আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৬.২০

বিশ

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার সাথে পাথর-বাঁধানো প্রকাণ্ড বারান্দাটায় ঢুকে আন্না বললেন, ‘এই আপনার ডল্লি, প্রিন্সেস। যাকে আপনি খুব দেখতে চাইছিলেন।’ প্রিন্সেস ভারভারা সেখানে ছায়ায় এম্ব্রয়ডারি ফ্রেমের সামনে বসে কাউন্ট আলেকসেই কিরিলোভিচের ইজি-চেয়ারের জন্য একটি আসন বানাচ্ছিলেন। ‘ডল্লি বলছে ডিনারের আগে কিছুই খাবে না সে, কিন্তু কিছু জলযোগ দিতে বলুন। আমি আলেক্সেইকে খুঁজতে চললাম। ওঁদের সবাইকেই নিয়ে আসব।

ডল্লিকে সস্নেহেই নিলেন প্রিন্সেস ভারভারা এবং খানিকটা মুরুব্বিয়ানার ঢঙে। আর তৎক্ষণাৎ তাঁকে বোঝাতে লাগলেন যে তিনি আন্নার এখানে উঠেছেন। কেননা সব সময় তিনি আন্নাকে ভালোবেসেছেন তাঁর চেয়ে বেশি, এবং এখন সবাই যখন আন্নাকে ত্যাগ করেছে, তখন সবচেয়ে দুঃসহ এই অন্তর্বর্তী কালটায় আন্নাকে সাহায্য করা তাঁর কর্তব্য বলে মনে করেছেন তিনি।

‘স্বামী ওকে বিবাহবিচ্ছেদের অনুমতি দিলেই আমি আবার আমার একাকিত্বে ফিরে যাব, কিন্তু এখন আমি কাজে লাগতে পারি আর অন্যদের মত নয়, আমার পক্ষে যত কঠিনই হোক, নিজের কর্তব্য আমি করে যাব। এসে বড্ডো ভালো করেছ, লক্ষ্মী তুমি। এরা আছে একেবারে সেরা দম্পতির মত; সৃষ্টিকর্তা ওদের বিচার করবেন, আমরা নই। কিন্তু বিরিউজোভস্কি আর আভেনিয়েভাও কি… আর স্বয়ং নিকান্দ্রভ, ভাসিলিয়েভ আর মামোনোভা, আর লিজা নেপতুনোভা?… কেউ তো কিছু বলল না। পরিণামে সবাই তাদের ঘরে ডেকেছে। তারপর, এখানকার অবস্থাটা ভারি মিষ্টি আর পরিপাটী। সবই ইংরেজি কায়দায়। প্রাতরাশের সময় সবাই জোটে, তারপর যে যার মত ছড়িয়ে পড়ে। ডিনারের আগে পর্যন্ত যার যা খুশি করে। ডিনার সাতটায়। স্তিভা তোমাকে এখানে পাঠিয়ে খুব ভালো করেছে। এদের সাথে লেগে থাকা ওর দরকার। জান তো, ও তার মা আর ভাইয়ের মারফত সব কিছু করাতে পারে। তাছাড়া অনেক উপকার করে তারা। নিজের হাসপাতালটার কথা বলেনি তোমাকে? এটা হবে সুন্দর, সবই প্যারিস থেকে।’

কথাবার্তা থেমে গেল বারান্দায় পুরুষদলসহ আন্নার প্রত্যাবর্তনে। তাঁদের তিনি পেয়েছিলেন বিলিয়ার্ড ঘরে। ডিনারের সময় হতে তখনো অনেক বাকি, আবহাওয়া চমৎকার, তাই এই বাকি দু’ঘণ্টা কিভাবে কাটানো যায় তার নানা প্রস্তাব এল। আর ভজ্‌দ্‌ভিজেনস্কয়েতে সময় কাটাবার উপায় ছিল প্রচুর, পক্রোভ্স্কয়েতে যেসব উপায়ের আশ্রয় নেওয়া হত, মোটেই তেমন নয়।

‘এক দফা টেনিস’, নিজের সেই সুন্দর হাসি হেসে ফরাসি ভাষায় প্রস্তাব দিলেন ভেস্লোভস্কি, ‘আবার আপনি হবেন আমার পার্টনার, আন্না আর্কাদিয়েভনা।’

‘না, বড় গরম। বরং বাগানে খানিক বেরিয়ে তারপর নৌবিহার, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনাকে তীরভূমি দেখানো যাবে’, বললেন ভ্রন্‌স্কি।

‘আমি সব কিছুতেই রাজি’, সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি বললেন।

‘আমার মনে হয় ডল্লির সবচেয়ে ভালো লাগবে হেঁটে বেড়াতে, তাই না? তারপর নৌকো’, বললেন আন্না। তাই স্থির হল। ভেস্লোভস্কি আর তুশকেভিচ গেলেন গোসলের ঘাটে, সেখানে নৌকো ঠিক করে সবাইয়ের প্রতীক্ষায় থাকবেন বলে কথা দিলেন।

পথ দিয়ে ওঁরা হাঁটছিলেন জোড়ায় জোড়ায়—–ভিয়াস্কির সাথে আন্না, ভ্রন্‌স্কির সাথে ডল্লি। আন্নার আচরণকে তিনি বিমূর্তভাবে, তত্ত্বগত দিক থেকে মেনে নিয়েছিলেন শুধু তাই নয়, সমর্থনই করেছিলেন। সাধ্বী জীবনের একঘেয়েমিতে ক্লান্ত হয়ে পড়া নিষ্কলুষ সাধ্বী নারীদের ক্ষেত্রে সাধারণভাবে যা প্রায়ই ঘটে থাকে, পাতকী প্রেমকে তিনি শুধু মার্জনাই করেননি। এমন কি তার জন্য ঈর্ষাই বোধ করেছিলেন। তাছাড়া সত্যিই তিনি ভালোবাসতেন আন্নাকে। কিন্তু বাস্তব ক্ষেত্রে, তাঁর কাছে অনাত্মীয় এই সমস্ত লোকদের মধ্যে আন্নাকে দেখে, শীলতা সম্পর্কে যাঁদের মতামত দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার কাছে নতুন, তাতে তাঁর অস্বস্তি হচ্ছিল। বিশেষ করে তাঁর খারাপ লাগছিল প্রিন্সেস ভারভারাকে দেখে, যিনি সব কিছু ক্ষমা করে দিচ্ছেন যেসব সুবিধা ভোগ করছেন তার জন্য।

আন্নার আচরণ ডল্লি অনুমোদন করেছিলেন সাধারণভাবে, বিমূর্তিতে, কিন্তু যে লোকটির জন্য এরূপ আচরণ করা হল, তাঁকে দেখতে পারছিলেন না ডল্লি। তাছাড়া ভ্রন্‌স্কিকে তাঁর ভালো লাগেনি কখনো। তিনি তাঁকে ভাবতেন অহংকারী, আর ঐশ্বর্য ছাড়া অহংকার করার মত কিছুই দেখেননি তাঁর মধ্যে। কিন্তু এখানে, নিজের বাড়িতে তিনি ডল্লির ইচ্ছার বিরুদ্ধেই তাঁকে অভিভূত করছিলেন আগের চেয়ে আরো বেশি, তাঁর সামনে নিঃসংকোচ হতে পারছিলেন ডল্লি। নিজের নাইট-গাউনের জন্য পরিচারিকার সামনে তাঁর যেরকম লেগেছিল, অনেকটা সেইরকম লাগছিল তাঁর। তালিগুলোর জন্য পরিচারিকার সামনে তাঁর যেমন লজ্জা নয়, অস্বস্তি হয়েছিল, ভ্রন্‌স্কির সামনেও তেমনি তাঁর নিজের জন্য লজ্জা নয়, অস্বস্তি লাগছিল।

বিব্রত বোধ হওয়ায় কথোপকথনের একটা প্রসঙ্গ খুঁজছিলেন ডল্লি। ভ্রন্‌স্কি যা অহংকারী তাতে তাঁর বাগান ও বাড়ির প্রশংসায় তাঁর মন উঠবে না বলে ভাবলেও কথাবার্তার অন্য প্রসঙ্গ না পেয়ে ডল্লি তাঁকে শেষ পর্যন্ত বলেই ফেললেন যে তাঁর বাড়িটা তাঁর খুব ভালো লেগেছে।

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘হ্যাঁ, ভালো সাবেকী রীতিতে এটা ভারি সুন্দর একটা কুঠি ‘

‘গাড়ি-বারান্দার সামনের আঙিনাটা খুব ভালো লেগেছে আমার। এটা কি আগেও অমনি ছিল?’

‘আরে না!’ পরিতৃপ্তিতে জ্বলজ্বলে মুখে বললেন তিনি। ‘এবারের বসন্তে আঙিনাটা দেখলে পারতেন!’

এবং প্রথমটা সন্তর্পণে, তারপর ক্রমেই মেতে উঠে ডল্লির মনোযোগ আকর্ষণ করতে লাগলেন বাড়ি আর বাগানের নানা দিককার শোভায়। বোঝা যাচ্ছিল যে নিজের সম্পত্তিটার উন্নয়ন ও শোভাবর্ধনের জন্য অনেক খাটায় ভ্রন্‌স্কি নতুন লোকের কাছে বড়াই করার তাগিদ বোধ করছিলেন, অন্তর থেকেই তিনি খুশি হলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার প্ৰশংসায়।

‘আপনি যদি হাসপাতালটা দেখতে চান এবং ক্লান্ত না হয়ে থাকেন, তাহলে চলুন যাই, বেশি দূর নয়’, ডল্লির যে সত্যিই ব্যাজার লাগছে না সে বিষয়ে নিশ্চিত হবার জন্য তাঁর মুখের দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন।

তারপর আন্নার দিকে ফিরলেন, ‘তুমিও যাবে নাকি আন্না?’

‘যাব। তাই না?’ সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিকে বললেন আন্না। ‘কিন্তু বেচারা ভেস্লোভস্কি আর তুশকেভিচকে নৌকায় ক্লান্ত হতে বাধ্য করা উচিত নয়। ওদের বলতে পাঠানো দরকার। হ্যাঁ, এখানে একটা স্মৃতিস্তম্ভ ও গড়ছে’, ডল্লিকে তিনি বললেন সেই রকম ধূর্ত, অভিজ্ঞ হাসি নিয়ে, যেভাবে তিনি আগেও হাসপাতালের কথাটা পেড়েছিলেন।

‘আহ্, চমৎকার একটা কীর্তি বটে!’ সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি বললেন। কিন্তু তাঁকে যাতে ভ্রন্‌স্কির ধামা-ধরা বলে না দেখায়, তার জন্য যোগ করলেন সামান্য সমালোচনার একটা টিপ্পনি। ‘তবে আমার অবাক লাগে কাউন্ট’, বললেন তিনি, ‘জনগণের স্বাস্থ্যের জন্যে এতকিছু করলেও স্কুলের ব্যাপারে আপনি উদাসীন থাকতে পারেন কি করে।

‘স্কুল হয়ে দাঁড়িয়েছে বড় বেশি মামুলি ব্যাপার’, ফরাসিতে বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘আপনি বুঝতে পারছেন ও জন্যে নয়, এমনি এ কাজটায় মেতে উঠেছি। এটা হাসপাতালে যাবার পথ’, তরুবীথির ধার দিয়ে বেরোবার একটা রাস্তা দেখিয়ে দারিয়া আলেকসান্দ্রভনাকে বললেন তিনি।

মহিলারা ছাতা খুলে গেলেন পাশের পথে। কয়েকটা মোড় নিয়ে ফটক দিয়ে বেরতেই দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার চোখে পড়ল সামনে উঁচু একটা জায়গার ওপর জটিল আকারের মস্তো এক লাল দালান, নির্মাণ তার প্রায় সম্পূর্ণ হয়ে এসেছে। লোহার পাতের চালে তখনো রঙ পড়েনি, উজ্জ্বল রোদে তা ঝকঝক করছিল। শেষ হয়ে আসা এই দালানটার পাশে মাথা তুলছে আরেকটা দালান, তখনো তা ভারা বাঁধা, অ্যাপ্রন পরা মজুরেরা তক্তার ওপর দাঁড়িয়ে ইঁট গাঁথছিল, চুন-সুরকির প্রলেপ দিয়ে তা সমান করছিল কর্ণিক চালিয়ে।

সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি বললেন, ‘আপনার কাজ চলছে কেমন চটপট! গতবার যখন এসেছিলাম তখন চালও ছিল না।’ আন্না বললেন, ‘শরৎ নাগাদ সব তৈরি হয়ে যাবে। ভেতরের কাজ প্রায় শেষ হয়ে এসেছে।’

‘আর এই দালানটা কিসের?’

‘এখানে থাকবেন ডাক্তার, ঠাঁই নেবে ঔষধালয়’, বললেন ভ্রন্‌স্কি। তারপর খাটো, হালকা ওভারকোটে স্থপতিকে তাঁর দিকে আসতে দেখে মহিলাদের কাছে ক্ষমা চেয়ে গেলেন তাঁর দিকে।

একটা গর্ত থেকে মজুরেরা চুন-সুরকি তুলছিল, সেটার পাশ দিয়ে তিনি গেলেন স্থপতির কাছে এবং উত্তেজিত হয়ে কি নিয়ে যেন আলোচনা করলেন।

কি ব্যাপার জিজ্ঞেস করায় আন্নাকে তিনি বললেন, ‘মাথাল নিচুই থেকে যাচ্ছে।’

আন্না বললেন, ‘আমি তো বলেছিলাম যে বনিয়াদটা উঁচু করা দরকার।’

স্থপতি বললেন, ‘সেটা ভালো হত বৈকি আন্না আর্কাদিয়েভনা। কিন্তু এখন আর উপায় নেই।’

বাস্তুকর্মে আন্নার জ্ঞানে বিস্ময় প্রকাশ করায় সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিকে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, এ নিয়ে আমি খুবই আগ্রহী। নতুন দালানটাকে আগেরটার সাথে খাপ খাওয়ানো দরকার ছিল। অথচ ওটার কথা ভাবা হয়েছে পরে, শুরু করা হয়েছে বিনা পরিকল্পনায়।’

স্থপতির সাথে কথাবার্তা শেষ করে ভ্রন্‌স্কি মহিলাদের নিয়ে গেলেন হাসপাতালের ভেতরটা দেখাতে।

বাইরে তখনো কাজ হচ্ছিল কার্নিস নিয়ে, দেওয়া হচ্ছিল নিচের তলায়, তাহলেও ওপরতলায় সব কাজই প্রায় শেষ। পেটা লোহার চওড়া সিঁড়ি দিয়ে চাতালে উঠে তাঁরা ঢুকলেন প্রথম বড় ঘরখানায়। দেয়ালের পলেস্তারা শ্বেত পাথরের ধাঁচে, বড় বড় জানালায় শার্সি বসেছে এর মধ্যেই, শুধু মেঝের পার্কেট তখনো শেষ হয়নি। উঁচু হয়ে ওঠা চৌখুপিগুলোর ওপর র‍্যাঁদা ঘষা থামিয়ে ছুতারেরা মাথার চুল বেঁধে রাখার পটি খুলে উঠে দাঁড়াল অভ্যাগতদের অভিনন্দন জানাতে।

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘এটা হবে রোগী গ্রহণকক্ষ। এখানে থাকবে ডেস্ক, টেবিল, আলমারি, ব্যস, আর কিছু নয়।’

‘এখানে, এখান দিয়ে যাব। জানালার কাছের যেও না’, এই বলে আন্না পরখ করে দেখলেন রঙ শুকিয়েছে কিনা, ‘আলেক্‌সেই, রঙ শুকিয়ে গেছে’, যোগ করলেন তিনি।

রোগী গ্রহণকক্ষ থেকে তাঁরা গেলেন করিডরে। এখানে ভ্রন্‌স্কি তাঁদের দেখালেন নতুন পদ্ধতিতে নির্মিত বায়ু- চলাচলের ব্যবস্থা। তারপরে দেখালেন মর্মরে বাঁধানো গোসলখানা, বিচিত্র ধরনের স্প্রিং দেওয়া শয্যা। তারপর একের পর এক ওয়ার্ড, গুদাম, বিছানার চাদরপত্র রাখার ঘর, অতঃপর নতুন ডিজাইনের ফায়ারপ্লেস, করিডর বরাবর দরকারি জিনিসপত্র জোগাবার ঠেলাগাড়ি যাতে শব্দ হবে না, এবং আরও অনেক কিছু। নতুন সমস্ত উন্নতি সম্পর্কে ওয়াকিবহাল লোকের মত সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি কদর করলেন সব কিছুর। এ যাবত যেসব জিনিস তিনি দেখেননি, তা দেখে স্রেফ থ’ হয়ে গেলেন ডল্লি এবং সব কিছু বোঝার জন্য খুঁটিয়ে প্রশ্ন করতে লাগলেন। সেটা স্পষ্টতই ভালো লাগল ভ্রন্‌স্কির।

সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি বললেন, ‘হ্যাঁ, আমার মনে হয়, এটাই হবে রাশিয়ায় পুরোপুরি সুনির্মিত একমাত্র হাসপাতাল।’ কিন্তু আপনাদের এখানে প্রসূতি বিভাগ থাকবে না?’ ডল্লি জিজ্ঞেস করলেন : ‘গ্রামে যে তার ভারি দরকার। আমি প্রায়ই…’

নিজের সৌজন্যশীলতা সত্ত্বেও ভ্রন্‌স্কি থামিয়ে দিলেন তাঁকে।

‘এটা প্রসূতি সদন নয়, হাসপাতাল। সংক্রামক ছাড়া অন্য সমস্ত রোগ নিয়ে তার কাজ’, বললেন তিনি, আর এটা দেখুন…’ যারা সেরে উঠবে তাদের জন্য সদ্য আমদানি করা একটা চলন্ত চেয়ার তিনি টেনে নিয়ে গেলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার কাছে; ‘এই দেখুন’, চেয়ারটায় বসে তিনি তা চালাতে লাগলেন; ‘রোগী হাঁটতে পারছে না, এখনো দুর্বল, অথবা পা রুগ্‌ণ, কিন্তু তার তাজা হওয়া দরকার, এতে বসে দিব্যি তা চালিয়ে যাবে…’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার সব কিছুতেই আগ্রহ ছিল, সব কিছুই ভালো লাগল তাঁর কিন্তু সবচেয়ে ভালো লাগল ভ্রন্‌স্কিকে। এসব ব্যাপারে নেশা যাঁর অকৃত্রিম, সহজ-সরল। ‘হ্যাঁ, ভারি সুন্দর মিষ্টি মানুষ’, মাঝে মাঝে ভ্রন্‌স্কির কথায় কান না দিয়ে তাঁর দিকে চেয়ে। তাঁর মুখভাব বোঝার চেষ্টা করে, নিজেকে আন্নার জায়গায় বসিয়ে মনে মনে ভাবছিলেন তিনি। তাঁর উৎসাহে এখন ভ্রন্‌স্কিকে তাঁর এত ভালো লাগল যে বুঝতে পারলেন কেন তাঁর প্রেমে পড়েছিলেন আন্না।

একুশ

আস্তাবলে যাবার প্রস্তাব দিলেন আন্না, সেখানে নতুন একটা মর্দা ঘোড়াকে দেখতে চাইছিলেন য়িাঙ্কি। কিন্তু আন্নাকে ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘না, আমার মনে হয় প্রিন্সেস ক্লান্ত হয়ে পড়েছেন। তাছাড়া ঘোড়ায় তাঁর উৎসাহ থাকার কথা নয়। তোমরা যাও, আমি প্রিন্সেসকে বাড়ি পৌঁছে দেব আর কিছু কথাবার্তা বলব’, ডল্লির দিকে ফিরে তিনি বললেন, ‘যদি আপনার সেটা খারাপ না লাগে।’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা খানিকটা অবাক হয়ে বললেন, ‘ঘোড়ার ব্যাপারে আমি কিছু বুঝি না। আপনার কথায় আমি খুব রাজি।’

ভ্রন্‌স্কির মুখ দেখে তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর কাছ থেকে ওঁর কিছু চাইবার আছে। ভুল হয়নি তাঁর। ফটক পেরিয়ে আবার বাগানে ঢুকতেই আন্না যেদিকে যাচ্ছিলেন সেদিকে তাকিয়ে দেখে এবং আন্না যে তাঁদের দেখতে বা কথা শুনতে পাবে না। সে বিষয়ে নিশ্চিত হয়ে ভ্রন্‌স্কি শুরু করলেন, ‘আপনি ধরতে পেরেছিলেন যে আপনার সাথে আমার কথা আছে?’ হাসি-হাসি চোখে ডল্লির দিকে তাকিয়ে ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘আমি ভুল করব না যদি ধরি আপনি আন্নার বন্ধু’, টুপি খুলে রুমাল বার করে তা দিয়ে মাথায় টাক পড়তে শুরু করা জায়গাটা মুছলেন।

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা কোন উত্তর দিলেন না, শুধু ভীত দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে। ভ্রন্‌স্কির সাথে একা হয়ে হঠাৎ ভারি আতংক হল তাঁর। হাসি-হাসি চোখ আর কঠোর মুখভাব তাঁকে ভয় পাওয়াচ্ছিল।

ভ্রন্‌স্কি তাঁর সাথে কথা বলতে চাইছেন কি বিষয়ে, তা নিয়ে নানান অনুমান মাথায় খেলে গেল তাঁর : উনি আমার ছেলেমেয়েদের নিয়ে এখানে এসে থাকতে বলবেন আর আমাকে তা প্রত্যাখ্যান করতে হবে; অথবা মস্কোয় আন্নার জন্যে যাতে একটা বন্ধমহল গড়ে দিই, তাই নিয়ে…কিংবা ভাসেকা ভেস্লোভস্কি আর আন্নার সাথে তার সম্পর্ক নিয়ে নয়ত? হয়ত বা কিটি সম্পর্কে, বলবেন যে নিজেকে তিনি দোষী মনে করছেন?’ শুধু যা খারাপ, তেমন সব কিছু ভেবে দেখলেন তিনি, কেবল অনুমান করতে পারেননি কি নিয়ে ভ্রন্‌স্কি কথা বলতে চাইছেন তাঁর সাথে।

ভ্রন্‌স্কি বললেন, ‘আন্নার ওপর আপনার প্রভাব অনেক। আপনাকে সে খুবই ভালোবাসে। আমাকে সাহায্য করুন।

ভীত সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা চাইলেন তাঁর তেজস্বী মুখের দিকে, যার ওপর কখনো সবটাতেই, কখনো জায়গায় জায়গায় রোদ এসে পড়ছিল লিণ্ডেন গাছের ছায়া ভেদ করে, কখনো আবার তা বিমর্ষ হয়ে উঠছিল ছায়ায়। তিনি প্রতীক্ষা করছিলেন যে ভ্রন্‌স্কি আরো কিছু বলবেন, কিন্তু উনি নীরবে নুড়ির ওপর ছড়ি ঠুকতে ঠুকতে চললেন তাঁর পাশে পাশে।

‘আপনি যখন আমাদের এখানে এসেছেন, আন্নার পুরানো বন্ধুদের মধ্যে একমাত্র আপনি—প্রিন্সেস ভারভারাকে আমি হিসেবে ধরি না—তখন আমি ধরে নিচ্ছি আপনি এসেছেন আমাদের অবস্থাটা স্বাভাবিক ভেবে নয়। এসেছেন এই কারণে যে অবস্থাটার দুঃসহতা আপনি বোঝেন এবং সব সত্ত্বেও আন্নাকে ভালোবাসেন বলে তাকে সাহায্য করতে চান। আমি আপনাকে ভালোবাসেন বলে তাকে সাহায্য করতে চান। আমি আপনাকে ঠিক বুঝেছি কি?’ তাঁর দিকে তাকিয়ে ভ্রন্‌স্কি জিজ্ঞেস করলেন।

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা ছাতা বন্ধ করে বললেন, ‘সে তো বটেই। কিন্তু…’

‘না’, এই বলে তাঁকে থামিয়ে দিয়ে ভ্রন্‌স্কি অচেতন একটা ঝোঁকে দাঁড়িয়ে পড়লেন, ভুলে গেলেন যে এতে করে তাঁর সঙ্গিনীকে তিনি একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলছেন, তাঁকেও দাঁড়িয়ে পড়তে হচ্ছে; ‘আমার চেয়ে বেশি করে, তীব্রভাবে আর কেউ অনুভব করে না আন্নার অবস্থার দুর্বিষহতা। আপনি যদি আমাকে হৃদয়বান পুরুষ বলে গণ্য করার সম্মান দেন, তাহলে আপনি সেটা বুঝবেন। এ অবস্থাটার জন্যে দায়ী আমি, তাই সেটা প্রাণ থেকে অনুভব করি।’

‘বুঝতে পারছি’, যে আন্তরিকতায় এবং দৃঢ়তায় ভ্রন্‌স্কি কথাটা বললেন, তাতে অজান্তে মুগ্ধ হয়ে বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা; ‘কিন্তু আপনি নিজেকে দায়ী মনে করছেন বলেই আমার ভয় হচ্ছে যে আপনি বাড়িয়ে দেখছেন।’

‘সমাজটা নরক’, বিমর্ষ মুখ গোঁজ করে দ্রুত বলে গেলেন ভ্রন্‌স্কি। পিটার্সবুর্গে দু’সপ্তাহ থাকাকালে যে নৈতিক মর্মবেদনা সে ভোগ করেছে। তার চেয়ে খারাপ কিছু কল্পনা করা যায় না… সেটা বিশ্বাস করুন, অনুরোধ করছি।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু এখানে, যতদিন আন্নার… বা আপনার প্রয়োজন থাকছে না সমাজের…’

‘সাজ!’ ঘৃণাভরে বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘সমাজে কি দরকার থাকতে পারে আমার…’

‘ততদিন পর্যন্ত, আর এটা হতে পারে বরাবরের জন্যে—আপনারা সুখী, নিশ্চিন্ত। আন্নাকে দেখে আমি বুঝতে পারছি সে সুখী, পুরোপুরি সুখী, নিশ্চিন্ত। আমাকে এটা সে বলেছেও’, দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা বললেন হেসে; কিন্তু বলতে গিয়ে আপনা থেকেই তাঁর সন্দেহ হল, সত্যিই কি আন্না সুখী?

কিন্তু মনে হল ভ্রন্‌স্কির কোন সন্দেহ নেই তাতে। তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ-হ্যাঁ, আমি জানি তার মর্মযন্ত্রণাগুলোর পর সেরে উঠেছে সে; সে সুখী। বর্তমানে সে সুখী। কিন্তু আমি?… আমাদের কপালে যে কি আছে ভেবে ভয় হয়… মাপ করবেন, হাঁটতে চান?’

‘না, মানে আমার কিছু এসে যায় না।’

‘তাহলে বসা যাক এখানে।’

তরুবীথির কোণে বাগানের বেঞ্চিতে বসলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, ভ্রন্‌স্কি দাঁড়ালেন তাঁর সামনে।

‘আমি দেখতে পাচ্ছি সে সুখী’, পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি আর আন্না যে সুখী নন এ সন্দেহ আরো বেশি পেয়ে বসল দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনাকে। ‘কিন্তু এভাবে কি চলতে পারে? আমরা ভালো করেছি নাকি খারাপ, সেটা অন্য প্রশ্ন। কিন্তু দান পড়ে গেছে’, বললেন ভ্রন্‌স্কি রুশ থেকে সরে গিয়ে ফরাসি ভাষায়, ‘সারা জীবনের জন্যে আমরা বাঁধা। আমাদের কাছে সবচেয়ে পবিত্র যে বন্ধন সেই প্রেমে আমরা বাঁধা। আমাদের একটি মেয়ে আছে, আরো ছেলেপেলে হতে পারে আমাদের। কিন্তু আইন এবং আমাদের সমস্ত পরিস্থিতি থেকে যে হাজার হাজার জটিলতা দেখা দিচ্ছে। সমস্ত দুঃখ-কষ্টের পর এখন বিশ্রাম পেয়ে আন্না সেগুলো গ্রাহ্য না করে পারি না। আমার মেয়ে আইন অনুসারে আমার নয়, কারেনিনের। এই প্রবঞ্চনা আমি চাই না!’ আপত্তির একটা সতেজ ভঙ্গি করে বললেন তিনি। দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার দিকে তাকালেন একটা বিমর্ষ জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে।

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা কিছু বললেন না, শুধু তাকিয়ে রইলেন ভ্রন্‌স্কির দিকে। উনি বলে চললেন : ‘আর কাল আমার যদি ছেলে হয়, আমার ছেলে, আইন অনুসারে তার উপাধি হবে কারেনিন। আমার উপাধি বা সম্পত্তির উত্তরাধিকারী সে হবে না, এবং আমাদের পরিবার যত সুখীই হোক, যত ছেলেপেলেই হোক না আমাদের, ওদের সাথে কোন সম্পর্ক থাকবে না আমার। সবাই ওরা কারেনিনের। আপনি বুঝে দেখুন এরকম অবস্থার কষ্ট আর ভয়াবহতা! এ নিয়ে আন্নার সাথে কথা বলার চেষ্টা করেছি। তাতে বিরক্ত হয় সে। সে বোঝে না, অথচ সব ব্যাপারটা আমি বলতে পারি না ওকে। এবার অন্য দিকে থেকে দেখুন। আমি ওর প্রেমে সুখী, কিন্তু আমাকে তো একটা কাজ নিয়ে থাকতে হবে। সে কাজ আমি পেয়েছি, তার জন্যে আমি গর্বিত এবং মনে করি যে দরবারে বা ফৌজে আমার ভূতপূর্ব বন্ধুদের কাজের চেয়ে এটা মহনীয়। এখন কোন সন্দেহই নেই যে, আমার এ কাজটা বদলে ওদের কাজে আর যাব না। আমি এখানে, আমার ভিটায় থেকে খাটছি, এতে আমি সুখী সন্তুষ্ট, সুখের জন্যে আমাদের দরকার নেই আর কিছুর। এ কাজটা আমি ভালোবাসি। আর সেটা এজন্য নয় যে, এর চেয়ে ভালো কিছু নেই। ঠিক উল্টো … ‘

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা লক্ষ করেছিলেন যে, বক্তব্যের এই জায়গায় এসে উনি গুলিয়ে ফেলছেন। কিন্তু এই প্রসঙ্গচ্যুতিটা তিনি ভালো বুঝতে পারছিলেন না। তবে টের পাচ্ছিলেন যে, আন্নার কাছে প্রাণের যে কথাগুলো বলতে পারেন না। তা যখন বলতে শুরু করেছেন, তখন সবটাই বলবেন এবং গ্রামাঞ্চলে তাঁর কাজের প্রশ্নটাও আন্নার সাথে সম্পর্ক নিয়ে তাঁর প্রাণের কথাগুলোর সাথে একই কোঠায় পড়ে।

ভ্রন্‌স্কি একটু সচেতন হয়ে বললেন, ‘তাহলে আমি বলে যাই। প্রধান কথাটা এই যে কাজ করতে গিয়ে আমার এমন নিশ্চিতি-থাকা দরকার যে কাজটা আমার সাথে সাথে ফুরিয়ে যাবে না, আমার উত্তরাধিকারী থাকবে, কিন্তু সেটা আমার নেই। কল্পনা করুন এমন এক পুরুষের অবস্থা, যার আগে থেকে জানা আছে যে তার এবং তার প্রিয়তমা নারীর ছেলেমেয়েরা তার হবে না, হবে কে জানে কার, যে এই ছেলেমেয়েদের দেখতে পারে না, কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না তাদের সাথে। এ যে সাংঘাতিক ব্যাপার!’

তিনি চুপ করে গেলেন স্পষ্টতই ভয়ানক উত্তেজিত হয়ে।

‘তা ঠিক, আমি এটা বুঝতে পারছি। কিন্তু আন্না কি করতে পারে?’ জিজ্ঞেস করলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

‘হ্যাঁ, এতে আমি আমাদের কথাবার্তার উদ্দেশ্যে আসছি’, অতি কষ্টে সুস্থির হয়ে তিনি বললেন; ‘আন্না পারে, এটা নির্ভর করছে তার ওপর… আমি যদি সন্তানকে পোষ্য নেবার জন্যে জারের কাছে আবেদন করি, তাহলেও দরকার বিবাহবিচ্ছেদ। আর এটা নির্ভর করছে আন্নার ওপর। ওর স্বামী বিবাহবিচ্ছেদে রাজি—আপনার স্বামী এক সময় ওকে রাজি করিয়েছিলেন, আমি জানি, এখনো সে আপত্তি করবে না। শুধু ওকে লিখে জানাতে হবে। সে তখন সোজাসুজি বলেছিলে, আন্না যদি ইচ্ছা প্রকাশ করে সে আপত্তি করবে না। বলাই বাহুল্য’, বিমর্ষ মুখে বললেন তিনি, ‘এটা একটা ভণ্ডের নিষ্ঠুরতা, যা হৃদয়হীন এসব লোকদের পক্ষেই সম্ভব। ও জানে যে ওর সম্পর্কে কোন কথা মনে পড়লে কি কষ্ট হয় আন্নার আর আন্নাকে জানে বলেই তার চিঠি দাবি করছে। আমি বুঝি আন্নার পক্ষে সেটা যন্ত্রণাকর, কিন্তু কারণগুলো এত গুরুত্বপূর্ণ যে দরকার ভাবপ্রবণতার এসব সূক্ষ্মতা পেরিয়ে যাওয়া। ব্যাপারটা আন্না আর তার সন্তানদের সুখ এবং ভাগ্য নিয়ে। আমি নিজের কথা কিছু বলছি না, যদিও আমার পক্ষে এটা দুঃসহ, খুবই দুঃসহ’, তাঁর কাছে দুঃসহ হচ্ছে বলে কার প্রতি যেন একটা শাসানির ভাব নিয়ে তিনি বললেন। ‘তাই প্রিন্সেস, নির্লজ্জের মত আমি আপনাকে আমার ভরসাস্থল বলে ধরছি। ওকে চিঠি লিখে বিবহবিচ্ছেদ দাবি করার জন্যে ওকে বুঝিয়ে সাহায্য করুন আমাকে!’

‘হ্যাঁ, সে তো বলা বাহুল্য’, চিন্তিতভাবে বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, কারেনিনের সাথে শেষ সাক্ষাৎটা স্পষ্টভাবে ভেসে উঠছিল তাঁর মনে। ‘হ্যাঁ, সে তো বলা বাহুল্য’, আন্নার কথা মনে করে দৃঢ়ভবে পুনরুক্তি করলেন তিনি।

‘ওর ওপর আপনার প্রভাব খাটান, চিঠি লেখান ওকে দিয়ে। এ নিয়ে আমি ওকে কিছু বলতে চাই না, বলতে প্রায় পারিই না।’

‘বেশ, আমি কথা বলব। কিন্তু ও নিজে কেন ভেবে দেখছে না?’ বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা। হঠাৎ তাঁর মনে পড়েছিল আন্নার চোখ কোঁচকানোর অদ্ভুত নতুন অভ্যাসটার কথা। তাঁর এও মনে পড়ল যে, আন্না চোখ কোঁচকানো ঠিক যখন কথাটা ওঠে জীবনের অন্তরতম দিক নিয়ে। ঠিক যেন নিজের জীবনের দিকে চোখ কোঁচকাচ্ছেন যাতে তার সবটা দেখতে না হয়’, ভাবলেন ডল্লি। ‘অবশ্য অবশ্যই আমি নিজের জন্যে আর আন্নার জন্যে কথা বলব ওর সাথে’, ভ্রন্‌স্কির কৃতজ্ঞতা প্রকাশে জবাব দিলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

তাঁরা উঠে দাঁড়িয়ে বাড়ি চলে গেলেন।

বাইশ

ডল্লি এর আগেই ফিরেছেন দেখে আন্না তাঁর চোখের দিকে তাকালেন যেন এই প্রশ্ন নিয়ে ভ্রন্‌স্কির সাথে কি কথা হয়েছে তাঁর, কিন্তু কথায় সেটা বললেন না। বললেন, ‘মনে হচ্ছে ডিনারের সময় হয়ে গেছে। তোমাকে আমাকে একেবারেই দেখা হচ্ছে না। আশা করছি সন্ধেয় হবে। এখন আমার পোশাক বদলানোর জন্যে যাওয়া দরকার। মনে হয় তোমারও। ঘর তোলা দেখতে গিয়ে সবাই আমরা নোংরা মেখেছি।’

ডল্লি গেলেন তাঁর ঘরে, হাসি পেল তাঁর। বেশভূষা করার কিছুই তাঁর ছিল না। কারণ তাঁর সেরা গাউনটা তিনি আগেই পরে আছেন; কিন্তু ডিনারের জন্য কিছুটা সাজ করেছেন এটা দেখাবার জন্য তিনি তাঁর গাউনটা ফিটফাট করতে বললেন দাসীকে, কি আর ফিতে বদলে নিলেন, লেস স্কার্ফ দিলেন মাথায়।

‘এটুকুই আমি যা করতে পেরেছি’, হেসে তিনি বললেন আন্নাকে, আবার তৃতীয় একটি অসামান্য সাধারণ পোশাকে তিনি এসেছিলেন ডল্লির কাছে।

‘হ্যাঁ, আমার এখানে বড় খুঁতখুঁতে’, আন্না বললেন যেন নিজের সাজের ঘটায় মাপ চেয়ে, ‘তুমি এসেছ বলে আলেক্সেই এত খুশি যা সে হয় প্রায় কদাচিৎ। নিশ্চয়ই ও তোমার প্রেমে পড়েছে’, তারপর যোগ করলেন তিনি; ‘আর তুমি ক্লান্ত হও নি তো?

ডিনারের আগে কিছু নিয়ে কথা বলার সময় ছিল না। ড্রয়িং-রুমে এসে তাঁরা দেখলেন ইতিমধ্যেই সেখানে হাজির প্রিন্সেস ভারতারা আর কালো কোট পরা পুরুষেরা। স্থপতির পরনে ফ্রক-কোট। ডাক্তার আর গোমস্তার সাথে ডল্লির পরিচয় করিয়ে দিলেন ভ্রন্‌স্কি। স্থপতির সাথে আগেই পরিচয় হয়েছিল হাসপাতালে।

মাড় দেওয়া সাদা টাই পরা মোটাসোটা খানসামা জ্বলজ্বলে চাঁছা-ছোলা মুখে জানাল যে খাবার তৈরি। মহিলারা উঠলেন। ভ্রন্‌স্কি য়িাঙ্কিকে অনুরোধ করলেন আন্না আর্কাদিয়েভনাকে বাহুলগ্ন করতে, নিজে গেলেন ডল্লির কাছে। তুশকেভিচের আগেই প্রিন্সেস ভারভারার দিকে ভেস্লোভস্কি হাত বাড়িয়ে দিতে গোমস্তা আর ডাক্তারের সাথে তুশকেভিচ গেলেন একা একা।

ডিনার, ডাইনিং-রুম, বাসনপত্র, পরিচারকেরা, সুরা, খাদ্যদ্রব্য শুধু গৃহের নতুন বিলাসের অনুরূপই নয়, মনে হল সব কিছুর চেয়েও তা বেশি নতুন আর বিলাসী। তাঁর কাছে নতুন এই বিলাসটা লক্ষ করলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা আর সংসারের ভার নেওয়া গৃহকর্ত্রী হিসেবে তাঁর জীবনযাত্রার অনেক ঊর্ধ্বে এসব বিলাসের একটাও তাঁর সংসারে দেখার আশা না রাখলেও আপনা থেকেই সমস্ত খুঁটিনাটিতে মন দিলেন, ভাবলেন কে এসব করেছে, এবং কিভাবে? ভাসেকা ভেস্লোভস্কি, তাঁর নিজের স্বামী, এমন কি সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি এবং আরো বহু যেসব লোককে তিনি জানেন, তাঁর এ নিয়ে ভাবতেন না, সমস্ত সজ্জন গৃহস্বামীই তাঁর অতিথিদের যা ভাবতে চান, বিশ্বস করতেন তাঁর কথায়, যথা : এত চমৎকার যে আয়োজন হয়েছে, তাতে তাঁর, গৃহস্বামীর কোন প্রয়াসই ছিল না, ওটা হয়েছে আপনা থেকেই। দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা তো জানেন যে এমন কি ছেলেমেয়েদের প্রাতরাশের মণ্ডও আপনা থেকে হয় না। তাই এমন জটিল ও অপূর্ব আয়োজনের পেছনে কারো সতর্ক মনোযোগ থাকার কথা। এবং আলেক্সেই কিরিলোভিচ যেভাবে টেবিলের দিকে দৃষ্টিপাত করলেন, যেভাবে মাথা নেড়ে ইঙ্গিত করলেন খানসামাকে। যেভাবে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনাকে জিজ্ঞেস করলেন মাছ-সবজির নাকি মাংসের কোন সূপটা তাঁর পছন্দ, তা থেকে তিনি বুঝলেন যে সবই করা হচ্ছে এবং চলছে স্বয়ং গৃহস্বামীর প্রয়াসে। এর জন্য ভেস্লোভস্কির কৃতিত্ব যতটা, আন্নার কৃতিত্ব তার বেশি নয়। আন্না স্প্রিয়াজুস্কি, প্রিন্সেস আর ভেস্লোভস্কি—সবাই একই রকমের অতিথি। তাঁদের জন্য যা আয়োজন করা হয়েছে, সানন্দে উপভোগ করছেন তা।

আন্না গৃহকর্ত্রীর দায়িত্ব পালন করছিলেন কেবল কথাবার্তার ধারা পরিচালনায়। এবং অনতিবৃহৎ টেবিল, গোমস্তা আর স্থপতির মত একেবারে ভিন্ন জগতের লোক, যারা অনভ্যস্ত এই বিলাসে সংকুচিত না হবার জন্য চেষ্টিত। সাধারণ কথাবার্তায় বেশিক্ষণ অংশ নিতে অক্ষম, তাঁদের নিয়ে কথোপকথনের যে ধারা স্থির করা গৃহকর্ত্রীর পক্ষে খুবই কঠিন আন্না তা চালিয়ে যাচ্ছিলেন তাঁর অভ্যস্ত মাত্রাবোধে, স্বাভাবিকতায়, এমন কি আনন্দের সাথে, যা লক্ষ করেছিলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা

তুশকেভিচ আর ভেস্লোভস্কি কিভাবে একলা নৌকো চালিয়ে গেছেন, কথাবার্তা হচ্ছেল তাই নিয়ে। পিটার্সবুর্গের ইয়াশ্ট-ক্লাবে শেষবারের প্রতিযোগিতার কথা বলতে শুরু করলেন তুশকেভিচ। তাঁর কথায় ছেদ পড়া পর্যন্ত অপেক্ষা করে আন্না তৎক্ষণাৎ স্থপতিকে তাঁর নীরবতা থেকে বার করে আনবার জন্য ফিরলেন তাঁর দিকে

‘গতবার তিনি যখন এখানে এসেছিলেন, তারপর কত তাড়াতাড়ি দালান উঠেছে দেখে নিকোলাই ইভানিচ চমৎকৃত’, সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি সম্পর্কে বললেন তিনি; ‘কিন্তু আমি নিজেই রোজ যাই আর কদত তাড়াতাড়ি কাজ এগুচ্ছে, দেখে অবাক হই রোজই।’

‘হুজুরের সাথে কাজ করে আরাম আছে’, হেসে বললেন স্থপতি (নিজের কৃতিত্ব সম্পর্কে সচেতন হলেও সশ্রদ্ধ সুস্থির একটি মানুষ তিনি)। ‘সরকারী কর্তাদের সাথে কাজের মত নয়। সেখানে গাদা গাদা কাগজ সই করতে হয়, আর কাউন্টকে আমি স্রেফ মতামত জানাই, একটু আলোচনা হয়, তিন কথাতেই সিদ্ধান্ত।’

সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি হেসে বললেন, ‘আমেরিকান পদ্ধতি।

‘জ্বি হ্যাঁ, সেখানে দালান তোলা হয় যুক্তিযুক্ত ভিত্তিতে…’

কথাবার্তা সরে গেল মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রে ক্ষমতার অপব্যবহার প্রসঙ্গে। কিন্তু নীরবতা থেকে গোমস্তাকে বের করে আনার জন্য তখনই আন্না অন্য প্রসঙ্গ তুললেন।

‘ফসল তোলার যন্ত্রগুলো তুমি দেখোনি?’ দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনাকে জিজ্ঞেস করলেন তিনি; ‘তোমার সাথে যখন সাক্ষাৎ হয়, তখন দেখতে গিয়েছিলাম আমরা। আমি নিজেই এই প্রথম দেখলাম।’

‘কিভাবে কাজ করে ওগুলো?’ জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।

‘একেবারে কাঁচির মত। একটা তক্তা আর ছোট ছোট বহু কাঁচি তাতে। এই রকম।

আন্না তাঁর সুন্দর অঙ্গুরীশোভিত সাদা হাতে ছুরি কাঁটা নিয়ে দেখাতে লাগলেন। উনি নিশ্চয় বুঝছিলেন যে, তাঁর ব্যাখ্যায় কোন ফল হচ্ছে না; কিন্তু তিনি সুন্দর করে কথা বলছেন, হাত দু’খানাও তাঁর সুন্দর, এটা জানা থাকায় ব্যাখ্যা চালিয়ে গেলেন তিনি।

‘কলম-কাটা ছুরির মত অনেকটা’, আন্নার ওপর থেকে চোখ না সরিয়ে কৌতুক করে বললেন ভেস্লোভস্কি।

আন্না সামান্য হাসলেন, কিন্তু কোন উত্তর দিলেন না।

‘সত্যি কাঁচির মত, তাই না কার্ল ফিওদরিচ?’ গোমস্তাকে তিনি জিজ্ঞেস করলেন।

জবাব দিলেন জার্মান, ‘ও হ্যাঁ, এটা নিতান্ত সাধারণ জিনিস’, এবং যন্ত্রের গঠনকৌশল বোঝাতে লাগলেন তিনি।

‘এ যন্ত্র যে আঁটি বাঁধে না, এটা দুঃখের কথা’, বললেন সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি, ‘ভিয়েনার প্রদর্শনীতে আমি তার দিয়ে আঁটি বাঁধতে দেখেছি, ওতে বেশ লাভ হত।’

‘সব দাঁড়াচ্ছে এটায়…তারের দাম হিসেব করতে হয়’, নীরবতা থেকে ছাড়া পেয়ে জার্মান ভাষায় ভ্রন্‌স্কিকে বললেন, ‘এটা হিসেব করা যায়, হুজুর’, পকেটে যেখানে তিনি হিসাবপত্র টুকে রাখতেন সেই পকেটবই আর পেনসিলটা নেবার জন্য তিনি হাত বাড়াতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তিনি যে এখন ডিনার টেবিলে সেটা মনে পড়ায় এবং ভ্রন্‌স্কির নিরুত্তাপ দৃষ্টি লক্ষ করে ক্ষান্ত হলেন। ‘বড় বেশি জটিল, ঝামেলা হবে অনেক’, তিনি জার্মান ভাষায় মন্তব্য করলেন।

‘আয় করতে চাইলে ঝামেলাও সইতে হবে’, জার্মান ভাষায় ভাসেকা ভেস্লোভস্কি বললেন জার্মানকে ব্যঙ্গ করে; ‘জার্মান ভাষা খুব ভালোবাসি’, ফরাসি ভাষায় আবার সেই হাসি নিয়ে তিনি তাকালেন আন্নার দিকে

‘থামুন’, আন্না কপট কঠোরতায় ফরাসি ভাষায় বললেন।

‘আর আমরা ভেবেছিলাম আপনাকে মাঠে দেখতে পাব। ভাসিলি সেমিওনিচ’, রুগ্‌ণ ডাক্তারটিকে বললেন আন্না, ‘আপনি গিয়েছিলেন সেখানে?’

‘গিয়েছিলাম, কিন্তু হাওয়া হয়ে যাই’, বিমর্ষ রসিকতা করে জবাব দিলেন ডাক্তার।

‘তার মানে, আপনি বেশ একটু বেরিয়ে বেড়িয়েছেন।’

‘চমৎকার!’

‘আর বৃদ্ধা কেমন আছে? আশা করি, টাইফয়েড নয়?’

‘টাইফয়েড হোক না হোক, ভালোর দিকে যাচ্ছে না।’

‘কি দুঃখের কথা!’ এই বলে গার্হস্থ্য লোকদের সম্মান জানিয়ে আন্না মন দিলেন অতিথিদের দিকে

‘যাই বলুন, আপনার কথামত যন্ত্র বানানো মুশকিল, আন্না আর্কাদিয়েভনা’, রসিকতা করে বললেন সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি। ‘কেন, মুশকিল কিসে?’ হেসে জিজ্ঞেস করলেন আন্না, সে হাসিতে বোঝা গেল যে যন্ত্রের গঠনকৌশল নিয়ে তাঁর ব্যাখ্যায় মধুর কিছু-একটা ছিল যা সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিরও নজরে পড়েছে অল্পবয়সী ছেনালির এই নতুন দিকটা ডল্লির ভালো লাগল না।

‘কিন্তু বাস্তুকর্ম সম্পর্কে আন্না আর্কাদিয়েভনার যা জ্ঞান সেটা আশ্চর্য’, বললেন তুশকেভিচ।

‘নয়ত কি, কাল আমি থামের ভিৎ নিয়ে কথা বলতে শুনেছিলাম আন্না আর্কাদিয়েভনাকে’, বললেন ভেস্নোভস্কি, ‘ঠিক না?’

চারপাশে যখন এতকিছু দেখা যাচ্ছে, শোনা যাচ্ছে, তখন এতে অবাক হবার কিছু নেই’, বললেন আন্না; ‘আর আপনি নিশ্চয় জানেন না কি দিয়ে বাড়ি তৈরি হয়?’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা দেখতে পেলেন যে আন্না আর ভেস্লোভস্কির মধ্যে যে একটা লীলারঙ্গের সুর ছিল সেটা আন্নার ভালো লাগছিল না তাহলেও অনিচ্ছায় ধরা দিলেন তাতে।

এক্ষেত্রে ভ্রন্‌স্কি মোটেই লেভিনের মত আচরণ করলেন না। ভেস্লোভস্কির বাচালতায় তিনি স্পষ্টতই কোন গুরুত্ব দেননি, বরং উৎসাহ দিলেন রসিকতাটায়।

‘তাহলে বলুন ভেস্লোভস্কি, পাথর জোড়া লাগে কিসে?’

‘সিমেন্টে নিশ্চয়।’

‘চমৎকার! কিন্তু সিমেন্ট কি জিনিস?’

‘একতাল কাদার মত… না, পুটিঙের মত’, ভেস্লোভস্কির উত্তরে হো-হো করে হেসে উঠলেন সবাই।

বিষণ্ণ নীরবতায় নিমগ্ন ডাক্তার, স্থপতি আর গোমস্তা ছাড়া ভোজনরতদের আলাপ থামছিল না। কখনো তা পিছলিয়ে যাচ্ছিল, কখনো মোক্ষম খোঁচা মারছিল কাউকে। একবার দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা খুবই আহত হয়েছিলেন, এত উত্তেজিত হয়ে উঠেছিলেন যে লাল হয়ে ওঠেন। পরে মনে করার চেষ্টা করেছেন অবান্তর ও অপ্রীতিকর কিছু বলেছিলেন কিনা। য়িাঙ্কি লেভিনের কথা তোলেন। তাঁর এই অদ্ভুত মতামতের উল্লেখ করেন যে রুশী কৃষি কাজে যন্ত্র ক্ষতিকর।

‘মিঃ লেভিনকে জানার সৌভাগ্য আমার হয়নি’, হেসে বলেন ভ্রন্‌স্কি, ‘কিন্তু যে যন্ত্রগুলোকে তিনি ধিক্কার দিচ্ছেন, সেগুলো সম্ভবত তিনি কখনো দেখেননি, আর দেখে পরখ করে থাকলেও সেটা ওপর-ওপর, এবং রুশী যন্ত্র, বিদেশী নয়। এখানে মতামত আসতে পারে কোত্থেকে?’

‘মোটের ওপর তুর্কী মতামত’, আন্নার দিকে তাকিয়ে হেসে হেসে বললেন ভেস্লোভস্কি।

‘আমি ওঁর মতামত সমর্থন করতে যাচ্ছি না’, লাল হয়ে বলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা। ‘কিন্তু এ কথা বলতে পারি যে, উনি অতি সুশিক্ষিত লোক। এখানে থাকলে কি জবাব দিতে হবে সেটা তিনি নিজেই জানতেন, আমি জানি না।’

‘ওকে আমি ভারি ভালোবাসি। খুবই বন্ধু আমরা’, সদয় হাসি হেসে বললেন সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি, কিন্তু মাপ করবেন, কিছুটা উদ্ভটত্ব আছে ওর। যেমন জেমভো প্রশাসন আর সালিসী আদালতকে সে মনে করে নিষ্প্রয়োজন, তাতে যোগ দিতে চায় না।’

‘এটা আমাদের রুশী ঔদাসীন্য’, বোঁটার ওপর বসানো পাতলা একটা পাত্রে বরফ পানি ঢালতে ঢালতে বললেন ভ্রন্‌স্কি, ‘আমাদের অধিকার হেতু যেসব দায়িত্ব আমাদের ওপর বর্তায় তা অনুভব না করে এসব দায়িত্ব অস্বীকার করা। ‘নিজের দায়িত্ব পালনে ওঁর চেয়ে বেশি কঠোর লোক আমি দেখিনি’, ভ্রন্‌স্কির এই শ্রেষ্ঠত্বের সুরে তিতিবিরক্ত হয়ে বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

‘বিপরীতপক্ষে আমি’, কথাটায় কেন জানি রীতিমত খোঁচা খেয়ে ভ্রন্‌স্কি বলে চললেন, ‘বিচারক নির্বাচিত করায় আমি নিকোলাই ইভানিচের নিকট (য়িাঙ্কিকে দেখালেন তিনি) অতি কৃতজ্ঞ। অধিবেশনে গিয়ে ঘোড়া নিয়ে চাষীর মামলা শোনা আমি আর যা কিছু করতে পারি তার মতই সমান গুরুত্বপূর্ণ বলে আমি মনে করি। আমাকে যদি পরিষদ সদস্য করা হয়, তাহলে সেটা আমার সম্মান বলে জ্ঞান করব। ভূস্বামী হিসেবে যেসব সুবিধা আমি ভোগ করি তা পরিশোধ করতে পারব এই দিয়ে। দুঃখের বিষয়, রাষ্ট্রে বৃহৎ ভূস্বামীদের যে গুরুত্ব থাকা উচিত সেটা বোঝা হচ্ছে না।’

ভ্রন্‌স্কি নিজের বাড়িতে খাবার টেবিলে নিজের ন্যায্যতা সম্পর্কে যেভাবে নিশ্চিন্তে কথা বলে যাচ্ছিলেন, সেটা শুনতে অদ্ভুত লাগছিল দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার। তাঁর মনে পড়ল, একেবারে বিপরীত দৃষ্টিধারী লেভিনও নিজের বাড়িতে খাওয়ার টেবিলে একই রকম দৃঢ়ভাবে নিজের মতামত প্রকাশ করেছিলেন। কিন্তু লেভিনকে ভালো লাগে তাঁর। তাই তাঁর পক্ষই নিয়েছিলেন।

‘তাহলে পরের অধিবেশনে আপনার ওপর আমরা ভরসা রাখতে পারি তো, কাউন্ট?’ সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি বললেন; ‘তবে রওনা দিতে হবে আগে যাতে আটই ওখানে পৌঁছে যান। সম্ভবত আমার কাছে আসার সম্মান দেবেন কি আমাকে?’

‘তোমার beau-frere-র সাথে আমি খানিকটা একমত’, আন্না বললেন, ‘শুধু উনি যা ভাছেন সেভাবে নয়’, হেসে যোগ করলেন তিনি। ‘আমার ভয় হচ্ছে, ইদানীং আমাদের সামাজিক দায়িত্ব বেড়ে গেছে বড় বেশি। আগে যেমন রাজপুরুষেরা ছিল এত বেশি যে প্রতিটি কাজের জন্যে একজন করে বরাদ্দ হত, এখন তেমনি এসব সামাজিক কর্মকর্তা। আলেক্সেই এখানে আছে ছয় মাস, কিন্তু ইতিমধ্যেই মনে হয় ও পাঁচটা কি ছ’টা সামাজিক সংস্থার সদস্য—ট্রাস্টি, জজ, পরিষদের সদস্য, জুরি, ঘোড়া নিয়ে আরো কি-একটা ব্যাপার। এই ধরনের জীবনযাত্রার কল্যাণে সমস্ত সময় যায় এর পেছনে। এসব ব্যাপার এত বেশি যে আমার ভয় হয় যে, ওগুলো কেবল একটা বাহ্যিক কৃত্যে দাঁড়াচ্ছে। আপনি কতকগুলো সংস্থার সদস্য নিকোলাই ইভানিচ?’ সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কিকের জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘মনে হয় বিশটার বেশি! তাই না?’

আন্না কথাগুলো বলছিলেন ঠাট্টা করে, কিন্তু তাঁর সুরে ধরা যাচ্ছিল বিরক্তি। আন্না আর ভ্রন্‌স্কিকে মন দিয়ে লক্ষ্য করে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা তখনই টের পেয়েছিলেন সেটা। এও তিনি লক্ষ করেছিলেন যে, এই কথাবার্তার সময় ভ্রন্‌স্কির মুখভাব হয়ে ওঠে গুরুতর, একরোখা।

এটা লক্ষ্য করে এবং প্রিন্সেস ভারভারা যে কথার মোড় ঘুরিয়ে দেবার জন্য তাড়াতাড়ি করে পিটার্সবুর্গের কথা পাড়লেন তা দেখে, এবং বাগানে ভ্রন্‌স্কি অপ্রাসঙ্গিকভাবে তাঁর ক্রিয়াকলাপের বিষয় বলছিলেন তা মনে পড়ায় ডল্লি বুঝলেন যে, সামাজিক ক্রিয়াকলাপের এই প্রশ্নটার সাথে আন্না ও ভ্রন্‌স্কির মধ্যে কি-একটা গোপন কলহ জড়িয়ে আছে।

খাদ্য, সুরা, পরিবেশন—সবই অতি চমৎকার। কিন্তু আনুষ্ঠানিক ডিনার আর বলনাচে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা যা দেখেছেন তেমনি, যাতে তিনি অনভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, যাতে থাকত সেই একই নৈব্যক্তিকতা আর চাপের ভাব; তাই সাধারণ একটা দিনে অল্প কয়েকজনের জন্য এসব পারিপাট্য বিছ্‌ছিরি লাগল তাঁর।

ডিনারের পর বারান্দায় বসলেন সবাই। তারপর শুরু হল লন টেনিস খেলা। খেলোয়াড়রা দুই দলে ভাগ হয়ে গিয়ে দাঁড়ালেন সমতল ও রোল করা ক্রকেটগ্রাউন্ডে, সোনালি খুঁটিতে টাঙানো নেটের দুই পাশে। দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা খেলে দেখতে চেয়েছিলেন, কিন্তু অনেকক্ষণ খেলাটার মাথামুণ্ডু কিছু বুঝছিলেন না। আর যখন বুঝলেন তখন এত ক্লান্ত হয়ে পড়েছিলেন যে প্রিন্সেস ভারভারার কাছে গিয়ে বসে শুধু দেখতে লাগলেন খেলোয়াড়দের। তাঁর পার্টনার তুশকেভিচও খেলা ছেড়ে দিলেন; কিন্তু অন্যান্যেরা খেলা চালিয়ে গেলেন অনেকক্ষণ। সি্‌ভ্‌য়াজ্‌স্কি আর ভ্রন্‌স্কি দুজনেই খেলছিলেন চমৎকার এবং গুরুত্ব দিয়ে। তাঁদের দিকে পাঠানো বলের ওপর তীক্ষ্ণ নজর রাখছিলেন তাঁরা, দেরি বা তাড়াহুড়া না করে দ্রুত ছুটে যাচ্ছিলেন তার দিকে। বলটার লাফিয়ে ওঠার অপেক্ষা করছিলেন, তারপর র‍্যাকেটের নিখুঁত ও অব্যর্থ ঘায়ে সেটাকে ফেরত পাঠাচ্ছিলেন নেটের ওপর দিয়ে। সবচেয়ে খারাপ খেলছিলেন ভেস্লোভস্কি। বড় বেশি উত্তেজিত হয়ে উঠছিলেন তিনি। তবে নিজের ফুর্তিতে মাতিয়ে রাখছিলেন খেলোয়াড়দের। থামছিল না তাঁর হাসি আর চিৎকার। মহিলাদের অনুমতি নিয়ে অন্যান্য পুরুষদের মত তিনি তাঁর ফ্রক-কোট খুললেন। সাদা শার্ট পরে, ঘর্মাক্ত রক্তিম মুখে, সুন্দর বিশাল দেহে দম্‌কা মেরে দৌড়াদৌড়ি করে বেশ একটা ছাপ ফেলেছিলেন মনে।

সে রাতে ঘুমাবার জন্য বিছানায় শুয়ে চোখ মুদতেই দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা ক্রকেটগ্রাউন্ডে ছুটোছুটি করতে দেখছিলেন ভাসেনকা ভেস্লোভস্কিকে।

খেলার সময়টায় কিন্তু দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রনার মন খারাপ ছিল। ভাসেকা ভেস্লোভস্কি আর আন্নার মধ্যে যে একটা চটুলতা চলছিল, আর শিশু সন্তান ছাড়া বয়স্করা বাচ্চাদের খেলা খেললে যে রকম অস্বাভাবিক মনে হয়, তেমন একটা সাধারণ অস্বাভাবিকতা-এর কোনটাই তাঁর ভালো লাগেনি। কিন্তু অন্যদের মনঃক্ষুণ্ণ না করা আর কোনক্রমে সময়টা কাটিয়ে দেবার জন্য তিনি বিশ্রাম নেওয়ার পর আবার খেলায় যোগ দিলেন এবং ভান করলেন যেন ফুর্তি পাচ্ছেন তিনি। সেদিন সারা সময়টা তাঁর কেবলি মনে হচ্ছিল যে তাঁর চেয়ে ভালো অভিনেতাদের সাথে তিনি থিয়েটারে নেমেছেন আর তাঁর খারাপ অভিনয়ে নাটকটাই মাটি হয়ে যাচ্ছে।

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা এই ভেবে এসেছিলেন যে ভালো লাগলে দু’দিন থাকবেন। কিন্তু সন্ধ্যায়, খেলার সময় তিনি স্থির করলেন চলে যাবেন পরের দিনই। মায়ের যে যন্ত্রণাকর ঝামেলাগুলোকে তিনি এখনে আসার সময় রাস্তায় এমন ঘৃণা করেছিলেন। একটা দিন তা ছাড়াই কাটার পর এখন তারা দেখা দিল অন্য আলোয়, সেই ঝামেলাগুলোই টানছিল তাঁকে।

সান্ধ্য চা আর নৈশ নৌকাবিহারের পর দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা যখন একা ঢুকলেন তাঁর ঘরে, পোশাক ছেড়ে রাতের জন্য পাতলা হয়ে আসা চুল আঁচড়াতে লাগলেন, মনটা অনেক হাল্কা লাগল তাঁর।

তাঁর কাছে এখন আন্না আসবেন—এটা ভেবে তাঁর এমন কি খারাপই লাগছিল। নিজের ভাবনা-চিন্তা নিয়ে তিনি একা থাকতে চাইছিলেন।

তেইশ

যখন ডল্লি শুতে যাচ্ছিলেন তখন তাঁর কাছে রাতের পোশাকে আন্না এলেন।

আন্না গোটা দিনটা বার কয়েক তাঁর প্রাণের কথা বলতে চেয়েছিলেন, কিন্তু দু’চারটা কথা বলেই থেমে যাচ্ছিলেন, বলছিলেন : ‘সে পরে হবে, তুমি আমি একলা হলে বলব। তোমাকে আমার কত কথা বলার আছে।’

ওঁরা এখন একলা, কিন্তু আন্না ভেবে পাচ্ছিলেন না–কি বলবেন। জানালার কাছে বসে তিনি ডল্লির দিকে তাকিয়ে রইলেন, প্রাণ থেকে কথাবার্তার যে ভাণ্ডার অফুরন্ত লেগেছিল, মনে মনে তা হাতড়াতে লাগলেন কিন্তু কিছুই খুঁজে পাচ্ছিলেন না। এই মুহূর্তে তাঁর মনে হচ্ছিল যে বলা হয়ে গেছে সবই।

‘তা কিটি কেমন আছে?’ গভীর শ্বাস ফেলে দোষী-দোষী ভাব নিয়ে ডল্লির দিকে তাকিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘আমাকে সত্যি করে বলো তো ডল্লি, আমার ওপর সে রাগ করে আছে কি?’

‘রাগ? মোটেই না’, হেসে বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

‘কিন্তু আমাকে দেখতে পারে না, ঘৃণা করে?’

‘না, না! তবে জানো তো এটা ক্ষমা করে না কেউ।’

‘হ্যাঁ, তা ঠিক’, মুখ ফিরিয়ে, খোলা জানালার দিকে তাকিয়ে আন্না বললেন, ‘কিন্তু আমার দোষ ছিল না। আর কেই-বা দোষী? দোষী কি জিনিস? হতে পারত কি অন্যরকম? কি মনে করো তুমি? তুমি স্তিভার স্ত্রী নও, এ কি হতে পারত?’

‘সত্যি জানি না। তবে তুমি আমাকে বল…’

‘হ্যাঁ, বলব, কিন্তু কিটির প্রসঙ্গটা আমরা শেষ করিনি এখনো। ও কি সুখী? লোকে বলে, লেভিন চমৎকার লোক।’

‘শুধু চমৎকার বললে কম বলা হয়। ওঁর চেয়ে ভালো লোক আমি আর দেখিনি।’

‘আহ্, কি যে আনন্দ হচ্ছে! ভারি আনন্দ হচ্ছে! শুধু চমৎকার বললে কম বলা হয়’, পুনরুক্তি করলেন আন্না।

ডল্লি হাসলেন।

‘কিন্তু নিজের কথা তুমি বল আমাকে। তোমার সাথে লম্বা কথাবার্তা আছে। বাগানে আমরা…’ কিন্তু ভ্রন্‌স্কিকে কি নামে উল্লেখ করবেন ভেবে পেলেন না ডল্লি। কাউন্ট বা আলেক্সেই কিরিলোভিচ—দুটো নামেই তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল অস্বস্তিকর।

‘এমন হঠাৎ করে বলি কিভাবে? সত্যি আমি জানি না।’

‘না, তাহলেও বল… তুমি আমার জীবন দেখতে পাচ্ছ। কিন্তু ভুলো না যে এটা দেখছ গ্রীষ্মে, তুমি যখন এলে আমরা একা ছিলাম না… কিন্তু আমরা এসেছিলাম বসন্তের একেবারে গোড়ায়, ছিলাম নিতান্ত একা-একা, থাকবও আবার একা, এর চেয়ে ভালো কিছু আমি কামনা করি না। কিন্তু কল্পনা করে দ্যাখো, আমি থাকছি একা, ওকে ছাড়া, একা, আর সেটা ঘটবে… সব কিছু থেকে দেখতে পাচ্ছি যে এটা ঘটবে ঘন ঘন, ওর অর্ধেকটা সময় কাটবে বাড়ির বাইরে’, উঠে দাঁড়িয়ে বললেন তিনি, সরে এসে বসলেন ডল্লির কাছে।

ডল্লি আপত্তি করতে যাচ্ছিলেন, কিন্তু তাঁকে থামিয়ে দিয়ে আন্না বললেন, ‘বলাই বাহুল্য, ওকে আমি আটকে রাখব না জোর করে, এখনো আটকে রাখছি না। ঘোড়দৌড় হচ্ছে, ওর ঘোড়া দৌড়াবে, ও চলল। তাতে আমি খুবই খুশি। কিন্তু তুমি আমার কথাটা ভাবো, কল্পনা কর আমার অবস্থাটা… যাক গে, ওসব বলে কি হবে!’ হাসলেন আন্না; ‘তা সে কি বলল তোমাকে?’

‘সে যা বলল, সেটা আমিও তোমাকে বলতে চাই। ওর ওকালতি করা আমার পক্ষে সহজ : আমি বলতে চাই, উপায় কি নেই, এ কি হয় না…’, থতমত খেলেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, ‘তোমার অবস্থাটা শোধরানো, ভালো করার উপায় কি নেই?… তুমি জানো কিভাবে আমি দেখছি… তবুও যদি উপায় থাকে, তোমার বিয়ে করা উচিত…’

‘তার মানে বিবাহবিচ্ছেদ?’ আন্না বললেন; ‘জানো, পিটার্সবুর্গে একমাত্র যে নারী আমার কাছে এসেছে সে বেত্‌সি ভেস্কায়া। তুমি চেনো তাকে? মূলত এটি এক ব্যভিচারিণী নারী। অতি জঘন্য উপায়ে স্বামীকে প্রতারণা করে সে সম্পর্ক পেতেছিল তুশকেভিচের সাথে। আর সেই কিনা আমাকে বলল যে, আমার অবস্থাটা যতক্ষণ বিশৃঙ্খল থাকছে, ততক্ষণ আমার সাথে সে কোন সম্পর্ক রাখতে চায় না। ভেবো না যে আমি ওর সাথে তুলনা করলাম… আমি তোমাকে তো জানি, বোন। ওটা আপনা থেকে কেমন মনে পড়ে গেল… তা ও কি বলল তোমাকে?’ পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি

‘বললেন যে তোমার জন্যে, নিজের জন্যে কষ্ট পাচ্ছেন তিনি। তুমি হয়ত বলবে এটা স্বার্থপরতা, কিন্তু অতি সঙ্গত এবং উদার স্বার্থপরতা! উনি চান প্রথমত নিজের মেয়েকে বৈধ করতে আর তোমার স্বামী হতে, তোমার ওপর অধিকার পেতে।’

‘আমার অবস্থায় কোন স্ত্রী, কোন ক্রীতদাসীর পক্ষে সম্ভব আমার মত ক্রীতদাসী হওয়া?’ বিমর্ষ কণ্ঠে বাধা দিলেন তিনি ‘প্রধান যে জিনিসটা উনি চাইছেন… উনি চাইছেন, তুমি যেন কষ্ট না পাও।’

‘সেটা অসম্ভব! তারপর?’

‘তারপর অতি ন্যায়সঙ্গত একটা জিনিস—উনি চান তোমাদের ছেলেমেয়েদের যেন বৈধ নাম থাকে।’

‘কিসের আবার ছেলেমেয়ে?’ ডল্লির দিকে না তাকিয়ে চোখ কুঁচকে বললেন আন্না।

‘আনি আর ভবিষ্যতে যারা আসবে…’

‘ও নিশ্চিন্ত থাকতে পারে, আমার আর ছেলেমেয়ে হবে না।’

‘হবে না বলছ কেমন করে?…’

হবে না কারণ আমি তা চাই না।’

এবং নিজের সমস্ত অস্থিরতা সত্ত্বেও ডল্লির মুখে একটা সরল কৌতূহল, বিস্ময় আর আতংক দেখে হাসলেন তিনি।

‘আমার অসুখের পর ডাক্তার আমাকে বলেছে …’

‘হতে পারে না!’ বিস্ফারিত চোখে ডল্লি বললেন। তাঁর কাছে এটা এমন একটা উদ্ঘাটন যার পরিণাম আর খতিয়ান এতই বৃহৎ যে প্রথম মুহূর্তগুলোতে টের পেতে হয় যে সবটা বুঝে উঠতে পারা অসম্ভব, তার জন্য অনেক, অনেক ভেবে দেখতে হবে।

পরিবারে কেন মাত্র একটি বা দুটো শিশু থাকে এই যে রহস্যটা আগে তাঁর কাছে ছিল দুর্বোধ্য এই উদ্‌ঘাটন তা পরিষ্কার করে দিয়ে এত ভাবনা, চিন্তা আর পরস্পরবিরোধী ভাবাবেগের উপলক্ষ হযে উঠল যে ডল্লি কিছুই বলতে পারলেন না। শুধু অবাক হয়ে চোখ বড় বড় করে তাকিয়ে রইলেন আন্নার দিকে। আজ রাস্তায় আসতে আসতে তিনি যার স্বপ্ন দেখছিলেন, ব্যাপারটা তাই-ই, কিন্তু সেটা যে সম্ভব তা এখন জেনে আতংক হল তাঁর। মনে হল বড় বেশি জটিল প্রশ্নের এ এক সহজ উত্তর।

‘এটা কি নীতি-বিগর্হিত নয়?’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে ফরাসি ভাষায় শুধু এটুকুই বলতে পারলেন তিনি।

‘কেন? ভেবে দ্যাখো, দুয়ের একটা আমাকে বেছে নিতে হবে : হয় গর্ভবতী হওয়া, তার মানে অসুস্থতা, নয় স্বামীর বন্ধু, সখি হওয়া, যতই হোক স্বামীই তো’, ইচ্ছাকৃত একটা অগভীর লঘু সুরে আন্না বললেন।

‘তা বটে, তা বটে’, যে যুক্তিগুলো দিয়ে আগে নিজেকে বুঝিয়েছিলেন তা শুনে বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা। তবে এখন আর তাতে আগের প্রত্যয় ছিল না।

‘তোমার, অন্যদেরও’, ডল্লির ভাবনাটা অনুমান করেই যেন বললেন আন্না, ‘এতে এখনো সন্দেহ থাকতে পারে; কিন্তু আমার পক্ষে… তুমি বুঝে দ্যাখো, আমি স্ত্রী নই; ও আমাকে ভালোবাসছে, ভালোবাসবে যতদিন ভালোবাসা আছে। তাহলে, কি দিয়ে আমি ওর ভালোবাসা ধরে রাখব? এটা দিয়ে।’

সাদা হাত দু’খানা তিনি বাড়িয়ে ধরলেন উদরের সামনে।

উত্তেজনার মুহূর্তগুলোয় যেমন হয়, অসাধারণ ক্ষিপ্রতায় ভাবনা আর স্মৃতি ভিড় করে এল দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার মনে। তিনি ভাবলেন, ‘আমি স্তিভাবে নিজের দিকে আকৃষ্ট করতে পারিনি; সে চলে যায় অন্যদের কাছে। প্রথম যেটির জন্যে সে আমার প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করে, সেটি সব সময় সুন্দরী হাসি-খুশি থেকেও তাকে ধরে রাখতে পারেনি। সে তাকে ত্যাগ করে যায় অন্যের কাছে। আন্না সত্যিই কি ভাবে সে এই দিয়ে কাউন্ট ভ্রন্‌স্কিকে আকৃষ্ট করবে, ধরে রাখবে? উনি যদি এটাই চান, তাহলে আরো প্রাণোচ্ছল আর মনোহর প্রসাধন আর ঠাক-ঠমক তিনি খুঁজে পাবেন। আন্নার নগ্ন বাহু যত ধবধবে, যত অপরূপই হোক, যত সুন্দরই হোক তাঁর সুডৌল দেহবল্লরী, কালো চুলের মধ্যে থেকে তাঁর এই আতপ্ত আনন, আরো বেশি সুন্দরীকে ভ্রন্‌স্কি পাবেন, যেমন খুঁজে পায় আমার জঘন্য, করুণ, প্রিয়তম স্বামী।’

কোন কথা না বলে ডল্লি শুধু দীর্ঘশ্বাস ত্যাগ করলেন। আপত্তিজ্ঞাপক এই দীর্ঘশ্বাসটা লক্ষ করে আন্না তাঁর কথা চালিয়ে গেলেন। আরো যুক্তি ছিল তাঁর হাতে আর তা এতই জোরালো যে খণ্ডন করা সম্ভব নয়।

‘তুমি বলছ, এটা খারাপ? কিন্তু ভালো করে ভেবে দেখা দরকার’, বলে চললেন আন্না, ‘তুমি ভুলে যাচ্ছ আমার অবস্থাটা। সন্তান আমি চাইতে পারি কেমন করে? প্রসবকষ্টের কথা বলছি না, ওতে আমার ভয় নেই। ভেবে দ্যাখো, কি হবে আমার শিশু? অপরের উপাধিধারী অভাগা। জন্মের মুহূর্তে থেকেই তাদের পড়তে হবে মা, বাপ, নিজের জন্মের জন্যেই লজ্জা পাবার আবশ্যিকতায়।’

‘এজন্যেই তো দরকার বিবাহবিচ্ছেদ।’

কিন্তু আন্না তাঁর কথায় কান দিলেন না। যেসব যুক্তি দিয়ে নিজেকে তিনি বহুবার বুঝিয়েছেন, তা সবটা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল তাঁর।

‘দুনিয়ায় অভাগাদের জন্ম না দেবার জন্যে যদি তা ব্যবহার না করি, তাহলে কেনই-বা বিচার-বুদ্ধি দেওয়া হয়েছে আমাকে?’

ডল্লির দিকে তাকালেন তিনি, কিন্তু উত্তর না পেয়ে বলে গেলেন : ‘এসব অভাগা শিশুদের কাছে আমি সব সময় নিজেকে অপরাধী জ্ঞান করতাম। ওরা যদি না থাকে, তাহলে অন্ততপক্ষে ওরা অভাগা নয়, আর যদি অভাগা হয়, তাহলে একা আমিই দোষী।’

এগুলো ঠিক সেই যুক্তি যা দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা নিজেই নিজের কাছে উত্থাপন করেছিলেন; কিন্তু এখন সেগুলো শুনে তিনি বূঝতে পারছিলেন না কিছু। ভাবলেন, ‘যে জীবেরা নেই, তাদের কাছে দোষী হওয়া যায় কেমন করে?’ হঠাৎ তাঁর মনে এল, এমন কোন ক্ষেত্র সম্ভব কি যাতে তাঁর আদরের দুলাল গ্রিশার পক্ষে আদৌ না জন্মানো ভালো হত? ব্যাপারটা তাঁর কাছে বিদঘুটে, এত অদ্ভূত লাগল যে ঝাঁক বেঁধে আসা এই উন্মাদ ভাবনাগুলোর তালগোলটাকে তাড়াবার জন্য মাথা ঝাঁকালেন তিনি।

‘না, আমি জানি না, এটা ভালো নয়’, মুখে বিতৃষ্ণার ভাব নিয়ে শুধু এটুকু বললেন তিনি

‘হ্যাঁ, কিন্তু তুমি ভুলো না কে তুমি, কে আমি… তাছাড়া’, নিজের যুক্তির বিভব আর ডল্লির দৈন্য সত্ত্বেও এটা যে ভালো নয় সেটা যেন স্বীকার করে তিনি যোগ দিলেন, ‘প্রধান কথাটা তুমি ভুলো না যে আমি এখন তোমার অবস্থায় নেই। তোমার কাছে প্রশ্ন হল, চাও কি যে ছেলে আর না হোক, আমার কাছে প্রশ্ন, চাই কি ছেলে হোক? দুয়ের মধ্যে অনেক তফাৎ। বুঝতে পারছ, আমার অবস্থায় এটা আমি চাইতে পারি না।’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা আপত্তি করলেন না। হঠাৎ তিনি অনুভব করলেন যে, আন্নার কাছ থেকে তিনি এত দূরে সরে গেছেন যে তাঁদের মধ্যে কতকগুলো প্রশ্নে তাঁরা কখনোই একমত হবেন না, তার কথা না তোলাই ভালো।

চব্বিশ

ডল্লি বললেন, ‘সে জন্যই তো যদি সম্ভব হয়, তোমার অবস্থাটা ঠিকঠাক করে নেওয়া আরো বেশি দরকার।’

‘হ্যাঁ, যদি সম্ভব হয়’, হঠাৎ আন্না বললেন একেবারে অন্যরকম একটা কণ্ঠস্বরে, মৃদু, বিষণ্ণ।

‘বিবাহবিচ্ছেদ কি সম্ভব নয়? আমি শুনেছি যে তোমার স্বামী রাজি।’

‘ডল্লি! এ নিয়ে কথা বলতে ইচ্ছে না আমার।’

‘বেশ, বলব না’, আন্নার মুখে যন্ত্রণা ফুটে উঠতে দেখে তাড়াতাড়ি করে বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা; ‘আমি শুধু দেখতে পাচ্ছি যে, তুমি সব কিছু দেখছ বেশি বিষাদের দৃষ্টিতে।’

‘আমি? একেবারে নয়। আমি খুব ফুর্তিতে, সুখে-স্বাচ্ছন্দে আছি। তুমি দেখেছ, আমার সাফল্য আছে। ভেস্লোভস্কি … ‘

‘হ্যাঁ, সত্যি বলতে কি, ভেস্লোভস্কির হালচাল আমার ভালো লাগেনি’, কথার মোড় ফেরাবার জন্য বললেন দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা।

‘আরে না! এতে আলেক্সেইকে একটু সুড়সুড়ি দেওয়া হয়, তার বেশি কিছু না; একেবারে খোকা, পুরোপুরি আমার হাতে; আমার যেমন খুশি তেমনি ওকে চালাই, বুঝেছ! ও ঠিক তোমার গ্রিশার মত… ডল্লি!’ হঠাৎ প্রসঙ্গ পালটালেন তিনি, ‘তুমি বলছ আমি সব কিছু দেখছি বিষাদের দৃষ্টিতে। তুমি বুঝতে পারবে না। এটা বড় বেশি ভয়ংকর। আদৌ কিছু না দেখার চেষ্টা করি আমি।’

‘কিন্তু আমার মনে হয় দেখা দরকার। যা সম্ভব, দরকার তেমন সব কিছু করা।’

‘কিন্তু কি সম্ভব? কিছুই না। বলছ যে আলেকসেইকে বিয়ে করা দরকার আর সে কথা ভাবছি না। আমি তা ভাবছি না!’ পুনরুক্তি করলেন তিনি, ‘লাল হয়ে উঠল তাঁর মুখ। উঠে দাঁড়িয়ে দীর্ঘশ্বাস নিতে নিতে তিনি তাঁর লঘূ চলনে পায়চারি করতে লাগলেন ঘরময়, থামছিলেন মাঝে মাঝে। ‘আমি ভাবছি না? এমন একটা দিন, একটা ঘণ্টাও যায় না, যখন আমি ভাবিনি আর ভেবেছি বলে আক্ষেপ করিনি… কেননা ও নিয়ে ভাবনা আমাকে পাগল করে দিতে পারে। পাগল করে দেয়’, পুনরাবৃত্তি করলেন তিনি। ‘যখন এ নিয়ে ভাবি, মর্ফিয়া ছাড়া ঘুমতে পারি না। বেশ, শান্তভাবে কথা বলা যাক। আমাকে বলা হচ্ছে– বিবাহবিচ্ছেদ। প্রথমত, আমাকে উনি সেটা দেবেন না। উনি এখন কাউন্টেস লিদিয়া ইভানোভনার কবলস্থ।’

দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা সহানুভূতিতে কাতর মুখে চেয়ারে সোজা হয়ে বসে পাদচারণরত আন্নাকে দেখছিলেন মাথা ফিরিয়ে ফিরিয়ে। মৃদুস্বরে বললেন, ‘তাহলেও চেষ্টা করা দরকার।’

‘ধরে নিচ্ছি চেষ্টা করা গেল’, হাজারবার ভেবে দেখা প্রায় ঠোঁটস্থ একটা চিন্তা প্রকাশ করে বললেন তিনি; ‘এর অর্থ, যে আমি ওঁকে মহানুভব বলে মনে করলেও ঘৃণা করি, তবে তাঁর কাছে দোষী বলে মেনে নিই—সেই আমাকে হীন হতে হবে ওঁকে চিঠি লেখার জন্যে… বেশ, ধরা যাক আমি নিজের ওপর জোর খাটিয়ে এটা করলাম। হয় পাব অপমানকর জবাব, নয় সম্মতি। বেশ, নয় সম্মতিই পেলাম…’ আন্না এই সময় ঘরের দূর কোণটায় থেমে ব্যস্ত হলেন জানালার পর্দা নিয়ে, ‘সম্মতি আমি পেলাম, কিন্তু ছে… ছেলে? ছেলেকে তো ওরা দেবে না আমাকে। আমাকে ঘৃণা করে ও বড় হবে বাপের কাছে, যাকে আমি ত্যাগ করেছি। তুমি বুঝে দ্যাখো, দুটো প্রাণী, সেরিওজা আর আলেক্‌সেই—দুজনকেই আমি সমান ভালোবাসি, নিজের চেয়েও বেশি।’

‘ঘরের মাঝখানে এসে দুই হাতে বুক চেপে তিনি দাঁড়ালেন ডল্লির সামনে। সাদা ড্রেসিং-গাউনে তাঁর মূর্তিটা মনে হল বড় বেশি লম্বা-চওড়া। মাথা নিচু করে তিনি তাঁর চকচকে সজর চোখে মাঝে মাঝে চাইছিলেন ছোটখাট, রোগা, তালি-মারা গাউন আর নৈশ টুপিতে করুণ ডল্লির দিকে, যিনি ব্যাকুলতায় কাঁপছিলেন।

‘শুধু এই দুটো প্রাণীকেই আমি ভালোবাসি আর একটায় নাকচ হয় অন্যটা। ওদের আমি মেলাতে পারছি না, আর শুধু এটাই আমার চাই। এটা যদি না হয়, তাহলে আর সবে বয়েই গেল। সব, সব কিছুতে। যে করেই হোক এর একটা শেষ হবে, তাই এ সম্পর্কে আমি বলতে পারি না, বলতে ভালোবাসি না। তাই আমাকে ধিক্কার দিও না, কোন দোষ ধ’রো না আমার। আমার যে কত জ্বালা, তোমার পবিত্রতায় তার সবটা তুমি বুঝতে পারবে না।’

কাছে এসে তিনি বসলেন ডল্লির পাশে, দোষী-দোষী মুখে তাঁর দিকে তাকিয়ে তাঁর হাতটা টেনে নিলেন।

‘কি তুমি ভাবছ? কি তুমি ভাবছ আমার সম্পর্কে? ঘৃণা করো না আমাকে। ঘৃণার আমি যোগ্য নই, একান্তই হতভাগ্য আমি। হতভাগ্য কেউ থাকলে সে আমি’, এই বলে ডল্লির দিকে থেকে মুখ ফিরিয়ে তিনি কেঁদে ফেললেন।

ডল্লি যখন একা হলেন, প্রার্থনা সেরে বিছানায় শুলেন। আন্নার সাথে যখন তিনি কথা বলছিলেন, তখন তাঁর জন্য সত্যিই বড় কষ্ট হচ্ছিল তাঁর। কিন্তু এখন তাঁর কথা তিনি চেষ্টা করেও ভাবতে পারলেন না। বাড়ি আর ছেলেমেয়েদের স্মৃতি তাঁর কল্পনায় ভেসে উঠল বিশেষ একটা নতুন মাধুর্যে, কেমন একটা নতুন ঔজ্জ্বল্যে। তাঁর এই জগৎটা তাঁর কাছে মনে হল এত আপন আর মধুর যে এর বাইরে কিছুতেই একটা দিনও কাটাতে রাজি নন তিনি, স্থির করলেন অবশ্য-অবশ্যই চলে যাবেন পরের দিনই।

আন্না ওদিকে নিজের ঘরে গিয়ে একটা পানপাত্রে কয়েক ফোঁটা ওষুধ ঢাললেন। যার বেশির ভাগই মর্ফিয়া। সেটা খেয়ে নিশ্চল হয়ে কয়েক মিনিট বসে থেকে শান্ত সজীব প্রাণে গেলেন শোবার ঘরে।

আন্না শোবার ঘরে ঢুকতে ভ্রন্‌স্কি মন দিয়ে তাকালেন তাঁর দিকে। ডল্লির ঘরে এতক্ষণ যে কাটালেন, তাতে অবশ্যই যে কথাবার্তা হবার কথা। তার ফলে কি দাঁড়াল সেটা ধরতে চাইছিলেন তিনি। কিন্তু আন্নার সংযত-উত্তেজিত যে মুখভাব কি যেন লুকিয়ে রাখছিল, তাতে ভ্রন্‌স্কি তাঁর সৌন্দর্য, এ সৌন্দর্য সম্পর্কে তাঁর চেতনা। আর সেটা ভ্রনস্কির ওপর কাজ করুক এমন একটা ইচ্ছা, যাতে তিনি অভ্যস্ত হলেও এখনো তার মোহে ধরা দেন—এছাড়া আর কিছু পেলেন না। কি কথাবার্তা হয়েছে সে বিষয়ে জিজ্ঞেস করতে চাইলেন না তিনি, আশা করলেন আন্না নিজেই কিছু- একটা বলবেন। কিন্তু আন্না বললেন শুধু : ‘ডল্লিকে তোমার ভালো লেগেছে বলে আমি খুশি। ভালো লেগেছে তো, তাই না?’

‘ওকে আমি অনেকদিন থেকে জানি। ভারি ভালোমানুষ, মনে হয় তবে বড় বেশি গদ্যজাতীয়। তাহলেও ও আসায় আমি খুব খুশি।’

আন্নার হাতটা নিয়ে উনি জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইলেন আন্নার চোখের দিকে।

দৃষ্টিটার অন্য মানে করে আন্না হাসলেন তাঁর উদ্দেশে।

পরের দিন সকালে গৃহের কর্তা-কর্ত্রীর অনুরোধ সত্ত্বেও দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা তৈরি হলেন যাবার জন্য। নিজের পুরানো কাফতান আর ডাক-হরকরী টুপি পরে লেভিনের কোচোয়ান তার বহুরূপী ঘোড়াগুলো আর তাপ্পি-মারা গাড়িটা আচ্ছাদিত বালি-ঢালা গাড়ি-বারান্দায় চালিয়ে নিয়ে এল দৃঢ়সংকল্প গোমড়া মুখে।

প্রিন্সেস ভারভারা আর অন্যান্য ভদ্রলোকদের কাছে বিদায় জ্ঞাপনের পালাটা ডল্লির কাছে সহজ হয়নি। একদিন কাটিয়েই ডল্লি এবং গৃহস্বামীরা স্পষ্টত টের পেয়েছিলেন যে তাঁর পরস্পরের যোগ্য নন, দহরম-মহরম না করাই ভালো। শুধু মন খারাপ হয়েছিল আন্নার। তিনি জানাতে যে তাঁর প্রাণের মধ্যে এই সাক্ষাৎটায় যেসব ভাবাবেগ উথলে উঠেছিল ডল্লি চলে যাওয়ায় এখন তা আর কেউ সচকিত করে তুলবে না। এসব অনুভূতির উদ্বেগ তাঁর কাছে ছিল কষ্টকর। তাহলেও তিনি জানাতেন যে সেগুলোই ছিল তাঁর প্রাণের সেরা দিক আর যে জীবন তিনি যাপন করছেন তাতে দ্রুত সে দিকটা আগাছায় ছেয়ে গেছে।

খোলা মাঠে এসে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনার মন ভরে উঠল স্বাচ্ছন্দ্যের একটা প্রীতিকর অনুভূতিতে। ইচ্ছে হচ্ছিল চাকর-বাকরদের জিজ্ঞেস করবেন, কেমন লাগল ভ্রন্‌স্কির ওখানে। হঠাৎ কোচোয়ান ফিলিপ নিজেই বলে উঠল : ‘বড় লোক বটে, আচ্ছা বড় লোক, আর ওট দিলে মাত্র তিন মাপ। মোরগ ডাকা ভোরের আগেই সব শেষ। তিন মাপে কি হয়? শুধু নাস্তা। গেরস্তরা এ বছর ওট বেচছে পঁয়তাল্লিশ কোপেক করে। আমাদের ওখানে যত ঘোড়া আসে, যত তারা খেতে পারে তত ওট দেওয়া হয়।’

‘কৃপণ জমিদার’, সমর্থন করল মুহুরি।

‘কিন্তু ওদের ঘোড়াগুলো কেমন লাগল তোমার?’ জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।

‘ঘোড়া সে অন্য কথা। খাবার-দাবারও ভালো। তবে আমার কেমন যেন বেজার লাগছিল দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা, আপনার কেমন লেগেছে জানি না’, সুন্দর ভালোমানুষি মুখটা ফিরিয়ে সে বলল।

‘আমারও খারাপ লেগেছে। তা সন্ধ্যা নাগাদ পৌঁছব তো?’

‘পৌঁছতে হবে গো।’

বাড়ি ফিরে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা দেখলেন সবাই নিরাপদে আছে। সবাইকেই আরো বেশি ভালো লাগল তাঁর এবং অতি উৎসাহে বলতে লাগলেন তাঁর যাত্রার কথা, কি চমৎকার অভ্যর্থনা করা হয়েছে তাঁকে; ভ্রন্‌স্কিদের কেমন বিলাসবহুল জীবন আর সুরুচি, কি রকম তাদের আমোদ-প্রমোদ—এসবের কথা বলে ভ্রন্‌স্কিদের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে দিলেন না কাউকে।

‘আন্না আর ভ্রন্‌স্কিকে—এবার আমি ওঁকে আরো ভালো করে জানালাম—ভালো করে জানলেই বোঝা যাবে কি মর্মস্পর্শী মধুর মানুষ তাঁরা—এখন সত্যিই অকপটে বললেন, ওখানে যে একটা অনির্দিষ্ট অপ্রসন্নতা আর অস্বস্তি বোধ করেছিলেন, সেটা ভুলে গেলেন তিনি।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *