে। আন্না পড়লেন : ‘দশটার আগে আসতে পারব না। ভ্রন্স্কি।’
‘আর যে লোককে পাঠানো হয়েছিল, সে ফিরেছে?’
হল-পোটার বলল, ‘এখনো ফেরেনি।’
‘তাই যদি হয়, তাহলে আমি জানি কি আমাকে করতে হবে’, আন্না বললেন নিজেকে; নিজের ভেতর অনির্দিষ্ট একটা ক্রমবর্ধমান রোষ আর প্রতিহিংসার তাগিদ অনুভব করে তিনি ছুটে গেলেন ওপরে। ‘আমি নিজেই যাব তার কাছে। চিরকালের মত ছেড়ে যাবার আগে আমি তাকে সব কিছু বলে যাব। এই লোকটার মত আর কখনো কাউকে আমি এত ঘৃণা করিনি!’ ভাবলেন তিনি। হ্যাঙ্গারে ওঁর টুপি দেখে আন্না কেঁপে উঠলেন বিতৃষ্ণায়। আন্না ভেবে দেখেননি যে ভ্রন্স্কির টেলিগ্রামটা ছিল তাঁর টেলিগ্রামের জবাব, চিঠিটা তিনি তখনো পাননি। তাঁর মনে ভেসে উঠল যে এখন তিনি শান্তভাবে মা আর সরোকিনার সাথে কথাবার্তা বলে আনন্দ পাচ্ছেন তাঁর কষ্টে। ‘হ্যাঁ, তাড়াতাড়ি যেতে হয়’, মনে মনে ভাবলেন আন্না কোথায় যাবেন না জেনেই। ভয়ংকর সেই বাড়িতে তাঁর যে অনুভূতিগুলো হয়েছে তা থেকে তাড়াতাড়ি চলে যেতে চাইছিলেন তিনি। এ বাড়ির চাকর-বাকর, দেয়ালগুলো, জিনিসপত্র—সবই তাঁর মনে ঘৃণা আর রাগের উদ্রেক করছিল, কেমন একটা চাপে পিষ্ট করছিল তাঁকে।
‘হ্যাঁ, যাওয়া দরকার রেল স্টেশনে, সেখানে যদি ও না থাকে, তাহলে ওখানেই যাব, ছিঁড়ে ফেলব ওর মুখোশ। খবরের কাগজে ট্রেনের সময়-নির্ঘণ্ট দেখলেন আন্না। সন্ধ্যা আটটা দুই মিনিটে ট্রেন ছাড়ছে। ‘হ্যাঁ, সময় আছে।’ ঘোড়া বদলে অন্য ঘোড়া জোতার হুকুম দিলেন তিনি, দিন কয়েকের জন্য যা প্রয়োজন তেমন সব জিনিসপত্র ভরতে লাগলেন ব্যাগে। তিনি জানতেন যে এখানে আর ফিরবেন না। মাথায় যত রকম পরিকল্পনা আসছিল, তার মধ্যে ঝাপসাভাবে তিনি স্থির করলেন যে স্টেশনে বা কাউন্টেসের মহালে যাই ঘটুক, নিজনি নভগোরদ রেলপথে প্রথম শহর পর্যন্ত গিয়ে তিনি সেখানে থামবেন।
টেবিলে খাবার দেওয়া ছিল; সেখানে গিয়ে রুটি আর পনীর শুঁকে তিনি নিশ্চিন্ত হলেন যে সমস্ত খাবারের গন্ধ তাঁর কাছে ন্যক্কারজনক, গাড়ি দিতে বলে বেরিয়ে গেলেন তিনি। গোটা রাস্তা জুড়ে ছায়া পড়েছে বাড়ির, সন্ধ্যাটা ঝরঝরে, রোদে তখনো উষ্ণ। তাঁর সাথে সাথে মাল নিয়ে আসছিল আনুশ্কা, গাড়িতে জিনিসপত্র রাখছিল পিওত্র আর সহিস দাঁড়িয়েছিল স্পষ্টতই বেজার হয়ে—সবাই তাঁর কাছে জঘন্য লাগছিল, তাদের কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গিতে তাঁর বিরক্ত বোধ হচ্ছিল।
‘তোমাকে আমার দরকার নেই, পিওত্র।’
‘কিন্তু টিকিট?’
আন্না বিরক্তিভরে বললেন, ‘বেশ, তোমার যা ইচ্ছে, আমার তাতে কিছু এসে যায় না।’
কোচবাক্সে উঠে পিওত্র কোমরে হাত রেখে স্টেশনে যাওয়ার জন্য হুকুম দিলেন।