আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৬.২৫

পঁচিশ

সেই একই অবস্থায় ভ্রন্‌স্কি আর আন্না। বিবাহবিচ্ছেদের কোন ব্যবস্থা না নিয়ে একইরকমে গ্রামে কাটালেন গোটা গ্রীষ্ম আর হেমন্তের একাংশ। তাঁরা ঠিক করেছিলেন কোথাও যাবেন না; কিন্তু যত বেশি তাঁরা একা একা থাকতে লাগলেন। বিশেষ করে শরতে, অতিথি যখন নেই, ততই তাঁরা অনুভব করলেন যে এ জীবনে টিকে থাকা যাবে না, বদলাতে হবে তাকে।

মনে হতে পারত এ জীবনের চেয়ে আরো ভালো কিছু কামনার থাকতে পারে না। ছিল পরিপূর্ণ প্রাচুর্য, স্বাস্থ্য, শিশু, আর কাজ ছিল দুজনেরই। অতিথি না থাকলেও আন্না নিজের রূপের দিকে মন দিচ্ছিলেন একই রকম। বই পড়ছিলেন অনেক, উপন্যাস আর গুরুত্বপূর্ণ যে সব বইয়ের তখন বেশ চল। ওঁরা যে সব বিদেশী পত্র-পত্রিকা নিতেন, তাতে যে সমস্ত বইয়ের সপ্রশংস উল্লেখ থাকত। তার বরাত দিতেন আন্না, আর পড়তেন সেই মনোযোগে যা সম্ভব কেবল একাকিত্বে। তাছাড়া যেসব বিষয় নিয়ে ভ্রন্‌স্কি ব্যস্ত ছিলেন সেগুলি নিয়েও তিনি পড়াশুনা করেন বই আর বিশেষ পত্রিকা থেকে। ভ্রন্‌স্কি সরাসরি তাঁর কাছে আসতেন কৃষি, বাস্তুকর্ম, এমন কি ঘোড়া ও ক্রীড়ার প্রশ্ন নিয়েও। তাঁর জ্ঞান আর স্মৃতিশক্তিতে অবাক হতেন তিনি। প্রথম দিকে তাঁর সন্দেহ হত, প্রমাণ চাইতেন, আর যা নিয়ে তাঁর প্রশ্ন, বইয়ে সেই জায়গাটা বার করে আন্না তাঁকে দেখিয়ে দিতেন।

আন্না হাসপাতাল নিয়েও ব্যস্ত ছিলেন। তিনি শুধু সাহায্যই করেননি, অনেক কিছুর ব্যবস্থা করেছেন, ভেবে বার করেছেন নিজেই। তাহলেও তাঁর প্রধান ব্যস্ততা ছিল নিজেকে নিয়ে, নিজে—কেননা তাঁকে থাকতে হবে ভ্রন্‌স্কির প্রিয়তমা। তাঁর জীবনের একমাত্র লক্ষ্য হয়ে দাঁড়িয়েছে এই যে কামনাটা, তাঁকে ভ্রন্‌স্কির ভালো লাগুক শুধু নয়, ভ্রন্‌স্কির দাসত্ব করারই এই আকাঙ্ক্ষাটার মূল্য দিতেন ভ্রন্‌স্কি। কিন্তু সেই সাথে আন্না যেসব প্রেমাজালে তাঁকে জড়াতে চাইতেন, ক্লেশ বোধ করতেন তিনি। যত দিন যাচ্ছিল, যত ঘন ঘন তিনি নিজেকে দেখতে পাচ্ছিলেন এসব জালে আবদ্ধ, ততই তা থেকে বেরিয়ে আসতে নয়, ইচ্ছা হত পরখ করে দেখবেন তাঁর স্বাধীনতায় তা বাধা দিচ্ছে কিনা স্বাধীন হবার এই ক্রমবর্ধমান ইচ্ছাটা না থাকলে, অধিবেশন বা ঘোড়দৌড়ের জন্য প্রতিবার শহরে যাবার সময় রাগারাগির ঘটনাগুলো না ঘটলে নিজের জীবনে সম্পূর্ণ তুষ্ট থাকতে পারতেন ভ্রন্‌স্কি। যে ভূমিকাটা তিনি বেছে নিয়েছিলেন, রুশ অভিজাত সমাজের কোষকেন্দ্র যাদের হওয়ার কথা, ধনী ভূস্বামীর সেই ভূমিকাটা শুধু তাঁর মনে ধরেছিল তাই নয়, এভাবে ছয় মাস কাটাবার পর এখন তাতে ক্রমেই তৃপ্তি পাচ্ছিলেন বেশি। তাঁর বিষয়কর্মেও তিনি ক্রমেই বেশি করে ব্যস্ত ও লিপ্ত থাকছিলেন আর তা চলছিলও চমৎকার। হাসপাতালের জন্য যে বিপুল পরিমাণ টাকা লেগেছিল, তাছাড়াও যন্ত্রপাতি, সুইজারল্যান্ড থেকে আনানো গরু এবং আরো অনেককিছুর জন্য যে খরচ সেটা অপব্যয় নয় বলে তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছিল, ভাবতেন নিজের সম্পত্তি তিনি বাড়িয়ে তুলছেন। যেখানে ব্যাপারটা আয় নিয়ে, কাঠ, শস্য, ভেড়ার লোম বেচা, জমি বিলি নিয়ে, ভ্রন্‌স্কি সেখানে হতেন পাথরের মত শক্ত, দামে ছাড় দিতেন না। এই এবং অন্যান্য সম্পত্তিতে বিষয়কর্মের বড় বড় ব্যাপারে তিনি অতি সাধারণ পদ্ধতি অবলম্বন করতেন, যাতে কোন ঝুঁকি থাকবে না। ছোটখাট ব্যাপারে হতেন অতি মনোযোগী ও হিসেবী। ভ্রন্‌স্কি ধরা দেননি জার্মানটার চালাকি আর কায়দায়, যে তাঁকে কেনাকাটায় টানছিল আর যত রকম হিসেব দিচ্ছিল তাতে প্রথমে টাকা লাগত অনেক বেশি, কিন্তু খুঁটিয়ে দেখলে ওই একই ব্যাপার করা যেত অনেক সস্তায় এবং তখনই লাভ পাওয়া যেত তা থেকে। ভ্রন্‌স্কি গোমস্তার কথা শুনতেন, প্রশ্ন করতেন এবং তার প্রস্তাবে তখনই রাজি হতেন যখন যে জিনিসটার বরাত দেওয়া বা যা নিৰ্মাণ করা হচ্ছে, তা হত খুবই নতুন, রাশিয়ায় যা অজ্ঞাত, চমক দিতে পারবে। তাছাড়া বড় একটা খরচায় তিনি তখনই মত দিতেন, যখন বাড়তি টাকা থাকত হাতে। আর তা খরচা করার সমস্ত খুঁটিনাটি খতিয়ে দেখতেন আর নিজের টাকার সেরা ফায়দা আদায় করতেন। তাই যেভাবে তিনি সম্পত্তি দেখছিলেন তা থেকে পরিষ্কার বোঝা যেত যে তিনি টাকার অপব্যয় করছেন না, সম্পত্তি বাড়িয়ে তুলছেন।

অক্টোবর মাসে কাশিন গুবের্নিয়ায় অভিজাত নির্বাচন হওয়ার কথা। ভ্রন্‌স্কি, সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি কজ্‌নিশেভ, অব্‌লোন্‌স্কির মহাল ছিল সেখানে এবং লেভিনেরও সামান্য অংশ।

নানা কারণবশত এবং তাতে অংশ নেওয়া ব্যক্তিদের জন্য নির্বাচনগুলি জনসমাজের মনোযোগ আকর্ষণ করে। নানা আলোচনা হয় তা নিয়ে, তোড়জোড় চলতে থাকে। মস্কো, পিটার্সবুর্গের লোকেরা এবং যে প্রবাসী রুশীরা কোন দিন নির্বাচনে আসত না, তারাও আসে এই নির্বাচনগুলোয়

অনেকদিন আগেই ভ্রন্‌স্কি সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিকে কথা দিয়েছিলেন যে নির্বাচনে তিনি যাবেন।

ভজ্‌দ্‌ভিজেনস্কয়েতে সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি আসতেন প্রায়ই, নির্বাচনের আগে ভ্রন্‌স্কির কাছে গেলেন তিনি

এর আগের দিনটায় প্রস্তাবিত যাত্রা দিয়ে ভ্রন্‌স্কি আর আন্নার মধ্যে প্রায় কলহ বাধার উপক্রম হয়েছিল। গ্রামাঞ্চলের সবচেয়ে কষ্টকর একঘেয়ে হেমন্তকাল তখন। তাই সংগ্রামের জন্য তৈরি হয়ে, আন্নার সাথে আগে যেভাবে কথা বলেননি কখনো, তেমন একটা নিরুত্তাপ মুখভাব নিয়ে ভ্রন্‌স্কি তাঁর যাত্রার কথা ঘোষণা করেছিলেন। কিন্তু তিনি অবাক হয়ে দেখলেন যে আন্না খবরটা নিলেন অতি শান্তভাবে, শুধু জিজ্ঞেস করলেন কবে তিনি ফিরবেন। তাঁর এই শান্ত ভাবের কারণ বুঝতে না পেরে ভ্রন্‌স্কি গভীর মনোযোগে তাকালেন তাঁর দিকে। তাঁর দৃষ্টি দেখে আন্না হাসলেন। নিজের মধ্যে গুটিয়ে যাবার এই ক্ষমতাটা ভ্রন্‌স্কির কাছে অজ্ঞাত নয়। তিনি এও জানতেন যে, আন্না এভাবে গুটিয়ে যান শুধু তখনই যখন নিজের পরিকল্পনাটা না জানিয়ে নিজের সম্পর্কে একটা স্থির সিদ্ধান্ত নেন। এটাই ভয় পাচ্ছিলেন তিনি। কিন্তু রাগারাগি এড়াতে খুবই চাইছিলেন বলে যা তিনি বিশ্বাস করতে চাইছিলেন, ভাব করলেন যেন তা বিশ্বাস করেছেন এবং অংশত সত্যিই বিশ্বাস করলেন যথা— আন্নার কাণ্ডজ্ঞান আছে।

‘আশা করি, তোমার একঘেয়ে লাগবে না?’

‘আশা করি। কাল গতিয়ে’র কাছ থেকে এক বাক্স বই পেয়েছি। না, একঘেয়ে লাগবে না।’

‘এই ভাবটাও দেখাতে চাইছে, তা বরং ভালো’, ভাবলেন ভ্রন্‌স্কি, ‘নইলে সেই একই ব্যাপার দাঁড়াবে।’

আন্না তাঁর মনের কথাটা খোলাখুলি প্রকাশ করুন, এ জেদ না ধরে ভ্রন্‌স্কি ওভাবেই চলে গেলেন নির্বাচনে। সবটা বোঝাবুঝি না করে আন্নাকে তিনি ছেড়ে গেলেন তাঁদের মিলিত জীবনে এই প্রথম। একদিক থেকে, এতে তাঁর দুশ্চিন্তা হচ্ছিল, অন্যদিকে তাঁর মনে হল এটাই ভালো। ‘প্রথমটা এখনকার মত আবছা, লুকানো কিছু-একটা থাকবে, তারপর অভ্যস্ত হয়ে যাবে। অন্তত আমি ওকে সবই দিতে পারি, কিন্তু আমার পুরুষোচিত স্বাধীনতাটা নয়’, ভাবলেন তিনি।

ছাব্বিশ

সেপ্টেম্বর মাসে কিটির প্রসবের জন্য মস্কো আসেন লেভিন। বিনা কাজে মস্কোয় এক মাস যখন কাটল, কজ্‌নিশেভ তখন নির্বাচনে যাবার উদ্যোগ করছিলেন। কশিন গুবের্নিয়ায় তাঁর মহাল আছে, এবং আসন্ন নির্বাচনের ব্যাপারে বড় একটা ভূমিকা নিচ্ছিলেন তিনি। লেভিনকে তিনি সাথে ডাকলেন, সেলেনেস্কি উয়েদ্ বাবদ একটা ভোট ছিল লেভিনের। তাছাড়া বিদেশবাসী বোনের জন্য কাশিনে খুব জরুরী একটা কাজও তাঁর ছিল—অছি আর ক্ষতিপূরণের টাকা পাওয়া নিয়ে।

মনঃস্থির করে উঠতে পারছিলেন না লেভিন। কিন্তু মস্কোতে ওঁর একঘেয়ে লাগছে দেখে কিটি পরামর্শ দিল যেতে আর লেভিনকে না জানিয়ে আশি রুব্‌ল দামের অভিজাত উর্দির বরাত দিল। উর্দির জন্য ব্যয় করা এই আশি রুলই প্রধান কারণ যা তাঁকে যেতে প্রবৃত্ত করল। তিনি কাশিনে চলে গেলেন।

আজ ছয় দিন কাশিনে আছেন লেভিন। রোজ সভায় যান, তদবির তদারক করেন বোনের কাজটা নিয়ে। কিন্তু কোন সুরাহা হচ্ছিল না তার। অভিজাতপ্রমুখের সবাই নির্বাচন নিয়ে ব্যস্ত, তাই অছি সংক্রান্ত নিতান্ত সাধারণ কাজটাও করা যাচ্ছিল না। দ্বিতীয় কাজ—টাকা পাওয়া, তাতেও বিঘ্ন ঘটছিল। ব্যাপারটা নিয়ে দীর্ঘ ছোটাছুটির পর টাকাটা পাবার মত আবস্থা হল। কিন্তু অতি পরার্থপর নোটারি চেক দিতে পারলেন না। কেননা সভাপতির সই চাই, আর কাউকে দায়িত্ব না দিয়ে সভাপতি চলে গেছেন অধিবেশনে। এসব ঝামেলা, এক জায়গা থেকে আরেক জায়গায় হাঁটাহাঁটি, অতি সহৃদয় সজ্জন যেসব ভদ্রলোকেরা পুরোপুরি বোঝেন যে আবেদনকারী খুবই অনুচিত একটা অবস্থায় পড়েছেন। কিন্তু তাঁকে সাহায্য করতে অক্ষম—তাঁদের সাথে কথা বলা নিষ্ফল এসব প্রসাস লেভিনের মধ্যে শক্তিহীনতার যন্ত্রণাকর একটা অনুভূতি জাগাচ্ছিল। যেমনটা হয় স্বপ্নে, দৈহিক শক্তি প্রয়োগ করতে গিয়ে অথচ না পেরে। এই অনুভূতিটা লেভিনের প্রায়ই হচ্ছিল তাঁর সহৃদয় এজেন্টের সাথে কথা বলতে গিয়ে। মুশকিল থেকে লেভিনকে উদ্ধার করার জন্য তিনি যেন সম্ভবপর সব কিছু করছেন। কাজে লাগাচ্ছেন নিজের সমস্ত মানাসিক শক্তি। ‘এটা করে দেখুন’, বহুবার বলেছেন তিনি, ওখানে যান— সেখানে যান’, এবং সর্বনাশা যে নিমিত্তটা সব কিছুতে ঝগড়া দিচ্ছিল, তাকে এড়িয়ে যাবার জন্য পুরো একটা পরিকল্পনাও ছকে ফেললেন। কিন্তু তখনই যোগ দিলেন, ‘তাহলেও আটকে রাখবে, তবু চেষ্টা করে দেখুন।’ লেভিনও চেষ্টা করে দেখলেন, হাঁটাহাঁটি করলেন, গেলেন। সবাই অতি ভালোমানুষ এবং অমায়িক, কিন্তু দেখা গেল অতিক্রান্ত বাধাটা আবার মাথাচাড়া দিয়েছে শেষের দিকে এবং পথ আটকে রাখছে। লেভিনের বিশেষ রকমের বিশ্রী লাগছিল যে কিছুতেই বুঝতে পারছিলেন না কার সঙ্গে তিনি লড়ছেন, তাঁর ব্যাপারটার ফয়সালা না হওয়ায় লাভ হচ্ছে কার। মনে হল কেউ সেটা জানে না; জানে না তাঁর এজেন্টও। কিউয়ে না দাঁড়িয়ে টিকিট কেনার জানালায় যাওয়া যায় না—এটা লেভিন যেমন বোঝেন, ব্যাপারটা তেমনি করে বুঝতে পারলে লেভিনেরও দুঃখ হত না; কিন্তু কাজটায় যেসব প্রতিবন্ধক দেখা দিচ্ছে, কি তার কারণ, কেন তারা আছে, কেউ বোঝাতে পারল না তাঁকে। কিন্তু বিয়ের পর থেকে অনেক বদলে গেছেন লেভিন। সহিষ্ণু হয়েছেন তিনি। যদি ধরতে না পারতেন ব্যাপারটা এমন কেন, তাহলে নিজেকে বোঝাতেন যে সব কিছু না জেনে তিনি মত দিতে পারেন না, সম্ভবত ওটাই দরকার, চেষ্টা করতেন বিক্ষুব্ধ না হবার।

এখন নির্বাচনে উপস্থিত থেকে, তাতে অংশ নিয়ে লেভিন একইভাবে চেষ্টা করছিলেন ধিক্কার না দিতে, তর্ক না করতে, সৎ ও সুন্দর যে লোকদের তিনি শ্রদ্ধা করেন তাঁর যে ব্যাপারটায় এত গুরুত্ব দিচ্ছেন, এত উৎসাহিত হচ্ছেন, সেটাও যতটা সম্ভব বুঝতে চাইছিলেন। লঘুচিত্ততাবশে আগে যা তাঁর কাছে অকিঞ্চিৎকর মনে হত, বিয়ে করার পর থেকে তার ভেতর এত নতুন নতুন গুরুত্বপূর্ণ দিক তিনি অনুমান করছিলেন, খোঁজ করছিলেন সেটার।

নির্বাচনে যে কু’দেতা ঘটবে বলে ধরা হচ্ছে তার গুরুত্ব ও তাৎপর্য তাঁকে বোঝান কজ্‌নিশেভ। গুবের্নিয়ার যে অভিজাতপ্রমুখের হাতে অছিগিরি (যা নিয়ে লেভিন এখন ভুগছেন), অভিজাতদের কাছ থেকে পাওয়া মোটা টাকা, বালিকাদের বালকদের উচ্চ বিদ্যালয়, ফৌজী তালিম, নতুন ধারায় জনশিক্ষা এবং শেষত জেমভো প্রশাসন প্রভৃতি নানা গুরুত্বপূর্ণ সামাজিক কর্তব্যের ভার ন্যস্ত। সেই স্নেৎকোভ পুরনো অভিজাত আমলের লোক, প্রচুর টাকা উড়িয়েছেন, ভালোমানুষ, নিজের ধরনে সৎ কিন্তু একেবারেই বোঝেন না নবকালের দাবি। সব ব্যাপারেই তিনি অভিজাতদের পক্ষ নিতেন। সরাসরি বিরোধিতা করেন শিক্ষা প্রসারের, আর যে জেমভো সংস্থাগুলোর বিপুল গুরুত্ব থাকার কথা, তাদের তিনি নিতান্ত সম্প্রদায় বিশেষের সংস্থা বলে গণ্য করতেন। তাঁর স্থলাভিষিক্ত করা উচিত একেবারে নতুন, তাজা, আধুনিক মনোভাবাপন্ন কর্মিষ্ঠ কোন লোককে। আর কাজটা এমনভাবে চালাতে হবে যাতে অভিজাত সম্প্রদায়কে আত্মশাসনের যেসব সুবিধা দেওয়া হয়েছে, সেটা অভিজাত হিসেবে নয়, জেমভোর উপাদান হিসেবে তা কাজে লাগানো যায়। সমৃদ্ধ কাশিন গুবের্নিয়া সব সময়ই সকলের চেয়ে এগিয়ে থেকেছে। এখানে এত শক্তি এখন জমেছে যে এখানে উচিতমত কাজ চালালে তা অন্যান্য গুবের্নিয়া, গোটা রাশিয়ার পক্ষে আদর্শস্থানীয় হতে পারে। তাই গোটা ব্যাপারটার গুরুত্ব প্রভূত। সুতরাং অভিজাতপ্রমুখ স্নেৎকোভের জায়গায় সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিকে বসাবার কথা ভাবা হচ্ছে কিংবা আরো ভালো হয় নেভেদোভস্কিকে বসালে যিনি ভূতপূর্ব অধ্যাপক, চমৎকার বুদ্ধিমান লোক, কজ্‌নিশেভের বড় বন্ধু।

সভার উদ্বোধন করলেন রাজ্যপাল। অভিজাতদের উদ্দেশে তিনি বললেন যে, তাঁর যেন কর্মকর্তাদের নির্বাচন করেন ব্যক্তিগত পছন্দ-অপছন্দের জন্য নয়, তাঁদের কৃতিত্ব। পিতৃভূমির কল্যাণ হেতু তাঁদের কাজের জন্য, এবং এই আশা তিনি প্রকাশ করলেন যে কাশিনের মাননীয় অভিজাতকুল আগেকার নির্বাচনগুলোর মতই পবিত্রভাবে নিজেদের কর্তব্য পালন করে মহারাজের আস্থার মর্যাদা রাখবেন।

বক্তৃতা শেষে রাজ্যপাল হলঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন আর অভিজাতরা কলরব করে, স্ফুর্তিতে, কেউ কেউ এমন কি উচ্ছ্বসিত হয়েই অনুসরণ করলেন তাঁকে, উনি যখন তাঁর ওভারকোট পরতে পরতে গুবের্নিয়া প্রমুখের সাথে বন্ধুর মত কথা বলছিলেন, তখন তাঁকে ঘিরে ধরলেন তাঁরা। সব কিছু বোঝা এবং কিছুই ছেড়ে না দেবার চেষ্টায় উৎকর্ণ লেভিনও ছিলেন ভিড়ের মধ্যে, রাজ্যপালকে তিনি বলতে শুনলেন, ‘মারিয়া ইভানোভনাকে দয়া করে বলবেন যে, আমার স্ত্রী খুবই দুঃখিত। কিন্তু তাঁকে নিঃস্বনিকেতনে যেতে হচ্ছে।’ এর পর অভিজাতরা ফুর্তি করে ওভারকোট খুঁজে নিয়ে সবাই গেলেন গির্জায় 1

গির্জায় লেভিন অন্য সকলের মত হাত তুলে যাজকপ্রধানের কথাগুলো আওড়ালেন এবং সাংঘাতিক এই শপথ নিলেন যে, রাজ্যপাল যা আশা করেছেন তা পূরণ করবেন। গির্জার ক্রিয়াকর্ম সব সময়ই প্রভাব বিস্তার করে লেভিনের ওপর এবং ‘ক্রুশ চুম্বন করি’ বলে তিনি যখন নবীন প্রবীণ ভদ্রলোকদের জনতার দিকে তাকিয়ে একই কথা বলতে শুনলেন, অভিভূত হলেন তিনি।

দ্বিতীয় ও তৃতীয় দিনে আলোচনা চলল অভিজাতদের তহবিল আর বালিকাদের জিমনাসিয়াম নিয়ে। কজ্‌নিশেভ বোঝলেন যে, প্রশ্ন দুটোর কোন গুরুত্ব নেই। তাই লেভিন আলোচনায় কান না দিয়ে নিজের কাজ নিয়ে হাঁটাহাঁটি করলেন। চতুর্থ দিনে রাজ্যপালের টেবিল ঘিরে গুবের্নিয়া তহবিলের হিসাব-পরীক্ষা হয়। নতুন ও পুরাতন দলের মধ্যে প্রথম সংঘাতটা হয় এখানেই। যে কমিশনের ওপর হিসাব-পরীক্ষার ভার দেওয়া হয়েছিল, তাঁরা সভার কাছে বিবৃতি দিলেন যে হিসাবে খুঁত নেই। গুবের্নিয়ার অভিজাতপ্রমুখ উঠে দাঁড়িয়ে তাঁর ওপর আস্থার জন্য অভিজাতবর্গকে ধন্যবাদ জানালেন সজল চোখে। অভিজাতরা উচ্চ কণ্ঠে শুভসম্ভাষণ জানালেন তাঁকে, করমর্দন করলেন। কিন্তু এই সময় কজ্‌নিশেভের দলের জনৈক অভিজাত বললেন যে তিনি শুনেছেন, কমিশন হিসাব-পরীক্ষা করলে অভিজাত অপমান করা হবে বলে তাঁরা মনে করছেন। কমিশনের একজন সদস্য অসাবধানে সমর্থন করলেন ব্যাপারটা। তখন দেখতে ছোটখাট অতি তরুণ কিন্তু বচনে অতি বিষজিহ্ব এক ভদ্রলোক বললেন যে, গুবের্নিয়ার অভিজাতপ্রমুখের নিশ্চয় হিসাব বুঝিয়ে দিয়ে আনন্দ হতে পারত, কিন্তু কমিশন সভ্যদের মাত্রাতিরিক্ত ভদ্রতা তাঁকে এই নৈতিক তুষ্টি থেকে বঞ্চিত করেছে। কমিশনের সভ্যরা তখন প্রত্যাহার করলেন তাঁদের বিবৃতি, আর কজ্‌নিশেভ যুক্তি বলে প্রমাণ করতে চাইলেন যে, স্বীকার করতে হবে হিসাবটা হয় পরীক্ষিত হয়েছে কিংবা হয়নি, এবং অতি খুঁটিনাটিতে বিস্তারিত করলেন এই দ্বৈধ। অপর দলের এক বাক্যবীর আপত্তি করলেন কজ্‌নিশেভের কথায়। তারপর বক্তৃতা দিলেন সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি এবং আবার বিষজিহ্ব সেই ভদ্রলোকটি। আলোচনা চলল অনেকক্ষ ধরে কিন্তু কোন সিদ্ধান্তে পৌঁছল না। লেভিনের অবাক লাগল এই দেখে যে ব্যাপারটা নিয়ে বিতর্ক চলছে এতক্ষণ, বিশেষ করে কজ্‌নিশেভকে তিনি যখন জিজ্ঞেস করেছিলেন যে তহবিলের অপচয় হয়েছে বলে তিনি মনে করেন কিনা, তখন তিনি জবাব দিয়েছিলেন : ‘আরে না! লোকটা সৎ। কিন্তু অভিজাতদের ব্যাপার পরিচালনার এই সাবেকী পিতৃতান্ত্রিক পারিবারিক পদ্ধতিটা নড়িয়ে দেওয়া দরকার।’

পঞ্চম দিনে নির্বাচিত হলেন উয়েদ্ প্রমুখেরা। কয়েকটা উয়েজদে দিনটা ডিনার পার্টি দেন তিনি।

সাতাশ

ষষ্ঠ দিনে গুবের্নিয়া কর্মকর্তাদের নির্বাচন ধার্য হয়। ছোট-বড় হলঘরগুলো ভরে উঠেছিল নানান উর্দি পরা অভিজাতে। অনেকেই এসেছিলেন শুধু এই দিনটার জন্যই কেউ ক্রিমিয়া, কেউ পিটার্সবুর্গ, কেউ বিদেশ থেকে আগত যে পরিচিতদের দেখা-সাক্ষাৎ হয়নি অনেক দিন, তাঁরা মিললেন হলগুলিতে। রাজ্যপালের টেবিল ঘিরে জারের প্রতিকৃতি তলে আলোচনা চলছিল।

বড় আর ছোট হলঘরে অভিজাতরা ভাগ হয়ে গিয়েছিল দুই শিবিরে। মতামতের বৈপরীত্য ও অনাস্থা, অন্য কাউকে কাছে আসতে দেখলে চুপ করে যাওয়া। কেউ কেউ ফিসফিস করে কথা বলতে বলতে যেভাবে দূর করিডরে চলে যাচ্ছিল, তা থেকে বোঝা যায় যে উভয় পক্ষেরই পরস্পরের কাছ থেকে লুকানো কোন ব্যাপার আছে। বাহ্যিক চেহারায় অভিজাতরা দুই দলে পড়ে— নবীন আর প্রাচীন। বুড়োদের পরনে বেশির ভাগ পুরানো কালের অভিজাত বোতাম-আঁটা উর্দি, মাথায় টুপি, পাশে তলোয়ার, নয় নিজেদের বিশেষ নৌবহরী, অশ্বারোহী, পদাতিক কাঁধপট্টি : স্পষ্টতই তা খাটো, কোমরের কাছে আঁটো, যেন পরিহিতরা বেড়ে উঠেছে তাদের মধ্যে থেকে। নবীনদের পরনে অভিজাত উর্দির বোতাম খোলা, নিচু কোমর, কাঁধের কাছটা চওড়া, সাদা ওয়েস্ট-কোট, নয় কালো কলারের আদালতী উর্দি, তাতে জলপাই পাতার নক্শা তোলা। দরবারী পোশাকও নবীনদের পরনেই, কোথাও কোথাও তা জনতার শোভা বর্ধন করছিল।

কিন্তু নবীন ও বৃদ্ধদের ভাগটা দলের ভাগাভাগির সাথে মেলেনি। লেভিন লক্ষ করলেন যে নবীনদের কেউ কেউ রয়েছে পুরানোদের দলে। আবার অতি বৃদ্ধদের কেউ কেউ ফিসফিসিয়ে কথা বলছিলেন সি্‌ভ্‌য়াজস্কির সাথে এবং স্পষ্টতই বোঝা যাচ্ছিল তারা নতুন দলের উৎসাহী সমর্থক।

ছোট যে হলটায় লোকে ধূমপান ও জলযোগ করছিল, সেখানে নিজেদের লোকজনদের একটা দলের কাছে দাঁড়িয়ে লেভিন শুনছিলেন কি তারা বলছে, আর যা বলছে সেটা বোঝায় জন্য বৃথাই নিজের মানসশক্তি খাটাচ্ছিলেন। কজ্‌নিশেভ ছিলেন মধ্যমণি, তাঁকে ঘিরে জোট বেঁধেছে অন্যেরা। তিনি সিভয়াজস্কি এবং আরেকটি উয়েদের অভিজাতপ্রমুখ, তাঁর দলভুক্ত গ্লিউস্তোভের কথা শুনছিলেন। নিজের গোটা উয়েদ নিয়ে স্নেকোভকে ব্যালট ভোটে দাঁড়াতে বলতে আপত্তি করছিলেন স্লিউস্তোভ আর য়িাজঙ্কি তাঁকে বোঝাচ্ছিলেন সেটা করার জন্য। কজ্‌নিশেভ অনুমোদন করলেন পরিকল্পনাটা। লেভিন বুঝতে পারছিলেন না যে অভিজাতপ্রমুখকে বিরোধী পক্ষ সরাতে চাইছে, তাঁকে ভোটে দাঁড়াতে বলা হবে কেন।

খানাপিনা শেষ করে শোভন পাড়-দেওয়া বাতিস্ত রুমালে মুখ মুছতে মুছতে কামেরহের উর্দি পরিহিত অব্‌লোন্‌স্কি এলেন দলটার কাছে।

দুই দিকের গালপাট্টা ঠিক করে তিনি বললেন, ‘রুখে দাঁড়াচ্ছি তো সের্গেই ইভানিচ?’

এবং যা নিয়ে কথাবার্তা হচ্ছিল তা শুনে তিনি সমর্থন করলেন সি্‌ভ্‌য়াজস্কির মত।

একটি উয়েদেই যথেষ্ট, আর সি্‌ভ্‌য়াজঙ্কি স্পষ্টতই হবে বিরোধী পক্ষ—তিনি বললেন লেভিন ছাড়া আর সবার কাছেই বোধগম্য এক ভাষায়। ‘কি কস্তিয়া, মনে হচ্ছে তুমিও পথে এসেছ?’ লেভিনের হাত ধরে তাঁকে বললেন তিনি। পথে আসতে পারলে লেভিন খুশিই হতেন, কিন্তু ব্যাপারটা যে কি নিয়ে সেটা তিনি বুঝে উঠতে পারছিলেন না। যারা কথা বলছিল তাদের কাছ থেকে কয়েক পা সরে গিয়ে অব্‌লোন্‌স্কিকে বললেন যে, তিনি বুঝতে পারছেন না কেন প্রয়োজন হল গুবের্নিয়া প্রমুখকে অনুরোধ করার।

‘অহো পবিত্র সরলতা!’ লাতিন ভাষায় কথাটা বলে ব্যাপারটা কি তা সংক্ষেপে আর পরিষ্কার করে লেভিনকে বোঝালেন অব্‌লোন্‌স্কি।

আগেকার নির্বাচনগুলোর মত সমস্ত উয়েদ যদি গুবের্নিয়া প্রমুখকে অনুরোধ করে, তাহলে সমস্ত সাদা বলের ভোটে তিনি নির্বাচিত হয়ে যাবেন। সেটা উচিত নয়। এখন আটটা উয়েজ্দ তাঁকে অনুরোধ করতে রাজি হয়েছে: দুটো উয়েদ যদি অনুরোধ করতে গররাজি হয়, তাহলে স্নেৎকোভ ব্যালট ভোটে দাঁড়াতে না চাইতে পারেন। তখন পুরানো দলটা নিজেদের মধ্যে থেকে অন্য কাউকে মনোনীত করবে। কেননা বানচাল হয়ে যাবে সমস্ত হিসাব। কিন্তু যদি শুধু একটা উয়েদ, সি্‌ভ্‌য়াজস্কির উয়েজ্দ অনুরোধ না করে, তাহলে স্নেকোভ ভোটে দাঁড়াবে। নির্বাচিত করা হবে তাঁকে, ইচ্ছা করেই বেশি ভোট দেওয়া হবে তাঁর পক্ষে, বিরোধীপক্ষের চোখে ধুলো দেওয়া হবে, তাই আমাদের প্রার্থী যখন দাঁড়াবে ওরাও ভোট দেবে তার পক্ষে

লেভিন বুঝলেন, কিন্তু পুরোটা নয়, আরো কিছু প্রশ্ন করার ইচ্ছে হয়েছিল তাঁর, কিন্তু এই সময় হঠাৎ সবাই বলতে বলতে কলরব করে এগিয়ে গেল বড় হলটায়।

‘কি ব্যাপার?’ এ্যাঁ?’ ‘কাকে?’ ‘প্রত্যয়পত্র?’ ‘কার জন্যে?’ ‘এ্যাঁ?’ ‘আপত্তি করছে?’ ‘প্রত্যয়পত্র নেই।’ ‘ফ্লেরভকে অনুমতি দিচ্ছে না।’ ‘তার নামে মামলা আছে তো কি হল?’ ‘তাহলে তো কেউই অনুমতি পাবে না।’ ‘জঘন্য ব্যাপার।’ ‘আইন!’ চারদিক থেকে লেভিন শুনতে পেলেন আর কোন-এক দিকে যাবার জন্য যারা তাড়াহুড়া করছে, ভয় পাচ্ছে কিছু-একটা বুঝি ফসকে যাবে, তাদের সবার সাথে গেলেন বড় হলে এবং অভিজাতদের ঠেলাঠেলিতে পৌঁছলেন রাজ্যপালের টেবিলের অনেকটা কাছে। সেখানে গুবের্নিয়া প্রমুখ, সিভয়াজস্কি এবং অন্যান্য পাণ্ডাদের মধ্যে উত্তপ্ত বিতর্ক চলছিল।

আটাশ

বেশ দূরেই দাঁড়িয়ে ছিলেন লেভিন। তাঁর পাশে একজন অভিজাতদের ঘড়ঘড়ে ভারী নিঃশ্বাস এবং অন্য মারেকজনের ক্যাঁচকেঁচে জুতোর সোলে পরিষ্কার করে শুনতে পাচ্ছিলেন না কথাগুলো। দূর থেকে তাঁর কানে এল শুধু অভিজাতপ্রমুখের নরম গলা, বিষজিহগব অভিজাতটির ক্যাঁককেঁকে কণ্ঠস্বর, তারপর সিভয়াস্কির গলা। লেভিন যতটা বুঝলেন ওঁরা তর্ক করছিলেন আইনের একটা ধারা, এবং তদন্তাধীন ব্যক্তি কথাটার অর্থ নিয়ে।

জনতা ভাগ হয়ে কজ্‌নিশেভকে যাবার পথ করে দিলে। বিষজিহ্ব অভিজাতের বক্তৃতা শেষ না হওয়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে তিনি বললেন যে তাঁর মনে হচ্ছে আইনের ধারাটা দেখাই ভালো, সেক্রেটারিকে অনুরোধ করলেন ধারাটা বার করতে। ধারায় লেখা ছিল, মতদ্বৈধ ঘটলে ব্যালট ভোট নিতে হবে।

কজ্‌নিশেভ ধারাটা পড়ে শুনিয়ে তার ব্যাখ্যা করতে শুরু করলেন। কিন্তু এই সময় আঁটো উর্দি পরা এক লম্বা, মাটা, কোলকুঁজো জমিদার, পিঠের দিক থেকে কলারটা যাঁর ঘাড়ে গেঁথে বসেছে, মোচে যাঁর কলপ দেওয়া, তিনি বাধা দিলেন। টেবিলের কাছে এসে তাতে তিনি তার আংটি ঠুকে চেঁচিয়ে উঠলেন।

‘ব্যালট! ভোট! কথা বলে কোন ফায়দা হবে না! ভোট!’

এই সময় হঠাৎ আরো কয়েকটা গলা শুনা গেল। আংটি পরা লম্বা ভদ্রলোকটি ক্রমেই ক্ষিপ্ত হয়ে উঠে চেঁচাতে লাগলেন সবার চেয়ে উচ্চকণ্ঠে। কিন্তু কি তিনি বলছেন সেটা বোঝা যাচ্ছিল না।

কজ্‌নিশেভ যা বলেছিলেন, তিনিও বলছিলেন তাই-ই কিন্তু বোঝা গেল, কজ্‌নিশেভ এবং তার গোটা দলটার উপর তিনি রুষ্ট, এ রোষ পরিব্যাপ্ত হচ্ছিল সমস্ত দলটায় এবং অপর পক্ষ থেকে একই রকম যদিও অনেক শিষ্টতা সম্মত আক্রোশের উদ্রেক করছিল। শুরু হল চেঁচামেচি এবং মুহূর্তের মধ্যে এমন তালগোল পাকিয়ে উঠল যে শৃঙ্খলা রক্ষার জন্য অনুরোধ করতে হল গুবেনির্য়া প্রমুখকে।

‘ব্যালট, ব্যালট! যে অভিজাত, সেই এটা বুঝবে। আমারা রক্ত দিই… মহারাজের আস্থা.. অভিজাত মুখের ইসাব-পরীক্ষা হবে না। উনি হিসাবনবিশ নন…আরে, সেটা কোন প্রশ্ন নয়…ভোট! নোংরামি!… শোনা গেল চারদিক থকে ক্ষিপ্ত আক্রোশের চিৎকার। দৃষ্টি আর মুখের ভাব ছিল তাদের কথার চেয়েও বেশি ক্ষিপ্ত ও আক্রোশপরায়ণ। মাপোসহীন বিদ্বেষ প্রকাশ পাচ্ছিল তাতে। লেভিন একেবারেই বুঝতে পারছিলেন না, ব্যাপারটা কি নিয়ে, ফ্লেভ ম্পর্কে সিদ্ধান্ত গ্রহণে ভোট নেওয়া হবে কি হবে না, এ প্রশ্নটা যে উত্তেজনায় বিতর্কিত হচ্ছিল তাতে অবাক লাগল তাঁর। যে ন্যায়সূত্র অনুসারে কজ্‌নিশেভ পরে তাঁকে যা বুঝিয়েছিলেন, যথা—সাধারণ কল্যাণের জন্য গুবের্নিয়ার মভিজাতপ্রমুখকে পদচ্যুত করা দরকার। আর পদচ্যুত করার জন্য ভোট পাওয়া চাই সংখ্যাধিক্যে; সংখ্যাধিক ভোটের জন্য ফ্লেরভকে ভোটদানের অধিকার দেওয়া প্রয়োজন; আর ফ্লেরভকে অধিকারী বলে স্বীকৃতি করাতে হলে আইনের ধারাটা ব্যাখ্যা করা আবশ্যক। সেটা তাঁর মনে ছিল না।

‘একটা ভোটেই সমস্ত ব্যাপারটার ফয়সালা হয়ে যেতে পারে, সমাজসেবায় লাগতে চাইলে এ ব্যাপারে গুরুত্ব দেওয়া, সঙ্গতিশীলতা অনুসরণ করা উচিত’, উপসংহার টেনেছিলেন কজ্‌নিশেভ।

সেটা কিন্তু লেভিনের খেয়াল ছিল না। এসব সজ্জন শ্রদ্ধেয় ব্যক্তিদের এমন বিশ্রী, ক্রুদ্ধ উত্তেজনায় দেখা তার পক্ষে কষ্টকর হচ্ছিল। কষ্টটা থেকে রেহাই পাবার জন্য তিনি বির্তকের অবসান পর্যন্ত অপেক্ষা না করেই বেরিয়ে গেলেন ছোট হলে। সেখানে ব্যুফের কাছে পরিচারকরা ছাড়া আর কেউ ছিল না। বাসন মোছা এবং ডিশ ও পানপাত্রগুলিকে যথাস্থানে রাখায় ব্যস্ত পরিচারকদের দেখে তাদের শান্ত সজীব মুখ লক্ষ করে অপ্রত্যাশিত একটা লঘুতা বোধ করলেন লেভিন, যেন গুমোট একটা ঘর থেকে বেরিয়ে এসেছেন খোলা বাতাসে। সন্তষ্ট চিত্তে পরিচারকদের দিকে তাকিয়ে তিনি পায়চারি করতে লাগলেন আগুপিছু। একজন পরিচারকের পাকা গালপাট্টা, তাকে টিটকারি দিচ্ছিল যে, অল্পবয়সীরা অবজ্ঞাভরে তাদের সে যেভাবে ন্যাপকিন ভাঁজ করা শেখাচ্ছিল, সেটা ভারি ভালো লাগল লেভিনের। বৃদ্ধের সাথে লেভিন কথা বলতে যাচ্ছিলেন, এমন সময় অভিজাতদের অছিগিরি সংক্রান্ত সজীব এক বৃদ্ধ যার দায়িত্বে গুবের্নিয়ার সমস্ত অভিজাতদের নাম ও পিতৃনাম জেনে রাখা, তিনি এগিয়ে এসে বললেন, ‘বড় ভাই আপনাকে খুঁজচ্ছেন, কনস্তান্তিন দ্‌দ্‌মিত্রিচ। ভোট শুরু হচ্ছে।’

লেভিন হলঘরে এলেন, পেলেন সাদা বল, বড় ভাই কজ্‌নিশেভের পেছনে পেছনে গেলেন টেবিলের কাছে। সি্‌ভ্‌য়াজস্কি সেখানে দাঁড়িয়ে ছিলেন একটা গুরুগম্ভীর বিদ্রূপাত্মক মুখে, দাড়ি মুঠো করে তা শুকছিলেন। কজ্‌নিশেভ বাক্সে হাত ঢোকালেন—কোথায় যেন রাখলেন নিজের বলটা, লেভিনের জন্য পথ ছেড়ে দিয়ে কজ্‌নিশেভকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘কোথায় ফেলব?’ জিজ্ঞেস করেছিলেন তিনি আস্তে করে আশেপাশের লোকেরা যখন কথা বলছিল। তিনি আশা করেছিলেন যে তার প্রশ্নটা কারো কানে যাবে না। কিন্তু যারা কথা বলছিল, চুপ করে গেল তারা অন্যায় প্রশ্নটা তাদের কানে গিয়েছিল। ভুরু কোঁচকালেন কজ্‌নিশেভ।

কঠোর স্বরে তিনি বললেন, ‘এটা প্রত্যেকের নিজ নিজ মতামতের ব্যাপার।’

কেউ-কেউ হেসে ফেললেন। লাল হয়ে উঠলেন লেভিন, আচ্ছাদনের তলে হাত ঢুকিয়ে বলটা ফেললেন ডান বাক্সে। কেননা বলটা ছিল তার ডান হাতে। বলটা ফেলার পর তার স্মরণে এল যে হাতটাই ঢোকানোর কথা। ঢোকালেন কিন্তু ততক্ষণে দেরি হয়ে গিয়েছিল, আরো বেশি থতমত খেয়ে চলে গেলেন একেবারে পিছনের সারিতে।

পক্ষে একশ ছাব্বিশ নির্বাচক, বিপক্ষে আটানব্বই অনির্বাচক! শোনা গেল ‘র’ উচ্চারণে অক্ষম সেক্রেটারির গলা। পরে উঠল হাসি। বাক্সে পাওয়া গেছে বোতাম আর দুটো বাদাম। ভোটের অধিকার পেলেন ফ্লেভ, জিতল নতুন দল।

কিন্তু পুরানো দল নিজেদের পরাজিত বলে মানছিল না। লেভিন শুনলেন যে স্নেকোভকে ভোটে দাঁড়াতে অনুরোধ করা হচ্ছে, দেখলেন অভিজাতদের একটা দল ঘিড়ে দাঁড়িয়েছে গুবের্নিয়ার প্রমুখকে, কি যেন তিনি বলছিলেন তাদের। লেভিন কাছিয়ে গেলেন। অভিজাতদের উত্তরদান প্রসঙ্গে তিনি বলছিলেন তার ওপর আস্থা, তার প্রতি অনুরাগের কথা, যার অযোগ্য তিনি। কেননা তার যা কিছু কাজ সবই অভিজাত সম্প্রদায়ের সেবায়। তাদের জন্য তিনি তার লোককর্মের বারো বছর ব্যয় করেছেন। বারকয়েক তিনি পুনরুক্তি করলেন, ‘যথাশক্তি কাজ করেছি বিশ্বাস আর সততা নিয়ে, আস্থায় মূল্য দিচ্ছি, কৃতজ্ঞ বোধ করছি।’ হঠাৎ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে থেমে গিয়ে তিনি হল ছেড়ে চলে গেলেন। চোখের পানিটা তার প্রতি অন্যায় করা হয়েছে বলে, নাকি অভিজাত সম্প্রদায়ের প্রতি তার অনুরাগের জন্য, অথবা চাপের দরুন—সে যাই হোক ব্যাকুলতা সঞ্চারিত হল অন্যান্যদের মধ্যে, বেশির ভাগ অভিজাতই আলোড়িত হল, স্নেৎকোভের প্রতি একটা কোমলতা বোধ করলেন লেভিন।

দরজার কাছে গুবেনির্য়ার প্রমুখ ধাক্কা খেলেন লেভিনের সাথে।

‘মাপ করবেন, মাপ করবেন দয়া করে’, তিনি বললেন এমনভাবে যেন বলছেন অপরিচিত কাউকে, কিন্তু লেভিনকে চিনতে পেরে ভীরুভীরু হাসলেন। লেভিনের মনে হল তিনি কিছু-একটা যেন বলতে চাইছিলেন, কিন্তু পারছিলেন না তার অস্থিরতায়। তার মুখভাব, ক্রস-আঁটা তার গোটা উর্দি আর বুনট করা সাদা পেন্টালুন পরা মুতি, যে শশব্যস্তায় তিনি চলে যাচ্ছিলেন, সব কিছু থেকে লেভিনের মনে হচ্ছিল তিনি যেন একটা তাড়িত পশু যে বুঝতে পারছে যে তার অবস্থা সঙ্গিন। তার এই মুখের ভাবটাই লেবিনের কাছে বিশেষ মর্মস্পশী ঠেকেছিল। কেননা আগের দিনই তার অছিগিরি ব্যাপার নিয়ে লেভিন দেখা করতে গিয়ে ছিল তার বাড়িতে। দেখেছিলেন তাকে সদাশয় সাংসারিক লোকের সমস্ত মহিমায়। মস্ত একটা বাড়ি, তাতে সাবেকি বংশগত সব আসবাবপত্র; চাল-না-মারা, নোংরা গোছের পুরানো চাকর-বাকর, তবে প্রভুর প্রতি সশ্রদ্ধ, বোঝা যায় তারা আগেকার ভূমিদাস, মনিবকে ছেড়ে যায়নি 1 মোটাসোটা ভালোমানুষ স্ত্রী, লেস দেওয়া টুপি মাথায়, তুর্কি শাল জড়িয়ে মেয়ের সুন্দরী কন্যা, নাতনিকে যিনি আদর করেছিলেন। জিমনাসিয়ামের ষষ্ঠ শ্রেণীর ছাত্র ছোকরা গোছের ছেলে, যে জিমনাসিয়াম থেকে এসে পিতাকে অভিনন্দন জানিয়ে চুমু খেল তার প্রকাণ্ড হাতে। গৃহকর্তার ভারিক্কি সস্নেহে কথাবার্তা আর ভাবভঙ্গি—এসবই গতকাল লেভিনের মধ্যে একটা অগোচরে শ্রদ্ধা ও সহানুভূতির উদ্রেক করেছিল। এখন এই বৃদ্ধকে তার মর্মস্পশী ও করুণ মনে হল, ভাবলেন ওকে দুটো ভালো কথা বলবেন। বললেন, ‘আপনি তাহলে আবার আমাদের অভিজাতপ্রমুখ হচ্ছেন?’

‘বড় একটা নয়’, সভয়ে এদিক-ওদিক তাকিয়ে বললেন অভিজাতপ্রমূখ, ‘আমি ক্লান্ত হয়ে পড়েছি, বয়স তো হল। আমার চেয়ে কমবয়সী যোগ্য ব্যক্তি আছেন, কাজের ভার নিন তাঁরা।’

এবং পাশের দরজা দিয়ে অন্তর্ধান করলেন অভিজাতপ্রমূখ।

দেখা দিল সবচেয়ে গুরুগম্ভীর মুহূর্ত। তখন ভোট দেওয়ার কথা। উভয় দলের পাণ্ডারা আঙুল দিয়ে গুণছিল সাদা কালো বল।

ফ্লেরভকে নিয়ে বির্তকে নতুন দল শুধু একটা ভোটেই লাভবান হল না, সময়ও পেল, যাতে নির্বাচনে অংশগ্রহণ থেকে যে তিনজন অভিজাতকে পুরানো দল চালাকি করে বঞ্চিত করেছিল, তাদের নিয়ে আসা যায়। দুজন অভিজাতের দুর্বলতা ছিল মদে, স্নেৎকোভের লোকেরা তাদের মাতাল করে দেয়, আর তৃতীয়জনের উর্দি কেড়ে নেয় তারা।

এসব জানতে পেরে ফ্লেরভকে নিয়ে বির্তকের সময় নতুন দল ছ্যাকড়া গাড়িতে নিজেদের লোক পাঠাতে পারে অভিজাত ব্যক্তিটিকে উর্দি পরাতে এবং মাতাল দুজনের মধ্যে একজনকে সভায় নিয়ে আসতে।

‘এনেছি একজনকে, পানি ঢেলেছি’, তাকে আনতে গিয়েছিল যে জমিদার, সিভয়াজস্কির কাছে গিয়ে সে বলল, ‘ভাবনা নেই, চলে যাবে।’

‘বড় বেশি মাতাল নয় তো? টলে পড়বে না?’ মাথা নেড়ে জিজ্ঞেস করলেন সিভয়াজস্কি।

‘না, চালু ছোকরা। শুধু এখানে ওকে মদ না খাওয়াতে পারলেই হয়… আমি ব্যুফের লোককে বলেছি কোনক্রমে যেন এক ফোঁটাও না দেয়।’

ঊনত্রিশ

যে সংকীর্ণ হলটায় লোকজন ধূমপান আর জলযোগ করছিল, তা অভিজাতে ভরা। ক্রমেই বেড়ে উঠছিল উত্তেজনা, চোখে পড়ছিল সমস্ত মুখেই অস্থিরতা। বিশেষ প্রবল রকমে উত্তেজিত হয়েছিল নেতারা, সমস্ত খুটিনাটি ও ভোটের হিসাব যাদের জানা ছিল। এরা হলেন আসন্ন সংঘষের ব্যবস্থাপক। বাকিরা সাধারণ সৈন্যের মত লড়াইয়ের জন্য তৈরি হলেও আপাতত চিত্তবিনোদনের সন্ধানে ছিলেন। কিউ টেবিলের সামনে দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে অথবা বসে নাস্তা সারছিলেন; অন্যেরা সিগারেট টানতে টানতে লম্বা ঘরখানার এ-মাথা ও-মাথা পায়চারি করছিলেন আর আলাপ করছিলেন বহুদিন না-দেখা বন্ধু-বান্ধবদের সাথে

খাবার ইচ্ছে হচ্ছিল না লেভিনের, ধূমপান তিনি করেন না। নিজেদের লোকদের অর্থাৎ কজ্‌নিশেভ, অব্‌লোন্‌স্কি সি্‌ভ্‌য়াজস্কি এবং অন্যান্যদের কাছে যেতে চাইছিলেন না। কারণ তাদের সঙ্গে টগবগে আলাপে যোগ দিয়েছিলেন অশ্বপালের উর্দি পরিহিত ভ্রন্‌স্কি। আগের দিনই লেভিন তাকে দেখেছিলেন নির্বাচনে এবং সাক্ষাৎ হোক এটা না চেয়ে প্রাণপণে তাকে এড়িয়ে যান। জানালার কাছে গিয়ে লেভিন বসলেন এবং চারপাশের গ্রুপগুলোর দিকে তাকিয়ে শুনতে লাগলেন কি আলোচনা চলছে। মন-মরা হয়ে ছিলেন তিনি, বিশেষ করে এজন্য যে উনি দেখতে পাচ্ছেন সবাই চাঙ্গা, দুশ্চিন্তাগ্রস্ত, ব্যস্ত, আর তিনিই এবং নৌবাহিনীর উর্দি পরা দন্তহীন জনৈক বৃদ্ধেরই কেবল কোন আগ্রহ নেই, কোন কাজ নেই। লেভিনের পাশে বসে বৃদ্ধ আপনমনে বিড়বিড় করে যাচ্ছিলেন।

‘কি পাজি! আমি বলেছিলাম, কিন্তু না; কেন! তিন বছরের মধ্যে উনি জোগাড় করে উঠতে পারলেন না’, সতেজে বলছিলেন অনুচ্চ চেহারার কোলকুঁজো এক জমিদার, পমেডের প্রলেপ দেওয়া তাঁর চুল এসে পড়েছে উর্দির নকশা- তোলা কলারের ওপর। নতুন, বোঝা যায় নির্বাচন উপলক্ষেই কেনা বুটের হিল সজোরে ঠুকছিলেন তিনি। লেভিনের দিকে একটা বিরক্ত দৃষ্টিপাত করে জমিদার ঝট করে ঘুরে গেলেন।

‘কারসাজি আছে, সে আর বলতে’, সরু গলায় বললেন ক্ষুদ্রকায় আরেক জমিদার

এই দুজনের পেছনে মোটাসোটা এক জেনারেলকে ঘিরে জমিদারদের পুরো একটা ঝাঁক তাড়াতাড়ি করে এগিয়ে আসছিল লেভিনের দিকে। জমিদাররা স্পষ্টতই একটা জায়গা খুঁজছিল যেখানে কথা বললে অন্যের কানে যাবে না।

‘কি স্পর্ধা, বলে কিনা ওর ট্রাউজার চুরি করতে বলেছি আমি! বেচে দিয়ে মদ টেনেছে বলে মনে হয়। ওকে আর

ওর প্রিন্স কেতাবকে আমি কেয়ার করি থোড়াই। কথা বলতে এসো না, এটা খচরামি!’

‘কিন্তু ওরা যে আইনের ধারার আশ্রয় নিয়েছে’, কথা হচ্ছিল আরেকটা গ্রুপে, ‘তাঁর স্ত্রীকে অভিজাত বলে তালিকাভুক্ত করা উচিত!’

‘চুলোয় যাক গে ধারা! আমি অন্তর থেকে কথা বলছি। ঘরানা অভিজাত। বিশ্বাস করতে হয়।’

‘হুজুর, চলুন যাই, চমৎকার শ্যাম্পেন!

একজন অভিজাত প্রচণ্ড চিৎকার করে কি যেন বলছিল এবং আরেকটা দল আসছিল তার পিছু পিছু; মদ খাইয়ে মাতাল করা তিন জনের মধ্যে সে একজন।

মারিয়া সেমিওনোভনাকে আমি সব সময়ই বলেছিলাম জমি খাজনায় দিতে, কেননা নিজে উনি চালাতে পারেন না’, শ্রুতিমধুর গলায় বললেন মোচ পাকা এক জমিদার, পরনে সাবেকী জেনারেল স্টাফের কর্নেলী উর্দি; ইনি সেই জমিদার লেভিন যাঁকে দেখেছিলেন সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কির ওখনে। সাথে সাথেই তাঁকে চিনতে পারেন তিনি। জমিদারও লেভিনের দিকে ভালো করে তাকিয়ে সম্ভাষণ বিনিময় করলেন।

‘ভারি আনন্দ হল। চিনব না মানে! বেশ ভালো মনে আছে। গত বছর। অভিজাতপ্রমুখ সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কির ওখানে।’

‘তা আপনার কৃষিকর্ম কেমন চলছে?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।

‘সেই একই রকম লোকসানে’, জমিদার বললেন বিনীত হাসি ফুটিয়ে, কিন্তু এই প্রশান্তি ও প্রত্যয় নিয়ে যে তাই- ই হওয়া দরকার। লেভিনের কাছে দাঁড়ালেন তিনি, জিজ্ঞেস করলেন; ‘কিন্তু আপনি আমাদের গুবের্নিয়ায় যে? আমাদের কু’দেতায় যোগ দিতে এসেছেন?’ ফরাসি শব্দটা বললেন তিনি দৃঢ় কিন্তু খারাপ উচ্চারণে। ‘সারা রাশিয়া চলে এসেছে, কামেরহেররাও, প্রায় মন্ত্রীরাও’, অব্‌লোন্‌স্কির দর্শনধারী মূর্তির দিকে ইঙ্গিত করে তিনি বললেন। সাদা পেন্টালুন আর কামেরহেরী উর্দিতে তিনি হাঁটছিলেন এক জেনারেলের সাথে।

‘আমি আপনার কাছে স্বীকার করছি যে অভিজাত নির্বাচনের গুরুত্ব আমি বুঝি কম’, লেভিন বললেন।

‘বোঝার আবার আছেটা কি? কোন গুরুত্বই নেই। ক্ষীয়মাণ একটা প্রতিষ্ঠান চলে যাচ্ছে জাড্যের শক্তিতে উর্দিগুলো দেখুন, তা দেখেই বুঝতে পারবেন, এটি সালিশী জজ, স্থায়ী সদস্য ইত্যাদির সমাবেশ, অভিজাতদের নয়।’

‘তাহলে আপনি আসেন কেন?’ জিজ্ঞেস করলেন লেভিন।

‘প্রথম অভ্যাসবশে। তাছাড়া যোগ সম্পর্কাদি রাখতে হয়। কিছু পরিমাণ নৈতিক দায়িত্বও। আর সত্যি বললে, নিজের স্বার্থও আছে। আমার জামাতা স্থায়ী সদস্য নির্বাচনে দাঁড়াতে চায়। ওরা ধনী নয়, তাই ওকে চালু করে দেওয়া দরকার। কিন্তু ওনারা আসেন কেন?’ বিষজিহ্বা যে ভদ্রলোকটি রাজ্যপালের টেবিলে থেকে কথা বলেছিলেন তাকে দেখিয়ে বললেন তিনি।

‘এরা অভিজাত সম্প্রদায়ের নতুন পুরুষ।’

‘নতুন নয় হল। কিন্তু অভিজাত নয়। ওরা জমিদার আর আমরা ভূস্বামী। অভিজাত হিসেবে ওরা নিজেই নিজেদের খতম করেছে।’

‘কিন্তু আপনি নিজেই তো বললেন যে, আয়ু ফুরিয়েছে প্রতিষ্ঠানটার।’

‘ফুরিয়েছে ফুরাক। তাহলেও সম্মান দেখাতে হয়। অন্তত স্নেকোভকে….আমরা ভালো হই, না হই, হাজার বছর ধরে বাড়ছি। ধরুন আপনি বাড়ির সামনে একটা বাগান করতে চান আর সেখানে রয়েছে একশ বছরের একটা গাছ… সে গাছ দরকচামারা বুড়ো হলেও ফুলবাগান আর কেয়ারির জন্য তাকে কাটতে তো যাবেন না। বরং ফুলবাগানগুলো এমনভাবে বসাবেন যাতে কাজে লাগে গাছটা। ওটা তো আর এক বছরে বেড়ে উঠেবে না’, সাবধানে এই কথা বলে সাথে সাথেই প্রসঙ্গ পাল্টালেন তিনি, ‘তা আপনার কৃষিকর্ম কেমন চলছে?’

‘খারাপ। শতকরা পাঁচ।

‘হ্যাঁ, অথচ নিজেকে আপনি ধরছেন না। আপনারাও তো কিছু দাম আছে। শুনুন, নিজেন কথা বলি। যতদিন আমি ফৌজের ছিলাম, কৃষিকর্মে লাগিনি। পেতাম তিন হাজার। আর এখন ফৌজের চেয়ে বেশি খাটছি, কিন্তু পাচ্ছি আপনার মতই শতকরা পাঁচ, তাও সৃষ্টিকর্তা দেন। নিজের খাটুনির গেল বেফায়দা।

‘তাহলে কেন এটা করছেন? যখন সোজাসুজি লোকসান?’

‘অথচ করছি। উপায় নেই। অভ্যাস আর কি, জানি যে তাই করা দরকার। আপনাকে আরো বলি’, জানালার বাজুতে কনুই ভর দিয়ে উনি বলে চললেন, ‘কৃষিকর্মে ছেলের কোনরকম আগ্রহ নেই। বোঝা যাচ্ছে, পণ্ডিত হবে। অথচ কাউকে তো চালিয়ে যাওয়া দরকার। তাই করি। এই তো এ বছর বাগান বসালাম।’

‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, কতটা সম্পূর্ণ ঠিক’, লেভিন বললেন, ‘আমি সব সময় টের পাই যে আমার বিষয়-আশয়ে সত্যিকার কোন ফায়দা নেই। অথচ করে যাই। জমির জন্যে একটা কেমন যেন দায়িত্ব।’

‘শুনুন বলি’, জমিদার চালিয়ে গেলেন, ‘আমার পড়শী একজন কারবারী। এসেছিল আমার কাছে। আমরা বিষয়- সম্পত্তি বাগান সব ঘুরে দেখলাম। বলে, ‘না’ স্তেপান ভাসিলিচ, সবই আপনার ঠিকঠাক চলছে, কিন্তু বাগানটায় বড় অযত্ন।’ ঐ লিন্ডেন গাছগুলোকে কেটে ফেলতাম, শুধু রসটা বের করে নিয়ে। লিন্ডেন গাছ তো এখানে হাজার হাজার। প্রচুর চমৎকার বাকল হবে। আর বাকলের এখন ভালো দাম। আমি হলে কেটে ফেলতাম।’

‘আর সে টাকায় ও গরু-বাছুর বা জমি কিন্তু পানির দামে, চাষীদের তা খাজনায় বিলি করত’, হেসে কথাটা শেষ করলেন লেভিন, স্পষ্টতই এরকম হিসাব তাকে শুনতে হয়েছে একাধিকবার। ‘ও সম্পত্তি করবে আর সৃষ্টিকর্তা করুন, আপনার আমার যা আছে শুধু সেটুকু দরে রেখে ছেলেমেয়েদের যেন দিয়ে দিতে পারি।’

‘শুনেছি আপিন বিবাহিত?’ জিজ্ঞেস করলেন জমিদার।

‘হ্যাঁ’, সর্গব তৃপ্তিতে লেভিন বললেন; ‘কেমন যেন আশ্চর্য’, বলে চললেন তিনি, ‘আমরা হিসাবের পরোয়া না করে চলি। আমাদের এখানে বসানো হয়েছে ঠিক পুরাকালের ভেস্টালদের মত কোনরকমে আগুন আগলিয়ে রাখতে।’

সাদা মোচের মধ্যে মুচকি হাসলেন জমিদার।

‘আমাদের মধ্যেও কেউ কেউ আছেন, যেমন অন্তত বন্ধুবর নিকোলাই ইভানিচকেই ধরুন কিংবা কাউন্ট ড্রস্কি, যিনি এখানে বসত পেতেছেন, তাঁরা চান কৃষি চালাতে শিল্পের কায়দায়, কিন্তু পুঁজি লোকসান দেওয়া ছাড়া এ যাবত কিছুই দাঁড়ায়নি।

কিন্তু কারবারীটার মত আমরা করছি না কেন? বাকলের জন্য কেন কেটে ফেলছি না বাগান? যে প্রশ্নটা লেভিনকে হতভম্ব করছিল, তাতে ফিরে এসে তিনি বললেন।

‘ঐ যে আপনি বললেন আগুন আগলিয়ে রাখা? নইলে অভিজাতদের কাজ আবার কি? আর অভিজাতদের কাজটা চলে এখানে নয়, নির্বাচনে নয়, সেখানে নিজের কোনটিতে। সামাজিক একটা সম্প্রদায় হিসেবে নিজেদের একটা স্বতঃবোধও আছে কি করা উচিত, কি নয়। চাষীদেরও আছে; মাঝে মাঝে দেখি কি ভালো চাষী, যত পারে জমি করছে। সে জমি যত খারাপই হোক চষে যাচ্ছে। শুধু হিসাবের পরোয়া না করে। স্রেফ লোকসান দিয়ে।’

‘আমরাও তাই’, লেভিন বললেন আর তার দিকে সি্‌ভ্‌য়াজস্কিকে আসতে দেখে যোগ দিলেন, ‘দেখা হয়ে খুবই, খুবই আনন্দ হল।’

‘আপনার বাড়ির পর আমাদের আবার দেখা হল এই প্রথম’, জমিদার বললেন, ‘কথাবার্তাও হল।’

‘কি, নতুন ব্যবস্থার মুণ্ডপাত করলেন তো?’ হেসে প্রশ্ন করলেন সি্‌ভ্‌য়াজস্কি।

‘তাছাড়া কি চলে।’

‘বুক জুড়ালেন।’

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *