পাঁচ
‘ভারভারা আন্দ্রেয়েভনা, আমি যখন ছিলাম খুবই তরুণ, তখন আমি এক আদর্শ নারীর মূর্তি কল্পনা করেছিলাম, যাকে আমি ভালোবাসব, স্ত্রী হিসেবে যাকে পেলে আমি খুশি হতে পারি। জীবনের অনেক দিন কাটল আর যা খুঁজছিলাম তা প্রথম পেলাম আপনার মধ্যেই। আমি আপনাকে ভালোবাসি এবং আপনার পাণিপ্রার্থনা করছি।’
ভারেঙ্কার কাছ থেকে দশ পা দূরেই কজ্নিশেভ কথাগুলো বলছিলেন মনে মনে। ভারেঙ্কা তখন হাঁটু গেড়ে বসে গ্রিশার কাছ থেকে ব্যাঙের ছাতা হাত দিয়ে আটকে ছোট্ট মাশাকে ডাকছিল।
‘এখানে, এখানে বাচ্চারা, এখানে অনেক’, মিষ্টি নিচু খাদের গলায় বলছিল ভারেঙ্কা।
কজ্নিশেভকে আসতে দেখে ভারেঙ্কা উঠল না, বদলাল না তার ভঙ্গি; কিন্তু সে যে তাঁর আসা টের পাচ্ছে আর তাতে যে খুশি তা বোঝা যাচ্ছিল সবকিছু থেকেই।
সুন্দর, স্মিত মুখখানা তাঁর দিকে ফিরিয়ে সে তার সাদা রুমালের তল থেকে শুধাল, ‘পেলেন কিছু?’
‘একটাও না’, বললেন কজ্নিশেভ, ‘আর আপনি
ভারেঙ্কা জবাব দিলে না, ছেলেমেয়েরা ঘিরে ধরেছিল তাকে, তাদের নিয়ে সে ব্যস্ত।
‘ওই যে আরো একটা, ডালপালার পাশে’, ছোট্ট মাশাকে ব্যাঙের ছাতাটা দেখিয়ে সে বলল। শুকনো যে ঘাসের তল থেকে সেটা মাথা তুলছিল, তাতে তার টান-টান গোলাপি ছাতাটা আড়াআড়ি কেটে গিয়েছিল। সেটাকে সাদা দু’টুকরোয় ভেঙে মাথা যখন তা তুলল, তখনই ভারেঙ্কা উঠে দাঁড়াল। ছেলেমেয়েদের ছেড়ে কর্নিশেভের সাথে যেতে যেতে সে বলল, ‘এতে আমার নিজের ছেলেবেলার কথা মনে পড়ে।’
কয়েক পা তারা হাঁটল নীরবে; ভারেঙ্কা দেখতে পাচ্ছিল যে উনি কিছু বলতে চাইছেন; সেটা কি তা অনুমান করে পুলক আর ত্রাসের উত্তেজনায় বুক তার নিথর হয়ে এল। ওঁরা এত দূরে চলে গিয়েছিলেন যে ওঁদের কথা কারো কানে যাওয়া সম্ভব নয়, কিন্তু তখনও তিনি কিছু বলতে শুরু করেনি। ভারেঙ্কার পক্ষে চুপ করে থাকাই ভালো হত; তাঁরা যা বলতে চাইছিলেন সেটা ভালো বলা যেত নীরবতার পরে, ব্যাঙের ছাতা নিয়ে আলাপের পরে নয়। কিন্তু নিজের বিরুদ্ধেই যেন একটা আপতিক ঝোঁকে ভারেঙ্কা বলে উঠল, ‘তাহলে আপনি কিছুই পেলেন না? তবে বনের ভেতর দিকে ব্যাঙের ছাতা থাকে সব সময়ই কম।’
সের্গেই ইভানোভিচ দীর্ঘশ্বাস ফেললেন, কোন জবাব দিলেন না। ও যে ব্যাঙের ছাতা নিয়ে কথা বলছে, এতে বিরক্তি লাগছিল তাঁর। নিজের শৈশবের কথা ও যা প্রথমে বলেছিল, সেই প্রসঙ্গে ওকে ফেরাতে চাইছিলেন তিনি; কিন্তু যেন নিজের ইচ্ছার বিরুদ্ধেই, কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে মন্তব্য করলেন ভারেঙ্কার প্রথম নয়, শেষ কথাটার ওপর।
‘আমি শুধু শুনেছি যে সাদা ছত্রাক গজায় প্রধানত কনের কিনারায়, কিন্তু সাদাগুলো আমার চোখে পড়ে না।‘
কাটল আরো কয়েক মিনিট, ছেলেপেলেদের কাছ থেকে আরো দূরে চলে গিয়েছিলেন তাঁরা, একেবারে তাঁরা, একেবারে তাঁরা তখন একলা। ভারেঙ্কার বুক এমন টিপটিপ করছিল যে তার শব্দ পর্যন্ত শুনতে পাচ্ছিল সে, টের পাচ্ছিল যে সে রাঙা হয়ে উঠছে, ফ্যাকাশে হয়ে যাচ্ছে, আবার রাঙা।
মাদাম শ্টালের কাছে ভারেঙ্কা যে অবস্থায় ছিল, তারপর কর্নিশেভের মত একজন মানুষের স্ত্রীর হতে পারা তার কাছে মনে হচ্ছিল সুখের চূড়ান্ত। তা ছাড়া সে প্রায় নিশ্চিত হয়ে উঠেছিল যে ওঁকে সে ভালোবাসে। এখানই সেটা স্থির হয়ে যাওয়ার কথা। ভয় হচ্ছিল তার। কি উনি বলবেন আর কি বলবেন না, দুয়েতেই ভয়।
প্রেম নিবেদনের সময় হয় এখনই, নতুবা আর কখনোই নয়; এটা কজ্নিশেভও টের পাচ্ছিলেন। ভারেঙ্কার সবকিছুতে, তার দৃষ্টি, গণ্ডের লালিমা, নত নয়নে প্রকাশ পাচ্ছিল একটা আতুর প্রতীক্ষা।কজ্নিশেভ সেটা দেখতে পাচ্ছিলেন, ভারেঙ্কার জন্য কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। তিনি এও অনুভব করছিলেন যে এখন ওকে কিছু না বলা মানে ওকে অপমান করা। নিজের সিদ্ধান্তের সপক্ষে যুক্তিগুলি তিনি সব মনে মনে ঝালিয়ে নিলেন। যে কথায় তিনি ওর পাণিপ্রার্থনা করবেন ভেবেছিলেন, সেটারও পুনরাবৃত্তি করলেন মনে মনে; কিন্তু সে কথাগুলোর বদলে হঠাৎ কি-একটা অপ্রত্যাশিত ভাবনার উদয় হওয়ায় তিনি বললেন : ‘সাদা আর বার্চ ছত্রাকের মধ্যে পার্থক্য কি?’
উত্তর দিতে গিয়ে ভারেঙ্কার ঠোঁট থরথর করছিল : ‘ছাতার দিকে প্রায় কোন পার্থক্য নেই, কিন্তু বোঁটার দিকে আছে।’
আর এই কথাগুলো বলা মাত্রই দুজনেরই বোঝা হয়ে গেল যে ব্যাপারটা চুকে গেছে, যা বলার কথা ছিল তা আর বলা হবে না, দুজনের যে উদ্বেলতা এর আগে কূল ছাপাতে যাচ্ছিল, তা শান্ত হয়ে আসতে থাকল।
‘বার্চ ছত্রাকের বোঁটা—মনে হবে যেন দু’দিন না কামানো কালো দাড়ি’, একেবারে সুস্থির হয়ে বললেন কজ্নিশেভ।
‘সত্যি’, হেসে জবাব দিলে ভারেঙ্কা আর অজ্ঞাতসারে তাঁদের গতি বদলে গেল। বাচ্চাদের দিকে যেতে থাকলেন তাঁরা। ভারেঙ্কার কষ্ট হচ্ছিল, লজ্জা হচ্ছিল, সে সাথে হালকাও বোধ করছিল সে।
বাড়ি ফিরে সমস্ত যুক্তিগুলো আবার বিচার করে কজ্নিশেভ দেখলেন যে তিনি ভুল সিদ্ধান্ত করেছিলেন। মেরি’র স্মৃতির প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করতে তিনি পারেন না।
আনন্দে কলরব করে ছেলেমেয়েরা যখন ছুটে এল তাঁদের দিকে, স্ত্রীকে আগালয়ে লেভিন বলতে কি সক্রোধেই চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘আস্তে, আস্তে বাচ্চারা!’
ছেলেমেয়েদের পর বন থেকে বেরোলেন কজ্নিশেভ আর ভারেঙ্কা। ভারেঙ্কাকে জিজ্ঞেস করার দরকার হল না কিটির; দুজনের শান্ত আর কিছুটা লজ্জিত মুখভাব দেখে কিটি বুঝল যে তার পরিকল্পনা ফলেনি।
বাড়ি ফেরার পথে স্বামী জিজ্ঞেস করলেন, ‘তা, কি হল?’
‘লাগল না’, কিটি বলল হেসে এবং এমন ভঙ্গিতে যাতে লেভিন প্রায়ই তার পিতার ধরন দেখে খুশি হতেন।
‘লাগল না মানে?’
