ত্রিশ
ইতিমধ্যে ভাসিলি লুচি যে প্রথমটা বুঝতে পারেনি মহিলাটি কে এবং এখন কথাবার্তা থেকে জানতে পারল ইনিই সেই মা যিনি স্বামীকে ত্যাগ করে গেছেন, যাঁকে সে দেখেনি কারণ এ বাড়িতে সে কাজে ঢুকেছে উনি গৃহত্যাগ করার পর, এখন সে সন্দেহের মধ্যে পড়ল ঘরে ঢুকবে নাকি কারেনিনকে খবর দেবে। শেষ পর্যন্ত নির্দিষ্ট একটা সময়ে সেরিওজাকে জাগিয়ে দেওয়া তার কর্তব্য, সুতরাং কে বসে আছেন মা না অন্য কেউ তা নিয়ে মাথা না ঘামিয়ে তার কর্তব্য পালন করে যাওয়া দরকার এটা বুঝে সে পোশাক পরে নিয়ে গেল দরজা খুলতে।
কিন্তু মা আর ছেলের সোহাগ, তাদের কণ্ঠস্বর আর যে কথা তারা বলছিল তাতে তার সংকল্প পরিবর্তন করতে হল। মাথা নেড়ে দীর্ঘশ্বাস ফেলে দরজা ভেজিয়ে দিল সে। কেশে চোখের পানি মুছে মনে মনে সে ভাবল, ‘আরো দশ মিনিট অপেক্ষা করা যাক।’
এই সময় বাড়ির চাকরবাকরদের মধ্যে খুব একটা আলোড়ন চলছিল। সবাই জেনে গিয়েছিল যে কর্ত্রী এসেছেন, কাপিতোনিচ তাঁকে ঢুকতে দিয়েছে, এখন তিনি আছেন শিশুকক্ষে, অথচ কর্তা নিজে রোজ আটটার পরে আসেন সেখানে, এবং সবাই বুঝতে পারছিল যে স্বামী-স্ত্রীর সাক্ষাৎ হতে দেওয়া চলে না, বাধা দিতে হবে তাতে। পোশাক- বরদার কর্নেই পোর্টারদের ঘরে গিয়ে জিজ্ঞেস করে কে ওঁকে আসতে দিয়েছে এবং কিভাবে। কাপিতোনিচ তাঁকে আসতে দিয়েছে এবং ঘরেও পৌঁছে দিয়েছে জেনে বুড়োকে বকুনি দেয়। পোর্টার একগুঁয়ের মত চুপ করে রইল, কিন্তু কর্নেই যখন বলল যে এর জন্য তাকে তাড়িয়ে দেওয়া উচিত, কাপিতোনিচ তখন কর্নেইয়ের মুখের সামনে হাত নেড়ে বলে দিলে : ‘হ্যাঁ, তুমি হলে ঢুকতে দিতে না বৈকি! দশ বছর এখানে কাজ করছি, ভালো ছাড়া মন্দ কিছু দেখিনি আর এখন কিনা গিয়ে বলবে : ভাগুন দয়া করে! স্বার্থজ্ঞান তোমার টনটনে! বুঝলে? কর্তার রেকুন কোট কিভাবে হাতড়াও সেটা একটু মনে করে দেখলে পারতে!’
‘আরে আমার ধর্মপুত্র!’ তাচ্ছিল্যভরে বলল কর্নেই; আয়া ভেতরে ঢুকতে তার দিকে ফিরল সে। ‘আপনিই বলুন মারিয়া এফিমোভনা : ঢুকতে দিয়েছে, কাউকে কিছু বলেনি’, ধাইকে বলল কর্নেই, ‘এক্ষুণি বেরোবেন কারেনিন, খোকার ঘরে যাবেন।
‘কি কাণ্ড!’ আয়া বলল, ‘আপনি বরং ওঁকে, কর্তাকে কোনরকমে আটকে রাখুন কর্নেই ভাসিলিয়েভিচ, আমি যাচ্ছি কর্ত্রীর কাছে, কোনরকমে ওঁকে সরিয়ে দেব। কি কাণ্ড! মাগো!’
আয়া যখন শিশুকক্ষে ঢুকল, সেরিওজা তখন মাকে বলছিল কিভাবে সে আর নাদেঙ্কা ঢিপি থেকে পিছলে নামতে গিয়ে তিনবার ডিগবাজি খেয়েছে। আন্না শুনছিলেন তার কণ্ঠস্বর, দেখছিলেন তার মুখ, মুখভাবের চাঞ্চল্য, স্পর্শ করছিলেন তার হাত, কিন্তু কি সে বলছে বুঝতে পারছিলেন না। চলে যাওয়া দরকার, ওকে ছেড়ে যাওয়া দরকার— শুধু এই একটা কথাই তিনি ভাবছিলেন ও অনুভব করছিলেন। দরজার দিকে এগিয়ে আসা ভাসিলি লুকিচের পদশব্দ আর কাশির আওয়াজ কানে গিয়েছিল তাঁর, আয়ার পায়ের শব্দও শুনতে পাচ্ছিলেন তিনি; কিন্তু শিলীভূতের মত তিনি বসে রইলেন, কথা বলার, উঠে দাঁড়াবার শক্তি তাঁর ছিল না।
আন্নার কাছে গিয়ে তাঁর হস্ত ও স্কন্ধ চুম্বন করে আয়া বলল, ‘লক্ষ্মীটি আমার, আমাদের খোকার জন্মদিনে কি যে আনন্দ পাঠালেন সৃষ্টিকর্তা। আপনার চেহারা তো একইরকম আছে দেখছি।
‘ওহ্ ধাই-মা, লক্ষ্মীটি আমার, আমি জানতাম না যে আপনি এ বাড়িতে’, এক মুহূর্তের জন্য সম্বিৎ ফিরে পেয়ে বললেন আন্না।
‘এখানে থাকি না, আছি মেয়ের সাথে। এসেছি অভিনন্দন জানাতে, আন্না আর্কাদিয়েভনা!’
হঠাৎ কেঁদে ফেলল আয়া, আবার হস্তচুম্বন করতে থাকল তাঁর।
হেসে চোখ জ্বলজ্বল করে সেরিওজা এক হাতে মা, অন্য হাতে ধাইমাকে ধরে গালিচার ওপর দাপাদাপি করতে লাগল পুরুষ্টু পায়ে। মায়ের প্রতি ধাই-মায়ের কোমলতায় উল্লসিত হয়েছিল সে।
‘মা, উনি প্রায়ই আমার কাছে আসেন, আর যখন আসেন…’ সেরিওজা বলতে শুরু করেছিল, কিন্তু মাকে ধাই- মা ফিসফিসিয়ে কি যেন বলল আর মায়ের মুখে ফুটে উঠল ভীতি আর কেমন একটা লজ্জার ভাব, যা তাঁকে মানায় না, এই দেখে থেমে গেল।
আন্না ঝুঁকলেন তার দিকে।
বললেন, ‘মানিক আমার!’
বিদায় বলতে পারলেন না তিনি, কিন্তু মুখের ভাবে সেটা প্রকাশ পেল এবং সেরিওজাও তা বুঝল। ‘লক্ষ্মী আমার কুতিক’, ও যখন ছোট ছিল তখন আন্না তাকে যা বলে ডাকতো সেই নামটা বললেন তিনি, ‘আমাকে তুই ভুলে যাবি না তো? তুই…’ কিন্তু আর বলতে পারলেন না তিনি।
ওকে যা বলা যেত তেমন কত কথা তাঁর মনে হয়েছে পরে, কিন্তু এখন তিনি কিছুই বলতে পারলেন না। কিন্তু কি বলতে চাইছিলেন সেটা বুঝল সেরিওজা। সে বুঝল যে মায়ের প্রাণে সুখ নেই আর ভালোবাসেন তাকে। এও সে বুঝতে পারল ধাই-মা কি বলেছেন ফিসফিসিয়ে। একটা কথা তার কানে গিয়েছিল : ‘সব সময় আটটার পরে।’ সে বুঝতে পেরেছিল যে কথাটা পিতাকে নিয়ে এবং মা-বাপের দেখা হওয়া চলে না। এটা সে বুঝেছিল, কিন্তু বুঝতে পারেনি কেন মায়ের মুখে ফুটে উঠল ভীতি আর লজ্জা?… মায়ের কোন দোষ নেই, অথচ ভয় পাচ্ছেন ওঁকে, কিনের জন্য যেন লজ্জা পাচ্ছেন। ভেবেছিল একটা প্রশ্ন করে খটকাটা পরিষ্কার করে নেবে; কিন্তু সাহস হল না : সে দেখতে পাচ্ছিল যে কষ্ট পাচ্ছেন মা, তাঁর জন্য মায়া হচ্ছিল তার। নীরবে সে মায়ের শরীর ঘেঁষে বলল, ‘এখনই যেও না। শিগগির আসবেন না উনি।’
ও যা ভাবছে, তাই বলছে কি, সেটা বোঝার জন্য মা তাকে নিজের কাছ থেকে সরিয়ে দিলেন খানিকটা দূরে আর তার ভীত মুখভাব দেখে বুঝলেন যে শুধু বাপের কথাই বলল না, যেন শুধাচ্ছে বাপ সম্পর্কে কি তার ভাবা উচিত। বললেন, ‘সেরিওজা, সোনা আমার, ভালোবাসা ওঁকে, আমার চেয়ে উনি ভালো, দয়ামায়া আছে বেশি, তাঁর কাছে আমি দোষী। যখন বড় হবে, নিজেই তুমি তখন ভেবে দেখবে।’
‘তোমার চেয়ে ভালো কেউ নেই!…’ পানিভরা চোখে হতাশায় চিৎকার করে সে গলা জড়িয়ে ধরল মায়ের, আকুলতায় কাঁপা কাঁপা হাতে প্রাণপণে মাকে টানতে লাগল নিজের দিকে 1
‘ধন আমার, জাদু আমার!’ শক্তিহীন হয়ে সেরিওজার মতই ছেলেমানুষি কান্নায় ভেঙে পড়লেন তিনি।
এই সময় দরজা খুলে গেল, ভেতরে ঢুকল ভাসিলি লুকিচ। পদশব্দ শোনা গেল দ্বিতীয় দরজাটার কাছে। ত্রস্ত ফিসফিসানিতে আয়া বলল, ‘আসছেন’, এবং টুপিটা দেওয়া হল আন্নাকে।
বিছানায় লুটিয়ে পড়ল সেরিওজা, ঢুকরে উঠল হাত দিয়ে মুখ ঢেকে। আন্না তার হাত সরিয়ে চোখের পানিতে ভেজা মুখে চুমু খেলেন আরেক বার এবং দ্রুত পায়ে গেলেন দরজার দিকে। সেখানে মুখোমুখি হলেন কারেনিনের। আন্নাকে দেখে তিনি থেমে গিয়ে মাথা নোয়ালেন।
এমাত্র যদিও তিনি বলেছেন যে উনি তাঁর চেয়ে ভালো, দয়ামায়া আছে বেশি, তাহলেও চকিত দৃষ্টিপাতে সমস্ত খুঁটিনাটিতে তাঁর মূর্তিটা দেখে তাঁর প্রতি একটা ঘেন্না, বিদ্বেষ, আর ছেলের জন্য একটা ঈর্ষা আচ্ছন্ন করল আন্নাকে। ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে মুখাবগুণ্ঠন নামিয়ে, পদক্ষেপ বাড়িয়ে, প্রায় দৌড়ে বেরলেন ঘর থেকে।
যে খেলনাগুলি তিনি অত দরদে আর বেদনায় কাল বেছেছিলেন দোকানে, তা বার করার ফুরসৎ আর হল না, ফেরত নিয়ে গেলেন।
একত্রিশ
ছেলের সাথে দেখা করার বাসনাটা আন্নার যত প্রবলই হয়ে থাকুক, তার জন্য তিনি যত দীর্ঘ দিন ভেবেছেন আর তৈরি হয়েছেন, এ সাক্ষাৎ তাঁর মধ্যে এমন যে প্রবল প্রতিক্রিয়া ঘটাবে, তা মোটেই আশা করেননি তিনি। হোটেলে তাঁর নিঃসঙ্গ স্যুটে ফিরে বহুক্ষণ তিনি বুঝতে পারেননি কেন তিনি ওখানে। টুপি না খুলে ফায়ার-প্লেসের কাছে ইজি-চেয়ারে বসলেন তিনি, ভাবলেন, ‘সব চুকে গেল, আবার আমি একা।’ দুই জানলার মাঝখানে টেবিলের ওপর একটা ব্রোঞ্জ ঘড়ির দিকে স্থির দৃষ্টিতে তাকিয়ে ভাবনায় ডুবে গেলেন।
বিদেশ থেকে যে ফরাসি দাসীটিকে নিয়ে আসা হয়েছিল, সে এসে পোশাক বদলাতে ডাকল তাঁকে। অবাক হয়ে আন্না তার দিকে তাকিয়ে থেকে বললেন, ‘পরে।’
চাপরাশি এসে বলল তাঁকে কফি দেবে কি?
‘পরে’, আন্না বললেন।
ইতালিয়ান স্তন্যদাত্রী মেয়েটাকে পোশাক পরিয়ে নিয়ে এল আন্নার কাছে। গোলগাল সুপুষ্ট মেয়েটা বরাবরের মত মাকে দেখে নিচের দিকে যেন সুতায় মোড়া হাত বাড়িয়ে দন্তহীন হাসি হেসে পাখনা মেলা মাছের মত মাড় দেওয়া, ফুল তোলা স্কার্টে ঝাপট মেরে খসখস শব্দ করতে লাগল। খুকির উদ্দেশে না হেসে, চুমু না খেয়ে পারা যায় না, তার দিকে আঙুল না বাড়িয়ে দিয়ে পারা যায় না, যা সে আঁকড়ে ধরতো চিল্লিয়ে, সমস্ত শরীর ঝাঁকিয়ে; নিজের ঠোঁট তার কাছে না ধরে পারা যায় না, যা সে চুমু খাওয়ার মত করে পুরে নিতো মুখের মধ্যে। এ সবই করলেন আন্না, কোলে তুলে নিলেন তাকে, নাচালেন, চুমু খেলেন তার তাজা গালে, অনাবৃত কনুইয়ে; কিন্তু এই শিশুটিকে দেখে তাঁর কাছে আরও পরিষ্কার হয়ে গেল যে সেরিওজার জন্য তাঁর যা টান, তার তুলনায় এই মেয়েটার প্রতি তাঁর স্নেহ স্নেহই নয়। মেয়েটার সবই মিষ্টি, কিন্তু কেন জানি আন্নার মন কাড়তে পারছিল না সে। প্রথম সন্তানটি যাঁর ঔরসজাত তাঁকে তিনি ভালো না বাসলেও সব ভালোবাসা ঢেলে দিয়েছিলেন তার ওপর, যা পরিতৃপ্তির পথ পাচ্ছিল না; মেয়েটার জন্ম হয় অতি কঠিন অবস্থার মধ্যে, প্রথম সন্তানটির জন্য যে যত্ন হয়েছিল তার শতাংশও ঘটেনি তার ক্ষেত্রে। তা ছাড়া মেয়েটার সবকিছুই এখনো আশার গণ্ডিতে, অথচ সেরিওজা প্রায় মানুষ হয়ে উঠেছে, প্রিয়পাত্র মানুষ; তার ভেতর ইতিমধ্যে ভাবনা আর অনুভূতির ঢেউ উঠেছে, সে তাঁকে বোঝে, ভালোবাসে, বিচার করে দেখে—তার কথা আর দৃষ্টি স্মরণ করে আন্না ভাবলেন। আর তিনি চিরকালের জন্য তার কাছ থেকে শুধু দৈহিকভাবে নয়, আত্মিক দিক থেকেও বিচ্ছিন্ন আর তার সুরাহা করার উপায় নেই।
স্তন্যদাত্রীকে মেয়েটা ফেরত আর তাদের ছুটি দিয়ে তিনি বার করলেন একটা পদক, যাতে প্রায় এই মেয়েটার বয়সেরই একটা পোর্ট্রেট ছিল সেরিওজার। টুপি খুলে উনি অ্যালবাম মেলে ধরলেন টেবিলে যাতে সেরিওজার ফটোগ্রাফ ছিল অন্য নানা বয়সের। ছবিগুলি মিলিয়ে দেখার জন্য তিনি তাদের খুলে নিতে লাগলেন অ্যালবাম থেকে। খুলে নিলেন সব ক’টাই। রইল শুধু একটা সব শেষের সুন্দর ছবিটা। সাদা শার্ট পরে চেয়ারের দু’দিকে পা ঝুলিয়ে বসে চোখ কুঁচকে সে হাসছে। এটা হল সেরিওজার বিশেষ রকমের একটা সুন্দর মুখভাব। ক্ষিপ্র হাতের সরু সরু সাদা সাদা অতি উত্তেজিত আঙুলে তিনি ফটোটার কোণ ধরে খুঁটলেন বার কয়েক, কিন্তু ছবিটা খসে এল না, তিনি নিতে পারলেন না সেটা। টেবিলে কাগজ কাটার ছুরি ছিল না, তিনি নিতে পারলেন না সেটা। টেবিলে কাগজ কাটার ছুরি ছিল না, পাশের ছবিটা (এটা রোমে তোলা ভ্রন্স্কির ফটো, মাথায় গোল টুপি, লম্বা চুল) খসিয়ে তা দিয়ে ছেলের ছবিটা তুলে ফেললেন। ভ্রন্স্কির ছবিটার দিকে চেয়ে তিনি বললেন, ‘হ্যাঁ, ও-ই!’ আর হঠাৎ মনে পড়ল যে সেই তাঁর বর্তমান দুঃখের কারণ। সারা সকালটা আন্না ওঁর কথা ভাবেননি একবারও। কিন্তু এখন পুরুষোচিত, সম্ভ্রান্ত, তাঁর অতি পরিচিত ও সুমিষ্ট এই মুখখানা দেখে হঠাৎ তাঁর প্রতি ভালোবাসার একটা জোয়ার অনুভব করলেন তিনি।
‘সত্যি, কোথায় সে? আমার দুঃখকষ্টের মধ্যে একলা আমাকে ফেলে রেখে সে থাকে কি করে?’ হঠাৎ একটা অভিযোগ নিয়ে আন্না ভাবলেন, মনে পড়ল না যে নিজেই তিনি তাঁর ছেলের ব্যাপারটা সব চেয়ে রেখেছিলেন তাঁর কাছ থেকে। এক্ষুণি তাঁর কাছে আসার জন্য তিনি লোক পাঠালেন তাঁকে ডাকতে। কি কথায় তিনি তাঁকে সবকিছু বলবেন এবং ভালোবাসার কি বাব নিয়ে তিনি তাঁকে সান্ত্বনা দেবেন সে কথা ভাবতে ভাবতে তিনি আড়ষ্ট বুকে প্রতীক্ষা করতে লাগলেন। যাকে পাঠিয়েছিলেন সে লোকটা এই জবাব নিয়ে ফিরল যে ওঁর ঘরে অতিথি, তবে শিগগিরই তিনি আসছেন এবং জিজ্ঞেস করেছেন পিটার্সবুর্গে আগত প্রিন্স ইয়াভিনকে সাথে নিয়ে তিনি আসতে পারেন কিনা। আন্নার মনে হল, ‘একা আসছে না তাহলে, অথচ গতকাল ডিনারের পর থেকে সে আমাকে দেখেনি, এমনভাবে আসছে না যাতে সব কথা বলতে পারি ওকে, আসছে ইয়াভিনের সাথে।’ হঠাৎ একটা ভয়াবহ চিন্তা এল তাঁর মনে : আন্নার প্রতি ভালোবাসা যদি তাঁর চলে গিয়ে থাকে?
এবং ইদানীংকার ঘটনাগুলো ভেবে দেখে তাঁর মনে হল সবকিছুতেই এই ভয়াবহ চিন্তাটার সমর্থন দেখতে পাচ্ছেন তিনি : কাল তিনি বাড়িতে খায়নি, জিদ ধরেছিলেন যে পিটার্সবুর্গে তাঁরা থাকবেন আলাদা আলাদা, এমনকি এখনো তিনি আসছেন একা নয়, যেন চোখাচুখি হতে চাইছেন না।
কিন্তু সে কথা আমাকে ওর বলা উচিত। আমার সেটা জানা দরকার। সেটা যদি আমি জানতে পারি, তাহলে কি আমি করব সেটা আমার জানা আছে’, মনে মনে ভাবলেন তিনি, কিন্তু ভ্রন্স্কির ঔদাসীন্যে নিঃসন্দেহ হয়ে উঠলে কি অবস্থায় তিনি পড়বেন, সেটা অনুমান করার শক্তি তাঁর ছিল না। তিনি ভাবছিলেন যে ভ্রন্স্কির ভালোবাসা মরে গেছে, নিজেকে চরম হতাশার প্রান্তে এসে দাঁড়িয়েছেন বলে মনে হচ্ছিল তাঁর এবং সেই কারণেই নিজে বিশেষ রকমের উদ্দীপিত বোধ করছিলেন। দাসীকে ডেকে গেলেন সাজ ঘরে। পোশাক পরতে গিয়ে নিজের প্রসাধন নিয়ে ব্যস্ত হয়ে উঠলেন সাম্প্রতিক দিনগুলোর চেয়ে বেশি, যেন ভালোবাসা চলে যাবার পর যে গাউন আর কেশসজ্জা তাঁকে মানায় ভালো তার জন্য ভ্রন্স্কি আবার প্রেমে পড়তে পারেন তাঁর।
তৈরি হয়ে উঠতে পারার আগেই তিনি ঘণ্টি শুনলেন। যখন ড্রয়িং-রুমে ঢুকলেন, তখন ভ্রন্স্কি নন, ইয়াভিন তাঁকে স্বাগত করলেন দৃষ্টি দিয়ে। টেবিলে ছেলের যে ছবিটা তিনি ফেলে গিয়েছিলেন সেটা দেখছিলেন ভ্রন্স্কি, আন্নার দিকে চাইবার তাড়া ছিল না তাঁর।
‘আমরা তো পরিচিত’, নিজের ছোট্ট হাতখানা অপ্রতিভ ইয়াভিনের (যেটা তাঁর বিশাল দৈর্ঘ্য ও রুক্ষ মুখের পক্ষে ভারি অদ্ভূত) বিরাট হাতটায় রেখে আন্না বললেন। ‘পরিচিত সেই গত বছরের ঘোড়দৌড়ের সময় থেকে। দিন তো আমাকে’, ছেলের যে ফটোগুলো ভ্রনস্কি দেখছিলেন, ক্ষিপ্র ভঙ্গিতে তাঁর কাছ থেকে সেগুলো ছিনিয়ে নিয়ে আন্না বললেন এবং জ্বলজ্বলে চোখে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিতে তাকালেন তাঁর দিকে। ‘এ বছর ঘোড়দৌড় ভালো হয়েছিল? এর বদলে আমি ঘোড়দৌড় দেখি রোমের কর্সোতে। তবে আপনার তো বিদেশের জীবন ভালো লাগে না’, আন্না বললেন সস্নেহে হেসে, ‘আমি আপনার সব কথা জানি, জানি আপনার সমস্ত পছন্দ-অপছন্দ, যদিও আপনার সাথে দেখা হয়েছে সামান্যই।’
‘শুনে দুঃখ হল, কেননা আমার পছন্দগুলো বেশির ভাগই খারাপ’, বাঁ দিককার মোচ কামড়ে ইয়াভিন বললেন।
কিছুক্ষণ কথাবার্তার পর ভ্রনস্কি ঘড়ি দেখছেন লক্ষ করে ইয়াভিন আন্নাকে জিজ্ঞেস করলেন পিটার্সবুর্গে কত দিন থাকবেন এবং বিশাল শরীরখানা টান করে টুপি নিলেন।
‘মনে হয় বেশি দিন নয়’, এই বলে বিব্রত দৃষ্টিতে তিনি তাকালেন ভ্রন্স্কির দিকে।
‘তাহলে আমাদের আর দেখা হচ্ছে না?’ উঠে দাঁড়িয়ে ইয়াভিন ভ্রন্স্কির দিকে ফিরলেন, ‘কোথায় খাবি তুই?’
‘আমার এখানে খেতে আসুন’, নিজের বিব্রত ভাবটার জন্য যেন নিজের ওপরেই রাগ করে দৃঢ়কণ্ঠে বললেন আন্না, তবে নতুন লোকের সামনে নিজের অবস্থাটা প্রকাশ পেলে যেমন হয় বরাবরের মত তেমনি লাল হয়ে। ‘খাবার এখানে ভালো নয়, তবে ওর সাথে অন্তত থাকতে পারবেন। আলেকসেই তার রেজিমেন্টের বন্ধুদের মধ্যে সবার চেয়ে বেশি ভালোবাসে আপনাকে।’
‘খুব আনন্দ হচ্ছে’, যেরকম হেসে ইয়াভিন কথাটা বললেন তা থেকে ভ্রন্স্কি বুঝলেন যে আন্নাকে তাঁর বেশ ভালো লেগেছে।
ইয়াভিন মাথা নুইয়ে বেরিয়ে গেলেন, ভ্রন্স্কি রয়ে গেলেন কিছুক্ষণের জন্য আন্না জিজ্ঞেস করলেন, ‘তুমিও যাচ্ছ?’
‘এমনিতেই দেরি হয়ে গেছে’, ভ্রন্স্কি বললেন, ‘যা! আমি এক্ষুণি আসছি’, চেঁচিয়ে তিনি বললেন ইয়াভিনকে। ভ্রন্স্কির হাত ধরে আন্না অপলকে চেয়ে রইলেন তাঁর দিকে, মনে মনে ভাবতে লাগলেন কি বললে তাঁকে আটকে রাখা যায়।
‘দাঁড়াও, তোমাকে কিছু বলার আছে’, তার বেঁটে হাতখানা নিয়ে আন্না চেপে ধরলেন নিজের গলায়, ‘হ্যাঁ, খেতে নেমন্তন্ন করায় খারাপ কিছু হয়নি তো?’
‘ভালোই করেছ’, প্রশান্ত হাসি নিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন, যাতে দেখা গেল তাঁর সুবিন্যস্ত দাঁত। আন্নার হাতে চুমু খেলেন তিনি 1
নিজের দুই হাতে ওঁর হাতটায় চাপ দিয়ে আন্না বললেন, ‘আলেকসেই, আমার প্রতি তোমার মনোভাব বদলায়নি? আমার বড় বিছছিরি লাগছে এখানে। কবে আমার যাব?’
‘শিগগিরই, শিগগিরই। তোমার বিশ্বাস হবে না আমার পক্ষেও এখানে দিন কাটানো কি কষ্টকর’, এই বলে নিজের হাত টেনে নিলেন তিনি।
‘তা যাও, যাও!’ আহত বোধ করে আন্না বললেন এবং দ্রুত চলে গেলেন তাঁর কাছ থেকে।
বত্রিশ
ভ্রন্স্কি যখন ফিরলেন, আন্না ঘরে ছিলেন না। শুনলেন উনি চলে যাবার কিছু পরেই কে একজন মহিলা আসেন তাঁর কাছে এবং দুজনে একসাথে বেরিয়ে যান। কোথায় যাচ্ছেন তা না বলে আন্না যে বেরিয়ে গেছেন, এখনো পর্যন্ত তাঁর যে দেখা নেই, সকালেও আন্না যে কিছু না বলে গিয়েছিলেন কোথায় যেন—সেই সাথে আজ সকালে তাঁর মুখের উদ্দীপিত ভাবটা এবং ইয়াভিনের সামনে যে ক্রুদ্ধ স্বরে ছেলের ফটোগুলো তাঁর হাত থেকে প্রায় ছিনিয়ে নেন, এ সব ভ্রন্স্কিকে ভাবাল। তিনি স্থির করলেন যে আন্নার সাথে একটা বোঝাবুঝি হয়ে যাওয়া দরকার। ড্রয়িং-রুমে তিনি বসে রইলেন। কিন্তু আন্না ফিরলেন একা নয়, নিজের ফুফু, বৃদ্ধা কুমারী প্রিন্সেস অবলোস্কায়াকে সাথে করে। ইনি সেই মহিলা সকালে যিনি এসেছিলেন এবং যাঁকে নিয়ে আন্না বাজার করতে যান। দুশ্চিন্তাগ্রস্ত ও সপ্রশ্ন ভ্রন্স্কির মুখের ভাব যেন লক্ষ করছিলেন না আন্না, ফুর্তি করে তাকে বললেন কি তিনি কিনেছেন আজ সকালে। ভ্রন্স্কি দেখতে পাচ্ছিলেন যে বিশেষ কিছু-একটা ব্যাপার ঘটেছে ওঁর : যে জ্বলজ্বলে চোখে তিনি ভ্রন্স্কির দিকে চকিত দৃষ্টিপাত করছিলেন তাতে ফুটছিল একটা টান-টান মনোযোগ এবং তাঁর ভাবভঙ্গি ও কথাবার্তায় ছিল সেই দ্রুততা আর লাবণ্য যা তাঁদের অন্তরঙ্গতার প্রথম দিকটায় অত মুগ্ধ করেছিল তাঁকে আর এখন শংকিত ও ভীত করে তুলছে।
চার জনের জন্য খাবার ব্যবস্থা হয়েছিল। ছোট ডাইনিং-রুমটায় যাবার জন্য সবাই তৈরি হচ্ছে এমন সময় আন্নার কাছে তুশকেভিচ এলেন প্রিন্সেস বেত্সির কাছে থেকে। বিদায় জানাতে আসতে পারছেন না বলে প্রিন্সেস বেত্সি ক্ষমা চেয়েছেন; তিনি অসুস্থ, কিন্তু আন্নাকে অনুরোধ করেছেন সাড়ে ছ’টা থেকে ন’টার মধ্যে তাঁর কাছে আসতে। এভাবে সময় বেঁধে দেওয়ায় ভ্রন্স্কি তাকালেন আন্নার দিকে, তার মানে কারও সাথে যাতে তাঁর দেখা না হয়, সে ব্যবস্থা করা হয়েছে; কিন্তু আন্না যেন খেয়াল করলেন না সেটা।
মৃদু হেসে তিনি বললেন, ‘খুব দুঃখিত যে ঠিক ওই সাড়ে ছ’টা থেকে ন’টার মধ্যেই যেতে পারছি না।’
‘প্রিন্সেস খুব দুঃখিত হবেন।’
‘আমিও।’
‘আপনি তাহলে পাত্তি শুনতে যাচ্ছেন নিশ্চয়’, বললেন তুশকেভিচ।
‘পাত্তি? ভালো কথা বলেছেন তো। যেতাম যদি বক্সের টিকিট পেতাম।’
‘আমি জোগাড় করে দিতে পারি’, বললেন তুশকেভিচ।
‘অনেক, অনেক ধন্যবাদ’, আন্না বললেন, ‘আমাদের সাথে খেতে বসবেন না?’
সামান্য কাঁধ কোঁচকালেন ভ্রন্স্কি। আন্না কি করছেন তা একেবারেই বুঝতে পারছিলেন না তিনি। কেন উনি নিয়ে এসেছেন এই বৃদ্ধা প্রিন্সেসকে, কেন তুশকেভিচকে ধরে রাখলেন খাবার জন্য, আর সবচেয়ে আশ্চর্যের ব্যাপার, কেন তাকে পাঠানো হচ্ছে বক্সের টিকিট কাটতে? তাঁর অবস্থায় পাত্তির দাতব্য কনসার্টে যাওয়ার কথা ভাবা যায় কি, যেখানে থাকবে তাঁর পরিচিত গোটা সমাজটা? গুরুতর দৃষ্টিতে তিনি চাইলেন তাঁর দিকে, কিন্তু আন্না জবাব দিলেন হয় আমুদে, নয় মরিয়া সেই একই চ্যালেঞ্জের দৃষ্টিপাতে যার অর্থ তিনি ধরতে পারছিলেন না। খাবার সময়টায় আন্না হয়ে উঠলেন উদ্ধত ফুর্তিবাজ : তিনি যেন রঙ্গলীলা করছিলেন তুশকেভিচ আর ইয়াভিন দুজনের সাথেই। যখন খাওয়ার টেবিল ছেড়ে ওঠা হল এবং তুশকেভিচ গেলেন বক্সের ধান্ধায় আর ইয়াভিন ধুমপান করতে, ভ্রন্স্কি তাঁর সাথেই চলে গেলেন নিজের ঘরে। সেখানে কিছুক্ষণ বসে থেকে তিনি উঠলেন ওপরে। আন্না ততক্ষণে হালকা রঙের সিল্ক আর মখমলের বুক খোলা গাউনে তৈরি, এটি তিনি বানিয়েছিলেন প্যারিসে। মাথায় তাঁর দামী সাদা লেস, মুখখানাকে বেড় দিয়ে তা তাঁর ঝলমলে রূপ ফুটিয়ে তুলেছে বিশেষভাবে।
তাঁর দিকে তাকাবার চেষ্টা না করে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘সত্যিই আপনি থিয়েটারে যাবেন?’
‘অমন ভীত হয়ে জিজ্ঞেস করছেন যে?’ ভ্রন্স্কি তাঁর দিকে তাকাচ্ছেন না বলে পুনরায় আহত বোধ করে আন্না বললেন, ‘না যাবার কি আছে?’
আন্না যেন বুঝতে পারছিলেন না তাঁর কথার গুরুত্ব।
বলাই বাহুল্য, না যাবার কোন কারণ নেই’, ভুরু কুঁচকে বললেন ভ্রন্স্কি।
‘সেই কথাই তো আমি বলছি’, আন্না বললেন, ভ্রন্স্কির কথার সুরে যে ব্যঙ্গ ছিল সেটা বুঝতে চাইলেন না ইচ্ছে করেই, দীর্ঘ, সুরভিত দস্তানাটা পরতে লাগলেন শান্তভাবে।
‘আন্না, দোহাই সৃষ্টিকর্তা! কি হল আপনার?’ উনি বললেন তাঁর চৈতন্য উদ্রেকের জন্য ঠিক যেভাবে একদা বলেছিলেন আন্নার স্বামী।
‘বুঝতে পারছি না কি আপনি বলতে চাইছেন। ‘
‘আপনি জানেন যে যাওয়া চলে না।’
‘কেন? আমি একা যাচ্ছি না। প্রিন্সেস ভারভারা পোশাক বদলাতে গেছেন। তিনি যাবেন আমার সাথে।’
বোধের অক্ষমতা ও হতাশার ভঙ্গি ফুটিয়ে কাঁধ কোঁচকালেন ভ্রন্স্কি। বলতে শুরু করেছিলেন, ‘কিন্তু আপনি কি জানেন না…’
‘জানতে চাই না আমি!’ প্রায় চিৎকার করে উঠলেন আন্না। ‘চাই না। যা করেছি তার জন্য অনুশোচনা করব কি? না, না, না। প্রথম থেকে যদি শুরু করতে হয়, তাহলে যা ঘটেছে, তাই-ই ঘটবে। আমাদের কাছে, আমার আর আপনার কাছে গুরুত্ব ধরে শুরু একটা জিনিস : দুজন দুজনকে আমরা ভালোবাসি কিনা। অন্য কথা ধর্তব্য নয়। কেন এখানে আমরা আলাদা আলাদা থাকছি, দেখা সাক্ষাৎ হচ্ছে না? কেন আমি যেতে পারি না? তোমাকে ভালোবাসি আমি, আর সবে আমার বয়ে গেল’, বললেন তিনি রুশীতে, চোখে ভ্রন্স্কির কাছে দুর্বোধ্য একটা ঝিলিক তুলে তাঁর দিকে তাকিয়ে; ‘যদি তুমি বদলে না গিয়ে থাকো। কেন তুমি তাকাচ্ছ না আমার দিকে?’
আন্নার দিকে ভ্রন্স্কি চাইলেন। দেখলেন তাঁর মুখ আর সব সময় মানানসই সাজগোজের সমস্ত সৌন্দর্য। কিন্তু এখন তাঁর এই সৌন্দর্য আর সৌষ্ঠবেই পিত্তি জ্বলে যাচ্ছিল তাঁর।
‘আমার হৃদয়াবেগ যে বদলাতে পারে না, তা আপনি জানেন, কিন্তু অনুরোধ করছি, মিনতি করছি যাবেন না’, কণ্ঠস্বরে কোমল একটা মিনতি কিন্তু দৃষ্টিতে শীতলতা নিয়ে আবার তিনি বললেন ফরাসিতে।
কথাগুলো শুনছিলেন না আন্না, কিন্তু দৃষ্টির শীতলতা দেখতে পাচ্ছিলেন, ক্ষিপ্র কণ্ঠে জবাব দিলেন, ‘আর আমার অনুরোধ কেন আমার যাওয়া চলে না, সেটা বলুন। ‘
‘কারণ এতে আপনার…আপনার…’ থতমত খেলেন ভ্রন্স্কি।
‘কিছুই বুঝতে পারছি না। ইয়াভিনসুনাম নষ্ট করতে পারেন না, প্রিন্সেস ভারভারাও অন্যদের চাইতে খারাপ কিছু নন। আ, এই তো উনি এসে গেছেন।’
তেত্রিশ
নিজের অবস্থাটা ইচ্ছে করে বুঝতে না চাওয়ার জন্য আন্নার ওপর বিরক্তি, প্রায় আক্রোশ ভ্রন্স্কি বোধ করলেন এই প্রথম। জ্বালাটা আরো বেড়ে গিয়েছিল এই জন্য যে তাঁর বিরক্তির কারণটা তিনি মুখ ফুটে বলতে পারছিলেন না। কি তিনি ভাবছেন, সেটা সোজাসুজি বলতে হলে তিনি এই বলতেন : ‘সবার পরিচিত এক প্রিন্সেসের সাথে এই বেশভূষার থিয়েটারে যাওয়ার অর্থ শুধু পতিতা নারী হিসেবে নিজের অবস্থাটা মেনে নেওয়াই নয়, সমাজকে চ্যালেঞ্জ করাও, অর্থাৎ চিরকালের জন্য সমাজ থেকে বিতাড়িত হওয়া।’
এ কথাটা আন্নাকে তিনি বলতে পারেন না। ‘কিন্তু এ কথাটা সে বুঝতে পারছে না কেমন করে, কি ঘটছে ওর মধ্যে?’ নিজেকে বলছিলেন তিনি। টের পাচ্ছিলেন একই সময়ে আন্নার প্রতি শ্রদ্ধা তাঁর যেমন কমেছে, তেমনি বেড়েছে তাঁর রূপ সম্পর্কে চেতনা।
মুখ গোমড়া করে তিনি ফিরলেন নিজের কামরায়। লম্বা ঠ্যাঙ একটা চেয়ারের ওপর বাড়িয়ে দিয়ে ইয়াভিন সেলজার পানি দিয়ে কনিয়াক পান করছিলেন। তাঁর পাশে বসে বললেন তাঁকেও খানিকটা দিতে।
তুই বলছিলি লানকোস্কির ‘মগুচি’র কথা। ঘোড়াটা ভালো, কিনতে পরামর্শ দিচ্ছি তোকে’, বন্ধুর বিমর্ষ মুখের দিকে চেয়ে বললেন ইয়াভিন, ‘ওর গতরটা ভারী, কিন্তু পা আর মাথার তুলনা হয় না।’
‘তাই ভাবছি, কিনব’, বললেন ভ্রন্স্কি।
ঘোড়া নিয়ে কথাবার্তায় ব্যস্ত থাকলেও ভ্রন্স্কি মুহূর্তের জন্য আন্নার কথা ভুলতে পারছিলেন না, আপনা থেকেই কান পেতে থাকছিলেন করিডরে পদশব্দের জন্য, ফায়ার-প্লেসের ওপর ঘড়িটার দিকে চাইছিলেন বারে বারে।
‘আন্না আর্কাদিয়েভনা আপনাকে বলতে বলেছেন যে তিনি থিয়েটারে গেছেন।
ফেনিল পানিটায় আরো একপাত্র কনিয়াক ঢেলে এবং তা উদরস্থ করে উঠে দাঁড়িয়ে উর্দির বোতাম বন্ধ করলেন ইয়াভিন।
‘তাহলে? চল যাই’, বললেন তিনি মোচের তলে সামান্য হেসে আর সে হাসিতে এটা বুঝিয়ে দিয়ে যে ভ্রন্স্কির মনমরা হওয়ার কারণটা তিনি বোঝেন, কিন্তু তাতে কোন গুরুত্ব দিচ্ছেন না
‘আমি যাব না’, আঁধার মুখে বললেন ভ্রন্স্কি।
‘কিন্তু আমাকে যেতে হবে, কথা দিয়েছি। বেশ, তাহলে আসি। তুই বরং একটা সীট নে। ক্রাসিস্কির সীটটা’, যেতে যেতে যোগ করলেন ইয়াভিন।
‘না, আমার কাজ আছে।’
হোটেল থেকে বেরিয়ে ইয়াভিন ভাবলেন, ‘বৌ থাকলে ঝামেলা, প্রেমিকা থাকলে আরো খারাপ।’
চেয়ার থেকে উঠে ভ্রন্স্কি একা একা পায়চারি করতে লাগলেন ঘরে।
‘আচ্ছা কি চলছে আজকে? চতুর্থ দাতব্য কনসার্ট… সস্ত্রীক ইয়েগর থাকবে সেখানে, খুব সম্ভব মা-ও। তার মানে সেখানে গোটা পিটার্সবুর্গ। এখন আন্না ঢুকেছে, ওভারকোট ছেড়ে গেছে, ঢুকছে আলোয়, তুশকেভিচ, ইয়াভিন, প্রিন্সেস ভারভারা…’ ছবিটা তিনি কল্পনা করলেন মনে মনে, ‘আর আমি? আমি কি ভয় পাচ্ছি, নাকি তার ওপর তদারকির ভার ছেড়ে দিয়েছি তুশকেভিচের ওপর? যেদিক থেকেই দেখা যাক, আহাম্মকি, আহাম্মকি—কেন আমাকে সে এমন অবস্থায় ফেলছে?’ হাতের একটা হতাশ ভঙ্গি করে তিনি বললেন।
হাতের সে ভঙ্গিটা গিয়ে ঠেকল ছোট টেবিলটায় যেখানে ছিল সেলৎজার পানি আর কনিয়াকের পানপাত্র। প্রায় সেটা উলটে পড়ছিল, ধরতে গেলেন তিনি কিন্তু ফসকে গেল, বিরক্তিতে টেবিলে লাথি মেরে ঘণ্টি বাজালেন।
সাজ-ভৃত্য ঘরে ঢুকতে তাকে বললেন, ‘যদি তুমি আমার এখানে কাজ করতে চাও, তাহলে নিজের কর্তব্য মনে রেখো। এমনটা যেন না হয়। পরিষ্কার করো এগুলো।’
নিজেকে নির্দোষ জ্ঞান করে সাজ-ভৃত্য আত্মসমর্থন করতে যাচ্ছিল, কিন্তু হুজুরের মুখ দেখে বুঝল যে কেবল চুপ করে থাকা দরকার, তাড়াতাড়ি গালিচার ওপর ঝুঁকে যা ভেঙেছে এবং ভাঙেনি, তেমন সব পানপাত্র আর বোতল কুড়োতে লাগল।
‘এটা তোমার কাজ নয়, সাফ করতে বলো চাপরাশিকে আর আমাদের সান্ধ্য পোশাকের ব্যবস্থা করো।’
ভ্রন্স্কি থিয়েটার হলে ঢুকলেন সাড়ে আটটায়। অপেরা চলছে পুরোদমে। ওভারকোট রাখার তদারকিতে যে বৃদ্ধটি ছিল সে ভ্রন্স্কির কোট খুলতে গিয়ে তাঁকে চিনতে পেরে ‘হুজুর’ বলে সম্বোধন করলে এবং বলল, ট্যাগ নম্বর নেবার দরকার নেই, ফিওদর বলে হাঁক দিলেই হবে। আলোকিত করিডরে এই বৃদ্ধটি এবং ফার কোট হাতে দুজন চাপরাশি ছাড়া আর কেউ ছিল না, দরজায় কান পেতে তারা গান শুনছিল। দরজা দিয়ে শোনা যাচ্ছিল অর্কেস্ট্রার স্ট্যাকাটোর সন্তর্পণে সঙ্গত এবং একটি নারীকণ্ঠ যা চমৎকার তান ধরছিল। দরজা খুলে একজন পরিচারক চুপি চুপি বেরিয়ে আসতেই যে তানটা শেষ হতে যাচ্ছিল তা অভিভূত করল ভ্রন্স্কির কর্ণকুহর। কিন্তু সাথে সাথেই বন্ধ হয়ে গেল দরজা, গানের শেষটা ও তার মূর্ছনা তাঁর শোনা হল না, কিন্তু দরজার ওপাশে প্রচণ্ড করতালিধ্বনি থেকে বুঝলেন যে মূর্ছনা শেষ হয়েছে। ঝাড়লণ্ঠন আর ব্রোঞ্জের গ্যাস দীপাধারে অত্যুজ্জ্বল প্রেক্ষাগৃহে যখন তিনি প্রবেশ করলেন, করতালি তখনো চলছিল। মঞ্চে নগ্নস্কন্ধে ও হীরকে দেদীপ্যমানা গায়িকা নত হয়ে হেসে পাদপ্রদীপের ওপর দিয়ে বিদঘুটে রকমে ছুড়ে দেওয়া ফুলের তোড়া কুড়িয়ে নিচ্ছিলেন তাঁর হাত ধরে থাকা ‘টেনরের সাহায্যে; পাদপ্রদীপের ওপর দিয়ে লম্বা হাত বাড়িয়ে কি-একটা উপহার নিয়ে এগিয়ে গিয়েছিলেন মাথার মাঝখানে টেরি কাটা পমেড মাখা চমচকে চুলের এক ভদ্রলোক, তাঁর কাছে এলেন গায়িকা, অমনি স্টল আর বক্সের সমস্ত শ্রোতা চঞ্চল হয়ে উঠল, ঝুঁকি পড়ল সামনে, চিৎকার করে উঠল, হাততালি দিল। বেদীতে দণ্ডায়মান কন্ডাক্টর সাহায্য করলেন উপহারটা পৌঁছে দিতে এবং ঠিকঠাক করে নিলেন তাঁর সাদা টাই। স্টলের মাঝামাঝি পর্যন্ত গিয়ে ভ্রুনস্কি চেয়ে দেখতে লাগলেন চারিদিক। পরিচিত অভ্যস্ত পরিস্থিতি, মঞ্চ, কোলাহল, ঠেসে ভরে তোলা প্রেক্ষাগৃহের এসব চেনা, অনাকর্ষণীয়, বিচিত্র দর্শকদলের দিকে তিনি আজ নজর দিলেন সবচেয়ে কম।
বক্সে বরাবরের মতই পেছনদিকে সেই একই কি-সব অফিসারের সাথে কি-সব মহিলা; সেই একই রংবেরঙের নারী, উর্দি, ফ্রক-কোট–সৃষ্টিকর্তা জানেন কারা; ওপর সার্কেলে সেই একই নোংরা ভিড় আর সে ভিড়ের মধ্যে, বক্সে আর সামনের সারিগুলোয় আসল পুরুষ আর নারী জন চল্লিশেক। এই মরূদ্যানগুলির দিকেই মনোনিবেশ করলেন ভ্রন্স্কি এবং তৎক্ষণাৎ তাদের যোগসূত্র খুঁজে পেলেন।
ভ্রন্স্কি যখন ভেতরে ঢোকেন, অংকটা তখন শেষ হয়ে গিয়েছিল, তাই বক্সে বড় ভাইয়ের কাছে না গিয়ে সোজাসুজি এলেন প্রথম সারিতে সেপুখোভঙ্কয়-এর দিকে। অর্কেস্ট্রা পিটের কাছে হাঁটু বেঁকিয়ে হিল ঠুকছিলেন তিনি, দূর থেকে ভ্রন্স্কিকে দেখতে পেয়ে হেসে কাছে ডাকেন।
আন্নাকে তখনো দেখেননি ভ্রন্স্কি, ইচ্ছে করেই তাকাননি তাঁর দিকে। কিন্তু লোকের দৃষ্টি যে দিকে তা থেকে তিনি জানতেন কোথায় আন্না। অলক্ষ্যে তিনি চাইছিলেন এদিক-ওদিক, কিন্তু আন্নাকে খুঁজছিলেন না; সবচেয়ে খারাপটার অপেক্ষায় তিনি দৃষ্টি দিয়ে সন্ধান করছিলেন কারেনিনের। সৌভাগ্যের কথা যে এবার তিনি থিয়েটারে ছিলেন না।
‘ফৌজী রকম-সকম তোর মধ্যে এখন টিকে আছে কত কম!’ ভ্রন্স্কিকে বললেন সেপুখোভস্কয়, ‘তুই এখন একজন কূটনীতিক, শিল্পী বা ঐ ধরনের কিছু-একটা।’
‘হ্যাঁ, বাড়ি ফেরা মাত্র আমি ড্রেস-স্যুট পরেছি’, হেসে জবাব দিয়ে ভ্রন্স্কি ধীরে ধীরে অপেরা-গ্লাস বার করতে লাগলেন।
‘হ্যাঁ, এই ব্যাপারটায় তোকে আমার ঈর্ষা হয় তা কবুল করছি। বিদেশ থেকে ফিরে আমি যখন এটা পারি’, নিজের কাঁধ-পট্টি দেখালেন তিনি, ‘তখন স্বাধীনতা খোয়ানোর জন্য কষ্ট হয়।’
ভ্রন্স্কির সামরিক ক্রিয়াকলাপের আশা সেপুখোভস্কয় জলাঞ্জলি দিয়েছেন অনেকদিন, কিন্তু তাঁকে ভালোবাসেন আগের মতই আর এখন তো তাঁর জন্য সবিশেষ প্রীতিবোধই করছেন।
‘দেরি করে তুই এলি, প্রথম অংকটা দেখতে পেলি না, আফশোষ হচ্ছে।’
এক কান দিয়ে শুনতে শুনতে ভ্রন্স্কি ওপর থেকে প্রথম তলা পর্যন্ত বক্সগুলোকে দেখছিলেন শিরপেচ পরা এক মহিলা আর বাড়িয়ে আনা অপেরা-গ্লাসে রেগে চোখ মিটমিট করা এক টেকো ভদ্রলোকের কাছাকাছি হঠাৎ তিনি দেখতে পেলেন আন্নার মুখ—গর্বিত, আশ্চর্য সুন্দর, লেসের বন্ধনীর মধ্যে হাস্যময়ী। ছিলেন তিনি পঞ্চম বক্সের নিচতলায়, ওঁর কাছে থেকে বিশ পা দূরে। সামনে বসে সামান্য মাথা হেলিয়ে কি যেন বলছিলেন ইয়াভিনকে। প্রশস্ত মনোহর স্কন্ধে মাথার ঠাট, চোখে সংযত-প্রবুদ্ধ দীপ্তির ছটা এবং তাঁর সমগ্র মুখমণ্ডলে ভ্রন্স্কির মনে হচ্ছিল মস্কোর বলনাচে তাঁকে যেমন দেখেছিলেন ঠিক তেমনি। কিন্তু এ রূপে এখন তাঁর মনোভাব হল একেবারে ভিন্ন। আন্নার প্রতি তাঁর অনুভবে এখন কুহকের মত কিছু আর ছিল না, তাই তাঁর রূপ তাঁকে আগের চেয়েও প্রখরভাবে টানলেও সেইসাথে এখন আহতও করছিল। আন্না তাঁর দিকে চাইছিলেন না, কিন্তু ভ্রন্স্কি টের পাচ্ছিলেন যে তাঁকে তিনি দেখেছেন।
ভ্রন্স্কি যখন আবার সেদিকে তাঁর অপেরা-গ্লাস নিবদ্ধ করলেন, দেখলেন প্রিন্সেস ভারভারা অস্বাভাবিক হাসিতে লাল হয়ে ঘন ঘন তাকাচ্ছেন পাশের বক্সের দিকে; আন্না তাঁর পাখা গুটিয়ে লাল মখমলের ওপর তা ঠুকতে ঠুকতে কোথায় যেন তাকিয়ে আছেন, কিন্তু পাশের বক্সে কি হচ্ছে সেটা তিনি দেখছেন না, স্পষ্টতই চাইছেন না দেখতে। ইয়াভিনের মুখে তেমন একটা ভাব যা ফুটে উঠতো জুয়ায় হেরে গেলে। মুখ গোমড়া করে বাঁয়ের মোচটা মুখের মধ্যে ক্রমাগত গিলতে গিলতে তিনি কটাক্ষে চাইছিলেন পাশের বক্সটায়।
বাঁ পাশের ওই বক্সটায় ছিলেন কার্তাসোভরা। ভ্রন্স্কি তাঁদের চিনতেন এবং এও জানতেন যে আন্না তাঁদের পরিচিত। কার্তাসোভ পত্নী ছোটখাটো শীর্ণা এক নারী, আন্নার দিকে পিছন ফিরে নিজের বক্সে দাঁড়িয়ে স্বামী তাঁকে যে কেপটা এগিয়ে দিচ্ছিলেন সেটা পরছিলেন। মুখ তাঁর বিবর্ণ ও ক্রুদ্ধ। উত্তেজিত হয়ে কি যেন বলছিলেন তিনি। টেকোমাথা মুটকো কার্তাসোভ স্ত্রীকে শান্ত করার চেষ্টা করতে করতে অবিরাম তাকাচ্ছিলেন আন্নার দিকে। স্ত্রী বেরিয়ে গেলে স্বামী অনেকক্ষণ অপেক্ষা করলেন আন্নার চোখে পড়া এবং স্পষ্টতই তাঁকে লক্ষ্য করছেন না, ইয়াভিনের নিচু হয়ে আসা চুল-ছাঁটা মাথার উদ্দেশে কি যেন বলছিলেন। অভিবাদন না করেই বেরিয়ে যেতে হল কার্তাসোভকে, ফাঁকা হয়ে গেল বক্সটা।
কার্তাসোভ দম্পতি আর আন্নার মধ্যে ঠিক কি ঘটেছে সেটা ভ্রন্স্কি না জানলেও এটা বুঝলেন যে আন্নার পক্ষে কিছু-একটা ঘটেছে যা অপমানকর। এটা তিনি বুঝলেন যা দেখলেন তা থেকে এবং আরও বেশি বুঝলেন আন্নার মুখে দেখে, যিনি গৃহীত ভূমিকা চালিয়ে যাবার জন্য শেষ শক্তি সংগ্রহ করছেন বলে তিনি জানতেন। বাহ্যিক প্রশান্তির এই ভূমিকাটা তাঁর বেশ উত্তাল। যারা তাঁকে আর তাঁর মহলকে জানে না, সমাজে দর্শন দিতে এবং নিজের লেস-ভূষণ আর রূপে এমন লক্ষণীয়রূপে দর্শন দিতে পারছেন বলে নারী সমাজের সমবেদনা, ক্রোধ ও বিস্ময়ের কথাগুলো যারা শোনেনি, তারা এই মহিলার প্রশান্তি ও রূপে মুগ্ধ হত, ভাবতেই পারত না যে উনি লাঞ্ছনা-মঞ্চে চাপানো এক ব্যক্তির মর্মপীড়া বোধ করছেন।
কিছু-একটা ঘটেছে তা জানায়, কিন্তু ঠিক কি ঘটেছে তা না জানায় যন্ত্রণাকর উদ্বেগ হচ্ছিল ভ্রন্স্কির, তাই কোন কিছু জানার জন্য গেলেন বড় ভাইয়ের বক্সে। আন্নার বক্সের বিপরীত ধাপ দিয়ে উঠে বেরোতে গিয়ে তাঁর দেখা হয়ে গেল রেজিমেন্টের ভূতপূর্ব কমান্ডারের সাথে। দুজন পরিচিতের সাথে কথা বলছিলেন তিনি। আলাপে কারেনিনদের নামোল্লেখ কানে এল ভ্রন্স্কির এবং লক্ষ করলেন কিভাবে উচ্চৈস্বরে তাঁকে ডেকে আলাপীদের দিকে অর্থপূর্ণ দৃষ্টিপাত করলেন কমান্ডার।
‘আরে, ভ্রন্স্কি যে! রেজিমেন্টে আসছ কবে? একটা ভোজ ছাড়া তোমাকে তো যেতে দিতে পারি না আমরা। তুমি আমাদের যে মূল শিকড়’, বললেন রেজিমেন্ট কমান্ডার।
‘সময় পাচ্ছি না, খুব দুঃখের কথা, পরের বার’, বলে ভ্রন্স্কি উঠলেন বড় ভাইয়ের বক্সের দিককার সিঁড়ি বেয়ে। বক্সে বড় ভাইয়ের সাথে ছিলেন ইস্পাতের মত কুণ্ডলী করা চুল নিয়ে ভ্র।কর মা, বৃদ্ধা কাউন্টেস। ভারিয়া আর প্রিন্সেস সরোকিনার সাথে তাঁর দেখা হল একতলায় করিডোরে।
প্রিন্সেস সরোকিনাকে মায়ের কাছে পৌঁছে দিয়ে এসে দেবরের করমর্দন করে ভারিয়া তৎক্ষণাৎ বলতে লাগলেন যে বিষয়ে তাঁর আগ্রহ সেই কথা। এত উত্তেজিত তাঁকে ভ্রন্স্কি আগে কখনো দেখেননি।
‘আমি মনে করি, এটা অতি হীন ও জঘন্য কাজ, মাদাম কার্তাসোভার কোন অধিকার নেই। মাদাম কারেনিনাকে…’ বলতে শুরু করেছিলেন তিনি।
‘কিন্তু কি হয়েছিল? আমি কিছু জানি না।’
‘সে কি! তুমি কিছু শোননি?
‘তুমি জানো তো, এ ব্যাপারটা আমি শুনছি সবার শেষে।’
‘এই কার্তাসোভার মত বিছুটি জীব আর আছে কি?’
‘কিন্তু কি সে করেছে?’
‘আমি স্বামীর কাছে শুনলাম… কারেনিনাকে অপমান করেছে সে। ওর স্বামী পাশের বক্স থেকে কারেনিনার সাথে কথা বলতে শুরু করেছিলেন আর কার্তাসোভা এক নাটক বাধায়। লোকে বলছে, সে নাকি অপমানকর কিছু-একটা বলে বেরিয়ে যায়।’
‘কাউন্ট, আপনার মা আপনাকে ডাকছেন’, বক্সের দরজায় মুখ বাড়িয়ে বললেন প্রিন্সেস সরোকিনা। ‘এদিকে আমি তোর অপেক্ষায় বসে আছি’, মা বললেন ঈষৎ বিদ্রূপের হাসি হেসে, ‘তোর যে দেখা পাওয়াই ভার।’
ছেলে দেখলেন যে আন্দের হাসি তিনি চাপতে পারছেন না।
‘প্রণাম মা। যে আনন্দের হাসি তিনি চাপতে পারছেন না।
‘প্রণাম মা। আমি এলাম আপনার কাছে’, নিরুত্তাপ কণ্ঠে বললেন ভ্রন্স্কি।
‘কেন তুই গেলি না মাদাম কারেনিনার পরিতোষণে?’ প্রিন্সেস সরোকিনা করে তিনি ফরাসি ভাষায় যোগ করলেন
‘চমক লাগিয়েছে সে! তার জন্য লোকে ভুলে যাচ্ছে পাত্তিকেও!’
‘মা, আমি আপনাকে অনুরোধ করেছিলাম আমার সামনে এ সব কথা না বলতে’, ভুরু কুঁচকে ভ্রন্স্কি বললেন। ‘আমি তাই বলছি যা লোকে বলছে।’
কোন জবাব দিলেন না ভ্রন্স্কি, প্রিন্সেস সরোকিনার সাথে কয়েকটা বাক্য বিনিময় করে বেরিয়ে এলেন। দোরগোড়ায় দেখা হল বড় ভাইয়ের সাথে।
তিনি বললেন, ‘আ, আলেক্সেই! কি জঘন্যতা! মহিলাটি একটি গর্দভ, তার বেশ কিছু নয়… আমি এক্ষুণি ভাবছিলাম আন্নার কাছে যাব। চল যাই একসাথে।
ভ্রন্স্কি তাঁর কথা শুনছিলেন না, দ্রুত পদক্ষেপে নিচে নামছিলেন তিনি, টের পাচ্ছিলেন কিছু-একটা করা দরকার, কিন্তু কি সেটা জানতেন না। আন্না নিজেকে এবং তাঁকে এমন একটা অস্বস্তিকর অবস্থায় ফেলেছেন বলে তার জন্য একটা বিরক্তি এবং সেই সাথে তাঁর কষ্টের জন্য অনুকম্পায় দোলায়িত হচ্ছিলেন তিনি। নিচে স্টলে নেমে তিনি সোজা গেলেন আন্নার বক্সের কাছে। বক্সে স্ত্রেমভ দাঁড়িয়ে দাঁড়িয়ে কথা বলছিলেন তাঁর সাথে : ‘টেনর আর নেই।উধাও হয়েছে।’
আন্নার উদ্দেশে মাথা নুইয়ে ভ্রন্স্কি থামলেন স্ত্রেমভকে অভিবাদনের জন্য।
‘আপনি সম্ভবত দেরিতে এসেছেন, সেরা আরিয়াটা আপনার শোনা হয়নি’, ভ্রন্স্কিকে আন্না বললেন যে দৃষ্টিপাতে সেটা তাঁর মনে হল বিদ্রূপাত্মক।
কঠোর দৃষ্টিতে তাঁর দিকে তাকিয়ে ভ্রন্স্কি বললেন, ‘আমি সঙ্গীতের তেমন সমঝদার নই।
‘যেমন প্রিন্স ইয়াভিন’, হেসে বললেন আন্না, ‘ওঁর ধারণা পাত্তি গাইছেন বড় চড়া গলায়।’
পড়ে যাওয়া বিজ্ঞাপনপত্রটা ভ্রন্স্কি তুলে দিলে দীর্ঘ দস্তানা পরা ছোট হাতে সেটা নিয়ে আন্না বললেন ‘ধন্যবাদ!’ এবং হঠাৎ সেই মুহূর্তেই সুন্দর মুখখানা তাঁর কেঁপে উঠল। উঠে চলে গেলেন বক্সের পেছন দিকে।
পরের অংকে তাঁর বক্স শুন্য দেখে কাভাতিনা’র ধ্বনিতে স্তিমিত হয়ে আসা থিয়েটার হলে ক্রুদ্ধ হিসহিসানি জাগিয়ে ভ্রনস্কি স্টল থেকে বেরিয়ে এলেন এবং ফিরলেন হোটেলে।
আন্না আগেই চলে এসেছিলেন। ভ্রন্স্কি যখন তাঁর ঘরে ঢুকলেন, তিনি তখন একা, যে সাজে থিয়েটারে গিয়েছিলেন সেই সাজেই। দেয়ালের কাছে প্রথম চেয়ারটায় বসে তিনি চেয়ে ছিলেন সামনের দিকে। ভ্রন্স্কির দিকে একবার দৃষ্টিপাত করেই তক্ষুণি তিনি ফিরে গেলেন আগের অবস্থায়।
‘আন্না’, ভ্রন্স্কি ডাকলেন।
‘তুমি, সব তোমার দোষ!’ উঠে দাঁড়িয়ে হতাশা ও বিদ্বেষের অশ্রুজলে রুদ্ধ কণ্ঠে চেঁচিয়ে উঠলেন তিনি।
‘আমি বলেছিলাম, মিনতি করেছিলাম না যেতে। জানতাম যে তোমার অমঙ্গল হবে…’
‘অমঙ্গল!’ চেঁচিয়ে উঠলেন আন্না, ‘সাঙ্ঘাতিক! যতদিন বাঁদি, এটা ভুলব না কখনো। ও বলল যে আমার পাশাপাশি বসে থাকা ওর পক্ষে লজ্জার কথা।’
‘হাঁদা মেয়েমানুষের কথা’, বললেন ভ্রন্স্কি, ‘কিন্তু কি দরকার ছিল ঝুঁকি নেওয়ার, চ্যালেঞ্জ করার…
‘তোমার ওই প্রশান্তিকে আমি ঘৃণা করি। আমাকে ওই অবস্থায় ঠেলে দেওয়া উচিত ছিল না তোমার। যদি আমাকে ভালোবাসতে…’
‘আন্না, ভালোবাসার কথা কেন…’
‘হ্যাঁ, আমি যেমন ভালোবাসি তেমন যদি ভালোবাসতে, আমার মত যদি যন্ত্রণায় ভুগতে…’ ভ্রন্স্কির দিকে চেয়ে সভয়ে বললেন আন্না।
তাঁর জন্য ভ্রন্স্কির মায়া হলেও বিরক্তি ধরছিল। তিনি যে ভালোবাসেন এ আশ্বাস তাঁকে দিলেন, কেননা বুঝতে পারছিলেন যে কেবল এটাই শান্ত করতে পারবে তাঁকে, কথায় তাঁকে তিরস্কার করলেন না, কিন্তু তিরস্কার করলেন মনে মনে।
এবং ভালোবাসার যে আশ্বাসদান তাঁর কাছে এত ছেঁদো লাগছিল যে উচ্চারণ করতেও লজ্জা হচ্ছিল, সেটা কিন্তু আন্না আকণ্ঠ পান করে ধীরে ধীরে শান্ত হয়ে উঠলেন। এর পরের দিন দুজনের মিটমাট হয়ে গেল পুরোপুরি, যাত্রা করলেন গ্রামে।