এক
মস্কোয় লেভিনরা তৃতীয় মাস কাটাচ্ছেন। ওয়াকিবহাল লোকদের নির্ভুল হিসাব অনুসারে কিটির প্রসব হবার সময় পেরিয়ে গেছে অনেকদিন, কিন্তু এখনো সে অন্তঃসত্ত্বা আর দু’মাস আগের চেয়ে প্রসবের মুহূর্তটা এগিয়ে এসেছে এমন অনুমানের কোন কারণই দেখা যাচ্ছিল না। ডাক্তার, ধাত্রী, ডল্লি, কিটির মা, এবং বিশেষ করে লেভিন, আসন্নের কথা যিনি বিনা ভীতিতে ভাবতে পারতেন না, সবাই অধীর ও অস্থির হয়ে উঠলেন; শুধু কিটির নিজেকে একেবারে নিশ্চিন্ত আর সুখী বোধ হচ্ছিল।
ভবিষ্যৎ শিশু, অংশত এমন কি এখনই বদ্যমান শিশুটির জন্য নতুন যে ভালোবাসাটা জেগে উঠেছে তার ভেতর সেটা এখন পরিষ্কার অনুভব করছে কিটি, আর সানন্দে আত্মসমর্পণ করত তাতে। শুিটি এখন আর কিটির অংশমাত্র নয়, মাজে মাঝে তার থেকে স্বাধীন জীবনও যাপন করছিল। প্রায়ই সেটা বেদনাদায়ক হত কিটির পক্ষে, কিন্তু বিচিত্র এই নতুন আনন্দে খিলখিলিয়ে ওঠার ইচ্ছে হত তার।
যাদের কিটি ভালোবাসে, তারা সবাই তার কাছেই; তার জন্য সবারই এত মমতা, এত যত্ন, সব কিছুতে তাকে খুশিতে রাখার জন্যএত উদ্বেগ যে এগুলো শিগগিরই শেষ হবে এটা অনুভব না করলে এবং তা জানা না থাকলে এর চেয়ে ভালো আর সুমধুর জীবন কিটি কামনা করতে পারত না। শুধু একটা ব্যাপারে ক্ষুণ্ণ হচ্ছিল এ জীবনের মাধুর্য : যে স্বামীকে কিটি ভালোবাসত, গাঁয়ে তিনি যেমন ছিলেন, এখন যেন আর সে মানুষ নন।
গ্রামে তাঁর সৌম্য, সস্নেহ, অতিথিবৎসল আচরণ ভালো লাগত কিটির। শহরে কিন্তু তিন সব সময়ই অস্থি, সতর্ক, যেন কেউ বুঝি তাঁকে, বড় কথা কিটিকে আঘাত দেবে। গ্রামে, সেটা তাঁর নিজের জায়গা জানা থাকায় তাড়াহুড়া করতেন না কখনো, বিনা কাজে থাকতেন না। এখানে, শহরে সব সময় তিনি শশতব্যস্ত, যেন কিছুই ফসকে যেতে দিতে চান না, অথচ করবার নেই কিছু। তাঁর জন্য কষ্ট হত কিটির। কিটি জানত, অন্যের কাছে লেভিনকে করুণ দেখায় না; বরং প্রিয়তমকে লোকে মাঝে মাঝে যেমনভাবে দেখে, অন্যদের ওপর সে কি ছাপ ফেলছে পরকতীয় দৃষ্টিতে সেটা স্থির করে নেবার জন্য লোকজনের মাঝে লেভিনকে সেভাবে দেখে কিটি সভয়ে, ঈর্ষিত হয়ে লক্ষ করেছে যে তাঁর শীলতা, নারীদের প্রতি খানিকটা সেকেলে, সলজ্জ সৌজন্যে, তাঁর বলিষ্ঠ দেহে, বিশেষ করে কিটির যা মনে হয়েছিল, ব্যঞ্জনাময় মুখভাবে লেভিন শুধু করুণ তো নন-ই, বরং অতি আকর্ষণীয় একজন মানুষ। কিন্তু কিটি তাঁকে দেখত বাইরে থেকে নয়, ভেতর থেকে;
আর দেখত যে এখানে তিনি আসল মানুষ নন। এ ছাড়া কিটি অনত্যভাবে বর্ণনা করতে পারত না তাঁর অবস্থা। উনি যে শহরে থাকতে পারেন না তার জন্য কিটি মাঝে মাঝে অন্তর থেকেই ভৎর্সনা করেছে তাঁকে; মাঝে মাঝে বুঝেছে যে তৃপ্তি পেতে পারেন এমন জীবন এখানে গড়ে তোলা ওঁর পক্ষে সত্যিই কঠিন
সত্যিই তো, কি করার আছে তাঁর? তাস খেলতে তাঁর ভালো লাগে না। ক্লাবে যান না। অবলোন্স্কির মত ফুর্তিবাজ পুরুষদের সাথে মেশার মানে কি সেটা কিটি এখন জানে… তার অর্থ মদ্য পান করা এবং পানের পর কোথাও যাওয়া। এরূপ অবস্থায় পুরুষেরা কোথায় যায় সেটা বিনা আতংকে ভাবতে পারে না কিটি। সমাজে যাতায়াত করবেন? কিন্তু কিটি জানত এর জন্য দরকার তরুণী-যুবতীদের সাথে ঘনিষ্ঠতা ভালো লাগা আর সেটা সে চাইতে পারে না। তার সাথে, মায়ের সাথে, বোনেদের সাথে ঘরে বসে থাকবেন? কিন্তু বার বার একই যে আলাপ যতই প্রীতিপ্রদ আর মিষ্টি হোক—বোনেদের মধ্যে এই যে আলাপটাকে বৃদ্ধ প্রিন্স বলতেন ‘বকবকম’-সেটা লেভিনের কাছে একঘেয়ে লাগবে বলে কিটি জানত। তাহলে কতী করার রইল তাঁর? নিজের বই লেখাটা চালিয়ে যাবেন? সেটা করার চেষ্টা তিনি করেছেন, বইয়ের জন্য নোট নিতে, তথ্য জোগাড় করতে প্রথম প্রথম যেতেন গ্রন্থাগারে। কিন্তু কিটিকে তিনি যা বলেছেন, যতই তিনি কিছুই করছেন না, হাতে তাঁর সময় থাকছে ততই কম। তাছাড়া, কিটির কাছে তিনি অনুযোগ করেছেন, নিজের বইটা নিয়ে তিনি কথাবার্তা বলেছেন বড় বেশি, ফলে ভাবনাচিন্তাগুলোর মধ্যে গোলমাল হয়ে যাচ্ছে, এতে কোন আগ্রহ থাকছে না তাঁর।
শহুরে জীবনে একটা লাভ হয়েছিল এই যে এখানে তাঁদের মধ্যে ঝগড়া হয়নি কখনো। শহরের পরিস্থিতি অন্যরকম বলেই কি, নাকি এ ব্যাপারে তাঁরা দুজনেই হয়ে উঠেছেন সতর্ক আর বিচক্ষণ, শহরে ঈর্ষাঘটিত কলহের যে ভয় হয়েছিল তাঁদের, মস্কোয় তা ঘটেনি।
এদিক থেকে দুজনের পক্ষেই অতি গুরুত্বপূর্ণ একটা ব্যাপার ঘটে—ভ্রন্স্কির সাথে কিটির সাক্ষাৎ।