‘এইরকম’, স্বামীর হাত নিয়ে রুদ্ধ মুখের কাছে ছুঁয়ে সে বলল, ‘পাদ্রীর হাতে লোকে চুমু খায় যেভাবে ‘ হেসে লেভিন শুধালেন, ‘কার লাগল না?’
‘দুজনেরই, অথচ দরকার ছিল এইরকমটা…’
‘এই, চাষীরা আসছে।’
‘না, ওরা দেখতে পায়নি।
ছয়
ছেলেমেয়েরা যখন চা খাচ্ছে, বড়রা তখন ঝুল-বারান্দায় বসে এমনভাবে কথাবার্তা বলছিলেন যেন কিছুই হয়নি, যদিও সবাই, বিশেষ করে কজ্নিশেভ আর ভারেঙ্কা ভালো করে বুঝছিলেন যে নেতিবাচক হলেও খুবই গুরুতর একটা ব্যাপার ঘটে গেছে। দুজনেরই একইভাবে নিজেদের মনে হচ্ছিল সেই ছেলের মত, পরীক্ষায় ফেল করে যাকে নিচের ক্লাসেই পড়ে থাকতে হবে, নতুবা একেবারেই ছেড়ে দিতে হবে লেখাপড়া। কিছু-একটা ঘটে গেছে টের পেয়ে উপস্থিতরাও সবাই সজীব কথাবার্তা চালাচ্ছিলেন অন্য বিষয় নিয়ে। এ সন্ধ্যায় লেভিন আর কিটি নিজেদের বোধ করছিলেন বিশেষ রকমের প্রেমাকুল আর সুখী। এবং তাঁরা যে নিজেদের প্রেমে সুখী, তাতে অন্যদের প্রতি একটা ভর্ৎসনার ইঙ্গিত নিহিত থাকছিল যাঁরা তাই চেয়েছিলেন, কিন্তু পারলেন না—তার জন্য লজ্জা হচ্ছে তাঁদের।
‘এই আমি বলে রাখছি, আলেকজান্ডার আসবে না’, বললেন প্রৌঢ়া প্রিন্সেস।
আজ সন্ধ্যায় ট্রেনে করে অব্লোন্স্কি আসবেন বলে সবাই আশা করছিলেন আর বৃদ্ধ প্রিন্স লিখে পাঠিয়েছিলেন যে তিনিও আসতে পারেন।
‘আর আমি জানি কেন আসবে না’, বলে চললেন প্রিন্সেস, ‘ও বলে যে নবদম্পতিকে প্রথম দিকটায় একলা থাকতে দেওয়া উচিত।’
‘হ্যাঁ, উনি আমাদের ফেলে রেখেছেন। কতদিন দেখিনি, কিটি বলল, ‘তা ছাড়া আমরা নবদম্পতি হলা কোথায়? বুড়িয়েই গেছি।’
‘যদি ও না আসে, আমি তাহলে তোমাদের কাছ থেকে বিদায় নেব বাছারা’, সখেদে দীর্ঘশ্বাস ফেলে বললেন প্রিন্সেস।
‘কি বলছেন মা!’ দুই মেয়েই ঝাঁপিয়ে পড়লেন তাঁর ওপর।
‘তুই ভেবে দেখ, ওর কি অবস্থা, ওর এখন…’
হঠাৎ গলা কেঁপে উঠল প্রৌঢ়া প্রিন্সেসের। মেয়েরা চুপ করে গিয়ে মুখ চাওয়াচাওয়ি করলেন। সে চাউনি বলছিল, ‘কিছু-একটা দুঃখ মা সব সময়ই খুঁজে নেবে।’ তাঁরা জানতেন না যে মেয়ের কাছে থাকতে প্রিন্সেসের যতই ভালো লাগুক, এখানে তাঁর প্রয়োজনীয়তা তিনি যতই অনুভব করুন, আদরের শেষ মেয়েটাকে বিয়ে দেওয়ায় সংসারের বাসা শূন্য হয়ে যাবার পর থেকে নিজের জন্য, স্বামীর জন্য তাঁর বড় কষ্ট।
রহস্যময় ও গুরুতর একটা ভাব করে এসেছিলেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা।
‘কি ব্যাপার, আগাফিয়া মিখাইলোভনা’, সচকিত হয়ে জিজ্ঞেস করল কিটি 1
‘রাতের খাওয়া কি হবে।’
‘ভালোই হল, তুই যা’, বললেন ডল্লি, ‘খাবারের খবরদারি কর, আমি যাই, গ্রিশার পড়া করাই, আজ কিছুই করেনি সে।’
‘এটা আমার পক্ষে একটা শিক্ষা! না ডল্লি, আমি যাচ্ছি’, লাফিয়ে উঠে বললেন লেভিন।
গ্রিশা ভর্তি হয়েছে জিমন্যাসিয়ামে, গ্রীষ্মে পুরনো পড়াগুলো আবার আবৃত্তি করার কথা। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা মস্কো থাকতেই ছেলের সাথে লাতিন পড়তেন, লেভিনদের এখানে এসে তিনি নিয়ম করেছিলেন যে দিনে অন্তত একবার পাটীগণিত আর লাতিনের সবচেয়ে কঠিন পাঠগুলোর পুনরাবৃত্তি করাতে হবে। লেভিন তাঁর জায়গা নিতে চান। কিন্তু লেভিন কিভাবে পড়াচ্ছেন, একবার তা শুনে এবং মস্কোয় টিউটর যেভাবে শেখান সেখাবে শেখানো হচ্ছে না লক্ষ করে ডল্লি হতবুদ্ধি হয়ে এবং লেভিনকে আঘাত না দেবার চেষ্টা করেও দৃঢ়ভাবে বলেন যে পড়ানো উচিত পাঠ্যপুস্তক অনুসারে, যেভাবে শিক্ষক পড়াতেন, নইলে বরং ডল্লি নিজেই পড়াবার ভারটা আবার নেবেন। অব্লোন্স্কি যে হেলাফেলায় ছেলের পড়াশুনা দেখার ভার নিজে না নিয়ে মায়ের ওপর ছেড়ে দিয়েছেন, যা তিনি কিছুই বোঝেন না, আর শিক্ষকরা যে এত খারাপভাবে ছেলেদের শেখায়, তার জন্য বিরক্তি ধরেছিল লেভিনের, কিন্তু শ্যালিকাকে তিনি কথা দিয়েছিলেন যে পড়াবেন তিনি যেমন চান, তেমনি ভাবেই। এবং গ্রিশাকে তিনি পড়াতে লাগলেন নিজের পদ্ধতিতে নয়, পাঠ্যপুস্তক অনুসারে, আর তাই অনিচ্ছায় প্রায়ই ভুলে যেতেন পড়াবার সময়। আজও তাই হল।
বললেন, ‘না, আমি যাচ্ছি ডল্লি, তুমি বসো। আমরা সব ঠিকঠাক করব, পাঠ্যপুস্তকে যেমন। তবে স্তিভা এলেই কিন্তু আমরা যাব শিকারে, তখন কিন্তু ফাঁক পড়বে।’
লেভিন গেলেন গ্রিশার কাছে।
ভারেঙ্কাও একই রকম কথা বলেছিল কিটিকে। লেভিনদের সুখী, গোছানো সংসারেও কাজে লাগার উপায় করে নিতে পারার নৈপুণ্য ছিল তার।
‘রাতের খাবারের ব্যাপারটা আমি দেখছি, আপনারা বসে থাকুন এখানে’, এই বলে সে গেল আগাফিয়া মিখাইলোভনার কাছে।
‘সত্যিই তো’, কিটি বলল, ‘বাচ্চা মুরগি পাওয়া যায়নি। তাহলে নিজেদেরগুলোকেই কি…’
‘সে আমি আর আগাফিয়া মিখাইলোভনা বুঝব’, দুজনে চলে গেলেন ওঁরা।
‘কি মিষ্টি মেয়ে!’ বললেন প্রিন্সেস।
‘শুধু মিষ্টি নয় মা, এত অপূর্ব হয় না কখনো।’
‘তাহলে আজ আপনারা অব্লোন্স্কির আশা করছেন’, ভারেঙ্কাকে নিয়ে আলোচনাটা চলুক, স্পষ্টতই এটা না চেয়ে বললেন কজ্নিশেভ, ‘এত ভিন্ন দুটো জামাই পাওয়া কঠিন’; মিহি হেসে তিনি মন্তব্য করলেন, ‘একজন সজীব, মাছ যেমন পানিতে, তেমনি সমাজে যে সাবলীল; অন্যজন, আমাদের কস্তিয়া, প্রাণবন্ত, ক্ষিপ্র, সবকিছুতে সজাগ, কিন্তু যেই সমাজে গিয়ে পড়ে অমনি আড়ষ্ট হয়ে যায়, ডাঙায় পড়া মাছের মত মিছেই ঝাপটায় পাখনা।’
‘হ্যাঁ, ও বড় লঘুচিত্ত’, কজ্নিশেভের দিকে ফিরে বললেন প্রিন্সেস, ‘আমি আপনাকেই বলতে চাইছিলাম যে ওর (কিটির দিকে ইঙ্গিত করলেন তিনি) ‘এখন যে এখানে থাকা চলে না, অবশ্য-অবশ্য থাকা থাকা উচিত মস্কোয়, সে কথাটা আপনি ওকে বোঝান। ও বলে যে মস্কোর ডাক্তারকে ডাকবে…’
‘মা, ও সবই করবে, সবকিছুতেই ও রাজি’, এ ব্যাপারে কজ্নিশেভকে বিচারকের ভূমিকায় ডাকায় মায়ের ওপর রাগ করে বলল কিটি।
কথাবার্তার মাঝখানে ছায়াবীথিতে শোনা গেল ঘোড়ার ঘোঁৎঘোঁৎ শব্দ আর নুড়ির ওপর চাকার ঘর্ঘর।
ডল্লি উঠে স্বামীকে স্বাগত করতে যাবার আগেই নিচে গ্রিশার পড়ার ঘরের জানলা দিয়ে লাফিয়ে বেরোলেন লেভিন, গ্রিশাকে নিলেন সাথে।
ঝুল-বারান্দার নিচে থেকে লেভিন চেঁচালেন, ‘এ স্তিভা! আমাদের পড়া হয়ে গেছে। ভয় নেই ডল্লি’, এই বলে তিনি বাচ্চার মত ছুটলেন গাড়ির দিকে।
‘সে, সে (স্ত্রী), উহা, তাকে তাকে, তাকে’, ছায়াবীথিতে লাফাতে লাফাতে লাতিন ভাষায় চেঁচাতে লাগল গ্রিশা। বীথির মোড়ে থেমে লেভিন চেঁচিয়ে বললেন, ‘আরে, আরো একজন দেখছি। নিশ্চয় বাবা! খাড়া সিঁড়ি বেয়ে নেমো না কিটি, ঘোরানো সিঁড়ি দিয়ে।’
কিন্তু গাড়িতে যে বসে ছিলেন, তাঁকে বৃদ্ধ প্রিন্স ভাবায় ভুল হয়েছিল লেভিনের। গাড়ির কাছে যেতে তিনি অব্লোন্স্কির সাথে দেখলেন প্রিন্সকে নয়, সুন্দর স্বাস্থ্যবান এক যুবাপুরুষকে, মাথায় তাঁর পেছন দিকে লম্বা ফিতে ঝোলানো স্কটল্যান্ডী টুপি। এটি ভাসেকা ভেস্লোভস্কি, শ্যেরবাৎস্কিদের তিন ধাপে সম্পর্কিত ভাই, পিটার্সবুর্গ-মস্কোর দীপ্তিমান যুবক, ‘চমৎকার ছোকরা আর শিকারের প্রচণ্ড ভক্ত’, অব্লোন্স্কি তাঁর পরিচয় দিতে গিয়ে যে কথাটা বলেছিলেন।
বৃদ্ধ প্রিন্সের বদলে তিনি আসায় যে হতাশা দেখা দিয়েছিল, তাতে বিন্দুমাত্র বিচলিত না হয় তিনি ফুর্তি করে প্রিয়-সম্ভাষণ করলেন লেভিনের সাথে, মনে করিয়ে দিলেন যে তাঁদের আগেই পরিচয় হয়েছিল, অব্লোন্স্কি যে পয়েন্টার কুকুর সাথে আনছিলেন, তার ওপর দিয়ে গ্রিশাকে তুলে নিলেন গাড়িতে।
লেভিন গাড়িতে উঠলেন না, হেঁটে এলেন তার পেছন পেছন। বৃদ্ধ প্রিন্স, যাঁকে গাড়িতে উঠলেন না, হেঁটে এলেন তার পেছন পেছন। বৃদ্ধ প্রিন্স, যাঁকে তিনি যত বেশি জানছেন ততই ভালোবাসছেন, তিনি না আসায়, এবং একেবারে অনাত্মীয় ও অবান্তর এই ভাসেকা ভেস্লোভস্কিটির আবির্ভাব ঘটায় খানিকটা বিরক্তই হয়েছিলেন তিনি। তাঁকে লেভিনের বেশি অনাত্মীয় ও অবান্তর লেগেছিল আরো এই জন্য যে ছোট-বড় সবার চঞ্চল জটলা শুরু হয়েছিল যে গাড়ি-বারান্দাটায় সেখানে এসে তিনি দেখলেন যে ভাসেকা ভেস্লোভস্কি কিটির হস্তচুম্বন করছেন বিশেষ একটা সোহাগ ঢেলে, নাগরের ভাব নিয়ে।
‘আমি আপনার স্ত্রীর সম্পর্কিত ভাই, পুরানো পরিচিত’, বলে ভাসেকা ভেস্লোভস্কি আবার সজোরে করমর্দন করলেন লেভিনের।
‘কি শিকার আছে?’ প্রত্যেককে আলাদা আলাদা করে সম্ভাষণ জানানো কোনরকমে শেষ করে লেভিনকে জিজ্ঞেস করলেন অব্লোন্স্কি। ‘ও আর আমি একেবারে মারমুখী হয়ে আছি। কি মা, সেই থেকে ওরা মস্কোয় যায়নি। নে তানিয়া, এটা তোর জন্য! গাড়ির পেছন দিকে আমার ব্যাগটা আছে, নিয়ে আয়-না’, তিনি কথা বলছিলেন প্রত্যেকের সাথেই, ‘ডল্লিনকা, বেশ যে দেখছি তাজা হয়ে উঠেছ’, স্ত্রীকে বললেন তিনি, আরো একবার তাঁর হাতে চুমু খেয়ে আর তা ধরে রেখে অন্য হাতে তার ওপর টোকা দিতে দিতে।
এক মিনিট আগেও লেভিন ছিলেন অতি শরিফ মেজাজে, কিন্তু এখন তিনি সবার দিকে চাইছিলেন মুখ হাঁড়ি করে, কিছুই তাঁর ভালো লাগছিল না।
স্ত্রীর প্রতি অব্লোন্স্কির কমনীয়তা লক্ষ করে লেভিন ভাবলেন, ‘ওই ঠোঁট দিয়ে কাকে সে চুমু খেয়েছে গতকাল?’ ডল্লির দিকে চাইলেন তিনি, তাঁকেও তাঁর ভালো লাগল না।
‘ওর ভালোবাসায় তো ওর বিশ্বাস নেই। তাহলে অত আহ্লাদ কিসের? জঘন্য!’ ভাবলেন লেভিন।
চাইলেন প্রিন্সেসের দিকে, এক মিনিট আগেও যাঁকে বেশ লেগেছিল লেভিনের, কিন্তু ফিতে ঝোলানো, এই ভাসেকাকে তিনি যে সমাদরে স্বাগত করছেন যেন এটা তাঁর নিজের বাড়ি, সেটা ভালো লাগল না তাঁর।
এমনকি কজ্নিশেভ, তিনিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন গাড়ি-বারান্দায়, তাঁকেও তাঁর ভালো লাগল না এই জন্য যে অব্লোন্স্কিকে তিনি একটা কৃত্রিম সৌহার্দ্য দেখাচ্ছেন, যে ক্ষেত্রে অব্লোন্স্কিকে তিনি ভালোবাসেন না, শ্রদ্ধা করেন না, সেটা লেভিন জানেন।
আর ভারেঙ্কাকেও তাঁর খারাপ লাগল, কারণ সাধু-এর ভাব করে সে মহাশয়টির সাথে পরিচয় ফাঁদছে। কেননা তার একমাত্র কামনা বিয়ে করা যায় কিভাবে।
আর সবচেয়ে বিছ্ছিরি লাগল কিটিকে, কেননা গ্রামে এই আগমনকে তাঁর নিজের এবং সবার কাছে একটা উৎসব বলে গণ্য করে এই যে মহাশয়টি ফুর্তির হাওয়া বইয়ে দিয়েছেন, তাতে গা ভাসিয়েছে কিটিও; যে বিশেষ একটা হাসি দিয়ে লোকটার হাসির জবাব দিল কিটি, সেটা খারাপ লাগল সবচেয়ে বেশি।
কলরব করে কথা বলতে বলতে সবাই ঢুকলেন ভেতরে; কিন্তু সবাই আসন নেওয়া মাত্র লেভিন পিছন ফিরে বেরিয়ে গেলেন।
কিটি দেখতে পাচ্ছিল স্বামীর কিছু-একটা হয়েছে। ওঁর সাথে একা কথা বলার সুযোগ খুঁজছিল কিটি, কিন্তু সেরেস্তায় কাজ আছে বলে লেভিন চলে গেলেন তাড়াতাড়ি। বিষয়-আশয়ের ব্যাপারটা তাঁর কাছে আজকের মত এত জরুরি বোধ হয়নি বহুদিন। তাঁর মনে হল, ‘ওদের তো উৎসব, কিন্তু এখানে উৎসব নয়, যা অপেক্ষা করে থাকবে না, দিন চলবে না তা ছাড়া।’
সাত
নৈশাহারের জন্য তাঁকে ডাকতে লোক পাঠাবার পরই মাত্র বাড়ি ফিরলেন লেভিন। সিঁড়িতে দাঁড়িয়ে কিটি আর আগাফিয়া মিখাইলোভনা পরামর্শ করছিলেন খাবার সময় কি সুরা দেওয়া হবে।
‘কি ব্যতিব্যস্ততা? সাধারণত যা দেওয়া হয় তাই দেবেন।’
‘না, স্তিভা তা খাবে না… কস্তিয়া, দাঁড়াও তো, কি হল তোমার?’ লেভিনের পিছু পিছু গিয়ে কিটি বলল। কিন্তু তার জন্য অপেক্ষা না করে নির্মমভাবে বড় বড় পা ফেলে লেভিন চলে গেলেন ডাইনিং-রুমে এবং ভাসেকা ভেস্লোভস্কি আর অবলোন্স্কি যে সাধারণ সজীব আলাপটা চালু রেখেছিলেন, তৎক্ষণাৎ যোগ দিলেন তাতে।
‘তাহলে কি, কাল যাব শিকারে?’ জিজ্ঞেস করলেন অবলোবস্ক্রিপ
‘হ্যাঁ, যাওয়া যাক’, অন্য একটা চেয়ারে সঙ্গে পাপকে ভঙ্গিতে বসে পায়ের ওপর মোটা একখানা পা চাপিয়ে বললেন ভেস্লোভস্কি।
‘বেশ, খুশি হলাম, যাব। এ বছর আপনি শিকার করেছেন কি?’ মন দিয়ে তাঁর পা-টা নিরীক্ষণ করতে একটা কপট সৌজন্য নিয়ে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন। এটা কিটির চোখে পড়েছিল এবং লেভিনকে এটা মানায় না। বড় স্নাইপ পাওয়া যাবে কিনা জানি না, কিন্তু ছোট পাখি অনেক। তবে যেতে হবে সকাল সকাল। আপনি ক্লান্ত হবেন না? তুমি ক্লান্ত হওনি স্তিভা?’
‘আমি ক্লান্ত হব? কদাচ ক্লান্ত হইনি আমি। এসো, সারা রাত আজ ঘুমাব না। চলো বেড়াতে যাই।’
‘সত্যিই ঘুমাব না! চমৎকার হবে!’ সমর্থন করলেন ভেস্লোভস্কি।
‘আমাদের কোন সন্দেহ নেই যে তুমি নিজে না ঘুমিয়ে অন্যদেরও ঘুমাতে না দিতে পারো’, ডল্লি বললেন সামান্য লক্ষণীয় সেই খোঁচা দিয়ে যেটা তখন থেকে আজকাল স্বামীর সাথে সম্পর্কে প্রায়ই উঁকি দেয়। ‘আর আমার মতে ঘুমোবার সময় হয়ে গেছে… চললাম, রাতে আমি খাই না।’
‘না, না, বসো ডল্লিনকা’, বড় যে টেবিলটায় খাবার দেওয়া হয়েছিল, তার ওপাশে ডল্লির কাছে গিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘তোমাকে কিছু বলবার মত খবর আছে।’
‘নিশ্চয় কিছুই না।’
‘জানো, ভেস্লোভস্কি গিয়েছিল আন্নার কাছে। আবার ওদের কাছে যাবে। ওরা যে তোমাদের এখান থেকে মাত্র সত্তর ভার্স্ট দূরে। আমিও অবশ্য-অবশ্য যাব। ভেস্লোভস্কি, আয় এখানে!’
মহিলাদের দলে গিয়ে ভেস্লোভস্কি বসলেন কিটির পাশে।
‘আহ্, বলুন-না। আপনি গিয়েছিলেন আন্নার কাছে? কেমন আছে সে?’ দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা জিজ্ঞেস করলেন তাঁকে।
লেভিন টেবিলের অন্য প্রান্তে বসে প্রিন্স-মহিষী আর ভারেঙ্কার সাথে অনবরত কথা চালিয়ে যেতে যেতে লক্ষ করছিলেন যে অব্লোন্স্কি, ডল্লি, কিটি আর ভেস্লোভস্কির মধ্যে একটা সজীব ও রহস্যময় কথোপকথন চলছে। শুধু রহস্যময় নয়, প্রাণবন্ত ঢঙে ভাসেকা কি যেন বলছিলেন আর তাঁর সুন্দর মুখের দিকে অপলকে চেয়ে থাকা তাঁর স্ত্রীর মুখে একটা গুরুত্বপূর্ণ ভাব লক্ষ করলেন লেভিন।
ভ্রন্স্কি আর আন্না সম্পর্কে ভাসেকা বলছিলেন, ‘বেশ ভালো আছে ওরা, আমি অবশ্য বিচার করতে যাব না, কিন্তু ওদের বাড়িতে মনে হয় যেন নিজেদের সংসারেই আছি।’
‘কি ওরা করবে ভাবছে?’
‘মনে হয় শীতকালটা মস্কোয় কাটাবে।’
‘তুমি যাবে?’ স্ত্রীকে শুধালেন অব্লোন্স্কি।
ডল্লি বললেন, ‘আমার অনেক দিনের ইচ্ছে। নিশ্চয় যাব। ওর জন্য কষ্ট হয় আমার। ওকে তো আমি চিনি। অপরূপ নারী। আমি যাব একলা যখন তুমি চলে আসবে। কারো কোন বাধা ঘটাব না। তুমি না থাকলেই বরং ভালো।’
‘বেশ’, বললেন অব্লোন্স্কি, ‘আর তুমি, কিটি?’
‘আমি? আমি কেন যাব?’ একেবারে লাল হয়ে কিটি বলল, চাইলে স্বামীর দিকে।
‘আপনি আন্না আর্কাদিয়েভনার সাথে পরিচিত?’ জিজ্ঞেস করলেন ভেস্কোভস্কি, ‘অতি মনোহরা নারী।’
‘হ্যাঁ পরিচিতি’, আরো লাল হয়ে উত্তর দিল কিটি, উঠে গেল স্বামীর কাছে।
বলল, ‘তাহলে কাল তুমি শিকারে যাচ্ছ?’
এ কয়েক মিনিটে ঈর্ষা তাঁর প্রচণ্ড বেড়ে উঠেছিল, বিশেষ করে ভেস্লোভস্কির সাথে কথা বলার সময় কিটির গণ্ডে রক্তিমা ছড়িয়ে পড়তে দেখে। এখন কিটির কথাটার অর্থ তিনি করলেন নিজের মত করে। পরে ব্যাপারটা স্মরণ করে তাঁর অদ্ভুত লাগলেও এখন তাঁর মনে হল এটা পরিষ্কার যে কাল তিনি শিকারে যাবেন কিনা যখন জিজ্ঞেস করছে, তখন ভাসেকা ভেস্লোভস্কিকে এই উপভোগটা তিনি দেবেন কিনা জানতে চাইছে সেইটেই। তাঁর ধারণা, কিটি ওঁর প্রেমে পড়ে গেছে।
‘হ্যাঁ, যাব’, অস্বাভাবিক গলায় উত্তর দিলেন তিনি, যা নিজের কাছেই বিছছিরি শোনাল।
‘না, কাল বরং বাড়ি থেকো ডল্লি স্বামীকে দেখেনি অনেকদিন, পরশু যেও’, বলল কিটি।
কিটির কথার মানে লেভিন করলেন এইরকম : ‘ওকে আমার কাছে থেকে সরিয়ে নিও না। তুমি যদি যাও তাতে কিছু এসে যায় না আমার, কিন্তু সুন্দর এই যুবকটির সাহচর্য উপভোগ করতে আমাকে দাও।’
‘তুমি যদি চাও তাহলে কাল বাড়ি থাকব’, খুব একটা প্রীতির ভাব নিয়ে বললেন লেভিন।
তাঁর উপস্থিতিতে লেভিনের কি কষ্ট হচ্ছে সে সম্পর্কে বিন্দুমাত্র সন্দেহ না করে ভাসেকা ইতিমধ্যে কিটির পরই টেবিল ছেড়ে উঠে দাঁড়ালেন এবং মধুর দৃষ্টিপাত করে হেসে এলেন তার কাছে।
সে দৃষ্টি নজরে পড়েছিল লেভিনের। ফ্যাকাশে হয়ে গেল তাঁর মুখ, মুহূর্তের জন্য দম আটকে এল তাঁর। ‘আমার স্ত্রীর দিকে অমনভাবে সে চাইতে পারে কেমন করে!’ ভেতরটা তাঁর টগবগ করছিল।
‘তাহলে কালকে? চলুন যাই’, চেয়ারে বসে নিজের অভ্যাসমত ঠ্যাঙের ওপর ঠ্যাঙ তুলে বললেন ভাসেকা। লেভিনের ঈর্ষা বেড়ে গেল আরও। প্রতারিত স্বামী বলে নিজেকে বোধ হচ্ছিল, স্ত্রী এবং তার প্রণয়ীর কাছে যার দরকার কেবল তাদের সুখস্বাচ্ছন্দ্য ও উপভোগের ব্যবস্থা করার জন্য… তা সত্ত্বেও তিনি সৌজন্য ও আতিথেয়তার সাথে রাজি হলেন পরের দিন শিকারে যেতে।
লেভিনের সৌভাগ্যক্রমে প্রৌঢ়া প্রিন্সেস নিজে উঠে পড়লেন পড়লেন এবং কিটিকে পরামর্শ দিলেন ঘুমাতে যাবার জন্য। তাতে লেভিনের কষ্টটা দূর হল বটে, কিন্তু নতুন আরেকটা কষ্ট বাদ গেল না তাঁর। গৃহস্বামিনীকে বিদায় দেবার সময় আবার তার হস্তচুম্বনের চেষ্টা করলেন ভাসেকা, কিন্তু লাল হয়ে কিটি হাত টেনে নিয়ে সরল রূঢ়তায় বলে দিলঃ ‘আমাদের এখানে ওটার চল নেই।’
এর জন্য পরে মায়ের কাছে বকুনি খেতে হয়েছিল কিটিকে। এরকম একটা সম্পর্ক হতে দিয়েছে বলে লেভিনের চোখে কিটি দোষী আর সে সম্পর্ক যে তার ভালো লাগছে না সেটা অমন বিদঘুটের মত প্রকাশ করে দোষ করেছে আরো বেশি।
‘কি এত ঘুমাবার তাড়া!’ নৈশাহারের সময় কয়েক গ্লাস মদ্যপানের পর নিজের অতি মধুর ও কাব্যিক মেজাজে পৌঁছে অব্লোন্স্কি বললেন, ‘ওই দেখো কিটি’, লিন্ডেন গাছের পেছনে উদীয়মান চাঁদের দিকে দেখিয়ে বললেন তিনি, ‘কি অপূর্ব! ভেস্লোভস্কি, এই হল সেরিনেড গাওয়ার সময়। জানো, চমৎকার গলা ওর। সারা রাস্তা আমরা দুজনে গাইতে গাইতে এসেছি। চমৎকার রোমান্স নিয়ে এসেছে ও, দুটো নতুন। ভারভারা আন্দ্রেয়েভনার সাথে গাইলে হত।’
.
সবাই চলে গেলে ভেস্লোভস্কির সাথে অব্লোন্স্কি অনেকক্ষণ বেড়ান তরুবীথিটায়। শোনা যাচ্ছিল তাঁদের গাওয়া নতুন রোমান্স।
স্ত্রীর শয়নকক্ষে চেয়ারে বসে মুখে গোঁজ করে সে গান শুনছিলেন লেভিন, তাঁর কি হয়েছে, কিটির এ প্রশ্নে চুপ করে থাকছিলেন একগুঁয়ের মত; কিন্তু কিটি নিজেই যখন ভীরু হেসে জিজ্ঞেস করল, ‘ভেস্লোভস্কিকে তোমার খারাপ লেগেছে বুঝি?’ লেভিন ফেটে পড়লেন, বললেন সবকিছু, আর যা বললেন তাতে নিজেকে অপমানিত লাগছিল তাঁর, ফলে আরো বেশি চটে উঠছিলেন।
কিটির সামনে তিনি দাঁড়িয়ে ভ্রূকুটির তল থেকে ভয়াবহ চকচকে চোখে চাইলেন কিটির দিকে, সবল হাতে বুক চাপলেন, যেন নিজেকে সংযত রাখার জন্য নিয়োগ করছেন সমস্ত শক্তি। তাঁর মুখভাবকে কঠোর, এমনকি নিষ্ঠুরই বলা যেতে পারত যদি তাতে না থাকত যন্ত্রণার ছাপ, যা স্পর্শ করল কিটিকে। চোয়াল তাঁর কেঁপে উঠল, ভেঙে গেল গলা।
‘আমার কথাটা বোঝো, ঈর্ষা হচ্ছে না আমার, ওটা অতি নীচ একটা কথা। ঈর্ষা করতে আমি পারি না এবং বিশ্বাস করতে যে… আমি কি বোধ করছি সেটা তোমাকে বুঝিয়ে বলতে পারছি না, কিন্তু এটা সাঙ্ঘাতিক….ঈর্ষা আমি করছি না, কিন্তু কেউ তোমার দিকে অমন দৃষ্টিতে চাইবে বলে ভাববে, চাইবার স্পর্ধা করবে, এতে আমি অপমানিত, লাঞ্ছিত বোধ করছি।’
‘কিরকম দৃষ্টিতে?’ সেদিন সন্ধ্যায় ওঁদের ওখানে যত কথা আর ভাবভঙ্গির বিনিময় হয়েছিল, সততার সাথে তা সব স্মরণ করার চেষ্টা করে বলল কিটি।
মনের গভীরে কিটি জানতো যে ভেস্লোভস্কি যখন টেবিলের অন্য প্রান্তে তার কাছে চলে আসেন সেই মুহূর্তটায় কিছু-একটা হয়েছিল, কিন্তু নিজের কাছেই সেটা স্বীকার করার ইচ্ছে হচ্ছিল না তার, আর তা বলে লেভিনের যন্ত্রণা আরো বাড়িয়ে দেবার সাহস তো একেবারেই হচ্ছিল না।
‘আমি এখন যে অবস্থায় তাতে আমার মধ্যে আকর্ষণীয় কি থাকতে পারে?…’
‘আহ্!’ মাথা চেপে ধরে চেঁচিয়ে উঠলেন লেভিন, ‘ও কথাটা না বলল আর চলছিল না? তার মানে তোমার যদি আকর্ষণ থাকত…’
‘আরে, না কস্তিয়া, শোন, শোন’, লেভিনের দিকে সমবেদনার কাতর দৃষ্টিতে চেয়ে কিটি বলল, ‘কি তুমি ভাবতে পারো যখন কোন নাগর নেই আমার, নেই, নেই!… অপর কারো মুখও দেখব না, তাই তুমি চাও?’
লেভিনের ঈর্ষার প্রথমটা ক্ষুণ্ন হয়েছিল কিটি; সামান্য একটা আমোদ, তাও যা নিতান্ত নির্দোষ, তা তাকে বারণ করা হচ্ছে বলে সে বিরক্ত হয়েছিল, কিন্তু এখন লেভিনের প্রশান্তির জন্য, যে কষ্ট তিনি ভোগ করছেন তা থেকে তাঁকে মুক্ত করার জন্য শুধু ওই ধরনের তুচ্ছ ব্যাপারই নয়, সবকিছুই সাগ্রহে ত্যাগ করতে সে প্রস্তুত।
‘আমার অবস্থাটা যে কি সাংঘাতিক আর হাস্যকর সেটা বুঝে দেখো’, হতাশায় ফিসফিস করে বললেন লেভিন, ‘সে আমার অতিথি, এই আমোদ দানটুকু আর পায়ের ওপর পা তুলে দেওয়া ছাড়া সত্যিই কিছু সে করেনি, ধারণা যে এটা বেশ ভালো রেওয়াজ, সুতরাং তার প্রতি সৌজন্য দেখাতে হবে।’
‘তুমি কিন্তু বাড়িয়ে বলছ কস্তিয়া’, কিটি বলল, তার প্রতি লেভিনের ভালোবাসার যে প্রবলতা এখন প্রকাশ পেল ঈর্ষায় তাতে অন্তরে অন্তরে খুশিই হয়েছিল সে।
‘সবচেয়ে সাংঘাতিক যে তুমি যেমন বরাবর, তেমনি এখন আমার কাছে তুমি যখন অতি পবিত্র, আমরা যখন সুখী, বিশেষ রকমের সুখী, হঠাৎ কিনা এই ওঁছাটা… না, ওঁছা নয়, কেন গালাগালি করছি ওকে। ওকে নিয়ে আমার যেন বড় দায়। কিন্তু আমার সুখ, তোমার সুখ কিসের জন্য?…’
‘আমি বুঝতে পারছি কি থেকে এমনটা ঘটেছে’, শুরু করল কিটি
‘কি থেকে? কি থেকে?’
‘রাতের খাওয়ার সময় আমরা যখন গল্প করছিলাম, তখন কেমন করে তুমি চেয়েছিল আমি দেখেছি।’
‘তা ঠিক, তা ঠিক!’ লেভিন বললেন ভীতভাবে।
কি নিয়ে তাঁরা কথা বলছিলেন সেটা বলল কিটি। আর সেটা বলতে ব্যাকুলতায় দম বন্ধ হয়ে এল তার। লেভিন চুপ করে রইলেন। তারপর কিটির বিবর্ণ ভীতু, মুখখানা লক্ষ করে নিজের মাথা চেপে ধরলেন হঠাৎ।
‘কাতিয়া, তোমাকে কষ্ট দিয়েছি আমি! ক্ষমা করো লক্ষ্মীটি! এটা যে ক্ষেপামি! কাতিয়া, সব দোষ আমার। অমন একটা বাজে ব্যাপার নিয়ে অত কষ্ট পাবার মানে হয় কখনো?’
‘না, তোমার জন্য কষ্ট হচ্ছে আমার।’
‘আমার জন্য? আমার জন্য? কে আমি? ক্ষেপা!… কিন্তু তোমার কষ্ট হবে কেন? ভাবতেই ভয় হয় যে যতসব বাইরের লোক এসে আমাদের সুখ পণ্ড করে দিতে পারে…’
‘বটেই তো, এটাই হল অপমানকর…’
‘উলটে আমি ইচ্ছে করে আমার কাছে ওকে রেখে দেব সারা গ্রীষ্মকালটা, সৌজন্য ওকে ছেয়ে দেব’, কিটির করচুম্বন করে লেভিন বললেন। ‘দেখেনিও তুমি। কাল… হ্যাঁ, সত্যি, কাল আমরা যাচ্ছি।’
আট
মহিলারা এখনো ওঠেননি, ফটকের কাছে শিকারীদের গাড়িগুলো তৈরি। সকাল থেকেই লাস্কা বুঝেছিল যে শিকারে যাচ্ছে, প্রাণপণে ঘেউঘেউ আর লাফালাফি করে সে গিয়ে বসল কোচয়ানের পাশে আর যে দরজাটা দিয়ে শিকারীরা এখনো বেরোচ্ছে না, অসন্তুষ্ট আর উত্তেজিত হয়ে তাকাতে লাগল তার দিকে। প্রথমে বেরোলেন ভাসেকা ভেস্লোভস্কি। তাঁর প্রকাণ্ড নতুন হাই-বুট উঠেছে মোটা উরুর আধখানা পর্যন্ত, পরনে সবুজ কামিজ, নতুন চামড়ার গন্ধ ছাড়া কার্তুজ রাখার কোমারবন্ধ। মাথায় সেই ফিতে দোলানো টুপি, শিকলি ছাড়া নতুন একটা বিলাতি বন্দুক। লাস্কা লাফিয়ে গেল তাঁর কাছে, স্বাগত করল, লাফালাফি করে নিজের ধরনে জিজ্ঞেস করলে শিগগিরই ওরা বেরোবে নাকি, কিন্তু উত্তর না পেয়ে আবার ফিরে গেল তার প্রতীক্ষার জায়গায়, মাথাটা পাশে হেলিয়ে, একটা কান খাড়া করে নিথর হয়ে রইল। অবশেষে সশব্দে দরজা খুলে গেল, বাতাসে পাক খেয়ে লাফাতে লাগল অব্লোন্স্কির ফুটকিদার পয়েন্টার কুকুর ক্রাক, তারপর বন্দুক হাতে চুরুট মুখে স্বয়ং অব্লোন্স্কি। কুকুরটা তার পেট আর বুকে পা দিয়ে শিকারের ব্যাগে থাবা আটকে বসালে তিনি আদর করে চ্যাঁচাতে লাগলেন, ‘নাম্ ক্রাক, নাম্!’ পরনে তাঁর খাটো কোট, ছেঁড়া পেন্টালুন, পায়ে চাষীদের ধরনে ন্যাকরা, মাথায় জীর্ণ কি-একটা টুপি, কিন্তু নতুন মডেলের বন্দুকটা অপূর্ব, শিকারের ব্যাগ আর কার্তুজের বেল্ট নতুন না হলেও বেশ মজবুত।
এর আগে ভাসেকা ভেস্লোভস্কি জানতেন না যে শিকারীর সত্যিকারের চালিয়াতি হল ন্যাতাকানি পরা কিন্তু সেরা কিসিমের হাতিয়ার রাখা। দীনহীন বেশে অব্লোন্স্কির জ্বলজ্বলে, সুশ্রী, অভিজাত হৃষ্টপুষ্ট মূর্তিটা দেখে তিনি এখন সেটা বুঝলেন এবং স্থির করলেন পরের বার শিকারে অবশ্য-অবশ্যই ওই রকমের বেশ ধারণ করবেন।
‘কিন্তু আমাদের, কর্তাটি কোথায়?’ জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘তরুণী ভার্যা’, হেসে বললেন অব্লোন্স্কি।
‘হ্যাঁ, এবং অমন মনোহারিণী।’
‘ওর তো পোশাক পরা হয়ে গিয়েছিল। নিশ্চয় আবার গেছে বৌয়ের কাছে।’
অব্লোন্স্কি ঠিকই অনুমান করেছিলেন। লেভিন স্ত্রীর কাছে আবার গিয়েছিলেন আরো একবার গতকালের আহাম্মকির জন্য সে ক্ষমা করেছে কিনা জিজ্ঞেস করতে এবং তা ছাড়াও খ্রিস্টের দোহাই দিয়ে অনুরোধ করতে সে যেন সাবধানে থাকে। প্রধান কথা, ছেলেমেয়েদের কাছ থেকে সরে থাকে যেন, সব সময়ই তারা ধাক্কা দিতে পারে তাকে। তা ছাড়া উনি দু’দিনের জন্য চলে যাচ্ছেন তাতে কিটি যে পরের দিন সকালে সে যেন সওয়ারের হাতে অবশ্যই অন্তত দুটো কথা লিখে পাঠায় যাতে তিনি জানতে পারেন যে ভালো আছে সে
দু’দিন স্বামীকে ছেড়ে থাকতে হবে, এতে কষ্ট হচ্ছিল কিটির, কিন্তু লেভিনের সজীব মূর্তি, শিকারীর হাই-বুট আর সাদা ব্লাউজে যা কেমন যেন আরো বড় আর বলিষ্ঠ মনে হচ্ছিল, এবং তার কাছে দুর্বোধ্য শিকারের উত্তেজনার দীপ্তি—এসব দেখে লেভিনের আনন্দের জন্য কিটি নিজের দুঃখটুকু ভুলে গেল, ফুর্তি করেই বিদায় দিলে তাঁকে।
‘মাপ করবেন সাহেবেরা!’ গাড়ি-বারান্দায় ছুটে এসে তিনি বললেন, ‘প্রাতরাশ দিয়েছিল? পাটকিলে রঙের
ঘোড়াটা ডাইনে কেন? যাক-গে কিছু এসে যাবে না। লাস্কা নেমে আয়, বসবি।’
বলদগুলোর কি করা হবে জিজ্ঞেস করতে এসেছিল গোপালক, গাড়ি-বারান্দার কাছে সে অপেক্ষা করছিল। তার দিকে ফিরে লেভিন বললেন, ‘পালে ছেড়ে দাও। মাপ করবেন, আরও এক বেটা ছ্যাঁচোড় আসছে।’
লেভিন উঠে বসেছিলেন গাড়িতে, সেখান থেকে নেমে গেলেন ভাড়া করা ছুতারের কাছে, মাপকাঠি হাতে সে গাড়ি-বারান্দার দিকে আসছিল।
‘কাল সেরেস্তোয় এলে না আর এখন আমাকে আটকে রাখছো। কি ব্যাপার?’
‘আরও একটা পাক দিতে আজ্ঞা করুন। মাত্র তিনটা ধাপ জুড়লেই চলবে। একেবারে যা চাই। নির্ঝঞ্ঝাট হবে।’
‘আমার কথা শুনলে পারতে’, বিরক্তিতে বললেন লেভিন, ‘বলেছিলাম আগে ফ্রেমটা কর, পরে সিঁড়ির ধাপগুলো বানিয়ো। এখন আর উপায় নেই, আমি যেমন বলেছিলাম তাই কর। নতুন করে বানাও।’
ব্যাপারটা হয়েছিল এই : বাড়ির একটা নতুন অংশ করতে গিয়ে ছুতার সিঁড়িটা আলাদা করে বানিয়ে তার উচ্চতার হিসেবে না করে তা নষ্ট করে ফেলে এবং তা যথাস্থানে বসাতে গিয়ে দেখা গেল তা ঢালু হয়ে গেছে। এখন সে ওই সিঁড়িটাই রেখে তার সাথে তিনটা ধাপ যোগ করতে চাইছে।
‘অনেক ভালো হবে।’
‘তিন ধাপ নিয়ে ওটা কোন কাজে লাগবে?’
‘দেখুন কেনে’, অবজ্ঞার হাসি হেসে বলল ছুতার, ‘একেবারে ফ্রেমে ঢুকে যাবে। মানে শুরু করতে হবে নিচু থেকে’, বললে একটা নিশ্চিতির ভঙ্গি করে। ‘এক-ধাপ দু’ধাপ করে লেগে যাবে একদম।’
‘লম্বায় যে আরো তিন ধাপ… কোথায় তা পৌঁছবে?’
‘মানে নিচু থেকে শুরু করলে পৌঁছে যাবে’, একগুঁয়ের মত নিশ্চিত কণ্ঠে বলল ছুতার।
‘দেয়াল ফুঁড়ে একেবারে সিলিঙের নিচে।’
‘আজ্ঞে দেখুন কেনে—নিচু থেকে যে শুরু হচ্ছে। এক ধাপ, দু’ধাপ করে বাস—পৌঁছে যাবে।’
বন্দুকের নল পরিষ্কার করার একটা শিক নিয়ে ধুলোর মধ্যে লেভিন সিঁড়ি এঁকে দেখাতে লাগলেন তাকে।
‘এখন দেখছো তো?’
‘যা বলবেন’, ছুতার বলল, হঠাৎ চোখ তার জ্বলজ্বল করে উঠল, মনে হল শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা তার মাথায় ঢুকেছে, ‘বোঝা যাচ্ছে ব্যাপারটা, তাহলে নতুন করে বানাতে হবে।’
‘হ্যাঁ, তাই কর যা বললাম!’ গাড়িতে উঠতে উঠতে চিৎকার করে বলল লেভিন, ‘চালাও! কুকুরগুলোকে ধরে রেখো ফিলিপ!’
পরিবার আর বিষয়-আশয়ের সমস্ত ঝামেলা পেছনে ফেলে লেভিন এমন একটা প্রবল জীবনানন্দ আর প্রত্যাশা বোধ করছিলেন যে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল না তাঁর। তা ছাড়া অকুস্থল কাছিয়ে আসতে প্রতিটি শিকারীই যা বোধ করে, তেমন একটা একাগ্র উত্তেজনা হচ্ছিল তাঁর। কোন কিছু নিয়ে এখন তাঁর যদি কোন ভাবনা থেকে থাকে, তবে সেটা এই নিয়ে যে কলপেনস্কি জলায় তাঁরা কিছু পাবেন কিনা, ক্রাকের তুলনায় কেমন কীর্তি দেখাবে লাস্কা, এবং আজ তিনি নিজে ভালো গুলি করতে পারবেন কি। যে করেই হোক এই নতুন লোকটার সামনে নিজেকে যেন লজ্জা পেতে না হয়, অব্লোন্স্কি যেন তাঁকে ছাড়িয়ে না যায়—এসব চিন্তাই মাথায় আসছিল তাঁর।
অব্লোন্স্কিরও মনোভাব হচ্ছিল একই রকম এবং তিনিও কথা বলতে চাইছিলেন না। শুধু ভাসেকা ভেস্লোভস্কি ফুর্তিতে বকে চললেন অনর্গল। এখন তাঁর কথা শুনে গত সন্ধ্যায় লেভিন যে তাঁর সম্বন্ধে অন্যায় ধারণা করেছিলেন তা স্মরণ করে লজ্জা হল তাঁর। ভাসেকা সত্যিই খাসা ছোকরা, সহজ সরল ভালোমানুষ, এবং অতি ফুর্তিবাজ। লেভিন অবিবাহিত থাকতে দেখা হলে ওঁর সাথে ঘনিষ্ঠ হয়ে উঠতে পারতেন। জীবন সম্পর্কে তাঁর কেমন একটা উৎসবের মনোভাব আর বাবুগিরির হেলাফেলা চাল খানিকটা ভালো লাগেনি লেভিনের। ওঁর যে লম্বা লম্বা নখ, টুপিটা এবং উপযোগী আরো অনেক কিছু আছে, তার জন্য নিজেকে যেন নিঃসন্দেহে অতি গুরুত্বপূর্ণ বলে ভাবছিলেন তিনি; কিন্তু সেটা মার্জনা করা যায় তাঁর ভালোমানুষি আর সৌজন্যের জন্য। তাঁর চমৎকার সহবত, ইংরেজি ও ফরাসি ভাষায় দখল, এবং উনি যে তাঁরই জগতের লোক, এ সবের জন্য তাঁকে ভালো লাগল লেভিনের।
ভাসেকার ভারি ভালো লেগেছিল জোয়ালের বাইরে বাঁয়ে বাঁধা দেন স্তেপ অঞ্চলের ঘোড়াটাকে। কেবলি তারিফ করছিলেন তার।
‘কি চমৎকার হয়ে স্তেপের ঘোড়ায় চেপে স্তেপে ছোট, অ্যাঁ? তাই না?’ বলছিলেন তিনি।
স্তেপের ঘোড়ায় চেপে তিনি যে ছুটছেন, নিজের সম্পর্কে তাঁর এই কল্পনাটা খানিকটা উদ্দাম, কাব্যিক, বাজে; কিন্তু তাঁর সরলতা, বিশেষ করে তাঁর রূপ, মিষ্টি হাসি, সুশ্রী ভঙ্গিমার সাথে মিলে খুবই আকর্ষণীয় লাগছিল। তাঁর স্বভাবটাই লেভিনের কাছে মনোরম বলে, নাকি গতকালের পাপ স্খালনের জন্য তাঁর মধ্যে সবকিছু ভালো দেখতে চাইচ্ছেন বলে, সে যাই হোক, লেভিনের ভালো লাগল তাঁর সঙ্গ।
তিন ভার্স্ট চলে যাবার পর ভেস্লোভস্কির হঠাৎ টনক নড়ল যে চুরুটের বাক্স আর মানি ব্যাগ নেই, মনে করতে পারলেন না ওগুলো হারিয়েছেন না ফেলে এসেছেন টেবিলে। মানি ব্যাগে ছিল তিনশ সত্তর রুল, তাই ব্যাপারটা ফেলে রাখা যায় না।
‘জানেন লেভিন, আমি এই দনের ঘোড়াটায় বাড়ি ফিরে যাই। চমৎকার হবে, এ্যা?’ এই বলে প্ৰায় নামতে যাচ্ছিলেন তিনি।
‘আপনি কেন?’ ভাসেন্কার ওজন অন্তত ছয় পুদ হবার কথা, মনে মনে এই হিসেব করে লেভিন বললেন, ‘আমি কোচোয়ানকে পাঠাচ্ছি।’
কোচোয়ান বাড়তি ঘোড়াটায় চেপে চলে গেল, লেভিন নিজে গাড়ি চালাতে লাগলেন।
নয়
‘তা আমাদের পথটা কেমন হবে? বুঝিয়ে দাও তো ভালো করে’, বললেন অব্লোন্স্কি।
‘এই আমাদের পরিকল্পনা : এখন আমরা যাচ্ছি গভদেভোতে। গভজ্দেবোর এদিকটায় বড় স্নাইপের জলা। আর ওদিকটায় অপূর্ব স্নাইপ ঝিল, বড় স্নাইপও আছে। এখন গরম, আমরা পৌঁছব (বিশ ভার্স্ট) সন্ধের দিকে। সন্ধ্যার মাঠে কিছু শিকার করা যাবে, রাত কাটাব আর বড় জলা কাল সকালে।’
‘আর পথে কিছু পড়বে না?
‘আছে, কিন্তু দেরি হয়ে যাবে। তা ছাড়া গরম। দুটো চমৎকার জায়গা আছে, কিন্তু কিছু মিলবে কিনা সন্দেহ।’ লেভিনের নিজেরই ইচ্ছে হচ্ছিল জায়গা দুটোয় যাবার, কিন্তু বাড়ি থেকে তা বেশি দূরে নয়, সব সময়ই তিনি শিকারে যেতে পারেন সেখানে, তাছাড়া জায়গাটা ছোট, তিন শিকারী ধরবে না। সেই জন্য কিছু মিলবে কিনা সন্দেহ বলে তিনি মিথ্যাচার করেন। শিগগিরই ছোট জলাটার কাছে এসে গেল গাড়ি। লেভিন চেয়েছিলেন পাশ কাটিয়ে চলে যাবেন, কিন্তু অব্লোন্স্কির অভিজ্ঞ শিকারী চোখ রাস্তা থেকে নজরে পড়া জলো জায়গাটা শিকারের জায়গা বলে ধরে ফেলল।
‘যাব নাকি?’ ছোট জলাটা দেখিয়ে বললেন তিনি।
‘লেভিন, চলুন যাই! কি চমৎকার!’ অনুরোধ করতে লাগলেন ভাসেকা ভেস্লোভস্কি, ফলে লেভিন রাজি না হয়ে পারলেন না।
গাড়ি থামতে না থামতেই কুকুর দুটো পাল্লাপাল্লি করে ছুটল জলার দিকে।
‘ক্রাক! লাস্কা!…’
কুকুর দুটো ফিরে এল।
‘তিনজনের পক্ষে বড় ঘেঁষাঘেঁষি হবে। আমি এইখানেই থাকব’, লেভিন বললেন এই আশায় যে পিউইট ছাড়া আর কিছু ওঁরা পাবেন না। কুকুর দেখে তারা পালায় আর এখন জলার ওপর দুলে দুলে উড়ে করুণ কান্না জুড়েছে।
‘উঁহু! চলুন লেভিন, চলুন একসাথে!’ ডাকলেন ভেস্লোভস্কি।
‘সত্যিই ঘেঁষাঘেঁষি। লাস্কা আবার, লাস্কা! দুটো কুকুর কি আপনার দরকার হবে?’
গাড়ির কাছে রয়ে গেলেন লেভিন, ঈর্ষার দৃষ্টিতে দেখতে লাগলেন শিকারীদের। গোটা জলা তাঁরা পাড়ি দিলেন। পিউইট ছাড়া কিছুই ছিল না জলায়, তার একটা মেরেছিলেন ভাসেকা
‘দেখলেন তো’, লেভিন বললেন, ‘জলার জন্য আমি দ্বিধা করিনি, শুধু সময় নষ্ট।’
‘না, তাহলেও বেশ ফুর্তি হল। আপনি দেখেছিলেন?’ হাতে বন্দুক আর পাখিটা নিয়ে আনাড়ির মত গাড়িতে উঠতে উঠতে বললেন ভাসেকা ভেস্লোভস্কি, ‘কি চমৎকার মারলাম এটাকে! তাই না? কিন্তু সত্যিকার জলায় শিগগিরই পৌঁছব কি? হঠাৎ হেঁচকা মেরে ছুটতে গেল ঘোড়াগুলো, কার যেন বন্দুকের নলে ঘা লাগল লেভিনের মাথায়, শোনা গেল গুলি ছোঁড়ার আওয়াজ। আওয়াজটা অবশ্য আগেই হয়েছিল, কিন্তু লেভিনের কাছে ঘটনা এইরকম লেগেছিল। ব্যাপারটা হয়েছিল এই যে ভেস্লোভস্কি তাঁর বন্দুক লক করতে গিয়ে একটা ঘোড়া খাড়াই রেখেছিলেন। কারো ক্ষতি না করে কার্তুজ ঢুকে যায় মাটিতে। অব্লোন্স্কি ভর্ৎসনায় মাথা দুলিয়ে মৃদু হাসলেন ভেস্লোভস্কির দিকে চেয়ে। কিন্তু তিরস্কার করতে মন হচ্ছিল না লেভিনের। প্রথমত, যে কোন রকম তিরস্কারই মনে হতে পারত কেটে যাওয়া বিপদটার জন্য ভয় আর কপালের ফোলাটার কারণে; দ্বিতীয়ত, ভেস্লোভস্কি প্রথমটা এত সরল রকমে মুষড়ে পড়েছিলেন এবং পরে সকলের আঁকানিতে এমন ভালোমানুষি চিত্তজয়ী হাসি হাসতে লাগলেন যে নিজেও না হেসে পারা গেল না।
দ্বিতীয় জলাটার কাছে তাঁরা যখন এলেন, যেটা বেশ বড় গোছের, শিকারে অনেক সময় নেবার কথা, লেভিন বোঝালেন না নামতে। কিন্তু ভেস্লোভস্কি আবার অনুরোধ করতে লাগলেন। জলাটা সরু বলে লেভিন আবার অতিথিবৎসল গৃহস্বামীর মত রয়ে গেলেন গাড়ির কাছে
পৌঁছতেই ক্রাক সোজা ছুটল ঘেসো চাপড়াগুলোর দিকে। কুকুরটার পেছনে প্রথম ছুটলেন ভাসেকা ভেস্লোভস্কি। অবলোন্স্কি তাঁদের কাছে পৌঁছতে না পৌঁছতেই উড়ে উঠল একটা বড় স্নাইপ। ভেস্লোভস্কির গুলি ফসকাল, পাখিটা উড়ে গিয়ে আবার বসল একটা ঘেষো মাঠে। সেটা ছেড়ে দেওয়া হল ভেস্লোভস্কির জন্য। ক্রাক আবার পাখিটাকে খুঁজে বার করে দাঁড়িয়ে পড়ল, ভেস্লোভস্কি সেটাকে মেরে ফিরে গেল গাড়ির কাছে।
‘এবার আপনি যান, আমি থাকছি ঘোড়ার কাছে’, বললেন তিনি। শিকারীর ঈর্ষা কুরে কুরে খেতে শুরু করেছিল লেভিনকে। ভেস্লোভস্কির হাতে লাগাম দিয়ে তিনি চলে গেলেন জলায়।
লাস্কা অনেকক্ষণ ধরে করুণ সুরে কেঁউ-কেঁউ করছিল, অভিযোগ করছিল তার প্রতি অন্যায়ের, এখন সে সোজা ছুটে গেল লেভিনের পরিচিত ঘাসের চাপড়ায় আকীর্ণ নির্ভরযোগ্য একটা জায়গায় যেখানে ক্রাক যায়নি।
‘ওকে থামাচ্ছ না কেন?’ চেঁচালেন অব্লোন্স্কি।
‘ও ভয় পাইয়ে দেবে না’, জবাব দিলেন লেভিন। নিজের কুকুরের জন্য আনন্দ হচ্ছিল তাঁর, চললেন তার পেছু পেছ্।
চেনা চাপড়াগুলোর দিকে লাস্কা যতই কাছিয়ে আসছিল, ততই তার অন্বেষণে দেখা দিচ্ছিল একটা গুরুত্বের ভাব। জলার ছোট্ট একটা পাখি শুধু মুহূর্তের জন্য বিমনা করেছিল তাকে। লাস্কা চাপড়াগুলোকে একটা পাক দিয়ে দ্বিতীয় পাক দিতে যাচ্ছিল, হঠাৎ কেঁপে উঠে নিথর হয়ে গেল।
‘এসো, এসো স্তিভা!’ লেভিন চিৎকার করে ডাকলেন। টের পাচ্ছিলেন তিনি বুক তাঁর কি প্রচণ্ড ঢিপঢিপ করছে, হঠাৎ যেন তাঁর উত্তেজিত কর্ণকুহরে কি-একটা জানলা খুলে গিয়েছে আর সমস্ত শব্দ দূরত্বের বোধ না রেখেই এলোমেলোভাবে কিন্তু প্রচণ্ডরকম ঘা দিচ্ছে তাঁকে। অব্লোন্স্কির পদধ্বনি শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি আর মন হচ্ছিল তা যেন দূরে ঘোড়ার খুর ঠোকার শব্দ, যে চাপড়ায় তিনি পা দিয়েছিলেন তার কোণে শিকড় সমেত উপড়ে আসা ঘাসের ঠুনকো শব্দ শুনতে পেলেন আর মনে হল তাঁর সেটা স্নাইপ ওড়ার শব্দ। পেছনে খানিক দূরে পানিতে ছপছপ শব্দ, কিন্তু সেটা কি ধরতে পারলেন না।
‘পা রাখার জায়গা খুঁজে তিনি এগিয়ে গেলেন কুকুরের দিকে।
‘নে!’
বড় নয়, ছোট একটা স্নাইপ উড়ে গেল কুকুরের কাছ থেকে লেভিন বন্দুক তুললেন, কিন্তু যেই তাক করতে যাবেন ঠিক সেই সময়েই ছপছপানিটা বেড়ে উঠল, কাছিয়ে এল, আর সেই শব্দের সাথে যোগ দিল ভেস্লোভস্কির গলা, অদ্ভুত রকম চিৎকার করে কি যেন বলছেন। লেভিন দেখতে পেলেন যে পাখিটাকে তিনি তাক করেছেন পেছন থেকে, যেটা উচিত নয়, তা সত্ত্বেও গুলি করলেন।
গুলি যে ফসকেছে সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে লেভিন ফিরে তাকালেন এবং দেখলেন যে গাড়ি-ঘোড়া রাস্তায় আর নেই, জলায়।
শিকার দেখার জন্য ভেস্লোভস্কি জলায় গাড়ি চালিয়ে আসেন এবং ঘোড়াগুলোকে পাঁকে আটকে ফেলেন। ‘চুলায় যা তুই!’ আটকে যাওয়া গাড়ির কাছে ফিরে মনে মনে উচ্চারণ করলেন লেভিন, ‘কেন এলেন এখানে?’ শুকনো গলায় ওঁকে তিনি বলে কোচোয়ানকে ডাক দিয়ে ঘোড়া খুলতে লাগলেন।
লেভিনের এই জন্য রাগ হয়ে গিয়েছিল যে তিনি শিকারও ফস্কালেন, ঘোড়াগুলোও আটকে পড়েছে, আর প্রধান কথা, ঘোড়া খোলার জন্য অব্লোন্স্কি বা ভেস্লোভস্কি কেউই তাঁকে আর কোচোয়ানকে সাহায্য করছেন না, কেননা ঘোড়ার জোতটা কি ব্যাপার সে সম্পর্কে দুজনের কারুরই সামান্যতম ধারণাও ছিল না। জায়গাটা একেবারে শুকোন ছিল, ভাসেকার এই নিশ্চিতিদানে একটা কথাও না বলে লেভিন ঘোড়াগুলোকে খুলে আনার জন্য নীরবে খেটে চললেন কোচোয়ানের সাথে। কিন্তু পরে, কাজের উত্তেজনায় এবং এই দেখে যে মাডগার্ড ধরে ভেস্লোভস্কি গাড়িটাকে এত মন দিয়ে প্রাণপণে টানছেন যে সেটাকে ভেঙেই ফেলবেন বুঝি, লেভিন নিজেকে এই বলে ভর্ৎসনা করলেন যে গতকালকার অনুভূতির প্রভাবে ভেস্লোভস্কির সাথে তিনি বড় বেশি নিষ্প্রাণ ব্যবহার করেছেন, বিশেষ রকমের সৌজন্য দেখিয়ে চেষ্টা করলেন নিজের এই রুক্ষতাটা মুছে ফেলতে। যখন সব ঠিকঠাক হয়ে গেল, গাড়ি দাঁড়াল রাস্তায়, লেভিন খাবার দিতে বললেন।
‘ভালো খিদে মানে বিবেকও ভালো। এই কুক্কুটশাবক যাচ্ছে আমার প্রাণের গভীরে।’ আবার খুশি হয়ে উঠে দ্বিতীয় কুক্কুটশাবকটিকে শেষ করে ফরাসি ভাষায় ইয়ার্কি করলেন ভাসেকা। ‘তাহলে আমাদের বিপদ ঘুচেছে; এখন সব চলবে ভালোয় ভালোয়। শুধু আমি আমার দোষের জন্য কোচোয়ানের বাক্সে বসতে বাধ্য। তাই না? এ্যা? উঁহু, আমি অটোমেডন। দেখুন-না কেমন করে আমি আপনাদের নিয়ে যাই!’ লেভিন কোচোয়ানকে বাক্সে উঠতে দিতে বলায় লাগাম না ছেড়ে জবাব দিলেন তিনি। ‘উঁহু, আমাকে পাপ স্খালন করতেই হবে আর কোচোয়ানের বাক্সে আমার চমৎকার লাগে।’ গাড়ি ছেড়ে দিলেন তিনি।
লেভিনের খানিকটা ভয় হচ্ছিল যে ঘোড়াগুলোকে উনি কষ্ট দেবেন, বিশেষ করে বাঁয়ের পাটকিলেটাকে যেটাকে তিনি সামলাতে পারছিলেন না; কিন্তু অজ্ঞাতসারেই ওঁর ফুর্তিতে লেভিন আত্মসমর্পণ করলেন, বাক্সে বসে সারা রাস্তা উনি যে রোমান্সগুলো গেছে যাচ্ছিলেন, শুনতে লাগলেন তা অথবা দেখতে লাগলেন ইংরেজ কিভাবে চার ঘোড়ার গাড়ি চালায় তার অভিনয়। খাওয়া-দাওয়ার পর অতি ফুর্তির মেজাজে তাঁরা পৌঁছলেন গভজ্দেভো জলায়।