আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৬.৩০

ত্রিশ

সি্‌ভ্‌য়াজস্কি লেভিনের হাত ধরে তাকে সাথে করে চললেন নিজেদের লোকদের কাছে।

এখন আর ভ্রন্‌স্কিকে এড়ানো যায় না। অব্‌লোন্‌স্কি আর কজ্‌নিশেভের সাথে দাঁড়িয়ে তিনি সোজা তাকিয়ে ছিলেন লেভিনের দিকেই।

‘ভারী আনন্দ হল। মনে হচ্ছে প্রিন্সেস শ্যেরবাৎস্কায়ার বাড়িতে…আপনার সাথে দেখা হবার সৌভাগ্য হয়েছিল আমার’, লেভিনের দিকে হাত বাড়িয়ে দিয়ে ভ্রন্‌স্কি বললেন।

‘হ্যাঁ, আমাদের সাক্ষাৎটা আমার খুবই মনে আছে’, সিঁদুরে লাল হয়ে লেভিন বললেন এবং তখনই ফিরে কথা শুরু করলেন বড় ভাইয়ের সাথে।

সামান্য হেসে সি্‌ভ্‌য়াজস্কির সাথে আলাপ চালিয়ে গেলেন ভ্রন্‌স্কি, কিন্তু লেভিন বড় ভাইয়ের সাথে কথা বলতে বলতে ক্রমাগত তাকাচ্ছিলেন ভ্রন্‌স্কির দিকে, ভাবছিলেন তার রূঢ়তা মোচনের জন্য কথা বলা যায় কি বিষয়ে

‘এখন তাহলে ব্যাপারটা কি নিয়ে?’ সি্‌ভ্‌য়াজস্কি আর ভ্রন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

‘স্নেৎকোভকে নিয়ে। দরকার উনি হয় আপত্তি করুণ নয় সম্মতি দিন’, জবাব দিলেন সি্‌ভ্‌য়াজস্কি।

 ‘তা উনি সম্মতি দিয়েছেন, নাকি দেননি?

‘ব্যাপারটাই তো এই যে, তিনি কোনটাই করছেন না’, বললেন ভ্রন্‌স্কি।

‘উনি যদি আপত্তি করেন, কে দাঁড়াবে?’ ভ্রন্‌স্কির দিকে তাকিয়ে বললেন লেভিন।

‘যে চায়’, সি্‌ভ্‌য়াজস্কি বললেন।

‘আপনি দাঁড়াবেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।

‘অন্তত আমি নই’, বিব্রত হয়ে কজ্‌নিশেভের কাছে দণ্ডায়মান বিষজিহ্ব ভদ্রলোকের দিকে সভয়ে দৃষ্টিপাত করে সি্‌ভ্‌য়াজস্কি বললেন।’

‘কে তাহলে? নেভেদোভস্কি?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন। টের পাচ্ছিলেন যে তিনি একটা গোলমাল করে ফেললেন।

কিন্তু ব্যাপারটা আরো খারাপ। নেভেদোভস্কি আর সি্‌ভ্‌য়াজস্কি ছিলেন দুই প্রতিদ্বন্দ্বী প্রার্থী।

‘আমি কোনক্রমেই নই’, জবাব দিলেন বিষজিহ্ব ভদ্রলোক।

বোঝা গেল ইনিই নেভোদোভস্কি। সি্‌ভ্‌য়াজস্কি তার সাথে পরিচয় করিয়ে দিলেন লেভিনের

‘কি, তোমারও আঁতে ঘা লেগেছে?’ ভ্রন্‌স্কির দিকে চোখ মটকে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘এ যেন ঘোড়দৌড়, বাজিও রাখা যায়।’

‘হ্যাঁ, ঘা লেগেছে’, ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘ব্যাপারটা হাতে একবার নিলে তার হেস্তনেস্ত করার ইচ্ছে হয়। সংগ্রাম ভুরু কুঁচকে নিজের শক্ত চেপে বললেন তিনি।

‘কি কাজের লোক সি্‌ভ্‌য়াজস্কি! সব কিছু ওর কাছে পরিষ্কার।’

‘ও হ্যাঁ’, অন্যমনস্কভাবে জবাব দিলেন ভ্রন্‌স্কি।

নীরবতা নামল আর সে সময় কিছু-একটার দিকে তাকাতে হয় বলে ভ্রন্‌স্কি তাকালেন লেভিনের দিকে। তার পা, তার উর্দি, তার মুখের দিকে তার বিষণ্ণ দৃষ্টি তাঁর দিকেই নিবদ্ধ দেখে কিছু-একটা বলতে হয় বলে মন্তব্য করলেন। ‘আপনি বরাবর গ্রামবাসি হয়েও সালিশ জজ নন কেন? সালিশ জজের উর্দি তো আপনি পরেননি দেখছি।’

‘কারণ, আমি মনে করি সালিশী আদালত একটা নির্বোধ প্রতিষ্ঠান’, মন মরার মত জবাব দিলেন লেভিন এতক্ষণ তিনি ছিলেন ভ্রন্‌স্কির সাথে কথা বলার সুযোগের অপেক্ষায়, যাতে প্রথম সাক্ষাতেই তার রূঢ়তাটা ক্ষালন করে নিতে পারেন।

‘আমি তা মনে করি না, উল্টোটা ভাবি’, শান্ত বিস্ময়ে ভ্রন্‌স্কি বললেন।

‘এটা খেলনা’, লেভিন বাধা দিলেন তাকে, ‘সালিশীর আমাদের প্রয়োজন নেই। আট বছরের মধ্যে সালিশী আদালতের কাছে আমার কোন কাজ ছিল না, যা ছিল তাতে রায় হয়েছে উল্টো। আমার ওখান থেকে আদালত চল্লিশ ভাষ্ট দূরে। যে মামলার ফয়সালা হয় দুই রুলে তার জন্যে আমাকে এজেন্ট পাঠাতে হয় পনের রুবল দিয়ে।’

এবং তিনি একজন চাষীর কথা বললেন যে কল-মালিকের কাছ থেকে ময়দা চুরি করেছিল; কল-মালিক সে কথা তাকে বলতে যে কুৎসা রটনার দায়ে মামলা ঠোকে তার বিরুদ্ধে। সমস্ত কাহিনীটি অপ্রাসঙ্গিক এবং নির্বোধোচিত, বলার সময় লেভিন নিজেই সেটা টের পাচ্ছিলেন

‘ও ভারী অসাধারণ বটে’, মধুমাখা হাসি হেসে অব্‌লোন্‌স্কি বললেন, ‘কিন্তু চলুন, মনে হচ্ছে ভোট শুরু হয়েছে,…

ওঁরা ছড়িয়ে পড়লেন।

‘আমি বুঝি না’, ভাইসব কতকগুলি উদ্ভট কাণ্ড চোখে পড়ায় কজ্‌নিশেভ বললেন, ‘আমি বুঝি না, এই মাত্রায় সর্ববিধ রাজনৈতিক বোধ হারানো যায় কেমন করে। এ বোধ আমাদের রুশীদের নেই। গুবের্নিয়া প্রমুখ আমাদের শত্রু—তুমি তাঁর সাথে দহরম-মহরম করছো, দাঁড়াতে বলছো নির্বাচনে আর কাউন্ট ভ্রন্‌স্কি…ওঁকে আমি বন্ধু বানাব না; উনি ডেকেছেন ডিনারে, আমি যাব না; কিন্তু উনি আমাদের দলে, কেন শত্রু করে তুলতে হবে ওঁকে? তারপর নেভেদোভস্কিকে তুমি বলালে সে নির্বাচনে দাঁড়াবে কিনা। এসব কেউ করে না।

‘আহ, আমি কিছুই বুঝি না! এসবই নিরর্থক ব্যাপার’, বিষণ্ন বদনে বললেন লেভিন।

‘বলছ অনর্থক, কিন্তু তার মধ্যে গিয়ে সব গুলিয়ে ফেলো।

লেভিন চুপ করে রইলেন। তাঁরা দুজনেই বড় হলঘরে গেলেন।

গুবের্নিয়া প্রমুখ বাতাসে যদিও গন্ধ পাচ্ছিলেন কিছু-একটা প্যাঁচ কষা হচ্ছে, এবং যদিও সবাই তাঁকে দাঁড়াতে অনুরোধ করেনি, তাহলেও ঠিক করলেন দাঁড়াবেন। হলঘরে সবাই চুপ করে গেলেন আর সেক্রেটারি উচ্চৈস্বরে ঘোষণা করলেন যে, গুবের্নিয়া প্রমুখ পদের জন্য ভোটে দাঁড়াচ্ছেন গার্ড ক্যাপটেন মিখাইল স্তেপানোভিচ স্নেকোভ।

উয়েদ প্রমুখেরা তাঁদের টেবিল থেকে বল ভরা প্লেট নিয়ে গেলেন রাজ্যপালের টেবিলের দিকে, শুরু হল ভোটাভুটি।

উয়েদ প্রমুখের পেছনে পেছন বড় ভাইয়ের সাথে লেভিন যখন টেবিলের দিকে যাচ্ছিলেন ফিসফিস করে অব্‌লোন্‌স্কি তাকে বললেন : ‘ডান দিকে ফেলো।’ যে সব কারণ তাঁকে বোঝানো হয়েছিল ইতিমধ্যে সে সব ভুলে গিয়ে তাঁর ভয় হল, ‘ডান দিকে’ বলে অব্‌লোন্‌স্কি ভুল করেননি তো? স্নেৎকোভ তো তাদের শত্রু। ডান হাতে বল নিয়ে বাক্সের কাছে গিয়ে ভুল করছে ভেবে একেবারে শেষ মুহূর্তে সেটা পাচার করলেন বাঁ হাতে এবং বোঝাই যায় যে তা বাঁয়েই ফেললেন। ওয়াকিবহাল যে ভদ্রলোকটি বাক্সের কাছে দাঁড়িয়ে ছিলেন কনুইয়ের এক ভঙ্গিতেই যিনি বুঝে নেন—কে কোথায় বল ফেলছে, তিনি অপ্রসন্ন হয়ে মুখ কোঁচকালেন। নিজের অন্তর্ভেদী ক্ষমতা জাহির করার অন্য কোন উপায় ছিল না তাঁর।

যখন ভোট গণনা হচ্ছিল তখন সবাই চুপ করে গেলেন। পরে একক একটি কণ্ঠ ঘোষণা করল পক্ষে-বিপক্ষে প্রদত্ত ভোটের সংখ্যা।

গুবের্নিয়া প্রমুখ নির্বাচিত হয়েছেন রীতিমত সংখ্যাধিক্য ভোটে। সবাই কলরব করে উঠলেন, সবেগে ছুটলেন দরজার দিকে। স্নেৎকোভ ভেতরে এলেন, অভিজাতরা অভিনন্দন জানিয়ে ঘিরে ধরলেন তাঁকে

‘এখন শেষ তো?’ কজ্‌নিশেভকে জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।

‘মাত্র শুরু হচ্ছে’, হেসে কজ্‌নিশেভের হয়ে জবাব দিলেন সি্‌ভ্‌য়াজস্কি। উপপ্রমুখ পেতে পারে আরো বেশি ভোট।’

আবার এ কথাটা মনে ছিল না লেভিনের। কেবল এখন তাঁর স্মরণ হল কি-একটা যেন সূক্ষ্ম চাল ছিল এর পেছনে, কিন্তু সেই সূক্ষ্মতাটা কিসে তা ভাবতে বেজার লাগল তাঁর; মন খারাপ হয়ে গেল, ইচ্ছে হচ্ছিল এই জটলা থেকে বেরিয়ে যান।