কিটির ধর্মমাতা, তার প্রতি বরাবর অতি স্নেহশীল বৃদ্ধা প্রিন্সেস মারিয়া বরিসভনা তাকে দেখতে চান। নিজের অবস্থার দরুন কোথাও না গেলেও পিতার সাথে কিটি যায় এই শ্রদ্ধেয়া বৃদ্ধার কাছে এবং সেখানে ভ্রন্স্কিকে দেখতে পায়।
এ সাক্ষাৎ প্রসঙ্গে কিটি নিজেকে ধিক্কার দিতে পারে কেবল এজন্য যে একদা অতি পরিচিত যে চেহারাটাকে কিটি চিনতে পারল বেসমারিক পোশাকে, অমনি নিঃশ্বাস বন্ধ হয়ে আসে তার, রক্ত চলকে উঠেছিল বুকে, টের পেল যে টকটকে রং ছড়িয়ে পড়ছে তার মুখে। কিন্তু সেটা শুধু কয়েক সেকেন্ডের জন্য। ইচ্ছা করে পিতা ভ্রন্স্কির সাথে সরবে যে আলাপ শুরু করেছিলেন, সেটা শেষ না হতেই ভ্রন্স্কির দিকে শান্তভাবে তাকাবার দরকার পড়লে কথা বলবার জন্যও কিটি পুরোপুরি তৈরি হয়ে গিয়েছিল, যেমনভাবে সে কথা বলছে মারিয়া বরিসভনার সাথে, আর সবচেয়ে বড় জিনিস, কথা বলবে সে এমনভাবে, যাতে তার কথার ক্ষীণ টান আর হাসিটা পর্যন্ত অনুমোদন করেন তার স্বামী এই মুহূর্তে যাঁর অদৃশ্য উপস্থিতি অনুভব করছিল কিটি।
কিটি কয়েকটা বাক্য বিনিময় করল ভ্রন্স্কির সাথে, রসিকতা করে তিনি যেটাকে বললেন ‘আমাদের পার্লামেন্টে’ নির্বাচন, তখন কিটি শান্তভাবে হাসলে পর্যন্ত। (হাসা প্রয়োজন ছিল এটা দেখাবার জন্য যে রসিকতাটা কিটি বুঝেছে। কিন্তু সাথে সাথেই সে মুখ ফেরায় প্রিন্সেস মারিয়া বরিসভনার দিকে আর বিদায় নিয়ে ভ্রনস্কি উঠে না দাঁড়ানো পর্যন্ত আর একবারও তাকায়নি তাঁর দিকে; তখন সে তাকায় স্পষ্টতই শুধু এজন্য যে লোকটা যখন তার উদ্দেশে মাথা নোয়াচ্ছে তখন তার দিকে না তাকানো অশোভন।
ভ্রন্স্কির সাথে সাক্ষাৎ নিয়ে পিতা কোন কথা বললেন না বলে কিটি তাঁর প্রতি কৃতজ্ঞ। কিন্তু মারিয়া বরিসভনার ওখানে খবরাখবরের পর হেটে বেড়ানোর সময় কিটির প্রতি বাবার অতি সস্নেহ মনোভাব দেখে কিটি বুঝল যে তিনি তার ব্যবহারে সন্তুষ্ট। নিজেই সে খুশি হয়েছিল নিজের ওপর। ভ্রন্স্কি সম্পর্কে তার আগেকার হৃদয়াবেগের সমস্ত স্মৃতি প্রাণের কোন গভীরে অবরুদ্ধ করে শুধু দেখাবার জন্য নয়, সত্যি সত্যিই তাঁর সম্পর্কে পুরোপুরি নির্বিকার আর অচঞ্চল হতে পারার মত শক্তি সে পাবে, এটা কিটি আশাই করেনি।
কিটি যখন বলল যে প্রিন্সেস মারিয়া বরিসভনার ওখানে তার দেখা হয়েছে ভ্রন্স্কির সাথে, লেভিন তখন লাল হয়ে ওঠেন কিটির চেয়েও বেশি। লেভিনকে কথাটা বলা খুবই কঠিন ছিল কিটির পক্ষে, কিন্তু আরো কঠিন হল সাক্ষাতের খুঁটিনাটি বিবরণ দেওয়া। কেননা কিছু জিজ্ঞেস করছিলেন না লেভিন, শুধু ভুরু কুঁচকে তাকিয়ে ছিলেন কিটির দিকে।
‘আমার খুবই আফসোস হচ্ছে যে তুমি ছিলে না’, কিটি বলল, ‘ঘরেই যে থাকতে হত এমন নয়… তুমি থাকলে অত স্বাভাবিক আমি হতে পারতাম না…তখনকার চেয়ে আমি এখন লাল হয়ে উঠছি অনেক অনেক বেশি’, কিটি বলল চোখ ফেটে পানি বেরোবার মত লাল হয়ে : কিন্তু একটা ফাটল দিয়েও তুমি যে দেখতে পেলে না।’
কিটির অকপট চোখ লেভিনকে বলল যে কিটি নিজের আচরণে সন্তুষ্ট, এবং এখন সে লাল হয়ে ওঠা সত্ত্বেও লেভিন শান্ত হয়েগিয়ে প্রশ্ন করতে শুরু করলেন আর শুধু এটাই চাইছিল কিটি। লেভিন যখন সমস্ত কিছু জানলেন, এমন কি শুধু প্রথম মুহূর্তেই যে কিটি রাঙা না হয়ে উঠে পারেনি, কিন্তু তারপর যে তার কাছে প্রথম পরিচিতের সাথে সাক্ষাতের মতই ব্যাপারটা সহজ আর অনায়াস লেগেছিল, জানলেন এসব খুটিনাটি পর্যন্ত, তখন আহমাদে একেবারে আটখানা হয়ে উঠলেন লেভিন, বললেন যে ব্যাপারটায় তিনি খুবই খুশি, এবার ভ্রন্স্কির সাথে তাঁর দেখা হবার প্রথম সুযোগেই তিনি যথাসম্ভব বন্ধর মত ব্যবহার করবেন, নির্বাচনে যে বৃঢ়তা দেখিয়েছিলেন, তা করবেন না।
‘এমন লোক আছে, প্রায় শত্রুই বলা চলে, তবু তার সাথে সাক্ষাৎ আমার কাছে দুর্বিষহ হওয়া সম্ভব ভাবতেই কষ্ট লাগে’, লেভিন বললেন; ‘আমার ভারি, ভারি আনন্দ হল।’
দুই
কিটি স্বামীকে বলল, ‘বলদের ওখানে যেও লক্ষ্মীটি’, যখন বাড়ি থেকে বেরোবার আগে তিনি বেলা এগারোটায় এলেন কিটির কাছে; ‘আমি জানি তুমি সন্ধেয় খাবে ক্লাবে, বাবা তোমার নাম লিখিয়ে রেখেছে। কিন্তু দিনের বেলাটা কি করবে?’
‘আমি শুধু কাতাভাসোভের কাছে যাব’, লেভিন বললেন।
‘এত আগে গিয়ে কি হবে?’
‘মেত্রভের সাথে আমার পরিচয় করিয়ে দেবে বলেছে। পিটার্সবুর্গের এই নামজাদা অর্থনীতিবিদের সাথে নিজের বইটা নিয়ে কথা বলার ইচ্ছে আছে আমার’, লেভিন বললেন।
‘প্রশংসায় তুমি পঞ্চমুখ হয়েছিলে এরই প্রবন্ধ নিয়ে? বেশ, তারপর?’ জিজ্ঞেস করল কিটি।
‘সম্ভবত আদালতে যাব আমার বোনের ব্যাপারটা নিয়ে।’
‘আর কনসার্টে যাবে না? জিজ্ঞেস করল কিটি
‘আমি একা গিয়ে কি হবে!’
‘না-না, যেও; নতুন নতুন জিনিস পরিবেশন করছে ওরা…তোমার তাতে ভারি আগ্রহ ছিল। আমি হলে অবশ্যই যেতাম।’
‘অন্তত বাড়ি ফিরব ডিনারের আগে’, ঘড়ি দেখে বললেন লেভিন। কাছে। ‘
‘যাওয়ার বড়ই দরকার আছে কি?’
‘অবশ্য-অবশ্যই দরকার! কাউন্ট আমাদের এখানে এসেছিলেন। কি এমন কষ্ট? যাবে বসবে, মিনিট পাঁচেক আলাপ করবে আবহাওয়া নিয়ে, তারপর উঠে দাঁড়াবে, চলে আসবে।’
‘কিন্তু তোমার বিশ্বাস হবে না যে এতে আমি অনভ্যস্ত হয়ে পড়েছি, এতে আমার লজ্জাই লাগছে। কি করে এটা হয়? এল বাইরের একজন লোক, বসলে, বিনা কাজে সময় কাটাল, ওঁদের বিরক্ত করলে, নিজের বিছ্ছিরি লাগল, তারপর উঠে চলে গেল।’
হেসে উঠল কিটি। বলল, ‘যখন অবিবাহিত ছিলে, তখন তুমিও কি লোকদের বাড়ি যেতে না?’
‘যেতাম, কিন্তু সব সময়ই লজ্জা হত। আর এখন অনভ্যস্ত হয়ে যাবার পর সৃষ্টিকর্তার দিব্যি, ও বাড়িতে যাবার চেয়ে বরং দু’দিন উপোস দেব। এত লজ্জা করে! আমার কেবলি মনে হচ্ছে ওঁরা বিরক্ত হবেন। বলবেন : বিনা কাজে কেন এলে বাছা?
‘না, বিরক্ত হবেন না। এ আমি তোমাকে কথা দিচ্ছি’, হেসে তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে কিটি বলল; হাতটা টেনে নিলে তাঁর, ‘নাও এসো এখন… যেও কিন্তু লক্ষ্মীটি।
স্ত্রীর করচুম্বন করে যাওয়ার উপক্রম করতেই কিটি থামাল লেভিনকে।
‘জানো কস্তিয়া, আমার কাছে আছে আর মাত্র পঞ্চাশ রুল।’
‘তা বেশ, ব্যাংকে যাব। কত তুলব?’ লেভিন বললেন কিটির কাছে পরিচিত তাঁর অসন্তোষের মুখভাব নিয়ে।
‘না-না, দাঁড়াও’, হাত ধরে তাঁকে থামাল কিটি; ‘ব্যাপারটা নিয়ে কথা বলা যাক, আমার দুশ্চিন্তা হয়। মনে হয় আমি অনাবশ্যক কিছু খরচ করছি না, অথচ টাকা উড়ে যাচ্ছে। উচিতমত কিছু-একটা যেন করছি না আমরা।’
‘সব ঠিক করছি’, গলা খাঁকারি দিয়ে ভুরুর তল থেকে কিটির দিকে তাকিয়ে লেভিন বললেন।
এই গলা খাঁকারিটা কিটির জানা। এ হল কিটির ওপর নয়, তাঁর নিজের ওপরেই তীব্র অসন্তোষের লক্ষণ। সত্যিই অসন্তুষ্ট হয়েছিলেন তিনি, অনেক টাকা খরচ হয়েছে বলে নয়, এজন্য যে তাঁকে মনে করিয়ে দেওয়া হল যে কিছু- একটা গোলামাল আছে জেনেও তিনি সেটা ভুলতে চাইছেন।
‘সকোলোভকে আমি বলেছি গম বিক্রি করে দিতে আর অগ্রিম টাকা নিতে মিলের জন্যে। যতই হোক টাকাথাকবে।’
‘না, আমার ভয় হচ্ছে যে অনেক বেশি…’
‘মোটেই না, মোটেই না’, পুনরাবৃত্তি করলেন লেভিন, ‘তাহলে আসি আমার আদরিণী।’
‘না, সত্যি, মায়ের কথা শুনেছি বলে মাঝে মাঝে আফসোস হয় আমার। দিব্যি ছিলাম গ্রামে! আর এখন তোমাদের সবাইকে জ্বালাচ্ছি, টাকারও শ্রাদ্ধ…’
‘মোটেই না, মোটেই না। আমি বিয়ে করার পর থেকে একবারও ভাবি নি এখন যা, অন্যকিছু তার চেয়ে ভালো হতে পারত…’
‘সত্যি?’ লেভিনের চোখের দিকে তাকিয়ে কিটি জিজ্ঞেস করল।
লেভিন কথাটা বলেছিলেন ভেবেচিন্তে নয়, শুধু কিটিকে প্রবোধ দেবার জন্য। কিন্তু লেভিন যখন দেখলেন যে কিটির অকপট মধুর চোখ দুটো সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে তাঁর দিকে নিবদ্ধ, তখন আবার তিনি একই কথা বললেন, কিন্তু এবার গোটা অন্তর থেকে। ‘সত্যি, ওর অবস্থাটা আমি বড় ভুলে যাই, ভাবলেন লেভিন। গিগিরই তাঁদের কি ঘটতে যাচ্ছে, সেটা মনে পড়ল তাঁর।
‘কিন্তু শিগগিরই কি? তাই মনে হচ্ছে তোমার?’ কিটির দুই হাত ধরে ফিসফিসিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘কতবার ও নিয়ে ভেবেছি, কিন্তু এখন আর ভাবি না, কিছুই জানি না আমি।’
‘ভয় করে না?’
অবজ্ঞায় মুচকি হাসল কিটি।
বলল, ‘এক বিন্দুও না।’
‘তাহলে যদি কিছু ঘটে, জানিও, আমি থাকব কাতাভাসোভের ওখানে ‘
‘কিছুই ঘটবে না আর ও সব চিন্তাকেও ঠাঁই দিও না মনে। আমি বাবার সোথে বেড়াতে যাব বুলভারে। তারপর যাব ডল্লির কাছে। ডিনারের আগে এসো, অপেক্ষা করে থাকব। আর হ্যাঁ, জানো, ডল্লির অবস্থা হয়ে দাঁড়াচ্ছে একেবারে নিরুপায়। দেনায় আকণ্ঠ ডুবে আছে, টাকা নেই। গতকাল মা আর আমি আর্সেনির সাথে কথা বলেছি’ (কিটির আরেক বোন নাটালি ভভার স্বামীকে সে এই নামে ডাকত), ‘ঠিক করেছি তুমি আর আর্সেনি দুজনে মিলে স্তিভার পেছনে লাগবে। ব্যাপারটা একেবারে অসহ্য হয়ে দাঁড়াচ্ছে। বাবার কাছে এসব কথা তোলাই যায় না… কিন্তু তুমি আর ও যদি …’
‘কিন্তু কি আমরা করতে পারি?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
‘তাহলেও তুমি যেও আর্সেনির কাছে, কথা বলো, সে তোমাকে জানাবে কি আমরা স্থির করেছি।’
‘আর্সেনি যা বলবেন, আমি আগেভাগেই তার সবেতেই রাজি। বেশ, যাব ওঁর কাছে। ভালো কথা, যদি কনসার্টে যাই নাটালির সাথেই যাব। তাহলে আসি।’
অলিন্দে লেভিনের।বিবাহিত জীবনের সময় থেকে পুরানো চকর কুজ্মা, এখন শহরে গৃহস্থালির সরকার, তাঁকে থামালে।
বলল, ‘সুন্দরীকে’ (এটি হল গ্রাম থেকে আনা বাঁয়ে জোতার ঘোড়া) ‘আবার নাল পরানো হয়েছে, তাহলেও খোঁড়াচ্ছে। কি আজ্ঞা করেন?
মস্কোয় এসে প্রথম দিকটা লেভিন ব্যস্ত থাকেন গ্রাম থেকে আনা ঘোড়াদের নিয়ে। ভেবেছিলেন কম খরচে এদিকটার একটা ভালো ব্যবস্থ করবেন; কিন্তু দেখা গেল, ছ্যাকড়া গাড়ির চেয়ে তাঁর ঘোড়াদের পেছনে খরচা বেশি আর তাহলেও ছ্যাকড়া গাড়ি নিতে হচ্ছে।
‘ঘোড়ার বদ্যিকে ডেকে পাঠাও, বোধ হয়কড়া পেকে উঠেছে।’
‘আর কাতেরিনা আলেক্সান্দ্রভনার জন্যে কি ব্যবস্থা?’ জিজ্ঞেস করল কুজ্মা।
মস্কো জীবনের প্রথম দিকে ভজ্দভিজেন্কা স্ট্রিট থেকে সিসেভ ভ্রাজেক পর্যন্ত যেতে ভারি একটা জুড়ি গাড়িতে যে জুড়তে হত দুটো তাগড়াই ঘোড়া আর পোয়াটেক ভার্স্ট গিয়ে চার ঘণ্টা দাঁড়িয়ে থাকার জন্য দিতে হত পাঁচ রুল, এটা আর লেভিনকে অবাক করে না। এখন এটা তাঁর কাছে মনে হচ্ছে স্বাভাবিক।
বললেন, ‘ভাড়াটে গাড়ির গাড়োয়ানকে বলো দুটো ঘোড়া আমাদের গাড়ির সাথে জুততে।’
‘জ্বি আচ্ছা।’
যে সমস্যা মেটাতে গ্রামে প্রচুর ব্যক্তিগত মেহনত ও মনোযোগ দরকার হত, শহুরে সবিধের কল্যাণে এত সহজে আর অনায়াসে তার ফয়সালা করে দিয়ে লেভিন বেরিয়ে এলেন অলিন্দে, একটা ভাড়াটে গাড়ি ডেকে চললেন নিকিস্কায়ায়। গাড়িতে উঠে তিনি আর টাকার কথা ভাবছিলেন না, পিটার্সবুর্গের যে জ্ঞানী ব্যক্তিটি সমাজবিদ্যা নিয়ে কাজ করছেন, কেমন করে তাঁর সাথে পরিচয় করবেন, নিজের বই সম্পর্কে কি তিনি বলবেন তাঁকে এই নিয়েই চিন্তা করছিলেন।
মস্কোয় এসে গ্রামবাসীর কাছে দুর্বোধ্য যে অনুৎপাদক কিন্তু অপরিহার্য খরচাগুলো চারদিক থেকে দাবি করা হচ্ছিল তাঁর কাছে, সেটা লেভিনকে হতবাক করেছিল শুধু গোড়ার দিকেই। কিন্তু এখন তাতে তিনি অভ্যস্ত। এ ব্যাপারে তাঁর তাই ঘটেছিল, যা মাতালের ক্ষেত্রে ঘটে থাকে বলে জনশ্রুতি আছে: প্রথম পাতত্র—গোঁজ গেলা, দ্বিতীয় সরগর, তৃতীয়—ফুরফুরে পাখি। লেভিন যখন তাঁর প্রথম একশ’ রুলের নোট ভাঙান পরিচারকদের চাপরাশ কেনার জন্য, তখন তাঁর মনে না হয়ে পারেনি যে নিতান্ত নিষ্প্রয়োজন কিন্তু নিশ্চয়ই অপরিহার্য (এগুলো ছাড়াই চলতে পারে এমন ইঙ্গিত করায় প্রিন্সেস আর কিটি যেরকম থ’ হয়ে গিয়েছিলেন তা থেকে মনে হয়) এই চাপরাশগুলোর দামে ভাড়া করা যেত দুজন গ্রীষ্মকালীন মজুর, অর্থাৎ ইস্টার থেকে মিকেলমাস পর্যন্ত তিনশ’ শ্রমদিন, আর প্রতিটি দিনেই ভোর থেকে সাঁঝ পর্যন্ত হাড়ভাঙা খাটুনি। একশ’ রুলের প্রথম এই নোটটা ছিল গোঁজ গেলা। আত্মীয়দের জন্য ডিনার উপলক্ষে আটাশ রুব্ল মূল্যের খাদ্যদি কেনার জন্য দ্বিতীয় যে নোটটা ভাঙান সেটা অনেকটা সহজ হয়েছিল, যদিও লেভিনের মনে পড়েছিল যে এই আটাশ রুলটা হল কেটে তোলা, আঁটি বাঁধা, ঝাড়াই করা, খোসা ঝরানো, চালুনি দিয়ে ঝেড়ে তুলে রাখা আড়াই পুদ ওটের সমান। আর এখন নোট ভাঙাতে গিয়ে বহুদিন ও সব কথা আর লেভিনের মনে হয় না, ফুরফুরে পাখির মত তারা উড়ে যায়। অর্থোপার্জনে যে শ্রম লগ্নি করা হয়েছে, সেটা তদ্বারা ক্রীত জিনিসগুলো থেকে পাওয়া পরিতৃপ্তির সমানুপাতিক কিনা, এ খুঁতখুঁতি উবে গেছে বহুদিন। বিশেষ একটা শস্য নির্দিষ্ট একটা দরের নিচে বেচা হবে না, এই হিসেবিআনাও লেভিন ভূলে গেলেন। রাইয়ের দাম লেভিন ধরে রেখেছিলেন অনেকদিন তা বিক্রি হল একমাস আগে লোকে যা দিতে চাইছিল, তার চেয়ে সিকি পুদ পিছু পঞ্চাশ কোপেক কমে। এরকম খরচে দেনা না করে বছর কাটবে না, এ হিসাবটারও গুরুত্ব রইল না কোন। দরকার ছিল একটা জিনিসের—যেখান থেকেই তা আসুক না কেনা যাবে মাংস। এই নিয়মটা এতদিনও মেনে আসা হচ্ছিল, ব্যাংকে সব সময়ই টাকা থাকত লেভিনের। কিন্তু এখন ব্যাংকের টাকাও ফুরিয়ে গেল আর লেভিন ঠিক জানতেন না কোত্থেকে তা পাওয়া যায়। কিটি যখন টাকার কথা মনে করিয়েদেয়, তখন এই ব্যাপারটাই মুহূর্তের জন্য বিচলিত করেছিল তাঁকে। কিন্তু তা নিয়ে মাথা ঘামাবার সময় নেই এখ। উনি চললেন মেত্রভের সাথে আসন্ন পরিচয় আর কাতাভাসোভের কাথা ভাবতে ভাবতে।
তিন
মস্কোয় এবারের সফরে লেভিন আবার ঘনিষ্ঠ হয়ে ওঠেন বিশ্ববিদ্যালয়ে তাঁর ভূতপূর্ব সতীর্থ প্রফেসার কাতাভাসোভের সাথে, বিয়ের পর থেকে তাঁর সাথে লেভিনের দেখা হয়নি। কাতাভাসোভকে লেভিনের ভালো লাগত তাঁর বিশ্বদৃষ্টির স্বচ্ছতা ও সহাজতার জন্য। লেভিন ভাবতেন যে কাতাভাসোভের দৃষ্টিভঙ্গির স্বচ্ছতা আসছে তাঁর স্বভাবের দীনতা থেকে। ওদিকে কাতাভাসোভ মনে করতেন যে লেভিনের চিন্তায় অসঙ্গতিটা আসছে তাঁর অপরিশীলিত মনন থেকে; কিন্তু কাতাভাসোভের স্বচ্ছতাটা লেভিনের ভালে লাগত আর কাতাভাসোভের ভালো লাগত লেভিনের চিন্তায় অসঙ্গতির প্রাচুর্য; তাই দেখা সাক্ষাৎ করে পরস্পর তর্ক করতে বেশ লাগত তাঁদের।
লেভিন তাঁর রচনার কিছু অংশ পড়ে শোনান কাতাভাসোভকে, সেটা তাঁর ভালো লেগেছি। গত কাল সাধারণ বক্তৃতায় লেভিনের সাথে দেখা হয় তাঁর। কাতাভাসোভ তাঁকে বলেন যে খ্যাতনামা মেত্রভ, যাঁর প্রবন্ধ লেভিনের অত ভালো লেগেছিল, তিনি এখন মস্কোয়। লেভিনের কাজ সম্পর্কে মেত্রভকে তিনি যা বলেছেন তাতে তিনি খুব আগ্রহী হয়ে উঠেছেন, পরের দিন মেত্রভ ওঁর ওখানে আসবেন বেলা এগারোটায়, লেভিনের সাথে পরিচিত হতে পারলে খুবই আনন্দিত হবেন।
‘সত্যিই বদলাচ্ছ ভায়া, দেখেও আনন্দ হয়’, ছোট ড্রয়িং-রুমটায় লেভিনকে স্বাগত করে বললেন কাতাভাসোভ; ‘ঘণ্টি শুনে ভাবলাম, ঠিক সময়ে এসেছে, হতেই পারে না… কিন্তু কেমন দেখালে মন্টেনেগ্রীনরা? জাত যোদ্ধা।’
‘কিন্তু কি হয়েছে?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।
সংক্ষেপে শেষসংবাদ জানিয়ে কাতাভাসোভ ঢুকলেন স্টাডিতে, অনতিদীর্ঘ, গাট্টাগোট্টা এক ভদ্রলোকের সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন লেভিনের। চেহারাটা তাঁর ভারি সুশ্রী। ইনিই মেত্রভ। কিছুক্ষণ আলোচনা চলল রাজনীতি নিয়ে, সাম্প্রতিক ঘটনাগুলোকে পিটার্সবুর্গ সর্বোচ্চ মহল কে কি চোখে দেখছেন সেই বিষয়ে। এই উপলক্ষে জার এবং জনৈক মন্ত্রী কি বলেছেন, সেটা তিনি জানালেন বিশ্বস্ত সূত্র থেকে শুনেছেন যে জার বলেছেন একেবারেই অন্য কথা। এমন একটা অবস্থা লেভিন কল্পনা করার চেষ্টা করলেন যাতে দুটো উক্তিই সম্ভব হতে পারে এবং আলাপটা থেমে গেল।
‘হ্যাঁ, জমির সাথে সম্পর্কে শ্রমিকের প্রাকৃতিক পরিস্থিতি নিয়ে বইটা উনি প্রায় শেষ করে এনেছেন’, বললেন কাতাভাসোভ; আমি অবশ্য বিশেষজ্ঞ নই, কিন্তু প্রকৃতিবিদ হিসেবে আমার ভালো লেগেছে যে মানুষকে তিনি দেখেছেন জীবজগতের নিয়মগুলির বহির্ভূত করে নয়, পক্ষান্তরে তাকে দেখেছেন পরিবেশের ওপর নির্ভরশীল আর এই নির্ভরশীলতা থেকে খুঁজেছেন বিকাশের নিয়ম।’
‘খুবই মনোগ্রাহী’, শ্রমিকদের প্রশ্ন নিয়ে খাটতে গিয়ে’, লাল হয়ে লেভিন বললেন, ‘পৌঁছলাম একেবারে অপ্রত্যাশিত সিদ্ধান্তে।’
এই বলে লেভিন সাবধানে, যেন পায়ের নিচে মাটি যাচাই করে পেশ করলেন তাঁর দৃষ্টিভঙ্গি। তিনি জানতেন যে চালু রাজনৈতিক-অর্থনৈতিক মতবাদের বিরুদ্ধে প্রবন্ধ লিখেছেন মেত্রভ, কিন্তু নিজের নতুন দৃষ্টিভঙ্গিতে তাঁর সহানুভূতি কতদূর পর্যন্ত আশা করা যেতে পারে, সেটা তিনি জানতেন না, আর তা অনুমান করাও সম্ভব ছিল না বিজ্ঞানীর ধীমান প্রশান্ত মুখ দেখে।
‘কিন্তু রুশ কৃষি-শ্রমিকের বৈশিষ্ট্য আপনি দেখছেন কিসে?’ বললেন মেত্রভ, ‘সেটা কি তার বলা যাক, জীবজাগতিক স্বাতন্ত্র্যে নাকি যে পরিস্থিতিতে সে রয়েছে তা শর্তে?’
লেভিন দেখতে পেলেন যে প্রশ্নটার মধ্য দিয়ে এমন একটা মতামত প্রকাশ পাচ্ছে যা তিনি মানেন না। কিন্তু ভূমির প্রতি রুশু কৃষি-শ্রমিকের মনোভাব যে অন্যান্য জাতির চেয়ে একেবারেই ভিন্ন, এই চিন্তাটা তিনি উপস্থিত করে গেলেন। আর এই কথাটা প্রমাণ করার জন্য তাড়াতাড়ি করে যোগ দিলেন যে তাঁর মতে রুশ কৃষকের এই মনোভাব আসছে তার এই চেতনা থেকে যে পুবের বিশাল অনধিকৃত জমিকে অধ্যুষিত করা তার কাজ।
বাধা দিয়ে মেত্রভ বললেন, ‘একটা জাতির সাধারণ কাজ সম্পর্কে সিদ্ধান্ত টানতে গিয়ে সহজেই বিভ্রান্তির মধ্যে গিয়ে পড়া সম্ভব। শ্রমিকের অবস্থা সব সময়ই নির্ভর করবে জমি আর পুঁজির সাথে তার সম্পর্কের ওপর।’
এবং লেভিনকে তাঁর বক্তব্য শেষ করতে না দিয়ে মেত্রভ তাঁর নিজের মতবাদের বৈশিষ্ট্য বোঝাতে লাগলেন।
তাঁর মতবাদের বৈশিষ্ট্য কিসে সেটা লেভিন বুঝলেন না। কেননা কষ্ট স্বীকার করলেন না বোঝার। তিনি দেখতে পাচ্ছিলেন যে অর্থনীতিবিদদের মতবাদ খণ্ডন করে তিনি যে প্রবন্ধ লিখেছেন তা সত্ত্বেও আর সবার মতই তিনিও রুশ কৃষি-শ্রমিকের অবস্থাটা দেখছিলেন পুঁজি, মজুরি আর খাজনার দৃষ্টিকোণ থেকে। যদিও ওঁর স্বীকার করার কথা যে রাশিয়ার সবচেয়ে বৃহদংশের, পূর্বাঞ্চলের জমিতে খাজনা এখনো শূন্য, আট কোটি রুশ অধিবাসীর দশের নয় অংশের কাছে মজুরি প্রকাশ পাচ্ছে নিজেরা খেয়ে বেঁচে থাকায়, আর আদিম হাতিয়ার হিসেবে ছাড়া অন্য কোন রূপে পুঁজি এখনো নেই, তাহলেও তিনি শুধু ওই দৃষ্টিভঙ্গি থেকেই সমস্ত রুশ কৃষি-শ্রমিককে দেখছিলেন, যদিও অনেক ব্যাপারেই তিনি অর্থনীতিবিদদের সাথে একমত নন, মজুরি সম্পর্কে তাঁর নিজের নতুন একটা তত্ত্ব আছে আর সেটা তিনি বোঝাচ্ছিলেন লেভিনকে।
লেভিন শুনলেন অনিচ্ছাসহকারে, প্রথম দিকে আপত্তিও করেছিলেন। তাঁর ইচ্ছা হয়েছিল মেত্রভের কথায় বাধা দিয়ে নিজের মতামতটা বলে দেন যাতে বেশি বাক্যব্যয় হয়ে পড়ে নিষ্প্রয়োজন। কিন্তু যখন নিঃসন্দেহ হলেন যে ব্যাপারটা তাঁরা এতই ভিন্ন দৃষ্টিতে দেখছেন যে কেউ কাউকে বুঝবেন না কদাচ, তখন তিনি আপত্তি করায় ক্ষান্ত হলেন, এবং শুধুই শুনে গেলেন। মেত্রভ যা বলছিলেন তাতে এখন তাঁর কোনেই আগ্রহ না থাকলেও তাঁর কথায় তৃপ্তিও পাচ্ছিলেন খানিকটা। এমন একজন বিদ্বান ব্যক্তি এত আগ্রহে, এত মনোযোগের সাথে, বিষয়টা যে লেভিন বোঝেন এই আস্থা নিয়ে, শুধু এক একটা ইঙ্গিতেই গোটা দিকটা বুঝিয়ে তিনি যে তাঁর বক্তব্য বলে যাচ্ছিলেন, তাতে লেভিনের আত্মাভিমান পুলকিত হচ্ছিল। এটা তিনি নিজের যোগ্যতা বলে ধরেছিলেন, জানতেন না যে নিজের বন্ধবান্ধবদের কাছে নিজের বক্তব্য বহুবার বলার পর মেত্রভ নতুন কোন লোক পেলেই বিষয়টা বোঝাতে চাইতেন সাগ্রহে, আর তাঁর নিজের কাছেই যে জিনিসটা অপরিষ্কার সোৎসাহে বলতেন তা নিয়ে।
‘আমাদের কিন্তু দেরি হয়ে যাচ্ছে’, মেত্রভ তাঁর বক্তব্য শেষ করতেই ঘড়ি দেখে বললেন কাতাভাসোভ।
লেভিনের প্রশ্নের জবাবে কাতাভাসোভ জানালেন, ‘হ্যাঁ, আমাদের অপেশাদার সমিতির আজকের অধিবেশনটা স্নিতিচের মৃত্যুর পঞ্চাশত্তম বার্ষিকী নিয়ে। পিওত্র ইভানোভিচের সাথে আমরা যাব ঠিক করেছি। প্রাণিবিজ্ঞান নিয়ে ওঁর যা কাজ, তার ওপর একটা নিবন্ধ পড়ব আমি। চলো যাই, খুব মনোজ্ঞ অনুষ্ঠান।
‘হ্যাঁ, সত্যিই সময় হয়ে গেছে’, বললেন মেত্রভ, ‘চলুন আমাদের সাথে, তারপর ওখান থেকে সুবিধা হলে, আমার বাসায়। আমার ভারি ইচ্ছে, আপনার রচনাটা আপনি পড়ে শোনান।’
‘না-না, কি বলছেন। এটা যে এখনো শেষ হয়নি। তবে অধিবেশনে যাব খুশি হয়েই।’
‘ওহে শুনেছেন? আলাদা আলাদা প্রস্তাব পেশ করা হয়েছে’, পাশের ঘরে ফ্রক-কোট পরতে পরতে বললেন কাতাভাসোভ।
শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা।
এই শীতে মস্কোয় বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্নটা হয়ে ওঠে খুবই গুরুত্বপূর্ণ। পরিষদে তিনজন প্রবীণ প্রফেসার নবীনদের মতামত অগ্রাহ্য করেন। পৃথক প্রস্তাব দেন নবীনেরা। এক দলের মতে এ প্রস্তাব সাংঘাতিক, অন্য দলের মতে—অতি সরল ও ন্যায়সঙ্গত। দুই দলে বিভক্ত হয়ে যান প্রফেসারা।
কাতাভাসোভ যে দলের অন্তর্ভুক্ত তাঁরা তাঁদের বিরোধী দলের মধ্যে দেখতেন কেবল জঘন্য গুপ্তচরবৃত্তি আর শঠতা; অপর পক্ষ এঁদের মধ্যে ধেখতেন ছেলেমানুষি আর কর্তৃপক্ষের প্রতি অশ্রদ্ধা। বিশ্ববিদ্যালয়ের সাথে লেভিনের কোন সংস্রব না থাকলেও মস্কো থাকাকালে বার কয়েক ব্যাপারটা শুনেছেন, আলোচনা করেছেন এবং এ নিয়ে নিজস্ব একটা মতামত গড়ে নিয়েছেন। বিশ্ববিদ্যালয়ের পুরানো দালান পর্যন্ত তিনজনে না-পৌঁছানো পর্যন্ত রাস্তায় যে আলাপ হচ্ছিল, লেভিনও যোগ দিলেন তাতে।
অধিবেশন শুরু হয়ে গিয়েছিল…বস্ত্ৰ-আচ্ছাদিত যে টেবিলের পেছনে কাতাভাসোভ আর মেত্রভ আসন নিলেন, সেখানে বসে ছিলেন আরো ছয় জন, একজন পাণ্ডুলিপির ওপর ভয়ানক ঝুঁকে কি যেন পড়ে শোনাচ্ছিলেন। টেবিল ঘিরে যে চেয়ারগুলো ছিল, তার একটা খালি পেয়ে লেভিন বসলেন সেখানে, পাশে বসা ছাত্রটিকে জিজ্ঞেস করলেন কি পড়া হচ্ছে। লেভিনের দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিপাত করে ছাত্রটি বলল, ‘জীবনী।’
বিজ্ঞানীর জীবনী নিয়ে লেভিনের কোন আগ্রহ না থাকলেও এমনি শুনতে লাগলেন এবং খ্যাতনামা বিজ্ঞানীর জীবনের কিছু কিছু চিত্তাকর্ষক নতুন ঘটনা জানলেন।
পাঠ শেষ হরে সভাপতি তাঁকে ধন্যবাদ জানালেন এবং এই জয়ন্তী উপলক্ষে কবি মেন্ত্ যে কবিতা পাঠিয়েছিলেন তা পড়ে শোনালেন আর কবির উদ্দেশেও কৃতজ্ঞতাসূচক কথা বললেন কয়েকটা। এর পর কাতাভাসোভ তাঁর সজোর খনখনে গলায় পড়তে লাগলেন বরেণ্য ব্যক্তিটির বৈজ্ঞানিক অবদান সম্পর্কে তাঁর নোট।
কাতাভাসোভ যখন শেষ করলেন, লেভিন ঘড়িতে চোখ বুলিয়ে দেখলেন একটা বেজে গেছে, ভাবলেন কনসার্টে যাওয়ার আগে মেত্রভকে তাঁর পড়ে শোনাবার সময় হবে না, তাছাড়া সে ইচ্ছেও ছিল না তাঁর। ওঁদের মধ্যে যে আলাপটা হয়েছিল, প্রবন্ধ পাঠের সময় তা নিয়ে ভাবছিলেন তিনি। এখন তাঁর কাছে পরিষ্কার হয়ে উঠল যে মেত্রভের চিন্তায় হয়ত-বা গুরুত্ব থাকতে পারে; কিন্তু তাঁর নিজের চিন্তাটাও গুরুত্বপূর্ণ, আর এই চিন্তাগুলোকে পরিচ্ছন্ন করে কোন কিছুতে উপনীত হওয়া সম্ভব কেবল দুজনে যদি তাঁদের নির্বাচিত পথে খাটেন আলাদা আলাদা, ভাবনাগুলোকে মেলালে কোন লাভ হবে না। এবং মেত্রভের আমন্ত্রণ প্রত্যাখ্যান করবেন স্থির করে অধিবেশনের শেষে লেভিন গেলেন তাঁর কাছে। লেভিনের সাথে সভাপতির পরিচয় করিয়ে দিলেন মেত্রভ, রাজনৈতিক ঘটনাবলির কথা সভাপতিকে বলছিলেন তিনি। আর বললেন ঠিক তাই যা আগে তিনি লেভিনকে বলেছেন আর লেভিনও ঠিক সেই মন্তব্য করলেন যা তিনি করেছেন আজ সকালে, তবে বৈচিত্র্য আনার জন্য তখনই যা মাথায় খেলল, তেমন একটা নতুন নিজস্ব অভিমত যোগ করলেন তিনি। এর পর আবার শুরু হল বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রশ্ন নিয়ে আলোচনা। আর লেভিন যেহেতু আগেই এসব শুনেছেন, তাই তাড়াতাড়ি করে মেত্রভকে জানিয়ে দিলেন যে তাঁর আমন্ত্রণের সদ্ব্যবহার করতে পারছেন না বলে তিনি দুঃখিত, মাথা নুইয়ে বিদায় নিয়ে তিনি ভভের কাছে চলে গেলেন।
চার
কিটির বোন নাটালির স্বামী ভভ তাঁর সারা জীবন কাটিয়েছেন দেশের দুই রাজধানীতে (পিটার্সবুর্গ আর মস্কো) আর বিদেশে, সেখানেই তিনি শিক্ষালাভ করে কূটনীতিকের চাকরি নেন।
গত বছর তিনি কূটনীতিকের কাজ ছেড়ে দেন, সেটা কোন অসুবিধায় পড়েছিলেন বলে নয় (কখনো কোন অসুবিধা হত না তাঁর), নিজের দুই পত্রকে সেরা শিক্ষাদানের উদ্দেশ্যে মস্কোয় এসে দরবারী প্রশাসনে কাজ নেন।
অভ্যাস ও মতামতে প্রখর পার্থকত্য থাকলেও, ভভ লেভিনের চেয়ে অনেক বড় হলেও এই শীতটায় দুজনের মধ্যে খুব ভাব হয়ে যায়, পরস্পরকে বেশ পছন্দ করতেন তাঁরা।
ল্ভভ বাড়ি ছিলেন, খবর না দিয়ে লেভিন সোজা চলে গেলেন তাঁর কাছে।
ভভের পরনে বেল্ট বাঁধা ঘরোয়া ফ্রক-কোট, পায়ে সোয়েডের জুতো, চেয়ারে বসে নীলচে কাঁচের পেঁসনেই পরে স্ট্যান্ডে রাখা একটা বই পড়ছিলেন তিনি, সুন্দর হাতে ইতিমধ্যে অর্ধেক ছাই হয়ে যাওয়া চুরুটটা ধরে রেখেছিলেন সাবধানে কিছুটা দূরে।
মুখখানা তাঁর সুশ্রী, চিকন, এখনো যুবকের মত, ঝকঝকে কোঁকড়া রূপোলী চুলে আভিজাত্য ফুটেছে আরো বেশি। লেভিনকে দেখে মুখ তাঁর উজ্জ্বল হয়ে উঠল হাসিতে।
‘চমৎকার! আমি নিজেই আপনাকে ডেকে পাঠাব ভাবছিলাম। তা কেমন আছে কিটি? এখানে বুসন, স্বস্তি পাবেন…’ উঠে দাঁড়িয়ে একটা দোলন চেয়ার টেনে আনলেন, ‘জার্নাল দে সেন্ট পিটার্সবুর্গ’-এ প্রকাশিত শেষ সার্কুলারটা পড়েছেন? আমার তো বেশ ভালো লেগেছে’, উনি বললেন কিছুটা ফরাসি টানে।
পিটার্সবুর্গে লোকে কি বলছে, সে সম্পর্কে কাতাভাসোভের কাছে লেভিন যা শুনেছিলেন সেটা বললেন। তারপর রাজনীতির পাট শেষ করে তিনি বললেন মেত্রভের সাথে তাঁর নতুন পরিচয় আর অধিবেশনে যাবার কথা। এতে খুব আগ্রহী হলেন ভভ।
‘এই দেখুন, বিজ্ঞানের এই চিত্তাকর্ষক জগতে আপনার প্রবেশ আছে বলে হিংসে করি আপনাকে’, উনি বললেন। সাধারণভাবে কথা বলতে বলতে তখনই তিনি চলে যাচ্ছিলেন তাঁর পক্ষে সুবিধাজনক ফরাসি ভাষায়, ‘অবশ্য সময়ও আমার নেই তা ঠিক। আমার চাকরি আর ছেলেদের পড়ানোর দরুন এ থেকে আমি বঞ্চিত; তাছাড়া বলতে লজ্জা নেই যে আমার শিক্ষা বড় বেশি অপ্রতুল।’
‘আমি তা ভাবি না’, লেভিন বললেন হেসে। নিজেকে বিনম্র দেখানো, এমন কি বিনম্র হওয়ার জন্য নয়, একেবারে অকপটেই নিজের সম্পর্কে এই যে নিচু মত প্রকাশ করলেন, বরাবরের মতই তাতে মন ভিজে উঠেছিল লেভিনের
‘সত্যি, শিক্ষা আমার কত কম সেটা এখন আমি বেশ টের পাই। ছেলেদের পাঠ নিতে গিয়ে স্মৃতির অনেক কিছু ঝালিয়ে নিতে, স্রেফ শিখে নিতে হচ্ছে। কেননা শুধু শিক্ষক হলেই চলে না। পরিদর্শকও হতে হয়, যেমন আপনার কৃষিকর্মে মজুর আর তত্ত্বাবধায়ক দুই-ই দরকার। যেমন এটা আমি পড়ছি’, স্ট্যান্ডে রাখা বুসলায়েভের ব্যাকরণটা তিনি দেখালেন; ‘মিশাকে এটা শিখতে হবে, অথচ ভারি সেটা কঠিন… আমাকে বুঝিয়ে দিন তো। এখানে উনি বলছেন…’
লেভিন তাঁকে বলতে চেয়েছিলেন যে এটা বোঝার নয়, মুখস্থ করার ব্যাপার; কিন্তু ভভ মানলেন না।
‘বুঝেছি, এসব দেখে হাসছেন আপনি!
‘বরং উল্টো; আপনি কল্পনা করতে পারবেন না আপনাকে দেকে সব সময়ই আমি শিখি যা আমাকে করতে হবে—সন্তানদের শিক্ষা দান।’
‘আপনার শেখার কিছু নেই’, ভভ বললেন।
লেভিন বললেন, ‘আমি শুধু জানি যে আপনার ছেলেমেয়েদের চেয়ে বেশি মার্জিত ছেলেমেয়ে আমি দেখিনি এবং তাদের চেয়ে ভালো ছেলেমেয়ে আমি আশা করি না।’
বোঝা যায় নিজের আনন্দ যাতে প্রকাশ না পায় তার চেষ্টা করছিলেন ভভ, কিন্তু জ্বলজ্বলে হয়ে উঠলেন হাসিতে।
বললেন, শুধু ওরা হোক আমার চেয়ে ভালো। কেবল এটাই আমার কামনা। আমার ছেলেদের মত প্রবাসী জীবনযাত্রায় যারা অবহেলিত হয়েছে, তাদের নিয়ে কত খাটতে হচ্ছে তা আপনি জানেন না।’
‘ওটা পুষিয়ে নেবেন। ভারি বুদ্ধিমান আপনার ছেলেরা। প্রধান কথা—নৈতিক শিক্ষা। আপনার ছেলেদের দেখে এটাই শিখি আমি।’
‘বলছেন নৈতিক শিক্ষা। সেটা কত কঠিন কল্পনা করা যায় না! সবে একটা দিকের সাথে লড়লেন, দেখা দিল আরেকটা, আবার সংগ্রাম। ধর্মে একটা খুঁটি না থাকলে—মনে আছে, আপনাকে বলেছিলাম একবার—এই সাহায্যটা ছাড়া শুধু নিজের শক্তিতে ছেলে মানুষ করা কোন বাপের পক্ষে সম্ভব নয়।’
লেভিনের পক্ষে সব সময় আকর্ষণীয় এই আলাপটা থেমে গেল সুন্দরী নাটালিয়া আলেক্সান্দ্রভনা আসায়। বাইরে বেরোবার জন্য সাজসজ্জা করেছিলেন তিনি।
‘আরে, আমি জানতাম না যে আপনি এখানে’, তাঁর বহুদিনকার জানা এবং স্পষ্টতই বিরক্তি ধরে যাওয়া এই আলাপটা থেমে গেল বলে দুঃখ নয়, আনন্দ নিয়েই বললেন তিনি; ‘তা কিটি কেমন আছে? আজ আপনাদের ওখানে ডিনার খাব। তাহলে আর্সেনি’, স্বামীর দিকে তাকিয়ে বললেন তিনি, ‘গাড়ি নেবে তো…’
এবং দিনটা কেমনভাবে কাটানো যায় তা নিয়ে শুরু হল স্বামী-স্ত্রীর মধ্যে আলোচনা। স্বামীকে যেহেতু সাক্ষাৎ করতে হবে একজনের সাথে, কাজ আছে, আর স্ত্রীকে যেহেতু যেতে হবে কনসার্টে এবং দক্ষিণ-পূর্ব কমিটির জনসভায়, তাই অনেককিছু ভেবে স্থির করার ছিল। নিজেদের লোক হিসেবে এসব পরিকল্পনায় অংশ নিতে হয়লেভিনকে। স্থির হল নাটালির সাথে লেভিন যাবেন কনসার্ট আর জনসভায়, সেখান থেকে তাঁরা গাড়িটা পাঠাবেন আর্সেনির জন্য তাঁর দপ্তরে। ওতে করে তিনি নাটালির কাছে আসবেন এবং কিটির কাছে পৌঁছে দেবেন তাঁকে; আর যদি তাঁর কাজ শেষ না হয়ে থাকে, তাহলে গাড়িটা তিনি ফেরত পাঠাবেন এবং নাটালিকে নিয়ে যাবেন লেভিন।
‘এই বলে লেভিন আমাকে নষ্ট করছেন যে আমাদের ছেলেরা নাকি অতি সুন্দর’, স্ত্রীকে বললেন ভভ, ‘যখন আমি জানি কত খারাপ জিনিস আছে ওদের মধ্যে।’
‘আমি সব সময়ই বলি যে আর্সেনি চরমে চলে যায়’, স্ত্রী বললেন ‘যদি নিখুঁতের পেছনে ছোট, তাহলে তুষ্ট হতে পারবে না কখনো। বাবা ঠিকই বলেন যে আমাদের মানুষ করায় একটা চূড়ান্তপনা ছিল – আমাদের রাখা হত চিলেকোঠায় আর মা-বাপে থাকতেন বড় ঘরগুলোয়; এখন আবার উল্টো, মা-বাপেরা ভাঁড়ার ঘরে, বড় ঘরগুলোতে ছেলেমেয়েরা।’
‘সেটা যদি বেশি ভালো লাগে?’ মধুর হেসে নাটালির হাত টেনে নিয়ে ভভ বললেন, ‘তোমাকে যে জানে না, সে ভাববে তুমি মা নও, সৎ-মা।’
‘না, কিছুতেই চূড়ান্তপনা ভালো নয়’, টেবিলের যে জায়গাটায় কাগজ-কাটা ছুরিটা থাকার কথা সেখানে সেটা রেখে শান্তভাবে বললেন নাটালি।
‘এই যে, আয় রে এখানে নিখুঁত আমার ছেলেরা’, সুন্দর যে ছেলে দুটো ঘরে ঢুকলে তাদের বললেন ভভ। লেভিনের উদ্দেশে মাথা নুইয়ে তারা গেল পিতার কাছে, বোঝা গেল কিছু-একটা চাইতে এসেছে।
লেভিনের ইচ্ছে হয়েছিল ওদের সাথে কথা বলে, বাপকে কি বলবে সেটা শোনে, কিন্তু নাটালি কথা বলতে লাগলেন ওঁর সাথে; ঠিক এই সময় ঘরে ঢুকলেন চাকরি-ক্ষেত্রে ভভের বন্ধু মাখোতিন, কার সাথে যেন সাক্ষাৎকরতে একত্রে যাবে বলে দরবারী উর্দি পরে এসেছেন। শুরু হয়ে গেল হার্জেগোভিনা, প্রিন্সেস কর্জিনস্কায়া, দুমা, আপ্রাকসিনার অকালমৃত্যু নিয়ে অনর্গল আলাপ।
যে কাজের ভার পেয়ে লেভিন এসেছিলেন, সেটা ভুলেই গিয়েছিলেন তিনি। সে কথা মনে পড়ল কেবল বেরোবার ঘরে গিয়ে।
‘ও হ্যাঁ, অব্লোন্স্কিকে নিয়ে আপনার সাথে কি-সব কথা বলার ভার কিটি আমাকে দিয়েছে’, লেভিন বললেন যখন স্ত্রী আর তাঁকে বিদায় জানাবার জন্য সিঁড়িতে এসে দাঁড়িয়েছেন ভভ।
‘হ্যাঁ, শাশুড়ি চান যেন আমরা ভায়রা ভাইরা ওর ওপর ঝাঁপিয়ে পড়ি’, হেসে লাল হয়ে ভভ বললেন, ‘কিন্তু এর মধ্যে আমি কেন?’
‘আমিই ঝাঁপিয়ে পড়ি তাহলে’, কুকুরের ফার দিয়ে বানানো সাদা রোব পরিহিতা নাটালি কথাবার্তা শেষ হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে থেকে হেসে বললেন, ‘চলুন যাই।’
দিনের কনসার্টে মন টানার মত দুটো জিনিস ছিল।