পনেরো
লেভিন স্ত্রীকে ওপরতলা পর্যন্ত এগিয়ে দিয়ে ডল্লির কাছে গেলেন। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনারও সেদিন বড় দুঃখ। সারা ঘরে পায়চারি করে কোণে দণ্ডায়মান মেয়েটাকে ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলছিলেন, ‘হ্যাঁ, সারা দিন ঐ কোণেই দাঁড়িয়ে থাকবি। খাবার খাবি একা-একা। তুই একটা পুতুলও পাবি না, নতুন ফ্রকও সেলাই করব না তোর জন্যে’, আরো কি করে শাস্তি দেওয়া যায় ভেবে না পেয়ে তিনি বলছিলেন।
তিনি লেভিনের দিকে ফিরে বললেন, ‘না, এটা একটা লক্ষ্মীছাড়া মেয়ে! এসব বিছ্ছিরি প্রবৃত্তি আসে কোত্থেকে?’
লেভিন বেশ নির্বিকারভাবেই বললেন, ‘কিন্তু সে কি করল?’ তিনি চেয়েছিলেন যে নিজের ব্যাপারটা নিয়ে কিছু পরামর্শ চাইবেন। তাই অসময়ে এসে পড়েছেন বলে বিরক্ত তাঁর লাগছিল।
‘গ্রিশার সাথে ও যায় র্যাম্পবেরি ভুঁইয়ে… আর সেখানে কি যে করেছে তা বলার নয়। মিস এলিয়টকে কতবার মাপ করে দিয়েছি, কিন্তু উনি কিছুই দেখেন না। একটা যন্ত্র …কল্পনা করুন, মেয়েটা…’, দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা এই বলে মাশার অপরাধ বর্ণনা করতে লাগলেন।
লেভিন প্রবোধ দিলেন, ‘এতে কিছুই প্রমাণ হয় না, এটা মোটেই বিছিরি প্রবৃত্তির লক্ষণ নয়। নেহাৎ দুষ্টুমি।’
‘কিন্তু তুমি কেমন যেন মনমরা? কেন এলে বল তো?’ জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি, ‘ওখানে কি হচ্ছে?’
প্রশ্নের ধরনটা দেখে লেভিন বুঝলেন তিনি যা বলতে চাইছিলেন তা বলা সহজ হবে।
আমি ওখানে ছিলাম না, কিটির সাথে বাগানে গিয়েছিলাম। এই দ্বিতীয়বার আমাদের ঝগড়া হুল… যেদিন থেকে স্তিভা এসেছে।
বিজ্ঞ, বোদ্ধার দৃষ্টিতে ডল্লি তাঁর দিকে তাকালেন।
‘কিন্তু বুকে হাত দিয়ে বলো তো…কিটির দিক থেকে নয়, এই ভদ্রলোকটির আচরণে এমন কিছু কি ছিল, যা সম্ভবত স্বামীর কাছে অপ্রীতিকর। না, অপ্রীতিকর নয়। ভয়ংকর, অপমানকর?’
‘কি তোমাকে বলি… যা, দাঁড়িয়ে থাক কোণে!’ মাশাকে ধমকে উঠলেন ডল্লি, মায়ের মুখে সামান্য হাসির লক্ষণ দেখতে পেয়ে সরে যাবার উপক্রম করছিল সে। ‘সমাজের মত হবে সমস্ত যুবাপুরুষ যেভাবে চলে, ও-ও সেভাবে চলছে। সুন্দরী ও যুবতী মেয়েমানুষের পেছন পেছন সে ঘুরঘুর করে এবং বাস্তব বুদ্ধির স্বামীর তাতে গৌরব বোধ করা উচিত।’
‘হ্যাঁ, তা বটে’, লেভিন বিমর্ষ হয়ে বললেন, ‘কিন্তু তুমি লক্ষ করেছিলে?’
‘শুধু আমি নই, স্তিভাও লক্ষ করেছে। চায়ের পর ও আমাকে স্পষ্টই বলে : আমার মনে হয় ভেস্লোভস্কি খুব সহজেই কিটির পেমে পড়ছে।’
লেভিন বললেন, ‘তা বেশ। এবার নিশ্চিন্ত। ওকে আমি ভাগাব।’
‘পাগল হলে নাকি?’ সভয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন ডল্লি, ‘কি বলছ কস্তিয়া, সচেতন হও!’ তিনি হেসে বললেন। ‘নে, এবার ফান্নির কাছে যেতে পারিস’, তিনি মাশাকে অনুমতি দিলেন। ‘না, যদি চাও, আমি স্তিভাকে বলব। তাকে সে সরিয়ে নিয়ে যাবে। বলা চলতে পারে যে, অতিথির অপেক্ষা করছ তুমি। মোটের ওপর ও আমাদের বাড়ির উপযুক্ত নয়।
‘না-না, আমি নিজেই বলব।’
‘ওর সাথে ঝগড়া করবে তো?…’
‘একটুও না। আমার বরং ফুর্তিই লাগবে’, সত্যিই ফুর্তিতে চোখ জ্বলজ্বল করে লেভিন বললেন, ‘নাও ডল্লি, ওকে মাপ করে দাও। ও আর করবে না’, ছোট্ট অপরাধিনীটি সম্পর্কে তিনি বললেন। ফান্নির কাছে না গিয়ে সে অনিশ্চিতের মত দাঁড়িয়ে ছিল মায়ের সামনে। চোরা চোখে খুঁজছিল এবং আশা করছিল মায়ের দৃষ্টিপাত।
মা তাকালেন তার দিকে। মেয়েটা ডুকরে কেঁদে উঠে মুখ গুঁজল মায়ের জানুতে। ডল্লি তার মাথার ওপরে রাখলেন নিজের শীর্ণ নরম হাত।
‘আদপেই কিই-বা মিল আছে ওর সাথে আমাদের?’ এই ভেবে লেভিন খুঁজতে গেলেন ভেস্লোভস্কিকে।
প্রবেশ-কক্ষ দিয়ে যাবার সময় তিনি হুকুম দিলেন স্টেশনে যাবার জন্য গাড়ি ঠিক করতে।
চাকর বলল, কাল একটা স্প্রিং ভেঙে গেছে।’
‘তাহলে তারাত্তাস জুততে বল, কিন্তু জলদি। আমাদের অতিথিটি কোথায়?’
‘উনি নিজের ঘরে গেছেন।’
ভাসেকার কাছে লেভিন যখন গেলেন তখন তিনি স্যুটকেস থেকে জিনিসপত্র বের করে, নতুন রোমান্সগুলো সরিয়ে অশ্বারোহণে যাবার জন্য লেগিংস পরীক্ষা করে দেখছিলেন।
লেভিনের মুখভাবে বিশেষ কিছু-একটা ছিল, নাকি ভাসেকা নিজেই অনুভব করছিলেন যে ‘সামান্য এই ফষ্টিনষ্টি’ যা তিনি শুরু করেছিলেন তা এ পরিবারে বেমানান। সে যাই হোক, লেভিন ঘরে ঢোকায় তিনি খানিকটা (একজন উঁচু সমাজের লোকের পক্ষে যতটা হওয়া সম্ভব) হতবুদ্ধি হয়ে পড়েছিলেন।
‘আপনি লেগিংস পরে ঘোড়ায় চাপেন?’
‘হ্যাঁ, এটা অনেক পরিষ্কার’, চেয়ারের ওপর মোটা একটা পা তুলে দিয়ে নিচের হুকটা আঁটতে আঁটতে ফুর্তিতে ভালোমানুষি হাসি হেসে ভাসেকা বললেন।
তিনি নিঃসন্দেহে সহৃদয় ছোকরা। ওঁর চোখে ভীরুতা লক্ষ করে ওঁর জন্য লেভিনের কষ্ট এবং গৃহকর্তা হিসেবে নিজের জন্য লজ্জা বোধ হল।
টেবিলে একটা লাঠি পড়ে ছিল যেটা আজ সকালের ব্যায়ামে ওজন তুলতে গিয়ে তাঁরা ভেঙেছেন। ভাঙা লাঠিটা নিয়ে তার ডগার ছিল্কাগুলো ভাঙতে লাগলেন, ভেবে পাচ্ছিলেন না শুরু করবেন কিভাবে
‘আমি চাই…’ বলেই তিনি চুপ করে যেতে গিয়েছিলেন, কিন্তু কিটিকে এবং যা কিছু ঘটেছে তা মনে পড়ায় তিনি স্থির দৃষ্টিতে ভাসেকার চোখের দিকে তাকিয়ে বললেন, ‘আপনার জন্যে আমি গাড়ি জুততে বলেছি।’
অবাক হয়ে ভাসেকা শুরু করলেন, ‘তার মানে? আমি কোথায় যাব?’
‘রেল স্টেশনে যাবেন’, মুখ ভার করে, লাঠির ডগায় চিমটি কাটতে কাটতে লেভিন বললেন।
‘আপনারা কোথাও চলে যাচ্ছেন নাকি অথবা কিছু-একটা ঘটেছে?’
‘ঘটেছে এই যে, আমার এখানে অতিথিসমাগম হবে বলে আমি আশা করছি’, বলিষ্ঠ আঙুলে ক্রমেই দ্রুত ছিকা ভাঙতে ভাঙতে লেভিন বললেন; ‘না, অতিথিও কেউ আসবে না, ঘটেনিও কিছুই। কিন্তু অনুরোধ করছি, আপনি চলে যান। আমার অসৌজন্যের যেমন খুশি ব্যাখ্যাকরে নিতে পারেন আপনি।’
ভাসেকা খাড়া হয়ে উঠলেন।
‘আপনাকে অনুরোধ করছি, বুঝিয়ে বলুন…’ শেষ পর্যন্ত ব্যাপারটা বুঝতে পেরে মর্যাদার সাথে তিনি বললেন। ‘আমি আপনাকে বুঝিয়ে বলতে পারব না’, মৃদু স্বরে ধীরে, গণ্ডের কম্পন দমনের চেষ্টা করে লেভিন বললেন, ‘কিছু প্রশ্ন না করলেই ভালো হয়।’
সব ছিল্কাগুলো ভাঙা হয়ে গিয়েছিল বলে লেভিন লাঠির মোটা মোটা প্রান্ত ধরে তা ভেঙে ফেললেন এবং যে খণ্ডটা হাত থেকে পড়ে যাচ্ছিল, সেটা চট করে লুফে নিলেন
নিশ্চয় লেভিনের এই উত্তেজিত, আজ ব্যায়ামাগারে তাঁর যে পেশী ভাসেকা টিপে দেখেছেন তা, ঝকঝকে চোখ, গণ্ডের কম্পমান পেশী দেখে বিনা কথায়ই ভাসেকা নিঃসন্দেহ হয়ে থাকবেন। কাঁধ কুঁচকে ঘৃণাভরে হেসে মাথা নোয়ালেন তিনি।
‘অলোনস্কির সাথে দেখা করা চলে না?’