কেউ যেহেতু মন দিচ্ছিল না তাঁর দিকে, এবং মনে হল কারো প্রয়োজন নেই তাঁকে, চুপি চুপি তিনি রওনা দিলেন জলযোগের ছোট হলটায় এবং আবার পরিচারকদের দেখে ভারি হালকা লাগল তাঁর। বৃদ্ধ পরিচারক তাঁকে আমন্ত্রণ করল কিছু মুখে তুলতে, লেভিন রাজি হলেন। বরবটি সহযোগে একটা কাটলেট খেয়ে, এবং পরিচারকের সাথে তার আগেকার মনিবদের নিয়ে আলাপ করার পর লেভিনের ইচ্ছে হল না তাঁর কাছে অপ্রীতিকর হলঘরটায় ঢোকেন, গেলেন গ্যালারিতে।

গ্যালারি সুসজ্জিত মহিলায় ভরা, নিচে যে আলোচনা হচ্ছিল, রেলিঙে ভর দিয়ে তার একটা ফসকে না-যেতে দিতে তারা সচেষ্ট। মহিলাদের কাছে বসে অথবা দাঁড়িয়ে ছিলেন সুবেশী সব অ্যাডভোকেট, চশমাধারী জিমনাসিয়াম শিক্ষক, সামরিক অফিসার। সর্বত্রই আলোচনা হচ্ছিল নির্বাচন নিয়ে, গুবের্নিয়া প্রমুখ কি রকম জেরবার হয়ে পড়েছিলেন আর কি চমৎকার হয়েছিল বিতর্ক, তাই নিয়ে। একটা দলে লেভিন শুনলেন তাঁর প্রশংসা। একজন মহিলা অ্যাডভোকেটকে বলছিলেন : ‘কজ্‌নিশেবের বক্তৃতা শুনে কি যে আনন্দ হল! খাওয়া ফেলে রেখে তা শোনার মত। চমৎকার! সব কিছু পরিষ্কার, সুস্পষ্ট! আপনাদের আদালতে কেউই এমন করে বলতে পারে না। হয়ত-বা শুধু এক মেইডেল। কিন্তু তিনিও মোটেও এমন বাকপটু নন। ‘

রেলিঙের কাছে একটা খালি জায়গা পেয়ে তাতে ভর দিয়ে লেভিন দেখতে আর শুনতে লাগলেন।

অভিজাতরা সবাই নিজেদের উয়েদের জন্য আলাদা করা ঘের দেওয়া আসনগুলোয় বসে ছিলেন। হলের মাঝখানে উর্দি পরা একটি লোক তীক্ষ্ণ সরু গলায় ঘোষণা করলেন : ‘উপপ্রমুখ পদে নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন স্টাফ- ক্যাপটেন ইয়েঙ্গেনি ইভানোভিচ আপুতিন!’

মৃত্যুবৎ স্তব্ধতা নামল, শোনা গেল একটা জরাজীর্ণ ক্ষীণ গলা : ‘প্রত্যাহার করছি!’

আবার শোনা গেল : ‘নির্বাচনে দাঁড়াচ্ছেন প্রিভি কাউন্সিলর পিওত্‌র পেত্রবিচ বল!’

‘প্রত্যাহার করছি!’ শোনা গেল যুবকের একটা খেঁকখেঁকে গলা। আবার একই জিনিস শুরু হল এবং ‘আবার প্রত্যাহার করছি’। এই চলল প্রায় এক ঘণ্টা। রেলিঙে কনুই ভর দিয়ে লেভিন দেখছিলেন আর শুনছিলেন। প্রথমটা তাঁর অবাক লাগছিল, বুঝতে চেষ্টা করছিলেন—কি এর মানে; তারপর বুঝতে যে পারবেন না সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হওয়ায় তাঁর ব্যাজার লাগতে লাগল। তারপর সকলের মুখে তিনি যে উত্তেজনা আর আক্রোশ দেখেছেন, সেটা মনে পড়ায় ভারি মন খারাপ হয়ে গেল তাঁর। ঠিক করলেন, চলে যাবেন। নীচে নামতে গিয়ে দেখলেন, গ্যালারিতে এদিক- ওদিক পায়চারি করছে ফুলো-ফুলো চোখে জিমনাসিয়ামের এক ছাত্র। সিঁড়িতে দেখা হল এক যুগলের সাথে, খটখটিয়ে মহিলা দ্রুত উঠছিলেন আর সহ-অভিশংসক বলছিলেন।

‘আমি তো আপনাকে বলেছিলাম যে দেরি হবে না’, লেভিন তখন পাশে সরে গিয়ে মহিলার জন্য পথ করে দিচ্ছিলেন।

লেভিন বেরিয়ে যাবার সিঁড়ির কাছে এসে যখন ওয়েস্ট-কোট থেকে ওভারকোটের কুপন বের করছিলেন, সেক্রেটারি এসে ধরলেন তাঁকে; ‘অনুগ্রহ করুন কনস্তান্তিন দ্‌দ্‌মিত্রিচ, ভোট চলছে।’

অমন দৃঢ়ভাবে যিনি আপত্তি জানিয়েছিলেন সেই নেভোদোভস্কি দাঁড়িয়েছেন নির্বাচনে।

দরজার দিকে গেলেন লেভিন। হলের দরজা বন্ধ। সেক্রেটারি টোকা দিতে দরজা খুলে গেল, রক্তিম বদনে লেভিনের দিকে ছুটে এল দুজন জমিদার।

‘আমি আর পারছি না’, বলল রক্তিমবদনের একজন।

জমিদারের পেছনে উঁকি দিল গুবেনির্য়া প্রমুখের মুখ। আতংকে আর ক্লেশে সে মুখ ভয়াবহ।

‘আমি তোমাকে বলেছিলাম যে, কাউকে বেরোতে দেবে না!’ দারোয়ানের উদ্দেশে হুঙ্কার দিলেন তিনি। ‘আমি শুধু ঢুকতে দিয়েছি, হুজুর!’

