দশ
ভাসেকা ঘোড়াগুলোকে এমন জোর হাঁকিয়েছিলেন যে জলায় তাঁরা বড় বেশি আগেই এসে পড়েন, ফলে তখনো গরম যায়নি।
তাঁদের যাত্রার যা প্রধান লক্ষ্য, বিস্তীর্ণ এই জলাটার কাছে আসতে আসতে লেভিন অজ্ঞাতসারেই ভাবছিলেন কি করে ভাসেন্কার কাছ থেকে রেহাই পেয়ে অবাধে হাঁটা যায়। স্পষ্টতই অব্লোন্স্কিও তাই চাইছিলেন। লেভিন তাঁর মুখে দেখলেন দুশ্চিন্তার ছাপ, শিকার শুরুর আগে সত্যিকার শিকারীদের ক্ষেত্রে যা দেখা যায়, দেখলেন তাঁর স্বভাবসিদ্ধ খানিকটা সেই ধূর্ততা।
‘কিভাবে আমরা যাব? জলা চমৎকার, তা দেখতে পাচ্ছি, বাজপাখিও আছে’, হোগলাগুলোর ওপর ভাসমান দুটো বড় বড় পাখি দেখিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘যেখানে বাজপাখি আছে, সেখানে শিকারও থাকবে নিশ্চয়। ‘
‘হ্যাঁ, ওই দেখুন আপনারা’, খানিকটা বিমর্ষ মুখে হাই-বুট টেনে, বন্দুকের লক পরীক্ষা করে লেভিন বললেন, ‘ওই হোগলা ঝাড়টা দেখতে পাচ্ছেন? নদীর ডান দিক বরাবর বিশাল এক আধ-কাটা ঘাসের স্যাঁৎসেঁতে মাঠে কালোয় সবুজে গাঢ় হয়ে আসা হোগলার একটা চর দেখিয়ে তিনি বললেন, ‘জলা শুরু হচ্ছে এখান থেকে, সোজা আমাদের সামনে। ঐ যে, যে-জায়গাটা বেশি সবুজ। এখান থেকে তা গেছে ডাইনে, যেখানে ঘোড়া চরছে; সেখানে ঘাসের চাপড়াগুলোর মধ্যে বড় স্নাইপ থাকে, আর তা চলে গেছে গোটা হোগলা বন ঘিরে, সোজা অ্যালডার ঝোপ আর মিল পর্যন্ত। আর ঐ দেখুন, যেখানে খাঁড়িটা রয়েছে। এটা সবচেয়ে ভালো জায়গা। একবার ওখানে আমি সতেরটা স্নাইপ মারি। কুকুর নিয়ে আমরা ভিন্ন ভিন্ন দিকে চলে গিয়ে মিলব মিলটার ওখানে।
‘তাহলে কে ডানে যাবে, কে বাঁয়ে?’ জিজ্ঞেস করলেন অব্লোন্স্কি। ‘ডানের দিকটা চওড়া, আপনারা দুজনে যান, আমি বাঁয়ে’, তিনি বললেন এমনভাবে যেন ব্যাপারটা কিছুই নয়।
‘চমৎকার! আমরা ওঁকে হারিয়ে দেব। চলুন যাই, চলুন!’ কথাটা লুফে নিলেন ভাসেকা।
রাজি না হয়ে লেভিন পারলেন না, দু’ভাগ হলেন ওঁরা।
জলায় পা দেওয়া মাত্র দুটো কুকুরই শুঁকতে শুঁকতে ছুটল একটা জায়গার দিকে, পানি যেখানে মরচে রঙা। লাস্কার এই সাবধান অনির্দিষ্ট অনুসন্ধান লেভিনের জানা; জায়গাটাও তিনি চিনতেন এবং আশা করছিলেন যে উঠবে এক ঝাঁক পাখি।
‘ভেস্লোভস্কি, আমার পাশে পাশে আসুন, পাশে পাশে!’ পেছনে পানি ছপছপ করে হাঁটছেন যে সঙ্গীটি, তাঁকে বললেন লেভিন আড়ষ্ট গলায়, কলপেনস্কি জলায় সেই আচমকা গুলিটার পর তাঁর বন্দুকের নল কোন দিকে ঘোরানো সেটায় অজ্ঞাতসারেই আগ্রহী হয়ে উঠেছিলেন লেভিন।
‘না, আমি আপনার বাধা হয়ে থাকব না, ভাববেন না আমাকে নিয়ে।’
কিন্তু আপনার থেকেই লেভিনের ভাবনা হচ্ছিল, মনে পড়ল বিদায় দেবার সময় কিটির কথাটা : ‘দেখো, দুজন দুজনকে গুলি করে বসো না যেন।’ একে অপরকে এড়িয়ে, প্রত্যেকেই নিজ নিজ সূত্র ধরে কাছিয়ে আসছিল কুকুর দুটো; স্নাইপের প্রতীক্ষাটা ছিল এতই প্রবল যে মরচে রঙা জলা থেকে টেনে তোলা মচমচ শব্দটা লেভিনের মনে হচ্ছিল স্নাইপের ডাক, বন্দুক বাগিয়ে ধরলেন তিনি।
‘গুম, গুম!’ শোনা গেল একেবারে কানের কাছেই। জলা থেকে উঠে একঝাঁক হাঁস উঁচুতে পাল্লার অনেক বাইরে উড়ে আসছিল শিকারীদের দিকে, ভাসেকা গুলি করেছেন তাদের। লেভিন ফিরে তাকাতে না তাকাতেই ফুরুৎ করে বেরোল একটা, দুটো, তিনটা, একের পর এক আরো আটটা স্নাইপ।
একটা পাখি তার আঁকাবাঁকা ওড়া শুরু করার মুহূর্তেই তাকে ঘায়েল করলেন অব্লোন্স্কি, একটা দলার মত ঝুপ করে সে পড়ল জলায়। নিচুতে হোগলা বনের দিকে উড়ে যাচ্ছিল আরেকটা পাখি। তাড়াহুড়ো না করে অব্লোন্স্কি তাক করলেন, গুলির শব্দের সাথে সাথে পাখিটাও পড়ে গেল; দেখা যাচ্ছিল কেটে ফেলা হোগলা মাঠে কিভাবে সে তার একটা অক্ষত, নিচের দিকে সাদা রঙের ডানা ঝাপটিয়ে লাফাচ্ছে।
লেভিন তেমন সৌভাগ্যবান হননি : প্রথম স্নাইপটাকে তিনি গুলি করেন বড় বেশি কাছ থেকে এবং গুলি ফসকে যায়; পাখিটা ওপরে উঠতে শুরু করলেন তার দিকে তাক করছিলেন, এমন সময় আরো একটা তাঁর পায়ের কাছ থেকে উড়ে গিয়ে মনোযোগ বিক্ষিপ্ত করল, ফস্কালেন দ্বিতীয়বার
বন্দুকে যখন আবার গুলি ভরা হচ্ছিল, আরো একটা স্নাইপ উড়ল। ভেস্লোভস্কির গুলি ভরা ইতিমধ্যে শেষ হয়ে যাওয়ায় পানির ওপর তিনি ছররা গুলি চালালেন দু’বার। অব্লোন্স্কি তাঁর স্নাইপ দুটো জোগাড় করে জ্বলজ্বলে চোখে চাইলেন লেভিনের দিকে।
‘এবার ভাগাভাগি হওয়া যাক’, এই বলে অব্লোন্স্কি বাঁ পায়ে খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে বন্দুক বাগিয়ে শিস দিয়ে ডাকলেন তাঁর কুকুরকে এবং চললেন একদিক ধরে। লেভিন আর ভেস্লোভস্কি গেলেন অন্যদিকে।
প্রথম গুলিটা ফসকালে লেভিন সব সময়ই উত্তেজিত হয়ে রেগে উঠতেন আর সারা দিনটাই তাঁর বন্দুক চলতো বাজে। আজকেও তাই হল। স্নাইপ দেখা গেল অনেক। কুকুরের পায়ের কাছ থেকে, শিকারীদের পায়ের কাছ থেকে অবিরাম উড়ে যেতে থাকল পাখিগুলো, ফলে লেভিন তাঁর লোকসান পুষিয়ে নিতে পারত; কিন্তু যত বেশি তিনি গুলি করলেন তত বেশি তাঁর মাথা হেঁট হল ভেস্লোভস্কির কাছে, যিনি পাল্লার মধ্যে হোক, বাইরে হোক ফুর্তিতে গুলি চালিয়ে যাচ্ছিলেন, কিছুই মারা পড়ছিল না এবং তাতে বিব্রত বোধ করছিলেন না একটুও। লেভিন তাড়াহুড়া করছিলেন, ধৈর্য ধরতে পারছিলেন না, ক্রমেই উত্তেজিত হয়ে এমন পর্যায়ে পৌঁছলেন যে গুলি করতে লাগলেন পাখি মারার আশা না রেখে। মনে হল লাস্কা যেন সেটা বুঝেছে। পাখি খজতে লাগল সে আরও আলস্যে, শিকারীদের দিকে তাকাতে থাকল হতবুদ্ধি অথবা ভর্ৎসনার দৃষ্টিতে। গুলি চলছিল একের পর এক। শিকারীদের ঘিরে রইল বারুদের ধোঁয়া, অথচ লেভিনের প্রকাণ্ড, প্রশস্ত থলেটায় মাত্র তিনটা শোচনীয় ছোট স্নাইপ। তাও তার একটা মেরেছে ভেস্লোভস্কি, অন্যটা পড়েছে দুজনেরই গুলিতে। তবে জলার অন্যদিকে শোনা যাচ্ছিল অব্লোন্স্কির ঘন ঘন নয়, তবে লেভিনের মনে হচ্ছিল মোক্ষম গুলির শব্দ আর প্রায় প্রতিটি গুলির পরেই কানে আসছিল : ‘ক্রাক, ক্রাক, নিয়ে আয়!’
সেটা আরো বেশি ব্যাকুল করছিল লেভিনকে। হোগলা ঝোপের ওপর অবিরাম উড়ছিল স্নাইপগুলো। মাটিতে তাদের ফুরুৎ করে বেরোবার শব্দ আর আকাশে ক্রেঙ্কার ডাক থামছিল না, শোনা যাচ্ছিল তা চারদিক থেকে। যে স্নাইপগুলো আগে থেকে উড়ছিল, তারা মাটিতে বসে পড়ছিল শিকারীদের সামনেই। দুটো বাজপাখির বদলে এখন কয়েক ডজন চিঁচিঁ করে উড়ছিল জলার ওপর
জলার আধখানার বেশি পাড়ি দিয়ে আসার পর লেভিন আর ভেস্লোভস্কি পৌঁছলেন সেই জায়গাটায় যেখানে হোগলা বনে এসে পড়া লম্বা লম্বা ফালিতে ভাগ করা হয়েছে চাষীদের ঘেসো জমি, কোথাও সীমা টানা হয়েছে ঘাস পায়ে দলে, কোথাও কেটে। এসব ফালির ঘাস অর্ধেকই কাটা হয়ে গিয়েছিল।
যেমন ঘাস কেটে ফেলা জায়গায়, তেমনি না-কাটা জায়গাতেও শিকার মেলার আশা না থাকলেও লেভিন অব্লোন্স্কিকে কথা দিয়েছিলেন যে ওঁর সাথে মিলিত হবেন, তাই দু’রকম জায়গা দিয়েই তিনি এগিয়ে চললেন সঙ্গীকে নিয়ে।
‘ওহে শিকারী ভেয়েরা!’ ঘোড়া খুলে রাখা একটা গাড়ির কাছে বসে থাকা একদল চাষীর মধ্যে থেকে একজন ডাকলে তাঁদের। ‘এসো আমাদের সাথে ভোজন হবে! মদও খাব!’
লেভিন এদিক-ওদিক তাকালেন।
‘এসো, এসো, ডর নাই গো!’ ধবধবে সাদা দাঁত কেলিয়ে রোদ্দুরে ঝকমকে একটা সবুজ বোতল তুলে চেঁচালে রক্তিমানন ফুর্তিবাজ দেড়েল একজন চাষী।
ভেস্লোভস্কি ফরাসি ভাষায় জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি ওরা বলছে?’
‘ভোদ্কা খেতে ডাকছে। ওরাই বোধ হয় ঘেসো মাঠটা ভাগ করেছে। আমি আপত্তি করব না’, লেভিন বললেন একটু চালাকি না করে নয়, আশা করছিলেন যে ভোদ্কার কথায় প্রলুব্ধ হয়ে ভেস্লোভস্কি যাবেন ওদের কাছে।
‘কিন্তু আমাদের নিমন্ত্রণ করছে কেন?’
‘এমনি, ফুর্তি করতে। সত্যি, যান ওদের কাছে। মজা পাবেন।’
‘চলুন যাই, কৌতূহলের ব্যাপার।’
‘যান, যান, মিলে যাবার পথ আপনি খুঁজে পাবেন!’ লেভিন বললেন চেঁচিয়ে আর খুশি হয়ে চেয়ে দেখলেন যে ভেস্লোভস্কি কুঁজো হয়ে, ক্লান্ত পায়ে হোঁচট খেতে খেতে বন্দুক তুলে ধরে জলা থেকে বেরিয়ে যাচ্ছেন চাষীদের কাছে।
‘তুমিও এসো গো!’ লেভিনের উদ্দেশে চ্যাঁচাল একজন চাষী, ‘ডর কি! পিঠে খেয়ে দেখবে!’
লেভিনের ভয়ানক ইচ্ছে হচ্ছিল এক টুকরো রুটি আর ভোদ্কা খেতে। জেরবার হয়ে পড়েছিলেন তিনি, টের পাচ্ছিলেন যে কাদায় বসে যাওয়া পা তুলতে হচ্ছে কষ্ট করে, মুহূর্তের জন্য তিনি দ্বিধায় পড়লেন। কিন্তু কুকুর ওদিকে দাঁড়িয়ে পড়ল। সমস্ত ক্লান্তি অন্তর্ধান করল তৎক্ষণাৎ, কাদা ভেঙে অনায়াসে লেভিন গেলেন কুকুরের কাছে। তাঁর পায়ের কাছ থেকে উড়ে গেল একটা স্নাইপ; লেভিন গুলি করে মারলেন সেটাকে—কুকুর কিন্তু দাঁড়িয়েই রইল। ‘নে!’ কুকুরের কাছ থেকে উঠল আরেকটা। লেভিন গুলি করলেন। কিন্তু দিনটা ছিল অপয়া, গুলি ফসকে গেল। আর যেটাকে মারা গিয়েছিল, খুঁজতে গিয়ে সেটাকেও পেলেন না। গোটা হোগলা ঝোপটা তিনি মাড়ালেন, কিন্তু লাস্কার বিশ্বাস হচ্ছিল না যে তিনি মারতে পেরেছেন, তাই লাস্কাকে যখন খুঁজতে ডাকলেন, সে ভান করল যেন খুঁজছে, কিন্তু খুঁজছিল না।
নিজের সমস্ত অসাফল্যের জন্য তিনি দায়ী করেছিলেন ভেস্লোভস্কিকে, কিন্তু তিনি না থাকাতেও উন্নতি হল না অবস্থার। এখানেও স্নাইপ অনেক, কিন্তু একের পর এক গুলি তাঁর ফসকাল।
সূর্যের তীর্যক রোদে গরম তখনো বেশি। ঘামে ভিজে জবজবে জামা এঁটে বসেছে গায়ের সাথে; পানিতে ভরা বাঁ দিকের বুটটা ভারি হয়ে উঠে প্রতি পদে পচ্পচ্ করে উঠছে; বারুদের থিতানিতে নোংরা মুখ বেয়ে গড়াচ্ছে বিন্দু বিন্দু ঘাম; মুখটা তেতো, নাকে বারুদ আর মরচের গন্ধ; কানে স্নাইপের ক্ষান্তিহীন ফুরুৎ শব্দ; বন্দুকের নল এত গরম যে ছোঁয়া যায় না; বুকের স্পন্দন ঘন ঘন, সংক্ষিপ্ত; উত্তেজনায় হাত কাঁপছে, হোঁচট খাচ্ছে ক্লান্ত পা, জড়িয়ে যাচ্ছে ঘাসের চাপড়ায় আর কাদায়; তাহলেও এগিয়ে গেলেন তিনি, গুলি করে চললেন। শেষ পর্যন্ত লজ্জাকর একটা ব্যর্থতার পর টুপি আর বন্দুক তিনি ছুঁড়ে ফেললেন মাটিতে।
‘না, আত্মস্থ হতে হবে!’ নিজেকে বললেন তিনি। টুপি আর বন্দুক তুলে নিয়ে তিনি লাস্কাকে নিজের কাছে ডাকলেন এবং বেরিয়ে এলেন জলা থেকে। শুকনো ডাঙায় এসে তিনি বসলেন একটা চাঙড়ের ওপর, জুতা খুললেন, বাঁয়ের বুট থেকে পানি ঢেলে ফেললেন, তারপর গেলেন জলায়, মরচের স্বাদ মাখা পানি খেলেন পেট পুরে, বন্দুকের আতপ্ত নল দুটোকে ঠাণ্ডা করলেন পানি মাখিয়ে আর নিজের হাত মুখ ধুলেন। তাজা হয়ে তিনি আবার গেলেন সেই জায়গাটায় যেখানে স্নাইপটা এসে বসেছে, দৃঢ় সংকল্প করলেন যে উত্তেজিত হবেন না।
ভেবেছিলেন সুস্থির থাকবেন, কিন্তু দাঁড়াল সেই একই। পাখিটাকে নিশানা করার আগেই আঙুল তাঁর ঘোড়া টিপে বসল। ব্যাপার গড়াল কেবলই খারাপের দিকে।
যে অ্যালডার ঝোপটার কাছে অব্লোন্স্কির সাথে তাঁর মেলার কথা, জলা থেকে উঠে সেখানে যখন তিনি গেলেন, তখন তাঁর থলেতে মাত্র পাঁচটা পাখি।
অব্লোন্স্কিকে দেখার আগেই তিনি দেখতে পেলেন তাঁর কুকুরকে।
অ্যালডারের পাকানো পাকানো শিকড়ের তল থেকে সে লাফিয়ে এল, জলার দুর্গন্ধ-ভরা পাঁকে সর্বাঙ্গ তার কালো, বিজয়ীর ভঙ্গিতে শুঁকল লাস্কাকে। ক্রাকের পরে অ্যালডার গাছের ছায়ায় দেখা দিল অব্লোন্স্কির দর্শনধারী মূর্তি। রক্তিম মুখে, ঘর্মাক্ত কলেবরে বোতাম খোলা গলায় আগের মতই খোঁড়াতে খোঁড়াতে তিনি এগিয়ে এলেন লেভিনের দিকে।
‘কি? অনেক মেরেছ?’ ফুর্তিতে হেসে জিজ্ঞেস করলেন তিনি।
‘আর তুমি?’ লেভিন শুধালেন। কিন্তু শুধাবার কিছু ছিল না, কেননা দেখতে পাচ্ছিলেন যে শিকারের থলেটা ভরা।
‘মন্দ নয়।‘
চৌদ্দটি স্নাইপ পেয়েছেন তিনি।
‘চমৎকার জলা! তোমার নিশ্চয় অসুবিধা ঘটিয়েছে ভেস্লোভস্কি। দুজন শিকারী, একটা কুকুর-এ ঠিক চলে না’, নিজের বিজয়কে নামিয়ে আন্নার জন্য বললেন অব্লোন্স্কি।
এগারো
লেভিন যে চাষীর বাড়িতে সব সময় আস্তানা গাড়তেন, অব্লোন্স্কির সাথে সেখানে যখন তিনি পৌঁছলেন, দেখা গেল ভেস্লোভস্কি ইতিমধ্যেই এসে গেছেন সেখানে। কুটিরের মাঝখানে দুই হাতে বেঞ্চি ধরে ছিলেন তিনি, আর গৃহকর্ত্রীর ভাই, জনৈক সৈনিক তাঁর পাঁক ভরা হাই-বুট টেনে খুলছিল। হাসছিলেন তিনি তাঁর সংক্রামক ফুর্তির হাসি।
‘আমি এইমাত্র এসেছি। চমৎকার লোক। ভেবে দেখুন, আমাকে ওরা খাওয়াল, পান করাল। কি রুটি, অপূর্ব! সুস্বাদু! আর ভোদ্কা—এর চেয়ে ভালো জিনিস আমি আর কখনো খাইনি! কিন্তু কিছুতেই পয়সা নিতে চাইল না। কেন জানি কেবলি বলল, ‘কড়া চোখে চেয়ো না গো’।’
‘পয়সা লেবে কেনে? ওরা আপনাকে মানে মান্য করল। ওদের ভোদকা কি আর বেচার জন্য?’ কালো হয়ে আসা মোজা আর ভেজা বুট শেষ পর্যন্ত টেনে বার করে বলল সৈনিক
শিকারীদের বুটের কাদা আর কুকুরদের গা চেটে তুলতে থাকায় নোংরা কুটিরের পাঁক, ঘরভরা জলা আর বারুদের গন্ধ, এবং ছুরি-কাঁটার অভাব সত্ত্বেও শিকারীরা চা খেলেন, রাতের খাবার সারলেন এমন তৃপ্তিতে যা সম্ভব কেবল শিকারে। গা-হাত-পা ধুয়ে পরিষ্কার-পরিচ্ছন্ন হয়ে তাঁরা গেলেন ঝাড় দেওয়া বিচালি গোলায়, সহিসেরা যেখানে সাহেবদের জন্য বিছানা করে রেখেছিল।
অন্ধকার হয়ে এলেও শিকারীদের কারো ইচ্ছে হচ্ছিল না ঘুমাবার।
গুলি চালনা, কুকুর, আগেকার শিকার ইত্যাদির স্মৃতি ও কাহিনীর মধ্যে দোল খেয়ে আলাপটা চলল তাঁদের সবাকার আগ্রহজনক প্রসঙ্গ নিয়ে। এরকম নিশা যাপনের মধুরতা, বিচালির সুগন্ধ, ভাঙা গাড়ির (ওঁর মনে হয়েছিল ভাঙা, যদিও শুধু খুলে নেওয়া হয়েছিল সামনের চাকা দুটো) অপূর্বতা, তাঁকে ভোদ্কা খাইয়েছিল যে চাষীরা তাদের সদাশয়তা, নিজ নিজ কর্তার পায়ের কাছে পড়ে থাকা কুকুর ইত্যাদি নিয়ে ইতিমধ্যেই কয়েকবার পুনরুক্ত ভাসেকার উচ্ছ্বাস উপলক্ষে অব্লোন্স্কি বললেন মালতুসের ওখানে তাঁর শিকারের অপরূপ কাহিনী। গত বছর গ্রীষ্মে সেখানে গিয়েছিলেন তিনি। মালতুস রেলপথের নামকরা একজন মালিক। অব্লোন্স্কি বললেন ভের গুবের্নিয়ায় কি রকম জলা কিনেছেন মালতুস, কিভাবে তা আগলে রাখছেন এবং কিসব গাড়ি আর ডগ্-কার্টে শিকারীদের নিয়ে যাওয়া হয়েছিল আর জলার কাছে খাটানো হয়েছিল কেমন তাঁবু আর সেখানে ছিল কত খাবার।
‘তোমাকে আমি বুঝি না’, নিজের তৃণশয্যা থেকে মাথা তুলে বললেন লেভিন; ‘এসব লোকদের কেন তোমার খারাপ লাগে না বুঝি না। লাফিত সহযোগে প্রাতরাশ যে খুবই উপাদেয় তা বুঝি, কিন্তু ঠিক এই বিলাসটাই কি তোমার বিছছিরি লাগে না? এসব লোকেরা আমাদের আগেকার ঠিকা-জমিদারদের মত টাকা কামায় এমনভাবে যে কামাবার সময় লোকের ঘৃণার পাত্র হলেও সে ঘৃণা উপেক্ষা করে আর পরে অসাধু উপায়ে অর্জিত টাকায় আগেকার সে ঘৃণা কিনে নেয়।’
‘ঠিক বলেছেন!’ সায় দিলেন ভাসেকা ভেস্লোভস্কি, ‘ঠিক, ঠিক! অবশ্য অব্লোন্স্কি এটা করছেন ভালো মনে, কিন্তু অন্যেরা তো বলবে যে অব্লোন্স্কিও ভিড়ল।’
‘মোটেই না’, লেভিন টের পাচ্ছিলেন যে তাঁর এই কথায় অব্লোন্স্কি হাসছেন, ‘ধনী কোনো বেনিয়া বা অভিজাতের চেয়ে ওঁকে বেশি অসাধু বলে আমি মনে করি না। এরা আর ওরা টাকা করেছে একই রকম খেটে আর মাথা খাটিয়ে।’
‘কিন্তু কি খাটুনি? একটা পারমিট পেয়ে অন্যকে সেটা বেচে দেওয়া কি খাটুনি হল?’
‘অবশ্যই খাটুনি। এই অর্থে খাটুনি যে উনি বা ওঁর মত লোক না থাকলে রেলপথই হত না।’
‘কিন্তু এ খাটুনি তো চাষী-মজুর বা বুদ্ধিজীবীর মত নয়।’
‘মানলাম, কিন্তু তাঁর ক্রিয়াকলাপ ফল দিচ্ছে—রেলপথ। তবে তুমি তো মনে কর রেলপথ অনাবশ্যক।’
‘না, এটা অন্য প্রশ্ন। আমি মানতে রাজি যে রেলপথের প্রয়োজন আছে, কিন্তু যে টাকাটা খাটুনির সমানুপাতিক নয় তা কামনো অসাধু।’
‘কিন্তু সমানুপাতটা স্থির করবে কে?’
‘অসাধু পন্থায়, কলা-কৌশলে’, সাধু আর অসাধুর মধ্যে যে স্পষ্ট সীমারেখা টানতে পারছেন না তা অনুভব করেই লেভিন বললেন, ‘টাকা করা একটা ব্যাঙ্কের মালিক হওয়ার মত ব্যাপার’, বলে চললেন তিনি; ‘এটা একটা অকল্যাণে, না খেটে বিপুল টাকা পাওয়া, সেই আগেকার ঠিক বন্দোবস্তের মত, শুধু এখন তার চেহারা পালটেছে।রাজা মারা গেছেন, দীর্ঘজীবী হোন রাজা! ঠিকা বন্দোবস্তের হাত থেকে রেহাই পেতে না পেতেই দেখা দিয়েছে রেলপথ, ব্যাংক : এও না খেটে মুনাফা।’
‘এ সবই সম্ভবত খুবই ঠিক এবং বুদ্ধিমন্ত… থাম, ক্রাক!’ চেঁচালেন অব্লোন্স্কি। কুকুরটা নিজেকে আঁচড়াচ্ছিল, বিচালি এলোমেলো করে দিচ্ছিল, তাকে ধমকালেন তিনি, তারপর স্পষ্টতই নিজের যুক্তির ন্যায্যতায় নিঃসন্দেহ হওয়ায় ধীরস্থিরভাবে বললেন, ‘কিন্তু সাধু আর অসাধু শ্রমের মধ্যে ভেদরেখাটা তো তুমি দেখালে না। আমার অধীনস্থ যে বড়বাবু কাজকর্ম আমার চেয়ে ভালো জানলেও আমি যে বেতন পাই তার চেয়ে অনেক বেশি, এটা কি অসাধু?’
‘জানি না।’
‘তাহলে আমি তোমাকে বলি : কৃষিকাজে তোমার খাটুনির জন্য তুমি যে পাচ্ছ ধরা যাক পাঁচ হাজারের ওপর, যেখানে আমাদের স্বাধীন চাষী যতই খাটুক পঞ্চাশ রুবলের বেশি পাচ্ছে না, এটাও ঠিক তেমনি অসাধু যেমন আমি পাই আমার নিম্নতন বড়বাবুর চেয়ে বেশি, মালতুস বেশি পায় তার রেল-মিস্ত্রির চেয়ে। এসব লোকের প্রতি সমাজের কেমন একটা অযৌক্তিক বিরূপতায় আমার বরং মনে হয় রয়েছে ঈর্ষা…
‘না, এটা অন্যায়’, বললেন ভেস্লোভস্কি, ‘ঈর্ষা হতে পারে না। এসব ব্যাপারে কিছু-একটা কারচুপি থাকেই। ‘না শোন’, লেভিন বলে চললেন, ‘বলছ এটা ন্যায্য নয় যে আমি পাই পাঁচ হাজার আর চাষী পঞ্চাশ, তা ঠিক, এটা অন্যায়, আমি সেটা অনুভব করি, কিন্তু…’
‘সত্যিই তাই। কেন আমরা কোন মেহনত না করে খানাপিনা করি, শিকারে যাই, আর সে খেটেই চলেছে অবিরাম?’ ভাসেকা ভেস্লোভস্কি বললেন, স্পষ্টতই জীবন পরিষ্কার করে এ বিষয়ে ভাবলেন এই প্রথম, তাই তাঁর কথায় ছিল পরিপূর্ণ অকপটতা।
‘হ্যাঁ, তুমি অনুভব কর, কিন্তু নিজের সম্পত্তিটা ওকে দাও না’, যেন ইচ্ছে করে লেভিনকে খোঁচাবার জন্য বললেন অব্লোন্স্কি।
ইদানীং দুই ভায়রাভাইয়ের মধ্যে যেন গোপন একটা শত্রুতা গড়ে উঠেছিল : দুজন দুই বোনকে বিয়ে করার পর থেকে তাঁদের মধ্যে যেন একটা প্রতিযোগিতা শুরু হয়েছিল—কে তাঁর জীবনকে ভালো করে গড়ে তুলবেন তাই নিয়ে এখন এই শত্রুতা প্রকাশ পেল কথাবার্তায় একটা ব্যক্তিগত ঝাঁঝ এনে।
‘দিই না কারণ কেউ সেটা চাইছে না আমার কাছে, আর আমি নিজে চাইলেও এমন কেউ নেই যাকে দেওয়া যায়’, লেভিন বললেন।
‘দিয়ে দাও এই চাষীটাকে, সে আপত্তি করবে না।
‘কিন্তু দেব কেমন করে? ওর সাথে গিয়ে দলিল সই করব?’
‘তা জানি না, তবে তোমার যদি বিশ্বাস হয়ে থাকে যে তোমার অধিকার নেই…’
‘মোটেই সে বিশ্বাস আমার নেই। বরং আমি অনুভব করি যে দান করার অধিকার আমার নেই, বরং জমি এবং পরিবারের কাছে দায়িত্ব আছে আমার।’
‘না শোন, যদি তুমি মনে কর এই অসাম্য অন্যায়, তাহলে কেন এমন কাজ করছ না…’
‘আমি সেই কাজই করছি, শুধু নেতিবাচক দিক থেকে, শুধু দুজনের মধ্যে অবস্থার যে পার্থক্য আছে সেটা বাড়িয়ে তোলার চেষ্টা আমি করব না।’
‘না, মাপ কর, এটা একটা আপাতবিপরীত কূট।’
‘হ্যাঁ, এটা কেমন যেন একটা কুতার্কিক যুক্তি বলে মনে হচ্ছে’, সমর্থন করলেন ভেস্লোভস্কি; ‘আরে, কর্তা যে!’ দরজা ক্যাচকেঁচিয়ে এ সময় চালাঘরে ঢোকায় চাষীটাকে বললেন তিনি, ‘কি, এখনো ঘুমাচ্ছ না?’
‘কোথায় ঘুম! ভাবলাম আমাদের বাবুরা ঘুমিয়ে পড়েছে, শুনি কথাবার্তা। এলাম একটা আঁকশি নিতে। কুকুরটা কামড়াবে না তো?’ সাবধানে খালি পা ফেলে জিজ্ঞেস করল সে।
‘আর তুমি ঘুমাবে কোথায়?’
‘রাতের ডিউটিতে।’
‘আহ্, কি রাত!’ খোলা দরজার বড় ফ্রেম দিয়ে প্রদোষের ক্ষীণ আলোয় দেখা যাচ্ছিল কুটিরের একটা কোণ, ঘোড়া খুলে নেওয়া গাড়ি, সেদিকে তাকিয়ে বলে উঠলেন ভেস্লোভস্কি, ‘আরে শুনুন, শুনুন, মেয়েদের গলায় গান, গাইছে মন্দ না তো! কে গাইছে কর্তা?’
‘গাঁয়ের মেয়েরা, ওই কাছেই।’
‘চলুন যাই, বেরিয়ে আসি! ঘুম তো হবে না। অব্লোন্স্কি, চলুন, বেড়ানো যাক!
‘শুয়ে থাকা আর যাওয়া, কি করে হয় একসাথে’, দেহ টান করে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘শুয়ে থাকাটা চমৎকার। ‘তাহলে আমি একাই যাব’, সবেগে উঠে দাঁড়িয়ে বুট পরতে পরতে বললেন ভেস্লোভস্কি, ‘আসি সাহেবরা। ফুর্তির কিছু থাকলে আপনাদের ডাকব। আপনরা আমাকে শিকারে এনেছেন সেটা ভুলব না।
‘চমৎকার ছোকরা, তাই না?’ ভেস্লোভস্কি চলে গেলে এবং চাষী দরজা বন্ধ করে দেবার পর বললেন অব্লোন্স্কি।
‘হ্যাঁ, চমৎকার’, যে আলাপটা হচ্ছিল তার কথা ভাবতে ভাবতে জবাব দিলেন লেভিন। তাঁর মনে হচ্ছিল, তিনি যতটা পারেন পরিষ্কার করে তাঁর ভাবনা ও অনুভূতি প্রকাশ করেছেন, অথচ দুজনেই ওঁরা, নির্বোধ বা কপট নন, একবাক্যে বলেছেন যে কুযুক্তিতে তিনি প্রবোধ দিচ্ছেন নিজেকে। এটা বিচলিত করছিল তাঁকে।
‘তাহলে ভায়া, দুটোর একটা। হয় মানো যে বর্তমান ব্যবস্থাটা ন্যায্য, তাহলে নিজের অধিকার বজায় রাখো; নয় স্বীকার কর যে অন্যায় বিশেষাধিকার ভোগ করছ, আর আমি যা করি, সেটা ভোগ করি খুবই তৃপ্তির সাথেই। ‘না, এ সুবিধা যদি অন্যায় হয়, তাহলে তৃপ্তির সাথে সেটা ভোগ করতে তুমি পার না, অন্তত আমি পারি না। আমার কাছে প্রধান কথা হল এই যে আমার দোষ নেই, এটা অনুভব করা।
‘কিন্তু সত্যি, গেলে হয় না?’ স্পষ্টতই এসব ভাবনায় ক্লান্তি বোধ করে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘ঘুম তো হবে না, সত্যি, চল যাই!’
লেভিন উত্তর দিলেন না। তিনি ন্যায় আচরণ করছেন নেতিবাচক অর্থে এই যে কথাটা তাঁরা বলেছেন, তা নিয়ে ভাবছিলেন তিনি। নিজেকে প্রশ্ন করলেন, ‘ন্যায্য হওয়া যায় কেবল কি নেতিবাচক দিক থেকে?’
‘আহ্ কি গন্ধ ছাড়ছে তাজা বিচালি!’ উঠে বসে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘না, কিছুতেই ঘুমাব না। ভাসেকা কিছু- একটা জমিয়েছে ওখানে। শুনছ খিলখিল হাসি আর ওর গলা? গেলে হয় না? চল যাই!’
‘না, আমি যাব না’, লেভিন বললেন।
‘এটাও তোমার একটা নীতি নাকি?’ অন্ধকারে টুপি খুঁজতে খুঁজতে হেসে বললেন অব্লোন্স্কি।
‘নীতি নয়, কিন্তু কেন যাব আমি?’
‘জানো, তুমি নিজের বিপদ ডেকে আনছ’, টুপিটা পেয়ে উঠে দাঁড়িয়ে বললেন অব্লোন্স্কি।
‘কি করে?’
‘আমি কি দেখতে পাচ্ছি না স্ত্রীর কাছে তুমি নিজেকে কোথায় দাঁড় করিয়েছ? দু’দিনের জন্য তুমি শিকারে যাবে কি যাবে না, এই প্রশ্নটা তোমাদের কাছে কি গুরুত্বপূর্ণ হয়ে উঠেছিল সে তো আমি শুনেছি। এ সবই ভালো একটা সহজিয়া গীত হিসেবে। কিন্তু সারা জীবন তো তাতে চলবে না। পুরুষকে হতে হবে স্বাধীন, তার আছে নিজের পুরুষালী আগ্রহ। পুরুষকে হতে হবে পৌরুষময়’, অব্লোন্স্কি বললেন দরজা খুলে।
‘তার মানে? গাঁয়ে কুমারীদের সাথে লীলায় যেতে হবে?’ লেভিন জিজ্ঞেস করলেন।
‘যদি ফুর্তি লাগে, তাহলে কেন নয়? এতে পরিণামের কিছু নেই। এতে আমার স্ত্রীর কিছু খারাপ হবে না অথচ আমার খানিকটা ফুর্তি হবে। প্রধান কথা, গৃহটা পবিত্র রাখা। ঘরে যেন কিছু না হয়। কিন্তু নিজের হাত তো খোলা রাখা চাই।
‘হয়ত তাই’, শুষ্ককণ্ঠে বলে লেভিন পাশ ফিরলেন, ‘কাল সকাল সকাল যেতে হবে, কাউকে জাগিয়ে দেব না আমি। ভোর হতেই আমি যাব।’
‘তাড়াতাড়ি আসুন সাহেবরা!’ শোনা গেল ভেস্লোভস্কির গলা, ফিরেছেন তিনি; মনোহারিণী! আমি আবিষ্কার করেছি ওকে। মনোহারিণী! একেবারে গ্রেঠেন, আমাদের ভাব হয়ে গেছে। সত্যি পরমাসুন্দরী’, এমন পুলকিত হয়ে উনি বলতে লাগলেন যেন পরমাসুন্দরীকে গড়া হয়েছে তাঁর জন্যই, এবং তাঁর জন্যই যিনি গড়ে দিয়েছেন, তাঁর ওপর তিনি তুষ্ট।
ঘুমের ভান করলেন লেভিন আর বুট পরে চুরুট ধরিয়ে চালাঘর থেকে বেরিয়ে গেলেন অব্লোন্স্কি, শিগগিরই মিলিয়ে গেল তাঁদের কণ্ঠস্বর।
অনেকক্ষণ ঘুম এল না লেভিনের। শুনতে পাচ্ছিলেন বিচালি চিবুচ্ছে তাঁর ঘোড়ারা, গৃহকর্তা তার বড় ছেলেকে নিয়ে চলে গেল রাত চৌকিতে; পরে শুনলেন চালাঘরের অন্যদিকে সৈনিক তার ভাগনে, গৃহস্বামীর ছোট ছেলেকে নিয়ে শুচ্ছে; সরু গলায় ছেলেটা তার মামাকে বলছে কুকুরগুলোর কথা, সেগুলোকে ভয়ংকর আর অতিকায় বলে মনে হয়েছিল তার; এর পর সে জিজ্ঞেস করলে কি ধরবে কুকুরগুলো, ঘুম-ঘুম ভাঙা গলায় সৈনিক বলল যে, কাল শিকারীরা জলায় যাবে, গুলি চালাবে। তারপর ছেলেটার প্রশ্ন এড়াবার জন্য বলল, ‘নে ভাস্কা, ঘুমো, ঘুমো, নইলে দেখাব মজা’, এবং শিগগিরই নাক ডাকাতে লাগল নিজেই। চারদিক নিঝুম হয়ে এল; শোনা যাচ্ছিল শুধু ঘোড়ার হ্রেষাধ্বনি, স্নাইপের কর্কশ ডাক। ‘সত্যিই কি শুধু নেতিবাচক দিক থেকে’, মনে মনে আওড়ালেন লেভিন, ‘তা কি হল? আমার তো কোন দোষ নেই।’ আগামীকালের কথা তিনি ভাবতে লাগলেন।
‘কাল সকাল-সকাল যাব, উত্তেজিত হব না। স্নাইপ অঢেল, বড় স্নাইপও আছে। ফিরে দেখব কিটির চিঠি এসেছে। তা স্তিভা ঠিকই বলেছে। কিটির কাছে আমি পুরুষ নই, মেয়েমানুষ বনে গেছি… কিন্তু কি করা যাবে! আবার ওই নেতি!’
তিনি ঘুমের মধ্যে শুনলেন, ভেস্লোভস্কি আর অব্লোন্স্কির হাসি এবং উচ্ছল কথাবার্তা। তিনি ক্ষণিকের জন্য চোখ মেলে দেখলেন; চাঁদ উঠেছে, খোলা দরজায় উজ্জ্বল জ্যোৎস্নায় কথা বলছেন ওঁরা। ডবকা ছুঁড়ির সাথে সদ্য ফেটে- যাওয়া বাদামের তুলনা দিয়ে কি যেন বললেন অব্লোন্স্কি আর তাঁর সংক্রামক হাসি হেসে ভেস্লোভস্কি পুনরুল্লেখ করলেন, ‘নিশ্চয় চাষী তাঁকে যা বলেছিল সেই কথাটা তুমি তোমার নিজেরটিকে জোগাড় করার জন্যে যত পারো তোয়াজ করো!’
লেভিন ঘুমের মধ্যেই বললেন, ‘কাল সকালে!’ এ কথা বলেই ঘুমিয়ে পড়লেন তিনি।
বারো
লেভিন খুব ভোরে ঘুম ভেঙে সঙ্গীদের জাগাবার চেষ্টা করলেন। ভাসেকা উপুড় হয়ে মোজা পরা একটা পা টান করে এমন বেদম ঘুমাচ্ছিলেন যে, তাঁর কাছ থেকে কোন জবাব পাওয়া সম্ভব হল না। ঘুমের মধ্যেই অব্লোন্স্কি আপত্তি করলেন এত সকালে যেতে। বিচালির কিনারায় কুণ্ডলী পাকিয়ে ঘুমাচ্ছিল লাস্কা। এমন কি সেও উঠল অনিচ্ছায়, আলস্যভরে পেছনের পা দুটোর আড়মোড়া ভাঙল। হাই-বুট পরে, বন্দুক নিয়ে, সন্তর্পণে চালাঘরের ক্যাঁচকেঁচে দরজা খুলে লেভিন বেরিয়ে এলেন। কোচোয়ানরা ঘুমাচ্ছিল গাড়িতে, ঘোড়ারা ঝিমাচ্ছিল। শুধু একটা ঘোড়া আলস্যভরে ওট খাচ্ছিল, ঘোঁতঘোঁত করে তা ছড়াচ্ছিল পাতনায়। বাইরে তখনো ধূসর আঁধার।
কুটির থেকে বৃদ্ধা গৃহকর্ত্রী বেরিয়ে এসেছিল, যেন অনেক কালের পরিচয় এমনভাবে সে লেভিনকে জিজ্ঞেস করল, ‘এত সকালে উঠলে যে বাছা?’
‘শিকারে যাব খালা। এদিক দিয়ে জলায় যাওয়া যাবে?’
‘সোজা পেছনের আঙিনা দিয়ে; মাড়াইয়ের জমি হয়ে তিসি ক্ষেত। সেখানেই হাঁটা পথটা বেরিয়েছে।’
বৃদ্ধা সাবধানে রোদ-পোড়া খালি পা ফেলে লেভিনকে এগিয়ে দিল। তাঁর জন্য মাড়াইয়ের জমির বেড়া খুলে দিল।
‘সোজা চলে গেলেই জলা। আমাদের ছেলেগুলো কাল সাঁঝে ঘোড়া খেদিয়েছে ওখানে।’
হাঁটা পথটা দিয়ে ফুর্তিতে লাস্কা ছুটে গেল। অবিরাম আকাশটা লক্ষ্য করতে করতে ক্ষিপ্র লঘু পদক্ষেপে লেভিন গেলেন তার পিছু পিছু। তাঁর ইচ্ছে হচ্ছিল জলায় পৌঁছবার আগে যেন সূর্য না ওঠে। কিন্তু গড়িমসি করল না সূর্য। যখন তিনি বেরোন, বাঁকা চাঁদ তখনো জুলজুল করছিল। এখন তার আভা এক ফোঁটা পারদের মত : কিছুক্ষণ আগেও শুকতারা চোখে না পড়ে যেত না এখন তাকে খুঁজতে হচ্ছে; দূরের ক্ষেতে যে ছোপগুলো আগে আবছা দেখা যাচ্ছিল, এখন তা পরিষ্কার ফুটে উঠেছে; রাই শস্যের আঁটি এগুলি। উঁচু উঁচু সুগন্ধ তিসি গাছ থেকে বন্ধ্যা মঞ্জরিগুলো তুলে ফেলা হয়েছে। সূর্যের আলো না থাকায় তখনো অদৃশ্য শিশির বিন্দুগুলো লেভিনের পা আর ব্লাউজ ভিজিয়ে দিল কোমরের ওপর পর্যন্ত। প্রভাতের স্বচ্ছ স্তব্ধতায় সামান্যতম ধ্বনিও শোনা যাচ্ছিল। গুলির শিস দিয়ে লেভিনের কানের কাছ দিয়ে উড়ে গেল একটা মৌমাছি। তাকিয়ে দেখতে দ্বিতীয় এবং তৃতীয় মৌমাছিও চোখে পড়ল। বেড়ার পেছনে মৌচাক থেকে উড়ে গিয়ে তারা তিসি ক্ষেতের ওপর দিয়ে সোজা জলার দিকে মিলিয়ে যাচ্ছে। পথটা চলে গেছে জলায়। জলাটা চেনা যায় সেখান থেকে ওঠা ভাঁপ দেখে, কোথাও তা ঘন, কোথাও পাতলা, সে ভাঁপের মধ্যে দ্বীপের মত দুলছে হোগ্লা আর উইলোর ঝোপ। যে ছোকরা আর মরদেরা রাতে ঘোড়াগুলোর চৌকি দিয়েছিল জলার কিনারায় আর পথের ধারে তারা ভোর হলেও অঘোরে ঘুমাচ্ছে কাফতান জড়িয়ে। তাদের অদূরে চলছে ছাঁদনদড়ি বাঁধা তিনটা ঘোড়া। তাদের একটা ঝনঝনিয়ে চলছে বেড়ি। লাস্কা যাচ্ছিল তার প্রভুর পাশে পাশে, তাকাচ্ছে এদিক- ওদিক, এগিয়ে যেতে চাইছে। ঘুমন্ত চাষীদের পেরিয়ে গিয়ে প্রথম নাবালটায় পৌঁছে লেভিন তাঁর কার্তুজ পরীক্ষা করে লেলিয়ে দিলেন কুকুরটাকে। বাদামি রঙের তিন-বছুরে একটা পুরুষ্টু ঘোড়া কুকুর দেখে লাফিয়ে সরে গিয়ে ঘোঁতঘোঁত করে উঠল। ভয় পেয়েছিল বাকি ঘোড়াগুলোও। ছাঁদনদড়ি বাঁধা পায়ে পানিতে ছপছপ করে ঘন পাঁকে ডুবে যাওয়া খুর টেনে তোলায় হাততালি দেবার মত শব্দ করে তারা লাফিয়ে এল জলা থেকে। লাস্কা থেমে গিয়ে ঘোড়াগুলোর দিকে সবিদ্রূপ আর সপ্রশ্ন দৃষ্টিতে লেভিনের দিকে তাকাল। লেভিন তার গায়ে হাত বুলিয়ে শিস দিয়ে ইঙ্গিত করলেন যে, এখন শুরু করা যায়।
লাস্কা তার পায়ের তলার টলমলে পাঁকের ওপর দিয়ে ফুর্তিতে উদ্বেগ নিয়ে ছুটল।
লাস্কা জলায় তখনই শিকড়, জলা-ঘাস, মরচের চেনা এবং অশ্বমলের অচেনা গন্ধের মধ্যে টের পেল সারা জায়গাটায় ছড়িয়ে যাওয়া পাখির গন্ধ, ঠিক সেই ঝাঁঝালো গন্ধটাই যা তাকে তাতিয়ে তোলে সবচেয়ে বেশি। শ্যাওলা আর পানার মধ্যে কোথাও কোথাও গন্ধটা খুবই তীব্র, কিন্তু ঠিক কোন দিকে তা বেড়ে উঠছে বা কমে আসছে তা স্থির করা যাচ্ছিল না। দিশা ঠিক করার জন্য সরে আসতে হত বাতাস থেকে। পায়ের গতি সম্পর্কে সচেতন না থেকে লাস্কা প্রাপ্ৰত্যূষ যে বাতাস বইছিল পূর্ব থেকে তার ডান দিকে ছুটে গিয়ে, বাতাসের দিকে ফিরে লাফিয়ে চলল উত্তেজিত দুলকি চালে এমনভাবে যাতে প্রয়োজন পড়লে দাঁড়িয়ে যেতে পারে। বিস্ফারিত নাক দিয়ে বাতাস টেনে সে তখনই টের পেল যে শুধু গন্ধ নয়, পাখিগুলো রয়েছে তার কাছেই এবং শুধু একটা নয়, অনেক। লাস্কা তার চলার গতি কমাল। পাখিগুলো খুঁজে পাবার জন্য সে পাক দেওয়া শুরু করা মাত্র শুনল প্রভুর ডাক। ‘লাস্কা! এখানে!’ অন্য দিক দেখিয়ে বললেন তিনি। জিজ্ঞাসু দৃষ্টিতে দাঁড়িয়ে পড়ল লাস্কা : যা শুরু করেছে সেটা শেষ করাই কি ভালো হবে না? কিন্তু পানিতে ভাসা কয়েকটা ঘেসো ডিপি যেখানে কিছুই থাকতে পারে না, সেটা দেখিয়ে রাগত স্বরে লেভিন পুনরাবৃত্তি করলেন তাঁর হুকুমের। তাঁর কথা শুনল লাস্কা, প্রভুকে খুশি করার জন্য ভান করল যেন খুঁজছে, ডিপিগুলোর মাঝে ঢুকল সে, কিন্তু আগের জায়গায় ফিরে আসতেই টের পেল পাখিদের। এখন, লেভিন যখন তাকে বাধা দিচ্ছেন না, লাস্কা বুঝে গেল কি করতে হবে এবং নিজের পায়ের দিকে না তাকিয়ে, বিরক্তিতে উঁচু উঁচু ডিপিগুলোয় হোঁচট খেয়ে, পানিতে পড়ে গিয়ে কিন্তু স্থিতিস্থাপক সবল পায়ে সামলে নিয়ে সে শুরু করল পাক দিতে, যাতে সব কিছু পরিষ্কার হয়ে যাওয়ার কথা। ওদের গন্ধ ক্রমেই তীব্র আর সুনির্দিষ্ট রূপে অভিভূত করছিল তাকে, আর হঠাৎ তার কাছে পরিষ্কার হয়ে গেল যে ওদের একটা আছে এখানেই, পাঁচ পা দূরে তার সামনের ডিপিটার পেছনে, থেমে গেল সে, আড়ষ্ট হয়ে উঠল গোটা শরীর। পা তার খাটো হওয়ায় সামনে কিছু সে দেখতে পাচ্ছিল না, কিন্তু গন্ধটা ক্রমাগত টেনে প্রত্যাশার পরিতৃপ্তিতে দাঁড়িয়ে রইল সে। উত্তেজিত লেজ টান টান হয়ে তিরতির করছিল কেবল ডগাটায়। মুখ সামান্য হাঁ-করা, কান খাড়া। দৌড়ের দরুন একটা কান উল্টে গেছে, হাঁফাচ্ছিল লাস্কা। কিন্তু সাবধানে এবং আরো সাবধানে, মাথা না ঘুরিয়ে বরং শুধু চোখ দিয়ে তাকাচ্ছিল প্রভুর দিকে। তাঁর মুখ তার কাছে অভ্যস্ত, কিন্তু চোখ সব সময়ই ভয়ংকর, আসছেন তিনি ঘেসো ডিপিতে হোঁচট খেতে খেতে এবং লাস্কার মনে হল, আসছেন অসাধারণ ধীরে। লাস্কার মনে হয়েছিল যে তিনি আসছেন ধীরে ধীরে, আসলে কিন্তু তিনি দৌড়াচ্ছিলেন।
যে বিশেষ ভঙ্গিতে লাস্কা একেবারে শুয়ে পড়ে, পেছনের বড় থাবায় মাটি আঁচড়ায় আর মুখ সামান্য হাঁ করে, তা দেখে লেভিন বুঝলেন যে বড় স্নাইপের ধান্ধায় আছে সে, এবং যাতে সাফল্য লাভ করেন, বিশেষ করে প্রথম পাখিটায়, তার জন্য মনে মনে সৃষ্টিকর্তার কাছে প্রার্থনা করে ছুটে গেলেন লাস্কার দিকে। তার পাল্লা ধরে উঁচু থেকে তিনি চাইলেন সামনে আর লাস্কা যা দেখেছিল গন্ধে সেটা তিনি দেখলেন চোখ দিয়ে। দুটো ডিপির মাঝখানে একটায় তিনি দেখতে পেলেন বড় একটা স্নাইপ। মাথা ঘুরিয়ে ও যেন কান পাতল। তারপর ডানা নেড়ে আবার তা গুটিয়ে বিদঘুটে ঢঙে পিছিয়ে কোণে লুকিয়ে গেল।
লেভিন পেছন থেকে লাস্কাকে ঠেলা দিয়ে চেঁচিয়ে উঠলেন, ‘নে, নে!’
লাস্কা ভাবল : ‘কিন্তু আমি যে যেতে পারি না। যাব কোথায়? এখান থেকে আমি ওদের টের পাচ্ছি, আর যদি এগিয়ে যাই, তাহলে ধরতে পারব না কোথায় তারা, কে তারা।’ কিন্তু লেভিন হাঁটু দিয়ে তাকে ঠেলা মেরে উত্তেজিত ফিসফিস স্বরে আবার বললেন, ‘নে লাসোকা, নে!’
‘তা উনি যদি তাই চান, তাহলে করছি, কিন্তু আমার কোন দায়িত্ব থাকবে না’, এই ভেবে লাস্কা তেড়ে গেল সামনের ডিপি দুটোর মাঝখানে। এখন সে আর কোন গন্ধ পাচ্ছিল না, কিছুই না বুঝে শুধু দেখছিল আর শুনছিল।
আগের জায়গাটা থেকে দশ পা দূরে, প্রচণ্ড ক্যাঁ-ক্যাঁ করে ডেকে, বড় স্নাইপের বৈশিষ্ট্যসূচক পক্ষধ্বনি তুলে উড়ল একটা পাখি। আর গুলির পরেই সাদা বুকে ধপ করে পড়ল ভেজা মাটির ওপর। দ্বিতীয় পাখিটা কুকুর ছাড়াই উড়ল লেভিনের পেছন থেকে।
লেভিন যখন ঘুরলেন তার দিকে। ততক্ষণে অনেক দূরে চলে গেছে সে, তাহলেও গুলিটা লাগল। আরো কিছুটা উড়ে গিয়ে, সোজা হয়ে, বলের মত ঘুরপাক খেয়ে সশব্দে সে পড়ল শুকনো ডাঙ্গায়।
‘হ্যাঁ, এটা একটা কাজের কাজ হল’, মাংসল স্লাইপ দুটোকে থলের মধ্যে ভরতে ভরতে লেভিন ভাবলেন, ‘কি লাসোকা, কাজ হবে তো?’
আবার বন্দুকে গুলি ভরে লেভিন যখন আরো এগিয়ে গেলেন, সূর্য তখন উঠে গিয়েছিল। যদিও মেঘের আড়াল থেকে দেখা যাচ্ছিল না। শশীকলা তার সমস্ত দীপ্তি হারিয়ে ম্যাড়ম্যাড় করছিল সাদা একখণ্ড মেঘের মত; একটা তারাও দেখা যাচ্ছিল না আর। শিশিরে নাবালগুলো আগে ছিল রূপালি, এখন সোনালি। মরচে-ধরা পানিগুলো এখন অ্যাম্বারের মত হলদে। ঘাসের নীলাভা এখন পরিণত হলদেটে সবুজে। স্রোতের কাছে শিশিরে চিকচিকে, লম্বা ছায়া ফেলা ঝোপঝাড়গুলোয় গিজগিজ করছে জলার পাখিরা। ঘুম থেকে জেগে একটা বাজপাখি খড়ের গাদিতে বসে এপাশে- ওপাশে মাথা ফিরিয়ে অপ্রসন্ন দৃষ্টিতে চাইছিল জলার দিকে। মাঠের ওপর দিয়ে উড়ছিল দাঁড়কাকগুলো। ঘুম থেকে উঠে কাফতানের তল থেকে গা চুলকাচ্ছিল একজন বৃদ্ধ। খালি পা একটা বালক ঘোড়াগুলোকে তাড়িয়ে আনছিল তার দিকে। গুলির ধোঁয়া দুধের মত ধবধব করছিল সবুজ ঘাসের ওপর। লেভিনের দিকে ছুটে এল একটা ছেলে। কিছু দূরে পেছন পেছন যেতে যেতে একটা ছেলে চেঁচাল, ‘কাল হেথায় হাঁস এসেছিল কাকা!’ ছেলেটার চোখের সামনে পরপর আরো তিনটা স্নাইপ মারতে পেরে দ্বিগুণ খুশি লাগল লেভিনের। ছেলেটার মুখে তারিফ ফুটেছিল।
তেরো
পয়লা শিকার, তা পশু বা পাখি যাই হোক যদি ফসকে না যায়, তাহলে শিকারে ভাগ্য খুলবে — দেখা গেল শিকারীদের এই বিশ্বাসটা সত্যি।
ঊনিশটা শাঁসালো পাখি নিয়ে বেলা নয়টার পর ক্লান্ত, ক্ষুধার্ত, আনন্দিত লেভিন তিরিশ ভার্স্ট পাড়ি দিয়ে বাড়ি ফিরলেন। একটা হাঁস থলেয় ঢোকানো যায়নি বলে সেটাকে তিনি ঝুলিয়ে নিয়েছিলেন তাঁর বেল্টে। তাঁর সঙ্গীদের ঘুম ভেঙেছে অনেকক্ষণ। তাঁরা ইতিমধ্যেই খিদে মিটিয়ে প্রাতরাশ সেরেছেন।
‘দাঁড়ান, দাঁড়ান, আমি জানি, উনিশটা’, উড়ন্ত অবস্থায় পাখিগুলোর যে রূপ ছিল এখন তা হারিয়ে মোচড়ানো, রক্তের দাগ ধরা, শুকিয়ে ওঠা স্নাইপগুলোকে দ্বিতীয়বার গুণতে গুণতে লেভিন বললেন।
লেভিন খুশি হলেন হিসেবটা সঠিক এবং অব্লোন্স্কির ঈর্ষায়। এটাও তাঁর ভালো লাগল যে ঘরে ফিরে তিনি দেখতে পেলেন কিটির চিঠি নিয়ে আসা লোকটাকে।
‘আমি বেশ ভালো আছি, হাসি-খুশি। আমার জন্যে তুমি যদি ভয় পাও, তাহলে এখন আরো নিশ্চিন্ত থাকতে পারো। আমার নতুন দেহরক্ষী হয়েছেন মারিয়া ভাসিয়েভনা (এই ধাইটি লেভিনের সংসারে নতুন গুরুত্বপূর্ণ একটি ব্যক্তি)। আমি কেমন আছি দেখতে এসেছিলেন তিনি। দেখলেন, আমি পুরোপুরি সুস্থ; তোমার আসা পর্যন্ত ওঁকে ধরে রেখেছি আমরা। সবাই আমরা ভালো আছি, সবাই হাসি-খুশি। তুমি বাপু তাড়াহুড়া করো না। শিকার যদি ভালো চলে, তাহলে আরো একদিন থেকে যেও।
পয়মন্ত শিকার আর স্ত্রীর চিঠি—এ দুই আনন্দ ছিল এতই বিপুল যে পরে যে দুটো ছোটখাটো অপ্রীতিকর ব্যাপার ঘটেছিল তাতে বিশেষ বিচলিত হননি লেভিন। তার একটা হল, বাড়তি পাটকিলে ঘোড়টাকে গতকাল স্পষ্টতই অত্যন্ত খাটানোয় সে খাচ্ছিল না কিছু, মুষড়ে পড়েছিল। কোচোয়ান বলল, সে জেরবার হয়ে গেছে। বলল, ‘কাল বড় বেশি ছুটিয়েছি ওকে। খারাপ রাস্তায় দশ ভার্স্ট পথ, কম তো নয়।
দ্বিতীয় যে ঘটনাটা তাঁর প্রথমদিককার খোশমেজাজকে মাটি করে দিয়েছিল, কিন্তু পরে যা নিয়ে তিনি খুব হেসেছেন সেটা এই যে, কিটি এত প্রচুর পরিমাণে খাবার দিয়েছিল যে এক সপ্তাহ ধরে খেয়েও শেষ করা যাবে না বলে মনে হয়েছিল, তার কিছুই আর অবশিষ্ট নেই। শিকার থেকে ক্লান্ত ও ক্ষুধার্ত হয়ে ফেরার সময় লেভিনের কাছে পিঠেগুলোর ছবি এত জ্বলজ্বলে হয়ে উঠেছিল যে ঘরের কাছে এসে তিনি নাকে-মুখে তার স্বাদ-গন্ধ এমনই পাচ্ছিলেন যেমন লাস্কা পায় মৃগয়ার, ফিলিপকে তখনই খাবার দিতে বললেন তিনি। দেখা গেল শুধু পিঠে নয়, মুরগির ছানাগুলোও শেষ করে ফেলেছে।
‘খিদে বটে!’ হেসে ভাসেকা ভেস্লোভস্কিকে দেখিয়ে বললেন অব্লোন্স্কি, ‘অগ্নিমান্দ্যে আমি ভুগি না, কিন্তু এটা আশ্চর্য…’
‘তা কি করা যাবে!’ ভেস্লোভস্কির দিকে বিষণ্ণ বদনে তাকিয়ে লেভিন বললেন, ‘তাহলে গরুর মাংসই দাও, ফিলিপ।
‘গরুর মাংসও খাওয়া হয়ে গেছে’, ফিলিপ বলল, ‘হাড়গুলো আমি দিয়েছি কুকুরদের।’
লেভিন এত ক্ষুব্ধ হলেন যে সখেদে বললেন, ‘অন্তত কিছু রাখলে পারতেন আমার জন্যে!’ কান্না পাচ্ছিল তাঁর। ভাসেকার দিকে তাকাবার চেষ্টা না করে কাঁপা কাঁপা গলায় তিনি ফিলিপকে বললেন, ‘যাও, পাখিগুলোর ছাল ছাড়াও গিয়ে। আর বিছুটি দিতে ভুলো না। আমার জন্যে অন্তত খানিক দুধ চেয়ে আনো তো।’
দুধ খাওয়ার পর বাইরের লোকের সামনে বিরক্তি প্রকাশ করেছেন বলে যখন তাঁর লজ্জা হয়, নিজের ক্ষুধার্ত উষ্মা নিয়ে তখন হাসাহাসি করেছিলেন তিনি।
বিকেলে আরেকবার শিকারে যান তাঁরা, ভেস্লোভস্কি পর্যন্ত তাতে পাখি মারতে পারেন কয়েকটা। বাড়ি ফিরলেন রাতে।
ফিরতি পথটাও এখানে আসবার মত কাটল ফুর্তিতে। ভেস্লোভস্কি কখনো গান ধরলেন, কখনো স্মরণ করলেন চাষীদের কাছে তাঁর যাওয়াটা। যারা তাঁকে ভোদ্কা খাইয়ে বলেছিল : ‘কড়া চোখে তাকিয়ো না’। কখনো বললেন বাদামের সাথে তুলনীয় গ্রাম্য ছুঁড়ির সাথে তাঁর রঙ্গরসের কথা। একটি চাষী তাঁকে জিজ্ঞেস করেছিল তিনি বিবাহিত কিনা, আর বিবাহিত নন জেনে বলেছিল, ‘পরস্ত্রীর দিকে চোখ দিও না। নিজেরটিকে জোগাড় করার জন্যে তোয়াজ করো।’ এই কথাটায় ভীষণ মজা পেয়েছিল ভেস্লোভস্কি
‘বলা যায় এই সফরটায় ভীষণ আনন্দ পেলাম। আর লেভিন, আপনি?’
লেভিন আন্তরিকভাবেই বললেন, ‘আমিও। বাড়িতে ভাসেকার প্রতি যে বিরূপতা তিনি বোধ করেছিলেন সেটা আর বোধ করছিলেন না তাই নয়, বরং তাঁর প্রতি অতি সৌহার্দের একটা মনোভাবে তাঁর ভীষণ আনন্দ হচ্ছিল
চৌদ্দ
ভাসেকা যে ঘরে ঘুমাচ্ছিলেন পরদিন সকাল দশটায়, সেখানে টোকা দিলেন লেভিন।
ভেস্লোভস্কি ফরাসি ভাষায় চেঁচিয়ে বললেন, ‘আসুন। মাপ করবেন, আমি সবেমাত্র আমার প্রক্ষালন সারলাম।’ তিনি শুধু অন্তর্বাস পরা অবস্থায় হেসে বললেন।
‘সংকোচের কিছু নেই’, জানালার কাছে বসলেন লেভিন, ‘ভালো ঘুম হয়েছে তো?’
‘ঘুমিয়েছি মড়ার মত। আজকের দিনটা শিকারের পক্ষে কেমন?’
‘কি খাবেন, চা নাকি কফি?’
‘এর কোনটাই নয়। আমি প্রাতরাশের অপেক্ষায় রইলাম। সত্যি লজ্জা হচ্ছে। মহিলারা এতক্ষণে উঠে পড়েছেন নিশ্চয়? এখন চমৎকার লাগবে বেড়াতে। আপনি আপনার ঘোড়া দেখান আমাকে।’
বাগান দিয়ে হেঁটে, আস্তাবলে গিয়ে, এমন কি প্যারালাল বারে একসাথে ব্যায়াম করে লেভিন অতিথি সমভিব্যাহারে বাড়ি ফিরে ঢুকলেন ড্রয়িং-রুমে।
কিটি বসে ছিল সামোভারের সামনে। তার কাছে গিয়ে ভেস্লোভস্কি বললেন, ‘শিকার হয়েছে চমৎকার। মনে কত যে ছাপ পড়ল! এ পরিতোষ থেকে মহিলারা বঞ্চিত বলে কষ্ট হচ্ছে।’
‘কি আর হল, গৃহস্বামিনীর সাথে ওর কথা তো বলতে হয়’, মনে মনে ভাবলেন লেভিন। অতিথির হাসিতে, বিজয়ীর যে ভাব নিয়ে তিনি কথা বলছিলেন কিটির সাথে তার ভেতর আবার কি-একটা যেন নজরে পড়ল তাঁর 1
মারিয়া ভ্লাসিয়েভনা আর অব্লোন্স্কির সাথে প্রিন্স-মহিষী বসেছিলেন টেবিলের অন্য দিকটায়। লেভিনকে কাছে ডেকে তিনি প্রসবের জন্য কিটিকে মস্কো নিয়ে যাওয়া এবং ফ্ল্যাট ঠিকঠাক করা নিয়ে কথা পাড়লেন। বিয়ের সময় যেমন হয়েছিল আসনের মহিমার সামনে যে-কোন উদ্যোগ-আয়োজনই তার তুচ্ছতায় বিশ্রী লাগে লেভিনের কাছে, আর প্রসবের যে সময়টা সবাই কেমন যেন আঙুলে গুণে রেখেছে, তা তোড়জোড় তাঁর কাছে ঠেকল আরো অপমানকর। ভবিষ্যৎ শিশুকে কিভাবে কাঁথা জড়িয়ে রাখতে হবে, সে সব কথাবার্তায় কানে তালা দিয়ে রাখার চেষ্টা করলেন তিনি। অবিরাম বুনে চলা রহস্যময় কি সব ফালি, কি-সব সুতি ত্রিভুজ যাতে বিশেষ গুরুত্ব দেন ডল্লি। এসব না দেখার জন্য তিনি মুখ ফিরিয়ে নেবার চেষ্টা করলেন। পুত্রের যে জন্ম হবে বলে লোকে তাঁকে আশ্বাস দিয়েছে (তাঁর দৃঢ় বিশ্বাস ছেলেই হবে), তাহলেও বিশ্বাস করতে পারছিলেন না—ঘটনাটা তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল অতি অনন্যসাধারণ, এবং এক দিক থেকে এতই বিপুল সুতরাং অসম্ভাব্য একটা সুখ, অন্য দিক থেকে এতই রহস্যময় একটা ব্যাপার যে যা হতে চলেছে তা নিয়ে লোকদের কল্পিত একটা জ্ঞান আর সাধারণ একটা ব্যাপারের মত তার জন্য তোড়জোড় তাঁর কাছে মনে হচ্ছিল বিরক্তিকর, অপমানকর।
কিন্তু প্রিন্স-মহিষী তাঁর অনুভূতি বুঝছিলেন না। এ নিয়ে ভাবতে, কথা বলতে তাঁর অনিচ্ছাকে ধরে নিলেন লঘুচিত্ততা ও উদাসীনতার ফল, তাই শান্তি দিচ্ছিলেন না তাঁকে। ফ্ল্যাটটা দেখার ভার তিনি দিয়েছিলেন অব্লোন্স্কির ওপর আর এখন কাছে ডাকলেন লেভিনকে।
‘আমি কিছুই বুঝি না প্রিন্সেস। যা চান, করুন’, লেভিন বললেন।
‘তোমরা কখন আসছ, ঠিক করা দরকার।’
‘সত্যি, আমি জানি না। জানি যে লক্ষ লক্ষ শিশু জন্মাচ্ছে মস্কো এবং ডাক্তার ছাড়াই… তাহলে কেন…’
‘যদি তাই হয়…’
‘না-না, কিটি যা চাইবে তাই হবে।’
‘এ নিয়ে কিটির সাথে কথা বলা চলে না! তুমি কি চাও ওকে ভয় পাইয়ে দেব? এই তো, এই বছরেরই বসন্তে নাটালি গলিৎসিনা মারা গেল খারাপ ধাত্রীবিদ্যার জন্যে।’
‘আপনি যা বলবেন, আমি তাই করব’, বিমর্ষ মুখে বললেন লেভিন।
প্রিন্স-মহিষী কি-সব বলছিলেন ওঁকে, কিন্তু উনি শুনছিলেন না। প্রিন্স-মহিষীর কথাগুলো তাঁকে ক্ষুব্ধ করছিল, কিন্তু তিনি বিমর্ষ হয়েছিলেন তাঁর কথায় নয়, সামোভারের ওখানে যা ঘটছিল তা দেখে।
সুন্দর হাসি নিয়ে কিটির দিকে ঝুঁকে ভাসেকা কি যেন বলছেন তাকে আর বিচলিত কিটি যে লাল হয়ে উঠেছে, সেদিকে তাকিয়ে তিনি ভাবছিলেন, ‘না, এ অসম্ভব।’
ভাসেন্কার ভঙ্গিতে, তার দৃষ্টিতে, তার হাসিতে অসাধু কি-একটা যেন ছিল। লেভিন এমন কি কিটির ভঙ্গিতে আর দৃষ্টিতেও অসাধু কিছু-একটা দেখতে পেলেন। আবার তাঁর চোখে আঁধার নেমে এল। গতকালের মত আবার সুখ, প্রশান্তি, মর্যাদা থেকে হঠাৎ হতাশা, বিদ্বেষ, হীনতার অতলে নিক্ষিপ্ত বলে অনুভব করলেন নিজেকে। আবার সবাই এবং সব কিছু হয়ে উঠল তাঁর চক্ষুশূল।
‘যা চান তাই করুন প্রিন্সেস’, আবার ওঁদের দিকে দৃষ্টিপাত করে লেভিন বললেন।
‘মহারাজের উষ্ণীষ ধারণ বড় সহজ নয়’, রহস্য করে অব্লোন্স্কি বললেন তাঁকে, স্পষ্টতই ইঙ্গিতটা প্রিন্স-মহিষীর সাথে কথোপকথন নিয়ে শুধু নয়, তাঁর অস্থিরতার কারণ নিয়েও। যেটা তাঁর নজরে পড়েছিল, ‘আজ এত দেরি করলে যে ডল্লি!’
দারিয়া আলেক্সান্দ্রভনাকে সম্ভাষণের জন্য উঠে দাঁড়ালেন সবাই। ভাসেকা এক মিনিটের জন্য উঠে দাঁড়িয়ে মহিলাদের প্রতি সৌজন্যের যে অভাব নব্য যুবাদের প্রকৃতিগত তার পরিচয় দিয়ে সামান্য মাথা নুইয়ে আবার কথাবার্তা চালিয়ে গেলেন কি জন্য যেন হাসতে হাসতে।
‘মাশা আমাকে জ্বালিয়েছে। ভালো ঘুম হয়নি তার, আজ নানারকম জেদ ধরেছে কেবলি’, ডল্লি বললেন।
কিটির সাথে ভাসেকা যে কথাবার্তা শুরু করেছিলেন তা আবার চলতে থাকল গতকালের প্রসঙ্গ, আন্নার ব্যাপারটা আর প্রেম সামাজিক রীতিনীতির ঊর্ধ্বে হতে পারে কিনা তাই নিয়ে। এ আলাপটা কিটির ভালো লাগছিল না। তার বিষয়বস্তু এবং যে সুরে তা ব্যক্ত হচ্ছিল, দুয়েতেই অস্থির বোধ করছিল সে। বিশেষ করে এজন্য যে, এতে স্বামীর কি প্রতিক্রিয়া ঘটবে তা সে জানত। কিন্তু বড় বেশি সহজ-সরল হওয়ায় আলাপটা থামিয়ে দিতে, এমন কি এই যুবা পুরুষটির সুস্পষ্ট মনোযোগে সে যে একটা বাহ্যিক তুষ্টিলাভ করছে, সেটা পর্যন্ত লুকাতে পারছিল না। কথাবার্তাটা বন্ধ করতেই সে চাইছিল, কিন্তু জানত না কি করতে হবে তাকে। যা-ই সে করুক, স্বামী যে সেটা লক্ষ করবেন এবং সব কিছুরই একটা খারাপ অর্থ করা হবে তা সে জানত। এবং কিটি যখন ডল্লিকে জিজ্ঞেস করল, মাশার কি হয়েছে আর ভাসেন্কার কাছে নীরস এই আলাপটা শেষ হবার অপেক্ষায় উদাসীন দৃষ্টিতে তিনি তাকিয়ে রইলেন ডল্লির দিকে, তখন সত্যিই লেভিনের মনে হল যে প্রশ্নটা স্বাভাবিক নয়, কদর্য একটা চালাকি।
ডল্লি জিজ্ঞেস করলেন, ‘কি, আজ ব্যাঙের ছাতা তুলতে যাব?’
‘চল যাই, আমিও যাব’, বলে কিটি লাল হয়ে উঠল। ভাসেকাও যাবেন কিনা, সৌজন্যবশত এটা সে জিজ্ঞেস করতে চেয়েছিল, কিন্তু করল না।
দৃঢ় পদক্ষেপে স্বামী যখন তার পাশ দিয়ে চলে যাচ্ছিলেন, তখন দোষী-দোষী ভাব নিয়ে কিটি তাঁকে জিজ্ঞেস করল, ‘কোথায় যাচ্ছ কস্তিয়া?’ এই দোষী-দোষী ভাবটায় সমর্থিত হল তাঁর সন্দেহ।
কিটির দিকে না তাকিয়ে লেভিন বললেন, ‘আমি যখন ছিলাম না, তখন মেকানিক এসে গিয়েছিল, অথচ আমার সাথে এখনো দেখা হয়নি।’
নিচে নেমে গেলেন তিনি, কিন্তু স্টাডি থেকে বেরোতেনা-বেরোতেই শুনলেন স্ত্রীর পরিচিত অসাবধান পায়ের আওয়াজ দ্রুত কাছিয়ে আসছে তাঁর দিকে।
‘কি ব্যাপার?’ তিনি শুকনো গলায় বললেন, ‘আমাদের কাজ আছে।’
জার্মান মেকানিককে কিটি বলল, ‘মাপ করবেন, স্বামীকে আমার কয়েকটা কথা বলার আছে।’
জার্মানটি চলে যাবার উপক্রম করছিল, কিন্তু লেভিন তাকে বললেন, ‘আপনি ব্যতিব্যস্ত হবেন না।’
‘ট্রেন তিনটার সময়?’ জিজ্ঞেস করল জার্মান, ‘আবার দেরি না হয়ে যায়।’
লেভিন কোন জবাব না দিয়ে স্ত্রীর সাথে বেরিয়ে গেলেন।
‘তা আপনি কি বলতে চান আমাকে?’ জিজ্ঞেস করলেন ফরাসিতে।
কিটির মুখের দিকে তিনি তাকালেন না, তার এই অবস্থায় সারা মুখ যে তার কাঁপছে, চেহারা হয়েছে করুণ, বিধ্বস্ত, সেটা দেখতে চাইছিলেন না।
‘আমি…আমি বলতে চাইছিলাম যে, এভাবে থাকা চলে না, এটা যন্ত্রণা…’ কিটি বলল।
‘বুফেতে লোক আছে’, তিনি ক্রুদ্ধ কণ্ঠে বলে উঠলেন, ‘নাটক জমিয়ো না। ‘
‘তাহলে চল ওখানে যাই!’
ওঁরা দাঁড়িয়ে ছিলেন প্রবেশ-কক্ষে, কিটি চাইছিল পাশের ঘরে যেতে কিন্তু সেখানে ইংরেজ গৃহশিক্ষিকা তানিয়াকে পড়াচ্ছে।
‘চল, বাগানে যাই!’
বাগানে পথ সাফ করছিল একটা মুনিষ, তার সম্মুখে পড়লেন তাঁরা। সে যে তার অশ্রুসিক্ত এবং স্বামীর অস্থির মুখ দেখতে পাচ্ছে সে কথা না ভেবে, ওঁদের চেহারা যে হয়েছে কোন-একটা দুর্ভাগ্য থেকে পলায়মান লোকের মত সে সম্পর্কে একটুও চিন্তা না করে ওঁরা দ্রুত পায়ে এগিয়ে গেলেন। অনুভব করছিলেন যে তাঁদের কথা বলে নিতে হবে, সন্দেহ নিরসন করতে হবে, একলা থাকতে হবে। দুজনেই যে যন্ত্রণায় ভুগছেন, তা থেকে পরিত্রাণ পেতে হবে। লিন্ডেন বীথির একটা কোণে নির্জন একটা বেঞ্চি পেয়ে কিটি বলল, ‘এভাবে বাঁচা চলে না! এ যে যন্ত্রণা! আমি কষ্ট পাচ্ছি, তুমিও কষ্ট পাচ্ছ। কিসের জন্যে?’
বুকে মুঠো চেপে যে ভঙ্গি তিনি সেদিন রাতে নিয়েছিলেন সেই ভঙ্গিতে কিটির সামনে দাঁড়িয়ে তিনি জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমি শুধু আমাকে একটা কথা বল : ওর গলার সুরে অশোভন, অসাধু, অপমানকর-ভয়ংকর কিছু ছিল কি?’
কিটি কাঁপা-কাঁপা গলায় বলল, ‘ছিল। কিন্তু কন্তিয়া, তুমি কি দেখতে পাচ্ছ না যে আমার দোষ নেই? আমি সকাল থেকে চেয়েছিলাম এমন একটা ভাব করব, কিন্তু এসব লোক…কেন ও এল? কেমন সুখে ছিলাম আমরা!’ অশ্রুরুদ্ধ কণ্ঠে সে বলল, ফোঁপানিটা কাঁপিয়ে দিচ্ছিল তার ভারী হয়ে ওঠা সারা শরীর।
তাঁদের যদিও কিছুই তাড়া করেনি, সুতরাং কোন কিছুর কবল থেকে পালাবার ছিল না, এবং বেঞ্চিটায় ওঁদের পক্ষে বিশেষ আনন্দের কিছু পাওয়া সম্ভব নয়। তাহলেও মালী অবাক হয়ে দেখল যে, ওঁরা তার কাছ দিয়ে প্রশান্ত জ্বলজ্বলে মুখে ঘরে ফিরছেন।