আন্না কারেনিনা - প্রথম পর্ব
আন্না কারেনিনা - দ্বিতীয় পর্ব
আন্না কারেনিনা - তৃতীয় পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - চতুর্থ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - পঞ্চম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - ষষ্ঠ পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - সপ্তম পৰ্ব
আন্না কারেনিনা - অষ্টম পৰ্ব
1 of 2

আন্না কারেনিনা – ৬.১

এক

ছেলেমেয়েদের নিয়ে দারিয়া আলেক্‌সান্দ্রভনা গ্রীষ্মটা কাটালেন বোন কিটি লেভিনার কাছে, পত্রোভ্স্কয়েতে। তাঁর নিজের মহালের বাড়িটা একেবারে ভেঙে পড়ছিল, লেভিন এবং তাঁর স্ত্রী তাঁকে বোঝান গ্রীষ্মটা তাঁদের ওখানেই কাটাতে। অব্‌লোন্‌স্কি খুবই অনুমোদন করেন ব্যবস্থাটা। বললেন যে, গরম কালটা সপরিবারে গ্রামে কাটাতে বাধা দিচ্ছে তাঁর কাজ, এটা তাঁর পক্ষে অতীব সুখের ব্যাপার হত। মস্কোয় থেকে তিনি মাঝে মধ্যে গ্রামে আসতেন দিন দুয়েকের জন্য। সমস্ত সন্তান ও গৃহশিক্ষিকাকে নিয়ে ডল্লি ছাড়াও লেভিনদের ওখানে আসেন বৃদ্ধা প্রিন্স-মহিষী, অনভিজ্ঞা গর্ভবতী কন্যার দেখাশুনা করা নিজের কর্তব্য বলে জ্ঞান করেছিলেন তিনি। তা ছাড়া বিদেশে কিটির সখ্য হয়েছিল ভারেঙ্কার সাথে, সে কথা দিয়েছিল যে কিটির বিয়ে হলে সে আসবে তার কাছে, সেটা সে পালন করে এল বান্ধবী সকাশে। সবাই এরা লেভিনের স্ত্রীর আত্মপরিজন। আর তাঁদের সবাইকে লেভিন পছন্দ করলেও লেভিনীয় জগৎ ও ব্যবস্থাটার জন্য তাঁর খানিকটা দুঃখ হত, যা তাঁর ভাষায় ‘শ্যেরবাৎস্কি’ উপাদানের এই প্লাবনে ভেসে গেছে। এ গ্রীষ্মে নিজের আত্মীয় বলতে এসেছিলেন সৎ-ভাই সের্গেই ইভানোভিচ, তবে তিনিও লেভিনীয় নয়, কজ্‌নিশেভ বংশের লোক, ফলে লেভিনীয় আমেজ উবে গিয়েছিল একেবারেই।

বহুদিন খালি পড়ে থাকা লেভিনের বাড়িটা লোকে এমন ভরে উঠল যে প্রায় কোনো ঘরই আর খালি রইল না। আর প্রায় প্রতিদিন খাবার টেবিলে বসে বৃদ্ধা প্রিন্স-মহিষীকে লোক গুণতে হত, আর যে নাতি বা নাতনিটি অশুভ তের নম্বরে পড়তো, তাকে বসাতেন আলাদা ছোট একটা টেবিলে। সংসার চালাবার খুবই চেষ্টা ছিল কিটির, কিন্তু অতিথি ও শিশুদের গ্রীষ্মকালীন খিদে মেটাবার জন্য হাঁস, মুরগি সংগ্রহে তারও ঝামেলা হত কম নয়।

সবাই খেতে বসেছিল। ডল্লির ছেলেমেয়ে, গৃহশিক্ষিকা এবং ভারেঙ্কা পরিকল্পনা ফাঁদছিল ব্যাঙের ছাতা তোলার জন্য কোথাও যাওয়া সবচেয়ে ভালো। বিদ্যা-বুদ্ধির জন্য সমস্ত অতিথিদের মধ্যে কজ্‌নিশেভের সম্মান ছিল প্রায় ভক্তির সমতুল্য, সবাইকে অবাক করে দিয়ে তিনি যোগ দিলেন ব্যাঙের ছাতার আলোচনায়।

ভারেঙ্কার দিকে তাকিয়ে তিনি বললেন, ‘আমাকেও সাথে নাও। ব্যাঙের ছাতা খুঁজতে বড় ভালোবাসি আমি। ওটা আমার কাছে বেশ আকর্ষণীয় একটা কাজ বলে মনে হয়।’

‘বেশ তো, খুব আনন্দের কথা’, ভারেঙ্কা বলল লাল হয়ে। কিটি আর ডল্লি অর্থপূর্ণ দৃষ্টি বিনিময় করলেন। ইদানীং কিটি যে অনুমান নিয়ে খুব মেতে উঠেছিল, ভারেঙ্কার সাথে ব্যাঙের ছাতা তুলতে যাবার জন্য বিদ্বান বুদ্ধিমান কজ্‌নিশেভের প্রস্তাবে সমর্থিত হল সেটা। মায়ের সাথে সে তাড়াতাড়ি কথা শুরু করলে যাতে তার চাউনি চোখে না পড়ে। খাবার পর তাঁর কফির কাপ নিয়ে কজ্‌নিশেভ বসলেন ড্রয়িং-রুমের জানলার কাছে, ভাইয়ের সাথে যে আলাপটা শুরু করেছিলেন সেটা চালিয়ে যেতে যেতে তাকাচ্ছিলেন দরজার দিকে, যেখান দিয়ে ব্যাঙের ছাতা সংগ্রহে বেরোবে ছেলেমেয়েরা। ভাইয়ের কাছে জানালায় বসলেন লেভিন।

স্বামীর কাছে দাঁড়িয়ে ছিল কিটি, যে আলাপটা তার কাছে আকর্ষণহীন, স্পষ্টতই শেষ হবার পর স্বামীকে কিছু- একটা বলবার জন্য।

‘বিয়ের পর তুই অনেক বদলে গেছিস আর সেটা ভালোই’, কিটির দিকে চেয়ে হেসে এবং স্পষ্টতই শুরু করা কথাবার্তাটায় বিশেষ আগ্রহ না রেখে বললেন কজ্‌নিশেভ, ‘তবে অতি কিম্ভুত সব মতামত আঁকড়ে থাকার নেশা তোর যায়নি।’

‘কাতিয়া, দাঁড়িয়ে থাকা তোমার পক্ষে ভালো নয়’, তার দিকে একটা চেয়ার এগিয়ে দিয়ে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে বললেন লেভিন।

‘তবে সময় হয়ে গেছে’, ছুটন্ত ছেলেমেয়েদের দেখে বললেন কজ্‌নিশেভ।

সবচেয়ে আগে তাঁর কাছে ছুটে এল টান-টান মোজা পায়ে পাশকে ভঙ্গিতে লাফাতে লাফাতে তানিয়া, ব্যাঙের ছাতা তোলার ঝুড়ি আর কজ্‌নিশেভের টুপি দোলাতে, দোলাতে।

অসংকোচে তাঁর কাছে গিয়ে, পিতার চমৎকার চোখজোড়ার মত তার দুটো চোখ জ্বলজ্বল করে সে সের্গেই ইভানোভিচকে তাঁর টুপি দিয়ে ভীরু ভীরু কোমল হাসিতে তার ঔদ্ধত্য নরম করে এনে বেশ বুঝিয়ে দিলে যে টুপিটা সে তাঁকে পরাতে চায়।

সের্গেই ইভানোভিচের হাসি দেখে সে বুঝলে যে ওটা সম্ভব। সন্তর্পণে টুপিটা পরিয়ে দিয়ে সে বলল, ‘ভারেঙ্কা অপেক্ষা করছে।’

মাথায় সাদা রুমাল বেঁধে হলুদ একটি সুতি ফ্রকে ভারেঙ্কা দাঁড়িয়ে ছিল দরজার কাছে।

‘আসছি, আসছি ভারভারা আন্দ্রেয়েভনা’, কফি শেষ করে ভিন্ন ভিন্ন পকেটে রুমাল আর সিগারেট কেস রেখে বললেন কজ্‌নিশেভ।

‘কি ভালো আমাদের ভারেঙ্কা, তাই না?’ কজ্‌নিশেভ উঠে দাঁড়াতেই কিটি বলল স্বামীকে। বলল এমনভাবে যাতে কজ্‌নিশেভ কথাটা শুনতে পান এবং বোঝাই যায় যে সেটাই চাইছিল কিটি। ‘আর কি সুন্দরী, মর্যাদাময় সৌন্দর্য! ভারেঙ্কা!’ চেঁচিয়ে ডাকলে কিটি, ‘তোমরা কলের বনে যাবে? আমরা সঙ্গ ধরব তোমাদের।’

তুই তোর অবস্থাটা একেবারে বুলে যাস কিটি’, তাড়াতাড়ি দরজা দিয়ে বেরিয়ে বললেন বৃদ্ধা প্রিন্স-মহিষী, ‘অমন চিৎকার করা উচিত নয়।’

কিটির ডাক আর মায়ের তিরস্কার শুনে ভারেঙ্কা দ্রুত লঘু পদক্ষেপে গেল কিটির কাছে। তার গতিভঙ্গির দ্রুততা, সজীব মুখমণ্ডলের রক্তিমা—সব থেকেই বোঝা যাচ্ছিল তার মধ্যে অসাধারণ কিছু এককটা ঘটছে। সে অসাধারণটা কি, কিটি তা জানতো এবং মনোযোগ দিয়ে তাকে সে লক্ষ করছিল। ভারেঙ্কাকে সে ডাকল কেবল কিটির ধারণায় আজ ডিনারের পরে বনে যে গুরুত্বপূর্ণ ব্যাপারটা ঘটার কথা, তার জন্য মনে মনে তাকে আশীর্বাদ জানাবার উদ্দেশ্য।

তাকে চুমু খেয়ে ফিসফিসিয়ে সে বলল, ‘ভারেঙ্কা, একটা ব্যাপার ঘটলে আমি খুবই সুখী হব।’

‘আর আপনি আমাদের সাথে আসছেন তো?’ যে কথাটা তাকে বলা হল, সেটা যেন তার কানে যায়নি এমনকি ভাব করে বিব্রত হয়ে ভারেঙ্কা জিজ্ঞেস করলে লেভিনকে।

‘আমি যাব, তবে মাড়াই তলা পর্যন্ত। সেখানেই থেকে যাব।’

‘কি তোমার এত গরজ পড়ল?’ বলল কিটি।

নতুন গাড়িগুলো দেখতে আর হিসাব করতে হবে’, লেভিন বলল, ‘আর তুমি থাকবে কোথায়?’

‘খোলা বারান্দায়।’

দুই

সমস্ত নারীই জুটেছিলেন বারান্দায়। সাধারণতই খাবার পর সেখানে বসে থাকতে তাঁরা ভালোবাসতেন, কিন্তু আজ আরো একটা ব্যাপার ছিল। বাচ্চার ফতুয়া সেলাই আর কম্বল বোনার যে কাজে সবাই ব্যস্ত থাকত, তা ছাড়াও আজ সেখানে জ্যাম বানানো হচ্ছিল আগাফিয়া মিখাইলোভনার কাছে নতুন এক পদ্ধতিতে, বিনা পানিতে। নতুন এই পদ্ধতিটা কিটি চালু করেছে, যা চলে তাঁদের বাড়িতে। এ ব্যাপারটার ভার আগে ছিল আগাফিয়া মিখাইলোভনার, যাঁর বিশ্বাস ছিল যে লেভিনদের সংসারে যা হবে তা কখনো খারাপ হতে পারে না; স্ট্রবেরি জ্যামে তিনি তাহলেও পানি দিয়েছিলেন এই দৃঢ় মত নিয়ে যে জিনিসটা অন্য কোন ভাবে হতে পারে না। তাতে তিনি ধরা পড়ে যান এবং এখন সবার সমক্ষে তৈরি হচ্ছে র্যাম্পিের জ্যাম, আগাফিয়া মিখাইলোভনাকে বোঝাতে হবে যে পানি ছাড়াও জ্যাম হতে পারে ভালো।

রাঙা আর রাগান্বিত মুখে, এলোমেলো চুলে, কনুই অবধি অনাবৃত হাতে চুলার ওপর বৃত্তাকারে গামলা ঘোরাচ্ছিলেন আগাফিয়া মিখাইলোভনা আর বিষণ্ণ দৃষ্টিতে র‍্যাম্পবেরিগুলোর দিকে তাকিয়ে সর্বান্তঃকরণে চাইছিলেন যেন তা সিদ্ধ না হয়ে জমে যায়। র‍্যাম্পবেরি জ্যাম বানানোয় নিজেকে প্রধান উপদেষ্টা গণ্য করে প্রিন্স-মহিষী আগাফিয়া মিখাইলোভনার ক্রোধ টের পেয়ে ভাব করেছিলেন যে তিনি অন্য ব্যাপারে ব্যস্ত, র‍্যাম্পবেরির দিকে তাঁর নজর নেই, কথা কইছিলেন অন্য বিষয়ে, কিন্তু আড়চোখে চাইছিলেন চুলার দিকে।

‘আমার চাকরানিদের পোশাকের জন্য সব সময় আমি নিজে শস্তা ছিট কিনে দিই’, যে প্রসঙ্গটা শুরু হয়েছিল তার জের টেনে বলছিলেন তিনি… ‘ফেনা তুলে ফেলার সময় হয়নি কি এখনো?’ আগাফিয়া মিখাইলোভনার উদ্দেশে বললেন তিনি, ‘নিজে তোর এ কাজ করা একেবারে বারণ, খুব গরম’, বললেন কিটিকে।

‘আমি করছি’, বলে ডল্লি উঠে দাঁড়ালেন এবং চিনির ফেনিল ভিয়ানে সাবধানে চামচ নাড়তে লাগলেন, চামচেতে লেগে যাওয়া গাদ ঝাড়ার জন্য ইতিমধ্যেই লাল রঙের সিরাপ চোয়ানো হলুদ-গোলাপি ফেনায় জমে-ওঠা একটা ডিশে চামচটা ঠুকছিলেন। নিজের ছেলেমেয়েদের সম্পর্কে ভাবছিলেন, ‘চায়ের সাথে কি আহ্লাদেই না এটা ওরা খাবে!’ মনে পড়ল তিনি নিজে যখন শিশু ছিলেন তখন সবচেয়ে যেটা ভালো, সেই ফেনাটা বড়রা খায় না দেখে ভারি অবাক লাগল তাঁর।

সেইসাথে লোককে কিভাবে উপহার দেওয়া ভালো, এই চিত্তাকর্ষক প্রসঙ্গটা চালিয়ে ডল্লি বললেন, ‘স্তিভা বলে, টাকা দেওয়া অনেক ভালো, কিন্তু…’

‘টাকা কেন?’ সমস্বরে বলে উঠলেন প্রিন্স-মহিষী ও কিটি, ‘উপহারের কদর করে ওরা।’

‘যেমন আমি গত বছর আমাদের মাত্রেনা সেমিওনোভনার জন্য ঠিক পপলিনের নয়, তবে ঐ ধাঁচের কাপড় কিনে দিয়েছিলাম’, বললেন প্রিন্স-মহিষী।

‘মনে আছে, পোশাকটা সে পরেছিল আপনার জন্মদিনে।’

‘সুন্দর প্যাটার্ন; কি সহজ, অথচ সম্ভ্রান্ত। ওর না হলে আমি নিজেই নিজের জন্য একটা বানাতাম। ভারেঙ্কার ফ্রকের মত কিছু। দেখতে সুন্দর অথচ শস্তা।’

‘এখন মনে হচ্ছে তৈরি’, চামচ থেকে সিরাপ ফেলতে ফেলতে ডল্লি বললেন।

‘যখন গুটি বেঁধে যাবে, তখন। আরো একটা জ্বালে রাখুনে আগাফিয়া মিখাইলোভনা।’

‘জ্বালালে এই মাছিগুলো!’ রেগে বললেন আগফিয়া মিখাইলোভনা। ‘দাঁড়াবে ঐ একই’, যোগ দিলেন তিনি। ‘আহ্, কি সুন্দর, তাড়া দেবেন না ওকে’, রেলিঙের ওপর বসে বোঁটা উলটে র‍্যাম্পবেরি ঠোকরাচ্ছিল একটা চড়াই, সেটা দেখে হঠাৎ বলে উঠল কিটি।

‘হ্যাঁ, তবে তুই সরে আয় চুলার কাছ থেকে’, মা বললেন।

‘ভালো কথা ভারেঙ্কার ব্যাপারে’, কিটি ফরাসি ভাষায় বলল যা তাঁরা অনবরত বলছিলেন যাতে আগাফিয়া মিখাইলোভনা বুঝতে না পারেন। ‘জানেন মা, কেন জানি আজ একটা সিদ্ধান্ত হয়ে যাবে বলে আমি আশা করছি। আপনি বুঝতে পারছেন কি। কি ভালোই না হয় তাহলে!’

‘ওস্তাদ ঘটকী বটে!’ ডল্লি বললেন, ‘কি সাবধানে আর কায়দা করে ও মেলাচ্ছে ওঁদের…

‘না, আপনি বলুন মা, আপনি কি ভাবছেন?’

‘ভাববার কি আছে? উনি’ (বলাই বাহুল্য উনি মানে সের্গেই ইভানোভিচ কজনিশেভ) সব সময়ই রাশিয়ায় সবচেয়ে কাম্য পাত্র হতে পারতেন; এখন অবশ্য বয়স হয়েছে, তাহলেও আমি জানি, এখনো অনেকেই ওকে বিয়ে করতে রাজি থাকবে… এ মেয়েটার দয়ামায়া আছে, কিন্তু উনি হয়ত,

‘না, আপনি বুঝে দেখুন মা, কেন ওঁদের দুজনের পক্ষেই এর চেয়ে ভালো কিছু আর হয় না। প্রথমত, ভারেঙ্কা অপূর্ব মেয়ে! কিটি বলল তার একটা আঙুল গুটিয়ে

‘উনি যে ভারেঙ্কাকে খুবই পছন্দ করছেন, তা ঠিক’, সমর্থন করলেন ডল্লি।

‘তারপর, সমাজে ওঁর এমন প্রতিষ্ঠা যে বৌয়ের সম্পত্তি বা প্রতিষ্ঠা ওর কাছে একেবারে নিষ্প্রয়োজন। শুধু একটা জিনিস ওঁর দরকার—ভালো, শান্তশিষ্ট, মিষ্টি একটি স্ত্রী।

‘হ্যাঁ, ভারেঙ্কার সাথে উনি শান্তিতে থাকতে পারবেন’, সমর্থন করলেন ডল্লি

তৃতীয়ত দরকার স্ত্রী যেন তাকে ভালোবাসে। ভালো সে তো বাসে… বিয়েটা হলে কি ভালোই না হয়। …পথ চেয়ে আছি, ওঁরা যখন বন থেকে ফিরবেন, ঠিকঠাক হয়ে যাবে সব। ওঁদের চোখ দেখেই আমি বুঝে যাব। কি আনন্দই যে হত! তুমি কি মনে করো উল্লি

‘আরে, অস্থির হসনে। অস্থির হওয়া তোর এখন বারণ’, মা বললেন।

‘আমি অস্থির হচ্ছি না মা। আমার মনে হচ্ছে উনি আজ পাণিপ্রার্থনা করবেন।

‘কিভাবে আর কখন যে পুরুষেরা পাণিপ্রার্থনা করে সেটা ভারি অদ্ভুত… প্রথমে কেমন একটা বাধা থাকে, তারপর হঠাৎ তা ভেঙে পড়ে’, অব্‌লোন্‌স্কির সাথে তাঁর অতীতের সম্পর্ক স্মরণ করে চিন্তামগ্ন হাসি হেসে বললেন ডল্লি

হঠাৎ কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘আচ্ছা মা, বাবা আপনার কাছে বিবাহ-প্রস্তাব দিয়েছিলেন কিভাবে?’

‘বিশেষত্ব কিছু ছিল না, নিতান্ত সাধারণ ব্যাপার’, বললেন প্রিন্স-মহিষী, কিন্তু সে ব্যাপারটা মনে পড়ায় মুখ তাঁর জ্বলজ্বল করে উঠল।

‘ছিল না মানে? আপনার কাছে কথাটা পাড়তে দেওয়ার আগে ভালো তো বাসতেন?’

নারী জীবনের প্রধান এসব প্রশ্ন নিয়ে মায়ের সাথে সমানে কথা বলতে পারছে বলে খুবই একটা তৃপ্তি পাচ্ছিল কিটি।

‘ভালোবাসতাম বৈকি। ও এসেছিল আমাদের কাছে, গ্রামে।’

‘কিন্তু কি করে সব স্থির হয়ে গেল মা?’

‘তুই বুঝি ভাবিস তোরা নতুন কিছু-একটা ভেবে বার করেছিস? সবাই একই ব্যাপার : স্থির হয়ে গেল চো দিয়ে, হাসি দিয়ে।’

‘ভারি সত্যি কথা বলেছ মা! ঠিক ঐ চোখ আর হাসি দিয়েই’, সমর্থন কররেন ডল্লি।

‘কিন্তু কি কথা উনি বলেছিলেন?’

‘কস্তিয়া তোকে কি বলেছিল?’

‘সে লিখেছিল খড়ি দিয়ে। আশ্চর্য ব্যাপার!… আমার মনে হচ্ছে সে যেন কত দিন আগে!’ কিটি বলল। তিনজন নারী ভাবতে লাগলেন একই কথা। প্রথম নীরবতা ভঙ্গ করল কিটি। তার মনে পড়ছিল বিয়ের আগের গোটা শীতকালটা আর ভ্রন্‌স্কির জন্য তার আকুলতা।

‘শুধু একটা ব্যাপার… ভারেঙ্কার আগেকার প্রেমটা’, কিটি বলল, চিন্তার স্বাভাবিক যোগসম্পর্কে ব্যাপারটা মনে পড়েছিল তার; ‘সের্গেই ইভানোভিচকে ঘটনাটার কথা বলতে চেয়েছিলাম আমি, তাঁকে তৈরি করে রাখতে। ওরা, সমস্ত পুরুষই’, যোগ দিল কিটি, ‘আমাদের অতীত নিয়ে সাঙ্ঘাতিক ঈর্ষাপরায়ণ।’

‘সবাই নয়’, ডল্লি বললেন, ‘তুই তোর স্বামীকে দিয়ে বিচার করছিস। আজও পর্যন্ত ভ্রন্‌স্কির কথা ভেবে ওর যন্ত্রণা হয়। তাই না? সত্যি?’

‘সত্যি’, চোখে হাসি নিয়ে চিন্তাচ্ছন্নভাবে বলল কিটি।

কন্যার জন্য নিজের জননীসুলভ উদ্বেগ নিয়ে প্রিন্স-মহিষী বললেন, ‘শুধু আমি জানি না তোর কোন অতীতটায় ওর দুশ্চিন্তা হতে পারে। ভ্রন্‌স্কি তোকে প্রেম নিবেদন করেছিল বলে? সমস্ত মেয়ের ক্ষেত্রেই সেটা ঘটে থাকে।’

‘কিন্তু সে নিয়ে আমরা কথা কইছি না’, কিটি বলল লাল হয়ে।

‘না, দাঁড়া’, বলে গেলেন মা, ‘ভ্রন্‌স্কির সাথে আমি কথা বলি, সেটা তুই-ই পরে চাসনি। মনে আছে?’

‘আহ, মা!’ কিটি বলল মুখভাবে যন্ত্রণা নিয়ে।

‘এখন তোদের আর বেঁধে রাখা যায় না…তবে তোর সম্পর্কটা উচিত সীমার বাইরে যেতেই পারেনি; আমি নিজেই ওকে ডেকে পাঠাতাম। কিন্তু তোর বাছা অস্থির হওয়া উচিত নয়। সেটা মনে রেখে শান্ত হ’ তো।’

‘আমি একেবারে শান্ত, মা।’

‘কিটির পক্ষে কি সৌভাগ্যের ব্যাপার হয়েছে যে আন্না এসেছিলেন’, ডল্লি বললেন, ‘আর আন্নার পক্ষে কি দুর্ভাগ্য। একেবারে উল্টোটা’, নিজের ভাবনায় নিজেই বিস্মিত হয়ে যোগ দিলেন ডল্লি, তখন আন্না ছিলেন ভারি সুখী আর কিটি নিজেকে দুর্ভাগা মনে করত। কেমন একেবারে উল্টো! আমি প্রায়ই ভাবি আন্নার কথা।’

‘ভাবনার লেক পেলি বটে! ইতর, জঘন্য, হৃদয়হীন নারী’, বললেন মা, কিটির যে ভ্রন্‌স্কির সাথে বিয়ে হল না, হয়েছে লেভিনের সাথে এটা তিনি ভুলতে পারছিলেন না।

‘এসব কথা বলার কি যে এত সাধ’, বিরক্তিতে বলল কিটি, ‘আমি ও নিয়ে ভাবি না, ভাবতে চাই না … ভাবতে চাই না’, বারান্দার সিঁড়িতে স্বামীর পরিচিত পদশব্দে কান পেতে থেকে পুনরাবৃত্তি করলে সে।

বারান্দায় উঠে লেভিন জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি নিয়ে ঐ ভাবতে চাওয়া হচ্ছে না?’

কেউ জবাব দিলেন না, উনিও প্রশ্নটা করলেন না দ্বিতীয়বার।

‘আপনাদের নারী রাজ্যে অশান্তি ঘটালাম বলে দুঃখ হচ্ছে’, লেভিন বললেন সকলের দিকে অপ্রসন্ন দৃষ্টিপাত করে। তিনি বুঝেছিলেন যে এমন কিছু নিয়ে কথা হচ্ছিল যা তাঁরা বলতে চান না তাঁর সামনে।

র‍্যাম্পবেরি জ্যাম বানানো হচ্ছে বিনা পানিতে, এ নিয়ে, এবং সাধারণভাবে শ্যেরবাৎস্কিদের প্রভাবে আগাফিয়া মিখাইলোভনার অসন্তুষ্টি তিনিও বোধ করলেন মুহূর্তের জন্য। তাহলেও হেসে গেলেন কিটির কাছে।

‘কিছু না। ভালোই, আর তোমার ব্যাপার-স্যাপার?’ জিজ্ঞেস করলে কিটি।

‘সাধারণ গাড়ির চেয়ে তিনগুণ মাল নিচ্ছে ওয়াগনগুলো। তাহলে ছেলেমেয়েদের জন্য যাওয়া হবে নাকি? আমি ঘোড়া জুততে বলেছি।’

‘সে কি, তুমি কিটিকে নিয়ে যেতে চাও বগি-গাড়িতে?’ প্রিন্স-মহিষী বললেন তিরস্কারের সুরে।

‘ঘোড়াগুলোকে যে হাঁটিয়ে নিয়ে যাব, প্রিন্সেস।’

প্রিন্স-মহিষীকে লেভিন কখনো ‘মা’ সম্বোধন করেননি, যা করে থাকে জামাতারা, এটা প্রিন্স-মহিষীর ভালো লাগত না। কিন্তু প্রিন্স-মহিষীর প্রতি তাঁর বেশ ভালোবাসা ও শ্রদ্ধা থাকলেও নিজের প্রয়াতা জননীর প্রতি তাঁর হৃদয়াবেগকে কলুষিত না করে তাঁকে মা বলা সম্ভব ছিল না।

‘মা, আপনিও চলুন আমাদের সাথে’, বলল কিটি

‘এসব অবিবেচনার সাথে সম্পর্ক রাখতে চাই না।’

‘বেশ, তাহলে আমি পায়ে হেটে যাব, সেটা তো আমার পক্ষে ভালো’—এই বলে উঠে দাঁড়িয়ে স্বামীর কাছে গিয়ে কিটি তাঁর হাত ধরলে।

‘ভালো, কিন্তু সবকিছুরই মাত্রা আছে’, বললেন প্রিন্স-মহিষী।

‘কি আগাফিয়া মিখাইলোভনা, জ্যাম তৈরি?’ আগাফিয়া মিখাইলোভনার দিকে চেয়ে হেসে তাঁকে খুশি করার চেষ্টায় লেভিন বললেন, ‘নতুন পদ্ধতিটা ভালো?’

‘ভালো হওয়াই উচিত। তবে আমাদের কাছে কড়া পাক।’

‘সেটাই তো ভালো আগাফিয়া মিখাইলোভনা, টকে যাবে না। আমাদের ঠাণ্ডী ঘরের বরফ গলে গেছে, কোথাও ওগুলো রাখবার জায়গা নেই’, স্বামীর ইচ্ছাটা কি তৎক্ষণাৎ বুঝতে পেরে এবং নিজেও সেই একই ইচ্ছাবশে বৃদ্ধাকে বলল কিটি, ‘তবে আপনার নোনা শবজিগুলো যা, মা বলেন তেমন তিনি খাননি কোথাও’, হেসে বৃদ্ধার মাথার রুমাল ঠিক করে দিয়ে যোগ দিল সে।

আগাফিয়া মিখাইলোভনা কিটির দিকে চাইলেন রাগত দৃষ্টিতে।

‘আমাকে সান্ত্বনা দিতে হবে না গো। আপনাদিগে দুজনাকে একবার দেখলেই আমার আনন্দ’, বললেন উনি আর এই অমার্জিত গ্রাম্য ভাষায় মন গলে গেল কিটির।

সে বলল, ‘চলুন আমাদের সাথে ব্যাঙের ছাতা তুলতে, জায়গাগুলো দেখিয়ে দেবেন।’

আগাফিয়া মিখাইলোভনা হেসে মাথা নাড়লেন, যেন বলতে চান, ‘আপনাদের ওপর রাগ করে সুখ আছে, কিন্তু ওটি হবে না।’

‘আমি যা বলছি তাই করে দেখুন’, বললেন প্রৌঢ়া প্রিন্স-মহিষী। ‘জ্যামের ওপর কাগজ রেখে রাম দিয়ে ভেজান, বরফ না থাকলেও ছাতা পড়বে না।’

তিন

স্বামীর সাথে একা হতে পারার সুযোগ পেয়ে ভারি খুশি হয়েছিল কিটি, কেননা বারান্দায় গিয়ে যখন তিনি জিজ্ঞেস করেছিলেন কি নিয়ে কথা হচ্ছে এবং কেউ জবাব দিলেন না, তখন তাঁর অতি সংবেদনশীল মুখখানায় ক্ষোভের যে একটা ছায়া খেলে গিয়েছিল, সেটা কিটির চোখে পড়েছিল।

পায়ে হেঁটে যখন তাঁরা অন্যদের চেয়ে এগিয়ে গিয়ে ধুলোভরা, রাইয়ের মঞ্জরি আর শস্যদানা ছড়ানো সমতল রাস্তায় উঠলেন, কিটি স্বামীর হাতে ওপর রীতিমত ভর দিয়ে তাঁকে টানলেন নিজের দিকে। মুহূর্তের বিরূপতা লেভিন ভুলে গিয়েছিলেন অনেক আগেই, আর কিটিকে একা পেয়ে এখন, তার অন্তঃসত্ত্বা অবস্থা নিয়ে ভাবনা মুহূর্তের জন্যও যাচ্ছিল না মন যখন তখন তিনি অনুভব করলেন প্রিয়তমা নারীর সাথে সান্নিধ্যের একেবারে কামগন্ধহীন, তাঁর পক্ষে নতুন, আনন্দময় একটা উপভোগ। বলবার কিছু ছিল না, কিন্তু তিনি শুনতে চাইছিলেন কিটির কণ্ঠস্বর, গর্ভবতী অবস্থায় যা এখন তার দৃষ্টির মতই বদলে গিয়েছে। যেমন তার চাউনিতে, তেমনি তার গলার স্বরে ছিল এমন একটা কোমলতা আর গভীরতা যা অনেকটা শুধু নিজের প্রিয় বিষয়ে মগ্ন লোকদের মধ্যে দেখা যায়।

‘হয়রান হয়ে পড়বে না তো? আমার ওপর আরো বেশি ভর দাও’, কিটিকে বললেন লেভিন।

‘না, তোমার সাথে শুধু একা থাকতে পেয়ে কি যে আনন্দ হচ্ছে; ওঁদের সঙ্গ আমার যতই ভালো লাগুক, বলতে

বাধা নেই যে আমাদের দুজনকার একসাথে শীতের সন্ধ্যাগুলোর কথা ভেবে মন কেমন করে।’

‘সেটাও ভালো ছিল, এটাও আরো ভালো। দুই-ই ভালো’, লেভিন বললেন তার হাতে চাপ দিয়ে।

‘তুমি যখন এলে তখন কি নিয়ে কথা বলছিলাম জানো?’

‘জ্যাম নিয়ে?’

‘হ্যাঁ, জ্যাম নিয়েও; কিন্তু তারপর লোকে পাণিপ্রার্থনা করে কিভাবে তাই নিয়ে।’

‘অ’, লেভিন বললেন বটে, তবে কিটির কথাগুলো শোনার চেয়ে বেশি শুনছিলেন তার কণ্ঠস্বর, যে পথটা এখন বনের দিকে গেছে, অনবরত ভাবছিলেন সেটা নিয়ে, যেসব জায়গায় কিটির বেঠিক পা ফেলা সম্ভব, এড়িয়ে যাচ্ছিলেন সেগুলো।

‘তা ছাড়া সের্গেই ইভানিচ আর ভারেঙ্কা সম্পর্কেও। তুমি খেয়াল করেছ?… আমি এটা খুবই চাই’, বলে চলল কিটি, ‘কি তুমি ভাবছ এ ব্যাপারে?’ লেভিনের মুখের দিকে চাইলে সে।

‘কি ভাবা যায় জানি না’, হেসে জবাব দিলেন লেভিন, ‘এদিক থেকে সের্গেইকে আমার ভারি অদ্ভূত লাগে। আমি তো তোমাকে বলেছি যে…’

‘হ্যাঁ, একটি মেয়েকে তিনি ভালোবাসতেন যে মারা গেছে…’

‘ঘটনাটা ঘটে যখন আমি বাচ্চা। ব্যাপারটা শুনেছি লোকের মুখে। ওঁকে তখন যা দেখেছি মনে আছে। আশ্চর্য সুন্দর লোক ছিলেন তিনি তখন। সেই থেকে নারী সাহচর্যে আমি তাঁকে লক্ষ করে দেখেছি; তাদের প্রতি তিনি ছিলেন সৌজন্যশীল, কাউকে কাউকে তাঁর ভালোও লাগত, কিন্তু আমি টের পেতাম, ওঁর কাছে ওরা নারী নয়, স্রেফ লোক।’

‘হ্যাঁ, কিন্তু এখন ভারেঙ্কার বেলায়… মনে হয় কিছু-একটা আছে…’

‘হয়ত আছে… কিন্তু ওঁকে জানা দরকার… উনি আলাদা ধরনের এক আশ্চর্য মানুষ। উনি বাস করেন শুধু মননের জগতে। বড় বেশি উনি নির্মল আর উন্নত প্রাণের লোক।’

‘তার মানে? এতে ওঁর মানহানি হবে?’

‘তা নয়, কিন্তু মননের জগৎ নিয়ে থাকতে তিনি এত অভ্যস্ত যে সাংসারিক ব্যাপার মেনে নিতে তিনি পারবেন না, আর ভারেঙ্কা যতই হোক, সাংসারিক জীব।’

যথাযথ ভাষায় মুড়ে নিজের বক্তব্য প্রকাশ করার কষ্ট না নিয়ে লেভিন এখন তা স্পষ্টাস্পষ্টি বলে দিতে অভ্যস্ত হয়ে উঠেছেন, তিনি জানতেন যে এখনকার মত ভালোবাসায় নিবিড় এই মুহূর্তে কি তিনি বলতে ছাইছিলেন কিটি সেটা বুঝবে ইঙ্গিতেই, এবং সে বুঝলও

‘হ্যাঁ, কিন্তু আমার মত এই সাংসারিকতাটা ভারেঙ্কার মধ্যে নেই; আমি বুঝি যে আমাকে উনি ভালোবাসতে পারতেন না কখনো। কিন্তু ভারেঙ্কার সবটাই ঊর্ধ্ব জগতের…’

‘আরে না, তোমার উনি ভালোবাসেন আর আমার আত্মীয়স্বজনেরা যে তোমাকে ভালোবাসেন সেটা ভারি ভালো লাগে আমার…’

‘আমার প্রতি তিনি প্রসন্ন, কিন্তু…’

‘কিন্তু প্রয়াত নিকোলাইয়ের মত নন, তোমাদের দুজন দুজনকে ভালো লেগেছিল’, বাক্যটা শেষ করলেন লেভিন, ‘সেটা না বলবার কি আছে?’ যোগ করলেন তিনি, ‘মাঝে মাঝে নিজেকে আমি ভর্ৎসনা করি : পরিণামে ভুলে যাব। কি সাংঘাতিক অথচ চমৎকার মানুষ ছিলেন… ও, হ্যাঁ, কি নিয়ে কথা কইছিলাম আমরা?’ কিছুক্ষণ চুপ করে থেকে লেভিন বললেন।

তুমি ভাবছ যে উনি প্রেমে পড়তে পারেন না’, নিজের মত করে ব্যাপারটাকে রাখল কিটি 1

‘প্রেমে পড়তে পারেন না এমন নয়’, হেসে লেভিন বললেন, ‘কিন্তু এর জন্য যে দুর্বলতাটুকু প্রয়োজন, সেটা ওঁর নেই…সব সময় আমি হিংসে করেছি ওঁকে, আর এখন আমি সুখী হলেও হিংসে করি।’

‘হিংসে করো উনি ভালোবাসতো পারেন না বলে?‘

‘হিংসে হয় কেননা আমার চেয়ে উনি ভালো’, হেসে বললেন লেভিন, ‘উনি বেঁচে থাকেন নিজের জন্য নয়। জীবন তাঁর কর্তব্য পালনের নিবেদিত। তাই তিনি সৌম্য আর সন্তুষ্ট থাকতে পারেন।’

‘আর তুমি?’ উপহাস আর ভালোবাসার হাসি নিয়ে কিটি বলল।

চিন্তার যে ধারাটা কিটির মুখে হাসি ফুটিয়েছিল, সেটা সে প্রকাশ করে বলতে পারত না কিছুতেই; কিন্তু তার শেষ কথাটা হল এই যে স্বামী তাঁর ভাইয়ের কথায় উচ্ছ্বসিত হয়ে ও নিজেকে হীন করে কপটতা করছেন। সে জানতো যে এই কপটতাটা আসছে বড় ভাইয়ের প্রতি তাঁর ভালোবাসা থেকে, নিজের বড় বেশি সুখের জন্য বিবেক দংশন আর নিজে ক্রমাগত ভালো হয়ে ওঠার অবিরত বাসনা থেকে। ওঁর ভেতরকার এই জিনিসটা কিটির ভালো লাগত তাই সে হাসলে।

সেই একই হাসি নিয়ে সে জিজ্ঞেস করল, ‘আর তুমি? কিসে তোমার অসন্তোষ?’

নিজের ওপর তাঁর অসন্তোষে কিটির অবিশ্বাস খুশি করল লেভিনকে আর তার এই অবিশ্বাসের কারণটা যাতে সে বলে, অজ্ঞাতসারে সেই দিকে কিটিকে ঠেলা দিলেন লেভিন।

বলল, ‘আমি সুখী, কিন্তু নিজের ওপর অসন্তুষ্ট।‘

‘সুখী হলে অসন্তুষ্ট হতে পারো কি করে?’

মানে কি করে তোমাকে বোঝাই? যেমন মনে প্রাণে আমি এখন চাইছি শুধু তুমি যেন হোঁচট না খাও। আহ্, অমন করে লাফাতে হয় কখনো!’ হাঁটা পথটায় পড়ে থাকা একটা ডাল ডিঙতে গিয়ে বড় বেশি তাড়াহুড়ো করায় কিটিকে বকুনি দেবার জন্য তিনি থেমে গেলেন নিজের কথায়। কিন্তু যখন আমি নিজেকে বিচার করি, তুলনা করি অন্যদের বিশেষ করে বড় ভাইয়ের সাথে, তখন বেশ বুঝি যে আমি ভালো নেই।

‘কিসে খারাপ?’ একই হাসি নিয়ে বলে গেল কিটি, তুমিও কি অন্যদের জন্যে কাজ করো না? চাষীদের বিলি করা জমি, তোমার নিজের কৃষি কাজ, তোমার বই, এ সব কি তবে?…’

‘না, আমি এটা অনুভব করছি এবং আরও বেশি করে এখন : ও সব যে ঠিক তেমন নয়, কিটির হাতে চাপ দিয়ে বলল তিনি, ‘তার জন্য দায়ী তুমি। এ আমি করি এমনি, ওপর-ওপর। তোমাকে যেমন ভালোবাসি এ সব কাজকে যদি তেমনি ভালোবাসতে পারতাম… ইদানীং আমি এ সব করছি যেন স্কুলের হোমটাস্ক।‘

কিটি জিজ্ঞেস করল, ‘তাহলে বাবাকে কি তুমি বলবে? উনি খারাপ কারণ সাধারণের জন্য কিছুই তিনি করেননি?’

‘উনি? না, উনি নন। তোমার বাবার মত সহজ-সরলতা, স্বচ্ছতা, সহৃদয়তা থাকা দরকার, সেটা কি আমার আছে? আমি কিছু করছি না আর কষ্ট পাচ্ছি সে জন্য। এটা তুমি ঘটিয়েছ। যখন তুমি ছিলে না আর ছিল না এটি’, কিটির উদরের দিকে দৃষ্টিপাত করে তিনি বললেন এবং ইঙ্গিতটা কিটি বুঝল, তখন কাজে আমার সমস্ত শক্তি আমি ঢেলে দিয়েছিলাম; কিন্তু এখন তা আর পারছি না অথচ বিবেকে বিঁধছে। আমি এ সব করি ঠিক হোমটাস্ক করার মত, ভান করি…’

‘তা এখন তোমার জায়গা বদল করতে চাও কি কজ্‌নিশেভের সাথে?’ কিটি শুধাল, চাও কি সাধারণের জন্য কাজ করতে আর শুধু ওই হোমটাস্কটাকে ওঁর মত ভালোবাসতে, বাস?’

‘অবশ্যই নয়’, লেভিন বললেন, ‘তবে আমি এত সুখী যে জ্ঞানগম্যি আর কিছু নেই। আচ্ছা, তুমি সত্যিই ভাবছ যে উনি আজ পাণিপ্রার্থনা করবেন?’ একটু চুপ করে থেকে যোগ দিলেন উনি।

‘ভাবছিও বটে, আবার ভাবছিও না। শুধু ওটা চাইছি ভয়ানক। দাঁড়াও, দাঁড়াও’, নিচু হয়ে পথের পাশে গজানো বুনো একটা ডেইজি ফুল তুলল সে, ‘এবার পাপড়িগুলো পর পর গুণে যাও : পাণিপ্রার্থনা করবেন, কি করবেন না, করবেন, কি করবেন না’, ফুলটা দিয়ে কিটি বলল।

লম্বা, সাদা পাপড়িগুলো ছিঁড়তে ছিঁড়তে লেভিন বলে চললেন, ‘করবেন, করবেন না… ‘

‘উঁহু, উঁহু, হল না’, উদ্‌দ্গ্রীব হয়ে লেভিনের আঙুল লক্ষ করছিল কিটি, হাত ধরে তাঁকে থামিয়ে সে বলে উঠল, ‘এক বার দুটো পাপড়ি ছিঁড়ে ফেলেছ তুমি।’

‘তাতে কি, এই ছোটটা তো আর ধর্তব্য ছিল না’, পুরো বেড়ে না-ওঠা একটা পাপড়ি ছিঁড়ে লেভিন বললেন, ‘এই তো আমাদের বগিগাড়ি এসে গেছে।’

‘ক্লান্ত হোসনি, কিটি?’ গাড়ি থেকে চেঁচিয়ে জিজ্ঞেস করলেন প্রিন্স-মহিষী।

‘একটুও না।’

‘নইলে গাড়িতে উঠতে পারিস, ঘোড়াগুলো যদি শান্তভাবে এক-পা করে চলে।’

কিন্তু গাড়িতে উঠতে হল না। কাছাকাছি এসে পড়েছিল জায়গাটা, তাই সবাই চলল পায়ে হেঁটে।

চার

ভারেঙ্কার কালো চুল সাদা রুমালে বাঁধা। ছেলেমেয়ের দল ঘিরে ধরেছে তাকে, তাদের নিয়ে সে বেশ আনন্দ করেই ব্যস্ত আর যে পুরুষটিকে তার ভালো লাগে তাঁর কাছ থেকে প্রেম নিবেদন শোনার সম্ভাবনায় স্পষ্টতই আন্দোলিত। অতি আকর্ষণীয় লাগছিল তাকে। কজ্‌নিশেভ হাঁটলেন তার পাশে পাশে আর মুগ্ধ হয়ে দেখছিলেন তাকে। তার দিকে তাকিয়ে তাঁর মনে পড়ছিল কত মধুর কথা তিনি শুনেছেন ভারেঙ্কার কাছ থেকে, তার সম্পর্কে কত ভালো ভালো জিনিস জানতে পেরেছেন তিনি আর ক্রমেই টের পাচ্ছিলেন যে তার প্রতি যে হৃদয়াবেগ তিনি বোধ করছেন সেটা কেমন যেন বিশেষ রকমের, তেমনটা বহুকাল তাঁর হয়নি, যা হয়েছিল তাও শুধু একবার, তাঁর প্রথম যৌবনে 1 তার কাছাকাছি থাকার আনন্দটা ক্রমেই বেড়ে উঠে এমন স্তরে পৌঁছল যে সরু ডাঁটির ওপর কিনারা মেলে দেওয়া যে বার্চ ব্যাঙের ছাতাটি তিনি পেয়েছিলেন সেটি ভারেঙ্কার ঝুড়িতে দেবার সময় তিনি তার চোখের দিকেই চাইলেন আর তার মুখ ছেয়ে দেওয়া পুলকিত ও ত্রস্ত উত্তেজনার লালিমা লক্ষ করে নিজেই তিনি হকচকিত হয়ে নীরবে হাসলেন বড় বেশি মুখর হাসিতে।

‘তাই যদি হয়, তাহলে আমাকে ভেবে দেখে সিদ্ধান্ত নিতে হবে’, নিজেকে বললেন তিনি, ‘বালকের মত ক্ষণিকের মোহে গা ভাসালে চলবে না।’

‘এবার কারও অপেক্ষা না রেখে চলে যাচ্ছি ব্যাঙের ছাতা তুলতে, নইলে আমার জোগান হয়ে থাকছে অকিঞ্চিৎকর’, এই বলে বনের যে কিনারায় বুড়ো বুড়ো বিরল বার্চ গাছগুলোর মাঝে রেসম-চিকন ছোট ছোট ঘাসের ওপর তাঁরা হাঁটছিলেন, সেখান থেকে তিনি চলে গেলেন বনের গভীরে, যেখানে বার্চ গাছের সাদা সাদা গুঁড়ির মাঝে মাঝে অ্যাম্পেন গাছের ধূসর গুঁড়ি আর হ্যাজেলের কালো ঝোঁপ দেখা যাচ্ছিল। চিল্ল পা সরে গিয়ে গোলাপি-লাল মঞ্জরি ঝোলানো স্পিণ্ডল-বুশ ঝেপের পেছনে কজ্‌নিশেভ থামলেন। জানতেন সেখানে তাঁকে কেউ দেখতে পাবে না। চারিদিক একেবারে স্তব্ধ। শুধু যে বার্চ গাছগুলোর তলে তিনি ছিলেন তাদের ডগায় একঝাঁক মৌমাছির মত ভন ভন করছিল মাছি আর মাঝে মাঝে ভেসে আসছিল ছেলেমেয়েদের কণ্ঠস্বর। হঠাৎ বনপ্রান্তের অদূরে শোনা গেল ভারেঙ্কার খাদের গলা, গ্রিশাকে ডাকছিল সে। কজ্রনিশেভর মুখে ফুটে উঠর আনন্দের হাসি। হাসিটা সম্পর্কে সচেতন হয়ে তিনি মাথা নাড়লেন নিজের এ অবস্থা পছন্দ না করে, চুরুট বার করে ধরাবার চেষ্টা করলেন। বার্চ গাছের কাণ্ডে দেশালাইয়ের কাঠি ঘষে অনেকক্ষণ তিনি তা ধরাতে পারছিলেন না। বার্চের সাদা বাকলের ওপরকার নরম ঝিল্লি ফসফোরে জড়িত গিয়ে আগুন নিবিয়ে দিচ্ছিল। অবশেষে একটা কাটি জ্বলল আর বার্চের ঝুলন্ত ডালের তলেকার ঝোপটার ওপরে ও সামনে দোলায়মান চাদরের মত বিছিয়ে গেল চুরুটের গন্ধী ধোঁয়া। ধোঁয়াটা লক্ষ করে নিজের অবস্থা সম্পর্কে ভাবতে ভাবতে তিনি চুপচাপ হাঁটতে লাগলেন।

তিনি ভাবছিলেন, ‘কেনই বা নয়? এটা যদি হত শুধুই একটা দমকা ভাবাবেগ কিংবা যৌনকামনা, যদি আমি এই আকর্ষণটা, এই পারস্পরিক আকর্ষণটা (পারস্পরিকই বলতে পারি আমি) বোধ করতাম, অথচ টের পেতাম যে তা আমার সমস্ত জীবনধারার বিরুদ্ধে যাচ্ছে, এই আকর্ষণে আত্মসমর্পণ করে যদি আমি অনুভব করতাম যে আমার সাধনা ও কর্তব্যের প্রতি বিশ্বাসঘাতকতা করছি… কিন্তু সে তো নয়। এর বিরুদ্ধে শুধু একটা যে কথা আমি বলতে পারি সেটা এই যে মেরিকে হারিয়ে আমি মনে মনে বলেছিলাম যে তার স্মৃতির প্রতি বিশ্বস্ত থাকব। নিজের হৃদয়াবেগের বিরুদ্ধে শুধু এই কথাটাই বলতে পারি… এটা গুরুত্বপূর্ণ।’ কজ্‌নিশেভ ভাবলেন গুরুত্বপূর্ণ, সেইসাথে অনুভব করছিলেন যে ব্যক্তিগতভাবে তাঁর কাছে ওটার কোন গুরুত্ব থাকতে পারে না, যদিও লোকের চোখে তাঁর কাব্যিক মূর্তিটা মাটি হয়ে যেতে পারে। ‘কিন্তু এটা ছাড়া যতই খুঁজি কিছুই পাচ্ছি না আমার হৃদয়াবেগের বিরুদ্ধে। শুধু যুক্তি দিয়ে যদি কাউকে নির্বাচন করি, তাহলে ওর চেয়ে ভালো কাউকে পাব না।’

তাঁর পরিচিত নারী ও কুমারীদের তিনি যতই স্মরণ করে দেখুন, এমন কাউকে তিনি মনে করতে পারলেন না যার মধ্যে নিরাবেগে বিচার করে স্ত্রীর ভেতর যে গুণগুলি দেখতে তিনি চান, তা সব, একেবারে সবই ওর মত এমন মাত্রায় মিলেছে। যৌবনের সমস্ত মাধুর্য ও স্ফূর্তি তার ছিল, কিন্তু কচি খুকি সে নয়। তাঁকে যদি সে ভালোবেসে থাকে, তবে ভালোবেসেছে সজ্ঞানে, নারীর যেভাবে ভালোবাসা উচিত; এই হল এক কথা। দ্বিতীয়ত, উচ্চসমাজী চাল তার ছিল না শুধু তাই নয়, স্পষ্টতই উচ্চ সমাজের প্রতি বিতৃষ্ণাই ছিল তার, অথচ সমাজকে সে জানতো এবং ভালো সমাজের নারীর যোগ্য সবকিছু আচার ব্যবহার ছিল তার, যা ছাড়া জীবনসঙ্গিনী কজ্‌নিশেভের কাছে অকল্পনীয়। তৃতীয়ত, সে ধর্মপ্রাণা, কিন্তু শিশুর মত নির্বিচার ধর্মপরায়ণ আর ভালোমানুষ সে নয়, যেমন ধরা যাক–কিটি, কিন্তু তার জীবন প্রতিষ্ঠিত ধর্মীয় প্রত্যয়ের ওপর। স্ত্রীর কাছে যা তাঁর প্রত্যাশা, এমনকি খুঁটিনাটিতে পর্যন্ত তা সবকিছু কজ্‌নিশেভ দেখতে পেলেন ভারেঙ্কার মধ্যে; সে গরিব, একাকিনী, সুতরাং স্বামীগৃহে সে একরাশ আত্মীয়স্বজন আর তাদের প্রভাব নিয়ে আসবে না যা কিটি করেছে বলে তিনি দেখছেন, বরং সব সময় ঋণী থাকবে স্বামীর কাছে, এটাও নিজের ভবিষ্যৎ পারিবারিক জীবনের জন্য সব সময় তিনি চাইতেন। আর যে মেয়ের মধ্যে এই সমস্ত গুণই মিলেছে সে ভালোবাসে তাঁকে। তিনি মিতদর্শী কিন্তু এটা না দেখে তিনি পারলেন না। আর তিনিও ভালোবাসেন তাকে। বিরুদ্ধে শুধু একটা যুক্তি—তাঁর বয়স। কিন্তু তিনি দীর্ঘজীবী বংশের লোক, একটি চুলও তাঁর পাকে নি, সবাই বলবে তাঁর বয়স চল্লিশও নয়; তাঁর মনে পড়ল, ভারেঙ্কা বলেছিল যে কেবল রাশিয়াতেই লোকে পঞ্চাশ বছরেই বৃদ্ধ মনে করে নিজেকে, অথচ ফ্রান্সে পঞ্চাশবছরী পুরুষ নিজেকে মনে করে, বয়সের প্রভাতগগনে আর চল্লিশবছরী যুবাপুরুষ। কিন্তু কি মানে হয় বয়সের হিসেব করার যখন প্রাণে তিনি তেমনি তাজা যা ছিলেন বিশ বছর আগে? অন্য দিক থেকে বনের কিনারায় আবার ফিরে তীর্যক রোদের আলোয় ঝুড়ি হাতে হলদে পোশাকে, বুড়ো বার্চ গাছের কাছ দিয়ে লঘু পদক্ষেপে এগিয়ে যাওয়া ভারেঙ্কার সুশ্রী মূর্তিটা যখন তিনি দেখেছিলেন, তখন তাঁর যা অনুভূতি, সেটা কি যৌবন নয়? আর ভারেঙ্কার এই ছবিটা যখন একসাথে মিলে যায় বাঁকা রোদে হলুদ হয়ে আসা ওট খেত আর খেতের পরে হলুদ ছিটানো, সুদূরের নীলে মিলিয়ে যাওয়া পুরনো বনের সৌন্দর্যের সাথে যা বিস্মিত করছিল তাঁকে তখন আনন্দে টনটন করে উঠল তাঁর বুক। মন তাঁর গলে গেল। তিনি অনুভব করছিলেন ধে সিদ্ধান্ত হয়ে গেছে। ব্যাঙের ছাতা তোলার জন্য বসে নমনীয় ভঙ্গিতে উঠে ভারেঙ্কা সবে চাইছিল চারিপাশে, চুরুট ছুঁড়ে ফেলে দৃঢ় পদক্ষেপে কজ্‌নিশেভ এগিয়ে গেলেন তার দিকে।

Post a comment

Leave a Comment

Your email address will not be published. Required fields are marked *