‘হায় সৃষ্টিকর্তা!’ দীর্ঘশ্বাস ফেলে মাথা নিচু করে সাদা পেন্টালুন পরা গুবের্নিয়া প্রমুখ ক্লান্ত ভঙ্গিতে ফিরে গেলেন হলের মাঝখানে পাতা বড় টেবিলটার কাছে।

যা হবার করা হয়েছিল, নেভেদোভস্কিকে এত বেশি ভোট দেওয়া হয়েছিল যে তিনিই হলেন নতুন গুবের্নিয়া প্রমুখ। অনেকেরই ফুর্তি হল, অনেকেই সন্তুষ্ট, সুখী, অনেকে উল্লসিত, অনেকে আবার অসন্তুষ্ট, অসুখী। একেবারে হতাশ হয়ে পড়েছিলেন গুবের্নিয়া প্রমুখ, সেটা তিনি লুকাতেও পারছিলেন না। নেভেদোভস্কি যখন হল থেকে বেরোলেন, জনতা ঘিরে ধরল তাঁকে এবং সোল্লাসে তাঁর অনুগমন করতে লাগল ঠিক যেভাবে নির্বাচন উদ্বোধনের পর তারা অনুগমন করেছিল রাজ্যপালের এবং স্নেৎকোভ যখন নির্বাচিত হয়েছিলেন তখন যেভাবে তারা তার অনুগমন করেছিল।

একত্রিশ

ভ্রন্‌স্কি সেদিন নবনির্বাচিত গুবের্নিয়া প্রমুখ এবং নতুনদের বিজয়ী পার্টির অনেকের জন্য ডিনারের আয়োজন করলেন।

ভ্রন্‌স্কি নির্বাচনে এসেছিলেন। কারণ গ্রামে একঘেয়ে লাগছিল। তাছাড়া আন্নার কাছে নিজের স্বাধীনতার অধিকার ঘোষণা করতে হত এবং জেমভো পরিষদের নির্বাচনে সি্‌ভ্‌য়াজস্কি তাঁর জন্য যত কিছু করেছেন; এই নির্বাচনে তাঁকে সমর্থন করে তা পরিশোধ করা। আর সর্বোপরি অভিজাত ও ভূস্বামীর যে ভূমিকাটা তিনি বেছে নিয়েছেন, তজ্জনিত সমস্ত কর্তব্য কঠোরভাবে পালনের উদ্দেশ্যে। কিন্তু তিনি মোটেই আশা করেননি যে, নির্বাচনের ব্যাপারটা তাঁকে এমন মাতবে, উত্তেজিত করবে, আর ব্যাপারটা তিনি এত ভালোভাবে নির্বাহ করতে পারবেন। অভিজাদের মহলে তিনি একেবারে নতুন, কিন্তু স্পষ্টতই সেখানে প্রতিষ্ঠা করে নিতে পারেন এবং এ কথা ভেবে ভুল করেননি যে, অভিজাতদের মধ্যে ইতিমধ্যেই প্রভাব বিস্তার করেছেন তিনি। এ প্রভাব বিস্তারে সাহায্য করে : তাঁর ধন-সম্পত্তি এবং কাউন্ট পদ; শহরে চমৎকার একটা বাসা বা তাঁর জন্য ছেড়ে দেন তাঁর পুরানো পরিচিত শিকভ, যিনি আর্থিক ব্যাপারে নিয়োজিত, এবং কাশিনে উন্নতিশীল একটি ব্যাংকের প্রতিষ্ঠাতা; গ্রামের বাড়ি থেকে নিয়ে আসা ভ্রন্‌স্কির চমৎকার পাচক; রাজ্যপালের সাথে আগেই যিনি ছিলেন ভ্রন্‌স্কির বন্ধু ও তাঁর পৃষ্ঠপোষকতায় ধন্য; কিন্তু সবচেয়ে বেশি সবার সাথে তাঁর সহজ সমান ব্যবহার যাতে তাঁর কল্পিত অহংকার সম্পর্কে অধিকাংশ অভিজাতের ধারণা বদলায়। ভ্রন্‌স্কি নিজেই টের পাচ্ছিলেন যে, কিটি শ্যেরবাৎস্কায়ার স্বামী এই যে খেপাটে ভদ্রলোকটি কথা নেই, বার্তা নেই উন্মাদ আক্রোশে তাঁকে রাজ্যের আজেবাজে কথা বলে মনে ঝাল ঝেড়েছেন, তিনি ছাড়া যার সাথেই তাঁর পরিচয় হয়েছে, তেমন প্রতিটি অভিজাতই হয়েছেন তাঁর পক্ষপাতি। তিনি পরিষ্কার দেখতে পাচ্ছিলেন এবং অন্যরা স্বীকার করছিল যে, নেভোদোভস্কির সাফল্যে তার অবদান যথেষ্ট। আর এখন নিজের বাড়িতে খাবারের টেবিলে বসে নেভেদোভস্কির জয়োৎসব উপলক্ষে নিজের নির্বাচিতের বিজয়ের জন্য তার একটা মধুর অনুভূতি হচ্ছিল। নির্বাচনে তিনি এত বেশি মেতে উঠেছিলেন যে, তিন বছরের মধ্যে যদি তিনি বিবাহিত লোক হন, তাহলে নিজেই ভোটে দাঁড়াবেন বলে ভাবছিলেন—জকি পুরস্কার পাবার পর যেমন নিজেরই ইচ্ছা হয় ঘোড়া ছোটাবার।

এখন উৎসব হচ্ছে সেই বিজয়ী জকিকে নিয়ে। ভ্রন্‌স্কি বসে ছিলেন টেবিলের শিয়রে, ডান দিকে যুবক রাজ্যপাল, জার সুইটের অন্তর্ভুক্ত জনৈক জেনারেল। যে রাজ্যপাল গুরুগম্ভীরভাবে নির্বাচনের উদ্ভোধন করেন, বক্তৃতা দেন, অনেকের মধ্যেই সম্মান ও পদলেহনের মনোভাব জাগান—যা ভ্রন্‌স্কি দেখতে পাচ্ছিলেন, সবার কাছে তিনিই গুবের্নিয়ার কর্তা; ভ্রন্‌স্কির কাছে কিন্তু ইনি নিতান্তই কাকা মাসলভ—পেজ কোরে এই ছিল তার ডাকনাম, ভ্রন্‌স্কির সামনে তিনি অপ্রস্তুত বোধ করছিলেন আর তাঁকে চাঙ্গা করার চেষ্টা করছিলেন ভ্রন্‌স্কি। তার বাঁ দিকে তার তরুণ, অটল বিষাক্ত মুখ নিয়ে নেভদোভস্কি। তার সাথে ভ্রন্‌স্কির ব্যবহার ছিল সহজ, সশ্রদ্ধ।

সি্‌ভ্‌য়াজঙ্কি তাঁর পরাজয়টা মেনে নিলেন ফুর্তি করেই। তাঁর কাছে এটা পরাজয়েই নয়, যা তিনি নিজেই বলেন নেভেদোভস্কির উদ্দেশে পানপাত্র তোলার সময় : অভিজাতবৃন্দকে নতুন ধারা অনুসরণ করতে হবে। এর মত তার সেরা প্রতিনিধি আর পাওয়া যাবে না। সেই কারণে সমস্ত সাধু ব্যক্তিই তাঁর বর্তমান সাফল্যের পক্ষে থেকেছে, বিজয়োৎসব করছে তাঁকে নিয়ে।

ফুর্তি করে সময় কাটল আর সবাই আনন্দ করছে বলে অব্‌লোন্‌স্কি খুশি ছিলেন। অপূর্ব খাদ্যের সাথে সাথে চলছিল নির্বাচনের ঘটনাবলির বিবরণ। প্রাক্তন গুবেনির্য়া প্রমুখের অশ্রুসজল বক্তৃতাটা সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি শোনালেন কৌতুক করে। তারপর নেভেদোভস্কিকে লক্ষ করে ফোড়ন কাটলেন : হিসাব পরীক্ষার জন্য চোখের পানির চেয়ে আরো জটিল কোন পদ্ধতি নিতে হবে হুজুরকে। আরেকজন রসিক ভদ্রলোক বললেন যে, গুবের্নিয়া প্রমুখের নির্বাচন উপলক্ষে বলনাচের জন্য মোজা পরা চাপরাশিদের বরাত দেওয়া হয়েছিল। কিন্তু এখন তাদের ফেরত পাঠাতে হচ্ছে যদি অবশ্য নতুন গুবের্নিয়া প্রমুখ মোজা পরা চাপরাশিদের নিয়ে বলনাচের আয়োজন না করেন

ডিনারে সময় নেভেদোভস্কিকে সম্বোধন করা হচ্ছিল আমাদের গুবের্নিয়া প্রমুখ আর হুজুর বলে।

‘তা কেবল তারা সেই রকম আনন্দ পাচ্ছিলেন যেমন লোকে পেয়ে থাকে নববিবাহিত তরুণীকে ‘মাদাম অমুক’ বলতে পেরে। নেভেদোভস্কি ভাব করলেন খেতাবটা তার কিছু এসে যায় না। তাই শুধু নয় এটাকে তিনি ঘৃণাই করেন, কিন্তু স্পষ্ট বোঝা যাচ্ছিল। যে উনি খুশিই হচ্ছেন, তবে যে নতুন উদারনৈতিক পরিবেশের মধ্যে সবাই রয়েছেন, তার পক্ষে অশোভন একটা উল্লাস প্রকাশ না করার জন্য সংযত রাখছিলেন নিজেকে।

ডিনারের মধ্যেই নির্বাচনের ফলাফলে আগ্রহী কিছু লোকের কাছে টেলিগ্রাম পাঠানো হল। খুবই শরিফ মেজাজে ছিলেন অব্‌লোন্‌স্কি। তিনিও দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার কাছে এই মর্মে এক টেলিগ্রাম পাঠালেন; নেভেদোভস্কি নির্বাচিত হয়েছেন বারো ভোটে। অভিনন্দন। খবরটা অন্যদের দিও। চেঁচিয়ে চেঁচিয়ে তিনি টেলিগ্রামের বয়ান দিতে থাকলেন। এবং মন্তব্য করলেন, ‘ওরাও আনন্দ করুক।’ বার্তা পেয়ে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা কিন্তু দীর্ঘশ্বাস ছাড়লেন, টেলিগ্রামের পেছনে যে এক রুব্‌ল খরচ হয়েছে তার জন্য এবং বুঝলেন, এটা ডিনারের শেষদিককার ব্যাপার। তিনি জানতেন যে ভালো একটা ডিনারের শেষে টেলিগ্রাফের অপব্যবহার করা স্তিভার একটা দুর্বলতা।

উৎকৃষ্ট আহার এবং রুশী নয়, সোজা বিদেশে বোতলজাত করা সুরা মিলিয়ে সবই হয়েছিল বেশ সম্ভ্রান্ত, সহজ আর হাসি-খুশি। একমতাবলম্বী, উদারনৈতিক, কিন্তু সেই সাথে সুরসিক সজ্জন নতুন কর্মকর্তাদের নিয়ে সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি বেছেছিলেন জনা বিশেক লোকের একটা দল। নতুন গুবের্নিয়া প্রমুখ, রাজ্যপাল, ব্যাংকের ডিরেক্টার আর ‘আমাদের অমায়িক গৃহস্বামীর’ স্বাস্থ্যপান করা হল, তাও অর্ধেক রহস্য করে।

ভ্রন্‌স্কি খুশি হয়েছিলেন। মফস্বলে যে এমন একটা মধুর পরিবেশ সম্ভব তা আশা করেননি তিনি।

ডিনারের শেষে ফুর্তি জমল আরো বেশি। সার্ব ভ্রাতাদের সাহায্যের জন্য তাঁর স্ত্রী কর্তৃক আয়োজিত একটি কনসার্টে আসতে রাজ্যপাল আমন্ত্রণ জানালেন ভ্রন্‌স্কিকে, স্ত্রী তাঁর সাথে পরিচিতও হতে চান।

‘বলনাচের ব্যবস্থা আছে, সেখানে দেখতে পাবে আমাদের সুন্দরীকে। সত্যিই অপরূপা।’