লেভিন কাঁধ কোঁচকানি আর হাসিটায় চটে ওঠেননি। ভাবলেন, ‘এছাড়া ওর কিই-বা করার আছে?’
‘এখুনি আমি ওকে পাঠিয়ে দিচ্ছি আপনার কাছে।’
বন্ধুকে যে তাড়িয়ে দেওয়া হচ্ছে সেটা তাঁর কাছ থেকে জানতে পেরে এবং লেভিনকে বাগানে পেয়ে, যেখানে তিনি অতিথি চলে যাবার প্রতীক্ষায় পায়চারি করছিলেন, অব্লোন্স্কি বললেন, ‘কি পাগলামি! এসব যে হাস্যকর! কি মাছি কামড়িয়েছে তোমাকে? এটা যে চূড়ান্ত রকমের হাস্যকর! কি তোমার মাথায় ঢুকল যদি একজন যুবক…..
কিন্তু মাছিটা লেভিনের যে জায়গাটায় কামড়িয়েছিল, বোঝা গেল সেটা তখনো টাটাচ্ছিল। কারণ অব্লোন্স্কি যখন ব্যাপারটা বোঝাতে চাইছিলেন তখন আবার বিবর্ণ হয়ে তিনি তাঁকে ঝট করে থামিয়ে দিয়ে বললেন : ‘দোহাই তোমার, বোঝাতে এসো না! আমি অন্য কিছু করতে পারি না! তোমার এবং ওর কাছে আমি খুবই লজ্জিত। কিন্তু আমার ধারণা যে, চলে যেতে হচ্ছে বলে ওর বড় একটা কষ্ট হবে না। কিন্তু আমার এবং আমার স্ত্রীর কাছে ওর উপস্থিতি অসহ্য।’
‘কিন্তু ওকে অপমান করা হয়েছে! আর তাছাড়া এটা হাস্যকর!’
‘আমার পক্ষেও অপমানকর, যন্ত্রণাকর! আমার কোন দোষ নেই। কষ্ট সইতে হবে এমন কোন কারণ নেই আমার।’
‘আমি তোমার কাছ থেকে এটা আশা করিনি! ঈর্ষা হতে পারে, তাই বলে এই মাত্রায়, এটা ভয়ানক হাস্যকর!’ লেভিন দ্রুত ওঁর কাছ থেকে বীথির গভীরে সরে গিয়ে সামনে-পেছনে পায়চারি করে চললেন। অচিরেই তারান্তাসের ঘর্ঘর শব্দ কানে এল তাঁর। গাছের ফাঁক দিয়ে দেখলেন যে ভাসেকা তাঁর স্কচ টুপি পরে খড়ের ওপর বসে (দুঃখের বিষয় গাড়িটায় গদি-আঁটা সীট ছিল না) রাস্তায় ধাক্কা খেয়ে লাফাতে লাফাতে চলে যাচ্ছেন।
‘এ আবার কি?’ বাড়ি থেকে ছুটে বেরিয়ে একটা চাকর গাড়িটা থামাতে অবাক হলেন লেভিন। এটা সেই জার্মান মেকানিক যার কথা লেভিন একেবারে ভুলে গিয়েছিলেন। মাথা নুইয়ে ভেস্লোভস্কিকে কি-একটা যেন সে বলে; তারপর গাড়িতে উঠে দুজনে চলে গেল।
লেভিনের এই কাণ্ডটায় অব্লোন্স্কি এবং প্রিন্স-মহিষী ক্ষুব্ধ হয়েছিলেন। লেভিন নিজেও নিজেকে চরম মাত্রায় হাস্যাস্পদ শুধু নয়, সম্পূর্ণ দোষী ও কলংকিত বলে বোধ করছিলেন। কিন্তু তিনি এবং তাঁর স্ত্রী যে কষ্ট সয়েছেন সে কথা মনে হওয়ায় দ্বিতীয়বার এরূপ ক্ষেত্রে তিনি কি করতেন, নিজেকে এ প্রশ্ন করে জবাব একই রকম দিলেন।
এসব সত্ত্বেও প্রিন্স-মহিষী, যিনি এ আচরণের জন্য লেভিনকে ক্ষমা করতে পারেননি তিনি ছাড়া দিনের শেষে সবাই হয়ে উঠল প্রাণবন্ত, হাসি-খুশি, শাস্তি থেকে মুক্তি পাবার পর যেমন হয়ে ওঠে শিশুরা, অথবা দুঃসহ একটা সরকারি অভ্যর্থনা সমাপ্তির পর বড়রা। ফলে সন্ধ্যায়, প্রিন্স-মহিষী না থাকলে ভাসেন্কার বিতাড়ন নিয়ে কথা হচ্ছিল যেন সেটা বহু আগেরকার একটা ঘটনা। পিতার কাছ থেকে ডল্লি পেয়েছিলেন রগড় করে কথা বলার গুণ। সবে অতিথির জন্য নতুন রিবন-টিবন পরে ড্রয়িং-রুমে যেতেই হঠাৎ তিনি শুনলেন চাকার ঘর্ঘর—আর কে গাড়িতে বসে আছে খড়ের ওপর? তা স্কচ টুপি, রোমান্স, লেগিংস নিয়ে স্বয়ং ভাসেকা। নতুন নতুন হাসির ফোড়ন দিয়ে তৃতীয় কি চতুর্থ বার এই গল্প করছিলেন ডল্লি আর হেসে লুটিয়ে পড়ছিল ভারেঙ্কা।
‘ভালো একটা গাড়িতেও তো বসাতে পারতে! তা নয়, পরে শুনলাম : ‘থামাও!’ ভাবলাম দয়া হয়েছে। ওমা, দেখি মোটা জার্মানটাকে তার পাশে বসিয়ে গাড়ি ছেড়ে দিল… আমার রিবনগুলো একেবারে পানিতে গেল!…‘
ষোলো
তাঁর সংকল্প পূর্ণ করলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা, আন্নার কাছে গেলেন। বোনকে দুঃখ দিতে আর তার স্বামীকে উত্ত্যক্ত করতে তাঁর খুবই কষ্ট হচ্ছিল। ভ্রন্স্কির সাথে কোন সম্পর্ক রাখতে না চেয়ে লেভিন দম্পতি যে ঠিকই করেছেন সেটা তিনি বুঝছিলেন; কিন্তু আন্নার অবস্থা বদলালেও তাঁর প্রতি ডল্লির মনোভাব যে বদলায়নি সেটা তাঁর কাছে গিয়ে দেখানো তাঁর কর্তব্য বলে তিনি মনে করেছিলেন।
এই যাত্রাটার জন্য লেভিনদের মুখাপেক্ষী থাকতে না চেয়ে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা ঘোড়া ভাড়া করার জন্য গাঁয়ে লোক পাঠান। সেটা জানতে পেরে ডল্লির কাছে এসে লেভিন তিরস্কার করলেন।
‘কেন ভাবছ যে, তুমি যাচ্ছ বলে বিছ্ছিরি আমার লাগছে? যদি বিছ্ছিরি লাগতও, তাহলেও আমার ঘোড়া নিচ্ছ না বলে বিছ্ছিরি লাগছে আরো বেশি’, বললেন তিনি, ‘আমাকে তুমি একবারও বলোনি যে তুমি যাবেই। আর গাঁয়ের লোকের কাছে ঘোড়া ভাড়ার করা—সেটা প্রথমত আমার পক্ষে অপ্রীতিকর আর সবচেয়ে বড় কথা, ওরা রাজি হয়ে যাবে বটে, কিন্তু শেষ পর্যন্ত তোমাকে পৌঁছে দেবে না। আমার ঘোড়া আছে, আমার মনে দুঃখ দিতে না চাইলে আমার ঘোড়াগুলো নাও।’
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে সম্মতি দিতে হল। নির্দিষ্ট দিনে শ্যালিকার জন্য লেভিন তৈরি রাখলেন তাঁর মাল- টানা ও সওয়ার-বওয়া ঘোড়াদের মধ্যে থেকে চারটা আর একটা মজুদ, দেখতে খুবই অসুন্দর, কিন্তু দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে তারা পৌঁছে দিতে পারবে এক দিনেই। প্রিন্স-মহিষীকে পৌঁছে দেওয়া আর ধাই ডেকে আনার জন্য যখন ঘোড়ার দরকার হয়, লেভিন মুশকিলে পড়েছিলেন, কিন্তু দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা তাঁর বাড়িতে থাকলেও ঘোড়ার ভাড়া করবেন অন্য কোথা থেকে, আতিথেয়তার কর্তব্যবোধে এটা তিনি হতে দিতে পারেন না। তাছাড়া ঘোড়ার জন্য তাঁর কাছে যে বিশ রুব্ল চাওয়া হয়েছিল, সেটা তাঁর কাছে একটা মোটা টাকা বলে তিনি জানতেন; দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার আর্থিক অবস্থা যে অতি খারাপ সেটা লেভিন অনুভব করতেন যেন ওটা তাঁর নিজেরই অবস্থা।
লেভিনের পরামর্শ মত দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা রওনা দেন খুব ভোরে। রাস্তাটা ভালো, গাড়িটা আয়েসী, ফুর্তি করে ছুটল ঘোড়াগুলো। আর কোচবাক্সে কোচোয়ান ছাড়াও বসে রইল তাঁর সেরেস্তার মুহুরি, চাপরাশির বদলে একে লেভিন পাঠালেন নিরাপত্তার জন্য। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা ঢুলতে লাগলেন, জেগে উঠলেন কেবল সরাইখানায় পৌঁছে, এখানে ঘোড়া বদলাবার দরকার ছিল।
সি্ভ্য়াজ্স্কির কাছে যাবার সময় লেভিন যে ধনী চাষী গেরস্তের বাড়িতে থেমেছিলেন সেখানে চা খেয়ে, মেয়েদের সাথে ছেলেপুলেদের গল্প করে আর বৃদ্ধের সাথে কাউন্ট ভ্রন্স্কিকে নিয়ে আলাপ করে (যাঁর খুবই প্রশংসা করল বৃদ্ধ), বেলা দশটার সময় দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার গাড়ি আবার এগিয়ে চলল। ছেলেমেয়েদের নিয়ে ব্যস্ত থাকায় বাড়িতে তাঁর ভাবনা-চিন্তার সময় হত না। কিন্তু যে ভাবনাগুলো আগে তিনি ঠেকিয়ে রেখেছিলেন হঠাৎ তা সব এল ভিড় করে। নিজের গোটা জীবনটা নিয়ে তিনি ভাবলেন এবং নানা দিক থেকে, যা তিনি আগে কখনো ভাবেননি। তাঁর নিজের কাছেই অদ্ভুত ঠেকছিল চিন্তাগুলো। প্রথমে ভাবনা হয়েছিল ছেলেমেয়েদের জন্য, যদিও মা এবং প্রধান কথা কিটি (তার ওপরেই ওঁর বেশি ভরসা) কথা দিয়েছিলেন যে ওদের দেখাশোনা করবেন, তাহলেও দুশ্চিন্তা হচ্ছিল। ‘মাশা আবার দুষ্টুমি শুরু না করে, গ্রিশাকে চাঁট না মারে ঘোড়া, লিলির পেট যেন আর বেশি খারাপ না হয়।’ কিন্তু পরে বর্তমানের স্থান নিতে লাগল ভবিষ্যৎ প্রশ্ন। তিনি ভাবতে শুরু করলেন এই শীতকালের জন্য মস্কোতে নতুন বাসা ভাড়া নেওয়া যায় কিভাবে। ড্রয়িং-রুমের আসবাবপত্র বদলাতে হবে, বড় মেয়ের জন্য বানাতে হবে নতুন ফার-কোট। পরে আরো দূর-ভবিষ্যতের প্রশ্ন উঠতে লাগল তাঁর মনে : ছেলেমেয়েদের কিভাবে তিনি মানুষ করে তুলবেন। মেয়েদের জন্যে নয় তেমন ভাববার কিছু নেই, কিন্তু ছেলেদের?
‘বেশ, গ্রিশাকে আমি এখন শিক্ষা দিচ্ছি। কিন্তু সে তো কেবল এজন্য যে আমি নিজেই এখন ফাঁকা, ছেলেমেয়ে বিয়োচ্ছি না। বলাই বাহুল্য যে, স্তিভার ওপর কোন ভরসা করা যায় না। সজ্জন লোকদের সাহায্যে আমিই মানুষ করে তুলব ওদের। কিন্তু যদি আবার সন্তান হয়…’ তাঁর মাথায় এই চিন্তাটা এল যে যন্ত্রণায় সন্তানের জন্ম দিতে হবে মেয়েদের, লোকে বলে সেটা নাকি অভিশাপ, এটা বড় ভুল। ‘জন্ম দেওয়াটা কিছু নয়, কিন্তু গর্ভধারণ করা—এটাই হল যন্ত্রণার ব্যাপার’, নিজের শেষ গর্ভাবস্থা আর এই শেষ সন্তানটির মৃত্যুর ঘটনাটা কল্পনা করে ভাবলেন তিনি। তাঁর মনে পড়ল সরাইখানায় যুবতী মেয়েটার সাথে তাঁর আলাপের কথা। তার ছেলেমেয়ে আছে কিনা জিজ্ঞেস করায় সুন্দরী যুবতীটি ফুর্তির সুরে বলেছিল, ‘খুকি ছিল একটি, সৃষ্টিকর্তা নিয়ে নিলেন। লেন্ট পরবের সময় গোর দিয়েছি!
‘খুব কষ্ট হয় না?’ জিজ্ঞেস করেছিলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা।
‘কষ্ট হবে কেন? এমনিতেই বুড়োর নাতিপুতি অনেক, শুধু ঝামেলা বাড়ে। কাজ নেই, কর্ম নেই, হাত বাঁধা।’ যুবতীটির মন-খোলা মিষ্টত্ব সত্ত্বেও দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার কাছে জঘন্য লেগেছিল জবাবটা; কিন্তু এখন আপনা থেকেই মনে পড়ল কথাগুলো। ধৃষ্ট এই উক্তিটায় সত্যের একটা ভাগও আছে যেন।
পনের বছরের গোটা এই বিবাহিত জীবনটায় দৃষ্টিপাত করে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা ভাবলেন, ‘সত্যি, সাধারণভাবেই তাই। গর্ভধারণ, বিবমিষা, ভোঁতা বুদ্ধি, সব কিছুতে ঔদাসীন্য, আর সবচেয়ে বড় কথা কদাকার চেহারা। কিটি, রূপসী তরুণী কিটি—তারও রূপ গেছে, আর আমি গর্ভবতী হলে যে কদর্য হয়ে উঠি তা আমি জানি। প্রসব যন্ত্রণা, বিকট যন্ত্রণা, শেষ ঐ মুহূর্তটা… তারপর মাই দেওয়া, রাত জাগা, ভয়াবহ ঐ যন্ত্রণা…’
প্রায় প্রতিটি প্রসবেই তাঁর স্তনবৃন্ত যে ফেটে গিয়েছে, সেই যন্ত্রণার কথাটা শুধু মনে পড়তেই শিউরে উঠলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। ‘তারপর ছেলেমেয়েদের অসুখ-বিসুখ, অবিরাম একটা আতংক; তারপর লালন-পালন, বিছিরি প্রবৃত্তি (র্যাম্পবেরি ভুঁইয়ে ছোট্ট মাশার অপরাধটার কথা মনে পড়ল তাঁর), তারপর পড়ানো, লাতিন—এ সবই অতি দুর্বোধ্য, কষ্টকর। তার ওপর আবার এসব সন্তানের মৃত্যু’। আবার তাঁর মনে জেগে উঠল তাঁর মাতৃহৃদয়কে নিরন্তর মথিত করা শেষ সন্তানটির মৃত্যুর নির্মম স্মৃতি, কোলের ছেলে ছিল সে, মারা যায় ঘুংরি কাশিতে, মনে পড়ল তার অন্ত্যেষ্টি, ছোট্ট গোলাপী কফিনে বন্ধ করা হচ্ছিল, ঠিক সেই মুহূর্তে তার বিবর্ণ ললাট, রগের কাছে চুলের কুণ্ডলী, কফিন থেকে হাঁ-করে থাকা ছোট্ট যে মুখখানা দেখা গিয়েছিল তাতে শুধু তাঁরই বুক-ফাটা নিঃসঙ্গ যন্ত্রণা।
‘অথচ কেন এসব? কি হবে এসব থেকে? শুধু এই যে ক্ষণেকের শান্তি না পেয়ে কখনো গর্ভবতী, কখনো স্তন্যদাত্রী হয়ে সব সময় খিটখিটে গজগজে আমি, স্বামীর চক্ষুশূল, নিজে জ্বলেপুড়ে, অন্যদের জ্বালিয়ে নিজের জীবনটা কাটিয়ে দেব আর সংসারে নিয়ে আসব হতভাগ্য, কুশিক্ষিত কপর্দকহীন কয়েকটি সন্তান। আর এখন গ্রীষ্মটা লেভিনদের ওখানে না থাকলে কি করে দিন কাটত জানি না। বলাই বাহুল্য, কিটি আর কস্তিয়া এতই মার্জিত যে আমাদের সেটা মনে করতে দেয় না; কিন্তু এভাবে তো আর চলতে পারে না। ওদেরও ছেলেমেয়ে হবে, আমাদের সাহায্য করার জো থাকবে না; এমন কি এখনই টানাটানি চলছে ওদের। তাহলে সাহায্য করবেন কি বাবা, যিনি নিজের বলতে কিছু বাকি রাখেননি? নিজে আমি ছেলেমেয়েদের মানুষ করতে পারব না, হলে হবে অন্যদের সাহায্যে, হীনা সয়ে। সবচেয়ে সৌভাগ্যের কথাটাই যদি ধরি, ছেলেমেয়েরা আর মরছে না, আমি কোনরকম করে তাদের মানুষ করে তুলছি, তাহলে বড় জোর তারা দুরাত্মা হয়ে উঠবে না। শুধু এইটুকুই কামনা করতে পারি আমি। শুধু এর জন্যেই কত কষ্টস্বীকার, কত মেহনত… গোটা জীবনটাই নষ্ট হল!’ আবার তাঁর মনে পড়ল যুবতীটির কথা এবং আবার সেটা স্মরণ করতে বিছ্ছিরি লাগল তাঁর। কিন্তু তিনি না মেনে পারলেন না যে কথাগুলোয় খানিকটা রূঢ় সত্য আছে।
‘আর কত দূর, মিখাইল?’ ভয় পাওয়ানো চিন্তা থেকে মন সরাবার জন্য মুহুরিকে জিজ্ঞেস করলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা।
‘শুনেছি এই গ্রামটা থেকে সাত ভার্স্ট।’
গ্রামের রাস্তা দিয়ে গিয়ে গাড়ি উঠল একটা সাঁকোয়। সাঁকো দিয়ে উচ্চ কণ্ঠে ফুর্তিতে কথা বলতে বলতে আসছিল একদল হাসি-খুশি মেয়ে, কাঁধে আঁটি বাঁধার খড়ের দড়ি। সাঁকোর ওপর থেমে গিয়ে তারা উৎসুক হয়ে দেখতে লাগল গাড়িতে কে আছে। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার দিকে যে মুখগুলি উত্তোলিত তা সবই সুস্থসবল, আমুদে, জীবনের আনন্দে তাঁকে খেপাচ্ছে বলে মনে হল তাঁর। মেয়েদের পেরিয়ে, একটা ঢিবিতে উঠে ঘোড়া আবার দুলকি চালে ছুটতে থাকল, পুরানো গাড়িটার নরম স্প্রিঙের ওপর প্রীতিপ্রদ দোলানিতে দুলতে দুলতে ডল্লির মনে হতে লাগল, ‘সবাই বেঁচে-বর্তে আছে, সবাই জীবন উপভোগ করছে। আর জ্বালা-যন্ত্রণায় মেরে-ফেলা এক দুনিয়া থেকে, এক জেলখানা থেকে ছাড়া পাওয়ায় আমার এখন চৈতন্য হল কেবল মুহূর্তের জন্যে। সবাই বেঁচে আছে: এই মেয়েরা, নাটালি বোন, ভারেঙ্কা, যার কাছে যাচ্ছি সেই আন্নাও, শুধু আমি নই।
‘অথচ লোকে আন্নাকে আক্রমণ করছে। কিসের জন্যে? আমি কি ওর চেয়ে ভালো? আমার অন্তত স্বামী আছে যাকে আমি ভালোবাসি। যেভাবে ভালোবাসতে আমার ইচ্ছে হয় সেভাবে না হলেও ভালোবাসি, আর আন্না তার স্বামীকে ভালোবাসত না। ওর দোষ কি? সে বেঁচে থাকতে চায়। সৃষ্টিকর্তা আমাদের প্রাণে এই বাসনাটা দিয়ে রেখেছেন। খুবই সম্ভব যে আমিও একই কাজ করতাম। ভয়ংকর সেই সময়টায় আন্না যখন মস্কোয় আসে তখন তাঁর কথা শুনে ভালো করেছিলাম কিনা তা জানি না আজও। তখন স্বামীকে ত্যাগ করে নতুন জীবন শুরু করা উচিত ছিল আমার। সত্যি করে ভালোবাসতে আর ভালোবাসা পেতে পারতাম আমি। এখন কি কিছু ভালো হয়েছে? ওকে আমি শ্রদ্ধা করি না। ওকে আমার দরকার’, স্বামী সম্পর্কে ভাবলেন তিনি, ‘তাই সহ্য করে যাই। এটা কি ভালো হয়েছে? তখনো লোকের চোখে ধরে যেতে পারতাম আমি, তখনো রূপ ছিল আমার’, ভেবে চললেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল আয়নায় নিজে চেহারাটা দেখেন। ব্যাগে তাঁর ভ্রমণোপযোগী আয়না ছিল, ইচ্ছে হচ্ছিল সেটা বের করবেন; কিন্তু কোচোয়ান আর মুহুরির দোদুল্যমান পিঠ দেখে তিনি টের পেলেন ওদের কেউ যদি তাকিয়ে দেখেন তাঁর দিকে, তাহলে তিনি লজ্জা পাবেন, তাই বের করলেন না আয়না।
কিন্তু আয়নায় মুখ না দেখেও তাঁর মনে হল এখনো তত দেরি হয়ে যায়নি। কজ্নিশেভকে মনে পড়ল তাঁর, যিনি তাঁর প্রতি বিশেষ সৌজন্য দেখিয়েছেন আর স্তিভার বন্ধু তুরোভ্ৎসিন, স্কার্লেট জ্বরের প্রকোপটার সময় যিনি তাঁর ছেলেমেয়েদের সেবা-যত্ন করেছেন, প্রেমে পড়েছিলেন ডল্লির। আরো ছিল অতি তরুণ একটি ছেলে, সমস্ত বোনদের মধ্যে ডল্লিই সবচেয়ে সুন্দর, রসিকতা করে স্বামী এই যে কথাটা বলেছিলেন, সেও মনে করত তাই। দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার চোখের সামনে ভেসে উঠতে লাগল অতি উদ্দাম এবং অসম্ভব সব ভালোবাসার ছবি। ‘চমৎকার কাজ করেছে আন্না, আমি তাকে ছি-ছি করতে যাব না। সে সুখী, অন্য একজনকে সুখ দিচ্ছে। আমার মত বিধ্বস্ত নয়, আর আমি নিঃসন্দেহ যে বরাবরের মত তেমনি সে তাজা, বুদ্ধিমতী, সকলের কাছে খোলামেলা’, ভাবলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা, এবং একটা শয়তানি হাসিতে তাঁর ঠোঁট কুঞ্চিত হয়ে উঠল। সেটা এজন্য যে আন্নার প্রণয়লীলার কথা ভাবতে গিয়ে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা তারই সমান্তরালে নিজেকে দেখছিলেন সমষ্টিভূত এক কল্পিত পুরুষের সাথে প্রায় একই রকম এক প্রেমে যে ভালোবাসছে তাঁকে। আন্নার মত তিনিও স্বামীকে সব কিছু খুলে বলেছেন। আর তাঁর মুখে অবলোনস্কির বিস্ময় ও হতবুদ্ধিতাই হাসি ফুটিয়েছিল।
এ রকম স্বপ্ন দেখতে দেখতে বড় সড়ক থেকে তিনি বাঁক নিলেন অন্য একটা রাস্তায় যা ভজ্দ্ভিজেনস্কয়েতে গেছে।
সতেরো
তার ঘোড়ার গাড়ি থামিয়ে কোচোয়ান ডানে তাকিয়ে দেখল রাই ক্ষেতের দিকে যেখানে একটা গাড়ির কাছে বসে ছিল চাষীরা। মুহুরি লাফিয়ে নামতে যাচ্ছিল, কিন্তু মত বদলিয়ে কর্তৃত্বের সুরে চেঁচিয়ে হাতছানি দিয়ে চাষীকে নিজের কাছে ডাকল। গাড়ি চলার সময় যে বাতাস বইছিল, গাড়ি থামতে তা মরে এল। ঝাঁক বেঁধে ডাঁশ মাছিগুলো ছেঁকে ধরল ঘর্মাক্ত ঘোড়াদের, যারা রেগে তাড়াবার চেষ্টা করছিল তাদের। কাস্তেয় শান দেবার যে ধাতব শব্দ আসছিল গাড়িটার কাছ থেকে, তা থেমে গেল। একজন চাষী উঠে দাঁড়িয়ে এদিকে আসতে থাকল।
‘ইস, ভেঙে পড়েছ দেখছি’, স্বল্পব্যবহৃত রাস্তার বিশুষ্ক চাঙড়গুলোর ওপর ধীরে ধীরে নগ্ন পা ফেলে আসছিল চাষীটা। ক্রুদ্ধ কণ্ঠে তার উদ্দেশে চেঁচাল মুহুরি, ‘পা চালিয়ে!’
বুড়োর কোঁকড়া চুল বার্চ ছালের ফালি দিয়ে বাঁধা। ঘামে কালো হয়ে উঠেছে কুঁজো পিঠ। গতি বাড়িয়ে সে এল গাড়ির কাছে, রোদে পোড়া হাতে মাডগার্ড ধরল।
‘ভজ্ভিজেনস্কয়ে মহালবাড়িতে? কাউন্টের কাছে?’ বলল সে। ‘সোজা এগিয়ে যাও, বাঁয়ে মোড় দিয়ে গলি ধরে গেলেই পেয়ে যাবে। কার কাছে তোমাদের আসা হল? ওনার কাছেই?’
‘ওঁরা বাড়িতে আছেন নাকি, বাবাজি?’ অনির্দিষ্টভাবে জিজ্ঞেস করলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। ভেবে পাচ্ছিলেন না চাষীটার কাছেও আন্নার কথা বলবেন কিভাবে।
‘বাড়িতেই থাকবে বৈকি’, ধুলোয় পাঁচ আঙুল সমেত পরিষ্কার ছাপ ফেলে এ-পা ও-পায়ে চাষীটি বলল, ‘থাকবে বৈকি’, পুনরাবৃত্তি করল সে। বোঝা যাচ্ছিল তার কথা চালিয়ে যাবার ইচ্ছে হচ্ছে। ‘কাল আবার অতিথি এসেছিল।
কত যে অতিথি!… কি হল তোর?’ গাড়ি থেকে তার উদ্দেশে কি যেন চেঁচিয়ে বলছিল এক ছোকরা.। তার দিকে ফিরল সে, ‘ও হ্যাঁ, সবাই ইদিক দিয়ে গেছিল ফসল কাটা দেখতে। এতক্ষণে ঘরে ফেরার কথা। আর তোমরা কে হে বাপু?’
‘আমরা দূরের লোক’, কোচবক্সে উঠে কোচোয়ান বলল, ‘তাহলে দূর নয়?’
‘বলছি তো, এখানেই। যেই খানিক এগিয়ে যাবে…’ মাডগার্ডে হাত বুলোতে বুলোতে সে বলল।
গাঁট্টাগোঁট্টা বলিষ্ঠ চেহারার একটি ছোকরাও এগিয়ে এল। জিজ্ঞেস করল, ‘ফসল কাটার কাজ মিলবে নাকি?’
‘জানি না, বাছা।’
‘তাহলে বাঁয়ে ঘুরবে, তাহলেই পেয়ে যাবে’, বুড়ো বলল। স্পষ্টতই যারা এসেছে অনিচ্ছায় তাদের যেতে দিয়ে, তাদের সাথে কথা বলার ইচ্ছে হচ্ছিল তার।
কোচোয়ান গাড়ি ছাড়ল, কিন্তু ছাড়তে-না-ছাড়তেই চাষী চেঁচিয়ে উঠল : ‘এই থামাও! ওহে দাঁড়াও!’ চেঁচাচ্ছিল দুজন মিলেই।
কোচোয়ান গাড়ি থামাল।
‘ওনারাই আসছে’, রাস্তা দিয়ে আসা চারজন ঘোড়সওয়ার আর শকটে আরোহী দুজনকে দেখিয়ে বলল সে। এঁরা হলেন অশ্বপৃষ্ঠে ভ্রন্স্কি, তাঁর জকি, ভেস্লোভস্কি আর আন্না। গাড়ির ভেতরে ছিলেন প্রিন্সেস ভারভারা আর
সি্ভ্য়াজ্স্কি। তাঁরা বেড়াতে বেরিয়েছিলেন, সেই সাথে ফসল তোলার সদ্য কেনা যন্ত্রগুলো দেখতে।
ডল্লির গাড়ি থামতে সওয়ারিরা তাঁদের ঘোড়া চালাতে লগালেন পা-পা করে। সামনে আসছিলেন ভেস্লোভস্কির পাশাপাশি আন্না। শাস্ত কদমে আন্না আসছিলেন একটা বেঁটে পুরুষ্টু বিলাতি কর্ ঘোড়ায় চড়ে, তার কেশর ছাঁটা, লেজ খাটো। উঁচু টুপির নীচ থেকে বেরিয়ে আসা আন্নার কালো চুলে ভরা সুন্দর মাথা, সুডৌল স্কন্ধ, কালো রাইডিং-হ্যাবিটে ঘেরা ক্ষীণ কটি, এবং তাঁর সমস্ত শান্ত ললিত ঠাট বিস্মিত করল ডল্লিকে।
প্রথমে তাঁর মনে হয়েছিল আন্না যে ঘোড়ায় চেপে আসছেন সেটা অশালীন। ডল্লির চেতনায় মহিলাদের অশ্বারোহণ মিলে গিয়েছিল একটা তারুণ্যোচিত লঘু রঙ্গলীলার সাথে যেটা আন্নার অবস্থার সাথে খাপ খায় না; কিন্তু কাছ থেকে যখন তাঁকে ভালো করে দেখলেন, তৎক্ষণাৎ মেনে নিলেন তাঁর অশ্বারোহণ। লালিত্য ছাড়াও ভঙ্গিতে, পোশাকে, গতিবিধিতে সব কিছুই এমন সহজ, সৌম্য, মর্যাদাপূর্ণ যে তার চেয়ে স্বাভাবিক আর কিছুই হতে পারে না।
আন্নার পাশে পাশে স্কচ টুপির ফিতে উড়িয়ে ধূসর, তেজী একটা ক্যাভেলরি ঘোড়ায় মোটা পা সামনে এগিয়ে দিয়ে আসছিলেন ভেস্লোভস্কি। স্পষ্টতই নিজেকে নিয়ে তিনি মুগ্ধ। তাঁকে চিনতে পেরে মজা-পাওয়ার হাসিটা চাপতে পারলেন না দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। তাঁদের পেছনে আসছিলেন ভ্রন্স্কি। তাঁর ঘোড়াটা মাদী, রং তার গাঢ়-পিঙ্গল, স্পষ্টতই কদমে ছোটায় সে উত্তেজিত। লাগাম টেনে ভ্রন্স্কি তাকে সংযত রাখছিলেন।
তাঁর পেছনে জকির উর্দিতে ছোটখাট একটি লোক। মস্ত এক কালো ঘোড়ায় নতুন গোছের একটা গাড়িতে সি্ভ্য়াজ্স্কি আর প্রিন্সেস ছাড়িয়ে গেলেন সওয়ারদের।
পুরানো গাড়িটার কোণে ছোট মূর্তিটা যে ডল্লির সেটা চিনতে পারা মাত্রই আন্নার মুখ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল আনন্দের হাসিতে। চেঁচিয়ে উঠলেন আন্না, জিনের ওপর ছটফট করে উঠলেন, আবার ঘোড়া চালালেন কদমে। গাড়ির কাছে এসে কারো সাহায্য না নিয়েই লাফিয়ে নামলেন ঘোড়া থেকে। রাইডিং-হ্যাবিট খানিক উঁচু করে তুলে ধরে ছুটে গেলেন ডল্লির কাছে।
‘আমি ভাবছিলাম তুমি, আবার সাহসও হচ্ছিল না ভাবতে। কি আনন্দ! তুমি কল্পনা করতে পারবে না—কি আনন্দ হচ্ছে আমার!’ কখনো ডল্লির গালে গাল চেপে তাঁকে চুমু খেয়ে, কখনো তাঁর কাছ থেকে মুখ সরিয়ে নিয়ে হেসে তাঁকে লক্ষ করতে করতে বলছিলেন আন্না।
‘কি আনন্দ আলেক্সেই!’ বললেন তিনি ভ্রন্স্কির দিকে তাকিয়ে, ঘোড়া থেকে নেমে তিনি তাঁদের দিকে আসছিলেন।
ছাই রঙের উঁচু টুপি খুলে ভ্রন্স্কি এলেন ডল্লির কাছে।
‘আপনি এসেছেন বলে আমরা কি খুশি যে হয়েছি, ভাবতে পারবেন না’, প্রতিটি শব্দে বিশেষ তাৎপর্য আরোপ করে তিনি বললেন। হাসিতে দেখা গেল তাঁর ঘনসনদ্ধ সাদা দাঁত।
ভাসেকা ভেস্লোভস্কি ঘোড়া থেকে না নেমে টুপি খুলে মাথার ওপর সানন্দে রিবন দোলাতে সংবর্ধনা জানালেন অতিথিকে।
সুন্দর গাড়িখানা কাছে এলে ডল্লির চোখে জিজ্ঞাসু দৃষ্টি দেখে আন্না বললেন, ‘উনি প্রিন্সেস ভারভারা।’
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা বললেন, অ!’ অনিচ্ছাসত্ত্বেও মুখে তাঁর ফুটে উঠল অসন্তোষ।
প্রিন্সেস ভারভারা হলেন তাঁর স্বামীর চাচী। অনেকদিন থেকে তিনি তাঁকে জানেন কিন্তু শ্রদ্ধা করতেন না। তিনি জানতেন যে, সারা জীবন তিনি কাটিয়েছেন তাঁর ধনী আত্মীয়-স্বজনদের ঘাড়ে চেপে। কিন্তু উনি যে এখন রয়েছেন ভ্রন্স্কির ওখানে, যিনি তাঁর অনাত্মীয়, এতে ডল্লি অপমানিত বোধ করলেন উনি তাঁর স্বামীর আত্মীয় বলে। তাঁর মুখভাব লক্ষ করেছিলেন আন্না, বিব্রত বোধ করে লাল হয়ে উঠে তিনি রাইডিং-হ্যাবিটের খুঁট ছেড়ে দিলেন আর হোঁচট খেলেন তাতে।
ওঁদের গাড়ির কাছে গিয়ে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা নিরুত্তাপ সম্ভাষণ জানালেন প্রিন্সেস ভারভারাকে। সি্ভ্য়াজ্স্কির সাথেও আগে পরিচয় ছিল। তিনি জিজ্ঞেস করলেন তরুণী ভার্যার সাথে কেমন দিন কাটছে তাঁর ক্ষেপাটে বন্ধুর। তারপর চকিত দৃষ্টিপাতে বেজোড় ঘোড়া আর মাডগার্ডে তালি-মারা লেভিনের গাড়িটা লক্ষ্য করে প্রস্তাব দিলেন যে মহিলারা যাবেন ভ্রন্স্কির গাড়িতে।
বললেন, ‘আর আমি যাব ওই মহারথে। ভ্রন্স্কির ঘোড়াটা বাধ্য, প্রিন্সেসও চমৎকার সারথি।’
‘না, যেখানে ছিলেন, সেখানেই থাকুন’, ওঁদের কাছে এসে আন্না বললেন, ‘আমরা যাব এই গাড়িতে’, আর ডল্লিকে বাহুলগ্না করে নিয়ে গেলেন তাঁকে।
এরকম মনোহর গাড়ি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা আগে কখনো দেখেননি। চোখ তাঁর ধাঁধিয়ে দিলে গাড়িটা : চমৎকার ঘোড়াগুলো, জ্বলজ্বলে সুশ্রী এই যে মুখগুলো তাঁকে পরিবেষ্টিত করেছে। কিন্তু সবচেয়ে বেশি তাঁকে চমৎকৃত করল তাঁর পরিচিতা, প্রিয়পাত্রী আন্নার মধ্যেকার পরিবর্তনটা। অন্য কোন নারী যিনি কম মনোযোগী, আন্নাকে যিনি আগে চিনতেন না, বিশেষ করে পথে আসতে আসতে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা যেসব ভাবনা ভেবেছেন তা যিনি ভাবেননি, তিনি আন্নার মধ্যে অসাধারণ কিছু বৈশিষ্ট্যের সন্ধান পেতেন না। কিন্তু শুধু প্রেমাবেগের মুহূর্তে নারীর মধ্যে যে একটা সাময়িক রূপোচ্ছ্বাস দেখা দেয়, সেটা এখন আন্নার মুখে দেখতে পেয়ে অভিভূত হলেন ডল্লি। সে মুখের সব কিছু—গালে আর থুতনিতে সুস্পষ্ট টোল, ঠোঁটের ভাঁজ, যেন তাঁর মুখ ঘিরে ভাসমান হাসি, চোখের ছটা, ভাবভঙ্গির চারুতা ও ক্ষিপ্রতা, কণ্ঠস্বরের পূর্ণতা, এমন কি ভেস্লোভস্কি যখন তাঁর কর্ ঘোড়াটাকে চেয়েছিলেন ডান পা বাড়িয়ে কদমে ছোটা শেখাবার জন্য, তখন যে সস্নেহ রাগে তিনি জবাব দিয়েছিলেন—সবই ভারি মন টানছিল; এবং মনে হল আন্না নিজেই সেটা জানেন আর তাতে খুশি।
দুজনেই যখন গাড়িতে উঠলেন, হঠাৎ কেমন অস্বস্তি লাগল দুজনেরই। ডল্লি যে মনোযোগী, জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে চাইছিলেন তাঁর দিকে, তাতে অস্বস্তি বোধ করছিলেন আন্না; আর মহারথ নিয়ে সি্ভ্য়াজ্স্কির খোঁটাটার পরেও যে এই পুরানো, নোংরা গাড়িটাতেই আন্না বসলেন তাঁর পাশে, সে জন্য আপনা থেকেই লজ্জা হচ্ছিল ডল্লির। কোচোয়ান ফিলিপ আর মুহুরিরও সেই রকম লাগছিল। মুহুরি তার অস্বস্তি চাপা দেবার জন্য শশব্যস্ত হয়ে উঠল মহিলাদের গাড়িতে বসাতে। কিন্তু কোচোয়ান ফিলিপ মুখ ভার করে তৈরি হতে লাগল বাহ্যিক এই চমৎকারিত্বকে পাত্তা না দেবার জন্য। কালো ঘোড়াটার দিকে তাকিয়ে সে হাসল ব্যঙ্গভরে। মনে মনে স্থির করল গাড়ির কালো ঘোড়াটা লোক- দেখানোর জন্যই ভালো। কিন্তু এই গরমে এক দফায় চল্লিশ ভার্স্ট পাড়ি দিতে পারবে না।
চাষীরা সবাই উঠে দাঁড়িয়ে উৎসুক হয়ে দেখতে লাগল এই অতিথিবরণ আর ফুর্তিতে মন্তব্য করতে লাগল নিজেদের মধ্যে।
‘বড় খুশি, অনেক দিন দেখা-সাক্ষাৎ নাই যে’, বলল বার্চ ছালের ফালি বাঁধা কোঁকড়া-চুলো বুড়ো।
‘গেরাসিম চাচা, ঐ কালো ঘোড়াটাকে দিয়ে খড় বওয়ালে হত, ফুর্তিতে খাটত!’
আরে দেখ-দেখ, প্যান্ট পরা এটা কি মহিলা?’ একজন বলল ভাসেকা ভেস্লোভস্কিকে দেখিয়ে, আন্নার মেয়েলী
জিনে চেপে বসেছিলেন তিনি।
‘না-না, পুরুষ! দেখো কেমনে উঠে বসল!’
‘কি হে, ঘুম আর হবে না দেখছি?’
বুড়ো তির্যক দৃষ্টিতে সূর্যের দিকে তাকিয়ে বলল, ‘আজ আর কিসের ঘুম! দেখছিস, বেলা দুপুর পেরিয়ে গেছে হুকগুলো নিয়ে চলে যাও!’
আঠারো
ডল্লির শীর্ণ, পীড়িত মুখ, বলিরেখাগুলোয় রাস্তার ধুলো জমেছে। তা দেখে আন্নার কি মনে হয়েছিল, তা বলতে যাচ্ছিলেন তিনি, যথা—ডল্লির দৃষ্টি সেটা তাঁকে জানিয়েছে, এটা মনে পড়ায় দীর্ঘশ্বাস ফেলে আন্না নিজের কথা বলতে লাগলেন। বললেন, ‘আমাকে দেখে তুমি ভাবছ আমার অবস্থায় আমি সুখী হতে পারি কি? তা কি করা যাবে! স্বীকার করতে লজ্জা হচ্ছে, কিন্তু আমি… আমি অমার্জনীয় রকমের সুখী। কি-একটা অলৌকিক ব্যাপার ঘটেছে আমার। যেমন স্বপ্ন যখন হয়ে উঠেছে ভয়াবহ, সাংঘাতিক, তখন হঠাৎ ঘুম ভেঙে দেখা যায় যে ভয়টয় কিছু নেই। আমি ঘুম ভেঙে উঠেছি। যন্ত্রণার মধ্যে দিয়ে, ভয়ের মধ্যে দিয়ে গেছি আমি, কিন্তু এখন অনেকদিন থেকে, বিশেষ করে এখানে আমরা যত দিন থেকে আছি, আমি ভারি সুখী!’ তিনি ডল্লির দিকে তাকিয়ে প্রশ্নের একটা ভীরু হাসি নিয়ে বললেন।
‘ভীষণ আনন্দ হচ্ছে’, হেসে ডল্লি বললেন। তবে যা চেয়েছিলেন সুরটা হল তার চেয়ে নিরুত্তাপ; ‘তোমার জন্যে খুবই আনন্দ হচ্ছে আমার। কিন্তু আমাকে চিঠি লিখলে না কেন?’
‘কেন?… কারণ সাহস হয়নি। আমার অবস্থাটা কি তা তুমি ভুলে যাচ্ছ…’
‘আমার কাছে চিঠি লিখতে? সাহস হল না? যদি জানতে আমি কতটা… আমি মনে করি…’
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার ইচ্ছা হয়েছিল আজ সকালে যা ভাবছিলেন সেটা বলবেন, কিন্তু এখন কেন জানি মনে হল তা বলার সময় এটা নয়।
‘তবে ও-কথা পরে হবে। এসব ঘরবাড়িগুলো কিসের?’ প্রসঙ্গ বদলাবার জন্য অ্যাকেসিয়া আর লাইলাক ঝোপের ফাঁক দিয়ে যে লাল আর সবুজ চালগুলো চোখে পড়ছিল তা দেখিয়ে জিজ্ঞেস করলেন তিনি, ‘ঠিক যেন একটা শহর।’
আন্না কিন্তু ওঁর প্রশ্নে কান দিলেন না।
‘না-না, আমার অবস্থা সম্পর্কে কি ভাবো তুমি, কি মনে করো? কি?’ জিজ্ঞেস করলেন আন্না।
‘আমি মনে করি…’ শুরু করতে যাচ্ছিলেন ডল্লি। কিন্তু এ সময় কর্ ঘোড়াটাকে ডান পা বাড়িয়ে কদমে ছোটার তালিম দিয়ে ভাসেকা ভেস্লোভস্কি মেয়েলী সোয়েদ জিনের ওপর তাঁর খাটো জ্যাকেট পরা ভারী দেহ থপথপিয়ে ছুটে গেলেন। চেঁচালেন, ‘হচ্ছে, আন্না আর্কাদিয়েভনা!’
আন্না তাঁর দিকে তাকালেন না পর্যন্ত; কিন্তু আবার দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার মনে হল গাড়িতে এই দীর্ঘ কথোপকথনটা শুরু করায় সুবিধা হবে না। তাই নিজের ভাবনাটা তিনি সংক্ষিপ্ত করে নিলেন। বললেন, ‘কিছুই আমি মনে করি না, কিন্তু সব সময়ই ভালোবেসেছি তোমাকে। আর ভালোবাসতে হলে লোকটা যেমন তার সবটাই ভালোবাসতে হয়, আমি যেমন চাই শুধু সেটুকু নয়।
আন্না বান্ধবীর মুখ থেকে দৃষ্টি সরিয়ে, চোখ কুঁচকে (এটা একটা নতুন অভ্যাস, ডল্লি আগে তা দেখেননি কথাগুলোর অর্থ পুরোপুরি হৃদয়ঙ্গম করে তাকালেন ডল্লির দিকে। বললেন, ‘তোমার যদি কোন পাপ থাকে, তোমার আসা আর এই কথাগুলোর জন্যে তা সব খণ্ডন হয়ে যাবে।’
ডল্লি দেখতে পেলেন চোখ তাঁর ভরে উঠছে পানিতে। নীরবে আন্নার হাতে চাপ দিলেন তিনি।
‘তা এই বাড়িগুলো কিসের? অনেকগুলো যে!’ মিনিট খানেক চুপ করে থেকে ডল্লি পুনর্বার প্রশ্নটা করলেন।
‘এগুলো আমাদের শ্রমিক-কর্মচারীদের বাড়ি, কর্মশালা, আস্তাবল’, আন্না বললেন, ‘আর এখান থেকে পার্ক শুরু হচ্ছে। এ সবই চুলায় যাচ্ছিল, কিন্তু আলেক্সেই সব উদ্ধার করেছে। এই সম্পত্তিটা সে খুবই ভালোবাসে আর আমি যা মোটেই আশা করিনি, সাংঘাতিক ওর মন বসেছে বিষয়-আশয়ে। তবে স্বভাবে ও ভারি বিত্তবান! যে কাজই হাতে নেবে, সেটা সম্পূর্ণ করবে চমৎকার করে। এখানে ওর শুধু যে মন কেমন করছে না। তাই নয়, প্রাণ দিয়ে কাজে লেগেছে। আমি যতটা জানি, ও হয়ে উঠছে হিসেবী, চমৎকার মালিকা। এমন কি বিষয়-কর্মের ব্যাপারে কৃপণই, কিন্তু শুধু বিষয়-আশয়ের ব্যাপারে। অথচ যেখানে ব্যাপারটা হাজার হাজর টাকা নিয়ে, ও কেয়ার করে না’, আন্না বললেন খুশির সেই সেয়ানা হাসি নিয়ে। যেভাবে শুধু তারই কাছে উদ্ঘাটিত প্রিয়তমের গুণের কথা প্রায়ই বলে থাকে নারীরা; ‘দেখছ, ওই বড় দালানটা? এটা নতুন হাসপাতাল। আমার মনে হয় এতে লাখ খানেক যাবে। এটাই এখন ওর সাম্প্রতিক খেয়াল, নেশা। আর জানো কি থেকে এর শুরু? চাষীরা মনে হয় সস্তায় ঘেসো জমি দিতে, ছাড় দিতে বলেছিল ওকে। ও তা অগ্রাহ্য করে, ওর কিপটেমির জন্যে ওকে বকুনি দিই আমি। বলা বাহুল্য, শুধু এই কারণেই নয়, সব কিছু মিলিয়ে—ও এই হাসপাতালটা বানাতে শুরু কর এটা দেখাবার জন্যে যে মোটেই ও কৃপণ নয়, বুঝেছ তো। বলতে পারো এটা তুচ্ছ ব্যাপার; কিন্তু এর জন্যে ওকে ভালোবাসি আরও বেশি। আর এখনই দেখতে পাব বাড়ি। এটা ওর দাদার বাড়ি, কিন্তু বাইরেটা তার কিছুই বদলায়নি ও।’
‘কি সুন্দর!’ বাগানের বুড়ো গাছগুলোর বিচিত্র শ্যামলিমার মধ্যে স্তম্ভশ্রেণী শোভিত সুদৃশ্য বাড়িটা দেখে স্বতঃই চমৎকৃত হয়ে বলে উঠলেন ডল্লি।
‘সত্যিই সুন্দর, তাই না? আর বাড়ির ওপরতলা থেকে চারপাশের যে দৃশ্য, সেটা অপূৰ্ব।’
নুড়ি ছড়ানো পথ দিয়ে ফুলে ভরা একটা আঙিনায় ঢুকলেন তাঁরা। ফুল বাগানের আলগা করে দেওয়া মাটিতে সেখানে আকাঁড়া ঝামা পাথর বসাচ্ছিল দুজন মালী। গাড়ি থামল আচ্ছাদিত গাড়ি-বারান্দায়।
‘আ, ওরা এসে গেছে দেখছি!’ সওয়ারীদের যে ঘোড়াগুলোকে অলিন্দের কাছ থেকে সরিয়ে নিয়ে যাওয়া হচ্ছিল। তা দেখে আন্না বললেন, ‘সত্যি, সুন্দর নয় ঘোড়াটা? এটা কর্, আমার পেয়ারের ঘোড়া। নিয়ে এসো এখানে, আর চিনি দাও আমাকে। কাউন্ট কোথায়?’ বাহারী চাপরাশ পরা যে দুজন ভৃত্য ছুটে এসেছিল তাদের জিজ্ঞেস করলেন তিনি। তারপর ভেস্লোভস্কি সমভিব্যাহারে ভ্রনস্কিকে বেরোতে দেখে বললেন : ‘ও, এই যে!
‘তুমি কোথায় থাকতে দেবে প্রিন্সেস দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে’, ফরাসিতে আন্নাকে জিজ্ঞেস করলেন ভ্রন্স্কি, এবং উত্তরের অপেক্ষা না করে, দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার সাথে আরেকবার সম্ভাষণ বিনিময়ান্তে এবার করচুম্বন করে বললেন, ‘আমার মনে হয়, ঝুল-বারান্দা দেওয়া বড় ঘরটায় নয় কি?’
‘আরে না, বরং কোণের ঘরটায়। আমাদের দেখা-সাক্ষাৎ হতে পারবে বেশি। নাও চলো’, ভৃত্য যে চিনি এনে দিয়েছিল, নিজের পেয়ারের ঘোড়াকে তা খাইয়ে বললেন আন্না।
‘আপনি আপনার দায়িত্ব ভুলছেন’, ভেস্লোভস্কিও এসে দাঁড়িয়েছিলেন অলিন্দে, তাঁকে ফরাসি ভাষায় বললেন আন্না।
‘মাফ করবেন, ওতে আমার পকেট ভরা’, হেসে ফরাসি ভাষায় উত্তর দিয়ে ওয়েস্ট-কোটের পকেটে আঙুল ঢোকালেন ভেস্লোভস্কি।
কিন্তু আপনি দর্শন দেন বড় দেরি করে’, চিনি খাওয়াবার সময় তাঁর যে হাতটা ঘোড়া লালায় ভিজিয়েছিল সেটা রুমাল দিয়ে মুছতে মুছতে আন্না ফরাসি ভাষায় বললেন। ডল্লিকে জিজ্ঞেস করলেন, ‘এলে কতদিনের জন্যে? একদিনের জন্যে কি? সে হতে পারে না!’
‘তাই বলে এসেছি, তাছাড়া ছেলেমেয়েরা…’ গাড়ি থেকে ব্যাগটা নেওয়া হয়নি আর তিনি বুঝতে পারছিলেন যে তাঁর মুখ অতি ধূলিধূসর। এই দু’কারণেই অস্থিরতা বোধ করে বললেন ডল্লি।
না, ডল্লি লক্ষ্মীটি… সে দেখা যাবে; চল, চল যাই’, আন্না ডল্লিকে নিয়ে গেলেন তাঁর ঘরে।
ভ্রন্স্কি যে জমকালো ঘরের প্রস্তাব দিয়েছিলেন এটা তেমন নয়, বরং এমন যার জন্য ডল্লির কাছে মাপ চেয়ে নিলেন আন্না। কিন্তু মাপ চাইতে হল যে ঘরখানার জন্য, সেটাও এত বিলাসী যাতে ডল্লি থাকেননি কোনদিন। যা তাঁকে মনে করিয়ে দিচ্ছিল বিদেশের সেরা হোটেলগুলোর কথা।
‘কি বলব ভাই, কি যে আনন্দ আমার!’ নিজের রাইডিং-হ্যাবিট পোশাকেই ডল্লির কাছে কিছুক্ষণের জন্য বসে আন্না বললেন, ‘এবার তোমার কথা বল। স্তিভাকে আমি দেখেছিলাম এক ঝলকের জন্যে। কিন্তু ছেলেমেয়েদের কথা ও কিছু বলতে পারেনি। কেমন আছে আমার আদরের তানিয়া? ডাগর হয়ে উঠেছে নিশ্চয়?’
‘হ্যাঁ, বেশ ডাগর’, সংক্ষেপে জবাব দিলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা, নিজেরই তাঁর অবাক লাগল যে নিজের ছেলেমেয়েদের কথা তিনি বলতে পারছেন এত নিরুত্তাপ গলায়। ‘লেভিনদের ওখানে আমরা বেশ ভালো আছি’, যোগ করলেন তিনি।
বললেন আন্না, ‘হ্যাঁ, যদি জানতাম যে, তুমি আমাকে ঘৃণা করছ না… তাহলে তোমরা সবাই আসতে পারতে এখানে; ‘স্তিভা তো আলেক্সেইয়ের পুরানো আর ঘনিষ্ঠ বন্ধু’, তিনি এই কথাটা যোগ করে হঠাৎ লাল হয়ে উঠলেন।
‘কিন্তু আমরা সেখানে বেশ ভালো আছি…’ অস্বস্তিভরে বললেন ডল্লি।
‘হ্যাঁ, অবশ্য আনন্দ থেকে বোকার মত এসব কথা বলছি। শুধু কি খুশি হয়েছি তোমাকে পেয়ে!’ আবার ডল্লিকে চুমু খেয়ে বললেন আন্না। ‘এখনো তুমি বলোনি আমার সম্পর্কে কি তুমি ভাবো অথচ আমি তা সবই জানতে চাই। তবে আমি যেমন, তেমনি অবস্থায় তুমি আমাকে দেখবে, এতে আমি খুশি। আমার কাছে বড় জিনিস, আমি কিছু- একটা প্রমাণ করতে চাই, এমন কথা কেউ যেন না ভাবে। কিছুই প্রমাণ করতে চাই না আমি। শুধু বাঁচতে চাই; নিজের ছাড়া আর কারো অনিষ্ট করতে চাই না। সে অধিকার আমার আছে, তাই না? তবে এটা লম্বা আলাপের ব্যাপার। তার সময় হবে। আমি এবার পোশাক বদলাতে যাই। দাসী পাঠিয়ে দিচ্ছি তোমার জন্যে! ‘
উনিশ
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা একা হয়ে গৃহকর্ত্রীর দৃষ্টিতে ঘরটা দেখতে লাগলেন। বাড়ির কাছে আসতে, তার ভেতর দিয়ে যেতে, এবং এখন নিজের ঘরটায় যা তিনি দেখলেন, সব কিছুতেই একটা প্রাচুর্য, বাবুগিরি এবং হালের সেই ইউরোপীয় বিলাসের ছাপ যার কথা তিনি পড়েছেন কেবল ইংরেজি উপন্যাসে, কিন্তু রাশিয়ায় ও গ্রামে তা দেখেননি কখনো। নতুন ফরাসি ওয়াল-পেপার থেকে শুরু করে সারা ঘর জোড়া গালিচাটা পর্যন্ত সবই নতুন। শয্যায় স্প্রিঙের গদি, বিশেষ ধরনের শিরোধার। ছোট বালিশে সিল্কের ওয়াড়। মার্বেল পাথরের ওয়াশ-স্ট্যান্ড, প্রসাধন টেবিল, সোফা, টেবিল, ফায়ার প্লেসের ওপর ব্রেঞ্জ ঘড়ি, জানালা-দরজার পর্দা—সবই দামী এবং নতুন।
সুন্দর কবরী আর ডল্লির চেয়েও ফ্যাশন-দুরস্ত পোশাকে যে দাসীটি এল পরিচর্যার জন্য। সেও ঘরের সব কিছুর মত নতুন আর দামী। বিনয়, পরিপাটীত্ব আর কাজে লাগার আগ্রহের জন্য তাকে ভালো লেগেছিল দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার, আবার অস্বস্তিও হচ্ছিল; কি পোড়া কপাল যে ভুল করে তাঁর ব্যাগে রাখা হয়েছিল তালি-মারা নাইট- গাউন, দাসীর সামনে এতে লজ্জা হচ্ছিল। যেসব তালি-মারা আর রিফু-রা জায়গাগুলোর জন্য তিনি বড়াই করতেন বাড়িতে, লজ্জা হল তার জন্যই। বাড়িতে খুবই পরিষ্কার ছিল যে, ছয়টা গাউনের জন্য দরকার পঁয়ষট্টি কোপেক দরে চব্বিশ আর্শিন ( আর্শিন : ৭১ সেন্টিমিটারের মত রুশ দৈর্ঘ্যের মাপ ) নানসুক, সেলাই আর ফুল তোলার খরচা বাদে এতে দাঁড়াত পনের রুবলের বেশি, এই পনের রুবলটা বাঁচাতে হত সংসারের খরচা থেকে। কিন্তু দাসীর সামনে এর জন্য শুধু লজ্জা নয়, কেমন যেন অস্বস্তিই বোধ হচ্ছিল।
যখন ঘরে এল তাঁর পূর্বপরিচিত আনুশ্কা, স্বস্তির নিঃশ্বাস ফেললেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা। বিলাসিনী দাসীটির দরকারে পড়েছিল প্রভুপত্নীর কাছে, আনুশ্কা রইল দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার সাথে।
ডল্লি আসায় আনুশ্কা স্পষ্টতই খুবই খুশি হয়েছিলেন যে গুহস্বামিনীর অবস্থা, বিশেষ করে আন্না আর্কাদিয়ে নার জন্য সে খুবই আগ্রগী। কিন্তু ও নিয়ে সে কথা শুরু করা মাত্র ডল্লি থামিয়ে দিচ্ছিলেন তাকে।
‘আমি তো আন্না আর্কাদিয়েভনার সাথে বেড়ে উঠেছি, উনি আমার বড় আপন। বিচার করার আমি কে? আর যখন মনে হচ্ছে এত ভালোবাসছেন…’.
‘সম্ভব হলে এগুলো ধুতে দাও’, ওকে থামিয়ে দিলেন দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা।
‘ঠিক আছে। আমাদের ধোপঘরে দুটো মেয়ে বহাল করা হয়েছে বিশেষ করে এই জন্যেই। আর বিছানার চাদর- টাদর সবই ধোয়া হয় যন্ত্রে। কাউন্ট নিজেই সেটা দেখেন। কি রকম যে স্বামী… ‘
আন্না আসায় আনুশ্কার বকবকানি বন্ধ হতে খুশি হলেন ডল্লি।
আন্না অতি সাধারণ একটা বাতিস্ত ফ্রক পরে এসেছিলেন। মন দিয়ে ডল্লি লক্ষ্য করলেন এই সাধারণ পোশাকটা। তিনি জানতেন এই সহজিয়ার কি অর্থ এবং কি মূল্যে তা অর্জিত হয়।
‘আমার পূর্বপরিচিতা’, আনুশ্কা সম্পর্কে আন্না বললেন।
এখন আর তিনি বিব্রত বোধ করছিলেন না। এখন তিনি পুরোপুরি সুস্থির, সাবলীল। ডল্লি দেখতে পেলেন যে তাঁর আসায় আন্নার যে প্রতিক্রিয়া হয়েছিল, সেটা এখন তিনি পুরোপুরি কাটিয়ে উঠে এমন একটা বাহ্যিক নিরাসক্তির সুর অবলম্বন করলেন যাতে বোঝা যায় যে-প্রকোষ্ঠে তাঁর হৃদয়াবেগ ও আন্তরিক ভাবনাগুলো আছে তার দরজা বন্ধ।
‘তোমার মেয়েটা কেমন আছে?’ জিজ্ঞেস করলেন ডল্লি।
‘আনি?’ (মেয়ে আন্নাকে তিনি ঐ নামে ডাকতেন।) ‘ভালো আছে। মোটা হয়েছে খুব। দেখবে ওকে? চল যাই, তোমাকে দেখাই। ভয়ানক ঝামেলা গেছে আয়া নিয়ে’, বলতে শুরু করলেন উনি, ‘একটি ইতালীয় মেয়ে ছিল স্তন্যদাত্রী। এমনিতে ভালো, কিন্তু একেবারে হাঁদা! ভেবেছিলাম ছাড়িয়ে দেব। কিন্তু মেয়েটা ওর বড় ন্যাওটা হয়ে পড়েছে, তাই রেখেছি এখনো।’
‘কিন্তু কি ঠিক করলে?…’ মেয়েটার উপাধি কি হবে সে বিষয়ে প্রশ্ন করতে যাচ্ছিলেন ডল্লি; কিন্তু আন্নার মুখে ভ্রুকুটি দেখে প্রশ্নটার অর্থ পালটিয়ে দিলেন, ‘তা কি ঠিক করেছ? মাই ছাড়িয়েছ নাকি?’
কিন্তু আন্না বুঝেছিলেন।
‘তুমি তো সে কথা জিজ্ঞেস করতে চাইছিলে না? তুমি তো ওর উপাধি সম্পর্কে জানতে চাইছিলে? তাই না? আলেক্সেই-এর সেই কষ্ট। ওর কোন উপাধি নেই। মানে, ও কারেনিনা’, আন্না বললেন চোখ এতটা কুঁচকে যে দেখা যাচ্ছিল কেবল জুড়ে আসা আঁখি পদ্ম; ‘তবে’, হঠাৎ উদ্ভাসিত হয়ে উঠল মুখমণ্ডল, এ নিয়ে কথা বলব পরে। চল, তোমাকে দেখাব ওকে। সে ভারী মিষ্টি! এর মধ্যেই হামাগুড়ি দিতে শিখেছে।’
যে বিলাসোপকরণ বাড়ির সর্বত্র অভিভূত করছিল দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে, তা আরো অভিভূত করল শিশুকক্ষে। এখানে ছিল ইংলন্ড থেকে আনানো গাড়ি, হাঁটতে শেখাবার সাজ-সরঞ্জাম, হামাগুড়ি দেবার জন্য বিলিয়ার্ড টেবিলের মত করে ঢেলে সাজা সোফা, দোলনা, গোসলের জন্য বিশেষ ধরনের টব। জিনিসগুলো সবই বিলাতি, মজবুত আর বোঝাই যায় যে বেশ দামী। ঘরটা বড়, খুবই উঁচু আর আলো-খেলানো।
ওঁরা যখন ঘরে ঢুকলেন, শুধু একটা কামিজ পরে চেয়ার-টেবিলে বসে ক্বাথ খাচ্ছিল মেয়েটা, সে পানীয়ে বুক তার ভেসে যাচ্ছিল। ওকে খাওয়াচ্ছিল এবং বোঝা যায় সেই সাথে নিজেও খাচ্ছিল শিশুকক্ষের পরিচারিকা একটি রুশী মেয়ে। স্তন্যদাত্রী বা আয়া, কেউই ছিল না। ওরা ছিল পাশের ঘরে, সেখান থেকে ভেসে আসছিল বিচিত্র এক ফরাসি ভাষায় তাদের আলাপ–শুধু এই ভাষাতেই আদান-প্রদান চলতে পারত তাদের মধ্যে।
আন্নার গলা শুনতে পেয়ে তাড়াতাড়ি করে ঘরে ঢুকল ঢ্যাঙামত, সাজগোজ করা এক ইংরেজ মহিলা, তার অসুন্দর মুখটায় একটা কপট ছায়া, সোনালি চুলের কুণ্ডলীগুলো ঝাঁকিয়ে তখনই সে কৈফিয়ৎ দিতে শুরু করল যদিও আন্না কোন দোষ দেননি তাকে। আন্নার প্রতিটি শব্দে বারকয়েক করে সে ইংরেজিতে বলছিল, ‘জ্বি হ্যাঁ, কর্ত্রী।’
আগন্তুকের দিকে কঠোর দৃষ্টিতে তাকালেও কালো-ভুরু, কালো-চুল, লালচে-গাল খুকিটিকে বড় ভালো লাগল দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার। তারা রাঙা দেহখানায় টান টান হয়ে আছে মুরগির চামড়ার মত চামড়া; তার সুস্থ চেহারার
জন্য এমন কি হিংসাই হল ডল্লির। খুকি যেভাবে হামাগুড়ি দিচ্ছিল, সেটাও তাঁর ভারি ভালো লাগল। তাঁর নিজের ছেলেমেয়েদের কেউই অমন হামাগুড়ি দিতে পারেনি। খুকিটির পোশাক পেছন দিকে টেনে তুলে যখন তাকে বসিয়ে দেওয়া হল গালিচার ওপর, আশ্চর্য সুন্দর লাগছিল তাকে। ছোট্ট একটা জন্তুর মত সে তার জ্বলজ্বলে কালো চোখ মেলে চাইছিল বড়দের দিকে, তাকে যে লোকে মুগ্ধ হয়ে দেখছে, এতে স্পষ্টতই আনন্দ হচ্ছিল তার। হেসে দু’পাশে দু’পা রেখে সে ঝট করে হাতে ভর দিয়ে দ্রুত পাছাটা তুলল এবং আবার হাত দিয়ে সামনে এগিয়ে গেল।
কিন্তু শিশুকক্ষের সাধারণ আবহাওয়া, বিশেষ করে ইংরেজ মহিলাটিকে ভালো লাগেনি দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনার। লোকজন সম্বন্ধে আন্নার যথেষ্ট বুদ্ধিশুদ্ধি থাকা সত্ত্বেও তিনি যে এমন এক কুরূপা, অশ্রদ্ধেয়া ইংরেজ মহিলাকে রেখেছেন নিজের কাছে ডল্লি তার ব্যাখ্যা করে নিলেন এই ধরে নিয়ে যে আন্নার মত এমন বিশৃঙ্খল পরিবারে ভালো আয়া আসবে না। তাছাড়া তখনই কতকগুলি কথা থেকে দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনা বুঝলেন যে আন্না, স্তন্যাদত্রী, আয়া আর শিশুটির মধ্যে বনিবনাও নেই এবং শিশুকক্ষে মায়ের আগমন অতি অসাধারণ একটা ব্যাপার। আন্নার ইচ্ছে হয়েছিল খুকিকে খেলনা দেবেন, কিন্তু খুঁজে পেলেন না সেটা।
তবে সবচেয়ে তাজ্জব ব্যাপার এই যে, খুকির ক’টা দাঁত উঠেছে এ প্রশ্নের ভুল জবাব দিলেন আন্না, শেষ দুটো দাঁতের কথা একেবারেই জানতেন না তিনি।
‘আমি এখানে নিষ্প্রয়োজন, তা দেখে মাঝে মাঝে কষ্ট হয় আমার’, শিশুকক্ষ থেকে বেরোবার সময় দরজার কাছে পড়ে থাকা কোন খেলনা এড়িয়ে যাবার জন্য পোশাকের লুটিয়ে যাওয়া পুচ্ছাংশ তুলে ধরে আন্না বললেন, ‘আমার প্রথম সন্তানটির বেলায় এমনটা হয়নি।’
‘আরে না! জানো তো আমি ওকে, সেরিওজাকে দেখে এসেছি’, এমনভাবে চোখ কুঁচকে আন্না বললেন যেন অনেক দূরের কিছু-একটা দেখছেন, ‘তবে সে পরে হবে। জানো তুমি, আমি ঠিক সেই বুভুক্ষুর মত যার সামনে হঠাৎ পুরো একটা ভোজ রাখা হয়েছে আর সে ভেবে পাচ্ছে না কোনটা দিয়ে শুরু করবে। পুরো ভোজটা হল তুমি আর তোমার সাথে আমার যেসব কথাবার্তা হবে, যা আর কাউকে আমি বলতে পারিনি; অথচ ভেবে পাচ্ছি না শুরু করব কোনটা দিয়ে। একটুও দয়া করব না তোমাকে। সব কিছু বলতে হবে আমাকে। হ্যাঁ, যে সমাজটা আমাদের এখানে দেখতে পাবে, তার একটা নক্শা তোমার জন্যে আঁকা দরকার’, আন্না শুরু করলেন; মহিলাদের দিয়ে শুরু করা যাক। প্রিন্সেস ভারভারা। ওঁকে তো তুমি চেনো, ওঁর সম্পর্কে তোমার আর স্তিভার মতামত কি তাও আমি জানি। স্তিভা বলে যে ওঁর জীবনের একমাত্র উদ্দেশ্য হল কাতেরিনা পাভলোভনা চাচির চেয়ে তিনি কত ভালো সেটা দেখানো। তা সত্যি, কিন্তু ওঁর মনটা ভালো; আমি ওঁর কাছে ভারি কৃতজ্ঞ। পিটার্সবুর্গে এমন একটা সময় এসেছিল যখন আমার প্রয়োজন হয় একজন সহচরী, এক্ষেত্রে তিনি সাহায্য করেন। সত্যি, ভালোমানুষ উনি। আমার অবস্থাটা তিনি হালকা করে দেন অনেক। ওখানে, পিটার্সবুর্গে… আমার অবস্থাটা যে কত দুঃসহ তা তুমি বুঝছ না-উনি অভিজাতপ্রমুখ এবং খুবই সজ্জন লোক, কিন্তু আলেক্সইে-এর কাছ থেকে কি যেন একটা চাইছেন। বুঝতে পারছ তো, গাঁয়ে বাসা পাতার পর সম্পত্তির কারণে আলেকসেই এখন মফস্বলে খুবই প্রভাবশালী লোক। তারপর তুশকেচি, তুমি দেখেছ ওঁকে, ছিলেন বেত্সির ওখানে। এখন কিন্তু বেত্সি ওঁকে ছেড়ে দিয়েছেন, উনিও চলে এলেন আমাদের কাছে। আলেক্সেই যা বলে, উনি তেমনি একজন লোক যারা নিজেদের যেভাবে দেখাতে চায়, সেভাবেই তাদের ধরা হলে খুবই প্রীতি লাভ করে। তাছাড়া, অতি ভব্য লোক। যা বলেন প্রিন্সেস ভারভারা। তারপর ভেস্লোভস্কি -ওকে তো তুমি চেনো, চমৎকার ছেলে’, শয়তানি হাসিতে কুঞ্চিত হয়ে উঠল তাঁর ঠোঁট; কিন্তু কি এই ক্ষ্যাপা কাণ্ডটা করল লেভিন? ভেস্লোভস্কি গল্প করেছে আলেক্সেই-এর কাছে, কিন্তু আমাদের বিশ্বাস হচ্ছে না। উনি অতি মধুর স্বভাবের লোক এবং খুবই সরল।’ আন্না বললেন আবার সেই হাসি নিয়ে। পুরুষদের চাই আমোদ-প্রমোদ আর আলেক্সেই-এর দরকার লোকজন, সেই জন্যেই এঁদের আমি কদর করি। আমাদের এখানে চলুক ফুর্তি, সব থাক হাসি-খুশি, যাতে নতুন কোন কিছুর জন্যে আলেক্সেই-এর মন কেমন না করে। তারপর আমাদের গোমস্তাকে দেখতে পাবে। জার্মান কিন্তু ভারি ভালো, নিজের কাজটা বেশ বোঝে। আলেকসেই ওর খুবই কদর করে। তারপর ডাক্তার, অল্পবয়সী, একেবারে নিহিলিস্ট বলব না, তবে খাবার খায় ছুরি দিয়ে… কিন্তু খুব ভালো ডাক্তার। তারপর স্থপতি… ছোট্ট একটা দরবার।