‘ওটা আমার ধারায় নেই’, তাঁর মনে ধরে যাওয়া বুলিটা ভ্রন্‌স্কি ইংরেজিতে বললেন বটে, তাহলেও হেসে কথা দিলেন যে, যাবেন। টেবিল ছেড়ে যাবার আগে সবাই যখন ধূমপান করছে ভ্রন্‌স্কির সাজভৃত্য ট্রে-তে করে একটা চিঠি এনে দিল।

‘ভজ্‌ভিজেন্‌স্কয়ে থেকে একজন লোক নিয়ে এসেছে’, সে বলল অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকিয়ে

ভ্রন্‌স্কি যখন ভুরু কুঁচকে চিঠিটা পড়ছিলেন, অতিথিদের মধ্যে কে-একজন তাঁর সাজভৃত্য সম্পর্কে বলে উঠলেন ফরাসিতে : ঠিক আমাদের অভিশংসক সেক্তিৎস্কির মত দেখতে, আশ্চর্য।’

চিঠি পাঠিয়েছেন আন্না। পড়ার আগেই ভ্রন্‌স্কি জানতেন, কি তাতে লেখা আছে। নির্বাচন পাঁচ দিনের মধ্যে শেষ হবে ধরে নিয়ে তিনি কথা দিয়েছিলেন ফিরবেন শুক্রবারে। আজ শনিবার এবং তিনি জানতেন যথাসময়ে না ফেরার জন্য তিরস্কার আছে চিঠিতে। গতকাল সন্ধ্যায় তিনি যে চিঠিটা পাঠিয়েছেন সম্ভবত তা এখনো পৌঁছায়নি।

যা ভেবেছিলেন, চিঠির বক্তব্য তাই-ই। কিন্তু তার প্রকাশটা তাঁর কাছে অপ্রত্যাশিত এবং অতি বিশ্রী লাগল। আনি খুব অসুস্থ, ডাক্তার বলছে নিউমোনিয়া হতে পারে। আমি একা, মাথা খারাপ হয়ে যাবার যোগাড়। প্রিন্সেস ভারভারা কোন সাহায্য নন, বাধা। গত পরশু, গতকাল আমি তোমাকে আশা করেছিলাম, এখন লোক পাঠাচ্ছি জানতে কোথায় তুমি, কি ব্যাপার। আমি নিজেই ভেবেছিলাম যাব, কিন্তু তোমার ভালো লাগবে না, জানা থাকায় গেলাম না। কিছু-একটা জবাব দিয়ো যাতে বুঝতে পারি কি করতে হবে আমাকে।’

‘মেয়েটা অসুস্থ আর ও চাইছিল কিনা আসতে। মেয়েটা অসুস্থ আর এ রকম একটা বিদ্বেষের সুর।’

নির্বাচনের এই নিরীহ আনন্দ আর যে বিমর্ষ, দুঃসহ প্রেমের কাছে তাঁকে ফিরতে হবে, দুইয়ের মধ্যে বৈপরীত্য অভিভূত করল তাঁকে। কিন্তু যেতে হবে, রাতের প্রথম ট্রেনে বাড়ি ফিরলেন তিনি

বত্রিশ

ভ্রন্‌স্কি প্রতিবার বাইরে চলে যাবার সময় যে কাণ্ডগুলো ঘটত, তা ভ্রন্‌স্কিকে তাঁর প্রতি আসক্ত না করে নিরাসক্ত করে তুলতে পারে, এটা ভেবে দেখে ভ্রন্‌স্কি নির্বাচনে যাবার আগে আন্না স্থির করেছিলেন যে শান্তভাবে বিচ্ছেদ সইবার জন্য নিজের ওপর সর্বশক্তি প্রয়োগ করবেন। কিন্তু যাত্রার কথা ঘোষণা করতে এসে যে হিমশীতল কঠোর দৃষ্টিতে ভ্রন্‌স্কি তাকিয়েছিলেন তাঁর দিকে, তাতে আহত হন আন্না, ভ্রন্‌স্কি রওনা দেবার আগেই তাঁর সব প্রশান্তি চূর্ণ হয়ে যায়।

এই যে দৃষ্টিতে প্রকাশ পেয়েছিল স্বাধীনতার অধিকার, একাকিত্বে তা নিয়ে ভাবতে ভাবতে বরাবরের মত আন্না পৌঁছলেন নিজের সেই একই অবমাননাবোধে। ‘যখন আর যেখানে খুশি যাবার অধিকার তার আছে। শুধু নিজে যাবার নয়, আমাকে রেখে যাবারও। সব অধিকার ওর আছে, আমার কিছুই নেই। সেটা জানা থাকায় এটা করা তার অন্যায় হয়েছে। কিন্তু কি করল সে?… আমার দিকে সে চাইল হিমশীতল কঠোর মুখভাব নিয়ে। অবশ্য এখনো এটা অনিৰ্দিষ্ট, ধরা-ছোঁয়ার বাইরে, কিন্তু আগে এটা ছিল না, এ দৃষ্টি বোঝাচ্ছে অনেক কিছু’, ভাবলেন আন্না, ‘এ দৃষ্টি দেখাচ্ছে যে, প্রেম জুড়িয়ে যেতে শুরু করেছে।’

আর জুড়িয়ে যেতে যে শুরু করেছে সে বিষয়ে নিঃসন্দেহ হলেও করার কিছু ছিল না, তাঁর প্রতি তাঁর মনোভাব বদলানো যায় না কোন দিক থেকেই। ঠিক আগের মতই তিনি ওঁকে ধরে রাখতে পারেন কেবল ভালোবাসা আর আকর্ষণী শক্তি দিয়ে। ভ্রন্‌স্কি যদি তাঁকে আর ভালো না বাসেন তাহলে কি হবে, এই ভয়াবহ চিন্তাটাকে তিনি দিনে কিছু-একটা নিয়ে ব্যস্ত থেকে আর রাতে মর্ফিয়া নিয়ে চাপা দিতে পারতেন ঠিক আগের মতই। অবশ্য আরো একটা উপায় ছিল : তাঁকে ধরে রাখা নয়,–এর জন্য আন্না তাঁর ভালোবাসা ছাড়া আর কিছু চান না, কিন্তু ওঁর সাথে সন্নিহিত হওয়া এমন অবস্থায় থাকা যাতে ভ্রন্‌স্কি ওঁকে ত্যাগ না করেন। এই উপায়টা হল বিবাহবিচ্ছেদ আর দ্বিতীয় বিবাহ। এটাই চাইতে লাগলেন তিনি এবং ভ্রন্‌স্কি বা স্তিভা কথাটা প্রথম তুললেই তিনি রাজি হয়ে যাবেন ঠিক করলেন।

এসব ভাবনা-চিন্তায় আন্না ভ্রন্‌স্কিকে ছাড়া কাটালেন পাঁচ দিন, যে পাঁচ দিন ওঁর অনুপস্থিত থাকার কথা।

বেরিয়ে, প্রিন্সেস ভারভারার সাথে আলাপ করে, হাসপাতালে গিয়ে আর প্রধান কথা বইয়ের পর বই পড়ে তাঁর সময় কাটল। কিন্তু ষষ্ঠ দিনে, কোচোয়ান যখন ফিরল তাঁকে ছাড়াই, তখন ভ্রন্‌স্কি সম্পর্কে, কি তিনি করছেন সেখানে, সে সম্পর্কে চিন্তাগুলো চাপা দেবার শক্তি তাঁর আর নেই বলে তিনি অনুভব করলেন। এ সময়েই অসুখ হল মেয়ের। তার সেবা-শুশ্রূষার ভার নেন তিনি, কিন্তু তাতে মন বসল না। বিশেষত তেমন গুরুত্বর ছিল না অসুখটা। যত চেষ্টাই করুন, মেয়েটাকে ভালোবাসতে পারেননি আন্না, আর ভালোবাসার ভান করা তাঁর পক্ষে ছিল অসম্ভব। সেদিন সন্ধ্যায় একা হয়ে ভ্রন্‌স্কির জন্য এতই ভয় হল তাঁর যে প্রায় ঠিক করে ফেলেছিলেন যে শহরে যাবেন, কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখে ভ্রন্‌স্কি যে স্ববিরোধী চিঠিটা পান সেটা লেখেন এবং বার্তাবাহক মারফত পাঠান। পরের দিন সকালে ভ্রন্‌স্কির চিঠি পেলেন আন্না আর নিজেরটার জন্য অনুতাপ হল তাঁর। যাবার সময় ভ্রন্‌স্কি যে কঠোর দৃষ্টিপাত করেছিলেন, বিশেষ করে যখন জানবেন যে মেয়ের অসুখটা গুরুতর নয়, তখন তার পুনরাবৃত্তি ঘটবে ভেবে তাঁর আতংক হল। তাহলেও চিঠিটা লিখেছেন বলে তিনি খুশি। আন্না এখন মানেন যে উনি ভ্রন্‌স্কির ওপর একটা বোঝা, তাঁর কাছে আসার জন্য ভ্রনস্কি তাঁর স্বাধীনতা বিসর্জন দেন খেদের সাথে, তাহলেও তিনি আসছেন বলে আন্না খুশি। হোক আন্নাকে তাঁর ভার বোধ, কিন্তু এখানে তিনি আন্নার কাছেই থাকবেন, আন্না তাঁকে দেখতে পাবেন, জানবেন তাঁর প্রতিটি গতিবিধি।

ড্রয়িং-রুমে বাতির নিচে বসে আন্না তেঁ-র একটা নতুন বই পড়তে পড়তে শুনতে লাগলেন আঙিনায় বাতাসের আওয়াজ আর প্রতি মুহূর্তে রইলেন গাড়ি আসার অপেক্ষায়। কয়েকবার তাঁর মনে হয়েছিল যেন চাকার শব্দ শুনছেন, কিন্তু সেটা ভ্রমাত্মক। অবশেষে শোনা গেল শুধু চাকার শব্দই নয়, কোচোয়ানের চিৎকার, আচ্ছাদিত গাড়ি-বারান্দায় চাপা আওয়াজ। পেশেন্স খেলায় রত প্রিন্সেস ভারভারারও কানে গেল তা। আন্না লাল হয়ে উঠে দাঁড়ালেন, কিন্তু আগে দু’বার যা করেছেন, সিঁড়ি দিয়ে নিচে না নেমে থেমে গেলেন। নিজের ছলনার জন্য লজ্জা হল তাঁর, কিন্তু ভ্রন্‌স্কি কিভাবে তাঁকে নেবেন, সেটা ছিল অনেক ভয়ের ব্যাপার। অপমানের জ্বালা আগেই মুছে গিয়েছিল তাঁর। ভ্রন্‌স্কির মুখে এখন অসন্তোষ ফুটবে কিনা শুধু এই তাঁর এখন ভয়। তাঁর মনে পড়ল মেয়ে আজ দ্বিতীয় দিন একেবারে সুস্থ। মেয়ের ওপর তাঁর রাগই হল যে চিঠি পাঠাতেই সে সুস্থ হয়ে উঠেছে। তারপর তাঁর মনে পড়ল ভ্রন্‌স্কিকে, তাঁর হাত চোখ নিয়ে গোটাটা তিনি এখানে। তাঁর কণ্ঠস্বর শুনলেন আন্না। অমনি সব কিছু ভুলে তিনি আনন্দে ছুটে গেলেন নিচে।

‘কেমন আছে আনি?’ সিঁড়ি দিয়ে তাঁর দিকে ছুটে আসা আন্নাকে তিনি ভয়ে ভয়ে জিজ্ঞেস করলেন।

ভ্রন্‌স্কি বসে ছিলেন চেয়ারে। ভৃত্য তাঁর গরম হাই-বুট টেনে খুলছিল।

‘ও কিছু নয়, ভালো আছে।’

‘আর তুমি?’ গা ঝাড়া দিয়ে বললেন ভ্রন্‌স্কি।

নিজের দু’হাতে ভ্রন্‌স্কির একখানা হাত ধরে আন্না টেনে নিলেন নিজের কোমরের দিকে, দৃষ্টি সরালেন না তাঁর মুখ থেকে।

‘ভারি আনন্দ হল’, আন্নাকে, তাঁর কবরী, তাঁর পোশাকটা যা আন্না তাঁর জন্যই পরেছেন বলে জানেন, নিরুত্তাপ দৃষ্টিতে এসব লক্ষ করে তিনি বললেন।

এসবই ভালো লাগল তাঁর, কিন্তু ভালো লেগেছে কত কত বার! আর আন্নার যাতে এত ভয়, মুখে তাঁর স্থির হয়ে রইল সেই পাষাণ-কঠোর ভাবটা।

‘ভারি আনন্দ হচ্ছে। তুমি ভালো তো?’ ভেজা দাড়ি রুমাল দিয়ে মুছে আন্নার হাতে চুমু খেয়ে বললেন ভ্রন্‌স্কি।

আন্না ভাবলেন, ‘এতে কিছু এসে যায় না। শুধু ও এখানেই থাকলেই হল। আর যতক্ষণ সে এখানে, ততক্ষণ আমাকে ভালো না বাসার সাহস হবে না তার।’

সন্ধ্যা কাটল আনন্দে, ফুর্তিতে, প্রিন্সেস ভারভারার উপস্থিতিতে। তিনি অনুযোগ করলেন যে ভ্রন্‌স্কি না থাকার সময় আন্না মর্ফিয়া নিয়েছেন।

‘কি করা যাবে, ঘুম আসত না যে… ভাবনা-চিন্তায় ব্যাঘাত হত। ও থাকলে আমি মর্ফিয়া নিই না। প্রায় নিই না।‘

‘নির্বাচনের গল্প করলেন ভ্রন্‌স্কি আর প্রশ্ন করে আন্না তাঁকে নিয়ে এলেন প্রধান কথাটায় যা আনন্দ দিয়েছে তাঁকে, যথা তাঁর সাফল্যে। আর বাড়িতে ভ্রন্‌স্কির যাতে আগ্রহ, সে সব গল্প করলেন আন্না, আর সব কথাই হল অতি মনোরম।

কিন্তু ভর সাঁঝে, প্রিন্সেস ভারভারা চলে যাবার পর আন্না যখন দেখলেন যে ভ্রন্‌স্কি পুরোপুরি তাঁর করতলগত, তাঁর ইচ্ছে হল চিঠির দরুন সেই দুঃসহ ভাবটা মুছে দিতে। বললেন : ‘স্বীকার কর, চিঠি পেয়ে তোমার ভারি রাগ হয়েছিল, আমার কথা বিশ্বাস করোনি, তাই না?’

এ কথা বলা মাত্র তিনি বুঝতে পারলেন, এখন তাঁর প্রতি ভ্রন্‌স্কির যত ভালোবাসাই জাগুক, এটা তিনি ক্ষমা করেননি। ভ্রন্‌স্কি বললেন : ‘হ্যাঁ, চিঠিটা ছিল ভারি অদ্ভুত। এই আনির নাকি অসুখ, এই আবার তুমি আসতে চাইছ।’

‘এ সবই ছিল সত্যি।’

‘আমি তাতে সন্দেহ করিনি।’

‘না, করেছ। দেখতে পাচ্ছি তুমি অসন্তুষ্ট’।

‘এক মিনিটের জন্যেও নয়। তবে সত্যি, এটা আমার ভালো লাগে না যে তুমি যেন মানতে চাও না যে কিছু কর্তব্য আছে…’

‘কনসার্টে যাবার কর্তব্য…

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘যাক গে, এ নিয়ে কিছু আর বলব না।‘

আন্না বললেন, ‘কেন বলব না?’

‘আমি শুধু বলতে চাই যে, অবশ্যপ্রয়োজনীয় কাজ সামনে আসতে পারে। যেমন আমার মস্কো যাওয়া দরকার, বাড়িটার ব্যাপারে… হ্যাঁ, তুমি একদিনের জন্যে এসেই চলে যাও, যেভাবে…

‘আন্না, এটা নিষ্ঠুরতা। আমি সমস্ত জীবন দিতে প্রস্তুত…’

কিন্তু আন্না ওঁর কথা আর শুনছিলেন না।

‘তুমি যদি মস্কো যাও, আমিও যাব। এখানে পড়ে থাকব না আমি। হয় আমাদের ছাড়াছাড়ি হয়ে যাক, নয় একসাথে থাকব।’

‘তুমি তো জানো যে শুধু এটাই আমার কামনা। কিন্তু তার জন্যে…’

‘দরকার বিবাহবিচ্ছেদ? বেশ, আমি লিখব ওকে। আমি দেখতে পাচ্ছি যে, এভাবে আমি থাকতে পারি না… তবে আমি মস্কো যাচ্ছি তোমার সাথে।’

‘ঠিক যেন হুমকি দিচ্ছ আমাকে। তোমার সাথে আমার যেন বিচ্ছেদ না হয়, এর চেয়ে আর কিছুই তো আমি চাই না’, হেসে বললেন ভ্রন্‌স্কি।

কিন্তু এই নরম কথাগুলো যখন বললেন, চোখে তাঁর দেখা গেল শুধু শীতল নয়, নির্যাতিত, নিষ্ঠুর হয়ে ওঠা মানুষের ক্ষিপ্ত ঝলক।

সে দৃষ্টি চোখে পড়ল আন্নার এবং তার অর্থ ঠিক করলেন তিনি।

‘তাই যদি হয়, তাহলে সেটা মহা দুঃখ!’ বলল দৃষ্টিটা। এটা মুহূর্তের একটা অনুভূতি, কিন্তু আন্না কখনো ভোলেননি সেটা।

বিবাহবিচ্ছেদ চেয়ে আন্না চিঠি লিখলেন স্বামীকে। পিটার্সবুর্গে যাবার দরকার ছিল প্রিন্সেস ভারভারার। তাঁর কাছ থেকে বিদায় নিয়ে ভ্রুনস্কির সাথে তিনি চলে গেলেন মস্কোয়। প্রতিদিন কারেনিনের জবাব এবং তারপর বিবাহ বিচ্ছেদের আশায় তাঁরা এবার বাসা নিলেন স্বামী-স্ত্রীর মত।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *